সোমবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

ডাঃ নুরজাহান বেগম চৌধুরীর সিলেট মেডিক্যাল কলেজ ২১তম ব্যাচের পুনর্মিলনী

 

ডাঃ নুরজাহান বেগম চৌধুরীর সিলেট মেডিক্যাল কলেজ ২১তম ব্যাচের পুনর্মিলনী

সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজের পঞ্চাশতম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উৎসব অত্যাসন্ন। নভেম্বর ২০১২ সাল। একদিন আমার গিন্নীর এক সম্মানিত সহপাঠি দম্পতি ডাঃ সৈয়দ শাখাওত হোসেন এবং ডাঃ লুতফুন্নাহার জেসমিন রিকাবীবাজারে তাদের আরোগ্য ক্লিনিকে এক সভায় আমাদেরকে আমন্ত্রণ করলেন। আমি ও ডাঃ নুরজাহান বেগম সেই সভায় হাজির হয়ে সিলেট শহরে অবস্থানরত তাদের বেশ কয়েকজন সহপাঠি চিকিৎসকের দেখা পাই। তারা হলেন কুচাই পশ্চিমবাগের শিশুরোগ বিশেষঞ্জ ডাঃ শামিম আহমদ, স্ত্রীরোগ বিশেষঞ্জ ডাঃ আফরোজা বেগম শীলা, পরিবার পরিকল্পনা বিভাগে কর্মরত কুমিল্লার জাতক ডাঃ নজরুল ইসলাম খান, আমাদের সাগরদিঘিপারের প্রতিবেশী হৃদরোগ বিশেষঞ্জ ডাঃ মানিক ভাই, মুন্সিপাড়ার লেখক ডাঃ আনোয়ার হোসেন এবং অর্থপেডিক্স বিশেষঞ্জ হবিগঞ্জের ডাঃ কামরুল ইসলাম, অতি চটপটে স্বভাবের জন্য সহপাঠীরা যাকে কৌতুক করে ডাকতো রঙ্গীলা কামরুল।

এ সভার উদ্দেশ্য হল, সিলেট মেডিক্যাল কলেজের সুবর্ণ জৈয়ন্তী পালনে দেশবিদেশ হতে সমবেত হওয়া ২১তম ব্যাচের সহপাঠিদেরে নিয়ে একটি পারিবারিক গেট টুগেদার অনুষ্ঠানের আয়োজন করা। এই অনুষ্ঠান জাঁকজমকের সহিত আয়োজন করতে হলে প্রচুর টাকার প্রয়োজন। সৈয়দ শাখাওয়াত হোসেন ভাই প্রস্তাব করলেন বাহির হতে যেসব সহপাঠীরা সিলেট আসবেন তাদের কাছ থেকে কোন চাঁদা আমরা গ্রহণ করব কিনা? আমি বললাম না, বাহিরের যারা আসবেন তারা আমাদের গেষ্ট এবং আমরা হলাম হোষ্ট। সিলেটে অবস্থানরত আমাদের কারো আয় রোজগার মন্দ নয়। পুরো অনুষ্ঠানের খরচ আমরা সিলেটবাসী চিকিৎসকগণ বহন করতে পারব। শাখাওয়াত-জেসমিন দম্পতি দিলেন বিশ হাজার, আমরা বাকি সবাই মাথাপিছু দশ হাজার টাকা করে সংগ্রহ করলাম। কিছু ঔষধ কোম্পানিও টুকটাক সহায়তা করল।

কুচাই পশ্চিমভাগের ডাঃ শামিম আহমদ খুব হাসিখুশি মানুষ। দুধফর্সা ডাঃ শামিম আহমদ আমাদের ব্যাংকের সহকারী মহাব্যবস্থাপক সৈয়দ আতাউর রহমানের অতিমেধাবী চিকিৎসক কন্যাকে বিয়ে করেন। ডাঃ শামিমের ফর্সা গাল হঠাৎ কালো দাড়িতে আচ্ছাদিত হয়ে যায়। ডাঃ শামিমের পত্নী এফসিপিএস পাশ করামাত্রই কচিকচি তিন কন্যাকে নিয়ে তারা সপরিবারে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। ডাঃ শামিম রংপুর মেডিকেলে ভর্তি হলেও পরে আসন বিনিমিয় করে সিলেটে মেডিক্যালে চলে আসেন।

এবার অনুষ্ঠানের ভেন্যু নিয়ে আলোচনা শুরু হলে ডাঃ শামিম বললেন আলীবাহার বাগানের মালিক তার খুব ঘনিষ্ঠ সজন। তিনি বললেই পাহাড়ের উপর আলীবাহারের সুরম্য বাংলোটি তিনি একদিনের জন্য পেয়ে যাবেন। তবে এই বাগানের মালিকা এই কিছুদিন হয় ক্যান্সার হয়ে  মারা গেছেন, তাই এখানে অনুষ্ঠান ও হৈ হল্লা করতে দিতে তার সন্থানরা রাজি হবেন তো। সবাই বললেন এই রাজি করানোর দায়িত্ব শামিমের, কারণ ডাঃ শামিম খুব বাকপঠু। কথাবার্তায় একাই একশ ডাঃ শামিম পারবেন না তো কে পারবে। যাক ডাঃ শামিম পারলেন।

শহর হতে মাত্র মাইল দেড়েক দূরে এক সবুজ চা বাগানের টিলার নিচে চা কারখানা ও উপরে এই সুসজ্জিত বাংলো উদ্যানের অবস্থান। আমরা এখানে সমবেত হয়েই সদ্যমৃত বাগান মালিকার জন্য প্রথমেই একটা প্রার্থনা করে নেই যাতে দৃষ্টিকটুতা মূছে ফেলা যায়।  

সিলেট মেডিকেলের সুবর্ণজৈয়ন্তী হয় টানা দুইদিন এবং পরবর্তী তৃতীয় দিনটিতে আলীবাহারের বাংলো আঙিনায় আমরা অনুষ্ঠান করি। ফ্যামিলি প্ল্যানিং সিলেট জেলাপ্রধান ডাঃ লুতফুন্নাহার জেসমিন। তিনি অফিসের বড় জিপে করে ডেগভর্তি খাবার, ফলমূল, চানাস্তা এবং নাচগানের সব সরঞ্জাম আলীবাহারের সুউচ্চ পাহাড়ের উপরে পৌঁছে দেন। সিলেট মেডিক্যালের ২১তম ব্যাচের সবাই এসে সপরিবারে সিলেট স্টেডিয়ামের সামনে জমায়েত হন। সিলেটের সবার প্রাইভেট গাড়ি আছে। বিভিন্ন ক্লিনিকের এ্যাম্বুলেন্স এবং প্রাইভেট গাড়িগুলো মেহমানগণকে তুলে নিয়ে ধীর গতিতে সারি বেঁধে আমার সাগরদিঘিরপারের বাসার সামনের রাস্থা দিয়ে অগ্রসর হয়। আমার গাড়িতে ছিলেন আমার বেগমের মেডিক্যাল কলেজ জীবনের দিলরূবা হোস্টেলের রূমমেট ডাঃ রুকশানা আক্তার  লিজু এবং তার দুইজন পুত্রকন্যা। হবিগঞ্জের কন্যা চিকনতনু সুন্দরী ডাঃ রুখশানা আক্তার লিজু ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের একজন অধ্যাপিকা।       

আলীবাহার চা বাগানের সৌকিন মালিক যে কোন ধরনের অনুষ্ঠান করার উপযোগী করে বাংলোটি নির্মাণ করেছেন। টিনের সুন্দর পাকা ভবনের বামের ময়দানে একটি বিশাল ছাতা স্থাপিত। এই ছাতার নিচে সবুজ ঘাসে শতাধিক মানুষ অনায়াসে বসে আনন্দানুষ্ঠান করতে পারেন। এই ছাতার একদিকে বুফে চা নাস্তা ও ভারি খাবার গ্রহণের জন্য নির্মিত একটি পাকা স্টেজ, অন্যদিকে অনুষ্ঠান করার জন্য একটি পাকা রঙ্গমঞ্চ স্থাপিত।

সারাটা টিলা জুড়ে লাগানো ফুল বাগিচার বর্ণনা আর নাইবা দিলাম। চারদিকে ছড়িয়ে আছে চাবাগানের শ্যামল সবুজ প্রান্তর। সবুজের ফাঁকে ফাঁকে রয়েছে বেশ কিছু পাকা টালি নির্মিত বেঞ্চ। ভবনের ডানদিকের আঙিনায় প্রচুর গাড়ি পার্কিং করার জায়গা আছে। গাড়িগুলো ১ম গিয়ারে বেয়ে বেয়ে টিলার উপরে উঠে এই পার্কিং স্পেসে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করে। শিল্প করে সাজানো পরিপাঠি এই বাংলো দেখে অতিথিরা সবাই বাগান মালিকের রুচিবোধের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হন।    

আমার বেগমের চিকিৎসক সহপাঠিগণ এখানে এসে বহুকাল পর একাত্ম হয়ে যান। আসেন ডাঃ লিজুর প্রাণনাথ শিশু বিশেষঞ্জ ডাঃ সৈয়দ মুয়াজ আহমদ, গাইনী স্পেশালিষ্ট ডাঃ আফরোজা বেগম শীলার প্রাণনাথ ডাঃ সাইদুর রহমান এবং ডাঃ নুরজাহান বেগম চৌধুরীর স্বামী আমি ইসফাক কুরেশীসহ বেশ কয়েকজন দোলাভাই। আর এসেছেন অগণিত ভাবী। চিকিৎসক নন এমন সব ভাবীরাই সবাই দেখলাম দারূন সুন্দরী। আমরা সবার আত্মজ ও আত্মজারা মনের আনন্দে জীবনের জয়গানে মামা ও খালাম্মাদের রাজ্যে হারিয়ে যান। প্রত্যেক ব্যাচমেট সপরিবার মঞ্চে উঠে লাউড স্পিকারে পরিবারের সবার নাম ও পরিচিতি বলে যান। আমার পুত্র জেফার তখন ছিল ব্লুবার্ড স্কুলের ছাত্র।

একটি তালিকায় ২১তম ব্যাচের সবার নাম টাঙ্গানো হল। এদের মধ্যে দুই একজন ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে পরজগতেও চলে গেছেন। তাদের জন্য শোক প্রকাশ করা হল। ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ও বিদেশে অবস্থানরত কয়েকজন সহপাঠি চিকিৎসক এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। তাদের শরীরটা বিদেশে অবস্থান করলেও মনটা যেন এই আলীবাহারের বাংলোয় গড়াগড়ি খায়। তবে ২১তম ব্যাচের সিলেট শহরে অবস্থানকারী জামাতে ইসলামের মহিলানেত্রী ডাঃ সুলতানা রাজিয়া ও ডাঃ আমেনা শফিক এমপিকে কোন অনুষ্ঠানেই খুঁজে পাওয়া গেল না। এই সভায় আসেন ডাঃ পলি, ডাঃ ------ ------- -------

রাস্থার ওপাশের টিনের মসজিদে জোহরের নামাজ আদায় করে সবাই দল বেঁধে বাগানের সুরম্য কাজলদিঘির পারে ছুটে যান। এইখানে ছনের ছাউনি ঢাকা দিঘির গোলাকার ঘাটে না জানি কি যে এক মধু আছে। চাফুল ফোঁটা পনের/বিশ ফুট উচ্চ কলম করার জন্য লাগানো গুচ্ছশাখার চাগাছ বনের নিচদিয়ে হাঁটার আনন্দই আলাদা।

বিকেলে হল আনন্দ অনুষ্ঠান। সবার বাচ্চারা মেধানুসারে গান গাইল, কবিতা আবৃত্তি করল, কৌতুক অভিনয় করে লোক হাসালো। জনক ও জননীদের মত এসব বাচ্চারাও দারুণ মেধাবী। কেউবা পড়ছে ঢাকা মেডিকেলে, কেঊবা বুয়েটে। কেউবা হয়ে গেছে চিকিৎসক, অফিসার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার। দেশের সব নামীদামী প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী তারা।

আমার বেগমের সহপাঠীরা প্রায় সবাই প্রতিষ্ঠিত সরকারি পদে রয়েছেন। কেউবা অধ্যাপক, কেউবা সেনা কর্মকর্তা, কেউবা ব্যবসায়ী, কেউবা মাল্টিন্যাশনাল প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদে আসীন। বি.বাড়িয়ার অনিন্দ্যসুন্দরী ডাঃ ------ইউ এন ডি পি র বিশ্বমানের চাকুরি নিয়ে দেশ বিদেশ প্রদক্ষিণ করছেন। তাদের প্রত্যেকেরই রয়েছে এফসিপিএস, এম এস, এম ডি, এম আর সি পি, পি এইচ ডি, ডিপ্লোমা ইত্যাদি ডিগ্রির সমাহার। এমন কি বাংলাদেশের প্রথম মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরূল ইসলামের কন্যা ডাঃ সৈয়দা জাকিয়া নূর লিপি প্রত্যক্ষ ভোটে সাংসদ নির্বাচিত হন এবং ডাঃ আমেনা শফিক হন সিলেক্টেড মহিলা সাংসদ। বিকেলে খেলাধুলা র‍্যাফেল ড্র হল। কেউ কেউ পরিশ্রান্ত হয়ে বাংলোয় শুয়ে বসে রেস্ট নেন। ধীরে ধীরে সন্ধ্যা গণিয়ে আসে। জীবনের আর অগণন দিনের মত আমার সহধর্মিনীর মেডিকেল কলেজের সহপাঠীদের মধুর মিলনের এই স্মৃতিময় দিনটি রাতের আধারে হারিয়ে গেল। নীরব স্বাক্ষি হয়ে রইল এই আলীবাহার চাবাগানের নির্জন বাংলো, আর কি হে হবে কোন এমন মিলনমেলা, যতদিন যাবে!

পরদিন ডাঃ রুকশানা আক্তার লিজুর পূত্রকন্যাকে নিয়ে আমরা তিনজন কারে চড়ে ঘুরে বেড়াই সিলেট শহরের বনবাদাড়ে ও শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পাহাড়ের উপরের সুউচ্চ শহিদ মিনারে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন