শনিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

স্মৃতির মনিকোঠায় মদন মোহন কলেজ, সিলেটঃ

 

স্মৃতির মনিকোঠায় মদন মোহন কলেজ, সিলেটঃ

সেশনঃ ১৯৮৩-৮৪, চুড়ান্ত পরীক্ষাবর্ষ ১৯৮৫ অবস্থানঃ জানুয়ারি ১৯৮৪ হতে ডিসেম্বর ১৯৮৫ সাল

নানা তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে আমি সিন্ধান্ত নিলাম শহরে কোন আত্মীয়স্বজনের বাসায় থাকব না, যদিও কলেজ হোস্টেলে কিংবা ছাত্রমেছে থাকার মত আর্থিক সামর্থ্য আমার নেই। এমন বিষয়ে ভর্তি হব, যা বাড়ি হতে আসা যাওয়া করে সহজে পড়া যাবে। ১৯৮৩ সালের শেষদিকে সোজা মদন মোহন কলেজে গিয়ে ১৯৮৫ সালের বিএ (ব্যাচেলর অব আর্টস) পরীক্ষার্থী ব্যাচে ভর্তি হয়ে গেলাম। এম সি কলেজে ভর্তি হই নাই, কারণ প্রিয় এম সি কলেজ শহর থেকে অনেক দূরে অবস্থিত। প্রশ্ন আসতে পারে বিএসসি কিংবা বিকম নয় কেন? কারণ ইতিমধ্যে আমি সিলেট পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটে সিবিল টেকনোলজিতে ভর্তি হয়ে গেছি। একসাথে ডাবল ইঞ্জিন ড্রাইভ করতে হবে। ভাবলাম, বিএ তে ভর্তি হবার কারণে কোন বিষয়ে প্রাইভেট পড়তে হবেনা, সেইসাথে ক্লাসে হাজিরা অল্পবিস্তর একটা কিছু হলেই চলবে।

আমি তখন পুরোপুরী হতাশ, মনে হল কিছু না পেলে আব্বার হাইস্কুল শিক্ষকের চাকুরিটা অন্ততঃ বগলদাবা করে নিতে পারব। আর ভাবি চাচাতো ভাই পুলিশের আইজিপি জনাব ই এ চৌধুরীকে ধরে অন্ততঃ পুলিশের সাব ইন্সপেক্টর হবারও চেষ্টা করা যাবে। আব্বারও অনেক বয়স হয়ে গেছে, চাকুরি আর বেশিদিন করার মত অবস্থায় তিনি নেই। নিতান্ত বাধ্য হয়েই সামান্য কিছু টাকার জন্য বুড়ো বয়সে তিনি শিক্ষকতা করে যাচ্ছেন।

অন্যদিকে আমাদের জমিজামা নিয়ে লোভী রাক্ষসদলের অশুভ জবরদস্তি ও দখলবাজিতে তখন বৃদ্ধ বয়সে তাঁর প্রাণের একেবারে অষ্টাগত অবস্থা। এতদিনের সব বড় বড় স্বপ্নকে এবার ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করি। নিজেকে বলি, জনাব সেফাক সাহেব, পৃথিবীতে সব মানুষ বড় হবার জন্য জন্ম নেয়না। হাতেগুণা দুইএক জন রাজা-রাজড়া হয়, বাকী বেশীরভাগ মানুষ জন্ম নেয় প্রজা হতে। আমি না হয় প্রজাই রইলাম। মোল্লার দৌড় মসজিদে, অনুরূপ তোমারও দৌড়ের একটা সীমারেখা রয়েছে। আল্লাহ না চাইলে তুমি কে, যে সেই ভাগ্যের সীমান্ত পারি দেবে। জনাব ইসফাক কুরেশি, চেয়ে চেয়ে দেখ তোমার ভাগ্যের লিখন তোমাকে কোথায় নিয়ে যায়

তবে এত স্বপ্নভঙ্গের মধ্যেও অবচেতন মনে কেবলমাত্র একটি স্বপ্ন সুপ্ত রয়ে গেল, তাহল কবি, সাহিত্যিক ও সুফি হবার স্বপ্ন। বাল্যকৌশরে মনের গহিনে মহান আল্লাহর মেহেরবানিতে জেগে উঠা সেই লেখক ও সূফি সাধক হবার স্বপ্ন আমার মরলনা। বরং সারাটা জীবনভর রয়ে রয়ে মনের ভিতর সেই গুণী মানুষ হবার সোনালি স্বপ্নটা বারবার ঘাই মেরে যায়।  এযেন এক সুপ্ত অগ্নেয়গীরি যে বার বার জেগে উঠে গরম লাভা ও অগ্নি উদ্গীরণ করে শান্ত হয়। 

এই মদন মোহন কলেজটির জন্ম ১৯৪০ সালে সিলেট শহরের প্রায় কেন্দ্রস্থল লামাবাজারে। এই কলেজ সিলেটের মহান হিন্দুদের নিঃস্বার্থ দান। কলেজের জায়গার পরিমান মাত্র সাড়ে তিন একর যা কয়েক হাজার ছাত্রছাত্রীর জন্য সামান্যই বলা যায়, তাই ডানদিকে উঁচুউঁচু বহুতল ভবনের ইট পাথরের ঠাসবুনুনি। বামদিকে কলেজ ছাত্রাবাস, মসজিদ, প্রিন্সিপালের বাসা ও পোষ্ট অফিস। সামনে বড় গেটের বামপাশে ছিল মহান একুশের শহিদ মিনার, তাতে তামার পাতে খূদাই করে লিখা ছিল ‘লক্ষ শহিদ ঘুমিয়ে আছে বাংলার পথেপ্রান্তরে,/ তারা মরে নাই, মরেনা শহিদ যুগযুগান্তরে’একবার একদল উম্মুক্ত দুবৃত্ত হামলা করে এই তামার স্মৃতিফলকটি শাবল মেরে ফুটো করে দেয়। 

১৯৮৪ সালের জানুয়ারিতে ক্লাস আরম্ভ হল। চারতলার একই কক্ষে বি এ প্রথমবর্ষের সবগুলো ক্লাস হত। এমসি কলেজের মত এখানেও তিন শতাধিক ছাত্রছাত্রী ভর্তি হয়। কিন্তু দিনে মাত্র তিন চারটি ক্লাস হত ও শিক্ষার্থী উপস্থিত হতেন মাত্র পঞ্চাশ ষাট জন। তাই পরিচিত সহপাঠীর সংখ্যা হাতেগুনা মাত্র কয়েকজন। এই কলেজে তেমন মেধাবীরা ভর্তি হতনা। সারা কলেজ জুড়ে চলত কেবল রাজনীতির হৈ চৈ, মিটিং মিছিল। সাধারণ মেধার এইসব ছাত্রই ছিল এক একজন নেতা, উপনেতা কিংবা পাতিনেতা। কলেজের ছোট্ট চত্বরে চলত ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া ও পুলিশের লাটিচার্জ। মাঝে মাঝে ঘটে যেত খুনখারাবি ও জখম। পরবর্তীকালে সেই সময়ের ছাত্রনেতা মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ, আবুল কাহের শামিম, শামিম সিদ্দিকি, আজিজুল হক মানিক, আসাদ উদ্দিন প্রমুখ জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ের নেতা হন।  

জাসদ, বাসদ, ছাত্রলীগ, ছাত্রশিবির, ছাত্র মজলিশ, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র সমাজ, ছাত্রদল এমন কোন রাজনৈতিক ছাত্র সংঘটন ছিলনা যাদের সাইনবোর্ড, ব্যানার ও পোস্টার এখানে নেই। আলকাতরার চিকামেরে ওয়ালগুলোর অবস্থা এমন বিশ্রী করে ফেলা হত যে ওদিকে তাকালে ঘেন্না হত। এখানে রোজ রোজ হত নবীনবর উৎসব আর সেইসাথে  হৈচৈ মারামারি। এখানে লেখাপড়ার চেয়ে রাজনীতি নিয়েই ছাত্ররা বেশি ব্যতিব্যস্ত থাকতেন। কিছু কিছু ছাত্রনেতাদের আচার আচর দেখে মনে হত এরা গূন্ডা মাস্তানের চেয়েও অধম এবং এরাই কলেজে ছাত্রদের নেতৃত্ব দিত। 

সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা ভয়ে কিছুই বলতনা, হয়ত তাঁরা কারো দলে ঢুকে সুবিধা নিত, নতুবা চুপ থাকত। আমি ছিলাম নিরপেক্ষ চুপ থাকার দলের একজন। এই হাঙ্গামার রাজনীতি নিয়ে আমার কোন উৎসাহ ছিলনা, রাজনীতি করার মত সময় ও অর্থ কিছুই এই বান্দার ছিলনা। গ্রাম থেকে সকালে আসি, বিকেলে গ্রামে ফিরে যাই। এই আল্লার বান্দা প্রবীণ বয়সে এসে এসব স্বল্প মেধার উশৃংখল নেতাদের অনেককে দেশ ও জাতীর নেতৃত্বের চেয়ারে আসীন দেখে মনে মনে ভাবি এজন্য বুঝি বাংলাদেশের রাজনীতির এই বেহাল অবস্থা, এত লুটপাট।

এখানে প্রতি ক্লাসে রোলকল হত, আমার রোল নং ছিল ২০৭৫আমার ছাত্রাবস্থায় এই কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন শ্রীকৃষ্ণ কুমার পাল চৌধুরী যিনি ছিলেন নবীগঞ্জ এলাকার লোক। কে কে পাল স্যার একটি ইংলিশ গ্রামার রচনা করেন যাহা এই কলেজে বাধ্যতামূলক পাঠ্যপুস্তক ছিল, ফলে তার এই গ্রামারটি ছাত্রছাত্রীরা কিনতে বাধ্য হত। তিনি আমাদের ইংলিশ গ্রামারের ক্লাস নিতেন। ছাত্রদের উপর কে কে পাল স্যারের ভাল নিয়ন্ত্র ছিল। এমনকি ছাত্রনেতারাও তাকে বেশ সমীহ করে চলত। তিনি বলতেন কম ও চলতেন ধীর পদক্ষেপে।

ইংলিশের একজন আত্মভূলা স্যার ছিলেন, তাঁর নাম আতাউর রহমান। এই আত্মনিমগ্ন শিক্ষক এতই বেখেয়াল ছিলেন যে, পরবর্তী ক্লাসের শিক্ষক এসে কক্ষে ঢুকে তাকে না জাগালে বুঝতেই পারতেন না তার ক্লাসের সময় অনেক আগে শেষ হয়ে গেছে। আতাউর রহমান স্যারকে ক্লাসে রেখে ছাত্ররা একজন একজন করে চুপে চুপে বেরিয়ে যেত স্যার টেরই পেতেন না। শেষ পর্যায়ে তার ক্লাস ছাত্রশূন্য হয়ে যেত। আর আত্মভোলা এই স্যার ছাত্রশুন্য ক্লাসে অপনমনে পড়ায়ে যেতেন। রিকশাওয়ালা প্রতিদিন কলেজগেট পেরিয়ে তাকে নিয়ে অনেক দূর চলে গেলে তিনি বুঝতেন ভুল হয়ে গেছে, তিনি কলেজটাকে বেশ পিছনে ফেলে এসেছেন। স্যার রিকশাওয়ালার প্রতি ইংলিশ-বাংলা বাক্য ছুড়ে দিলে সে ভয়ে ভ্যাবাচাকা খেয়ে থেমে যেত, তখন আশপাশের কোন একজন পরিচিত ছাত্র এগিয়ে এসে আতাউর রহমান স্যারকে কলেজে পৌঁছানোর কঠিন উদ্ধার কাজটি সমাধা করে দিত। ইংলিশের অন্য একজন শিক্ষক ছিলেন আব্দুল হান্নান। 

আতাউর রহমান পির বেশ নামকরা শিক্ষক ছিলেন, যিনি পরে কলেজের অধ্যক্ষ হন। তাঁর নামের আগে লেফটেনেন্ট কর্নেল লিখতেন। তাঁর বাড়ি সুনামগঞ্জের জয়পাশা। আমি ভাবতাম তিনি সেনাবাহিনীর অফিসার ছিলেন। একদিন একজন সহপাঠী বলল, পিরস্যার জীবনে কোনদিন সেনাবাহিনীতে চাকুরী করেননি। জানতে চাই তাহলে তিনি লেফটেনেন্ট কর্নেল আতাউর রহমান পির হলেন কেমনে? জবাব পাই ছাত্রদের কেডেট কোরের নেতৃত্ব দিয়ে তিনি নিচতলা থেকে ধারাবাহিক পদোন্নতি পেয়ে এই লেফটেনেন্ট কর্নেল হয়েছেন। বললাম, তাহলে এটা এযুগের অনলাইনের নকল ডক্টরেটের মত নকল লেফটেনেন্ট কর্নেল নাকি? যাহা বিনা কষ্টে, বিনা সাধনায় কুড়ানো হয়েছে। জবাব পাই, না ভাই, তিনি সেনাবাহিনীতে কখনও চাকুরী না করেই একের পর এক অনেকগুলো প্রমোশন পেয়ে লেফটেনেন্ট কর্নেল হয়ে কলেজে মিষ্টি বিতরণ করেন। নকল লেফটেনেন্ট কর্নেল হলে কি এই টাকার শ্রাদ্ধ করতেন? 

আমাদের প্রথম ক্লাসটি ছিল বাংলা। ক্লাস নেন বাংলার শিক্ষক বিজিত কুমার দে। বিজিত স্যারের পিছনে পিছনে ক্লাসে আসেন কয়েকজন ছাত্রী। তাঁরা নাজমিন ইসলাম নিম্মি, লিপি, শেফালি, সীমা কর, চাঁদ সুলতানা রত্না, স্বপ্না, নাজমা বেগম প্রমুখ। সামনের সারিতে বসা ছেলেদেরকে উঠায়ে বিজিত স্যার মেয়েদের জন্য সামনের সিট বরাদ্ধ করে দেন। ক্লাস সমাপ্ত হলে মেয়েরা স্যারের সাথে বের হয়ে ছাত্রী মিলনায়তনে চলে যায়।

চৌহাট্টার সেন্ট্রাল ফার্মেসির মালিক বিজিত দে স্যারের বাচনভঙ্গি ছিল চিত্তাকর্ষক। তার ভাষ ছিল আকর্ষণীয়, তিনি পড়াতেন বংলাসাহিত্য শরতচন্দ্রের ‘বিলাসী’ ছোটগল্পটি প্রাবন্ত করে পড়াতেন যে মনে হত তিনি গল্পটি অভিনয় করে যাচ্ছেন। 

নিরঞ্জন দেবনাথ চর্যাপদ থেকে মধ্যযুগ পেরিয়ে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ হয়ে এখন পর্যন্ত হাজার বছরের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস পড়াতেন। এই বিষয় আমার কাছে বেশ আকর্ষণীয় ছিল। প্রনব কুমার সিংহ ছিলেন কলেজের উপাধ্যক্ষ, তার মুখে সব সময় মিষ্টিহাসি লেগে থাকত। তিনি সিলেটের মনিপুরী সম্প্রদায়ের লোক ছিলেন। তিনি আমাদেরকে আবুল মনসুর আহমদের উপন্যাস ‘সত্যমিথ্যা’ এবং কবি মাইকেল মধুসুদন দত্তের নাটক ‘কৃষ্ণকুমারী’ পড়াতেন।

ইতিহাস আমার অত্যন্ত আকর্ষণীয় বিষয়, তাই ইসলামের ইতিহাসের ক্লাস আমি কখনো বাদ দিতাম না। চেক হাফসার্ট পরা গোলমুখ ফজলুল হক পড়াতেন ইসলামের অভ্যুদয় হতে পরবর্তী হাজার বছরের ইসলামের সোনালি ইতিহাস। ফজলুল হক স্যার আবিস্কার করেন পৃথিবীর ইতিহাসের সব যুগান্তকারী যুদ্ধসমূহের প্রায় যুদ্ধক্ষেত্রেই বড় সেনাদল ছোট সেনাদলের হাতে পরাজিত হয়। যেমন, বদর, পরিখা, ইয়ারমুখ, পানিপথের প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় যুদ্ধ, খানুয়ার যুদ্ধ, ওয়াটারলুর যুদ্ধ, আইনজালুতের যুদ্ধ, জিব্রাল্টার যুদ্ধ। এমন কি পলাশির যুদ্ধও এই তালিকায় পড়ে। পলাশির যুদ্ধে নবাব সিরাজুদ্দৌলার পঞ্চাশ হাজার সৈন্য ক্লাইভের মাত্র তিন হাজার সৈন্যের হাতে পরাজিত হয়। 

‘ইসলামের সংস্কৃতির ইতিহাস’ পড়াতেন নজরুল ইসলাম, যিনি পরবর্তীকালে এই কলেজের অধ্যক্ষের পদে অধিষ্ঠিত হন। তিনি ছিলেন সুরমাপারের খিত্তা পরগনার লোক। একদিন ক্লাসে স্যার একটি হাদিস উল্লেখ করেন, ‘তোমরা যৌবনে উপনীত হলে সামর্থ্য থাকলে বিয়ে কর, সামর্থ্যহীন হলে রোজা রেখো’একজন ছাত্র দাঁড়িয়ে স্যারকে প্রশ্ন করল, বিয়ে করার সামর্থ্য না থাকলে আমরা কেন রোজা রাখব স্যার? বুদ্ধিমান স্যার একটু সময় চিন্তা করে হেসে ছাত্রটিকে বললেন, তোমার কোন সেয়ানা বুঝদার  সহপাঠির কাছ থেকে উত্তরটি জেনে নিও।

বহুবছর পর নজরুল ইসলাম স্যার ও আমি সাগরদিঘিরপার একই পাড়ার বাসিন্দা হই। আমি ২০১২ সালের আগে যখন “শাহজালাল(রঃ) ও শাহদাউদ কুরেশী(রঃ)” গ্রন্থটি রচনা করি তখন তিনি আমাকে অনেক উপদেশ প্রদান ছাড়াও “বৃহত্তর সিলেটের ইতিহাস” বইটি উপহার দিয়ে সহায়তা করেন। নজরুল ইসলাম স্যার আজ আর নেই। হে করুনাময় আল্লাহ আপনি তাঁকে উত্তম বিনিময় দান করুন, তাঁকে জান্নাতবাসী করুন, আমিন। 

আমাদেরকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়াতেন গ ক ম আলমগীর ও আকরাম আলী। আকরাম আলী স্যারের বাড়ি টুকেরবাজারের কাছে কোন এক গ্রামে। কৃষ্ণবর্ণ বেঁটে স্থুলকায়া আকরাম আলী স্যারের কন্ঠস্বর এত তীব্র ছিল যে ছাত্ররা বলত তার বাজখাই গলার আওয়াজ শুনলে কফিনের লাশ জেগে উঠবে। আকরাম আলী স্যারও ইন্তেকাল করেছেন। 

গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস, প্লেটো ও এরিস্টেটলের রাজনৈতিক দর্শন আমি খুব আগ্রহ নিয়ে ক্লাসে শুনতাম। কার্লমাক্সের দর্শনে আমার বেশ আগ্রহ ছিলো। ম্যাকিয়াভেলির রাজনৈতিক দর্শন চিন্তায় ভিন্নমাত্রা যোগ করে দেয়। জ্যাক রুশোর দি সসিয়াল কন্ট্রাক্ট, মর্গানের অযাচার যুগ আমার চিন্তাজগতে নতুন ধারনা তৈরী করে। আলফারাবী ও ইবনে খালদুনের রাজনৈতিক ফিলোসফি পড়েও বেশ আনন্দ পেতাম। 

ম্যাকেয়াভেলী, সেন্ট থমাস একুইনাস, ভল্টেয়ার পড়ে ভ্যাটিকানের ঈশ্বরের রাজ্য, ধর্ম ও রাজনীতির ইউরোপীয় চিন্তাধারার বিবর্তন জেনে নেই। প্রটেস্টেন্ট আন্দোলনের মাধ্যমে খৃস্টজগতে ধর্ম ও রাজনীতি ধীরে ধীরে আলাদা হয়ে যায়। পোপ ও যাজকগণ রাজনৈতিক ও বিচারিক ক্ষমতা হারিয়ে কেবলমাত্র আধ্যাত্মিক প্রতিষ্ঠানে পরিনত হন। 

মুসলিম বিশ্বের পুরো রাজনীতিকে তখন  রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোকে মেলাতে বেশ চিন্তাভাবনা করি। মুসলিম রাজনীতি সূচনায় সর্বাত্মকবাদী পুরহিততন্ত্র হলেও মাত্র ত্রিশ বছরের মাথায় চরম বংশীয় রাজতন্ত্রে রূপ নেয়। আধুনিককালে এসে এই রাজনীতি না গণতন্ত্র, না রাজতন্ত্র, না একনায়কতন্ত্র, না সামরিকতন্ত্র, না পুরোহিততন্ত্র, কোথায়ও ঢুকাতে পারিনি। এক এক দেশে এক এক ভাবে মুসলিম রাজনীতি চলছে। 

সামরিকতন্ত্র আছে মিশর, সুদান, সুমালিয়া, নাইজেরিয়ায়, সামরিকতন্ত্র এর সাথে গণতন্ত্রের দ্বৈতশাসন আছে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, তুরস্ক ইত্যাদি দেশে, মরক্কো, সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, জর্ডান, ওমানে চলছে চরম রাজতন্ত্র, লিবিয়া, সিরিয়া, ইরাক, ইয়ামেনে একনায়কতন্ত্র, ইরানে একদলীয় শিয়া পুরহিততন্ত্র ইত্যাদি। 

মুসলিম দেশসমুহে পশ্চিমা দেশগুলোর মত স্থায়ী কোন রাজনৈতিক শাসনকাঠামো নেই। সবতন্ত্রের একধরনের মিশ্র পদ্ধতিতে মুসলিম বিশ্বে রাজনীতি বহমান। মুসলিম রাজনীতিতে কোন কোন দেশে ধর্মের নামে শ্রেণিবিশেষের প্রাচীন মোল্লাতন্ত্র কিংবা সুবিধাবাদী অভিজাততান্ত্রিক শাসন ও শোষণ সবযুগে চালু থাকতে দেখা যায়। তাই রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং কোন্দলীয় রাজনীতি অধিকাংশ মুসলিম দেশের রাজনৈতিক বৈশিষ্টে পরিনত হয়েছে। প্রথম রাষ্ট্রবিজ্ঞান পাঠ আমার সাবেক চিন্তার সাথে মিথস্ক্রিয়া করে এই ধরনের দর্শনই জ্ঞানপিপাসু মনে জন্ম দেয়, যা সম্পূর্ণই আমার ব্যক্তিগত অভিমত।  

অর্থনীতির অধ্যাপক ইনসাফ হোসেন কুরেশি জগন্নাথপুরের জাতক। ইনসাফ কুরেশি স্যার লম্বা ফর্সা সুদর্শন লোক। কিন্তু তাঁর দুই পা ল্যাংড়া, পায়ের পাতা উল্টানো। তাঁর নিজস্ব চারতলা বাসা আমার কাছে সুবিদবাজার, ছড়ার পারে। তিনি বিয়ে করেন যুধিষ্টিরপুর, ঘিলাছড়া, ফেন্সুগঞ্জ। তাঁর পত্নী ভাতালিয়া প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা আত্মীয়তা সূত্রে আমার বোন। কলেজে একদিন দুলাভাই বলায় আমার দিকে বড় বড় চোখে তাকান। আমি পাজলামী করছি মনে করে ইনসাফ কুরেশি স্যার ভীষণ রেগে গিয়ে আমাকে তলব করেন। প্রশ্ন করেন, আমি তোমার কবেকার দুলাভাই। আমি জবাব দেই আপনি আমার অনেক আগেকার দুলাভাই। এই জবাব শুনে তাঁর রাগ আর তুঙ্গে উঠে। পারলে আমাকে মারবেন এমন অবস্থা। এবার হেসে হেসে পরিচয় দিয়ে বললাম আপাকে ফোন করে জেনে নিন। সাথে সাথে তাঁর রাগের মাত্রা শত ডিগ্রি হতে শূন্য ডিগ্রিতে নেমে আসে। নিমিষেই তাঁর রাগ মুচকি হাসিতে পরিনত হয়। 

মদন মোহন কলেজে অল্প কয়েকজন সহপাঠির সাথে পরিচয় ও বন্ধুত্ব হয়। সিদ্দিকুর রহমান নির্ঝরের সাথে এখানেই পরিচয় হয় ও পরে তাহা সারাজীবনের বন্ধুত্বে রূপলাভ করে। একটু খাটো শ্বেতকায়া স্বপ্নবিলাসী তরুণ সিদ্দিক, তার হৃদয় জুড়ে অসংখ্য স্বপ্নের জালবুনা। পিএইচডি করা হতে শুরু করে দেশের মন্ত্রী প্রধানমন্ত্রী হওয়া পর্যন্ত কত আকাশ কুসুম কল্পনা তার মনের স্বপ্নরাজ্যে ঘুরে বেড়াত। আমাদের দুইজনের একটা বিষয়ে মিল ছিল, আমার মত তারও পত্রিকায় মাঝে মধ্যে দু’একটা লেখা ছাপা হত। প্রতিদিন গ্রাম হতে শহরে আসা বিষাদগ্রস্ত তরু আমি তার পাশে বসে যেন কেমন একটা শান্তি অনুভব করতাম ও অলীক স্বপ্নের জাল বুনে আনন্দ পেতাম। সিদ্দিক নির্ঝরের নিজবাড়ি ও নানাবাড়ি পাশাপাশি, তাঁর গ্রাম ইমিদপুর, ডাক রশিদপুর, উপজেলা বিশ্বনাথ।

সিদ্দিকুর রহমানের বাসা কলেজের কাছেই সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পিছনে পুরান মেডিকেল সরকারি আবাসিক এলাকায়। সিদ্দিকুর রহমান খুব দয়ালু প্রকৃতির উদার মনের মানুষপ্রায়ই দুপুরে বলতেন, এত সাতসকালে গ্রাম থেকে বেরিয়ে এসেছিস, চল আমার বাসায় খেয়ে যাবে‘না, না’ বলেও অনেক সময় পার পাওয়া যেত না। এখানে এমন একজন মমতাময়ী মায়ের সন্ধান পাই যিনি দুই কন্যা ও চারপুত্রের এক পরিবারকে পরম আদরে তার বূকের সাথে বেঁধে রেখেছেন। এই মহান মায়ের নাম আলেখজান খাতুন। টিনের বারান্দায় সিদ্দিকের শোবার কক্ষ, একটা ছোট দেড়জনি পালং, ছোট টেবিলের সাথে দুইটি চেয়ার ও বিচিত্র সব  ছবি ও হস্তকর্মের ছড়াছড়ি।

কোথাকার এক গায়ের ছেলে আমি এখানে এসে এক নতুন মাতৃস্নেহের সন্ধান পেলাম। বড় দুইবোন কামরুন্নেছা ও মেহেরুন্নেছা সরকারি চাকুরি করেন, ছোট দুইভাই হালিমুর রহমান ও ডালিমুর রহমান স্কুল কলেজের ছাত্র। সিদ্দিকের বড়ভাই হাফিজুর রহমান ছিলেন বেশ সহজসরল স্নেহপ্রব লোক। তিনি দক্ষিসুরমা বাস টার্মিনালে টায়ারের ব্যবসা করতেন। আমি কলেজ হতে ফেরার পথে টার্মিনালে দেখা হলে প্রায়ই বলতেন, সেফাক তুমি আস, তোমাকে নিয়ে দুপুরের খাবার খাবো। আমি লজ্জায় অজর আপত্তি দেখালেও তিনি ছাড়তেন না, বলতেন আজ আমার ভাল রুজি হয়েছে। বাধ্য হয়ে কোন হোটেলে তার সাথে মাঝেমধ্যে আমাকে ঢুকতেই হত। জগন্নাথপুরের ভবেরবাজারের পাশে একটি বহু ঘাটওয়ালা ঘনবসতি বাড়িতে হাফিজ ভাই বিয়ে করেন। তার বিয়ের বাসে চড়ে আমি জীবনের প্রথমবার রশিদপুর হতে সাপের মত আঁকাবাঁকা এক সড়ক দিয়ে জগন্নাথপুর উপজেলায় প্রবেশ করি। 

নিদারুণ দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে ছোটভাই ডালিম  ও হাফিজ ভাই আজ আর দুনিয়ায় নেই। মমতাময়ী খালাম্মা আলেখজান খাতুনও নেই। আমরা তাঁদের সবাইকে রশিদপুরে বিশ্বনাথ সড়কের পাশে পারিবারিক কবরগায় চিরশায়িত করি। মহান আল্লাহ পাক তাঁদেরকে জান্নাত দান করুন, আমিন।

দাড়িয়াপাড়ার পুরান মেডিকেলের এই সবুজময় বাসায় ঢুকলে মনে হত এযেন শহরে আমার আরেক পরিবার। টিনের এই সরকারি পাকাবাসার সামনে খুব সুন্দর উন্নতমানের গোলাপবাগান ছিল। বৈজ্ঞানিক নিয়মে গোলাপ চাষের ফলে সিদ্দিকের এই বাগানে ইয়া বড় বড় নানান রঙের প্রচুর গোলাপ ফুল ফুটতো। চৌহাট্টার ফুল বিক্রেতারা এসে বেশ ভাল দামে প্রতিদিন বেশকিছু গোলাপ কিনে নিত। তাতে বেকার ছাত্র সিদ্দিকুর রহমান নির্ঝরের হাতখরচের কিছু টাকা বেরিয়ে আসত।

এখানে পরিচয় হয় কবি ও সাংবাদিক চৌধুরী আমিরুল হোসেইনের সাথে, তিনি বাউলসম্রাট আব্দুল করিমের জন্মস্থান দিরাই উপজেলার উজানধল গ্রামের সন্তান। সুদর্শন ফর্সা চৌধুরী আমিরুল হোসেইন তখন দৈনিক সিলেট বানীতে কাজ করতেন। মনে হত সিলেট শহরে তিনি যেন একজন ছন্নছাড়া জিপসি যাযাবর। চৌধুরী আমিরুল হোসেইন সৎ ও সহজ সরল মানুষ। আল্লাহর প্রতি তাঁর ইমান মজবুত, সবকিছু আল্লাহ পাকের কাঁধে ছেড়ে দিয়ে দিয়ে তিনি নির্ভয়ে সুখী নির্ভার জীবন কাটান। দুই পুত্র, এক পুত্রবধু ও ভাবীকে নিয়ে আলমপুরের এক সুরম্য রাজবাড়িতে বর্তমানে তিনি সুখী সময় পার করছেন। 

মদন মোহন কলেজগেটের সামনে নিজস্ব দোকানে বসে ব্যবসা করেন মাহবুব আলম। সিদ্দিকের বন্ধু মাহবুব আলম তখন এমসি কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স পড়তেন। সেই সময় মাহবুব আলম ভাইয়ের এই দোকান আমাদের এক আড্ডাখানা ছিল। হোমিও চিকিৎসক মাহবুব আলম ভাই খুব সৎ ও ধার্মিক লোক। তাঁর ফুফুতো ভাই ডাঃ আব্দুল মান্নান আমার এমসি কলেজের সহপাঠী ছিলেন।  

সিদ্দিকের বাসায় দেখা একজন কালো ও ভালো তরুণ রমজান আলী। আলিফের মত সরল ও নিরিহ এই মানুষটির কথা মনে পড়ে, যিনি খাদিম চাবাগানে চাকুরি করতেন। রমজান আলী অল্প বয়সে বিয়ে করেন, আবার বাচ্চাকাচ্চা রেখে অল্প বয়সে চিরবিদায় নেন। 

সিদ্দিকুর রহমানের মাধ্যমে একজন অতি নম্রভদ্র বন্ধু লাভ করি, তিনি আমার আত্মার আত্মীয় সিলেট বেতারের সংবাদ ও কথিকা লেখক এবং দৈনিক সিলেটের ডাক পত্রিকার সাংবাদিক আব্দুস সবুর মাখন ভাই। মাখন ভাই একজন কবি, গীতিকার ও গল্পকার। ইতোমধ্যে তাঁর একটি গল্প ও একটি গানের বই প্রকাশ হয়েছে। 

আব্দুস সবুর মাখন ভাই বিশ্বনাথের জাতক, তিনি বিয়ে করেন দক্ষিণসুরমার সিকন্দরপুর, লালাবাজার। তাঁর পত্নী হেলেন বেগমের সাথে আমার বেগমের বেশ সুসম্পর্ক রয়েছে। আব্দুস সবুর মাখন ভাইয়ের দুই পুত্রকন্যা অনিক ও উর্মি। একমাত্র কন্যা উর্মির বিয়েতে মাখন ভাই আমাকে উকিলের দায়িত্ব দেন। উর্মি এখন বৃটেনে, আল্লাহ পাক তাঁকে রাজকপাল দান করুন। 

হবিগজ্ঞের জাতক সমরেন্দ্র বিশ্বাস সিলেট বেতারে নিয়মিত গান করেন। নজরুলগীতির গায়ক ও সাংবাদিক সমরেন্দ্র বিশ্বাস সিলেটের ডাকে চাকুরী করতেন। চলনে বলনে বিনয়ী সমরেন্দ্র বিশ্বাস দীর্ঘদিন সিলেট প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। 

দাড়িয়াপাড়ার প্রতিবেশি এনামুল হক চৌধুরী। এনামুল হক চৌধুরীর গ্রামের বাড়ি দক্ষিণসুরমার কামালবাজার। তাঁর বাসার পাশেই পুরান মেডিকেল। এনাম চৌধুরীর বাসায় বেশ কবার গিয়েছি। এনামদের বাপচাচারা মিলে অনেক সদস্যের এক বড় যৌথপরিবার ছিল। এনাম চৌধুরী বেশ ভাগ্যবান, তিনি একজন বৃটিশ-বাংলাদেশী সুন্দরীকে বিয়ে করে ইংল্যান্ডে চলে যান। 

সিদ্দিক নির্ঝরের পুরান মেডিকেলের শোবার কক্ষে আড্ডা জমানো এই বন্ধুরা সবাই ছিলেন দিলখোলা, আন্তরিক ও উষ্ণহৃদয়। সিদ্দিক নির্ঝরের এই কক্ষটি ছিল যেন বিখ্যাত শিল্পী মান্নাদের কলকাতার সেই আড্ডার কফি হাউস, তবে এখানে কফি নয়, চলত গরম চা ও নাস্তা।

একবার পুরান মেডিকেলে খুব বেশী চোরের উপদ্রপ শুরু হয়। খালাম্মা আলেখজান খাতুন চোরের হাত হতে রক্ষা পেতে প্রতিরাতে আয়াতুল কুরসি পড়ে ঘুমাতেন। একদিন ঘুমের ঘুরে স্বপ্নের মধ্যে পিছনের জানালা দিয়ে চোর ঢুকে যেতে দেখে তার ঘুম ভেঙ্গে যায়। তখন তিনি পিছনের ডাইনিং কক্ষে গিয়ে দেখেন সত্যিই জানালা একটু ভেঙ্গে গ্রীলের ভিতরে ঢুকানো চোরের হাত নড়াচড়া করছে। কোরানের এই পবিত্র আয়াতের চাক্ষুস মুজেজা দেখে অভিভুত আমি তখনই আয়াতুল কুরসি মুখস্ত করে ফেলি।

বি এ ক্লাসে অধ্যয়নকালে একজন শক্তিমান লেখকের দেখা পাই, তিনি এডভোকেট অনুজ কুমার রায় বাদল। বিভিন্ন পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রায়ই পড়তাম। তিনি ছিলেন লেখাপড়ায় ভাল ও বুদ্ধিতে চৌকস। বাদল মাস্টার্স ও এলএলবি ডিগ্রি নেন। সুদক্ষ আইনজীবী অনুজ রায়ের পুত্র কানাডায় আছে। অনুজ রায় বাদল খুব স্নেহপ্রবণ মানুষ। 

অনুজ কুমার রায় বাদলের একটি আত্মজৈবনিক লেখা আমার নজর কাড়ে। তাঁর এই স্মৃতিচারণে কয়েকজন সহপাঠীর সাথে আমারও নাম উল্লেখ করেছেন। তাঁর সেই ছোট্ট লেখাটি আমার এই আত্মজীবনী গ্রন্থে সংযুক্ত করে দিলাম।

এডভোকেট অনুজ কুমার রায় বাদল লিখেছেন- আমাদের গ্রামের বাড়ি ভাটি এলাকার শেষপ্রান্তে সুনামগঞ্জ জেলার শাল্লা থানার রাহুতলা গ্রামে। এই গাঁয়ের পরেই নেত্রকোনা জেলা। আমি সাধারণ কৃষক পরিবারের সন্থান। স্বাধীনতা সংগ্রামের পরপরই বড়ভাই মুক্তিযুদ্ধা অজিত রায়ের হাত ধরে সিলেটে আসি। তারপর শৈশব, কৈশর, যৌবন পেরিয়ে মদন মোহন কলেজে আগমন। আমরা ছয়ভাই ও ছয়বোনের মধ্যে আমি সবার ছোট। রামের দিঘিরপার মাসীর বাড়িতে আমাদের আশ্রয় হলো। বাসাটি মদন মোহন কলেজের পাশেই। পড়াশুনায় আমি মাঝারি মানের ছাত্র ছিলাম, কিন্তু মনে প্রচন্ড জেদ ছিলো ভাল করার। ইন্টারমেডিয়েট পরীক্ষায় ভাল ফলাফল করার আশায় ভারতের বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অরুণ কুমার স্যান্যালের কাছে পত্র লিখি। আমাকে অবাক করে কদিন পরই ডাকযোগে তাঁর কাংখিত বইটি পেলাম। কলেজের পাশে ছিল সহপাঠী নিম্মির বাসা, সেখানেই চলল নোট করা। তারপর আর কি? ভাল ফল হলো, আমরা আস্তে আস্তে দলছুট হতে লাগলাম। ইসফাক কুরেশি ছিলো দারুণ হেন্ডসাম, তাঁকে নম্রতা ও ভদ্রতার জন্য আজও মনে রেখেছি। সোনায় মোড়ানো সেই দিনগুলো খুব মনে পড়ে। দীপক, উত্তম, প্রশান্ত, জামাল, অজয়, মুকুল, সেলিম আওয়াল, নাজমা, চাঁদ সুলতানা, শেফালি, দুলাল, নিখিল, ফুলু, সীমা, বিশু, নির্মল, সিদ্দিক, আমিরুল, আর কত প্রিয়জন। কোথাও কেউ নেই যেন আজ।

হ্যান্ডসাম সহপাঠি বন্ধু বিশ্বজিত গু একজন ব্যাংকার, তিনি আমাদের সুন্দরী সহপাঠিনী সীমা করকে বিয়ে করেন কলেজের এক পুজার অনুষ্ঠানে তাদের অভিসার আমাদের চোখে পড়ে, যাহা পরে পরিয়ে গড়ায়। আমার অন্য সহপাঠিনী ছিলেন স্বপ্না পাল ও নাজমা বেগম।

সুনিল সিংহ ও অনিল সিংহ ছিলেন দুইজন মনিপূরী জমজ ভ্রাতা। তাঁদের বাসা সিলেট শহরের লালাদিঘির পার। অতিভদ্র সহজসরল এই দুইভাই উপজাতি কোটায় সরকারি চাকুরিতে খুব সহজে নিয়োগ পান। ওবা সুনিল তুমি কেমন আছ? বললে উত্তর পেতাম, আমি সুনিল নই, আমি অনিল। অনিলকে ডাক দিলে জবাব পেতাম, আমি অনিল নই, আমি সুনিল। 

বিএ সহপাঠী এই দুই ভাইয়ের চেহারা ও কন্ঠস্বরে এতই মিল ছিল যে কে সুনিল আর কে অনিল নির্ণয় করা বেশ কঠিন কাজ ছিল। একদিন রাস্তায় সুনিলের দেখা পাই, সুনিল বলল বন্ধু তোমার লেখা আমি পত্রিকায় নিয়মিত পড়ি। সে কি করে বলতেই জবাব পাই তহশিলদার হয়েছি। বললাম, তাহলে খুব মালপানি বানাইরায় রেবা। জবাব দেয়, না রে ভাই, আমরা কি উপরি নিতে পারি? 

আমার বুঝতে অসুবিধা হলনা সুনিল ও অনিল উপজাতি লোক। তাঁরা সৎ ও সহজসরল। যত সব দুই নম্বরি কাম আমরা বাঙ্গালিরা করি। আমরা নামাজ পড়ি, রোজা রাখি, ঘটা করে পূজা করি, ধর্ম ধর্ম বলে চিৎকার দেই। সেইসাথে চুরি করি, ডাকাতি করি, দুর্নীতি করি, ঘুষ খাই, অন্যকে ঠকাই। 

মোঃ আব্দুল মুমিন চৌধুরী মাসুম ছিলেন জালালপুরের এক অভিজাত পরিবারের সন্থান। বিএ পরীক্ষার আগে একদিন আম্বরখানা সরকারি আবাসিক এলাকায় তার বাসায় দাওয়াত খাই। তার প্রৌড়া জননী রান্না করে খাবার পরিবেশন করেন। মাসুম ইসলামি ব্যাংকে কয়েক বছর চাকুরি করে জিন্দাবাজারে ব্যবসায় ফিরে যান। এখন তিনি তাবলীগ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। পহেলা বউ ক্যান্সার হয়ে অল্প বয়সে মারা গেলে ২০২৫ এ তিনি আবার বিয়ে করে সংসার পাতেন। তাঁর আর্থিক অবস্থা বেশ ভাল। সিলেট শহরে তাঁর বাসা, ব্যবসা, ফ্লাট সব আছে। মাসুমের ছেলেমেয়েরা সবাই বিদেশে আছেন। 

শেখঘাটের আমিনুন নুর ভাই ছিলেন মাবাবার একমাত্র সন্থান। স্থুলকায়া ও দীর্ঘ্যাঙ্গ সহপাঠি প্রভাষক আমিনুন নুর ভাইকে পরে কাজলশাহ পাড়ায় প্রতিবেশী হিসাবে পাই। আমার পত্নীর সাথে তার সহধর্মিনীর বেশ বান্ধবীয়ানাও জমে উঠে। তিনি তখন বিশ্বনাথ কলেজে শিক্ষকতা করতেন।

শেখঘাটের আমার আরেক সহজসরল সহপাঠি বন্ধু ছিলেন রফিকুল ইসলাম বাচ্ছুতিনি আমার মত একজন ব্যাংকার ছিলেন। পঁচিশ বছর ক্যাশে কঠিন কাজ করে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেন। তাঁর প্রথম বিয়েতে কোন সন্তান হয়নি, বিয়েও টেকেনি। দ্বিতীয় বিয়ে সুখের হয় ও তিনি সন্তানের বাবা হন। আমার অফিসের পাশে তাঁর বাসা, আমরা প্রায়ই মুখোমুখি হই। 

শেখঘাটের স্বনামধন্য সাহিত্যিক ও সরকারি আমলা মুসলিম চৌধুরীর সুযোগ্য সন্থান চৌধুরী মমতাজ মম ছিলেন একজন রসিক সহপাঠি। তিনি হেসে হেসে বিছিয়ে বিছিয়ে বেশ আর্ট করে কথা বলতেন, যা আমাদেরকে বিমুগ্ধ করত। তিনি একজন প্রসিদ্ধ সাংবাদিক ও বর্তমানে ‘দৈনিক সবুজ সিলেট’ নামের একটি স্থানীয় পত্রিকা সম্পাদনা করছেন।

সিলেটের বর্তমান বিএনপি নেতা সম্পর্কে ভাগনা আবুল কাহের চৌধুরী শামিম আমাদের সাথে ১৯৮৫ সালে বিকম পরীক্ষা দেন। তাঁর গ্রামের বাড়ি সাদিনাপুর, বিয়ানিবাজার। সিলেটের বাসা যতরপুর, সুপানিঘাট। মোঠাতনু শামিম তখন কলেজের জাসদ ছাত্রলিগের একজন নম্রভদ্র শীর্ষনেতা ছিলেন। আক্কলমন্দ ছাত্রনেতা আবুল কাহের শামিম পরে বিএনপিতে যোগদান করেন।

দক্ষিণসুরমার বরইকান্দির জাতক এডভোকেট এটিএম ফয়েজ আমার বেশ প্রিয় বন্ধু ছিলেন। তিনি ছাত্রলিগ বাসদের শীর্ষ পর্যায়ের ছাত্রনেতা ছিলেন। একদিন প্রিন্সিপাল আব্দুস শহিদ স্যার আমাদের ইংরেজি ক্লাসে ছিলেন। এসময় বাহিরের মিছিলের চিৎকারে বিরক্ত হয়ে বেরিয়ে এসে নেতা এটিএম ফয়েজকে সামনে পেয়ে বেশ ধমক দেন। আব্দুস শহিদ স্যারের ধমকে সবাই ভূদৌড়ে পালায়। নেমে আসে পিনপতন নীরবতা। শীর্ণতনু শ্যামলা এডভোকেট এটিএম ফয়েজ পরে বিএনপিতে যোগ দেন। তাঁর আইনজীবী পত্নী সিলেট সিটি কর্পোরেশনের কমিশনার ছিলেন।

১৯৮৫ সালের জানুয়ারিতে বিএ দ্বিতীয় বর্ষের ক্লাস শুরু হয়। এমন সময় সিলেট পলিটেকনিকে ক্লাস শুরুর ঘোষণা আসে। এই বছর এরশাদ বিরোধী ছাত্র আন্দোলন তীব্র আকার ধার করে। সামরিক শাসকের দমন পীড়নে কলেজ প্রায়ই বন্ধ ঘোষণা হত। পলিটেকনিকে ক্লাস করে শেখঘাটে খেয়ানৌকায় সুরমা নদী পার হয়ে এসে মাঝে মাঝে এখানে দ্বিতীয় বর্ষের ক্লাসে যোগ দিতাম। এই বছর একদিন প্রিন্সিপাল শ্রীকৃষ্ণ কুমার পাল অবসর গ্রহণ করেন এবং পাজামা-পাঞ্জাবিধারী ইয়া দাড়িওয়ালা আমাদের ইংলিশের অধ্যাপক আব্দুস শহিদ ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব গ্রহ করেন।

মদন মোহন কলেজে বি এ প্রথম বর্ষে পুরো ক্লাশ করেছি, দ্বিতীয় বর্ষে করেছি মাঝে মাঝে আংশিক। পলিটেকনিকের ক্লাসের ফাঁকে বেরিয়ে এসে বিএ ক্লাসে যোগ দিতাম। চোখের পলকে বিএ দ্বিতীয় বর্ষ শেষ। সহসা একদিন বিএ চুড়ান্ত পরীক্ষার তারিখ আগস্ট ১৯৮৫ ঘোষিত হয়। দশ দিনে দশ বিষয় পরীক্ষা হয়। পরীক্ষায় বেশ নকল হয়, শিক্ষকরা বাধ্য হয়ে নকলের টুকা কেড়ে নিতেন। মাঝে মাঝে পেপার কেড়ে নিয়ে অনেক পর ফেরত দিতেন। এভাবেই মদন মোহন কলেজে বিএ চুড়ান্ত পরীক্ষা সমাপ্ত হয়। নিমিষেই ব্যাচেলর অব আর্টস (বিএ) পড়ার ধূসর দিনগুলো যেন কালের কপোত তলে হারিয়ে যায়

একদিন শুনলাম বিএ পরীক্ষার ফল বেরিয়েছে। কলেজের নোটিশ বোর্ডে আমার ফলাফল খোঁজতে ছুটে এলাম। বিশ বাইশটি সিরিয়াল নম্বর পরপর এক একটি উত্তীর্ণ নম্বর আসছে। তীব্র হৃদকম্প নিয়ে খোঁজতে থাকি, সহসাই আমার নম্বরটি চোখে পড়ে ও প্রাণে স্বস্তি ফিরে আসে। ১৯৮৫ সালে এই কলেজে ৩২৪ জন ছাত্রছাত্রী বিএ চুড়ান্ত পরীক্ষায় অংশগ্রহ করে উত্তীর্ণ হন হাতেগুনা মাত্র ১৬ জন। কয়েকদিন পর মার্কসিট হাতে নিয়ে দেখলাম আমার প্রাপ্ত নম্বর ৪৮২ যাহা দ্বিতীয় বিভাগের প্রাপ্য নম্বর ৪৫০ এর চেয়ে ৩২ বেশী।

বাংলাসাহিত্য, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইসলামের ইতিহাসের প্রতি বিষয়ে ৩০০ করে মোঠ নম্বর ছিল ৯০০ কিন্তু ইংলিশে ছিল মাত্র ১০০ নম্বর। ১০০ নম্বরের ইংলিশ ছিল খুব কঠিন বিষয় এবং এই ইংরেজিই বিএ পরীক্ষায় এত এত ছাত্রের ফেল করার কার হত। সাইফুল নামের ইংলিশ দক্ষ একজন ক্লাসমেট ছিলেন। তিনি ইংরেজিতে ৪৬ নম্বর পেলেও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাত্র ১৭ পেয়ে ফেলের খাতায় নাম লেখান। ১৯৮৬ সাল থেকে ইংরেজি আর বাধ্যতামূলক বিষয় থাকেনি। ফলে বিএ পরীক্ষায় দ্বিতীয় বিভাগ ও পাশের হার অনেক অনেক বেড়ে যায়। মদন মোহন কলেজে একদা আমি চুপে চুপে এলাম, আবার চুপে চুপে হারিয়ে গেলাম। পড়ে রলো এই অনেক স্মৃতির ধূসর দিনপুঞ্জিকা। বিদায় এম এম কলেজ, সিলেট।

দাউদপুর জামে মসজিদ নিয়ে সমস্যা ও সমাধান। নতুন মসজিদ নির্মাণ।

সেই ১৯৮৪ ও ১৯৮৫ সালে আমাদের গ্রামের দাউদপুর কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের মোতাওয়াল্লি ছিলেন সফিকুর রহমান চৌধুরী। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে মুছল্লিদের স্থান সংকুলান বেশ কঠিন হয়ে যায়। তাছাড়া সে সময় ছয়পাড়ায় এযুগের মত এত মসজিদের ছড়াছড়ি ছিলনা। তাই আমার পিতা মোতাওয়াল্লী সফিকুর রহমান চৌধুরী প্রাচীন চুনসুরকির গম্বুজওয়ালা বিশাল মসজিদ ভেঙ্গে নুতন আরসিসি বহুতল মসজিদ নির্মাণের সিন্ধান্ত নেন। এমন সময় হঠাৎ গ্রামের ছয়পাড়ার নেতারা দাবি তুলেন নতুন মসজিদ নির্মাণের আগে চৌধুরীগোষ্টীকে মসজিদটি হেবা বা দানপত্র করে দিতে হবে। এই বিশাল রাজকীয় মসজিদটি কয়েক শত বছর আগে আমাদের পুর্বপুরুষ জমিদারগ তাদের মালিকানাধীন ভূমিতে নির্মা করেন। হজরত শাহজালালের(রঃ) সাথী সুফি ও দরবেশ হজরত শাহদাউদ কুরেশির(রঃ) মাজার এই মসজিদ চত্বরে হওয়ায় এই মসজিদের বিশেষ গুরুত্ব ছিল, তাই দূরদূরান্তের মানুষ এখানে নামাজ পড়তে আসতেন। 

যুগ যুগ ধরে সিলেটের এই সুউচ্চ চারতলা মিনারের অপরূপ সুন্দর বিশাল শাহি মসজিদটিতে মানুষ নামাজ পড়ে এসেছেন কিন্তু কোনকালে কোনদিন মসজিদ কাগজ করে দেওয়ার কোন দাবি উঠেনি। আব্বা সফিকুর রহমান চৌধুরী বেশ সমস্যায় পড়লেন; তিনি কি করবেন, না করবেন, চিন্তা করারও ফুরসৎ তাকে কেউ দিতে রাজি নয়। গ্রামবাসীর এই আন্দোলন ক্রমেক্রমে তীব্র আকার ধার করে।

দেশে বিদেশে চলে যাওয়ায় চৌধুরীবাড়িগুলো প্রায়ই লোকশুন্য। একই রক্তের সাতটি চৌধুরীবাড়ির সবার সাথে আলোচনা না করে আব্বার পক্ষে একা কিছু করার কিংবা সিন্ধান্ত দেবার কোন উপায় ছিলনা। বিগত কয়েক শত বছরে এক বাড়ি ভেঙ্গে সাত বাড়িতে পরিনত হওয়ায় এই সুপ্রাচীন জায়গায় সবকটি চৌধুরীবাড়ির মালিকানা রয়ে যায়। 

কর্পুর হুজুর নামের গ্রামের একজন লোক মোতাওয়াল্লীর অনুমতি ছাড়াই আগের ইমামকে সরিয়ে জুরপূর্বক চর দখলের মত মসজিদের ইমামতি দখল করে বসে। এলাকার বিখ্যাত আলেম হজরত মৌলানা হরমুজুল্লাহ সায়দা(রঃ) কেতাব ঘেঁটে জানালেন এই ইমামের পিছনে নামাজ হবেনা। কিছুদিনের মধ্যে সিলেটের তথা বাংলাদেশের বিখ্যাত পীরে কামিল হজরত আব্দুল লতিফ চৌধুরী ফুলতলী সাহেবকিবলা(রঃ) ফতোয়া দেন মোতোয়াল্লীর অনুমোদন ছাড়া কোন মসজিদে  ইমামতি করা সম্পূর্ণ নাজায়েজ। বেশ কয়েকদিন এই কর্পুর হুজুর অবৈধ ইমামতি করে পাততাড়ি গুটায়। তবে সবাই নয়, কিছু সংখ্যক মানুষ এই লোকের পিছনে নামাজ পড়ে তাঁদের নামাজ নষ্ট করেন।     

ইতিমধ্যে বুরোধান কাটার মৌসুম এলে গ্রামবাসী ধানকাটা বয়কট করেন। এবছরের পুরো বুরোধান ক্ষেতে বিনষ্ট হয়। আব্বার অগোচরে একদিন পুরো বিষয়টি জানিয়ে আমি চাচাতো ভাই পুলিশের আইজিপি ই এ চৌধুরীকে রাজারবাগের ঠিকানায় একটি চিটি দেই। দুই এক দিন পরই একদল পুলিশ এসে জিপে করে আব্বা ফিকুর রহমান চৌধুরীকে সিলেটের এসপি অফিসে নিয়ে যায়। এসপি সাহেব আব্বাকে লম্বা সালাম দিয়ে বললেন, আইজি স্যার আপনাকে সব ধরণের সাহায্য করতে বলেছেন, বলুন আমরা আপনাকে কি সাহায্য করব। আব্বা এইদিন চাইলে অনেক লোকজনকে গ্রেপ্তার করাতে পারতেন কিন্তু তিনি এসপি সাহেবকে ঘটনার বিবর পেশ করে বললেন, আমার পূত্র হয়ত ভয় পেয়ে আমার অগোচরে ভাগনা এমাদকে চিটি দিয়েছে। আপাততঃ বিষয়টা আমরা নিজেরাই সমাধা করে নিতে পারব এবং যদি প্রয়োজন হয় তবে আপনাদের সাহায্য নেব।

আব্বার ছিল খুব মহানুভব স্বত্তা, তাকে তীব্র যন্ত্রণা দিলেও তিনি বদলা নেওয়ার কোন সুযোগই নিতেন না। এবার আইজি ভাই নিজে বিষয়টির সমাধানে নামেন এবং একদিন আব্বা সফিকুর রহমান চৌধুরী, চাচা আবুল হাসান চৌধুরী, রেজওয়ান চৌধুরী, আবুল লেইস চৌধুরী, আলমগির কুরেশি এবং গ্রামের নেতাদেরকে নিয়ে সিলেট সার্কিট হাউসে আলাপ আলোচনা করে মসজিদ পরিচালনার একটি সুন্দর সংবিধান তৈরি করে বিষয়টির সমাধান করেন।

অতি বিচক্ষ ও দুরদর্শী ব্যাক্তিত্ব তৎকালীন বাংলাদেশ পুলিশ প্রধান ই এ চৌধুরী সিলেট সার্কিট হাউসে সবাইকে নিয়ে বসে বিষয়টির দ্রুত একটি চিরস্থায়ী সমাধান করায় আব্বা সফিকুর রহমান চৌধুরী বাড়িতে গিয়ে খুশি হয়ে বললেন, আমার ভাগনা এমাদ কি আর এমনি এমনি দুইবার পিএসসি পরীক্ষা পাস করেছে, পুলিশের আইজি হয়েছে। 

কিছুদিনের মধ্যে মোতাওয়াল্লি আমার আব্বা সফিকুর রহমান চৌধুরী বর্তমান আধুনিক মসজিদের নির্মাকাজ শুরু করেন এবং মসজিদটি কয়েক বছরের মধ্যেই বর্তমানে বিদ্যমান এই স্থাপত্যশৈলীতে পরিত হয়। আব্বার ডাকে সাড়া দিয়ে সর্বজনাব শফি চৌধুরী, মনির আহমদ, সৈয়দ আব্দুল মতিন,  ই এ চৌধুরী ও নাসির চৌধুরী এই মসজিদের নির্মা কাজে লক্ষ লক্ষ টাকা নিজেরা দান করেনএমন কি তারা বিভিন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও প্রতিষ্ঠান হতেও বড় বড় অঙ্কের অর্থ সংগ্রহ করে দেন। গ্রামবাসী সর্বসাধার নিজ নিজ সামর্থানুসারে অর্থ ও শ্রম দিয়ে নির্মাকাজে অংশগ্রহ করেন। সবার ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফসল আজকের এই বহুতল দাউদপুর জামে মসজিদ। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন