মঙ্গলবার, ১১ আগস্ট, ২০২০

তৃতীয়বার যুক্তরাষ্ট্র যাত্রা- সাউথ ক্যারোলিনা, ইংল্যান্ড ও ওয়েলস সফর পর্ব- ছয়

 




তৃতীয়বার যুক্তরাষ্ট্র যাত্রা- 
সাউথ ক্যারোলিনা, ইংল্যান্ড ও ওয়েলস সফর    পর্ব- ছয়

ইস্ট লন্ডন পরিদর্শনঃ

৩০ জুন ২০১৭ সাল। পবিত্র শুক্রবার। ভাগ্নি পপির বাসায় সকালের নাস্তা শেষ হতেই বড়ভাই তাহমিদ চৌধুরী এসে হাজির হন। আমরা ভাইয়ের গাড়িতে করে ইস্ট লন্ডন চলে আসি। আজ ইস্টলন্ডন বাংলাদেশীদের বড় মসজিদে জুমুয়ার নামাজ পড়ার সিন্ধান্ত নেই। ড্রাগেনহাম ইস্ট স্টেশনে গিয়ে ভূতল ট্রেন ধরি। ইস্ট লন্ডন জামে মসজিদের সিন্নিকটে White Chapal স্টেশনে নামি। ভূতল স্টেশন হতে বের হয়েই উপরে বাংলা টাউন। কিছুদূর হেঁটে যাবার পরই The East London mosque লিখা সাইনবোর্ড ও মসজিদ গম্বুজ চোখে পড়ে। টুপী পরা বাংলাদেশী মুসল্লীরা দলে দলে মসজিদে ঢূকছেন। উপরের সবতলা লোকে লোকারন্য, ফাঁকা জায়গা নেই। তাই কোনমতে ভূতল মেঝে ঢুকলাম। পূর্ব পরিকল্পনায় এখানে বন্ধু সিদ্দিকুর রহমান নির্ঝরের সাথে দেখা হয়।  

      

মসজিদে আরবীতে খুতবা পড়া হয়। তারপর এই খুতবা প্রথমে বাংলা ও পরে ইংরেজীতে অনুবাদ করে পাঠ করা হয়। সুন্দর খুতবা পড়েন খতিব শেখ আব্দুল কাইয়ুম। খতিব বাংলাদেশের নোয়াখালী জেলার বাসিন্দা। তিনি গভীর ধর্মীয় জ্ঞান সম্পন্ন বাগ্মী আলেম। খুতবার বিষয়বস্তু খুবই সাধারন অথচ জরুরী একটি বিষয় যে, পশ্চিমা বিশ্বে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যেসব অপপ্রচার ও প্রপাগান্ডা চলছে সেগুলো নির্দেশ করে তার প্রতিকার ব্যবস্থা। ঈমাম সাহেব মুসলমানদেরকে প্রতিটি অপকর্মের জবাব ভাল ব্যবহার ও সুকর্মের মাধ্যমে দিতে উদ্ভুদ্ধ করেন। শান্তি বিঘ্নিত হয় এমন কোন কাজ কোন মুসলিম করতে পারেনা। ইতিমধ্যে কিছু দুবৃত্ত জঙ্গী লন্ডনের রাস্থায় কিছু নিরীহ লোকজনকে কোপিয়ে হত্যা করে। এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় দুচার জায়গায় মুসলমানরা এসিড হামলার শিকার হন। ঈমাম ধর্য্যধারন ও বৃটিশ আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে মুসল্লীদেরকে উপদেশ দেন।

মসজিদটির সবকটি তলায় কয়েক সহস্র মানুষ নামাজ আদায় করতে পারেন। এখানে মক্কা ও মদীনা মসজিদের নিয়মে নামাজ ও খুতবা পরিচালিত হয়। মসজিদটি সিলেটিরা প্রতিষ্টা করেন এবং কমিটি সিলেটিদের দখলে রয়েছে। লন্ডনে পরলোক গমনকারী সিলেটিদের জানাজাও সাধারণতঃ এই মসজিদে সম্পন্ন হয়। বাদ জুমুয়ায় আমরাও একজন অজ্ঞাত স্বদেশীর জানাজায় শরীক হই।


ইস্ট লন্ডন সিলেটি অধ্যুষিত এলাকা। এখানে বাংলাটাউনের অবস্থান। দোকানপাঠ, ব্যবসা-বানিজ্য, বাসা-বাড়ি সবই সিলেটিদের দখলে। এখানে রাস্থার দুপাশে অসংখ্য ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট বাংলাদেশী লোকজন পরিচালনা করেন। হোটেলগুলোর নামও ভারতীয়, যেমন হোটেল তাজ, হোটেল দিল্লী, হোটেল হিন্দুস্থান ইত্যাদি। আসলে এই হোটেলগুলোর মালিক বাংলাদেশী, ব্যবসার কৌশল হিসাবে এইসব ভারতীয় নামের ব্যবহার করা হয় মাত্র।

১৯৭০ সাল হতে ১৯৮৬ সালের মধ্যে ইহুদি অধ্যুষিত এই এলাকাটি সিলেটিদের হস্থগত হয়। বাংলাটাউনের রাস্থা সিলেটি ভাষা ও সিলেটি লোকজনের কোলাহলে সর্বদা মুখরিত থাকে। এখানে দোকান সমূহের সাইনবোর্ড বাংলা ও ইংরেজী হরফে লিখা রয়েছে। এখানে হাঁটার সময় মনে হয়েছে আমি বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলে হাঁটছি। ক্ষনিকের ভ্রান্তি যখন ভেঙে যায় তখন মনে পড়ে এটাতো উন্নত দেশ বৃটেন, তৃতীয় বিশ্বের কোন মফশ্বল শহর নয়।

মসজিদের প্রচন্ড মুসল্লী ভীড়ে গাদাগাদি দাঁড়িয়ে জুমুয়ার নামাজ আদায় করে আমি বন্ধু সিদ্দিকের হাত ধরে বাংলাটাউনের রাস্থায় নেমে আসি। জেফার ও অন্যরা বাসায় চলে যান। আমি জড়াজড়ি করে রাস্থায় হাঁটতে চাইলে সিদ্দিক বাঁধা দেয়। আমি কারন জানতে চাইলে সে বলল এদেশে অসংখ্য সমকামী পুরুষ (Gay) ও সমকামী নারী (Lesbian) রয়েছেন। এভাবে হাত ধরে হাঁটলে লোকে আমাদেরকে Gay ভাববে। বুঝলাম, এসব উন্নত দেশগুলো নষ্টামিতে ভরা। আমাদের দেশ দরিদ্র হলেও এসব নষ্টামি হতে পবিত্র রয়েছে। কিছুদূর গিয়ে নির্ঝর বলল- আমি একজনের সাথে বক্ষ মিলাবো। একটি বনাজি ঔষধের দোকানে ঢুকে হাত বাড়াতেই একজন শীর্নতনু শ্বেতাঙ্গ বেরিয়ে এসে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে কোলাকুলি করেন। জিন্সপ্যান্ট ও লাল গ্যাঞ্জী পরা লোকটা পুরুষ, নাকি নারী বুঝার কোন উপায় নেই। তাকে যে কোন জেন্ডারে ঢূকিয়ে দেয়া যাবে। বক্ষ সমতল অথচ মসৃন মুখশ্রী বিশিষ্ট লোকটা যে একজন নারী তা অনেকক্ষন পর বুঝতে পারি।

ইস্ট লন্ডনের রাস্থায় হাঁটার সময় অসংখ্য সিলেটি ভাইসাবের দেখা পাই যারা সিদ্দিকের পরিচিত আপনজন। সবাই দৌড়ে এসে তাকে সালাম দেন ও বুক মেলান। সাথে আমিও বাদ নই। এখানে কয়েকজন সাংবাদিকের দেখা পেলাম যারা আমাকে নিয়ে প্রেস কনফারেন্স করার আমন্ত্রন জানান। ইস্টলন্ডনে বাংলা প্রেসক্লাব রয়েছে। এখানে দেশবার্তা, টেমস-সুরমা সহ যে সব ক্ষুদে পত্র-পত্রিকা আছে এগুলোর সাংবাদিকরা সমবেত হন।

আমি দশ বারটি বইয়ের লেখক হিসাবে তাদের দৃষ্টিতে প্রেস কনফারেন্সের জন্য একজন উপযুক্ত ব্যাক্তি। এখানে বাংলাদেশ হতে আগত ভূইফুড় নেতা, লেখক, কবি, শিল্পীরা প্রেস কনফারেন্সে এসে সাক্ষাতকার দেন। স্থানীয় পত্রিকাগুলোয় তাদের সচিত্র খবর প্রকাশিত হয়। আমার হাতে সময় নেই, তাই প্রেস কনফারেন্সের আমন্ত্রন ফিরিয়ে দেই। এবার ইস্ট লন্ডনের আফতাব আলী পার্কে এসে বসি। এই আফতাব আলী একজন বিশ্বনাথী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে। সবেমাত্র সিলেটিরা লন্ডনে আসতে শুরু করেছেন। তখন বর্নবাদ ছিল তীব্র। বর্নবাদীদের হামলার ভয়ে এসব সিলেটিরা দলবেঁধে ঘুরাফেরা করতেন। কোন এশিয়ানকে একাকি পেলে উগ্র বর্নবাদীরা হামলা করত। প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে এই উগ্র বর্নবাদীদের উপর্যুপরি ছুরিকাঘাতে আফতাব আলী এখানে শহীদ হন। এই আফতাব আলী পার্কের চারপাশে আজকের বাংলাটাউন।

প্রাথমিক যুগের সিলেটিরা তেমন শিক্ষিত ছিলেন না। আধুনিক উচ্চ শিক্ষিত ইংলিশ সমাজ ও সংস্কৃতির সাথে খাপ খাওয়াতে তাদের বেশ কষ্ট হয়। এই হাইটেক সমাজ ও নগর কাঠামোতে তারা তেমন মানানসই ছিলেন না। একই ধরনের বাসাবাড়ি ও পাড়ামহল্লায় বসবাসে তারা অনভ্যস্থ ছিলেন। বাসা হারানোর ভয়ে তারা বাসার সামনে ইট পাতর রেখে দিত কিংবা দাগ কেটে চিহ্ন তৈরি করতেন বলে শুনা যায়। স্মারক বস্তু কিংবা চিহ্ন হেরে গেলে বাসার খোঁজে তারা গলদ  ঘর্ম হতেন। আশপাশের শ্বেতাংদেরকে না ইশারায় না কথাবার্তায় তারা বুঝাতে পারতেন আবাস হারিয়ে ফেলেছি। কালিবডিয়ান সড়কে তারা সরকারী স্নানাগারে দলবেঁধে গোসল করতেন। উচ্চারন করতে না পেরে তারা সড়কটির নাম কালাপানি রোডে পরিনত করেন। ইংরেজরাও বিভিন্ন দেশে এভাবে উচ্চারন করতে না পেরে অনেক নাম নিজেদের মত করে বদলে দিতেন। যেমন তারা চট্টগ্রামকে চিটাগাং এবং কোলকাতাকে ক্যালকাট্টায় চেন্নাইকে মাদ্রাজে পরিনত করেন। সভ্য ইংরেজরা যখন একাজ করেছে, তখন বলেন তো আমাদের অভিবাসীদের দুষ কিসে? জানালা দিয়ে বৃদ্ধ বাঙ্গালী মহিলা যখন পানের পিক ফেলতেন, তখন রক্তবমি করছে মনে করে ছুটে আসত আম্বুল্যান্স। বাসার লোকজনের আম্বুল্যান্স উচ্চারন করা ছিল কঠিন কাজ। তারা আম্বুল্যান্সকে নিজের মত একটি নাম দেয় আলী হোসেন’। আম্বুল্যান্সের ইংলিশরা যখন জানলেন এটা রক্তবমি নয়, এক ধরনের খাবার, তখনই আলী হুসেনকে নিয়ে চিকিৎসক প্রস্থান করেন। বর্তমান লন্ডন-প্রবাসী বাংলাদেশী ও তাদের বংশধরগন আজ আর সেই অবস্থায় নেই। এই ধরনের মিথ বা কাহিনী এখন অচল। বর্তমান সিলেটিদের সম্পর্কে এধরনের হাস্যকর মিথ আর সাজেনা। তারা এখন লন্ডনের যথেষ্ট স্মার্ট ও চলনসই এশিয়ান জনগুষ্টি। তারা বৃটেনে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করছেন। বাংলাদেশকে পৃথিবীর দরবারে তুলে ধরছেন।

সিদ্দিকের ছোট্ট পরিপাটি বাসায় ঢূকে তার জার্মান পত্নী ইভাঙ্কা জেজেগকে পালঙ্কে ঘুমন্ত পাই। এক সময় তিনি ছিলেন পরমা সুন্দরী। একেবারে গোলাপফুলের রঙ্গ মাখা তনু। এই শ্বেতাঙ্গিনী সুন্দরীকে দেখে আশপাশের বাঙ্গালরা ঈর্ষানুভব করতো এবং কাচা ভাষায় বলতো- ছোট খাট সিদ্দিক মিয়া এমন মাল লাগাইলা কেমনে। এই সাদা পরী তোমার ঘরে টিকবেনা বেশী দিন। অথচ এই রমণী আজ কন্যা সাকিবা ও পুত্র ইব্রাহিম ইশরাকের জননী। সগৌরবে পার করে দেয়েছেন পনের ষোল বছর। তিনি বেশ দয়ালু মহানুভব মহিলা। দুচারটা বাংলা বলার চেষ্টা করেন। কন্যা সাকিবা খুব চালাক, তাকে বাঙ্গালী মেয়ে মনে হয়। ছেলে ইব্রাহিম উল্টো, দুধে আলতা মেশানো রঙের এই শিশুটি যেন একজন বিদেশী শ্বেতাঙ্গের প্রতিরূপ। ইভাঙ্কা ভাবী এখন বেশ মোঠা হয়ে গেছেন। দশ বছর আগের রূপ যৌবনে এখন ভাটা পড়েছে।


এবার ইভাঙ্কা ভাবী আমাকে নিয়ে সপরিবারে চললেন বনভোজনে। শিশু ইব্রাহীমকে দোলনাগাড়িতে বসিয়ে হেঁটে হেঁটে আসি বড় রাস্থায়। এবার একটি দুতলা বাসে চেপে অনেক দূরে ইভাঙ্কা ভাবীর জার্মান বান্ধবীর বাসায়। ছয়তলা বাসার বাসার পাচতলার একটি ফ্ল্যাটে থাকেন ইভাঙ্কা ভাবীর স্বদেশী বান্ধবী ও তার বাংলাদেশী স্বামী কুষ্টিয়া জেলার হারুন ভাই। হারূন ভাই লন্ডনে পড়তে এসে এই জার্মান শ্বেতাঙ্গিনীর প্রেমে পড়েন, যা পড়ে বিয়েতে গড়ায়। তাদের মিশ্রজাতের দুই সুন্দর পুত্র-কন্যা রয়েছে। বাসার পিছনের সুন্দর বাগানে যাই। বেশ বড় বাগান, বাচ্চাদের খেলার জন্য অবারিত জায়গা। বাগানে ডিজাইন করে নানা জাতের কুসুম বীথি লাগানো। চারপাশে নানা জাতের কুসুমের মধু হাসি। হারুন ভাই তার গিন্নীকে নিয়ে খোলা আকাশের নিচে বারবিকিউ রান্না করছেন। কড়কড়ে মোরগের রোষ্ট, সরষে বাটা, নানরুটি, কড়া পানীয়, সবজি, সবমিলে এক ভূরিভোজের আয়োজন। চুল্লীর ধুয়া উড়ছে। কাবারের মজাদার খুশবো বাগানে ভেসে বেড়াচ্ছে। রাতের আগমনের পূর্বে অতি ধীরলয়ে দুই/তিন ঘন্টা রান্না ও খাওয়া দাওয়া চলল। পার্কের পাকা বেঞ্চে বসে ফুলের কুঞ্জে কুঞ্জে আড়ালে আবডালে বসে বসে গল্প করে সুদীর্ঘ্য বিকেলটা আনন্দে হারিয়ে গেল। মান্নাদের প্রিয় গান্টা মনে পড়লো- কোথায় হারিয়ে গেল সোনালী বিকেলগুলো এই, আজ আর নেই’।

যুক্তরাজ্যের বাচ্চাগুলো শান্তশিষ্ট, আমাদের শিশুদের মত এত দুষ্ট নয়। তারা ময়লা যেখানে সেখানে ফেলেনা, ডাস্টবিনে নিয়ে যায়। গাছের কোন ফুল বা পাতা ছিড়ে না। এরা একে অন্যে মারামারি করতেও জানেনা। এতগুলো বাচ্চা খেলাধুলা করছে কিন্তু কোন চেচামেচি নেই, হৈ চৈ নেই। চারপাশ শান্ত ও নিস্থব্ধ। ভান করা, মিথ্যাচার কিছুই এই বাচ্চাদেরকে স্পর্শ করতে পারেনা। পার্কের চেয়ারে কুসুমের কুঞ্জবনে বসে অনেক গল্প করি। বছরের পর বছরের জমানো গল্প।

সিদ্দিকের কাছে তার শ্বশুর-বাড়ি জার্মানী সফরের কাহিনী মনযোগ দিয়ে শুনি। সেই কাহিনীতে জার্মান সংস্কৃতি সম্পর্কে বেশ জানা হয়। একবার সে তার শ্বশুরবাড়ি জার্মানীর রাইনল্যান্ডে যায়। অপরূপ সুন্দর নদী রাইনের নামে প্রদেশটির নাম রাইনল্যান্ড। বড় বাড়ি, ছবির মত সুন্দর দেশ। আমাদের দেশে শ্বাশুর ও মেয়ে জামাইয়ের মধ্যকার সম্পর্ক পিতা-পুত্রের মত কিন্তু জার্মানীতে এই সম্পর্ক বন্ধু সম্পর্ক’। এখানে শ্বাশুড় ও শ্বাশুড়ি মেয়ে জামাইয়ের সাথে হাসিটাট্টা করেন। অনুরূপ শ্বাশুড়িও জননীর মত নন, যেন একজন বয়ঃজৈষ্ট্যা বান্ধবী।

সিদ্দিকের জার্মান শ্বশুর উঁচু ও বেশ মোঠা তনুর লোক। সেই তুলনায় সে বেঁটে ও চিকন। শ্বশুর মহাশয় কৌতুক করে বাচ্চা কোলে নেওয়ার মত তাকে কূলে তুলে নেন। শ্বাশুড়ী ও খালা শ্বাশুড়িরা বাড়ির গরম জলের সুইমিংপুলে আনন্দ গোসল করছেন। মেয়ে জামাইকে শ্বাশুড়িরা তাদের সাথে আনন্দ স্নানে শরীক হবার আমন্ত্রন জানান। শ্বশুর-শ্বাশুড়ী-খালা শ্বাশুড়ি, মেয়ে ও মেয়ে জামাই সবাই মিলে সুমিংপুলের মৃদু উষ্ণ পরিস্কার জলে একসাথে আনন্দ গোসল, সাতার-কাটা ও জলকেলিতে মত্ত হন। এটাই জার্মান সংস্কৃতি। প্রতি তিন চার মাস পরপর জার্মানী হতে লন্ডনে সিদ্দিকের ঘরে কাপড়, খেলনা ইত্যাদি উপহার আসে।

সময় শেষ কিন্তু আমাদের গল্পের শেষ নেই। বিকেলটা ফুরিয়ে গেল। এবার চললাম হারুন ভাইয়ের পাচতলা ফ্ল্যাটে। এখানে খোলা বারান্দার টেবিলে আসে দৈ, কফি ও মিষ্টি। ঝুলন্ত ফ্লাওয়ার বক্স ও আর্কিড সজ্জিত সবুজ বারান্দায় মিষ্টি রোদেলা বিকেল শেষ হল। জার্মান হোস্টভাবী হালকা-পাতলা শ্বেতাঙ্গিনী। দেখতে তরুনী ও সুন্দরী, যদিও দুইজন সাদা বালক বালিকার জননী। জার্মান হোস্টভাবী ও হারুনভাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে নামিয়ে আসি। হয়ত এটাই চিরবিদায় যদি স্রস্টার অপার মহিমায় আবার না আসি এবাসায়। নিচে কার নিয়ে বড়ভাই হাজির। এবার ছুটলাম লন্ডনে আমাদের স্থায়ী ঠিকানা ড্যাগেনহাম ইস্ট।          ১লা জুলাই ২০১৭ শনিবার। মর্নিংওয়ার্কে বের হয়ে ভীমভ্যালি কান্ট্রি পার্কে ঢুকি। পার্কের সীমান্ত বের করার জন্য দৌঁড়াতে থাকি। দুপাশে প্রাকৃতিক বন-বনানী, ফল-ফুলের বর্ণিল সমাহার। এই বন পার হয়ে অপূর্ব সুন্দর সমতল পাহাড়ে যাই। দুই পাহাড়ের মধ্যভাগে নিচু উপত্যকা দিয়ে একটি সুন্দর ছোট নদী বহমান। জল স্বচ্ছ ও দুপারে কাশফুল-শনফুলে একাকার হয়ে আছে। নদীর উপর কাঠের সেতু পার হয়ে সমতল পাহাড়ের মধ্যভাগ দিয়ে পীচঢালা রাস্তা বরাবর হাঁটি। দুপাশের সুবিশাল মাঠ জুড়ে কাশবন। নাম না জানা বৃক্ষসারি। এযেন সিলেটের টিলার উপত্যকা ও ঝর্ণা। টিলার নিচের শান্ত জলাশয়। এখানে বড় বড় কাকের পাল ও নাম না জানা পাখির দেখা পাই। পাঁচ ছয়টি খরগোস ঘাস খাচ্ছে। কিছু খরগোস আমাকে দেখে ঝোপ ঝাড়ের আড়ালে লুকিয়ে যায়। শিরশির বাতাস ও বৃক্ষপত্রের ছন্দময় পট্ পট্ আওয়াজ বাংলাদেশের বসন্তকালের চা বাগানের ছায়াবৃক্ষের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।(চলবে)


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন