এম সি কলেজের অম্লমধুর স্মৃতি, কখনও হবেনা ইতি
সেশনঃ ১৯৮১-৮২, চুড়ান্ত পরীক্ষা বর্ষ- ১৯৮৩ সাল, অবস্থানঃ জুন ১৯৮১ হতে আগস্ট ১৯৮৩ সাল
আমাদের সময় সিলেট মুরারিচাঁদ কলেজ তথা এমসি কলেজকে বলা হত সিলেট সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ। আব্বা সফিকুর রহমান চৌধুরী ১৯৩৭ সাল হতে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত এই এমসি কলেজের ছাত্র ছিলেন। পিতার প্রস্থানের চল্লিশ বছর পর আমি এমসি কলেজের একাদশ বিজ্ঞানে ভর্তি হই।
এই কলেজে আমার পদচিহ্ন আঁকার প্রায় নব্বই বছর আগে ১৮৯২ সালে কলেজটির জন্ম হয়। সিলেটের বিখ্যাত জমিদার রাজা গিরিশ চন্দ্র রায় তার পালক পিতা মুরারী চাঁদের নামে কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেন। আমার আগে এখানে অধ্যয়ন করেন চাচাত ভাই প্রথম সিলেটি আইজিপি ই এ চৌধুরী, চাচাত ভাই সচিব ও সাহাবউদ্দিন সরকারের উপদেষ্টা ইমামউদ্দিন চৌধুরী, চাচাত ভাই গ্রীনডেল্টা ইন্সুরেন্স কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা কিংবদন্তী বিমা ব্যক্তিত্ব নাসির এ চৌধুরী, ফুফুত ভাই বিখ্যাত শিক্ষাবিদ ও শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ভাইস চেন্সেলর ডঃ সদরউদ্দিন চৌধুরী, ফুফুত ভাই সড়ক ও জনপথ বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী ও পিএসসির সদস্য বদরউদ্দিন চৌধুরী। তাছাড়া অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান, শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, মন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতসহ সিলেট অঞ্চলের প্রায় সব সম্মানিত ঐতিহাসিক ব্যাক্তিবর্গ এই কলেজের ছাত্র ছিলেন।
ঐতিহ্যবাহী এই কলেজটি ছিল সিলেট বিভাগের তৎকালীন সময়ের
সেরা বিদ্যাপীট। তখনকার দিনে জালালাবাদ ক্যান্টনমেন্ট কলেজ, ব্লুবার্ড স্কুল এন্ড কলেজ, স্কলার্সহোম কলেজ কিংবা এত প্রাইভেট কলেজের
ছড়াছড়ি ছিলনা। সেকালে এই অঞ্চলে শিক্ষার গুণেমানে এমসি কলেজের কোন তুলনা ছিলনা, তাই সিলেট বিভাগের
এসএসসি উত্তীর্ণ বিজ্ঞানের সেরা ছাত্রছাত্রীরা এই কলেজে ভর্তি হতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করতেন।
১৯৮১ সালে এসএসসি পরীক্ষার
ফল বের হবার পর এমসি কলেজে একাদশ বিজ্ঞানে
ভর্তির ফরম ফিলআপ করতে এপ্রিল কিংবা মে মাসে এক সকালে দাউদপুর হতে বের হলাম। মা আসমতুন্নেসা চৌধুরী খুবভোরে উঠে তাড়াতাড়ি রান্নাবান্না করে খাইয়ে উদ্ভিঘ্ন মনে “ফিআমানিলিল্লাহ” বলে
আমাকে বিদায় জানান। মায়ের উদ্বেগের কারণ
আমি তার চোখে তখনও বাচ্চাছেলে, শহরে গিয়ে নাজানি যদি হেরেটেরে যাই। তখন আমার বয়স
মাত্র পনের ষোল বছর এবং এটাই আমার প্রথম একাকী শহরযাত্রা। মাকে বললাম ভয়ের কোন কারণ নেই, আমি এখন যথেষ্ট সাবালক, আমি সব বুঝি এবং নির্বিঘ্নে
সব করে নিতে পারব। পাহাড়লাইনের মুড়িরটিন মার্কা বাসে চড়ে কদমতলী টার্মিনালে এসে নামি। কদমতলী থেকে সুরমাপারের চিরচেনা পথে হেঁটে হেঁটে কিনব্রিজ পার হই। সুরমা সেতু রিকশায় চড়ে অনেকবার পার হলেও এই প্রথম পায়ে হেঁটে
পার হলাম।
মাত্র ছয়সাত মাইল দূরে বাড়ি হলেও
এই সিলেট শহরের কোন অলিগলি আমার চেনাজানা ছিলনা। টিলাগড় কোনদিকে তাও জানিনা, তাই একটি
রিকশায় ছুটলাম। এই রাস্তার দুই দিকের সাইনবোর্ড পড়ে পড়ে বাজারগুলোর নাম মিরাবাজার, শিবগঞ্জ ও টিলাগড় মনে গেঁথে নিলাম। কারণ এই পথে আগামি দুই বৎসর আমাকে ঘুরপাক খেতে হবে। কলেজ গেটে রিকশা হতে নেমে জীবনের এই
প্রথমবার আমার দীর্ঘ প্রতীক্ষিত ও বহুকাংখিত এমসি কলেজের সামনে দাড়াই। প্রশস্ত গেটে খোদাই করে লেখা সিলেট সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ। কলেজটিও যেন আমাকে স্বাগত জানাতে শত বছরের ঐতিহ্য ধারণ করে বেশ কটি পরিপাটি টিলা ও নান্দনিক বৃক্ষরাজি বুকে নিয়ে শিরউঁচু করে সামনে নীরবে দাঁড়িয়ে আছে। সারাদিন মহানন্দে কলেজের সবুজ টিলায় টিলায় ঘুরাঘুরি করে বাদ মাগরেব যখন ঘরে ফিরে এলাম, তখন মনে হল মায়ের সারাদিনের অবিরাম দুশ্চিন্তা ও
মহাঅপেক্ষার অবসান হল, তিনি যেন সকালবেলা হারিয়ে যাওয়া তাঁর মানিক রতন আবার রাতের আঁধারে ফিরে পেয়েছেন।
সিলেট বিভাগের হাইয়ার সেকেন্ড ডিভিশন ও প্রথম বিভাগ পাওয়া সাত শতাধিক ছাত্রছাত্রী একাদশ বিজ্ঞানে ভর্তি হবার জন্য আবেদন করেন। ভর্তির জন্য কোন লিখিত পরীক্ষার বিধান ছিলনা। তবে এসএসসি পরীক্ষায় মার্কসিটে প্রাপ্ত নম্বর বিবেচনা করা হয় এবং শিক্ষকরা ভর্তির জন্য আমাদের একটা মৌখিক পরীক্ষা নেন। এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার পর অবসর সময়ে তুড়ুকখলার দীপক চক্রবর্তী ও কয়েকজন ছাত্র আমার কাছে এসে টিউশনি পড়ে। ফলে বিজ্ঞান ও গণিত আমার মনে সতেজ ছিল। স্যাররা নবম ও দশম শ্রেণি পর্যায়ের গণিত, বিজ্ঞান ও ইংলিশ বিষয়ে প্রশ্ন করেন। মৌখিক পরীক্ষার সবকটি উত্তর দেই অনায়াসে। ভর্তির সিট সংখ্যা মাত্র তিনশত, নির্দিষ্ট দিনে উত্তীর্ণদের তলিকা অফিসের সামনে নোটিশ বোর্ডে টেনে দেওয়া হল। ভয়ে ভয়ে নোটিশ বোর্ডে চোখ বুলিয়ে আমার নাম ও নম্বর দেখে আনন্দে লাফিয়ে উঠি। স্রষ্টার অপার মেহেরবানিতে কাংখিত এই স্বপ্নের কলেজে ভর্তি হবার দুর্লভ সুযোগ খুব সহজেই পেয়ে গিয়ে মহান আল্লাহপাকের দরবারে অশেষ কৃতজ্ঞতা জানাই। দুঃখ পেলাম, যখন দেখি মোগলাবাজার রেবতী রমন উচ্চবিদ্যালয়ের আমার প্রিয় সহপাঠি তৌহিদুল ইসলাম টিপু ও বেলাল আহমদ এখানে ভর্তি হবার সুযোগ পায়নি।
আব্বা সফিকুর রহমান চৌধুরী ছাত্র থাকাকালে উচ্চমাধ্যমিকে এখানে কলা ও বানিজ্য বিভাগ চালু ছিল, পরে পাশে সরকারি উচ্চমাধ্যমিক কলেজ প্রতিষ্ঠার পর এখানে কেবল বিজ্ঞান
চালু রেখে অপর দুইটি বিভাগ বন্ধ করে পাশের নতুন কলেজে স্থানান্তর করে দেওয়া হয়।
১৯৮১ সালের জুনে সিলেট সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের (বর্তমান এমসি কলেজ) একাদশ বিজ্ঞানে তিনশত বিশ জন ছাত্রছাত্রী ভর্তি হই। শিক্ষার্থীগণকে “এ” এবং “বি” দুই সেকশনে ভাগ করা হয়। বেজোড় সিরিয়াল নম্বরের ছাত্ররা সেকশন- “এ” এবং জোড়রা সেকশন- “বি” তে অন্তভুক্ত হন। আমার সিরিয়াল নম্বর ১১৭; সংখ্যাটি বেজোড় হওয়ায় “এ” সেকশনে আমি ঠাঁই পাই। “এ” সেকশনের একশত ষাট জন ছাত্র একসাথে লেখাপড়া করে যৌবনের মধুময় দুইটি বৎসর চোখের পলকে পার করে দেই। “বি” সেকশনের সহপাঠিদের সাথে কলেজের চত্বরে, রাস্তায়, খেলার মাঠে, কলেজ হোস্টেলে, ছাত্র মিলনায়তনের ইনডোর গেইমে টিনের পাকাঘরে, অডিটোরিয়ামে ও কেন্টিনে মাখামাখি হত।
বিশাল এই সুন্দর কলেজে জায়গার পরিমান ১২৪ একর। টিলাগড়ের অনন্যসুন্দর বেশ কয়েকটি টিলা ও ধাপে ধাপে উঁচুনিচু সমতল সবুজ চত্বর নিয়ে কলেজটি গঠিত। কলেজ চত্বর জুড়ে সব সময় বিরাজ করে এক মধুময় নীরবতা। এই কলেজে টিলার পিঠে টিলা একে অন্যকে জড়িয়ে আছে। এমসি কলেজে ঢুকার দুটি গেট ছিল। পিছনের ঈদগাহ রোডের গেটদিয়ে হোস্টেলের ছেলেরা কলেজে ঢুকতো।
সামনের তামাবিল সড়কের পাশের
প্রধানগেট দিয়ে ঢুকে
ডানের নিম্নভুমিতে দুইটি লালটিনের ছাদঢাকা পুর্ব-পশ্চিম বিস্তৃত সুদীর্ঘ পাকাভবন, রাস্তার সমান্তরালে উত্তরদিকের ভবনে ল্যাবরটরিসহ রসায়ন বিভাগ ও দক্ষিণদিকের ভবনে ছিল
ইতিহাস, অর্থনীতি ও বাংলাবিভাগ। বামের টিলার ধাপে ছাত্রী মিলনায়তন ও আটত্রিশটি সিঁড়িবেয়ে উপরে উঠে বৃটিশামলে
নির্মিত সুন্দর কলেজ অফিস। এই অফিসে রয়েছে অধ্যক্ষের কার্যালয় ও সাধারণ শিক্ষক মিলনায়তন।
অফিসের চারপাশে ছিল ঝাউবন ও পুষ্প উদ্যান।
অফিসের পশ্চিমের টিলায় এমসি
কলেজ পাঠশালায় কমলা রঙ্গের সার্ট ও সাদা প্যান্টপরা শিশুরা যখন পাহাড়ের ঢালুতে কৃষ্ণচূড়া বৃক্ষের তলায় দল বেঁধে লুটোপুটি
খেত তখন মনে হত এযেন কমলা রঙ্গের শিশুমেলা বসেছে।
কলেজের অফিসটিলা হতে নিচে
নেমে সামনের টিলায় সিঁড়িবেয়ে ঊঠে অপূর্ব সুন্দর বৃটিশ নির্মাণশৈলীতে নির্মিত দুতলা
কলাভবন। কলেজের প্রতিষ্ঠালগ্নে
এক বিশাল টিলাকে কেটে সমতল করে কলাভবন চত্বর সাজানো হয়েছে। কলাভবনের বামে টেনিস গ্রাউন্ড ও চারপাশ জুড়ে সমতল সবুজ
ঘাসচত্বর, চত্বরের কিনারা জূড়ে ছিল সারি সারি ঝাউগাছের সুরম্য বন ও নানান জাতের
বিদেশী বৃক্ষের বিচিত্র সমাহার। বেশ কয়েকটি লম্বা পামগাছ ভবনের ছাদ ছুঁয়ে আছে। পামগাছ পেচিয়ে পেচিয়ে সাপের মত মানিপ্লান্ট বড় বড় পত্রসহ আগা ছুঁয়ে আছে। এই বনবীথির ফাঁকে ফাঁকে ছিল বসার সারি সারি ব্রেঞ্চ।
যে ব্রেঞ্চে বসে আমরা মজার মজার আড্ডা দিতাম কিংবা নীরবে বসে অধ্যয়ন করতাম। এখানে আমরা সহপাঠিরা একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে বসে কত যে
রঙ তামাশা করেছি, কুনটুসি মেরেছি, আজ তার হিসাব দেবার মত কেঊ নেই।
অপূর্ব সুন্দর টিলাটির নাম থ্যাকারে টিলা।
বিখ্যাত ইংরেজ সাহিত্যিক থ্যাকারের পিতামহ উইলিয়াম ম্যাকপিস থ্যাকার ১৭৬৫ সাল হতে ১৭৭০ সাল
পর্যন্ত সিলেটের প্রথম ইংলিশ কালেক্টর ছিলেন। উনি যে পাহাড়ে বাসস্থান নির্মাণ করে সিলেটে বৃটিশ শাসনদন্ড পরিচালনা করতেন তাই হল
‘থ্যাকারে টিলা’। কলাভবনের পিছনে ঐতিহ্যবাহী সুউচ্চ এই থ্যাকারে পাহাড়ের উপর বৃক্ষ ও বাগান
সজ্জিত অধ্যক্ষের বাসভবন, এযেন বিদেশী চাবাগানের কোন এক সুরম্য বাংলোবাড়ি। এই বাসভবন হতে টিলাগাত্র পেছিয়ে পেছিয়ে পিচঢালা কালো
রাস্তা নিচে নেমে এসে ঈদগাহ সড়কে পড়েছে। আপাদমস্তক সারাটা টিলাজুড়ে ছিল দেশী বিদেশী বৃক্ষরাজীর অপূর্ব মিলনমেলা।
আমাদের সময়ে এই ভবনের বাসিন্দা ছিলেন অধ্যক্ষ গোলাম রসুল, যিনি সিলেট শহরের হাওয়াপাড়ার সন্তান, খাঁটি সিলেটি কুট্টি। আমাদের পুরাটা সময়ই তিনি এই কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন ও আমরা বেরিয়ে যাবার কিছুদিন পর ১৯৮৩ সালের শেষদিকে অবসর গ্রহণ করেন।
আমার শ্বশুর ফুড কন্ট্রোলার এনামউদ্দিন চৌধুরী ২০০৩ সালের ৩০ জানুয়ারি
পরলোকগমন করেন। তাঁকে
হজরত শাহজালালের দরগাহ মসজিদের পিছনের টিলায় দাফন করা হয়। আমার শ্বশুরের মৃত্যুর বছরখানেক
পর জেয়ারত করতে গিয়ে দেখি তার কবরের উপর একটি সমাধিফলক বসানো- অধ্যাপক গোলাম রসুল,
প্রাক্তন অধ্যক্ষ, এমসি কলেজ, সিলেট। বাসায় ফিরে গিন্নীকে বললাম, তোমার বাবা একজন
অতি ভাল মানুষ, তাই মহান আল্লাহতায়ালা কবরেও অধ্যক্ষ গোলাম রসুল স্যারের মত একজন
উত্তম মানুষকে তার বন্ধু ও সঙ্গী করেছেন।
কলাভবনের পুর্বদিকের সিঁড়িবেয়ে নিচে নেমে বিশাল বর্গাকার কাজলদিঘি, যে দিঘির জলে অজস্র লালপদ্ম মুখমেলে শোভা বিতরণ করত। ফুটতো শাপলা শালুক কুমুদসহ নানাবর্ণের জলজ ফুল। এই কাজলদিঘির দুইপারে ছিল পিচঢাকা পথ যা সামনের ছড়াসেতু পেরিয়ে পদার্থবিজ্ঞান ভবনের আঙিনায় পৌঁছে গেছে।
মনে পড়ে কলেজ হতে বিদায়বেলার কোন এক সোনালি দিনে আমরা সহপাঠিরা এই কাজল দিঘিতে জল ছুড়াছূড়ি খেলায় মেতে উঠি। দিঘির সামনে আসা সহপাঠিদের কেউই রেহাই পায়নি। একে
অন্যকে বা কয়েকজন মিলে একজনকে ধরে বেঁধে পাজাকুলা করে এনে জলে নিক্ষেপ করি। দিঘির কিনারা ঘেষে ছিল কোমর কিংবা একবুক জল। সেই মেঘলা গরম মধুভরা দিনে
জুতা মোজা প্যান্ট সার্ট ভিজিয়ে এলোমেলো বেশে সবাই বাসা ফিরে যাই।
দিঘির পশ্চিমপারে ছিল এমসি কলেজ পাঠাগার, এই সমৃদ্ধ পাঠাগারে ছিল সারি সারি মূল্যবান
বই। এই পাঠাগার কেবলমাত্র বই ভান্ডারই নয়, এযেন এক অমূল্য জাদুঘর, যেখানে কলেজের
শত বছরের সচিত্র ইতিহাস রক্ষিত রয়েছে। এখানে আছে কলেজের বিগত দিনের অনেক নামীদামী
অধ্যাপক ও উজ্জ্বল ব্যক্তিত্বদের জীবনী ও তৈলচিত্র, আছে সুসজ্জিত গ্যালারি ও বই পড়ার এক নিরিবিলি পরিবেশ।
দিঘির উত্তরপারে ছিল কলেজ কেন্টিন ও ছাত্র মিলনায়তন, দুটি ভবনই পাকা লালটিনের বড় বারান্দার আলাদা দুটি খোলা ঘর। ছাত্র মিলতায়নে ছিল ইন্ডোরগেমের নানা সরঞ্জাম। এখানে কয়েকটি ক্যারম বোর্ড ও টেবিল টেনিসের বোর্ডে সবসময় ছাত্ররা মহানন্দে খেলা করত। একদল খেলত, অন্যদল দেখত, আড্ডা দিত। এখানে প্রায়ই হৈ হৈ, রৈ রৈ করত ছেলেরা। আমিও সেখানে অনেক খেলেছি, ক্যারম বোর্ডে কিংবা টেনিস বলে বেড মেরে ক্লাসের সময় হয়ে গেলে মাঝপথে খেলা সাঙ্গকরে ছুটে গেছি ক্লাসে। বল ও বোর্ড সাথে সাথে লুফে নিয়েছে অপেক্ষায় থাকা অন্যকেউ।
কলেজ ক্যান্টিনে একটি টেবিলে ছিল
বিস্কুট ও সিঙ্গারা, পাশে মিটসেফে চিনি ও দুধপটের কাছঘেষে কেরসিনের চুলায় বসান গরম
চা। এখানে হত
নগদে লেনদেন, আজকে আমার, কালকে তোমার পালা। এখানে পালা করে বিল দিয়ে খায় দায় ফুর্তি করে ছাত্ররা সবাই।
কাজলদিঘির দক্ষিণপারে ছিল এমসি কলেজ অডিটরিয়াম। ধাপে ধাপে উপরে গিয়ে শেষ সীমানায় রঙ্গমঞ্চ, একতলা ও দুতলা জুড়ে স্থাপিত দুইটি আলাদা বসার গ্যালারি হতে সবাই স্বাচ্ছন্দ্যে স্পষ্ট দেখতে পেত মঞ্চের অনুষ্ঠান। ভর্তির পর আমাদেরকে বরণ করতে বিভিন্ন ছাত্রসংঘটন বেশ কয়েকটি নবীনবরণ অনুষ্ঠান করে। আসল উদ্দেশ্য নবাগতদেরে দলে টানা। এইচএসসির সিলেবাস বিশাল, তাই এখানে ভর্তি হওয়া মেধাবী ছেলেদের রাজনীতিতে জড়ানোর সময় ও সুযোগ কোনটাই ছিলনা। ফলে অনার্স ও ডিগ্রি ক্লাসের ছাত্ররা রাজনীতি ও নেতাগিরি করতেন। তাঁরা ভাষণ দিতেন ও মিছিল করতেন। আমরা ছিলাম নীরব দর্শক।
এবার এমসি কলেজের একটি স্মৃতিময় নবীনবরণ অনুষ্ঠানের
বিবরণ দেব। মনে হয় সেদিন ছাত্রলীগের অনুষ্ঠান
ছিল, কারণ এই অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর দুঃখে অনেক নেতাকে চোখের জল মুছে মুছে তেজস্বী ভাষণ দিতে দেখি।
বক্তারা ঘাতকের হাতে নিহত বঙ্গবন্ধু পরিবারের প্রতিজন সদস্যের নাম উচ্চারণ করে যেন শোকগাঁথা
পাঠ করে যান। তাঁরা বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের বিচারের দাবি জানান। এই সভায় প্যান্ডেলের একটি চেয়ারে বসেন কবি নির্মেলেন্দু গুন। লম্বা দাড়িগোঁফ, খদ্দরের পাজামা পাঞ্জাবি পরিহিত কবি নির্মলেন্দু গুনকে সেদিন টুপিবিহীন
একজন মুসলিম পীরফকির মনে হল।
অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকে “শেখ শেখ শেখ মুজিব, লও লও লও সালাম”, “এক মুজিব লোকান্তরে, লক্ষ মুজিব ঘরে ঘরে”, “আমরা সবাই মুজিব হবো, মুজিব হত্যার বদলা নেবো” এবং “জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু” ইত্যাদি শ্লোগানে সারা অডিটরিয়াম বার বার কেঁপে উঠে।
মাঝে মাঝে ক্যাম্পাসে ইসলামি ছাত্রশিবিরের “নারায়ে তাকবির, আল্লাহু আকবর” এবং “আমরা সবাই শিবির সেনা, ভয় করিনা বুলেট বোমা” শুনা যেত। তাঁদের আরেক সাধারণ শ্লোগান ছিল “বাঁচলে শহিদ মরলে গাজি, আমরা সবাই মরতে রাজি”। টুপিপরা জনকয়েক মোল্লামার্কা সহজসরল ছাত্রদেরে তাঁদের মিছিলে দেখা যেত।
জাসদ ছাত্রলিগের এক অনুষ্ঠানে কর্নেল আবু তাহেরের গুণগান ও জেনারেল জিয়াউর রহমানের মুন্ডুপাত করা হয়। ছাত্র ইউনিয়নের সভায় মঞ্চে এসে বসেন পদার্থবিজ্ঞানের দাড়িওয়ালা শিক্ষক আহমদ আলী স্যার। সেদিন “দুনিয়ার মজদুর এক হও, বাংলার মজদুর, দুনিয়ার মজদুর, এক হও লড়াই করো” শ্লোগান শুনা যায়।
মজার মজার তেজস্বী
ভাষণ শুনে শুনে বেলা পেরিয়ে রাত হত, তখন
রঙ্গমঞ্চে পর্দা পড়ত, নানাবর্ণের
আলো জ্বলে উঠত। কবিতা, কৌতুক ও মঞ্চনাট্য হত, কলেজের ছাত্রছাত্রীরা অংশ নিতেন। সিলেট ও ঢাকার শিল্পীরা সুর ও
সঙ্গীতের লহরী তুলতেন।
এখনও কানে বাজে কোন এক নবীনবরণ
অনুষ্ঠানে আমাদের সিনিয়র ক্লাসের
দুইজন ছাত্র ও ছাত্রী মিলে গাইছেন- “কি জাদু
করিলা, পীরিতি শিখাইলা, থাকিতে পারিনা ঘরেতে, প্রাণসজনী, থাকিতে পারিনা ঘরেতে, কি মন্ত্র পড়াইলা”।
অডিটরিয়ামের পূর্বদিকে এই দিঘিপারে ছিল বুটানিভবন ও সুসজ্জিত বুটানিক্যাল গার্ডেন। এই ভবনের দক্ষিণপ্রান্তে তামাবিল রোডের সাথে ছিল সোনালী
ব্যাংকের একটি শাখা। ব্যবস্থাপক ছিলেন আমার এক দোলাভাই পাতারিয়ার পূবভাগের জামালউদ্দিন চৌধুরী। দিঘির
পুর্বপারে ছিল টিনের একটি পাকা মসজিদ ও অজুর ঘাট। এখানে আমি প্রায়ই জোহরের নামাজ জামাতে পড়তাম।
পিছনের গেটদিয়ে বের হয়ে ঈদগাহ রাস্তা দিয়ে ডানে অগ্রসর হলে প্রথমেই ডানদিকে চোখে পড়ে দুইটি তিনতলা শিক্ষক বাসভবন। আর সামনে এগিয়ে গেলে বামে সুবিশাল এমসি কলেজ মাঠ, যে মাঠটি এত বড় যে এখানে একসাথে পাঁচ ছয়টি ফুটবল মাঠ সাজানো সম্ভব। বাসা ছিল কাছে খরাদিপাড়ায় তাই এই মাঠেও আমার বেশ কয়েক দিনের ফুটবল খেলার স্মৃতি আছে। সহপাঠি পারভেজ, মিয়া আশিক, চট্টগ্রামের সুশান্ত, সুনয়ন, কুমিল্লার স্বপন প্রমুখের সাথে এই ফুটবল মাঠে অনেক খেলেছি, যদিও আমি ভাল কোন খেলাড়ু ছিলাম না কোনদিন। কেবল আনন্দ ও শখের বশে বলের পিছে ছুটাছুটি করে ব্যায়ামের কাজটা সেরে নিতাম।
সিলেট অন্তঃকলেজ ফুটবল ফাইনাল দর্শকভবনের দুতলায় গাদাগাদি হয়ে দাঁড়িয়ে আমরা খেলা উপভোগ করি। ভয় হত আমাদের ভারে যেন ছাদ ভেঙ্গে পড়ে না যায়। বৃটিশ আমলে নির্মিত এই স্থাপনার নিচ দিয়ে মাঠে ঢুকার প্রবেশপথ ও সিঁড়িবেয়ে উপরের তলা খোলা দর্শক চত্বর।
কলেজ মাঠের দক্ষিণে রাস্তা পার হলেই সুপ্রাচীন বৃটিশ আমলের এমসি কলেজ হোস্টেল।
বৃটিশ আমলে নির্মিত পাঁচটি একতলা লালটিনের পনের ফুট উঁচু ছাদের আসাম পেটার্ন পাকা ভবন। প্রতিটি ভবনের
সামনে পামগাছ ও আকাশখোলা প্রান্তর। এই হোস্টেলে ফেঞ্চুগঞ্জ সারকারখানার মুরাদ, সুনয়ন চৌধুরী,
সুনামগঞ্জের কাজি শামসুল হুদা সুহেলসহ অনেক সহপাঠির কক্ষে বসতাম। এই হোস্টেলের নিরিবিলি সবুজ চত্বরে ২০১৬ সালের ছুটির দিনগুলোতে একমাত্র পুত্র ডাক্তার জেফারকে আমি গাড়ি চালানো শিখাই।
ভ্যাটিকান সিটি নামক দেশটির আয়তন মাত্র ৯০০ একর। মাঝে মাঝে ভাবি আমাদের
প্রিয় এমসি কলেজকে যদি এমনই একটি ক্ষুদে দেশ হত, তাহলে এটিকে অবশ্যই
সুইজারল্যান্ডের সাথে তুলনা করা যেত।
এখানে আছে পাহাড়টিলা, আছে উপত্যকা, আছে কাজলদিঘি লেক, আছে পাহাড়চুড়া। কাজলদিঘি, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ ও বর্তমান বুটানিভবনের পাশঘেঁষে পাহাড়ের বালিচুষা ঝর্ণাটি এক পার্বত্য ছোটনদী কলকল সুরে বয়ে গেছে। আমাদের সময়ের বুটানিক্যাল গার্ডেন, অডিটোরিয়াম ও সামনের রসায়ন ভবন যেন নিম্ন উপত্যকা। দুই বড়গেট দিয়ে ঢুকা
কাল পিচঢাকা রাস্তাটি কলাভবনের সামনে একত্র হয়ে পুর্বের কাজলদিঘি পেছিয়ে ঝর্ণাসেতু
পার হয়ে পাহাড়ঘেরা সবুজশ্যামল প্রান্তরে বর্তমান বুটানিউদ্যান ও বুটানিভবনে গিয়ে শেষ হয়েছে।
সারাটা কলেজ ছিল গাঢ় সবুজ
ঘাসের গালিচায় মুড়ানো, স্থানে স্থানে উচ্চশির পামবৃক্ষগুলোকে দেখলে মনে হত যেন স্যুটকোট
পরে অভিজাত ফুলবাবুরা দাঁড়িয়ে আছেন। এই রাস্তা হতে কোথায়ও সিঁড়িবেয়ে উপরে উঠে, আবার কোথায়ও কয়েকসিঁড়ি নিচে নেমে ভবনমালার সমারোহ। এই
কলেজটি ছিল ফুল, রংপত্র, পাখি ও বৃক্ষের এক স্বর্গীয় সৌন্দর্য্যের লীলাভূমি। আমাদের সময়ে সুসজ্জিত ও পরিকল্পিত লে-আউট অনুযায়ী দেশী বিদেশী
বৃক্ষরাজি লাগান ছিল। ক্যাম্পাসের সর্বত্র জুড়ে নানা বৃত্ত ও কোয়ারী করে লাগান
অজস্র মৌসুমি ও বারমাসি রঙবেরঙের বিচিত্র ফুল ও পাতাবাহার অপুর্ব শোভা বিলিয়ে দিত।
পাকিস্তানের জনক মোহাম্মদ আলী
জিন্নাহ একবার এমসি কলেজে এসে এই কলেজের অপরূপ নৈসর্গিক সৌন্দর্য্যে অভিভুত হয়ে
একে বলেছিলেন “The flower of the east”.
কবি দিলওয়ার তাঁর
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমসি কলেজ নিয়ে একাধিক কবিতা লিখেছেন। তিনি ‘স্মৃতিময় এমসি কলেজ’
কবিতায় লিখেছেন, ‘চোখে জল, বুকে প্রেম, ফুটে থাকে শতাব্দী কুসুম/ এমসি কলেজ নাম,
প্রজ্ঞা তাঁর সবুজে নির্ঘুম’।
একদিন ক্লাস শুরু হবার তারিখ ঘোষণা করা হল। ক্লাস রুটিন সংগ্রহ করে প্রথমদিনের ক্লাস ধরতে কলেজে গেলাম। এমসি কলেজ ১৯৮৩ ব্যাচের ‘এ’ সেকশনের প্রথম দিনের প্রথম ক্লাসটি অনুষ্ঠিত হয় রসায়ন ভবনের ক্লাস গ্যালারিতে। সম্পূর্ণ কাটের তৈরি গ্যালারির সামনে টিচারমঞ্চ, তারপর কাটের ডেক্স ও ব্রেঞ্চ নিচ থেকে ধাপে ধাপে উঁচু হয়ে ক্লাসরুমের শেষপ্রান্তের দেয়ালে গিয়ে ঠেকেছে। রসায়ন বিজ্ঞানের এই ক্লাস নিতে আসেন আব্দুল মতিন স্যার। মতিন স্যারের মাথার তালুতে চুল একটু কম হলেও অন্য তিনদিকের ঘনচুল সযত্নে তালুতে ফেলে টাক ঢেকে নিতেন।
বুদ্ধিদীপ্ত চেহারার আব্দুল মতিন স্যার রসায়ন বিজ্ঞানের কোন নিদৃষ্ট বিষয় পাঠে না গিয়ে রসায়ন বিজ্ঞানের নানা চমকদার ঘটনা বলেন। একটু পর রসায়ন গবেষণাগারের কর্মীরা স্যারের সামনের বড় টেবিলে কাঁচের জার ও নানান জাতের ক্যামিক্যাল দিয়ে পুর্ণ করে দেয়। এবার স্যার রসায়ন বিজ্ঞানের নানা অদ্ভুদ ও বিচিঁত্র সব ঘটনা চোখের সামনে ঘটিয়ে আমাদেরকে বিস্ময়ে হতবাক করে দেন। আব্দুল মতিন স্যার একটি জারের পানির নিচে আগুন জ্বেলে দেখান, আমরা অবাক হই পানির মাঝে আগুন। তিনি একটি ট্রেতে অগ্নেয়গীরির অববিকল অগ্নিউৎপাত সংঘটিত করে সবাইকে থাক লাগিয়ে দেন। মতিন স্যার কাঁচের পাত্রে ভ্যালকেনর জ্বলন্ত লাভাপ্রবাহ তৈরি করেন। কক্ষ অন্ধকার করে বাতাসে কৃত্রিম আলোর তারাকা তৈরি করেন। রসায়নের নানা মজাদার যাদুখেলা দেখে দেখে আমার কলেজ জীবনের প্রথম ক্লাসটি সমাপ্ত হয়। আব্দুল মতিন স্যারের হাতের কারুকাজ রসায়ন বিজ্ঞানের এই প্রথম ক্লাসটিকে আমাদের জীবনে স্মরণীয় করে দেয়।
বুদ্ধিমান আব্দুল মতিন স্যারের পরিপাটি গোঁফ ছিল, তিনি শেষ বয়সে সিলেট সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করে অবসর নেন। আজ কেউ যদি আমাকে প্রশ্ন করেন, আপনার কলেজ জীবনের প্রথম শিক্ষক কে? তাহলে নির্দ্বিধায় বলব, আমার প্রিয় আব্দুল মতিন স্যার, যিনি আজ পরলোকের বাসিন্দা। আল্লাহ পাক তাঁকে সুখ ও শান্তিতে রাখুন, আমিন।
বাংলার প্রথম ক্লাসটি করান ডঃ
শফিউদ্দিন স্যার। কাঁধে উত্তরীয় ফেলে সাদা পাজামা ও খদ্দরের পাঞ্জাবি পরে ক্লিনসেভ ডঃ শফিউদ্দিন স্যার তার লিখা “মানুষ
বিদ্যাসাগর” নামক বইটি বগলে নিয়ে ক্লাসে প্রবেশ করেন। ঢাকার কাছে নরসিংদির রায়গঞ্জে জন্ম
নেওয়া শফিউদ্দিন স্যারকে দেখে পুরাদস্তুর একজন বিখ্যাত সাহিত্যিক মনে হয়। প্রথম ক্লাসেই
স্যার বাজিমাত করলেন। স্যারের অসাধারণ
বক্তৃতা শুনে ক্লাসে পিনপতন নীরবতা
নেমে আসে। শফিউদ্দিন স্যারের ভাষণ
জুড়ে ছিল উদার মানবতাবাদের জয়গান ও মানুষকে ভালবাসার উপদেশ।
বাংলাসাহিত্যে মানবতাবাদ নিয়ে
ভাষণে তিনি বললেন, খেটে খাওয়া মানুষকে
সম্মান দিতে হবে, রিকশাওয়ালাদের সাথে ভাড়া নিয়ে অনায্য আচরণ যেন তার কোন ছাত্র কখনও না করে।
এই চিরস্মরণীয় ভাষণে
তিনি কয়েকটি লাইন আবৃতি করেন যা আমি কোনদিন ভূলি নাই, ভুলবনা- “নানান বরণ
গাভীরে ভাই, একই বরণ
দুধ।/ জগত ভ্রমণিয়া দেখলাম, একই মায়ের পুত”। এভাষণে
তিনি মধ্যযুগের অমর কবি কালীদাসের বিখ্যাত লাইন আবৃতি
করেন- “শোন হে মানব ভাই, সবার উপরে মানুষ
সত্য, তার উপরে নাই”।
ছাত্ররা বলত শফিউদ্দিন স্যারের একজন পীর আছেন, সেই পীর ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর। তিনি সব সময় বিদ্যাসাগরের গুণগান করতেন, বিদ্যাসাগর নিজে খেয়ে না খেয়ে কেমন করে দশ হাজার টাকা বিলাতে পাঠিয়ে উড়লচন্ডি দেউলিয়া কবি মাইকেল মধুসুদন দত্তকে উদ্ধার করে আনলেন সেই মহানুভবতার গল্প শোনাতেন। কিছু ছাত্ররা বলত, শফিউদ্দিন স্যারের মুখে আল্লাহ ও রসুলের কোন নাম নেই, সারাক্ষণ কেবল বিদ্যাসাগর, বিদ্যাসাগর। ছাত্ররা কানাকানি করত শফিউদ্দিন স্যার নাকি তখন ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের উপর পিএইচডি গবেষণা করছেন। তবে পরে তাঁর জীবনী পড়ে জানলাম এই উড়োকথাটি সত্য নয়, তিনি পিএইচডি করেন চর্যাপদের উপর।
২০২০ সালে আমি বদলী হয়ে ঢাকা গেলে একদিন সহকর্মী সায়েদ আব্দুল্লাহ যীশুকে নিয়ে নয়াপল্টনে শফিউদ্দিন স্যারের বাসায় যাই। তিনি তখন বয়সের ভারে
জর্জরিত। তাঁর ছেলেমেয়েরা সুপ্রতিষ্ঠিত। আমাকে জড়িয়ে ধরে আলিঙ্গন করেন। স্যারের সাথে বেশ কিছু ছবি তুলি। ডঃ শফিউদ্দিন স্যার একসময় শাহজালাল বিঞ্জান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন এবং বাংলাবিভাগের প্রধানের পদ থেকে অবসর গ্রহণ করে ঢাকায় চলে যান।
বাংলাসাহিত্যের ক্লাসে শরতচন্দ্রের উপন্যাস “শ্রীকান্ত” পড়াতেন বিরেশ বাবু। সিনিয়রদের কাছে শুনলাম বিরেশ স্যার এই ক্লাশে বহুবছর ধরে এই শ্রীকান্তই পড়িয়ে যাচ্ছেন। গাইলে হয় নাম, করলে হয় কাম। নিশ্চিত করে বলা যায় বছরের পর বছর শ্রীকান্ত উপন্যাসে পড়াতে পড়াতে বিরেশ স্যার একজন শ্রীকান্ত এবং শরত বাবু বিশেষজ্ঞ হয়ে গেছেন।
বিরেশ স্যার বাঙালি নারীদের জীবনচিত্র দুটি লাইনে প্রকাশ করতেন ’রাঁধার পরে খাওয়া, খাওয়ার পরে রাঁধা। একসাথে বাইশটা বছর বাঁধা’। তিনি দেখে যেতে পারেননি, বাংলাদেশের নারীদের সেই আটপৌর গৃহবন্দী জীবন আজ আর নেই। তিরিশ লক্ষ বাঙ্গালী গার্মেন্টস নারীকর্মী বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানী পণ্য গার্মেন্টসকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে নিরলস শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন। বাংলার অবলা রাঁধুনি নারীরা আজ দেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলনেত্রী, স্পিকার, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যাংকার, সেনাপতি, আইনজীবী, উদ্যোক্তা, কৃষিবিদ, ব্যবসায়ী, শিক্ষাবিদ, প্রশাসক, আর কত কি। সবখানে আজ তাঁদের সফল বিচরণ। তাঁদের জীবন এখন কেবল রাঁধার সাথে বাঁধা নয়।
এতদিন স্কুলজীবনে আমরা একই কক্ষে বসে সারাদিন ক্লাস করেছি ও কেবল প্রথম ক্লাসটিতে রোলকলে “ইয়েস স্যার” বা “প্রেজেন্ট স্যার” বলেছি। বৈচিত্রময় ব্যাপার হল এখানে প্রতিটি ক্লাসেই রোলকল হয়, প্রতিটি ক্লাসের শুরুতে প্রেজেন্ট স্যার বলতে হয়। একজনের ইয়েস স্যার অন্যজনও বলে দেয়। প্রতিক্লাসের পর শ্রেণিকক্ষ পরিবর্তন হয়। তাও আবার একটি ভবন হতে অন্য কোন দূরের ভবনে, এক টিলা হতে আরেক টিলায়। তাঁর কারণ এমসি কলেজে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়নবিজ্ঞান, গণিত, বাংলা, ইংলিশ ও জীববিজ্ঞান প্রতিটি অনুষদ বেশ দূরদূরান্তে ছড়িতে ছিটিয়ে থাকা সুরম্য ভবনমালায় অবস্থিত।
প্রতিক্লাসে সামনের লাইনে বসার প্রতিযোগিতা হত। শতাধিক ছাত্রদের দল নেচে গেয়ে হৈ চৈ করে দিত এক লম্বা ম্যারাথন দৌড়। এইচ এস সি বিজ্ঞানের সিলেবাস বিশাল, বড় বড় বিজ্ঞান ও গণিত বই, দেখলেই ভয় লাগে। ক্লাশের সাথে তাল মিলানো বেশ কঠিন কাজ। তাই সবার মাঝে টেনশন আর উত্তেজনা। ঘন্টায় ঘন্টায় একশত ষাট জন ছাত্রছাত্রীর মধ্যে হত বিরামহীন দৌড় প্রতিযোগিতা। যাদের মগজ ভাল, তাঁরা সহজে বুঝে, যাদের মগজ কাঁচা তাঁদের অবস্থা, মরে গেলাম রে, আর সইতে পারছিনা রে, মাগো বাঁচাও।
ক্লাশ শুরু হবার কিছুদিন পর একবার সামনের সিটে বসা নিয়ে রসিক সহপাঠি বন্ধু খলিলের সাথে বেশ ঝগড়া করি, সে হেঁটপরা কমলেশকে তামাশা করে বলত কম্বলেশ, মৃণালকে বলত সিনাল। সিলেটি ভাষায় কম্বল অর্থ পাছা এবং সিনাল অর্থ ভ্রষ্টা নারী। কমলেশ ও মৃনাল তাতে খুব একটা মাইন্ড করত না, তাঁরা কৌতুক মনে করে হেসে উড়িয়ে দিত।
বন্ধু খলিলুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানে অনার্সসহ মাস্টার্স করে ১৯৯০ সালে আমার সাথে পুবালী ব্যাংকে অফিসার হিসাবে যোগদান করেন। একি সাথে শিক্ষানবীশ অফিসার হিসাবে এম সি কলেজের সহপাঠি বন্ধু জকিগঞ্জের মাহবুব আহমদও পূবালী ব্যাংকে আসেন। এম সি কলেজ এইচএসসি ১৯৮৩ ব্যাচের তিন সহপাঠীর মধ্যে মাহবুব আহমদ জকিগঞ্জ শাখায়, খলিলুর রহমান ঢাকা স্টেডিয়াম শাখায় এবং আমি চৌধুরী ইসফাক সিলেট মহিলা কলেজ শাখায় নিয়োগ পাই। কয়েক মাস পূবালী ব্যাংকে কাজ করার পর খলিলুর রহমান বিসিএস (প্রশাসন) পাস করে সরকারি চাকুরিতে চলে যান। শ্রীমঙ্গলের জাতক খলিলুর রহমান বাংলাদেশ সরকারের যুগ্ন সচিব পদ হতে কিছুদিন আগে অবসরে যান। মাহবুব আহমদ ডিজিএম অবসরে গেছেন, কেবল আমি এখনো পূবালী ব্যাংকে নিভু নিভু হয়ে জ্বলছি।
এমসি কলেজে সাইকেল সেড ছিল, অনেক ছাত্ররা বাইসাইকেল চড়ে কলেজে আসত। সারি সারি সাইকেলে সেড ভরে যেত। সেকালে রাস্তায় এত ট্রাফিক জ্যাম ছিলনা, ছাত্ররা দশবার জন মিলে দলবেঁধে নিরিবিলি ঈদগাহ রোড দিয়ে সাইকেল চালিয়ে গল্পগোজব করে করে কলেজে আসত। তখনকার দিনে মনে করা হত এমসি কলেজ শহরের বাহিরে তিন মাইল দূরের এক মফস্বল এলাকা।
এমসি কলেজে একটিমাত্র হালকা নীলাভ বড় কলেজবাস সচল ছিল। আমরা গাদাগাদি হয়ে সেই বাসে চলাফেরা করতাম, জায়গা না পেয়ে অনেক ছাত্র বাসের ছাদে বেয়ে উঠত। বাসের গায়ে বড় বড় অক্ষরে লেখা ছিল ‘সিলেট বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ’।
চালক ছিলেন ছাত্রদের সবার প্রিয় তারুভাই। একদিন পেঠমোঠা শ্যামলা তরুভাই গাড়ি চালিয়ে আমাদেরকে নয়াসড়ক জামে মসজিদে নিয়ে যান অধ্যক্ষ গোলাম রসুল স্যারের পিতার নামাজে জানাজায়। তাঁকে মানিকপিরের কবরগায় দাফন করা হয়। সেইদিন প্রথম ছাত্রদের সাথে মানিকপির টিলার একদম উপরে যাই। টিলাটি এত উঁচু যে নিচে সারাটা শহরের ভবনমালা অনায়াসে দেখা যায়।
আরেকদিন তারুভাই গাড়ি চালিয়ে আম্বরখানায় আসামাত্র ছাদে বসা আমাদের সহপাঠি ফুলবাড়ির ইমরান চৌধুরী টেলিফোনের তাঁরে ঝুলে যায়। তারুভাই জুরে ব্রেক মারেন। ছাত্ররা আচমকা ব্রেকে তাল সামলাতে না পেরে একে অন্যের গায়ে ধাক্কা খান। সামনে আমরা সবাই মিলে ইমরানকে হাসপাতালে নিয়ে যাই। এই সহপাঠি বন্ধু ইমরান চৌধুরী আজ আর নেই। তাঁকে নিয়ে আমি ঝরাকলি নামে একটি গল্প রচনা করি। এই সকরুন গল্পটি আপনারা আমার গল্পগ্রন্থ ঝরাপাতা হতে পড়ে নিতে পারেন।
আমাদের গণিতের ক্লাস নিতেন ঋষিকেশ স্যার। ঋষিকেশ স্যারের কোন তথ্য আমি পাইনি।
একদিন সদ্য বিসিএস পাস করা একজন সতরুণ গণিতের শিক্ষক যোগদান করেন। তিনি জিন্সের প্যান্ট ও দামী গেঞ্জি পরে ক্লাস নিতেন, তখনও কিশোরকুমার সেই স্মার্ট ও হাসিমুখ স্যারের নাম ছিল ধীরেশ চাঁদ সরকার। চলনে বলনে ধীরেশ স্যার ছিলেন ছাত্রদের আইডল। শুনেছি একসময় তিনি তাঁর উপযুক্ত একজন স্বধর্মীয় ছাত্রীর প্রেমে পড়েন। পারিবারিক সম্মতিতে সেই ছাত্রীকে বিয়ে করে সুখী দাম্পত্যজীবন পার করেন।
আমরাই ছিলাম ধীরেশ স্যারের চাকুরি জীবনের উদয়বেলার প্রথম ছাত্রব্যাচ। ২০১৩ খ্রিস্টাব্দে আমি এম সি কলেজের অধ্যক্ষ অফিসে গিয়ে ধীরেশ চাঁদ সরকার স্যারকে অধ্যক্ষের চেয়ারে আসীন দেখতে পাই। ক্লিন সেভ, স্মার্ট গোঁফের আড়ালে সেই মুছকি হাসি লেগে আছে। তাঁর হাতে আমার লিখা “ইসফাক কুরায়শী রচনাসমগ্র” কলেজ পাঠাগারের জন্য তুলে দেই। অধ্যক্ষ ধীরেশ স্যার বেশ খুশি মনে বইটি হাতে তুলে নেন। ধীরেশ স্যারের নিজস্ব বাসা ছিল আমার বাসার কাছে বাগবাড়ি হিন্দুপাড়ায়। এম সি কলেজের অধ্যক্ষ পদ হতে অবসর গ্রহণ করে তিনি বাগবাড়িতে স্থায়ী হন।
আমার পুত্র জেফার এইচএসসির গণিত
শিখতে ধীরেশ স্যারের কাছে টিউশনি পড়তে যায়। আমি জেফারকে নিয়ে ২০১৫ সালে ধীরেশ স্যারের
সাথে তাঁর বাগবাড়ির বাসায় দেখা করি। বেশ সুন্দর ছিমছাম বাসা। আমি এমসি কলেজ এইচএসসি ১৯৮৩ ব্যাচ বলতেই চিনে ফেলেন। আমার
সহপাঠি ওয়াদুদ, হাফিজ, রুমি, মতিউরসহ অনেকের নাম বলে যান অবলীলায়,
যারা ছিল সেরা মেধাবী। আমি ধীরেশ স্যারের এত স্মৃতিশক্তি দেখে বিষ্মিত হয়ে
বললাম, এত আগেকার ছাত্রদের নাম স্যারের এখনও কি মনে আছে? জবাব দেন মনে থাকবেনা কেন?
এমসি কলেজ ১৯৮১ সালে ভর্তি হওয়া এইচএসসি ১৯৮৩ ব্যাচ আমার শিক্ষকজীবনের প্রথম
ব্যাচ। ডাঃ আব্দুল ওয়াদুদ তো আমার হার্টের চিকিৎসা
করে। সে অতিশয় বিনয়ী। এই ছিল ধীরেশ স্যারের সাথে আমার শেষ দেখা। আমি পূবালী ব্যাংক পিএলসির প্রধান কার্যালয়, মতিঝিল, ঢাকায় বদলি হয়ে আসার পর ২০২০ সালে ফেসবুকে খবর পাই আমাদের প্রিয় ধীরেশ চাঁদ সরকার স্যার
না ফেরার দেশে চলে গেছেন। আমি তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি।
আমরা ভর্তি হবার পর গণিত পড়াতেন এমন একজন জনপ্রিয় শিক্ষক ছিলেন ডক্টর মাসুদ কাবেলি। ছেলেরা আফগান রাজধানী কাবুলের নামে তাঁকে ডাকত কাবুলি স্যার। তিনি কলেজের টেনিস গ্রাউন্ডে সর্বদা লনটেনিস খেলতেন। কলেজের ইয়াং স্যারেরা বেশি বেশি লনটেনিস খেলতেন, তবে সিনিয়র ক্লাসের কিছু মুরব্বী ছাত্ররাও খেলায় অংশ নিতেন। একসময় মেধাবী শিক্ষক ডঃ মাসুদ কাবেলি স্যার উচ্চশিক্ষার সুযোগ পেয়ে বিদেশে চলে যান। তিনি আর বাংলাদেশে ফিরে আসেননি।
আমেরিকার মিশিগান প্রবাসী আমাদের সহপাঠী বন্ধু অলিউর রহমানের মাধ্যমে ১৯৮৩ ব্যাচ গ্রুপের ওয়ার্সএপে জানতে পারি মাসুদ কাবেলি স্যার ২৯ ডিসেম্বর ২০২২ ডেট্রয়েট শহরের এক হাসপাতালে ইন্তেকাল করেছেন। ২০২২ সালের ৩০ ডিসেম্বর ডেট্রোয়েট আলফালাহ মসজিদে নামাজে জানাজা শেষে তাঁকে মিশিগানে দাফন করা হয়। আমাদের কয়েকজন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সহপাঠি বন্ধুরা তাঁর নামাজে জানাজা ও দাফন কাফনে শরিক হন। ডঃ মাসুদ কাবেলি স্যার ছিলেন নেত্রকোনার জাতক। মহান আল্লাহপাক তাঁকে জান্নাত দান করুন, আমিন।
গণিতের আরেকজন শিক্ষকের নাম মনে আছে, তিনি আনোয়ার হোসেন। তাঁর সম্পর্কে আমি তেমন কিছু জানতে পারিনি।
জামালউদ্দিন নাগরি নামেরও একজন গণিতের স্যারের মুখ চোখে ভাসে। তিনি সিলেটি নাগরি বর্ণমালা নিয়ে সারাজীবন কাজ করেন এবং অবসরের পর বিশ্বনাথ উপজেলার কোন এক প্রত্যন্ত গ্রামের নিভৃতে চলে যান। সিলেটি নাগরি ভাষা ও বর্ণমালা বাঁচাতে অক্লান্ত প্রচেষ্টার জন্য সিলেটি জনগণ তাঁর নামের শেষে নাগরি উপাধি যুক্ত করে দেন। জামালউদ্দিন নাগরি স্যার বুড়োবয়সটা দীনহীন অবস্থায় কাটিয়ে সিলেটের মফস্বলে পরলোকগমন করেন। সিলেটি নাগরি ভাষা গবেষক জামালউদ্দিন নাগরি স্যারের মৃত্যুসংবাদ সিলেটের বিভিন্ন স্থানীয় পত্র পত্রিকায় পড়ি। তাঁকে শ্রদ্ধা জানাই ও বেহেশত কামনা করি, আমিন।
পদার্থবিজ্ঞানের ননসিলেটি আফসার উদ্দিন স্যারের কথা খুবই মনে পড়ে। আফসার উদ্দিন স্যারের টিলাগড়ের ভাড়া বাসায় গিয়ে প্রাইভেট পড়ে আমি ক্যালকুলাস, গতিবিদ্যা ও স্থিতিবিদ্যা শিখি। আফসার উদ্দিন স্যারের একছেলে তখন সিলেট সরকারি মেডিকেল কলেজে এমবিবিএস পড়ত।
জবদুল হক স্যারের স্মৃতি আজও বেশ অম্লান। জবদুল হক স্যার ছিলেন পদার্থবিজ্ঞানের বিভাগপ্রধান, তিনি এম সি কলেজের শিক্ষক কলোনির সরকারি বাসায় সপরিবারে বসবাস করতেন। জবদুল হক স্যার পদার্থবিজ্ঞানের নিউটনের গতিসূত্র, শক্তি, গতি, ভর, বেগ, পড়ন্ত বস্তুর সূত্র, শব্দ, আর্কিমিডিসের সূত্র, আলোক, বিদ্যুৎ, মেন্ডেলিফের পর্যায় সারণী, বয়েলের সূত্র ইত্যাদি সব বিষয় পড়াতেন। একবার একজন সহপাঠী বলল, বৈজ্ঞানিক নিউটন বেটা সব জঞ্জালের ঘটি, তিনি দুনিয়ায় না এলে এত কষ্ট করে তাঁর গতিসূত্র ও ক্যালকুলাসের মত জটিল গণিত আমাদের পড়তে হতনা।
জবদুল হক স্যারের বাড়ি রাজশাহী বিভাগে। তিনি রাজশাহীর আঞ্চলিক টানে কথা বলতেন। শব্দ কম্পাংক পরিমাপের টিউনিংফর্ক বা সুরেলিকাটাকে রাজশাহীর আঞ্চলিক টানে জবদুল হক স্যার উচ্চারণ করতেন ছুরেলিকাটা। তিনি দ্রুততার সাথে কথা বলতেন। সূর্যের আলোর মৌলিক সাতরঙ্গ বে, নী, আ, স, হ, ক, লা (বেগুনি, নীল, আসমানি, সবুজ, হলুদ, কমলা ও লাল) তিনি ঝরঝর করে বলে যেতেন।
জবদুল হক স্যারের বাসায় গিয়ে আমাদের অনেক সহপাঠিরা গণিত ও ফিজিক্স পড়েন। অধ্যাপক জবদুল হক স্যার বাংলাদেশের অনেকগুলো নামীদামী কলেজে বিভাগপ্রধান ও অধ্যক্ষ হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। লোকমুখে শুনেছি তিনিও এখন ইহজগতে নেই। তিনি জান্নাতবাসী হউন, আমিন।
শীর্ণকায়া ইকবাল আহমদ স্যার তাপ, আলো, শক্তি ইত্যাদি পড়াতেন। ইকবাল স্যারের ছোট্ট গাল শেষবয়সে এলোমেলো দাড়িতে ভরে যায়। আমি তাঁকে উচকো কুচকো চুলদাড়ি নিয়ে সিলেট শহরে উদ্ভ্রান্তের মত একমনে হেঁটে যেতে দেখে প্রায়ই সালাম দিতাম, কিন্তু বেখেয়াল স্যারের কোন সাড়াশব্দ পেতাম না। শুনেছি, ইকবাল আহমদ স্যার শেষবয়সে
কিছুটা অপ্রকৃতিস্থ হয়ে সিলেট শহরে মারা
যান। ইকবাল আহমদ স্যার ইহজগতে মানসিক রোগে বেশ কষ্টভোগ করেন, আল্লাহ পাক তাঁর পরকাল শান্তিময় করুন, আমিন।
রসায়ন বিভাগে বেশ কয়েকজন প্রাণবন্ত স্যার ক্লাস নিতেন। মেঘনাদ সাহা ও পরিমল দে স্যার তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তাঁরা ছাত্রদের খুব প্রাণপ্রিয় শিক্ষক ছিলেন। তাঁরা দুইজনই ছিলেন ভদ্র, নিরীহ ও দয়ালু। এমন নিবিষ্ঠ মনে পড়াতেন যে শ্রেণিকক্ষে সব শেখা হয়ে যেত। লবণ সনাক্তকরণ, হাইড্রোকার্বন, এসিড, ক্ষার, মৌল, মৌলের রাসায়নিক সংক্ষেত ইত্যাদি আমরা এই অধ্যাপকগণের বদণ্যতায় সহজেই শিখে ফেলি। সরলতার কারণে হয়ত তাঁরা অধ্যক্ষ উপাধ্যক্ষ জাতীয় বড় পদে বসতে পারেননি, কিন্তু তাঁদের দায়িত্ববোধের কোন অভাব ছিলনা। মেঘনাদ সাহা স্যার এখন কেমন আছেন, কোথায় আছেন, জানিনা। আমার সহপাঠী কাজি শামসুল হুদা সুহেলের মাধ্যমে জেনেছি পরিমল দে স্যার তাঁর জন্ম শহর সুনামগঞ্জে সুস্থ শরীরে ভালোই আছেন। সুনামগঞ্জের নানা সামাজিক সাংস্কৃতিক ও জনকল্যাণকর কর্মকান্ডে তিনি জড়িত আছেন। তাঁদের মঙ্গোল কামনা করি।
সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের সন্থান অধ্যাপক সুধাংশু শেখর চক্রবর্তী স্যার ছিলেন শ্যামলা ও লম্বা চওড়া ব্যক্তিত্ববান শিক্ষক। স্যার ছিলেন একটু কড়া ও নির্ভীক। ছাত্ররা স্যারকে ভয় পেত ও খুব সমিহ করত। পরীক্ষার হলে ছাত্রনেতারাও উল্টাপাল্টা কিছু করলে সুধাংশু স্যার একবিন্দুও ছাড় দিতেন না। আমি কিন্তু সুধাংশু স্যারকে ভয় পেতাম না। মনে হত তিনি খুব আত্মমর্যাদাশীল ন্যায়নিষ্ঠ শিক্ষাগুরু। যতই গরম হউন না কেন, তিনি আমাদের ভাল চান ও মঙ্গলের জন্য একটু কড়া আচরণ করেন। চট্টগ্রামের সুশান্তসহ আমরা কয়েকজন সহপাঠী সকালবেলা বালুচর অরামবাগে সুধাংশু স্যারের বাসার বারান্দায় বসে বীজগণিত ও ত্রিকোণমিতি প্রাইভেট টিউশনি পড়ি। সমাবেশ বিন্যাস, মুলদ অমূলদ, লগারিদম, অসীম সংখ্যার সমীকরণ, দ্বিঘাত সমীকরণ, সাইন টিটা, কস টিটা, কসেক টিটা ইত্যাদি শিখে নেই। অধ্যাপক সুধাংশু শেখর চক্রবর্তী স্যার একসময় এমসি কলেজের রসায়ন বিভাগের প্রধান হন। সুযোগ্য সুধাংশু স্যার পরে এমসি কলেজের উপাধ্যক্ষ পদেও বসেন। বর্তমানে তিনি সিলেট শহরে অবসরে আছেন।
এইচএসসি ১৯৮৩ ব্যাচের আমন্ত্রণে সুধাংশু শেখর চক্রবর্তী স্যার একবার সিলেটের কোন এক হোটেলে আমাদের ডিনারে স্বস্ত্রীক যোগ দেন। সুধাংশু স্যার ও বৌদিকে পেয়ে আমাদের সবার মনে এক আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। এমসি কলেজ মাঠের ফুটবল টুর্নামেন্ট নিয়ে সেদিন মিয়া আশিক ও পারভেজ আক্তার বেশ মজার স্মৃতিচারণ করেন।
সেকালে মোবাইল ছিলনা, যুগটা ছিল পত্রালাপের। প্রেমপত্র বিনিময়ের মাধ্যমে প্রেমে পড়ে ভারতের হিন্দিভাষী একজন হিন্দু তরুণি চলে আসেন মিয়া আসিকের দরবারে। পত্রমিতা ভারতীয় এই হিন্দু মেয়েটাকে নিয়ে মহাবিপদে পড়ে যান মিয়া আশিক। তরুণী মেয়েটাকে কি করবেন, কোথায় রাখবেন। আবাসিক হোটেলে একাকি রাখা নিরাপদ না, আত্মীয়স্বজনের বাসায়ও নেয়া যাবেনা, এদিকে রাত ঘনিয়ে আসছে। শেষমেষ কি আর করবেন, মেয়েটাকে নিয়ে মিয়া আশিক ছুটে যান সুধাংশু শেখর স্যারের বাসায়। বৌদি ও সুধাংশু স্যারকে মধ্যরাতে ডেকে ঘটনাবৃত্তান্ত জানিয়ে মিয়া আশিক বললেন, ভারত থেকে একা একা সিলেটে চলে আসা এই পাগলিটাকে সামলান। স্যার ও বৌদি কি আর করবেন। অপরিচিত মেয়েটাকে বাসায় আশ্রয় দেন ও বুঝিয়ে সুজিয়ে ভারতে পাঠান। সুধাংশু স্যার ও বৌদি সেদিন ভিনদেশি, ভিনভাষী ও ভিন্নধর্মী দুইজন আশুক-মাসুককে এভাবে মহাবিপদ হতে উদ্ধার করে নিরাপদে ও সসম্মানে তীরে পৌঁছে দেন।
রসায়নবিজ্ঞান বিভাগের হবিগঞ্জি বাকিবিল্লাহ স্যারের স্মৃতি খানিকটা মনে পড়ে। এই দাড়িওয়ালা পাজামা পাঞ্জাবি পরিহিত সরল প্রকৃতির হুজুর স্যারের পুরো নাম সৈয়দ আবুসজ্জাদ বাকিবিল্লাহ। তিনি ক্লাসে আজ যা পড়াতেন, কাল তাঁর উপর পরীক্ষা নিতেন। তাই সৈয়দ আবু সজ্জাদ বাকিবিল্লাহ স্যারকে কিছু ছেলেরা কৌতুক করে বলত নগদবিল্লাহ স্যার। তিনি অধ্যাপনা এবং আল্লাহর আরাধনা, এই দুই কাজে জীবন পার করে দেন।
আমাদেরকে ইংরেজি পড়াতেন এম এ বাকী এবং এম এ বারী নামের দুইজন শিক্ষক। তাঁরা সংক্ষেপে ছাত্রদের বাকী স্যার ও বারী স্যার। কৃশতনু যুবতী জিন্নাত আরা ম্যাডাম আমাদের ইংরেজি ক্লাস নিতেন। জিন্নাত আরা ছিলেন ফর্সা ও সুন্দরী। তার ইংলিশ বাক্যালাপ ছিল নির্ভূল ও সুস্পষ্ট। মেডামের মায়াবি চেহারা, স্মার্টনেস কথাবার্তা ও রূপলাবণ্য ছাত্রদের কাছে বেশ আলোচনার বিষয় ছিল। ইংরেজির চৌকষ শিক্ষিকা জিন্নাত আরা মেডামও সময়ের প্রবাহে বিস্মৃতির আড়ালে হারিয়ে যান। ইংলিশের স্বল্প পরিচিত আরেকজন ননসিলেটি স্যারের নাম ছিল বারিক সরকার।
আমার মূল বিষয় ছিল গণিত ও জীববিজ্ঞান ঐচ্ছিক। ঐচ্ছিক বিষয় না রাখলেও চলে। ঐচ্ছিক বিষয়ে পাসফেলে রেজাল্টে কিছু যায় আসেনা। যারা মেডিকেলে আগ্রহী তাঁরা জীববিজ্ঞান এবং ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে আগ্রহীগণ গণিতকে মূল বিষয় নির্বাচন করতেন। জীববিজ্ঞানের ক্লাসে এসে আমরা দ্বিতীয় একজন পরিমল স্যারের দেখা পাই। তাঁকে ছাত্ররা বলত বুটানির পরিমল স্যার। সহপাঠী বন্ধু বিজিত রঞ্জন বৈদ বুটানির পরিমল স্যারের একটি স্মৃতি মনে করিয়ে দেন। জীববিজ্ঞানের পরিমল স্যার কলেজ জীবনে তাঁর সর্দারীর কাহিনি বেশ গর্বভরে বলতেন এভাবে, আমি ছিলাম জগন্নাথ কলেজের ভি.পি + গুন্ডা।
জীববিজ্ঞানের দুইটি শাখা, প্রাণিবিদ্যা ও উদ্ভিদবিদ্যা। প্রাণিবিদ্যার ক্লাস নিতেন তরতাজা ফর্সা সুন্দরী শিক্ষিকা গুলনাহার বেগম। গুলনাহার মেডামের বয়স তখন বড়জুর পয়ত্রিশ। ম্যাডাম মেটাফিজ/ মেমোসিজ পড়াতেন, উদ্ভিদকোষ ও প্রাণিকোষের মিল অমিল ইত্যাদি পড়াতেন। গুলনাহার মেডাম বড়বড় আগুন চোখে যখন তাকাতেন, সদ্য গোঁফ গজানো টিনেজার ছেলেরা ভয়ে চুপসে যেত। আমিও মেডামকে খুব ভয় পেতাম। কেন যেন আমাকে তিনি বারবার ক্লাসে দাড় করে নানা প্রশ্ন করতেন। মেডামের প্রশ্নের জবাব দিতে এই বান্দার বেশ মানসিক চাপ হত। হয়ত গুলনাহার মেডাম আমার চেহারাসূরত দেখে খুব মেধাবী একজন ছাত্র মনে করতেন।
গুলনাহার মেডাম পড়ান, ডিম্বানুতে শুধু ওয়াই ক্রমোজম থাকে, শুক্রানুতে এক্স এবং ওয়াই এই দুই ধরনের ক্রমোজম থাকে। এক্স ক্রমোজম ক্রিয়ায় ভ্রূণের প্রাণ নর এবং ওয়াই ক্রমোজমের ক্রিয়ায় নারী লিঙ্গ হয়। সেই গোপন বিষয়টি গুলনাহার মেডাম ছাত্রদের চোখে চোখ রেখে গড়গড় করে পড়াতেন। কেউ একটু হেসে দিলে বাঁচা অসম্ভব। একবার কোন এক ছেলে মুচকি হাসি দিলে মেডাম সাথে সাথে তাঁকে ক্লাস থেকে বের করে দেন। তাই গুলনাহার মেডামের ক্লাসে বিরাজ করত পিনপতন নীরবতা।
গুলনাহার মেডাম বেশ ভাগ্যবতী, তিনি একসময় জাতীয় পাঠ্যক্রম
ও স্কুল টেক্সট বুক বোর্ডের চেয়ারমেন হন। ২০২১ সালে ফেসবুকে সহপাঠি গোপী সরকারের লেখা পড়ে
জানতে পারি গুলনাহার মেডাম আজ আর পৃথিবীতে নেই। সেই সময় জীববিজ্ঞান বিভাগে যোগ দেন একজন তরুণ
প্রভাষক আজিজুর রহমান লস্কর। অবসর নিয়ে আজিজুর রহমান লস্কর নানা বিষয়ে প্রচুর লেখালেখি করেন এবং সিলেটে ইন্তেকাল করেন।
আমাদের রসায়ন গবেষণাগারে ব্যবহারিক ক্লাসের দায়িত্বে ছিলেন ডেমনেষ্ট্রেটর লস্কর সাহেব। তিনি ব্যবহারিক খাতায় একটু ভুল পেলে খাতা ছুড়ে ফেলতেন। দ্বাদশ ক্লাসে ফাইন্যাল পরীক্ষার আগে যতবারই খাতা দেই ততবারই লস্কর সাহেবের মন ভরেনা, তিনি ছুড়ে মারেন। শেষে আমরা কয়েকজন মনস্থির করলাম মাত্র পাঁচ নম্বরের খাতার জন্য আর কত সময় নষ্ট করব, এই লোকটার আর কত হাতপা ধরব। আমরা লস্কর সাহেবের সই অবিকল জাল করে খাতার পাতায় পাতায় বসিয়ে দিলাম। একজন বলল শালার লস্কর, আমাদেরে আর কত গরম দেখাবি রে। ব্যবহারিক পরীক্ষার দিন এত খাতা জমা হয় যে পরীক্ষক স্যাররা তা খোলেও দেখেননি। সবাইকে পাঁচের মধ্যে কোন একটা পাস নম্বর বসিয়ে দেন।
রসায়ন ল্যাবকর্মী সালাম মিয়া আজব লোক, সে গ্লাসের উপর পড়া এসিড খালি হাতে মুছে পানির টেপে ধুয়ে ফেলে বলত, এসিড
খুবদ্রুত পানি দিয়ে ধুয়ে ফেললে ত্বক পোড়ানোর সময় পায়না।
লবণ সনাক্তকরণের পরীক্ষার আগের দিন ল্যাবকর্মী সালাম মিয়াকে আমরা কয়েকজন বিশ টাকা করে বখশিস দেই। পরীক্ষাস্থলে কর্মরত সালাম মিয়া এসে আমার নমুনা লবণের কয়েকদানা হাতে নিয়ে ভাল করে দেখে দুএক দানা জিহ্বায় দেন। তারপর বলেন এই লবণ মনে হয় “জিঙ্ক সালফেট” হবে। এবার তিনি একটি কাঁচের টেস্টটিউবে লবণের একটু নমুনা নিয়ে কি একটা কেমিকেল নিশিয়ে আগুনে ধরে দেখেন হালকা সবুজ রঙ এসেছে এবং গরম লবণের ধুঁয়ার গন্ধ শুকে বললেন এটি নিশ্চিত “জিঙ্ক সালফেট”। সালাম মিয়ার সৌজন্যে আমার লবণ সনাক্তকরণ পরীক্ষা নিমিশেই শেষ, খেইড় খতম।
পদার্থবিজ্ঞানের ব্যবহারিক পরীক্ষার দিনে লটারি হয় কে কোন বিষয়ে পরীক্ষার ফলাফল নির্ণয় করবেন। অনেকগুলো কাগজের টুকায় পরীক্ষার বিষয় লিখে সামনে ফেলা হয়। লটারির মত টুকা তুলে খোলার পর দেখা যায় একেক জনের ভাগ্যে একেকটি পরীক্ষা লাগছে। মনমত পরীক্ষা যাদের লাগে তাঁরা মহাখুশি, আর যাদের লাগে নাই তাঁদের মন খারাপ। লটারির টুকা তুলার পর চেহারাই বলে দেয়, কে খুশ, আর কে নাখুশ।
লটারিতে আমার ভাগ্যে
‘আতশী কাঁচের সাহায্যে আলোর প্রতিসরাঙ্ক নির্ণয়’ ওঠে। খুশি হলাম, এই টেস্ট আমার
ভালভাবে জানা ছিল এবং আমি চেয়েছিলামও তাই। ভাগ্যবান আমি সেদিন আতশী কাঁচের সাহায্যে আলোর প্রতিসরাঙ্ক নির্ণয় করে সহজেই পার পেলাম।
একাদশ বিজ্ঞানে ভর্তি হওয়া আমার তিনশত বিশ জন সহপাঠির অনেকের নাম আমার জানা হয়নি। তবে দুই বৎসর একসাথে থাকা “ক” শাখার একশত ষাট জনের মধ্যে আমার অনেক সহপাঠির স্মৃতি সুস্পষ্ট মনে আছে। আমি “ক” শাখার প্রিয় সহপাঠিদের স্মৃতিই আগে তুলে ধরব। “খ” শাখারও অনেকেই সুপরিচিত ছিলেন। তাদেরে আমি কি স্মৃতি থেকে মুছে ফেলতে পারি? উত্তর হলো- না, পারিনা।
আব্দুল হাফিজ ছিলেন অতি মেধাবী ছাত্র। তিনি এসএসসি ১৯৮১ পরীক্ষায় বিশাল চট্টগ্রাম বোর্ডে বিজ্ঞানে পঞ্চম স্থান অধিকার করেন। এসএসসিতে তাঁর প্রাপ্ত নম্বর ছিল ৭৯২। তিনি চোখে চশমা দিতেন ও ফুলসার্ট পরে ক্লাসে আসতেন। মিতবাক হাফিজ ছিলেন কিছুটা আত্মভূলা। তিনি অন্যদের সাথে খুব একটা মিশতেন না, কিংবা পড়ালেখা নিয়ে এতই ব্যস্ত ছিলেন যে তার বারবাজারী দুস্তিয়ানা করার সময়ই ছিলনা। হাফিজের গ্রামের বাড়ি গোয়াইনঘাট হলেও তারা সিলেটের হাউজিং এস্টেটে নিজবাসায় বসবাস করতেন। তাঁরা ভাইবোনরা সবাই মেধাবী। হাফিজ বুয়েট হতে ডিগ্রি নিয়ে বাংলাদেশ আনবিক শক্তি কমিশনে যোগদান করেন এবং বাংলাদেশের একজন শ্রেষ্ঠ আনবিক বিজ্ঞানী হন।
আমি পুবালী ব্যাংক বরইকান্দি শাখার
ব্যবস্থাপক থাকাকালে একদিন কে একজন ফোন করে বলল আব্দুল হাফিজ নেই, শাহজালালের(রঃ) মাজার মসজিদে জানাজা হবে। শাহজালালের দরগায় জানাজায়
গিয়ে বহুবছর পর আবার দেখা হল সাদা কাফনে আবৃত্ত আমাদের সবচেয়ে মেধাবী সহপাঠী আব্দুল হাফিজের সাথে,
তখন তিনি মহানিদ্রায় শুয়ে আছেন চিরবিদায়ের খাটিয়ায়। আহারে, প্রিয়তমা পত্নী ও সন্তানদেরে রিক্ত করে শেষযাত্রাকালে তার বয়স হয়েছিল মাত্র পাঁচচল্লিশ বছর। মহান আল্লাহপাক তাঁকে জান্নাতের বাসিন্দা করুন, আমিন।
তিনি আব্দুল
ওয়াদুদ চৌধুরী ওরফে নিয়াজ, গ্রামের বাড়ি উত্তরকুল, জকিগঞ্জ। এসএসসিতে তাঁর প্রাপ্ত মোঠ নম্বর ছিল ৭৪৫। বৈশাখী হাউস,
কুমারপাড়া, ঝর্ণারপার নিজবাসায় অবস্থান করে লেখাপড়া করতেন। ওয়াদুদ চৌধুরী সিলেট সরকারি
পাইলট স্কুলের ছাত্র ছিলেন। সেখানে রুটিন বিভ্রাটে পড়ে এসএসসি পরীক্ষার
কোন এক সকালের পরীক্ষা বিকেলে দিতে গিয়ে একবছর ড্রপ পড়ার
কাহিনি শুনতাম। তিনি ছিলেন কৃশতনু শ্যামলা
ও দীর্ঘাঙ্গ। একটু খুড়িয়ে হাঁটা
ওয়াদুদের চোখে ছিল পুরু চশমা। সবসময় হাসিমুখ ওয়াদুদ ছিলেন মিশুক ও কথাবার্তায় বেশ
হ্যান্ডসাম। উচ্চাকাংখী ও মেধাবী আব্দুল ওয়াদুদ
চৌধুরী ছিলেন নিরহঙ্কার ও আত্মপ্রত্যয়ী। তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হতে এমবিবিএস পাশ
করে পরে এফসিপিএস ও এমআরসিপি করেন। অধ্যাপক
ডাঃ আব্দুল ওয়াদুদ চৌধুরী দীর্ঘকাল ঢাকা মেডিকেল কলেজের হৃদরোগ বিভাগের প্রধানের দায়িত্ব
পালন করেন। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ জীবানুবিদ্যা ইন্সটিটিউটের অধ্যক্ষের দায়িত্বে আছেন।
মতিউর রহমান ছিলেন মেধাবী কিন্তু দরিদ্র ছাত্র। এসএসসিতে তিনি ৭৩৫ নম্বর পান। তিনি ভাদেশ্বর পুর্বভাগ নাসিরউদ্দিন হাইস্কুল হতে আসেন। তিনি একসেট নীলপ্যান্ট ও হলুদসার্ট পরে উচ্চ মাধ্যমিক পার করে দেন। পড়াশুনায় তিনি ছিলেন খুব মনোযোগী। মতিউর বুয়েট হতে ডিগ্রি নিয়ে পরে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। তাঁর সাথে আর কখনো দেখা হয়নি।
ডাক্তার ইব্রাহিম আলী ফেঞ্ছুগঞ্জ কাশিম আলী হাইস্কুলের ছাত্র ছিলেন। এসএসসিতে তিনি পাঁচ বিষয়ে লেটারমার্কসহ মোঠ ৭৩৫ নম্বর পান। তিনি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হতে এমবিবিএস করেন। ডাঃ ইব্রাহিম আলী ছিলেন বেঁটে হাসিখুশি লোক। তিনি আমার পত্নী ডাঃ নুরজাহান বেগম চৌধুরীর সাথে বিভিন্ন সময় কাজ করেন। সিলেটে তাঁর সাথে প্রায়ই আমার দেখা হত। ইব্রাহিম আলী ছিলেন কঠোর পরিশ্রমি চিকিৎসক। তিনি আমেরিকার গ্রিনকার্ডধারী হলেও সিলেটে থাকতেন। দুইপুত্রকে নিয়ে তাঁর পত্নী যুক্তরাষ্ট্রের কার্লিফোনিয়ায় অবস্থান করতেন। ডাঃ ইব্রাহিম আলী রাগিব রাবেয়া মেডিকেল কলেজসহ কয়েকটি হাসপাতাল ও ডায়গনেস্টিক সেন্টারে আল্ট্রাসনোগ্রাম করতেন।
ডাঃ ইব্রাহিম আলী বাগবাড়িতে একটি চারতলা বাড়ি নির্মাণ করেন। এই বাড়িতে একা একা থাকতেন। একসময় তাঁর স্মৃতিভ্রম রোগ দেখা দেয়। হাতপায়ে কাঁপুনি ধরে। ধিরে ধিরে কাজপাগল মানুষটি অবশ হয়ে যান। এত রোগ নিয়েও তিনি আমাদের ব্যাচের সবকটি অনুষ্ঠানে কেঁপে কেঁপে এসে হাজির হতেন। সবার প্রতি তাঁর মায়ামমতার কোন সীমা ছিলনা। বাংলাদেশে চিকিৎসায় কাজ হচ্ছেনা দেখে তিনি উন্নত চিকিৎসার জন্য আমেরিকা চলে যান। সেই যে যান আর জন্মভূমিতে ফেরা হয়নি। ডাঃ ইব্রাহিম আলী ২০২০ সালে মাত্র চৌয়ান্ন বছর বয়সে যুক্তরাষ্ট্রের কার্লিফোনিয়ায় মারা যান। আমরা তাঁর বেহেশত কামনা করি। আমিন।
গোলাপগঞ্জ উপজেলার ফুলবাড়ি গ্রামের খায়রুল আক্তার চৌধুরী ও আসফাকুল ইমরান চৌধুরী ছিলেন আমার দূরসম্পর্কীয় ভাগনা। তাঁরা পরস্পর চাচাতো ভাই। খুব সম্ভব তাঁরা গোলাপগঞ্জ এম সি (মোহাম্মদ চৌধুরী) একাডেমির ছাত্র ছিলেন। তাদের সৌজন্যে এমসি কলেজে অনেকের কাছে আমি মামুতে পরিণত হই।
কৃশতনু, দুগ্ধবর্ণ, সুদর্শন খায়রুল আক্তার চৌধুরীর মুখে সবসময় একটা মিষ্টি হাসি লেগে থাকে। খায়রুল আমার মত উচ্চতায় পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি। তাঁর কমিউনিকেশন দক্ষতা অসাধারণ। খায়রুল চৌধুরীর ইলেক্ট্রনিক্স মেধা জন্মগত ও আল্লাহ প্রদত্ত। তিনি ছাত্রজীবনে টেস্টার দিয়ে খুচাখুচি করে টিভি, ফ্রিজ, রেডিও, টর্সলাইট ইত্যাদি মেরামত করে ফেলতেন। খায়রুল আক্তার চৌধুরী ইলেক্ট্রনিক্সে ডিপ্লোমা এবং বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন এবং সিনিয়র আইটি কর্মকর্তা হিসাবে ২০২৩ সালে অবসরে যান। খায়রুল আক্তার চৌধুরীর পত্নী নিম্মি চৌধুরী আনন্দনিকেতন স্কুলের শিক্ষিকা। তাঁদের দুই পুত্র, জৈষ্ঠ্য পুত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিটার সাইন্সে অনার্স পড়ছে। সে বেশ মেধাবী ও বিভিন্ন দেশে রবুটিক টেকনোলজী প্রতিযোগীতায় অংশ নিয়ে বিজয়ী হয়।
সুদর্শন ও ফরসা দুঃসাহসী আসফাকুল ইমরান চৌধুরী ১৯৮৯ সালে মাত্র তেইশ বছর বয়সে রহস্যজনক কারণে সদ্য বিবাহিত পত্নী রেখে পরপারে পারি দেন।
আত্মনিমগ্ন কবি মোহাম্মদ হোসেন দোয়ারাবাজারের সন্তান। অসচ্ছল পরিবার হতে আসা মোহাম্মদ হোসেনের বড় হবার দুরন্ত স্বপ্ন ছিল, কিন্তু জায়গীর বাসায় অবস্থান করে বাসার ছাত্রছাত্রী পড়িয়ে তিনিও হোঁচট খান। তিনি এম সি কলেজ থেকে রসায়ন বিজ্ঞানে অনার্স ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করেন। তিনি সিলেট শহরের খাসদবির সরকারি মাধ্যমিক স্কুলের প্রধানশিক্ষক হতে ২০২৩ সালে অবসর গ্রহণ করেন। মোহাম্মদ হোসেন অনেকগুলো আধুনিক কাব্যের রচয়িতা। তার কবিতা সরোবরে আছে জীবনে না পাওয়ার অব্যক্ত ব্যদনা, এক চাপা দুঃখবোধের হিমঘর যা আবৃতিকালে হৃদয়কে যন্ত্রণায় ভারাক্রান্ত করে দেয়। মোহাম্মদ হোসেইন তিন কন্যার বাবা। বড়কন্যা সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় হতে মাস্টার্সে প্রথম হয়েছে।
আতিকুর রেজা চৌধুরী ফেঞ্ছুগঞ্জ ঘিলাছড়ার অভিজাত ঘরের ছেলে। সে ছিল ফর্সা ও সতেজ। তার সাথে আমার বেশ ভাব ছিল। একদিন আমি তামাশা করে তাকে কি একটা গালী দেই। কিন্তু সে বেশ রাগ করে বসে। আমি তাঁর মাথায় হাত বুলিয়ে রাগ থামাই। ২০২৪ সালে তিরাশী ব্যাচের এক অনুষ্ঠানে একচল্লিশ বছর পর তার সাথে আরার দেখা হয়। তাঁর চেহারা সুরত সেই আগেকার মত রয়ে গেছে। শুনেছি সে এখন বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালের নির্বাহী কর্মকর্তা। কালো হোসেইন আহমদ ছিলেন মিসুক ও সুভাষী। তিনি এখন ঢাকায় আছেন।
যার সাথে আমার যোগসুত্র কোনদিন
ছিন্ন হয়নি, তিনি মাহবুব আহমদ। তার বাড়ি কালিগঞ্জ, জকিগঞ্জ। দীর্ঘতনু ও শ্যামলা মাহবুব মেধাবী, সরল ও রসিক ব্যক্তিত্ব। ধার্মিক ও নামাজি মাহবুব আহমদের উপরও ছাত্রজীবনে ছিল
দারিদ্রের কুঠারাঘাত, যা তার অপার সম্ভাবনাকে অনেকটা
নষ্ট করে দেয়। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হতে দ্বিতীয় বিভাগে বিএসসি পাশ করেন। মজার
ব্যাপার হলো সে বছর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র পাঁচজন বিএসসি পরীক্ষায়
দ্বিতীয় বিভাগ পান। পরিশ্রমী মাহবুব আহমদ ২০২৪ সালে পুবালী ব্যাংক
লিমিটেডের ডিজিএম পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
ঈদগাহের শাহাদাত চৌধুরী সাহেদের গ্রামের বাড়ি ছিল বারহাল, জকিগঞ্জ। সামান্য খাটো মিষ্টি চেহারার শাহাদাত চৌধুরী সাহেদ ছিলেন বন্ধুবাৎসল উদার ব্যক্তিত্ব। ঈদগায় সাহেদের তিতলা বাসায় মোহাম্মদ হোসেন, সিরাজ, সুশান্ত, আমি ও সাকিম বসে বসে অনেক আড্ডা দিতাম। শাহাদাত চৌধুরী সাহেদ পরে বিদেশে চলে যান।
ঈদগাহের হাজারিভাগ মহল্লার সাকিম আহমদ খুব সহজ সরল উদার চিত্তের মানুষ। তিনি কৃষি ব্যাংকে চাকুরি করতেন। একসময় চাকুরি ছেড়ে সপরিবারে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। আমি ঈদগাহ শাখার ব্যবস্থাপক থাকাকালে সাকিমের সাথে সর্বদা দেখা হত। মুহাম্মদ হোসেন, কাজি সুহেল, খরাদিপাড়ার মাসিমা মেসের সুখময় চক্রবর্তী, শাহাদত, সাকিম ও আমি প্রায়ই কলেজ শেষে ঈদগাহ রোড দিয়ে একসাথে হেঁটে হেঁটে খরাদিপাড়ার বাসায় ফিরতাম।
চট্টগ্রামের ছেলে শ্রী
সুশান্ত শেখর চক্রবর্তী ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তার
পূত্র। তারা কুমারপাড়া দিঘিপারের এক
টিনের বাসায় বসবাস করতেন। সুশান্ত শখের বসে বাসায় কবুতর ও মোরগ
পুষতো। সুশান্ত ছিল আমার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু, আমি অনেকবার তাঁর বাসায় যাই। একবার আমেরিকায় ভর্তি হলে সুশান্তের বাবা বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি পত্র বের করে দেন। তিনি সিলেট পলিটেকনিকেও আমার সহপাঠি ছিল। সুশান্তের সাথে আমার পাঁচ বছর একত্রে কেটেছে। সুশান্ত অতিমাত্রায় ভদ্র ও পরোপকারী, তাঁর কোন স্বার্থ চিন্তা নেই। শুনেছি, সুশান্ত
এখন ঠিকাদারী পেশায় আছে। বহু বছর পার হয়েছে বন্ধু সুশান্তকে আর দেখিনি। সুকান্ত যেখানেই থাকুক মহান আল্লাহপাক তাঁকে ভাল রাখুন, সুখে রাখুন।
কৃষ্ণবরণ ও মিশুক প্রকৃতির অধ্যাপক অরুণ কুমার পাল এমসি কলেজের গণিত বিভাগের প্রধান ছিলেন। তিনি কাজলশাহ দিঘিরপারে বসবাস করেন। এম সি কলেজে অধ্যয়নকালে মায়াবী চেহারার অরুন কুমার পাল বয়সের তুলনায় বাড়েন নি। তাই তাকে তখন একজন বড় বালকই মনে হত। অধ্যাপক অরুন কুমার পাল সিলেট শিক্ষাবোর্ডে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের দায়িত্ব হতে ২০২৪ সালে অবসর গ্রহণ করেন।
শ্রী সুখময় চক্রবর্তী কানাইঘাটের জাতক, সে খরাদিপাড়ায় আমার কাছে মাসিমা মেসে থেকে পড়ত। আমাকে তাঁর বেডে নিয়ে যেত। তাঁর সাথে আর দেখা হয়নি। একবার শুনেছি, সে সরকারি কলেজের অধ্যাপক হয়েছে। তাঁকে কেমন যেন রুগ্ন মনে হত।
নিরিহ সাকিম ছিলেন ঈদগাহ হাজারিবাগের আদি বাসিন্দা। তিনি কৃষিব্যাংকে কিছুকাল চাকুরি করে সপরিবারে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। জৈন্তার কৃষ্ণবরণ ওয়ারিস উদ্দিন ও শামসুদ্দিন ছিলেন দারুণ গণিতবাজ। তাঁরা ছিলেন ধার্মিক ও ভদ্র, কোন ঝগড়াঝাটিতে নেই। আমি তাদের কাছে ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে অঙ্ক বুঝে নিতাম। ওয়ারিস উদ্দিন গণিতে এমএসসি করে ইসলামি ব্যাংকে যোগদান করেন। ইসলামি ব্যাংক তালতলা শাখায় গেলেই তাঁর সাথে দেখা হত। কয়েক বছর পর চাকুরী ছেড়ে ওয়ারিস লন্ডনে গিয়ে স্থায়ী হন। তাঁর পুত্র অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় হতে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে বৃটিশ পেট্রোলিয়ামে উচ্চপদে কাজ করছে। ওয়ারিশের বাড়ি রাতারগুল জলাবনের ধারের কোন এক গ্রামে। শুনেছি, শামসুদ্দিন গণিতে মাস্টার্স করে জৈন্তা সরকারি কলেজের গণিত বিভাগ প্রধানের দায়িত্বে আছেন।
মনিপুরী সহপাঠী স্বপন কুমার সিংহ তাতিপাড়া হতে এসে ক্লাস করতেন। তার গ্রামের বাড়ি মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার আদমপুর। স্থুলকায়া ফর্সা ও চীনা চেহারার স্বপনের এসএসসি রেজাল্ট আমার মত হলেও পরে তিনি উপজাতি কোঠায় বুয়েটে সুযোগ পান। তিনি একজন উচ্চপদস্থ সরকারি প্রকৌশলী ছিলেন। তার পত্নী স্ত্রীরোগ বিশেষঞ্জ ডাঃ মিনতী সিনহা কিছুদিন আমার গৃহিণী ডাঃ নূরজাহান চৌধুরীর সহকর্মী ছিলেন। স্বপন কুমার সিংহ বাংলাদেশের হিন্দু ধর্মালম্বী ও উপজাতীয়দের মধ্য থেকে আসা প্রথম প্রধানবিচারপতি এস কে সিনহার শালক।
স্বপন কুমার সিংহ আমাকে একটি মনিপুরি শব্দ শিখান, শব্দটি ‘পামি, পামি’ যার অর্থ ‘ভালোবাসি, ভালোবাসি’। একদিন ডাঃ মিনতির সাথে লালাদিঘিরপারে স্বপনের বাসায় যাই। হাফপ্যান্ট পরা বেশ মোঠাসোঠা ফর্সা একজন চাইনিজ এসে সামনে বসেন। আমি চিনলেও তিনি আমাকে চিনতে সময় নেন। সুন্দর ছিমছাম দুতলা বাসা। তাঁকে মানসিকভাবে যেন বিপর্যস্ত মনে হল। ডাঃ মিনতি বললেন স্বপন হার্টের রোগী, ওপেনহার্ট সার্জারি হয়েছে।
বরইকান্দি এলাকার এনাম আহমদের সাথে নানা কাজে বারবার দেখা হয়। এনামের বয়স বুঝা দায়, মনে হয় এখনো তরুণ। তিনি এখন পপুলার ইন্সুরেন্স কোম্পানির সিলেট অফিসের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা।
চৌকশ সহপাঠি গোলাম রাব্বানী চৌধুরীর বাড়ি গোলাপগঞ্জের বাঘায়। তিনি সশব্দে কথা বলতেন ও বেশ দূর হতে শোনা যেত। প্রত্যুৎপন্নমতি গোলাম রাব্বানী চৌধুরী একজন সফল শিল্প উদ্যোক্তা। নয়াসড়কে তাঁর মামার আলিম ইন্ডাস্ট্রিতে খায়রুল চৌধুরী ও রাব্বানী চৌধুরীর সাথে মাঝেমাঝে দেখা হত। তিনি এখন বারাকাতুল্লাহ পাওয়ার কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ী নেতা। তিনি সিলেটের কুইন্স হাসপাতালের চেয়ারমেনের দায়িত্বে আছেন। রয়েলসিটিসহ সিলেটের অনেকগুলো হোটেল মোটেলে স্কুল ইত্যাদির তিনি উদ্যোক্তা পরিচালক। রাব্বানী চৌধুরীর মামি আমার পত্নীর খালাতো বোন রণকেলি গ্রামের জাতিকা জেবা চৌধুরী।
শান্ত ও সুভদ্র বড়লেখার নিজাম উদ্দিন গণিতে মাস্টার্স করে ‘ওপি-ওয়ান” লটারি জেতে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। তিনি আমার নানাবাড়ি পাতারিয়ার কাটলতলীর জাতক। তাঁর বাড়ির কাছেই মাধবকুন্ড জলপ্রপাতের অবস্থান। প্রবাসী বিএনপি নেতা বারিষ্টার সফিক, শেখঘাটের মুহিত, ভাদেশ্বরের সাহেদ চৌধুরী ও বদরুল এখন লন্ডনে আছেন। কলেজ জীবনে মুহিত ছিলেন খুব মোঠাসোঠা ও কথাবার্তায় হেন্ডসাম। সাহেদ চৌধুরী আমার আত্মীয়। কলেজ জীবনে সাহেদ বেশ ধূমপান করত। একবার তাঁকে আমি ধূমপানে বারণ করলে সে বেশ মাইন্ড করে। সে জবাব দেয়, আমি বিড়ি খাই, না খাই তাতে তোমার কি? সাহেদ ছিল ছিল সব সময় হাস্যমান ও চটপটে।
লালাবাজারের ফুটবলার লন্ডনপ্রবাসী মিয়া আশিক লালাবাজারে তার পিতার নামে আব্দুল গফুর হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন। কালো ও স্মার্ট নিজাম উদ্দিন আজ ব্যবসায়ী ও কানাইঘাটের মেয়র।
শমশেরনগরের সেলিম চৌধুরী, যার দীর্ঘ দেহাবয়বের সাথে ছিল ডিম্বাকৃতির লম্বাটে সুন্দর চেহারা। সুনামগঞ্জ জেলা হাইস্কুল হতে তিনি প্রথম বিভাগে এসএসসি পাস কতে এমসি কলেজে আসেন। তাকে এমসি কলেজে কখনও গান গাইতে দেখিনি কিন্তু পরবর্তীকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে দেশের একজন শ্রেষ্ট লোকসঙ্গীত শিল্পীতে পরিণত হন। তিনি হুমাউন আহমদের অনেক নাটকে সঙ্গীত পরিবেশন করেন। টিভিতে প্রায়ই তাকে গাইতে দেখতাম- “আঁকাবাঁকা মেঠোপথে কোন সুন্দরী হেঁটে যায়”। সেলিম চৌধুরীর গাওয়া হাসন রাজার একটি গানের ক্যাসেট আমার খুব প্রিয় ছিল। তাঁর গাওয়া হাসনগীতির সেই ক্যাসেট সারাটা বাংলাভাষী দুনিয়ায় ভাইরাল হয়। সিলেট বিভাগের লোকগানে তাঁর অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
সেলিম চৌধুরী খুব মেধাবী ছাত্র ছিলেন এবং এইচ এস সি তে প্রথম বিভাগ পান। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে অনার্স ও মাস্টার্সে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। আমেরিকা বৃটেন কানাডাসহ পৃথিবীর অনেক অনেক দেশে তিনি সঙ্গীত পরিবেশন করেন। দুঃখ হয় আমার এই প্রাণপ্রিয় সহপাঠি চিরকুমারই রয়ে গেছেন। জানিনা, কেন যে এমন হল।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে কোন না কোন ক্ষতির শিকার হননি, এমন মানুষ বাংলাদেশে নেই। সেলিম চৌধুরীও এর ব্যতিক্রম নন। একাত্তুরে বোমার আঘাতে তিনি গুরুতর আহত হন, নিজে কোনমতে বেঁচে গেলেও ছোটবোনকে হারান। বড়বোনের স্বামী ছিলেন মরমি কবি হাসন রাজার প্রপৌত্র সুনামগঞ্জের মেয়র কবি মইনুল মউজদিন। এই বোনও সিলেট ঢাকা মহাসড়কে এক কার দুর্ঘটনায় স্বামীসহ হারিয়ে যান। শিল্পী সেলিম চৌধুরী এখন তাঁর জন্মভূমি শমশেরনগরে একটি দাতব্য হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায় ব্যস্ত আছেন। শত যন্ত্রণা বুকে নিয়েও তিনি শক্ত মনোবল নিয়ে বেঁচে আছেন, মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন।
আমাদের অত্যন্ত মেধাবী সহপাঠী জাভেদ ইকবাল রুমি। তিনি সিলেট সরকারি পাইলট স্কুলের ছাত্র ছিলেন। এসএসসিতে তাঁর প্রাপ্ত নম্বর ৭৫৮ এবং পাঁচ বিষয়ে লেটার মার্ক। ছাত্রজীবনে খুব স্মার্ট, মিশুক ও বুদ্ধিমান ছিলেন। যৌবনে তিনি ছিলেন দীর্ঘকায়া, ফরসা ও ঝাকড়া চুলের অধিকারী সুপুরূষ। তাঁকে কেন্দ্র করে বিরামবেলায় ছাত্রদের হৈচৈয়ের আসর বেশ জমে যেত। তিনি বুয়েট থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। সেখানে তিনি সাইবার নিরাপত্তার কাজে উচ্চপদে আছেন। তাঁর বর্তমান ঠিকানা বোস্টন, ম্যাসাসুসেট। আমি আটলান্টিক পারের সুন্দর শহর বোস্টন গেলেও তাঁর সাথে দেখা হয়নি। রুমি একজন চিন্তাশীল রম্য লেখক। ফেলে আসা বাংলাদেশ তাঁর ভাবনার প্রধান বিষয়। পারিবারিক জীবনে পুত্রকন্যা নিয়ে তিনি প্রবাসে সুখী জীবন পার করছেন।
ডাঃ সৈয়দ ইনসাফ আলীও যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী, তার গ্রামের বাড়ি ছাতকের সৈয়দপুর। তিনি চক্ষুবিশেষঞ্জ সৈয়দ মারুফ আলীর ভাই।
২০১৪ সালে আমার বই সিলেট সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে উপহার দিতে গিয়ে এমসি কলেজের চারজন শিক্ষার্থী ও সহপাঠীকে সেখানে পাই। তারা হলেন উক্ত স্কুলের শিক্ষক শাহ মোঃ আখতারুজ্জামান, জহুর আহমদ, মখলেছুর রহমান ও মইনুল হক। সহপাঠী মখলেছুর রহমান মৌলভীবাজার জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা হন এবং মইনুল হক মৌলভীবাজার জেলা হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক হতে অবসরে যান। সেদিন সিলেট সরকারি পাইলট হাইস্কুলের শিক্ষক মিলনায়তনে উপস্থিত আমার আত্মীয় শিক্ষক সাদেক আহমদ চৌধুরী বললেন, আপনাদের ব্যাচের আর একজন টিচার আছেন, তিনি নুসরত হক।
বিসিএস কর্মকর্তা ইকবাল আব্দুল্লাহ হারুন খুবই ভাগ্যবান। তিনি মোহাম্মদ ইউনুস সরকারের আমলে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সচিব পদে পদোন্নতি পান। আমাদের সহপাঠী বন্ধুদের মধ্যে তিনিই পূর্ণ সচিব হবার সৌভাগ্য লাভ করেন। তাকে তো ধন্যবাদ দিতেই হয়।
এমসি কলেজের শিক্ষকতায় আছেন সালাহ উদ্দিন ফয়সল ও তুতিউর রহমান। তুতিউর রহমান এখন এমসি কলেজের অর্থনীতির অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান। নাজমুল ইসলাম জালালাবাদ গ্যাসে ও পারভেজ আক্তার এনজিও সীমান্তিকে কর্মরত রয়েছেন। রনকেলী দিঘিরপারের রাফেহ চৌধুরী ও ফারেহ চৌধুরী, এই বেঁটে দুইভাই একই ড্রেসপরে ক্লাসে আসতেন। তারা এখন যুক্তরাষ্ট্রের সিটিজেন। তাঁরা নাকি তাবলীগ জামাত নিয়ে ব্যস্ত থাকেন।
সুদর্শন ফর্সা ডাঃ শিবলী খান ওসমানী মেডিকেল কলেজ হতে এমবিবিএস করে
সিলেট শহরের একজন চিকিৎসক। তাঁর বাড়ি বিশ্বনাথের ঐতিহ্যবাহী গ্রাম দশঘর। তিনি বিশ্বনাথে প্র্যাকটিস করছেন।
নাজিম উদ্দিন এমসি কলেজের পর আমার সাথে সিলেট পলিটেকনিকে
ভর্তি হন। তিনি এখন শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকুরি করছেন।
২০১৩ সালে
একটা মজার ব্যাপার ঘটে, সিলেট আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এমবিএ পড়তে গিয়ে আমি
সেখানে এমসি কলেজ সহপাঠি মোঃ আব্দুল
লতিফকে বানিজ্যিক গনিতের শিক্ষক হিসাবে পাই। লতিফ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা
কমিটির একজন প্রধান হর্তাকর্তা। মাথার চুলছাটা হ্যাটপরা কাজলবরণ
আব্দুল লতিফকে চিনতে আমার কোন অসুবিধা হয়নি। এককালের সহপাঠি আজ আমার শিক্ষক।
আমি পরিচয় দিলামনা তাকে, তিনিও চিনলেন না আমাকে। ক্লাস
চলাকালে ব্যাংকের একজন এজিএম হিসাবে আমাকে তিনি আপনি আপনি করেই কথা বলতেন। এভাবে
দুই বছর তার কাছে লেখাপড়া করে পরিচয় গোপন রেখেই একদিন সনদপত্র নিয়ে চলে আসলাম।
সরলপ্রাণ
গোবিন্দ আজ আয়কর বিভাগে ও ডাঃ মতিন, ডাঃ আব্দাল মিয়া,
ডাঃ মতিউর, ডাঃ আব্দুল মান্নান স্বাস্থ্য বিভাগে কর্মরত আছেন। রানাপিংয়ের বেঁটে ডাঃ মুজিব
ওসমানী মেডিকেল থেকে এমবিবিএস পাশ করে মার্কিন কনে বিয়ে
করে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। দুগ্ধধবল
সদাহাস্য মাসুদে রাব্বানী ইসলামি ব্যাংকে ও মুজিবুর রহমান
ইবনে সিনা ফার্মাসিউটিক্যালে কর্মরত আছেন। এমসি কলেজে আমার
আগের রোল নং ১১৩ এর দরগাহ ঝর্নারপারের খোকন বৃটেনে ও রোল নং ১১৫ এর দরগার
পুকুরপারের গৌরাঙ্গ দীর্ঘাঙ্গ
কুমিল্লার সুদর্শন তরুণ রূকনের কোন খোজখবর আর পাইনি।
মেধাবী ও প্রাণপ্রাচুর্য্যে ভরপুর রুমি বুয়েট পাশ করে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান।
পিঙল চোখের
উজ্জ্বল শ্যামলা দীর্ঘতনু এডভোকেট এহসানুল মাহবুব জোবায়ের তখনই ছাত্রশিবির করতেন,
আমাকে শিবিরের মিছিলে নিয়ে যেতে প্রায়ই টানাটানি করতেন। তিনি এই দলে বেশ ভাল
অবস্থান তৈরি করেন ও পরবর্তীকালে ইসলামি ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি হন। তিনি ছিলেন কুলাউড়ার উপজেলার সন্তান।
এ সেকশনের একমাত্র ছাত্রী ছিলেন নুসরাত হক। কিন্তু একা হওয়ায় এ সেকশনে তাঁর মন বসেনি। কিছুদিন ক্লাস করে চলে যান বি সেকশনে। ছাত্রীরা ছিলেন কেবলমাত্র বি সেকশনে। আয়শা আক্তার, নুসরাত হক, রাফেজা বেগম হেমা, শোকরানা বেগম, তাবাসসুম ফেরদৌস নীতা প্রমুখের নাম মনে পড়ে। সেই সময়ের সিলেটের জেলা প্রশাসকের কন্যাও আমাদের সহপাঠিনী ছিল। তারা ছাত্রী মিলনায়তনে অবস্থান করত এবং টিচারদের সাথে ক্লাশে প্রবেশ করত। সামনের বেঞ্চ তাদের জন্য বরাদ্ধ ছিল। এই মেয়েদের বেশিরভাগ এখন বিদেশে আছেন।
ডাঃ তাবাসসুম ফেরদৌস নীতা সিলেট সরকারি মেডিকেল কলেজে আমার পত্নী ডাঃ নূরজাহান বেগম চৌধুরীর সহপাঠিনী ছিলেন। তাবাসসুম ফেরদৌস নীতা এখন অস্ট্রেলিয়ায় জীবনের তরী বেয়ে যাচ্ছেন। ছাত্রনেতা আজাদ আহমদ ছিলেন নীতার স্বামী, তিনি এ বি ব্যাংকের কর্মকর্তা ছিলেন। নুসরাত হক একমাত্র পড়ুয়া যিনি দুই সেকশনে অধ্যয়ন করেন।
৭ই মার্চ ২০২৪। ফেসবুকে খবর পাই প্রিয় বন্ধু হোসেন আহমদ সবুর নেই। তিনি আজ পরপারের বাসিন্দা। তিনি এম সি কলেজ এইচ এস সি (বিজ্ঞান) ১৯৮৩ ব্যাচের সহপাঠি। এই সিলেট শহরে আমরা যে কজন সহপাঠি বসবাস করি, তাঁদের মধ্যে দেখাশুনা হয় প্রায়ই। আমি পূবালী ব্যাংক প্রিন্সিপাল অফিস সিলেটে ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২ তারিখে যোগদান করামাত্রই আমাকে দেখতে অফিসে ছুটে আসেন। তাঁর বুক ছিল মায়ামমতায় ভরা। তখন স্ত্রীর ডাইলাইসিস নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় ছিলেন। চিকিৎসার যোগান দিতে তিনি প্রায় সর্বশান্ত, অথচ তাঁর ছিল অসাধারণ সহ্য গুণ। সব দুঃখ কষ্ট অবলীলায় সয়ে গেছেন জীবনের শেষপ্রান্তে। ছোট্ট একটা সরকারি চাকুরী নিয়ে সৎভাবে জীবন পার করেছেন। ছিলেন ধার্মিক ও নিঃশ্বার্থ পরোপকারী একজন মানুষ। আজ বাদজোহর শাহজালালের(রঃ) দরগা মসজিদে তাঁর কফিনের সামনে দাঁড়াতেই দুচোখ সজল হয়ে যায়। আমরা বেশ কয়েকজন বন্ধু তাঁর জানাজায় শরিক হয়। দুই বছর আগে তাঁর পত্নীর জানাজায় শরিক হয়েছিলাম। মহান আল্লাহ তাকে জান্নাত দান করুন আমিন।
কলেজে
অধ্যয়নকালে একদিন প্রিন্সিপাল গোলাম রসুলের পিতা মারা যান। আমরা কলেজবাসে এসে
নয়াসড়ক জামে মসজিদে তার জানাজায় শরিক হই। মানিকপীরের টিলায় তাকে দাফন করা হয়। এই
প্রথম আমি মানিকপীরের টিলার চূড়ার মাজারে আরোহন করি। এখান থেকে অনেক নিচের সিলেট
শহরটিকে অপূর্ব শ্যামল এক নিসর্গ জনপদ মনে হল।
এবার
আপনাদেরকে এম সি কলেজ জীবনে আমার বসত খরাদিপাড়ার গল্প শুনাব। ১৯৭৭
সালে গ্রামের চেয়ারম্যান ভোটের খরচ জোগাতে আমাদের তের চৌদ্দটি গরু বিক্রি হয় ও
অনেক ঋণের জন্ম হয়। আমাদের জমি বর্গাচাষে চলে
যায়। বড়ভাই তাহমিদ চৌধুরী মদন মোহন কলেজ সিলেটে গ্রাম হতে প্রতিদিন আসা যাওয়া শুরু
করেন। বোন সেহার বিয়েতে জমি বিক্রি করা কিছু
দুষ্টলোকের কারণে অসম্ভব হয়ে পড়ে। তারা বলত এজমালি সম্পত্তি কেউ কিনলে এতে তাদের স্বত্ব দাবী করবে ও দেখে নেবে। আমার
বাপচাচাদের মধ্যে কোন বাটুরানামা না থাকায় তাদের হুমকিতে ক্রেতারা ভয়ে সরে যেত। কালু
চাচার একমাত্র পুত্র আলালের ঘরের দুলাল শিক্ষাদীক্ষাহীন মতিভাইয়ের পৃথিবীতে কোন
কিছু করে টিকে থাকার কোন যোগ্যতা ও মন মানসিকতা ছিলনা। আমাদের প্রচুর জমিজামা ছিল।
এই জমির উপর নব্যধনী কিছু লোভী লন্ডনি দুষ্ট লোকের
কুদৃষ্টি পড়ে। এই লোভী রাক্ষসের দল জুয়াসক্ত মতিভাইয়ের সহায়তায় ও মছরুভাইয়ের গোপন
উদারতায় আমাদের চৌদ্দপনের বিঘা দু’ফসলা
মূল্যবান জমি ফুফুতো রেজা ভাইয়ের জাল সহিতে দলিল তৈরি করে দখল করে নেয়।
আব্বা
সফিকুর রহমান চৌধুরী আমাদের বংশের প্রতিষ্ঠিত
মসজিদ ও মাদ্রাসার প্রায় কমিটিতে চৌধুরী বংশের নেতৃত্ব দিতেন। কিছুলোক নানা সুযোগ
সুবিধা নিতে কমিটিতে ঢুকতো, তারা নানান
ব্যক্তিস্বার্থ আদায় ও চৌধুরী বংশের প্রভাব প্রতিপত্তি খর্ব করতে সচেষ্ট থাকতো। এই
চৌধুরী বংশের লোকজন দেশবিদেশে চলে গেলে এই পরিবারের বয়স্ক সুযোগ্য ব্যক্তি আমার
পিতা সফিকুর রহমান চৌধুরী তাদের টার্গেটে পরিণত
হন। এরা মতি ভাইয়ের এসব ক্রিয়াকলাপে সহায়তা করতো।
তারা মনে করত, চৌধুরী বংশের সফিক চৌধুরীকে শুন্য করে দিতে পারলে এই বংশের নামগন্ধ
দ্রুত নিঃশেষ হয়ে যাবে। অন্যদেরকে তারা তেমন হিসাবযোগ্য লোক মনে করতনা।
পৃথিবীতে
দুই ধরনের লোক থাকে একদল সৃজনশীল, যাদের হাতে জ্ঞান, ধনসম্পদ ও মানসম্মান সৃষ্টি
হয়। আরেক দল এর বিপরীত, তারা ধ্বংসশীল- এদের হাতে ধনসম্পদ মানমর্যাদা সব ধ্বংস হয়ে
যায়। মতিভাইয়ের ভাগে আমার চিরকুমার মখলিস চাচার সম্পদও ছিল কিন্তু এই জমিজামার
সিংহভাগ খুব অল্প সময়ের মধ্যে গায়ের পেটুক লন্ডনিদের
পেটে চলে যায়। মছরু ভাই তলে তলে
মতি ভাইকে হাত করে ষোলআনা সুবিধা নেন এবং মতিভাইয়ের কাছ
থেকে বাড়ির উত্তর দিকের প্রচুর জায়গা বাড়িতে ঢুকাতে সক্ষম হন।
এমনই এক
দূর্যোগময় অস্বচ্ছল সময়ে আমি এমসি কলেজে ভর্তি হই। আব্বার হাইস্কুলের সামান্য
বেতনের উপর বিরাট এক সংসারের বুজা চাপে,
তদুপরি প্রচুর সম্পদ বাস্তবে আছে অথচ কাজে নেই। একটুকরা জমি বিক্রি করে ঐ টাকায়
কলেজ হোস্টেলে কিংবা ছাত্রমেছে গিয়ে শান্তিতে পড়বো
তারও কোন উপায় ছিলনা। তখন আমাদের সহায় সম্পদ সব ভাগবাটুরা করে লোটপাট করে নেওয়ার
জন্য ঘরে বাইরে এক গভীর ষড়যন্ত্র ও দুষ্টখেলা জমে উঠেছিল।
আব্বা
সিন্ধান্ত নেন তার ধনী লন্ডনি ভাগনি
সিরিয়া আপার কাঁধে আমাকে চাপাবেন। আমার খালাত ভাই
তারেক আটদশ বছর আমাদের গৃহে অবস্থান করে পড়েছেন। আমাদের বাংলোয় অবস্থান করে অনেক
তালবা, ফুফুতো ভাইরা ও বাহিরের লোকেরা বছরের পর
বছর লেখাপড়া করেছেন। আব্বার ধারনা এটা আর এমন কি? একেতো
এমসি কলেজ অনেক দূরে, তদুপরি উচ্চমাধ্যমিক বিজ্ঞানের বিশাল কোর্স দাউদপুরের বাড়ি
হতে ঘোড়দৌড় দিয়ে আসা যাওয়া করে চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।
আজকের মত
উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা হলে হয়ত তখন দাউদপুরের বাড়ি হতে এম সি কলেজে আসা যাওয়া করতাম।
আমি তীব্র
মানসিক দ্বিধাদ্বন্দে ভুগলাম কিন্তু আর কোন দ্বিতীয় উপায় খোঁজে পেলাম না। শেষমেশ
একদিন আব্বা আমাকে নিয়ে শিবগঞ্জ খরাদিপাড়ায় তার ভাগ্নির বাসায় ফেলে আসলেন। বাসাটির
নাম ‘ফাজিলপুর লজ”। দোলাভাই সৈয়দ মইজুল ইসলাম কদই মিয়া
ছিলেন খুব বড় আত্মার লোক, তিনি দুহাতে টাকা উড়াতেন। হাতেমতাঈ
দোলাভাই লোকজনকে খুব সাহায্য করতেন, তার কাছে এসে কেউ খালি হাতে ফিরত না। একদিন
তিনি আমার বামকানের পানিপড়া রোগের টের পেয়ে বললেন- “ওবা সেফাক মিয়া, আমার কাছ থেকে
যত টাকা লাগে নাও, বালা করি ডাক্তার দেখাও”। চিকিৎসার
জন্য তিনি আমার হাতে তখনকার দিনের বারশত টাকা তুলে দেন।
আমি সিলেট
স্টেডিয়াম মার্কেটে গিয়ে নাক কান গলা বিশেষঞ্জ ডাঃ এ কে এম হাফিজকে দেখাই তখন তার
ভিজিট ছিল মাত্র পঞ্চাশ টাকা। কোথাকার কোন মশামাছি এসে তার হাতীগাত্রে বসল, না উড়ে
গেল, না তার খেয়ে সাবাড় করল, এসব নিয়ে কদই দোলাভাইয়ের কোন ভাবনা ছিলনা। ভাদেশ্বর
নালিউরি গ্রামে পিচঢালা রাস্তার পাশে টিলার উপর তাদের খুব সুন্দর বাগান বাড়ি ছিল।
তাদের আটদশটি গাড়ি, পেট্রোল পাম্প, বিয়ে সেন্টার ও চাবাগানের
মালিকানা ছিল। তিনি সিলেটের মেহমান ভর্তি এই বদ্ধ বাসার চেয়ে নালিউরির বাগানবাড়িতে
থাকতে বেশী আনন্দ ও স্বাচ্ছন্দবোধ করতেন।
এখানে এসে
ভাগনা পাপু, ভাগ্নি জুলি ও কোলের শিশু ভাগ্নি এলিকে পাই। আর দেখলাম এখানে আমি
ছাড়াও আর দুইজন আত্মীয় তাদের পিঠে ইতিপুর্বে সওয়ার হয়েছেন। পহেলা জন টেকোমাথার
খানিক বেঁটে এডভোকেট মাসিয়ত উল্লা চৌধুরী, লন্ডনি সাহেবের সমনদিক, যিনি এখানে
অবস্থান করে সিলেট জজকোর্টে প্র্যাকটিস করছেন। দুসরা জন লন্ডনির
শ্যালিকা ফাবিয়া আপার বালিকা কন্যা ইমা, সে লন্ডনি দোলাভাইয়ের সন্তানদের খেলার সাথী ও শাহজালাল জামেয়া ইসলামিয়া স্কুলের সহপাঠিনী।
এবাসায় আমার
অনাহুত আগমন উকিল সাহেবের খুব মাথাব্যথায় কারন হয়ে গেল। তিনি একদিন আমাকে বললেন এই
ছড়া পার হয়ে একটু এগুলে ঝরনারপারে তোমার খালার বাসা, সেখানে চলে গেলে তোমার ভাল
হবে। কিন্তু উকিল সাহেব যেখানে চলে যাবার কথা বলছেন সেখানে থাকার মত অবস্থা হলে আমিতো
এখানে আসতামই না।
তিনি কোন
কোন দিন বলতেন, মাস্টর এখানে থেকে তোমার লেখাপড়া হবেনা অন্যদিকে রাস্থা খোঁজ।
সিরিয়া আপা কিংবা দোলাভাই কোনদিন তাদের ছেলেমেয়েদেরে পড়ানোর জন্য কোন তাগিদ দেননি,
অথচ উকিল সাহেবের এই ব্যাপারে খুব শিরঃপীড়া ছিল। তিনি প্রতিদিন সকালে বলতেন,
মাস্টর, তাদেরে নিয়ে পড়াতে বস। বাচ্চাদের প্রাইভেট টিউটার ছিল, রোজ রোজ এসে পড়াত।
তা সত্বেও উকিল সাহেবের জ্বালায় সকাল সন্ধ্যায় বাচ্চাদের নিয়ে বসতে হত। এযেন মায়ের
চেয়ে মাসীর দরদের ঠেলাঠেলি।
টিনের
পাকাবাসাটি লোকজনের তুলনায় ছোট হওয়ায় আমি বেশ কিছুদিন খরাদিপাড়ার দুতলা মসজিদের
গেটদিয়ে ঢুকে একজন বৃদ্ধার ঘরে রাতে ঘুমাই। এই
বৃদ্ধার দুই ছেলে বিদেশে থাকায় তিনি ভাইপো শাহানকে নিয়ে একাকী থাকতেন। একদিন
বিটিভিতে ফজলে লোহানীর জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান
“যদি কিছু মনে না করেন” দেখে দেরি করে গিয়ে
দেখি বৃদ্ধার ঘরের দরজা বন্ধ। ডাকাডাকি করে দরজা খোলাতে ব্যর্থ হলাম।
সেই রাতে প্রচন্ড শীত পড়ে, কোয়াশার মধ্যে এসে মসজিদের দুতলার মেঝে কনকনে শীতের
মধ্যে চাদরবিহীন ঘুমিয়ে পড়লাম। সে রাতে গাঁয়ে সোয়াটারও ছিলনা।
মসজিদের
জৈন্তাপুরী ইমাম সাহেব কি কারণে শেষরাতে
এসে এই দুঃসহ শীতে আমাকে এই অবস্থায় পেয়ে তার কক্ষে নিয়ে আলাদা বেডে শুইতে দেন।
উকিল সাহেবের নানা কথাবার্তার ছুরিকাঘাতে ক্ষতবিক্ষত হৃদয় নিয়ে নিতান্ত নিরুপায়
হয়ে বাসাটিতে সময় পার করি। শুক্রবার কিংবা ছুটির দিনে আমি কাম্মিনকালেও এই বাসায়
অবস্থান করতাম না। বৃহস্পতিবার সকালে বের হয়ে কলেজ করে বাড়ি ছুটতাম ও শনিবার
বিকেলে ক্লাস শেষে একবুক লজ্জার মাথা খেয়ে দুরুদুরু বুকে খরাদিপাড়ার বাসায় ফিরতাম।
বাসায়
কুটিনা নামের অজ্ঞাতকুলশীল বার তের বয়সের মেয়েটি বাচ্চাদের দেখাশুনা করত, মধ্যবয়সী
বাবুর্চি আব্দুর রহিম পাকঘরের ঠেলা সামলাতেন, তাকে সাহায্য করতেন ধলাই নামের
স্থূলকায় একজন মোঠামাথার গ্রাম্য যুবক। বাসার
ড্রাইভার চাবাগানের লোক, তার নাম ছিল গোপাল। এইসব কাজের লোকজন অন্নখেত ও বেতন নিত
লন্ডনি কদই মিয়ার, আর রোজ রোজ কনুইয়ের
গুত্তা খেত ছোটবোনের পিঠে সওয়ার হওয়া উকিল
মাসিয়ত উল্লাহ চৌধুরীর। তিনি কুটিনার গাঁয়ে একদিন বাশের
কঞ্চি ছোঁয়ালে বুদ্ধিমতি মেয়েটি চোখ রাঙ্গিয়ে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে- “খবরদার, আর
যদি আপনি এসব করেন তবে বলে দেব”। উকিল সাহেব
চুপসে যান। এখানে বাশের চেয়ে কঞ্চি শক্ত ও কঞ্চির ঘায়ে সবার প্রাণ
ছিল অষ্টাগত। উকিল সাহেবের স্বৈরশাসনে অতীষ্ঠ গৃহকর্মীরা
তার অত্যাচার হতে বাঁচতে পথ খোঁজে। কয়েকদিন
পর বাড়ি হতে খরাদিপাড়া এসে দেখি বাবুর্চি আব্দুর রহিমের চাকুরি
খতম ও ধলাই নালিউরিতে বিদায়, কেবল ড্রাইভার গোপাল টিকে আছেন। পরে জানলাম উকিল
সাহেবকে সরাতে তারা কি এক গভীর ষড়যন্ত্র করে ধরা খায় ও তল্পিতল্পা গোটায়।
জুলি তখন
ছোট্ট বালিকা, একদিন আমার একটি সাদাকালো ফটোতে কলম দিয়ে গোফ লাগিয়ে তার সামনে নিয়ে
বললাম, চিনতে পার কি এটা কার ছবি? ছবিটি দেখে সে ভয়ে চিৎকার দিয়ে উঠল। পাশের কক্ষ
হতে আপা ছুটে আসেন। আমি আজও চিন্তা করে পাইনা সে কেন এত ভয় পেল এবং এমন আচরণ
করল। এইচএসসি ফাইন্যাল পরীক্ষার কিছুদিন আগে এক সুদীর্ঘ
কলেজ ছুটিতে আমি খরাদিপাড়া থেকে দাউদপুর চলে যাই। সিরিয়া আপা ও দোলাভাই তখন লন্ডনে
ছিলেন। একদিন ফুফুত আব্দুল্লাহ
ভাই বাড়ি আসেন। তিনি অবিশ্বাস্য এক খবর দেন, খবরটি হল ভাগ্নি ইমা বেঁচে নেই, হঠাৎ
এক গলরোগ হয়ে দ্রুত সে চলে গেছে না ফেরার দেশে। শুনলাম,
তিনচার দিন আগে শাহপরানের কবরগায় তার দাফনও হয়েছে। আমি ভাগ্নি ইমাকে মাত্র কয়েকদিন
আগে সম্পূর্ণ সুস্থ্য ও হাসিখুশি রেখে আসি।
বালিকা ইমার পিতা হোসেন আহমদ দোলাভাই সোনালী ব্যাংকে
চাকুরি করতেন ও একটি হোন্ডা ফিফটি মোটর
সাইকেলে এসে প্রতিদিন দুপুরে এখানে খেয়ে মেয়েকে দেখে যেতেন। বালিকা ইমা ছিল বেশ
বুদ্ধিমতি, প্রায়ই সে গান গাইত- “একদিন ছুটি হবে, অনেক দূরে যাব। নীল আকাশে সবুজ
ঘাসে খুশিতে হারাব”। হ্যা, সত্যিই যেন ইমার ছুটি হয়ে
গেল, সে তার গাওয়া গানের কলির লাইনের মত সেই নীল আকাশে চিরদিনের মত হারিয়ে গেল।
এবার আমি
আমার প্রথম পাওয়া প্রেমপত্রের গল্প শুনাব। প্রেমপত্রটি আমি দেইনি, এটা আচমকা আমার
উপর অবতীর্ণ হয়। আজকের মোবাইলের যুগে আর অনেক
কিছুর মত প্রেমপত্রও উদাও হয়ে গেছে। অথচ সেকালে এই প্রেমপত্র ছাড়া কদমতলার বাশীই
বাজত না। পাশের বাসা একজন লন্ডনি হাজি
সাহেবের যিনি ছিলেন জগন্নাতপুরের অধিবাসী। এখানে তিনি তার
দ্বিতীয়া সহধর্মিনী নিয়ে জীবনের শেষ অবসর দিনগুলো তসবিহ জপে জপে পার করছিলেন। হাজির
অষ্টম শ্রেণি পড়ুয়া কন্যা মিলন বেগম একদিন সিরিয়া
আপাকে এসে বললেন “দুই একদিনের জন্য তাইনর ইংরেজি
গ্রামারটা আমার দরকার”। সিরিয়া আপা একটু কৌতুক করে আমাকে ডেকে
বললেন “ও বা মিলনের তাইন, তোমার গ্রামারটা তাকে কয়েকটা দিনের
জন্য ধার দাও”। আমি ধরে নিলাম এটাতো স্বাভাবিক ব্যাপার যে কেউ একটা বই খোঁজে নিয়ে পড়তে পারে। তাছাড়া স্কুলে আসা যাওয়ার
পথ ব্যাতিরেকে এই মেয়েটির সাথে আমার কোনদিন তেমন একটা দেখাও হয়নি। আমি এর ভিতর কোন
মতলব আছে আদৌ টাহর করতে পারিনি।
কিন্তু
অচিরেই একটা মতলব টের পেলাম যখন কয়েকদিন মেহমানদারী করে গ্রামারটি ফেরত আসল।
গ্রামারের ভিতর লুকিয়ে আসল মিলন বেগমের একটা মধুভরা প্রেমপত্র। সুচনা মাস্টার
সাহেবে ও সমাপ্তি এক গানের কলিতে “যদি একখান সুন্দর মুখ পাইতাম, মহেশখালির পানখিলি
তারে বানাই খাওয়াইতাম”। অষ্টম শ্রেণির অল্প বয়সী এক কিশোরীর কাচা
হাতের লিখা চিটি, খাপছাড়া ভাষায় কচি হৃদয়ের ভালবাসার আকুল
আকুতি পেলাম। ভাসান বন্যার জলে তখন এক ভাসমান খড়কুটো আমি, আমার কি আর এত সময় আছে
প্রেম প্রেম খেলায় মেতে উঠার, কিংবা না সাহস আছে চৌদ্দপনের বছর
বয়সী এক কিশোরীর সাথে খেলতে গিয়ে ধরা পড়ে মানসম্মান খোয়ানোর ঝুঁকি
নেওয়ার। এই অপ্রেমিক মাস্টার সাহেবের পাষাণলোহা হৃদয়ের সাড়া মিলন বেগম কোনদিনই
ফেরত পাননি। চট্টগ্রামের মহেষখালি দ্বীপ কেন, সিলেটের বন্দরবাজারের পানখিলি
খাওয়ানোর কোন সুযোগও মিলন বেগমের ভাগ্যে আর জুটেনি। বিষয়টা খুব তুচ্ছ একটা সাধারণ ঘটনা
হলেও আমার কাছে তা ঐতিহাসিক, কারণ এই চিটিই
ছিল আমার হাতে আসা কোন মেয়ের প্রথম নিবেদিত প্রেমপত্র।
একদিন পাশের
মাসিমা মেছে আমার এক হিন্দু সহপাঠি রসময় চক্রবর্তীর কক্ষে যাই। কানাইঘাটের ছেলে এই
রসময় নিরীহ ও পড়া-নিমগ্ন ছাত্র। নাম আজ আদৌ মনে পড়ছেনা এমন আর কয়েকজন সহপাঠি ও
পরিচিতকে সেখানে পাই। তারা আমাকে কানেকানে একটি লোভনীয় প্রস্তাব
দিল, তারা কয়েকজন মিলে গোপনে রাতে ভিডিওতে পর্ণছবি
দেখবে। আমি চাইলে একটা চাঁদা দিয়ে তাদের সাথে শরিক হতে পারি। আমি বললাম এইসব
ছাইপাস দেখার আমার সাহস নেই, অবসরও নেই। পরদিন তাদের পর্নছবি দর্শনের নানা অশ্লীল
গল্প শ্রবন ইন্দ্রীয়কে বেশ জালাপালা করে।
সেকালে
পর্নছবি দেখা ছিল খুবই বিপদজনক কাজ। বাহিরের লোকজন জেনে গেলে বাসা ঘেরাও করে ধরে
গনপিটুনী দিতে কসুর করবেনা। আর পুলিশ টাহর পেলে
ভিডিও, টিভি ও নীলছবিসহ সব দর্শকদেরকে ধরে নিয়ে চালান দেবে। এমন কি পরদিন পত্রিকায়
সবার কুকীর্তির সবিবরন ছবিও ছাপা হয়ে যেতে পারে। অথচ আজকাল তা নস্য, গোগলে সার্চ
দিলেই পর্নছবি এসে দৌড়ে সামনে হাজির। একেই বলে যুগ বদলের অপহাওয়া,
আজ কার সাধ্য পর্ণছবি আটকায়।
স্থুলকায়া
কদই দোলাভাই ছিলেন গোলবদন হাসিমুখের মানুষ, মাথায় একটু টাকপড়া হলেও চেহারায় ছিল
লাবন্য ও অভিজাত্যের ছাপ। স্যুট কোট টাই পরে ফিটফাট হয়ে থাকতেন তিনি। বিছানায় তার
পাশে শুয়ে অনেক সময় হাত-পা উঠিয়ে দিতাম। তার ওজন ছিল বেশি।
একদিন রসিকতা করে কোলে তুলে বিপদে পড়ি, না পারছি রাখতে, না পারছি
নামাতে। শেষে কোনমতে নরম বিছানায় ফেলে দিয়ে রক্ষা পাই। তার দুই ভাই
ছন্দই ও এনাম ভাই ভাদেশ্বর নালিউরি থাকতেন। কাজলবরণ
দুই ভাইয়ের মধ্যে ছন্দই একটু খাটো ও এনাম ভাই ছিলেন দীর্ঘাঙ্গ।
অন্যজন পঙ্কি ভাই এর বাসা ছিল নয়াসড়ক। তিনি কিছুটা
কদই দোলাভাইয়ের মত, তবে বেঁটে ও কৃশকায়। তারা ভাইরা এত সরল ও ভাল মানুষ ছিলেন যে,
মনে হত বাংলাদেশের অন্ততঃ কিছু মানুষ তাদের মত হলে দেশটা বদলে যেত।
বহুবছর পর
আমি ছিলাম পুবালী ব্যাংক লিঃ মোকামবাজার শাখার রিলিভিং ম্যানেজার, একজন যাত্রিবাস
হতে দেখলাম নালিউরির ঔ বাড়িটিতে গাড়ির সারি ও মানুষের ভীড়। পরদিন অফিসে নালিউরির
একজন কাস্টমার বললেন গতকল্য ছন্দই ভাই মারা গেছেন। এনাম ভাই পরে গ্রামের মেম্বার
হন, তিনি ছিলেন আমার ছোটমামা শহিদের সহপাঠি।
সেই সময়
এনাম ভাইয়ের বিয়ে খাই, নালিউরি হতে শেওলায় গিয়ে বেশকটি মিনিবাস নিয়ে বড়খেয়ায়
কুশিয়ারা নদীপার হই এবং একটু সামনে গিয়ে যানগুলো সাতরে জলেডুবা এক রাস্থা পার হয়ে
আমদেরকে সাদিনাপুর কনেবাড়ি নিয়ে যায়। এনাম ভাইও
আজ নেই। অল্প বয়সে ব্রেন টিউমার হয়ে পরপারে চলে যান।
সে সময়
সিরিয়া আপা দুএকবার আমাকে কিছু টাকা দিতে চাইলে আমি নেইনি, মনে হত
এখানে থেকে তাদেরকে অনেক যন্ত্রনা দিচ্ছি, তার উপর তাদের টাকা নেব এটা হয়না। আমার
বিপদের দিনে তাদের কাছে আশ্রয় পেয়েছি। দোলাভাই ও সিরিয়া আপার সীমাহীন স্নেহমমতা না
পেলে হয়ত আমি এবাসায় এতদিন টিকতাম না। তাদের কাছে আমার অনেক ঋণ আছে, আমি তাদের
কাছে শত ঋণী, শত কৃতঞ্জ।
ফাইন্যাল পরীক্ষার পর একদিন রেজাল্ট বের হল। এই বৎসর উচ্চ মাধ্যমিক বিঞ্জানে কুমিল্লা বোর্ডে মাত্র ৩৫% ছাত্রছাত্রী উত্তীর্ণ হন। এই রিজাল্ট আমাকে কাঁদাল, বাড়িতে না গিয়ে সিরিয়া আপার বাসায় সারা রাতভর কেঁদে বালিশ ভিজিয়ে দিলাম। এসএসসিতে হতাশা ছিল সামান্যের জন্য প্রথম বিভাগ হারানোর, আর এবারের কান্না, জীবনে আটকে পড়ার কান্না, এই রেজাল্টে ভাল কোথাও ভর্তি হওয়া যাবেনা। ইংরেজিতে সমস্যা হওয়ায় বেশ ভাল নম্বর উঠানো সত্বেও উচ্চ মাধ্যমিক চুড়ান্ত পরীক্ষা যতটুকু ভাল ফলাফল আশা করেছিলাম, তা হলনা। আমার এই অস্থির অবস্থা দেখে পরদিন সিরিয়া আপা বললেন এটা এমন চিন্তার কি? এক বছর সময় কিছুনা, আগামী বছর আবার পরীক্ষা দিয়ে পুষিয়ে নেবে। আর একটা বছর পড়লে তুমি নিশ্চিত প্রথম বিভাগ পেয়ে যাবে।
সিরিয়া
আপাকে বললাম আমি কোন রাজপুত্র হয়ে জন্মিনি যে বারবার পরীক্ষা দিয়ে সময় নষ্ট করব।
আমার যে করুন আর্থসামাজিক অবস্থা তাতে
বাস্তবতা হল দ্রুত কিছু শিখে আমাকে জীবনযুদ্ধে নেমে পড়া। আমি
অযাচিঁতভাবে অন্যের গলগ্রহ হয়ে তাদেরকে আর এক বছর কষ্ট দেই, এমনটি আমার মন চাইলনা।
আমি একদিন
খরাদিপাড়া ছাড়লাম, মনে মনে বুঝলাম সিরিয়া আপা বেশ মনঃকষ্ট পাচ্ছেন। তবুও তাদেরকে
প্রায় দেড় বছর অনেক অনেক যন্ত্রণা দিয়ে এক অনুজ্বল ফলাফল নিয়ে ভগ্নহৃদয়ে
অগন্তস্থ্য যাত্রায় বেরিয়ে পড়লাম। দেখলাম আমি দুইটি ভূল করেছি, প্রথমতঃ গণিত বাদ
দিয়ে উদ্ভিদবিজ্ঞান নিয়ে পড়লে অবশ্যই ভাল হত। দ্বিতীয়তঃ
বিজ্ঞানের বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিলেও আমি ইংরেজিকে
তেমন আমলে নেইনি। আর্থিক অসচ্ছলতা তো ছিলই, তাই অনেকে ইংরেজি বিষয়ে টিউশনি পড়লেও আমি পড়িনি। সেইসাথে ছিল খরাদিপাড়া ও দাউদপুরের
বাড়িতে লেখাপড়ার এক অগুছালো এলোমেলো পরিবেশ। নানি রফিকুন্নেছার জীবনের শেষবেলায় আম্মা আসমতুন্নেছা ও অগ্রজা আনিছা মান্না অসুস্থ্য নানির সেবাযত্ন করতে অনবরত নানাবাড়ি অবস্থান করতেন। দাউদপুরের বাড়িতে
গেলে সেখানে আম্মা ও বোন প্রায়ই অনুপস্থিত। আব্বা সফিক চৌধুরী একা, কাজের মেয়ে শমি ও তসিঝি রান্না
করে দেন। রাতে ইঁদুর মাটি কেটে মেঝে স্থুপাকার করে রাখত, ঘরের ছাদে গেছো ইঁদুর ছুটাছুটি করত, আঙ্গিনায় এলোমেলো ঘাস, কেমন যেন এক ছন্নছাড়া
পরিবেশ।
তখন দাউদপুর গ্রামের হাওরে আমাদের ভূসম্পত্তি কেড়ে নেবার মারামারি চলছে। চর দখলের মত জমিজামা কেড়ে নিতে ঘরে বাহিরে চলছে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হওয়া গ্রামের একদল দুষ্টলোকের মহোৎসব। এই ধরনের এক বৈরী ও শান্তিহীন পরিবেশে লেখাপড়ায় মন আর টেকে কতক্ষণ? সিলেট ও দাউদপুরের এই নোংরা আর্থ-সামাজিক পরিবেশ আমার জীবনের দিক নির্ধারণকারী সবচেয়ে গুরুত্ববাহী এইচ এস সি পরীক্ষা- ১৯৮৩ এর ফলাফলকে কেমন যেন অনুজ্জ্বল করে দেয়। জীবনে এলিট হবার স্বপ্নরাজ্য ধুঁয়ায় ছেয়ে ফেলে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন