পুবালী
ব্যাংক লিমিটেড, শাহী ঈদগাহ শাখা, সিলেটঃ
অবস্থানকালঃ
১লা মার্চ ২০০৬ সাল হতে ২৫ জানুয়ারি ২০১০ সাল।
অবস্থানঃ ৩ বৎসর
১০ মাস ২৪ দিন।
আমি তখন
দরগাগেইট শাখায়। ২০০৫ সালের রমজান মাসে হেড অফিসের একটি চিটি আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে
আব্দুল ওয়াহিদ সাহেব বললেন আপনার প্রতি রাজতলব এসেছে শীঘ্রই ঢাকা যেতে হবে। আমি
বললাম, রমজান মাসে আবার কিসের তলব, রোজা রেখে আমি ঢাকা যেতে পারবনা। আমার ধারনা হল
হয়ত কোন কর্মশালায় যাবার আদেশ এসেছে। কিন্তু
পত্রপাঠে দেখলাম সমন পাঠিয়েছেন আমাদের মহামান্য ব্যবস্থাপনা পরিচালক
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ স্বয়ং। কি উদ্দেশ্যে
এই তলব তার কোন ইশারা এই পত্রে নেই।
এই রমজানে
কিসের এই এত জরুরী স্বাক্ষাৎকার? কেউ বললেন খুব সম্ভব প্রমোশন। আমার সিনিয়র অফিসার
পদে অবস্থান প্রায় তিন বছর ছুই ছুই করছে, তবে হেডঅফিস এখনও প্রমোশন ডিউদের কোন
তালিকা চায় নাই। সবাই বললেন, ডাক যখন এসেছে বিসমিল্লাহ পাঠকরে রাজদর্শনে যান, রাজদর্শনে লাভ হয় বৈ কোন ক্ষতি
হয় না।
পূবালী
ব্যাংক প্রধান কার্য্যালয়ের তিনতলায় এমডি অফিসে গিয়ে দেখি অনেককে ফিটফাট ফুলবাবু
হয়ে চেয়ারে বসে আছেন। চট্টগ্রাম হতে এসেছেন কানাইঘাট
কন্যা সায়মা আক্তার, যিনি আমার সাথে ব্যাংকে যোগদান করেন এবং সিলেট শাখায় বেশ
কিছুদিন তিনি আমার সহকর্মি ছিলেন। সিলেট হতে আসেন শফিউল হাসান চৌধুরী, মশিউর রহমান
খান এবং এনামুল হক সৈয়দ। এরা সবাই সিনিয়র এবং প্রিন্সিপাল
অফিসার। ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দর্শনার্থী
হলের চেয়ারে লাইনে বসে সবাই পুরোনো দিনের
বন্ধু ও সহকর্মিদের সাথে বুক হাত মিলায়ে
হৃদয়ের জমানো সব খুশগল্প বিলায়ে দিচ্ছেন।
স্বনামধন্য
ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদ খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ স্যারকে এবার খুব কাছ থেকে দেখার
সৌভাগ্য আমার হল। একবার স্যার বেরিয়ে তার অফিস কক্ষে
যান। নীল হাফসার্টে কালো কারুকাজ, ঘি কালার প্যান্ট, পায়ে চপ্পল ও চোখে ছিল পুরু
চশমা। তার হাঁটার গতি ধীর এবং চোখের দৃষ্টি ধ্যানময়।
সাক্ষাৎকার
চলছে, একজন বের হলে ক্রমানুসারে অন্যজনের ডাক পড়ছে। এবার আমার ডাক পড়ল। সালাম দিয়ে
ভিতরে ডুকামাত্র এম ডি স্যার আমাকে সামনের চেয়ারে বসতে বললেন। আমার ধারনা ছিল তিনি
ব্যাংকিং বিষয়ে জিঞ্জাসাবাদ করবেন। কিন্তু তিনি এসব বিষয়ে কোন প্রশ্নই করলেন না।
তিনি আমার মা বাবার বয়স কত? তাদের শরীর স্বাস্থ্য কেমন? তারা আমার সাথে একত্রে
থাকেন কিনা? আমার পত্নী কি করেন? আমার পুত্র কি করে, কোথায় পড়ে? এমনকি আমার
ভাইবোনেরা কে কোথায় আছেন, কি করেন ইত্যাদি বিষয় জানতে চান। সেইসাথে ইব্রাহিম খালেদ
স্যার আমার পরিবারের আর্থিক ও সামাজিক অবস্থান জানারও চেষ্টা করেন।
শেষমেষ
বুঝলাম অতি বিচক্ষণ এম ডি ইব্রাহিম খালেদ মহোদয় আমাদের
কাঁধে দায়িত্বের লোড চাপাবেন, তাই বাহিরের কি পরিমান লোড এই আদমদের কাঁধে চেপে আছে
তাই গণনা করতে গিয়ে তিনি এতসব তথ্য জানতে চেয়েছেন। আজকের এম ডি এই আব্দুল হালিম
চৌধুরীর মত তিনি ধারনা, অনুমান, কিংবা অন্যের কথাবার্তায় প্রভাবিত হয়ে কোন কাজ
করতেন না, তিনি নিজে সবকিছু ভালভাবে পরখ করে দেখে স্বাধীনভাবে সঠিক ও নির্ভুল
সিন্ধান্তটি গ্রহন করতেন।
এইদিন রাতে
ধানমন্ডির তাকওয়া মসজিদে তারাবি পড়ে আমার
সমনদিক আজিজ ভাই আমাকে নিয়ে পাজারো চালিয়ে তার গোলশানের বাসায় যান। সেখান হতে বের
হয়ে তিনচার বাসা এসেই বললেন এই তোমার ব্যাংকের পরিচালক হাফিজ আহমদ মজুমদারের বাসা।
আমি বললাম গাড়ি একটু থামান আমি গিয়ে তার সাথে দেখা করে আসি। ড্রাইভার
খোকন মুল রাস্থার একপাশে গাড়ি থামাল।
আমি একাকী
গিয়ে তার বাসার দুতলায় সিটিং রোমে বসলাম। হাফসার্ট পড়ে চশমাচোখে ক্লিনসেভ হাফিজ
মজুমদার এম পি সাহেব এসে পাশের সোফায় বসলেন। এক ভরাট গলায় সজুরে গৃহকর্মীকে আদেশ
দেন, আব্দুল তাড়াতাড়ি নাস্তা নিয়ে আয়। চোখের পলকে সামনে চানাস্তা এসে হাজির হল।
অতীতে কোন একদিন এক আত্মীয়ের সাথে এই বাসায় এসে তার পত্নী হাফসা আপার সাথে দেখা
করেছিলাম। সেদিন হাফিজ মজুমদারকে পাই নি।
আজ তাকে পেয়ে গেলাম কিন্তু হাফসা আপা অসুস্থ হওয়ায় তার দেখা পেলাম না।
তিনি পুবালী
ব্যাংকে আমার অবস্থান জেনে নিয়ে কিছু পরামর্শ দেন। বললেন এই ব্যাংকে সুযোগ সুবিধা
অনেক কম, তদুপরি সর্টকার্ট পথে উপরে উঠার কোন রাস্থা এখানে নেই। তুমি আর অনেকের মত
একটার পর একটা ব্যাংক বদল করে করে কয়েক বছরেই এই পেশায় মগডালে উঠে যেতে পার। আমি
জবাব দিলাম আমার এত উচ্চকাংখা নেই, এখানে কেবল সবগুলো প্রমোশন ঠিকমত পেয়ে যেতে
পারলেই হল। আর বললাম আমি সামান্য টুকটাক ব্যবসা করি, এভাবে আমার দিন কোনমতে চলে
যাবে। এবার তিনি জানতে চান কিসের ব্যবসা? আমি হতচকিত হয়ে বললাম- শেয়ার টেয়ার এসব।
আমার এই ফটকাবাজি ব্যবসার খবর শুনে জাত ব্যবসায়ী মজুমদার সাহেব খুব একটা সন্তুষ্ট
হয়েছেন মনে হল না। সেইরাতে হাফিজ আহমদ মজুমদারের বাসা হতে বেরিয়ে সোজা ফিরে এলাম
ধানমন্ডির বাসায়।
ঢাকায়
রাজদর্শন দিয়ে ফিরে আসার কিছুদিন পরই বুঝলাম কেন এই রাজতলব, এবার প্রধান
কার্য্যালয় হতে আমার প্রতি পুবালী ব্যাংক লিমিটেড শাহী ঈদগাহ শাখার ব্যবস্থাপকের
দায়িত্ব গ্রহনের আদেশপত্র হাতে আসল। সেইসাথে মশিউর রহমান খান মহিলা কলেজ শাখা এবং
সফিউল হাসান চৌধুরী চৌধুরীবাজার শাখার শাসনকর্তার গুরুদায়িত্ব পান। ইতিপূর্বে আমি
পুবালী ব্যাংকের অনেক শাখায় অনেকবার অস্থায়ী ইমামতি করেছি। এমন কি চৌধুরীবাজার ও
চন্দরপুর শাখায় একসাথে দুইতিন মাসও আমি অস্থায়ী প্রধান ছিলাম।
এই অভিজ্ঞতা আমাকে এই গুরুদায়িত্ব কাঁধে তুলে নেবার যথেষ্ট সাহস যোগায় ।
প্রথম
ব্যবস্থাপক হবার আনন্দই আলাদা, এযেন সামান্য আমার বিশ্ববিজয়।
২৮ ফেব্রুয়ারি ২০০৬ সাল। এই
দিনটি দরগাগেইট শাখায় ছিল আমার শেষ কর্মদিবস। ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ মোসাদ্দিক
চৌধুরী স্যার এইদিন একটি ঘোষণা দেন- আমাদের কুরেশি সাহেব আজই চলে যাবে।
মোসাদ্দিক স্যার বললেন, কোরেশিকে আর ধরে রাখা যাবেনা, আঞ্চলিক প্রধান আব্দুল করিম
চৌধুরী মহোদয় নির্দেশ দিয়েছেন আজই যেন তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। আমি
বিকেলে মোসাদ্দিক স্যারের সামনের চেয়ারে বসে আছি, এমন সময় দেখলাম স্যার তার
কম্পিউটারে কি যেন লিখছেন। একটু পরই
স্যারের পাশে বসানো প্রিন্টার মেশিন হতে কটকট কটকট শব্দকরে আমার রিলিজ
অর্ডারটি বেরিয়ে আসল।
এবার
মোসাদ্দিক স্যার সকলকে ডাক দেন- আপনারা আসুন সবাই, একটু চানাস্তা করে কুরেশিকে
বিদায় জানাই। কর্ম কোলাহলে মুখর দরগাগেইট শাখায়
সবাই একসাথে টেবিল ছেড়ে আসা বেশ কঠিন ব্যাপার। চেম্বারের ভিতর ও বাহিরে সকলে এসে
জমায়েত হল। তাদের এতদিনের ঘনিষ্ট একজন সহকর্মী এই আমি প্রথমবারের মত ব্যবস্থাপক
হয়েছি, তাইতো সবাই দারুণ খুশী এবং আমাকে প্রাণভরে অভিনন্দন জানাতে কারও যেন কোন
কার্পণ্য নেই। একে একে ছোটবড় সবার সাথে কোলাকোলি করে সেইদিন সন্ধ্যাবেলা পারহলে
নিয়নবাতির আলো ঝলমলে সামনের রাস্থায় নামলাম। দরগার পুর্বগেটের রাস্থা ধরে গুটিগুটি
পায়ে হেটে হজরত শাহজালালের(রঃ) মাজারে ছুটে গেলাম। কারণ হাতে তেমন সময় নেই, আজই এই মহান ওলি আল্লাহর
দোয়া ও আশির্বাদ নিয়ে আগামীকল্যই ইদগাহ শাখায়
হাজির হয়ে ব্যবস্থাপকের গুরুদায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে হবে।
১লা মার্চ
২০০৬ সকাল ৯ ঘটিকার বেশ আগেই ঈদগাহ শাখায় এসে
হাজির হই। ঐতিহ্যবাহী শাহীইদগাহ
ময়দানের উত্তর পূর্ব প্রান্তে একটি তিনতলা ভবনের দুতলায় শাখাটির অবস্থান। বর্তমান
শাখা ব্যস্থাপকের নাম নুরুল হুদা, বেশ মোঠাসোঠা বডি ও পাতলা চুলের এই হুদাস্যারের
বাড়ি কুমিল্লায়। তিনি একটি পুরানো ভ্যাসপা মোটর সাইকেল
চড়ে বাঘবাড়ি হতে অফিসে আসা যাওয়া করতেন। খুব একটা উচ্চ
শিক্ষিত না হলেও তিনি নিম্নস্থরে চাকুরিতে ঢুকে
ব্যবস্থাপক হন। টেবিলওয়ার্কে তার বেশ দক্ষতা আছে কিন্তু চাকুরির
শেষ হবার আর বেশী দিন বাকী নেই। নুরুল হুদা স্যার হাস্যবদনে দুএকদিনের মধ্যে শাখার
সব দ্বায়দায়িত্ব আমাকে বুঝিয়ে দিয়ে বিদায় নেন। নুরুল হুদা স্যার এখানে
ব্যবস্থাপনার সাথে সব ধরনের মাসিক, ত্রৈমাসিক, ষান্মাসিক ও বাৎসরিক বিবরনী
প্রস্তুত করে প্রধান কার্যালয়ে পাঠাতেন। ঋন বিভাগ এবং আদায় বিভাগের সমুদয় কাজও
তিনি একহাতে করতেন। আমি তার করা সমুদয় কাজগুলো নিজহাতে তুলে নিলাম। যথেষ্ট অতীত
অভিজ্ঞতা থাকায় একাকী এই কাজগুলো করা আমার জন্য খুব একটা অস্বস্তিকর মনে হল না।
এখানে এসে
সহকর্মী হিসাবে আমার কদমতলী শাখার বস
আলাউদ্দিন স্যারের ভাগনা বদরুল আলম, কানাইঘাটের মোঃ জাহাঙ্গীর আহমদ, আমার দরগাগেইট
শাখার বস মোসাদ্দিক স্যারের ছোটভাই আব্দুল মুমিত চৌধুরীকে পেয়ে যাই। মুমিত সাহেবের
মোঠাদেহ, তার ওজন কমাতে আমি হেটে আম্বরখানা আসতাম, তাকেও সাথে হাঁটতে বাধ্য করতাম।
ক্যাশ কাউন্টারের প্রধান ছিলেন ফেনীর ফরিদ আহমদ, যার সাথে মহিলা কলেজ শাখায় একসাথে
কাজ করেছি।
আমি আসার
কিছুদিন পর এখানে যোগদেন ভাগ্নি সালেহা আক্তার। তিনি আমার ফুফুতো ভাই গোলাপগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান এডভোকেট ইকবাল আহমদ চৌধুরীর ভাগ্নি।
সালেহার পতি বেলাল আহমদ চৌধুরী আমার পূর্ব পরিচিত, তিনি গ্রীনডেলটা ইন্সুরেন্সে
চাকুরি করতেন। সালেহার বাসা অফিসের পাশেই ছিল। সেখানে
শাখার সবাই কয়েকবার গিয়ে দাওয়াত খেয়ে আসি।
আমার
দায়িত্বপালন কালে যোগদান করেন শিক্ষানবিশ আফিসার জকিগঞ্জের কাওসার আহমদ এবং মোঃ
কামরুজ্জামান। মোঃ কামরুজ্জামান পরে উপজেলা শিক্ষা অফিসার হয়ে ব্যাংকের চাকুরি
ছেড়ে চলে যান।
অফিস কর্মী ছিল খাদিমের শাহনাজ মিয়া। সে একজন মৃগী রোগী। একদিন হঠাৎ সে মঝেতে পড়ে
এমনভাবে গড়াগড়ি করতে থাকে যে মনে হচ্ছিল এই বুঝি মারা যাবে।
তার মুখ দিয়ে ফেনা বেরুতে থাকে। কে একজন তার নাকের সামনে জুতা ধরেন। জুতার গন্ধে
নাকি মৃগীরোগ চলে যায়। আমি ভয় পেয়ে গেলে মুমিত সাহেব বললেন তার মাঝে মধ্যে এরকম
হয়। এটা নিয়ে ভয়ের কিছু নেই, সে পরে এমনিতেই ভাল হয়ে যাবে। তার অসহ্য গড়াগড়ি বন্ধ
হলে সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে। এক সময় তার জ্ঞান ফিরলে তাকে বললাম, শাহনাজ কি হয়েছে রে
তর। অদ্ভুত ব্যাপার সে জবাব দিল, কিছুই
জানিনা। বললাম, তর বুঝি অসম্ভব কষ্ট হয়েছে? বলল, কিছুই বুঝি নি।
বললাম, চিকিৎসা করেছিছ? বলল একটু আধটু করেছি, আমরা গরিব মানুষ,
টাকার অভাবে সম্ভব হয় নি। আমি তখন দশ হাজার টাকা চিকিৎসা করার জন্য তার হাতে তুলে দিলাম। পরে
আমি সচেষ্ট হয়ে তার চাকুরী স্থায়ী করে দেই।
ঈদগাহ শাখায়
একটি গ্যাসের চুলা ছিল। শাহনাজ প্রতিদিন মধ্যাহ্নে রান্না করে আমাদের খাবার আয়োজন
করত। তার কুচি কুচি আদা দিয়ে রান্না করা
মোরগের তরকারি ছিল বেশ মজাদার।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন