বৃহস্পতিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২০

দ্বিতীয়বার যুক্তরাষ্ট্র যাত্রা- মাস্যাসুসেট, মিশিগান এবং ক্যানাডা সফরপর্ব- উনিশ

 


দ্বিতীয়বার যুক্তরাষ্ট্র যাত্রা- মাস্যাসুসেট
, মিশিগান এবং ক্যানাডা সফরপর্ব- উনিশ

নায়েগ্রা ফলস পরিদর্শনঃ
১৬ জুলাই ২০১৬ সাল। দিনটি স্মরণীয় কারন এদিন জীবনে দেখা সেরা সুন্দর নায়াগ্রা আমাদের দেখা হয়। টরেন্টো হতে মাত্র দুই ঘণ্টায় কানাডার পর্যটন শহর নায়াগ্রায় পৌছা যায়। দুই শহরের দুরত্ব প্রায় ২০০ কিলোমিটার। সকাল ১১ টায় রুহুলের সেভেন সিটের গাড়ি পূর্ন লোড হয়ে যাত্রা শুরু করি। বোন সেহা, ভাগনা, ভাগ্নি, ভাগনা বউ সবাই আনন্দ স্ফূর্তি করে ১ ঘটিকার সময় নায়াগ্রা শহরে প্রবেশ করি। হাজার হাজার পর্যটকের পদভারে মুখরিত রূপের রানী পর্যটন নগরী নায়াগ্রা। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা সীমান্তের পাঁচটি সুবিশাল লেকের একটি ইরি ও অন্যটি লেক অন্টারিও। বড় বড় চ্যানেল দিয়ে ইরি লেকে এসে অন্য তিন লেক সুপিরিয়র, মিশিগান ও হুরনের অথৈ জলরাশী জমা হয়। ইরি লেক উচ্চভূমিতে এবং অন্টারিও লেক চারপাচ শত ফুট নিম্নভূমিতে অবস্থিত। ইরি লেকে জমা হওয়া বিশাল জলরাশীর প্রবল তোড় প্রচন্ড বেগে উপচে পড়ে নায়াগ্রা নদী সৃষ্টি করে এবং এই নদী দিয়ে অন্টারিও লেকে বয়ে যায়। এই জলরাশির শেষ গন্তব্য লাব্রাডা প্রনালী হয়ে আটলান্টিক মহাসাগর। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার সীমান্তরেখা নায়াগ্রা নদী। এই সুন্দর টলটলে নদীর পূর্বপার যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমপার ক্যানাডা। নায়াগ্রা জলপ্রপাতের সিংহভাগ অংশ ক্যানাডায় অবস্থিত, তাই নায়াগ্রাকে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে ক্যানাডা হতেই ভালভাবে উপভোগ করা যায়।
নায়াগ্রার দুইটি অংশ, প্রথমাংশে যুক্তরাষ্ট্র হতে চারপাচ শত ফুট প্রশস্থ একটি নদী সরলপথে এসে অনেক উপর থেকে নায়াগ্রা নদীতে উপচে পড়ছে। এই জলপ্রপাত হতে দুই ফার্লং দূরে  মূল নায়াগ্রা জলপ্রপাতের অবস্থান। বাংলাদেশের আয়তনের কয়েকগুণ বড় চারটি সমুদ্রসম লেকের কোটি কোটি টন পানি আমাদের এম সি কলেজ মাটের মত আয়তনের বৃত্তাকার ক্ষেত্র রচনা করে ভয়ঙ্কর তর্জন গর্জন করে চার পাঁচ শত ফুট নিচে নেমে একটি নদীর জন্ম দেয়। এই নদীটিই পৃথিবী বিখ্যাত নায়াগ্রা নদী। এখানে জলের সাথে জলের প্রচন্ড সংঘর্ষে জলকনা কুন্ডলী তৈরী করে উড়ে যায় আকাশে। এই জলকনা উপরে মেঘমালা তৈরী করে নায়াগ্রার আকাশে সব সময় বিচরন করে। ভাসমান জলকনা ভিজিয়ে দেয় আশপাশের বৃক্ষ-লতা-ভুমি। তাইতো নায়াগ্রার উদ্যানমালা এত সতেজ, এত সজিব, এত সুন্দর। নায়াগ্রা নদীর জলকনায় ফোটে উঠে শত সহস্র রংধনু। রংধনুর সাতরং মানুষের চোখে বর্নচ্ছটার আলোক ধাঁধা লাগিয়ে দেয়। এ যেন একই সাথে, একই সময়ে, হাজার হাজার রংধনুর বিচিত্র রংখেলা।
এখানে জলের সাথে বাতাসেরও সংঘর্ষ হয়ে। ভাসমান জলকনার সুশীতল ঘুর্নীবায়ু শরীর-মন শিহরিত করে তুলে। এই প্রবল সংঘর্ষে জল ও বাতাস মিশে ধূয়াশায় রূপ নেয়। নায়াগ্রার অপরূপ বাগানে খোলা আকাশ তলায় বৃক্ষছায়ায় আমরা লান্স করি। লান্স শেষে নায়াগ্রার পারে পারে নায়াগ্রার অপরূপ রূপসুধা পান করে করে আমরা হেঁটে হেঁটে ওয়াটার-ক্রুজার স্টেশনে পৌছি। আমরা জাহাজে নায়াগ্রা জলপ্রপাতের নিচে যাবার জন্য রুহুল জনপ্রতি ২০ ডলার করে সাতটি টিকেট ক্রয় করে। আমার সহধর্মিনী ভয়ে জাহাজে উঠতে নারাজ। বোন সেহাও বহুবার এখানে এলেও জাহাজে চড়ার সাহস করেন নি। আমি ও রুহুল জুর করে তাদেরকে রাজি করাই। আমাদেরকে পানি-কাপড়ের লাল রেইনকোট পরানো হয়। লিফটে প্রায় দেড় দুই শত ফুট নিচে নেমে নায়েগ্রা নদীপারে জাহাজ ঘাট। আমরা তিনচার শত নানা জাত-বর্নের লোক লাইন ধরে জাহাজে আরোহন করি। এই ঘাট হতে দুইটি পর্যটন জাহাজ সারাদিন নায়াগ্রার নিচে আসা যাওয়া করে। লোকবুজাই দুতলা জাহাজটি নায়াগ্রা নদীর উজান বেয়ে ধীরে ধীরে নায়াগ্রা জলপ্রপাতের দিকে এগিয়ে যায়। আমরা যাচ্ছি এমসি কলেজের মাটের সম আয়তনের বৃত্তাকার ক্ষেত্রটির দিকে যেখানে নায়েগ্রা জলপ্রপাত নায়েগ্রা নদীকে প্রসব করেছে। জাহাজঘাট হতে এই স্থানটির দূরত্ব মাইল দেড়েকের কম হবেনা। 
নায়াগ্রা পাহাড়ি নদী, তাই নদীতে বইছে খরস্রোতা জল। তবে আমাদের মেঘনার মত প্রশস্ত এই নদীটি পুরোপুরী নাব্য। জাহাজ জলের স্রোতে উজান বেয়ে প্রথম নায়াগ্রা জলপ্রপাতের কাছে আসে। এখানে আমরা যুক্তরাষ্ট্র হতে ছুটে আসা বর্ষার সুরমার আকারের মত একটি গর্জনশীল নদীকে তিনশত ফুট উপর হতে নায়াগ্রা নদীতে লাফিয়ে নামতে দেখি। রেটল স্নেইক অন্য প্রজাতির জীবন্ত সাপকে মাথার দিক হতে গিলে ধীরে ধীরে খেয়ে ফেলে। আমার মনে হল নায়েগ্রা নদী এখানে সেই রেটল স্নেইকের মত যুক্তরাষ্ট্র হতে ছুটে আসা জীবন্ত নদীটাকে এভাবে গিলে খেয়ে ফেলছে। সাথে বিশাল এলাকা জুড়ে চলছে জলকনা ও বাতাসের হিল্লোল। এখানে এত বিশাল রংধনুর সাথে দেখা হয় যে, এটাই আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে বড় রংধনু। রংধনুটি জলপ্রপাতের একপ্রান্ত হতে মাইলখানেক উপরে উঠে এক বিশাল অর্ধবৃত্ত তৈরি করে নদীর অন্যদিকে নেমে এসেছে। বাংলাদেশের আকাশে বাদল দিনে অনেক রংধনু দেখেছি, কিন্তু নায়াগ্রার রংধনু সৌন্দর্য্য ও বিশালতায় তুলনাহীন।
আমাদের ওয়াটার ক্রোজার ঢেউ ঠেলে ঠেলে নায়াগ্রা ফলসের কাছাকাছি চলে আসে। নায়েগ্রা নদী তীর প্রাকৃতিক শিলায় গড়া। শিলার ফাঁকে ফাঁকে পাখির বাসা। শত শত সাদা ফ্যালিকন উড়াউড়ি করে নায়াগ্রার রূপ সুধা পান করছে। আমাদের জাহাজ নায়াগ্রা জলপ্রপাতের বৃত্তাকার পতনভূমির প্রবল তোড়ের দিকে আগায়। এই ঝড়বৃত্তে বড় কষ্টে উত্তাল ঢেউ ভেঙে ভেঙে তার বডি প্রবেশ করায়। প্রায় এক কিলোমিটার বৃত্তাকার পথে কোটি কোটি টন জলের তুড় দুনিয়া তোলপাড় করে দৈত্যের মত নিচে নামছে। জাহাজের চারপাশে ছন্দহীন উশৃংখল দৈত্যাকার পাগলা ঢেউয়ের বিরামহীন লাফালাফি। রূপালী জলরাশির ভয়ঙ্কর তর্জন গর্জন, প্রচন্ড ঘুর্নী বাতাসের সজল ঝাপটা ভিজিয়ে দেয় সারাটা জাহাজের বাহির ও ভিতর। চোখ জুড়ে শুধু ঝড়, বৃষ্টি, জল, কুয়াশা ও বাতাসের তান্ডব। আধো আলো আধো অন্ধকার জলকনার রাজ্য জুড়ে কেবল রংধনুর বর্নচ্ছোটা। নায়াগ্রার অপার সৌন্দর্য্যে সবার ভয়ভীতি পালিয়ে যায়। লোকজন ও বাচ্চারা নায়াগ্রার স্বর্গীয় রূপ দেখে বাহ্যজ্ঞান হারিয়ে চিৎকার করছে। আর আমি তখন স্মরণ করছি এই অপরূপ নায়াগ্রার স্রষ্টা বিশ্ব অধিপতি মহান আল্লাহকে, তার এই সৃষ্টি সত্যই অতুলনীয়। নায়াগ্রার এই সুন্দর চোখে দেখার, কানে শুনার, ত্বকে স্পর্শের এবং অতীন্দ্রিয় হৃদয় দিয়ে অনুভবের।
কুলাউড়ার হাজিপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও স্বভাব কবি আব্দুল কুদ্দুস চৌধুরীর কবিতায় নায়াগ্রার যে চিত্র ফুটে উঠেছে তা পাঠকের ভালই লাগবে-
ছেলেবেলায় পড়েছিলাম ভূগোল ইতিহাসে,
বৃহত্তম জলপ্রপাত ক্যানাডা নামের দেশে।
বুড়ো কালে দেখিলাম বিষ্মিত চোখ নিয়ে,
নায়াগ্রা জলপ্রপাতের অতি কাছে গিয়ে।
শুনিলাম নিজকানে পানির গর্জন,
শুন্যে ঝুলে রামধনু জুড়ায় নয়ন।
দৃশ্য ছবি, কবিতা কিংবা মুখে বলিলে,
বুঝিবেনা কোনকিছু নিজে না দেখিলে।
এমসি কলেজ মাটের সময়াতনের উপবৃত্তাকার নায়াগ্রার ক্ষেত্রটি এই গ্রহের এক অনন্য অপার্থিব স্থান। এযেন মর্তের পৃথিবীতে এক টুকরো বেহেশত। এইখানে যেন পৃথিবীর সিংহভাগ সুন্দর ও সব স্বর্গীয় আনন্দ লুকিয়ে রয়েছে।
জাহাজ হতে নামার পর রুহুল বলল, মামাকে নায়াগ্রার আর কিছু দেখাব যার খবর লোকেরা তেমন জানেনা। সেদিকে মানুষ খুব অল্পই যায়। সে দ্রুত গাড়ি ড্রাইভ করে আমাদেরকে নায়াগ্রা জলপ্রপাতের অনেক উজানে নিয়ে যায়। কয়েক মাইল জায়গা জুড়ে নায়াগ্রার দিকে ধাবমান পানির দৃশ্য নয়নকে সম্মোহন করে দেয়। এযেন চেঙ্গিস খানের ধাবমান বিশাল অজেয় অশ্বারোহী মোঙ্গর বাহিনী, যারা ধপাস ধপাস করে ঘোড়ার খুরের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ তুলে বিশ্ব জয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।
ফিরে এসে আমি ও জেফার পথের পাশে ভূতের বাড়িতে প্রবেশ করি। জেফার অন্ধকারে ভয় পেয়ে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। সামনে দুইজন চীনা নরনারী। একটি কবর ফুড় করে বেরিয়ে আসছে ভুতের হাত। আমাদের কানের কাছে তার নিঃশ্বাসের শব্দ টের পাচ্ছি। বেরুলেই জড়িয়ে ধরবে আমাদেরকে। আমরা ভয়ে শিহরিত। চীনা নরনারী ভয় পেয়ে তাদের মোবাইলের আলো জ্বেলে দিলো। তাদের করুনায় আমরা ভুতের আক্রমন ও ভয় হতে রক্ষা পাই।
নায়েগ্রা তীরে তীরে টিউলিপ উদ্যান। সারি সারি লাল, হলুদ, নীল, সাদা টিউলিপে বাগান ছেয়ে আছে। মাঝে মাঝে বসার গ্যালারী। শ্বেতাঙ্গ, কৃষ্ণাঙ্গ ও চীনা চোখ ধাঁধানো কয়েক জোড়া ময়ূর ময়ুরী। আমাদের দেশে পাঁচ তারকার উপর হোটেল নেই। এখানে সাত তারকা ম্যারিওট হোটেল, সাত তারকা শেরাটন হোটেল উঁচু পাহাড়ের উপর নায়াগ্রার কুয়াশার রাজ্যে যেন ঘুমিয়ে আছে। বিচিত্র তার-ট্রেনে চড়ে ঐ পাহাড়ে যেতে হয়। নায়াগ্রার জলকনায় সিক্ত সতেজ ফুলবাগ, বৃক্ষলতা, পাহাড় চূড়ার ওয়াচ টাওয়ার, পাহাড়ে ওঠার কাঁচের লিফট, ক্যাসিনো হাউস, এমিউজমেন্ট পার্ক, গার্ডেন, মার্কেট এবং সাত তারকা হোটেলের ছড়াছড়ি।
এই নায়াগ্রা এসে বুঝা যায় পাশ্চাত্য জীবনে যে কত আনন্দ, কত রঙ্গ। সামারের নায়াগ্রা জীবনের শত রঙ্গে যেন রঙ্গীন হয়ে উঠে। এবার আমরা নায়াগ্রা পারের স্কাই হুইলারে আরোহন করি। হুইলার থেমে থেমে উপরে উঠছে। হুইলার হতে নায়াগ্রার ওপারের যুক্তরাষ্ট্রের পর্যটন এলাকা দেখা যাচ্ছে। নীল রেইনকোট পরে নায়াগ্রা ফলসে যেতে আমেরিকানরা জাহাজে উঠছে। নায়াগ্রা নদীর আমেরিকা-পারে একটি ওয়াচ সেতু নদীর ভিতর এসে সমাপ্ত হয়েছে। সুদূরে নায়াগ্রা নদীর উপর ক্যানাডা- যুক্তরাষ্ট্রের সংযোগ সেতু দেখা যাচ্ছে। নায়াগ্রা জলপ্রপাতের উপর নায়াগ্রাসৃষ্ট মেঘমালায় পর্যটক নিয়ে কিছু হেলিকপ্টার ও ছোট্ট প্লেন আবর্তন করতে দেখি।
নায়াগ্রা নদী আমাদের ভৈরবের মেঘনার মত প্রশস্থ কিন্তু দুইদিকে সুউচ্চ শিলার গীরিমালা। ক্যানাডা-পারে আল্লাহ পাকের অপূর্ব সৃষ্টি নায়াগ্রা জলপ্রপাত ও সুন্দরের রানী নায়াগ্রা শহর। 
আমাদের চোখের সামনে সন্ধ্যা নেমে আসছে আনন্দ নগরী নায়াগ্রায়। রাতে নায়াগ্রা আরেক রূপ ধারন করে। হাজার হাজার নামী দামী গাড়ি নায়াগ্রা ছাড়ছে। রাতের নায়াগ্রা ফলসে কাছের পাহাড় হতে ফেলা সাতরঙের আলো খেলা করে। ঘুর্নায়মান বর্নিল আলোর বন্যায় নায়াগ্রা রঙ্গীন হয়ে উঠে। আলোর লাইন বরাবর যতদূর দৃষ্টি যায় কেবল নানা বর্নের জলকনা হীরা, মুক্তা ও সোনা দানার মত ঝলমল করে। রাতের নায়াগ্রাও সত্যই অপরূপ।
রাত কালো ও গভীর হচ্ছে। এবার ফেরার পালা। সারাদিনের মধুস্মৃতি ফেলে আসতে কষ্ট হয়। এই হয়ত নায়াগ্রার সাথে প্রথম ও শেষ দেখা। মনে মনে মধুকবির ভাষায় বললাম- হে প্রিয় নায়াগ্রা, আর কি হে হবে দেখা যতদিন যাবে।(চলবে)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন