শনিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

পূবালী ব্যাংক দরগাগেইট শাখায় দেখা কিছু প্রিয়মুখঃ

 

পূবালী ব্যাংক দরগাগেইট শাখায় দেখা কিছু প্রিয়মুখঃ

এই শাখায় এসে আমার এক প্রিয় দোলাভাইকে পাই, তিনি ঠিকাদার আব্দুল মতিন চৌধুরী। তার বেগম ছিলেন আমার কানিহাটি হাজিপুরের ফুফার ভাতিজি। মতিন চৌধুরী একসময় ছিলেন গোলাপগঞ্জ এম সি একাডেমীর ইংরেজি শিক্ষক, দেওয়ান মোঃ আজরফের সহকর্মি। প্রধান বিচারপতি মাহমুদুল আমিন চৌধুরীও ছিলেন তার সহপাঠি। তিনি খুব ভাল ইংলিশ জানতেন- যেমন স্পিকিং তেমন রাইটিং। তার বাড়ি আলীনগরের কাছে চন্দরপুর গ্রামে। তবে শহরের ইলেকট্রিক সাপ্লাই এলাকায় তার দুইটি সুরম্য বাড়ি ছিল। তিনি এসে এজিএম চেম্বারে বসতেন, তবে আমার সামনে বসতে কোনদিন তার ব্যত্যয় হতনা। আধা বাংলা ও আধা ইংলিশে আমাকে ভাই ভাই ডেকে তিনি অনেক অনেক গল্প করতেন। পরে আমি ব্যবস্থাপক হয়ে ঈদগাহ শাখায় চলে গেলে তিনি স্নেহের টানে বেশ কয়েকবার সেখানে গিয়েও দেখা করেন। কয়েক বৎসর আগে আমার এই প্রিয় দোলাভাই অনন্ত জীবনে পাড়ি জমান। তার পত্নী তুতুআপাও আজ আর নেই। এই শাখায় আসতেন তাহিরপুর-জামালগঞ্জের এম পি সৈয়দ মোহাম্মদ রফিক যিনি মতিন দোলাভাইয়ের আপন ভাতিজিপতি। কিন্তু জানিনা কি কারনে তিনি এম পি সৈয়দ রফিককে একদম সহ্য করতেন না, তার নাম শুনলেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠতেন।

এই শাখার আরেকজন কস্টমারের নাম মনে পড়ে তিনি আব্দুল আউয়াল। তারবাড়ি সুনামগঞ্জের ভাটি এলাকা মধ্যনগর। আউয়াল সাহেব একজন ধুর্ত চালুমাল। তিনি ভাটির আওয়ামী লীগ নেতা, সিলেটে বসে বসে সেখানকার রাজনীতি নিয়ন্ত্রন করতেন। লম্বাকার দেহ, ঘনকাল চুল, চোখে চশমা, বুদ্ধিদীপ্ত কথাবার্তায় তার চেহারায় একটা নেতা নেতা ভাব ফুটে উঠত। তিনি ছিলেন পুবালী ব্যাংকের একজন নিবন্ধিত সি এল এস এজেন্ট। এই শাখায় তার অনেক ঋণও ছিল। তিনি প্রতিদিন সকালে ব্যাংকে এসে অফিসের ফোনে  সি এল এস সহ সবধরনের রাজনীতি ও ব্যবসার কাজ সেরে নিতেন। দরগাগেইট শাখা ছিল আমাদের মত তারও একটি অফিস। আউয়াল সাহেবের বাসা ছিল আমার পাশে সাগরদিঘীরপার। একবার তিনি ভোট খেলে জয়ী হয়ে তার নিজ উপজেলার চেয়ারম্যান হন। এই চেয়ারম্যানির অনেক কাজ তিনি এখানে বসে বসে চালিয়ে যেতেন।

এখানে এসে আমার আরেক ঘনিষ্ট আত্মীয়কে পেয়ে যাই। তিনি ডঃ নুরজাহানের মামাত বোন লোকবা আপার জীবনসাথী খোকন দোলাভাই। খোকন দোলাভাই পীরমহল্লার সৈয়দবাড়ির সন্থান। তিনি এই সৈয়দবাড়ির ত্রিশ চল্লিশ বিঘা ওয়াকফ সম্পত্তির মোতাওয়াল্লীও ছিলেন। এই ওয়াকফ সম্পত্তির ভিতর হাউজিং এস্টেট সংলগ্ন একটি মসজিদ, ঈদগাহ, আক্কলকুপের কবরগাহ, বেশ কিছু বাসাবাড়ি ও একটি কমিউনিটি সেন্টার বিদ্যমান ছিল। পীরমহল্লায় তার ঘন সবুজ বাড়িটি ছিল গ্রামের বাড়ির আদলে নির্মিত। যার সামনে ছিল বাংলো ও ঘাটবাধানো বড় পুকুর। টিনের সুরম্য ঘরের চারপাশ ঘিরে ছিল যতনে লাগানো প্রচুর ফুলগাছ। আমার বিয়ের পর এই বাড়িতে রাতে দাওয়াত খেতে গিয়ে এক সুন্দর সন্ধ্যায় ফুল, পাতাবাহার ও লতাপাতার প্রান্তে প্রান্তে গিয়ে এসব পুষ্পরাজির রঙরূপ দেখি ও সুবাস নেই। ফেরার সময় খোকন দোলাভাই তার গাছের প্রচুর জাম্বুরা ফল আমার কারে তুলে দেন।

লোকবা আপা ছিলেন একজন খুব স্নেহময়ী ও মমতাময়ী মহিলা। হঠাৎ একদিন মরনব্যাধী স্থন ক্যান্সারে তাকে পেয়ে বসে। অপারেশন করা হলেও কাজ হয়নি। আমরা প্রায়ই তাকে দেখতে যেতাম। আমাদেরকে নিয়ে তিনি সামনের পুকুরঘাটে বসতেন। অনেক কষ্ট হজম করে মাত্র আটচল্লিশ বছর বয়সে তিনি অনন্তের পথে পাড়ি জমালেন। কাছেই নির্মানাধীন সুন্দর ডুপ্লেক্স বাসায় ক্ষণকালের জন্য তার পা রাখা সম্ভব হলনা।

দরগাগেইট শাখায় এসে দেখলাম খোকন দোলাভাইয়ের সব ব্যাংকিং কার্যক্রম চলছে এই শাখায়। তিনি তখন পীরমহল্লায় নতুন ডুপ্লেক্স বাসা নির্মান শেষ করেন। উদ্বোধনের অনুষ্টানে আমরা অতিথি হলাম। প্রায়ই বললেন, আজ দুপুরে আমার বাসায় আপনার দাওয়াত, আপনি যাবেন। শিন্নি, মিলাদ, পারিবারিক অনুষ্ঠান কিছুতেই আমার এই দাওয়াত পাওয়া বাদ পড়ত না। আচমকা খোকন দোলাভাইয়ের কি এক মরনব্যাধী দেখা দিলঢাকার এপোলো হাসপাতালে দীর্ঘ চিকিৎসায়ও কোন কাজ হল না। তার ছেলেমেয়েরা সবাই যুক্তরাজ্যে, কেবলমাত্র ছোট কন্যাটি মাকে হারিয়ে বাবাকে জড়িয়ে পাশে ছিল। দেড় দুই বছরের ব্যবধানে একমাত্র আশ্রয় বাবাকেও হারিয়ে সে পাগলপ্রায় হয়ে পড়ে। তার সদ্য নির্মিত সুন্দর ডুপ্লেক্স বাসাটিতে এই মেয়েটি ছাড়া থাকার মত আর কেউ রইল না আজও আমি যখন আক্কল কুয়ার মাজারের পাশ দিয়ে যাই, তখন এখানে চিরশায়িত এককালের এই অতিসুখী দম্পতির কথা মনে পড়ে যায় এবং নিজের অজান্তে অন্তর হতে বেরিয়ে আসে- ‘আসসালামু আলাইকুম ইয়া আহলাল কুবুরী, ওয়া রাহমাতুল্লাহী ওয়া বারাকাতুহু’

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন