শনিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

এম সি কলেজের অম্লমধুর স্মৃতি, কখনও হবেনা তার ইতি

এম সি কলেজের অম্লমধুর স্মৃতি, কখনও হবেনা তার ইতি

সেশনঃ ১৯৮১-৮২, চুড়ান্ত পরীক্ষা বর্ষ-১৯৮৩ সাল

অবস্থানঃ জুন ১৯৮১ হতে আগস্ট ১৯৮৩ সাল                            

 

আমাদের সময় এম সি কলেজকে বলা হত সিলেট সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ। আব্বা সফিকুর রহমান চৌধুরী ১৯৩৭ সাল হতে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত এই এম সি কলেজের ছাত্র ছিলেন। পিতার প্রস্থানের চল্লিশ বছর পর আমি এই এম সি কলেজের একাদশ বিজ্ঞানে ভর্তি হই।

এই কলেজে আমার পা রাখার প্রায় নব্বই বছর আগে ১৮৯২ সালে কলেজটির জন্ম হয়। সিলেটের বিখ্যাত জমিদার রাজা গিরিশ চন্দ্র রায় তার পালক পিতা মুরারী চাদের নামে কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেন। আমার আগে এখানে অধ্যয়ন করেন আমার চাচাত ভাই প্রথম সিলেটি আইজিপি ই এ চৌধুরী, চাচাত ভাই সচিব ও  সাহাবউদ্দিন সরকারের উপদেষ্টা ইমাম উদ্দিন চৌধুরী, চাচাত ভাই গ্রীনডেল্টা ইন্সুরেন্স কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা কিংবদন্তী বিমাব্যাক্তিত্ব নাসির চৌধুরী, ফুফুত ভাই বিখ্যাত শিক্ষাবিদ শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্টাতা ভাইস চেন্সেলর ডঃ সদরউদ্দিন চৌধুরী, ফুফুত ভাই সড়ক ও জনপথ বিভাগের প্রধান প্রকৌশলীপিএসসির সদস্য বদরউদ্দিন চৌধুরী। তাছাড়া অর্থমন্ত্র এম সাইফুর রহমান, শিক্ষামন্ত্র নুরুল ইসলাম নাহিদ, মন্ত্র আবুল মাল আব্দুল মুহিতসহ সিলেট অঞ্চলের প্রায় সব সম্মানিত ঐতিহাসিক ব্যাক্তিবর্গ এই কলেজের ছাত্র ছিলেন। ঐতিহ্যবাহী এই কলেজটি ছিল সিলেট বিভাগের তৎকালীন সময়ের সেরা বিদ্যাপীট। তখনকার দিনে সিলেট ক্যান্টনমেন্ট কলেজ, স্কলার্সহোম কলেজ কিংবা এত প্রাইভেট কলেজের ছড়াছড়ি ছিলনা। তখন এই অঞ্চলে এম সি কলেজের কোন তুলনা ছিলনা, তাই সিলেট বিভাগের এসএসসি উত্তীর্ণ বিজ্ঞানের সেরাছাত্ররা এই কলেজে ভর্তি হতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করতেন

১৯৮১ সালে এস এস সি পরীক্ষার ফল বের হবার পর এম সি কলেজে একাদশ বিজ্ঞানে ভর্তির ফরম ফিলআপ করতে এপ্রিল কিংবা মে মাসে এক সকালে দাউদপুর হতে বের হলাম। মা খুবভোরে উঠে তাড়াতাড়ি রান্নাবান্না করে খাইয়ে উদ্ভিঘ্ন মনে “ফিআমানিলিল্লাহ” বলে আমাকে বিদায় জানান। মায়ের উদ্বেগের কার আমি তার চোখে এখনও বাচ্চাছেলে শহরে গিয়ে নাজানি যদি হেরেটেরে যাই। তখন আমার বয়স মাত্র পনের ষোল বছর এবং এটাই আমার প্রথম একাকী শহরযাত্রা। মাকে বললাম ভয়ের কোন কার নেই, আমি এখন যথেষ্ট সাবালক, আমি সববুঝি এবং নির্বিঘ্নে সব করে নিতে পারব।  কদমতলীতে বাস থেকে নেমে চিরচেনা পথে হেটে এসে কিনব্রিজ পার হই। সুরমা ব্রিজ রিকশায় চড়ে অনেকবার পার হলেও হয়ত এই প্রথম পায়ে হেঁটে পার হলাম।

সাত মাইল দূরে আমার বাড়ি হলেও এই সিলেট শহরের কোন অলিগলি আমার চেনা ছিলনা। টিলাগড় কোনদিকে তাও জানিনা, তাই একটি রিকশায় ছুটলাম। এই রাস্থার দুই দিকের সাইনবোর্ড পড়ে পড়ে বাজারগুলোর নাম মিরা বাজার, শিবগঞ্জ ও টিলাগড় মনে গেঁথে নিলাম। কার এই পথে আগামি দুই বৎসর আমাকে ঘুরতে হবে। গেটে রিকশা হতে নেমে জীবনের এই প্রথমবার আমার দীর্ঘ প্রতীক্ষিত ও বহুকাংখিত এম সি কলেজের সামনে দাড়াই। কলেজটি যেন আমাকে স্বাগত জানাতে শত বছরের ঐতিহ্যধার করে বেশকটি পরিপাটি টিলা ও নান্দনিক বৃক্ষরাজি বুকে নিয়ে  শিরউঁচু করে সামনে নরবে দাঁড়িয়ে আছে। সারাদিন কলেজে ঘুরাঘুরি করে বাদ মাগরেব যখন ঘরে ফিরলাম মনে হল মায়ের সারাদিনের দুশ্চিন্তা ও মহাঅপেক্ষার অবসান হল, তিনি যেন তার সকালবেলা হারিয়ে যাওয়া মানিক রতন সারাদিনের অপেক্ষার পর রাতে ফিরে পেয়েছেন।

সিলেট বিভাগের হাইয়ার সেকেন্ড  ডিভিশন ও প্রথম বিভাগ পাওয়া সাত শতাধিক ছাত্র একাদশ বিঞ্জানে ভর্তি হবার জন্য আবেদন করেন। ভর্তির জন্য কোন লিখিত পরীক্ষার বিধান ছিলনা। তবে এসএসসি পরীক্ষায়  মার্কসিটে প্রাপ্ত নম্বর বিবেচনা করা হয় এবং শিক্ষকরা ভর্তির জন্য আমাদের মৌখিক পরীক্ষা নেন। আমি এস এস সি পরীক্ষা দেবার পর তুড়ুকখলার দীপক চক্রবর্তী ও কয়েক জন ছাত্র আমার কাছে এসে টিউশনি পড়ে। ফলে বিঞ্জান ও গণিত আমার মনে সতেজ ছিল। স্যাররা নবম ও দশম শ্রেণি পর্যায়ের গণিত, বিজ্ঞান ও ইংলিশ বিষয়ে প্রশ্ন করেন। মৌখিক পরীক্ষার উত্তর দেই অনায়াসে। ভর্তির সিট সংখ্যা মাত্র তিনশত, নির্দিষ্ট দিনে উত্তীর্ণদের তলিকা অফিসের সামনে নোটিশ বোর্ডে টেনে দেওয়া হল। ভয়ে ভয়ে নোটিশ বোর্ডে চোখ বুলিয়ে আমার নাম ও নম্বর দেখে আনন্দে লাফিয়ে উঠি। যার অপার মেহেরবানিতে কাংখিত স্বপ্নের কলেজটিতে  ভর্তির দুর্লভ সুযোগ খুব সহজেই পেয়ে যাই, আমি সেই সুযোগ পেয়ে মহান আল্লাহকে অশেষ কৃতঞ্জতা জানাই দুঃখ পেলাম, যখন দেখি আমার মোগলাবাজার রেবতী রমন উচ্চবিদ্যালয়ের কোন সহপাঠি এখানে ভর্তি হবার কোন সুযোগ পায়নি একসময় এখানে উচ্চমাধ্যমিকে কলা ও বানিজ্য বিভাগ ছিল, পাশে সরকারি উচ্চমাধ্যমিক কলেজ প্রতিষ্ঠার পর এখানে বিজ্ঞান চালুরেখে অপর দুইটি বিভাগ বন্ধকরে দেওয়া হয়। 

১৯৮১ সালের জুনে সিলেট বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের (বর্তমান এম সি কলেজ) একাদশ বিজ্ঞানে তিন শত বিশ জন ছাত্রছাত্র ভর্তি হন। বেজোড় নম্বারের ছাত্ররা  সেকশন- “এ” ও জোড়রা সেকশন- “বি”তে অন্তভুক্ত হন। আমার নম্বর পড়ে ১১৭; সংখ্যাটি বেজোড় হওয়ায় “এ” সেকশনে আমি ঠাই পাই। এখানে একশতষাট জন ছাত্র একসাথে লেখাপড়া করে যৌবনের মধুময় দুইটি বৎসর চোখের পলকে পারকরে দেই।  

বিশাল এই সুন্দর কলেজে জায়গার পরিমান ১২৪ একর। টিলাগড়ের অনন্যসুন্দর বেশ কয়েকটি টিলা ও সমতল সবুজ চত্বর নিয়ে কলেজটি গঠিত। কলেজ চত্বর জুড়ে সব সময় বিরাজ করে এক মধুময় নরবতা। এই কলেজে টিলার পিঠে টিলা জড়ানকলেজে ঢুকার দুটি গেট ছিল। পিছনের ঈদগাহ গেটদিয়ে হোস্টেলের ছেলেরা কলেজে ঢুকত

সামনের তামাবিল সড়কের পাশের প্রধানগেট দিয়ে ঢুকে ডানের নিম্নভুমিতে দুইটি লালটিনের ছাদঢাকা পুর্ব-পশ্চিম বিস্তৃত সুদীর্ঘ্য পাকাভবন, রাস্থার সমান্তরালে উত্তরদিকেরটি ছিল রসায়ন ভবন ও দক্ষিণদিকের ভবনে ছিল ইতিহাস, অর্থনীতি ও বাংলাবিভাগবামে টিলার ধাপে ছাত্রী মিলনায়তন ও আটত্রিশটি সিঁড়িবেয়ে আর উপরে উঠে বৃটিশামলে নির্মিত সুন্দর কলেজ অফিস। এই অফিসে রয়েছে অধ্যক্ষের কার্যালয় ও সাধার শিক্ষক মিলনায়তন অফিসের চারপাশে ছিল ঝাউবন ও পুষ্প উদ্যান।

অফিসের পশ্চিমের টিলায় এম সি কলেজ পাঠশালায় কমলা রঙ্গের সার্ট ও সাদা প্যান্ট পরা শিশুরা যখন পাহাড়ের ঢালুতে কৃষ্ণচূড়া বৃক্ষের তলায় দল বেঁধে লুটোপুটি খেত তখন মনে হত এযেন কমলা রঙ্গের শিশুমেলা হচ্ছে

কলেজের অফিস টিলা হতে নিচে নেমে সামনের টিলায় সিঁড়িবেয়ে ঊঠে অপূর্ব সুন্দর বৃটিশ নির্মানশৈলীতে নির্মিত দুতলা কলাভবন। কলেজের প্রতিষ্ঠালগ্নে এক বিশাল টিলাকে কেটে সমতল করে কলাভবন চত্বর সাজানো হয়েছে। কলাভবনের বামে  টেনিস গ্রাউন্ড ও চারপাশ জুড়ে সমতল সবুজ ঘাসচত্বর, চত্বরের কিনারা জূড়ে ছিল সারি সারি ঝাউগাছের সুরম্য বন ও নানা জাতের বিদেশী বৃক্ষের বিচিত্র সমাহার। এই বনের ফাঁকে ফাঁকে ছিল বসার সারি সারি ব্রেঞ্চ। যে ব্রেঞ্চে বসে আমরা মজার আড্ডা দিতাম কিংবা নরবে বসে অধ্যয়ন করতাম। এখানে আমরা সহপাঠিরা একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে বসে কত যে রঙ তামাশা করেছি আজ তার হিসাব দেবার কেঊ নেই।

টিলাটির নাম থ্যাকারে টিলা। বিখ্যাত ইংরেজ সাহিত্যিক থ্যাকারের পিতামহ উইলিয়াম ম্যাকপিস থ্যাকার ১৭৬৫ সাল হতে ১৭৭০ সাল পর্যন্ত সিলেটের প্রথম ইংলিশ কালেক্টর ছিলেন। উনি যে পাহাড়ে বাসস্থান তৈরি করে সিলেটে বৃটিশ শাসনদন্ড পরিচালনা করতেন তাই হল ‘থ্যাকারে পাহাড়’ কলা ভবনের পিছনে ঐতিহ্যবাহী সুউচ্চ এই থ্যাকারে পাহাড়ের উপর বৃক্ষ ও বাগান সজ্জিত অধ্যক্ষের বাসভবন, এযেন বিদেশী চাবাগানের এক সুরম্য বাংলো বাড়িএই বাসভবন হতে টিলা পেছিয়ে পেছিয়ে পিচঢালা কালো রাস্থা নিচে নেমে এসে ঈদগাহ সড়কে পড়েছেনীচ হতে উপরে সারাটা টিলাজুড়ে ছিল দেশী বিদেশী বৃক্ষের অপূর্ব মিলনমেলা।

আমাদের সময়ে এই ভবনের বাসিন্দা ছিলেন অধ্যক্ষ গোলাম রসুল, যিনি সিলেট শহরের হাওয়াপাড়ার সন্তান। আমাদের পুরাটা সময়ই তিনি এই কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন ও আমরা বেরিয়ে যাবার কিছুদিন পর ১৯৮৩ সালের শেষদিকে অবসর গ্রহ করেন। আমার শ্বশুর ফুড কন্ট্রোলার এনাম উদ্দিন চৌধুরী ২০০৩ সালের ৩০ জানুয়ারি পরলোকগমন করেন। তাঁকে হজরত শাহজালালের দরগাহ মসজিদের পিছনের টিলায় দাফন করা হয় আমার শ্বাশুরের  মৃত্যুর বছরখানেক পর জেয়ারত করতে গিয়ে দেখি তার কবরের উপর একটি সমাধিফলক বসানো- অধ্যাপক গোলাম রসুল, প্রাক্তন অধ্যক্ষ, এম সি কলেজ, সিলেট। বাসায় ফিরে গিন্নীকে বললাম, তোমার বাবা একজন অতিভাল মানুষ, তাই মহান আল্লাহতায়ালা কবরেও অধ্যক্ষ গোলাম রসুল স্যারের মত একজন উত্তম মানুষকে তার বন্ধু ও সঙ্গী করেছেন।

কলাভবনের পুর্বদিকের সিড়িবেয়ে নিচে নেমে বিশাল বর্গাকার কাজলদিঘি, যে দিঘির জলে অজস্র লালপদ্ম মুখমেলে শোভা বিতর করত। ফুটত নানা বর্ণের জলজ ফুল। এই কাজলদিঘির দুইপারে ছিল পিচডাকা পথ যা সামনের ছড়াসেতু পেরিয়ে পদার্থবিঞ্জান ভবনের এপ্রোচে পৌছে গেছে। মনে পড়ে কলেজ হতে বিদায়বেলার কোন এক সোনালি দিনে আমরা সহপাঠিরা এই কাজল দিঘিতে জল ছুড়াছূড়ি খেলায় মেতে উঠি। সামনে পড়া সহপাঠিদের কেউই রেহাই পায়নি। একে অন্যকে বা কয়েকজন মিলে একজনকে ধরে বেঁধে পাজাকুলা করে এনে জলে নিক্ষেপ করি। দিঘির কিনারা ঘেষে ছিল কোমর কিংবা একবুক জল। এই মধুভরা দিনে জুতজা প্যান্ট সার্ট ভিজিয়ে এলোমেলো বেশে সবাই বাসা ফিরে।

দিঘির পশ্চিমপারে ছিল কলেজ পাঠাগার, এই সমৃদ্ধ পাঠাগারে ছিল সারি সারি মূল্যবান বই। এই পাঠাগার কেবলমাত্র বই ভান্ডারই নয়, এযেন এক অমূল্য জাদুঘর, যেখানে কলেজের শত বছরের সচিত্র ইতিহাস রক্ষিত রয়েছে। এখনে আছে কলেজের বিগত দিনের অনেক নামীদামী অধ্যাপক ও উজ্জ্বল ব্যক্তিত্বদের জীবনী ও তৈলচিত্র, আছে সুসজ্জিত গ্যালারি ও বই পড়ার এক নরব নিস্থব্দ পরিবেশ।

উত্তর দিঘিপারে ছিল কলেজ কেন্টিন ও ছাত্র মিলনাতন, দুটি ভবনই পাকা লালটিনের আলাদা দুটিঘর। ছাত্র মিলতায়নে ছিল ইন্ডোরগেমের নানা সরঞ্জাম। এখানে কয়েকটি ক্যারম বোর্ড ও টেবিল টেনিসের বোর্ডে সব সময় ছাত্ররা মহানন্দে খেলা করত। আমিও সেখানে অনেক খেলেছি, ক্যারম বোর্ডে কিংবা টেনিস বলে বেড মেরে ক্লাসের সময় হয়ে গেলে মাঝপথে খেলা সাঙ্গকরে ছুটে গেছি ক্লাসেবল ও বোর্ড সাথে সাথে লুফে নিয়েছে অপেক্ষায় থাকা অন্যকেউ। ক্যান্টিনে একটি টেবিলে ছিল বিস্কুট ও সিঙ্গারা, পাশে মিটসেফে চিনি ও দুধপটের কাছঘেষে কেরসিনের চুলায় বসান গরম চাএখানে হত নগদে লেনদেন, আজকে আমার, কালকে তোমার পালা।

কাজলদিঘির দক্ষিণপারে ছিল কলেজ অডিটরিয়াম। ধাপে ধাপে উপরে গিয়ে শেষসীমানায় রঙ্গমঞ্চ, একতলা ও দুতলা জুড়ে স্থাপিত দুই বসার গ্যালারি হতে সবাই স্বাচ্ছন্দ্যে স্পষ্ট দেখতে পেত মঞ্চের অনুষ্ঠান। ভর্তির পর আমাদেরকে বর করতে বিভিন্ন ছাত্রসংঘটন বেশ কয়েকটি নবীনবরন অনুষ্ঠান করে। এইচ এস সি তে বিশাল সিলেবাসের জন্য ভর্তি হওয়া মেধাবী ছেলেদের রাজনীতিতে জড়ানর সময় ও সুযোগ কোনটাই ছিলনাউপরের অনার্সের ও বড় ক্লাসের ছাত্ররা রাজনীতি ও নেতাগিি করতেন।

এবার একটি স্মৃতিময় নবীনবর অনুষ্ঠানের বিবর দেব। মনে হয় সেদিন ছাত্রলীগের অনুষ্ঠান ছিল, কার এই অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর দুঃখে অনেক নেতাকে চোখের জল মুছে মুছে তেজস্বী ভাষ দিতে দেখি বক্তারা ঘাতকের হাতে নিহত বঙ্গবন্ধু পরিবারের প্রতিজন সদস্যের নাম উচ্চার করে যেন শোকগাঁথা পাঠ করে যান। তাঁরা বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের বিচার দাবি করেন। এই সভায় প্যান্ডেলের একটি চেয়ারে বসেন কবি নির্মেলেন্দু গুন। লম্বা দাড়িগোঁফ, খদ্দরের পাজামা পাঞ্জাবি পরিহিত কবি নির্মলেন্দু গুনকে সেদিন টুপিহীন একজন মুসলিম পীরফকির মনে হল

অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকে “জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু” শ্লোগানে সারা অডিটরিয়াম কেঁপে উঠে

আরেক জাসদ ছাত্রলিগের অনুষ্ঠানে কর্নেল তাহেরের গুণগান ও জেনারেল জিয়ার মুন্ডুপাত করা হয়ছাত্র ইউনিয়নের সভায় মঞ্চে এসে বসেন পদার্থবিজ্ঞানের দাড়িওয়ালা শিক্ষক আহমদ আলী স্যার। সেদিন “দুনিয়ার মজদুর এক হও, বাংলার মজদুর এক হও” শ্লোগান শুনা যায়। মজার মজার তেজস্বী ভাষ শুনে শুনে বেলা পেরিয়ে রাত হত, তখন রঙ্গমঞ্চে পর্দা পড়ত, নানা বর্ণের আলো জ্বলে উঠত। কবিতা, কৌতুক ও মঞ্চনাট্য হত। সিলেট ও ঢাকার শিল্পীরা সুর ও সঙ্গীতের লহরী তলতেন। এখনও কানে বাজে কোন এক নবীনবর অনুষ্ঠানে আমাদের সিনিয়র ক্লাসের দুইজন ছাত্র ও ছাত্রী মিলে গাইছেন-“কি জাদু করিলা, পীরিতি শিখাইলা, থাকিতে পারিনা ঘরেতে, প্রাসজনী, থাকিতে পারিনা ঘরেতে, কি মন্ত্র পড়াইলা” 

অডিটরিয়ামের পূর্বদিকে এই দিঘিপারে ছিল বোটানিভবন ও সুসজ্জিত বুটানিক্যাল গার্ডেন। এই ভবনের দক্ষিণপ্রান্তে তামাবিল রোডের সাথে ছিল সোনালী ব্যাংকের একটি শাখা। দিঘির পুর্বপারে ছিল টিনের একটি পাকা মসজিদ ও অজুর ঘাট। এখানে আমি প্রায়ই জোহরের  নামাজ জামাতে পড়তাম।

পিছনের গেটদিয়ে বের হয়ে ঈদগাহ রাস্থা দিয়ে ডানে অগ্রসর হলে প্রথমেই ডানদিকে চোখে পড়ে শিক্ষকদের বাসভবন। আর সামনে এগিয়ে গেলে বামে সুবিশাল এম সি কলেজ মাঠ, যে মাঠটি এত বড় যে এখানে একসাথে পাঁচ ছয়টি ফুটবল মাঠ সাজানো সম্ভব। বাসা ছিল কাছে তাই এই মাঠেও আমার দুই চার দিনের ফুটবল খেলার স্মৃতি রয়েছে। সিলেট অন্তঃকলেজ ফুটবল ফাইনাল দর্শকভবনের দুতলায় গাদাগাদি হয়ে দাঁড়িয়ে উপভোগ করি। মাঠের দক্ষিণে রাস্থা পার হলেই কলেজ হোস্টেল। বৃটিশ আমলে নির্মিত পাঁচটি একতলা লালটিনের উচু ছাদের পাকা ভবন। প্রতিটি ভবনের সামনে পামগাছ ও খোলা প্রান্তর। এই হোস্টেলে ফেঞ্চুগঞ্জ সারকারখানার সুনয়ন, সুনামগঞ্জের সুহেলসহ অনেক সহপাঠির কক্ষে পড়া শিখতে বসতাম।

আমি মাঝে মাঝে ভাবতাম আমার প্রিয় এম সি কলেজকে যদি একটি দেশ হিসাবে কল্পনা করি তাহলে কি হবে, এটিকে অবশ্যই সুইজাল্যান্ডের সাথে তুলনা করা যাবে। এখানে আছে পাহাড়টিলা, আছে উপত্যকা, আছে কাজলদিঘি লেক, আছে পাহাড়চুড়াকাজলদিঘি ও বুটানিভবনের উত্তরঘেষে পাহাড়ের বালিচুষা ঝর্ণাটি এক পার্বত্য ছোটনদী হয়ে বয়ে গেছেবুটানিক্যাল গার্ডেন ও সামনের রসায়ন ভবন যেন নিম্ন উপত্যকা। দুই গেট দিয়ে ঢুকা কাল পিচঢাকা রাস্থাটি সামনে একত্র হয়ে পুর্বের কাজলদিঘি পেছিয়ে ঝর্ণাসেতু পার হয়ে পাহাড়ঘেরা সবুজশ্যামল প্রান্তরে গিয়ে শেষ হয়েছে

সারাটা কলেজ ছিল গাড় সবুজ ঘাসের গালিচায় মুড়ানো, স্থানে স্থানে উচ্চশির পামবৃক্ষগুলোকে মনে হত যেন স্যুটকোট পরে অভিজাত ফুলবাবুরা দাঁড়িয়ে আছেন। এই রাস্থা হতে কোথায়ও সিঁড়িবেয়ে উপরে উঠে, আবার কোথায়ও কয়েকসিঁড়ি নিচে নেমে ভবনমালার সমারোহ। এই কলেজটি ছিল ফুল পাখি ও বৃক্ষের এক স্বর্গীয় সৌন্দর্য্যের লীলাভূমি। আমাদের সময় সুসজ্জিত ও পরিকল্পিত লে-আউট অনুযায়ী দেশী বিদেশী বৃক্ষরাজি লাগান ছিল। ক্যাম্পাসের সর্বত্র জুড়ে নানা বৃত্ত ও কোয়ারী করে লাগান অজস্র মৌসুমি ও বারমাসি রঙবেরঙের বিচিত্র ফুল ও পাতাবাহার অপুর্ব শোভা বিতর করত।

পাকিস্তানের জনক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ একবার এম সি কলেজে এসে এই কলেজের অপরূপ নৈসর্গিক সৌন্দর্য্যে অভিভুত হয়ে একে বলেছিলেন “The flower of the east”.

কবি দিলওয়ার তাঁর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমসি কলেজ নিয়ে একাধিক কবিতা লিখেছেন। ‘স্মৃতিময় এমসি কলেজ’ কবিতায় লিখেছেন, ‘চোখে জল, বুকে প্রেম, ফোটে থাকে শতাব্দী কুসুম/ এমসি কলেজ নাম, প্রজ্ঞা তাঁর সবুজে নির্ঘুম’।

একদিন ক্লাস শুরু হবার তারিখ ঘোষিত হল ক্লাস রুটিন সংগ্রহ করে প্রথমদিনের ক্লাস ধরতে কলেজে গেলাম। প্রথম ক্লাসটি অনুষ্ঠিত হয় রসায়ন ভবনের ক্লাস গ্যালারিতে। কাটের গ্যালারির ডেক্স ও ব্রেঞ্চ সামনা হতে ধাপে ধাপে উচু হয়ে ক্লাসরুমের শেষপ্রান্তে সমাপ্ত হয়েছে। রসায়ন বিজ্ঞানের এই ক্লাস নিতে আসেন আব্দুল মতিন স্যার। স্যারের মাথার তালুতে চুল একটু কম হলেও অন্য তিনদিকের ঘনচুল সযত্নে ফেলে টাক ঢেকে নিতেন।

বুদ্ধিদীপ্ত চেহারার মতিন স্যার রসায়ন বিজ্ঞানের কোন নিদৃষ্ট বিষয় পাঠে না গিয়ে রসায়ন বিঞ্জানের নানা চমকদার ঘটনা বলেন। একটু পর রসায়ন গবেষনাগারের কর্মরা স্যারের সামনের বড় টেবিল নানা কাচের জার ও ক্যামিক্যাল দিয়ে পুর্ণ করে দেয়। এবার স্যার রসায়ন বিঞ্জানের নানা অদ্ভুদ ও বিচিঁত্র ঘটনা সামনে ঘটিয়ে আমাদেরকে বিস্ময়ে অবিভূত করে দেন। স্যার একটি জারের পানির নিচে আগুন জ্বেলে দেখান ও একটি ট্রেতে অগ্নেয়গির অবিকল অগ্নিউৎপাত সংঘটিত করে সবাইকে থাক লাগিয়ে দেন। তিনি কাচের পাত্রে ভ্যালকেনর জ্বলন্ত লাভাপ্রবাহ তৈরি করেন। কক্ষ অন্ধকার করে বাতাসে কৃত্রিম আলোর তারাকা তৈরি করেন। রসায়নের নানা মজাদার যাদুখেলা দেখে দেখে আমার কলেজ জীবনের প্রথম ক্লাসটি সমাপ্ত হয়

বুদ্ধিমান আব্দুল মতিন স্যার অনেক পরে কয়েক বছর সিলেট মহিলা কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করে অবসর গ্রহ করেন। আজ কেউ যদি আমাকে প্রশ্ন করেন, আপনার কলেজ জীবনের প্রথম শিক্ষক কে? তাহলে নিদ্বিধায় বলব, আমার প্রিয় আব্দুল মতিন স্যার, যিনি আজ পরলোকের বাসিন্দা।

বাংলার প্রথম ক্লাসটি করান ডঃ শফি উদ্দিন স্যার। কাঁধে উত্তরীয় ফেলে সাদা পাজামা ও খদ্দরের পাঞ্জাবি পরে ক্লিনসেভ ডঃ শফি উদ্দিন স্যার তার লিখা “মানুষ বিদ্যাসাগর” নামক বইটি বগলে নিয়ে ক্লাসে প্রবেশ করেন। ঢাকার কাছে নরসিংদিতে জন্ম নেওয়া স্যারকে দেখে পুরাদস্তুর একজন বিখ্যাত সাহিত্যিক মনে হচ্ছিল। প্রথম ক্লাসেই স্যার বাজিমাত করলেন। স্যারের অসাধার বক্তৃতা শুনে ক্লাসে পিনপতন নরবতা নেমে আসে। স্যারের ভাষ জুড়ে ছিল উদার মানবতাবাদের জয়গান ও মানুষকে ভালবাসার উপদেশ।

বাংলাসাহিত্যে মানবতাবাদ নিয়ে ভাষণে তিনি বললেন, খেটে খাওয়া মানুষকে সম্মান দিতে হবে, রিকশাওয়ালাদের সাথে ভাড়া নিয়ে অনায্য আচর যেন তার কোন ছাত্র কখনও না করে। এই চিরস্মরণীয় ভাষণে তিনি কয়েকটি লাইন আবৃতি করেন যা আমি কোনদিন ভূলি নাই, ভুলবনা- “নানা বর গাভীরে ভাই, একই বর দুধ।/ জগত ভ্রমণিয়া দেখলাম, একই মায়ের পুত”এভাষণে তিনি মধ্যযুগের কবি কালীদাসের বিখ্যাত লাইন আবৃতি করেন- “শোন হে মানব ভাই, সবার উপরে মানুষ সত্য তার উপরে নাই”

ছাত্ররা বলত স্যারের একজন পীর আছেন, সেই পীর ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর। তিনি সব সময় বিদ্যাসাগরের গুণগান করতেন, বিদ্যাসাগর নিজে খেয়ে না খেয়ে কেমন করে দশ হাজার টাকা বিলাতে পাঠিয়ে উড়লচন্ডি দেউলিয়া কবি মাইকেল মধুসুদন দত্তকে উদ্ধার করে আনলেন সেই মহানুভবতার গল্প শোনাতেন। কিছু ছাত্ররা বলত, স্যারের মুখে আল্লাহ রসুলের কোন নাম নেই, সারাক্ষণ কেবল বিদ্যাসাগর, বিদ্যাসাগর। আমি বদলী হয়ে ঢাকা গেলে একদিন সহকর্মী যীশুকে নিয়ে নয়াপল্টনে শফি উদ্দিন স্যারের বাসায় যাই। তিনি তখন বয়সের ভারে জর্জরিত।  

বাংলাসাহিত্যের ক্লাসে শরতচন্দ্রের উপন্যাস “শ্রীকান্ত” পড়াতেন বিরেশ বাবু তিনি বাঙি নারীদের জীবনচিত্র দুটি লাইনে প্রকাশ করতেন ’রাঁধার পরে খাওয়া, খাওয়ার পরে রাঁধা একসাথে বাইশটা বছর বাঁধা’সিনিয়রদের কাছে শুনলাম বিরেশ স্যার বহুবছর ধরে এই শ্রীকান্তই পড়িয়ে যাচ্ছেন।

এতদিন স্কুলজীবনে আমরা একই কক্ষে বসে সারাদিন ক্লাস করেছি ও কেবল প্রথম ক্লাসটিতে রোলকলে “ইয়েস স্যার” বা “প্রেজেন্ট স্যার” বলেছি। বৈচিত্রময় ব্যাপার হল এখানে প্রতিক্লাসে রোলকল হয় ও শ্রেণিকক্ষ পরিবর্তন হয়। তাও আবার একটি ভবন হতে অন্য কোন দূরের ভবনে। সামনের লাইনে বসার প্রতিযোগিতায় শতাধিক ছাত্র নেচে গেয়ে হৈ চৈ করে দিত এক ম্যারাথন দৌড়।

একবার সামনের সিটে বসা নিয়ে রসিক সহপাঠি খলিলের সাথে বেশ ঝগড়া করেছি, সে কমলেশকে তামাশা করে বলত কম্বলেশ, মৃণালকে বলত সিন্যালখলিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ বিঞ্জানে মাস্টার্স করে ১৯৯০ সালে আমার সাথে পুবালী ব্যাংকে অফিসার হিসাবে যোগদান করে এবং কিছুদিন ব্যাংকে কাজ করার পর বিসিএস (প্রশাসন) পাস করে সরকারি চাকুরিতে যোগ দেয়। শ্রীমঙ্গলের জাতক খলিল জ বাংলাদেশ সরকারের সহকারী সচিব

কলেজে সাইকেল সেড ছিল, অনেক ছাত্র বাইসাইকেল চড়ে কলেজে আসত। হালকা নীলাভ বড় কলেজবাসেও আমরা গাদাগাদি করে চলাফেরা করতাম, জায়গা না পেয়ে অনেক ছাত্র বাসের ছাদেও বেয়ে উঠত বাসের গায়ে বড় বড় অক্ষরে লেখা ছিল ‘সিলেট বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ’। চালক ছিলেন ছাত্রদের সবার প্রিয় তরুভাই।

ণিতের ক্লাস নিতেন ঋষিকেশ স্যার। কাবুলি স্যার কিছুদিন ক্লাস নিয়ে বিদেশে চলে যান। একদিন সদ্য বিসিএস পাস করে সতরু একজন গণিতের শিক্ষক যোগদান করেন। তিনি জিন্সের প্যান্ট ও দামী গেঞ্জি পরে ক্লাস নিতেন, তখনও কুমার সেই স্মার্ট ও হাসিমুখ স্যারের নাম ছিল ধীরেশ সাহা। তিনি পরে এম সি কলেজের অধ্যক্ষ হয়ে অবসর গ্রহ করেন।

আমরাই ছিলাম ধীরেশ স্যারের চাকুরি জীবনের উদয়বেলার প্রথম ছাত্রব্যাচ ২০১৩ খ্রিস্টাব্দে আমি এম সি কলেজের অধ্যক্ষ অফিসে গিয়ে ধীরেশ সাহা স্যারের হাতে আমার লিখা “ইসফাক কুরায়শী রচনাসমগ্র” কলেজ পাঠাগারের জন্য তুলে দেই। ধীরেশ স্যারের নিজস্ব বাসা ছিল আমার বাসার কাছে বাগবাড়ি হিন্দুপাড়ায়

আমার পুত্র জেফার এইচএসসির গণিত শিখতে স্যারের কাছে টিউশনি পড়তে যায়। আমি জেফারকে নিয়ে ২০১৫ সালে ধীরেশ স্যারের সাথে তাঁর বাসায় দেখা করি। বেশ সুন্দর ছিমছাম বাসা। আমি এমসি কলেজ ১৯৮৩ ব্যাচ বলতেই চিনে ফেলেন। আমার সহপাঠি ওয়াদুদ, হাফিজ, রুমি, মতিউরসহ অনেকের নাম বলে যান, যারা ছিল সেরা মেধাবী। আমি ধীরেশ স্যারের স্মৃতিশক্তি দেখে বিষ্মিত হয়ে বললাম এত আগেকার ছাত্রদের নাম স্যারের এখনও মনে আছে? জবাব দেন মনে থাকবেনা কেন? এমসি কলেজ এইচ এস সি ১৯৮৩ ব্যাচ আমার শিক্ষকজীবনের প্রথম ব্যাচ। ডাঃ আব্দুল ওয়াদুদ তো আমার হার্টের চিকিৎসা করে। সে অতিশয় বিনয়ী। আমি ঢাকায় বদলি হয়ে আসার পর ২০২০ সালে ফেসবুকে খবর পাই আমাদের প্রিয় ধীরেশ সাহা স্যার না ফেরার দেশে চলে গেছেন।

আমরা ভর্তি হবার পর গণিত পড়ান এমন একজন জনপ্রিয় শিক্ষক ছিলেন ডক্টর মাসুদ কাবেলী স্যার। তিনি কলেজের টেনিস গ্রাউন্ডে সর্বদা টেনিস খেলতেন। এক সময় তিনি বিদেশে চলে যান। আমেরিকার মিশিগান প্রবাসী আমাদের সহপাঠী বন্ধু অলিউর রহমানের মাধ্যমে ১৯৮৩ ব্যাচ গ্রুপের ওয়ার্সসাপে জানতে পারি তিনি ২৯ ডিসেম্বর ২০২২ ডেট্রয়েট শহরের এক হাসপাতালে ইন্তেকাল করেছেন। ৩০ ডিসেম্বর স্থানীয় আলফালাহ মসজিদে নামাজে জানাজা শেষে তাঁকে মিশিগানে দাফন করা হয়। তিনি ছিলেন নেত্রকোনার জাতক। আল্লাহ তাঁকে জান্নাত দান করুন।    

আমাদের অঙ্কের আরেকজন শিক্ষকের নাম মনে আছে, তিনি আনোয়ার স্যার। জামাল উদ্দিন নাগরি নামেরও একজন গণিতের স্যারের মুখ চোখে ভাসে।

আমাদের পদার্থ বিঞ্জানের ননসিলেটি আফসার উদ্দিন স্যারের কথা খুবই মনে পড়ে। স্যারের টিলাগড়ের ভাড়া বাসায় গিয়ে প্রাইভেট পড়ে আমি ক্যালকুলাস, গতিবিদ্যা ও স্থিতিবিদ্যার গণিত শিখি। স্যারের একছেলে তখন সিলেট মেডিকেল কলেজে এমবিবিএস পড়ছিল। ফজলুল হক ও যবদুল হক নামের আর দুজন স্যারের স্মৃতি আজও মনে আছে। যল হক ছিলেন পদার্থ বিঞ্জানের বিভাগীয় প্রধান, তিনি শিক্ষক কলোনির সরকারি বাসায় সপরিবারে বসবাস করতেন। ইকবাল স্যার “শব্দ” পড়াতেন, তিনি শেষবয়সে কিছুটা অপ্রকৃতিস্থ হয়ে মারা যান।

রসায়ন বিভাগে বেশ কয়েকজন প্রাবন্ত স্যার ক্লাস নিতেন। মেঘনাদ ও পরিমল স্যারের কথা খুবই মনে পরে। সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের সন্থান অধ্যাপক সুধাংশু শেখর চক্রবর্তী স্যার ছিলেন শ্যামলা ও লম্বা চওড়া ব্যক্তিত্ববান শিক্ষক। স্যার ছিলেন একটু কড়া ও নির্ভীক। ছাত্ররা স্যারকে খুব সমিহ করত। পরীক্ষার হলে ছাত্রনেতারাও উল্টাপাল্টা কিছু করলে স্যার একবিন্দুও ছাড় দিতেন না। আমি সকালবেলা বালুচর অরামবাগে সুধাংশু স্যারের বাসায় গিয়ে বীজগণিত ও ত্রিকোণমিতি প্রাইভেট টিউশনি পড়ি। এই স্যার পরে এমসি কলেজের উপাধ্যক্ষ হন। আব্দুল মতিন স্যারের কথা আগেই বলা হয়ে গেছে। রসায়ন বিভাগের হবিগঞ্জি বাকিবিল্লাহ স্যারের স্মৃতি মনে পড়ে, এই হুজুর স্যারের পুরো নাম সৈয়দ আবু সজ্জাদ বাকিবিল্লাহ।

আমাদেরকে ইংরেজি পড়াতেন এমএ বাকী এবং এমএ বারী নামের দুইজন শিক্ষক। কৃশতনু যুবতী জিন্নাত আরা ম্যাডাম আমাদের ইংরেজি ক্লাস নিতেন। জিন্নাত আরা ছিলেন ফর্সা ও সুন্দরী। তার ইংলিশ বাক্যালাপ ছিল নির্ভূল ও সুস্পষ্ট। ইংলিশের অন্য স্যারের নাম ছিল বারিক সরকার

উদ্ভিদবিঞ্জান ছিল আমার ঐচ্ছিক বিষয়। এখানে দ্বিতীয় একজন পরিমল স্যারের দেখা পাই।

প্রাণিবিদ্যার ক্লাস নিতেন একজন তাজা ফর্সা সুন্দরী শিক্ষিকা। তাঁর নাম গুলনাহার বেগম। সেই ম্যাডাম মেটাফিজ/মেমোসিজ পড়াতেন, তিনি বড়বড় আগুন চোখে যখন তাকাতেন, ছেলেরা ভয়ে চুপ হয়ে যেত। গুলনাহার মেডান একসময় জাতীয় পাঠ্যক্রম ও স্কুল টেক্সট বুক বোর্ডের চেয়ারমেন হন। ২০২১ সালে ফেসবুকে সহপাঠি গোপীর লেখা পড়ে জানতে পারি গুলনাহার মেডাম আর পৃথিবীতে নেই। এসময় এই বিভাগে যোগ দেন সদ্য নিযুক্ত তরু প্রভাষক আজিজুর রহমান লস্কর। অবসর নিয়ে আজিজুর রহমান লস্কর স্যার প্রচুর লেখালেখি করেন।

আমাদের রসায়ন গবেষণাগারে ব্যবহারিক ক্লাসের দায়িত্বে ছিলেন ডেমনেষ্টেটর লস্কর সাহেব। তিনি ব্যবহারিক খাতায় একটু ভুল পেলে খাতা ছুড়ে ফেলতেন। দ্বাদশ ক্লাসে ফাইন্যাল পরীক্ষার আগে যতবারই খাতা দেই ততবারই লস্কর সাহেবের মন ভরেনা, তিনি ছুড়ে ফেলে দেন। শেষে আমরা কয়েকজন মনস্থির করলাম মাত্র পাঁচ নম্বরের খাতার জন্য আর সময় নষ্ট করব না, এই লোকটার হাতপা ধরবনা। আমরা লস্কর সাহেবের সই অবিকল জাল করে পাতায় পাতায় বসিয়ে দিলাম। ব্যবহারিক পরীক্ষার দিন এত খাতা জমা হয় যে স্যাররা তা খোলেও দেখেননি। রসায়ন ল্যাবকর্ম সালাম গ্লাসের উপর পড়া এসিড খালি হাতে মুছে পানির টেপে ধুয়ে ফেলত, বলত এসিড খুবদ্রুত পানি দিয়ে ধুয়ে ফেললে ত্বক পোড়ানোর সময় পায়না।

লব সনাক্তকরণের পরীক্ষার আগের দিন ল্যাবকর্ম সালামকে আমরা কয়েকজন বিশ টাকা করে বখশিস দেই। পরীক্ষাস্থলে কর্মরত সালাম এসে আমার নমুনা লবণের কয়েকদানা হাতে নিয়ে ভাল করে দেখে দুএক দানা জিহ্বায় দেন। তারপর বলেন এই লব মনে হয় “জিঙ্ক সালফেট” হবে। এবার তিনি একটি কাঁচের টেস্টটিউবে একটু নমুনা নিয়ে আগুনে ধরে দেখে ও শুকে বললেন এটি নিশ্চিত “জিঙ্ক সালফেট”

পদার্থবিজ্ঞানের ব্যবহারিক পরীক্ষার দিনে লটারি হয় কে কোন বিষয়ে পরীক্ষার ফলাফল নির্ণয় করবে। পাঁচ ছয়টি কাগজের টুকায় পরীক্ষার বিষয় লিখে সামনে ফেলা হয়। লটারিতে আমার ভাগ্যে ‘আতশী কাঁচের সাহায্যে আলোর প্রতিসরাঙ্ক নির্ণয়’ ওঠে। খুশি হলাম, এই টেস্ট আমার ভালভাবে জানা ছিল এবং আমি চেয়েছিলামও তাই। সেদিন অতশী কাঁচে আলোর প্রতিসরাঙ্ক নির্নয় করে সহজেই পার পেলাম।

একাদশ বিঞ্জানে ভর্তি হওয়া আমার তিনশত বিশ জন সহপাঠির অনেকের নাম আমার জানা হয়নি। তবে দুই বৎসর একসাথে থাকা “ক” শাখার একশত ষাট জনের মধ্যে আমার অনেক সহপাঠির স্মৃতি সুস্পষ্ট মনে আছে। আমি “ক” শাখার আমার প্রিয় সহপাঠিদের স্মৃতিই আগে তুলে ধরব। আব্দুল হাফিজ ছিলেন অতি মেধাবী ছাত্র। তিনি এসএসসি পরীক্ষায় বিশাল চট্টগ্রাম বোর্ডে বিঞ্জানে পঞ্চম স্থান অধিকার করেন তিনি চোখে চশমা দিতেন ও ফুলসার্ট পরে ক্লাসে আসতেন মিতবাক হাফিজ ছিলেন কিছুটা আত্মভূলা। তিনি অন্যদের সাথে খুব একটা মিশতেন না, কিংবা পড়ালেখা নিয়ে তিনি এতই ব্যস্ত ছিলেন যে তার বারবাজারি দুস্তিয়ানার সময়ই ছিলনা। হাফিজের গ্রামের বাড়ি গোয়াইনঘাট হলেও তারা হাউজিং এস্টেটে নিজবাসায় বসবাস করতেন। তিনি বুয়েট হতে ডিগ্রি নিয়ে বাংলাদেশ আনবিক শক্তি কমিশনে যোগদান করেন এবং আনবিক বিজ্ঞানী হনআমি পুবালী ব্যাংক বরইকান্দি শাখার ব্যবস্থাপক থাকাকালে একদিন শুনলাম আব্দুল হাফিজ আর নেই। শাহজালালের দরগায় জানাজায় গিয়ে বহুবছর পর আবার দেখা হল আমাদের সবচেয়ে মেধাবী সহপাঠী আব্দুল হাফিজের সাথে, তখন তিনি মহানিদ্রামগ্ন হয়ে শুয়ে আছেন খাটিয়ায়। শেষ যাত্রাকালে তার বয়স হয়েছিল বড়জুড় পাঁচচল্লিশ বছর

তিনি আব্দুল ওয়াদুদ চৌধুরী ওরফে নিয়াজ, গ্রামের বাড়ি উত্তরকুল, জকিগঞ্জ। বৈশাখী হাউস, কুমারপাড়া, ঝর্ণারপার নিজবাসায় অবস্থান করে তিনি লেখাপড়া করতেন ওয়াদুদ চৌধুরী সিলেট সরকারি পাইলট স্কুলের ছাত্র ছিলেন। সেখানে রুটিন বিভ্রাটে পড়ে এসএসসি পরীক্ষার কোন এক সকালের পরীক্ষা বিকেলে দিতে গিয়ে একবছর ড্রপ পড়ার কাহিনি শুনতাম। তিনি ছিলেন কৃশতনু শ্যামলা ও দীর্ঘঙ্গ। একটু খুড়িয়ে হাঁটা ওয়াদুদের চোখে ছিল পুরু চশমা। সবসময় হাসিমুখ ওয়াদুদ ছিলেন মিশুক ও কথাপোকথনে বেশ হ্যান্ডসাম। উচ্চাকাংখী ও মেধাবী আব্দুল ওয়াদুদ চৌধুরী ছিলেন নিরহঙ্কার ও আত্মপ্রত্যয়ী। তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হতে এমবিবিএস পাশ করে পরে এফসিপিএস ও এমআরসিপি করেনবর্তমানে অধ্যাপক ডাঃ আব্দুল ওয়াদুদ চৌধুরী ঢাকা মেডিকেল কলেজের হৃদরোগ বিভাগের প্রধানের দায়িত্ব পালন করছে

মতিউর রহমান ছিলেন মেধাবী কিন্তু দরিদ্র ছাত্র। তিনি ভাদেশ্বর পুর্বভাগ হাইস্কুল হতে আসেন। তিনি একসেট নীলপ্যান্ট ও হলুদসার্ট পরে উচ্চ মাধ্যমিক পার করে দেনতিনি বুয়েট হতে ডিগ্রি নিয়ে পরে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান ইব্রাহিম আলী আসেন ফেঞ্ছুগঞ্জ কাশিম আলী হাইস্কুল হতে, তিনি চট্টগ্রাম মেডিকেল হতে এমবিবিএস করেন ডাঃ ইব্রাহিম আলী ২০২০ সালে মাত্র চৌয়ান্ন বছর বয়সে যুক্তরাষ্ট্রে মারা যান।

আত্মনিমগ্ন কবি মোহাম্মদ হোসেন দোয়ারাবাজারের সন্থানঅসচ্ছল পরিবার হতে আসা মোহাম্মদ হোসেনের বড় হবার দুরন্ত স্বপ্ন ছিল, কিন্তু আমার মত জায়গির বাসায় অবস্থান করে বাসার ছাত্রছাত্রী পড়িয়ে তিনিও হোঁচট খানতিনি রসায়ন বিজ্ঞানে অনার্স ও মাস্টার্স করে এখন খাসদবির প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক। তার কবিতা সরোবরে আছে এক চাপা দুঃখবোধ যা  আবৃতিকালে আমার হৃদয় যন্ত্রনায় ভারাক্রান্ত করে দেয়

ফুলবাড়ির খায়রুল আক্তার চৌধুরী ও সফাকুল ইমরান চৌধুরী ছিলেন আমার দূরসম্পর্কীয় ভাগনা। তাদের সৌজন্যে আমি এমসি কলেজে অনেকের কাছে মামুতে পরিত হই। কৃশতনু দুগ্ধবর্ণ সুদর্শন খায়রুল আক্তার চৌধুরী ডিপ্লোমা এবং বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে এখন শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের আইটি কর্মকর্তা। দুঃসাহসী সুদর্শন ইমরান চৌধুরী মাত্র তেইশ বছর বয়সে রহস্যজনক কারণে পরপারে পারি দেন

আতিকুর রেজা চৌধুরী ফেঞ্ছুগঞ্জ ঘিলাছড়ার অভিজাত ঘরের ছেলে। সে ছিল ফর্সা ও সতেজ। তার সাথে আমার বেশ ভাব ছিল। একদিন আমি তামাশা করে তাকে গালী দেই। কিন্তু সে কিছুটা রাগ করে বসে। তার সাথে আর কোনদিন আমার দেখা হয়নি। তবে শুনেছি সে এখন বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালের নির্বাহী কর্মকর্তা। কালো হোসেইন আহমদ মিসুক ও সুভাষীতিনি এখন ঢাকায় আছেন।   

যার সাথে আমার যোগসুত্র কোনদিন ছিন্ন হয়নি, তিনি মাহবুব আহমদ। তার বাড়ি কালিগঞ্জ, জকিগঞ্জ। দীর্ঘাঙ্গ ও শ্যামলা মাহবুব মেধাবী, সরল ও রসিক ব্যক্তিত্ব। ধার্মিক ও নামাজি মাহবুব আহমদের  উপরও ছাত্রজীবনে ছিল দারিদ্রের কুঠারাঘাত, যা তার অপার সম্ভাবনাকে অনেকটা নষ্ট করে দেয়। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হতে দ্বিতীয় বিভাগে বিএসসি পাশ করেন। মজার ব্যাপার হলো সে বছর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র পাঁচজন বিএসসি পরীক্ষায় দ্বিতীয় বিভাগ পান। পরিশ্রমী মাহবুব আহমদ ২০২৪ সালে পুবালী ব্যাংক লিমিটেডের ডিজিএম পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন।

ঈদগাহের শাহাদাত চৌধুরী সাহেদের গ্রামের বাড়ি ছিল বারহাল, জকিগঞ্জ। সামান্য খাটো মিষ্টি চেহারার শাহাদাত চৌধুরী সাহেদ ছিলেন বন্ধুবাৎসল উদার ব্যক্তিত্ব। ঈদগায় সাহেদের তিতলা বাসায় সুশান্ত, আমি ও সাকিম বসে বসে অনেক আড্ডা দিতাম। সাহেদ পরে বিদেশে চলে যান ঈদগাহের হাজারিভাগ মহল্লার সাকিম কৃষি ব্যাংকে চাকুরি করতেন এবং পরে চাকুরি ছেড়ে সপরিবারে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। চট্টগ্রামের ছেলে শ্রী সুশান্ত শেখর চক্রবর্তী ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তার পূত্র। তারা কুমারপাড়া দিঘিপারের এক টিনের বাসায় বসবাস করতেন। সুশান্ত শখের বসে বাসায় কবুতর ও মোরগ পুষতো। তিনি সিলেট পলিটেকনিকেও আমার সহপাঠি ছিলেন। সুশান্ত এখন ঠিকাদারী পেশায় আছেন।  

কালো ও মিশুক প্রকৃতির অরু চন্দ্র পাল আজ এম সি কলেজের গণিতের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান। তিনি কাজলশাহ দিঘিরপারে বসবাস করেন এম সি কলেজে অধ্যয়নকালে অরুণ চন্দ্র পাল বয়সের তুলনায় বাড়েন নি তাই তাকে তখন একজন বড় বালকই মনে হত অধ্যাপক অরুন চন্দ্র এম সি কলেজের গণিত বিভাগের প্রধান ছিলেন। তিনি এখন সিলেট শিক্ষাবোর্ডের রেজিস্টারের দায়িত্বে আছেন। নিরিহ সাকিম ছিলেন ঈদগাহ হাজারিবাগের আদি বাসিন্দা। তিনি কৃষিব্যাংকে কিছুকাল চাকুরি করে সপরিবারে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। জৈন্তার কৃষ্ণবর ওয়ারিস উদ্দিন ও শামসুদ্দিন ছিলেন দারুঙ্কবাজ, আমি তাদের কাছে ক্লাসের ফাঁকে অঙ্ক বুঝে নিতাম। ওয়ারিস গণিতে এমএসসি করে  ইসলামি ব্যাংকে যোগদান করেন এবং কয়েক বছর পর চাকুরী ছেড়ে লন্ডনে গিয়ে সেখানে স্থায়ী হন। শামসুদ্দিন গণিতে মাস্টার্স করে জৈন্তা কলেজের গণিত বিভাগ প্রধানের দায়িত্বে ছেন। 

মনিপুরী সহপাঠী স্বপন কুমার সিংহ তাতিপাড়া হতে এসে ক্লাস করতেন। তার গ্রামের বাড়ি মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার আদমপুর। স্থুলকায়া ফর্সা ও চীনা চেহারার স্বপনের এসএসসি রেজাল্ট আমার মত হলেও পরে তিনি উপজাতি কোঠায় বুয়েটে সুযোগ পান। তিনি এখন একজন উচ্চপদস্থ সরকারি প্রকৌশলী। তার পত্নী স্ত্রীরোগ বিশেষঞ্জ ডাঃ মিনতী সিনহা কিছুদিন আমার গৃহিণী ডাঃ নূরজাহান চৌধুরীর সহকর্মী ছিলেন। স্বপন সিংহ বাংলাদেশের  হিন্দু ধর্মালম্বী ও উপজাতীয়দের মধ্য থেকে আসা প্রথম প্রধান-বিচারপতি এস কে সিনহার শাল। স্বপন কুমার সিংহ আমাকে একটি মনিপুরি শব্দ শিখান, শব্দটি ‘পামি, পামি’ যার অর্থ ‘ভালোবাসি, ভালোবাসি’ বরইকান্দি এলাকার এনাম আহমদ এখন পপুলার ইন্সুরেন্সের সিলেট অফিসের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা।

চৌকশ সহপাঠি গোলাম রাব্বানী চৌধুরীর বাড়ি গোলাপগঞ্জের বাঘায়। তিনি সশব্দে কথা বলতেন ও বেশ দূর হতে শোনা যেত। প্রত্যুৎপন্নমতি রাব্বানী চৌধুরী একজন সফল শিল্প উদ্যোক্তা। তিনি এখন বারাকাতুল্লাহ পাওয়ার কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ী নেতা।

শান্ত ও সুভদ্র বড়লেখার নিজাম উদ্দিন রসায়নে মাস্টার্স করে ‘ওপি-ওয়ান” লটারি জেতে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। প্রবাসী বিএনপি নেতা বারিষ্টার সফিক, শেখঘাটের মুহিত, ভাদেশ্বরের সাহেদ চৌধুরী ও বদরুল এখন লন্ডনে আছেন। লালাবাজারের ফুটবলার লন্ডনপ্রবাসী মিয়া আশিক লালাবাজারে তার পিতার নামে আব্দুল গফুর হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন। কালো ও স্মার্ট নিজাম উদ্দিন আজ ব্যবসায়ী ও কানাইঘাটের মেয়র।

শমশেরনগরের সেলিম চৌধুরী, যার দীর্ঘ দেহাবয়বের সাথে ছিল ডিম্বাকৃতির লম্বাটে সুন্দর চেহারা। তাকে এমসি কলেজে কখনও গান গাইতে দেখিনি কিন্তু পরবর্তীকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তিনি দেশের একজন শ্রেষ্ট লোকসঙ্গীত শিল্পীতে পরিত হন। টিভিতে প্রায়ই তাকে গাইতে দেখতাম-“আঁকাবাঁকা মেঠোপথে কোন সুন্দরী হেঁটে যায়সেলিম চৌধুরীর গাওয়া হাসন রাজার একটি গানের ক্যাসেট আমার খুব প্রিয় ছিল। দুঃখ হয় আমার এই প্রাণপ্রিয় সহপাঠি চিরকুমারই রয়ে গেছেন। জানিনা, কেন যে এমন হল। তিনি হুমাউন আহমদের অনেক নাটকে সঙ্গিত পরিবেশন করে বিখ্যাত হন। 

ডাঃ সৈয়দ ইনসাফ আলীও যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী, তার গ্রামের বাড়ি ছাতকের সৈয়দপুর। তিনি চক্ষুবিশেষঞ্জ সৈয়দ মারুফ আলীর ভাই। ২০১৪ সালে আমার বই সিলেট সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে উপহার দিতে গিয়ে চারজন এমসি কলেজ সহপাঠিকে সেখানে পাই। তারা হলেন উক্ত স্কুলের শিক্ষক শাহ মোঃ আখতারুজ্জামান, জহুর আহমদ, মখলেছুর রহমান ও মইনুল হক। মইনুল হক এখন মৌলভীবাজার জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা। বিসিএস কর্মকর্তা ইকবাল আব্দুল্লাহ হারুন খুবই ভাগ্যবান। তিনি মোহাম্মদ ইউনুস সরকারের আমলে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সচিব পদে পদোন্নতি পান।  

এমসি কলেজের শিক্ষকতায় আছেন সালাহ উদ্দিন ফয়সল ও তুতুউর রহমান। তুতুউর রহমান এখন অর্থনীতির অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান। নাজমুল ইসলাম জালালাবাদ গ্যাসে ও পারভেজ এনজিও সীমান্তিকে কর্মরত রয়েছেন। রনকেলী দিঘিরপারের রাফেহ চৌধুরী ও ফারেহ চৌধুরী, এই বেঁটে দুইভাই একই  ড্রেসপরে ক্লাসে আসতেনতারাও যুক্তরাষ্ট্রের সিটিজেন। সুদর্শন ফর্সা ডাঃ শিবলী খান ওসমানী মেডিকেল কলেজ হতে এমবিবিএস করে সিলেট শহরের একজন চিকিৎসক। তিনি বিশ্বনাথে প্র্যাকটিস করছেন। নাজিম উদ্দিন এমসি কলেজের পর আমার সাথে সিলেট পলিটেকনিকে ভর্তি হন। তিনি এখন শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকুরি করছেন।

২০১৩ সালে একটা মজার ব্যাপার ঘটে, সিলেট আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এমবিএ পড়তে গিয়ে আমি সেখানে  এমসি কলেজ সহপাঠি মোঃ আব্দুল লতিফকে বানিজ্যিক গনিতের শিক্ষক হিসাবে পাই। লতিফ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির একজন প্রধান হর্তাকর্তা। মাথার চুলছাটা হ্যাটপরা কাজলবর আব্দুল লতিফকে চিনতে আমার কোন অসুবিধা হয়নি। এককালের সহপাঠি আজ আমার শিক্ষ। আমি পরিচয় দিলামনা তাকে, তিনিও চিনলেন না আমাকেক্লাস চলাকালে ব্যাংকের একজন এজিএম হিসাবে আমাকে তিনি আপনি আপনি করেই কথা বলতেন। এভাবে দুই বছর তার কাছে লেখাপড়া করে পরিচয় গোপন রেখেই একদিন সনদপত্র নিয়ে চলে আসলাম।

সরলপ্রাণ গোবিন্দ আজ কর বিভাগে ও ডাঃ মতিন, ডাঃ আব্দাল মিয়া, ডাঃ মতিউর, ডাঃ আব্দুল মান্নান স্বাস্থ্য বিভাগে কর্মরত আছেন। রানাপিংয়ের বেঁটে ডাঃ মুজিব ওসমানী মেডিকেল থেকে এমবিবিএস পাশ করে মার্কিন কনে বিয়ে করে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান দুগ্ধধবল সদাহাস্য মাসুদে রাব্বানী ইসলামি ব্যাংকে ও মুজিবুর রহমান ইবনে সিনা ফার্মাসিউটিক্যালে কর্মরত আছেন। এমসি কলেজে আমার আগের রোল নং ১১৩ এর দরগাহ ঝর্নারপারের খোকন বৃটেনে ও রোল নং ১১৫ এর দরগার পুকুরপারের গৌরাঙ্গ দীর্ঘঙ্গ কুমিল্লার সুদর্শন তরু রূকনের কোন খোজখবর আর পাইনি। মেধাবী ও প্রাণপ্রাচুর্য্যে ভরপুর রুমি বুয়েট পাশ করে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান।

পিঙল চোখের উজ্জ্বল শ্যামলা দীর্ঘতনু এডভোকেট এহসানুল মাহবুব জোবায়ের তখনই ছাত্রশিবির করতেন, আমাকে শিবিরের মিছিলে নিয়ে যেতে প্রায়ই টানাটানি করতেন। তিনি এই দলে বেশ ভাল অবস্থান তৈরি করেন ও পরবর্তীকালে ইসলামি ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি হন। তিনি ছিলেন কুলাউড়ার উপজেলার সন্তান।

সেকশনের একমাত্র ছাত্রী ছিলেন নুসরাত হক। কিন্তু একা হওয়ায় এ সেকশনে তাঁর মন বসেনি। কিছুদিন ক্লাস করে চলে যান বি সেকশনে। ছাত্রীরা ছিলেন কেবল আমাদের বি  সেকশনে। আয়শা আক্তার, নুসরাত হক, হেমা আক্তার, শোকরানা বেগম, তাবাসসুম ফেরদৌস নীতা প্রমুখের নাম মনে পড়ে তারা ছাত্রী মিলনায়তনে অবস্থান করত এবং টিচারদের সাথে ক্লাশে প্রবেশ করত। সামনের বেঞ্চ তাদের জন্য বরাদ্ধ ছিল। 

ডাঃ তাবাসসুম ফেরদৌস নীতা সিলেট সরকারি মেডিকেল কলেজে আমার পত্নী ডাঃ নূরজাহান বেগম চৌধুরীর সহপাঠিনী ছিলেন। তাবাসসুম ফেরদৌস নীতা এখন অস্ট্রেলিয়ায় জীবনের তরী বেয়ে যাচ্ছেন। নুসরাত হক একমাত্র পড়ুয়া যিনি দুই সেকশনে অধ্যয়ন করেন। ফেন্সুগঞ্জ কাশেম আলী হাইস্কুলের ছাত্র ডাঃ ইব্রাহিম আলী চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস করেন। তিনি আমার পত্নীর সাথে কাজ করেন। তাঁর সাথে প্রায়ই দেখা হত। তাঁর বাড়ি ফেন্সুগঞ্জ। তিনি ২০২১ সালে স্নায়ুবিক রোগে কার্লিফনিয়ায় মারা যান।

৭ই মার্চ ২০২৪। ফেসবুকে খবর পাই প্রিয় বন্ধু হোসেন আহমদ সবুর নেই। তিনি আজ পরপারের বাসিন্দা। তিনি এম সি কলেজ এইচ এস সি (বিজ্ঞান) ১৯৮৩ ব্যাচের সহপাঠি। এই সিলেট শহরে আমরা যে কজন সহপাঠি বসবাস করি, তাঁদের মধ্যে দেখাশুনা হয় প্রায়ই। আমি পূবালী ব্যাংক প্রিন্সিপাল অফিস সিলেটে ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২ তারিখে যোগদান করামাত্রই আমাকে দেখতে অফিসে ছুটে আসেন। তাঁর বুক ছিল মায়ামমতায় ভরা। তখন স্ত্রীর ডাইলাইসিস নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় ছিলেন। চিকিৎসার যোগান দিতে তিনি প্রায় সর্বশান্ত, অথচ তাঁর ছিল অসাধারণ সহ্য গুণ। সব দুঃখ কষ্ট অবলীলায় সয়ে গেছেন জীবনের শেষপ্রান্তে। ছোট্ট একটা সরকারী চাকুরী নিয়ে সৎভাবে জীবন পার করেছেন। ছিলেন ধার্মিক ও নিঃশ্বার্থ পরোপকারী একজন মানুষ। আজ বাদজোহর শাহজালালের(রঃ) দরগা মসজিদে তাঁর কফিনের সামনে দাঁড়াতেই দুচোখ সজল হয়ে যায়। আমরা বেশ কয়েকজন বন্ধু তাঁর জানাজায় শরিক হয়। দুই বছর আগে তাঁর পত্নীর জানাজায় শরিক হয়েছিলাম। মহান আল্লাহ তাকে জান্নাত দান করুন আমিন।      

কলেজে অধ্যয়নকালে একদিন প্রিন্সিপাল গোলাম রসুলের পিতা মারা যান। আমরা কলেজবাসে এসে নয়াসড়ক জামে মসজিদে তার জানাজায় শরিক হই। মানিকপীরের টিলায় তাকে দাফন করা হয়। এই প্রথম আমি মানিকপীরের টিলার চূড়ার মাজারে আরোহন করি। এখান থেকে অনেক নিচের সিলেট শহরটিকে অপূর্ব শ্যামল এক নিসর্গ জনপদ মনে হল।

এবার আপনাদেরকে এম সি কলেজ জীবনে আমার বসত খরাদিপাড়ার গল্প শুনাব১৯৭৭ সালে গ্রামের চেয়ারম্যান ভোটের খরচ জোগাতে আমাদের তের চৌদ্দটি গরু বিক্রি হয় ও অনেক ঋণের জন্ম হয়। আমাদের জমি বর্গাচাষে চলে যায়। বড়ভাই তাহমিদ চৌধুরী মদন মোহন কলেজ সিলেটে গ্রাম হতে প্রতিদিন আসা যাওয়া শুরু করেনবোন সেহার বিয়েতে জমি বিক্রি করা কিছু দুষ্টলোকের কারণে অসম্ভব হয়ে পড়ে। তারা বলত এজমালি সম্পত্তি কেউ কিনলে এতে তাদের স্বত্ব দাবী করবে ও দেখে নেবেআমার বাপচাচাদের মধ্যে কোন বাটুরানামা না থাকায় তাদের হুমকিতে ক্রেতারা ভয়ে সরে যেকালু চাচার একমাত্র পুত্র আলালের ঘরের দুলাল শিক্ষাদীক্ষাহীন মতিভাইয়ের পৃথিবীতে কোন কিছু করে টিকে থাকার কোন যোগ্যতা ও মন মানসিকতা ছিলনা। আমাদের প্রচুর জমিজামা ছিল। এই জমির উপর নব্যধনী কিছু লোভী লন্ডনি দুষ্ট লোকের কুদৃষ্টি পড়ে। এই লোভী রাক্ষসের দল জুয়াসক্ত মতিভাইয়ের সহায়তায় ও মছরুভাইয়ের গোপন উদারতায় আমাদের চৌদ্দপনের বিঘা দুফসলা মূল্যবান জমি ফুফুতো রেজা ভাইয়ের জাল সহিতে দলিল তৈরি করে দখল করে নেয়।

আব্বা সফিকুর রহমান চৌধুরী আমাদের বংশের প্রতিষ্ঠিত মসজিদ ও মাদ্রাসার প্রায় কমিটিতে চৌধুরী বংশের নেতৃত্ব দিতেন। কিছুলোক নানা সুযোগ সুবিধা নিতে কমিটিতে ঢুকতো, তারা নানা ব্যক্তিস্বার্থ আদায় ও চৌধুরী বংশের প্রভাব প্রতিপত্তি খর্ব করতে সচেষ্ট থাকতোএই চৌধুরী বংশের লোকজন দেশবিদেশে চলে গেলে এই পরিবারের বয়স্ক সুযোগ্য ব্যক্তি আমার পিতা সফিকুর রহমান চৌধুরী তাদের টার্গেটে পরিত হন। এরা মতি ভাইয়ের এসব ক্রিয়াকলাপে সহায়তা করত তারা মনে করত, চৌধুরী বংশের সফিক চৌধুরীকে শুন্য করে দিতে পারলে এই বংশের নামগন্ধ দ্রুত নিঃশেষ হয়ে যাবে। অন্যদেরকে তারা তেমন হিসাবযোগ্য লোক মনে করতনা।  

পৃথিবীতে দুই ধরনের লোক থাকে- একদল সৃজনশীল, যাদের হাতে জ্ঞান, ধনসম্পদ ও মানসম্মান সৃষ্টি হয়। আরেক দল এর বিপরীত, তারা ধ্বংসশীল- এদের হাতে ধনসম্পদ মানমর্যাদা সব ধ্বংস হয়ে যায়। মতিভাইয়ের ভাগে আমার চিরকুমার মখলিস চাচার সম্পদও ছিল কিন্তু এই জমিজামার সিংহভাগ খুব অল্প সময়ের মধ্যে গায়ের পেটুক লন্ডনিদের পেটে চলে যায়। মছরু ভাই তলে তলে মতি ভাইকে হাত করে ষোলআনা সুবিধা নেন এবং মতিভাইয়ের কাছ থেকে বাড়ির উত্তর দিকের প্রচুর জায়গা বাড়িতে ঢুকাতে সক্ষম হন।  

এমনই এক দূর্যোগময় অস্বচ্ছল সময়ে আমি এমসি কলেজে ভর্তি হই। আব্বার হাইস্কুলের সামান্য বেতনের উপর বিরাট এক সংসারের বজা চাপে, তদুপরি প্রচুর সম্পদ বাস্তবে আছে অথচ কাজে নেই। একটুকরা জমি বিক্রি করে ঐ টাকায় কলেজ হোস্টেলে কিংবা ছাত্রমেছে গিয়ে শান্তিতে পড়ব তারও কোন উপায় ছিলনা। তখন আমাদের সহায় সম্পদ সব ভাগবাটুরা করে লোটপাট করে নেওয়ার জন্য ঘরে বাইরে এক গভীর ষড়যন্ত্র ও দুষ্টখেলা জমে উঠেছিল।

আব্বা সিন্ধান্ত নেন তার ধনী লন্ডনি ভাগনি সিরিয়া আপার কাঁধে আমাকে চাপাবেন। আমার খালাত ভাই তারেক আটদশ বছর আমাদের গৃহে অবস্থান করে পড়েছেন। আমাদের বাংলোয় অবস্থান করে অনেক তালবা, ফুফুত ভাইরা ও বাহিরের লোকেরা বছরের পর বছর লেখাপড়া করেছেন। আব্বার ধারনা এটা আর এমন কি? একেত এমসি কলেজ অনেক দূরে, তদুপরি উচ্চমাধ্যমিক বিঞ্জানের বিশাল কোর্স দাউদপুরের বাড়ি হতে ঘোড়দৌড় দিয়ে আসা যাওয়া করে চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।

আজকের মত উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা হলে হয়ত তখন বাড়ি হতে রান এন্ড বেক করতাম।

আমি তীব্র মানসিক দ্বিধাদ্বন্দে ভুগলাম কিন্তু আর কোন দ্বিতীয় উপায় খোঁজে পেলাম না। শেষমেশ একদিন আব্বা আমাকে নিয়ে শিবগঞ্জ খরাদিপাড়ায় তার ভাগ্নির বাসায় ফেলে আসলেন। বাসাটির নাম ‘ফাজিলপুর লজ” দোলাভাই সৈয়দ মইজুল ইসলাম কদই মিয়া ছিলেন খুব বড় আত্মার লোক, তিনি দুহাতে টাকা উড়াতেনহাতেমতাঈ দোলাভাই লোকজনকে খুব সাহায্য করতেন, তার কাছে এসে কেউ খালি হাতে ফিরত না। একদিন তিনি আমার বামকানের পানিপড়া রোগের টের পেয়ে বললেন- “ওবা সেফাক মিয়া, আমার কাছ থেকে যত টাকা লাগে নাও, বালা করি ডাক্তার দেখাও”চিকিৎসার জন্য তিনি আমার হাতে তখনকার দিনের বারশত টাকা তুলে দেন।

আমি সিলেট স্টেডিয়াম মার্কেটে গিয়ে নাক কান গলা বিশেষঞ্জ ডাঃ এ কে এম হাফিজকে দেখাই তখন তার ভিজিট ছিল মাত্র পঞ্চাশ টাকা। কোথাকার কোন মশামাছি এসে তার হাতীগাত্রে বসল, না উড়ে গেল, না তার খেয়ে সাবাড় করল, এসব নিয়ে কদই দোলাভাইয়ের কোন ভাবনা ছিলনা। ভাদেশ্বর নালিউরি গ্রামে পিচঢালা রাস্তার পাশে টিলার উপর তাদের খুব সুন্দর বাগান বাড়ি ছিল। তাদের আটদশটি গাড়ি, পেট্রোল পাম্প, বিয়ে সেন্টার ও চাবাগানে মালিকানা ছিল। তিনি সিলেটের মেহমান ভর্তি এই বদ্ধ বাসার চেয়ে নালিউরির বাগানবাড়িতে থাকতে বেশী আনন্দ ও স্বাচ্ছন্দবোধ করতেন।

এখানে এসে ভাগনা পাপু, ভাগ্নি জুলি ও কোলের শিশু ভাগ্নি এলিকে পাই। আর দেখলাম এখানে আমি ছাড়াও আর দুইজন আত্মীয় তাদের পিঠে ইতিপুর্বে সওয়ার হয়েছেন। পহেলা জন টেকোমাথার খানিক বেঁটে এডভোকেট মাসিয়ত উল্লা চৌধুরী, লন্ডনি সাহেবের সমনদিক, যিনি এখানে অবস্থান করে সিলেট জজকোর্টে প্র্যাকটিস করছেন। দুসরা জন লন্ডনির শ্যালিকা ফাবিয়া আপার বালিকা কন্যা ইমা, সে লন্ডনি দোলাভাইয়ের সন্তানদের খেলার সাথী ও শাহজালাল জামেয়া ইসলামিয়া স্কুলের সহপাঠিনী।

এবাসায় আমার অনাহুত আগমন উকিল সাহেবের খুব মাথাব্যথায় কারন হয়ে গেল। তিনি একদিন আমাকে বললেন এই ছড়া পার হয়ে একটু এগুলে ঝরনারপারে তোমার খালার বাসা, সেখানে চলে গেলে তোমার ভাল হবে। কিন্তু উকিল সাহেব যেখানে চলে যাবার কথা বলছেন সেখানে থাকার মত অবস্থা হলে আমিতো এখানে আসতামই না

তিনি কোন কোন দিন বলতেন, মাস্টর এখানে থেকে তোমার লেখাপড়া হবেনা অন্যদিকে রাস্থা খোঁজ। সিরিয়া আপা কিংবা দোলাভাই কোনদিন তাদের ছেলেমেয়েদেরে পড়ানোর জন্য কোন তাগিদ দেননি, অথচ উকিল সাহেবের এই ব্যাপারে খুব শিরঃপীড়া ছিল। তিনি প্রতিদিন সকালে বলতেন, মাস্টর, তাদেরে নিয়ে পড়াতে বস। বাচ্চাদের প্রাইভেট টিউটার ছিল, রোজ রোজ এসে পড়াত তা সত্বেও উকিল সাহেবের জ্বালায় সকাল সন্ধ্যায় বাচ্চাদের নিয়ে বসতে হত। এযেন মায়ের চেয়ে মাসীর দরদের ঠেলাঠেলি।

টিনের পাকাবাসাটি লোকজনের তুলনায় ছোট হওয়ায় আমি বেশ কিছুদিন খরাদিপাড়ার দুতলা মসজিদের গেটদিয়ে ঢুকে একজন বৃদ্ধার ঘরে রাতে ঘুমাই। এই বৃদ্ধার দুই ছেলে বিদেশে থাকায় তিনি ভাইপো শাহানকে নিয়ে একাকী থাকতেন। একদিন বিটিভিতে ফজলে লোহানীর জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান “যদি কিছু মনে না করেন” দেখে দেরি করে গিয়ে দেখি বৃদ্ধার ঘরের দরজা বন্ধ। ডাকাডাকি করে দরজা খোলাতে ব্যর্থ হলাম। সেই রাতে প্রচন্ড শীত পড়ে, কোয়াশার মধ্যে এসে মসজিদের দুতলার মেঝে কনকনে শীতের মধ্যে চাদরবিহীন ঘুমিয়ে পড়লাম। সে রাতে গাঁয়ে সোয়াটারও ছিলনা।

মসজিদের জৈন্তাপুরী ইমাম সাহেব কি কারণে শেষরাতে এসে এই দুঃসহ শীতে আমাকে এই অবস্থায় পেয়ে তার কক্ষে নিয়ে আলাদা বেডে শুইতে দেন। উকিল সাহেবের নানা কথাবার্তার ছুরিকাঘাতে ক্ষতবিক্ষত হৃদয় নিয়ে নিতান্ত নিরুপায় হয়ে বাসাটিতে সময় পার করি। শুক্রবার কিংবা ছুটির দিনে আমি কাম্মিনকালেও এই বাসায় অবস্থান করতাম না। বৃহস্পতিবার সকালে বের হয়ে কলেজ করে বাড়ি ছুটতাম ও শনিবার বিকেলে ক্লাস শেষে একবুক লজ্জার মাথা খেয়ে দুরুদুরু বুকে খরাদিপাড়ার বাসায় ফিরতাম।

বাসায় কুটিনা নামের অজ্ঞাতকুলশীল বার তের বয়সের মেয়েটি বাচ্চাদের দেখাশুনা করত, মধ্যবয়সী বাবুর্চি আব্দুর রহিম পাকঘরের ঠেলা সামলাতেন, তাকে সাহায্য করতেন ধলাই নামের স্থূলকায় একজন মোঠামাথার গ্রাম্য যুবকবাসার ড্রাইভার চাবাগানের লোক, তার নাম ছিল গোপাল। এইসব কাজের লোকজন অন্নখেত ও বেতন নিত লন্ডনি কদই মিয়ার, আর রোজ রোজ কনুইয়ের গুত্তা খেত ছোটবোনের পিঠে সওয়ার হওয়া উকিল মাসিয়ত উল্লাহ চৌধুরীরতিনি কুটিনার গাঁয়ে একদিন বাশের কঞ্চি ছোঁয়ালে বুদ্ধিমতি মেয়েটি চোখ রাঙ্গিয়ে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে- “খবরদার, আর যদি আপনি এসব করেন তবে বলে দেব”উকিল সাহেব চুপসে যান। এখানে বাশের চেয়ে কঞ্চি শক্ত ও কঞ্চির ঘায়ে সবার প্রা ছিল অষ্টাগত। উকিল সাহেবের স্বৈরশাসনে অতীষ্ঠ গৃহকর্মরা তার অত্যাচার হতে বাঁচতে পথ খোঁজে। কয়েকদিন পর বাড়ি হতে খরাদিপাড়া এসে দেখি বাবুর্চি আব্দুর রহিমের চাকুরি খতম ও ধলাই নালিউরিতে বিদায়, কেবল ড্রাইভার গোপাল টিকে আছেন। পরে জানলাম উকিল সাহেবকে সরাতে তারা কি এক গভীর ষড়যন্ত্র করে ধরা খায় ও তল্পিতল্পা গোটায়।

জুলি তখন ছোট্ট বালিকা, একদিন আমার একটি সাদাকালো ফটোতে কলম দিয়ে গোফ লাগিয়ে তার সামনে নিয়ে বললাম, চিনতে পার কি এটা কার ছবি? ছবিটি দেখে সে ভয়ে চিৎকার দিয়ে উঠল। পাশের কক্ষ হতে আপা ছুটে আসেন। আমি আজও চিন্তা করে পাইনা সে কেন এত ভয় পেল এবং এমন আচর করল। এইচএসসি ফাইন্যাল পরীক্ষার কিছুদিন আগে এক সুদীর্ঘ কলেজ ছুটিতে আমি খরাদিপাড়া থেকে দাউদপুর চলে যাই। সিরিয়া আপা ও দোলাভাই তখন লন্ডনে ছিলেন। একদিন ফুফুত আব্দুল্লাহ ভাই বাড়ি আসেন। তিনি অবিশ্বাস্য এক খবর দেন, খবরটি হল ভাগ্নি ইমা বেঁচে নেই, হঠাৎ এক গলরোগ হয়ে দ্রুত সে চলে গেছে না ফেরার দেশেশুনলাম, তিনচার দিন আগে শাহপরানের কবরগায় তার দাফনও হয়েছে। আমি ভাগ্নি ইমাকে মাত্র কয়েকদিন আগে সম্পূর্ণ সুস্থ্য ও হাসিখুশি রেখে আসি বালিকা ইমার পিতা হোসেন আহমদ দোলাভাই সোনালী ব্যাংকে চাকুরি করতেন ও একটি হোন্ডা ফিফটি মোটর সাইকেলে এসে প্রতিদিন দুপুরে এখানে খেয়ে মেয়েকে দেখে যেতেন। বালিকা ইমা ছিল বেশ বুদ্ধিমতি, প্রায়ই সে গান গাইত- “একদিন ছুটি হবে, অনেক দূরে যাব। নীল আকাশে সবুজ ঘাসে খুশিতে হারাব” হ্যা, সত্যিই যেন ইমার ছুটি হয়ে গেল, সে তার গাওয়া গানের কলির লাইনের মত সেই নীল আকাশে চিরদিনের মত হারিয়ে গেল।

এবার আমি আমার প্রথম পাওয়া প্রেমপত্রের গল্প শুনাব। প্রেমপত্রটি আমি দেইনি, এটা আচমকা আমার উপর অবতীর্ণ হয়। আজকের মোবাইলের যুগে আর অনেক কিছুর মত প্রেমপত্রও উদাও হয়ে গেছে। অথচ সেকালে এই প্রেমপত্র ছাড়া কদমতলার বাশীই বাজত না। পাশের বাসা একজন লন্ডনি হাজি সাহেবের যিনি ছিলেন জগন্নাতপুরের অধিবাসীএখানে তিনি তার দ্বিতীয়া সহধর্মিনী নিয়ে জীবনের শেষ অবসর দিনগুলো তসবিহ জপে জপে পার করছিলেন। হাজির অষ্টম শ্রেণি পড়ুয়া কন্যা মিলন বেগম একদিন সিরিয়া আপাকে এসে বললেন “দুই একদিনের জন্য তাইনর ইংরেজি গ্রামারটা আমার দরকার”সিরিয়া আপা একটু কৌতুক করে আমাকে ডেকে বললেন “ও বা মিলনের তাইন, তোমার গ্রামারটা তাকে কয়েকটা দিনের জন্য ধার দাও”আমি ধরে নিলাম এটাত স্বাভাবিক ব্যাপার যে কেউ একটা বই খোঁজে নিয়ে পড়তে পারে। তাছাড়া স্কুলে আসা যাওয়ার পথ ব্যাতিরেকে এই মেয়েটির সাথে আমার কোনদিন তেমন একটা দেখাও হয়নি। আমি এর ভিতর কোন মতলব আছে আদৌ টাহর করতে পারিনি।

কিন্তু অচিরেই একটা মতলব টের পেলাম যখন কয়েকদিন মেহমানদারী করে গ্রামারটি ফেরত আসল। গ্রামারের ভিতর লুকিয়ে আসল মিলন বেগমের একটা মধুভরা প্রেমপত্র। সুচনা মাস্টার সাহেবে ও সমাপ্তি এক গানের কলিতে “যদি একখান সুন্দর মুখ পাইতাম, মহেশখালির পানখিলি তারে বানাই খাওয়াইতাম”অষ্টম শ্রেণির অল্প বয়সী এক কিশোরীর কাচা হাতের লিখা চিটি, খাপছাড়া ভাষায় কচি হৃদয়ের ভালবাসার আকুল আকুতি পেলাম। ভাসান বন্যার জলে তখন এক ভাসমান খড়কুটো আমি, আমার কি আর এত সময় আছে প্রেম প্রেম খেলায় মেতে উঠার, কিংবা না সাহস আছে চৌদ্দপনের বছর বয়সী এক কিশোরীর সাথে খেলতে গিয়ে ধরা পড়ে মানসম্মান খোয়ানোর ঝুঁকি নেওয়ার। এই অপ্রেমিক মাস্টার সাহেবের পাষাণলোহা হৃদয়ের সাড়া মিলন বেগম কোনদিনই ফেরত পাননি। চট্টগ্রামের মহেষখালি দ্বীপ কেন, সিলেটের বন্দরবাজারের পানখিলি খাওয়ানোর কোন সুযোগও মিলন বেগমের ভাগ্যে আর জুটেনি। বিষয়টা খুব তুচ্ছ একটা সাধারণ ঘটনা হলেও আমার কাছে তা ঐতিহাসিক, কার এই চিটিই ছিল আমার হাতে আসা কোন মেয়ের প্রথম নিবেদিত প্রেমপত্র।

একদিন পাশের মাসিমা মেছে আমার এক হিন্দু সহপাঠি রসময় চক্রবর্তীর কক্ষে যাই। কানাইঘাটের ছেলে এই রসময় নিরীহ ও পড়া-নিমগ্ন ছাত্র।  নাম আজ আদৌ মনে পড়ছেনা এমন আর কয়েকজন সহপাঠি ও পরিচিতকে সেখানে পাই। তারা আমাকে কানেকানে একটি লোভনীয় প্রস্তাব দিল, তারা কয়েকজন মিলে গোপনে রাতে ভিডিওতে পর্ণছবি দেখবে। আমি চাইলে একটা চাঁদা দিয়ে তাদের সাথে শরিক হতে পারি। আমি বললাম এইসব ছাইপাস দেখার আমার সাহস নেই, অবসরও নেই। পরদিন তাদের পর্নছবি দর্শনের নানা অশ্লীল গল্প শ্রবন ইন্দ্রীয়কে বেশ জালাপালা কর

সেকালে পর্নছবি দেখা ছিল খুবই বিপদজনক কাজ। বাহিরের লোকজন জেনে গেলে বাসা ঘেরাও করে ধরে গনপিটুনী দিতে কসুর করবেনা। আর পুলিশ টাহ পেলে ভিডিও, টিভি ও নীলছবিসহ সব দর্শকদেরকে ধরে নিয়ে চালান দেবে। এমন কি পরদিন পত্রিকায় সবার কুকীর্তির সবিবরন ছবিও ছাপা হয়ে যেতে পারে। অথচ আজকাল তা নস্য, গোগলে সার্চ দিলেই পর্নছবি এসে দৌড়ে সামনে হাজির। একেই বলে যুগ বদলের অহাওয়া, আজ কার সাধ্য পর্ণছবি আটকায়।   

স্থুলকায়া কদই দোলাভাই ছিলেন গোলবদন হাসিমুখের মানুষ, মাথায় একটু টাকপড়া হলেও চেহারায় ছিল লাবন্য ও অভিজাত্যের ছাপ। স্যুট কোট টাই পরে ফিটফাট হয়ে থাকতেন তিনি। বিছানায় তার পাশে শুয়ে অনেক সময় হাত-পা উঠিয়ে দিতাম। তার ওজন ছিল বেশি। একদিন রসিকতা করে কোলে তুলে বিপদে পড়ি, না পারছি রাখতে, না পারছি নামাতে। শেষে কোনমতে নরম বিছানায় ফেলে দিয়ে রক্ষা পাই। তার দুই ভাই ছন্দই ও এনাম ভাই ভাদেশ্বর নালিউরি থাকতেন। কাজলবর দুই ভাইয়ের মধ্যে ছন্দই একটু খাটো ও এনাম ভাই ছিলেন দীর্ঘাঙ্গ। অন্যজন পঙ্কি ভাই এর বাসা ছিল নয়াসড়ক। তিনি কিছুটা কদই দোলাভাইয়ের মত, তবে বেঁটে ও কৃশকায়। তারা ভাইরা এত সরল ও ভাল মানুষ ছিলেন যে, মনে হত বাংলাদেশের অন্ততঃ কিছু মানুষ তাদের মত হলে দেশটা বদলে যেত।

বহুবছর পর আমি ছিলাম পুবালী ব্যাংক লিঃ মোকামবাজার শাখার রিলিভিং ম্যানেজার, একজন যাত্রিবাস হতে দেখলাম নালিউরির ঔ বাড়িটিতে গাড়ির সারি ও মানুষের ভীড়। পরদিন অফিসে নালিউরির একজন কাস্টমার বললেন গতকল্য ছন্দই ভাই মারা গেছেন। এনাম ভাই পরে গ্রামের মেম্বার হন, তিনি ছিলেন আমার ছোটমামা শহিদের সহপাঠি। 

সেই সময় এনাম ভাইয়ের বিয়ে খাই, নালিউরি হতে শেওলায় গিয়ে বেশকটি মিনিবাস নিয়ে বড়খেয়ায় কুশিয়ারা নদীপার হই এবং একটু সামনে গিয়ে যানগুলো সাতরে জলেডুবা এক রাস্থা পার হয়ে আমদেরকে সাদিনাপুর কনেবাড়ি নিয়ে যায় এনাম ভাইও আজ নেই। অল্প বয়সে ব্রেন টিউমার হয়ে পরপারে চলে যান।

সে সময় সিরিয়া আপা দুএকবার আমাকে কিছু টাকা দিতে চাইলে আমি নেইনি, মনে হ এখানে থেকে তাদেরকে অনেক যন্ত্রনা দিচ্ছি, তার উপর তাদের টাকা নেব এটা হয়না। আমার বিপদের দিনে তাদের কাছে আশ্রয় পেয়েছি। দোলাভাই ও সিরিয়া আপার সীমাহীন স্নেহমমতা না পেলে হয়ত আমি এবাসায় এতদিন টিকতাম না। তাদের কাছে আমার অনেক ঋণ আছে, আমি তাদের কাছে শত ঋনী, শত কৃতঞ্জ

ফাইন্যাল পরীক্ষার পর একদিন রেজাল্ট বের হল। এই বৎসর উচ্চ মাধ্যমিক বিঞ্জানে কুমিল্লা বোর্ডে মাত্র ৩৫% ছাত্রছাত্রী উত্তীর্ণ হন। এই রিজাল্ট আমাকে কাঁদাল, বাড়িতে নাগিয়ে সিরিয়া আপার বাসায় সারা রাতভর কেঁদে বালিশ ভিজিয়ে দিলাম। এসএসসিতে হতাশা ছিল সামান্যের জন্য প্রথম বিভাগ হারানোর, আর এবারের কান্না, জীবনে আটকে পড়ার কান্না, এই রেজাল্টে ভাল কোথাও ভর্তি হওয়া যাবেনা। ইংরেজিতে সমস্যা হওয়ায় বেশ ভাল নম্বর উঠানো সত্বেও উচ্চ মাধ্যমিক চুড়ান্ত পরীক্ষা যতটুকু ভাল ফলাফল আশা করেছিলাম, তা হলনা। আমার এই অস্থির অবস্থা দেখে পরদিন সিরিয়া আপা বললেন এটা এমন চিন্তার কি? এক বছর সময় কিছুনা, আগামী বছর আবার পরীক্ষা দিয়ে পুষিয়ে নেবে। আর এক বছর পড়লে তুমি নিশ্চিত প্রথম বিভাগ পেয়ে যাবে।

সিরিয়া আপাকে বললাম আমি কোন রাজপুত্র হয়ে জন্মিনি যে বারবার পরীক্ষা দিয়ে সময় নষ্ট করব। আমার যে করুন আর্থসামাজিক অবস্থা তাতে বাস্তবতা হল দ্রুত কিছু শিখে আমাকে জীবনযুদ্ধে নেমে যেতে হবে। আমি অযাচিঁতভাবে অন্যের গলগ্রহ হয়ে তাদেরকে আর এক বছর কষ্ট দেই, এমনটি আমার মন চাইলনা।

আমি একদিন খরাদিপাড়া ছাড়লাম, মনে মনে বুঝলাম সিরিয়া আপা বেশ মনঃকষ্ট পাচ্ছেন। তবুও তাদেরকে প্রায় দেড় বছর অনেক অনেক যন্ত্রণা দিয়ে এক অনুজ্বল ফলাফল নিয়ে ভগ্নহৃদয়ে অগন্তস্থ্য যাত্রায় বেরিয়ে পড়লাম। দেখলাম আমি দুইটি ভূল করেছি, প্রথমতঃ গণিত বাদ দিয়ে উদ্ভিদবিজ্ঞান নিয়ে পড়লে অবশ্যই ভাল হতদ্বিতীয়তঃ বিজ্ঞানের বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিলেও আমি ইংরেজিকে তেমন আমলে নেইনি। আর্থিক অসচ্ছলতা তো ছিলই, তাই অনেকে ইংরেজি বিষয়ে টিউশনি পড়লেও আমি পড়িনি। সেইসাথে ছিল খরাদিপাড়া ও দাউদপুরের বাড়িতে লেখাপড়ার এক অগুছালো এলোমেলো পরিবেশ। নানি রফিকুন্নেছার জীবনের শেষবেলায় আম্মা আসমতুন্নেছা ও অগ্রজা আনিছা মান্না অসুস্থ্য নানির সেবাযত্ন করতে অনবরত নানাবাড়ি অবস্থান করতেন। দাউদপুরের বাড়িতে গেলে সেখানে আম্মা ও বোন প্রায়ই অনুপস্থিত। আব্বা সফিক চৌধুরী একা, কাজের মেয়ে শমি ও তসিঝি রান্না করে দেন। রাতে ইঁদুর মাটি কেটে মেঝে স্থুপাকার করে রাখত, ঘরের ছাদে গেছো ইঁদুর ছুটাছুটি করত, আঙ্গিনায় এলোমেলো ঘাস, কেমন যেন এক ছন্নছাড়া পরিবেশ।

তখন দাউদপুর গ্রামের হাওরে আমাদের ভূসম্পত্তি কেড়ে নেবার মারামারি চলছে। চর দখলের মত জমিজামা কেড়ে নিতে ঘরে বাহিরে চলছে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হওয়া গ্রামের একদল দুষ্টলোকের মহোৎসব। এই ধরনের এক বৈরী ও শান্তিহীন পরিবেশে লেখাপড়ায় মন আর টেকে কতক্ষ? সিলেট ও দাউদপুরের এই নোংরা আর্থ-সামাজিক পরিবেশ আমার জীবনের দিক নির্ধারণকারী সবচেয়ে গুরুত্ববাহী এইচ এস সি পরীক্ষা- ১৯৮৩ এর ফলাফলকে কেমন যেন অনুজ্জ্বল করে দেয়। জীবনে এলিট হবার স্বপ্নরাজ্য ধুঁয়ায় ছেয়ে ফেলে।  

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন