শনিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

স্মৃতির মনিকোঠায় মদন মোহন কলেজ, সিলেটঃ

 

স্মৃতির মনিকোঠায় মদন মোহন কলেজ, সিলেটঃ

সেশনঃ ১৯৮৩-৮৪, চুড়ান্ত পরীক্ষাবর্ষ-১৯৮৫ সাল

অবস্থানঃ জানুয়ারি ১৯৮৪ হতে ডিসেম্বর ১৯৮৫ সাল                             

 

নানা তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে আমি সিন্ধান্ত নিলাম  শহরে কোন আত্মীয় বাসায় আর থাকব না, যদিও কলেজ হোস্টেলে কিংবা ছাত্রমেছে থাকার মত আর্থিক সামর্থ্য আমার নেই। এমন বিষয়ে ভর্তি হব, যা বাড়ি হতে আসা যাওয়া করে সহজে পড়া যাবে। ১৯৮৩ সালের শেষদিকে সোজা মদন মোহন কলেজে গিয়ে ১৯৮৫ সালের বিএ (ব্যাচেলর অব আর্টস) পরীক্ষার্থী ব্যাচে ভর্তি হয়ে গেলাম। প্রশ্ন আসতে পারে বিএসসি কিংবা বিকম নয় কেন? কার ইতিমধ্যে আমি পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটে সিবিল টেকনোলজিতে ভর্তি হয়ে গেছি। একসাথে ডাবল ইঞ্জিন ড্রাইভ করতে হবে। বিএ তে ভর্তি হবার কারণে প্রাইভেট পড়তে হবেনা, সেইসাথে ক্লাসে হাজিরা অল্পবিস্তর একটা কিছু হলেই চলবে।

আমি তখন পুরোপুরী হতাশ, মনে হল কিছু না পেলে আব্বার হাইস্কুল শিক্ষকের চাকুরিটা অন্ততঃ বগলদাবা করে নিতে পারব। আর ভাবলাম চাচাত ভাই পুলিশের আইজিপি জনাব ই এ চৌধুরীকে ধরে অন্ততঃ পুলিশের সাব ইন্সপেক্টর হবারও চেষ্টা করা যাবে। আব্বারও অনেক বয়স হয়ে গেছে, চাকুরি আর বেশিদিন করার মত অবস্থায় তিনি নেই। নিতান্ত বাধ্য হয়েই সামান্য কিছু টাকার জন্য বুড়ো বয়সে তিনি শিক্ষকতা করে যাচ্ছেন।

অন্যদিকে আমাদের জমিজামা নিয়ে লোভী রাক্ষসদলের অশুভ জবরদস্তি ও দখলবাজিতে তখন তার বৃদ্ধপ্রাণের একেবারে অষ্টাগত অবস্থা। এতদিনের সব বড় বড় স্বপ্নকে এবার ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করলাম। নিজেকে বললাম, ‘জনাব সেফাক সাহেব, পৃথিবীতে সব মানুষ বড় হবার জন্য জন্ম নেয়না। হাতেগুণা দুইএক জন রাজা-রাজড়া হয়, বাকী বেশীরভাগ মানুষ জন্ম নেয় প্রজা হতে। মোল্লার দৌড় মসজিদে, অনুরূপ তোমারও দৌড়ের একটা সীমারেখা রয়েছে। আল্লাহ না চাইলে তুমি কে, যে সেই ভাগ্যের সীমান্ত পারি দেবে। চেয়ে চেয়ে দেখ তোমার ভাগ্যের লিখন তোমাকে কোথায় নিয়ে যায়

তবে এত স্বপ্নভঙ্গের মধ্যেও অবচেতন মনে কেবলমাত্র একটি স্বপ্ন সুপ্ত রয়ে গেল, তাহল কবি, সাহিত্যিক ও সুফি হবার স্বপ্ন। বাল্যকৌশরে মনের গহিনে মহান আল্লাহর মেহেরবানিতে জেগে উঠা সেই লেখক ও সূফি হবার স্বপ্ন আমার মরলনা। বরং সারাটা জীবনভর রয়ে রয়ে মনের ভিতর সেই গুণী মানুষটি হবার সোনালি স্বপ্নটা বারবার ঘাই মেরে গেল

এই মদন মোহন কলেজটির জন্ম ১৯৪০ সালে শহরের প্রায় কেন্দ্রস্থল লামাবাজারে। কলেজের জায়গার পরিমান মাত্র সাড়ে তিন একর যা কয়েক হাজার ছাত্রছাত্রীর জন্য সামান্যই বলা যায়, তাই ডানদিকে উচুউচু বহুতল ভবনের ইট পাতরের ঠাসবুনুনি। বামদিকে কলেজ ছাত্রাবাস, মসজিদ, প্রিন্সিপালের বাসা ও পোষ্ট অফিস। সামনে বড় গেটের বামপাশে ছিল মহান একুশের শহিদ মিনার, তাতে তামার পাতে খূদাই করে লিখা ছিল ‘লক্ষ শহিদ ঘুমিয়ে আছে বাংলার পথেপ্রান্তরে,/ তারা মরে নাই, মরেনা শহিদ যুগযুগান্তরে’একবার উম্মুক্ত একদল দুবৃত্ত হামলা করে এই তামার স্মৃতিফলকটি শাবল মেরে ফুটো করে দিয়েছিল। 

১৯৮৪ সালের জানুয়ারিতে ক্লাস আরম্ভ হল। চারতলার একই কক্ষে বি এ পাসের প্রথমবর্ষের সবগুলো ক্লাস হত। এমসি কলেজের মত এখানেও প্রায় তিন শতাধিক ছাত্রছাত্রী ভর্তি হন। কিন্তু দিনে মাত্র তিন চারটি ক্লাস হত ও শিক্ষার্থী উপস্থিত হতেন মাত্র পঞ্চাশ ষাট জন। এই কলেজে তেমন মেধাবীরা ভর্তি হতনা। সারা কলেজ জুড়ে চলত কেবল রাজনীতির হৈ চৈ, মিটিং মিছিল। সব ছাত্রই যেন এক একজন নেতা, উপনেতা কিংবা পাতিনেতা। চলত ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া ও পুলিশের লাটিচার্জ। মাঝে মাঝে খুন খারাবিও সংঘটিত হত।

জাসদ, বাসদ, ছাত্রলীগ, ছাত্রশিবির, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র সমাজ, ছাত্রদল এমন কোন রাজনৈতিক ছাত্র সংঘটন ছিলনা যাদের সাইনবোর্ড, ব্যানার ও পোস্টার এখানে নেই। আলকাতরার চিকামেরে ওয়ালগুলোর অবস্থা এমন বিশ্রী করে ফেলা হত যে ওদিকে তাকালে ঘেন্না হত। এখানে রোজ রোজ হত নবীনবর উৎসব আর সাথে মারামারি। এখানে লেখাপড়ার চেয়ে রাজনীতি নিয়েই ছাত্ররা বেশি ব্যতিব্যস্ত থাকতেন। নাম বলবনা এমন কিছুকিছু ছাত্রনেতাদের আচার আচর দেখে মনে হত এরা গূন্ডা মাস্তানের চেয়েও অধম এবং এরাই কলেজে ছাত্রদের নেতৃত্ব দিত। এই বয়সে এসে এসব নেতাদেরকে দেশের নেতৃত্বও প্রদান করতে দেখছি।    

এখানে প্রতি ক্লাসে রোলকল হত, আমার রোল নং ছিল ২০৭৫আমার ছাত্রাবস্থায় এই কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন শ্রীকৃষ্ণ কুমার পাল চৌধুরী যিনি ছিলেন নবীগঞ্জের লোকতিনি একটি ইংলিশ গ্রামার রচনা করেন যাহা এই কলেজে বাধ্যতামূলক পাঠ্যপুস্তক ছিল, ফলে তার এই গ্রামারটি ছাত্রছাত্রীরা কিনতে বাধ্য হত। তিনি আমাদের ইংলিশ গ্রামারের ক্লাস নিতেন। ছাত্রদের উপর কে কে পাল স্যারের ভাল নিয়ন্ত্র ছিল। এমনকি ছাত্রনেতারাও তাকে বেশ সমীহ করে চলত

আব্দুল হান্নান ইংলিশের আরেক শিক্ষক ছিলেন। ইংলিশের একজন আত্মভূলা স্যার ছিলেন তার নাম আতাউর রহমান। এই আত্মনিমগ্ন শিক্ষক এতই বেখেয়াল ছিলেন যে, পরবর্তী ক্লাসের শিক্ষক এসে কক্ষে ঢুকে তাকে না জাগালে তিনি বুঝতেই পারতেন না তার ক্লাসের সময় অনেক আগে শেষ হয়ে গেছে। আতাউর রহমান স্যারকে ক্লাসে রেখে ছাত্ররা একজন একজন করে বেরিয়ে যেত স্যার টেরই পেতেন না। শেষ পর্যায়ে তার ক্লাস ছাত্রশূন্য হয়ে যেত। আর আত্মভোলা স্যার ছাত্রশুন্য ক্লাসে অপনমনে পড়ায়ে যেতেন। রিকশাওয়ালা প্রতিদিন কলেজগেট পেরিয়ে তাকে নিয়ে অনেক দূর চলে গেলে তিনি বুঝতেন ভুল হয়ে গেছে, তিনি কলেজটাকে বেশ পিছনে ফেলে এসেছেন। স্যার রিকশাওয়ালার প্রতি ইংলিশ বাংলা বাক্য ছুড়ে দিলে সে ভয়ে ভ্যাবাচাকা খেয়ে থেমে যেত, তখন আশপাশের কোন ছাত্র এগিয়ে এসে স্যারকে কলেজে পাঠানোর কঠিন উদ্ধার কাজটি সমাধা করে দিত।

আমাদের প্রথম ক্লাসটি ছিল বাংলা। ক্লাস নেন বাংলার শিক্ষক বিজিত চৌধুরী। স্যারের পিছনে পিছনে ক্লাসে আসেন কয়েকজন ছাত্রী। তাঁরা সীমা কর, স্বপ্না, নাজমা খানম প্রমুখ। সামনের সারিতে বসা ছেলেদেরকে উঠায়ে বিজিত স্যার মেয়েদের জন্য সামনের সিট বরাদ্ধ করে দেন। ক্লাস সমাপ্ত হলে মেয়েরা স্যারের সাথে বের হয়য়ে ছাত্রী মিলনায়তনে চলে যায়।

চৌহাট্টার সেন্ট্রাল ফার্মেসির মালিক বিজিত চৌধুরী স্যারের বাচনভঙ্গি ছিল চিত্তাকর্ষক। তার ভাষ ছিল আকর্ষণীয়, তিনি পড়াতেন বংলাসাহিত্য শরতচন্দ্রের ‘বিলাসী’ ছোটগল্পটি প্রাবন্ত করে পড়াতেন। মনে হত তিনি অভিনয় করে যাচ্ছেন। নিরঞ্জন দেবনাথ পড়াতেন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস। প্রনব কুমার সিংহ ছিলেন কলেজের উপাধ্যক্ষ, তার মুখে সব সময় মিষ্টিহাসি লেগে থাকত। তিনি আমাদেরকে আবুল মনসুর আহমদের উপন্যাস ‘সত্যমিথ্যা’ এবং কবি মাইকেল মধুসুদন দত্তের নাটক ‘কৃষ্ণকুমারী’ পড়াতেন।

ইতিহাস ছিল আমার অত্যন্ত আকর্ষণীয় বিষয়, তাই ইসলামের ইতিহাসের ক্লাস আমি কখনো বাদ দিতাম না। চেক হাফসার্ট পরা গোলমুখ ফজলুল হক পড়াতেন ইসলামের অভ্যুদয় হতে পরবর্তী হাজার বছরের ইসলামের সোনালি ইতিহাস। স্যার আবিস্কার করেন পৃথিবীর ইতিহাসের যুগান্তকারী যুদ্ধসমূহের প্রায় যুদ্ধক্ষেত্রেই বড় সেনাদল ছোট সেনাদলের হাতে পরাজিত হয়‘ইসলামের সংস্কৃতির ইতিহাস’ পড়াতেন নজরুল ইসলাম, যিনি পরবর্তীকালে এই কলেজের অধ্যক্ষের পদে অধিষ্টিত হন। তিনি ছিলেন সুরমাপারের খিত্তা পরগনার লোক। একদিন ক্লাসে স্যার একটি হাদিস উল্লেখ করেন, ‘তোমরা যৌবনে উপনীত হলে সামর্থ্য থাকলে বিয়ে কর, সামর্থ্যহীন হলে রোজা রেখো’একজন ছাত্র দাঁড়িয়ে স্যারকে প্রশ্ন করল, বিয়ে করার সামর্থ্য না থাকলে আমরা কেন রোজা রাখব স্যার? বুদ্ধিমান স্যার একটু সময় চিন্তা করে হেসে ছাত্রটিকে বললেন, তোমার কোন সেয়ানা বুঝদার  সহপাঠির কাছ থেকে উত্তরটি জেনে নিও।

বহুবছর পর নজরুল ইসলাম স্যার ও আমি সাগরদিঘিরপার একই পাড়ার বাসিন্দা হই। আমি ২০১২ সালে যখন “শাহজালাল(রঃ) ও শাহদাউদ কুরেশী(রঃ)” গ্রন্থটি রচনা করি তখন তিনি আমাকে অনেক উপদেশ প্রদান ছাড়াও “বৃহত্তর সিলেটের ইতিহাস” বইটি উপহার দিয়ে সহায়তা করেন। আমাদেরকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়াতেন গ ক ম আলমগীর ও আকরাম আলী। আকরাম আলী স্যারের বাড়ি টুকেরবাজারের কাছে কোন এক গ্রামে। কৃষ্ণবর্ণ বেঁটে স্থুলকায়া আকরাম আলী স্যারের কন্ঠস্বর এত তীব্র ছিল যে ছাত্ররা বলত তার কথা শুনলে বধিরও ঘুম হতে জেগে উঠবে

এখানে অল্প কয়েকজন সহপাঠির সাথে পরিচয় ও বন্ধুত্ব হয়। সিদ্দিকুর রহমান নির্ঝরের সাথে এখানেই পরিচয় হয় ও পরে তাহা সারাজীবনের বন্ধুত্ব রূপলাভ করেএকটু খাটো শ্বেতকায়া স্বপ্নবিলাসী তরুণ সিদ্দিক, তার হৃদয় জুড়ে অসংখ্য স্বপ্নের জালবুনা। পিএইচডি করা হতে শুরু করে দেশের মন্ত্র প্রধানমন্ত্রী হওয়া পর্যন্ত তার স্বপ্নের রাজ্যে ঘুরে বেড়াত। আমাদের দুইজনের একটা বিষয়ে মিল ছিল, আমার মত তারও পত্রিকায় মাঝে মধ্যে দু’একটাখা ছাপা হত। প্রতিদিন গ্রাম হতে শহরে আসা বিষাদগ্রস্ত তরু আমি তার পাশে বসে যেন কেমন একটা শান্তি অনুভব করতাম ও অলিক স্বপ্নের জাল বুনে আনন্দ পেতাম।

তার বাসা কলেজের কাছে পুরান মেডিকেলে শহীদ মিনারের পিছনের সরকারি আবাসিক এলাকায়সে খুব দয়ালু ও উদার মনের মানুষপ্রায়ই দুপুরে বলতেন, এত সাতসকালে গ্রাম থেকে বেরিয়ে এসেছিস, চল আমার বাসায় খেয়ে যাবে‘না, না’ বলেও অনেক সময় পার পাওয়া যেত না। এখানে এমন একজন মমতাময়ী মায়ের সন্ধান পাই যিনি দুই কন্যা ও চারপুত্রের এক পরিবারকে পরম আদরে তার বূকের সাথে বেঁধে রেখেছেন। টিনের বারান্দায়  সিদ্দিকের শোবার কক্ষ, একটা ছোট দেড়জনি পালং, ছোট টেবিলের সাথে দুইটি চেয়ার ও তার বিচিত্র সব  ছবি ও হস্তকর্মের ছড়াছড়ি।

কোথাকার এক গায়ের ছেলে আমি এখানে এসে এক নতুন মাতৃস্নেহের সন্ধান পেলাম। বড় দুইবোন সরকারি চাকুরি করেন, হালিম ও ডালিম ছোট দুইভাই স্কুল কলেজের ছাত্র। তার বড়ভাইও ছিলেন সহজ সরল স্নেহপ্রব লোক। তিনি দক্ষিসুরমা বাস টার্মিনালে টায়ারের ব্যবসা করতেন। আমি কলেজ হতে ফেরার পথে টার্মিনালে দেখা হলে প্রায়ই বলতেন, সেফাক তুমি আস, তোমাকে নিয়ে দুপুরের খাবার খাবো। আমি লজ্জায় অজর আপত্তি দেখালেও তিনি ছাড়তেন না। বাধ্য হয়ে কোন হোটেলে তার সাথে মাঝেমধ্যে আমাকে ঢুকতেই হত। জগন্নাথপুরের ভবেরবাজারের পাশে একটি বহু ঘাটওয়ালা ঘনবসতি বাড়িতে এই ভাই বিয়ে করেন। তার বিয়ের বাস চড়ে আমি জীবনের প্রথমবার সাপের গতিপথের মত এক আঁকাবাঁকা সড়ক দিয়ে জগন্নাথপুর উপজেলায় প্রবেশ করি। বড়ই দুঃখের বিষয় ভাবী যথেষ্ট সুন্দরী হলেও তাদের কোন সন্থান হয়নি। একসময় ভাইয়ের হালকা প্যরালাইছিছ হলে ভাবী এই অসহায় ভাল মানুষটাকে ফেলে চলে যান।      

দাড়িয়াপাড়ার পুরান মেডিকেলের এই বাসায় ঢুকলে মনে হত এযেন শহরে আমার আরেক পরিবার। টিনের বাসার সামনে খুব সুন্দর উন্নত গোলাপবাগান। চৌহাট্টার ফুল বিক্রেতারা বেশ ভালদাম দিয়ে প্রতিদিন কিছু গোলাপ কিনে নিত। তাতে সিদ্দিক সাহেবের হাতখরচের কিছু টাকা বেরিয়ে আসত।

এখানে পরিচয় হয় কবি ও সাংবাদিক আমিরুল ইসলাম চৌধুরীর সাথে, তিনি বাউলসম্রাট আব্দুল করিমের জন্মস্থান দিরাই উপজেলার উজানধল গ্রামের সন্তান। সুদর্শন ফর্সা আমিরুল ভাই তখন দৈনিক সিলেট বানীতে কাজ করতেন। মনে হত তিনি যেন একজন ছন্নছাড়া জিপসি যাযাবর। রমজান নামের নিরিহ মানুষটির কথা মনে পড়ে, যিনি খাদিম চাবাগানে চাকুরি করতেন ও অল্প বয়সে চিরবিদায় নেন। সিদ্দিকের মাধ্যমে একজন অতি নম্রভদ্র বন্ধু লাভ করি, তিনি আমার আত্মার আত্মীয় সিলেটের ডাকের সাংবাদিক আব্দুস সবুর মাখন ভাই, নজরুলগীতি গায়ক ও সাংবাদিক সমরেন্দ্র বিশ্বাস এবং একই পাড়ার এনামুল হক চৌধুরীএনামুল হক চৌধুরীর গ্রামের বাড়ি দক্ষিণসুরমার কামাল্বাজার। সিদ্দিকের পুরান মেডিকেলের শোবার কক্ষে আড্ডা জমানো এই সব বন্ধুরাই ছিলেন মনখোলা, আন্তরিক ও উষ্ণহৃদয়। এই কক্ষটি ছিল যেন বিখ্যাত শিল্পী মান্নাদের কলকাতার সেই আড্ডার একটি কফি হাউস, যেখানে কফি নয়, এখানে চলত গরম চা।

একবার পুরান মেডিকেলে খুববেশী চোরের উপদ্রপ শুরু হয়। খালাম্মা চোরের হাত হতে রক্ষা পেতে প্রতিরাতে আয়াতুল কুরসি পড়ে ঘুমাতেন। একদিন ঘুমের ঘুরে স্বপ্নের মধ্যে পিছনের জানালা দিয়ে চোর ঢুকে পড়তে দেখে তার ঘুম ভেঙ্গে যায়। তখন তিনি পিছনের ডাইনিং কক্ষে গিয়ে দেখেন সত্যিই জানালা একটু ভেঙ্গে গ্রিলের ভিতরে চোরের হাত নড়াচড়া করছে। কোরানের এই পবিত্র আয়াতের চাক্ষুস মজেজা দেখে অভিভুত আমি তখনই আয়াতুল কুরসি মুখস্ত করে ফেলি।

বি এ ক্লাসে অধ্যয়নকালে আরেক লেখকের দেখা পাই, তিনি এডভোকেট অনুজ রায় বাদল। তার কথায় একটু জড়তা থাকলেও বুদ্ধিতে ছিলেন চৌকষহ্যান্ডসাম সহপাঠি বিশ্বজিত গু এখন একজন ব্যাংকার, তিনি আমাদের সুন্দরী সহপাঠিনী সীমা করকে বিয়ে করেন কলেজের এক পুজার অনুষ্ঠানে তাদের অভিসার আমাদের চোখে পড়, যাহা পরে তাহাদের পরিয়ে গড়ায়। আমার অন্য সহপাঠিনী ছিলেন স্বপ্না পাল ও নাজমা খানম।  সুনিল ও অনিল ছিলেন দুইজন মনিপূরী জমজ ভ্রাতা। অতিভদ্র ও সহজসরল এই দুইভাই উপজাতি কোটায় সরকারি চাকুরিতে খুব সহজে নিয়োগ পান। তারা দুই ভাইয়ের চেহারায় এতই মিল ছিলযে কে সুনিল আর কে অনিল নির্নয় করতে সবাইকে বেশ বেগ পেতে হত।

আব্দুল মুমিন চৌধুরী মাসুম ছিলেন জালালপুরের এক অভিজাত পরিবারের সন্থান। বি এ পরীক্ষার আগে একদিন আম্বরখানা সরকারি আবাসিক এলাকায় তার বাসায় দাওয়াত খাই। তার প্রৌড়া জননী রান্না করে খাবার পরিবেশন করেন। তিনি ইসলামি ব্যাংকে তার চাকুরি জীবন অতিবাহিত করেন। শেখঘাটের আমিনুন নুর ভাই ছিলেন মাবাবার একমাত্র সন্থান। স্থুলকায়া ও দীর্ঘ্যাঙ্গ সহপাঠি প্রভাষক আমিনুন নুর ভাইকে পরে কাজলশাহ পাড়ায় প্রতিবেশী হিসাবে পাই। আমার পত্নীর সাথে তার সহধর্মিনীর বেশ বান্ধবীয়ানাও জমে উঠে। তিনি তখন বিশ্বনাথ কলেজে শিক্ষকতা করতেন। শেখঘাটের আমার আরেক সহপাঠি ছিলেন রফিকুল ইসলাম বাচ্ছুতিনি আমার মত একজন ব্যাংকার হিসাবে জীবন পার করেন।

শেখঘাটের স্বনাধন্য সাহিত্যিক ও সরকারি আমলা মুসলিম চৌধুরীর সুযোগ্য সন্থান চৌধুরী মমতাজ মম ছিলেন একজন রসিক সহপাঠি। তিনি হেসে হেসে বিছিয়ে বিছিয়ে বেশ আর্ট করে কথা বলতেন, যা আমাদেরকে বিমুগ্ধ করত। তিনি একজন প্রসিদ্ধ সাংবাদিক ও বর্তমানে ‘দৈনিক সবুজ সিলেট’ নামের একটি স্থানীয় পত্রিকা পরিচালনা করছেন। সিলেটের বর্তমান বিএনপি নেতা ভাগনা আবুল কাহের শামিম আমাদের সাথে ১৯৮৫ সালে বিকম পরীক্ষা দেন। তিনি তখন কলেজের জাসদ ছাত্রলিগের একজন নম্রভদ্র শীর্ষনেতা ছিলেন।

১৯৮৫ সালের জানুয়ারিতে বিএ দ্বিতীয় বর্ষের ক্লাস শুরু হয়। সিলেট পলিটেকনিকে ক্লাস শুরুর ঘোষণা আসে। এই বছর এরশাদ বিরোধী ছাত্র আন্দোলন তীব্র আকার ধার করে। সামরিক শাসকের দমন পীড়নে কলেজ প্রায়ই বন্ধ ঘোষিত হত। পলিটেকনিকের ক্লাস করে শেখঘাটে খেয়ানৌকায় সুরমা নদী পার হয়ে এসে মাঝে মাঝে  এখানে দ্বিতীয় বর্ষের ক্লাসে যোগদান করতাম। এই বছর একদিন শ্রীকৃষ্ণ কুমার পাল অবসর গ্রহন করে এবং পাজামা-পাঞ্জাবিধারী দাড়িওয়ালা অধ্যাপক আব্দুস শহিদ ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্বভার গ্রহ করেন। সহসা একদিন বিএ চুড়ান্ত পরীক্ষার তারিখ আগস্ট ১৯৮৫ ঘোষিত হয় ও নিমিষেই এই বছরটি যেন কালের কপোত তলে হারিয়ে যায়

একদিন শুনলাম বিএ পরীক্ষার ফল বেরিয়েছে। কলেজের নোটিশ বোর্ডে আমার ফলাফল খোঁজতে ছুটে এলাম। তের চৌদ্দটি নম্বর পরপর এক একটি উত্তীর্ণ নম্বর আসছে। হৃদকম্প নিয়ে খোঁজতে লাগলাম, সহসাই আমার নম্বরটি চোখে পড়ল ও প্রাণে স্বস্তি ফিরে পেলাম। ১৯৮৫ সালে এই কলেজে ৩২৪ জন ছাত্র বিএ চুড়ান্ত পরীক্ষায় অংশগ্রহ করেন। কিন্তু উত্তীর্ন হন মাত্র ১৬ জন, যার মধ্যে ইংলিশ অত্যাবশ্যক থাকায় দ্বিতীয় বিভাগ কেউ পাননিমার্কসিট হাতে নিয়ে দেখলাম আমার প্রাপ্ত নম্বর ৪৭২ যাহা দ্বিতীয় বিভাগের প্রাপ্য নম্বর ৪৫০ এর চেয়ে ২২ বেশী। বাংলাসাহিত্য, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইসলামের ইতিহাসের প্রতি বিষয়ে ৩০০ করে মোঠ নম্বর ছিল ৯০০ কিন্তু ইংলিশে ছিল মাত্র ১০০ নম্বর। এই ইংলিশ ছিল খুব কঠিন বিষয় এবং এই ইংরেজিই এতএত ছাত্রের ফেল করার কার হত। সাইফুল নামে ইংলিশ দক্ষ একজন ক্লাসমেট ছিলেন। তিনি ইংরেজিতে ৪৬ নম্বর পেলেও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাত্র ১৭ পেয়ে ফেলের খাতায় নাম লিখেন। উচ্চমাধ্যমিকের মত আমার ভাগ্যলিখনে আবার ময়লা লাগল, ইংরেজিতে মাত্র ২টি নম্বর গ্রেস লাগার কণে আমার নিশ্চিত পাওয়া দ্বিতীয় বিভাগ মারা গেল।

এই সময় আমাদের গ্রামের দাউদপুর বড় মসজিদের মোতাওয়াল্লি আব্বা মুছল্লিদের স্থান সংকুলান না হওয়ায় প্রাচীন মসজিদ ভেঙ্গে নুতন মসজিদ নির্মাণের সিন্ধান্ত নেন। এমন সময় হঠাৎ গ্রামের নেতারা দাবি তুলেন নতুন মসজিদ নির্মাণের আগে চৌধুরীগোষ্টীকে মসজিদটি কাগজ করে দিতে হবে। মসজিদটি তিনচার শত বছর আগে আমাদের পুর্বপুরুষগ তাদের মালিকানাধীন ভূমিতে নির্মা করেন। এত এত বছর এই সুন্দর বিশাল মসজিদটিতে মানুষ নামাজ পড়ে এসেছেন কিন্তু কোনকালে কোনদিন এধরনের কোন দাবি উঠেনি। আব্বা সমস্যায় পড়লেন; তিনি কি করবেন, না করবেন, চিন্তা করারও ফুরসৎ তাকে তারা দিচ্ছেনা। গ্রামবাসীর এই আন্দোলন ক্রমেক্রমে তীব্র আকার ধার করে।

দেশে বিদেশে চলে যাওয়ায় চৌধুরীবাড়িগুলো প্রায়ই লোকশুন্য। আটটি চৌধুরীবাড়ির সবার সাথে আলোচনা না করে আব্বার পক্ষে কিছু করারও উপায় ছিলনা। ইতিমধ্যে বুরোধান কাটার মৌসুম এলে গ্রামবাসী ধানকাটা বয়কট করেন। এবছরের পুরো বুরোধান ক্ষেতে নষ্ট হয়।

আব্বার অগোচরে একদিন পুরো বিষয়টি জানিয়ে আমি চাচাত ভাই পুলিশের আইজিপি ই এ চৌধুরীকে রাজারবাগের ঠিকানায় একটি চিটি দেই। একদিন একদল পুলিশ এসে জিপে করে আব্বা ফিকুর রহমান চৌধুরীকে সিলেটের এস পি অফিসে নিয়ে যায়। এস পি সাহেব আব্বাকে লম্বা সালাম দিয়ে বললেন, আই জি স্যার  আপনাকে সব ধরণের সাহার্য্য করতে বলেছেন, বলুন আমরা আপনাকে কি সাহার্য্য করব। আব্বা এইদিন চাইলে অনেক লোকজনকে গ্রেপ্তার করাতে পারতেন কিন্তু তিনি এস পি সাহেবকে ঘটনার বিবর পেশ করে বললেন, আমার পূত্র হয়ত ভয় পেয়ে আমার অগোচরে ভাগনা এমাদকে চিটি দিয়েছে। আপাততঃ বিষয়টা আমরা নিজেরাই সমাধা করে নিতে পারব এবং যদি প্রয়োজন হয় তবে আপনাদের সাহায্য নেব।

আব্বার ছিল খুব মহানুভব স্বত্তা, তাকে তীব্র যন্ত্রণা দিলেও তিনি বদলা নেওয়ার কোন সুযোগই নেননি। এবার আই জি ভাই নিজে বিষয়টির সমাধানে নামেন এবং একদিন আব্বা ও গ্রামের নেতাদেরকে নিয়ে সিলেট সার্কিট হাউসে  আলাপ আলোচনা করে মসজিদ পরিচালনার একটি সুন্দর সংবিধান তৈরি করে বিষয়টির সমাধান করেন।

অতি বিচক্ষ ও দুরদর্শী ব্যাক্তিত্ব ই এ চৌধুরী বিষয়টির দ্রুত একটি চিরস্থায়ী সমাধান করে ফেলেন। আব্বা বাড়িতে গিয়ে বললেন, আমার ভাগনা এমাদ কি আর এমনি এমনি দুইবার  পিএসসি পরীক্ষায় পাস করেছিলকিছুদিনের মধ্যে মোতাওয়াল্লি আমার আব্বা সফিকুর রহমান চৌধুরী বর্তমান আধুনিক মসজিদের নির্মাকাজ শুরু করেন এবং মসজিদটি কয়েক বৎসরের মধ্যে বর্তমানে বিদ্যমান এই স্থাপত্যশৈলীতে পরিত হয়। আব্বার ডাকে সাড়া দিয়ে সর্বজনাব শফি চৌধুরী, মনির আহমদ, সৈয়দ আব্দুল মতিন,  ই এ চৌধুরী ও নাসির চৌধুরী এই মসজিদের নির্মা কাজে লক্ষ লক্ষ টাকা নিজেরা দান করেনএমন কি তারা বিভিন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও প্রতিষ্ঠান হতেও বড় বড় অঙ্কের অর্থ সংগ্রহ করে দেন। গ্রামবাসী সর্বসাধার নিজ নিজ সামর্থানুসারে নির্মাকাজে অংশগ্রহ করেন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন