দ্বিতীয়বার যুক্তরাষ্ট্র যাত্রা- মাস্যাসুসেট, মিশিগান এবং ক্যানাডা সফরপর্ব- একুশ
কানাডার পল্লীগ্রাম দর্শনঃ
২২ জুলাই ২০১৬ সাল। সকালে চানাস্তা শেষে
রুহুল গাড়ি স্টার্ট দেয়। আমি ও জেফার সাত সিটের মিনিবাসে কানাডার খামারগ্রাম দেখতে
বের হই। টরেন্টো শহর হতে বের হয়ে কৃষি অঞ্চলে প্রবেশ করি। রাস্থায় গাড়ি চলাচল নেই
বললেই চলে। চারলেন সড়কের টরেন্টোগামী লেইনে গাড়ি সংখ্যা বেশী। বহির্গামি লেন প্রায়
গাড়ি শূন্য। রাস্থার দু’পাশে ঘাসের চাদরে ঢাকা এবং নীল, সাদা ও হলুদ
বনফুলের সমারোহ। মনে হয় এই বুনো প্রকৃতিকে কে যেন সযতনে সাজিয়ে রেখেছে। কানাডার
গ্রামগুলো আমদের পল্লীর চেয়ে আর সবুজ আর শ্যামল। মাইলের পর মাইল সবুজ গমক্ষেত, ভূট্টাক্ষেত ও
আলুক্ষেত। মাঝে মধ্যে ডেইরী খামার। সড়কের দুই পাশে ফার্ন জাতীয় বৃক্ষের বন।
ক্যানাডায় প্রকৃতিকে কোন অত্যাচার করা হয়না, তাকে তার মত রেখে
দেয়া হয়। এখানে টিলা পাহাড় কখনও কাটা হয়না, ভূমিরূপ অযথা
পরিবর্তন কিংবা ধ্বংস সাধ্ন করা হয়না। এখানে পাহাড়ের পাশ ঘেষে কিংবা পাহাড়ের তল
উপর ঢেউ রচনা করে রাস্থা নির্মান করা হয়। সাগর ও লেককে তারা
প্রকৃতিতে যেমন ছিল তেমনটি রেখে দেয়।
কানাডার গ্রামের বাড়ি হল এলাকা জুড়ে সারি
সারি খামারবাড়ি। বিশাল বিশাল ক্ষেতের মাঝে
ছবির মত সুন্দর বাংলো বাড়ির সামনে বাগান, পাশে লেকপুকুর এবং
ঘোড়ার আস্থাবল। বড় বড় খামারে জালের মত বিস্তৃত পাইপ লাইনে বৃষ্টিপাতের মত জল
ছিটানো হয়। বড় পাইপের মূল হুইলটা ঘুরালেই দুইতিন শত একর জায়গা জুড়ে বৃষ্টির ধারা
বয়। আমাদের দেশে কিছু বিদেশী চাবাগানে এভাবে জলসেচের ব্যবস্থা রয়েছে। ক্যানাডায়
অনেক অনেক বড় বড় লেক জুড়ে রয়েছে বরফগলা জল। সামারে এই জলসেচন করে বাংলাদেশের মত
বিশাল এই এলাকা একটি কৃষি অঞ্চলে পরিনত হয়েছে। রুহুল বলল এখানে বাংলাদেশের মত
বারমাস শষ্য ফলানো যায়না। একবারই ফসল হয় এবং তা সামারে। বছরে মাত্র একবার শষ্য
ফলানোর জন্য মাটি থাকে খুব উর্বর এবং আমাদের তুলনায় ফসলের ফলন অনেক বেশী হয়। শীতে
এই সারাটা খামার অঞ্চল সাদা বরফে ঢেকে যায়। বাংলাদেশ চিরসবুজ দেশ কিন্তু ক্যানাডা
কেবল সামারে এত গাড় সবুজ থাকে। শীতে পাতাহীন বৃক্ষে বরফের ক্রিস্টাল ঝুলে থাকে।
ক্যানাডায় কাট সস্তা ও টেকসই। মাঠে
ময়দানে পার্কে সর্বত্র কাটের বেড়া, চেয়ার, টেবিল, প্যান্ড্যাল ও
বেঞ্চের ছড়াছড়ি। এগুলো এতই মজবুত যে রোদ বৃষ্টি হিমতুষার সহ্য করে বছরের পর বছর
অবিকৃত টেকে রয়।
কানাডার পল্লীর খামারবাড়ি ঢূকার আগ্রহ
নিয়ে আমরা বেলহেভেন নামক একটি সুন্দর পাহাড়ি গ্রামে গাড়ি থামাই। চারপাশে নির্জন
নিরবতা। ক্যানাডায় অনুমতি ছাড়া কোন খামারবাড়িতে ঢুকা অপরাধ। আর যুক্তরাষ্ট্রে
অনুমতি ছাড়া কারো সম্পত্তিতে ঢুকলে মালিক গোলী করার অধিকার রাখে। তাই আমরা অনুমতি
নিয়ে কোন একটা খামারবাড়িতে ঢুকার জন্য লোক খুজি। সুন্দর সুন্দর বাড়িগুলোতে এক
ছিমছাম নিস্থব্ধতা। মানুষের দেখা মেলা ভার। ভাগ্য ভাল মোঠাসোঠা একজন
শ্বেতাঙ্গিনীকে একটি ফুলবাগে জলসেচন করতে দেখি। রুহুল ‘গুড মর্নিং মেম’ বলতেই তিনি হাসি
মুখে এগিয়ে আসেন। জনবিরল এলাকার লোকজন সামনে মানুষের দেখা পেলেই খুশী হন। হাসিমুখে
পরিচয় দেন, মাই নেইম ইজ ডেইজি। তার বাবা কৃষক এবং
তিনি এই নির্জন গ্রামের একজন কৃষানী।
ডেইজির সাথে ছুটে আসে তার প্রিয় কুকুর হান্টার। অদ্ভুদ সুন্দর কুকুর এই হান্টার, তার শরীর ভেড়ার
হলুদ পশমে আবৃত। ওযেন ভেড়ার পশমের সোয়াটার জড়ানো বড়সড় রবোট কুকুর। কুকুরটি এসে
রুহুলের সামনে বসে হেন্ডসেক করার জন্য সামনের ডান পা বাড়িয়ে দেয়। তারপর আমি ও
জেফারের সাথে এসে করমর্দন করে। এমন সুন্দর ও স্নেহপ্রবন কুকুর আমি জীবনে কখনও
দেখিনি। কানাডার মানুষগুলো যেমন ভদ্র, কুকুরগুলোও তারচেয়ে
কোন অংশে কম যায়না। কুকুরদের ঞ্জানবুদ্ধি দেখে মাঝে মাঝে মনে হত, এরা বুঝি মানুষের
কাছে থেকে থেকে একসময় মানুষের পরবর্তী আশরাফুল মাখলুকাত হয়ে যাবে। ডেইজি আমাদেরকে
সিমকো লেইকের সন্ধান বাতলে দিয়ে বললেন ওখানে যান, জায়গাটা অসম্ভব
সুন্দর। ডেইজির সাথে আলাপ করে আমাদের লাভই হল, আমরা কাছেই নতুন
একটি অপরূপ লেকপল্লীর সন্ধান পেলাম।
ডেইজি টিচার। প্রতিদিন টরেন্টো এসে ভারত, শ্রীলঙ্কা ও
বাংলাদেশী শিশুদের স্কুলে শিক্ষকতা করে রাতে বেলহেভেনের খামারবাড়ি ফিরে যান।
একারনে তার ইংলিশ উচ্চারন ও কথাবার্তা আমাদের বুঝতে আদৌ অসুবিধা হয়নি।
কানাডার খামারবাড়িগুলো অদ্ভুদ নিরবতার
মাঝে অপার্থিব সৌন্দর্য্যের আধার। পল্লীর সড়কগুলো ডাবল লেন এবং কোন ধরনের
ভাঙ্গাচুরা নেই। শহরের চেয়ে গ্রামের বাড়িগুলো অনেক বড়সড় এবং সুরম্য বাগানঘেরা।
কানাডার গ্রামের মানুষ শ্বেতাঙ্গ। এরা হয়ত ইউরোপ হতে আসা আদি অভিবাসীদের বংশধর।
তারা মাত্রাতিরিক্ত ভদ্র ও শুদ্ধাচারী।
যুক্তরাষ্ট্র ও ক্যানাডায় সামনের বামসিটে
বসে গাড়ী চালাতে হয়, যা আমাদের দেশের বিপরীত। রুহুল বলল মামা
গাড়ী চালান। এখানে রাস্থায় গাড়ি নেই, পুলিশও নেই।
বেলহেভেন হতে সিমকো লেক যাবার পথে আমি গাড়ি ড্রাইভ করি এবং বিশ পঁচিশ মাইল ড্রাইভ
করে সিমকো লেকের কাছে এসে ড্রাইভিং সিট ছাড়ি। বাংলাদেশের বাইরে বিদেশে এই প্রথম
আমার গাড়ি চালানোর অভিজ্ঞতা। ক্যানাডায় গাড়ী চালানো খুব সহজ, বিরাটাকায়
বহু-লেইন বিশিষ্ট রাস্থায় গাড়ির তেমন ভীড় নেই। গাড়িগুলো ঝকঝকে চকচকে, আমাদের ডিসি, এসপি ও এমপিদের
গাড়িগুলোর অনুরূপ। কানাডার গাড়ি নিয়ে যখন লিখছি, তাহলে আর কিছু বলে
নেই। ক্যানাডা কিংবা যুক্তরাষ্ট্রে গাড়ি থামিয়ে রোড টেক্স কিংবা সেতু টোল দিতে
হয়না। সড়কের নির্ধারিত মুভি ক্যামেরা টেকস বিল তৈরি করে গাড়ি নাম্বারের ঠিকানায়
অটো পাঠিয়ে দেয়। এমন কি গাড়ি মালিক টেক্স অগ্রিম পরিশোধ করে থাকলে কেমেরা স্কেন
করে টেক্স পেইড প্রদর্শন করে। তাই এসব দেশে গাড়ি থামিয়ে সড়ক, সেতুর টেক্স
প্রদানের বিড়ম্বনা নেই। এখানে যানজটে গাড়িগুলো আটদশ ফুট দুরত্ব বজায় রেখে থামে এবং
মহাসড়কে পরস্পর দুই তিনশত ফুট দুরত্ব বজায় রেখে রান করে। এবার আমরা সিমকো লেকের
পারে ছোট্ট গ্রামীণ জনপদ জর্জে প্রবেশ করি। সিমকো লেকের আয়তন ৭৪৪ বর্গ কিলোমিটার।
অনেকটা আমাদের টাঙ্গুয়ার হাওরের মত। এলাকাটা যেমন সুন্দর, লেকপারের
পাড়াগুলোর নামও তেমনই সুন্দর। প্যারাডাইজ বিচ, ফিনলে বিচ
ইত্যাদি। লেকের পারে পারে ছোট ছোট বালির বিচে তরঙ্গমালা এসে মাথা ঠুকছে। লেকপারের
বাড়িগুলো ভারী সুন্দর। প্রতিটি বাড়ির সামনে দামি গাড়ি ও পিছনের ঘাটে বাঁধা
স্পিডবোট। প্রতিটি বাড়ি অনন্য ও অসাধারন। এই লেকে প্রচুর বুনো হাঁস ও জলচর পাখি
বিচরন করছে। রয়েছে সাজানো গুছানো ছোট ছোট বিচ- ফ্রাঙ্কলিন বিচ, উইলো বিচ ইত্যাদি।
আর আছে শিশুপার্ক ও উদ্যান।
আমাদের ‘রূপসী বাংলার’ কবি জীবনানন্দ দাশ
এখানে এলে ‘রূপসী ক্যানাডা’ নামে এক অনন্য
কাব্যগ্রন্থের জন্ম দিতেন। সিমকো লেক হতে বের হয়ে আমরা আবার খামারগ্রামে ডুকি।
আমাদের দেশের মত খন্ড খন্ড ছোট জমি এখানে নেই। এখানে কৃষিকাজে বড় বড় বুলডজার ও
যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয়। ফল কুড়ানোর মেশিন গাড়ি, শস্যকাটা যন্ত্র, যান্ত্রিক খড়
সংরক্ষণ, উন্নত সেচব্যবস্থা দেখে মনে হয় অটোমেশন
কৃষি ব্যবস্থা। উচ্চ প্রযুক্তির সাহায্যে এদেশে একজন কৃষক বাংলাদেশের শত কৃষি
শ্রমিকের কাজ একাই সম্পাদন করতে পারেন।
এবার কেজুইক টাউনে গ্যাস ভরে রুহুল
জিপিএস চালু করে আমরা দ্রুত টরেন্টো সিটির দিকে ধাবিত হই।
আমাদের গাড়ী এখন টরেন্টো বুটানিক্যাল
গার্ডেনে প্রবেশ করে। এই গার্ডেনের এডওয়ার্ড পার্কে যাই। নিচে একটি ঝর্না কলকল
ধ্বনী তুলে বয়ে যাচ্ছে। ঝর্নার ভাসমান পাতরে দারিয়ে ছবি তুলি। শ্বেতরা অতিমাত্রায়
দায়িত্ববান। তারা নিবিষত মনে ফুলবাগ, বৃক্ষ, লতাপাতার সেবাযত্ন
করছেন। তাদের কাজ নিখুঁত এবং কোন ফাঁকি ঝুঁকি নেই। এই বাগানে চীনারা বসে ধ্যান
করছেন। বিচিত্র ধরনের যোগ-ব্যায়ামও করছেন তারা। নয়ন মুদিয়া তারা ডানে বামে ডলছেন।
বৃক্ষলতা, ফুলে ফুলে সুরভিত টরেন্টো বুটানিক্যাল
গার্ডেনের রূপখনি দেখা শেষ হলে গাড়িতে বসি।
এবার আমরা টরেন্টোর সবচেয়ে ধনী অভিজাত
এলাকা পোস্ট রোড এরিয়ায় প্রবেশ করি। প্রতিটি বাড়ি দুই তিন একর জায়গা জুড়ে আছে।
দামি বাড়িগূলোতে বিভিন্ন যুগের বিভিন্ন দেশের স্থাপত্যের সমুন্নয় ঘটেছে। প্রতিটি
বাড়িতে নিজস্ব নিরাপত্তা ব্যবস্থা, বাগান, সুইমিংপুল, ফোয়ারা, ব্যায়ামাগার, সংগ্রহশালা, পাঠাগার, ইন্ডোর- আউটডোর
খেলার মাট সব রয়েছে। আর আছে কুকুর ও ঘোড়ার আলাদা বাসঘর। এখানকার এক একটা বাড়ি যেন
এক একটা স্বয়ং সম্পূর্ন দুর্গবাড়ি। নানা ডিজাইনে তৈরী বাড়িগুলোতে ইউরোপের প্রাচীন
প্রাসাদ, গির্জা, দুর্গ ইত্যাদির
স্থাপত্যের সংমিশ্রন রয়েছে। রুহুল বলল, এই প্রতিটি বাড়ির
দাম বাংলাদেশী টাকায় শতকোটির কম হবেনা।
এবার ঘোড়া চড়ার বাসনা নিয়ে আমরা সানি পার্কে আসি। এটি টরেন্টো শহরের আর একটি বড় নেচারপার্ক। এই পার্কটি বিখ্যাত এজন্য যে এখানে ঘোড়া চালানো শেখানো হয়। ঘোড়া চড়ার জন্য আমরা পার্কের সানি ব্রোক স্টাবল (আস্তাবল) প্রবেশ করি। ভাগ্য খারাপ সেদিন গরম পড়ায় ঘোড়া রোদে বের করা হয়নি। তাই ঘোড় সওয়ার হবার স্বপ্ন অপূর্ন রেখেই বেরিয়ে আসতে হল। সকালে ব্রেকফাস্টের পর বের হয়ে ১২০ কিলোমিটার/ঘন্টা বেগে প্রায় দুই শত মাইল দুরত্ব আমরা ঘুরে আসি। দেশটি এত বিশাল যে ঐ দূরত্বকে টরেন্টো শহরের উপকণ্ঠই মনে হল। এযেন বাসা থেকে বের হয়ে আশপাশ ঘুরে এলাম। বেলহেভেনের ডেইজির পোষা কুকুর হান্টারের সাথে হেন্ডসেক এবং চুমু খেয়ে আমরা অপবিত্র। তাই বাসায় ফিরে দ্রুত স্নান করে আমরা পবিত্র হই। তারপর গাড়ি চড়ে সবাই মিলে জুমুয়ার নামাজ আদায়ে মসজিদে চলে যাই।(চলবে)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন