এম সি কলেজের অম্লমধুর স্মৃতি, কখনও হবেনা ইতি
সেশনঃ ১৯৮১-৮২, চুড়ান্ত পরীক্ষা বর্ষ- ১৯৮৩ সাল, অবস্থানঃ জুন ১৯৮১ হতে আগস্ট ১৯৮৩ সাল
আমাদের সময় সিলেট মুরারিচাঁদ কলেজ তথা এমসি কলেজকে বলা হত সিলেট সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ। আব্বা সফিকুর রহমান চৌধুরী ১৯৩৭ সাল হতে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত এই এমসি কলেজের ছাত্র ছিলেন। পিতার প্রস্থানের চল্লিশ বছর পর আমি এমসি কলেজের একাদশ বিজ্ঞানে ভর্তি হই।
এই কলেজে আমার পদচিহ্ন আঁকার প্রায় নব্বই বছর আগে ১৮৯২ সালে কলেজটির জন্ম হয়। সিলেটের বিখ্যাত জমিদার রাজা গিরিশ চন্দ্র রায় তার পালক পিতা মুরারী চাঁদের নামে কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেন। আমার আগে এখানে অধ্যয়ন করেন চাচাত ভাই প্রথম সিলেটি আইজিপি ই এ চৌধুরী, চাচাত ভাই সচিব ও সাহাবউদ্দিন সরকারের উপদেষ্টা ইমামউদ্দিন চৌধুরী, চাচাত ভাই গ্রীনডেল্টা ইন্সুরেন্স কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা কিংবদন্তী বিমা ব্যক্তিত্ব নাসির এ চৌধুরী, ফুফুত ভাই বিখ্যাত শিক্ষাবিদ ও শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ভাইস চেন্সেলর ডঃ সদরউদ্দিন চৌধুরী, ফুফুত ভাই সড়ক ও জনপথ বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী ও পিএসসির সদস্য বদরউদ্দিন চৌধুরী। তাছাড়া অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান, শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, মন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতসহ সিলেট অঞ্চলের প্রায় সব সম্মানিত ঐতিহাসিক ব্যাক্তিবর্গ এই কলেজের ছাত্র ছিলেন।
ঐতিহ্যবাহী এই কলেজটি ছিল সিলেট বিভাগের তৎকালীন সময়ের
সেরা বিদ্যাপীট। তখনকার দিনে জালালাবাদ ক্যান্টনমেন্ট কলেজ, ব্লুবার্ড স্কুল এন্ড কলেজ, স্কলার্সহোম কলেজ কিংবা এত প্রাইভেট কলেজের
ছড়াছড়ি ছিলনা। সেকালে এই অঞ্চলে শিক্ষার গুণেমানে এমসি কলেজের কোন তুলনা ছিলনা, তাই সিলেট বিভাগের
এসএসসি উত্তীর্ণ বিজ্ঞানের সেরা ছাত্রছাত্রীরা এই কলেজে ভর্তি হতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করতেন। 
১৯৮১ সালে এসএসসি পরীক্ষার
ফল বের হবার পর এমসি কলেজে একাদশ বিজ্ঞানে
ভর্তির ফরম ফিলআপ করতে এপ্রিল কিংবা মে মাসে এক সকালে দাউদপুর হতে বের হলাম। মা আসমতুন্নেসা চৌধুরী খুবভোরে উঠে তাড়াতাড়ি রান্নাবান্না করে খাইয়ে উদ্ভিঘ্ন মনে “ফিআমানিলিল্লাহ” বলে
আমাকে বিদায় জানান। মায়ের উদ্বেগের কারণ
আমি তার চোখে তখনও বাচ্চাছেলে, শহরে গিয়ে নাজানি যদি হেরেটেরে যাই। তখন আমার বয়স
মাত্র পনের ষোল বছর এবং এটাই আমার প্রথম একাকী শহরযাত্রা। মাকে বললাম ভয়ের কোন কারণ নেই, আমি এখন যথেষ্ট সাবালক, আমি সব বুঝি এবং নির্বিঘ্নে
সব করে নিতে পারব। পাহাড়লাইনের মুড়িরটিন মার্কা বাসে চড়ে কদমতলী টার্মিনালে এসে নামি। কদমতলী থেকে সুরমাপারের চিরচেনা পথে হেঁটে হেঁটে কিনব্রিজ পার হই। সুরমা সেতু রিকশায় চড়ে অনেকবার পার হলেও এই প্রথম পায়ে হেঁটে
পার হলাম।
মাত্র ছয়সাত মাইল দূরে বাড়ি হলেও
এই সিলেট শহরের কোন অলিগলি আমার চেনাজানা ছিলনা। টিলাগড় কোনদিকে তাও জানিনা, তাই একটি
রিকশায় ছুটলাম। এই রাস্তার দুই দিকের সাইনবোর্ড পড়ে পড়ে বাজারগুলোর নাম মিরাবাজার, শিবগঞ্জ ও টিলাগড় মনে গেঁথে নিলাম। কারণ এই পথে আগামি দুই বৎসর আমাকে ঘুরপাক খেতে হবে। কলেজ গেটে রিকশা হতে নেমে জীবনের এই
প্রথমবার আমার দীর্ঘ প্রতীক্ষিত ও বহুকাংখিত এমসি কলেজের সামনে দাড়াই। প্রশস্ত গেটে খোদাই করে লেখা সিলেট সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ। কলেজটিও যেন আমাকে স্বাগত জানাতে শত বছরের ঐতিহ্য ধারণ করে বেশ কটি পরিপাটি টিলা ও নান্দনিক বৃক্ষরাজি বুকে নিয়ে  শিরউঁচু করে সামনে নীরবে দাঁড়িয়ে আছে। সারাদিন মহানন্দে কলেজের সবুজ টিলায় টিলায় ঘুরাঘুরি করে বাদ মাগরেব যখন ঘরে ফিরে এলাম, তখন মনে হল মায়ের সারাদিনের অবিরাম দুশ্চিন্তা ও
মহাঅপেক্ষার অবসান হল, তিনি যেন সকালবেলা হারিয়ে যাওয়া তাঁর মানিক রতন আবার রাতের আঁধারে ফিরে পেয়েছেন।
সিলেট বিভাগের হাইয়ার সেকেন্ড ডিভিশন ও প্রথম বিভাগ পাওয়া সাত শতাধিক ছাত্রছাত্রী একাদশ বিজ্ঞানে ভর্তি হবার জন্য আবেদন করেন। ভর্তির জন্য কোন লিখিত পরীক্ষার বিধান ছিলনা। তবে এসএসসি পরীক্ষায় মার্কসিটে প্রাপ্ত নম্বর বিবেচনা করা হয় এবং শিক্ষকরা ভর্তির জন্য আমাদের একটা মৌখিক পরীক্ষা নেন। এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার পর অবসর সময়ে তুড়ুকখলার দীপক চক্রবর্তী ও কয়েকজন ছাত্র আমার কাছে এসে টিউশনি পড়ে। ফলে বিজ্ঞান ও গণিত আমার মনে সতেজ ছিল। স্যাররা নবম ও দশম শ্রেণি পর্যায়ের গণিত, বিজ্ঞান ও ইংলিশ বিষয়ে প্রশ্ন করেন। মৌখিক পরীক্ষার সবকটি উত্তর দেই অনায়াসে। ভর্তির সিট সংখ্যা মাত্র তিনশত, নির্দিষ্ট দিনে উত্তীর্ণদের তলিকা অফিসের সামনে নোটিশ বোর্ডে টেনে দেওয়া হল। ভয়ে ভয়ে নোটিশ বোর্ডে চোখ বুলিয়ে আমার নাম ও নম্বর দেখে আনন্দে লাফিয়ে উঠি। স্রষ্টার অপার মেহেরবানিতে কাংখিত এই স্বপ্নের কলেজে ভর্তি হবার দুর্লভ সুযোগ খুব সহজেই পেয়ে গিয়ে মহান আল্লাহপাকের দরবারে অশেষ কৃতজ্ঞতা জানাই। দুঃখ পেলাম, যখন দেখি মোগলাবাজার রেবতী রমন উচ্চবিদ্যালয়ের আমার প্রিয় সহপাঠি তৌহিদুল ইসলাম টিপু ও বেলাল আহমদ এখানে ভর্তি হবার সুযোগ পায়নি।
আব্বা সফিকুর রহমান চৌধুরী ছাত্র থাকাকালে উচ্চমাধ্যমিকে এখানে কলা ও বানিজ্য বিভাগ চালু ছিল, পরে পাশে সরকারি উচ্চমাধ্যমিক কলেজ প্রতিষ্ঠার পর এখানে কেবল বিজ্ঞান
চালু রেখে অপর দুইটি বিভাগ বন্ধ করে পাশের নতুন কলেজে স্থানান্তর করে দেওয়া হয়।  
১৯৮১ সালের জুনে সিলেট সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের (বর্তমান এমসি কলেজ) একাদশ বিজ্ঞানে তিনশত বিশ জন ছাত্রছাত্রী ভর্তি হই। শিক্ষার্থীগণকে “এ” এবং “বি” দুই সেকশনে ভাগ করা হয়। বেজোড় সিরিয়াল নম্বরের ছাত্ররা সেকশন- “এ” এবং জোড়রা সেকশন- “বি” তে অন্তভুক্ত হন। আমার সিরিয়াল নম্বর ১১৭; সংখ্যাটি বেজোড় হওয়ায় “এ” সেকশনে আমি ঠাঁই পাই। “এ” সেকশনের একশত ষাট জন ছাত্র একসাথে লেখাপড়া করে যৌবনের মধুময় দুইটি বৎসর চোখের পলকে পার করে দেই। “বি” সেকশনের সহপাঠিদের সাথে কলেজের চত্বরে, রাস্তায়, খেলার মাঠে, কলেজ হোস্টেলে, ছাত্র মিলনায়তনের ইনডোর গেইমে টিনের পাকাঘরে, অডিটোরিয়ামে ও কেন্টিনে মাখামাখি হত।
বিশাল এই সুন্দর কলেজে জায়গার পরিমান ১২৪ একর। টিলাগড়ের অনন্যসুন্দর বেশ কয়েকটি টিলা ও ধাপে ধাপে উঁচুনিচু সমতল সবুজ চত্বর নিয়ে কলেজটি গঠিত। কলেজ চত্বর জুড়ে সব সময় বিরাজ করে এক মধুময় নীরবতা। এই কলেজে টিলার পিঠে টিলা একে অন্যকে জড়িয়ে আছে। এমসি কলেজে ঢুকার দুটি গেট ছিল। পিছনের ঈদগাহ রোডের গেটদিয়ে হোস্টেলের ছেলেরা কলেজে ঢুকতো।
সামনের তামাবিল সড়কের পাশের প্রধানগেট দিয়ে ঢুকে ডানের নিম্নভুমিতে দুইটি লালটিনের ছাদঢাকা পুর্ব-পশ্চিম বিস্তৃত সুদীর্ঘ পাকাভবন, রাস্তার সমান্তরালে উত্তরদিকের ভবনে ল্যাবরটরিসহ রসায়ন বিভাগ ও দক্ষিণদিকের ভবনে ছিল ইতিহাস, অর্থনীতি ও বাংলাবিভাগ। বামের টিলার ধাপে ছাত্রী মিলনায়তন ও আটত্রিশটি সিঁড়িবেয়ে উপরে উঠে বৃটিশামলে নির্মিত সুন্দর কলেজ অফিস। এই অফিসে রয়েছে অধ্যক্ষের কার্যালয় ও সাধারণ শিক্ষক মিলনায়তন। অফিসের চারপাশে ছিল ঝাউবন ও পুষ্প উদ্যান।
অফিসের পশ্চিমের টিলায় এমসি
কলেজ পাঠশালায় কমলা রঙ্গের সার্ট ও সাদা প্যান্টপরা শিশুরা যখন পাহাড়ের ঢালুতে কৃষ্ণচূড়া বৃক্ষের তলায় দল বেঁধে লুটোপুটি
খেত তখন মনে হত এযেন কমলা রঙ্গের শিশুমেলা বসেছে।
কলেজের অফিসটিলা হতে নিচে
নেমে সামনের টিলায় সিঁড়িবেয়ে ঊঠে অপূর্ব সুন্দর বৃটিশ নির্মাণশৈলীতে নির্মিত দুতলা
কলাভবন। কলেজের প্রতিষ্ঠালগ্নে
এক বিশাল টিলাকে কেটে সমতল করে কলাভবন চত্বর সাজানো হয়েছে। কলাভবনের বামে  টেনিস গ্রাউন্ড ও চারপাশ জুড়ে সমতল সবুজ
ঘাসচত্বর, চত্বরের কিনারা জূড়ে ছিল সারি সারি ঝাউগাছের সুরম্য বন ও নানান জাতের
বিদেশী বৃক্ষের বিচিত্র সমাহার। বেশ কয়েকটি লম্বা পামগাছ ভবনের ছাদ ছুঁয়ে আছে। পামগাছ পেচিয়ে পেচিয়ে সাপের মত মানিপ্লান্ট বড় বড় পত্রসহ আগা ছুঁয়ে আছে। এই বনবীথির ফাঁকে ফাঁকে ছিল বসার সারি সারি ব্রেঞ্চ।
যে ব্রেঞ্চে বসে আমরা মজার মজার আড্ডা দিতাম কিংবা নীরবে বসে অধ্যয়ন করতাম। এখানে আমরা সহপাঠিরা একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে বসে কত যে
রঙ তামাশা করেছি, কুনটুসি মেরেছি, আজ তার হিসাব দেবার মত কেঊ নেই। 
অপূর্ব সুন্দর টিলাটির নাম থ্যাকারে টিলা।
বিখ্যাত ইংরেজ সাহিত্যিক থ্যাকারের পিতামহ উইলিয়াম ম্যাকপিস থ্যাকার ১৭৬৫ সাল হতে ১৭৭০ সাল
পর্যন্ত সিলেটের প্রথম ইংলিশ কালেক্টর ছিলেন। উনি যে পাহাড়ে বাসস্থান নির্মাণ করে সিলেটে বৃটিশ শাসনদন্ড পরিচালনা করতেন তাই হল
‘থ্যাকারে টিলা’। কলাভবনের পিছনে ঐতিহ্যবাহী সুউচ্চ এই থ্যাকারে পাহাড়ের উপর বৃক্ষ ও বাগান
সজ্জিত অধ্যক্ষের বাসভবন, এযেন বিদেশী চাবাগানের কোন এক সুরম্য বাংলোবাড়ি। এই বাসভবন হতে টিলাগাত্র পেছিয়ে পেছিয়ে পিচঢালা কালো
রাস্তা নিচে নেমে এসে ঈদগাহ সড়কে পড়েছে। আপাদমস্তক সারাটা টিলাজুড়ে ছিল দেশী বিদেশী বৃক্ষরাজীর অপূর্ব মিলনমেলা।
আমাদের সময়ে এই ভবনের বাসিন্দা ছিলেন অধ্যক্ষ গোলাম রসুল, যিনি সিলেট শহরের হাওয়াপাড়ার সন্তান, খাঁটি সিলেটি কুট্টি। আমাদের পুরাটা সময়ই তিনি এই কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন ও আমরা বেরিয়ে যাবার কিছুদিন পর ১৯৮৩ সালের শেষদিকে অবসর গ্রহণ করেন।
আমার শ্বশুর ফুড কন্ট্রোলার এনামউদ্দিন চৌধুরী ২০০৩ সালের ৩০ জানুয়ারি
পরলোকগমন করেন। তাঁকে
হজরত শাহজালালের দরগাহ মসজিদের পিছনের টিলায় দাফন করা হয়। আমার শ্বশুরের  মৃত্যুর বছরখানেক
পর জেয়ারত করতে গিয়ে দেখি তার কবরের উপর একটি সমাধিফলক বসানো- অধ্যাপক গোলাম রসুল,
প্রাক্তন অধ্যক্ষ, এমসি কলেজ, সিলেট। বাসায় ফিরে গিন্নীকে বললাম, তোমার বাবা একজন
অতি ভাল মানুষ, তাই মহান আল্লাহতায়ালা কবরেও অধ্যক্ষ গোলাম রসুল স্যারের মত একজন
উত্তম মানুষকে তার বন্ধু ও সঙ্গী করেছেন। 
কলাভবনের পুর্বদিকের সিঁড়িবেয়ে নিচে নেমে বিশাল বর্গাকার কাজলদিঘি, যে দিঘির জলে অজস্র লালপদ্ম মুখমেলে শোভা বিতরণ করত। ফুটতো শাপলা শালুক কুমুদসহ নানাবর্ণের জলজ ফুল। এই কাজলদিঘির দুইপারে ছিল পিচঢাকা পথ যা সামনের ছড়াসেতু পেরিয়ে পদার্থবিজ্ঞান ভবনের আঙিনায় পৌঁছে গেছে।
মনে পড়ে কলেজ হতে বিদায়বেলার কোন এক সোনালি দিনে আমরা সহপাঠিরা এই কাজল দিঘিতে জল ছুড়াছূড়ি খেলায় মেতে উঠি। দিঘির সামনে আসা সহপাঠিদের কেউই রেহাই পায়নি। একে
অন্যকে বা কয়েকজন মিলে একজনকে ধরে বেঁধে পাজাকুলা করে এনে জলে নিক্ষেপ করি। দিঘির কিনারা ঘেষে ছিল কোমর কিংবা একবুক জল। সেই মেঘলা গরম মধুভরা দিনে
জুতা মোজা প্যান্ট সার্ট ভিজিয়ে এলোমেলো বেশে সবাই বাসা ফিরে যাই। 
দিঘির পশ্চিমপারে ছিল এমসি কলেজ পাঠাগার, এই সমৃদ্ধ পাঠাগারে ছিল সারি সারি মূল্যবান
বই। এই পাঠাগার কেবলমাত্র বই ভান্ডারই নয়, এযেন এক অমূল্য জাদুঘর, যেখানে কলেজের
শত বছরের সচিত্র ইতিহাস রক্ষিত রয়েছে। এখানে আছে কলেজের বিগত দিনের অনেক নামীদামী
অধ্যাপক ও উজ্জ্বল ব্যক্তিত্বদের জীবনী ও তৈলচিত্র, আছে সুসজ্জিত গ্যালারি ও বই পড়ার এক নিরিবিলি পরিবেশ।
দিঘির উত্তরপারে ছিল কলেজ কেন্টিন ও ছাত্র মিলনায়তন, দুটি ভবনই পাকা লালটিনের বড় বারান্দার আলাদা দুটি খোলা ঘর। ছাত্র মিলতায়নে ছিল ইন্ডোরগেমের নানা সরঞ্জাম। এখানে কয়েকটি ক্যারম বোর্ড ও টেবিল টেনিসের বোর্ডে সবসময় ছাত্ররা মহানন্দে খেলা করত। একদল খেলত, অন্যদল দেখত, আড্ডা দিত। এখানে প্রায়ই হৈ হৈ, রৈ রৈ করত ছেলেরা। আমিও সেখানে অনেক খেলেছি, ক্যারম বোর্ডে কিংবা টেনিস বলে বেড মেরে ক্লাসের সময় হয়ে গেলে মাঝপথে খেলা সাঙ্গকরে ছুটে গেছি ক্লাসে। বল ও বোর্ড সাথে সাথে লুফে নিয়েছে অপেক্ষায় থাকা অন্যকেউ।
কলেজ ক্যান্টিনে একটি টেবিলে ছিল
বিস্কুট ও সিঙ্গারা, পাশে মিটসেফে চিনি ও দুধপটের কাছঘেষে কেরসিনের চুলায় বসান গরম
চা। এখানে হত
নগদে লেনদেন, আজকে আমার, কালকে তোমার পালা। এখানে পালা করে বিল দিয়ে খায় দায় ফুর্তি করে ছাত্ররা সবাই। 
কাজলদিঘির দক্ষিণপারে ছিল এমসি কলেজ অডিটরিয়াম। ধাপে ধাপে উপরে গিয়ে শেষ সীমানায় রঙ্গমঞ্চ, একতলা ও দুতলা জুড়ে স্থাপিত দুইটি আলাদা বসার গ্যালারি হতে সবাই স্বাচ্ছন্দ্যে স্পষ্ট দেখতে পেত মঞ্চের অনুষ্ঠান। ভর্তির পর আমাদেরকে বরণ করতে বিভিন্ন ছাত্রসংঘটন বেশ কয়েকটি নবীনবরণ অনুষ্ঠান করে। আসল উদ্দেশ্য নবাগতদেরে দলে টানা। এইচএসসির সিলেবাস বিশাল, তাই এখানে ভর্তি হওয়া মেধাবী ছেলেদের রাজনীতিতে জড়ানোর সময় ও সুযোগ কোনটাই ছিলনা। ফলে অনার্স ও ডিগ্রি ক্লাসের ছাত্ররা রাজনীতি ও নেতাগিরি করতেন। তাঁরা ভাষণ দিতেন ও মিছিল করতেন। আমরা ছিলাম নীরব দর্শক।
এবার এমসি কলেজের একটি স্মৃতিময় নবীনবরণ অনুষ্ঠানের
বিবরণ দেব। মনে হয় সেদিন ছাত্রলীগের অনুষ্ঠান
ছিল, কারণ এই অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর দুঃখে অনেক নেতাকে চোখের জল মুছে মুছে তেজস্বী ভাষণ দিতে দেখি।
বক্তারা ঘাতকের হাতে নিহত বঙ্গবন্ধু পরিবারের প্রতিজন সদস্যের নাম উচ্চারণ করে যেন শোকগাঁথা
পাঠ করে যান। তাঁরা বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের বিচারের দাবি জানান। এই সভায় প্যান্ডেলের একটি চেয়ারে বসেন কবি নির্মেলেন্দু গুন। লম্বা দাড়িগোঁফ, খদ্দরের পাজামা পাঞ্জাবি পরিহিত কবি নির্মলেন্দু গুনকে সেদিন টুপিবিহীন
একজন মুসলিম পীরফকির মনে হল। 
অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকে “শেখ শেখ শেখ মুজিব, লও লও লও সালাম”, “এক মুজিব লোকান্তরে, লক্ষ মুজিব ঘরে ঘরে”, “আমরা সবাই মুজিব হবো, মুজিব হত্যার বদলা নেবো” এবং “জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু” ইত্যাদি শ্লোগানে সারা অডিটরিয়াম বার বার কেঁপে উঠে।
মাঝে মাঝে ক্যাম্পাসে ইসলামি ছাত্রশিবিরের “নারায়ে তাকবির, আল্লাহু আকবর” এবং “আমরা সবাই শিবির সেনা, ভয় করিনা বুলেট বোমা” শুনা যেত। তাঁদের আরেক সাধারণ শ্লোগান ছিল “বাঁচলে শহিদ মরলে গাজি, আমরা সবাই মরতে রাজি”। টুপিপরা জনকয়েক মোল্লামার্কা সহজসরল ছাত্রদেরে তাঁদের মিছিলে দেখা যেত।
জাসদ ছাত্রলিগের এক অনুষ্ঠানে কর্নেল আবু তাহেরের গুণগান ও জেনারেল জিয়াউর রহমানের মুন্ডুপাত করা হয়। ছাত্র ইউনিয়নের সভায় মঞ্চে এসে বসেন পদার্থবিজ্ঞানের দাড়িওয়ালা শিক্ষক আহমদ আলী স্যার। সেদিন “দুনিয়ার মজদুর এক হও, বাংলার মজদুর, দুনিয়ার মজদুর, এক হও লড়াই করো” শ্লোগান শুনা যায়।
মজার মজার তেজস্বী
ভাষণ শুনে শুনে বেলা পেরিয়ে রাত হত, তখন
রঙ্গমঞ্চে পর্দা পড়ত, নানাবর্ণের
আলো জ্বলে উঠত। কবিতা, কৌতুক ও মঞ্চনাট্য হত, কলেজের ছাত্রছাত্রীরা অংশ নিতেন। সিলেট ও ঢাকার শিল্পীরা সুর ও
সঙ্গীতের লহরী তুলতেন।
এখনও কানে বাজে কোন এক নবীনবরণ
অনুষ্ঠানে আমাদের সিনিয়র ক্লাসের
দুইজন ছাত্র ও ছাত্রী মিলে গাইছেন- “কি জাদু
করিলা, পীরিতি শিখাইলা, থাকিতে পারিনা ঘরেতে, প্রাণসজনী, থাকিতে পারিনা ঘরেতে, কি মন্ত্র পড়াইলা”।  
অডিটরিয়ামের পূর্বদিকে এই দিঘিপারে ছিল বুটানিভবন ও সুসজ্জিত বুটানিক্যাল গার্ডেন। এই ভবনের দক্ষিণপ্রান্তে তামাবিল রোডের সাথে ছিল সোনালী
ব্যাংকের একটি শাখা। ব্যবস্থাপক ছিলেন আমার এক দোলাভাই পাতারিয়ার পূবভাগের জামালউদ্দিন চৌধুরী। দিঘির
পুর্বপারে ছিল টিনের একটি পাকা মসজিদ ও অজুর ঘাট। এখানে আমি প্রায়ই জোহরের  নামাজ জামাতে পড়তাম।
পিছনের গেটদিয়ে বের হয়ে ঈদগাহ রাস্তা দিয়ে ডানে অগ্রসর হলে প্রথমেই ডানদিকে চোখে পড়ে দুইটি তিনতলা শিক্ষক বাসভবন। আর সামনে এগিয়ে গেলে বামে সুবিশাল এমসি কলেজ মাঠ, যে মাঠটি এত বড় যে এখানে একসাথে পাঁচ ছয়টি ফুটবল মাঠ সাজানো সম্ভব। বাসা ছিল কাছে খরাদিপাড়ায় তাই এই মাঠেও আমার বেশ কয়েক দিনের ফুটবল খেলার স্মৃতি আছে। সহপাঠি পারভেজ, মিয়া আশিক, চট্টগ্রামের সুশান্ত, সুনয়ন, কুমিল্লার স্বপন প্রমুখের সাথে এই ফুটবল মাঠে অনেক খেলেছি, যদিও আমি ভাল কোন খেলাড়ু ছিলাম না কোনদিন। কেবল আনন্দ ও শখের বশে বলের পিছে ছুটাছুটি করে ব্যায়ামের কাজটা সেরে নিতাম।
সিলেট অন্তঃকলেজ ফুটবল ফাইনাল দর্শকভবনের দুতলায় গাদাগাদি হয়ে দাঁড়িয়ে আমরা খেলা উপভোগ করি। ভয় হত আমাদের ভারে যেন ছাদ ভেঙ্গে পড়ে না যায়। বৃটিশ আমলে নির্মিত এই স্থাপনার নিচ দিয়ে মাঠে ঢুকার প্রবেশপথ ও সিঁড়িবেয়ে উপরের তলা খোলা দর্শক চত্বর।
কলেজ মাঠের দক্ষিণে রাস্তা পার হলেই সুপ্রাচীন বৃটিশ আমলের এমসি কলেজ হোস্টেল।
বৃটিশ আমলে নির্মিত পাঁচটি একতলা লালটিনের পনের ফুট উঁচু ছাদের আসাম পেটার্ন পাকা ভবন। প্রতিটি ভবনের
সামনে পামগাছ ও আকাশখোলা প্রান্তর। এই হোস্টেলে ফেঞ্চুগঞ্জ সারকারখানার মুরাদ, সুনয়ন চৌধুরী,
সুনামগঞ্জের কাজি শামসুল হুদা সুহেলসহ অনেক সহপাঠির কক্ষে বসতাম। এই হোস্টেলের নিরিবিলি সবুজ চত্বরে ২০১৬ সালের ছুটির দিনগুলোতে একমাত্র পুত্র ডাক্তার জেফারকে আমি গাড়ি চালানো শিখাই।
ভ্যাটিকান সিটি নামক দেশটির আয়তন মাত্র ৯০০ একর। মাঝে মাঝে ভাবি আমাদের
প্রিয় এমসি কলেজকে যদি এমনই একটি ক্ষুদে দেশ হত, তাহলে এটিকে অবশ্যই
সুইজারল্যান্ডের সাথে তুলনা করা যেত।
এখানে আছে পাহাড়টিলা, আছে উপত্যকা, আছে কাজলদিঘি লেক, আছে পাহাড়চুড়া। কাজলদিঘি, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ ও বর্তমান বুটানিভবনের পাশঘেঁষে পাহাড়ের বালিচুষা ঝর্ণাটি এক পার্বত্য ছোটনদী কলকল সুরে বয়ে গেছে। আমাদের সময়ের বুটানিক্যাল গার্ডেন, অডিটোরিয়াম ও সামনের রসায়ন ভবন যেন নিম্ন উপত্যকা। দুই বড়গেট দিয়ে ঢুকা
কাল পিচঢাকা রাস্তাটি কলাভবনের সামনে একত্র হয়ে পুর্বের কাজলদিঘি পেছিয়ে ঝর্ণাসেতু
পার হয়ে পাহাড়ঘেরা সবুজশ্যামল প্রান্তরে বর্তমান বুটানিউদ্যান ও বুটানিভবনে গিয়ে শেষ হয়েছে।
সারাটা কলেজ ছিল গাঢ় সবুজ
ঘাসের গালিচায় মুড়ানো, স্থানে স্থানে উচ্চশির পামবৃক্ষগুলোকে দেখলে মনে হত যেন স্যুটকোট
পরে অভিজাত ফুলবাবুরা দাঁড়িয়ে আছেন। এই রাস্তা হতে কোথায়ও সিঁড়িবেয়ে উপরে উঠে, আবার কোথায়ও কয়েকসিঁড়ি নিচে নেমে ভবনমালার সমারোহ। এই
কলেজটি ছিল ফুল, রংপত্র, পাখি ও বৃক্ষের এক স্বর্গীয় সৌন্দর্য্যের লীলাভূমি। আমাদের সময়ে সুসজ্জিত ও পরিকল্পিত লে-আউট অনুযায়ী দেশী বিদেশী
বৃক্ষরাজি লাগান ছিল। ক্যাম্পাসের সর্বত্র জুড়ে নানা বৃত্ত ও কোয়ারী করে লাগান
অজস্র মৌসুমি ও বারমাসি রঙবেরঙের বিচিত্র ফুল ও পাতাবাহার অপুর্ব শোভা বিলিয়ে দিত। 
পাকিস্তানের জনক মোহাম্মদ আলী
জিন্নাহ একবার এমসি কলেজে এসে এই কলেজের অপরূপ নৈসর্গিক সৌন্দর্য্যে অভিভুত হয়ে
একে বলেছিলেন “The flower of the east”. 
কবি দিলওয়ার তাঁর
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমসি কলেজ নিয়ে একাধিক কবিতা লিখেছেন। তিনি ‘স্মৃতিময় এমসি কলেজ’
কবিতায় লিখেছেন, ‘চোখে জল, বুকে প্রেম, ফুটে থাকে শতাব্দী কুসুম/ এমসি কলেজ নাম,
প্রজ্ঞা তাঁর সবুজে নির্ঘুম’। 
একদিন ক্লাস শুরু হবার তারিখ ঘোষণা করা হল। ক্লাস রুটিন সংগ্রহ করে প্রথমদিনের ক্লাস ধরতে কলেজে গেলাম। এমসি কলেজ ১৯৮৩ ব্যাচের ‘এ’ সেকশনের প্রথম দিনের প্রথম ক্লাসটি অনুষ্ঠিত হয় রসায়ন ভবনের ক্লাস গ্যালারিতে। সম্পূর্ণ কাটের তৈরি গ্যালারির সামনে টিচারমঞ্চ, তারপর কাটের ডেক্স ও ব্রেঞ্চ নিচ থেকে ধাপে ধাপে উঁচু হয়ে ক্লাসরুমের শেষপ্রান্তের দেয়ালে গিয়ে ঠেকেছে। রসায়ন বিজ্ঞানের এই ক্লাস নিতে আসেন আব্দুল মতিন স্যার। মতিন স্যারের মাথার তালুতে চুল একটু কম হলেও অন্য তিনদিকের ঘনচুল সযত্নে তালুতে ফেলে টাক ঢেকে নিতেন।
বুদ্ধিদীপ্ত চেহারার আব্দুল মতিন স্যার রসায়ন বিজ্ঞানের কোন নিদৃষ্ট বিষয় পাঠে না গিয়ে রসায়ন বিজ্ঞানের নানা চমকদার ঘটনা বলেন। একটু পর রসায়ন গবেষণাগারের কর্মীরা স্যারের সামনের বড় টেবিলে কাঁচের জার ও নানান জাতের ক্যামিক্যাল দিয়ে পুর্ণ করে দেয়। এবার স্যার রসায়ন বিজ্ঞানের নানা অদ্ভুদ ও বিচিঁত্র সব ঘটনা চোখের সামনে ঘটিয়ে আমাদেরকে বিস্ময়ে হতবাক করে দেন। আব্দুল মতিন স্যার একটি জারের পানির নিচে আগুন জ্বেলে দেখান, আমরা অবাক হই পানির মাঝে আগুন। তিনি একটি ট্রেতে অগ্নেয়গীরির অববিকল অগ্নিউৎপাত সংঘটিত করে সবাইকে থাক লাগিয়ে দেন। মতিন স্যার কাঁচের পাত্রে ভ্যালকেনর জ্বলন্ত লাভাপ্রবাহ তৈরি করেন। কক্ষ অন্ধকার করে বাতাসে কৃত্রিম আলোর তারাকা তৈরি করেন। রসায়নের নানা মজাদার যাদুখেলা দেখে দেখে আমার কলেজ জীবনের প্রথম ক্লাসটি সমাপ্ত হয়। আব্দুল মতিন স্যারের হাতের কারুকাজ রসায়ন বিজ্ঞানের এই প্রথম ক্লাসটিকে আমাদের জীবনে স্মরণীয় করে দেয়।
বুদ্ধিমান আব্দুল মতিন স্যারের পরিপাটি গোঁফ ছিল, তিনি শেষ বয়সে সিলেট সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করে অবসর নেন। আজ কেউ যদি আমাকে প্রশ্ন করেন, আপনার কলেজ জীবনের প্রথম শিক্ষক কে? তাহলে নির্দ্বিধায় বলব, আমার প্রিয় আব্দুল মতিন স্যার, যিনি আজ পরলোকের বাসিন্দা। আল্লাহ পাক তাঁকে সুখ ও শান্তিতে রাখুন, আমিন।
বাংলার প্রথম ক্লাসটি করান ডঃ
শফিউদ্দিন স্যার। কাঁধে উত্তরীয় ফেলে সাদা পাজামা ও খদ্দরের পাঞ্জাবি পরে ক্লিনসেভ ডঃ শফিউদ্দিন স্যার তার লিখা “মানুষ
বিদ্যাসাগর” নামক বইটি বগলে নিয়ে ক্লাসে প্রবেশ করেন। ঢাকার কাছে নরসিংদির রায়গঞ্জে জন্ম
নেওয়া শফিউদ্দিন স্যারকে দেখে পুরাদস্তুর একজন বিখ্যাত সাহিত্যিক মনে হয়। প্রথম ক্লাসেই
স্যার বাজিমাত করলেন। স্যারের অসাধারণ
বক্তৃতা শুনে ক্লাসে পিনপতন নীরবতা
নেমে আসে। শফিউদ্দিন স্যারের ভাষণ
জুড়ে ছিল উদার মানবতাবাদের জয়গান ও মানুষকে ভালবাসার উপদেশ। 
বাংলাসাহিত্যে মানবতাবাদ নিয়ে
ভাষণে তিনি বললেন, খেটে খাওয়া মানুষকে
সম্মান দিতে হবে, রিকশাওয়ালাদের সাথে ভাড়া নিয়ে অনায্য আচরণ যেন তার কোন ছাত্র কখনও না করে।
এই চিরস্মরণীয় ভাষণে
তিনি কয়েকটি লাইন আবৃতি করেন যা আমি কোনদিন ভূলি নাই, ভুলবনা- “নানান বরণ
গাভীরে ভাই, একই বরণ
দুধ।/ জগত ভ্রমণিয়া দেখলাম, একই মায়ের পুত”। এভাষণে
তিনি মধ্যযুগের অমর কবি কালীদাসের বিখ্যাত লাইন আবৃতি
করেন- “শোন হে মানব ভাই, সবার উপরে মানুষ
সত্য, তার উপরে নাই”।
ছাত্ররা বলত শফিউদ্দিন স্যারের একজন পীর আছেন, সেই পীর ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর। তিনি সব সময় বিদ্যাসাগরের গুণগান করতেন, বিদ্যাসাগর নিজে খেয়ে না খেয়ে কেমন করে দশ হাজার টাকা বিলাতে পাঠিয়ে উড়লচন্ডি দেউলিয়া কবি মাইকেল মধুসুদন দত্তকে উদ্ধার করে আনলেন সেই মহানুভবতার গল্প শোনাতেন। কিছু ছাত্ররা বলত, শফিউদ্দিন স্যারের মুখে আল্লাহ ও রসুলের কোন নাম নেই, সারাক্ষণ কেবল বিদ্যাসাগর, বিদ্যাসাগর। ছাত্ররা কানাকানি করত শফিউদ্দিন স্যার নাকি তখন ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের উপর পিএইচডি গবেষণা করছেন। তবে পরে তাঁর জীবনী পড়ে জানলাম এই উড়োকথাটি সত্য নয়, তিনি পিএইচডি করেন চর্যাপদের উপর।
২০২০ সালে আমি বদলী হয়ে ঢাকা গেলে একদিন সহকর্মী সায়েদ আব্দুল্লাহ যীশুকে নিয়ে নয়াপল্টনে শফিউদ্দিন স্যারের বাসায় যাই। তিনি তখন বয়সের ভারে
জর্জরিত। তাঁর ছেলেমেয়েরা সুপ্রতিষ্ঠিত। আমাকে জড়িয়ে ধরে আলিঙ্গন করেন। স্যারের সাথে বেশ কিছু ছবি তুলি। ডঃ শফিউদ্দিন স্যার একসময় শাহজালাল বিঞ্জান ও প্রযুক্তি  বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন এবং বাংলাবিভাগের প্রধানের পদ থেকে অবসর গ্রহণ করে ঢাকায় চলে যান।   
বাংলাসাহিত্যের ক্লাসে শরতচন্দ্রের উপন্যাস “শ্রীকান্ত” পড়াতেন বিরেশ বাবু। সিনিয়রদের কাছে শুনলাম বিরেশ স্যার এই ক্লাশে বহুবছর ধরে এই শ্রীকান্তই পড়িয়ে যাচ্ছেন। গাইলে হয় নাম, করলে হয় কাম। নিশ্চিত করে বলা যায় বছরের পর বছর শ্রীকান্ত উপন্যাসে পড়াতে পড়াতে বিরেশ স্যার একজন শ্রীকান্ত এবং শরত বাবু বিশেষজ্ঞ হয়ে গেছেন।
বিরেশ স্যার বাঙালি নারীদের জীবনচিত্র দুটি লাইনে প্রকাশ করতেন ’রাঁধার পরে খাওয়া, খাওয়ার পরে রাঁধা। একসাথে বাইশটা বছর বাঁধা’। তিনি দেখে যেতে পারেননি, বাংলাদেশের নারীদের সেই আটপৌর গৃহবন্দী জীবন আজ আর নেই। তিরিশ লক্ষ বাঙ্গালী গার্মেন্টস নারীকর্মী বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানী পণ্য গার্মেন্টসকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে নিরলস শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন। বাংলার অবলা রাঁধুনি নারীরা আজ দেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলনেত্রী, স্পিকার, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যাংকার, সেনাপতি, আইনজীবী, উদ্যোক্তা, কৃষিবিদ, ব্যবসায়ী, শিক্ষাবিদ, প্রশাসক, আর কত কি। সবখানে আজ তাঁদের সফল বিচরণ। তাঁদের জীবন এখন কেবল রাঁধার সাথে বাঁধা নয়।
এতদিন স্কুলজীবনে আমরা একই কক্ষে বসে সারাদিন ক্লাস করেছি ও কেবল প্রথম ক্লাসটিতে রোলকলে “ইয়েস স্যার” বা “প্রেজেন্ট স্যার” বলেছি। বৈচিত্রময় ব্যাপার হল এখানে প্রতিটি ক্লাসেই রোলকল হয়, প্রতিটি ক্লাসের শুরুতে প্রেজেন্ট স্যার বলতে হয়। একজনের ইয়েস স্যার অন্যজনও বলে দেয়। প্রতিক্লাসের পর শ্রেণিকক্ষ পরিবর্তন হয়। তাও আবার একটি ভবন হতে অন্য কোন দূরের ভবনে, এক টিলা হতে আরেক টিলায়। তাঁর কারণ এমসি কলেজে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়নবিজ্ঞান, গণিত, বাংলা, ইংলিশ ও জীববিজ্ঞান প্রতিটি অনুষদ বেশ দূরদূরান্তে ছড়িতে ছিটিয়ে থাকা সুরম্য ভবনমালায় অবস্থিত।
প্রতিক্লাসে সামনের লাইনে বসার প্রতিযোগিতা হত। শতাধিক ছাত্রদের দল নেচে গেয়ে হৈ চৈ করে দিত এক লম্বা ম্যারাথন দৌড়। এইচ এস সি বিজ্ঞানের সিলেবাস বিশাল, বড় বড় বিজ্ঞান ও গণিত বই, দেখলেই ভয় লাগে। ক্লাশের সাথে তাল মিলানো বেশ কঠিন কাজ। তাই সবার মাঝে টেনশন আর উত্তেজনা। ঘন্টায় ঘন্টায় একশত ষাট জন ছাত্রছাত্রীর মধ্যে হত বিরামহীন দৌড় প্রতিযোগিতা। যাদের মগজ ভাল, তাঁরা সহজে বুঝে, যাদের মগজ কাঁচা তাঁদের অবস্থা, মরে গেলাম রে, আর সইতে পারছিনা রে, মাগো বাঁচাও।
ক্লাশ শুরু হবার কিছুদিন পর একবার সামনের সিটে বসা নিয়ে রসিক সহপাঠি বন্ধু খলিলের সাথে বেশ ঝগড়া করি, সে হেঁটপরা কমলেশকে তামাশা করে বলত কম্বলেশ, মৃণালকে বলত সিনাল। সিলেটি ভাষায় কম্বল অর্থ পাছা এবং সিনাল অর্থ ভ্রষ্টা নারী। কমলেশ ও মৃনাল তাতে খুব একটা মাইন্ড করত না, তাঁরা কৌতুক মনে করে হেসে উড়িয়ে দিত।
বন্ধু খলিলুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানে অনার্সসহ মাস্টার্স করে ১৯৯০ সালে আমার সাথে পুবালী ব্যাংকে অফিসার হিসাবে যোগদান করেন। একি সাথে শিক্ষানবীশ অফিসার হিসাবে এম সি কলেজের সহপাঠি বন্ধু জকিগঞ্জের মাহবুব আহমদও পূবালী ব্যাংকে আসেন। এম সি কলেজ এইচএসসি ১৯৮৩ ব্যাচের তিন সহপাঠীর মধ্যে মাহবুব আহমদ জকিগঞ্জ শাখায়, খলিলুর রহমান ঢাকা স্টেডিয়াম শাখায় এবং আমি চৌধুরী ইসফাক সিলেট মহিলা কলেজ শাখায় নিয়োগ পাই। কয়েক মাস পূবালী ব্যাংকে কাজ করার পর খলিলুর রহমান বিসিএস (প্রশাসন) পাস করে সরকারি চাকুরিতে চলে যান। শ্রীমঙ্গলের জাতক খলিলুর রহমান বাংলাদেশ সরকারের যুগ্ন সচিব পদ হতে কিছুদিন আগে অবসরে যান। মাহবুব আহমদ ডিজিএম অবসরে গেছেন, কেবল আমি এখনো পূবালী ব্যাংকে নিভু নিভু হয়ে জ্বলছি।
এমসি কলেজে সাইকেল সেড ছিল, অনেক ছাত্ররা বাইসাইকেল চড়ে কলেজে আসত। সারি সারি সাইকেলে সেড ভরে যেত। সেকালে রাস্তায় এত ট্রাফিক জ্যাম ছিলনা, ছাত্ররা দশবার জন মিলে দলবেঁধে নিরিবিলি ঈদগাহ রোড দিয়ে সাইকেল চালিয়ে গল্পগোজব করে করে কলেজে আসত। তখনকার দিনে মনে করা হত এমসি কলেজ শহরের বাহিরে তিন মাইল দূরের এক মফস্বল এলাকা।
এমসি কলেজে একটিমাত্র হালকা নীলাভ বড় কলেজবাস সচল ছিল। আমরা গাদাগাদি হয়ে সেই বাসে চলাফেরা করতাম, জায়গা না পেয়ে অনেক ছাত্র বাসের ছাদে বেয়ে উঠত। বাসের গায়ে বড় বড় অক্ষরে লেখা ছিল ‘সিলেট বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ’।
চালক ছিলেন ছাত্রদের সবার প্রিয় তারুভাই। একদিন পেঠমোঠা শ্যামলা তরুভাই গাড়ি চালিয়ে আমাদেরকে নয়াসড়ক জামে মসজিদে নিয়ে যান অধ্যক্ষ গোলাম রসুল স্যারের পিতার নামাজে জানাজায়। তাঁকে মানিকপিরের কবরগায় দাফন করা হয়। সেইদিন প্রথম ছাত্রদের সাথে মানিকপির টিলার একদম উপরে যাই। টিলাটি এত উঁচু যে নিচে সারাটা শহরের ভবনমালা অনায়াসে দেখা যায়।
আরেকদিন তারুভাই গাড়ি চালিয়ে আম্বরখানায় আসামাত্র ছাদে বসা আমাদের সহপাঠি ফুলবাড়ির ইমরান চৌধুরী টেলিফোনের তাঁরে ঝুলে যায়। তারুভাই জুরে ব্রেক মারেন। ছাত্ররা আচমকা ব্রেকে তাল সামলাতে না পেরে একে অন্যের গায়ে ধাক্কা খান। সামনে আমরা সবাই মিলে ইমরানকে হাসপাতালে নিয়ে যাই। এই সহপাঠি বন্ধু ইমরান চৌধুরী আজ আর নেই। তাঁকে নিয়ে আমি ঝরাকলি নামে একটি গল্প রচনা করি। এই সকরুন গল্পটি আপনারা আমার গল্পগ্রন্থ ঝরাপাতা হতে পড়ে নিতে পারেন।    
আমাদের গণিতের ক্লাস নিতেন ঋষিকেশ স্যার। ঋষিকেশ স্যারের কোন তথ্য আমি পাইনি।
একদিন সদ্য বিসিএস পাস করা একজন সতরুণ গণিতের শিক্ষক যোগদান করেন। তিনি জিন্সের প্যান্ট ও দামী গেঞ্জি পরে ক্লাস নিতেন, তখনও কিশোরকুমার সেই স্মার্ট ও হাসিমুখ স্যারের নাম ছিল ধীরেশ চাঁদ সরকার। চলনে বলনে ধীরেশ স্যার ছিলেন ছাত্রদের আইডল। শুনেছি একসময় তিনি তাঁর উপযুক্ত একজন স্বধর্মীয় ছাত্রীর প্রেমে পড়েন। পারিবারিক সম্মতিতে সেই ছাত্রীকে বিয়ে করে সুখী দাম্পত্যজীবন পার করেন।
আমরাই ছিলাম ধীরেশ স্যারের চাকুরি জীবনের উদয়বেলার প্রথম ছাত্রব্যাচ। ২০১৩ খ্রিস্টাব্দে আমি এম সি কলেজের অধ্যক্ষ অফিসে গিয়ে ধীরেশ চাঁদ সরকার স্যারকে অধ্যক্ষের চেয়ারে আসীন দেখতে পাই। ক্লিন সেভ, স্মার্ট গোঁফের আড়ালে সেই মুছকি হাসি লেগে আছে। তাঁর হাতে আমার লিখা “ইসফাক কুরায়শী রচনাসমগ্র” কলেজ পাঠাগারের জন্য তুলে দেই। অধ্যক্ষ ধীরেশ স্যার বেশ খুশি মনে বইটি হাতে তুলে নেন। ধীরেশ স্যারের নিজস্ব বাসা ছিল আমার বাসার কাছে বাগবাড়ি হিন্দুপাড়ায়। এম সি কলেজের অধ্যক্ষ পদ হতে অবসর গ্রহণ করে তিনি বাগবাড়িতে স্থায়ী হন।
আমার পুত্র জেফার এইচএসসির গণিত
শিখতে ধীরেশ স্যারের কাছে টিউশনি পড়তে যায়। আমি জেফারকে নিয়ে ২০১৫ সালে ধীরেশ স্যারের
সাথে তাঁর বাগবাড়ির বাসায় দেখা করি। বেশ সুন্দর ছিমছাম বাসা। আমি এমসি কলেজ এইচএসসি ১৯৮৩ ব্যাচ বলতেই চিনে ফেলেন। আমার
সহপাঠি ওয়াদুদ, হাফিজ, রুমি, মতিউরসহ অনেকের নাম বলে যান অবলীলায়,
যারা ছিল সেরা মেধাবী। আমি ধীরেশ স্যারের এত স্মৃতিশক্তি দেখে বিষ্মিত হয়ে
বললাম, এত আগেকার ছাত্রদের নাম স্যারের এখনও কি মনে আছে? জবাব দেন মনে থাকবেনা কেন?
এমসি কলেজ ১৯৮১ সালে ভর্তি হওয়া এইচএসসি ১৯৮৩ ব্যাচ আমার শিক্ষকজীবনের প্রথম
ব্যাচ। ডাঃ আব্দুল ওয়াদুদ তো আমার হার্টের চিকিৎসা
করে। সে অতিশয় বিনয়ী। এই ছিল ধীরেশ স্যারের সাথে আমার শেষ দেখা। আমি পূবালী ব্যাংক পিএলসির প্রধান কার্যালয়, মতিঝিল, ঢাকায় বদলি হয়ে আসার পর ২০২০ সালে ফেসবুকে খবর পাই আমাদের প্রিয় ধীরেশ চাঁদ সরকার স্যার
না ফেরার দেশে চলে গেছেন। আমি তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি।
আমরা ভর্তি হবার পর গণিত পড়াতেন এমন একজন জনপ্রিয় শিক্ষক ছিলেন ডক্টর মাসুদ কাবেলি। ছেলেরা আফগান রাজধানী কাবুলের নামে তাঁকে ডাকত কাবুলি স্যার। তিনি কলেজের টেনিস গ্রাউন্ডে সর্বদা লনটেনিস খেলতেন। কলেজের ইয়াং স্যারেরা বেশি বেশি লনটেনিস খেলতেন, তবে সিনিয়র ক্লাসের কিছু মুরব্বী ছাত্ররাও খেলায় অংশ নিতেন। একসময় মেধাবী শিক্ষক ডঃ মাসুদ কাবেলি স্যার উচ্চশিক্ষার সুযোগ পেয়ে বিদেশে চলে যান। তিনি আর বাংলাদেশে ফিরে আসেননি।
আমেরিকার মিশিগান প্রবাসী আমাদের সহপাঠী বন্ধু অলিউর রহমানের মাধ্যমে ১৯৮৩ ব্যাচ গ্রুপের ওয়ার্সএপে জানতে পারি মাসুদ কাবেলি স্যার ২৯ ডিসেম্বর ২০২২ ডেট্রয়েট শহরের এক হাসপাতালে ইন্তেকাল করেছেন। ২০২২ সালের ৩০ ডিসেম্বর ডেট্রোয়েট আলফালাহ মসজিদে নামাজে জানাজা শেষে তাঁকে মিশিগানে দাফন করা হয়। আমাদের কয়েকজন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সহপাঠি বন্ধুরা তাঁর নামাজে জানাজা ও দাফন কাফনে শরিক হন। ডঃ মাসুদ কাবেলি স্যার ছিলেন নেত্রকোনার জাতক। মহান আল্লাহপাক তাঁকে জান্নাত দান করুন, আমিন।
গণিতের আরেকজন শিক্ষকের নাম মনে আছে, তিনি আনোয়ার হোসেন। তাঁর সম্পর্কে আমি তেমন কিছু জানতে পারিনি।
জামালউদ্দিন নাগরি নামেরও একজন গণিতের স্যারের মুখ চোখে ভাসে। তিনি সিলেটি নাগরি বর্ণমালা নিয়ে সারাজীবন কাজ করেন এবং অবসরের পর বিশ্বনাথ উপজেলার কোন এক প্রত্যন্ত গ্রামের নিভৃতে চলে যান। সিলেটি নাগরি ভাষা ও বর্ণমালা বাঁচাতে অক্লান্ত প্রচেষ্টার জন্য সিলেটি জনগণ তাঁর নামের শেষে নাগরি উপাধি যুক্ত করে দেন। জামালউদ্দিন নাগরি স্যার বুড়োবয়সটা দীনহীন অবস্থায় কাটিয়ে সিলেটের মফস্বলে পরলোকগমন করেন। সিলেটি নাগরি ভাষা গবেষক জামালউদ্দিন নাগরি স্যারের মৃত্যুসংবাদ সিলেটের বিভিন্ন স্থানীয় পত্র পত্রিকায় পড়ি। তাঁকে শ্রদ্ধা জানাই ও বেহেশত কামনা করি, আমিন।
পদার্থবিজ্ঞানের ননসিলেটি আফসার উদ্দিন স্যারের কথা খুবই মনে পড়ে। আফসার উদ্দিন স্যারের টিলাগড়ের ভাড়া বাসায় গিয়ে প্রাইভেট পড়ে আমি ক্যালকুলাস, গতিবিদ্যা ও স্থিতিবিদ্যা শিখি। আফসার উদ্দিন স্যারের একছেলে তখন সিলেট সরকারি মেডিকেল কলেজে এমবিবিএস পড়ত।
জবদুল হক স্যারের স্মৃতি আজও বেশ অম্লান। জবদুল হক স্যার ছিলেন পদার্থবিজ্ঞানের বিভাগপ্রধান, তিনি এম সি কলেজের শিক্ষক কলোনির সরকারি বাসায় সপরিবারে বসবাস করতেন। জবদুল হক স্যার পদার্থবিজ্ঞানের নিউটনের গতিসূত্র, শক্তি, গতি, ভর, বেগ, পড়ন্ত বস্তুর সূত্র, শব্দ, আর্কিমিডিসের সূত্র, আলোক, বিদ্যুৎ, মেন্ডেলিফের পর্যায় সারণী, বয়েলের সূত্র ইত্যাদি সব বিষয় পড়াতেন। একবার একজন সহপাঠী বলল, বৈজ্ঞানিক নিউটন বেটা সব জঞ্জালের ঘটি, তিনি দুনিয়ায় না এলে এত কষ্ট করে তাঁর গতিসূত্র ও ক্যালকুলাসের মত জটিল গণিত আমাদের পড়তে হতনা।
জবদুল হক স্যারের বাড়ি রাজশাহী বিভাগে। তিনি রাজশাহীর আঞ্চলিক টানে কথা বলতেন। শব্দ কম্পাংক পরিমাপের টিউনিংফর্ক বা সুরেলিকাটাকে রাজশাহীর আঞ্চলিক টানে জবদুল হক স্যার উচ্চারণ করতেন ছুরেলিকাটা। তিনি দ্রুততার সাথে কথা বলতেন। সূর্যের আলোর মৌলিক সাতরঙ্গ বে, নী, আ, স, হ, ক, লা (বেগুনি, নীল, আসমানি, সবুজ, হলুদ, কমলা ও লাল) তিনি ঝরঝর করে বলে যেতেন।
জবদুল হক স্যারের বাসায় গিয়ে আমাদের অনেক সহপাঠিরা গণিত ও ফিজিক্স পড়েন। অধ্যাপক জবদুল হক স্যার বাংলাদেশের অনেকগুলো নামীদামী কলেজে বিভাগপ্রধান ও অধ্যক্ষ হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। লোকমুখে শুনেছি তিনিও এখন ইহজগতে নেই। তিনি জান্নাতবাসী হউন, আমিন।
শীর্ণকায়া ইকবাল আহমদ স্যার তাপ, আলো, শক্তি ইত্যাদি পড়াতেন। ইকবাল স্যারের ছোট্ট গাল শেষবয়সে এলোমেলো দাড়িতে ভরে যায়। আমি তাঁকে উচকো কুচকো চুলদাড়ি নিয়ে সিলেট শহরে উদ্ভ্রান্তের মত একমনে হেঁটে যেতে দেখে প্রায়ই সালাম দিতাম, কিন্তু বেখেয়াল স্যারের কোন সাড়াশব্দ পেতাম না। শুনেছি, ইকবাল আহমদ স্যার শেষবয়সে
কিছুটা অপ্রকৃতিস্থ হয়ে সিলেট শহরে মারা
যান। ইকবাল আহমদ স্যার ইহজগতে মানসিক রোগে বেশ কষ্টভোগ করেন, আল্লাহ পাক তাঁর পরকাল শান্তিময় করুন, আমিন। 
রসায়ন বিভাগে বেশ কয়েকজন প্রাণবন্ত স্যার ক্লাস নিতেন। মেঘনাদ সাহা ও পরিমল দে স্যার তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তাঁরা ছাত্রদের খুব প্রাণপ্রিয় শিক্ষক ছিলেন। তাঁরা দুইজনই ছিলেন ভদ্র, নিরীহ ও দয়ালু। এমন নিবিষ্ঠ মনে পড়াতেন যে শ্রেণিকক্ষে সব শেখা হয়ে যেত। লবণ সনাক্তকরণ, হাইড্রোকার্বন, এসিড, ক্ষার, মৌল, মৌলের রাসায়নিক সংক্ষেত ইত্যাদি আমরা এই অধ্যাপকগণের বদণ্যতায় সহজেই শিখে ফেলি। সরলতার কারণে হয়ত তাঁরা অধ্যক্ষ উপাধ্যক্ষ জাতীয় বড় পদে বসতে পারেননি, কিন্তু তাঁদের দায়িত্ববোধের কোন অভাব ছিলনা।
মেঘনাদ সাহা প্রায় পঁচিশ বছর এক সি কলেজের অধ্যাপক ছিলেন। মেঘনাদ স্যার চট্টগ্রামের জাতক। অবসর নিয়ে তিনি নিজশহর চট্টগ্রামে চলে যান। সেখানে তিনি সুস্থ্য শরীরে প্রশান্ত মনে আছেন। আমার সহপাঠী কাজি শামসুল হুদা সুহেলের মাধ্যমে জেনেছি পরিমল দে স্যার তাঁর জন্ম শহর সুনামগঞ্জে সুস্থ শরীরে ভালোই আছেন। সুনামগঞ্জের নানা সামাজিক সাংস্কৃতিক ও জনকল্যাণকর কর্মকান্ডে তিনি জড়িত আছেন। আমরা তাঁদের মঙ্গোল কামনা করি।
সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের সন্থান অধ্যাপক সুধাংশু শেখর চক্রবর্তী স্যার ছিলেন শ্যামলা ও লম্বা চওড়া ব্যক্তিত্ববান শিক্ষক। স্যার ছিলেন একটু কড়া ও নির্ভীক। ছাত্ররা স্যারকে ভয় পেত ও খুব সমিহ করত। পরীক্ষার হলে ছাত্রনেতারাও উল্টাপাল্টা কিছু করলে সুধাংশু স্যার একবিন্দুও ছাড় দিতেন না। আমি কিন্তু সুধাংশু স্যারকে ভয় পেতাম না। মনে হত তিনি খুব আত্মমর্যাদাশীল ন্যায়নিষ্ঠ শিক্ষাগুরু। যতই গরম হউন না কেন, তিনি আমাদের ভাল চান ও মঙ্গলের জন্য একটু কড়া আচরণ করেন। চট্টগ্রামের সুশান্তসহ আমরা কয়েকজন সহপাঠী সকালবেলা বালুচর অরামবাগে সুধাংশু স্যারের বাসার বারান্দায় বসে বীজগণিত ও ত্রিকোণমিতি প্রাইভেট টিউশনি পড়ি। সমাবেশ বিন্যাস, মুলদ অমূলদ, লগারিদম, অসীম সংখ্যার সমীকরণ, দ্বিঘাত সমীকরণ, সাইন টিটা, কস টিটা, কসেক টিটা ইত্যাদি শিখে নেই। অধ্যাপক সুধাংশু শেখর চক্রবর্তী স্যার একসময় এমসি কলেজের রসায়ন বিভাগের প্রধান হন। সুযোগ্য সুধাংশু স্যার পরে এমসি কলেজের উপাধ্যক্ষ পদেও বসেন। বর্তমানে তিনি সিলেট শহরে অবসরে আছেন।
এইচএসসি ১৯৮৩ ব্যাচের আমন্ত্রণে সুধাংশু শেখর চক্রবর্তী স্যার একবার সিলেটের কোন এক হোটেলে আমাদের ডিনারে স্বস্ত্রীক যোগ দেন। সুধাংশু স্যার ও বৌদিকে পেয়ে আমাদের সবার মনে এক আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। এমসি কলেজ মাঠের ফুটবল টুর্নামেন্ট নিয়ে সেদিন মিয়া আশিক ও পারভেজ আক্তার বেশ মজার স্মৃতিচারণ করেন।
সেকালে মোবাইল ছিলনা, যুগটা ছিল পত্রালাপের। প্রেমপত্র বিনিময়ের মাধ্যমে প্রেমে পড়ে ভারতের হিন্দিভাষী একজন হিন্দু তরুণি চলে আসেন মিয়া আসিকের দরবারে। পত্রমিতা ভারতীয় এই হিন্দু মেয়েটাকে নিয়ে মহাবিপদে পড়ে যান মিয়া আশিক। তরুণী মেয়েটাকে কি করবেন, কোথায় রাখবেন। আবাসিক হোটেলে একাকি রাখা নিরাপদ না, আত্মীয়স্বজনের বাসায়ও নেয়া যাবেনা, এদিকে রাত ঘনিয়ে আসছে। শেষমেষ কি আর করবেন, মেয়েটাকে নিয়ে মিয়া আশিক ছুটে যান সুধাংশু শেখর স্যারের বাসায়। বৌদি ও সুধাংশু স্যারকে মধ্যরাতে ডেকে ঘটনাবৃত্তান্ত জানিয়ে মিয়া আশিক বললেন, ভারত থেকে একা একা সিলেটে চলে আসা এই পাগলিটাকে সামলান। স্যার ও বৌদি কি আর করবেন। অপরিচিত মেয়েটাকে বাসায় আশ্রয় দেন ও বুঝিয়ে সুজিয়ে ভারতে পাঠান। সুধাংশু স্যার ও বৌদি সেদিন ভিনদেশি, ভিনভাষী ও ভিন্নধর্মী দুইজন আশুক-মাসুককে এভাবে মহাবিপদ হতে উদ্ধার করে নিরাপদে ও সসম্মানে তীরে পৌঁছে দেন।
রসায়নবিজ্ঞান বিভাগের হবিগঞ্জি বাকিবিল্লাহ স্যারের স্মৃতি খানিকটা মনে পড়ে। এই দাড়িওয়ালা পাজামা পাঞ্জাবি পরিহিত সরল প্রকৃতির হুজুর স্যারের পুরো নাম সৈয়দ আবুসজ্জাদ বাকিবিল্লাহ। তিনি ক্লাসে আজ যা পড়াতেন, কাল তাঁর উপর পরীক্ষা নিতেন। তাই সৈয়দ আবু সজ্জাদ বাকিবিল্লাহ স্যারকে কিছু ছেলেরা কৌতুক করে বলত নগদবিল্লাহ স্যার। তিনি অধ্যাপনা এবং আল্লাহর আরাধনা, এই দুই কাজে জীবন পার করে দেন।
আমাদেরকে ইংরেজি পড়াতেন এম এ বাকী এবং এম এ বারী নামের দুইজন শিক্ষক। তাঁরা সংক্ষেপে ছাত্রদের বাকী স্যার ও বারী স্যার। কৃশতনু যুবতী জিন্নাত আরা ম্যাডাম আমাদের ইংরেজি ক্লাস নিতেন। জিন্নাত আরা ছিলেন ফর্সা ও সুন্দরী। তার ইংলিশ বাক্যালাপ ছিল নির্ভূল ও সুস্পষ্ট। মেডামের মায়াবি চেহারা, স্মার্টনেস কথাবার্তা ও রূপলাবণ্য ছাত্রদের কাছে বেশ আলোচনার বিষয় ছিল। ইংরেজির চৌকষ শিক্ষিকা জিন্নাত আরা মেডামও সময়ের প্রবাহে বিস্মৃতির আড়ালে হারিয়ে যান। ইংলিশের স্বল্প পরিচিত আরেকজন ননসিলেটি স্যারের নাম ছিল বারিক সরকার।
আমার মূল বিষয় ছিল গণিত ও জীববিজ্ঞান ঐচ্ছিক। ঐচ্ছিক বিষয় না রাখলেও চলে। ঐচ্ছিক বিষয়ে পাসফেলে রেজাল্টে কিছু যায় আসেনা। যারা মেডিকেলে আগ্রহী তাঁরা জীববিজ্ঞান এবং ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে আগ্রহীগণ গণিতকে মূল বিষয় নির্বাচন করতেন। জীববিজ্ঞানের ক্লাসে এসে আমরা দ্বিতীয় একজন পরিমল স্যারের দেখা পাই। তাঁকে ছাত্ররা বলত বুটানির পরিমল স্যার। সহপাঠী বন্ধু বিজিত রঞ্জন বৈদ বুটানির পরিমল স্যারের একটি স্মৃতি মনে করিয়ে দেন। জীববিজ্ঞানের পরিমল স্যার কলেজ জীবনে তাঁর সর্দারীর কাহিনি বেশ গর্বভরে বলতেন এভাবে, আমি ছিলাম জগন্নাথ কলেজের ভি.পি + গুন্ডা।
জীববিজ্ঞানের দুইটি শাখা, প্রাণিবিদ্যা ও উদ্ভিদবিদ্যা। প্রাণিবিদ্যার ক্লাস নিতেন তরতাজা ফর্সা সুন্দরী শিক্ষিকা গুলনাহার বেগম। গুলনাহার মেডামের বয়স তখন বড়জুর পয়ত্রিশ। ম্যাডাম মেটাফিজ/ মেমোসিজ পড়াতেন, উদ্ভিদকোষ ও প্রাণিকোষের মিল অমিল ইত্যাদি পড়াতেন। গুলনাহার মেডাম বড়বড় আগুন চোখে যখন তাকাতেন, সদ্য গোঁফ গজানো টিনেজার ছেলেরা ভয়ে চুপসে যেত। আমিও মেডামকে খুব ভয় পেতাম। কেন যেন আমাকে তিনি বারবার ক্লাসে দাড় করে নানা প্রশ্ন করতেন। মেডামের প্রশ্নের জবাব দিতে এই বান্দার বেশ মানসিক চাপ হত। হয়ত গুলনাহার মেডাম আমার চেহারাসূরত দেখে খুব মেধাবী একজন ছাত্র মনে করতেন।
গুলনাহার মেডাম পড়ান, ডিম্বানুতে শুধু ওয়াই ক্রমোজম থাকে, শুক্রানুতে এক্স এবং ওয়াই এই দুই ধরনের ক্রমোজম থাকে। এক্স ক্রমোজম ক্রিয়ায় ভ্রূণের প্রাণ নর এবং ওয়াই ক্রমোজমের ক্রিয়ায় নারী লিঙ্গ হয়। সেই গোপন বিষয়টি গুলনাহার মেডাম ছাত্রদের চোখে চোখ রেখে গড়গড় করে পড়াতেন। কেউ একটু হেসে দিলে বাঁচা অসম্ভব। একবার কোন এক ছেলে মুচকি হাসি দিলে মেডাম সাথে সাথে তাঁকে ক্লাস থেকে বের করে দেন। তাই গুলনাহার মেডামের ক্লাসে বিরাজ করত পিনপতন নীরবতা।
গুলনাহার মেডাম বেশ ভাগ্যবতী, তিনি একসময় জাতীয় পাঠ্যক্রম
ও স্কুল টেক্সট বুক বোর্ডের চেয়ারমেন হন। ২০২১ সালে ফেসবুকে সহপাঠি গোপী সরকারের লেখা পড়ে
জানতে পারি গুলনাহার মেডাম আজ আর পৃথিবীতে নেই। সেই সময় জীববিজ্ঞান বিভাগে যোগ দেন একজন তরুণ
প্রভাষক আজিজুর রহমান লস্কর। অবসর নিয়ে আজিজুর রহমান লস্কর নানা বিষয়ে প্রচুর লেখালেখি করেন এবং সিলেটে ইন্তেকাল করেন। 
আমাদের রসায়ন গবেষণাগারে ব্যবহারিক ক্লাসের দায়িত্বে ছিলেন ডেমনেষ্ট্রেটর লস্কর সাহেব। তিনি ব্যবহারিক খাতায় একটু ভুল পেলে খাতা ছুড়ে ফেলতেন। দ্বাদশ ক্লাসে ফাইন্যাল পরীক্ষার আগে যতবারই খাতা দেই ততবারই লস্কর সাহেবের মন ভরেনা, তিনি ছুড়ে মারেন। শেষে আমরা কয়েকজন মনস্থির করলাম মাত্র পাঁচ নম্বরের খাতার জন্য আর কত সময় নষ্ট করব, এই লোকটার আর কত হাতপা ধরব। আমরা লস্কর সাহেবের সই অবিকল জাল করে খাতার পাতায় পাতায় বসিয়ে দিলাম। একজন বলল শালার লস্কর, আমাদেরে আর কত গরম দেখাবি রে। ব্যবহারিক পরীক্ষার দিন এত খাতা জমা হয় যে পরীক্ষক স্যাররা তা খোলেও দেখেননি। সবাইকে পাঁচের মধ্যে কোন একটা পাস নম্বর বসিয়ে দেন।
রসায়ন ল্যাবকর্মী সালাম মিয়া আজব লোক, সে গ্লাসের উপর পড়া এসিড খালি হাতে মুছে পানির টেপে ধুয়ে ফেলে বলত, এসিড
খুবদ্রুত পানি দিয়ে ধুয়ে ফেললে ত্বক পোড়ানোর সময় পায়না।
লবণ সনাক্তকরণের পরীক্ষার আগের দিন ল্যাবকর্মী সালাম মিয়াকে আমরা কয়েকজন বিশ টাকা করে বখশিস দেই। পরীক্ষাস্থলে কর্মরত সালাম মিয়া এসে আমার নমুনা লবণের কয়েকদানা হাতে নিয়ে ভাল করে দেখে দুএক দানা জিহ্বায় দেন। তারপর বলেন এই লবণ মনে হয় “জিঙ্ক সালফেট” হবে। এবার তিনি একটি কাঁচের টেস্টটিউবে লবণের একটু নমুনা নিয়ে কি একটা কেমিকেল মিশিয়ে আগুনে ধরে দেখেন হালকা সবুজ রঙ এসেছে এবং গরম লবণের ধুঁয়ার গন্ধ শুকে বললেন এটি নিশ্চিত “জিঙ্ক সালফেট”। সালাম মিয়ার সৌজন্যে আমার লবণ সনাক্তকরণ পরীক্ষা নিমিশেই শেষ, খেইড় খতম।
পদার্থবিজ্ঞানের ব্যবহারিক পরীক্ষার দিনে লটারি হয় কে কোন বিষয়ে পরীক্ষার ফলাফল নির্ণয় করবেন। অনেকগুলো কাগজের টুকায় পরীক্ষার বিষয় লিখে সামনে ফেলা হয়। লটারির মত টুকা তুলে খোলার পর দেখা যায় একেক জনের ভাগ্যে একেকটি পরীক্ষা লাগছে। মনমত পরীক্ষা যাদের লাগে তাঁরা মহাখুশি, আর যাদের লাগে নাই তাঁদের মন খারাপ। লটারির টুকা তুলার পর চেহারাই বলে দেয়, কে খুশ, আর কে নাখুশ।
লটারিতে আমার ভাগ্যে
‘আতশী কাঁচের সাহায্যে আলোর প্রতিসরাঙ্ক নির্ণয়’ ওঠে। খুশি হলাম, এই টেস্ট আমার
ভালভাবে জানা ছিল এবং আমি চেয়েছিলামও তাই। ভাগ্যবান আমি সেদিন আতশী কাঁচের সাহায্যে আলোর প্রতিসরাঙ্ক নির্ণয় করে সহজেই পার পেলাম।
একাদশ বিজ্ঞানে ভর্তি হওয়া আমার তিনশত বিশ জন সহপাঠির অনেকের নাম আমার জানা হয়নি। তবে দুই বৎসর একসাথে থাকা “ক” শাখার একশত ষাট জনের মধ্যে আমার অনেক সহপাঠির স্মৃতি সুস্পষ্ট মনে আছে। আমি “ক” শাখার প্রিয় সহপাঠিদের স্মৃতিই আগে তুলে ধরব। “খ” শাখারও অনেকেই সুপরিচিত ছিলেন। তাদেরে আমি কি স্মৃতি থেকে মুছে ফেলতে পারি? উত্তর হলো- না, পারিনা।
আব্দুল হাফিজ ছিলেন অতি মেধাবী ছাত্র। তিনি এসএসসি ১৯৮১ পরীক্ষায় বিশাল চট্টগ্রাম বোর্ডে বিজ্ঞানে পঞ্চম স্থান অধিকার করেন। এসএসসিতে তাঁর প্রাপ্ত নম্বর ছিল ৭৯২। তিনি চোখে চশমা দিতেন ও ফুলসার্ট পরে ক্লাসে আসতেন। মিতবাক হাফিজ ছিলেন কিছুটা আত্মভূলা। তিনি অন্যদের সাথে খুব একটা মিশতেন না, কিংবা পড়ালেখা নিয়ে এতই ব্যস্ত ছিলেন যে তার বারবাজারী দুস্তিয়ানা করার সময়ই ছিলনা। হাফিজের গ্রামের বাড়ি গোয়াইনঘাট হলেও তারা সিলেটের হাউজিং এস্টেটে নিজবাসায় বসবাস করতেন। তাঁরা ভাইবোনরা সবাই মেধাবী। হাফিজ বুয়েট হতে ডিগ্রি নিয়ে বাংলাদেশ আনবিক শক্তি কমিশনে যোগদান করেন এবং বাংলাদেশের একজন শ্রেষ্ঠ আনবিক বিজ্ঞানী হন।
আমি পুবালী ব্যাংক বরইকান্দি শাখার
ব্যবস্থাপক থাকাকালে একদিন কে একজন ফোন করে বলল আব্দুল হাফিজ নেই, শাহজালালের(রঃ) মাজার মসজিদে জানাজা হবে। শাহজালালের দরগায় জানাজায়
গিয়ে বহুবছর পর আবার দেখা হল সাদা কাফনে আবৃত্ত আমাদের সবচেয়ে মেধাবী সহপাঠী আব্দুল হাফিজের সাথে,
তখন তিনি মহানিদ্রায় শুয়ে আছেন চিরবিদায়ের খাটিয়ায়। আহারে, প্রিয়তমা পত্নী ও সন্তানদেরে রিক্ত করে শেষযাত্রাকালে তার বয়স হয়েছিল মাত্র পাঁচচল্লিশ বছর। মহান আল্লাহপাক তাঁকে জান্নাতের বাসিন্দা করুন, আমিন।
তিনি আব্দুল
ওয়াদুদ চৌধুরী ওরফে নিয়াজ, গ্রামের বাড়ি উত্তরকুল, জকিগঞ্জ। এসএসসিতে তাঁর প্রাপ্ত মোঠ নম্বর ছিল ৭৪৫। বৈশাখী হাউস,
কুমারপাড়া, ঝর্ণারপার নিজবাসায় অবস্থান করে লেখাপড়া করতেন। ওয়াদুদ চৌধুরী সিলেট সরকারি
পাইলট স্কুলের ছাত্র ছিলেন। সেখানে রুটিন বিভ্রাটে পড়ে এসএসসি পরীক্ষার
কোন এক সকালের পরীক্ষা বিকেলে দিতে গিয়ে একবছর ড্রপ পড়ার
কাহিনি শুনতাম। তিনি ছিলেন কৃশতনু শ্যামলা
ও দীর্ঘাঙ্গ। একটু খুড়িয়ে হাঁটা
ওয়াদুদের চোখে ছিল পুরু চশমা। সবসময় হাসিমুখ ওয়াদুদ ছিলেন মিশুক ও কথাবার্তায় বেশ
হ্যান্ডসাম। উচ্চাকাংখী ও মেধাবী আব্দুল ওয়াদুদ
চৌধুরী ছিলেন নিরহঙ্কার ও আত্মপ্রত্যয়ী। তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হতে এমবিবিএস পাশ
করে পরে এফসিপিএস ও এমআরসিপি করেন। অধ্যাপক
ডাঃ আব্দুল ওয়াদুদ চৌধুরী দীর্ঘকাল ঢাকা মেডিকেল কলেজের হৃদরোগ বিভাগের প্রধানের দায়িত্ব
পালন করেন। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ জীবানুবিদ্যা ইন্সটিটিউটের অধ্যক্ষের দায়িত্বে আছেন।
মতিউর রহমান ছিলেন মেধাবী কিন্তু দরিদ্র ছাত্র। এসএসসিতে তিনি ৭৩৫ নম্বর পান। তিনি ভাদেশ্বর পুর্বভাগ নাসিরউদ্দিন হাইস্কুল হতে আসেন। তিনি একসেট নীলপ্যান্ট ও হলুদসার্ট পরে উচ্চ মাধ্যমিক পার করে দেন। পড়াশুনায় তিনি ছিলেন খুব মনোযোগী। মতিউর বুয়েট হতে ডিগ্রি নিয়ে পরে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। তাঁর সাথে আর কখনো দেখা হয়নি।
ডাক্তার ইব্রাহিম আলী ফেঞ্ছুগঞ্জ কাশিম আলী হাইস্কুলের ছাত্র ছিলেন। এসএসসিতে তিনি পাঁচ বিষয়ে লেটারমার্কসহ মোঠ ৭৩৫ নম্বর পান। তিনি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হতে এমবিবিএস করেন। ডাঃ ইব্রাহিম আলী ছিলেন বেঁটে হাসিখুশি লোক। তিনি আমার পত্নী ডাঃ নুরজাহান বেগম চৌধুরীর সাথে বিভিন্ন সময় কাজ করেন। সিলেটে তাঁর সাথে প্রায়ই আমার দেখা হত। ইব্রাহিম আলী ছিলেন কঠোর পরিশ্রমি চিকিৎসক। তিনি আমেরিকার গ্রিনকার্ডধারী হলেও সিলেটে থাকতেন। দুইপুত্রকে নিয়ে তাঁর পত্নী যুক্তরাষ্ট্রের কার্লিফোনিয়ায় অবস্থান করতেন। ডাঃ ইব্রাহিম আলী রাগিব রাবেয়া মেডিকেল কলেজসহ কয়েকটি হাসপাতাল ও ডায়গনেস্টিক সেন্টারে আল্ট্রাসনোগ্রাম করতেন।
ডাঃ ইব্রাহিম আলী বাগবাড়িতে একটি চারতলা বাড়ি নির্মাণ করেন। এই বাড়িতে একা একা থাকতেন। একসময় তাঁর স্মৃতিভ্রম রোগ দেখা দেয়। হাতপায়ে কাঁপুনি ধরে। ধিরে ধিরে কাজপাগল মানুষটি অবশ হয়ে যান। এত রোগ নিয়েও তিনি আমাদের ব্যাচের সবকটি অনুষ্ঠানে কেঁপে কেঁপে এসে হাজির হতেন। সবার প্রতি তাঁর মায়ামমতার কোন সীমা ছিলনা। বাংলাদেশে চিকিৎসায় কাজ হচ্ছেনা দেখে তিনি উন্নত চিকিৎসার জন্য আমেরিকা চলে যান। সেই যে যান আর জন্মভূমিতে ফেরা হয়নি। ডাঃ ইব্রাহিম আলী ২০২০ সালে মাত্র চৌয়ান্ন বছর বয়সে যুক্তরাষ্ট্রের কার্লিফোনিয়ায় মারা যান। আমরা তাঁর বেহেশত কামনা করি। আমিন।
গোলাপগঞ্জ উপজেলার ফুলবাড়ি গ্রামের খায়রুল আক্তার চৌধুরী ও আসফাকুল ইমরান চৌধুরী ছিলেন আমার দূরসম্পর্কীয় ভাগনা। তাঁরা পরস্পর চাচাতো ভাই। খুব সম্ভব তাঁরা গোলাপগঞ্জ এম সি (মোহাম্মদ চৌধুরী) একাডেমির ছাত্র ছিলেন। তাদের সৌজন্যে এমসি কলেজে অনেকের কাছে আমি মামুতে পরিণত হই।
কৃশতনু, দুগ্ধবর্ণ, সুদর্শন খায়রুল আক্তার চৌধুরীর মুখে সবসময় একটা মিষ্টি হাসি লেগে থাকে। খায়রুল আমার মত উচ্চতায় পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি। তাঁর কমিউনিকেশন দক্ষতা অসাধারণ। খায়রুল চৌধুরীর ইলেক্ট্রনিক্স মেধা জন্মগত ও আল্লাহ প্রদত্ত। তিনি ছাত্রজীবনে টেস্টার দিয়ে খুচাখুচি করে টিভি, ফ্রিজ, রেডিও, টর্সলাইট ইত্যাদি মেরামত করে ফেলতেন। খায়রুল আক্তার চৌধুরী ইলেক্ট্রনিক্সে ডিপ্লোমা এবং বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন এবং সিনিয়র আইটি কর্মকর্তা হিসাবে ২০২৩ সালে অবসরে যান। খায়রুল আক্তার চৌধুরীর পত্নী নিম্মি চৌধুরী আনন্দনিকেতন স্কুলের শিক্ষিকা। তাঁদের দুই পুত্র, জৈষ্ঠ্য পুত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিটার সাইন্সে অনার্স পড়ছে। সে বেশ মেধাবী ও বিভিন্ন দেশে রবুটিক টেকনোলজী প্রতিযোগীতায় অংশ নিয়ে বিজয়ী হয়।
সুদর্শন ও ফরসা দুঃসাহসী আসফাকুল ইমরান চৌধুরী ১৯৮৯ সালে মাত্র তেইশ বছর বয়সে রহস্যজনক কারণে সদ্য বিবাহিত পত্নী রেখে পরপারে পারি দেন।
আত্মনিমগ্ন কবি মোহাম্মদ হোসেন দোয়ারাবাজারের সন্তান। অসচ্ছল পরিবার হতে আসা মোহাম্মদ হোসেনের বড় হবার দুরন্ত স্বপ্ন ছিল, কিন্তু জায়গীর বাসায় অবস্থান করে বাসার ছাত্রছাত্রী পড়িয়ে তিনিও হোঁচট খান। তিনি এম সি কলেজ থেকে রসায়ন বিজ্ঞানে অনার্স ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করেন। তিনি সিলেট শহরের খাসদবির সরকারি মাধ্যমিক স্কুলের প্রধানশিক্ষক হতে ২০২৩ সালে অবসর গ্রহণ করেন। মোহাম্মদ হোসেন অনেকগুলো আধুনিক কাব্যের রচয়িতা। তার কবিতা সরোবরে আছে জীবনে না পাওয়ার অব্যক্ত ব্যদনা, এক চাপা দুঃখবোধের হিমঘর যা আবৃতিকালে হৃদয়কে যন্ত্রণায় ভারাক্রান্ত করে দেয়। মোহাম্মদ হোসেইন তিন কন্যার বাবা। বড়কন্যা সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় হতে মাস্টার্সে প্রথম হয়েছে।
আতিকুর রেজা চৌধুরী ফেঞ্ছুগঞ্জ ঘিলাছড়ার অভিজাত ঘরের ছেলে। সে ছিল ফর্সা ও সতেজ। তার সাথে আমার বেশ ভাব ছিল। একদিন আমি তামাশা করে তাকে কি একটা গালী দেই। কিন্তু সে বেশ রাগ করে বসে। আমি তাঁর মাথায় হাত বুলিয়ে রাগ থামাই। ২০২৪ সালে তিরাশী ব্যাচের এক অনুষ্ঠানে একচল্লিশ বছর পর তার সাথে আরার দেখা হয়। তাঁর চেহারা সুরত সেই আগেকার মত রয়ে গেছে। শুনেছি সে এখন বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালের নির্বাহী কর্মকর্তা। কালো হোসেইন আহমদ ছিলেন মিসুক ও সুভাষী। তিনি এখন ঢাকায় আছেন।
যার সাথে আমার যোগসুত্র কোনদিন
ছিন্ন হয়নি, তিনি মাহবুব আহমদ। তার বাড়ি কালিগঞ্জ, জকিগঞ্জ। দীর্ঘতনু ও শ্যামলা মাহবুব মেধাবী, সরল ও রসিক ব্যক্তিত্ব। ধার্মিক ও নামাজি মাহবুব আহমদের  উপরও ছাত্রজীবনে ছিল
দারিদ্রের কুঠারাঘাত, যা তার অপার সম্ভাবনাকে অনেকটা
নষ্ট করে দেয়। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হতে দ্বিতীয় বিভাগে বিএসসি পাশ করেন। মজার
ব্যাপার হলো সে বছর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র পাঁচজন বিএসসি পরীক্ষায়
দ্বিতীয় বিভাগ পান। পরিশ্রমী মাহবুব আহমদ ২০২৪ সালে পুবালী ব্যাংক
লিমিটেডের ডিজিএম পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। 
ঈদগাহের শাহাদাত চৌধুরী সাহেদের গ্রামের বাড়ি ছিল বারহাল, জকিগঞ্জ। সামান্য খাটো মিষ্টি চেহারার শাহাদাত চৌধুরী সাহেদ ছিলেন বন্ধুবাৎসল উদার ব্যক্তিত্ব। ঈদগায় সাহেদের তিতলা বাসায় মোহাম্মদ হোসেন, সিরাজ, সুশান্ত, আমি ও সাকিম বসে বসে অনেক আড্ডা দিতাম। শাহাদাত চৌধুরী সাহেদ পরে বিদেশে চলে যান।
ঈদগাহের হাজারিভাগ মহল্লার সাকিম আহমদ খুব সহজ সরল উদার চিত্তের মানুষ। তিনি কৃষি ব্যাংকে চাকুরি করতেন। একসময় চাকুরি ছেড়ে সপরিবারে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। আমি ঈদগাহ শাখার ব্যবস্থাপক থাকাকালে সাকিমের সাথে সর্বদা দেখা হত। মুহাম্মদ হোসেন, কাজি সুহেল, খরাদিপাড়ার মাসিমা মেসের সুখময় চক্রবর্তী, শাহাদত, সাকিম ও আমি প্রায়ই কলেজ শেষে ঈদগাহ রোড দিয়ে একসাথে হেঁটে হেঁটে খরাদিপাড়ার বাসায় ফিরতাম।
চট্টগ্রামের ছেলে শ্রী
সুশান্ত শেখর চক্রবর্তী ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তার
পূত্র। তারা কুমারপাড়া দিঘিপারের এক
টিনের বাসায় বসবাস করতেন। সুশান্ত শখের বসে বাসায় কবুতর ও মোরগ
পুষতো। সুশান্ত ছিল আমার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু, আমি অনেকবার তাঁর বাসায় যাই। একবার আমেরিকায় ভর্তি হলে সুশান্তের বাবা বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি পত্র বের করে দেন। তিনি সিলেট পলিটেকনিকেও আমার সহপাঠি ছিল। সুশান্তের সাথে আমার পাঁচ বছর একত্রে কেটেছে। সুশান্ত অতিমাত্রায় ভদ্র ও পরোপকারী, তাঁর কোন স্বার্থ চিন্তা নেই। শুনেছি, সুশান্ত
এখন ঠিকাদারী পেশায় আছে। বহু বছর পার হয়েছে বন্ধু সুশান্তকে আর দেখিনি। সুশান্ত যেখানেই থাকুক মহান আল্লাহপাক তাঁকে ভাল রাখুন, সুখে রাখুন।  
কৃষ্ণবরণ ও মিশুক প্রকৃতির অধ্যাপক অরুণ কুমার পাল এমসি কলেজের গণিত বিভাগের প্রধান ছিলেন। তিনি কাজলশাহ দিঘিরপারে বসবাস করেন। এম সি কলেজে অধ্যয়নকালে মায়াবী চেহারার অরুন কুমার পাল বয়সের তুলনায় বাড়েন নি। তাই তাকে তখন একজন বড় বালকই মনে হত। অধ্যাপক অরুন কুমার পাল সিলেট শিক্ষাবোর্ডে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের দায়িত্ব হতে ২০২৪ সালে অবসর গ্রহণ করেন।
শ্রী সুখময় চক্রবর্তী কানাইঘাটের জাতক, সে খরাদিপাড়ায় আমার কাছে মাসিমা মেসে থেকে পড়ত। আমাকে তাঁর বেডে নিয়ে যেত। তাঁর সাথে আর দেখা হয়নি। একবার শুনেছি, সে সরকারি কলেজের অধ্যাপক হয়েছে। তাঁকে কেমন যেন রুগ্ন মনে হত।
জৈন্তার কৃষ্ণবরণ ওয়ারিসউদ্দিন ও শামসুদ্দিন ছিলেন দারুণ গণিতবাজ। তাঁরা ছিলেন ধার্মিক ও ভদ্র, কোন ঝগড়াঝাটিতে নেই। আমি তাদের কাছে ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে অঙ্ক বুঝে নিতাম। ওয়ারিস উদ্দিন গণিতে এমএসসি করে ইসলামি ব্যাংকে যোগদান করেন। ইসলামি ব্যাংক তালতলা শাখায় গেলেই তাঁর সাথে দেখা হত। কয়েক বছর পর চাকুরী ছেড়ে ওয়ারিস লন্ডনে গিয়ে স্থায়ী হন। তাঁর পুত্র অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় হতে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে বৃটিশ পেট্রোলিয়ামে উচ্চপদে কাজ করছে। ওয়ারিশের বাড়ি রাতারগুল জলাবনের ধারের কোন এক গ্রামে। শুনেছি, শামসুদ্দিন গণিতে মাস্টার্স করে জৈন্তা সরকারি কলেজের গণিত বিভাগ প্রধানের দায়িত্বে আছেন।
মনিপুরী সহপাঠী স্বপন কুমার সিংহ তাতিপাড়া হতে এসে ক্লাস করতেন। তার গ্রামের বাড়ি মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার আদমপুর। স্থুলকায়া ফর্সা ও চীনা চেহারার স্বপনের এসএসসি রেজাল্ট আমার মত হলেও পরে তিনি উপজাতি কোঠায় বুয়েটে সুযোগ পান। তিনি একজন উচ্চপদস্থ সরকারি প্রকৌশলী ছিলেন। তার পত্নী স্ত্রীরোগ বিশেষঞ্জ ডাঃ মিনতী সিনহা কিছুদিন আমার গৃহিণী ডাঃ নূরজাহান চৌধুরীর সহকর্মী ছিলেন। স্বপন কুমার সিংহ বাংলাদেশের হিন্দু ধর্মালম্বী ও উপজাতীয়দের মধ্য থেকে আসা প্রথম প্রধানবিচারপতি এস কে সিনহার শালক।
স্বপন কুমার সিংহ আমাকে একটি মনিপুরি শব্দ শিখান, শব্দটি ‘পামি, পামি’ যার অর্থ ‘ভালোবাসি, ভালোবাসি’। একদিন ডাঃ মিনতির সাথে লালাদিঘিরপারে স্বপনের বাসায় যাই। হাফপ্যান্ট পরা বেশ মোঠাসোঠা ফর্সা একজন চাইনিজ এসে সামনে বসেন। আমি চিনলেও তিনি আমাকে চিনতে সময় নেন। সুন্দর ছিমছাম দুতলা বাসা। তাঁকে মানসিকভাবে যেন বিপর্যস্ত মনে হল। ডাঃ মিনতি বললেন স্বপন হার্টের রোগী, ওপেনহার্ট সার্জারি হয়েছে।
বরইকান্দি এলাকার এনাম আহমদের সাথে নানা কাজে বারবার দেখা হয়। এনামের বয়স বুঝা দায়, মনে হয় এখনো তরুণ। তিনি এখন পপুলার ইন্সুরেন্স কোম্পানির সিলেট অফিসের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা।
চৌকশ সহপাঠি গোলাম রাব্বানী চৌধুরীর বাড়ি গোলাপগঞ্জের বাঘায়। তিনি সশব্দে কথা বলতেন ও বেশ দূর হতে শোনা যেত। প্রত্যুৎপন্নমতি গোলাম রাব্বানী চৌধুরী একজন সফল শিল্প উদ্যোক্তা। নয়াসড়কে তাঁর মামার আলিম ইন্ডাস্ট্রিতে খায়রুল চৌধুরী ও রাব্বানী চৌধুরীর সাথে মাঝেমাঝে দেখা হত। তিনি এখন বারাকাতুল্লাহ পাওয়ার কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ী নেতা। তিনি সিলেটের কুইন্স হাসপাতালের চেয়ারমেনের দায়িত্বে আছেন। রয়েলসিটিসহ সিলেটের অনেকগুলো হোটেল মোটেলে স্কুল ইত্যাদির তিনি উদ্যোক্তা পরিচালক। রাব্বানী চৌধুরীর মামি আমার পত্নীর খালাতো বোন রণকেলি গ্রামের জাতিকা জেবা চৌধুরী।
শান্ত ও সুভদ্র বড়লেখার নিজাম উদ্দিন গণিতে মাস্টার্স করে ‘ওপি-ওয়ান” লটারি জেতে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। তিনি আমার নানাবাড়ি পাতারিয়ার কাটলতলীর জাতক। তাঁর বাড়ির কাছেই মাধবকুন্ড জলপ্রপাতের অবস্থান। প্রবাসী বিএনপি নেতা বারিষ্টার সফিক, শেখঘাটের মুহিত, ভাদেশ্বরের সাহেদ চৌধুরী ও বদরুল এখন লন্ডনে আছেন। কলেজ জীবনে মুহিত ছিলেন খুব মোঠাসোঠা ও কথাবার্তায় হেন্ডসাম। সাহেদ চৌধুরী আমার আত্মীয়। কলেজ জীবনে সাহেদ বেশ ধূমপান করত। একবার তাঁকে আমি ধূমপানে বারণ করলে সে বেশ মাইন্ড করে। সে জবাব দেয়, আমি বিড়ি খাই, না খাই তাতে তোমার কি? সাহেদ ছিল সব সময় হাস্যমান ও চটপটে। শাহেদের কন্যা বৃটেনের চিকিৎসক।
লালাবাজারের ফুটবলার লন্ডনপ্রবাসী মিয়া আশিক লালাবাজারে তার পিতার নামে আব্দুল গফুর হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন। শ্যামলা ও স্মার্ট নিজাম উদ্দিন আজ ব্যবসায়ী ও কানাইঘাটের মেয়র।
শমশেরনগরের সেলিম চৌধুরী, যার দীর্ঘ দেহাবয়বের সাথে ছিল ডিম্বাকৃতির লম্বাটে সুন্দর চেহারা। সুনামগঞ্জ জেলা জুবলি হাইস্কুল হতে তিনি প্রথম বিভাগে এসএসসি পাস করে এমসি কলেজে আসেন। তাকে এমসি কলেজে কখনও গান গাইতে দেখিনি কিন্তু পরবর্তীকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে দেশের একজন শ্রেষ্ট লোকসঙ্গীত শিল্পীতে পরিণত হন। তিনি হুমাউন আহমদের অনেক নাটকে সঙ্গীত পরিবেশন করেন। টিভিতে প্রায়ই তাকে গাইতে দেখতাম- “আঁকাবাঁকা মেঠোপথে কোন সুন্দরী হেঁটে যায়”। সেলিম চৌধুরীর গাওয়া হাসন রাজার একটি গানের ক্যাসেট আমার খুব প্রিয় ছিল। তাঁর গাওয়া হাসনগীতির সেই ক্যাসেট সারাটা বাংলাভাষী দুনিয়ায় ভাইরাল হয়। সিলেট বিভাগের লোকগানে তাঁর অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
সেলিম চৌধুরী খুব মেধাবী ছাত্র ছিলেন এবং এইচএসসিতে প্রথম বিভাগ পান। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে বায়োকেমেস্ট্রিতে অনার্স ও মাস্টার্সে দুটিতেই প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। আমেরিকা বৃটেন কানাডাসহ পৃথিবীর অনেক অনেক দেশে তিনি সঙ্গীত পরিবেশন করেন। দুঃখ হয় আমার এই প্রাণপ্রিয় সহপাঠি চিরকুমারই রয়ে গেছেন। জানিনা, কেন যে এমন হল।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে কোন না কোন ক্ষতির শিকার হননি, এমন মানুষ বাংলাদেশে নেই। সেলিম চৌধুরীও এর ব্যতিক্রম নন। একাত্তুরে বোমার আঘাতে তিনি গুরুতর আহত হন, নিজে কোনমতে বেঁচে গেলেও ছোটবোনকে হারান। বড়বোনের স্বামী ছিলেন মরমি কবি হাসন রাজার প্রপৌত্র সুনামগঞ্জের মেয়র কবি মইনুল মউজদিন। এই বোনও সিলেট ঢাকা মহাসড়কে এক মর্মান্তিক কার দুর্ঘটনায় স্বামীসহ হারিয়ে যান। শিল্পী সেলিম চৌধুরী এখন তাঁর জন্মভূমি শমশেরনগরে একটি দাতব্য হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায় ব্যস্ত আছেন। শত যন্ত্রণা বুকে নিয়েও তিনি শক্ত মনোবল নিয়ে বেঁচে আছেন, মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন।
আমাদের অত্যন্ত মেধাবী সহপাঠী জাভেদ ইকবাল রুমি। তিনি সিলেট সরকারি পাইলট স্কুলের ছাত্র ছিলেন। এসএসসিতে তাঁর প্রাপ্ত নম্বর ৭৫৮ এবং পাঁচ বিষয়ে লেটার মার্ক। ছাত্রজীবনে খুব স্মার্ট, মিশুক ও বুদ্ধিমান ছিলেন। যৌবনে তিনি ছিলেন দীর্ঘকায়া, ফরসা ও ঝাকড়া চুলের অধিকারী সুপুরূষ। তাঁকে কেন্দ্র করে বিরামবেলায় ছাত্রদের হৈচৈয়ের আসর বেশ জমে যেত। তিনি বুয়েট থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। সেখানে তিনি সাইবার নিরাপত্তার কাজে উচ্চপদে আছেন। তাঁর বর্তমান ঠিকানা বোস্টন, ম্যাসাসুসেট। আমি ২০১৬ সালের গ্রীষ্মের হিমেল হাওয়ায় আটলান্টিক পারের সুন্দর শহর বোস্টন গেলেও তাঁর সাথে দেখা হয়নি। রুমি একজন চিন্তাশীল রম্য লেখক। ফেলে আসা বাংলাদেশ তাঁর ভাবনার প্রধান বিষয়। পারিবারিক জীবনে পুত্রকন্যা নিয়ে তিনি প্রবাসে সুখীজীবন পার করছেন।
ডাঃ সৈয়দ ইনসাফ আলীও যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী, তার গ্রামের বাড়ি ছাতকের সৈয়দপুর। তিনি চক্ষুবিশেষঞ্জ সৈয়দ মারুফ আলীর ভাই।
২০১৪ সালে আমার বই সিলেট সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে উপহার দিতে গিয়ে এমসি কলেজের চারজন শিক্ষার্থী ও সহপাঠীকে সেখানে পাই। তারা হলেন উক্ত স্কুলের শিক্ষক শাহ মোঃ আখতারুজ্জামান, জহুর আহমদ, মখলেছুর রহমান ও মইনুল হক। সহপাঠী মখলেছুর রহমান মৌলভীবাজার জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা হন এবং মইনুল হক মৌলভীবাজার জেলা হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক হতে অবসরে যান। সেদিন সিলেট সরকারি পাইলট হাইস্কুলের শিক্ষক মিলনায়তনে উপস্থিত আমার আত্মীয় শিক্ষক গওহরপুরের সাদেক হোসেন চৌধুরী বললেন, আপনাদের ব্যাচের আর একজন টিচার আছেন, তিনি নুসরত হক।
বিসিএস কর্মকর্তা ইকবাল আব্দুল্লাহ হারুন খুবই ভাগ্যবান। তিনি মোহাম্মদ ইউনুস সরকারের আমলে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সচিব পদে পদোন্নতি পান। আমাদের সহপাঠী বন্ধুদের মধ্যে তিনিই পূর্ণ সচিব হবার সৌভাগ্য লাভ করেন। তাকে তো ধন্যবাদ দিতেই হয়।
এমসি কলেজের শিক্ষকতায় আছেন সালাহ উদ্দিন ফয়সল ও তুতিউর রহমান। তুতিউর রহমান এমসি কলেজের অর্থনীতির অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ছিলেন। তুতিউর রহমান একজন ব্যক্তিত্ববান করিতকর্মা লোক। তিনি সদ্য সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে অধ্যপনায় যোগদান করেছেন।
মোঃ নাজমুল ইসলাম চৌধুরী জালালাবাদ গ্যাস লিমিটেডের ডিজিএম পদ থেকে ২০২২ সালে অবসর গ্রহণ করেছেন। পারভেজ আক্তার এনজিও সীমান্তিকে নির্বাহী পদে কর্মরত আছেন। পারভেজ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হতে অর্থনীতিতে আমার সাথে মাস্টার্স করেন। তিনি ও আমি চবি এর মাস্টার্স ২০তম ব্যাচ। রনকেলী দিঘিরপারের রাফেহ চৌধুরী ও ফারেহ চৌধুরী নামে বেঁটে আপন দুইভাই একই ড্রেসপরে ক্লাসে আসতেন। তাদেরে দেখে জোড়ভাই মনে হত। তারা এখন যুক্তরাষ্ট্রের সিটিজেন। খায়রুলের মাধ্যমে জানলাম তাঁরা নাকি এখন সব দুনিয়াদারী কাজ ফেলে তাবলীগ জামাত নিয়ে ব্যস্ত থাকেন।
সুদর্শন ফর্সা ডাঃ শিবলী খান সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হতে এমবিবিএস করে সিলেটের একজন চিকিৎসক। তাঁর বাড়ি বিশ্বনাথের ঐতিহ্যবাহী গ্রাম দশঘর। তিনি বিশ্বনাথে প্র্যাকটিস করেন। ওসমানী মেডিকেল কলেজের প্রাক্তন ছাত্রদের নানা অনুষ্ঠানে দাওয়াত পেলে গিন্নীকে নিয়ে যাই তাঁর প্রিয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, সেখানে ডাঃ শিবলী খান ও ডাঃ উচিত কুমার সিনহার সাথে আমার অনেকবার দেখা হয়।
মনিপুরী বন্ধু ডাঃ উচিত কুমার সিনহা ও ডাঃ আব্দুল মান্নান আমার পত্নীর সাথে বিভিন্ন স্পটে কাজ করেন। তিনি বেশ ভাল গান করেন। তিনি সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে মেডিকেল অফিসার হিসাবে যোগদান করেন। ২০২৪ সালে তিনি গোলাপগঞ্জ উপজেলা হাসপাতালের প্রধান হতে অবসরে যান। ডাঃ আব্দুল মান্নান ও ডাঃ উচিত কুমার সিনহা আমাকে মাঝে মাঝে কৌতুক করে ডাকতেন দোলাভাই। ডাঃ উচিত সিনহা মাঝে মাঝে বলতেন, ওবা দোলাভাই, তুমি খুব ভাগ্যবান, নূরজাহান আফায় রুজি করি তোমারে বেশি বেশি খাওয়াইরা।
ডাঃ আব্দুল মান্নান লম্বা ও ফরসা, লামাবাজারে তাঁর চারতলা বাসা। তিনি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হতে এমবিবিএস পাস করে পরিবার পরিকল্পনা ও মাতৃস্বাস্থ্য বিভাগে মেডিকেল অফিসার পদে যোগদান করেন। ডাঃ আব্দুল মান্নান পরিবার পরিকল্পনা বিভাগ, সিলেট জেলাপ্রধানের পদ থেকে ২০২৪ সালে অবসর গ্রহণ করেন। তিনি খুব বন্ধুবাৎসল মানুষ।
নাজিম উদ্দিন এমসি কলেজের পর সিলেট পলিটেকনিকে ভর্তি হন। তিনি শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকুরি করতেন। সুবিদবাজারের প্রায়ই দেখা হত। তাঁর মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানে আমানুল্লাহ কনভেনশন সেন্টারে আমরা সহপাঠী বন্ধুরা অনেকে যোগ দেই। নাজিম উদ্দিন সদ্য আমেরিকা প্রবাসী হয়েছেন।
২০১৩ সালে
একটা মজার ব্যাপার ঘটে, সিলেট ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ে এমবিএ পড়তে গিয়ে সেখানে  এমসি কলেজ সহপাঠি মোঃ আব্দুল
লতিফকে বানিজ্যিক গণিতের শিক্ষক হিসাবে পাই। আব্দুল লতিফ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা
কমিটির একজন প্রধান হর্তাকর্তা মাথার চুলছাটা হ্যাটপরা কাজলবরণ
আব্দুল লতিফকে চিনতে আমার কোন অসুবিধা হয়নি। এককালের সহপাঠি আজ আমার শিক্ষক।
আমি পরিচয় দিলামনা তাকে, তিনিও চিনলেন না আমাকে। ক্লাস
চলাকালে ব্যাংকের একজন এজিএম হিসাবে আমাকে তিনি আপনি আপনি করেই কথা বলতেন। এভাবে
দুই বছর তার কাছে লেখাপড়া করে পরিচয় গোপন রেখেই একদিন সনদপত্র নিয়ে চলে আসলাম। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ভি সি আমার ফুফুতো ভাই ডঃ সদরুদ্দিন চৌধুরী তাঁকে এখানে নিয়ে আসেন। আব্দুল লতিফ গণিতে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে অধ্যাপক হন। তিনি সিলেটের রাজা ম্যানশনে বই ব্যবসায় নিয়োজিত আছেন।
সরলপ্রাণ গোবিন্দ আজ আয়কর বিভাগে আছেন। সিলেট ও মৌলভীবাজারের আয়কর অফিসে তাঁকে কাজ করতে দেখি। ডাঃ মতিন, ডাঃ আব্দাল মিয়া, ডাঃ মতিউর, ডাঃ আব্দুল মান্নান ও ডাঃ শাহজাজান কবির চৌধুরী স্বাস্থ্যবিভাগে কর্মরত আছেন। রানাপিংয়ের বেঁটে ডাঃ মুজিবুর রহমান ওসমানী মেডিকেল থেকে এমবিবিএস পাশ করে মার্কিন কনে বিয়ে করে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান।
দুগ্ধধবল সদাহাস্য মোঃ মাসুদে রাব্বানী সাউথইস্ট ব্যাংকে আছেন। মাসুদে রাব্বানী ও মোহাম্মদ হোসেন আমার বাড়ির পাশে মনির আহমদ একাডেমিতে কিছুদিন শিক্ষকতা করেন। মুজিবুর রহমান ইবনে সিনা ফার্মাসিউটিক্যালে কর্মরত ছিলেন। পেশাজনিত কাজে আমার পত্নী ডাঃ নূরজাহান বেগমের সাথে মুজিবের বেশ যোগাযোগ ছিল। মুজিবের ছেলে বুয়েটে অধ্যয়ন করছে। মুজিবের সাথে সিলেটে আমার সর্বদা দেখা হত।
এমসি কলেজে আমার রোল নং ১১৭, আগের রোল নং ১১৩ এর দরগাহ ঝর্নারপারের খোকন বৃটেনে এবং রোল নং ১১৫ এর দরগার
পুকুরপারের গৌরাঙ্গ দীর্ঘাঙ্গ
কুমিল্লার সুদর্শন তরুণ রূকনের কোন খোঁজখবর আর পাইনি। 
পিঙল চোখের উজ্জ্বল শ্যামলা দীর্ঘতনু এডভোকেট এহসানুল মাহবুব জোবায়ের তখনই ছাত্রশিবির করতেন। আমাকে শিবিরের মিছিলে নিয়ে যেতে প্রায়ই টানাটানি করতেন। শিক্ষাজীবনে তিনি এই দলে বেশ ভাল অবস্থান তৈরি করেন ও পরবর্তীকালে ইসলামি ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি হন। কুলাউড়ার উপজেলার সন্তান এহসানুল মাহবুব জোবায়ের এখন জামায়েতে ইসলামির একজন প্রভাবশালী কেন্দ্রীয় নেতা। ব্যক্তিজীবনে তিনি খুব বিনয়ী ও নম্রভদ্র মানুষ।
১৮ আগস্ট ২০২৫, সিলেট প্রিন্সিপাল অফিসে হৃদয়ের টানে আমাকে দেখতে আসেন সহপাঠী বন্ধু বিনয় ভূষণ রায়। এম সি কলেজ ও পলিটেকনিকে আমরা দুই বন্ধু পাঁচ বছর সহপাঠী ছিলাম। তিনি জয়েন করেন বাংলাদেশ ব্যাংকে, আর আমার ঠাঁই হয় পুবালী ব্যাংক পাড়ায়। বাংলাদেশ ব্যাংক, সিলেট, গেলেই দেখা হত। তিনি বাসা গড়েন মেজরটিলায়। বিনয় এক ছেলে ও দুই মেয়ের বাবা। দুই মেয়েই চিকিৎসক। এক কন্যা সেনাবাহিনীতে চিকিৎসক পদে যোগদান করেছেন। এই মেয়ের স্বামী বিসিএস চিকিৎসক। বিয়েতে অফিসে এসে আমন্ত্রণ জানান, কিন্তু যাওয়া হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিপুটি ডায়রেক্টার পদ থেকে তিনি ২০২৩ সালে অবসর গ্রহণ করেন।
এ সেকশনের একমাত্র ছাত্রী ছিলেন নুসরাত হক। কিন্তু একা হওয়ায় এ সেকশনে তাঁর মন বসেনি। কিছুদিন ক্লাস করে চলে যান বি সেকশনে। ছাত্রীরা ছিলেন কেবলমাত্র বি সেকশনে। আয়শা আক্তার, নুসরাত হক, রাফেজা বেগম হেমা, শোকরানা বেগম, তাবাসসুম ফেরদৌস নীতা, মুনিরা বেগম, জাহানারা বেগম প্রমুখের নাম মনে পড়ে। সেই সময়ের সিলেটের জেলা প্রশাসকের কন্যাও আমাদের সহপাঠিনী ছিল। তারা ছাত্রী মিলনায়তনে অবস্থান করত এবং টিচারদের সাথে ক্লাশে প্রবেশ করত। সামনের বেঞ্চ তাদের জন্য বরাদ্ধ ছিল। এই মেয়েদের বেশিরভাগ এখন বিদেশে আছেন। নুসরাত হক দক্ষিণসুরমা সরকারি উচ্চবিদ্যালয়, আলমপুর, সিলেট, এর প্রধানশিক্ষিকা পদ হতে ২০২৪ সালে অবসর গ্রহণ করেন।
ডাঃ তাবাসসুম ফেরদৌস নীতা সিলেট সরকারি মেডিকেল কলেজে আমার পত্নী ডাঃ নূরজাহান বেগম চৌধুরীর সহপাঠিনী ছিলেন। ডাঃ আলী আরশাদ সুইট নীতার স্বামী। সুইট ভাই সিলেট ওসমানি মেডিকেল কলেজে ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। পরবর্তীকালে তিনি সিলেট জেলা ও কেন্দ্রীয় ছাত্র ইউনিয়নের নেতা হন। তাবাসসুম ফেরদৌস নীতা ভাল গান গাইতেন। গোপী সরকারের লেখা পরে জানতে পারি নীতা একজন পরোপকারী উদার মনের মানবী ছিলেন। তাবাসসুম ফেরদৌস নীতা দম্পতি এখন অস্ট্রেলিয়ায় জীবনের তরী বেয়ে যাচ্ছেন।
৭ই মার্চ ২০২৪। ফেসবুকে খবর পাই প্রিয় বন্ধু হোসেন আহমদ সবুর নেই। তিনি আজ পরপারের বাসিন্দা। তিনি এম সি কলেজ এইচ এস সি (বিজ্ঞান) ১৯৮৩ ব্যাচের সহপাঠি। এই সিলেট শহরে আমরা যে কজন সহপাঠি বসবাস করি, তাঁদের মধ্যে দেখাশুনা হয় প্রায়ই। আমি পূবালী ব্যাংক প্রিন্সিপাল অফিস সিলেটে ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২ তারিখে যোগদান করামাত্রই আমাকে দেখতে অফিসে ছুটে আসেন। তাঁর বুক ছিল মায়ামমতায় ভরা। তখন স্ত্রীর ডাইলাইসিস নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় ছিলেন। চিকিৎসার যোগান দিতে তিনি প্রায় সর্বশান্ত, অথচ তাঁর ছিল অসাধারণ সহ্য গুণ। সব দুঃখ কষ্ট অবলীলায় সয়ে গেছেন জীবনের শেষপ্রান্তে। ছোট্ট একটা সরকারি চাকুরী নিয়ে সৎভাবে জীবন পার করেছেন। ছিলেন ধার্মিক ও নিঃস্বার্থ পরোপকারী একজন মানুষ। সেদিন বাদজোহর শাহজালালের(রঃ) দরগাহ মসজিদে তাঁর কফিনের সামনে দাঁড়াতেই দুচোখ সজল হয়ে যায়। এহসানুল মাহবুব জুবায়ের, খায়রুল আক্তারসহ আমরা বেশ কয়েকজন বন্ধু তাঁর জানাজায় শরিক হয়। দুই বছর আগে তাঁর পত্নীর জানাজায় শরিক হয়েছিলাম। মহান আল্লাহ তাকে জান্নাত দান করুন আমিন।
এম সি কলেজে আমার একজন প্রিয় সহপাঠী ছিলেন হেতিমগঞ্জের ওলিঊর রহমান। আমি প্রায়ই তাঁর পাশে বসতাম। আমার বাড়ি থেকে ওলিউরের বাড়ির দূরত্ব মাত্র দুই মাইল। তাঁর বাবা সিলেটের ডিসি অফিসে চাকুরী করতেন। বুদ্ধিমান পিতা সন্তানকে গ্রামের স্কুলের বদলে এইডেড হাইস্কুলে ভর্তি করে দেন। ওলিউর বাবার সাথে হেতিমগঞ্জ হতে সিলেটে আসা যাওয়া করে হাইস্কুলের পাঠ সমাপ্ত করে এম সি কলেজ এইচ এস সি ১৯৮৩ ব্যাচের সদস্য হন। ওলিঊর সহজ সরল বিনয়ী মানুষ। তিনি লেখাপড়ায় মনোযুগী, এককথায় জীবনের প্রতি কমিটেড ও সিরিয়াস।
ওলিউর রহমান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হতে অর্থনীতিতে অনার্স ও মাস্টার্স করে গোলাপগঞ্জ এম সি একাডেমিতে শিক্ষকতায় যোগ দেন। তারপর কিছুদিন জালালাবাদ গ্যাস কোম্পানিতে একাউন্টেন্ট পদে চাকুরী করেন। ১৯৯৪ সালে আমেরিকায় চলে যান। ওলিউরের বর্তমান ঠিকানা ডেট্রয়েট, মিশিগান। আমি দুইবার এই লেক শহরে যাই, কিন্ত জানতে পারিনি বন্ধু ওলিউর এই শহরে আছেন। আহারে পুড়া কপাল, তাই দেখা হলনা। তাঁর সাথে না দেখার হয়ে গেছে বিয়াল্লিশ বছর। ওলিউরকে আল্লাহপাক সুখে রাখুন, সুস্থ্য রাখুন।
আমার আমেরিকা প্রবাসী ভাগ্যবান সহপাঠী বন্ধু দেলোয়ার হাসান। গ্রামের বাড়ি বিয়ানীবাজার। দেলোয়ার হাসান খানিক বেঁটে বুদ্ধিমান ও কঠোর পরিশ্রমী লোক। তাঁর বন্ধুবাৎসল্য প্রশংসনীয়। বাংলাদেশে এলেই তিনি আমাদেরকে জমায়েত করেন। শুনেছি নিউইয়র্কে তাঁর দামি বাড়ি ও পাঁচটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সিলেট শহরে বিশাল বহুতল ভবন নির্মাণ করেছেন। গত বছর তাঁর ভবনের ছাদবাগানে আমরা সহপাঠীদেরে নিয়ে মজার বারবিকিউ আয়োজন করেন। তিন তিনবার নিউইয়র্ক গেলাম, ভাগ্যে নেই, তাই দেলোয়ার হাসানের সনে দেখা হলো না আমার। বন্ধু এমাদ সাদিকও নিউইর্কের বাসিন্দা।
বন্ধু ফনীভূষণ সরকার সিলেটে আছেন। তিনি পলিটেকনিক পেরিয়ে এসে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে সরকারি চাকুরি নেন। ২০২৩ সালে সিলেট সিভিল সার্জন অফিস হতে অবসরে যান। তাঁর কন্যা সিলেট মেডিকেল কলেজে ও পুত্র বুয়েটে অধ্যয়ন করছে। তাঁর পত্নী শিক্ষিকা ছিলেন। ফণীর সাথে সর্বদা দেখা হয়।
সহপাঠী বন্ধু ইকবাল লতিফ দক্ষিণসুরমার লাউয়াই গ্রামের ঐতিহ্যবাহী দালানবাড়ির সন্তান। রাজা জি সি হাইস্কুল থেকে তিনি এম সি কলেজে যান। পরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হতে পরিসংখ্যানে অনার্স ও মাস্টার্স সমাপ্ত করে বিলাতে চলে যান। সেখানে তিনি ব্যবসার সাথে জড়িত আছেন এবং বেতার বাংলার জনপ্রিয় রেডিও প্রেজেন্টার। তার বড় ছেলে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় হতে উচ্চশিক্ষা নিয়ে বৃটিশ সরকারের সিভিল সার্ভিসে চাকুরী করছেন। বাকি সন্তানরা সবাই গ্রেজুয়েট। মোহাম্মদ আব্দুল লতিফের সাথে আমার শেষ দেখা হয় লন্ডনে ফেব্রুয়ারি ২০২৫ সালে। আমি লন্ডনে পৌঁছামাত্রই বন্ধু ইকবাল লতিফ, বন্ধু গোলাম রাব্বানী চৌধুরী ও চবি সহপাঠী বন্ধু সিদ্দিক নির্ঝর আমার মায়ার টানে ছুটে আসেন ড্রেগেনহামে ভাই তাহমিদ চৌধুরীর বাসায়।
মোহাম্মদ শহিদ আহমদ ইসলামী ব্যাংকে উচ্চপদে আছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের জরুরি মিটিংসমূহে তাঁর সাথে প্রায়ই দেখা হয়। তিনি থাকেন দরগাগেইট। ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫ তারিখে তিনি অবসরে যাবেন। কাজি মোহাম্মদ সাজিদ আলী জকিগঞ্জের জাতক। আমাদের ব্যাচের জকিগঞ্জী ছেলেদের মধ্যে তিনি ছিলেন শ্রেষ্ঠ মেধাবী। তিনি চবি হতে পদার্থবিজ্ঞানে অনার্স ও মাস্টার্স করে আমেরিকান কোম্পানি সেভরনে যোগদান করেন। তিনি সিলেটের ভেলিসিটির বাসিন্দা। তাঁর বাচ্চারা সবাই উচ্চশিক্ষিত।
আমাদের একজন প্রিয় বন্ধু মোহাম্মদ কামরুজ্জামান। তাঁর ডাকনাম তুতু। তিনি উদ্ভিদবিজ্ঞানে অনার্স ও মাস্টার্স করে চাবাগানে চাকুরী নেন। সিলেটে শহরের পাশে বড়জান চাবাগানে তিনি ব্যবস্থাপকের দায়িত্বে আছেন। তাঁর সুরম্য বাংলোতে আমরা প্রায়ই বেড়াতে যাই। আমার পত্নী ডাঃ নুরজাহান বেগম চৌধুরী ও পুত্র ডাঃ জেফারকে নিয়ে কোন এক শুক্রবারে তাঁর উদ্যানময় বাংলো সফর করি। তিনি ও তাঁর পত্নীর আতিথেয়তায় আমরা বিমুগ্ধ হই। হাতের তৈরি নানাপদের পিঠা পায়েসে টেবিল ভরে যায়। তাঁর পত্নীর বাড়ি কানিহাটি, তিনি আমার বৃটেন প্রবাসী ভাগ্নী রায়হানা বেগম চৌধুরী চুন্নির সহপাঠিনী। আমরা আসার সময় পিঠার একটা থলি গাড়িতে তুলে দেন।
কামরুজ্জামানকে আমাদের সবকটি বন্ধুসভায় হাজির হন। তাঁর বাসার আলমিরা মেডেলে মেডেলে ভরে আছে। বেশ কিছু শিল্পকর্ম ওয়ালের শোভাবর্ধন করছে। তাঁর বড় মেয়ে কিশোরগজ্ঞ সরকারি মেডিকেল কলেজে এমবিবিএস অধ্যয়ন করছেন। আমাদের সবার চাকুরির অবসরের সময় নির্ধারিত হলেও তাঁর চাকুরির বয়স সীমাবদ্ধ নয়। মহান আল্লাহ পাক তাঁকে সুস্থ্য শরীরে রাখুন যাতে তিনি সুদীর্ঘকাল বাগান ম্যানেজার পদে বহাল থাকেন এবং আমরা যেন তাঁর বাংলোর অতিথি হবার সুযোগ পেয়ে ধন্য হই।
সালেহ আহমদ মসুফ একজন ভাবপ্রবণ কবি ও গায়ক। ছাত্রজীবনে ছিলেন কুঁকড়ানো চুলের অধিকারী ফরসা সুপুরুষ। তাঁর বাড়ি মৌলভীবাজার শহরে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে লন্ডনে চলে যান। তিনি ছিলেন একজন উদার মনের মানুষ, সালেহ মসুফ ২০২৪ সালে ঊনষাট বছর বয়সে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে বৃটেনে মারা যান। বড়ভাই তাহমিদ চৌধুরীকে নিয়ে আমি ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে লন্ডনের পিস অব হেভেন গোরস্থানে তাঁর কবর জেয়ারত করি।
সহপাঠী বন্ধু ডাঃ আবি লস্কর একজন স্কয়ার মানব, যেমন সুদর্শন তেমন মেধাবী। যেমন ফর্সা, তেমন মায়াবী চেহারা। বহু বছর পেরিয়ে করোনার সময় একজন মহামারী পরামর্শক হিসাবে তাকে আমরা আবিস্কার করি তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত লেখামালায়। আবি লস্কর সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হতে এমবিবিএস পাস করে উচ্চশিক্ষা নিতে বিলাতে চলে যান। আর দেশে ফেরে আসেননি। তিনি বৃটিশ স্বাস্থ্য বিভাগে চিকিৎসক হিসাবে কর্মজীবন পার করছেন। তিনি একজন কবি, লেখক এবং শৌখিন পর্যটক। ইজরায়েল ও জর্ডান ভ্রমণ করে তিনি বেশ মূল্যবান এক সফরনামা লেখেন।
কাজি শামসুল হুদা সুহেল আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলো। এম সি কলেজে তাঁর পাশে বসতাম, একসাথে ঈদগাহ রোডে হেঁটে হেঁটে বাসা ফিরতাম, কলেজ হোস্টেলে তাঁর কক্ষে মাঝে মাঝে বসে আড্ডা দিতাম। এম সি কলেজ শেষে আর তিন বছর আমরা প্রিয় সহপাঠী ছিলাম। সুহেল আমার মত সিবিল ইঞ্জিনিয়ার হয়। কাজি শামসুল হুদা সুহেল এখন জগন্নাথপুরের ভূমিকর অফিসের কর্মকর্তা। ফেসবুকের সুবাদে বছর দুয়েক আগে তাঁকে আবার ফিরে পাই।
গোপেন দেবকে আমি জানতাম একজন উদারমনের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হিসাবে। তিনি হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং উপজেলার মার্কুলীর জাতক। এমসি কলেজ পেরিয়া তিনি ইলেকট্রিক্যাল টেকনোলজীতে সিলেট পলিটেকনিকের ডিগ্রি নেন। লেখালেখি ও সাংবাদিকতায় তাঁর বেশ নামযশ ছিল। তিনি দৈনিক সিলেটের ডাক পত্রিকায় কিছুদিন কাজ করেন। সিলেট বেতারেও তিনি নানা অনুষ্ঠান করতেন। গোপেন দেব একসময় জন্মভুমির মায়া ছেড়ে কানাডায় চলে যান।
নকুল দে ছিলেন গোপেন দেবের অন্তরঙ্গ বন্ধু, তাঁরা দুজনের ছিল গলায় গলায় ভাব। সিলেট শহরের চালিবন্দরে নকুলের পৈত্রিক ব্যবসা ছিল একটি ফটো স্টুডিও। একদিন তাঁর স্টুডিওতে ফটো তুলতে যাই। দোকানের সামনের বারান্দার দুইদিকে দুইটি সিংহমুর্তি আরামছে বসে আছে। এম সি কলেজের পর নকুল দেরও ঠিকানা হয় সিলেট পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট। গোপেন ও নকুল, এই দুইবন্ধু আজ কানাডায় সুপ্রতিষ্ঠিত। তাঁরা আমাদেরও প্রিয় বন্ধু, লোকমুখে শুনেছি, এই বন্ধুযোগল সেখানে ভাল আছেন, সুখে আছেন। নকুল দে এখন টরোন্টোর বাসিন্দা। ২০১৬ সালের গ্রীষ্মকালে আমি টরোন্ট সফর করি।নকুলের ফোন নম্বর ছিলো না যে যোগাযোগ করি।
বন্ধু গোপেন দেব আমার এই লেখা পড়ে বেশ মর্মস্পর্শী ভাষায় প্রতিক্রিয়া জানান। তাঁর সেই হৃদয় নিংড়ানো প্রতিক্রিয়া আমার এই আত্মজীবনীতে ঢুকিয়ে দিলাম।
বন্ধু ইসফাক,
প্রথমেই কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি অনেকগুলো বছর পরও তুমি আমাদের কথা মনে রেখেছো। এই স্মৃতিশক্তি ও ধৈর্য্য ধরে নির্মোহ ভাবে পুরনো দিনের কথা লিখে যাচ্ছো, যা প্রশংসার দাবি রাখে। আমি তোমাকে দূর এবং কাছে থেকেও দেখেছি- এমন অমায়িক, ভদ্র, হাসিখুশি সহৃদয়বান মানুষ বর্তমান এই অস্থির সমাজে এখন খুব বেশি নেই। তুমি আমাদের আদর্শ। আমাদের সম্পর্কে তোমার ধারাবাহিক লেখা এই স্মৃতিচারণ ও পরিচিতি বহুদিন না দেখা ও না কথায় বিচ্ছিন্ন ও বিবর্ণ সম্পর্কটা আবার আমাদের মজবুত হচ্ছে।
যা হোক, আমার সম্পর্কে লেখার অংশে একটু সংশোধন ও সংযোজন করলে ভাল হয়, যদি সম্ভব হয়। আমার মূল বাড়ি মৌলভীবাজার নয়। যদিও মৌলভীবাজার শহর ও জেলার সহপাঠীদের সাথে কলেজে ও হোস্টেলে সবচেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠতা ছিল আমার। মৌলভীবাজার শহরের শান্তিবাগ আমার বউয়ের বাড়ি, মানে আমার শ্বশুরবাড়ি মৌলভীবাজার- হা হা হা। আমার জন্মস্থান ও মূল বাড়ি হবিগঞ্জ জেলার একসময়ের প্রসিদ্ধ নৌবন্দর ও ব্যবসাকেন্দ্র মার্কুলী বাজার।
তবে চার দশকের বেশি কাল যাবত সিলেট শহর আমাদের বর্তমান ঠিকানা। সিলেটের শিবগঞ্জ খরাদিপাড়ায় আমাদের নিজস্ব বাড়ি। যদিও শুধু তিন ভাইয়ের মধ্যে সব ছোটভাই তাঁর বউ, সন্তান নিয়ে সেখানে বসবাস করছে। আমি কানাডায় আরামার ইমিডিয়েট ছোটভাই যে দেশে পুলিশ অফিসার ছিল সে সপরিবারে আমেরিকার নিউইয়র্ক থাকে। আমি বউ, এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে মন্ট্রিয়লে, আর আমাদের সহপাঠী নকুলও বউ, এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে টরন্টোতে আছে।প্রবাসের ব্যস্ত জীবনে সুযোগ হয়না সবার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখার।নকুলের সাথে মাঝে মাঝে যোগাযোগ হয়, সে ভাল আছে।
আমি সিলেট বিভাগের সবচেয়ে জনপ্রিয় বহুল প্রকাশিত সিলেটের ডাক পত্রিকায় কানাডা আসার পূর্বদিন পর্যন্ত প্রথমে স্টাফ রিপোর্টার ও পরে সিনিয়র সাব এডিটর ছিলাম। দেশে থাকাকালীন আমার বহু সংবাদ, প্রতিবেদন, কলাম ও অন্যান্য লেখা স্থানীয় ও জাতীয় দৈনিক ও ম্যাগাজিনে ছাপা হয়েছে।
সিলেটের ডাকে ছাপা হওয়া আমার একতি বিশেষ সংবাদ প্রতিবেদন তখনকার সময়ে জাতীয় সংসদে রেফারেন্স হিসাবে আলোচিত হয়। তুমি প্রয়োজনে সিলেটের ডাকের বার্তা বিভাগের পুরানো স্টাফদের কাছ থেকে এবিষয়ে জানতে পারবে। প্রধান বার্তা সম্পাদক এনামুল হক জুবের ভাইকে জিজ্ঞেস করতে পারো।
আমি তখনকার রেডিও বাংলাদেশ, সিলেট কেন্দ্রের তালিকাভূক্ত নাটক ও একাংকিকা লেখক ও অভিনয় শিল্পী ছিলাম। পাশাপাশি আমি তখন কিছুদিন এই কেন্দ্র থেকে প্রচারিত জেলা সাংস্কৃতিক সংবাদ মাসিক অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচার করতাম। সিলেট প্রেসক্লাবের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্যও ছিলাম।
দেশ ছেড়ে পরবাসী হয়েছি প্রায় তিরিশ বছর। এখনো দেশে গেলে সিলেটের ডাক, সিলেট প্রেসক্লাব ও সিনিয়র, জুনিয়র, সমসাময়িক সকল পর্যায়ের সিলেটের সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক বন্ধুদের যে আপ্যায়ন, আন্তরিকতা পাই তা ভোলার নয়। ভোলার নয় এমসি কলেজের সহপাঠীদের আন্তরিক ভালবাসার কথা। গেলবার দেশে যাবার পর তোমরা যে আতিথেয়তা ও ভালবাসা দেখিয়েছো তা আমার চিরদিন মনে থাকবে। সহপাঠী বন্ধুরা যে কী রকম প্রাণের সাথী তা যত দিন যায় অনুভব করি, নস্টালজিক হই।
বন্ধু ইসফাক, তোমার দেয়া বইটি আমি সময় পেলেই উল্টাই। দেখি কী মায়া নিয়ে জীবনচরিতটি লিখেছো। মুগ্ধ হই। খায়রুল, রাব্বানী, নুসরাত, তুতিউর, অরুণ, তুমিসহ অন্য বন্ধুরা সিলেটে আমাকে নিয়ে যে মিলনমেলা আর আড্ডার আয়োজন করেছিলে- এর ঋণ আমি কখনোই শোধ করতে পারবনা বন্ধু। তোমরা আসলেই মহান। ভালো থেকো।
আর হ্যাঁ, আমার সম্পর্কে উপরে যা উদৃত করেছি সেটি আমাদের মধ্যকার জানাশোনার বিষয়টা যে নিবিড়- শুধু এই ধারণা দেয়ার জন্য। ধন্যবাদ আবারও বন্ধু। মন্ট্রিয়লে স্থায়ী হবার পর কানাডা ও আমেরিকা থেকে প্রকাশিত পত্রিকায় আমার লেখা নিয়মিত প্রকাশিত হয়। কানাডার নানা খবরাখবর নিয়ে দৈনিক প্রথম আলোতে লিখি সময় করে। যদিও এখন সংসার ও কাজের ব্যস্ততায় লেখালেখি এখন নিয়মিত চালিয়ে যাওয়া যাচ্ছেনা।
ইতি, গোপেন দেব, মন্ট্রিয়েল, কুইবেক, কানাডা, ২৬ আগস্ট ২০২৫
প্রিন্সিপাল হাবিবুর রহমান হাবিব একজন সৎ ধার্মিক সুন্নতি মানুষ। তার বাড়ি ওসমানীনগর উপজেলায়। তিনি অধ্যপনায় জীবন কাটান। বিয়ানীবাজার সরকারি কলেজের প্রিন্সিপাল পদ থেকে ২০২৩ সালে অবসর গ্রহণ করেন। তাঁকে গার্ড অফ অনারের মাধ্যমে বিদায় সম্বর্ধনায় সালাম জানানো হয়। তিনি মধুর কন্ঠে কুরান তেলাওত করেন। তাঁর বড় কন্যা সিলেট আলিয়া মাদ্রাসায় পড়ছে।
ডঃ আবু সাকের মুরাদুজ্জামান, বৈঞ্জানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট। তিনি ফেঞ্ছুগঞ্জ সারকারখানা স্কুলের ছাত্র ছিলেন। এম সি কলেজের পর তিনি ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেন। বর্তমানে তিনি অবসরে আছেন। তাঁর স্থায়ী নিবাস উত্তরা, ঢাকা। মুরাদের বড়কন্যা আমেরিকায় পিএইচডি করছে।
শামসুর রহমান চৌধুরী টুকু, নবাব আলী আমজদ স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষক ছিলেন। তিনি ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরে অবসর গ্রহণ করেন। অধ্যাপক বিজয় কৃষ্ণ দেব, বালাগঞ্জ সরকারি কলেজের সিনিয়র অধ্যাপক থেকে আগস্ট ২০২৪ এ অবসরে যান। ফেরদৌস আহমদ চৌধুরীর বাড়ি ছাতক, তিনি ছাতক কলেজের অধ্যাপক।
শফিকুর রহমান চৌধুরী শামিম আছেন আমেরিকার মিশিগানে। তিনি গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক পিএলসির একজন পরিচালক। দেশে এলেই আমাদের সাথে তাঁর দেখা হয়। জাহাঙ্গির আলম যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানে আছেন। তিনি দেশে এলে দুইবার দেখা হয়। ইকবাল হাসান নিউইয়র্কের একজন সফল ব্যবসায়ী।
মোহাম্মদ বেলাল উদ্দিন, হাইস্কুল শিক্ষক। তিনি গোলাপগঞ্জের জাতক। বিয়ানীবাজার উপজেলার কোন একটি উচ্চবিদ্যালয়ের টিচার তিনি। তাঁর লেখালেখির হাত আছে। জুয়েল আহমদ, লন্ডন প্রবাসী, বাড়ি গোলাপগঞ্জ উপজেলা। তিনি বেশ ভাল স্মৃতিকথা লিখেন। আমি তাঁর একজন পাঠক।
সুদর্শন ডাঃ জাকির হোসেনের বাড়ি ফেন্সুগঞ্জ। তিনি ওসমানী মেডিকেল কলেজে পড়েন। তিনি ফেন্সুগঞ্জ বাজারে রুগি দেখে দেখে নিভৃতে জীবন পার করে দেন। ২০২৪ সালে পপুলার ডায়াগনেস্টিকের ম্যানেজার সিরাজ উদ্দিনের চেম্বারে তাঁর সাথে দেখা হয়। বিজিত রঞ্জন বৈদ গণিতের অধ্যাপক। লেখাপড়া করেছেন এম সি কলেজ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। তিনি জগন্নাথপুর উপজেলার জাতক।
মাহবুব আলম ভূঁইয়া, এমদাদ সাদিক, মোঃ সফিকুর রহমান বেলাল, কিরণ বনিক সরকার, ফজলুল হক রিপন, মোঃ ফজলুর রহমান, মোস্তাক আহমদ, প্রকৌশলী রুহুল আলম খান, নুর উদ্দিন, মিহির ধর চৌধুরী, মোঃ মাহবুবুর রহিম আক্তার, সিরাজুল চৌধুরী সাবের, প্রশান্ত কুমার দাস, সৈয়দ নুরুজ্জামান, এ বি এম আজাদ, জাহেদ নেওয়াজ, কালিপদ আচার্যি, বৃটেন প্রবাসী রওনক শাহরিয়ার, আব্দুল চৌধুরী, তাহমিদ চৌধুরী, আব্দুস শহিদ, জাহিদ চৌধুরী, আব্দুল মান্নান প্রমুখের নাম ও চেহারা মনে আছে কিন্তু তাঁদের তেমন কোন নির্ভরযোগ্য তথ্য পাইনি।
মোঃ সমুজ উদ্দিন, কালীঘাটে ব্যবসা করেন। তাঁর পুত্র চিকিৎসক। তিনি কলেজে সবসময় একটি ছাতি হাতে রাখতেন। কলেজে ছাত্রদের কাছে তাঁর আর এক নাম হয়ে যায় ছাত্তি সমুজ।
গোপী সরকার, একজন তীক্ষ্ণ স্মরণশক্তিধর লেখক। তিনি অতীতের অনেক কাহিনী হুবহু লিখে ফেলতে পারেন। তাঁর বয়স বুঝা যায়না। এখনো মনে হয় তরুণ বয়সে আছেন। তিনি আমার বাসার কাছে বাঘবাড়ির বাসিন্দা।
শিপার আহমদ লন্ডনে বসবাস করেন। প্রতি বছর দেশে আসেন। প্রতি বছরই দেখা হয়। মোঃ খালেদুজ্জামান খুব হাসিখুশি লোক। তাঁর গ্রামের বাড়ি আমার গ্রামের ধারে লক্ষিপাশায়, তাঁর বাসাও আমার সন্নিকটে বাঘবাড়ি।
পিডিশন প্রধান আমাদের একমাত্র খাসিয়া সহপাঠী বন্ধু। চৈনিক চেহারা, হলুদ গাত্রবর্ণ, চীনাদের মত সোজা চুল তাঁকে আমাদের মধ্যে আলাদা এক সৌন্দর্য ও বৈচিত্রতা দান করে। তিনি কমলগঞ্জ এলাকার কোন এক খাসিয়াপুঞ্জি প্রধানের পুত্র, দেখতেও যেন রাজপুত্র। সবার জন্য খুব মায়া বক্ষে ধারন করে আছেন তিনি। আমাদেরে দেখতে প্রায়ই সুদূর শ্রীমংল হতে সিলেটে ছুটে আসেন সিলেটে। একজন উচ্চশিক্ষিত মানুষ হিসাবে তিনি নিজ সম্প্রদায়ের অবহেলিত লোকজনের অধিকার সুরক্ষায় কাজ করে যাচ্ছেন।
ভিন্ন ভিন্ন হাইস্কুল হতে আসা ছাত্ররা আলাদা আলাদা দলবেঁধে কলেজে বিচরণ করত। সিলেট সরকারি পাইলট স্কুল, ফেন্সুগঞ্জ সারকারখানা স্কুল, গোলাপগঞ্জ মোহাম্মদ চৌধুরী একাডেমি, সুনামগঞ্জ জেলাস্কুল, মৌলভীবাজার জেলাস্কুলের ছাত্রদের উপদলগুলো বেশ বড় ছিল। আমি মোগলাবাজার রেবতী রমন উচ্চবিদ্যালয় হতে আসা একমাত্র তালগাছ। আমার কোন দল কিংবা উপদল নেই। তাই সবাই ছিল আমার কুড়িয়ে পাওয়া বন্ধুর দল।
কলেজে অধ্যয়নকালে একদিন প্রিন্সিপাল গোলাম রসুলের পিতা মারা যান। আমরা কলেজবাসে এসে নয়াসড়ক জামে মসজিদে তার জানাজায় শরিক হই। মানিকপীরের টিলায় তাকে দাফন করা হয়। এই প্রথম আমি মানিকপীরের টিলার চূড়ার মাজারে আরোহন করি। এখান থেকে অনেক নিচের সিলেট শহরটিকে অপূর্ব শ্যামল এক নিসর্গ জনপদ মনে হল।
এবার আপনাদেরকে এম সি কলেজ জীবনে আমার বসত খরাদিপাড়ার গল্প শুনাব। ১৯৭৭ সালে গ্রামের চেয়ারম্যান ভোটের খরচ জোগাতে আমাদের তের চৌদ্দটি গরু বিক্রি হয় ও অনেক ঋণের বুঝা জন্ম হয়। আমাদের জমি বর্গাচাষে চলে যায়। বড়ভাই তাহমিদ চৌধুরী মদন মোহন কলেজ সিলেটে গ্রাম হতে প্রতিদিন আসা যাওয়া শুরু করেন। বোন সেহার বিয়েতে জমি বিক্রি করা কিছু দুষ্টলোকের কারণে অসম্ভব হয়ে পড়ে। তারা বলত এজমালি সম্পত্তি কেউ কিনলে এতে তাদের স্বত্ব দাবী করবে ও দেখে নেবে। আমার বাপচাচাদের মধ্যে কোন বাটুরানামা না থাকায় তাদের হুমকিতে ক্রেতারা ভয়ে সরে যেত। কালু চাচার একমাত্র পুত্র আলালের ঘরের দুলাল মতিভাইয়ের পৃথিবীতে কোন কিছু করে টিকে থাকার কোন যোগ্যতা ছিলনা। সংসার চালাতে তিনি অনবরত জমি বিক্রি করে বিশাল সম্পত্তি বিনাশ করেন।
আমাদের প্রচুর জমিজামা ছিল। এবার এই জমির উপর নব্যধনী কিছু লোভী লন্ডনি দুষ্টলোকের কুদৃষ্টি পড়ে। এই লোভী রাক্ষসের দল আমাদের কিছু রক্তসম্পর্কীয় লোকের গোপন সহায়তায় আমাদের চৌদ্দপনের বিঘা দু’ফসলা মূল্যবান জমি ফুফুতো রেজা ভাইয়ের জাল সহিতে দলিল তৈরি করে দখল করে নেয়।
আব্বা
সফিকুর রহমান চৌধুরী আমাদের বংশের প্রতিষ্ঠিত
মসজিদ ও মাদ্রাসার প্রায় কমিটিতে চৌধুরী বংশের নেতৃত্ব দিতেন। কিছুলোক নানা সুযোগ
সুবিধা নিতে কমিটিতে ঢুকতো, তারা নানান
ব্যক্তিস্বার্থ আদায় ও চৌধুরী বংশের প্রভাব প্রতিপত্তি খর্ব করতে সচেষ্ট থাকতো। এই
চৌধুরী বংশের লোকজন দেশবিদেশে চলে গেলে এই পরিবারের বয়স্ক সুযোগ্য ব্যক্তি আমার
পিতা সফিকুর রহমান চৌধুরী তাদের টার্গেটে পরিণত
হন। এরা মতি ভাইয়ের জমিজামা বিনাশের ক্রিয়াকলাপে সহায়তা করে নিজেদের আখের গুছাতো।
তারা মনে করত, চৌধুরী বংশের সফিকুর রহমান চৌধুরীকে শুন্য করে দিতে পারলে এই বংশের নামগন্ধ দুনিয়া থেকে দ্রুত নিঃশেষ হয়ে যাবে। আর অন্যদেরকে তারা তেমন হিসাবযোগ্য লোক মনে করতনা।   
পৃথিবীতে
দুই ধরনের লোক থাকে একদল সৃজনশীল, যাদের হাতে জ্ঞান, ধনসম্পদ ও মানসম্মান সৃষ্টি
হয়। আরেক দল এর বিপরীত, তারা ধ্বংসশীল- এদের হাতে ধনসম্পদ মানমর্যাদা সব ধ্বংস হয়ে
যায়। মতিভাইয়ের ভাগে আমার চিরকুমার মখলিস চাচার সম্পদও ছিল কিন্তু এই জমিজামার
সিংহভাগ খুব অল্প সময়ের মধ্যে গায়ের পেটুক লন্ডনিদের
পেটে চলে যায়। যে যেমনে পারে তলেতলে
মতি ভাইকে হাত করে ষোলআনা সুবিধা নেয় এবং মতিভাইয়ের কাছ
থেকে প্রচুর জায়গা দখলে সক্ষম হন।  
এমনই এক
দূর্যোগময় অস্বচ্ছল সময়ে আমি এমসি কলেজে ভর্তি হই। আব্বার হাইস্কুলের সামান্য
বেতনের উপর বিরাট এক সংসারের বুজা চাপে,
তদুপরি প্রচুর সম্পদ বাস্তবে আছে অথচ কাজে নেই। একটুকরা জমি বিক্রি করে ঐ টাকায়
কলেজ হোস্টেলে কিংবা ছাত্রমেছে গিয়ে শান্তিতে পড়ব তারও কোন উপায় ছিলনা। তখন আমাদের সহায় সম্পদ সব ভাগবাটুরা করে লুটপাট করে নেওয়ার
জন্য ঘরে বাইরে এক গভীর ষড়যন্ত্র ও দুষ্টখেলা জমে উঠেছিল। 
আব্বা সিন্ধান্ত নেন তার ধনী লন্ডনি ভাগনি সিরিয়া আপার কাঁধে আমাকে চাপাবেন। আমার খালাত ভাই তারেক আটদশ বছর আমাদের গৃহে অবস্থান করে পড়েছেন। আমাদের বাংলোয় অবস্থান করে অনেক তালবা, ফুফুতো ভাইরা ও বাহিরের লোকেরা বছরের পর বছর লেখাপড়া করেছেন। আব্বার ধারণা এটা আর এমন কি?
একেতো এমসি কলেজ অনেক দূরে, তদুপরি উচ্চমাধ্যমিক বিজ্ঞানের বিশাল কোর্স দাউদপুরের বাড়ি হতে ঘোড়দৌড় দিয়ে আসা যাওয়া করে চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। আজকের মত উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা হলে হয়ত তখন দাউদপুরের বাড়ি হতে এম সি কলেজে আসা যাওয়া করে পড়ে নিতে পারতাম।
আমি তীব্র মানসিক দ্বিধাদ্বন্দে ভুগলাম কিন্তু আর কোন দ্বিতীয় উপায় খোঁজে পেলাম না। শেষমেশ একদিন আব্বা আমাকে নিয়ে শিবগঞ্জ খরাদিপাড়ায় তার ভাগ্নির বাসায় ফেলে আসলেন। বাসাটির নাম ‘ফাজিলপুর লজ”। দুলাভাই সৈয়দ মইজুল ইসলাম কদই মিয়া ছিলেন খুব বড় আত্মার লোক, তিনি দুহাতে টাকা উড়াতেন। হাতেমতাঈ দুলাভাই লোকজনকে খুব সাহায্য করতেন, তার কাছে এসে কেউ খালি হাতে ফিরত না। একদিন তিনি আমার বামকানের পানিপড়া রোগের টের পেয়ে বললেন- “ওবা সেফাক মিয়া, আমার কাছ থেকে যত টাকা লাগে নিয়ে যাও, বালা করি ডাক্তার দেখাও”। চিকিৎসার জন্য তিনি আমার হাতে তখনকার দিনের বারশত টাকা তুলে দেন।
আমি সিলেট স্টেডিয়াম মার্কেটে গিয়ে নাক কান গলা বিশেষজ্ঞ ডাঃ এ কে এম হাফিজকে দেখাই, তখন তার ভিজিট ছিল মাত্র পঞ্চাশ টাকা। কোথাকার কোন মশামাছি এসে কদই মিয়ার হাতীগাত্রে বসল, না উড়ে গেল, না তার সবকিছু খেয়েদেয়ে সাবাড় করল, এসব নিয়ে বড়দিল কদই দুলাভাইয়ের কোন ভাবনা ছিলনা।
ভাদেশ্বর
নালিউরি গ্রামে পিচঢালা রাস্তার পাশে টিলার উপর তাদের খুব সুন্দর বাগানবাড়ি ছিল। বাগানবাড়ি জুড়ে ফুল আর ফুল। তাদের আটদশটি গাড়ি, পেট্রোল পাম্প, বিয়ে সেন্টার ও চাবাগানের
মালিকানা ছিল। তিনি সিলেটের মেহমান ভর্তি এই বদ্ধ বাসার চেয়ে নালিউরির বাগানবাড়িতে
থাকতে বেশী আনন্দ ও স্বাচ্ছন্দবোধ করতেন।
এখানে এসে
ভাগনা পাপু, ভাগ্নি জুলি ও কোলের শিশু ভাগ্নি এলিকে পাই। আর দেখলাম এখানে আমি
ছাড়াও আর দুইজন আত্মীয় তাদের পিঠে ইতিপুর্বে সওয়ার হয়েছেন। পহেলা জন টেকোমাথার
খানিক বেঁটে এডভোকেট মাসিয়ত উল্লাহ চৌধুরী, লন্ডনি সাহেবের সমনদিক, যিনি এখানে
অবস্থান করে সিলেট জজকোর্টে প্র্যাকটিস করছেন। দুসরা জন লন্ডনির
শ্যালিকা ফাবিয়া আপার বালিকা কন্যা ইমা, সে লন্ডনি দুলাভাইয়ের সন্তানদের খেলার সাথী ও শাহজালাল জামেয়া ইসলামিয়া স্কুলের সহপাঠিনী।
এবাসায় আমার অনাহুত আগমন ফুফুতো ভাই মাসিয়ত উল্লাহ উকিল সাহেবের খুব মাথাব্যথায় কারণ হয়ে গেল। তিনি একদিন আমাকে বললেন এই ছড়া পার হয়ে একটু এগুলে ঝরনারপারে তোমার খালার বাসা, সেখানে চলে গেলে তোমার ভাল হবে। কিন্তু উকিল সাহেব যেখানে চলে যাবার কথা বলছেন সেখানে থাকার মত অবস্থা হলে আমিতো এখানে আসতামই না। তিনি কোন কোন দিন বলতেন, মাস্টর এখানে থেকে তোমার লেখাপড়া হবেনা, অন্যদিকে রাস্তা খোঁজ।
সিরিয়া আপা কিংবা দুলাভাই কোনদিন তাদের ছেলেমেয়েদেরে পড়ানোর জন্য কোন তাগিদ দেননি, অথচ উকিল সাহেবের এই ব্যাপারে খুব শিরঃপীড়া ছিল। তিনি প্রতিদিন সকালে বলতেন, মাস্টর, তাদেরে নিয়ে পড়াতে বস। বাচ্চাদের প্রাইভেট টিউটার ছিল, রোজ রোজ এসে পড়াত। তা সত্বেও উকিল সাহেবের জ্বালায় সকাল সন্ধ্যায় বাচ্চাদের নিয়ে বসতে হত। এযেন মায়ের চেয়ে মাসীর দরদের ঠেলাঠেলি।
টিনের
পাকাবাসাটি লোকজনের তুলনায় ছোট হওয়ায় আমি বেশ কিছুদিন খরাদিপাড়ার দুতলা মসজিদের
গেটদিয়ে ঢুকে একজন বৃদ্ধার ঘরে রাতে ঘুমাই। এই
বৃদ্ধার দুই ছেলে বিদেশে থাকায় তিনি ভাইপো শাহানকে নিয়ে একাকী থাকতেন। এক শীতের রাতে বিটিভিতে ফজলে লোহানীর জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান
“যদি কিছু মনে না করেন” দেখে দেরি করে গিয়ে
দেখি বৃদ্ধার ঘরের দরজা বন্ধ। ডাকাডাকি করে দরজা খোলাতে ব্যর্থ হলাম।
সেই রাতে প্রচন্ড শীত পড়ে, কোয়াশার মধ্যে এসে মসজিদের দুতলার মেঝে কনকনে শীতের
মধ্যে চাদরবিহীন ঘুমিয়ে পড়লাম। সে রাতে গায়ে সোয়াটারও ছিলনা।
মসজিদের
জৈন্তাপুরী ইমাম সাহেবের সাথে আমার বেশ ভাব ছিল। কি কারণে তিনি শেষরাতে
এসে এই দুঃসহ শীতে আমাকে এই অবস্থায় পেয়ে তার কক্ষে নিয়ে আলাদা বেডে শুইতে দেন।
উকিল সাহেবের নানা কথাবার্তার ছুরিকাঘাতে ক্ষতবিক্ষত হৃদয় নিয়ে নিতান্ত নিরুপায়
হয়ে বাসাটিতে সময় পার করি। শুক্রবার কিংবা ছুটির দিনে আমি কাম্মিনকালেও এই বাসায়
অবস্থান করতাম না। বৃহস্পতিবার সকালে বের হয়ে কলেজ করে বাড়ি ছুটতাম ও শনিবার
বিকেলে ক্লাস শেষে একবুক লজ্জার মাথা খেয়ে দুরুদুরু বুকে খরাদিপাড়ার বাসায় ফিরতাম।
বাসায় কুটিনা নামের অজ্ঞাতকুলশীল বার তের বয়সের মেয়েটি বাচ্চাদের দেখাশুনা করত, মধ্যবয়সী বাবুর্চি আব্দুর রহিম পাকঘরের ঠেলা সামলাতেন, তাকে সাহায্য করতেন ধলাই নামের স্থূলকায় একজন মোঠামাথার গ্রাম্য যুবক ধলাই। বাসার ড্রাইভার চাবাগানের লোক, তার নাম ছিল গোপাল। এইসব কাজের লোকজন অন্নখেত ও বেতন নিত লন্ডনি কদই মিয়ার, আর রোজ রোজ কনুইয়ের গুত্তা খেত ছোটবোনের পিঠে সওয়ার হওয়া উকিল মাসিয়ত উল্লাহ চৌধুরীর। তিনি কুটিনার গায়ে একদিন বাঁশের কঞ্চি ছোঁয়ালে বুদ্ধিমতি মেয়েটি চোখ রাঙ্গিয়ে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে- “খবরদার, আর যদি আপনি এসব করেন তবে বলে দেব”। উকিল সাহেব চুপসে যান।
এখানে বাঁশের চেয়ে কঞ্চি শক্ত ও কঞ্চির ঘায়ে সবার প্রাণ ছিল অষ্টাগত। এডভোকেট মাসিয়তুল্লাহ উকিল সাহেবের স্বৈরশাসনে অতীষ্ঠ গৃহকর্মীরা তার অত্যাচার হতে বাঁচতে পথ খোঁজে। কয়েকদিন পর বাড়ি হতে খরাদিপাড়া এসে দেখি বাবুর্চি আব্দুর রহিমের চাকুরি খতম, গৃহকর্মী ধলাই আলী ও ছখাই আলী নালিউরিতে বদলি, কেবল ড্রাইভার গোপাল ও কাজের মেয়ে কুটিনা কোনমতে টিকে আছেন। পরে জানলাম উকিল সাহেবকে সরাতে তারা সবাই মিলে কি এক মিথ্যা নারীঘটিত ষড়যন্ত্র করে তদন্তে ধরা খায় ও তল্পিতল্পা গোটায়। এভাবে ফাজিলপুর লজে উকিল মাসিয়ত উল্লাহ চৌধুরীর বিরূদ্ধে সংঘটিত দাস বিদ্রোহ বুমেরাং হয়ে যায়।
ভাগ্নি জুলি তখন ছোট্ট বালিকা, একদিন আমার একটি সাদাকালো ফটোতে কলম দিয়ে গোঁফ লাগিয়ে তার সামনে নিয়ে বললাম, চিনতে পার কি এটা কার ছবি? ছবিটি দেখে সে ভয়ে চিৎকার দিয়ে উঠল। পাশের কক্ষ হতে সিরিয়া আপা ছুটে আসেন। আমি আজও চিন্তা করে পাইনা সে কেন এত ভয় পেল এবং এমন আচরণ করল। এলি এত ছোট ছিল যে প্রায়ই কোলে নিয়ে হাঁটতাম।
এইচএসসি ফাইন্যাল পরীক্ষার কিছুদিন আগে এক সুদীর্ঘ কলেজ ছুটিতে আমি খরাদিপাড়া থেকে দাউদপুর চলে যাই। সিরিয়া আপা ও কদই দোলাভাই তখন লন্ডনে ছিলেন। একদিন ফুফুতো আব্দুল্লাহ ভাই দাউদপুরের বাড়ি আসেন। তিনি অবিশ্বাস্য এক খবর দেন, খবরটি হল ভাগ্নি ইমা বেঁচে নেই, হঠাৎ এক গলরোগ হয়ে দ্রুত সে চলে গেছে না ফেরার দেশে। শুনলাম, তিনচার দিন আগে শাহপরানের কবরগায় তার দাফনও হয়েছে।
আমি ভাগ্নি ইমাকে মাত্র কয়েকদিন
আগে সম্পূর্ণ সুস্থ্য ও হাসিখুশি রেখে আসি।
বালিকা ইমার পিতা হোসেন আহমদ চৌধুরী দুলাভাই সোনালী ব্যাংকে
চাকুরি করতেন ও একটি হোন্ডা ফিফটি মোটর
সাইকেলে এসে প্রতিদিন দুপুরে এখানে খেয়ে মেয়েকে দেখে যেতেন। বালিকা ইমা ছিল বেশ
বুদ্ধিমতি, প্রায়ই সে গান গাইত- “একদিন ছুটি হবে, অনেক দূরে যাব। নীল আকাশে সবুজ
ঘাসে খুশিতে হারাব”। হ্যা, সত্যিই যেন ইমার ছুটি হয়ে
গেল, সে তার গাওয়া গানের কলির লাইনের মত সেই নীল আকাশে চিরদিনের মত হারিয়ে গেল।
এবার আমি
আমার প্রথম পাওয়া প্রেমপত্রের গল্প শুনাব। প্রেমপত্রটি আমি দেইনি, এটা আচমকা আমার
উপর অবতীর্ণ হয়। আজকের মোবাইলের যুগে আর অনেক
কিছুর মত প্রেমপত্রও উদাও হয়ে গেছে। অথচ সেকালে এই প্রেমপত্র ছাড়া কদমতলার বাঁশিই
বাজত না। পাশের বাসা একজন লন্ডনি হাজি সাহেবের যিনি ছিলেন জগন্নাথপুরের অধিবাসী। এখানে তিনি তার
দ্বিতীয়া সহধর্মিনী নিয়ে জীবনের শেষ অবসর দিনগুলো তসবিহ জপে জপে পার করছিলেন। হাজির
অষ্টম শ্রেণি পড়ুয়া কন্যা মিলন বেগম একদিন সিরিয়া
আপাকে এসে বললেন “দুই একদিনের জন্য তাইনর ইংরেজি গ্রামারটা আমার দরকার”। সিরিয়া আপা একটু কৌতুক করে আমাকে ডেকে
বললেন “ও বা মিলনের তাইন, তোমার গ্রামারটা তাকে কয়েকটা দিনের
জন্য ধার দাও”। আমি ধরে নিলাম এটাতো স্বাভাবিক ব্যাপার যে কেউ একটা বই চেয়ে নিয়ে পড়তে পারে। তাছাড়া স্কুলে আসা যাওয়ার
পথ ব্যতিরেকে এই মেয়েটির সাথে আমার কোনদিন তেমন একটা দেখাও হয়নি। আমি এর ভিতর কোন
মতলব আছে আদৌ টাহর করতে পারিনি। 
কিন্তু অচিরেই একটা মতলব টের পেলাম যখন কয়েকদিন মেহমানদারী করে গ্রামারটি ফেরত এলো। গ্রামারের ভিতর গুপ্তধনের মত লুকিয়ে আসে মিলন বেগমের একটা মধুভরা প্রেমপত্র। পত্রের সুচনা মাস্টার সাহেবে ও সমাপ্তি এক গানের কলিতে “যদি একখান সুন্দর মুখ পাইতাম, মহেশখালির পানখিলি তারে বানাই খাওয়াইতাম”। সবশেষে ইতি, মিলন বেগম। নবম শ্রেণির অল্প বয়সী এক কিশোরীর কাচা হাতের লিখা চিটি, খাপছাড়া ভাষায় কচি হৃদয়ের ভালবাসার আকুল আকুতি পেলাম।
আমার বয়স তখন মাত্র সতের, ভাসান বন্যার জলে এক ভাসমান খড়কুটো আমি। আমার কি আর এত অলস সময় আছে প্রেম প্রেম খেলায় মেতে উঠার, কিংবা না সাহস আছে পনের ষোল বছর বয়সী এক কিশোরীর সাথে খেলতে গিয়ে ধরা খেয়ে মানসম্মান খোয়ানোর ঝুঁকি নেওয়ার। এই অপ্রেমিক মাস্টার সাহেবের পাষাণলোহা হৃদয়ের সাড়া মিলন বেগম কোনদিনই ফেরত পাননি। চট্টগ্রামের মহেষখালি দ্বীপ কেন, সিলেটের বন্দরবাজারের পানখিলি এই হতভাগাকে খাওয়ানোর কোন সুযোগও মিলন বেগমের ভাগ্যে আর জুটেনি। বিষয়টা খুব তুচ্ছ একটা সাধারণ ঘটনা হলেও আমার কাছে তা ঐতিহাসিক, কারণ এই চিটিই ছিল আমার হাতে আসা কোন মেয়ের প্রথম হৃদয় নিংড়ানো প্রেমপত্র।
মিলন বেগম এখন কোথায় আছেন, কেমন আছেন, তা আর জানতে পারিনি। তবে তার বিলাতে থাকার সম্ভাবনাই বেশি, কারণ তিনি ছিলেন বৃটেনের জাতিকা। তাঁর প্রেমে সাড়া দিলে হয়ত আজ আমার ঠিকানা হত ইউনাইটেড কিংডম।
একদিন পাশের মাসিমা মেসে আমার এক হিন্দু সহপাঠি রসময় চক্রবর্তীর কক্ষে যাই। কানাইঘাটের ছেলে এই রসময় নিরীহ ও পাঠ্যনিমগ্ন ছাত্র। এই মেসে ফিজিক্সে অনার্স পরা সিনিয়র ভাই ছিলেন পরাগ দা। তিনি সহজে আমাকে ফিজিক্স ও গণিত বুঝিয়ে দিতেন। পরাগ দা পরে সরকারি কলেজের অধ্যাপক হন।
নাম আজ আদৌ মনে নেই এমন আর কয়েকজন সহপাঠি ও পরিচিতকে একদিন মাসিমা মেসে পাই। তারা আমাকে কানেকানে একটি লোভনীয় প্রস্তাব দিল, তাঁরা কয়েকজন মিলে গোপনে রাতে ভিডিওতে পর্ণছবি দেখবে। আমি চাইলে চাঁদা দিয়ে তাদের সাথে শরিক হতে পারি। আমি বললাম এইসব ছাইপাস দেখার আমার সাহস নেই, অবসরও নেই। পরদিন তাদের পর্ণছবি দর্শনের নানা অশ্লীল গল্পগোজব শুনে আমার শ্রবণযন্ত্র বেশ জ্বালাপালা করে।
সেকালে
পর্ণছবি দেখা ছিল খুবই বিপদজনক কাজ। বাহিরের লোকজন জেনে গেলে বাসা ঘেরাও করে ধরে
গনপিটুনী দিতে কসুর করবেনা। আর পুলিশ টাহর পেলে
ভিডিও, টিভি ও নীলছবিসহ দর্শকদেরকে ধরে নিয়ে চালান দেবে। এমন কি পরদিন পত্রিকায়
সবার কুকীর্তির সবিবরণ ছবিও ছাপা হয়ে যেতে পারে। অথচ আজকাল তা নস্যি, গোগলে সার্চ
দিলেই পর্ণছবি এসে দৌড়ে সামনে হাজির। একেই বলে যুগ বদলের হাওয়া,
আজ কার সাধ্য বিষাক্ত পর্ণছবি আটকায়।    
স্থুলকায়া
কদই দুলাভাই ছিলেন গোলবদন হাসিমুখের মানুষ, মাথায় একটু টাকপড়া হলেও চেহারায় ছিল
লাবন্য ও অভিজাত্যের ছাপ। স্যুট কোট টাই পরে ফিটফাট হয়ে থাকতেন তিনি। বিছানায় তার
পাশে শুয়ে অনেক সময় হাত-পা উঠিয়ে দিতাম। তার ওজন ছিল বেশী।
একদিন রসিকতা করে কোলে তুলে বিপদে পড়ি, না পারছি রাখতে, না পারছি
নামাতে। শেষে কোনমতে নরম বিছানায় ফেলে দিয়ে রক্ষা পাই। তার দুই ভাই
ছন্দই ও এনাম ভাই ভাদেশ্বর নালিউরি থাকতেন। কাজলবরণ
দুই সহোদরের মধ্যে ছন্দই ভাই একটু খাটো ও এনাম ভাই ছিলেন দীর্ঘাঙ্গ।
অন্যজন পঙ্কি ভাই এর বাসা ছিল নয়াসড়ক। তিনি কিছুটা
কদই দুলাভাইয়ের মত, তবে বেঁটে ও কৃশকায়। তারা ভাইরা এত সরল ও ভাল মানুষ ছিলেন যে,
মনে হত বাংলাদেশের অন্ততঃ কিছু মানুষ তাদের মত হলে দেশটা বদলে যেত। 
বহুবছর পর আমি ছিলাম পুবালী ব্যাংক লিঃ মোকামবাজার শাখার রিলিভিং ম্যানেজার, একদিন যাত্রীবাস হতে দেখলাম নালিউরির ঔ বাড়িটিতে গাড়ির সারি ও মানুষের ভীড়। পরদিন অফিসে নালিউরির একজন কাস্টমার বললেন গতকল্য ছন্দই ভাই মারা গেছেন। এনাম ভাই পরে গ্রামের মেম্বার হন, তিনি ছিলেন আমার ছোটমামা শহিদ চৌধুরীর সহপাঠি।
সেই সময় এনাম ভাইয়ের বিয়েতে যাই, নালিউরি হতে শেওলায় গিয়ে বেশকটি মিনিবাস নিয়ে বড়খেয়ায় কুশিয়ারা নদী পার হই এবং একটু সামনে গিয়ে যানগুলো সাঁতরে জলেডুবা এক রাস্তা পেরিয়ে আমদেরকে সাদিনাপুর কনেবাড়ি নিয়ে যায়। এনাম ভাইও আজ নেই। তিনি অল্প বয়সে ব্রেন টিউমার হয়ে পরপারে চলে যান।
সে সময়
সিরিয়া আপা দুএকবার আমাকে কিছু টাকা দিতে চাইলে আমি নেইনি, মনে হত
এখানে থেকে তাদেরকে অনেক যন্ত্রণা দিচ্ছি, তার উপর তাদের টাকা নেব এটা হয়না। আমার
বিপদের দিনে তাদের কাছে আশ্রয় পেয়েছি। দুলাভাই ও সিরিয়া আপার সীমাহীন স্নেহমমতা না
পেলে হয়ত আমি এবাসায় দেড় বছর টিকতাম না। তাদের কাছে আমার অনেক ঋণ আছে, তাদের
কাছে আমি শত ঋণী, শত কৃতঞ্জ। 
ফাইন্যাল পরীক্ষার পর একদিন রেজাল্ট বের হল। সেই বৎসর উচ্চ মাধ্যমিক বিজ্ঞানে কুমিল্লা বোর্ডে মাত্র ৩৫% ছাত্রছাত্রী উত্তীর্ণ হন। তাঁর মানে শতকরা পঁয়ষট্টি জনই ফেলের তালিকায়। অথচ বর্তমানকালে ফেল নেই, সবাই পাস, আমাদের যুগে ফেল স্বাভাবিক, পাস ছিলো অমাবশ্যার চাঁদ। ভয়ে ভয়ে কলেজে রেজাল্টের তালিকায় চোখ বুলাই। পাস করলাম বটে কিন্তু এই রিজাল্ট আমাকে তেমন খুশি করতে পারেনি, বাড়িতে না গিয়ে সিরিয়া আপার বাসায় সারা রাতভর কেঁদে বালিশ ভিজিয়ে দিলাম।
এসএসসিতে হতাশা ছিল সামান্যের জন্য প্রথম বিভাগ হারানোর, রসায়নে লেটারমার্ক হারানোর, আর এবারের কান্না, জীবনের গতিপথ কর্দমাক্ত হয়ে যাবার কান্না। এই রেজাল্টে বুয়েট কিংবা মেডিকেল কোথাও ভর্তি হওয়া যাবেনা। ইংরেজিতে সমস্যা হওয়ায় সর্বোপরি বেশ ভাল নম্বর উঠানো সত্বেও উচ্চ মাধ্যমিক চুড়ান্ত পরীক্ষা যতটুকু ভাল ফলাফল আশা করেছিলাম, তা হলনা। আমার এই অস্থির অবস্থা দেখে পরদিন সিরিয়া আপা বললেন এটা এমন চিন্তার কি? এক বছর সময় কিছুনা, আগামী বছর আবার পরীক্ষা দিয়ে পুষিয়ে নেবে।
কদই দুলাভাইয়ের ভাতিজা সিবিল ইঞ্জিনিয়ার খোকন চৌধুরী দ্বিতীয়বার এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে প্রথমবিভাগ পেয়ে বুয়েটে পড়ার সুযোগ পায়। সিরিয়া আপার পরামর্শ একটা বছর মনোযোগ দিয়ে পড়লে তুমি নিশ্চিত প্রথম বিভাগ পেয়ে যাবে। তোমার সামনে তখন সব দরজা খোলে যাবে।
সিরিয়া আপাকে বললাম আমি কোন রাজপুত্র হয়ে জন্মিনি যে প্রথম বিভাগের আশায় বারবার পরীক্ষা দিয়ে সময় নষ্ট করব। আমার যে করুন আর্থসামাজিক ও পারিবারিক অবস্থা তাতে বাস্তবতা হল দ্রুত কিছু শিখে জীবনযুদ্ধে নেমে পড়া।
আমি অযাচিঁতভাবে অন্যের গলগ্রহ হয়ে তাদেরকে আর এক বছর কষ্ট দেই, এমনটি আমার মন চাইলনা। তবে বেশ জীবনকাল পেরিয়ে আজ বুঝতে পারি বয়সে অনেক প্রবীণ ও অভিজ্ঞ আমার প্রিয় ফুফুতো বোন সিরিয়া আপার দুসরা বার এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে প্রথম বিভাগ পাবার পরামর্শ মোঠেও ভূল ছিলনা। তাঁর পরামর্শ মেনে নিলে আমি হয়ত অনেক লাভবান হতাম। আমার জীবনিতিহাস হয়ত আজ ভিন্ন হত, আর বহুত উজ্জ্বল হত।
বেশ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আমি একদিন খরাদিপাড়া ছাড়লাম, মনে মনে বুঝলাম সিরিয়া আপা বেশ মনঃকষ্ট পাচ্ছেন। তবুও তাদেরকে প্রায় দেড় বছর অনেক অনেক যন্ত্রণা দিয়ে এক অনুজ্বল ফলাফল নিয়ে ভগ্নহৃদয়ে অগন্তস্থ্য যাত্রায় বেরিয়ে পড়লাম। দেখলাম আমি দুইটি ভূল করেছি, প্রথমতঃ গণিত ঐচ্ছিক রেখে জীববিজ্ঞান নিয়ে পড়লে অবশ্যই ভাল হত। দ্বিতীয়তঃ বিজ্ঞানের বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিলেও আমি ইংরেজিকে তেমন আমলে নেইনি। আর্থিক অসচ্ছলতা তো ছিলই, তাই অনেকে ইংরেজি বিষয়ে টিউশনি পড়লেও আমি পড়িনি।
সেইসাথে ছিল খরাদিপাড়া ও দাউদপুরের
বাড়িতে লেখাপড়ার এক অগুছালো এলোমেলো বিরূপ পরিবেশ। নানি রফিকুন্নেছা চৌধুরীর জীবনের শেষবেলায় আম্মা আসমতুন্নেছা ও অগ্রজা আনিছা বেগম মান্না অসুস্থ নানির সেবাযত্ন করতে অনবরত নানাবাড়ি পাতারিয়ায় অবস্থান করতেন। দাউদপুরের বাড়িতে
গেলে সেখানে আম্মা ও বোন প্রায়ই অনুপস্থিত। আব্বা সফিক চৌধুরী একা, কাজের মেয়ে শমি ও তসিঝি রান্না
করে দেন। রাতে ইঁদুর মাটি কেটে মেঝে স্থুপাকার করে দিত, ঘরের ছাদে গেছো ইঁদুর ছুটাছুটি করত, আঙ্গিনায় এলোমেলো ঘাস, কেমন যেন এক ছন্নছাড়া
পরিবেশ। 
তখন দাউদপুর গ্রামের হাওরে আমাদের ভূসম্পত্তি কেড়ে নেবার মারামারি চলছে। চর দখলের মত জমিজামা কেড়ে নিতে ঘরে বাহিরে চলছে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হওয়া গ্রামের একদল দুষ্টলোকের মহোৎসব। এই ধরনের এক বৈরী ও শান্তিহীন পরিবেশে লেখাপড়ায় মন আর টেকে কতক্ষণ? সিলেট ও দাউদপুরের এই নোংরা আর্থ-সামাজিক পরিবেশ আমার জীবনের দিক নির্ধারণকারী সবচেয়ে গুরুত্ববাহী এইচ এস সি (বিজ্ঞান) পরীক্ষা- ১৯৮৩ এর ফলাফলকে মেঘের ছায়ার মত খানিকটা আঁধার করে দেয়।
শোকরিয়া জানাই মহান আল্লাহ পাককে, তিনি যে আমাকে অন্য অনেকের মত একদম আটকে দেননি। যদিও জীবনে একজন বড় এলিট হবার স্বপ্নটাকে ধুঁয়াশায় ছেয়ে ফেলে। এমনি এক অনিশ্চয়তা নিয়ে এমসি কলেজ হতে নীরবে চোখের জল মুছে একদা বিদায় নিলাম। পিছনে পড়ে রলো এমসি কলেজের অজস্র অমলিন স্মৃতিমালা।
আমার সহপাঠী বন্ধুরা পরবর্তীকালে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। তাঁরা বাংলাদেশসহ সারা দুনিয়ার সেরা সেরা বিশ্ববিদ্যালয় হতে ডিগ্রি নেয়। তাঁরা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যাংকার, জজ, ব্যারিস্টার, বিজ্ঞানী, আইনজ্ঞ, রাজনৈতিক নেতা, কৃষিবিদ, কোম্পানি নির্বাহী সবই হয়। প্রাইমারি টিচার থেকে শুরু করে তাবৎ সব নামীদামী কলেজ, মেডিকেল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হয়। কেরানী হতে শুরু করে বাংলাদেশ সরকারের উপসচিব, যুগ্নসচিব, এমন কি সচিব পর্যন্ত হয়। লন্ডনের রেস্তোরা ব্যবসা হতে শুরু করে তাঁরা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রির উদ্যোক্তা ও মালিক হয়। কেউবা হয়ে যায় কবি, লেখক, শিল্পী, সাহিত্যিক, গায়ক, ও গুণিজন। আমার সহপাঠী বন্ধুদের প্রতিভাকে কোনভাবে খাটো করার উপায় নেই। আমি তাঁদের সৃজনশীলতা ও ভালো ভালো কাজসমূহকে নতশিরে সম্মান জানাই। শোকরিয়া, আলহামদুলিল্লাহ, মহান আল্লাহ পাক তাদেরে এত এত ধন সম্পদ, মান মর্যাদা ও উচ্চতা দান করেছেন। হে দয়াময়, তাঁরা যে যেখানে আছে তুমি তাদেরে সর্বদা সুখে রেখো, শান্তিতে রেখো, আমিন।
গুডবাই প্রিয় এম সি কলেজ, সিলেট। গুডভাই, তিন শতাধিক প্রাণপ্রিয় সহপাঠী বন্ধুরা, আজ তোমরা কে কোথায় আছ, কেমন আছ, জানিনা? জানিনা আর কি হে হবে দেখা তোমাদের সনে,/ যতদিন যাবে এই নশ্বর জীবনে।
ইতি, আমি তোমাদের এক সহপাঠী বন্ধু ইসফাক কুরেশি।
এম সি কলেজে থাকাকালে ১৯৮৩ সালে দুলাভাই ইঞ্জিনিয়ার ফজলুর রহমান চৌধুরী একদিন আমাকে শাহজালাল উপশহরের সরকারি প্রকল্প অফিসে নিয়ে যান। সেখানে পাশের চেয়ারে এসে বসেন একজন হ্যান্ডসাম সুদর্শন তরুন, যিনি সিলেট সরকারি মেডিকেল কলেজের ছাত্র। চেহারায় দৃষ্টি পড়তেই মনে হল তিনি কোন অভিজাত ঘরের সন্তান হবেন, যাকে এই অফিসের সবাই বেশ খাতিরযত্ন করছে। আমার মত চেহারার বুদ্ধিদীপ্ত কথাবার্তার চৌকশ এই তরুনের মুখপানে চেয়ে কেমন যেন আপন আপন মনে হল। পরিচয় জিজ্ঞেস করতেই বেরিয়ে আসে তিনি আমার স্ববংশের সচিব ইমামউদ্দিন চৌধুরী ওরফে কয়ছর ভাইয়ের একমাত্র পুত্র নিয়াজ আহমদ চৌধুরী। অবাক ব্যাপার, তিনি আমার এত কাছের আত্মীয় হওয়া সত্বেও এই প্রথমবার দেখা হয়। দাউদপুর চৌধুরী বংশের এই প্রজন্মের এই শ্রেষ্ট সন্তানের সুন্দর মুখচ্ছবি সেইদিন আমার অন্তরে ক্ষুধিত হয়ে যায়। আমার এই ডাঃ নিয়াজ ভাতিজা পরে জাপান সরকারের বৃত্তি পেয়ে ওসাকা মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাস্কুলার সার্জারিতে পিএইচডি করেন। খুব অল্প বয়সে বাংলাদেশ বি বি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুর্ণ অধ্যাপক হন। একটি এনজিও এবং একটি হাইস্কুলের প্রতিষ্ঠাতা হন।
আমরা এমসি কলেজে ভর্তির সময় ৩০ মে ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়া চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে নিহত হন। কিছুদিন বিচারপতি আব্দুস সাত্তার প্রেসিডেন্ট ছিলেন। কিছুদিন পরই সেনাপ্রধান হোসেন মোঃ এরশাদ তার কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেন।
এরশাদ প্রেসিডেন্ট জিয়ার মত ‘হ্যাঁ’ ভোট, ‘না’ ভোট দেন। বাতাসি ‘হ্যাঁ’ ভোটে তার বাস্ক ভরে যায়। এরশাদ প্রথমে জনদল ও পরে জাতীয় পার্টির জন্ম দেন। সরকারি হালুয়া রুটি লাভের আশায় জাতীয় পার্টিতে নাম লেখাতে সেয়ানা আদমিদের মধ্যে তীব্র ঠেলাঠেলি লেগে যায়। দেশে পাবলিক মশাদের উপর মিয়া-বিবি-সাহেব-গোলামের রাজত্ব কায়েম হয়।
এরশাদের সামরিক শাসনামলেই আমাদের এম সি কলেজ জীবনের অনেকগুলো দিন অতিবাহিত হয়। দেশে তখন এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে ছাত্রদের সাহসী আন্দোলন দেখে দেখে আমাদের সময় পার হয়।
নানি রফিকুন্নেছা চৌধুরীর মহাপ্রয়াণ, স্মৃতির রঙ্গে আঁকা নানাবাড়িঃ
দুই প্রজন্ম আগেকার দাদা, দাদি, নানা ও নানি এই চার জনের মধ্যে আমার স্মৃতিতে উজ্বল হয়ে আছেন মাত্র একজন, তিনি আমার মাতামহী রফিকুন্নেছা চৌধুরী। মাতৃক্রোড় হতে নানাকে দেখেছি যিনি আমার মাত্র নয় মাস বয়সে ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৬৬ সালে মারা যান এবং আমার ভবের মেলায় আসার কয়েকযুগ আগেই দাদা ও দাদি পরলোকবাসী হন। নানি ছিলেন কুলাউড়া জংশন থেকে মাইলখানেক দূরে ঘাগটিয়া সাহেব বাড়ির মেয়ে। নানিরা ছিলেন দুইভাই ও একবোন। সাহেব বাড়ির সামনে বড়দিঘি, দিঘিপারে ১৮৫৭ সালে নানির পিতামহের নির্মিত সুন্দর বড় মসজিদ, বামপারে নানির পিতার নির্মিত পাঠশালা ও মসজিদের পাশে সাহেববাড়ির পারিবারিক কবরগাহ। বাড়িটির পিছনে দুইটি পুকুর, জায়গার পরিমান চব্বিশ/পঁচিশ বিঘার কম হবেনা। সারাটা বাড়ি উঁচু পাকা বাউন্ডারী ঘেরা। নানি ছিলেন এই বাড়ির সবার সবচেয়ে আদরের ধন। নানির বাপ ও বড়ভাই সেই আমলে হরিণ, পাখি, বনমুরগ শিকার করতেন কিন্তু নানিকে বাদ দিয়ে কিছুই খেতেন না। লাতুর ট্রেনে করে নানির ভাগ পাতারিয়া চলে আসত।
নানির হাত ছিল খুবই বরকতময়। তিনি নানাবাড়ির মাটিতে কিছু রোপে দিলে প্রচুর ফলন হত। আমগাছে পান লাগান, সারা গায়ের লোক খেয়েও পান শেষ হতনা। শীতের শেষে শক্ত আঙ্গুরলতা বৃক্ষে সবুজপত্র গজাতো ও প্রতিটি পত্রবৃন্ত থোকা থোকা আঙ্গুরফলে ভরে যেত। ত্রিশবিঘা অর্ধটিলা বাড়িটি ছিল আম কাটাল লিচু বেল জলপাই সুপারি জাম্বুরা ইত্যাদির এক বিশাল ফলবাগান। খালিবাড়িতে রবিশস্যের সাথে হত প্রচুর আদা, হলুদ ও মুকি। এবাড়িতে কখনো আদা হলুদ কেনার প্রয়োজন হতনা। পিছইন বনের লতায় ঝুলে থাকত অজস্র হলুদ কাঁকরোল। বাড়ির উত্তরের মাঠ শীতে রবিশস্যে ভরে যেত। 
পশুপালনেও ছিল নানির রাজকপাল। রাজহাঁস, টেপীহাস, মোরগ ও ছাগলের বিশাল কোয়াড় ছিল নানির। দরজা খোলামাত্র পচিশ ত্রিশটি ছাগল দৌড়াত, শতাধিক পাতিহাস রাজহাস দুই পুকুরের দিকে সশব্দে এগিয়ে যেত। আমরা নানাবাড়িতে গেলে হাঁস মোরগ ও খাসীর ভুরিভোজ চলত প্রতিদিন। বাড়ির চারপাশের ধানিজমিও ছিল এবাড়ির মালিকানায়, তাই এত ছাগল হাঁস মোরগ বিচরণে ভূমির কোন অভাব ছিলনা।
সামনের বড়পুকুরের মাছভাজি দিয়ে হত চোঙ্গাপোড়ার মজাদার খাবার ও রুটপিঠা। বাড়ির উঠোনে  চোঙ্গাপুড়া ও রুটপিঠা পুড়ানোর আনন্দ ছিল বেশুমার। প্রথমে এক ধরনের বাঁশের ভিতর কলাপাতা ঢুকায়ে তাতে জলেধূয়া আটালো ভাতের বিরুনচাল ভরা হত। এই বিরুনচাল ভরা বাশের চোঙ্গাগুলো খড়ের আগুনে পোড়ালে তৈরী হত সুগন্ধি ও মাজাদার চোঙ্গাপোড়া পিঠে। দক্ষিণের হাওরের পানি বড়পুকুরের কোন দিয়ে প্রবেশ করান হলে প্রচুর মাছ লাফিয়ে লাফিয়ে বের হত। আমরা এসব মাছ ধরে টুকরি ভরে ফেলতাম।
দক্ষিণভাগ পাহাড়ঘেরা চাবাগান এলাকা, শীত পড়ত প্রচুর। বার্ষিক পরীক্ষার পর প্রতি জানুয়ারীর শীতে এখানে আমরা রেহা, সেহা, মান্না, তাহমিদ, নিশাত ও আমি; খালাত বুলবুল ভাই, তারেক ভাই, সাহেদ, এলি আপা, কলি আপা, দিলি আপা, জলি আপা, শিবলি ও মামাতো ভাইবোন নিপা, রিপা, আরফা, সোফা, আফজলসহ সবাই মিলে চলত জাম্পেশ আড্ডা ও দিনভর খেলাধুলা।
আমাদের আগমনের খবর শুনে গাংকুল হতে ছুটে আসতেন মামাতো বোন হেলু আপা, ভাগ্নি খুকি ও মনি, ভাগ্না কেরল ও খায়রুল। আড্ডায় ভিড় করতেন সিবই ভাই, ছফুল ভাই, ওহিদ ভাই, হাদু ভাই, মনসুর ভাই, রায়হান ভাই, ইমাভাবী ও মুফতি ভাবী। প্রায়ই আসতেন রনকেলির মাজন আপা, ভাগ্না তাসমিম ও আম্মার চাচাতো বোন ছলু খালা। এক ঝাঁক সন্থান আসতেন মামাতো বোন নাজমা আপা।
কুলাউড়া হতে আসতেন ফকুমামা, তাহিরমামা, সাবুমামা, আসিকুল, শোভা, সেফু আপা, তপন, গীনিখালাসহ অনেকে। দুপুরে পুর্ববাড়ি ও বিকালে পুরানবাড়িতে পর্যায়ক্রমে চলত চানাস্তার আড্ডা। সেইসাথে চলত বারমাসি কাটাল, বরই ও জাম্বুরা চাটনির আসর। দুইবাড়িতে খেলার আসরও জমত। গোল্লাছুট, মার্বেল, দশপঁচিশ, তাস আর কত কি। দলবেঁধে বাড়ির পুকুরে সাঁতার ও লাইখেলায় বেশ মজা হত। বড়পুকুরের জলফল কুড়ায়ে খেতে কি যে মজা ছিল। দুই বাড়িতেই যখন তখন তক্কক ডাকত- ক ক্কা, ক ক্কা, ক ক্কা ---। শুনা যেত পাখি গাইছে, বউ কথা কও, বউ কথা কও।
দক্ষিণভাগে ঘাসের কোন অভাব ছিলনা, তাই ধানের খড় খালিবাড়ির মাঠে স্থুপাকারে ফেলে দেওয়া হত। আমরা শীতের কুয়াশাঝরা ভোরে এই খড় জ্বালিয়ে আগুন পোহাতাম। বর্ষায় এই খড় পচে মাটিতে মিশে যেত। তাই সেই মাটি ছিল খুব উর্বর এবং প্রচুর আদা, হলুদ, কাঁকরোল, মুকি, শিম, তুত, পান ইত্যাদি ফসল ফলতো।   
লয়লা ঝি, আমিনা ঝি, শুয়াই ঝি, রঙ্গী ঝি, তজি, কাজই, নমির আলী, বদলা, মাসুক, ফরিদ, হাসনারা পাকঘরে ভীড় করে নানির চারপাশে বৃত্ত রচনা করতেন। নানির এই লোকবৃত্ত বিশাল বাড়িতে তাকে ঘিরে নিয়ে আবর্তিত হত। সারাদিন চানাস্তা পান সুপারির বন্যা বইত। হাসমতি ঝি ও তার পুত্রকন্যা ছাকিল, অকিল, ছবিল, শমি ও সামিনা ছিল বাড়ির ভিতরের সদস্য ও আমাদের খেলার সাথী।
হাসমতি ঝির পুত্র ছবিল ছিল একটু বোবা, কিন্তু প্রচুর কাজ করত। বাড়ির পিছনের রাস্তা দিয়ে গানবাজনা বাজিয়ে মাধবকুন্ডে ছুটে যেত একটার পর একটা পর্যটন গাড়ি। ছবিল তখন কুন্ড শব্দকে পুন্ড পুন্ড বলে চীৎকার দিত। আমরা নানাবাড়ি ছেড়ে আসার দিন রেলগাড়িতে উঠার পর ছবিল দক্ষিণভাগ রেলস্টেশনে দাঁড়িয়ে চোখমুছে কাঁদত। পরবর্তীকালে কোন একসময় সে প্রায় চব্বিশ পঁচিশ বছর বয়সে হারিয়ে যায়। অনেক খোঁজাখোঁজি করেও তাঁকে আর পাওয়া যায়নি। সবার ধারনা লাতুর ট্রেনে চড়ে শাওয়াজপুর গিয়ে সে ভারতের বর্ডার পার হয়ে করিমগঞ্জ চলে গেছে। বাংলাদেশে থাকলে অবশ্যই তাঁকে পাওয়া যেত।
মাঝে মাঝে হাসমতি ঝি খবর পেতেন ছবিলের মত একজন লোক অমুখ গ্রামে আছে। অমনি তিনি ছুটে যেতেন এবং তাঁর পুত্র ছবিল মনে করে সেই মানুষকে ধরে নানাবাড়ি নিয়ে আসতেন। সবাই ভালভাবে পরখ করে দেখতেন লোকটা ছবিল নয়। কিন্তু হাসমতি কারো কথা মানতেন না, তিনি জুর দিয়ে বলতেন এই আউলা ঝাউলা মানুষটাই আমার হারানো পুত্র ছবিল। হাসমতি ঝি সব মাতৃস্নেহ ঢেলে দিয়ে লোকটার প্রচুর আদর যত্ন করতেন, মজার মজার খাবার খাওতেন। কিন্তু পরবৃক্ষের বাকল গায়ে আর টেকে কতক্ষণ। এত মায়ের আদর পেয়েও কয়েকদিন খেয়ে দেয়ে ফুর্তি করে হঠাৎ এই কুড়ানো ছবিল রতনেরা উদাও হয়ে যেত। হাসমতি ঝির চোখ বেয়ে এভাবে বার বার ঝরে যেত পুত্র হারানোর নুনা অশ্রুজল।
হাসমতি ঝি লাতুর ট্রেনের ঝনার ঝন, ঝনার ঝন, শব্দ শুনে সকাল ও সন্ধ্যায় টেবিলে খাবার পরিবেশন করতেন। নানি আদেশ দিতেন, হাসমতি খাবার রেডি কর? হাসমতি ঝি জবাব দিতেন, এখনো লাতুর ট্রেন যায়নি মাইজি। কোন কারণে লাতুর ট্রেনের দেরী হলে খাবারে দেরী হত, সবার পেট ক্ষুধার জ্বালায় ছু ছু করত।। দক্ষিণভাগে শীতে পুকুরের পানি শুকিয়ে যেত, আমরা পিছনের লস্করের বাড়ি (একসময়ের আম্মার চাচার বাড়ি) গিয়ে তাদের গভীর পুকুরে গোসল করতাম। কেউ কেউ, বিশেষ করে মামাতো ভাই মুহিত চৌধুরী ইন্দারার (কূপ) পানি দড়িবাঁধা বালতি দিয়ে তুলে গোছল করতেন। ইন্দারা ছিল বিপদজনক কুপ, যেখানে পরে গেলে রক্ষা নেই। তাই এর চারপাশে বৃত্তাকার বেড়া দেয়া হত। মামাতো সিবই ভাই মাঝে মাঝে দক্ষিণের হাওরের খালে আমাদেরে গোসলে নিয়ে যেতেন। 
মৌলানা মাহমুদুর রহমান মামা সব খরচপাতির হিসাব পাই পাই করে খাতায় লিখে রাখতেন। মেঝমামা সিদ্দিক উচ্চশিক্ষিত, তিনি চট্টগ্রামের কাপ্তাই পেপার মিলের একাউন্টেন্ট। তিনি বাড়ি এলে মৌলানা মামা তাঁকে নিয়ে পারিবারিক আয়ব্যয়ের হিসাব মেলাতে বসতেন। একদিন হিসাবের খাতা পড়ে সবাই খুব হাসলেন, সিদ্দিক মামা দেখেন বাজে খরচের খাতার এক পাতায় লিখা আছে, অমুক তারিখে কুলাঊড়া জংশনে ভীড়ের মধ্যে পকেটমার কতৃক মেরে দেওয়া অর্থের মোঠ পরিমান দুই শত পঁচিশ টাকা মাত্র।
একবার নানাবাড়িতে প্রচুর কচুর মুকি হয় কিন্তু সমস্যা হল রান্না করা এই মুকি খেলে গলনালীতে চুলকায়। সবাই বললেন এই কচুর মুকি খাওয়া যাবেনা, দক্ষিণভাগ বাজারে পাঠিয়ে বিক্রি করে দেওয়া হউক। মৌলানা মামু বললেন, না বিক্রি করা যাবেনা, পণ্যের দোষক্রুটি গোপন রেখে পণ্যবিক্রি করা ইসলাম ধর্মানুসারে জায়েজ নয়। সবাই বললেন জায়েজ কিংবা নাজায়েজ যাই হউক না কেন এই মুকি নষ্ট না করে, বিক্রি করাই উত্তম। গৃহকর্মী অসির মামু দুইবুজা কচুর মুকি নিয়ে দক্ষিণভাগ বাজারে ছুটলেন। মৌলানা মামু কড়া নির্দেশ দিলেন ক্রেতাকে বিক্রির আগেই বলে দিতে হবে এই মুকি খেলে গলে চুলকায়। অনেক ক্রেতা কিনতে আসে কিন্তু চুলকানির কাহিনী শুনে একে একে সবাই সরে যায়। একটা আদমও অসির মামুর কোন মুকি কিনলনা। ব্যর্থ অসির মামু শেষবাজারে জানতে চাইলেন অবিক্রিত এত মুকি তিনি কি করবেন। মৌলানা মামা আদেশ দিলেন সব মুকি রেললাইনের খালে ফেলে দিয়ে চলে এসো।
গৃহকর্মী অসির মামু ফিরে এসে বড় আক্ষেপ করে বললেন ‘আজকের দুনিয়ায় হাছা মাতরার ভাত নাই। হাছা মাতলাম তাই একটা মানুষও মুকি কিনলনা। যারা মিছা মাতে তারাই ঠিক। আজকে মিছা মাতলে শালারা সব মুকি কিনে নিত, একটা মুকিও রেলের খালে ফেলে আসতে হতনা’।
একবার টাকার খুব প্রয়োজন দেখা দিলে ছোটমামি তার একটি পোষা খাসী বিক্রি করতে পাঠান। পাশের দক্ষিণভাগ বাজারে ছাগল নিয়ে যায় গৃহকর্মী বগডুল ছাকিল। মামীকে সে বলল- চাচি কত টাকায় বেচবো? মামী বললেন আমার আড়াই হাজার টাকার দরকার। বাজারে খাসিটী তুলা মাত্র ক্রেতারা দাম হাঁকলো চার হাজার টাকা। ছাকিল বলল ছোটচাচি বলে দিয়েছেন আড়াইহাজার টাকা, আমি আড়াইহাজার টাকা ছাড়া খাসীটি বেচবো না। সাকিলের দাম হাঁকা শুনে বাজারের লোকেরা হাসি তামাশা করছে।
সাথে সাথে ছোটমামার এক সাগরেদ দৌঁড়ে গিয়ে তাকে বলল, শহিদ ভাই এখনই আসেন, নইলে আপনার ছাকিল উল্লা অর্ধেক দামে খাসীটি বিক্রি করে দিবে। মামা গিয়ে দামদর করে খাসীটির দাম উঠালেন আট হাজার টাকা। ঘরে ফিরে সাকিল কাচুমাচু হয়ে মামিকে বলল, চাচি আমি ছাগল বেচতে চেয়েছিলাম আড়াই হাজার টাকায়, ছোট চাচা এসে এই দামে বেচতে দেন নাই। আমি কি করব, তিনি বেচে দিছেন আর নাজানি কত টাকায়। এমনভাবে বলছে, যেন সে দুষ করে ফেলেছে ও মামির কাছে ক্ষমা চাইছে। এই হল হাসমতি ঝিয়ের বড় ছেলে ছাকিল উল্লাহ।
হাসমতি ঝি এবং অসির মামুর এক দঙ্গল ছেলেমেয়ে বেশ সুখে এই বড় জমিদার বাড়িতে অলস জীবন কাটায়। তাদের তেমন কোন কাজ ছিলনা, লেখাপড়াও ছিলনা। তাঁদের মধ্যে একমাত্র সামিনা চালাক, বাকিরা আস্তো গাধা। সামিনা তাঁদের নেতা, অন্যরা সাগরেদ। তাদেরে নামাজ শিখাতে গিয়ে হুজুররা গলদঘর্ম। হুজুর বলেন, লি ইলাফি ক্কুরাইশিন। সামিনা পড়ে, লেইলাফি কুরাইসিন। হুজুর বলেন, ফাইজা ফারাগতা ফানসাব। সামিনা পড়ে, ফাইজা ফাড়া খেতা ফানসাব। ঘরের সবচেয়ে মেধাবী সামিনার যদি এই অবস্থা হয় তবে ভাবুনতো অন্যদের কি হাল হতে পারে। তাদেরে স্কুলে পড়ানো আকাশকুসুম কল্পনা। তাই আমার মনে মনে বেশ ঈর্ষে হত, আহারে তাঁদের কি আরাম, পড়াও নেই, কাজও নেই। খালি খাওন, ঘুমন আর খেলন।
হায়রে কি ভীষণ জ্বালা আমাদের, পড়তে পড়তে দমবন্ধ হবার দশা। আর তাঁদের সময় কাটে আমাদের সাথে সারাদিন খেলাধুলা ও হৈ হল্লা করে, নচিন্তা ডুফুর্তি।
স্বাধীনতা লাভের পরক্ষণের কাহিনী, তখন যুদ্ধবিদ্ধস্থ দেশে অভাবের তীব্র খড়াঘাত। ফকির, ভিক্ষুক ও তস্করে দেশ ছেয়ে গেছে। সেইসাথে চারপাশে অজস্র ছোট ছোট ছিচকে চুরির ঘটনা নিয়মিত ঘটছে। ধরা খেলে অভাবের তাড়নায় নিতান্ত বাধ্য হয়ে চোর হওয়া লোকদেরে করা হয় অমানুষিক নির্যাতন।
একদিন ভোরে দেখা গেল নানাবাড়ির মসজিদের ওয়ালঘড়ি নেই। রাতে কোন এক চোর মহাশয় এই কমদামী ঘড়িটি চুরি করে নিয়ে গেছেন। চোর ঘড়িটি নিয়ে কাছের এক গ্রামে বিক্রি করে দেন। ঘড়ি উদ্ধার হল, সাথে চোরকেও গ্রামবাসী ধরে নিয়ে এলো। এই চোর অন্য দশজন সাধারণ চোরের মত কেউ নন, তিনি টুপি পাজামা পাঞ্জাবীপরা ইয়া দাড়িওয়ালা একজন পরহেজগার হুজুর। পরিচয় নিয়ে জানা গেল তিনি দুরের গ্রামের কোন এক ভদ্রঘরের সন্থান।
লোকজন তাকে উত্তম মাধ্যম দিতে উদ্যত হলে চোর মিয়া বললেন আমার কিছু কথা বলার আছে, আগে আমাকে আপনারা আমার বক্তব্য রাখতে দিন, তারপর যা খুশি করবেন। আমার সব কথা শুনার পর আপনারা বিচার করবেন, তখন আমাকে যে শাস্তি দিবেন মাথা পেতে নেব। মৌলানা মাহমুদুর রহমান মামু চোর হুজুরকে তার বক্তব্য পেশ করতে বললেন।
এবার চোর হুজুর বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম পড়ে আল্লাহ ও রসুলের নাম নিয়ে তার বক্তব্য ছুড়লেন ‘আমি মাওলানা মোহাম্মদ ছলিমউদ্দিন জুতিরবন্ধের মোল্লাবাড়ির লোক। সেই গ্রামে আমাদের পরিবারের বেশ নামডাক। আমার গোষ্টির লোকজন সবাই বড় বড় আলেম, কেউ চোর নেই, কেবল আমিই এই ঘড়ি চুরি করে সেইদিন পহেলাবারের মত চোর হয়েছি। আমার ঘরে গত দুইদিন ধরে কোন খাবার নেই। সবাই উপোষ আছে। আমাদের মত ভদ্রঘরের লোকরা যেখানে সেখানে হাতপাততে পারেনা। সারাদিনে কিছুই রোজগার হলনা। কোন টাকা জোগাড় করতে পারিনি যা দিয়ে খানিকটা চাল কিনে নিয়ে বাড়ি ফিরি। এই মসজিদে রাতে এশার নামাজ জামাতে পড়ে নিরাশ হয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকি। লোকজন একে একে সবাই চলে যায়।
এক সময় দুহাত তুলে আল্লাহকে বললাম হে মাওলা সারাদিনে কিছুই জোগাড় হলনা, এবার আমার চুরি করা ছাড়া আর কোন পথ খোলা নেই। উপবাসী বউ বাচ্চাদের মুখে দুমুঠো ভাত তুলে দিতে আমাকে শেষমেষ যদি চোর হতেই হয় তবে আল্লাহ তোমার মালই চুরি করব। হে আল্লাহ, আমি তোমার ঘরের মাল এই ঘড়িটা চুরি করলাম, আমাকে ক্ষমা করে দিও’। এই বলে আমি মসজিদের ঘড়িটি চুরি করে রাতের অন্ধকারে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে চালডাল কিনে বাড়ি ফিরলাম ও দুদিনের উপবাসী বাচ্চাদের মুখে ঝাউভাত তুলে দিলাম।
এবার চোর হুজুর বললেন আমার বক্তব্য এখানেই শেষ, আপনারা আমার বিচার করুন। এই চোরের সাথে জামাতে এসার নামাজ পড়া মৌলানা মামুর চোখে জলের ফোটা দেখা গেল। চোরের বক্তব্য শুনে মৌলানা মামা নিজের পকেট হতে টাকা বের করলেন, চারপাশ হতে চাঁদা তুলে প্রচুর টাকা চোরের হাতে তুলে দিয়ে বললেন এই টাকা নাও, কিছু একটা করে খাও, দেখ খোদা কিবা করে। চোর হুজুর তিরস্কারের বদলে পুরস্কার পেয়ে হাসিমুখে ফিরে গেল।
বড়মামা আব্দুর রহমান চৌধুরী ছাদ্দিক আশপাশের চাবাগানে ও বনে এয়ারগান নিয়ে ছুটতেন পাখি শিকারে। গুলিখেয়ে পাখি পড়ামাত্র আমরা কুড়িয়ে জবাই করে ব্যাগে পুরতাম। নানা বর্ণের নানা আকারের বৈচিত্রময় ভারী সুন্দর সুন্দর এইসব পাখি নিধন আমার খারাপই লাগত, বালক ছিলাম, তাই শখের বশে পিছুপিছু ছুটতাম। তবে বড় হবার পর পাখিশিকারকে আমি মনেপ্রাণে ঘৃণা করতে শিখি। বড় হয়ে বুঝলাম, বন্যরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃক্রোড়ে। একবার বেশ কিছু জীবিত পাখি শিকারিদের কাছ থেকে কেনে আমি বনে ছেড়ে দেই। মামা আব্দুর রহমান চৌধুরী ওরফে ছাদ্দিক চানভাগ চাবাগানে দীর্ঘদিন ব্যবস্থাপক ছিলেন।
মেঝমামা ফজলুর রহমান চৌধুরী ওরফে সিদ্দিক ছিলেন বি কম পাস, তিনি চট্টগ্রাম পেপার মিলে চাকুরি করতেন। তিনি ছুটিতে এসে চাকতিঘুরা কলেরগান বাজাতেন- সন্ধ্যা রানির মধুর কন্ঠের গান ‘চন্দনের পালঙ্কে শুয়ে একা একা কি হবে, ও গো তোমায় যদি পেলাম না’। কিংবা ‘আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যার দেশে, সাত সাগর আর তের নদীর পারে। /ময়ুর পঙ্কী সাজিয়ে এলাম সেথা, আমি দেখে এলাম তারে’। সেকালে পাতারিয়ায় খুব চোরের উপদ্রপ ছিল। রাতে বাড়িতে চোরের পদশব্দ শুনলে মেঝমামা সিদ্দিক চোর তাড়াতে উচ্চশব্দে ক্যাসেট বাজাতেন। তাতেও কাজ নাহলে রুলার দিয়ে টিন পেটাতেন।
অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে আমার এই দুইজন প্রিয় মামা আজ আর নেই। এই কিছুদিন আগে ৫ম জানুয়ারি ২০২৫ মেঝমামা ফজলুর রহমান চৌধুরী ওরফে সিদ্দিক ভার্জিনিয়ায় এবং ২৯ আগস্ট ২০২৫ বড়মামা আব্দুর রহমান চৌধুরী ছাদ্দিক নিউইয়র্কে দেহত্যাগ করেন। তাদেরকে আমেরিকায় দাফন করা হয়। মহান আল্লাহ পাক তাদেরকে জান্নাতুল ফেরদাউস দান করুন। আমিন।
ছোটমামা শহীদ চৌধুরী দিনরাত ব্যস্ত থাকতেন খেলার জগতে, কখনো রেডিও বাজিয়ে খেলার ধারাভাষ্য শোনে, কখনো দক্ষিণভাগ হাইস্কুলের মাঠে ফুটবল খেলায়। ছোটমামা বাঁশি বাজাতেন আর আমরা বল নিয়ে মাঠে মহানন্দে ফুটবল খেলায় নিমগ্ন হতাম। দক্ষিণভাগ বাজারে ব্যাডমিন্টন টুর্নামেন্ট হত, এই টুর্নামেন্টেরও পরিচালক ছোটমামা শহিদ চৌধুরী। টুর্নামেন্টে অংশ নিতেন ড্রাগন ক্লাব, ফেন্ডাস্টিক ক্লাব, লায়ন ক্লাব, টাইগার ক্লাবসহ সুন্দর সুন্দর নামের অনেকগুলো ক্লাব। বৈদ্যুতিক বাতির আলোয় শীতের রাতে আমরা ব্যাডমিন্টন খেলে ঘেমে ভিজে ঘরে ফিরতাম। ছোটমামার বাইসাইকেল চালিয়ে মাঝে মাঝে রশিদাবাদ, ধামাই ও সোনারোপা চাবাগানে চক্কর দিতাম। ছোটমামা খেলাধূলা শেষ করে প্রায়ই মধ্যরাতে বাড়ি ফিরতেন।
পাশের রশিদাবাদ চাবাগানের ম্যানেজার ছিলেন আমার মেঝ দুলাভাই আব্দুল কুদ্দুস চৌধুরী। বাগানের জিপে সেই বাগানের সুউচ্চটিলার উপর নির্মিত সুরম্য কুসুমফুটা বাংলোয় গিয়ে সবাই আনন্দফুর্তি করে দিনরাত কাটিয়ে দিতাম। কারখানার ঢুকে চা তৈরীর কর্মপ্রবাহ দেখতাম। বাগান মালিক জেবা রশিদ চৌধুরী এলে প্যান্ট পরে একটি ফিফটি মোটর সাইকেলে সারাটা বাগান পরিদর্শন করতেন। কেমব্রিজ শিক্ষিতা জেবা আপা প্রাক্তন মন্ত্রী ও স্পিকার হুমাউন রশিদ চৌধুরীর বোন। তিনি বেশ স্নেহশীলা আধুনিক নারী। জেবা আপা আদর করে একজন চাশ্রমিককে গরম চাইনিজ স্যুপ খেতে দেন। জীবনে প্রথম চাইনিজ স্যুপ মুখে দিয়ে সে বেশ বিপদে পড়ে, পাশে মালিকায়ে আলিয়া, না পারছে খাইতে, বা পারছে ফেলতে। জেবা আপা সরে গেলে তাঁকে সুধাই, চাইনিজ স্যুপ কেমন লেগেছে রে রতন। সে জবাব দেয়, কি খাওয়াইলো বিবিসাব, ভাতের মাড় না কচু। জেবা আপা একবার তাঁর লেখা একটি ছোট্ট গল্পের বই আমার হাতে তুলে দেন। রশিদাবাদ চাবাগান কর্মী রবি ও নীলমণি আমাদের সেবাযত্ন করত।
নানাবাড়ির রান্নার কিছু স্টাইল ছিল, কিছু স্পেশাল ব্যঞ্জন ছিল, যা অন্য কোথায়ও বিরল। চুঙ্গাপুড়া ও রুইট পিঠার কথা আগেই বলেছি। এখানে হাঁসের সাথে বাঁশ ছিল আরেক তরকারি আইটেম, এই ব্যঞ্জনে বাঁশের কচিমূল মিহি করে কেটে হাঁসের মাংশ দিয়ে রান্না করা হত। নানাবাড়ির আশপাশের পাহাড়ে গুঙ্গা এবং গর্তআলু হত। গুঙ্গা তরকারি পাহাড়ে হওয়া এক ধরনের গাছের লাল রঙের নরম মূল। তরকারী হত পিচ্ছিল। আমার তেমন ভাল না লাগলেও তা পাতারিয়ার লোকজনের বেশ প্রিয় খাদ্য ছিল এই গুঙ্গা। গর্তআলু পাহাড়ের গর্তে একধরনের লতাজাতীয় গাছের বেশ বড় নরম মূল, যা আলু গাজর ইত্যাদির মত জন্মাত। আলু কালারের এই খাবার ছিল বেশ মজাদার। বিরল এই দুই তরকারীই ছোট চিংড়ি, মাছ, মাংশ কিংবা শুটকি দিয়ে রান্না করা হত।
ছোটমামার সাথে দক্ষিণভাগ রেলস্টেশন মাস্টারের বন্ধুত্ব ছিল। ট্রেনের আগমনের শব্দ শুনে মেহমানরা ট্রেন ধরতে ঘর হতে বের হতেন। সবাই রয়েসয়ে ছুটতেন কেবল ছোটমামা দৌঁড়ে গিয়ে স্টেশন মাস্টারকে ট্রেন একটু লেট করতে বলতেন। মামার খাতিরে ট্রেন ছাড়ার সবুজ ফ্ল্যাগটি আর উড়তনা, সবাই ধীরপদে এসে ভালভাবে ট্রেনে ঊঠা শেষ হলে তবে সবুজ কাপড় উড়ত ও সেইসাথে হুইসেল দিয়ে ট্রেন যাত্রা শুরু করত। ছোটমামা শহিদ চৌধুরী ছিলেন বলবান ও সিংহের মত দুঃসাহসী। এই এলাকার দুইজন ভয়ঙ্কর মাস্তান ছোটমামার ছুরিকাঘাতে ঘায়েল হওয়ার কাহিনি প্রচলিত থাকায় লোকেরা তাকে যেমন মান্য করত, তেমনি জমের মত ভয়ও করত। ছোটমামা শহিদ চৌধুরীর পাশে দুইজন সার্বক্ষণিক বডিগার্ড ছিলেন নমির আলী ও বিধান বাবু।
তিনমামার বিয়ের স্মৃতিও সামান্য সামান্য মনে আছে। সৈয়দা হালিমুন্নেছা কুরছি মামি মৌলভীবাজারের মোস্তফাপুরের সৈয়দ বংশের মেয়ে। তিনি আসার সময় আমি কেবল ছয়সাত বছরের বালক মাত্র। নানাবাড়ি কনে আসার পর মনে হল নববধূ দেখে বড়রা খুব একটা খুশি হতে পারেননি। শেষে না খুশের কারণ বুঝলাম, ছাদ্দিক মামা খুব ফর্সা ও সুন্দর কিন্তু মামি সেই তুলনায় নীরস।
মেঝমামা সিদ্দিক বিয়ে করেন আমেরিকান কনে, তিনি নবীগঞ্জের দুর্লভপুরের কহিনুর চৌধুরী। বিয়ের রায়বার ছোটখালু আখলাকুস সামাদ চৌধুরী, কনে তাঁর বন্ধুর মেয়ে। এই কনে দেখে সবাই খুশীতে আটকানা। এযেন চাঁদে চাঁদে মহামিলন। মেঝমামার শালা মুরাদ মামা আমার চেয়ে খানিক ছোট ছিল, সে মিষ্টি গলায় গান গেয়ে শুনাত- “সে যে কেন এলোনা, কিছু ভাল লাগেনা, এবার আসুক তারে আমি মজা দেখাব”। এই দুই বিয়েই ১৯৭৩ কিংবা ১৯৭৪ সালে সুসম্পন্ন হয়। কেবলমাত্র ছোটমামা শহিদ চৌধুরীর বিয়েতে অনুশহর বড়লেখা পার হয়ে দাশেরবাজারের সন্নিকটে লঘাটি নামক গ্রামে বরযাত্রী হয়ে গমন করি। কনে সাহেদা বেগম চৌধুরী। আমরা ছোটমামার শ্বশুড় শ্বাশুড়ির বেশ স্নেহমমতা পাই।
তিনি মোহাম্মদ মুহিত চৌধুরী, আম্মার ভাই মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরীর একমাত্র পুত্র। সুদর্শন গৌরবর্ণ মুহিত ভাইয়ের  অর্ধপাকা টিনছাদের ঘর। তিনি একাকি থাকতেন। এই ঘরের খুঁটিতে গাঁথা ছিল আমার নানার শিকার করা দুই তিনটি হরিণের বহুডাল বিশিষ্ট শিং। মুহিত ভাইয়ের পরনে চকচক করত সাদালুঙ্গি ও সাদাসার্ট। মামি ছিলেন জকিগঞ্জের বালাউটের মেয়ে ও তার মাথায় পাগলামির দোষ ছিল। এর একটু ছিটে এসে তার একমাত্র পুত্র মুহিত ভাইকে আচর দেয়। তার কথায় কথায় দেওয়ান চৌধুরীর ঢেকুর বেরুত।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে উঠানো মুহিত ভাইয়ের একটি ছবি তিনি খুব সযতনে আলগে রাখতেন, লোক সমাগম ঘটলে গর্বের সাথে বের করে সেই ছবি দেখাতেন। এক সময় বলতেন বঙ্গবন্ধু তার কাছে শেখ হাসিনাকে বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। হায়রে পোড়াকপাল, হেনতেন করে করে সুযোগটা হাতছাড়া হয়ে গেল।
তার একমাত্র পুত্র সুহেল ব্লুবার্ড স্কুলে পড়ত। তিনি স্কুল কমিটির ভোটে খাড়া হয়ে ভোটারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে নির্বাচনে পাশ করে ব্লুবার্ড স্কুল কমিটির সদস্য হবার আপ্রাণ চেষ্টা করে বারবার ব্যর্থ হন। অথচ আমি পুত্র জেফারের শিক্ষকদের অনুরোধে নির্বাচনে গিয়ে সহজেই জিতে ব্লুবার্ড স্কুল ও কলেজ কমিটির সদস্য হই।
মুহিত ভাই তাঁর একমাত্র ছেলে সুহেলকে নিয়ে মিরেরময়দানের রাস্তায় হাঁটতেন ও তাঁকে কাছে নিয়ে আসতেন। আমাকে টেনে ধরে তার বাসায় নিয়ে চা পান করাতেন। তাঁর লেখা ছোট্ট ডায়রি পড়ে শুনাতেন। একদিন জন্ডিস হয়ে অল্প বয়সে এই সহজসরল মানুষটি সিলেট শহরে মারা যান। আমরা তাকে হজরত শাহজালালের মাজারে দাফন করি। তিনি আমাকে খুব গুরুত্ব দিতেন ও স্নেহ করতেন। আল্লাহ তাকে জান্নাত নসীব করুন। জেট।
নানি রফিকুন্নেসা চৌধুরী ছিলেন পাতারিয়ার এই প্রতাপশালী বাড়িটির মধ্যমনি। মুরগি যেমন তার বাচ্চাদেরকে ডানার তলায় জড়িয়ে রাখে, নানিও তেমনি সুদীর্ঘকাল তার সব আন্ডাবাচ্চা ও পালিত এক দঙ্গল লোকজনদেরে প্রশস্থ পালকতলায় নিরাপদে সযত্নে আগলে রেখেছিলেন। তিনি দুইহাত ভরে টাকাকড়ি, ধানচাল ও মালামাল বিলিয়ে দিয়ে মানুষকে সাহায্য করতেন। এজন্যই হয়ত তাঁর হাতে আল্লাহ পাক এত রহমত, বরকত ও নিয়ামত দান করেন। মানুষ তাবিজ ও টুটকা নিতেও নানির কাছে আসত। কি সব পড়ে ফুঁক দিতেন, মানুষ ভাল হয়ে যেত।
নানি মারা যান ১৯৮৩ খৃষ্টাব্দের ২০শে মার্চ। আম্মা আসমতুন্নেসা ও আমার অগ্রজা আনিসা মান্না তখন তার সেবাশুশ্রূষার জন্য বেশ কিছুদিন ধরে নানাবাড়িতে ছিলেন। তাদের চোখের সামনে নানি প্রায় আশি বছর বয়সে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। সেদিন নানির অন্য দুই কন্যা আবেদা খানম জবা ও মরিয়মুন্নেসা উপস্থিত ছিলেন। জীবনের সুর্যাস্তবেলায় নানি বহুমূত্র, রক্তচাপ ও হৃদরোগে ভূগতেন। তার খাবারের রুচি চলে যায়। আমি ও আব্বা নানির শারীরিক অবনতির খবর পেয়ে ট্রেনে নানাবাড়ি পৌছে নানিকে জীবিত পাইনি। তার লাশ তখন পালঙ্কে সাদা কাপড়ে ঢাকা ছিল ও তার চারপাশে বসে সবাই ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছিলেন।
সময়টা ছিল বসন্তকাল। বাড়িতে আম কাটাল লিচু ফুলের সুবাস ছিল, সেইসাথে ছিল মক্ষিকার গুনগুন গুঞ্জন। তখন বাহিরে কুকিলের কুহুকুহু ডাক শুনা যায়। চৈত্রমাসের ঐদিনই বাদআসর বাড়ির দিঘির পূবপারের খোলা চত্বরে জানাজা শেষে তাকে সামনের পারিবারিক কবরগায় দাফন করা হয়।
নানির মৃত্যুর মাত্র এগার বছর পর ২৯ মে ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে এই প্রভাবশালী বাড়িটির সব লোকজন দেশ ছেড়ে সুদূর যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। আপনপর লোকজন যে যা পারে এবাড়ি হতে নিয়ে নিয়ে যায়। আমার আম্মা আসমতুন্নেছা নিয়ে আসেন তার জনকজননীর মৃত্যুর তারিখ লেখা একটি মনোগ্রাম, যা এখনও আমাদের দাউদপুরের গ্রামের বাড়ির ওয়ালে ঝুলে আছে। পরবর্তীকালে ধাপে ধাপে পাতারিয়ায় নানাবাড়ি সংলগ্ন হাওরের অধিকাংশ কৃষিজমি বিক্রি হয়ে যায়।
বছর কয়েক আগে অফিসের জিপে নানাবাড়িতে গিয়ে হাজির হই। উঠোনে দাঁড়িয়ে মনে হল এটা যেন এক বিরানভূমি। বাড়িতে অসুস্থ্ হাসমতি ঝি তার একদঙ্গল অর্ধউলঙ্গ বংশধর নিয়ে আবর্জনার রাজ্যে পড়ে আছেন, তার চারপাশে প্রচুর মাছি উড়াউড়ি করছে।
সামনের দিঘিপারের মসজিদে গিয়ে দেখি সেখানে তাবলীগ জামাতের একদল লোক ডেগডেগসি ও গাট্টিবুচকাসহ অবস্থান করছেন, তাদের কেউ কেউ রাঁধছেন, কেউবা ঘুমাচ্ছেন। সারি সারি আগর গাছ গহিন অরণ্য রচনা করে নিসর্গে শ্যামল নিঃশ্বাস ফেলছে।
কার ধন কে খায়, কার ঘরে কে বা ঘুমায়। বাংলাদেশে এই বড়বাড়ির কোন মালিক নেই, তারা সবাই আমেরিকায়, সেখানে সুখে তাঁরা জীবন কাটায়। এই বাড়ির বংশধর কেউ আর ফিরবেনা, ফিরে এলেও এখানে একদিনও তাঁরা খাপ খাওয়াতে পারবেনা। মায়ের আগের প্রজন্মের যারা খুব যতনে কয়েক যুগে এই বড়বাড়ি সাজিয়ে ছিল, তাঁরা কি ভেবেছিল, একদিন তাঁদের এই স্বপ্নপুরিতে ঘুঘু চরাবে। এবাড়ির ইতিহাস রচিবার মত কেউ আর থাকবেনা। এবাড়ির ভবিষ্যৎ চিরশূন্য অন্ধকার। এবাড়ির উপাখ্যান হয়ত আমার এই লেখার মাধ্যমে সমাপ্ত হয়ে গেল।
 
 
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন