দ্বিতীয়বার যুক্তরাষ্ট্র যাত্রা- মাস্যাসুসেট, মিশিগান এবং ক্যানাডা সফরপর্ব- আটার
কানাডার টেলিভিশনে একটি সংবাদ দেখে আমার
মনে বেশ দাগ কাটে। একজন মাকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাচ্ছে। মহিলার অপরাধ তিনি তার শিশুকে গাড়িতে লক করে
বাজার করতে গেছেন। রোদে গাড়ি গরম হলে শিশুটা কষ্ট পেয়ে কাঁদছে। পুলিশ গাড়ির লক
ভেঙে শিশুটাকে মুক্ত করে এবং মাকে এরেস্ট করে। একে বলে মায়ের চেয়ে মাসীর দরদ বেশী।
ক্যানাডায় শিশুদের আসল মালিক রাষ্ট্র, তারপর মায়ের
অবস্থান।
১৫ জুলাই ২০১৬ সাল। কাওসার ভাবীর বাসা
হতে ১৫ মিনিট হেঁটে আমি ও জেফার একটি পাহাড়ি পার্কে আরোহন করি। বিশাল সমতল পাহাড়ের
মধ্যভাগ ফুটবল মাঠ। মাটের চারপাশে জগিং করার আবর্ত পথ। এখানে একর একর জায়গা জুড়ে
ম্যাপল, তুঁত, উইলো, পাইন ও ঝাউ বন।
ঘাসে ঘাসে ছেয়ে আছে ঘাসফুল। পাহাড়ের ঢালু বেয়ে নিচ পর্যন্ত নাম না জানা ফুল আর
ফুল।
অর্ধ নগ্ন রূপসী দেবীরা বসে আছেন মাঠের
সবুজ গালিচায়, যেন স্বর্গের থাকিয়ায় ঠেস দিয়ে বসা সব
হুরপরী। ছায়া বৃক্ষে রোডের ঝিলিমিলি, বসন্ত বাতাস
ভাসিয়ে নিচ্ছে চারপাশ। স্বর্গ-পরীদের কোল জুড়ে বসে আছে ছোট পুতুল আকারের সুন্দর
সুন্দর তুলতুলে সব পোষা কুকুর।
ক্যানাডায় বাঙ্গালী বিয়েতে যোগদানঃ
শ্রীমতি নূরজাহান চৌধুরীর খালাতো ভাই
বেলায়েত চৌধুরীর কন্যা নুদরাতের আকদ হবে মসজিদে। জুমুয়ার নামাজ শেষে মসজিদের
মহিলাঙ্গনে কনেকে নিয়ে বেশ কয়েকজন বাঙ্গালী, পাকিস্তানী ও আরবী
মহিলা জমায়েত হন। মসজিদে বরকে নিয়ে আসেন তার আত্মীয়রা। বর একজন কোরান হাফিজ। সে
বর্তমানে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। কনের বয়স ১৯ ও বরের ২১/২২ বছর। আরবী
ড্রেসপরা বাঙ্গালী বর লম্বা ও ফর্সা। পর্দার ওপার হতে কনের বাপ-চাচা কনের এজিন
নিয়ে আসেন। কাজী সাহেব বরের সম্মতি গ্রহন করে বিয়ে সম্পন্ন করেন। ভিনদেশী
মুসল্লীরা মারহাবা মারহাবা বলে বরের সম্মতিকে স্বাগত জানান। ঈমাম সাহেব শরিয়াভিত্তিক
দাম্পত্য জীবন নিয়ে এক নাতিদীর্ঘ্য মূল্যবান বয়ান পেশ করেন। বয়ানের বিষয় হল ইসলাম
ধর্মানুসারে স্বামী ও স্ত্রীর দায়িত্ব, কর্তব্য ও অধিকার।
এই মসজিদে নব দম্পতিদের জন্য ইসলামী
দাম্পত্য জীবনের উপর প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা রয়েছে। মহিলা আলেমা কনেকে এবং পুরুষ
আলেম বরকে এই প্রশিক্ষন প্রদান করেন। বর ও কনেকে এধরনের প্রশিক্ষন দেয়া আমাদের
দেশেও প্রয়োজন বলে আমার মনে হল। আমাদের দেশে মহিলাদেরকে ধর্মীয় নেতৃত্ব হতে দূরে
সরিয়ে রাখা হয় এবং তাদেরকে মসজিদে ঢুকতে দেওয়া হয়না। ক্যানাডায় মুসলিম পুরুষ ও
মহিলা ধর্মীয় কার্যাবলীতে সম অংশগ্রহন ও সমানধিকার ভোগ করে থাকেন।
রাতে প্রীতিভোজের আয়োজন করা হয়। বর ও কনে
দু’পক্ষ মিলে একটি অনুষ্টান। বাদ মাগরিব বোনের ক্রিসেন্ট
পার্কের বাসা হতে দুইটি গাড়ি ভরে বের হই এবং টরেন্টোয় সিলেটিদের বহুল পরিচিত শামিম
কমিউনিটি সেন্টারে যাই। মসজিদে বিয়ে অনুষ্টানে আরবী পোষাক পরিহিত সেই বর সেন্টারে
এলেন পশ্চিমা ড্রেস স্যুট-কোট-টাই পরে। মসজিদের সেই আনস্মার্ট হুজুরমার্কা বরকে
এখন মনে হচ্ছে একজন লম্বা সুদর্শন অতিস্মার্ট ব্যাক্তিত্ব। দিনের হুজুর রাতে হয়ে
গেলেন বোম্বে ছবির একজন নায়ক সালমান খান।
শামিম সেন্টারের একতলা মাটির নিচে
অন্যতলা উপরে। নিচতলায় মহিলা ও উপরে পুরুষদের খাবার আয়োজন করা হয়। সেন্টারের সামনে
সুবিশাল গাড়ি পার্কিং। এদেশে গাড়ির গতি ঘন্টায় একশ মাইলের উপর, রয়েছে ঘরে ঘরে
প্রাইভেট গাড়ি। তাই দুই তিন শত মাইল দূর হতে এসে মেহমানরা বিয়ে খেয়ে মধ্যরাতের আগে
নিজ নিজ বাটি ফিরে যান। সে রাতের ডিনার দুই পর্বে সম্পন্ন হয়। বুফে খাবার
ব্যবস্থা। তিনচার জন ভারতীয় নারী ব্লাংকেটে গরম খাবার সাজিয়ে রাখেন। সবাই খাবার
নিজ নিজ টেবিলে নিয়ে যান।
প্রথম পর্বে ভেজিটেবুল রোল, বাটার চিকেন, সস এবং ড্রিঙ্কস।
দ্বিতীয় পর্বে পোলাও, নানপরোটা, মাংস, রোস্ট, সবজি, ডাল, চিংড়ি ও রসমালাই।
সবশেষে চা ও কফি পরিবেশন করা হয়। খাবার আইটেমে ও পরিবেশনে বাংলাদেশের চেয়ে অনেক
ভিন্নতা রয়েছে।
এই অনুষ্টানে কুলাউড়ার গাগটিয়া সাহেববাড়ির মামাতো বোন শোভার দেখা পাই। এক সময়ের ডাক সাইটে সুন্দরী কিশোরী শোভা এখন একজন শ্বাশুড়ি। আমার তিনচার বছরে ছোট শোভার শরীরে এখন বয়সের ছাপ সুস্পষ্ট। তাদের কুলাউড়ার বাসায় শোভার সাথে আড্ডা দিয়ে অতীতে অনেক সোনালী সময় পার করে দিতাম। আমরা শোভার বাসায় যাবার নিমন্ত্রন পেলাম। পরদিন নায়েগ্রা জলপ্রপাতে যাবো। শোভার বাসা টরেন্টো ও নায়েগ্রা সিটির মধ্যবর্তী হ্যামিংটন শহরে। নায়েগ্রা হতে ফেরার পথে আমরা শোভার বাসায় রাতের খাবারের নিমন্ত্রন গ্রহন করি।(চলবে)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন