তৃতীয়বার যুক্তরাষ্ট্র যাত্রা- সাউথ ক্যারোলিনা, ইংল্যান্ড ও ওয়েলস সফর পর্ব- আট
ওয়েলস
সফরঃ
ভাগ্নি চুন্নীর শহর সোয়ান সি যাবার আমন্ত্রণ পাই।
ব্রিটেনের পশ্চিমের ক্ষুদ্ররাজ্য ওয়েলসের দ্বিতীয় প্রধান শহর এই সোয়ানসি। আট হাজার
ষোল বর্গমাইলের ওয়েলস রাজ্যটি পশ্চিমে আটলান্টিক উপকূলে ব্রিটিশ দ্বীপের একটি
উপদ্বীপ। রাজ্যটির রাজধানী ও প্রধান শহর কার্ডিফ। লোকসংখ্যা প্রায় তিন মিলিয়ন।
ভগ্নিপতি হুমাউন তাদের ব্যবসা প্রতিস্টানের একজন কর্মচারী ও নিগ্রো ড্রাইভারকে লন্ডনে পাঠান। সোয়ান সি হতে কালো জিপটি আসে বিকেল ৫টায়। ঘন্টা খানেক পর যাত্রা শুরু হয়। সোয়ান সি শব্দের অর্থ সমুদ্রের রাজহাঁস। এটি আমাদের মৌলভীবাজার শহরের মতো একটি শহর। আটলান্টিক হতে ঢুকে পড়া এক ছোট্ট উপসাগরের পারে শহরটির অবস্থান। প্রায় আড়াই লক্ষ জনসংখ্যার এই শহরটি লন্ডন হতে আড়াইশ মাইল পশ্চিমে অবস্থিত। জিপটি ব্রিটেনের মসৃন আটলেনের রাস্তা দিয়ে দ্রুত অগ্রসর হতে থাকে। পথে একটি রেস্ট হাউস এ নামি। রেস্ট হাউসটি যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার প্রতিরূপ। তবে এখানে একটি বাড়তি সুবিধা দেখলাম তা হলো কম্পিউটারাইজড ক্যাসিনো। দু’চার জন লোককে বসে বসে জুয়া খেলতে দেখলাম। রাস্তায় ক্রমান্বয়ে সুইন্ডন ও ব্রিস্টল পার হলাম। ব্রিটেনের রাস্তার দু’পাশের দৃশ্য যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার অনুরূপ। তিনটি দেশই শ্বেতাঙ্গদের হাতে গড়া উন্নত রাষ্ট্র। কাজেই এসব দেশের আবাসন, রাস্তাঘাট, জীবন বিন্যাস প্রায় একই পদ্ধতির ভিতর রয়েছে। ব্রিটেন প্রাচীন ও তুলনামূলকভাবে জনবহুল রাষ্ট্র হওয়ায় এখানে রাস্তাগুলো সামান্য অপ্রশস্ত। কিন্তু এ দেশের যে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের যে প্রাচীনত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে তা যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার নেই। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা কেবল ইংরেজদের রীতিনীতিকে অনুসরণ করছে।
রাস্তার দু’পাশ গাঢ় সবুজ। সমতল নেই, উঁচু নিচু পাহাড়
ও উপত্যকায় রূপালী গমক্ষেত, শষ্যক্ষেত ও বনবনানীর ছায়া।
সামনে এক বিশাল সামুদ্রিক খাড়ি। এখানে সমুদ্র একটি মহানদীর মতো ভূভাগের ভিতর বেশ
কয়েক মাইল ঢুকে রয়েছে। এ যেন আমাদের চাঁদপুরের দক্ষিণের কুলহীন মেঘনা। এই
সামুদ্রিক খাড়ির উপর কয়েক কিলোমিটার দীর্ঘ সেভেন রিভার ব্রীজ। সেতু হতে সমুদ্র
পারে এক ব্রিটিশ শিল্পনগরী দেখা যাচ্ছে। ব্রিটিশ স্টিল কোম্পানী চোখে পড়লো। সেতু
পার হয়ে ওয়েলস রাজ্যে প্রবেশ করলাম, ব্রিটেনের দু’টি রাজ্যের স্পর্শ পেলাম।
ঘণ্টাখানিক পর কার্ডিফের রাস্তার সাইনবোর্ড দেখলাম।
পরক্ষণেই আমাদের জিপ একদিকে সুউচ্চ পাহাড় ও অন্যদিকে সাগর পারের স্বর্গীয় সুন্দর
রাস্তা দিয়ে অগ্রসর হয়। রাস্তাটি অনেকটা আমাদের কক্সবাজারের হিমছড়ি উনানী সৈকত
রোডের অনুরূপ। ব্রিটেনের সুন্দর পর্যটন নগরী সোয়ানসিতে ঢুকে চোখে পড়লো সোয়ান সি
ইউনিভার্সিটি। সুউচ্চ পাহাড় ও উপত্যকার বুক চিরে বয়ে গেছে। দু’পাশের বাসাবাড়ি বাণিজ্যকেন্দ্র
সমুদ্রতীর পার হয়ে এক প্রাসাদাপম বাড়ির সামনে এসে গাড়ি থামে। বাড়ির সামনে গাড়ি
পাকিংয়ে ব্যবহার্য্য আটটি যান রয়েছে। পার্কিং লনটি এতো বড় যে এখানে অনায়াসে
বিশ-পঁচিশটি গাড়ি পার্ক করা যাবে। বাড়ির গেটটি প্রাচীন স্থাপত্যের ঐতিহ্য ধরে আছে।
কাঠের বড় সদর দরজা দিয়ে যুক্ত-ত্রিতল ভবনে ঢুকলাম। ভাগ্নিবর হুমাউন আভ্যন্তরীন
সিঁড়ি দিয়ে তিনতলা প্রাসাদটি চক্কর দিয়ে নিয়ে আসেন। একে একে গুনে গেলাম বড় বড়
বাইশটি কক্ষ, অসংখ্য বাথরুম, বারান্দা,
বাসাটির পিছনে সুবিশাল ঘাসের সবুজ লন, বৃক্ষ,
দোলনা ও ব্যায়াম ঘর। ছোট ছোট তরকারি ফলানোর প্লট। বাইরে আর আছে
গোদাম ও কাপড় ওয়াশিংয়ের ঘর। এযেন বাংলাদেশের সুবিখ্যাত কোন জমিদার বাড়ি। মনে হল
আমরা যেন হুমাউন আহমদের ‘অয়ময়’ নাটকের
জমিদার বড় মির্জার বা ঢাকার নওয়াব বাড়ির অতিথি হয়েছি। বাসাটি ছিল কিং জর্জের আমলের
এক জমিদার বাড়ি। চুন্নীর শ্বশুর আলহাজ মো. আব্দুল আহাদ সময়ে সুযোগে বাড়িটি কিনে
নেন। দুইশ বছর আগে রাজা জর্জের আমলে নির্মিত ভবনের আভ্যন্তরীন কাঠের সিঁড়ি শক্ত ও
ঐতিহ্যময়। ড্রয়িং কক্ষ এতো বড় যে এটির ভিতর লন্ডন শহরের একটি ছোট বাসা ঢুকিয়ে দেয়া
যাবে। কিচেন যেন একটি আস্তো বাসা। ডাইনিং টেবিলে এক সাথে ২০ জন বসে খাবার ব্যবস্থা,
যেন এক হলরুম। শীত প্রধান দেশগুলোর ঘরের মেঝে কার্পেট মোড়ানো থাকে।
বিশাল অতিথি কক্ষে ঘুমাতে যাই। বড় খান্দানি কাঠের পালঙ্কটি মনে হয় কক্ষের সামান্য
জায়গা দখল করে আছে। কক্ষটিতে দুইটি হাতা চেয়ার, হাফসেট
সোফাসহ টেবিল ও বড় আলমিরা রয়েছে। তারপরও প্রচুর ফাঁকা জায়গা কক্ষটিকে একটি লনে
পরিণত করেছে। একটি দোলক ওয়ালঘড়ি দোলে দোলে সশব্দে টকটক করে সময় জানান দিচ্ছে।
ওয়ালে কলিমা অঙ্কিত চিত্রকর্ম। বিশাল কক্ষের তিনদিকে ফায়ার মেশিন শীত এলে তাপ দেয়।
চারদিকে জমিদারী আমলের আভিজাত্য। এ যেন ব্রিটেনের
আটলান্টিক পারে কোন এক বাংলাদেশীর স্বপ্নময় জমিদারী। একটি সুন্দর সাজানো গোছানো
একান্নবর্তী বড় পরিবার। এ ধরনের বিশ পঁচিশ জনের বিশাল একান্নবর্তী পরিবার আজকাল
বাংলাদেশেও খুঁজে পাওয়া যায় না। চুন্নীর জা নিপা সুদক্ষ রাঁধুনী। রান্নার ড্রেস পরে
যখন রাঁধতে যান তখন খুবই স্মার্ট ও চৌকষ মনে হয়। সবাই কাজ করেন। ‘দশে মিলে করি কাজ, সবাই জিতি কিসে লাজ’। এখানে কাজ সহজ। মাছ, মাংস, তরি তরকারি সব বাজার হতে তৈরি ও
প্যাকেটজাত হয়ে আসে। শুধু চুলার উপর কড়াইতে ফেলে দিলেই হলো। সদ্যপ্রয়াত হাজী
আব্দুল আহাদ ছিলেন একজন উদ্যোমী ও পরিশ্রমী ব্যক্তিত্ব। তিনি তার সব ছেলে-মেয়েকে
উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলেন। কেউ ব্যারিস্টার, কেউ
ডাক্তার, কেউ বা ম্যাজিস্ট্রেট। ছেলেবউ দু’জনই চিকিৎসক। তাদের শাশুড়ি মা অসুস্থ, পালাক্রমে
পুত্র ও পুত্রবধুরা সেবা করে যাচ্ছেন। বিলাতের মতো জায়গায় তা সত্যিই প্রশংসনীয়।
এতো মানুষের এই সম্মিলিত সুখী পরিবার দেখে অনুপ্রাণিত হলাম এবং ভালোই লাগলো।
আমাদের আগের প্রজন্মে জমিদারী আমলে এধরনের বড় সংসারের কাহিনী শুনতাম। ব্রিটেনের
পশ্চিম প্রান্তে সোয়ানসি এসে এ ধরনের এ যৌথ পরিবারের সাক্ষাৎ পেয়ে মনে হলো আমি
যেন এমনই এক লর্ড পরিবার বাস্তবে পেয়ে গেলাম।
ব্রিটিশদের ঐতিহ্যপ্রীতি সর্বজনবিদিত। এই
ঐতিহ্যমুখিতা রাজধানী লন্ডন হতে শুরু করে প্রত্যন্ত এলাকা পর্যন্ত প্রসারিত। রাজা
জর্জের আমলের জমিদার বাড়ির কাঠের সদর দরজা নষ্ট হয়ে গেলে একটি সাধারণ দরজা লাগানো
হয়। কাউন্সিল হতে নির্দেশ আসে আগের খান্দানী ডিজাইনের দরজা লাগাতে হবে। এতো ভারী ও
কারুকার্য্যময় দরজা নির্মাণে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন, এটা কাউন্সিলকে জানানো হলো। আর্থিক সামর্থ্য না থাকলে
কাউন্সিল হতে খান্দানী দরজা নির্মানে ভর্তুকী প্রদান করা হয়। শেষমেষ অনেক অর্থ খরচ
করে রাজা জর্জের আমলের ডিজাইনের অনুরূপ ভারী কাঠের দরজা নির্মাণ করে ভবনের সদর
দরজা প্রতিস্থাপন করতে হলো।
কিছু দিন আগে
স্বপ্নে এক বিশাল ভবনে সপরিবারে বিচরণ করতে দেখি। এই বাড়িটি স্বপ্নে দেখা সেই
বিশাল বাড়ির প্রতিচ্ছবি মনে হলো। সিলেটের সিভিল সার্জনের বড় বাসাসহ অনেক চা বাগানের
বড় বড় বাংলোতে রাত কাটানোর অভিজ্ঞতা আমার রয়েছে। অথচ মনে হলো ওয়েলসের এই বাড়িটি
যেন আমার জীবনকালে ঘুমানো সর্ববৃহৎ বাড়ি।
৪ঠা জুলাই ২০১৭, মঙ্গলবার। সকালে ঘুম হতে ওঠে
ঝিরি ঝিরি বৃষ্টির দেখা পাই। মৃদু ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব। চুন্নী ছোট্ট কার চালিয়ে
আমাকে নিয়ে বের হয়। নাতি ইশরাকের অভিজাত স্কুলে যাই। ইশরাত বাংলাদেশে অবস্থান করে
মাত্র এগার বছর বয়সে কুরআন হাফিজ হয়। মৌলভীবাজারের কচুয়া জামে মসজিদে এই বালক
হাফিজের পিছনে তিনরাত তারাবীর নামাজ পড়ি। বাংলাদেশে টুপি ও লম্বা পাঞ্জাবী পরা
ইশরাতের এখন আর সেই ক্ষুদে হুজুরের বেশ নেই। এখন সে একটি নামী-দামী স্কুলের
স্মার্ট স্টুডেন্ট। তার বাৎসরিক টিউশন ফি দশ হাজার পাউন্ড।
বাসায় ফিরে হুমাউন বড় জিপে আমাদেরকে সোয়ানসি শহরের
পর্যটন ও গ্রাম এলাকা দেখাতে বের হন। তিনি আমাদের সুন্দর সৈকত ঘেরা গাওয়ার পেনিন
সুলায় নিয়ে যান। পথে চোখে পড়ে বড় বড় ভেড়ার খামার। খামারগুলোর চার দিকের বেড়া
প্রাকৃতিক বন দ্বারা নির্মিত। সাদা লোম বিশিষ্ট বেশ রিষ্টপুষ্ট। বাংলাদেশের ভেড়া
এতো সুন্দর হয় না। জিপ যাবার সরু রাস্তা ঘনো বনে আবৃত। উঁচু নিচু সবুজ পাহাড়, ঘাসের গালিচা দিগন্তহীন আটলান্টিক
মহাসাগরের সাথে একাকার হয়ে অপূর্ব সৌন্দর্য্য বিতরণ করছে। সাগরপারের এক পাহাড়ে
অবতরণ করি। এই জায়গার নাম ঞযৎবব বষরঢ় নধু. সামনে সমুদ্রে উটের আকৃতি বিশিষ্ট একটি
ক্ষুদে দ্বীপ রয়েছে। এই পাহাড় হতে অনেক নিচে সাগরের স্বচ্ছ জলের ঢেউ দেখা যাচ্ছে।
মৃদু বাতাস বইছে। এখানে পাহাড়ের ঢালুতে ধাপে ধাপে অসংখ্য ক্যারাভান গাড়ি রাখা।
অসংখ্য তাবু টাঙ্গিয়ে যাযাবরদের মতো পর্যটক নরনারী অবস্থান করছেন।
এই সুন্দর সামুদ্রিক পাহাড়ের মালিক এখানে তাবু ও
ক্যারাভান রাখার জায়গা ভাড়া দিয়ে প্রচুর অর্থ আয় করেন। আমি বললাম এখানে হোটেল
রিসোর্ট তৈরি করলে বেশি আয় হতো। হুমাউন বললেন সরকারি অনুমতি নেই। এখানে কোনো
বিনিয়োগ ছাড়াই প্রচুর উপার্জন হচ্ছে। তাছাড়া ক্যারাভান কিংবা তাবুতে থাকা লোকজন
হোটেলে যাবে না। তারা এভাবে যতোটুকু সম্ভব প্রকৃতির কাছাকাছি থাকতে পারে; হোটেল বা রিসোর্টে থেকে তা সম্ভব নয়।
এখানে গ্রেট ব্রিটেন ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশের লোকজন
আসেন।ইউরো ট্যানেল দিয়ে ক্যারাভান গাড়ি নিয়ে দলবেঁধে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের পর্যটকরা আসেন। পাহাড়ের মালিক রেস্ট রুম তৈরি করে
দেন। এখানে টয়লেট ও গোসলের কাজ চলে। ক্যারাভান গাড়িতে ডাইনিং, সিটিং, ও
স্লিপবেড রয়েছে। কোনো কোনো গাড়িতে গোসল ও টয়লেটের ব্যবস্থাও আছে। এখানে প্রকৃতি ও
মানুষ পরস্পর একাকার হয়ে যায়; যেমন বনের সাথে পাখি ও জলার
সাথে হাঁস একাকার হয়। সুনশান পাহাড়, পাদদেশে শান্ত স্নিগ্ধ
সমুদ্রে জোয়ান, বুড়া, নর-নারী ও শিশুরা
মনের আনন্দে প্রকৃতির সৌন্দর্য্যভূমে অবসর দিন ঘুরে বেড়ায়। সাগরের নিরবতা ভেদ করে
দু’চারটা সীগাল আকাশে উড়ে বেড়ায়। এই সৈকত হতে ফেরার পথে
চেরীবাগান, বিটক্ষেত, গমক্ষেত, গরু ও ঘোড়ার খামার, ভেড়ার খামার ও ভূট্টাক্ষেত দেখি।
এখানে পাহাড়ের ধাপে ধাপে ও উপত্যকায় প্রচুর ঘাস হয়। ঘাস আহরণ করে প্রক্রিয়াজাত করে
বড় বড় কালো পলিথিন ব্যাগ ভরে সংরক্ষণ করা হয়। বরফ ঢাকা শীতের তিন মাস পাতা ঝরে যায়,
ঘাস মরে যায়। এই কঠিন তিন মাস গরু, ঘোড়া ও
ভেড়া এই ঘাস খেয়ে বেঁচে রয়।
সোয়ান সী শহরটি একটি উঁচু পাহাড়িয়া শহর। সমুদ্র হতে বেশ উপরে শহরটির অবস্থান। পাহাড় যেন ধাপে ধাপে নেমে আটলান্টিক মহাসমুদ্রে এসে শেষ হয়েছে। সামনে বার্ধক্যনিবাস, ব্রিটেনে লোকজন বেশি দিন বেঁচে থাকে। এখানে নব্বই উর্দ্ধ ও শতায়ু লোকজনের বিচরণ স্বাভাবিক ঘটনা। লোকেরা সাধারণত সত্তুর আশি বছর পর্যন্ত কর্মক্ষম থাকেন। পুরো ওয়েলস্ রাজ্যটাই এক পার্বত্য উপদ্বীপ। গ্রীষ্মে সর্বক্ষণ পিনপিনে মেঘঝরে ও শীতে তুষারপাত হয়। আবহাওয়া ঠান্ডা। সমুদ্র উপকূল পাহাড়ি ও ভঙ্গুর।
এবার একটি সী বীচে যাই। বিচটি দেখতে অনেকটা আমাদের
হিমছড়ির মতো পাহাড় ও সমুদ্র ঘেরা। তবে বিচটির অবস্থান খাড়া পাহাড়ের পাদদেশে
নিম্নভূমিতে। পিছনের পাহাড়কে অপূর্ব দেখাচ্ছে। এখানে পাহাড়ে একজন বৃদ্ধ বড়শি দিয়ে
মাছ ধরছেন। নিচে এক বৃদ্ধা কুকুরকে সমুদ্রে গোসল করাচ্ছেন। ইংরেজ বৃদ্ধার কুকুরটি
বরশীর সুতায় পেছিয়ে গেলে দু’জনের মধ্যে ঝগড়া শুরু হয়। ব্রিটেনে এই প্রথম দেখা ঝগড়া বেশ উপভোগ করি।
বুডো ইংরেজের উত্তেজিত মোটা সুর ও বৃদ্ধার চিকন গলা সাগরের বাতাসের সাথে ঝংকার
তুলে। ওয়েলস ভাষার ঝগড়া, কিছুই বুঝিনি, তবে হুমাউনকে বুড়ার কাধে হাত রেখে হাসতে দেখলাম, এক
সময় এই বৃদ্ধ নাকি তাদের হোটেলে কাজ করতেন। ইংরেজদের রাগ বেশিক্ষণ থাকেনা।
কিছুক্ষণ পর একটু হাসাহাসি করে তারা নিজ নিজ কাজে মনোনিবেশ করেন। পাহাড়ি ঢালু পথ
দিয়ে নেমে সৈকতে গেলাম। সৈকতের বেলাভূমিতে জগিং করে দশ পনের মিনিট নিঃশেষ হয়ে গেল।
সাগরপারের খাড়া পাথুরে সবুজ পাহাড়কে সামনে রেখে অনেকগুলো ছবি উঠাই। হুমাউন বললেন,
এখানে যদি একটি নৌকায় চড়ে পশ্চিমদিকে চালাতে থাকেন তাহলে কলম্বাসের
মত আমেরিকায় চলে যাবেন।
এখানে সমুদ্র তীরবর্তী একটি হোটেলে কফি পান করি।
কাটের মেঝে ও গ্লাসের ওয়ালঘেরা টিন ছাদের বারটির ডিজাইন অসাধারণ। মনে হয় হোটেলটি
সাগরের ভিতর ঢুকে আছে। এখানে কর্মরতা টিনএজ মেয়েরা কালো প্যান্টসার্ট পরিহিত। কালো
পোষাকে এই শ্বেতাঙ্গিনী চিকন সুন্দরী মেয়েদেরকে অপরূপা লাগছিলো। কালোরঙের পোষাকের
ভিতর দুগ্ধধবল চর্ম ও সোনালী চুল যেন হা-মেলে হাসছে।
আসার পথে সমুদ্রতীরে বিমান চালানো শেখার স্কুল
দেখলাম। মিনিকারের মতো দুই/তিন সিটের প্লেন। হুমাউন বললেন- মামা, দু’এক মাস
এখানে থেকে এই ক্ষুদে বিমান চালনা শিখে সমুদ্রের উপর উড়াউড়ি করতে পারবেন। বললাম-
জীবনে অনেক উড়েছি, আর না।
এবার সোয়ান সী শহরের কেন্দ্রে এসে হুমাউনের মালিকানাধীন ইন্ডিয়ান
হোটেল ‘মহারাণী’ পর্যবেক্ষণ করি। অতি
সুসজ্জিত হোটেলটি ডিজিটাল ও অটোমেটেড। সেল পয়েন্ট মেশিনে লেনদেন হয়। সুইচ টিপলেই
পানীয়, ফ্রুট জুস, ওয়াইন, কপি, পাত্রে চরে আসে। রান্নাঘর অতি পরিচ্ছন্ন ও
স্বাস্থ্যকর। নানরুটি ও তন্দুরী তৈরির স্থান আলাদা। এবার তাদের পরিচালিত বড় মেঘাসপ
দেখতে যাই। রাস্তার লেভেলে বড় শো-রুম ও নিচ তলায় গোডাউন ও হীমাগার। আমাদের দেশের ‘স্বপ্ন’র শো-রুমের মতো এখানে হাজার হাজার পাউন্ডের
নিত্য প্রয়োজনীয় মালামাল রয়েছে। শহরের এপ্রান্তে হুমাউনদের অনেক বাসা বাড়ি ও দোকান
ভাড়া দেওয়া আছে।
এবার বাসায় ফিরলাম। ইংরেজ জীবন নিয়ে কথা হলো। ইংরেজরা বাচ্চাদের খুব
স্নেহ যত্নে বড় করে। লেখাপড়া শেখায়। অথচ বাচ্চারা বড় হলে হারিয়ে যায়। এ যেন সেই
মোরগীর মতো যে বাচ্চাদের খুব ভালোবাসে, আলগে রাখে। শিয়াল বা
চিল বাচ্চার উপর হানা দিলে প্রাণ ভয় ভুলে গিয়ে শিয়ালের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। অথচ সেই
মা মুরগীই বাচ্চা বড় হলে মেরে তাড়িয়ে দেয়। ইংরেজরা বুড়ো বয়সে একাকী হয়ে পড়ে,
ছেলে-মেয়েরা খবর রাখেনা। চুন্নীর ভাষ্য, এটা
আল্লাহর সিস্টেম। আমাদের দেশে বুড়ো মা-বাবাকে আল্লাহ সন্তান দিয়ে প্রতিপালন করান,
আর উন্নত দেশে বুড়োদেরে রাষ্ট্রকে দিয়ে পরিপালন করিয়ে যান।
এবার চুন্নীর মেঘাসপের ড্রাইভার আহমদ নাদিভ আমি জেফার ও নুরজাহানকে নিয়ে লন্ডনের পথে যাত্রা করেন। উঁচু পাহাড়ের উপর নাদিভের পরিবার বসবাস করেন। চল্লিশ বৎসর বয়সী নাদিভ সুদানী, তাঁর পত্নীও একজন নিগ্রো সুদানী মহিলা। তাঁর ভীমকালো পাঁচ পুত্রকে এক মাঠে ফুটবল খেলতে দেখলাম। সবগুলো একই চেহারার মনে হল। এ মাঠ থেকে নাদিভের এক কালো চাচাতো ভাই সামনের সিটে এসে বসলো। সামনে দু’জন কালো আফ্রিকান এবং আমরা তিনজন বাদামী এসিয়ান পিছনের সিটে বসে আছি। সাঁ সাঁ করে গাড়ি পূর্ব দিকে লন্ডনের পানে ছুটে যাচ্ছে। পথে ঐ আগের জায়গার রেস্ট রুমে থামলাম। কপি পান করে বাথরুম সেরে আবার ছুটলাম। রাতের অন্ধকার গায়ে মেখে মেখে লন্ডনের ডাগেনহাম ইস্টে ভাইয়ের বাসায় এসে নামলাম।(চলবে)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন