তৃতীয়বার যুক্তরাষ্ট্র যাত্রা- সাউথ ক্যারোলিনা, ইংল্যান্ড ও ওয়েলস সফর পর্ব- সাত
The O2- Millionium Domn পরিদর্শনঃ
লন্ডনে দু’ সহস্রাব্দকে স্মরণীয় করে রাখতে ‘মিলিওনিয়াম
ডম’ তৈরি হয়। ব্রিটিশরা বিশ্বের এক উদ্ভাবনী ক্ষমতাসম্পন্ন
জাতি। নতুন নতুন ধারণা, দর্শন, স্থাপনা,
অবকাঠামো উদ্ভাবনে তাদের জুড়ি মেলা ভার। অনুরূপ পুরাতনকে সংরক্ষণও
তাদের জুড়ি নেই।
‘The O2- Millionium Domn’ হচ্ছে কয়েক
একর জায়গা জুড়ে স্থাপিত অর্ধবলাকার স্থাপনা। শক্ত একধরনের কাপড় ও দড়ি দিয়ে প্রায়
একশত ফুট উঁচু ফুটবলের মতো বৃত্তাকার ছাদ। ঐ শক্ত কাপড়ের ছাদ দিয়ে ভোরের আলোর মতো
সূর্যের প্রাকৃতিক আলো আসে, অথচ তুষার, বৃষ্টি, বরফ এসব ঢুকতে পারে না। শীত প্রধান দেশের
ঠান্ডা হতেও ভিতর থাকে সুরক্ষিত। অনেকটা মরুদেশের এক্সিমোদের ঘর ইগলুর ডিজাইনে
নির্মিত। ইগলু ক্ষুদ্র, এটি কয়েক একর জায়গা জুড়ে প্রসারিত।
ইগলু বরফে তৈরি আর এটি শক্ত কাপড় ও দড়িতে তৈরি। এই ডুম এতই শক্ত যে, শত শত মানুষ পাহাড় টেকিংয়ের মতো দড়ি ধরে বেয়ে বেয়ে উপরের ছাদে উঠছে। লন্ডন
শহরে পর্বতারোহণের স্বাদ গ্রহণ করছে। ডুমের মধ্যে অজস্ত্র স্থাপনা, ব্যবসাকেন্দ্র ও দোকান পাঠ রয়েছে। প্রিয় ভাতিজি নওশীন নতুন চাকুরির বেতন
পেয়েছে। সে Millionium Domnতে অবস্থিত লন্ডনের বিখ্যাত
জিম্মি (Jimmy) রেস্টুরেন্টে এ প্রিয়জনদের আমন্ত্রণ করে। এই
রেস্টুরেন্টের সামনে এসে চব্বিশ পঁচিশজন একত্রিত হয়ে ডুমের ভিতর ঘুরে ঘুরে ছবি
তুলি। এখানে ছিলেন ভাতিজা মাহবুব, তার পত্নী ফারজানা,
পুত্র রায়হান ও রিদওয়ান, একমাত্র কন্যা
সারিনা। আর আছেন জাহেদ ও তার পত্নী জেবুন্নেছা, দু’কন্যা জাহরা ও জাকিরা। বিখ্যাত জিম্মি রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করি। ভিতরে
দেশ-বিদেশের অজস্র লোকজন, শিখ সম্প্রদায়েরও কয়েকজনকে একটি
টেবিলে বসতে দেখি। এই হোটেলে ইহুদি ছোট্ট টুপিপরা কাস্টমারও দেখা গেল। হোটেলের ওয়াল জুড়ে
সারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ঐতিহ্যবাহী স্মারকমালা চিত্রায়িত রয়েছে। ভারতের তাজমহল,
আইফেল টাওয়ার, কুতুব মিনার, স্ট্যাচু অব লিবার্টি, রুমের ক্যালাশিয়াম, গ্রীকের জিউসের মন্দির, চীনের প্রাচীর, মাচু পিচু, রেড ইন্ডিয়ান গ্রাম, ভ্যাটিকান সিটি, ধ্যানরত বৌদ্ধ, ক্রুশবিদ্ধ যিশু, শকটে বসা চেঙ্গিশ খান, ক্লিও পেট্টা, পিরামিড, বেবিলনের
শূন্য উদ্যান সব রয়েছে।
খাদ্যবিদ্যা এদেশে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কোন দেশের
পর্যটনের উন্নয়নে বিষয়টি অঙ্গাঅঙ্গি জড়িত। এই হোটেলে এক এক লাইনে এক এক ধরনের
খাদ্যের সারি রয়েছে। লাইন ধরে নানা ডিজাইনে খাদ্য, পানীয় ফলমূল সাজানো। হাজার হাজার পাউন্ডের খাদ্য ব্যবসায়ী এই
জিম্মি হোটেলের খাদ্য ও কোয়ালিটি ম্যানেজমেন্ট গবেষণা সেল রয়েছে। আমাদের বিল আসে
প্রায় ২০০ পাউন্ড। ঘণ্টা খানিক হোটেলে অবস্থান করে বেরিয়ে আসি। ডোম হতে বের হয়ে
এমিরাত এয়ারলাইনের মালিকানাধীন কেবলকার চড়ে টেমস ও তার এক শাখানদী পার হই। কেবলকার
এতো উপরে উঠে যে পুরো লন্ডন শহর দৃষ্টিগোচর হয়। নদী, নৌকা,
জাহাজ, শাখা নদী, পারের
পার্ক, মানুষের হাঁটাচলা দেখে দেখে গন্তব্যের প্লেটফরমে চলে আসি।
বাইরে টেমসের পারে জাহিদের বাসায় এসে ফল খাই। তারপর যাই বাংলাদেশে বর্তমানে
অবস্থানরত আসাদ ভাইয়ের তালা দেওয়া বাসায়। বহুদিন পর তালা খোলা হলো। পিছনের বাগানে
চেরিফল পেকে কালো হয়ে মাটিতে পড়ছে। পাকা চেরীতে ব্যাগ ভরে ফিরে আসি।
২রা জুলাই ২০১৭ রবিবার। লন্ডনের এক উজ্জ্বল সামারের দিন। সুদীর্ঘ আটারো ঘণ্টা দিন আর রাত ক্ষনিকের। এখানে ২.৩০ এ.এম তে দিবস শুরু হয় এবং ৯.৩০ পি.এম তে মাগরিবের নামাজের সময় হয়। ২৪ ঘণ্টার দিবসে রাতের পরিমাণ মাত্র ৬ ঘণ্টা। এতদীর্ঘ দিনে দেশটা আগুনে পরিণত হবার কথা অথচ তাপমাত্রা তেমনটি নেই। ঘরে বাতাস পাখার প্রয়োজন হয় না। এখানে সূর্য পূর্বাকাশে উদয় হলেও উত্তর আসমানে অবস্থান করে আবর্তিত হয়। ফলে সূর্যের রৌদ্রে তাপের পরিমাণ অল্প। সূর্য কিরণ নিস্তেজ। আমাদের দেশে গ্রীষ্মকালে সূর্যটা মাথার উপর খাড়াভাবে অবস্থান করে, ফলে রৌদ্র প্রচন্ড তাপ বর্ষণ করে। লন্ডনের সামার আমাদের বসন্তের মতো আরামদায়ক। মৃদুমন্দ সমীরণ শরীরে আনন্দ শিহরণ তুলে, শুনলাম এখানকার শীতকালটা সম্পূর্ণ উল্টো। তখন রাত শেষ হয় না, সূর্যের দেখা মেলে না। এক অস্বস্থিতে হৃদয়মন আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। তখন রাত আঠারো উনিশ ঘণ্টা। বিদঘুটে কালো রাত্রি। তখন দেশটা রাতের করাল গ্রাসে আপতিত হয়। এখানে নামাজ, খাবার-দাবার, ঘুম, অফিস, স্কুল সময় আমাদের দেশের মতো দিবস ও রজনীতে ভাগ ভাগ করে সম্পন্ন করা সম্ভব হয় না। শীতকালে সব কাজ রাতে এবং গ্রীষ্মকালে দিবসের শরীরে ঢুকে পড়ে।
আজ সকালে বের হয়ে ভাগ্নী লিজার বাসায় যাই। এখানে লিজার স্বামী রোমন, পুত্র আরমান ও কন্যা আমিরার সাথে দেখা হয়। তাদের বাড়ি ছাতকের শিমুলতলা গ্রামে। বাসাটি সুন্দর, এখানকার অন্যতম আকর্ষণ তিনটি পোষা বিড়াল। এদের জন্য আলাদা খাবার কেনা হয় ও বাহিরে নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে ওরা তাদের পয়ঃকর্ম সেরে আসে।
সন্ধ্যায় জাহিদ আমাদেরকে একটি টার্কিশ হোটেলে দাওয়াত
করে। সাথে সপরিবারে শরিক হন বড় ভাই, নিপা ও আফজল। তিনটি গাড়িতে করে যাই। ইস্টলন্ডনের হোটেলের নাম ‘হোটেল সুলতান’। টার্কিশ নর-নারীরা এই হোটেল পরিচালনা করে থাকেন।
সূচালো নাক, পটলচেরা চোখ, কালো চুল, চিকন-চাকন এই শ্বেত মেয়েদেরকে অটোম্যান ইতিহাসের
প্রখ্যাত সিনেমা সুলতান সুলেমানের হেরেমের মেয়েদের মতো লাগছিলো। হেরেমের মেয়েদের
পোষাক ছিল মধ্যযুগীয় তুর্কী, আর এই হোটেলের তুর্কি মেয়েদের
পরনে আধুনিক কালো রঙের প্যান্ট সার্ট। তাদেরকে অপরূপ লাগছিলো। হোটেলটিতে
কাস্টমারের প্রচন্ডভীড়। এই তুর্কী সুন্দরীদের গলদঘর্ম অবস্থা। নারী হওয়া সত্ত্বেও
এরা পুরুষের মতো ক্ষীপ্রগতিতে কাজ করে যাচ্ছে। মনে হলো এই অনিন্দ্যসুন্দরীরা যদি
বাংলাদেশে জন্মাতো তবে নিশ্চয়ই বড় লোকদের বেগম হতো। নরম পালংকে শুয়ে আরামে দিন পার
করতো। এভাবে হাড়ভাঙ্গা খাঁটুনি দিতে হতো না।
টার্কিস সুলতান হোটেলে ভূরিভোজ করে চলে যাই মামাতো বোন নিপার বাসায়। দুতলা বাসার উপরতলার বেডরুমে একঘুমে রাত পার হয়। সকালে নামাজ পড়ে নাস্তা করে হাঁটতে বের হই। আমরা সবাই ইলফিল্ডের ভ্যালেন্টাইন পার্কে ঘরে বেড়াই। বিশাল এক তালদিঘীর পাকা রাস্থা ঘেরা চারপার পনের মিনিটে একদৌড়ে ঘুরে আসি। এযেন আমাদের রাজনগরের কমলারানীর দিঘী। পানি ভরা দিঘীর তীরলেবেল ছোঁয়ে আছে। পার্কের ভুমি লেবেলে দিঘীর পানি-লেবেল বেশ ভালই লাগে।
দীঘিতে কয়েকটি বুট রাখা। কয়েক ডজন রাজহাঁস, পাতিহাঁস, ছোট ছোট ছানা নিয়ে লেকের জলে সাঁতার কাটছে। পার্কটিতে ব্যায়ামাগার ও টেনিস মাঠ আছে। ব্যায়ামাগারে কয়েক ধরনের ব্যায়াম করি বিশ পচিশ মিনিট। সাইকেল রেস, রানিং, নৌকা বাওয়া ইত্যাদি সব ধরনের ব্যায়াম করি একটু একটু করে। তারপর আরেকটি বুনোহাসের সরোবরে যাই। একটি ঘন জলাবন এই সরোবরের ভিতর উপদ্বীপের মত ঢুকে আছে। এখানে মাছরাঙ্গা টুপ করে মাছ ধরছে। এই পুকুরে অনেক জাতের বকও বিচরন করে। সরোবরের পারে একটি সাইনবোর্ডে এই জলাশয়ে বিচরনকারী সব প্রানী ও পাখিদের সচিত্র বিবরন রয়েছে। এবার হাঁটি হাঁটি পা পা করে ফিরে আসি আজকের নিবাস পাশেই নিপার বাসায়। (চলবে)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন