বৃহস্পতিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২০

দ্বিতীয়বার যুক্তরাষ্ট্র যাত্রা- মাস্যাসুসেট, মিশিগান এবং ক্যানাডা সফরপর্ব- বিশ

 




দ্বিতীয়বার যুক্তরাষ্ট্র যাত্রা- মাস্যাসুসেট
, মিশিগান এবং ক্যানাডা সফরপর্ব- বিশ

 ঘণ্টা খানেক পর আমাদের গাড়ী এসে পৌঁছে আমার শৈশবের খেলার সাথী মামাতো বোন শোভার বাসায়। হেমিংটন শহরের লেকপারে এক অপূর্ব সুন্দর বাসা। শোভার স্বামী একজন অতিথিপরায়ন সজ্জন ভদ্রলোক। তার গ্রামের বাড়ি শেরপুরের কাছে আওরঙ্গপুর গ্রামে। আমাদেরকে যে কত ভাল সেবা দিবেন তাই নয়ে একাট্টা তিনি। খাবারদাবারে টেবিল ভরে যায়। শোভার এক ছেলে ও দুই মেয়ে। ছেলে বউ শমসেরনগরের বিখ্যাত লোকসঙ্গীত শিল্পী আমার এইচএসসি সহপাঠী সেলিম চৌধুরীর ভাইঝি। ক্যানাডায় বড় হওয়া মেয়েটির ঘন কালো চুল, দুধে আলতা রঙ্গ, যেন হাফ শ্বেতাঙ্গ বিদেশিনী।

রাত ১টায় টরেন্টো ফিরলাম। একটি ছোট্ট সময়ের সিন্ধুর গভীরতা ভরা নায়াগ্রা সফর এভাবেই সমাপ্ত হলো।

টরেন্টো ডাউন টাউন পরিদর্শনঃ

১৮ জুলাই ২০১৬ সাল। মধ্যাহ্ন ভোজের পর ২ টায় ইগ্লিংটন স্টেশনে যাই। দুতলা ট্রেনের দ্বিতীয় তলায় বসে ডাউন টাউনের ইউনিয়ন স্টেশনে নামি। এই স্টেশনটি কানাডার সর্ববৃহৎ রেলস্টেশন। এক অদ্ভুদ ডিজাইনের ট্রেন, একতলা নিচে পাচ-ছয়টি সিড়ি বেয়ে দেড় তলায় আরেক কম্পার্টমেন্ট, এই দেড়তলা হতে আবার ছয়-সাতটি সিড়ি বেয়ে উপরে দ্বিতীয় তলা। এই তিনস্থরে ট্রেনের কম্পার্টমেন্ট সাজানো। রেলসড়কের দুইপাশ বনফুল, ঘাসফুল ও কাশফুলে ছেয়ে আছে।

ইউনিয়ন স্টেশন হতে বের হয়ে দীর্ঘ্য লাইনে দাঁড়িয়ে সি এন টাওয়ারে (ক্যানাডিয়ান ন্যশনাল টাওয়ার) আরোহনের জন্য টিকেট কাটি। ভাল প্রতিষ্টানে চাকুরীর সুবাদে ভাগনা রূহুলের টিকেট ফ্রি এবং তার গেস্ট হিসাবে টিকেটের দাম মাত্র ৪০% গ্রহন করে। টিকেট ক্রয়ে ১১৮ ডলার পরিশোধ করে আমরা চারজন সিএন টাওয়ারে উঠার জন্য নিচতলার আঁকাবাঁকা সর্পিল লম্বা লাইনে দাড়াই। সিএন টাওয়ারের উচ্চতা ১৪৬৮ ফুট। লিফটের কাছে আসতে আমাদের প্রায় ৩০/৩৫ মিনিট লেগে যায়। ৫/৬ টা লিফট সারাদিন একসাথে চৌদ্দপনের জন করে লোক নিয়ে উঠানামা করে। আমাদেরকে নিয়ে সম্পূর্ন গ্লাস নির্মিত লিফট দ্রুতবেগে উপরে উঠছে। বায়ুচাপ কমে যাওয়ায় কানের পর্দা পট পট করছে। লিফট হতে বেরিয়ে উপরের দ্বিতল টাওয়ার চাকতির উপর তলায় অবতরণ করি। নিচে চেয়ে দেখি নয়ন জুড়ানো টরেন্টো সিটি এবং অন্টারিও লেকের অথৈ নীল জলরাশি দিগন্তহীন দূর সীমানায় লীন হয়ে গেছে। লেকের মাঝে সুদূরে দেখা যাচ্ছে পর্যটন দ্বীপপুঞ্জ সেন্টার পার্ক। নৌকা ও স্পিডবোট নিয়ে ভিজিটররা দলে দলে জলবিহার করছে। সৈকতে মানুষ সাঁতার কাটছে। চূড়াতলা হতে সিড়ি বেয়ে একতলা নেমে শক্ত কাচ নির্মিত ফ্লোর। এই কাঁচের ফ্লোর মাটি হতে ১২৫০ ফুট উপরে। এই বর্নহীন কাঁচ ফ্লোরে উঠে নিচের দিকে তাকালে ভয়ে গা ছমছম করে। আমরা সবাই এই কাঁচের ফ্লোরে উঠে অনেক হাঁটাহাঁটি করি ও ছবি উঠাই। এই গ্লাসে উঠা এক দুঃসাহসী এডভেঞ্চার, এক বিরল অভিজ্ঞতা।

এবার চাকতির বাহিরে তার-নেট ঘেরা টাওয়ার বেষ্টনকারী গোলচত্বরে হাঁটি। ১২০০ ফুট উপরের এই চত্বরে তখন ঝড় হাওয়া বইছে। শীত শীত লাগছে। প্রচন্ড বাতাসের ধাক্কায় দাঁড়ানো যাচ্ছেনা। আমাদের শরীর আপনা আপনি সামনের দিকে উড়ে যাচ্ছে। এত প্রবল বাতাসের ধাক্কা আমি জীবনে আর কখনও অনুভব করিনি। আট দশ মিনিটে চাকতির বৃত্তাকার আবর্তন আমাদের শেষ হয়। ভয় হচ্ছিলো, এই বুঝি ঝড়ের ধাক্কায় সুউচ্চ টাওয়ারটা কালবৈশাখীর ঝাপ্টায় পড়া সুপারী গাছের মত হেলে ভেঙে পড়বে। টাওয়ার সেন্টারের ফাস্টফুড সপে ঢুকে আমরা কুক, কুকিজ ও চিপস কিনে খাই। এই সুউচ্চ টাওয়ার হতে কাছে বিমানবন্দরে উড়োজাহাজের উঠানামা দেখি। ঘন্টাখানেক আর এন টাওয়ারের এক বিচিত্র জগতে অবস্থান করে দ্রুতগামি লিফটে আবার মর্তে অবতরণ করি।

এবার আমরা টিকেট কেটে জলজ প্রানীর এক্যুরিয়ামে প্রবেশ করি। ইতিপূর্বে এশিয়ার বিখ্যাত সিঙ্গাপুর এক্যুরিয়াম দেখেছি। টরেন্টোর এক্যুরিয়াম আয়তনে বিশাল। মাথার উপরে নীল আকাশ বিশিষ্ট একটি কাঁচের সমুদ্র তৈরী করা হয়েছে। এই সাগরের ভিতর দিয়ে স্বচ্ছ কাঁচের টিউব সড়ক। একটি চলন্ত বেল্ট চড়ে আমরা সামনে এগিয়ে যাই। আশপাশে সাগরের মীনগণ হীন হয়ে আছে সরোবরে। হাঙ্গর, লাল কাকড়া, অক্টোপাস, জেলিফিস, ভাইপার, সি-আরপিন, কফিন জেব্রাফিস ইত্যাদি সামুদ্রিক মাছ ও প্রানী কখনও দলবেঁধে কখনও দলছুট সাঁতার কাটছে। ডানে বামে উপরে অজস্র মাছ বিচরন করছে। পানির উপর দেখা যাচ্ছে নক্ষত্র খচিত নীল আসমান।

এক্যুরিয়াম হতে বের হয়ে কানাডিয়ান রেল জাদুগর ঘুরে দেখি। এখানে বিভিন্ন যুগের রেল ইঞ্জিনের নমুনা রয়েছে। রেলগাড়ির সুচনাকাল হতে আজ পর্যন্ত রেলের যে সব উন্নয়ন হয়েছে সেই ধারাবাহিক বিবর্তন এখানে প্রত্যক্ষ করি।

এবার কানাডার একটি প্রতিষ্টানের লোকজনের বাৎসরিক আনন্দ অনুষ্টান উপভোগ করি। দুইজন নর্তকি হাওয়াইয়ান ট্রাইভাল নৃত্য পরিবেশন করেন। এক চিলতে রেড ইন্ডিয়ান ঘাঘরা কোনমতে নিতম্ব ডেকে রেখেছে। বুকের চুড়ো দুটি ছাড়া সারা শরীর অনাবৃত এই দুই শ্বেতাঙ্গিনী সুন্দরী সঙ্গীতের তালে তালে সাম্বা নৃত্য করছেন। লোকজন আনন্দে হৈ-হল্লা করছে, পানাহার করছে, চারদিকে আনন্দের ফোয়ারা বইছে। উৎসবে শ্বেতাঙ্গ বেশী হলেও অন্যরা  কেউ কালো, কেউ হলুদ, কেউ পীত, কেউ বাদামী, কেউবা মিশ্র বর্নের। এযেন মানব চর্মে নানা বর্নের মেলা। 

রাতে আবার দুতলা ট্রেনে বাসায় ফিরে আসি।(চলবে)

                            

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন