রবিবার, ২৬ জুলাই, ২০২০

মালয়েশিয়ার ডায়রী পর্ব- এক

মালয়েশিয়ার ডায়রীঃ         

৭ জুলাই ২০১৩ সাল, রবিবার। ভোর ৫টায় ব্যাংকক আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আমরা চারজন একসাথে প্রবেশ করি। মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনের কাউন্টারে বর্ডিং পাশের জন্য লাইনে দাড়াই। সামনে মহিলা অফিসার আমাদেরকে বললেন কুয়ালালামপুরে হোটেল বুকিং ছাড়া তিনি বোর্ডিং পাস দিবেন না। জিন্নুন এবং রাসেল ইন্টারনেটে হোটেল বুকিংয়ের প্রচেষ্টা চালান। কিন্তু কোনমতেই সম্ভব হচ্ছেনা। আমি ও খোকন দাঁড়ানো। হঠাৎ অফিসার আমাকে ডেকে নিয়ে আমাদের পাসপোর্ট দুটি আবার পরীক্ষা করেন। আমাদের পাসপোর্টে অনেক দেশের ভিসা দেখে সাথে কত ডলার আছে জানতে চায়। আমার পকেটে থাকা প্রায় তিনহাজার মার্কিন ডলার তাকে দেখাই। এই ডলার দেখে আর কোন ঘাটাঘাটি না করে উড়োজাহাজ উড্ডোয়নের পূর্ব মূহূর্তে আমাদেরকে বর্ডিং পাস প্রদান করে। এখানে এই বিড়ম্বনার জন্য মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনের কর্মকর্তাকে দোষ দেবার কিছু নেই। আমাদের দেশের দালালরা অসংখ্য মানুষকে অবৈধভাবে সেখানে নিয়ে যায়, সে কারনে আমাদের মত বৈধ যাত্রিরাও শেষ পর্যন্ত ভোগান্তির শিকার হন।

সকাল ৭টায় উড়ে কুয়ালালামপুরের দিকে যাত্রা করি। বিমান থাইসাগরের উপর দিয়ে মালয় উপদ্বীপের উপকূল বরাবর উড়তে ত্থাকে। নিচে কখনও থাই সমুদ্র কখনও মালয়ের পর্বতমালা নজরে পড়ে। সকাল ৯টা ৪৫মিনিটে আমাদের উড়ালযান কুয়ালালামপুরের মাটি স্পর্শ করে। এই বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশনেও আমরা বেশ বিড়ম্বনায় পড়ি। এখানে জিন্নুন ও আমাকে ইজি রিলিজ করলেও আমাদের দুইজন সাথি খোকন ও রাসেলকে প্রায় একঘন্টা পরীক্ষা করে এন্ট্রি দেয়। প্লেন থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্টের ভিতর দীর্ঘ্যপথ হাঁটতে হয়। দুইবার চলন্ত বেল্ট চড়েও সামনে এগিয়ে যাই। বিমানবন্দরের ভিতর কাচঘেরা কাঠামোর ভিতর বৃক্ষশোভিত টিলা সৌন্দর্য্য ছড়িয়ে দিচ্ছে। একটি প্লেটফরমে গিয়ে মিনিট্রেন চড়ে আর মানুষের সাথে আমরা বিমানবন্দর হতে বেরিয়ে আসি। এই মিনিট্রেনে বসে এই বিশাল বিমানবন্দরে অসংখ্য বিমান উঠানামা করতে দেখি। এই বিমানবন্দরে একদিকে প্রেন অবতরন করে এবং অন্যদিকে ভিন্নপথে অবতরন করে।

বিমানবন্দর হতে বেরিয়ে সিরিয়ালে আসা একটি লালক্যাবে কুয়ালালামপুর শহরের বুকিতবিনতাং এলাকায় যাই। এয়ারপোর্ট হতে আঁটলেনের এক সুপ্রশথ আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্থা দিয়ে আমাদের কারটি অগ্রসর হয়। দু’দিকে সবুজ পাহাড় এবং চোখ জুড়ানো পামবন। সারি সারি পাম গাছগুলো যেন আমাদের দেশের অনুচ্চ সুন্দর পরিপুষ্ট তালগাছ। সড়কটি কোথায়ও উঁচু কোথায়ও নিচু ঢেউয়ের মত এগিয়ে গেছে। আসলে মালয়েশিয়া একটি পার্বত্যদেশ, এখানে সমতলভূমি খুব একটা নেই। কুয়ালালামপুর শহরে ডুকার আগে রিসোর্টের মত পাহাড় ঘেরা জনপদ চোখে পড়ে। ঢালুছাদ ও টাইলস বসানো বাড়িগুলো খুব মনোরম। আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হতে পামবাগান পেরিয়ে কুয়ালালামপুর শহরে আসতে আমাদের প্রায় দেড়ঘন্টা লেগে যায়। সারাটা রাস্থাই জনশূন্য এবং পাহাড় ও পামবাগানে সুরভীত।

কুয়ালালামপুর প্রবেশ করে কারটি উঁচুনিচু পাহাড় পেরিয়ে বুকিতবিনতাং এলাকায় আসে। একটি তামিল রেস্টহাউস আমরা ভাড়া করি। বারান্দায় ফ্লাওয়ার বক্সে প্রচুর ফুল ফুটে আছে। এই রেস্টহাউসের সামনে পাহাড় এবং পিছনে বেয়ে বেয়ে নেমে নিচু উপত্যকা, যা অনেকটা আমাদের রাঙ্গামাটি-খাগড়াছড়ি শহরের মত। এই রেস্টহাউসের কর্নদার একজন কালো তামিল যুবতী। মোঠাসোঠা এই মহিলা আগেই ভাড়া চেয়ে নেই। মনোরম এই পাহাড়ি এলাকার রাস্থায় কিছু যুবক জটলা করে আড্ডা দিচ্ছেন। বাংলাদেশের মত এখানে নিশ্চয় অনেক অলস মানুষ আছেন, যা সিঙ্গাপুর কিংবা থাইল্যান্ডে নেই। কুয়ালালামপুরে লোকভীড় কম, রাস্থাঘাট প্রশস্থ, ঘন বৃক্ষরাজির ছিন্নপাতা এদিক ওদিক কিছুটা ছিটিয়ে রয়েছে। নগরে কোন কোলাহল কিংবা যানজট নেই। রেস্টহাউসের ব্যবস্থাপক যুবতীকে দেখি একটি তামিল ভাষায় লিখিত পত্রিকা পড়ছেন। এই যুবতী আমাকে বললেন তার পিতামহ ভারতের তামিলনাড়ু হতে বৃটিশ শাসনামলে মালয়েশিয়া আসেন। তিন প্রজন্ম ধরে তারা নিজেদের ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতি সযতনে লালন করে মালয়েশিয়ায় বসবাস করছেন।

কুয়ালালামপুরে সর্বত্র অনেক বাংলাদেশী পাকিস্তানী ও ভারতীয় খাবার হোটেল রয়েছে। এইসব হোটেল পরিচালনা করছেন অনেক বাংলাদেশী তরুণ। এশহরের রাস্থায় হাটলে অনেক বাংলাদেশীর দেখা মেলে। জীবিকার ধান্ধায় বাংলাদেশের মানুষ সারাটা মালয়েশিয়ায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন।

ঐদিন দুপুরে আমরা কুয়ালালামপুর শহর ঘুরতে বের হই। কুয়ালালামপুরে নীল ও লাল দুই ধরনের ট্যাক্সিক্যাব চলাচল করে। নীলে ভাড়া বেশী, লালে কম। আমরা লালক্যাব ভাড়া করি। চালক একজন চীনা, তার নাম সী কে। আমরা তাকে উপহার দিলে তিনি খুব খুশী হন। সহজ সরল এই ভদ্রলোকের মোবাইল নং ০১৬৯০৯৯০৯৯ তিনি একটি কার্ড এগিয়ে দিয়ে বললেন আর কোনদিন মালয়েশিয়া সফর করলে তাকে যেন আমরা কল করি। তিনি আমাদেরকে তামিল চালকদের গাড়িতে উঠতে বারন করে হাতদিয়ে এমনভাবে গলাকাটার অভিনয় করেন যেন ওদের গাড়িতে উঠলে আমাদের গলাকেটে খুনকরে সবকিছু লোটপাট করে নিয়ে যাবে। কিন্তু আসলে তিনি বড় কষ্টকরে অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে যা বুঝাতে চাইছেন তাহল তামিল চালকরা ঠগ, ওরা ধান্ধাবাজি করে অধিক ভাড়া নিয়ে যাবে। সীকের অহংকার তিনি একজন চীনা, তিনি সৎ, তামিল চালকরা তার মত সাচ্চা আদমি নয়।

সীকে আমাদেরকে মহাতির মোহাম্মদ নির্মিত অপরূপ সুন্দর শহর পুত্রজায়ায় নিয়ে যান। পুত্রজায়া এক স্বর্গশহর। কুয়ালালামপুর হতে একঘন্টা ঝড়বেগে গাড়ি চড়ে আমরা পুত্রজায়ায় যাই। অনন্যসুন্দর নদী ও লেক পরিবেষ্টিত পাহাড়ি শহর এই পুত্রজায়া। বিশ্বের সেরা সেরা নগরবিদ এবং স্থাপত্য শিল্পীরা এই আধুনিক শহর ডিজাইন করেন। তারা নদী ও লেক, পাহাড় ও উপত্যকা, বনভূমি ও প্রকৃতির এক অপূর্ব সম্মিলন ঘটান এই আধুনিক নগরে। ঝলমলে এক স্টিলের সেতু অতিক্রম করে পুত্রজায়ায় প্রবেশ করতে হয়। সীকে সেতুর উপর কার থামান। নদীর টলটলে জলে বসন্ত বাতাসে তরঙ্গমালা তৈরি করছে, এই তরঙ্গমালায় সূর্যরশ্মি পরে সোনার মত ঝিলমিল করছে। সামনে বড় লেক, ঝুলন্ত সেতুর স্টিলের আলো প্রতিফলিত হয়ে দূরে ছিটকে পড়ছে। সেতুর মাঝখানে বট বনসাই যতনে বসানো। একটি দুটি নয়,     অনেকগুলো বনসাই।

পুত্রজায়া এক স্বপ্নকল্প শহর। বড় বড় রাস্থা, দুপাশে সাজানো বাগান। পরিকল্পিত ঝাউগাছ কোথায়ও বর্গাকার, কোথায়ও ডিম্বাকার। লেকের মধ্যে ছোট ছোট দ্বীপমালাকে পরিনত করা হয়েছে সুন্দর সুন্দর বাগিচায়। পুত্রজায়া নিরবতার শহর, এখানে সব সময় বিরাজ করে এক সুনসান নিরবতা।

আমরা পুত্রজায়া জামে মসজিদে যাই। মসজিদের সুউচ্চ মিনার আমার দেখা দিল্লীর ঐতিহাসিক কুতুবমিনারকে উতরে যাবে। মসজিদের দুইদিকে কৃত্রিম লেক। বাহিরে অজু করে শাহী মসজিদে ডুকে দু’রাকাত দাকিয়াতুল মসজিদ নফল নামাজ পড়ি। এই মসজিদের সৌন্দর্য্য ও বিশালতা আমাদেরকে বিস্মিত করে। মসজিদের বামদিকে পর্দাঘেরা মহিলাদের এবাদত স্থল। নানা ধর্ম ও বর্নের লোকজন মসজিদে ডুকে মুসলিম স্থাপত্য দেখছেন। অবাক হই, যখন দেখি চীন জাপানী হাফপ্যান্ট পরিহিত মেয়েরা পাশে রাখা বোরকা পরে সারাটা মসজিদ ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং বের হয়েই বোরকা ফেলে আগের বেশে চলে যাচ্ছে।

পুত্রজায়া- সারাটা শহর যেন আর্কিড, ফুল, বনসাই ও বৃক্ষশোভিত স্বর্গউদ্যান। মসজিদ হতে বের হয়ে সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে লেকের জলসমতলের বাগানে যাই। এই বাগানে আছে দোকান, কফিসপ, হোটেল ইত্যাদি। আমরা একটি হোটেলে ডুকি। এখানে অনেক বিদেশী ও মালয়ী তরুণ তরুনীরা চা-আড্ডা দিচ্ছেন। জায়গাটা এত আকর্ষনীয় যে ফটো তুলার জায়গার অভাব নেই।     

মসজিদের কাছে লেকে ভেসে আছে একটি পাহাড়, সেই উঁচু পাহাড়ে রাজকীয় প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ। নানা জাতের ফুলে ফুলে ভবনটি সুসজ্জিত। আমরা প্রেসিডেন্ট হাউসের সিঁড়িতে বসি। আমাদের মত এত প্রহরার কড়াকড়ি এখানে নেই। প্রেসিডেন্ট ভবনের বাগানে আমরা ফটো তুলি ও ভিডিও করি। মালয়েশিয়া সরকারের সব সরকারী অফিস আদালত এবং আমলাদের বাসস্থান পুত্রজায়ায়। এখানে রয়েছে প্রেসিডেন্ট হাউস, মজলিশ ভবন (জাতীয় সংসদ), সচিবালয়, সুলতান ভবন ইত্যাদি। এশহরে রয়েছে বিভিন্ন দেশের এমব্যাসি, যা এই শহরটিকে মালয়েশিয়ার কুটনৈতিক পাড়ায় পরিনত করেছে।

চালক সিকে গাড়ি চালিয়ে আমাদেরকে পুত্রজায়ার একটি বাগান লেকে নিয়ে যান। এই অপরূপ স্থানে আমরা মৃদুমন্দ বসন্তি হাওয়ার পরশ উপভোগ করি। এদিকে সন্ধ্যা গনিয়ে আসছে, মিলিয়ে যাচ্ছে সূর্যের নাতিষীতুষ্ণ মোলায়েম রোদ। মালয়েশিয়া একই অঞ্চলে অবস্থিত সিঙ্গাপুরের মত চিরবসন্তের দেশ। এখানে সব সময় আমাদের দেশের মার্চ মাসের আবহাওয়া বিরাজ করে। বারমাসই প্রতিদিন একটু আধটু বৃষ্টি হয়। এখানে ঋতু একটাই- আর তা হল বসন্তকাল।

সিকে ড্রাইভারকে আমাদের পছন্দ হয়। গাড়ি তার নিজের, তাই ভাড়া স্বল্প। তার সাথে আমাদের কথা হল, পরদিন তিনি সারাটা কুয়ালামপুর ঘুরে দেখাবেন এবং বিকেলে গ্যান্টিং হাইল্যান্ডে আমাদেরকে ফেলে আসবেন। গ্যান্টিং হাইল্যান্ড হতে আমরা ফিরব রাতে শহরবাসে। খরচ কমাতেই এমন পরিকল্পনা।

৮ জুলাই ২০১৩ সাল সোমবার। সকাল বেলায় চালক সিকে নির্ধারিত স্থানে এসে ফোন করলেন। আমরা চারজন তার কারে বসি। প্রথমেই নিয়ে আসেন কুয়ালালামপুর টাওয়ার তথা কে.এল টাওয়ারে। ইহা অনেকটা সিঙ্গাপুর টাওয়ারের মত। তবে এই টাওয়ারের ভূমি সমতলে রয়েছে মালয়েশিয়া ভিলেজ হেরিটেজ। এখানে যেমন উচ্চ তেমন প্রশস্ত একটি বৃক্ষের সাথে মোলাকাত করি, সমরূপ বৃক্ষ বাংলাদেশের কোথায়ও দেখি নাই। কে.এল টাওয়ারের আরোহনের ভাড়া অত্যাধিক, তাই আমরা টাওয়ারের চূড়ায় উঠা হতে বিরত রই।

এবার আমাদের সামনা সামনি হয় বিশ্ববিখ্যাত পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার। টাওয়ার দুটি এতই উঁচু যে শীর্ষের স্থম্ব দুটি ছুঁয়ে ছুঁয়ে মেঘমালা উড়ে যাচ্ছে। এই টাওয়ারে আরোহন করে চারপাশে মেঘের উড়া উড়ি উপভোগ করা যায়। মেঘের ফোটা তৈরি হয়ে নিচের দিকে বৃষ্টি হয়ে নেমে আসার দৃশ্যও দেখা যায়। এই টাওয়ারের নিচদিকে কয়েকতলা জুড়ে মার্কেট। এখানে বহু ভিনদেশি লোকজন বাজার করতে আসেন। ২৫/৩০ তলা উপরে টাওয়ার দুটি একটি সেতুদ্বারা সংযুক্ত। দুবাইয়ের বুর্জ আল খলিফা নির্মানের আগে এই টুইন টাওয়ারই ছিল এশিয়ার সর্বোচ্চ ভবন। আমরা পেট্রোনাস টাওয়ার মার্কেটে প্রবেশ করি। একটি বিশ্ববিখ্যাত সোনা-হীরার দোকানে ডুকতে যাই। কিন্তু এখানে ক্রেতার প্রবেশ সংখ্যা সীমাবদ্ধ। দরজায় দাঁড়ানো প্রহরীরা যে কয়জন লোক বের হয় টিক তত জনকে ডুকতে দেয়। এই দোকানে ডুকার জন্য কিছুক্ষন লাইনে দাঁড়িয়ে বিরক্ত হয়ে ফিরে আসি।

পেট্রোনাস টাওয়ার হতে বেরুলে চালক সীকে আমাদেরকে একটি লেকগার্ডেনে নিয়ে যান। পানির উপর নির্মিত ঝুলন্ত স্থাপনায় বাতাস খেয়ে ও জল-গার্ডেনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য উপভোগ করি। এবার আমরা আসি মালয়েশিয়ার প্রাচীন সুলতানী প্রাসাদে। ঐতিহাসিক রাজপ্রসাদটিকে এখন যাদুঘরে পরিনত করা হয়েছে। একটি সুরম্য টিলার উপর রাজপ্রসাদটির অবস্থান। ভবনের ফটক খোলামাত্র প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী ফৌজি পোষাক সজ্জিত বল্লমধারী দুইজন মালয়ান প্রহরী আমাদেরকে সালাম দেন। তাদের পরনে লাল চেক লুঙ্গি, চেক লম্বা জুব্বা ও মাথায় রঙ্গীন পাগড়ি। আমরা তাদের সাথে ফটো তুলি। নিজেকে তখন একজন প্রাচীন মালয়ি অভিজাত মনে হচ্ছিল। রাজপ্রসাদে ডুকে চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। এত চাকচিক্যময় ভবন আগে আর তেমন দেখিনি। ভবনের দেয়ালে মালাক্কার প্রাচীন সুলতান সুলতানাদের ছবি এবং তাদের রাজত্বকালের বিবরন রয়েছে। ঘুরে ঘুরে সুলতানদের চিকিৎসা কক্ষ, দন্ত চিকিৎসা কক্ষ, ভি.আই.পি স্বাক্ষাৎ কক্ষ, সাধারন দর্শন কক্ষ, ডাইনিং, কিচেন, বৈঠকখানা, পাঠাগার, গোসলখানা ইত্যাদি।

রাজপ্রসাদের বাথরুমে ডুকে দেখি এযে এক বিরাট ভবন। এই বাথরুমে রয়েছে আলাদা আলাদা অনেক উপকক্ষ। উপকক্ষে ছড়িয়ে আছে হাইকমোড, অজুখানা, গোসলখানা, পোশাক বদলখানা, এবং অঙ্গসজ্জাখানা। চিন্তাই করা যায়না এসব প্রাচীন সুলতান সুলতানারা যে কি পরিমান আরাম আয়েশে জীবন কাটিয়ে গেছেন। তাদের দিনগুলো উপভোগে উপভোগে কতটুকু যে পরিপূর্ন করে গেছেন। মালয় রাজপ্রসাদের বিদেশী মেহমান আমরা বের হয়ে যাদুঘরের পরিদর্শন বহিতে সই করি। স্বাক্ষরের উপর লিখে দেই, একজন বাংলাদেশী হিসাবে এই যাদুঘর দেখে আমি ধন্য হয়েছি। আমি মালয়েশিয়ার আরো উন্নতি ও মঙ্গল কামনা করি। রাজপ্রসাদের চারপাশে রাজকীয় উদ্যান। রাজবাগানে ফটো তুলাতুলি শেষ হলে আমরা সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে রাজবাড়ির গেট পার হই।

এবার চালক সী কে আমাদেরকে একটি চকলেট কারখানায় নিয়ে আসেন। এখানে ফ্রি চকলেট খেয়ে পছন্দানুযায়ী সদ্য তৈরী চকলেট কিনি। মালয়েশিয়ার চকলেট বিখ্যাত এবং সারা বিশ্বে রপ্তানী হয়। আমরা চীনা চালক সী কের হাতে এক প্যাকেট চকলেট উপহার হিসাবে তুলে দেই। ভারী খুশী হন সীকে এবং কিছু প্রতিদান দিতে উদগ্রীব হয়ে যান।

এবারে আমাদের গন্তব্য মেঘের উপরের শহর গেন্টিং হাইল্যান্ড। মালয়েশিয়ার মসৃন আটলেনের রাস্থা দিয়ে প্রায় ১০০/১১০ কি.মি বেগে সিকের গাড়ি ধাবমান হয়। ছবির মত বনবনানি ঘেরা পাহাড়ি রাস্থা। এবার শিলঙয়ের মত পাহাড়ের আঁকা বাকা বাক বেয়ে গাড়ি উপরে উঠতে থাকে। কিছুক্ষন চলে খাড়া পাহাড় বেয়ে উপর হতে উপরে ওঠার পালা। বাতাসের চাপ কমে কানে তালা লাগে এবং দুই কানের পর্দা পটপট করতে থাকে। সিকের কারটি কুয়ালালামপুর হতে অন্ততঃ মাইল খানেক উপরে উঠে আসে।

পাশে বসা চালক সিকে আমাকে গল্প শুনান, তিনি জীবনে মাত্র একটি দেশ সফর করেছেন, আর তা হংকং। মানুষটার বয়স একচল্লিশ, নিজের গাড়ি চালিয়ে বেশ টাকা জমিয়েছেন এবং পরিবার পরিজন নিয়ে সুখেই আছেন। তিনি ইশারায় হংকঙয়ের যে বিবরন দেন তাতে মনে হল হংকং যে মালয়েশিয়ার চেয়ে আরো ডিজিটাল, আর ফাস্ট তা বুঝাতে চাইছেন। তিনি তার কাছে থাকা ২০ হংকং ডলার আমাদেরকে বিতরন করে দেন। আমার ভাগে পড়ে ৫ হংকং ডলার। কুয়ালালামপুরে পাওয়া চীনা গাড়িচালক সিকেকে আমার এতই ভাল লাগে যে বাংলাদেশে এসেও তাকে আমি ভূলতে পারিনি।

আবার আমি গেন্টিং হাইল্যান্ডে ফিরে আসি। সিকে আমাদেরকে এত উপরে নিয়ে এলেও এখনও দিল্লী হনযু দূরকা ওয়াস্ত। গেন্টিং হাইল্যান্ডে যেতে হলে আর দেড়-দুই মাইল উপরে যেতে হবে। মেঘরাজ্যের অনেক উপরে আরব্যরজনীর সেই স্বপ্ন শহর। গেন্টিং হাইল্যান্ডে যেতে হবে ক্যাবল কারে চড়ে। স্টেশনে টিকেট কেটে আমরা ক্যাবল কারের অপেক্ষা করি। ২৫/৩০ জন যাত্রি নিয়ে ক্যাবলতার বেয়ে নেমে আসছে একটার পর একটা কাচের চলন্ত কামরা। সারিবেধে একদিকে যাত্রিরা নামছেন, অন্যদিকে উঠছেন। আমরা ঝুলন্ত কামরায় বসতেই এটি উপরে উঠতে শুরু করে। নিচে আঁকাবাঁকা পাহাড় সারি বেঁধে বেঁধে যেন আকাশ ছুঁইতে ছুটেছে। সমান ফাঁক বহাল রেখে অনেকগুলো কাচ-কামরা তার বেয়ে বেয়ে একদিকে নামছে অন্যদিকে উঠছে। চিকন তার যদি ছিঁড়ে যায় ভাবলে প্রানটা ভয়ে শিউরে ওঠে। বেয়ে বেয়ে প্রায় দুই মাইল উপরে এসে গেন্টিং হাইল্যান্ড স্টেশনে আমরা অবতরন করি।

গেন্টিং হাইল্যান্ড মালয়েশিয়ার একটি নামকরা ব্যবসা ও পর্যটন কেন্দ্র। সামনেই মালয়েশিয়ান চীনা নাগরিক ও ব্যবসায়ী গেন্টিং সাহেবের এক বিশাল প্রতিকৃতি শোভা পাচ্ছে। তিনিই এই সুউচ্চে স্থাপিত আকাশ নগরের জনক। গেন্টিং হাইল্যান্ডের নিরাপত্তায় রয়েছে নিজস্ব নিরাপত্তা প্রহরী দল। জায়গাটার আবহাওয়া অদ্ভুদ, সবসময় মৃদু বৃষ্টিপাত হয়। এদিক ওদিক মেঘ ধুঁয়ার মত উড়াউড়ি করে। কুয়ালালামপুর কিংবা পুত্রজায়ার উষ্ণগরম আবহাওয়া হতে রক্ষা পেতে একঘন্টা গাড়ি চালিয়ে এখানে এসে গেলেই গ্রীষ্মের যন্ত্রনা শেষ, এক সুশীতল স্বর্গশহরে আপনি পৌছে যাবেন।

গেন্টিং হাইল্যান্ডের গল্প যেন কল্পলোকের গল্প। এখানকার ফুল, লতা পাতা, আর্কিড, বৃক্ষ সব যেন নবযৌবন নিয়ে সামনে হাজির। জলীয় বাষ্প সারাক্ষন ভিজিয়ে দিচ্ছে চিরসবুজ ঘাস,গাছ ও লতা-পাতা। মৃদু বৃষ্টিকনা এখানে সারাক্ষন শেয়াল তাড়ায়। এখনকার প্রকৃতির সব রঙ্গই নিখাদ, তাতে কোন ধূলাবালির প্রলেপ নেই। সবুজ সবুজই, হলুদ হলুদই এবং লাল লালই।

গেন্টিং হাইল্যান্ডে রয়েছে নানান ধরনের ব্যবসা ও বিনোদন। একটি বিশাল হাইফাই ক্যাসিনো ভবন। এই ক্যাসিনোকে কেন্দ্র করে কয়েকটি ফাইভ স্টার রিসোর্ট ও হোটেল। আরামদায়ক শীতল বাতাসের এই নিরিবিলি মেঘের দেশে রয়েছে বিশ্বমানের এম্যুজমেন্ট পার্ক এবং নয়নাবিরাম কুসুমবিথী।

আমি ও রাসেল জুতা খোলে খালিপায়ে ক্যাসিনো হাউসে প্রবেশ করি। ভিতরে জুয়ার এক এলাহিকান্ড। পাঁচসাত হাজার লোক কম্পিউটারে বসে বসে জুয়া খেলছেন। বড়দের সাথে আসা শিশুরাও খেলছে কম্পিউটার গেম। এখানে ২৪ ঘন্টা ৭ দিন অবিরাম জুয়াখেলা চলে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের লোকজন বিভিন্ন পাচতারা হোটেলে আস্তানা গেড়ে জুয়া খেলতে এসেছেন। সাথে করে নিয়ে এসেছেন বউ, পুত্র-কন্যা, আন্ডা-বাচ্ছা সব। এক ডিলে দুই পাখি শিকার। একে তো সপরিবারে দেশভ্রমন, সেইসাথে মজার জুয়াখেলা। এই ডাবল সুযোগ ছাড়ে কে ? গেন্টিং হাইল্যান্ডের ক্যাসিনোতে নানান দেশের লোকজন, তবে যেদিকে চোখ ফেরাই কেবল চীন, জাপান ও থাই চেহারার মানব-মানবী। একজন বাংলাদেশী বললেন, এখানে জুয়ার আসরে লাভবান হন খুব কমই লোক। বেশীরভাগই সর্বশ্রান্ত হয়ে ফিরে যান। তারপরও একটা বাজেট তারা খোয়াতে আসেন জুয়ার নেশায়। সরকার পান জুয়াকর, ক্যাসিনোর মালিক পান কমিশন। তাই এই জুয়াখানা বারমাস জমজমাট থাকে।    

গেন্টিং হাইল্যান্ডের জুয়াখানা একটি আনন্দ-রাজ্য। এখানে ২৪ ঘন্টা ঝাড়বাতির আলো ঝলমল করে ও শীতল বাতাস বয়। জুয়াখানার উপরে পাঁচতারা হোটেল, ফাস্টফুড ও নানাদেশি খাবার হোটেল, স্বয়ংক্রিয় ওয়াসরুম ও টয়লেট।

ক্যাসিনোর কম্পিউটারে বড় বড় স্কীনের সামনে বসে কেঊ বরশী দিয়ে মাছ মারছেন, কেউ বনের পাখি শিকার, বাঘ শিকার করছেন। কেউ চরকি ঘুরাচ্ছেন, কেউবা তাসের দানে তুফান তুলছেন। সুন্দরবন ভ্রমণকালে পতিতালয় কি জিনিস? কেবলমাত্র তা দেখে নিতে আমি ও  খলিল সাহেব বানিয়াশান্তা পতিতাপল্লীতে নৌকা ভিড়াই। পতিতাঘাটের সিঁড়ি বেয়ে পারে উঠে মাত্র চারপাঁচ মিনিট অবস্থান করে এই পাপপুরী হতে নৌকায় ফিরে আসি। ইসলাম ধর্মে নিষিদ্ধ স্থান পতিতাপল্লী এভাবে অনেক আগেই দেখা হয়। এবার ইসলামের আরেক নিষিদ্ধ স্থান জুয়ারাজ্য দেখা হল। আর সে জুয়ারাজ্যের অবস্থান মুসলিম দেশ মালয়েশিয়ায়।

জুয়াখানা (কেসিনো) হতে বেরিয়ে দেখি সন্ধ্যা সমাগত। আমি ও জিন্নুন মেঘের সাথে লুকাচুরি খেলায় মেতে উঠি। মেঘের ঘন বাস্প ছুটে এলে আমরা তাতে ডুকে পড়ি, মেঘের সাথে সাথে দৌড়াই। এই মেঘের বাস্পপ্রবাহ তখন আমাদের শীতের ভোরের ঘন কুয়াশার কথা মনে করিয়ে দেয়। যতক্ষন আমরা গেন্টিং হাইল্যান্ডে ছিলাম মনটা আনন্দে ফুরফুর করছিল- এযেন আরব্য উপন্যাসের যাদুর ঘোড়ায় উড়ে মেঘের রাজ্যে বিচরন। সেদিন রাত ৯টায় বড় বাসে চড়ে আমরা কুয়ালামপুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করি। কুয়ালামপুরের বহুতল বাস টার্মিনালের ভূগর্ব তলায় এসে বাস থামে। বেশ মাথা খাটিয়ে জটিল বাস টার্মিনাল হতে আমরা বেরিয়ে আসি। বুকিতবিনতাং রেস্টহাউসে এসে গভীর ঘুমে ঢলে পড়ি।

 

                                                                                                                                                             

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন