শনিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

নানি রফিকুন্নেছা চৌধুরীর মহাপ্রয়াণ, স্মৃতির রঙ্গে আঁকা নানাবাড়িঃ

 

নানি রফিকুন্নেছা চৌধুরীর মহাপ্রয়া, স্মৃতির রঙ্গে আঁকা নানাবাড়িঃ 

দুই প্রজন্ম আগেকার দাদা, দাদি, নানা ও নানি এই চার জনের মধ্যে আমার স্মৃতিতে উজ্বল হয়ে আছেন মাত্র একজন, তিনি আমার মাতামহী রফিকুন্নেছা চৌধুরী।  মাতৃক্রোড় হতে নানাকে দেখেছি যিনি আমার মাত্র নয় মাস বয়সে মারা যান এবং আমার ভবে আসার কয়েকযুগ আগেই দাদা ও দাদি পরলোকবাসী হন। কুলাউড়া ঘাগটিয়া সাহেব বাড়ির মেয়ে নানির হাত ছিল খুবই বরকতময়। তিনি নানাবাড়ির মাটিতে কিছু রোপে দিলে প্রচুর ফলন হত। আমগাছে পান লাগান, সারা গায়ের লোক খেয়েও শেষ হতনা। শীতের শেষে শক্ত আঙ্গুরলতা বৃক্ষটি সবুজপত্র ও প্রতি পত্রবৃন্তে থোকা থোকা আঙ্গুরফলে ভরে যেত। ত্রিশবিঘা অর্ধটিলা বাড়িটি ছিল আম কাটাল লিচু বেল জলপাই সুপারি জাম্বুরা ইত্যাদির এক বিশাল ফলবাগান। খালিবাড়িতে রবিশষ্যের সাথে হত প্রচুর আদা ও হলুদ। পিছইন বনে লতায় ঝুলে থাকত অজস্র হলুদ কাঁকরোল।

পশুপালনেও ছিল নানির রাজকপাল। রাজহাঁস, টেপীহাস, মোরগ ও ছাগলের বিশাল কোয়াড় ছিল নানির। দরজা খোলামাত্র পচিশ ত্রিশটি ছাগল দৌড়াত, শতাধিক পাতিহাস রাজহাস দুই পুকুরের দিকে সশব্দে এগিয়ে যেত। আমরা নানাবাড়িতে গেলে হাস মোরগ ও খাসীর ভুরিভোজ চলত প্রতিদিন। বাড়ির চারপাশের ধানিজমিও ছিল এবাড়ির মালিকানায়, তাই এত ছাগল হাস মোরগ বিচরনে ভূমির কোন অভাব ছিলনা।

সামনের বড়পুকুরের মাছভাজি দিয়ে হত চোঙ্গাপোড়ার মজাদার খাবার ও রুটপিঠা। বাড়ির উঠোনে  চোঙ্গাপুড়া ও রুটপিঠা পুড়ানোর আনন্দ ছিল বেশুমার। প্রথমে এক ধরনের বাশের ভিতর কলাপাতা ঢুকায়ে তাতে জলেধূয়া আটালো ভাতের চাল ভরা হত। এই বিরনচাল ভরা বাশের চোঙ্গাগুলো খড়ের আগুনে পোড়ালে তৈরী হত সুগন্ধি ও মাজাদার চোঙ্গাপোড়া পিঠে। দক্ষিনের হাওরের পানি বড়পুকুরের কোনদিয়ে প্রবেশ করান হলে প্রচুর মাছ লাফিয়ে লাফিয়ে বের হত। আমরা এসব মাছ ধরে টুকরি ভরে ফেলতাম।

দক্ষিনভাগ পাহাড়ঘেরা বাগান এলাকা, শীত পড়ত প্রচুর। প্রতি জানুয়ারীর শীতে এখানে আমরা রেহা, সেহা, মান্না, তাহমিদ, নিশাত ও আমি; খালাত বুলু ভাই, তারেক ভাই, সাহেদ, এলি আপা, কলি আপা, দিলি আপা, জলি, শিবলি ও মামাত নিপা, রিপা, আরফা, সোফা, আফজলসহ ভাইবোনরা মিলে চলত জাম্পেশ আড্ডা ও দিনভর খেলাধুলা।  মাঝে মাঝে শরিক হতেন খুকি, মনি, কেরল, খায়রুল, সিবই ভাই, ছফুল ভাই, ওহিদ ভাই, হাদু ভাই, ইমাভাবী। কুলাউড়া হতে আসতেন ফকুমামা, তাহিরমামা, সাবুমামা, আসিকুল, শোভা, সেফু আপা, তপন, গীনিখালা সহ অনেকে। দুপুরে পুর্ববাড়ি ও বিকালে পুরানবাড়িতে পর্যায়ক্রমে চলত চানাস্তার আড্ডা। সেইসাথে চলত বরই ও জাম্বুরা চাটনির আসর। দুইবাড়িতে খেলার আসরও জমত। গোল্লাছুট, মার্বেল, দশপঁচিশ, তাস আর কত কি। দুই বাড়িতেই যখন তখন তক্কক ডাকত- ক ক্কা, ক ক্কা, ক ক্কা ---

দক্ষিনভাগে ঘাসের কোন অভাব ছিলনা, তাই ধানের খড় খালিবাড়ির মাঠে স্থুপাকারে ফেলে দেওয়া হত। আমরা শীতের কুয়াশা ঝরা ভোরে এই খড় জ্বালিয়ে আগুন পোহাতাম। বর্ষায় এই খড় পচে মাটিতে মিশে যেত। তাই সেই মাটি ছিল খুব উর্বর এবং প্রচুর আদা, হলুদ, কাঁকরোল, মুকি, শিম, তুত, পান ইত্যাদি ফসল ফলতো।   

লয়লা ঝি, আমিনা ঝি, শুয়াই ঝি, রঙ্গী ঝি, তজি, কাজই, নমির, বদলা, মাসুক, ফরিদ, হাসনারা পাকঘরে ভীড় করে নানির চারপাশে বৃত্ত রচনা করতেন। নানির এই লোকবৃত্ত বিশাল বাড়িতে তাকে ঘিরে নিয়ে আবর্তিত হতসারাদিন চানাস্তা পান সুপারির বন্যা বইত। হাসমতি ঝি ও তার পুত্রকন্যা ছাকিল, অকিল, ছবিল, শমি ও সামিনা ছিল বাড়ির ভিতরের সদস্য ও আমাদের খেলার সাথী ছিল। ছবিল ছিল বোবা ও প্রচুর কাজ করত। সে আমরা ফিরে আসার দিন রেলগাড়িতে উঠার পর স্টেশনে দাঁড়িয়ে চোখমুছে কাঁদত। পরবর্তীকালে কোন একসময় সে হারিয়ে যায়।

হাসমতিঝি লাতুর ট্রেনের ঝনার ঝন শব্দ শুনে সকাল ও সন্ধ্যায় টেবিলে খাবার পরিবেশন করতেন। কোন কারনে ট্রেনের দেরী হলে খাবারেও দেরী হত। দক্ষিনভাগে শীতে পুকুরের পানি শুকিয়ে যেত, আমরা পিছনের লস্করের বাড়ি গিয়ে তাদের গভীর পুকুরে গোসল করে আসতাম। কেউকেউ ইন্দারার(কূপ) পানি উঠিয়ে গোছল করত।

মৌলানা মামা ঘরের খরচপাতির হিসাব পাই পাই করে খাতায় সব লিখে রাখতেন। একদিন তার হিসাবের খাতা পড়ে সবাই খুব হাসলেন, খরচের পাতায় সবাই দেখলেন একস্থানে লিখা আছে, অমুক তারিখে কুলাঊড়া জংশনে ভীড়ের মধ্যে পকেটমার কতৃক মেরে দেওয়া অর্থের মোঠ পরিমান দুই শত টাকা মাত্র।

একবার নানাবাড়িতে প্রচুর কচুর মুকি হয় কিন্তু সমস্যা হল রান্না করা এই মুকি খেলে গলনালতে চুলকায়। সবাই বললেন এই মুকি খাওয়া যাবেনা, দক্ষিভাগ বাজারে পাঠিয়ে বিক্রি করে দেওয়া হউক। মৌলানা মামু বললেন পণ্যের দোষক্রুটি গোপন রেখে পণ্যবিক্রি করা কোনমতে জায়েজ হবেনা। গৃহকর্ম অসির মামু দুইবুজা মুকি নিয়ে বাজারে ছুটলেনমৌলানা মামু কড়া নির্দেশ দিলেন ক্রেতাকে বিক্রির আগেই বলে দিতে হবে এই মুকি খেলে গলে চুলকায়। অনেক ক্রেতা আসল কিন্তু চুলকানোর কাহিনী শুনে একে একে সবাই সরে গেল। একটা আদমও অসির মামুর কোন মুকি কিনলনা। ব্যর্থ অসির মামু শেষবাজারে জানতে চাইলেন অবিক্রিত এত মুকি তিনি কি করবেন। মৌলানা মামা আদেশ দিলেন সব মুকি রেল লাইনের খালে ফেলে দিয়ে চলে আস

গৃহকর্মি অসির মামু ফিরে এসে আক্ষেপ করে বললেন ‘আজকের দুনিয়ায় হাছা মাতরার ভাত নাই। হাছা মাতলাম তাই একটা মানুষও মুকি কিনলনা। যারা মিছা মাতে তারাই ঠিক। আজকে মিছা মাতলে শালারা সব মুকি কিনে নিত, একটা মুকিও রেলের খালে ফেলে আসতে হতনা’

একবার টাকার খুব প্রয়োজন দেখা দিলে ছোটমামি তার একটি পোষা খাসী বিক্রি করতে বাজারে পাঠান। নিয়ে যায় গৃহকর্মী বগডুল ছাকিল। মামীকে সে বলল- চাচি কত টাকায় বেচবো? মামী বললেন আমার আড়াই হাজার টাকার দরকারবাজারে খাসিটী তুলা মাত্র ক্রেতারা দাম হাকল চার হাজার টাকা। ছাকিল বলল চাচি বলে দিয়েছেন আড়াইহাজার টাকা, আমি আড়াইহাজার টাকা ছাড়া খাসীটি বেচবো না। সাথে সাথে ছোটমামার এক সাগরেদ দৌড়ে তাকে বলল, শহিদ ভাই এখনই আসেন নইলে তোমাদের ছাকিল উল্লা অর্ধেক দামে খাসীটি বিক্রি করে দিবে। মামা গিয়ে দামদর করে খাসীটির দাম উঠালেন আট হাজার টাকা। ঘরে ফিরে সাকিল কাচু মাচু হয়ে মামিকে বলল, চাচি আমি ছাগল বেচতে চেয়েছিলাম আড়াই হাজার টাকায়, ছোট চাচা এসে এই দামে বেচতে দেন নাই। তিনি বেচে দিছেন আর নাজানি কত টাকায়। এমনভাবে বলছে, যেন সে দুষ করে ফেলেছে ও মামির কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চাইছে। এই হল হাসমতি ঝিয়ের বড় ছেলে ছাকিল।

স্বাধীনতা লাভের পরক্ষনের কাহিনী, তখন যুদ্ধবিদ্ধস্থ দেশে অভাবের তীব্র খড়াঘাত। ফকির ভিক্ষুকে দেশ ছেয়ে যায়। সেইসাথে চারপাশে অজস্র ছোট ছোট ছিচকে চুরির ঘটনা নিয়মে পরিনত হয়ে যায়একদিন ভোরে দেখা গেল নানাবাড়ির মসজিদের ওয়াল ঘড়ি নেই। রাতে কোন এক চোর মহাশয় এই স্বল্পদামী ঘড়িটি চুরি করে নিয়ে গেছেন।

চোর ঘড়িটি নিয়ে কাছের এক গ্রামে বিক্রি করে দেয়ঘড়ি উদ্ধার হল, সাথে চোরকেও গ্রামবাসী ধরে নিয়ে এল। এই চোর অন্য দশজন সাধারণ চোরের মত কেউ নন, তিনি টুপি পাঞ্জাবীপরা দাড়িওয়ালা একজন পরহেজগার হুজুর। পরিচয় নিয়ে জানা গেল তিনি দুরের গ্রামের এক ভদ্র ঘরের সন্থান।

লোকজন তাকে উত্তম মাধ্যম দিতে উদ্যত হলে চোর মিয়া বললেন আমার কিছু কথা বলার আছে, আগে আমাকে আপনারা আমার বক্তব্য রাখতে দিন, তারপর যা খুশি করবেন আমার কথা শুনার পর আপনারা আমার বিচার করবেন, আপনারা তখন আমাকে যে শাস্তি দিবেন মাথা পেতে নেব। মৌলানা মামু চোর হুজুরকে তার বক্তব্য পেশ করতে বললেন।

এবার চোর হুজুর বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম পড়ে আল্লাহ ও রসুলের নাম নিয়ে তার বক্তব্য ছুড়লেন ‘আমি ছলিম উদ্দিন জুতিরবন্ধের মোল্লাবাড়ির লোক। সে গ্রামে আমাদের পরিবারের বেশ নামডাক। আমার গোষ্টিতে সবাই আলেম, কেউ চোর নেই। আমার ঘরে গত দুইদিন ধরে কোন খাবার নেই। সবাই উপোষ আছে। আমাদের মত ভদ্র পরিবারের লোকরা যেখানে সেখানে হাত পাততে পারেনা। সারাদিনে কিছু করতে পারলাম না। কোন টাকা জোগাড় হলনা যা দিয়ে খানিকটা চাল কিনে নিয়ে বাড়ি ফিরি। এই মসজিদে রাতে এশার নামাজ পড়ে নিরাশ হয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকি।

এক সময় দুহাত তুলে আল্লাহকে বললাম হে মাওলা সারাদিনে কিছুই জোগাড় হলনা, এবার আমার চুরি করা ছাড়া আর কোন পথ খোলা নেই। উপবাসী বউ বাচ্চাদের মুখে দুমুঠো ভাত তুলে দিতে আমাকে শেষমেষ যদি চোর হতেই হয় তবে আল্লাহ তোমার মালই চুরি করব, আমি তোমার ঘরের ঘড়িটা চুরি করলাম, আমাকে ক্ষমা করে দিও’ এই বলে আমি এই ঘড়িটি চুরি করে রাতের অন্ধকারে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে চাল কিনে বাড়ি ফিরলাম ও দুদিনের উপবাসী বাচ্চাদের মুখে ঝাউভাত তুলে দিলাম।

এবার চোর হুজুর বললেন আমার বক্তব্য এখানেই শেষ, আপনারা আমার বিচার করুন এই চোরের সাথে জামাতে এসার নামাজ পড়া মৌলানা মামুর চোখে জলের ফোটা দেখা গেল। চোরের বক্তব্য শুনে মামা নিজের পকেট হতে টাকা বের করলেন, চারপাশ হতে চাদা তুলে প্রচুর টাকা চোরের হাতে তুলে দিয়ে বললেন এই টাকা নাও, কিছু একটা করে খাও, দেখ খোদা কিবা করে। চোর হুজুর তিরস্কারের বদলে পুরস্কার পেয়ে হাসিমুখে ফিরে গেল।

বড়মামা ছাদ্দিক পাশের চাবাগানে ও বনে এয়ারগান নিয়ে ছুটতেন পাখি শিকারে। পাখি পড়ামাত্র আমরা কুড়িয়ে জবাই করে ব্যাগে পুরতাম। নানা বর্ণের নানা আকারের বৈচিত্রময় ভারী সুন্দর এইসব পাখি নিধন আমার খারাপই লাগত, তবে শখের বশে পিছুপিছু ছুটতাম। মেঝমামা ফজলুর রহমান চৌধুরী ওরফে সিদ্দিক ছিলেন বি কম পাস, তিনি চট্টগ্রাম পেপার মিলে চাকুরি করতেন। তিনি ছুটিতে এসে চাকতিঘুরা কলেরগান বাজাতেন- ‘চন্দনের পালঙ্কে শুয়ে একা একা কি হবে, ও গো তোমায় যদি পেলাম না’ কিংবা ‘আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যার দেশে, সাত সাগর আর তের নদীর পারে/ময়ুর পঙ্কী সাজিয়ে এলাম সেথা, আমি দেখে এলাম তারে’ রাতে চোরের পদশব্দ শুনলে মেঝমামা চোর তাড়াতে উচ্চশব্দে ক্যাসেট বাজাতেন। তাতেও কাজ নাহলে রুলার দিয়ে টিন পেটাতেন।

ছোটমামা শহীদ চৌধুরী দিনরাত ব্যস্ত থাকতেন খেলার জগতে। কখনো রেডিও বাজিয়ে খেলার ধারাভাষ্য শোনা, দক্ষিনভাগ স্কুলের মাঠে ফুটবল খেলা নিয়ে। মামা বাশি বাজাতেন আর আমরা বল নিয়ে মাঠে মহানন্দে ফুটবল খেলায় নিমগ্ন হতাম। বাজারে ব্যাডমিন্টন টুর্নামেন্ট হত, এই টুর্নামেন্টেরও পরিচালক ছোটমামা শহিদ চৌধুরীটুর্নামেন্টে অংশ নিতেন ড্রাগন ক্লাব, ফেন্ডাস্টিক ক্লাব, টাইগার ক্লাবসহ সুন্দর সুন্দর নামের অনেক অনেক ক্লাব। বৈদ্যুতিক বাতির আলোয় শীতের রাতে আমরা ব্যাডমিন্টন খেলে ঘেমে ভিজে ঘরে ফিরতাম। ছোট মামার বাইসাইকেল চালিয়ে মাঝে মাঝে ধামাই ও সোনারোপা চাবাগানে চক্কর দিতাম।

পাশের রশিদাবাদ চাবাগানের ম্যানেজার ছিলেন আমার মেঝ দুলাভাই আব্দুল কুদ্দুস চৌধুরী। বাগানের জিপে সেই বাগানের সুউচ্চটিলার উপর নির্মিত সুরম্য বাংলোয় গিয়ে সবাই আনন্দফুর্তি করে দিনরাত কাটিয়ে আসতাম। কারখানার ডুকে চা তৈরীর কর্মপ্রবাহ দেখতাম। চাবাগান কর্মি রবি ও নীলমণি আমাদের সেবাযত্ন করত।

ছোটমামার সাথে দক্ষিনভাগ রেলস্টেশন মাস্টারের বন্ধুত্ব ছিল। ট্রেনের আগমনের শব্দ শুনে মেহমানরা ট্রেন ধরতে ঘর হতে বের হতেন। সবাই রয়েসয়ে ছুটতেন কেবল ছোটমামা দৌড়ে গিয়ে স্টেশন মাস্টারকে ট্রেন একটু লেট করতে বলতেন। মামার খাতিরে ট্রেন ছাড়ার সবুজ ফ্ল্যাগটি আর উড়তনা, সবাই ধীরপদে এসে ভালভাবে ট্রেনেঊঠা শেষ হলে তবে সবুজ কাপড় উড়ত ও সেইসাথে হুইসেল দিয়ে ট্রেন যাত্রা শুরু করত। ছোটমামা শহিদ চৌধুরী ছিলেন বলবান ও সিংহের মত দুঃসাহসী এই এলাকার দুইজন ভয়ঙ্কর ডাকাত ছোটমামার ছুরিকাঘাতে ঘায়েল হওয়ার কাহিনী প্রচলিত থাকায় লোকেরা তাকে যেমন মান্য করত, তেমনি জমের মত ভয়ও করত।

তিনমামার বিয়ের স্মৃতিও সামান্য মনে আছে। কুরছি মামি মৌলভীবাজারের মোস্তফাপুরের সৈয়দ বংশের মেয়ে। তিনি আসার সময় আমি কেবল ছয়সাত বছরের বালক মাত্র। নানাবাড়ি কনে আসার পর মনে হল নববধূ দেখে বড়রা খুব একটা খুশি হতে পারেননি। শেষে না খুশের কারন বুঝলাম, ছাদ্দিক মামা খুব ফর্সা ও সুন্দর কিন্তু মামি সেই তুলনায় নরস। মেঝমামা সিদ্দিক বিয়ে করেন আমেরিকান কনে, তিনি নবীগঞ্জের দুর্লভপুরের কহিনুর চৌধুরী। এই কনে দেখে সবাই খুশীতে আটকানা। এযেন চাদে চাদে মহামিলন। মেঝমামার শালা মুরাদ মামা আমার চেয়ে খানিক ছোট ছিল, সে সুন্দর গান গেয়ে শুনাত-“সে যে কেন এলোনা, কিছু ভাল লাগেনা, এবার আসুক তারে আমি মজা দেখাব” এই দুই বিয়েই ১৯৭৩ কিংবা ১৯৭৪ সালে সুসম্পন্ন হয়। কেবলমাত্র ছোটমামা শহিদ চৌধুরীর বিয়েতে অনুশহর বড়লেখা পার হয়ে দাশেরবাজারের সন্নিকটে লঘাটি নামক গ্রামে বরযাত্রি হয়ে গমন করি। মামার শ্বশুড় শ্বাশুড়ির বেশ স্নেহ মমতা পাই।

তিনি মুহিত চৌধুরী, আম্মার সৎ ভাই মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরীর একমাত্র পুত্র। সুদর্শন গৌরবর্ণ মুহিত ভাইয়ের  অর্ধপাকা টিনের ছাদের ঘর। এই ঘরের খুটিতে গাঁথা ছিল আমার নানার শিকার করা দুই তিনটি হরিণের বহুডাল বিশিষ্ট শিং। তার পরনে চকচক করত সাদালুঙ্গি ও সাদাসার্ট। মামি ছিলেন জকিগঞ্জের বালাউটের মেয়ে ও তার মাথায় পাগলামির দোষ ছিল। এর একটু ছিটে এসে তার একমাত্র পুত্র মুহিত ভাইকে আচর দেয়তার কথায় কথায় দেওয়ান চৌধুরীর ঢেকুর বেরুত।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে উঠানো মুহিত ভাইয়ের একটি ছবি তিনি খুব সযতনে আলগে রাখতেন, লোক সমাগম ঘটলে গর্বের সাথে বের করে সেই ছবি  দেখাতেন। এক সময় বলতেন বঙ্গবন্ধু তার কাছে শেখ হাসিনাকে বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ভাগ্য খারাপ, সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেল। তার একমাত্র পুত্র সুহেল ব্লুবার্ড স্কুলে পড়ত। তিনি ভোটে খাড়া হয়ে ভোটারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে নির্বাচনে পাশ করে ব্লুবার্ড স্কুল কমিটির সদস্য হবার আপ্রান চেষ্টা করেও বার বার ব্যর্থ হন। একমাত্র ছেলে সুহেলকে নিয়ে মিরেরময়দানের রাস্থায় হাঁটতেন ও আমার কাছে নিয়ে আসতেন। আমাকে টেনে ধরে তার বাসায় নিয়ে চা পান করাতেন। একদিন জন্ডিস হয়ে অল্প বয়সে এই সরল মানুষটি সিলেট শহরে মারা যান। আমরা তাকে শাহজালালের মাজারে দাফন করি। তিনি আমাকে খুব গুরুত্ব দিতেন ও স্নেহ করতেন। আল্লাহ তাকে জান্নাত নসীব করুন।    

বৃদ্ধা নানি ছিলেন পাতারিয়ার এই প্রতাপশালী বাড়িটির মধ্যমনিোরগি যেমন তার বাচ্চাদেরকে ডানার তলায় জড়িয়ে রাখে, নানিও তেমনি সুদীর্ঘকাল তার সব আন্ডাবাচ্চা ও পালিতদেরকে প্রশস্থ পালকতলায় নিরাপদে সযত্নে আগলে রেখেছিলেন। তিনি দুইহাত ভরে টাকাকড়ি, ধানচাল ও মালামাল দিয়ে মানুষকে সাহার্য্য করতেন। মানুষ তাবিজ ও টুটকা নিতেও নানির কাছে আসত।

নানি মারা যান ১৯৮৩ খৃষ্টাব্দের ২০শে মার্চ। আম্মা ও আমার অগ্রজা মান্না তখন তার সেবাশুশ্রূষার জন্য বেশ কিছুদিন ধরে নানাবাড়িতে অবস্থান করছিলেন তাদের চোখের সামনে নানি প্রায় আশি বছর বয়সে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। জীবনের সুর্যাস্তবেলায় নানি বহুমূত্র, রক্তচাপ ও হৃদরোগে ভূগতেন। তার খাবারের রুচি চলে যায়। আমি ও আব্বা নানির শারীরিক অবনতির খবর পেয়ে ট্রেনে নানাবাড়ি পৌছে নানিকে জীবিত পাইনি। তার লাশ তখন পালঙ্কে সাদা কাপড়ে ঢাকা ছিল ও তার চারপাশে বসে সবাই ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছিলেন। তখন বাহিরে কুকিলের কুহুকুহু ডাক শুনা যাচ্ছিল। তাকে সামনের পারিবারিক কবরগায় দাফন করা হয়।

নানির মৃত্যুর মাত্র এগার বছর পর ২৯ মে ১৯৯৪ খৃষ্টাব্দে এই প্রভাবশালী বাড়িটির সব লোকজন দেশ ছেড়ে সুদূর যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। আপনপর লোকজন যে যা পারে এবাড়ি হতে নিয়ে নিয়ে যায়। আমার আম্মা নিয়ে আসেন তার জনকজননীর মৃত্যুর তারিখ লেখা একটি মনোগ্রাম, যা এখনও আমাদের দাউদপুরের গ্রামের বাড়ির ওয়ালে ঝুলে আছে। পরবর্তীকালে ধাপে ধাপে পাতারিয়ায় নানাবাড়ি সংলগ্ন হাওরের অধিকাংশ কৃষিজমি বিক্রি হয়ে যায়। কয়েকদিন আগে অফিসের জিপে বাড়িটিতে গিয়ে মনে হল এটা যেন এক বিরানভূমি। বাড়িতে অসুস্থ্য হাসমতিঝি তার একদঙ্গল অর্ধউলঙ্গ বংশধর নিয়ে অবর্জনার রাজ্যে পড়ে আছেন, তার চারপাশে প্রচুর মাছি উড়াউড়ি করছে। সামনের দিঘীপারের মসজিদে গিয়ে দেখি সেখানে একদল তাবলীগ জামাতের লোকজন ডেগডেগসি ও গাট্টিবুচকাসহ অবস্থান করছেন, তাদের কেউ কেউ রাধছেন কেউবা ঘুমাচ্ছেন

১৯৮৩ সালে একদিন শাহজালাল উপশহরের সরকারী প্রকল্প অফিসে যাই। সেখানে পাশের চেয়ারে এসে বসেন একজন হ্যান্ডসাম সুদর্শন তরুন, যিনি সিলেট সরকারী মেডিকেল কলেজের ছাত্র। চেহারায় দৃষ্টি পড়তেই মনে হল তিনি কোন অভিজাত ঘরের সন্তান হবেন ও এই অফিসের সবাই তাকে বেশ খাতিরযত্ন করছে। বুদ্ধিদীপ্ত কথাবার্তায় চৌকশ এই তরুনের মুখপানে চেয়ে কেমন যেন আপন আপন মনে হল। পরিচয় জিঞ্জেস করতেই বেরিয়ে আসে তিনি আমার গ্রামের ও বংশের সচিব ইমাম উদ্দিন চৌধুরী ওরফে কয়ছর ভাইয়ের একমাত্র পুত্র নিয়াজ আহমদ চৌধুরী। অথচ তিনি আমার এত কাছের স্বজন হওয়া সত্বেও এই প্রথমবার আমার দৃষ্টিরাজ্যে আবির্ভুত হন। দাউদপুর চৌধুরী বংশের এই প্রজন্মের এই শ্রেষ্ট সন্তানের সুন্দর মুখচ্ছবিটি সেইদিন আমার অন্তরে ক্ষুধিত হয়ে গেল।                 

আমরা এমসি কলেজে ভর্তির সময় ৩০ মে ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়া নিহত হন। কিছুদিন বিচারপতি আব্দুস সাত্তার প্রেসিডেন্ট থাকার পর সেনাপ্রধান হোসেন মোঃ এরশাদ তার কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেন। তার সামরিক শাসনামলেই আমাদের এমসি কলেজ জীবনের বেশীরভাগ দিন অতিবাহিত হয়। তিনিও জিয়ার মত হ্যাঁ ভোট, না ভোট করেন। বাতাসি হ্যাঁ ভোটে তার বাস্ক ভরে যায়তিনি প্রথমে জনদল ও পরে জাতীয় পার্টির জন্ম দেন। সরকারি সুযোগ সুবিধা নিতে জাতীয় পার্টিতে নাম লিখাতে সেয়ানা আদমিদের মধ্যে সুতীব্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন