দেখে
এলাম ভারত, সেই তুলনায় বাংলাদেশ
যাত্রাঃ ৫ সেপ্টেম্বর ২০১২ ফেরতঃ
১৫ সেপ্টেম্বর ২০১২ অবস্থানঃ ১১ দিন
স্পটসমূহঃ শিলং, চেরাপুঞ্জি,
গৌহাটি, দিল্লি, আগ্রাদুর্গ, তাজমহল, মথুরা, বৃন্দাবন ইত্যাদি।
সপ্তম আশ্চর্যের
অন্যতম তাজমহল স্বচক্ষে দেখার এক তীব্র আকর্ষণ ছিল শৈশব
হতে। কোন এক ভারতীয় লেখক পৃথিবীর
মানুষকে দুইভাবে ভাগ করেছেন একভাগ হচ্ছে: যারা তাজমহল দেখেছেন এবং
অন্যভাগ হচ্ছেন: যারা দেখেন নি। যাক আমি, আমার সহধর্মিনী ডা: নূরজাহান বেগম চৌধুরী ও
পুত্র জেফার ১২ সেপ্টেম্বর
২০১২
সালে ঐ প্রথম ভাগের মানুষের অন্তভুক্ত হলাম। শৈশবে গ্রামের
মানুষের মুখে শুনতাম তাদের পূর্বপুরুষরা আসামে কাজ ও
ঠিকাদারী করতেন। আমাদের অনেক আত্মীয় বৃটিশ আমলে আসামের নানা অঞ্চলে
চাকুরী
করতেন। কামরূপ কামাক্ষ্যার রহস্য জগতে এ অঞ্চলের অনেক মানুষ গিয়ে
হারিয়ে যেত। লোকে বিশ্বাস করতো ঐ যাদুর জগতের মেয়েরা ঐসব লোকেদের চিরতরে যাদুমন্ত্রে
বন্দি করে রেখে দিত। আসলে ঐসব
লোকেরা বিয়েশাদি করে আসামের জনবিরল অঞ্চলে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করতো, পথের অগম্যতার কারণে
আর ফিরে আসতে সক্ষম হত না। ১৯৪৭ সনের ১৪ই আগষ্টের আগে ঐ অঞ্চলটা আমাদের সাথে একই রাষ্ট্রের অংশ ছিল। ১৯৪৭ এর সীমারেখা আমাদেরকে চিরদিনের জন্য আলগা করে দিল। আমরা
আলাদা হয়ে প্রথমে পাকিস্তান ও পরে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের অন্তভুক্ত হলাম।
বাংলাদেশের সিলেট
অঞ্চলের একজন বাসিন্দা হিসেবে কাছাকাছি মেঘালয় ও আসাম অঞ্চল ও ভারতের কেন্দ্র দিল্লি
আগ্রা দেখার এক তীব্র আগ্রহে গত বৎসর পূবালী ব্যাংক হতে ছুটি নেই। কিন্তু হঠাৎ ডা: নূরজাহান
চৌধুরী অসুস্থ হওয়ায় তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। শেষমেষ ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে
একইদিনে পিত্ততলী ও ফাইব্রয়েড অপারেশন হয়। তিনি মহান আল্লাহ মেহেরবানিতে সুস্থ্য
হয়ে চিন্তামুক্ত হই। সেবার আর যাত্রা সম্ভব হয়নি। এ বছর সিলামের সানওয়ার সাহেব
শিলং যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করলে তাকে নিয়ে লতিফ ট্রেভেলসে পাসপোর্ট জমা দেই।
শেষপর্যন্ত সানওয়ার সাহেবকে ভিসা না দিলেও আমরা তিনজন পেয়ে যাই। সামনে চলে আসে
আমার এম.বি.এ সেমিষ্টার ফাইন্যাল পরীক্ষা। পরীক্ষার আগেই যাত্রার সিন্ধান্ত নেই। কারণ
দেরী হলে জেফারের পড়াশুনার ক্ষতি হয়ে যাবে।
৫ সেপ্টেম্বর ২০১২
সালে সকাল ৮টা ৩০ মিনিটে ভাড়া কারে আমাদের সাগরদিঘিরপারের বাসা হতে যাত্রা শুরু
করে ৯.৩০ মিনিটে ডাউকি স্থলবন্দরে উপনীত হই। তামাবিলের কাছে
সুউচ্চ পাহাড় সারি ভারতের অংশ ও পাহাড়গুলোর পাদদেশ হতে আরম্ভ হওয়া সমতল ভূমি হচ্ছে
বাংলাদেশ। বাংলাদেশ সীমায় দু’টি অফিসে প্রয়োজনীয় কাজ সারতে হয়।
প্রথমে ইমিগ্রেশন অফিস যাহা বাংলাদেশ পুলিশ বিভাগ কর্তৃক পরিচালিত হয় ও অন্যটি
কাষ্টমস্ অফিস। অত্যন্ত ভগ্ন দৃষ্টিকটু দু’টি টিনের ঘরে অফিস দু’টি
পরিচালিত হয়। দু’টি অফিসে বাথরুমে পানি নেই, অসম্ভব দুর্গন্ধ। কাজকর্ম ভীষণ স্লো ও দায়ছাড়াগোছের। কাজ সেরে ছোট্ট বিজিবি
ক্যাম্প পার হয়ে বি.এস.এফ ক্যাম্পে যাই। পাগড়ী
দাড়ী ওয়ালা মেশিনগানধারী শিখ অফিসার পাসপোর্ট দেখে ভারতীয় ইমিগ্রেশন অফিস দেখিয়ে
দেন। পাহাড়ের ধাপে অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন ডালু ছাদ বিশিষ্ট ভবন। আমলারা দারুন মনযোগী
ও ব্যবহার সৌহার্দ্যপূর্ণ। বাথরুম খুবই পরিচ্ছন্ন। ভারতীয় আমলাতন্ত্র আমাদের চেয়ে
যে অনেক দক্ষ ও কার্য্যকর সীমারেখা পার হওয়া মাত্রই স্পষ্ট হয়ে উঠে।
ভারতীয় ইমিগ্রেশন
অফিসে দেখা হয় ইঞ্জিনিয়ার মাসুদুর রহমানের সাথে। তার বাড়ী জৈন্তার দরবস্তে। চাকুরি
করেন মংলা পোর্টে। স্ত্রী ও একমাত্র কন্যাকে নিয়ে যাচ্ছেন শিলং বেড়াতে। তিনি আগে
অনেকবার ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল সফর করেছেন। ভালো হিন্দি জানেন। মনে হয়েছে- তার
ভ্রমণের নেশা রয়েছে। তিনি ছোট্ট ন্যানো কারে প্রতিজন ২০ রুপী ভাড়ায় আমাদেরকে নিয়ে
যান ডাউকী বাজারে। সমুগাড়ি হচ্ছে টাটা কোম্পানি কর্তৃক নির্মিত পাহাড়ে চলাচলের
উপযোগী এক ধরনের জিপ। সমুগাড়িতে জনপ্রতি ১০০ রূপী ভাড়ায় ডাউকী হতে শিলংয়ের দিকে
রওয়ানা হই। কিছুক্ষণ পরই সুমো জিপ জাফলংয়ের সুপ্রসিদ্ধ ঝুলন্ত সেতু পার হয়ে যায়।
জিপটির যাত্রী সংখ্যা ১২ জন। আমরা ছাড়া বাকি লোকজন খাসিয়া। তাদের মধ্যে একজনকে বেশ
শিক্ষিত মনে হয়েছে। তিনি মেঘালয়ের অর্থনীতি ও রাজনীতি বিষয়ে বেশ অবগত। রাজ্যটির
বৃহৎ বাসিন্দা খাসিয়ারা সিলেটের উত্তরদিকের পাহাড়ে ও পরবর্তী নাগরিক গোষ্টি গারোরা
আমাদের ময়মনসিংহ জেলার উত্তরে বসবাস করে। আর আছেন প্রাচীন আমল হতে বসবাস করা
সামান্য সংখ্যক বাঙ্গালী জনগণ। শিলংয়ে খাসিয়াদের আধিপত্য অথচ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী
সাংমাই সংখ্যা লঘু গারোদের লোক। শিলং যাত্রী খাসিয়া ভদ্রলোক বাংলা জানেন। শুনলাম
অনেক কিছু। এখানে প্রচুর ঘাস হয়। তাই রয়েছে ড্রায়রী খামার। বাংলাদেশে রপ্তানি হয়
কয়লা, গ্রানাই ও চুনাপাতর। অনিন্দ্যসুন্দর মেঘালয়া পর্যটনের এক স্বর্গরাজ্য। শিলং
শহরটাকে বাদ দিলে সারাটা মেঘালয় বৃক্ষ ও সম্পদে ভরা এক জনবিরল পাহাড়ী অঞ্চল।
ঝুলন্ত ব্রীজ পার হবার পর জিপ উপরের দিকে উঠছেতো উঠছেই। মাইলখানেক নিচে বাংলাদেশের
সমতল জলাভূমি পাতুরে পাহাড়ের ধাপকেটে নির্মিত রাস্তা, যার একদিকে পাহাড় আকাশ ছুঁয়েছে, অন্যদিকে মাইল দেড়েক
নিচে নেমে গেছে কোথাও ঢালুভাবে আবার কোথাও খাড়াভাবে পাহাড়ের খাদ। গাড়ি উপরের দিকে
যেয়ে যেয়ে এক পাহাড়বেষ্টিত প্রায়সমতল ভূমিতে চলে আসে। খাসিয়াদের গ্রাম্যশহর।
বাড়ীগুলো মাছাংয়ের উপর নির্মিত। এই জনপদের নাম পেনিন সোলা। গাড়ী আরও উপরে উঠে আরেক
জনপদে থামে, যার নাম কাশী। গাড়ীর জানালার দিকে তাকিয়ে দেখছি, এমন
সব দৃশ্য, যা আর কখনও দেখিনি। এক পাহাড়ে রোদ, অন্য পাহাড়ে মেঘের
ছায়া নীচে পাহাড়ের গায়ে মেঘ তৈরি হচ্ছে। সাদা ঘন কুয়াশার মত মেঘ, দৃষ্টি আটকে দিচ্ছে। এক পাহাড়ের গায়ে অন্য পাহাড়ের ছায়া লুকোচুরি করছে। আমি
বান্দরবন ও রাঙ্গামাটি ঘুরেছি। কিন্তু শিলংয়ের পাহাড়ী দৃশ্য পার্বত্য চট্টগ্রামে
নেই। শক্ত পাতরের পাহাড়ে অপূর্ব সবুজের সমারোহ। পাহাড় বেয়ে নেমে আসা ঝর্ণা ও
জলপ্রপাত সবই অনন্য। ডাউকী বাজার হতে ১২ টায় ছেড়ে দেয়া সুমো জিপটি ৩টা ৩০ মিনিটে
শিলং শহরের অঞ্চলি বাস টার্মিনালে এসে থামে। শিলং শহরের পুলিশ বাজারে বিদেশীদের
জন্য অসংখ্য হোটেল রয়েছে। সহযাত্রী মাসুদ সাহেব ও আমি অনেক খোঁজাখুজি করে একটি
হোটেল বের করি। নাম ‘রেইন বো’ হোটেল। অবস্থান পুলিশ
বাজার। তিনজন থাকার মত ২ বেডের রুম। ভাড়া প্রতিদিন ৮০০ রুপি। ব্রডওয়ে হোটেল, শিলং
রেস্ট হাউস, গেইস হোটেল খুবই
কস্টলি। সামনের বাবা হোটেলে রুইমাছ সহ খাবার খেয়ে রুমে এসে ঘুমিয়ে পড়ি। পরদিন
নর্থইষ্ট ছাত্র ইউনিয়নের ডাকে সেভেন সিস্টারের রাজ্যগুলোতে আঞ্চলিক দাবি-দাওয়া
নিয়ে হরতাল। তাই রুমে বসে থাকতে হয়। হোটেল রুমটির মেঝে কাষ্টনির্মিত, ওয়ালগুলো কাটের আবরণে চাকা। বাথরুমে গরম ও ঠান্ডাপানির লাইন রয়েছে। রুমটির
টেলিভিশনের উপর কৃত্রিম গ্লাসের ছাদ। ঐ ছাদ দিয়ে দিন ও রাতে চন্দ্র ও সূর্যের
প্রাকৃতিক আলো আসে, যা সত্যই অপূর্ব ও অভিনব মনে হয়েছে।
পরদিন ৬ সেপ্টেম্বর
১২ তারিখে মেঘালয় বন্ধ। আমাদের হরতালে মারামারি হয়। জোর জবরদস্তি হয় কিন্তু শিলংয়ে
এর কিছুই নেই। পুলিশ ও হরতালকারীর ধাওয়া পালটা ধাওয়া নেই। মানুষ স্বেচ্ছায় যান
চলাচল ও দোকানপাট বন্ধ রেখেছে। ঘুম হতে উঠে দেড়-দুই ঘন্টা নির্জন
শহরে ভ্রমণ করি। শহরটা পাহাড়ি ও রাস্তাঘাট প্রশস্থ করার মত জায়গা না থাকায় কিছুটা
ভীড় লেগে থাকেই। এখানে রিকশা নেই। এক রাস্তা হতে নিচে নেমে অন্য রাস্তা দিয়ে হেঁটে
দূরের বসতি ঘুরে বেড়াই। সুন্দর ফুল, সুন্দর লতাপাতার
পাহাড়ি শহর শিলং। এক ধরনের নীল ফুল লতাবনে ঝুলে থাকে। জীবন্ত বাঁশের গাছগুলো বেড়া
তৈরি করে। রেস্ট হাউসের আগে সুন্দর পাহাড়ী লেইক পার্কে ফটো উঠাই। ৫/৭ তলা ভবনগুলো এমন ভাবে নির্মিত যে ২/১ তলা রাস্তার লেবেলের নীচে
চলে যায়। বাড়ীঘরগুলো বেশীর ভাগ পাহাড়ের ধাপে নির্মিত। শহরটিতে আজানের ধ্বনী শুনিনি
কারণ কোন মসজিদ নেই। ২/১টা হিন্দু মন্দির চোখে পড়েছে। তবে খাসিয়ারা
খ্রিস্টান। পূর্বে তারা প্রকৃতি পূজারী ছিল। ইংরেজ শাসনামলে মিশনারিরা স্কুল, হাসপাতাল, গীর্জা ইত্যাদি নির্মাণ করে তাদেরকে খ্রিস্টধর্মে দিক্ষীত করে নেয়। এখানে
বিভিন্ন স্থানে যিশুর প্রতিকৃতি ও ভাস্কর্য্য মূর্তি দেখতে পাওয়া যায়।
অন্যান্য
জাতিসত্ত্বার মত খাসিয়ারাও এলিট ও নন-এলিট দুই ভাগে বিভক্ত। এলিট
খাসিয়ারা শিক্ষিত ও ধনী। ছেলে ও মেয়েরা জিন্সের পেন্ট ও সার্ট কিংবা ট্রাউজার
পরিধান করে। চেহারা অনেকটা চীনাদের মত। তারা কিছুটা বেঁটে ও স্বল্পভাষী। মেয়েরা
স্মার্ট ফর্সা ও দারুণ সুন্দরী। নন এলিট খাসিয়ারা বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকা ও
প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাস করে। মেয়েরা ঘাঘরা (কোমর
বন্ধনী), ব্লাউজ ও একফলা কাপড় পরিধান করে। এরা দারুণ পরিশ্রমী। পূর্বে তাদের মধ্যে
মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। বিয়ের পর ছেলেদেরকে শ্বশুড়বাড়ি চলে যেতে
হত। বর্তমানে এইসব রীতিনীতি তেমনটি কার্য্যকর নেই।
শিলং ১৪৯৬ মিটার
উচ্চতায় অবস্থিত এক শৈল শহর। এখানে সবসময় শীতল আবহাওয়া বিরাজ করে। সিলেটের তীব্র
গরম হতে বের হয়ে মেঘাচ্ছন্ন শিলংয়ের হোটেল রুমে পৌষের শীতে আপতিত হই। শিলংয়ের
হোটেলে বৈদ্যুতিক পাখা বা এয়ারকন্ডিশন নেই। ঠান্ডায় লেপ গায়ে দিয়ে ঘুমাতে হয়।
এখানে শীতে ডিসেম্বর বা জানুয়ারিতে মাঝে মধ্যে বরফ পড়ে। তাদের স্কুল ড্রেসে নীল
সুয়েটার অন্তভুক্ত রয়েছে। শিলংয়ে মশা নেই। দ্রব্যমূল্য সিলেটের তুলনায় বেশী। সবজি
স্বাধহীন অথচ দাম মাছ-মাংসের চেয়েও অধিক। শিলংয়ের চেরীফল অনন্য।
খাসিয়ারা খাসিভাষায কথা বলে। তাদের কোন বর্ণমালা ছিল না। ইংরেজ মিশনারিরা ইংরেজি
হরফে খাসিয়া ভাষা লিখার প্রচলন করে। শিলংয়ে ইংরেজি হরফে লিখা খাসিয়া পত্রিকা
লোকজনকে পড়তে দেখেছি।
৭ সেপ্টেম্বর ২০১২, রোজ শুক্রবার, সহযাত্রী ইঞ্জিনিয়ার মাসুদ সাহেব ও আমরা
সাইট সিয়িংয়ের জন্য ২০০০ রুপিতে ১টি সুমোজিপ ভাড়া করি। ব্রেকফার্স্ট সেরে সকাল
১০টায় হোটেল রেইনবো হতে রওয়ানা হই। হোটেল ম্যানেজার চৈত্র বসনেট গাড়িটি বন্দোবস্ত
করে দেন। চৈত্র বসনেট সিলেটি ভাষায় কথা বলেন। তিনি আসামের তাজপুর শহরের বাসিন্দা।
তিনি দেখতে লম্বা স্মার্ট ও সুদর্শন।
আমাদের জিপটি
চেরাপুঞ্জীর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। শিলং হতে ৫৪ কি:মি: দক্ষিণে
চেরাপুঞ্জী প্রায় ১৩০০ মিটার উঁচুতে অবস্থিত। চেরাপুঞ্জি ইংরেজদের অবদান। খাসিয়া
সাহিত্য ও সংস্কৃতির পীটস্থান এই চেরাপুঞ্জি। ১৮৪১ সালে এখানে মিশনারি স্কুল
স্থাপিত হয়। এখানকার প্রাচীন গীর্জার নির্মাণ কাল ১৮৬৪ সাল। ইংরেজি অক্ষরে খাসি
লিপির জন্ম ও হয় এখানে মিশনারিদের হাতে। চেরাবাজারকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বসতি।
বিশ্বের সবচেয়ে বেশী বৃষ্টিপাত (বছরে ৫০র্০র্ ) হয় চেরাপুঞ্জিতে।
চেরাপুঞ্জির পথে
প্রথমে একটি স্পটে জিপ থামালো ড্রাইভার সজল। ড্রাইভারের বাড়ি শিলচরে ও তার
মাতৃভাষা সিলেটি। পাহাড় হতে নীচে নেমে দুই বিশাল পাহাড়ের মধ্যবর্তী স্থান হতে
অনিন্দসুন্দর গীরিখাদ দর্শন করি। পাতুরে পাহাড়ের বনের ঝিঁ ঝিঁ পোকার অপূর্ব
শব্দধ্বনী কর্ণকে মোহিত করে। উপরে রাস্তায় এসে উল্টো দিকে পাতরের উপর বয়ে চলা
অপূর্ব ঝর্ণাধারা। ঝর্ণার পারে কমলা ও লেবুর বন। নানা প্রজাতির ফুলের মেলা। এখানে
দোকান নিয়ে বসা খাসিয়া মহিলাদের দোকানে চা বিস্কুট খেয়ে রওয়ানা হয়ে সেভেন সিস্টার
জলপ্রপাতে পৌঁছি। এখানে সাতটি জলপ্রপাতের পানি মাইল দেড়েক নিচে ছিটকে পড়ছে। ছোট
ঝর্ণার ঝক ঝকে নীল পানি এসে নিচে নামছে। একটু দুরে নিচে বাংলাদেশের জলাভূমি
দৃষ্টিগোচর হয়। এখানে পাহাড়ের ভিতর দিয়ে বয়ে যাওয়া এক ঝর্ণা সুড়ংপথে দৃষ্টিগোচর
হয়। এখানে জলপ্রপাতের পানি কনায় সৌররশ্মি পড়ে রংধনুর সৃষ্টি করে। প্রকৃতির এই অপার
সৌন্দর্য্য দেখে মহান আল্লাহর প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে। সবশেষে চেরাপুঞ্জির
বাংলাদেশ সীমায় এসে পৌঁছে পাতরের উপর জোহরের নামাজ পড়ি। সামনে এক অপূর্ব পাহাড়
একজন মানুষের মত দাঁড়িয়ে আছে। এই পাহাড়ের মাথার উপর মনে হয় এক ফলের ঝুড়ি চাপানো।
এযেন প্রকৃতির এক বিচিত্র সৃষ্টি। ঐ ঝুড়িওয়ালা পাহাড়কে ঘিরে গড়ে উঠেছে খাসিয়া
উপাখ্যান- শুনলাম ড্রাইভারের মুখে, প্রাচীন কালে এক দৈত্য এসে
খাসিয়া জনপদে হানা দিয়ে মানুষের খাবার কেড়ে নিত। একদা মানুষ অতিষ্ট হয়ে দৈত্যের
খাবারে বিষ মিশিয়ে দেয়। দৈত্য খাবারে মুখ রেখে ঝুড়িটি ঐ পাহাড়ে রেখে পালিয়ে যায়।
তখন হতে দৈত্যের এই খাবারের ঝুড়ি যুগ যুগ ধরে পাহাড়ের শিরোভাগে আটকে রয়েছে। তারপর
সুমোগাড়ি চলে আসে মাওসমাই গোহায়। শক্তপাথরের পাহাড়ের এই গোহার ভিতর প্রায় ৩০০ ফুট
সুড়ঙ্গ পথে অন্ধকারে বৈদ্যুতিক বাতির ব্যবস্থা রয়েছে। উপরের দিকে পাহাড় চুষে পানি
ঝরছে। গোহামানবের কথা ইতিহাসে পড়েছি। এই প্রথম গোহামানবের আবাসস্থল পার্বত্য গোহা
দেখলাম। তিনশত ফুট সুড়ঙ্গ অতিক্রম করে পাহাড়ের অন্যপাশ দিয়ে বেরিয়ে এলাম। কোথাও
প্রশস্ত কোথাও সংকীর্ণ গোহার পথ। জীবন্ত অবস্থায় কবরের মধ্যে হাঁটার অভিজ্ঞতা নেই। সুড়ঙ্গের মধ্যে দুইটি স্টিলের সেতুও রয়েছে। স্রষ্টার সৃষ্টির এই অপূর্ব
নিদর্শন দেখানোর জন্য আবারও মহান আল্লাহকে ধন্যবাদ জানাতে হয়। সুড়ঙ্গ হতে বের হয়ে
আমরা দুই পরিবারের ৬ জন বাইরের হোটেলে খাবার খাই। খাসিয়াদের রান্না অপূর্ব। টমেটো
সুপ। আমাদের সুনামগঞ্জের হাওরের বড় মাছ ও মোরগ। ড্রাইভারদেরকে হোটেল মালিকগণ ফ্রি
খাবার দেন। খাবার শেষে চলে আসি শিলং শহরের নিকটস্থ ইলিফেন্ট জলপ্রপাতে। ক্যালেন্ডারে
শিল্পীর আঁকা জলপ্রপাতের চেয়েও সুন্দর এই জলপ্রপাত। বিশাল জলধারা সুউচ্চ পাহাড় হতে
নিচের মধ্য পাহাড়ে ও মধ্যপাহাড় হতে একদম নীচের আরেক পাহাড়ে নেমে আসছে। বিশাল
জলধারা ও অপূর্ব তার সুর। জলপ্রপাতের উপর দিয়ে এক পাহাড় হতে অন্য পাহাড়ে যাবার
ঝুলন্ত সেতু। সেই সেতু পার হয়ে শতাধিক সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এক অপূর্ব স্বর্গীয়
সুষমা। এই জলপ্রপাত ভারতের সর্ব শ্রেষ্ঠ জলপ্রপাত। এই অনিন্দ্য সুন্দরের স্রষ্টা
মহান আল্লাহকে আবারও ধন্যবাদ।
আমরা সন্ধিবিচ্ছেদে
পড়েছি মেঘ+আলয়=মেঘালয়। মেঘালয় একসময় আসাম রাজ্যের অংশ ছিল ও বৃহত আসামের রাজধানী ছিল শিলং।
১৯৭২ সালে মেঘালয় আলাদা রাজ্যের মর্যাদা লাভ করে। অনিন্দ্যসুন্দর মেঘের দেশ হিসেবে
ভারতীয়রা রাজ্যটির এই কাব্যিক নাম রাখেন ‘মেঘালয়’। এটি দারুণ এক সৌন্দর্যময় উপত্যকা। ঘাসের জমি, জলপ্রপাত, পাহাড়, সর্পিল পাহাড়ী নদী, ঢালুখাদ আর আকর্ষণীয় এর বন্য জীবন। আসলে
মেঘালয় পর্যটকদের কাছে “স্বপ্ন হল সত্যির এক রাজ্য”।
শিলং শহরে কোন রেল
সড়ক নেই। নর্থইস্টের সাত রাজ্যের লোকজন আসামের রাজধানী গৌহাটিতে এসে ট্রেনে উঠেন ও
চলে যান ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে। আমি ইতিমধ্যে শিলংয়ে ভারতীয় রেলওয়ে কাউন্টার হতে
বিদেশী কোঠায় গৌহাটি হতে দিল্লির আনানবিহার স্টেশনের টিকেট সংগ্রহ করি। নর্থইস্ট
এক্সপ্রেস ট্রেন ছাড়বে ৯ সেপ্টেম্বর ২০১২ইং সকাল সাড়ে নয়টায়।
১৯০০ কিলোমিটার দীর্ঘ রাস্থা পার হবে ৩৬ ঘন্টায়। ৮ সেপ্টেম্বর শনিবার সকালের খাবার
খেয়ে ধীরে সুস্থে শিলংয়ের গৌহাটি বাস টার্মিনালে চলে আসি। সুমো জিপ একটার পর একটা
গৌহাটির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হচ্ছে। একটি জিপের মধ্যভাগের তিন সিট জুড়ে বসলাম। ভাড়া
জনপ্রতি ১৫০ রুপি। ১২টা নাগাদ বাস ছেড়ে দিল। জিপের ড্রাইভারের পিতামহ বৃটিশ আমলে
নোয়াখালী জেলা হতে আসামে আসেন। আমরা বাংলাদেশের লোক জানতে পেরে খুব আদর যত্ন করলেন। অভয় দিলেন, চিন্তার কারণ নেই, হোটেল পর্যন্ত পৌঁছে দিবেন। বাস ছেড়ে দেওয়ার কিছুক্ষণ পর শহরের বাহিরে এক
বিশাল নজরকাড়া সুন্দর পাহাড়ী লেইক দৃষ্টিগোচর হয়। পানি টলটলে নীল। হৃদ হতে রাস্তা
পর্যন্ত প্রসারিত অপূর্ব সুন্দর পাইন ও ফার্ন বন। পাতরের পাহাড়ে পাইনের বন শিলংকে
এক অপূর্ব সুন্দরের রানী করে সাজিয়ে রেখেছে। সুন্দর নীল হৃদ, পাইন বন, সবুজ পাহাড় আপন আপন সৌন্দর্য্য মেলে ধরে একাকার হয়ে গেছে শিলং গৌহাটি রোডে।
মনে হল- বাস ছাড়ার পর হতে ক্রমে ক্রমে বাসটি নিচের দিকে নেমে আসছে। ঘন্টা দেড়েক পর
সুন্দর লেকের উপর একটি ঝুলন্ত সেতু অতিক্রম করি, আর ঘন্টা খানেক পর হ্রদটির অন্যপারের
সমতলভূমিতে নেমে আসে বাস। লেকের মধ্যে ভাসমান অসংখ্য মনোরম পাহাড়ের দৃশ্য
দৃষ্টিসীমায় ভেসে উঠে। এখান হতে মেঘালয় শেষ, আসামের শুরু। কোথাও
পাহাড়ি রাস্তা আবার কোথাও সমতল ভূমি বেদ করে জিপটি অগ্রসর হতে থাকে। কোথাও পার্বত্য
জনপদ আবার কোথাও আমাদের দেশের দরিদ্র গ্রামগুলোর মত অনগ্রসর গ্রাম। রাস্তার ধারে
একটি দু’তলা হোটেলে খাবার খেয়ে আবার যাত্রা শুরু। বিকাল প্রায় ৬ টায় গৌহাটি নগরে জিপটি
প্রবেশ করে। বিশাল প্রশস্থ রাস্তা, মধ্যভাগে ডিভাইডার।
যানজট নেই। ট্রেনলাইনের উপর দিয়ে বাস লাইন। বাস লাইন গুলোকে ক্রসলাইন করে উপর নিচ
করে দেয়া। ফলে গৌহাটি শহরটি এক বৃহৎ শহর হওয়া সত্ত্বেও যানজটমুক্ত। শিলং শহরটি
শিলং পিক (উচু চূড়া)
হতে দেখে মনে হয়েছে হয়তো আয়তনে সিলেট শহরের মত হবে। এর
লোকসংখ্যা ১৫/১৬ লক্ষ। অন্যদিকে গৌহাটি শহরকে অনেক বড় শহর মনে হয়েছে। আমাদের চট্টগ্রাম
শহরের মত হবে। অতীতের প্রাগজ্যেতিষপুর আজ হয়েছে গৌহাটি শহর। গুয়া হচ্ছে সুপারি আর
হাটি হচ্ছে হাট, অর্থাৎ সুপারিহাট হচ্ছে গোয়াহাটি বা
গৌহাটি।
আসাম তথা সমগ্র নর্থইস্টের প্রবেশদ্বারও এই গৌহাটি।
ব্রহ্মপুত্র নদের দক্ষিণ তীরে ৫৫ মিটার উচুতে শহরটি গড়ে উঠেছে। ব্রহ্মপুত্রের শোভা
খুবই সুন্দর। সুমোর ড্রাইভার আমাদেরকে দুইটি হোটেলে নিয়ে যান। নিজে ব্যাগটি বহন
করেন। অথচ বিদেশী জেনে কেউ রুমভাড়া দিতে রাজি হয়নি। সবশেষে এক রাতের জন্য ২২০০ রুপি
ভাড়ায় সিটি হোটেলের এক্সক্লুসিভ রুম ভাড়া নেই। গৌহাটি বড় শহর। ভবনগুলো দূরে দূরে ছড়ানো। জাম নেই, রিকশা অল্প। হোটেলের জানালা দিয়ে গৌহাটি স্টেডিয়াম দেখা যায়। খুব সুন্দর
স্টেডিয়াম। সাজানো গোছানো ফুলের বাগান। ফুটবল মাঠের চতুর্দিকে ফুলগাছ লাগানো ও
রাস্তা ঘেরা এ যেন স্টেডিয়াম কাম পার্ক। ভোরে অসংখ্য মানুষকে স্টেডিয়াম পার্কে হাঁটতে
ও দৌড়াতে দেখি। সময় স্বল্পতায় গোয়াহাটি শহর ঘুরে দেখা হয়নি। অথচ ঢুকার সময় প্রায়
এক ঘন্টা জিপটি শহর প্রদক্ষিণ করে আসে। ফলে শহরটিকে মোটামোটি জরিপ করে নেই। রাতে এক বাঙ্গালী হোটেলে খাবার খাই। আমরা বাঙ্গালি হিসেবে হোটেলের বাঙ্গালি
লোকজনের আলাদা সেবা পাই। রিন্টু নামের এক যুবকের সাথে দেখা হয়। তার পরিবার ১৯৬৫
সনে সিলেট ছেড়ে গৌহাটি চলে আসেন। আহমরা তাদেরকে বাঁকা চোখে দেখে। তিনি একবার
সিলেটের মদীনা মার্কেটে এসে আত্মীয় স্বজনদেরকে দেখে গেছেন। তিনি হিসেব মেলাতে
পারছেন না-
তার পূর্বপুরুষরা বাংলাদেশ ছেড়ে গিয়ে সঠিক কাজটি করেছেন কি
না? আসামীদের ভাষা ‘অহম’। তাদের
ভাষা বাংলা অক্ষরে লিখা হয়। কেবলমাত্র দু’একটি অক্ষরের আকার একটু
ভিন্ন রয়েছে। অহম ভাষায় সিলেটের আঞ্চলিক ভাষার শব্দাবলীর প্রাধান্য রয়েছে। হোটেলে
অহম পত্রিকা পড়ি। পত্রিকাটি বাঙ্গালি বিদ্বেষী মনে হয়েছে। বৃটিশ আমলে অনেক বাঙ্গালি
আসামের জনবিরল এলাকায় বসতি স্থাপন করেছেন। তাহাদের ধারণা এখনও বাংলাদেশের লোকেরা
তাদের অঞ্চলে ঢুকে পড়ছে। আমি কয়েকজনকে বলেছি, আমাদের বাংলাদেশের
পারিপার্শ্বিক অবস্থা আসামের চেয়ে কোনভাবে খারাপ নয় কাজেই বর্তমানে কেন আসামে আসবে
বাংলাদেশীরা। এখন আমেরিকা, বৃটেন, ক্যানাডা, মধ্যপ্রাচ্য মায়লশিয়া এসব উন্নত দেশে তাঁরা যাচ্ছে। আসামে গিয়ে তাদের পাবার মত
কিছু নেই। বর্তমানে যে সব বাঙ্গালি আছেন তারা বৃটিশ আমলে যখন উভয় অঞ্চল এক দেশ ছিল
তখন গিয়েছেন, এখন যাবার প্রশ্নই উঠে না। আমাদের দেশেও অনেক খাসিয়া মনিপুরী ইত্যাদি লোকজন
রয়েছেন এসব নিয়ে বাংলাদেশীদের কোন মাথাব্যাথা নেই। আসামের মুখ্যমন্ত্রী অরুন গগই।
ভোরে গৌহাটি শহরে একাকি হাঁটছি। একজন ব্রাহ্মন অত্যন্ত মমতার সহিত আমার কপালে একটি
লাল টিপ আঁকে দেন। আমাদের হুজুররা যেমন আতর বিতরণ করেন, বিষয়টি আমার কাছে তেমনটিই মনে হল। ভদ্রলোক যদি মনে ব্যাথা পান তাই বাঁধা দেই নি।
টিপ নিয়ে ফিরে আসি হোটেলে। সকালের নাস্তা সেরে সামনে গৌহাটি রেলস্টেশনে প্রবেশ
করি। স্টেশনটি আমাদের কমলাপুর রেলস্টেশন হতেও অনেক বড়। একটি ওভারব্রীজের উপর দিয়ে
যেতে হয়। ষোলটি টার্মিনালে নামার জন্য ওভারব্রিজ হতে সিঁড়ি নেমে এসেছে। ষোল নম্বর
টার্মিনাল হতে আমাদের নর্থইস্ট এক্সপ্রেস ট্রেন দিল্লির উদ্দেশ্যে ছাড়বে।
এবার ভারতের রেলপথ
নিয়ে দু’একটা কথা বলবো। ১৯৪৭ সালের পর হতে আমাদের রেল যখন ক্রমান্নয়ে তলিয়ে যাচ্ছে, ভারতীয়রা সেই রেলকে যুগোপযুগী করে এক অত্যাধুনিক আরামদায়ক কার্যকর যোগাযোগ
মাধ্যমে পরিণত করেছে। ভারতীয় রেলের শক্ত বাঁধনে বিশাল ভারত একাকার হয়ে গেছে।
ভারতীয় ট্রেন আকারে
বিশাল। প্রস্থে আমাদের ট্রেনের দেড়গুণ, উচ্চতায়ও তাই। বগিগুলো
ডাবল আংটা দিয়ে জাড়ানো হয়। প্রতিটি যাত্রির টিকেটে একটি বাসার সিট ও একটি ঘুমানোর
সিট বরাদ্ধ করা হয়। যাত্রিরা বসে কিংবা শুয়ে শুয়ে ভ্রমন করতে পারেন।
ভারতীয় ট্রেনের কোন
বগি টার্মিনালের কোথায় দাঁড়াবে তাও কম্পিউটার সাইনবোর্ডে ভেসে উঠে। প্রতি বগির
যাত্রিরা নিদৃষ্ট স্থানে স্থানে প্রস্তুত থাকেন। ও সহজেই নিজ নিজ কম্পার্টমেন্টে
উঠে পড়েন। বাংলাদেশের রেলওয়ে তাদের তুলনায় যে কোথায় আছে কে জানে। নর্থইস্ট এক্সপ্রেস
ট্রেনে আমার কোচ নং # এস-৯, সিট-৫৮ ইউ/বি। এখানে বসার সিট নং ৫৮ ঘুমানোর ইউ.বি অর্থাৎ আপার বেড।
২০১২ সালের ৯
সেপ্টেম্বর সকাল ৯.৩০ মিনিটে ট্রেন দিল্লির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু
করে। নানা ধর্ম বর্ণ ও নৃতাত্বিক মানুষ ট্রেনের যাত্রি। অনেক অনেক মাতৃভাষার লোক
হিন্দির মাধ্যমে সহজেই পরস্পর যোগাযোগ বজায় রাখছেন। আসলে প্রয়োজনীয় ৫০/৬০টি
হিন্দি শব্দ জানা থাকলেই আমার মনে হয়েছে সমগ্র ভারতবর্ষে নির্বিঘ্নে চলাচল সম্ভব।
রেলগাড়ি জমাজম, পা
পিছলে আলুর দম, গেয়ে গেয়ে দ্রুত পশ্চিম দিকে যাচ্ছে। বাংলাদেশের উত্তর সীমানা
বরাবর রেলপথ। পথে কামাক্ষ্যা, কামতাপুর, ব্রহ্মপুত্র নদ পার হয়ে পশ্চিম বঙ্গের নিউ কুচবিহার প্রবেশ করি। পরে আসে
নিউজলপাইগুড়ি এখন হতে দার্জিলিং যাবার পথ রয়েছে। পরে ট্রেন
ভারতের বিহার রাজ্যে প্রবেশ করে। ধীরে ধীরে রাত্রি নেমে আসে। সব যাত্রীরা সিটে
সিটে ঘুমিয়ে পড়েন। ট্রেনে পিনপতন নিরবতা নেমে আসে। ঝিকির-ঝিকির
শব্দে সারারাত ট্রেন চলে যায়। ঘুম যখন ভাঙ্গে আমরা তখন ভারতের সর্ববৃহৎ রাজ্য
উত্তর প্রদেশে সংক্ষেপে ইউ.পিতে এসে গেছি। এই ইউ.পিতে
বিশাল ভারতের রাজধানী দিল্লির অবস্থান। পথে পড়ে গান্ধি পরিবারের আসন এলাকা
এলাহাবাদ। তারপর কানপুর অতঃপর আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় খ্যাত শহর আলীগড়। এখানে
একজন যাত্রীকে প্রশ্ন করি দিল্লি আর কাহাতক দূর হ্যায়। ভদ্রলোক উত্তর দিলেন- তুড়াই
দূর হ্যায়। ধরে নিলাম হয়তো দিল্লির কাছে চলে এসেছি। কিন্তু রাস্তাতো আর ফুরায় না। শেষমেষ
জানলাম এখনও ৩/৪ শত কিলোমিটার পথ বাকী আছে। আসলে বিশাল ভারত
রাষ্ট্রের লোকজনের কাছে আমাদের সিলেট শহর হতে চট্টগ্রাম বা ঢাকার দূরত্ব কিছুই না, তুড়াই দূর হ্যায়। তাদের দ্রুতগামী ট্রেন এই সব দূরত্ব নিমিষেই পার হয়ে যায়। ৩৬
ঘন্টার দীর্ঘ্য যাত্রা শেষে ১০/০৯/২০১২ সোমবার রাত ৮ টায়
দিল্লির সন্নিকটে আনানবিহার স্টেশনে নেমে পড়ি। আমরা পূর্বেই নির্ধারণ করে আসি
দিল্লি রেলস্টেশনের নিকটস্থ ‘বিশাল’ হোটেলে উঠব।
আনানবিহার স্টেশনে নামামাত্র দালালরা তাদের হোটেলে নিয়ে যাবার জন্য ঘিরে ধরে।
কোনমতে একটি বেবিটেক্সি রিজার্ভ করে ৩০/৩৫ মিনিটে ‘বিশাল’ হোটেলে
চলে আসি। হোটেলের তিন তলায় বড় একটি এসি রুম নেই। ভাড়া প্রতিদিন ৮০০ রুপি। হোটেলের
মালিক কাশ্মিরি মুসলিম। হোটেলে একজন বাঙ্গালি কর্মচারী রয়েছে। হোটেলের মালিক দিল্লি
সাইট সিয়িংয়ের অর্ডার গ্রহণ করেন। তাকে এসি বাসে দিল্লি ভ্রমণের বিল বাবদ তিনজনে
৯০০ রুপি প্রদান করি। পরদিন সকাল ৬টা হতে রাত ৯.৩০ মিনিট পর্যন্ত
এসি বাসে দিল্লির স্থাপনাসমূহ ঘুরে দেখব। রাতে খাবার খেয়ে গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন
হয়ে পড়ি। খুব ভোরে ঘুম ভেঙ্গে যায়। গাইড এসে আমাদেরকে নিয়ে যাত্রা শুরু করে পথে
পথে অন্য হোটেল গুলোর পর্যটকদেরকে নিয়ে বড় রাস্তায় চলে আসে। রাস্তায় কুকুর নিয়ে
শিখরা প্রাতঃভ্রমণ করছেন। মন্দিরে পুজারীরা পুজা দিচ্ছেন। ইতিমধ্যে এক বিশাল এসি
কোচে আমাদেরকে উঠানো হয়। সেদিন ছিল ১১ সেপ্টেম্বর ২০১২, মঙ্গলবার। ওড়িশি নির্মাণ শৈলীতে ১৯৩৮ সালে বলদেও বিড়লা লক্ষিনারায়ণ মন্দির
নির্মাণ করেন। বিড়লা মন্দির নামেও পরিচিত। মন্দিরের বাহিরে বিশাল ঐতিহাসিক চত্বরে
সম্রাট চন্দগুপ্ত মৌর্য্য, সম্রাট অশোক ও শিখরাজ রনজিৎ সিংয়ের ভাস্কর্য্য
রয়েছে। আর আছে সর্পদেবী, হনুমান ও বানরের মূর্তি। তারপর দেখি ইন্ডিয়া গেট ও সংসদ
ভবন। স্যার লুথিয়েন্সের নকশায় ১৯১৩ সালে ৪২ মিটার উঁচু ইন্ডিয়া গেট স্থাপন করা হয়।
এখানে চারপাশে বিশাল উদ্যান। ভারতীয় সংসদ ভবনের চেয়ে আমাদের জাতীয় সংসদভবন অনেক
বেশী সুন্দর, যদিও আমাদের সংসদ ভারতীয় সংসদের মত সুষ্ঠুভাবে কার্য্যকর নয়। আমাদেরকে নিয়ে
আসে ইন্দিরা গান্ধীর বাসভবনে। সাদামাঠা ভবন। এখানে ইন্দিরা গান্ধি বসবাস করতেন।
তার দুইপুত্র সঞ্জয় গান্ধি ও রাজিব গান্ধি এ বাড়িতে বড় হন। ভবন হতে ১০০ গজ দূরে
তার অফিস গৃহ। অফিসে যাবার রাস্তায় তিনি তার শিখ দেহরক্ষীর গুলিতে নিহত হন। ঐ
রাস্তাটিকে ঢেউ ঢেউ কাচ দিয়ে মৃদুমন্দ তরঙ্গ ভরা নদীর রূপ দেওয়া হয়েছে। যেখানে তার
মৃত্যু হয় সেইস্থানটি কালো মার্বেল পাথরে ঢাকা রয়েছে। ইন্দিরা গান্ধি যাদুঘরে
ইন্দিরা গান্ধির ব্যবহৃত শাড়ি, গহনা, ক্রেষ্ট, তৈজসপত্র সযতনে রক্ষিত রয়েছে। বিশাল বাড়িটা বর্তমানে একটি সংরক্ষিত বাগান
যেখানে অসংখ্য কাটবিড়ালী সর্বক্ষণ লাফিয়ে বেড়ায়। ইন্দিরা গান্ধি যে এক বিশাল মাপের
ব্যক্তিত্ব ছিলেন তা যাদুঘর ঘুরে তার জীবনযাত্রা পর্যবেক্ষণ করলেই বুঝতে পারা যায়।
এবার আসি কুতুব মিনারে। ভারতে প্রথম মুসলিম বিজয়ের স্মারক হিসেবে গজনির নির্মাণ
শৈলীর অনুকরণে ভারতের প্রথম মুসলিম শাসক কুতুবউদ্দিন আইবেক ১১৯৯ সালে মিনারটির
নির্মাণ কাজ শুরু করেন, শেষ হয় ১২৩৬ সালে তার জামাতা সম্রাট
ইলতুৎমিশের হাতে। মিনারটির উচ্চতা ৭২.৫ মিটার। ঘোরানো সিড়ি উঠেছে
৩৬৭ ধাপের সামান্য হেলে থাকা কুতুব মিনারে। আকারেও বৈচিত্র আছে গোড়াতে ব্যাস ১৪.৪০
মিটার ক্রমশ সরু হয়ে শেষ হয়েছে ২.৪৪ মিটারে। মিনারের নিচুতে ১১৯৭ সালের
একটি মসজিদ রয়েছে। মসজিদটিতে আমরা তিনজন নামাজ আদায় করি। মিনারটি লাল বেলেপাতরে
তৈরি ও বহিদেয়ালে আরবি হরফে পবিত্র কোরানের আয়াত উৎকীর্ণ রয়েছে। ১৩১১ খ্রিস্টাব্দে
কুতুব মিনারের নিকট সম্রাট আলাউদ্দীন খলজি লাল বেলে পাতরে তৈরি করেন আলাই দরজা।
বাইজেন্টাইন তুরস্ক হতে ভাস্কর এনে সম্রাট আলাউদ্দিন ভারতে প্রথম ধনুকাকৃতি
খিলানের প্রচলন করেন। সম্রাটের সমাধি রয়েছে আলাই দরজার ডাইনে। কুতুবমিনারের উত্তরে
আলাউদ্দীনের অপূর্ণ স্বপ্ন ২৭ মিটার উচু আলাই মিনার। তার স্বপ্ন
ছিল কুতুবের দ্বিগুন উচু মিনার গড়ার। তবে মৃত্যু সময় দেয়নি, এবং যোগ্য উত্তরসূরীর
অভাবে একতলাতে অপূর্ণ থাকে সে দুঃস্বপ্ন। ইলতুৎমিস ১২৩৫ সালে এবং আলাউদ্দিন খিলজি
১৩১৬ সালে এখানে সমাধিস্থ হন। কুওয়াতের পশ্চিমে ইলতুৎমিস নিজেই গড়ে তুলেন ইন্ডো-ইসলামিক
শৈলীতে নিজের সমাধিসৌধ। এখানে উল্লেখ্য যে দিল্লির সম্রাট আলাউদ্দিন খলজির
রাজত্বকালে ১৩০৩ সালে হজরত শাহজালাল(র:) সিলেট আসেন।
পথে একটি মার্কেটে
গাড়ি থামিয়ে বিশাল বিপনীবিতান পরিদর্শন করান হয়- যেখানে কাপড়, গহনা, হেন্ডিক্রাফটসহ সব ধরণের প্রয়োজনীয় পন্যসামগ্রী রয়েছে। পথে গাড়ি হতে ৩৩০ একর
জমি জুড়ে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রপতি ভবন দেখে নেই। এখানে কৃত্রিম পাহাড়, বাগিচা, ঝরনা ও জলাশয়ের ১৩০ হেক্টরব্যাপ্ত মোগল উদ্যানটিও রমণীয়।
গাড়ী থামিয়ে
আমাদেরকে মহাত্মা গান্ধির সমাধি দেখানো হয়। বিশাল এক বাগানের মধ্যে সমাধিটি
স্থাপিত। একটি বড় কৌঠায় গান্ধির দেহভষ্ম রেখে একটি বিশাল প্যান্ডেলে সযতনে সাজিয়ে
রাখা হয়েছে। প্যান্ডেল জুড়ে তাজা ফুলের সমারোহ। ইতিমধ্যে আসরের সময় পার হয়ে যায়।
আমরা একটি বাহাই মন্দির পরিদর্শনে যাই। বাহাই ধর্মের আবির্ভাব ইরানে। পরবর্তীকালে
তাদের অনেকে দিল্লি চলে আসে। মন্দিরটির চারপাশ বিশাল চত্বর। তাদের কর্মীরা সবার
জুতো খুলে বস্তায় পুরে রেখে দেয়। ঢুকার পূর্বে বাহাই পুরুষ ও মহিলা পুরহিতরা উপদেশ
দিয়ে মানুষকে লাইনবদ্ধ করে মন্দিরে ঢুকান। মন্দিরটি পুরু কাঁচঘেরা ও সীমাহীন নীরবতাতাময়।
অসংখ্য চেয়ার বসানো। চেয়ারে বসে প্রার্থনা করে সবাই বেরিয়ে আসে।
ইতিমধ্যে রাত নেমে
আসে গাড়িটি লালকেল্লার পাশ দিয়ে শহরের দিকে ধাবিত হয়। লালকেল্লার ইতিহাস বলে যায়
গাইড। লালকেল্লার নির্মাণ কাজ শুরু করেন বাদশা আকবর। নির্মাণ কাজ সমাপ্ত করেন তার
নাতি সম্রাট শাহজাহান ১৬৪৮ সালে। এখানে সর্বপ্রথম স্বাধীন ভারতের জাতীয় পতাকা
তুললেন পন্ডিত জওহর লাল নেহেরু। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জাতির
উদ্দেশ্যে লালকেল্লা হতে নেহেরু ভাষণও দিলেন।
দিল্লি বিশাল শহর।
সকাল হতে রাত ১০টা পর্যন্ত ঘুরে এতটুকুই দেখা সম্ভব হয়েছে। আরও অনেক কিছু দেখার
বাকী রয়ে যায়। যেমন নিজাম উদ্দিন আউলিয়ার মাজার, বাদশাহ
হুমাউনের সমাধি, দিল্লি জামে মসজিদ ইত্যাদি। রাতে পরদিন আগ্রা
ভ্রমণের জন্য বুকিং দেই। খুব ভোরে গাইড এসে আমাদেরকে নিয়ে যায়। আমরা পনের বিশজন
একটি শীতোতাপ নিয়ন্ত্রিত গাড়িতে উঠি। দিল্লি শহর হতে বেরিয়ে আসতে একটু জামের কারণে
ঘন্টাখানেক পার হয়ে যায়। দিল্লি হতে আগ্রার দূরত্ব প্রায় ২০০ কিঃমিঃ। মধ্যভাগে একটি হোটেলে উত্তর প্রদেশীয় বিচিত্র
স্বাধের রান্না করা তুন্দুর রুটি ও বুটভাজা খাই। তরল পানিয় পরিবেশন করা হয়। একটা
নাগাদ আগ্রা শহরে প্রবেশ করি। দিল্লি শহরের মত বিরাট না হলেও আগ্রা ভারতের
রাজধানীর মর্যাদায় বিভিন্ন সময় অধিষ্টিত ছিল। এখানে প্রাচীন পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্য্যের
অন্যতম তাজের অবস্থান। মোগল স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের লীলাক্ষেত্র এই আগ্রা। বিখ্যাত
উর্দু কবি মির্জা গালিব (১৭৯৭ইং-১৮৭০ইং) ও
উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের আগ্রা ঘরানার জনক ওস্তাদ ফৈয়াজ খানের জন্মও এই আগ্রায়। মোগল
শাসনামলে ২/৩ বার রাজধানী বদল হলেও শেষ পর্যন্ত আগ্রাই সম্রাটদের মূল আবাসস্থলের মর্যাদা
লাভ করে। আমাদের গাড়ি আগ্রা দূর্গের সামনে এসে থামে। আগ্রা শহরের কেন্দ্রস্থলে
১৫৬৫-৭৩ সালে লাল বেলেপাতরে আকবরের হাতে দুর্গটি তৈরী হয়। দূর্গটির মেঝে ও ছাদ লাল
পাতরের তৈরি। ৪০ পিলারে ভর করা মর্মরে অলংকৃত প্যাভিলিয়ানে সুসজ্জিত সিংহাসনে বসে সম্রাট
প্রজাদের কথা শুনতেন। ১৬০৯ সনে এই দরবারে এসে ইংলিশ প্রতিনিধি উইলিয়াম হকিন্স
সম্রাট জাহাঙ্গীরে সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করেন। তৎকালীন যুগের ভি.আই.পি
ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে ভারত সম্রাটগণ এপয়েন্টমেন্ট করতেন দেওয়ান এ খাসে। বিখ্যাত
ময়ূর সিংহাসনটিও দেওয়ান এ খাসে স্থাপিত ছিল। যাহা পরবর্তীকালে ইরানের শাসক নাদির
শাহ লুণ্ঠন করে নিয়ে যান। দেওয়ান ই খাসের ঝরোখা ও লতার কাজও সুন্দর। দক্ষিণ সিড়ি
নেমেছে তেহখানায়, যেখানে গ্রীষ্মে মাঠির নিচে ঠান্ডা ঘরে
থাকতেন সম্রাট। বিপরীতে বাগিচা ও পূর্বে শিশমহল অর্থাৎ বেগমদের গোসল ঘর। তুর্কিশ
শৈলীতে তৈরী মহলের দেওয়াল ও ছাদ এমনভাবে কাঁচে মোড়া যে একটি বাতি সহস্র বাতি হয়ে
দেখা দেয়।
দেওয়ান ই খাস সংলগ্ন
বেগম মমতাজের জন্য শাহজাহানের তৈরি মনিমাণিক্য খচিত দ্বিতল অষ্টকোণী টাওয়ার। ভাতৃঘাতক
পুত্র ঔরঙ্গজেবের হাতে বন্দি পিতা শাহজাহানের জীবনের শেষ ৮ বছর (মৃত্যু
১৬৬৬ সন) যমুনায় তাজের প্রতিবিম্ব দেখে কাটিয়ে দেন এই টাওয়ারে। দক্ষিণে রয়েছে খাসমহল- সম্রাটের
বিশ্রাম তথা শয়নকক্ষ। অদূরেই মোগল দরবারের মহিলাদের জন্য তৈরী শ্বেতমর্মরের নাগিনা
মসজিদ। শিরে তিনটি গোল গম্বুজ। মীনাবাজার বসত সেকালে দুর্গের মেয়েদের জন্য নিচের
প্রাচীরঘেরা চত্বরে। এখানে ক্রেতা বিক্রেতা সবাই ছিলেন মহিলা।
অগ্রাদূর্গ দেখা শেষ
হলে আমাদের গাড়িটি একটি হোটেলে গিয়ে থামে। বিরাট দুতলা হোটেলটিতে রয়েছে নানান
নামের উত্তর প্রদেশীয় খাবার। মেনু হাতে নিয়ে নাড়া চাড়া করি। খাদ্য তালিকায় নিরামিষ/ পনির/ সবজি
ইত্যাদির প্রাধান্য। শেষ পর্যন্ত খাবার দেখিয়ে অর্ডার দেই। এখানে বাথরুম ব্যবস্থাও
ভাল। খাবার-দাবার শেষ হলে আমাদের ভারত ভ্রমণের সেরা আকর্ষণ তাজমহলের দিকে গাড়িটি ধাবিত হয়
ও কিছুক্ষণের মধ্যে তাজমহলের বহিগেটে থামে। বহিগেট হতে তাজমহলের দূরত্ব অনেক। এখান
হতে প্রাচীন ঘোড়ার গাড়ি অথবা ছোট্ট পর্যটক গাড়িতে চড়ে তাজের মূল গেটে যেতে হয়।
সেখানে গিয়ে টিকেট করে লাইন ধরে অসংখ্য দেশী বিদেশী পর্যটকের সহিত মূল তাজমহল
চত্বরে প্রবেশ করি।
মোগল সম্রাট
শাহজাহানের অমর কীর্তি তাজমহল। সম্রাট তাঁর প্রধান বেগম মমতাজের সমাধির উপর তৈরি
করান প্রেমের এই সৌধ। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ইন্ডোপারসিক স্থাপত্যে গড়া শ্বেতমর্মরের
তাজ দেখতে বছর জুড়ে পর্যটকের ভীড় লেগে থাকে। পূর্ণিমার রাতে তাজ আলো বিকিরণ করে
চাঁদের মত সজীব হয়ে উঠে। নক্ষত্রখচিত কালো রাতে বা উষাকালে তাজের সৌন্দর্য মুগ্ধ
করে মানুষকে। ক্ষণে ক্ষণে রঙ্গের বদল ঘটে চন্দ্রিমা ও সূর্যালোকে। দুগ্ধধবল রূপালী রঙ্গ নেয়
উষায়, তারপর রূপালী থেকে গোলাপী লালে। চাঁদের আলোয় দূর হতে মনে হয় জাহাজ হয়ে তাজ
ভাসছে যমুনার জলে আর বিদায়ী চাঁদের পান্ডুর আলোয় তাজকে মনে হয় চলমান। সোনারঙ্গ ধরে
তাজ সূর্যাস্তে। তেমনি বৃষ্টিতে তাজের যেন রূপ বেড়ে যায়। স্বর্গসম তাজের এই সুষমা
মোহিত করে দর্শককে।
বাংলার মেয়ে আরজুমান
বানু ভারত সম্রাট শাহজাহানের বেগম হন। পরবর্তী কালে বাদশাহ তার উপাধি দেন মমতাজ
মহল। তাঁদের ১৭ বছরের বিবাহিত জীবনে ১৪তম সন্তানের জননী হতে গিয়ে ৩৮ বছর বয়সে ১৬৩১
সনের ১৭ জুন মারা যান। মৃত্যুর ৬ মাস পর বেগম সাহেবা স্থানান্তরিত হন বুরহানপুরের
সাময়িক সমাধি থেকে আগ্রায়। সম্রাট শাহজাহান মমতাজের মৃত্যুর এক বৎসর পর ১৬৩২ সালে
তাজের নির্মাণ কাজ শুরু করেন। ৫৮০ী৩০০ বর্গমিটার
পরিব্যাপ্ত তাজের নির্মাণ কাজ শেষ হতে সময় লাগে ২২ (১৬৩২-১৬৫৪ সাল) বছর।
২০ হাজার কর্মি একটানা বাইশ বছর কাজ করেন এবং খরচ পড়ে তখনকার দিনে ৪০ লক্ষ পাউন্ড।
টিটানস নামক এক স্থপতির নকশায় পারস্য হতে আসা ওস্তাদ ইসা তৈরি করেন এই তাজ। বাগদাদ, পারস্য, তুরস্ক ও মধ্য এশিয়া হতে বিশেষজ্ঞরা আসেন তাজ তৈরিতে। জনশ্র“তি
রয়েছে পরবর্তীকালে দ্বিতীয়টি গড়ার ভয়ে মূল নির্মাতাদের হাত কেটে চোখ অন্ধ করে দেন
সম্রাট শাহজাহান।
১৬৪৮ সালে লাল
বেলেপাতরে তাজের প্রবেশ তোরণ নির্মাণ করা হয়। অষ্ঠকোণী প্রবেশ দ্বারের শিরে ২২টি
মিনার হয়েছে তাজ তৈরির ২২ বছরের স্মারক রূপে। পশ্চিমদ্বার দিয়ে ভিতরে ঢুকতেই বায়ে
তাজ-মিউজিয়াম। ইসলামি প্রথায় গার্ডেন অব প্যারাডাইজ হয়েছে। বয়ে যেত সেকালে
বেহেস্তের নদী প্রবাহ জল, দুধ, মদ ও মধুর মিশ্রণে।
চলতে চলতে ফোয়ারার জলধারে তাজকে দেখে নেওয়া যায় প্রতিবিম্বে। যমুনার পারে প্রথমে
মার্বেল পাতরের মোড়া এক বিশাল চত্বরে অবর্তন করি। যাহা তাজের ২২ ফুট উঁচু প্যান্ডেলটির
পূর্ব ও পশ্চিম দিকে লাল বেলে পাতরের বিরাট দুইটি এবাদত খানা। এখানে আমরা যোহর, আসর ও মাগরিবের কছর নামাজ আদায় করি। তারপর সামনের দিকে এসে ২২ ফুট সিঁড়ি বেয়ে
তাজের বহির চত্বরে আরোহন করি। প্যান্ডেলটির চারকোনে চারটি বিশাল মিনার। এখানে
যমুনার অপরূপ দৃশ্য ও ঠান্ডা হাওয়া উপভোগ করি। দেশী বিদেশী অসংখ্য কপোত কপোতী
এখানে মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াতে দেখি। এখন মূল তাজগৃহে সামনের দিকে ঢুকে পড়ি ও ফটো
উঠাই। ঠিক মধ্যভাগে বামে শাহজাহান ও ডানে মমতাজের কবরের রিপ্লেকা দৃষ্টিগোচর হয়।
আসলে সম্রাট ও সম্রাজ্ঞীর প্রকৃত কবর ২২ ফুট নিচে রয়েছে। আমরা কবর দুটি জিয়ারত
করি। ভারতের বিভিন্ন ধর্মবর্ণের মানুষকে কবরের কাছে এসে নমস্কার জানাতে দেখি।
তাজের ভিতর দিয়ে হাঁটতে থাকি। ১৫/২০ মিনিট পর যেখান দিয়ে তাজে ঢুকি আবার
সেখানে এসে উপনীত হই। আমার তাজ দেখার স্বপ্ন পূর্ণ হওয়ায়, মহান আল্লাহর দরবারে শুকরানা আদায় করি।
সন্ধ্যার পর তাজমহল
হতে গাড়ি দিল্লির দিকে যাত্রা শুরু করে। আগ্রার রাস্তার সংযোগস্থল সমূহে মোগল
সম্রাটদের ঘোড়ায় চড়া ভাস্কর্য্য দেখা যায়। পথে মথুরায় রামের জন্মস্থান ও মন্দির
পরিদর্শন করি। এই মথুরা প্রাচীন যুগে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের তীর্থক্ষেত্র ছিল। তারপর
আসি বৃন্দাবনে। বৃন্দাবন হিন্দুদের তীর্থস্থান। অসুরদের
বিনাশ করে পৃথিবীতে স্নেহধর্ম প্রতিষ্ঠা করতে এখানে শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব হয়।
শ্রীরাধা ও শ্রীকৃষ্ণের বিহার স্থল-বৃন্দাবন। এখানে
হিন্দুধর্মের বৈষ্ণব ধারা পূর্ণতা লাভ করে। এখানকার মন্দির বিশাল। বাসের হিন্দু যাত্রিরা জয়
রাম, জয় কৃষ্ণ শ্লোগান দিয়ে মন্দিরে যান। আমরাও সাথে সাথে গমন করি। পূজারীরা পুজা
দেন। সবার কপালে চন্দনের টিপ দেওয়া হয়। সর্বধর্মের মানুষকে এখানে যথার্থ শ্রদ্ধা ও
সম্মান জ্ঞাপন করেন মন্দিরের লোকজন। শেষরাতে দিল্লিষ্টেশনে আমরা বাস থেকে নেমে পড়ি
ও বেবিটেক্সিতে করে ‘বিশাল’ হোটেলে চলে আসি। সকাল ৮ টায়
ঘুম থেকে উঠে নাস্তা সম্পন্ন করে নিউদিল্লি স্টেশনে এসে রাজধানী এক্সপ্রেস ধরি।
সেদিন ১৩ সেপ্টেম্বর ৯.৩০ মিনিটে রাজধানী এক্সপ্রেস গৌহাটির উদ্দেশ্যে
যাত্রা শুরু করে। আমার ইচ্ছে ছিল আরও ২/৩ দিন অবস্থান করে জয়পুর, আজমির ও দিল্লির অন্যান্য ঐতিহাসিক স্থাপনা দেখে আসব। কিন্তু বেগম সাহেবার আর
ভারত অবস্থানের ধৈর্য্য নেই। তিনি আর কষ্ট সইতে পারবেন না। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও
যাত্রা বিরতি দিয়ে ফেরত হই।
এবার ভারত ও
বাংলাদেশের মধ্যকার কিছু সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য নিয়ে আলোচনা করব। ভারত এক বিরাট দেশ, আয়তন বার লক্ষ ছিয়াত্তুর হাজার বর্গমাইল, যা প্রায় তেইশটি
বাংলাদেশের সমান। দেশটি লোকসংখ্যা ১২০ কোটি, যা বাংলাদেশের ৮ গুণ। আসলে ভারতকে রাষ্ট্র না বলে রাষ্ট্রপুঞ্জ বলা সমুচিন।
আমরা স্বল্পোন্নত দেশ হলেও তারা আমাদের চেয়ে একধাপ উপরে উন্নয়নশীল দেশ। আমাদের দেশে প্রতি বর্গমাইলে জনসংখ্যা প্রায়
৩০০০ জন, সেখানে ভারতে বাস করে প্রতি বর্গমাইলে ১০০০ জন। ভারতীয়দের মাথাপিছু আয়ও আমাদের
দ্বিগুণ। প্রতিটি ক্ষেত্রে উন্নয়নে ভারত আমাদের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। ভারতে ১২ দিন
অবস্থান কালে ভারতের প্রত্যন্ত এলাকা শিলংয়ে মাত্র অর্ধঘন্টা বিদ্যুৎ যেতে দেখেছি।
অথচ আমাদের দেশে প্রতিদিন ৩/৪ বার বিদ্যুৎ চলে যায়। ভারতের ট্রেন
সার্ভিস এতই উন্নত যে, কোন ভারতীয় আমাদের ট্রেনে উঠলে লজ্জা
পেতে হবে। আমাদের সরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের সেবার মান
নিম্নমানের অথচ ভারতে সরকারি ব্যবস্থাপনায় প্রতিষ্ঠানগুলো প্রসংশনীয় ভাবে পরিচালিত
হচ্ছে। ভারত বিশাল রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও সেখানে আমাদের মত দুর্নীতির তীব্রতা নেই।
এত ধর্ম বর্ণ ও ভাষার লোকজন হওয়া সত্ত্বেও ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবোধ ও দেশপ্রেম
প্রবল। পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদের একজন মুসলিম স্বস্ত্রীক তাজমহলে যান। তিনি
বললেন ভারতীয় হিসেবে তিনি সুখী ও গর্বিত। গৌহাটির উলুবাড়ীর রঞ্জন রায়ের অহংকার, তিনি একজন ভারতীয়। ভারতের লোকেরা কোন বিদেশী গাড়ি ব্যবহার করে না। এমনকি
মন্ত্রী, এম.পিরাও নিজ দেশে তৈরি অল্পদামি গাড়ি ব্যবহার করেন। অথচ আমাদের মত গরিব দেশের এম.পি-মন্ত্রীরা
নির্লজ্জ্বের মত ৩/৪ কোটি টাকা দামের টেক্স-ফ্রি
বিদেশী গাড়ি ব্যবহার করেন। ভারতের রাজনীতিবিদগণ দুর্নীতিতে ধরা পড়লে স্থায়ীভাবে
রাজনীতি হতে বিতাড়িত হন, আর আমাদের হন পুরস্কৃত। আসামের একটা
ছেলে জানতে চেয়েছে আমাদের দেশে মোটর সাইকেল তৈরি হয় কিনা। বললাম আমাদের ওয়ালটন
কোম্পানি টেলিভিশন, ফ্রিজ ও মোটরসাইলেক তৈরি ও রপ্তানি করে
থাকে। সে দুঃখ করে বলল- জাপানি কোম্পানি ভারতে কারখানা তৈরি করে ভারতের
প্রচুর টাকা নিয়ে যাচ্ছে। ভারতীয়রা আমাদের মত বিদেশমুখী নন। তারা সবাই নিজেদের
দেশটাকে গড়ে নিতে ব্যস্ত। তাদের রাজনীতিবিদরা সুবিধাবাদী ও আত্মকেন্দ্রিক নন।
সেখানে ১৯৫০ সাল হতে একই সংবিধান অনুযায়ী গণপ্রতিনিধিরা দেশ পরিচালনা করে আসছেন, কখনও সামরিক অভ্যুত্থান হয়নি। দেশটির রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ঈর্ষণীয়। আর আমাদের
রাজনীতিবিদরা ঝগড়া-বিবাদে ব্যস্ত। রাজনৈতিক অস্তিরতা আমাদের
উন্নয়ন বাধাগ্রস্থ করছে। তাদের চারটি শহর পরিদর্শনে মনে হয়েছে সেখানে অত্যন্ত
সুশৃংখলভাবে নগরায়ন হচ্ছে। যেখানে আমাদের নগরসমূহ মানুষ বাসের অনুপযোগী হয়ে
যাচ্ছে। দিল্লির সহিত বিভিন্ন নাগরিক সুযোগ সুবিধা সূচকে ঢাকার কোন তুলনাই হয় না। উড়াল
ট্রেনে নাগরিকরা সারা দিল্লি সহজেই ঘুরে বেড়ান। চারটি নগর দেখে মনে হয়েছে শহরগুলোর
প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষায় ভারতীয়দের যথাযথ আইন ও নজরদারী রয়েছে। তাদের নগরে ভবনের গায়ে
ভবন নেই। যত্রতত্র নেই বহুতল ভবনের ছড়াছড়ি। রাজধানী দিল্লির প্রতিটি রাস্তার ধারে
প্রায় ১০০/১৫০ ফুট প্রশস্ত সবুজবৃক্ষের বেষ্টনী রয়েছে, তারপর
বাসাবাড়ির অবস্থান। অথচ আমাদের শহরগুলোতে রাস্তা ঘেষে গড়ে উঠেছে অপরিকল্পিত বহুতল
ভবন। দিল্লিতে আন্ডার গ্রাউন্ড ও ঝুলন্ত রেলপথে হাজার হাজার মানুষ চলাফেরা করেন
ফলে দিল্লী যানজট মুক্ত পরিচ্ছন্ন সবুজ শহর, অথচ আমাদের প্রিয় ঢাকা
শহর মানুষবাসের অনুপোযুগী এক বিষাক্ত শহরে পরিণত হচ্ছে। ভারতে সবখানেই আছে দীর্ঘমেয়াদী
পরিকল্পনার ছাপ। ভারতীয়রা আজ নিজ দেশে সূই থেকে শুরু করে পারমানবিক বোমা পর্যন্ত
তৈরি করছে। ভারতীয়দের মেধা আজ সারাবিশ্বে পূজীত হচ্ছে। ভারতীয়রা তাদের ইতিহাস
ঐতিহ্য রক্ষা করেন সযতনে, ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো আশপাশের বিশাল
চত্ত্বরসহ সংরক্ষণ করেন অথচ আমাদের পুরান ঢাকায় অবস্থিত শাহজাহান পুত্র শাহ সুজার
নির্মিত বড়কাটারা দখল করে লোকজন ধ্বংস করে ফেলতেছে।
ভারতীয় মুসলমানদেরকে
আমি তিনস্তরে বিচার করতে পারি। কিছু মুসলমান ভারতে আত্মনিমগ্ন অবস্থায় রয়েছেন।
তারা ভারতীয় মূল স্রোতে মিশতে পারছেন না। বিশেষতঃ দেওবন্দ
মাদ্রাসা পড়ুয়া অল্প শিক্ষিত মুসলমানরা এর অন্তুভুক্ত। এরা দিনদিন পিছিয়ে অনুর্বর
জনগোষ্ঠিতে পরিণত হচ্ছেন। পরবর্তী স্থরে রয়েছেন সেই সব মুসলমানরা যারা নিজেদের
ধর্মকর্ম ঐতিহ্য বজায় রেখে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে, মূল
ভারতীয় স্রোতে মিশে যাচ্ছেন। তৃতীয় স্তরে আছেন সেই সব মুসলিম, যারা উচ্চশিক্ষিত হচ্ছেন, সেইসাথে ধর্মকর্ম ভুলে
ভারতীয় হয়ে যাচ্ছেন। সালমান খান, শাহরুখ খান এই ধারার মুসলিম।
ভারতের আরেক বড় ধর্মীয় জনগোষ্ঠি শিখরা তাদের ধর্ম ও ঐতিহ্য বজায় রেখে মূল ভারতীয় স্রোতে মিশে ভারতে দাপটের সাথে বিচরণ করছেন। বর্তমান ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
বাংলাদেশ, আমাদের প্রিয় জন্মভূমি। বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভারত থেকে আমরা এখন পিছিয়ে থাকলেও সেদিন
হয়ত দূরে নয় যেদিন আমরা ভারতকে পিছনে ফেলে উপরে উঠে আসব। আমরা ভারত হতে পিছিয়ে
থাকার বেশ কিছু কারণও রয়েছে। প্রথমত আমরা ভারতের ২৪ বৎসর পর
স্বাধীনতা লাভ করি এবং ১৯৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধে মারাত্মক ভাবে বিদ্ধস্ত হই।
দ্বিতীয়তঃ আমাদের জনসংখ্যার ঘনত্ব ভারতের ৩ গুণ। গৌহাটি হতে দিল্লি পর্যন্ত
রেলপথের দু’পাশে ধান, ইক্ষু, চা, ভুট্টা ও শাক-সবজির ঘন সবুজ গালিচা অথচ জনপদ অল্পই
দৃষ্টিগোচর হয়। ভারতীয়রা জীবনকে উপভোগ করেন অনেক বেশী, কারণ জীবনকে উপভোগ করার মত অসংখ্য স্থান, সুযোগ ও অর্থ
ভারতবাসীর রয়েছে। আমাদের চেয়ে ধনী-গরীবের বৈষম্যও ভারতে কম। তৃতীয়তঃ ভারত বিশাল রাষ্ট্রপুঞ্জ হওয়ায় তাদের এক বিশাল অভ্যন্তরীণ বাজার রয়েছে
যা আমাদের নেই। ফলে তারা রক্ষণশীল অর্থনীতি অনুসরণ করে ও বহুক্ষেত্রে বৈদেশিক
আমদানি ছাড়াও চলতে পারে। তাছাড়া খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদের ছড়াছড়ি তো রয়েছেই।
আমরা উন্নয়নে ভারতকে
ডিঙ্গাঁতে পারি। যেমন আমাদের গড় আয়ু ভারতীয়দের চেয়ে চার বৎসর বেশি। আমাদের রপ্তানির
গড় প্রবৃদ্ধিও ভারতের উপরে রয়েছে। এমন কি স্বাধীনতার ৪০ তম বৎসরে (২০১১-১২) বর্ষে
এই প্রথমবার আমাদের রপ্তানি পাকিস্থানকে অতিক্রম করে সার্কের আট দেশের মধ্যে
দ্বিতীয় অবস্থানে চলে এসেছে। জনসংখ্যা রপ্তানি হতে বাংলাদেশ যা আয় করে তা ভারত বা
পাকিস্তানের মত বিশালাকার দেশের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। আমাদের অর্জনও অনেক। আমরা
বর্তমানে চীনের পর বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোষাক রপ্তানিকারক দেশ। জাতি সংঘের
শান্তিরক্ষায় সবচেয়ে বড় সেনাদল বেনব্যাট আমাদের। আমাদের ডঃ ইউনুসের ক্ষুদ্র ঋণের
ধারণা বিশ্বে ব্যাপক প্রসারিত হচ্ছে। তাঁর পুঁজি ও লভ্যাংশের সামাজিক মালিকানার
ধারণা বিশ্বের সর্বত্র পঠিত হচ্ছে। ধীরে হলেও আমরা গণতন্ত্রের দিকে যাচ্ছি। আমাদের
মিডিয়া স্বাধীন ও শক্তিশালী হচ্ছে। রাজনীতি স্থিতিশীল হচ্ছে। নিরপেক্ষ ভোটে ক্ষমতার
রদবদল হচ্ছে। পাকিস্তানের মত জঙ্গিবাদের ছোবল এখানে থাবা মেলতে পারছে না। এখানে
সমস্যা কেবল দুর্নীতির। এখানে আমলাতন্ত্র ও রাজনীতি ব্যক্তিস্বার্থ ও দুর্নীতির অথৈ কালো জলে
নিমজ্জিত। এখন কেবল প্রয়োজন আমাদের বদলে যাবার। যদি আমরা বদলে যেতে পারি, তাহলে সুখী, সমৃদ্ধ এক উন্নত বাংলাদেশ এসে দাঁড়াবে
আমাদের সামনে, যার তুলনা ভারত কেন বিশ্বের কেহই হতে পারবে না। বাংলাদেশের উপমা হবে কেবলই
বাংলাদেশ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন