মঙ্গলবার, ১১ আগস্ট, ২০২০

তৃতীয়বার যুক্তরাষ্ট্র যাত্রা- সাউথ ক্যারোলিনা, ইংল্যান্ড ও ওয়েলস সফর পর্ব- নয়

 


তৃতীয়বার যুক্তরাষ্ট্র যাত্রা- 
সাউথ ক্যারোলিনা, ইংল্যান্ড ও ওয়েলস সফর    পর্ব- নয়

দুইভাগ্না লবিদ ও হুদহুদের বাসা গমনঃ

০৫ জুলাই ২০১৭ সাল বুধবার। রাত পোহালে রুটিন মাফিক পাশের পার্কে এক ঘন্টা হাঁটি ও তারপর মার্কেটে কেনাকাটায় যাই। দুপুরে ইস্টলন্ডন লবিদের বাসায় দাওয়াত খেতে যাই। লবিদ আমার বড় বোনের ছেলে ও জৈষ্ট ভাগনা। তাদের দেশের বাড়ি দরগামহল্লা, সিলেট। লবিদের দুই ছেলে ও এক মেয়ে। ভাগনা বউ মৌলভীবাজারের মেয়ে ও সে লন্ডনের স্কুলটিচার। ইস্ট লন্ডনে তাদের পাঁচ বেডরুমের তিনতলা বাড়ি। এখানে বহুপদের বাংলাদেশী রান্না খাবার খাই। এসবের মাঝে শিম বীজ ভাজি ও জলপাইয়ের খাট্টাও রয়েছে। 

এইবাসা হতে বের হয়ে লবিদের অনুজ ভাগনা হুদহুদের দক্ষিন লন্ডনের বাসায় যাই। এবাসায় ভিন্ন ভিন্ন স্বাধ ও গন্ধ বিশিষ্ট কয়েকধরনের পানীয়তে একটু একটু করে চুমুক দেই। পানীয়গুলোর নাম 1. Tonik Water 2. Lima Cardian 3. Soda Water 4. Ginger Ale 5. Bitter Lemon 6. Lemonade 7. Sparkling Sampaine 8. Diet Cooke

এসব পানীয় সরোবরের মধ্যে Sparkling Sampaine হচ্ছে এক ধরনের হালাল মদ। এতে কোন এলকোহল নেই, তাই নেশা হয়না। অথচ এতে শতভাগ মদের স্বাধ ও ফ্লেবার রয়েছে। এসব উন্নত দেশে এত এত প্রকার পানীয় তৈরী হয় যে আমাদের মত গরীব দেশের লোকজন তার খবরও জানেনা। জীবনে এই প্রথম হালাল মদে চুমুক মেরে আসল মদের স্বাধ ও গন্ধ গ্রহন করি। হুদহুদের সুন্দর বাসার মালিক একজন নিঃসঙ্গ বৃদ্ধ। তার বাড়ি শ্রীরামশি, জগন্নাথপুর। বললেন ১৯৭১ সালে পাকবাহিনীর হাতে তার গ্রামের অনেক লোক শহীদ হন। তিনি তখন লন্ডনে থাকায় বেঁচে যান। তার জীবন ট্রাজেডিতে ভরা। এক সময় স্ত্রী ও পুত্রকন্যা নিয়ে তার সুখের সংসার ছিল। অকালে স্ত্রী-পূত্র-কন্যা সব হারিয়ে আজ তিনি একা। তার প্রচুর ধনসম্পদ আছে কিন্তু কোন বংশধর নেই। তার সঙ্গী বলতে আমার ভাগনা ও ভাগনা বউ। ভাগনা বউ হাউজিং এস্টেটের জুলকারনাইন খন্দকারের একমাত্র কন্যা। তাদের ফুটফুটে এক দুগ্ধধবল কন্যা হামাগুড়ি দেয়, হাসে ও কথাবলার চেষ্টা করে।


নিঃসঙ্গ বৃদ্ধ বাসাভাড়া পান চার হাজার পাউন্ড। বার্ধক্যভাতা যা পান তাই খরচ হয়না। তার কেবল টাকা জমানোর অভ্যাস। তবে দেশে তিনি তিন চারটি মসজিদ নির্মান করে পরকালের জন্য কিছুটা সঞ্চয় জমা করে রেখেছেন।

আমি ইংরেজদের ভদ্রতা ও সৌজন্যের প্রশংসা করি। তাদের রাগ নেই, মস্তিস্ক ঠান্ডা রেখে কাজ করে। আমার প্রশংসাবানী শুনে হুদহুদ কিছুটা কটাক্ষ্য করে বলল, রাগবে কেন, এরাতো Brooker জাতি, দালালী করে খায়। অভদ্রতা দেখালে কিংবা চটে গেলে অন্যকে ঠকায়ে পকেট ভারী করা কি সম্ভব।

লন্ডন হতে ফেরার প্রক্ষালেঃ

০৬ জুলাই ২০১৭ সাল। লন্ডনের এক উজ্জ্বল সামার মর্নিং। জ্যৈষ্ঠ ভাই তাহমিদ চৌধুরীর বাসার পিছনের বাগানে নানা ধরনের ফুল ফুটে আছে। সবগুলো বাসার বাগান মিলে পিছনে এক নয়নাভিরাম কুসুমবাগ  তৈরি হয়েছে। সীমানার বাহিরের বড়গাছ জুড়ে থোকা থোকা সাদা ফুল। সামারের এলোমেলো বাতাসের ধাক্কায় নিচে ঝরে ঝরে পড়ে মেঝের উপর পুস্প আস্তরণ তৈরি করছে। এই আস্তরণ প্রতিদিন ঝাড়ু দিয়ে পরিস্কার করতে হয়। এত কুসুম দেখে মাকে মনে পড়ে গেল, তিনি ফুল খুব ভালবাসতেন। তিনি আজ নেই, বেঁচে থাকলে নিশ্চয় আমাদের সফরসঙ্গী হতেন। এই পুস্পমেলা দেখে অবশ্যই আনন্দ পেতেন। সকালে বিমভেলী খরগোস বনে নিয়ম মাফিক একঘন্টা আমরা তিনজন প্রাতঃভ্রমন করি। জগিং করে ঘেমে বাসায় ফিরে গরমজলে গোসল করি। তারপর কেলগেরী জুস পান করে কিনাট, চকলেট এবং হোজলনাট খেয়ে ঘুমিয়ে যাই। ঘুম ভেঙে গেলে মজাদার দেশী মুড়ির মোয়া খাই। আজকে সিদ্দিক, জাহিদ, নিপা, আফজল ও বাদশা ভাই সহ অনেক আত্মীয় এসে একে একে আমাদেরকে বিদায় জানান।


০৭ জুলাই ২০১৭ সাল, শুক্রবার। ঐদিন সকালে আজফার ও নওসিন ভোরে এসে আমরা দুজনকে সালাম করে অফিসে চলে যায়। আজ চলে যাবো, তাই তাদের সাথে আর দেখা হবেনা। গতরাত ভাই ও ভারী আমাদের সুটকেস গোছগাছ ও বাঁধাবাঁধি করে দেন। তাই আমাদের কোন দুশ্চিন্তা করতে হয়নি।

স্বপ্নের শহর লন্ডন। অনেক অনেক গল্প কথার রঙ্গীন শহর এই লন্ডন। ১৯৯১ সালে এই শহরের একটি কলেজে ভর্তি হয়েও স্পন্সরের দুর্বলতায় ভিসা পাইনি। অনেক আত্মীয়স্বজন, পাড়া-পড়শী ও বন্ধু-বান্ধবের জীবন ও জীবিকার এই শহরটি আল্লাহপাকের মেহেরবানীতে প্রানভরে দেখলাম। এই মহানগরীর আভ্যন্তরীণ সৌন্দর্য্য ও জ্ঞানের আলোকরশ্মির উজ্জ্বল জ্যোতি দেখে বিমুগ্ধ হলাম।

বিশ্ব সভ্যতার অগ্রযাত্রায় এই শহরের অবদান বিস্ময়কর। অসংখ্য ইতিহাসখ্যাত বিজ্ঞানী, গবেষক, উদ্ভাবক, কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক ও জ্ঞানী গুনী মানুষের চর্চা ও চারণভূমি এই লন্ডন। এই লন্ডনের জ্ঞান সমুদ্রের সৃষ্টি বৈজ্ঞানিক নিউটন, উদ্ভাবক জেমসওয়াট, কার্লমার্কস, কবি শেক্সপিয়ার, চার্লস ডারউইন, স্টিফেন হকিং, জন লক, বারটান্ড রাসেলের মত ইতিহাস ও সভ্যতার গতি পরিবর্তনকারী মনিষীবৃন্দ। এই লন্ডন গনতন্ত্র, মুক্তচিন্তা ও জ্ঞানবিজ্ঞানের এক সুপ্রাচীন সুতিকাগার। এশহরের এই জ্ঞান ঐতিহ্যের ধারা আজও বহমান। ভাই তাহমিদ চৌধুরী ও আফজল মালামাল হিথ্রোর বেল্টে তুলে দিয়ে বিদায় নেন। লন্ডন বিকেল ৩টায় যাত্রা সুরু করে পরদিন সকাল বেলা সিলেট বিমান বন্দরে অবতরণ করি।


দেশে ফিরলাম। তবে লন্ডনকে মনে পড়ে, লন্ডনকে কি সহজে ভুলা যায়। গ্রেট বৃটেন, যে দেশটির বিশ্বে টিকে থাকার সক্ষমতা অন্যান্য ইউরোপীয় জাতির চেয়ে অনেক বেশী। খৃস্টপূর্ব ৫৫ সালে রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার দেশটি দখল করে নেন। ৪১০ খৃস্টাব্দে রোমান শাসনের অবসান হলে আর কোন শক্তি দেশটিকে পরাধীন করতে পারেনি। ষোড়শ শতাব্দীতে স্পেন যখন বিশ্বশক্তি তখন স্পেনের রানী ইসাবেলা ইংল্যান্ড দখলে স্প্যানিশ আর্মাডার ১৩০টি জাহাজ বহর প্রেরন করেন। ইংলিশ সেনাপতি নিলসনের হাতে ১৫৮৮ সালে স্প্যানিশ আর্মাডা বিদ্ধস্থ হয়। এই যুদ্ধজয়ের পর বৃটেন ইউরোপের শ্রেষ্ট নৌশক্তিতে পরিনত হয়।

ফরাসী সম্রাট নেপোলিয়ন সারাটা ইউরোপ পদানত করলেও বৃটেনকে বশে আনতে সক্ষম হননি। তিনি একজন তৃতীয় শ্রেনীর বৃটিশ সেনাপতি Gebhard L. Von এর হাতে ইউরোপ বিজয়ী সম্রাট নেপোলিয়ন ওয়াটারলুর যুদ্ধে ১৮১৫ সালে শোচনীয়ভাবে পরাজিত ও বন্দি হন।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলাকালে ইউরোপ দখলকারী এডলফ হিটলারের বিজয় রথ বৃটেনে এসে থেমে যায়। শত শত নাজি যুদ্ধবিমানের হামলা বৃটেনের মনোবল বিন্দুমাত্র টলাতে পারেনি। এই ছোট দেশটি এখনও যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও রাশিয়ার পর পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সামরিক শক্তি।

সুপ্রাচীন রাজতন্ত্র, মধ্যযুগের লর্ডতন্ত্র, ঐতিহ্যবাহী ও আধুনিক গনতন্ত্র সবকিছু একসাথে ধারন করে মাথা উঁচু করে দারিয়ে আছে আজকের বৃটেন। বৃটিশ রাজতন্ত্র সম্পর্কে একটি কথা প্রচলিত, একসময় পৃথিবীতে টিকে থাকবে কেবল দুইজন রাজা, এক- তাসের রানী এবং দুই- ইংল্যান্ডের রানী। দুই সাপ্তাহ এই গর্বিত ও সফল জাতির সাথে সহবস্থান করে অভিজ্ঞতার ঝুড়িকে সামান্য হলেও সমৃদ্ধ করলাম। স্মৃতিময় বৃটেন, তোমাকে আমরা ভূলবনা কোনদিন। গ্রেট, গ্রেট, গ্রেট বৃটেন।(সমাপ্ত)


 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন