সিলেট
ওসমানী মেডিকেল কলেজের পঞ্চাশতম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকি পালন এবং ডাঃ নুরজাহান বেগম
চৌধুরীর ২১তম ব্যাচের পুনর্মিলনী
আমার পত্নী ডাঃ নুরজাহান বেগম
চৌধুরীর অজস্র স্মৃতিঘেরা বিদ্যাপীঠ সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজের জন্ম
১৯৬২ সালে। ২০১২ সালের ডিসেম্বরে দুইদিনব্যাপী খুব জমকালো অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নতুন
পুরাতন ছাত্র-ছাত্রীগণ সবাই জমায়েত হয়ে এই মেডিক্যাল কলেজটির সুবর্ণ জৈয়ন্তী উৎসব
পালন করেন। কাজকর্ম সমঝে দিয়ে সারা বাংলাদেশ হতে ছুটে আসেন ঝাঁকে ঝাঁকে চিকিৎসকের
দল, তাও আবার পরিবার পরিজন নিয়ে। বেড়ে উঠা পরিবারের সদস্যদের দেখিয়ে দেয়া কোন
মেডিকেল কলেজটি আমাদেরকে গড়ে দিয়েছে। ব্যাস্ততার ফাঁকে প্রায় চিকিৎসকদেরই সময় হয়না
বৌবাচ্চাদেরে যৌবনের কত স্বপ্ন সাধের স্মৃতিময় দিনগুলোর স্মারক চিহ্নগুলো একটু
ঘুরে দেখানো।
সিলেট শহরের হোটেলগুলোতে এত ভীড়
জমে যে ঠাই নাই ঠাই নাই অবস্থার সৃষ্টি হয়। অনেক চিকিৎসক আবার বন্ধু সহপাঠিদের
বাসাতেও আশ্র্য় নেন। কলেজ কতৃপক্ষ চিকিৎসকদের কাছ থেকে অনুদান নিয়ে তিনদিনব্যাপী
সবার জন্য থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করেন। ডাঃ নুরজাহান বেগম তিন হাজার টাকা চাঁদা
দিয়ে উৎযাপনকারী হিসাবে তালিকাভুক্ত হন।
ভিতরের মাঠে লাশকাটা ঘরের সামনে বেশ
বড় প্যান্ডেল স্থাপন করা হয় এবং সারাটা মেডিকেল কলেজ আলোকসজ্জায় সুসজ্জিত হয়ে উঠে।
উৎসবের সুচনালগ্নে সিলেট স্টেডিয়ামের সামনে পুরাতন মেডিকেল হতে সেজেগুজে জাতীয়
পতাকার লাল সবুজ রঙের সুবর্ন জৈয়ন্তীর গেঞ্জি পরে স্পাউসগনকে নিয়ে হেটে হেটে মিছিল
সহকারে এক বিশাল চিকিৎসকের প্রবাহ গিয়ে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজের
ভিতরের অনুষ্ঠানস্থলে শেষ হয়। সুবর্ণ জৈয়ন্তী উপলক্ষে বের হওয়া বেশ মানসম্মত
ম্যাগাজিনটিতে ২১তম ব্যাচের অনেকের সাথে ডাঃ নুরজাহান বেগম চৌধুরীর নাম ও ছবি
প্রকাশিত হয়। অনুষ্ঠানের আয়োজকগন দুইদিনের সম্পুর্ণ খাবারদাবার ও চানাস্তার সুব্যবস্থা
করেন। হৈ-হল্লা করে সবার সাথে আমরা এসব রসনাদার ভোজন উৎসবে অংশ নেই। পুরানো দিনের
সহপাঠি বন্ধুবান্ধবীদের মিলনমেলায় ডাঃ নুরজাহান বেগম চৌধুরীর স্পাউস হিসাবে আমি
যোগদান করে উপভোগ করি, আহা! কী আনন্দ বহে সিলেট মেডিকেল কলেজের আকাশে বাতাসে।
প্রতি ব্যাচের ছাত্রছাত্রীগণের
স্মৃতিময় পুরাতন ছবি সংগ্রহ করে সবিবরন ধারাবাহিকভাবে সাজিয়ে রাখা হয়। এমন কি ১৯৬২
সালের প্রথম ব্যাচের শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের ফটোও বাদ পড়েনি।
কিছু ফটো পুরাতন হতে হতে ঝাপসা
হয়ে গেছে। একজন চিকিৎসক বললেন, পুরাতন হয়ে গেলে সবকিছুর দাম কমে যায় কিন্তু ফটো যত
পুরনো হয়, ততো তার মূল্য বাড়তে থাকে। আরেকজন বললেন, ফটোর বেলায় ওল্ড ইজ গোল্ড। এখানে
বেশ কিছু পুরাতন আমলের কলেজ ম্যাগাজিন এবং হাতে লিখা দেওয়াল পত্রিকার দেখা পেলাম।
সেই কোন আমলে কে কবে শক্ত কাগজে রঙ্গিন কালিতে মনের আবেগ মিশিয়ে কৌতুক, কবিতা,
ছড়া, বানী, অনুগল্প লিখে বার/তের বর্গফূট আয়তনের এইসব দেওয়াল পত্রিকাগুলোকে কলেজ
ক্যাম্পাসের ভিতর স্ট্যান্ডে দাড় করিয়ে রেখে দিত। মেডিকেল কলেজের তরুণ
ছাত্রছাত্রীরা এইসব ছোট্ট ছোট্ট বোর্ডে তাদের বড় বড় প্রতিভার স্বাক্ষর একে দিত। কিছু
কিছু লেখা পড়ে মনে মনে বললাম, ধন্য তোমরা মেডিকেল শিক্ষার্থীরা, তোমরা সত্যি
প্রতিভাবান, তোমাদের সম্ভাবনা সীমাহীন। অথচ তোমাদের এই অমিত প্রতিভা এক সময় অর্থ
উপার্জনের চোরাবালিতে পড়ে কোথায় যেন হারিয়ে যায়।
তেরপালঘেরা কাপড়ে ছাদঢাকা বিশাল
সুসজ্জিত প্যান্ডেলে একব্যাচের পর একব্যাচের ছাত্রছাত্রীরা ধারাবাহিক স্মৃতিচারণ
করে যান। চিকিৎসকরা অতি মেধাবী শ্রেণি, তাদের স্মৃতিশক্তি খুবই প্রখর। এক এক জন
আবেগ আপ্লুত হয়ে বহুদিন আগেকার সেই সময়ের কাহিনি অতি জীবন্ত করে মাইকে বলে যান। আমি
এই মেডিকেলের কেউ নই, অথচ এখানে বসে সবার ছয় সাত বছরের কলেজ জীবনের স্মৃতি আমি
বিমুগ্ধ হয়ে শোনে যাই কান পেতে ধ্যান ধরে। আমি চিকিৎসক নই কিন্তু আমার পত্নী ডাঃ
নুরজাহান বেগম চৌধুরীর সাথে এই সভায় যোগদান করে এখানকার সব আনন্দ, ব্যদনা, মিলন ও
বিরহ হৃদয়ের গভীর গহিনে ধারণ করে নেই।
এই স্মৃতিচারণ নিয়ে মাঝেমধ্যে মঞ্চে
লেগে যেত ঝগড়া ও খুনটুশি। একজনের বক্তব্যে আরেকজনের ইগোতে একটু লেগে গেলে আর যায়
কই। সাবেক প্রিন্সিপাল ডাঃ রেজাউল করিম চৌধুরী তার স্মৃতিকথায় বলে যান, স্বাধীনতা
পরবর্তী সময়ের দুর্ভিক্ষের দিনের কথা। তারা বন্যাদুর্গত মানুষের জন্য সিলেট হতে
প্রচুর টাকা সংগ্রহ করেন, তারপর এই টাকা বঙ্গবন্ধুর হাতে তুলে দিতে ঢাকা যান। হঠাৎ
মুখ ফসকে তিনি বলে ফেলেন তার এক সহপাঠী এই টাকা হতে একজোড়া জুতো কিনে ফেলেন। অমনি
সামনে বসা এই সহপাঠী তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে প্রতিবাদ জানাতে মঞ্চে চলে যান। তিনি
মাইক কেড়ে নিয়ে বললেন, রেজাউল করিম চৌধুরীর বক্তব্য সঠিক নয়, তিনি হয়ত ভুলে গেছেন
বঙ্গবন্ধুর ত্রাণ তহবিলে প্রদত্ত এই টাকা হতে একশত টাকার একটি নোট বঙ্গবন্ধু শেখ
মুজিবুর রহমান তার হাতে ফেরত তুলে দেন। তিনি এই টাকায় জুতো কিনেছেন। শেষপর্যন্ত
প্রিন্সিপাল মুর্শেদ আহমদ চৌধুরী মঞ্চে উঠে বিষয়টি সামাল দেন এবং তিনি সবাইকে
সাবধানে কথা বলতে অনুরোধ করেন, যাতে অন্যের সম্মানে কিংবা ইগোতে কোন প্রকার আঘাত
না লাগে।
সভার এসব নানা ঝগড়া ও বাদ প্রতিবাদ
বেশ মজাকরে উপভোগ করলাম। তখন মনে হল কোথায় সেই স্বাধীনতা পরবর্তী বাহাত্তুর/তিয়াত্তুর
সাল, কোথায় বঙ্গবন্ধুর ত্রাণ তহবিল, কোথায় আজ জাতির জনক, কোথায় এই সিলেট ওসমানী
মেডিক্যাল কলেজের পঞ্চাশতম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠান, যেখানে এক স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠানে
এই সব উপাদান এসে হাজির হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর প্রতি আমার হৃদয়ের দুর্বলতা তখন আমাকে
বেশ আবেগাপ্লুত করে তুলে।
অনেক অনেক চিকিৎসক দম্পতির দুজনই
এই মেডিক্যাল কলেজে লেখাপড়া করেছেন। এসেছেনও জোড় বেঁধে বেঁধে, তবে এখানে এসে সাময়িক
বিচ্ছিন্ন হয়ে মিশে গেছেন নিজ নিজ ব্যাচের সহপাঠী বন্ধু বান্ধবীদের ঝাঁকে। আমার
পত্নীর আগের ২০তম ব্যাচের ডাঃ আজমা আপার কথা মনে পড়ে। দেখতে আমার বেগমের মত
হৃষ্টপুষ্ট আজমা আপা স্থনক্যান্সার নিয়ে অনুষ্ঠানে যোগ দেন, সাথে ছিলেন তার স্বামী
হাস্যমুখ ডাঃ আকরাম ভাই। হাসিমুখ পরিশ্রমী ডাঃ আজমা আপাকে দেখে মনে হয়নি তিনি
কর্কট রোগী, কিংবা জীবন সংগ্রামে কখনও হোঁচট খাবেন। অথচ কিছুদিন পরই তিনি এই
চিরচেনা জগত হতে চিরতরে হারিয়ে যান।
রাতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে
যোগদান করে আবার ঠাহর করি, ডাক্তাররা সত্যিই জেনিয়াস, তারা সব পারেন এবং সফলভাবেই
পারেন। রোটারিয়ান ডাঃ জালাল আহমদ চৌধুরী (ডাঃ মঞ্জুর) স্যুট-কোট-টাই পরে সানগ্লাস
চোখে দিয়ে নববধুর মত সুসজ্জিত পাঁচজন সুন্দরী নায়িকার সাথে নেচেনেচে গান গাইলেন
‘ডিসকো বি বি নটি’। নায়ক ডাঃ জালাল আহমদ মঞ্জুর ছয় ফুট ছয় ইঞ্চি, কিন্তু নায়িকারা
তার কাধ বরাবর। মনে হল তিনি তার ব্যাচের নাকে নোলক পায়ে ঘুঙ্গুর পরা পাঁচজন সহপাঠিনীকে
নিয়ে নাচগান করছেন। কিন্তু যেইনা গান শেষ হল, অমনি রঙিন শাড়ির ভিতর হতে বেরিয়ে
আসেন তার ব্যাচের পাঁচজন পুরুষ চিকিৎসক। তাদের মধ্যে একজন আমাদের নর্থইষ্ট
মেডিক্যাল কলেজের পরিচালক হৃদরোগ বিশেষঞ্জ ডাঃ জালালি ভাই। অনুষ্ঠানে হাসির বন্যা
বইল।
একজন প্রবীণ চিকিৎসক তার হৃদয়ের
সব আবেগ ঝেড়ে দিয়ে গাইলেন রবীন্দ্র সঙ্গীতের সেই কালজয়ী গান- ‘যখন পড়বে না মোর
পায়ের চিহ্ন এই বাটে, আমি বাইব না মোর খেয়াতরী এই ঘাটে। চুকিয়ে দেব বেচাকেনা
মিটিয়ে দেব লেনাদেনা’--- --- ---। তার গাওয়া এই গানের গভীর আবেগ সভার সকলের চোখে
বৃষ্টি ঝরায়।
ডাঃ আদিল ভাইয়ের গিটারের সুর
সবাইকে মোহিত করে। তিনি লাশকাটার চিকিৎসক, মনে হল যার আঙ্গুলে এত সুন্দর গিটার সুর
বেজে উঠে, তিনি এই লাশকাটার মত নিষ্ঠুর নির্দয় কাজ করেন কী করে!
বিদায়ী সাংস্কৃতিক সন্ধ্যায় আসেন
দেশের বিখ্যাত গায়ক কুমার বিশ্বজিৎ। তাকে টেলিভিশনে অনেকবার দেখলেও এই প্রথম চোখের
সামনে দেখতে পেলাম। তিনি তার গাওয়া সেরা সেরা গানগুলো গেয়ে যান। ও ডাক্তার, আপনি
যখন করবেন আমার ওপেন হার্টসার্জারি/ যেখানে সীমান্ত তোমার, সেখানে বসন্ত আমার/ তরে
পুতুলের মত করে সাজিয়ে/ একতারা বাজাইওনা, দুতারা বাজাইওনা/ তুমি যদি বলো, পদ্মা
মেঘনা একদিন দিব পাড়ি; তুমি যদি বল, চাঁদের
বুকে বানাইবো আমার বাড়ি। ইত্যাদি গানগুলো তিনি যখন তার সবশক্তি ঝেড়ে দিয়ে গেয়ে
যান, আমরা তখন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনে যাই। তার গানেমুগ্ধ ফ্যান আমি বাচ্চাদের মত
সিদ্ধান্ত নিলাম, এত কাছে যখন এই প্রিয়শিল্পীকে পেয়ে গেছি, তার সাথে বুকটা মেলাবই।
অনুষ্ঠান সাঙ্গ হল অনেক রাতে। সবাই ছুটলো নিজ নিজ নিদমহলে। আমি মঞ্চের এক কোণে
দাঁড়িয়ে প্রাণের শিল্পী কুমার বিশ্বজিতের অপেক্ষায় রইলাম।
আমার এই প্রাণের শিল্পীর জন্ম
চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায়। তিনি আমার চেয়ে মাত্র দেড় বছরে বড়, জন্ম ১৯৬৩ সালের ১লা
জুন। তিনি রঙ্গমঞ্চ হতে নেমে আসতেই ডানহাতটা বাড়িয়ে দিলাম। শিল্পী কুমার বিশ্বজিৎ
আমাকে নিরাশ করেন নি। তার চিকন মোলায়েম হাত আমার পাঁচ আঙ্গুলের মধ্যে মিলিয়ে গেল।
এবার বুক মিলাতে গিয়ে হিসেবটা পেলাম। তার গাত্রবর্ণ শ্যামলা, দেহখানি হালকা লতার
মত। আমার চেয়ে খানিক বেটে কুমার বিশ্বজিৎ যেন দুমড়ে মুসড়ে আমার দেহকান্ডের ভিতরে
বিলীন হয়ে যান। পুতুলের মত সুন্দর এই গুণীশিল্পীকে একবার কোলে তুলে নিতে ইচ্ছে হল।
তবে ইচ্ছে হলেই কি তা আর করা সম্ভব আমার। সিলেট মেডিক্যালের এই বর্ণালী রাতে
শিল্পী কুমার বিশ্বজিৎ আমার জীবন স্মৃতির সোনালি খাতার একটি বিস্মৃত পাতা হয়ে যান।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন