শনিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

বিদ্যালয় জীবনের সমান্তরাল আরেক গ্রাম্য গৃহজীবনঃ

 

বিদ্যালয় জীবনের সমান্তরাল আরেক গ্রাম্য গৃহজীবনঃ

আমার পাঠশালা ও হাইস্কুল জীবনের পাশাপাশি বয়ে যায় দাউদপুর গ্রামের এক সমান্তরাল গ্রাম্যজীবন। এখানে জীবন ছিল কৃষিনির্ভর, কৃষির বাহিরে কিছু মানুষ বাঁশবেতের কুটির শিল্পে ও ছোট ছোট হাটুরে ব্যবসায় জড়িত ছিল। এত সচ্ছলতা না থাকলেও মানুষ ছিল সুখী, কার মানুষের চাহিদা ছিল অল্প ও জীবন ছিল সহজ সরল। মানুষ সবকিছু থেকে আনন্দ খোঁজে বের করে নিত। বর্ষায় উত্তরের হাওর অথৈজলে একাকার হয়ে যেত কিন্তু শীতে টলাখাল, নিম্নাঞ্চল ও মেহদিবিল ছাড়া বাকি হাওর শুকিয়ে যেত। এখানে ঘরে ঘরে গরুপোষা জীবনের অংশ ছিল। বর্ষায় মানুষ ঘাসিয়ারা নৌকা নিয়ে গরুর জন্য জলাঘাস সংগ্রহ করত ও শুষ্ক মৌসুমে অসংখ্য গরুর পাল নিয়ে হাওরের একপ্রান্ত হতে অন্যপ্রান্তে চরে বেড়াত ও গোধুলীবেলায় গাঁয়ে ফিরে যেত। আমাদের গরু জৈন্তায় পাঠান হত। সেখানে প্রচুর ঘাস খেয়ে গরুগুলো মোঠাতাজা হয়ে ফিরত।

তছব্বির আলী ও ইসকন্দর আলী গৃহকর্মী থাকাকালে তারা মাঝে মাঝে নৌকায় করে আমাদেরে বর্ষার ভাসানজলে বিলে নিয়ে যেত। আমাদের স্ববংশীয় কুনার চৌধুরীবাড়ির নৌকাঘাট হতে নৌকাচড়ায় যাত্রা ছিল বেশ আনন্দভ্রম কখন আগাভাসা ধানের মাঝ দিয়ে, কখনও টলাখাল দিয়ে, কখনো পদ্ম শাপলা ভেটফুলের বুকচিরে নৌকা বয়ে যেত। আমরা শাপলা ও নানা জলজফুল কুঁড়িয়ে ঘরে নিয়ে আসতাম। তসব্বির আলী বিল হতে শালুকফল ও জলফল কূড়াত, আমরা নৌকায় বসে চিবিয়ে চিবিয়ে খেতাম। বর্ষার মেঘলাদিনে মৃদুমন্দ বাতাসে নৌকাচড়ার সময় দিগন্তহীন জলে শিরতুলে দাড়ান অজস্র সাদা ও লাল বর্ণের জলজ কুসুমরাজির তলায় ভাসমান শাপলাপাতায় বৃষ্টির রুপালি জল জমত। 

আমাদের গাঁয়ের উত্তরে হাওরের মাঝে এক উচু মাটির ডিবিতে আকাশে শিরতুলে যেন একধ্যানে নামাজে দাড়ান ছিল এক তালগাছ। সারাটা হাওর ডুবে জল উথাল পাথাল করলেও ঐ তালগাছের ডিবি ডুবত না। গাঁয়ের লোকেরা এই তালগাছটাকে নিশানা করে নৌকা চালাত। এই পুরানো তালগাছের বয়স কত কেউ জানেনা, তবে আব্বা বলতেন তার শৈশবেও গাছটিকে এমনই দেখেছেন। অতল জলে  দু একটা বক একহাঁটু পানিতে দাঁড়িয়ে থাকত। লোকে বলত “নানি গো নানি, গাঙ্গে কত পানি? হাতি ঘোড়ার ঠাঁয় নাই, বগলার হাঁটুপানি”কোমরজলে ধানগুচ্ছের আড়ালে কুড়াপাখি একটানা ডাউক ডাউক সুর তুলে গান গাইত, যেন জলে বৈঠার তীব্র আঘাতের কলধ্বনী। এই নৌবিহারে অংশ নিতেন ভাই তাহমিদ, খালাত ভাই তারেক, বোন মান্না, ভাতিজা বদরু ও আমি।

বর্ষা মৌসুমে রণকেলি, ফুলবাড়ি ও ফাজিলপুর ইত্যাদি গ্রামের আত্মীয়রা বাড়ি এলে তাদেরে নৌকায় করে উত্তরহাওরের দেড়মাইল ভাসান জলের ঢেউ ভেঙ্গে রফিপুর ও শ্রীরামপুরের সীমারেখা উলাকি খাল দিয়ে সিলেট-গোলাপগজ্ঞ সড়কের উলাকির পুলে পৌঁছে দিতাম। উলাকিসেতু হতে গোলাপগজ্ঞ মাত্র চার মাইল। এই নৌভ্রমণ ছিল ভারি আনন্দের, যদিও স্বজন ফেলে আসার বিরহ ছিল। এই নৌপথ তাদের গন্তব্যের দূরত্ব প্রায় বার/তের মাইল কমিয়ে দিত। আসলে গোলাপগজ্ঞ শহর দাউদপুর হতে মাত্র ছয় মাইল দূরে অথচ চৌধুরীবাজার-রফিপুর মাইল দেড়েকের একটা ছোট্ট সংযোগ সড়ক না থাকায় দিল্লি হিনজু দূরকাওয়াস্ত। এই দূরত্ব সিলেট ছুঁয়ে হয়ে যায় প্রায় উনিশ মাইল।  

পশ্চিমের বাস ও রেলসড়কের কাছে বর্ষার ভাসান জলে নৌকাবাইচ হত। ছোট ছোট নৌকাচড়ে আমরা লোলাবিল এবং মেহদিবিলের নৌকা বাইচ উপভোগ করতাম। এই হাওরপারের নৈখাই, পালপুর, শ্রীরামপুর, রফিপুর, পানিগাঁও, গঙ্গাজল, জলকরকান্দি, উলালমহল, দাউদপুর, রায়বান, শিববাড়ি, দড়া, মদনগৌরি ইত্যাদি বিভিন্ন গ্রামের ময়ুরপঙ্কী সাজানো রঙিন লম্বালম্বা খেইড়নৌকা এসব প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহ করত। কেশরখালী নদী হয়ে নেগাল, মোগলাবাজার, হাজীগঞ্জ ও দক্ষিণের হাকালুকি হাওরপারের জনপদ হতেও অনেক ময়ূরপঙ্কি নাও মহিলুকা সেতু দিয়ে এসে যোগ দিত। সঙ্গীতের তালে তালে ঐক্যতান তৈরি করে খেইড় নৌকাগুলো এগিয়ে যেত। 

এইসব নৌকা দৌড়ে মারামারিও হত। আমাদের মাঝপাড়ার আকমল আলীর যুবক ভাতিজা এধরনের নৌকাবাইচের এক লগিবৈঠার মারামারিতে পড়ে মেরুদন্ড ভেঙ্গে বেশ কষ্টকরে আবশেষে মারা যান। নৌকাবাইচ উপভোগে এই হাওরপারের বিভিন্ন গ্রামের লোকজন ছোট ছোট নৌকা ভরা মানুষ নিয়ে বিশাল জলাভূমিতে ভাসমান লোকারণ্য তৈরি করত। তবে এই নৌকাবাইচ দেখার চেয়ে আসা যাওয়ার পথের আনন্দ ছিল আর বেশি। 

কুনার চৌধুরীবাড়ির নৌঘাট হতে পচিশ ত্রিশটি নৌকা বুজাই হয়ে আমার গ্রামবাসীরা নৌকার মিছিল রচনা করে নেচে গেয়ে বন্যার ভাসান জলে বৈঠামারার তালেতালে প্রায় দুইতিন মাইল পশ্চিমে পারাইরচকের ঝিলে কিংবা লোলাবিলে পৌঁছে যেতেন। সময় কিভাবে যে হারিয়ে যেত টেরই পাওয়া যেত না। হৈ হিল্লোড়ে পড়ে দুচারটা নৌকা ডুবে যেত, লোকজন সাঁতরে তালগাছের উঁচু ডিবি কিংবা হিজল, তমাল, করসের গুচ্ছমূলে পৌঁছাত। ফুর্তিবাজ মানুষেরা কোমরে গামছা বেঁধে জলে সিক্ত হয়ে হৈহল্লা করে রাতে ঘরে ফিরত।

এসব মধুরস্মৃতি মনে হলে বাউল আব্দুল করিমের একটি গানের কলি হৃদয়ে উঁকি মারে, আগে আমরা কি সুন্দর দিন কাটাইতাম

এই হাওরের এক এক প্রান্তের এক একটি নাম লোকমুখে প্রচলিত ছিল। পূর্বদিকে ধুপাকোনা ও দড়ারবন্দ, উত্তরদিকে বাদালউরা, বছনোমুখ, গোপাটমুখ পশ্চিমদিকে লোলা, মেদ্দি, মালিকান্দি ও ভেড়ি। ভেড়িতে আমাদের বাড়ির চল্লিশ-পঞ্চাশ বিঘা জমি আছে। ভেড়ি ও কান্দি নিম্নভূমি, এখানে বুরো ধান হয়। বর্ষায় ভেড়ির উপর নৌকা নিয়ে এলেই দেখা যেত প্রচুর শাপলা কুমুদ শালুক ফুল ফুটে আছে। 

মালিবাড়ির কান্দি ও ইয়াইছনো বাড়ি হাওরের মাঝে কোনকালে নিশ্চিত জনপদ ছিল। মন্দির, পুকুর, ঘাট ও ভিটার চিহ্ন সবই আছে, কিন্তু জনমানুষ নেই। কেউ বলতে পারেনা এইসব জায়গায় কবে কোনকালে লোকজন বসবাস করত এবং কেনইবা তাঁরা হারিয়ে গেল। ইয়াছনো বাড়ির সমতলে আমরা ফুটবল খেলতাম। মালিবাড়ির কান্দির বিশাল এলাকা ছিল গোচারণভূমি। 

এই সুন্দর হাওরপারে আয়তন ও জনসংখ্যায় সবচেয়ে বড় গ্রাম দাউদপুর (রেঙ্গা)। তাই বারবার উত্তরহাওর না বলে এই হাওরের নাম দিলাম দাউদপুর হাওর। বিশাল বিস্তৃত দাউদপুর হাওরের জলরাশি পশ্চিমে সমান্তরালে বহা সিলেট-ঢাকা রেললাইন ও সিলেট-ফেন্সুগঞ্জ মহাসড়কের এসে বিরিতি নেয়। মহিলুকা সেতু এই হাওর হতে বের হয়ে কেশরখালি নদী ও রেলপথের পূবহাওরে যাবার  রাস্তা রচে দেয়। মহিলুকার কাছে শাপলা শালুক ও জলপদ্মের পশরা মেলে পরিযায়ী পাখিদের বিচরণে কোলাহলমুখ নববধূ সেজে বসে আছে নামারনৈখাই এবং জলকরকান্দির নৈসর্গিক জলাভূমি। পারাইরচকেও ছিল জলাফুলের মেলা। এই কয়েক বছর আগেও শখের বসে কোন এক বর্ষার মেঘলা দিনে পারাইরচক হতে এই হাওরের ঢেউয়ের তালে তালে নৌকায় সপরিবারে দাউদপুরের বাড়ি যাই।  

দাউদপুর হাওরের প্রধান ছোটনদীর নাম টলাখাল। সিলেটে অনেক প্রজাতির বনবিড়াল আছে। প্রতি প্রজাতি বনবিড়ালের আলাদা আলাদা আঞ্চলিক নাম আছে, যেমন টলা, বাড়ল, খাটাশ, বাউয়াটলা ইত্যাদি। এই বড়খালের নাম কেন যে বনবিড়াল টলার নামে হল জানিনা কিন্তু সারাটা হাওরজুড়ে শিরা উপশিরার মত অনেকগুলো জলভরা খাল নালা এই টলাখালকে জড়িয়ে আছে। এসব ভরাখালের নানাপ্রান্তে ডিঙ্গির ছইয়ের ছায়ায় বসা জেলেদের করাজালের হাতছানি। টলাখাল হাওরের পূর্বদিকে দড়ার মাখই সেতু দিয়ে ঢুকে হাওরের জনহীন প্রান্তর পার হয়ে পশ্চিমের মহিলুকা সেতু দিয়ে খালোমুখে কেশরখালি নদীতে পড়েছে। টলাখালের আরেক শাখানদী উলাকিখাল উত্তরদিকে রফিপুর ও শ্রীরামপুরের সীমানা দিয়ে সিলেট-গোলাপগঞ্জ সড়কের উলাকি সেতু হয়ে সুরমায় পড়েছে টলাখালের পারে পারে বুরোক্ষেত। মাছধরার কুড় ও মৎস্যভরা জলা। শীতে জলসেচে ধরা হয় কাড়ি কাড়ি মাছ। টলাখালের জলে বাল্যকৌশরে কত যে ঘাসিয়ারা নাও চড়েছি, সেই মধুস্মৃতি কোনদিন ভূলিবার নয়।          

আজ এই লোলাবিল ও মেহদিবিলের বুকের উপর দিয়ে চলে গেছে শ্রীরামপুর-লালমাটিয়া বাইপাস সড়ক। হাওরের দক্ষিণসীমা বরাবর নির্মাণ করা হয়েছে দাউদপুর-দাউদাবাদ(উপজেলা অফিস) পাকা সড়ক। গড়ে উঠেছে সোনারগাঁও, রয়েল সিটিসহ অসংখ্য আবাসিক এলাকা, ময়লার বাগাড়, দক্ষিণসুরমা উপজেলা কমপ্লেক্স, উপজেলা হাসপাতাল ও সিলেট ট্রাকস্ট্যান্ড। দ্রুত নগরায়ন এই সুন্দর বিল ও হাওরের প্রাকৃতিক ইকোপদ্ধতি আমার এই ক্ষুদ্র জীবনকালের মধ্যেই গুড়িয়ে দিয়েছে। আজ মানুষের জীবন বদলে গেছে, খাল খনন হয়েছে, সুরমার দুইপারে বাঁধ নির্মাণ হয়েছে, রাস্তা বন্যারেখার উপরে উচ্চতা পেয়েছে, তাই আগের সেই ভাসান বন্যা নেই। কলের লাঙলের আগমনে নেই গরু ও গোশালা। নতুন নতুন পেশার ভিড়ে নেই সেই কৃষিনির্ভর হাওরকেন্দ্রিক গ্রাম্যজীবন। মানুষ গরুর পিছনে এত শ্রম দিত যে, নিজ সন্থানদের জন্যও এত শ্রম দিত কিনা সন্দেহ। তাই এযুগে আগের মত নেই ঘাসিয়ারা নৌকার ছড়াছড়ি। হয়ত এমন একদিন আসবে, যখন আমার এই সত্য হাওর কাহিনি সেকালের লোকজনের কাছে আষাড়ে গল্পই মনে হবে।

দাউদপুরের বাড়িতে জানালায় পাশে চেয়ার টেবিলে বসে সকাল বিকাল দুবেলা পড়তাম। মনে মনে পড়লে মা মনে করতেন পড়ছিনা। তাই শব্দ করে কিছু উচ্চার করে পড়তে হত। আমাদের ছোটনদী বহে বাঁকে বাঁকে, বর্ষায় মাঠে তার হাঁটুজল থাকে। অথবা, আলোচ্য অংশটুকু পল্লীকবি জসিম উদ্দিনের কবর কবিতা হতে নেওয়া হয়েছে। এই ধরনের লাইন মাকে খুশি করতে বারেবারে জপে যেতাম। 

আমার আউট বই পড়ার তীব্র নেশা ছিল। আম্মা পাহারা দিতেন পাঠ্য বইয়ের নিচে আউট বই রেখে গোপনে পরছি কিনা। শৈশবে মাঝে মাঝে আমি পড়তে বসতাম না। যেদিন পড়তাম না, সেদিন খাবার খেতে যেতাম না। আম্মাকে বলতাম আমি আজ পড়ি নাই, তাই খাব না। ফলে আম্মা আমাকে চোখ রাঙ্গানোর সুযোগ পেতেন না বরং উল্টো মাথায় হাত বুলিয়ে ভাত খাওয়াতেন।  

কাছাকাছি বসে পড়তেন অগ্রজ তাহমিদ চৌধুরী এবং অগ্রজা আনিছা মৌলা বেগম চৌধুরী মান্না। পরীক্ষার সময় এলে ভাই তাহমিদ চৌধুরী সারারাত জেগে পড়তেন। আসলেই তিনি ছিলেন একজন নিরলস মানব। তিনি এখন লন্ডনে ধনেজনে সুপ্রতিষ্ঠিত। বোন মান্নার লেখাপড়া ছিল দ্বায়ছাড়া গোছের, ভাল লাগলে পড়লেন, না লাগলে নেই। তাঁকে কেউ পড়তে চাপাচাপিও করতনা। ভাবখানা এমন, মেয়েরা পড়লে ভাল, না পড়লে নেই। তিনি সদ্যপ্রয়াত, আজ আমাদের মাঝে নেই। খালাতো ভাই তারেক আহমদ চৌধুরীর বাড়ি ভাদেশ্বর পশ্চিমভাগ। তিনি এখানে থেকে অধ্যয়ন করতেন। তাঁর লেখাপড়া ছিল শব্দহীন, তবে তিনি তাঁর ক্লাসে সেকেন্ডবয় ছিলেন। সেই ক্লাসে ফাস্টবয় ছিলেন খালোমুখের আব্দুল হান্নান।

আমরা ভাগ্যবান, আরবি ভাষা ও নামাজ শিখতে মোল্লা মুন্সিকে একটি টাকাও দিতে হয়নি। আমার মা ছিলেন একজন প্রখ্যাত আলেম ও পীরের সুযোগ্য কন্যা। নামাজ পড়া ও কোরান তেলাওত হতে শুরু করে সব ধর্মীয় শিক্ষা তিনি নিজেই আমাদেরকে প্রদান করেন। তার হাতে একে একে কায়দা ছিপারা ও পবিত্র কোরান শরিফ খতম করি। আমদেরকে আরবি ও ধর্মশিক্ষা প্রদানের সব কৃতিত্ব এককভাবে আমার মায়েরই প্রাপ্য। এমন একজন আলেম মাতা পেয়ে আমাদের জীবন ধন্য হল। একবার নজমা আপা আমাদের বাড়িতে আসেন ও মায়ের দারু কর্মতৎপরতা দেখে বললেন, মেঝ ফুফুআম্মা মাস্টারও, মোল্লাও, মুন্সিও, কত্রীও, ঘরের মালিকও, দাসীও, নাপিতও, ধোপাও  

আমাদের শৈশবে ঈদ ছিল খুব আনন্দের। ঈদের আগের রাতে মা ও বোনরা মিলে বেশ কয়েকপদের নাস্তা বানিয়ে রাত করে ঘুমাতেন। আগের দিন সকাল হতেই পিঠা বানান, গুড়ি তৈরি, মসলাবাটা ইত্যাদি কাজ শুরু হত। আমরা খুব ভোরে উঠে সদলবলে সামনের দিঘিতে ঈদের সুন্নাত গোসল করতাম। 

সেকালে মনে করা হত ঈদের দিনে যত ভোরে গোসল করা যায়, সওয়াব ততো বেশী। আমার শৈশবের কোন এক ঈদে বড়চাচি সফিকুন্নেছা চৌধুরী অধিক পুণ্যলাভের আশায় কাজের বুয়াকে নিয়ে ভুলবশতঃ ভোরের আজান হওয়ার আগেই বড়পুকুরে গোসল করতে চলে যান। এত ভোরে গিয়েও দেখেন ক’জন লোক পানিতে নেমে গোসল করছে। চাচির মনে হল এত ভোরে মানুষ গোসলে আসতে পারেনা, এরা নিশ্চয়ই মানুষ নয় জ্বীন। তিনি খুব ভয় পান এবং সভয়ে ঘরে ফিরে এসে সবাইকে বললেন, আমি দেখে এসেছি বড়পুকুরে একদল জ্বীন গোসল করতেছে। আমার মা-চাচিরা সবাই তাঁর কথা একশত পার্সেন্ট বিশ্বাস করলেন। তবে চাচির ভীতিকর অবস্থা দেখে তাঁকে অভয় দিয়ে বললেন, ডরাবার কিছু নেই, এরা জিন্নে মুমিন, জিন্নে মুমিন কারো ক্ষতি করেনা, তাঁরা লোকজন জাগার আগেই ঈদের সুন্নতি গোসল সেরে নিচ্ছে।

ঈদের আগের বিকেলে আমরা শীতের ভোরে গোসল করে আগুন পোহাতে বাংলোর সামনের মাঠে ভেড়াভেড়ির ঘর তৈরি করতাম। ভেড়াভেড়ির ঘর হল বাঁশ কাটে নির্মিত খেলনা ঘর। এই ঘরটায় আমরা খড়পাতা ঘন করে ভরে দিতাম। গোসল করে উঠে এই ঘরে আগুন লাগিয়ে আমরা দারুন ফূর্তি করে শীত নিবার করতাম। বর্তমান কালের চেয়ে আমাদের শৈশববেলায় শীত ছিল অনেক বেশি। শীতে সামনের দিঘিতে নামতেই শরীর কেঁপে উঠত, গোসলের পর দুপাঠি দাঁত ঠান্ডায় জমে কটমট করত। নতুন জামা পরে ঈদের জামাতে যেতেন বাড়ির সবাই একসাথে দলবেঁধে। আব্বা বাড়ির মুরব্বী, তিনি আগে, পিছু পিছু বাকি সবাই। সালাম ও কুলাকুলি শুরু হত দাউদপুর ঈদগাহে, বাড়ি এসে মা-চাচিদেরে সালাম করে নাস্তা খেয়ে কুলাকুলি শেষ হত। 

একবার দাউদপুর ঈদের জামাতে আচমকা বৃষ্টি শুরু হয়। সবাই আনচান করছেন কবে নামাজ শেষ হবে কিন্তু মরার উপর খরার ঘার মত ঈমাম সাহেব সেদিন নামাজে ভূল করে বসলেন, শেষ রুকুতে চার তকবির না দিয়েই সোজা রুকুতে চলে যান। মুসল্লিরা লোকমা দিলেও বুড়ো ঈমাম সাহেব বুঝতে না পেরে চলে যান সেজদায়। নামাজের শেষ সালাম ফেরাতেই ঈদগাহে ভীষণ হট্টগোল, নামাজ পড়ানো সঠিক হয়নি। প্রবল বর্ষণের মধ্যে আবার নতুনভাবে পড়ানো হয় ঈদের নামাজ। সেদিন মানুষ বৃষ্টিতে গোসল করে ঈদগাহ হতে বাড়ি ফিরে। তবে মুরব্বীরা বললেন বৃষ্টি আল্লাহ পাকের রহমত, তাই এই ঈদ রহমতি ঈদ। 

ঈদের দিন চৌধুরীবাজারের আনাচে কানাচে ক্যারম, মার্বেল ও তাস খেলার ধুম লেগে যেত। বিকেলে হত কাবাডি ও ফুটবল প্রীতি ম্যাচ। গ্রামের পরিচিতরা এসে এসে চানাস্তা করে যেতেন সারাদিন। আনন্দে আনন্দে নিশীতে হারিয়ে যেত ঈদের সেই দিন।         

বাল্যকালে আমার দুটি শক্তি ছিল, যা অন্য লোকের মাঝে ছিলনা। একটি হল সূর্যের দিকে অপলক নেত্রে তাকানর এক আশ্চর্য্য ক্ষমতা। একটু তাকানর পর চোখ সয়ে যেত। মেঘের সাথে সূর্যের লোকচুরি খেলা খালি চোখে চেয়ে দেখা আমাকে খুব আনন্দ দিত। আজ এতকাল পর মনে হয় আমার তীব্র জ্ঞানপিয়াসী মন আমাকে চাঁদ ও সুর্যের দিকে এভাবে বেপরওয়া তাকাতে উৎসাহ দিত। জেনে গিয়ে একদিন সবাই বাঁধা দেন, বলেন এভাবে সুর্যের পানে তাকালে দুচোখ নষ্ট হয়ে যাবে। আমারও সুর্য দেখার শখে ভাটা পড়ে কিন্তু চোখের কোন ক্ষতি হয়নি, আজ বায়ান্ন বছর বয়সেও আল্লাহর অপার মেহেরবানিতে চোখে চশমা পরতে হয়নি। দ্বিতীয় শক্তিটি ছিল জিহ্বা দিয়ে বন্দুকের গুলীর শব্দের মত সুতীব্র আওয়াজ তৈরি করার ক্ষমতা। এই শব্দ বর্ষ করামাত্র কক্ষ ক্ষেপে উঠত। বালকেরা এই শব্দ শুনতে আমার আশপাশে ভীড় জমাত, এমনকি পাঠশালার কাঞ্চন স্যারও এই শব্দ উপভোগ করতেন।

মনে পড়ে একদিন বাদশা বাড়ির ভিতর দিয়ে পাঠশালা হতে বাড়ি ফিরছি। হঠাৎ সামনে একটি লাল টকটকে আম পড়ল। আমটি কুড়িয়ে নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। মা আমটি দেখে বললেন কোথায় পেয়েছ, আমি কোথায় পেয়েছি বলতেই মা বললেন এই আম খাওয়া যাবেনা। এভাবে আন্যের মাল তার অনুমতি ছাড়া খাওয়া সিদ্ধ নয়। আমটি আমাদের ঘরে পচলো কিন্তু কেউ আর স্পর্শ করলেন না।

আমাদের বাড়ির উত্তরদিকের একজন কালো চিকন লোক উস্তার আলী, তিনি পান বেপারী। বাজারে বাজারে পান সুপারি বিক্রি করে সচ্ছল জীবন কাটান। একদিন দুপুরে বাড়ির বড়পুকুরে আমি, মান্না, বদরু ও আমাদের কাজের মেয়ে শমি পানি ছুড়াছুড়ি করে লাইখেলা খেলছি। এমন সময় পানেরবুজা পারে রেখে বাশের কুকড়ানো বাং হাতে নিয়ে হাঁটুজলে নামেন উস্তার আলী। বোন মান্না কালো লোক দেখলে ভীষ ভয় পেতেন। আলকাতরা কালো লিকলিকে উস্তার আলীকে তিনি ছেলেধরা মনে করে মাঝপুকুরে সাঁতরে পালান, আমিও তাকে অনুসর করি। বদরু ও শমি সাঁতারে তেমন দক্ষ নয়, তারা বেরাঘাটে পালিয়ে কান্না জুড়ে দেয়। বদরু হাতজো করে তাকে ধরে না নেওয়ার জন্য মিনতি জানায়, কিন্তু খোঁজকর নাছুড়বান্দা সে ধরে নেবেই। এমন সময় আব্বা এসে পড়েন, তিনি আমাদেরকে ভীমকালো কল্লা কাটরার কবল থেকে উদ্ধার করে বাড়ি নিয়ে যান। তারপর উস্তার আলীকে দেখলেই আমরা ভয় পেয়ে দৌড়ে অন্দরমহলে পালাতাম। আমরা বাড়িতে বেশি দুষ্টামী করলে বড়রা কল্লাকাটরা উস্তার আলীর ভয় দেখাতেন। বেশ বড় হয়ে আব্বার কাছে জানলাম উস্তার আলীর বাবাও নাকি আমার ফুফু ও চাচাদেরকে তাদের শৈশবে এভাবে কল্লাকাটরা সেজে ভয় দেখাতেন, এযেন দুপ্রজন্মে একই ঘটনার দুসরাবর্ত

সাঁতার শিখার পর যখন তখন সামনের দিঘিতে ঝাঁপ দেওয়া ও গরমের দিনে অনবরত সাঁতার কাটা আমার অভ্যাসে পরিত হয়। চোখ দুটি ভোমরার মত লাল হয়ে ব্যাথা করলে উঠে আসতাম। মাঝে মাঝে চাচাদের ঝাড়ি খেয়ে অর্ধনগ্ন হয়ে উঠে বাড়ির দিকে পালাতাম। সারাদিন পানিতে ডুবে থাকায় একদিন বামকানে ইনফেকশন হয়। কোন চিকিৎসায়ই এই ইনফেকশন কমেনি বরং আমাকে ১৯৯৫ সালে চিকিৎসক রমণী বিয়ের আগ পর্যন্ত ভীষ যন্ত্রণা দেয়। তাঁর চিকিৎসা ও সেবাশুশ্রূষা আমাকে এই বিরক্তিকর কর্ণরোগ হতে চিরমুক্ত করে। এই পানিপড়া রোগে বিগত দিনে বামকানের শ্রবশক্তি অনেকটা কমে যায়, ফলে আমি স্বাভাবিক স্মার্টনেস হারাই ও লোকজন আমাকে একটু অচৌকশ মানুষ ভাবতে থাকে। ফ্যানের বাতাসে কিংবা শব্দের ভিতরে থাকলে অন্যের কথাবার্তা বুঝা কঠিন হত, তাই ধীরে ধীরে কথা বলা কমিয়ে দিয়ে মনযোগী শ্রোতা হয়ে যাই। বাচাল থেকে আমি স্বল্পভাষী মানুষে পরিত হই। কানের জন্য আমার দ্বিমুখী মৌখিক যোগাযোগে জড়তা তৈরি হলেও আমি খুব ভাল বক্তৃতা দিতে পারতাম। বক্তৃতা অবশ্য একমুখী যোগাযোগ। আমার সুন্দর বক্তৃতা শুনে লোকে বলত চৌধুরী সাহেব যে তেজস্বী ভাষ দেন, মনে হয় আপনি রাজনীতিতে এলে খুব ভাল করতে পারবেন। আমি বামকানের পানিপড়া ও কমশুনা নিয়ে প্রায় বিশ বছর এক অমানুষিক মর্মজ্বালা ও হীনমন্যতায় দগ্ধ হই। প্রাত্যহিক ও চাকুরি জীবনে এই সমস্যা আমার কর্মকান্ডে বেশ বিরূপ প্রভাব ফেলে, যাহা কাউকে বলা যায়না, আবার সহাও যায়না। চিকিৎসক পত্নী নুরজাহান বেগম চৌধুরীর সৌজন্যে এই বিশ্রী আপদ হতে মুক্ত হয়ে আমি একটি সুখ ও শান্তিময় জীবনের সাধ পাই। আল্লাহ তাঁর মঙ্গল করুন। আমিন।    

শৈশবে চৌধুরীদের প্রতাপ দেখেছি কিন্তু ক্রমে ক্রমে তাহা কমে আসে। দাউদপুর ছয়পাড়ার এক বৃহৎ পঞ্চায়েত ছিল, লোকে বলত ছয়কুফা পঞ্চায়েত। কোন পাড়ায় বিবাদ হলে ঐ পাড়ার মুরব্বিরা বসে মিমাংসা করতেন, কিন্ত জটিলতা দেখা দিলে ছয়পাড়ার মুরব্বিরা জমায়েত হয়ে সমাধান করে দিতেন। পাড়া বা কুফাগুলো হল হাড়িয়ারচর, গাংপার, কুনারপাড়া, দক্ষিপাড়া, মাঝপাড়া ও পশ্চিমপাড়া। এই ছয়পাড়া মিলে বৃহৎ দাউদপুর হল রেঙ্গা পরগনার সবচেয়ে বড় গ্রাম। ধনবান, বাকপটু ও বুদ্ধিমানরা ছিলেন মাতব্বর, তারা বিচার আচার করতেন। 

এসব বিচারে ইউপি মেম্বাররা বেশ প্রভাব খাটাতেন। বাল্যকৌশরে আমার দেখা গ্রামের ছয় কুফার বিচারক নেতারা ছিলেন কুনারপাড়ার জরাফত আলী মেম্বার, মোজম্মিল আলী, আম্বর আলী, দক্ষিণপাড়ার মনির আলী মেম্বার, ইসন আলী ঠিকাদার, আত্তর আলী, মাঝপাড়ার তুতা ভাই, আফতার আলী, গাংপারে মর্তুজ আলী আছন মেম্বার, ইন্তাজ আলী মেম্বার, হাড়িয়াচরে ভাষানি মুরব্বী, হারিছ আলী মেম্বার, মাসুক মিয়া এবং পশ্চিমপাড়ার লটই মেম্বার ও ডক্টর কে এম দাসের পরিবার। ছয় কুফার নেতারা ব্যর্থ হলে হাসিবুর রাজা চৌধুরী চাচা, আবুল হাসান চৌধুরী চাচা, আব্বা সফিকুর রহমান চৌধুরী ও কালুচাচা খলিলুর রহমান চৌধুরীর ডাক পড়ত। এখানেও নিস্পত্তি না হলে বিবাদ ইউনিয়ন পরিষদে চলে যেত। খুব কম বিবাদই ছিল যা আইন আদালত ও থানা পুলিশ পর্যন্ত গড়াত। দাউদপুর ছয়পাড়ার নেতারা ও আমার বাপচাচারা বিচারে বসলে কখনো কোন পক্ষপাতিত্ব করতেন না, সব পক্ষের কথা শুনে ন্যায়বিচারই করতেন। তাই গ্রামে সর্বদা শান্তি বিরাজ করত। 

ফতোয়া দিয়ে অল্প শিক্ষিত জনকয়েক মোল্লাও বিচারে অবদান রাখতেন। পাশের বাড়ির হতদরিদ্র এম আলী বউকে তিন তালাক বলে বিপদে পড়ে, পাশের কিছুলোক শুনে ফেলে ঝামেলা পাকায়। মতব্বররা এবিষয়ে সভায় বসেন। মাতব্বরদের চাপে পড়ে শরিয়া আইন পালনে এম আলী বঊকে তুড়ুকখলার এক বূড়োর কাছে হিল্লা বিয়ে দিতে বাধ্য হন। বুড়ো লোকটি এম আলীর রূপসী বউকে ছাড়তে নারাজ। বুড়োর কাছ থেকে সুন্দরী বউকে উদ্ধার করতে গিয়ে এম আলী দীর্ঘদিন দৌড়াদৌড়ি করে খুব নাস্তানাবুদ হন। 

পূর্বপাড়ার এক বুড়োলন্ডনি মে উল্লাহ বিয়ে করে যুবতী বউকে জোয়ান পুত্র ছ আলীর কাছে রেখে যান। বছর দেড়েক পর যুবতী গর্ভবতী হন। এখানে আসামি ধনবান প্রভাবশালী, তাই মেয়েটিকে বাপের বাড়ি পাঠিয়েই খেইড় খতম। গ্রামে বউ পেঠানো ছিল নৈমিত্তিক ঘটনা, বড়পুকুরের ডানের বাড়ির মুরব্বী রান আলী বুড়ো বয়সে বউ পেঠাতেন। সকালে ঘুম হতে উঠে ঔ দিকে চেচামাচি শুনা যেত।

একদিন আমি একটি ঘটনার প্রতিবাদ করলে সবাই আমাকে বুঝান, চৌধুরী সাহেব, সে তার বউকে মারছে, তাতে আপনার কি আসে যায়, এতে আপনি কেন নাক গলাতে গিয়ে পরের ফ্যাসাদ নিজের কাঁধে আনবেন? বউ পেঠানোর ঘটনায় সাধারত বাইরের কেঊ সহজে নাক গলাতনা। মনে করা হত একটু আধটু বউ পেঠানো যেন পুরুষ জাতির মৌলিক অধিকার, ধর্মেও বউকে শাসন করতে কোন মানা নেই। ধর্ম মনে করে নারীজাতি পুরূষজাতির অধীনে জীবনযাপন করবে। তবে সন্তানরা বড় হয়ে গেলে পুরূষজাতি বিপদ হত, সাবালক সন্তানরা সর্বদা মায়ের পক্ষে দাড়াত এবং তাঁদের সমর্থনে বলবতী হয়ে এই অবলারা স্বামীদের নির্যাতন হতে রক্ষা পেত।

বউয়ের গর্ভে বাচ্চা না হলে দ্বিতীয় বিয়ে ঠেকায় কে? সব দুষ, নন্দ ঘোষ, এই বউ নামক মহিলার। কেউ বলে বাঞ্জি, কেউ বলে গোরমা, কেউবা বলেন বন্ধ্যা, কত নামে যে তাঁকে ডাকা হত। বছরের পর বছর বসবাস করেও শ্বশুরবাড়িতে তিনি একজন চরম অবাঞ্চিত মানবী। একজন মহিলার বিয়ের অনেক বছর পার হল কিন্তু বাচ্চা হলনা। নিরুপায় এই নারী বাধ্য হয়ে নিজ স্বামীকে দ্বিতীয় বিয়ে দেন। সৌভাগ্য স্বামীবাড়ি হতে তিনি বিতাড়িত হননি। স্বামীকে বিয়ে দেওয়ার কিছুদিন পর অলৌকিকভাবে তাঁর নিজের গর্ভ সঞ্চার হয়। যথাসময়ে একটি ফুটফুটে পুত্র সন্তান হয়। রাতে সন্তান কাঁদলে তিনি চিৎকার করে বলতেন, আইলি রে বাপ, তুই আইলি, শেষমেশ আমার বুকে পুকুর খুড়ে তুই আইলি। তবে এর ব্যতিক্রমও ছিল। আমাদের পাশের বাড়ির শফাত আলী ছিলেন নিঃসন্তান। তিনি সন্তান লাভের আশায় দুসরা বিবি আনতে যাননি। 

একদিন মাঝপাড়ার হাতুড়ে ডাক্তার আকমল আলী ভাই বললেন, চৌধুরী সাহেব, আপনারা মহিলাদের কথায় উঠাবসা করেন, আমরা কিন্তু বেটিমানুষের কথায় চলিনা তাঁর কথা শুনে আমি খানিক চিন্তা করে দেখলাম, সত্যই তো চৌধুরীরা আসলেই পত্নীদের সাথে পরামর্শ ছাড়া কিছুই করেন না, আর গ্রামবাসীরা মনে করত নারীদের কোন বুদ্ধিসুদ্ধি নেই তাছাড়া কোন বিষয়ে নারীদের সাথে পরামর্শ করাকে তারা অপমানজনক মনে করত। চৌধুরীবাড়িতে নারী স্বাধীনতা ও নারীর সম্মান সত্যই অনেক বেশি ছিল, যা গ্রামবাসী সাধারণ নারীরা পেতনা। তার কার ওখানে আধুনিক শিক্ষা কিংবা সচ্ছলতা, কোনটাই ছিলনা। 

গ্রামে তখন শিক্ষিত বলতে সেকেলে মাদ্রাসা পড়ুয়া দুএকজন আমছিপারা জানা মোল্লা মৌলভীর অবস্থান ছিল মাত্র। গ্রামের নারীদের সৌন্দর্য্য নির্ধার হত গাত্রবর্ণে, এখানে দেহাবয়ব ও চেহারার কোন মুল্য ছিলনা। যে মেয়ের চর্মের রঙ যত ফর্সা সফেদ তাকে ততবেশি সুন্দরী মনে করা হত। আমাদের এককালের গৃহকর্মী পাশের বাড়ির ইস্কন্দর আলী বিয়ে করার পর আশপাশে রাষ্ট্র হতে থাকে ইস্কন্দরের বউ খুব সুন্দরী। একদিন আমার মেঝবোন সেহা বড়পুকুরে গোসলে আসা ইস্কন্দরের বউকে দেখে বলেন, লোকে এত বলাবলি করছে নববধু খুব সুন্দরী, এখন দেখছি প্যাচামুখি মেয়ে, ফুঁদিলে বাতাসে উড়ে যাবে, কেবল গায়ের রঙটা সফেদকিছুদিন পর এই বাড়ির তজমুল আলী বিয়ে করলে মিষ্টি চেহারার নাদুস নুদুস শ্যামলা একজন বউ আসেন কিন্তু এই নববধুর রূপের সুনাম কেউ করলনা, কার মেয়েটি শ্যামলা, তেমন ফর্সা নয়। তাকেও একদিন সামনের পুকুরে দেখে আপা বললেন, লোকে কি যে দেখে, আর কি যে বলে। আমিতো দেখছি তজমুলের বউ ইস্কন্দরের বউয়ের চেয়ে শতগুন সুন্দরী। লোকজনের ঠোঁটের মার খেয়ে পাশে থাকা তজমুল আলী হীনমন্যতায় ভূগছিলেন তাঁর বউ কদাকার। আপার মুখে বউয়ের প্রশংসা শুনে তাঁর মুখে হাসি ফুটে উঠে, সেহা মাইজি গো, একমাত্র তুমি আমার বউকে রূপবতী সনদ দিয়েছ। সেহা মাইজি, তোমার মুখে চন্দন পড়ুক।

হাড়িয়ারচরের জালাল আহমদ আমার ছেলেবেলার বেশ ভক্ত বন্ধু। তাঁর মাংসল গোলমুখে সবসময় হাসির ঝিলিক দেখা যেত। জালাল আহমদ অবয়বে বেশ মোঠাতাজা। গাট্টাগুট্টা জালালকে লোকে দেখলেই বলত, দুস্ত তুমি কোন গোদামের ভাত খাও এমন সুন্দর স্বাস্থ্য বানিয়েছো, তোমার এত সুন্দর সুঠাম সুস্বাস্থ্য দেখলে আমাদের ঈর্ষা হয়। 

আবার আমার পাঠশালা ও হাইস্কুলের সহপাঠি তুড়ুকখলার লিকলিকে মুক্তার আহমদকে লোকে চিকন স্বাস্থ্যের জন্য মনে করত সে রোগা ও স্বাস্থ্যহীন। লোকে মুক্তারকে প্রায়ই বলত, ওবা মুক্তার মিয়া, তোমার মা বড় কঞ্জুস, ভাত খেতে দেন না, তাই স্বাস্থ্যের এই করুন দশা। কিন্তু আমি অনেকবার রেবতী রমন উচ্চবিদ্যালয় হতে ফেরার পথে দেখেছি নেগালের তাজাতাজা সহপাঠি আজিজ আহমদ, বেলাল আহমদ ও সোনাওর আলীরা খেলাচ্ছলে কুস্তি লড়ে মুক্তারের কাছে প্রায়ই কুপোকাত হয়ে যেত। তাহলে আপনারাই রায় দিন সেযুগের মানুষের ধারনা ঠিক না অঠিক ছিল। এবার ভাবুন সেই যুগের মানুষ ফেটিবডি নিয়ে যে ধারনা পোষণ করত তা ছিল বর্তমান যুগের ঠিক বিপরীত। 

গ্রামের কিছু দুষ্টলোক জমির আল কাটত, আইল নিয়ে মারামারি করে একে অন্যের মাথা ফাটাত। পাশের এক বাড়িতে সীমানার একটি বাঁশগাছের মালিকানা নিয়ে চাচা ভাতিজায় কুস্তি লড়তে দেখেছি। বাড়ির সীমানা নিয়ে ঝগড়া করে একভাই অন্যভাইকে “ম্যাগীর পোলা, তুই আমার শালা” ইত্যাদি বিদগুটে গালী দিতেও অনেক শুনেছি

মেরু উল্লাহ লন্ডনি ট্রাক্টক দিয়ে জমি চাষ করতেন এবং ইয়েস, নট, ভেরিগুড, থেঙ্ক ইউ ইত্যাদি ইংলিশ বাক্যে চাষীদের সাথে আলাপ করতেন। সৌদি প্রবাসী মাঝপাড়ার হোসেন আলী টেপ রেকর্ডার জমির আলে রেখে উচ্চশব্দে গান ও ওয়াজ বাজিয়ে শুনেশুনে হালচাষ করতেন। প্রবাসী বাড়িগুলোর তখন রমরমা অবস্থা, প্রায় বাড়িতে তখন পাকাঘর নির্মাণ হয় ও  সামনের পুকুরপারে শোভা পায় সুন্দর সুন্দর পাকা রঙিন ল্যাট্রিন। সদ্যধনী হওয়া প্রবাসীদের কেউ কেউ টাকার গরমে ভুগতেন ও ধরাকে সরা জ্ঞান করতেন। আমার প্রচুর টাকা আছে তা লোকজনকে দেখাতে নব্যধনীরা সদা মুখিয়ে থাকতেন। তবে এর একটা ভাল দিকও ছিলো, তাঁরা প্রতিযোগিতা করে প্রচুর টাকা দান খয়রাত করতেন। গ্রামবাংলার প্রবাসীদের বেকার আশ্রিতরা কেবল লাখ টাকা, আর কোটি টাকার গল্প বলে বেড়াতেন।    

মাঝে মাঝে পাড়ায় পাড়ায় মারামারি হত, মানুষ নিজ পাড়ার লোককে সত্যমিথ্যা পরখ না করেই সমর্থ দিত। এই মারামারি গ্রামে গ্রামেও হত। চৌধুরীবাজারে তুড়ুকখলা ও দাউদপুরের দুইজনের সামান্য কথা কাটাকাটি থেকে বিবাদের সুত্রপাত হয়ে তা প্রায়ই দুইগ্রামের সংঘাতে রূপান্তরিত হত। দুইদিকে দুইগ্রামের লোকজন এসে একটু ঠেলাঠেলি ও কিছু ডিল ছুড়াছড়ি করতেন। লড়াই লাগার আগেই দুইগ্রামের মাতব্বররা যুদ্ধ থামাতে নেমে যেতেন। কখনও লাটিসড়কি নিয়ে মারামারি করতে দেখিনি। আমার মনে হত এই যুদ্ধ যেন যুদ্ধ নয়, দুই গ্রামের লোকজন দুইদিকে জমে আনন্দ করছে। আমিও চৌধুরীবাজারে বসে বেশ মজা করে উপভোগ করতাম আমার জন্মভূমি এই দুই গ্রামের প্রিয় মানুষগুলোর অদ্ভুদ সব লীলাখেলা। দুই গ্রামের নেতারা এসে হৈ চৈ হাল্লাগোল্লা করে লোকজনকে ঠেলে বাড়ি পাঠিয়ে দিতেন। এখানে খেইড় খতম, পরদিন থেকে আবার আগের খাতিরানা। যেই লাউ, সেই কদু।

আমার জন্মভূমির এই দুই গ্রামবাসীর মধ্যে ভালবাসাও ছিল সীমাহীন। চৌধুরীবাজার তাঁদের মিলন কেন্দ্র। একবার তুড়ুকখলা নয়াগাঁওয়ের আবুল মিয়া চেয়ারম্যানের পক্ষে তার ব্যক্তিগত রাস্তা উদ্ধারে মারামারি করতে গিয়ে এই দুই গ্রামের অনেকেই বাড়ুকগ্রামের ধনী সফিক লন্ডনির বন্দুকের ছররা গোলা খেয়ে সিলেট মেডিকেলে ভর্তি হন। শতশত লোক যখন লন্ডনিকে ঘিরে ফেলে তখন আত্মরক্ষার্থে ছিটা বন্দুকের গোলা বর্ষণ করা ছাড়া সফিক লন্ডনির সামনে আর কোন বিকল্প ছিলনা। আহতদের মধ্যে তামাশা দেখতে যাওয়া আমার সহপাঠি তৈহিদুল ইসলাম টিপুও ছিল। 

ভিন গাঁয়ের একজন লোকের ভেজাল জমি উদ্ধারে মাগনা লাটিয়ালী করে গুলি খেয়ে পালিয়ে আসেন আমাদের গ্রামের সুরুজ আলী ও ছিতুল আলীরা। গ্রামে এসে তাঁরা বানিয়ে বানিয়ে তাদের বীরত্বের নানা ভূঁয়া কাহিনি লোকজনকে শুনিয়ে বেশ বাহাদূরী দেখানোর চেষ্টা করেন। পুর্বপাড়ার কালই চৌকিদার ও গাংপারের ইন্তাজ আলী মেম্বার দাউদপুরের লোকজনকে অন্য গ্রামের এই অন্যায় হাঙ্গামায় নিয়ে গিয়ে নিদারু অপদস্ত করেন। 

এবার খেলা দেখি, লন্ডনি টাকার খেলা। টাকার শক্তিই আসল শক্তি, বাড়ুক গ্রামের ধনী শফিক লন্ডনি অসংখ্য মামলায় জড়িয়ে প্রতিপক্ষকে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ে। যে রাস্তার কাজ থামাতে গিয়ে দুই গ্রামের এত লোকজন ছিটাবন্দুকের গোলী খেয়ে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গেল, সেই রাস্তা নির্মাণ কাজ বন্ধ হলনা। রাস্তা হল, ভয়ে বীরেরা কেউ আর বাঁধা দিতে গেলনা।   

সামান্য ঘাসকাটা, মাছধরা, গরুচরানো ইত্যাদি বিষয় নিয়ে হাওরপারের রফিপুর, দাউদপুর, নৈখাই, পানিগাও, শ্রীরামপুর, দড়া ইত্যাদি গ্রামবাসীরা নিজেদের গ্রামের পক্ষনিয়ে মাঝে মাঝে রক্তারক্তি কান্ডে জড়িয়ে পড়ত। মামলা টামলাও হত, তবে ন্যাপনেতা হামিদ মিয়া, কদমতলির মুক্তিযোদ্ধা এডভোকেট রফিক মিয়া, আমার পিতা সফিক চৌধুরী, কুচাই পশ্চিমভাগের দারা মিয়া, এমপি শফি চৌধুরী, রফিপুরের এডভোকেট ইকবাল চৌধুরী, শ্রীরামপুরের রূপবান সিরাজ, খিত্তার মখন মিয়ারা শালিসে বসলে পাহাড়সম সমস্যা জলবৎ তরলং হয়ে যেত। তাঁরা বিচারে বসলে আপনপর সাদাকালা তোয়াক্কা নাকরে সর্বদা ন্যায়বিচার করতেন। মানুষ খুশিমনে তাদের রায় মেনে নিত।  

গ্রামের কিছু রসিক মানুষ বেশ রসালো গল্প বলে লোক হাসিয়ে আনন্দ পেতেন। পাশের বাড়ির নওয়াব আলী মানুষের বায়ুত্যাগ নিয়ে নানা হাসির গল্প বলতেন। তার গল্প শুনে আমাদের হাসতে হাসতে চোখে জল এসে যেত। তাঁর বলা একটি গল্প না বলে পারছিনা। একজন যুবক বিয়ে করে নববধু নিয়ে রাতে বাসর ঘরে প্রবেশ করেন। সে বাসর রাতে কনের পেঠ খারাপ হয়ে যায়। নতুন বধুর পেঠে বায়ু ভীষণ তোলপাড় শুরু করে। একেতো নতুন জায়গা, তদুপরি পাশে নতুন লোক। তাই লজ্জায় তিনি বায়ুত্যাগ করতে না পেরে বহুকষ্টে আটকে রাখেন। ফলে বায়ু জমতে জমতে পেঠ বলের মত ফোলে যায়। আর কাঁহাতক সহ্য করা যায়, কাহাতক এই বাতাস আটকে রাখা যায়। এমন সময় বর নববধুকে বুকে জড়িয়ে ধরেন, বরের চিপানী খেয়ে অমনি ভীষণ তর্জন গর্জন করে নববধুর পেঠের বায়ু বেরিয়ে আসে। সেইসাথে সুর্গন্ধে সারাটা বাসর ঘর ছেয়ে যায়। হতভম্ব কনে লজ্জায় বরের মনযোগ অন্যদিকে ফেরাতে বুদ্ধি এঁটে বললেন, আমি একদম ভূলে গেছি, বলুন তো আপনারা ভাইবোন কয়জন? রসিক বর সাথে সাথে জবাব দেন, শুনগো সোনাধন, তোমার এই দুনিয়া কাঁপানো বোমা বিস্ফোরণে আমি যদি মারা না যাই তবে তিনজন। আর যদি মারা যাই তাহলে মাত্র দুইজন।

এখন আমি শৈশবে আমার গ্রামবাসীর ধর্মজীবন নিয়ে আলোচনা করব। আদিকালে এই গ্রামের চৌধুরীগণ ছিলেন বদরপুরী পীরের মুর্শিদ, যাহা পরে ফুলতলী পীর সাহেবের ছিলছিলায় রূপ নেয়। চৌধুরীগনের সুবাদে গ্রামবাসীরাও এই পীরের দলভূক্ত হন। আমাদের জমিতে প্রতিষ্ঠিত দাউদপুর মাদ্রাসায় প্রতি বৎসর পৌষের সূচনালগ্নে শীতের সুদীর্ঘ দিনরাতব্যাপী ইসলামি জলসা হত। সকালে সুচনা হওয়া মাহফিল সারাদিন সারারাত পেরিয়ে ফজরের জামাতের পর সিন্নী বিতর করে সমাপ্ত হত। আমাদের বাঁশঝা হতে বাঁশ আসত ও দাউদপুর ঈদগাহে প্যান্ডেল তৈরী করে মঞ্চ বসান হত। 

এই মঞ্চে সভাপতি হিসাবে চৌধুরীবংশের কেঊ না কেউ সব সময় বসতেন। মাঝের বাড়ির হাসিব চাচা, পশ্চিমবাড়ির মোতাহির চাচা, আবুল চাচা, কুনারবাড়ির তাহির চাচা, আমাদের বাড়ির আব্বা সফিক চৌধুরী, বড়চাচা তৈয়বুর রহমান, কালিমাটির চাচা মখলিসুর রহমানরা বসতেন। মঞ্চে মাদ্রাসার হেড মাওলানা ইসহাক আহমদ ও ওয়াজিরা বসতেন। 

বারবার শ্লোগান উঠত, নারায়ে তকবির, আল্লাহু আকবর। সিলসিলায়ে ফুলতলী জিন্দাবাদ, সিলসিলায়ে বদরপুরী জিন্দাবাদ, সিলসিলায়ে জৈনপুরী জিন্দাবাদ, হুজুর কিবলায়ে ফুলতলী জিন্দাবাদ এখানে ওয়াজের ফাঁকে ফাঁকে আল্লাহ ও রাসুলের গুণগানের সাথে ফুলতলী পীরসাহেবের শানে সমগতিতে গাওয়া হত প্রচুর গজল, হামদ ও নাত। ওয়াজের মাইকের শব্দ আমাদের বাড়ি হতে স্পষ্ট শুনা যেত। একদিন অনবরত আব্দুল লতিফ চৌধুরী ফুলতলীর শানে গজল শুনে শুনে বিরক্ত হয়ে আমাদের বাড়িতে আসা একজন মেহমান উপশহরের শাহ আলম ভাই বললেন, এই ওয়াজ কার? আল্লাহ ও তাঁর রসুলের, নাকি ফুলতলী হুজুরের? আমি জবাব দেই, জানিনা, এভাবে চলে আসছে, চলুক, ও রঙের ঘোড়া রে, দৌড়ে যাও। 

মনে পড়ে আমার বাল্যকালে একদিন হুজুরকিবলা আব্দুল লতিফ চৌধুরী ফুলতলী(রঃ) ওয়াজে এসে বড় চাচার ঘরে খেতে আসেন সাথে ভক্তের এক বড় দলবল নিয়েএকজন মুরব্বী হুজুরের জন্য বাঁশের ঘুটনিতে পানসুপারি চুনসাদাপাতা মিশিয়ে ঘুটে মিহি করে পরিবেশন করেন। হুজুর একটু একটু চিবিয়ে সুপারি ফেলে দিতেই লোকেরা কাড়াকাড়ি করে তার চিবানো সুপারি খেয়ে সাবাড় করে ফেলে। 

এবার ফুলতলী পীরসাহেব তওবা পড়ান। পীরসাহেব তার সামনের টেবিলে ডানহাত রাখেন। চারপাঁচ জন মুরিদ তাঁর এই হাতে তাদের হাত ছোঁয়ান, এদের পিছনের লোকজন সবাই দাঁড়িয়ে একে অন্যের পিঠ ছুঁয়ে হাত রাখেন এক দঙ্গল জনতার স্পর্শ এভাবে হুজুরকেবলা পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছে। তারপর হুজুরকিবলা(রঃ) কিছু আরবি কালাম উচ্চারণ করেন। হুজুরের সাথে সাথে সবাই এই আরবী কালাম সশব্দে পুনরুক্তি করেন। এভাবে তওবা পড়ান শেষ হয়। হুজুরের সাথে সমস্বরে উচ্চারিত এই আরবি কালামের অর্থ হয়ত কোন লোকই বুঝতে পারেনিতবে লোকেরা খুবই আত্মতৃপ্ত হয় এই ভেবে যে, আল্লার ওলির হাতধরে তওবা করায় জীবনের সব কবিরা ও সগিরা গোনাহ আজ মাফ হয়ে গেছে। কেউ কেউ পস্তান, ইস রে, আজি যদি মারা যেতাম, কতনা ভাল হত, কতনা সৌভাগ্য হত, বিনাবিচারে জান্নাতের বাসিন্দা হতাম। 

এবার হুজুরকিবলার(রঃ) দরবারে আমজনতা অসংখ্য পানিপুর্ণ বোতল পেশ করেন। তিনি মুখখোলা প্রতিটি পানির বোতল হাতে নিয়ে ঈষৎ চোখমুঝা অবস্থায় তিনচার বার করে ফোঁক দেন। লোকেরা ঔষধ মনে করে বোতলগুলো তুলে নিয়ে যায়। সেদিন কাটমোল্লা ধরনের একজন লোক হুজুরকিবলার(রঃ) এক কেরামত বর্ণনা করলেন, একবার পীরে কামিল ফুলতলী(রঃ) একজনের হাতে রাখা পানির বোতলে ফুঁক দেন, ওমনি তাঁর ফুঁকের আধ্যাত্মিক তজল্লি সহ্য করতে না পেরে কাঁচের বোতলটি ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়।    

হুজুরকিবলা ফুলতলী(রঃ) জামানার সবচেয়ে ভাগ্যবান লোক। শান্তসাম্য চেহারা, পরিস্কার তনু, কপালে সেজদার কড়কড়ে দাগ, গালভর্তি মেহদিমাখা দাড়ি, মাথায় সবুজ পাগড়ি, পাজামার সাথে লম্বা পাঞ্জাবী তাকে এক অলৌকিক বেহেশতি শোভা প্রদান করে। ধর্মীয় নেতৃত্ব এই বুদ্ধিমান পীরকে টাকাকড়ি, ধনজন, মানসম্মান, প্রভাব প্রতিপত্তি সবই ঢেলে দেয় পীর সাহেব শহরের সোবানীঘাটে তাঁর বাসার সামনে একটি মসজিদ নির্মা করেন, দাউদপুরের শতাধিক লোক পুণ্যের আশায় সারাদিন মাগনা ঢালাইয়ের কঠিন কাজ করে রাতে ধুলাকাদা মেখে বাড়ি ফেরেন। 

সেকালে ওয়াজি হুজুরদের নামের চেয়ে টাইটেলই বেশি শুনা যেত, যেমন বর্নীর বড়হুজুর, বিশ্বনাথী হুজুর, রাঘবপুরী হুজুর, বাঘার হুজুর, মাওলানা সুজানগরী, মাওলানা দশঘরি ইত্যাদি। হুজুরদের নামের সাথে নানা লকব সংযুক্ত হত যেমন জেহাদি, সায়দা, পীরানে পীর, পীরে কামিল, অনলবর্ষীবক্তা, হুজুরে কিবলা, আব্বাসী, আওলাদে রসুল, শাহ সুফি, সাইদি, সিদ্দিকি ইত্যাদি। এইসব মাওলানা হুজুরদের পৈত্রিক নাম একসময় তাঁদের লকব এবং গ্রামের নামের নিচে এতই পাথরচাপা হয়ে যেত যে তাঁদের প্রকৃত নাম খুঁজে পাওয়া কঠিন হত। 

একদিন আমাদের পাশের গ্রাম তুড়ুকখলার প্রসিদ্ধ মাওলানা ফরমুজউল্লাহ সায়দা(রঃ) সাহেবের ওয়াজ শুনি। তিনি তখন বয়ঃবৃদ্ধ লোক। কালো লিকলিকে দীঘল দেহাবয়ব ছিল তার। মোগলাবাজার হাইস্কুল যাবার পথে প্রায়ই দেখতে পেতাম তিনি তাঁর বাড়ির সামনে শস্যক্ষেতে ব্যস্ত আছেন। তাঁর ওয়াজ বেশ মধুর কিন্তু দাঁত নেই, সেইসাথে বয়সের কারণেব্দের উচ্চার অস্পষ্ট। কিছুদিন পর মোগলাবাজার রাঘবপুর ঈদগায় আবার তার ওয়াজ শুনতে যাই। লক্ষ্য করি এখানেও তিনি দাউদপুর ঈদগাহে করা ওয়াজের অবিকল হুবহু বয়ান করছেন। আগ্রহ নিয়ে তার ওয়াজ শুনতে গিয়ে এই একই ওয়াজে কোন নতুনত্ব না পেয়ে কিছুটা হতাশ হলাম। তবে এত বয়সেও তিনি যে শের গেয়ে বয়ান করছেন, তা কম কিসে।

হুজুরদের সারা ওয়াজ জুড়ে থাকত নানা চটকদার কাহিনি, অলৌকিক কাহিনি, প্রাচীনযুগের কেচ্ছা, রসাল কথাবার্তা ও দানের ফজিলতের বয়ান। দানের ফজিলতের বয়ান এত চটকদার হত যে তা শুনে গরিব মানুষেরা টাকা দানের সাথে সাথে তাদের গাছের নারিকেল, ক্ষেতের কদু মুলা, কুট্টির মোরগ, ডিম, মোরগের ছানা, ধান চাল সব এনে ওয়াজে দান খয়রাত করত। হুজুর মাইক ধরে জুরে বলতেন আম্বর আলী একটা রাজহাঁস দিয়েছেন সবাই বলুন মারহাবা। সমস্বরে শ্রুতারা বলতেন মারহাবা। এই মারহাবা পাবার জন্য কাড়ি কাড়ি টাকা দানের প্রতিযোগিতা লেগে যেত। 

এইসব ওয়াজ মাহফিলে বাকিতে মারহাবা নেওয়ার সুযোগ ছিল। অমুখ গৌছ আলী লন্ডনি দশ হাজার টাকা দেবার ওয়াদা করছেন সবাই বলুন মারহাবা, ওমনি লোকেরা চিৎকার দিত মারহাবা। মাহফিলে আসা লন্ডনি নুনুমিয়াকে সবাই চেপে ধরেন, একটা কিছু বলুন। তিনি ভেবেচিন্তে দুই হাজার টাকা বাড়িয়ে ওয়াদা করেন বার হাজার টাকা।  ওয়াদাবাজ বাকিরা শেষে ফাঁকিই দিত, তবে মারহাবা আদায়ের প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে সুনাম কুড়াত মাহফিলে ইসহাক হুজুরের নিচুগলা শুনা যেত আপনি গতবারের ওয়াদার টাকা এখনও দেননি, অন্ততঃ এবারেরটা দয়া করে তাড়াতাড়ি পৌঁছে দিবেন। কারো কারো বিগত দুই তিন চারবারের মাহফিলে ওয়াদার দান বাকির খাতায় লিখা আছে তবে কবে আদায় হবে কেউ জানেনা। শেষে ব্যাংকের অনাদায়ী হিসাবের মত এইসব দানহিসাব তামাদি বা রাইট অফফ করে দিতে হত।   

আরেক দল হুজুরের বয়ান জুড়ে থাকত মোল্লা রাজনীতি। সারাটা বাংলাদেশ জুড়ে লিল্লাহ জাকাতের কোটি কোটি টাকার একটি বিরাট বাজার রয়েছে সবাই সেই খয়রাতগঞ্জের খালে ত্রিকোনজাল ফেলে মাছ ধরেন। এই খয়রাতী খালেও মাছধরা নিয়ে বেসামাল প্রতিযোগিতা। এই সাদগাহ বাজারে ভাগ বসানো নিয়ে মোল্লারা সর্বদা পরস্পর দলবাজি ও হানাহানিতে লিপ্ত হন। যার দলে যত লোক ভীড়বে, তাঁর তত ক্ষমতা, তত টাকাকড়ি। তাই এই হুজুররা মুর্শিদ বাড়াতে দলপাকাতে একদল অন্যদলকে বেদাতি, বেমাজহাবি, ওহাবি, বেসুন্নাতি, আহলে হাদিস, বেঈমান, মুনাফেক, এমনকি জাহান্নামি কাফেরও ঘোষণা করতেনএকবার কোন এক ওয়াজে হুজুর বলছেন আল্লাহ পাক শয়তানকে বেহেশত হতে বিতাড়ন করে ভারতের দেওবন্দে ফেলে দেন। তাই দেওবন্দের হুজুররা নাকি শয়তানের অনুসারী ও বেদাতপন্থী, এরা ইসলাম থেকে খারিজ, কার এরা বসে বসে মিলাদ পড়ে নবিজির(সঃ) শানে বেয়াদবি করে।

জামাতিরা মাওদুদিবাদি ফেরকাবাজ, এরা দোযখে জ্বলবে কার তারা আল্লার রসুলের(সঃ) সাহাবিদের সমালোচনা করে ও মসনদের লোভে ধর্মচর্চা করে। আর তবলিগিরা গাট্টিওয়ালার দল, এরা সফল হবেনা কার তারা ঘর-সংসারের দায়দায়িত্ব ফেলে বের হয়ে মসজিদে মসজিদে ঘুরে বেড়ায়, যাহা আল্লার রসুল কখনও করেননি।

আরেক নতুন ফেরকার হল আরবি ইসলাম, এরা ওহাবি ও বেমাজহাবি। এরা পীরমুর্শিদ মানেনা, মাজার মানেনা। হজ্বে গমনকারী ও আরবে অবস্থানকারী বাঙালিরা এই অপইসলামের জ্বরে আক্রান্ত হয়। সৌদি সরকার কিছু লোককে সেখানে মাগ্না পড়িয়ে ডক্টরেট ডিগ্রি দিয়ে ওহাবি বানায়। দেশে এসে এসব অজ্ঞ শূন্যকলস ডক্টরেটরা ওহাবিবাদ ছড়ায়। এরা বুকে এহরাম বাঁধে, নামাজ শেষে হাত তোলে মোনাজাত করেনা ও সুরা ফাতেহা পাঠের পর জুরে আমি বলে জামাতের মাঝে চিৎকার দেয়। এরা সুন্নাত নামাজের ধার ধারেনা, তারাবি আট রাকাত ও বিতর নামাজ মাত্র এক রাকাতে সাঙ্গ করে দেয়।

দাদা বদিখার আমলের আরেক ফাসেক ফেরকা কাদিয়ানি মতবাদ। পাঞ্জাবের কাদিয়ানের বাসিন্দা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী এই ফেরকার জন্মদাতা। তিনি নিজেকে প্রথমে দাবি করে ইমাম মেহদি, কিছু সাঙ্গপাঙ্গ জোগাড় হলে দাবী করে বসেন নবি। কুরানের তাফসির লিখে নানা অপবাখ্যা করে নবি মুহাম্মদের(সঃ) অধীন একজন নবি বলে নিজেকে ঘোষণা করেন গোলাম আহমদ। বিখ্যাত রুশ পন্ডিত চেখব বলেছেন, একজন সুচতুর ধূর্ত বাটপার যখন কিছু বোকা মানুষের দেখা পায়, তখনি একটা নতুন ধর্ম পয়দা করে সে তাঁদের জয়গুরু হয়ে যায়। ইংরেজ শাসকদের সহায়তায় দক্ষিণ এসিয়ার প্রচুর লোক নতুন নবি গোলাম আহমদ কাদিয়ানির অনুসারী হয়। সেকালের আলেমরা এই কাদিয়ানিবাদ ঠেকাতে বেশ হিমশিম খান। বৃটিশ আমলে কাদিয়ানি মতবাদের যুক্তি খন্ডনে দাউদপুর মাদ্রাসার একজন আলেম এবং দাউদপুর চৌধুরীবংশের একজন পন্ডিত মিলে এক প্রশংসনীয় কিতাব রচনা করেন। ওয়াজি হুজুর বললেন, দেখুন মহান আল্লাহ পাকের কি যে শান, তিনি ভন্ডনবি গোলাম আহমদ কাদিয়ানির জান কবচ করেন লেট্রিনে। লেট্রিনের দরজা ভেঙ্গে তাঁর উম্মতরা তাঁদের নবির লাশ উদ্ধার করে। এবার হুজুর আবার বললেন, উফাতের পর নবিগনকে কোথায় দাফন করা হয় তা কি আপনারা জানেন? পাশেবসা আলেম বললেন, যেই স্থানে ইন্তেকাল হয়, সেই স্থানে। তাহলে এই ভন্ডনবি গোলাম আহমদ কাদিয়ানির কবর কোথায় হওয়া উচিত ছিল, সেই লেট্রিনে না। সবাই বললেন, সোবহান আল্লাহ, সবই আল্লাহ পাকের কুদরত। 

ফুলতলী ঘরানার এই ওয়ায়েজ এবার বললেন, মাওদুদি ফেরকার আবুল আলা মাওদুদি কোথায় মরেছেন, আপনারা কি জানেন। লাজওয়াব জলসার মাইকে তখন বেজে উঠে, তিনি মরেছেন নাসারাদের দেশ মিরিকিনের বাফেলো শহরের এক খ্রিস্টান হাসপাতালে। সকরাতুল মউতের সময় তিনি জনাকয়েক বেদ্বীন বেয়াব্রু সেবিকাবেষ্টিত ছিলেন। তার মুখে পানি দিয়ে কলেমা শুনানোর মত একজন মুসিলমানও সেখানে উপস্থিত ছিলনা। আবার সবাই বললেন, সোবহান আল্লাহ।

বড়হুজুর বয়ান করেন জঙ্গিরা আত্মহত্যা করে দোযখে যায়, কার আল্লাহর নবি(সঃ) আত্মহননকারীদের জানাজাই পড়তেন না। এই জাহিলরা নিরীহ মানুষ খুন করে হাবিয়াবাসী হয়, কার আল্লাহ তায়ালা তার পাক কালামে পরিষ্কার বলেছেন, যে একজন মানুষকে খুন করল সে পৃথিবীর সব মানুষকে খুন করল এবং যে একজন মানুষের প্রারক্ষা করল সে সারা মানবজাতির প্রা বাঁচাল এই জঙ্গিরা আমেরিকার সিআইএ ও ইজরাইলের মোশাদের পয়দা। জানের দুশমন কমিনিস্ট রাশিয়াকে খতম করতে আফগানিস্তানের তুড়াবুড়া পাহাড়ে এই জঙ্গিদেরে পয়দা করেছে কাফের আমেরিকা ও ইজরায়েল। 

খান্নাস জঙ্গি, আমেরিকার সিআইএ ও ইজরায়েলের মোশাদ এই তিন শক্তি মিলে মুসলমানদের মধ্যে রক্তপাত ও হানাহানি তৈরি করেছে। তাঁরা মুসলিম জাতিকে বিভক্ত ও দুর্বল করে তাদের অস্ত্রব্যবসা ও তৈলগ্যাস লুটের বাজার বানিয়েছে। দুঃখের বিষয় মুসলিম লেবাসধারী ও নামধারী কান্ডজ্ঞানহীন গবেট মূর্খ জঙ্গিরা তাদের দাবার গুটি হয়ে কাজ করে যাচ্ছে। এদের অপকর্ম মহান মুসলিম জাতির নামে বদনাম রটানোর উপাদান হচ্ছে। মুসলমানদের চিরতরে গোলাম বানানো ও কাটা দিয়ে কাটা তুলার জন্য ইবলিশ আমেরিকা এদের পয়দা করেছে। এদেরকে দিয়ে আমেরিকা তার গাত্রবিদ্ধ বিষকাটা দুষমন কমুনিষ্টদের খতম করেছে। কমুনিষ্ট রাশিয়া ভেঙ্গেচুরে শেষ, জঙ্গিদেরও কামকাজ শেষ, তাই শয়তান আমেরিকার হাতে তাদের কচুকাটা হবার পালা এসে গেছে। 

সবশেষে ফুলতলী তরিকার ওয়াজি হুজুর একটা হাদিস পেশ করেন, আল্লার রাসুল(সঃ) বলেছেন, আখেরি জামানায় আমার উম্মতেরা তিয়াত্তুর কাতারে ভাগ হবে, এর মধ্যে মাত্র এক কাতার বেহেশতি, বাকি বাহাত্তুর কাতার দোযখি। ওয়াজি হুজুরের নিখাদ বিশ্বাস এই বেহেশতি এক কাতারেই আছেন তিনি এবং তার দলের উলামায়ে কেরামগণ। বিশ্বের বাদবাকি সব ফেরকার মুসলমানরা বিধর্মীদের সাথে জাহান্নামের দাউদাঊ আগুনে আজীবন জ্বলেপুড়ে ছারখার হবে। হুজুর তার নিজ দলকে বেহেশতে ও প্রতিপক্ষ বাহাত্তুর দলকে দোযখে পাঠিয়ে মনে মনে দারু আত্মতৃপ্তি অনুভব করেন। মজলিশে বসা হুজুরের অন্ধ সমর্থকরা নারায়ে তকবির, আল্লাহু আকবর, চিৎকার দিয়ে এই জেহাদি নেতা হুজুরকে আর চাঙ্গা করে তুলেন। 

রাতের জলসায় বসে বসে ঘুমিয়ে পড়া ও ঝিমানো লোকদের ঘুম ও শয়তান তাড়ানোর জন্য ওয়াজি হুজুর মাঝে মধ্যে জুরছে লাইলাহা ইল্লাল্লাহ জিকির তুলতেন এবং ইয়া নবি সালামু আলাইকা দুরুদের তুফান বইয়ে দিতেন। ওয়াজের বেশ কিছু অংশ জুড়ে থাকত দাজ্জাল, ইয়াজুজ মাজুজ, ঈমাম মেহদী ও আসমান হতে আখেরি জামানায় ঈসা নবির(সঃ) আগমনের বিচিত্র বিবরণ। নবীগণ ছাড়া ওয়াজ হয় নাকি। কুরান পাকের সব মহান নবি(আঃ) আদম, শিশ, ঈসা, মুছা, দাউদ, সুলায়মান, ইউসুফ, ইয়াকুব, আয়ুব, লুত সবাই ভীড় করতেন দাউদপুরের ওয়াজের ময়দানে। বয়ানে আর থাকত কবর, হাসর, মিজান, পুলসেরাত ও আজ্রায়েল ফেরেশতার জান কবজের ভয়ানক বর্ণনা। সুদ, জুয়া, ঘুষ, জাকাত, নারী, জেনা, মাতৃসেবা কিছুই বাদ যেতনা দাউদপুর ঈদগাহের সেই সুদীর্ঘ ওয়াজ মাহফিলে।  

ঈদগাহ হতে চৌধুরীবাজার পর্যন্ত ওয়াজের বিরাট হাট বসত, এই হাটে মশাল জ্বালিয়ে সারা দিনরাত ছোলা-সিঙ্গারা, পানবিড়ি, চানাস্তা থেকে শুরু করে নানা ধরনের গ্রামীন মেলার পণ্য বিক্রি হত। একদিন একরাত দাউদপুর মসজিদ, ঈদগাহ, মাদ্রাসা ও চৌধুরীবাজারে বেশ উৎসবের আমেজ বিরাজ করত। দাউদপুর ছয়পাড়া (হাড়িয়ারচর, গাংপার, পশ্চিমপাড়া, মাঝপাড়া, দক্ষিণপাড়া ও কুনারপাড়া) থেকে মাহফিলে দুবেলার বড়বড় পনের বিশ ডেগ গরম মাংস পোলাও আসত। বিভিন্ন গ্রাম থেকে আসা মেহমানদেরে আগে খাইয়ে তারপর গ্রামবাসী লাইনে বসে সিন্নী খেতেন।    

ওয়াজের পর কয়েকদিন মাদ্রাসার পাশ দিয়ে যেতে মাদ্রাসার ভিতরে কেবল চেঁচামেচি ঝগড়াঝাটি শুনা যেত, যেন লড়াই হচ্ছে। ওয়াজে পাওয়া টাকার  ভাগবাটুরা নিয়ে হুজুরদের এই ঝগড়া চরমে পৌঁছে গেলে বিবাদ মেঠাতে শেষপর্যন্ত মাদ্রাসা কমিটির সভাপতি সফিকুর রহমান চৌধুরীর ডাক পড়ত। তিনি বিবাদমান সবাইকে নিয়ে বসে এই মালপানির লড়াই থামিয়ে শিক্ষার পরিবেশ ফিরায়ে আনতেন। আমার আব্বা মৌলভী সফিকুর রহমান চৌধুরী(রঃ) ছিলেন বেশ কয়েকটি স্কুল ও মাদ্রাসার গভর্নিং কমিটির সদস্য। তিনি বলতেন, স্কুলের হেডমাস্টারদের চেয়ে মাদ্রাসার হেডমৌলানারা দুনম্বরী কাজে বেশি সিদ্ধহস্ত। আমাদের মাদ্রাসায় একজন হেডমৌলানা দুইজন অস্তিত্বহীন শিক্ষক খাতায় দেখিয়ে বছরের পর বছর সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করতেন। একবার দাউদপুর মাদ্রাসায় শিক্ষক হয়ে আসেন হাইস্কুলে আমার দুই ক্লাস সিনিয়র খালেরমুখের রায়বান গ্রামের আব্দুল হান্নান ভাই। তার হাতে হেডমৌলানার এক পুকুর চুরি ধরা পড়ে। লাখ টাকা লাপাত্তা, কোথায় গেছে খবর নেই। 

তখন ব্যাংক ছিলনা, নগদ টাকা হেডমৌলানার জিম্মায় থাকত। অডিট আসার খবর শুনে চালুমাল হেডমৌলানা রাতে এক রহস্যজনক চুরির ঘটনা ঘটাতেন। সবাই দেখে, এমন কি পুলিশও এসে দেখে যায় স্টিল আলমিরার দরজা ভাঙ্গা ও ভিতরে রাখা লক্ষাধিক টাকা উদাও। সরকারি অডিটার সাহেব ঘুষের টাকা পকেটে ভরে সন্তুষ্টচিত্তে পুলিশের জিডি কপি ফাইলে ভরে নিয়ে যান। হরহামেশাই এধরনের চুরি হত ও যথাস্থানে ঘুষ প্রদান করে বারবারই অডিটসহ সবকিছু সামলে নিতেন বড়হুজুর। 

দাউদপুরের মোল্লাবাড়ির অনেক দেওবন্দি কওমি হুজুর এখানে ওয়াজে আসতেন না, তাঁরা দাউদপুর জামে মসজিদে জামাতে নামাজ না পড়ে তুড়ুকখলার জোয়াল্লিন মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়তেনদাউদপুর গাংপারের হাবিব মৌলানা বেশ ভাগ্যবান ব্যক্তি, তিনি লন্ডনি অধ্যুষিত ওসমানীনগর থানার কোন এক মসজিদে ইমামতি করতেন। একদিন সেখানে এক লন্ডনি কনের বিয়ের দিন প্যান্ডেল সাজিয়ে সবাই বরের অপেক্ষায় ছিলেন কিন্তু বর না এসে পালিয়ে যায়। কনের আত্মীয়রা হাবিব মৌলানাকে এসে অনুরোধ করে, হুজুর আপনি আমাদের মানসম্মান বাঁচান। হুজুর সুযোগের সদ্ব্যবহার করলেন, তিনি পাগড়ি পরে বরের আসনে গিয়ে বসে কনেপক্ষের মানসম্মান বাঁচান এবং সেইসাথে নিজের আখেরও গোছান। 

লন্ডনে গিয়ে হাবিব হুজুর বাটিয়ারচরে জমি কিনে পাকা বাড়ি নির্মা করেন। সমস্যা হল বাটিয়ারচরবাসী কওমি অনুসারী। তিনি গ্রামবাসীকে প্রস্তাব দেন, তাদের মসজিদ মক্তব সব তিনি অট্টালিকা করে দিবেন এক শর্তে, তা হল এখানে ফুলতলী অনুসারী হুজুররা কাজ করবেন। কিন্তু গ্রামবাসীরা তার এই লোভনীয় প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে। হাবিব হুজুর তখন বাটিয়ারচর জামে মসজিদের মাত্র শত হাত দূরে তার নতুন বাড়ির সামনের জমিতে এক সুরম্য মসজিদ নির্মা করেন। কিন্তু এই সুরম্য মসজিদে মাত্র দুইজন বেতনপ্রাপ্ত মুসল্লি নামাজ পড়েন, তাদের একজন ইমাম ও অন্যজন মুয়াজ্জিন।

পশ্চিমা দেশে অবস্থানকারী হুজুরদের টাকার কোন অভাব হয়না। এসব দেশে লিল্লাহ জাকাত দেবার মত লোক খোঁজে পাওয়া যায়না। চালাক হুজুররা এই সুযোগের যথাযত সদ্ব্যবহার করেন। দেশে মসজিদ মাদ্রাসা নির্মাণের নামে হাত পাতলেই ডলার পাউন্ডে দুহাত ভরে যায়। ঝাফা গ্রামের মাওলানা জালাল সিদ্দিকি হুজুরও নিউইয়র্কে মোল্লা রাজনীতি করে প্রভূত অর্থভিত্তের মালিক হন। তিনি নিউইয়র্কে জনগনের চাঁদার টাকায় একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। একদিন মুসল্লীরা নামাজ পড়তে এসে দেখেন মসজিদে তালা, গেটে ঝুলছে একজন বিধর্মীর মালিকানা সাইনবোর্ড। শেষে জানা গেল, মসজিদের জায়গাটি জালাল সিদ্দিকি হুজুর মুসল্লিদের টাকায় নিজনামে কিনেন এবং গোপনে বিক্রি করে সমুদয় টাকা মেরে উদাও হন। সুচতুর মাওলানা জালাল সিদ্দিকি নিউইয়র্কে একটা আস্ত মসজিদ অজগরের মত গিলে সাবাড় করে দেন।

আমার শৈশবে মোল্লাদের সমাজে যথেষ্ট প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল যাহা পরে বিলীন হয়ে যায়। আদিকালে চৌধুরীদের তৈরি চুনসুরকীর চারফুট প্রস্থ দেওয়ালের বিশাল মসজিদটিতে ছিল বড় বড় তিনটি গম্বুজ ও আর ছয়টি শীর্ষচূড়া, দক্ষিণে ছিল ইমাম সাহেব থাকার চুনসুরকী নির্মিত ভবন। উত্তরে সংযুক্ত ছিল আরেক পাকা ভবন যাহা সময়ে অসময়ে অতিরিক্ত মুসল্লিদের চাপ সামাল দিত। এই ভবনের উত্তরে হজরত শাহজালালের(রঃ) সহচর মক্কা হতে তাঁর সাথে আগত হজরত শাহদাউদ কুরেশী(রঃ), তার পুন্যাত্মা পত্নী(রঃ) ও একমাত্র পুত্র হজরত রহিম দাউদ কুরেশির(রঃ) মাজার শরিফ বিদ্যমান। এই মাজারের পশ্চিমে ছিল একটি ছোট ও নিরিবলি ইবাদাতখানা, চারপাশ আবর্তন করে ছিল পাকা বাউন্ডারি ওয়াল। মসজিদের সামনে ক্রমান্নয়ে কুনার চৌধুরীবাড়ি ও পুর্বচৌধুরীবাড়ির পারিবারিক কবরগাহ মসজিদের সামনে ওয়ালঘেরা একটি ফুলবাগান ছিল। বাগানে নানাজাতের রঙিন ফুল ফটত এবং এখানে ফোটা কাটলিচাপা ও হাসনাহেনার সুগন্ধে সারাটা মসজিদ মৌ মৌ করত। এই বাগানের ভিতর রয়েছে কুনারবাড়ির সুফি জমিদার আব্দুল মুজাফফর চৌধুরী ও তার মহাত্মা পত্নী ফজিরা বানুর কবর। দাউদপুর মাঝেরবাড়ির হামিদ রাজার মেয়ে ফজিরা বানু ও তার কন্যা পুর্ববাড়ির আবুল বশর চৌধুরীর পত্নী সফর চান্দ খাতুন ১৮৯১ সালে দাউদপুর মাদ্রাসায় একতাকে ২১ একর ১০ ডেসিমেল জায়গা ওয়াকফ করে দেন। 

দাউদপুর জামে মসজিদের দক্ষিণে ঈদগাহ ও চারতলা বর্গাকার মিনার। এই মিনারের দুতলায় মুয়াজ্জিন ঘুমাতেন। রঙিন কারুকার্যময় মিনারটি নেক দূর হতে দেখা যেত। বাল্যকালে সিঁড়িবেয়ে এই মিনারের চারতলায় উঠানামা করা ছিল আমার এক শখের খেলা। এই সুন্দর মিনারের দুতালায় মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে অনেকবার আজান দেওয়ার স্মৃতি আজও আমার মনে উজ্জল হয়ে আছে। বাহিরে বুড়িবরাকের পারে পুর্ববাড়ি প্রদত্ত মসজিদের অজুর পুকুর ও শৌচাগার। প্রথমে মিনারগেট, তারপর ঈদগাহ পেরিয়ে দ্বিতীয় প্রশস্ত প্রাচীন চুনসুরকী নির্মিত গেট দিয়ে মসজিদে ঢুকতে হত। মিনারগেটের ভিতর দুইদিকের পাকা বৈঠকখানা, নিচে কুলুপের ডেলা, এখানে চলত বেকার বুড়োদের রাজ্যের সব হাসিটাট্টা ও গল্পগোজব। 

এই প্রাচীন মসজিদটি বাহিরের অনেক লোকজন দেখতে আসত এবং কেউ কেউ বলত এই সুন্দর মসজিদটি পাগলাবাজারের ইয়াসিন মির্জার মসজিদকেও হার মানাবে। মানুষ মনে করত এই মসজিদ আয়তনে ও সৌন্দর্য্যে সিলেট বিভাগের সেরা মসজিদ, এর সাথে আর কোন মসজিদের তুলনা হয়না। আমার শৈশব ও কৈশরে এই মসজিদে ইমামতি করতেন তুড়ুকখলার মৌলানা তুতামিয়া। আজিকার দিনে পাড়ায় পাড়ায় মসজিদ হয়ে গেছে অথচ তখন দাউদপুরের ছয়পাড়ায় ছিল এই একটিমাত্র জামে মসজিদ। ছয়পাড়ার মানুষ দীর্ঘপথ পায়ে হেঁটে এসে এখানে জামাতে নামাজ পড়ত। মুরব্বিদের কাছে শুনেছি, তারও আগে তুড়ুকখলায়ও মসজিদ ছিলনা, তারাও এখানে এসে জামাতে নামাজ পড়তেন। রমজানের তারাবি জামাত শেষ হলে মুছল্লিরা মশাল জ্বালিয়ে যখন বিভিন্ন রাস্তা দিয়ে ঘরে ফিরতেন, মনে হত সারাটা গাঁয়ে যেন আলোর মিছিল বইছে। 

রোজা শেষে ঈদের দিন ঈদগায় বেরোজাদারদের বিচার হত। রোজা ভেঙ্গে খাওয়া প্রভাবশালী লোকের বিরুদ্ধে কোন স্বাক্ষী মেলতনা, এরা পার পেয়ে যেত, কিন্তু হতদরিদ্ররা ধরা পড়ে নাস্তানাবুদ হতএকজন চৌধুরী সাহেব রোজা রাখতেন না। বিচারের মজলিশে কেউ একজন তার নাম মুখে নিতে না নিতেই বিচারপতিরা বললেন, চুপ চুপ, এইনাম মুখে নেবেনা। খবরদার, এখবর তার কানে গেলে সবার বিপদ হবে। রোজা ভেঙ্গে খাওয়ার বিচারের হাত হতে বাঁচতে গাঁয়ের সুচতুর কেউ কেউ বাহিরে গিয়ে ঈদের নামাজ পড়ে রক্ষা পেতেন। সেকালে চৌধুরীদের জন্য ঈদের জামাতে সামনের কাতার নির্ধারিত ছিল। 

গ্রামের সব মানুষের আরবি ওস্তাদ ছিলেন মৌলানা তুতামিয়া। তিনি ছিলেন কৌশলী আদমি তিনি প্রভাবশালী চৌধুরীগণকে সুন্দরভাবে মানিয়ে চলতেনতিনি সম্মানের সাথে প্রায় চল্লিশ বছর এই প্রাচীন সুরম্য শাহি মসজিদে ইমামতি করেন। 

এই মসজিদে প্রথমে আমার চাচা আবুল হাসান চৌধুরী আবুলমিয়া ও তাঁর ইন্তেকালের পর আব্বা সফিকুর রহমান চৌধুরী আমৃত্যু মোতওয়াল্লি ছিলেন। আব্বার  মহাপ্রয়াণের পর আমার চাচাত ভাই গোলাম এহিয়া কুরেশি আমৃত্যু মোতাওয়াল্লির দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমান মোতাওয়াল্লি লন্ডন প্রবাসী চাচাত ভাই শওকত কুরেশি। 

একদা তুতামিয়া ইমাম সাহেবের পহেলা বিবির একজন পুত্র লন্ডনে চলে যান, তখন হুজুর দোয়া করতেন আল্লাহ পাক যেন তাকে নাসারাদের দেশের হারাম মাল ভক্ষণের মত শক্ত গোনাহ হতে ফানাহ দেন। এই প্রার্থনা চলাকালেই পরপর তার অন্য দুইপুত্রও বেদ্বীনের দেশ লন্ডনে চলে যানএযেন হুজুর তুতামিয়া আল্লাহর দরবারে চাইছেন এক, আল্লাহ ঘটাচ্ছেন আরেক। ছেলেরা টাকা পাঠালে হুজুর তার লন্ডনি ছেলেদের একটি টাকাও পকেটে নিতেন না, ইমামতি ও দানের সামান্য টাকায় দুসরা যুবতী বউ ও বাচ্চাদের নিয়ে কষ্টেমষ্টে বুড়াকি জীবন কাটান।

ইমাম তুতামিয়া আব্বাকে দেখলেই উর্দু মিশেল বাংলা বুলি আওড়াতেন, চৌধুরী সাহেবের তবিয়ত কেমন আছে, বুজুর্গানে দীন মিয়ারা কেমন আছেন, জিন্দেগানি কেমন যাচ্ছে, ইত্যাদি। আব্বা জবাব দিতেন, তবিয়ত ভাল, শোকর আলহামদুলিল্লাহ।

সারা দাউদপুরবাসী তুতামিয়ার ছাত্র, কিন্তু বুড়ো বয়সে তুতামিয়া হুজুর মসজিদে তাঁর কাছে আমসিপারা তামিল নেয়া জনাকয়েক লোকজনের হাতে বেয়াদবির শিকার হন এবং ইমামতি ছেড়ে চলে যান। তাঁর বিদায়ের সাথে সাথে গ্রামের দীর্ঘকালের এক শান্তিময় ধর্মীয় ব্যবস্থার অবসান ঘটে। বুজুরগানে দীন তুতামিয়া ইমাম সাহেব চলে গেলে জামে মসজিদে অজস্র মাতব্বরের আবির্ভাব হয়। এখানে তীব্র গ্রাম্য রাজনীতি শুরু হয়। মসজিদে এসে হৈ চৈ হাল্লাগোল্লা করলে কিছু লোক মনে করত সে বড় একজন কেউকেটা হয়ে গেছে। আসলে এই কেউকেটারা সবাই ছিল সদ্যধনী মাকাল ফল এবং শিক্ষাদীক্ষায় শূন্যকলস। ঘরের কেউ একজন বিদেশে গেছে, দেশে বসে বসে সেই প্রবাসীর কষ্টের আয়ে মহা ধূমধামে মত্ত আছে বেকারের দল। আর সারাক্ষণ টাকার অসহ্য গরমে বড়লোকি ব্যারামে ভোগছে তাঁরা সবাই।

এই সদ্য বড়লোকদের হৈ চৈ চেচামেচিতে মসজিদে ইবাদাতির পরিবেশ নষ্ট হয়ে যেত। তাদের মাতব্বরির ঠেলায় কোন ইমামের পক্ষেই এখানে বেশি দিন টিকে থাকা সম্ভব হত না। ফলে দাউদপুর শাহি মসজিদের আগের সুদির্ঘ জমিদারি আমলের সেই সুশৃংখল শান্তিময় ধর্মীয় পরিবেশ শেষ হয়ে যায়।  

আগে শিক্ষিত চৌধুরীরা সবকিছু দেখবাল করতেন, তাঁরা অনেকে গ্রাম ছেড়ে চলে যান। আসে নতুন উঠতি সর্দারদের যুগ আসে। এই উঠতি কেউকেটাদেরকে তোষামুদি করে ইমামরা চাকুরি ধরে রাখতে। আগের জামানায় সবাই তুতামিয়া ইমাম সাহেবকে তুষামুদি করত ও ওস্তাদ বিবেচনায় সালাম দিত, এখন উল্টো ইমামগ এদেরে লম্বা সালাম দিয়ে তুষামুদি করে নিজের রুটিরুজির অবলম্বন চাকুরিটা বাঁচানোর আপ্রা চেষ্টা করতে কয়েকদিন পরপর ইমামের পিছনে এক দল নামাজ পড়ে তো অন্যদল বয়কট করে। ইমামকে একদল তাড়াবে, অন্যদল রাখবে, দুই দলই নাছোড়বান্দা। দুইদল নেকড়ের পালের থাবার মধ্যে পড়ে ধর্মগুরু ইমামদের অবস্থা হত ত্রাহি মধুসুদন, শেষপর্যন্ত ইমাম সাহেবরা পালিয়ে গিয়ে আল্লার মাল পৈত্রিক প্রাটা বাঁচাতেন।

প্রতিটি শুক্রবারে জুমুয়ার নামাজের আগে কোন কার ছাড়াই মাতব্বরের দল চেঁচামেচি হৈ চৈ করে নামাজের পরিবেশ নষ্ট করে দিত, যা এই দরগাহ মসজিদে বড়জামাতে দুরদূরান্ত হতে আসা মুসল্লিদের সামনে লজ্জাজনক অবস্থা সৃষ্টি করত। মোতওয়াল্লি আমার আব্বা সফিক চৌধুরী এসব ফ্যাসাদ সামাল দিতে ঘেমে যেতেন, তবে অতিকষ্টে সামাল দিতেন। আমাদের পুর্বপুরুষদের গড়া এই জামে মসজিদ তিনি না পারতেন ছাড়তে, আবার না পারতেন ধরতে। চৌধুরীগ আগের কয়েক যুগে সওয়াবের নিয়তে মসজিদ, মাদ্রাসা, দরগা, স্কুল, বাজার ইত্যাদি জনগণের জন্য প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। তাদের কোন স্বার্থচিন্তা ছিলনা। এখন স্বার্থবাজরা কমিটিতে ঢুকে নানা ধরনের সুযোগ সুবিধা খোঁজতে থাকে, যদিও এখানে তাদের তেমন কোন দান অবদান নেই। 

আমাদের ভূমিতে স্থাপিত আরেক মসজিদ চৌধুরীবাজার মসজিদে কয়েক বছর ধরে সাপ্তাহে তিনদিন হাটবারে উঠানো হাজার হাজার টাকা একজন ইউ পি মেম্বার মেরে দে। এই টাকা উদ্ধার হল কিনা আমার জানা নেই। 

হজরত শাহদাউদ কুরেশীর দরগায় চৌধুরীগ চল্লিশ পঞ্চাশ বিঘা ভূমিদান করেন। এখানে তারা দানবাস্ক বসানো, গানবাজনা, ধর্মব্যবসা ও বেদাতি কাজকর্ম করার কোন সুযোগ দেননি। এখানে কেবল নামাজ, জিকির আজকার, দুয়াদুরুদ, তেলাওত ও জেয়ারত হত।  

কোন এক রমজান মাসে দাউদপুর জামে মসজিদে দারুল ক্বেরাত মজিদিয়া ফুলতলী মিশন শুরু হয়। বেশ কয়েকজন বয়স্ক মানুষ তাদের দোয়া কালাম সহি করতে আসেন। দেখা গেল তারা কেউ কেউ আরবিতে শেখা চার কলেমা সহিভাবে পাঠ করতে পারছেন না। কেউ কেউ চার কলেমা  পুরো বা আংশিক ভূলে গেছেন, সুরা ফাতেহার দুই এক আয়াত বাদ দিয়ে ভূল আয়াতে নামাজ পড়ে যাচ্ছেন, কেউবা কোন সুরার ভিতরের কিছু বাদ দিয়ে সুরাকে সংক্ষেপ করে নামাজে পড়তে আছেন

ক্কারিণের দরবারে যিনিই তেলাওত পরীক্ষা দিতে আসেন তিনিই ধরা খান এখানে পাস নেই, সবাই একচেটিয়া ফেল। এখানে বাল বাচ্চা, জোয়ান বুড়া সবাই মিলে একসাথে সহি করে পবিত্র কোরান তেলাওত, নামাজ পড়া, দোয়া কালাম শেখা শুরু করেনকয়েকজন ক্কারিসাহেব উচ্চশব্দে মাইক বাজিয়ে পড়েন, তাদের সাথে সমস্বরে আমজনতা ও তালবারা সুর তুলে গলা মেলান।

ফিবছর দারুলকেরাত কমিটি হয়, ঘাড়ে গর্দনায় ধরে ধরে চাঁদা তোলা হয়। দূরদূরান্ত হতে চাঁদা আদায়কারী সর্দারদের কমিশনের খবর কেউ পেতনা। খাটাখাটি করে হাত পেতে চাঁদা তুলে তাঁরা না আনলে যে টাকা ফান্ডে নিয়ে এসেছে তা কি আর আসত? তাই কেউ এই জনসেবকদের কাছে তিনি কত আদায় করে, কত জমা করলেন তা নিয়ে কোন প্রশ্ন করেনা। এই প্রশ্ন করার সাহস কয় জনেরইবা আছে।

দারূল কেরাতের চাঁদার ফান্ডের টাকা সমান তিন অংশে ভাগ করা হত। প্রথম অংশ ক্কারিদের বেতন ও কমিটির খরচপাতি, দ্বিতীয় অংশ ভবিষ্যৎ ফান্ড এবং তৃতীয় অংশটি দারুল কেরাত মজিদিয়া ফুলতলী ফান্ড, জকিগজ্ঞ চলে যায়। একদিন মসজিদ পুকুরের পুর্বপারে আমাদের জায়গায় চেয়ে দেখি দারুলকেরাত ফুলতলীর একটি পাকা অফিস ঘর তৈরি হয়ে গেছে। নতুন বছর দারুল কেরাতের চাঁদা উঠানোর সময় প্রায় বছরই দেখা যায় আগের বছরে রাখা ভবিষ্যৎ ফান্ডের টাকার হিসাব এলোমেলো, অফিসের দানবাক্স খালি কিংবা অন্যকোন রহস্যজনক কারণে খাতাপত্র লাপাত্তাএভাবে দারুল কেরাতের ভবিষ্যৎ ফান্ডের টাকা আংশিক কিংবা পুরোটাই প্রতিবছরই কোন না কোনভাবে তছরুফ হয়ে যেত।

এখানে কোরান শিখে লোকের উপকার হয়, সেইসাথে বেকার কিছু ফুলতলী তরিকার ক্কারিদের রমজান মাসে রুটিরুজির পথ হয়। কিন্তু সমস্যা হল শব্দদুষ, মাইকের তীব্রশব্দ দিন পেরিয়ে রাতেও জারি থাকত। সারাদিন রোজা রেখে সুদীর্ঘ তারাবি নামাজ পড়ে বাড়ি গিয়ে লোকজন একটু শান্তিতে ঘুমাবে কিন্তু না তখনও মাইকে বাজত দারুল কেরাতের কানফাটা আওয়াজ। শেষরাতেও এই ধর্মের মাইক বন্ধ হতনা। লোকজন বিরক্ত, রোগীরা অসহায় কিন্তু ধর্মকর্ম নিয়ে কিছু বলা যাবে না। তাই কোন প্রশ্ন ছাড়াই ভূক্তভোগীরা বিনিদ্র রাত কাটাতে বাধ্য হতেন। আসলে মাত্রাতিরিক্ত শব্দ যে মানুষ ও পশুপাখির জন্য ভীষণ ক্ষতিকর তা সেকালের কোন লোকই জানতনা। তবে এতকিছুর পরও আমার গ্রামের ধর্মাচারণ ছিল ফুলতলী(রঃ) সিলসিলার শান্তিময় সুফিবাদী ইসলামি তরিকা, যেখানে ব্যক্তিজীবনে ইসলাম চর্চাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হত, রাজনীতি মিছিলবাজি ও জঙ্গিপনার কোন জায়গা ছিলনা। 

গ্রামবাসীর ধর্মজীবন নিয়ে অনেক আলোচনা করলাম। এখন আমার ব্যক্তিগত ধর্মজীবন নিয়ে কিছু আলোচনা করব। পরকাল নিয়ে কিছু ধর্মীয় বই পড়ে মনে হত এই ক্ষণস্থায়ী জীবন মুল্যহীন। তাই ইহজীবনকে ফেলে রেখে আমি পরলোকচর্চায় মনোনিবেশ করি। ভয়ার্ত মনে পড়ে যাই ‘মৃত্যুর আগে ও পরে” নামের কোন এক অর্বাচীন লেখকের লিখা বই। ভয়ংকর ফেরেশতা আজ্রাইলের আগমন হতে আরম্ভ করে কবর হাশর পুলসিরাত পার করে মানুষকে তার অনন্তনিবাস বেহেশত কিংবা দোযখ পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে বিবর সমাপ্ত হত। বেহেশতের বাগান, হুর, গেলমান,র্ণা, পানি ও শরবতের লেক আবে কাওছার, অট্টালিকা ইত্যাদির চিত্তাকর্ষক বিবর শুনে বেহেশতে যেতে মন আনচান করত।

দোজখের অবর্ণনীয় নিষ্ঠুর শাস্তির বিবর পড়ে মনটা ভয়ে প্রকম্পিত হত। আজ্রায়েল ফেরেশতার বিকট আবয়ব, ছকরাতুল মউতের বিভীষিকাময় বিবর প্রাণে ভয়ে কাঁপন ধরাত। চুলের চেয়ে চিকন পুলসিরাতের সেতুর বিবরণও ছিল ভীতিকর, যার নিচে দাউ দাউ করে জ্বলতেছে জাহান্নামের আগুন। এই আগুনের তেজ দুনিয়ার আগুনের চেয়ে হাজারগুণ বেশি

হুজুর বললেন, ছুরা একলাস দশ বার পাঠ করলে আল্লাহ বেহেশতে ঐ ব্যক্তিকে একটি সুরম্য ভবন দান করেন। বেহেশতে অসংখ্য প্রাসাদ পাবার আশায় বা লোভে তখন প্রতিদিন অনবরত পড়তে থাকি- ‘ক্কুলহু আল্লাহু আহাদ। আল্লাহুস সামাদ। লামইয়ালিদ ওলাম ইউলাদ। অলাম ইয়া কুল্লাহু কুফুয়ান আহাদ’। সুরা ইয়াসিনের ফজিলতের বয়ান শুনে বাল্যকালে এই সুদীর্ঘ সুরাটি সম্পর্ণ মুখস্ত করে ফেলি।

ইসলাম ধর্মে মানূষের উপর এত বিধিবিধান রয়েছে যে সবগুলো সঠিকভাবে প্রতিপালন করা অসম্ভব মনে হত। একজন মানুষের পুরো ব্যক্তিগত জীবনই ধর্মের জায়েজ ও নাজায়েজের কিছু গতবাঁধা ছকে বেঁধে দেওয়া হয়। বলা হয় ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, এখানে মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতা অর্থহীন ও সব আচারচর ধর্মের নিয়মে আবদ্ধ। এখানে ভিন্ন চিন্তা, ভিন্ন মত ও ভিন্ন বিশ্বাসের কোন স্থান নেই। সহি হাদিসে আছে, মুসলিম হল সেই উটের মত, যার নাকে দড়িবাঁধা। যিনি নিজেকে যতবেশি এই ধর্মীয় নিয়মের অধীনে নিয়ে আসতে পারেন তিনি ততবেশি মোত্তাকি, ততবেশি ফরহেজগার। তাঁকে হুজুররা বলেন কামিয়াব মুমিন। সুন্নাতি জীবনে চলতে গিয়ে পদে পদে এতকিছু সঠিকভাবে মেনে চলা ছিল বেশ কঠিন কাজ। প্রতিটি নড়চড়ের এক একটা নিয়ম আছে, এক একটা দোয়া আছে। 

কিছুদিন পরপর আমি এই কঠিন ইসলামি জীবনব্যবস্থায় পুরাপূরি থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করতাম। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামে মসজিদে জামাতে পড়তাম, ভোরে তেলাওত করতাম, শেষরাতে জেগে তাহাজ্জুদ পড়তাম, দিনে একবার সালাতুস তাসবীহ ও ইয়াসিন সূরা পড়তাম। কিন্তু বেশিদিন এই প্রশিক্ষণে টেকা সম্ভব হতনা, একটা অবসাদ এসে মনকে গ্রাস করে দিত, মন একেবারে বিষন্ন হয়ে যেত। মনে মনে ভাবতাম, মা আসমতুন্নেসা এই কঠিন ইসলামি জীবনে সবসময় কি করে নিজেকে আবদ্ধ রাখেন। আমি রণে ভঙ্গ দিতাম, মনকে শিথিল করে কেবল ফরজ পালনে চলে যেতাম, প্রার্থনা করতাম, হে দয়াময়, আমার এই অক্ষমতা ক্ষমা কর্রে দিও।

বইপড়া আমার উপর নানা ধরনের আছর করত। গালিভার ট্রেভেলস পড়ে নিজেকে লিলিফুটের ছয় ইঞ্চি ক্ষুদে মানুষদের রাজা ভাবতে থাকি। আকবর দি গ্রেট পড়ে নিজেকে কল্পনা করি দিল্লির সিংহাসনে বসা ভারত সম্রাট আকবর। কিছুদিন মনে এধরনের একটা কল্পসুখ বিরাজ করত। তারপর তা হাওয়ায় মিলিয়ে যেত।  

তাজকিরাতুল আউলিয়া গ্রন্থে সেরা সেরা মুসলিম সুফি দরবেশদের জীবনী পড়ি। এই বই পড়ে ওলিআল্লাহ হবার স্বপ্ন মনকে মোহাচ্ছন্ন করে। ওলিআল্লাহ হয়ে গেলেই নাকি আল্লাহপাক চাহিবামাত্র সব দেন। ওলিরা ধ্যানমগ্ন হন যাকে বলে মুরাকাবা। তাজকিরাতুল আউলিয়ার ওলীগণ লোকালয় ছেড়ে বনে জঙ্গলে গীরিগোহায় গিয়ে নির্জনে মুরাকাবা করতেন। আল্লাহর রসুল(সঃ) হেরার গোহায় ও গৌতমবুদ্ধ বিহারের বৌদ্ধগয়ায় বটগাছের তলায় বসে ধ্যানমগ্ন হন। চিন্তা করি আমিও সুফিসাধনা করব, তবে বনে জঙ্গলে গিয়ে নয় বরং নির্জন লোকালয়ে।

বনে জঙ্গলে যাবার সাহস ও সুযোগ কোনটাই বালক আমার নেই। মুরাকাবা করার জন্য একটি স্থান বের করলাম, তা হল বিশ্ববিখ্যাত দরবেশ হজরত শাহজালালের(রঃ) সহচর মক্কা হতে আগত বিখ্যাত সুফি দরবেশ হজরত শাহদাউদ কুরেশির(রঃ) মাজার শরিফের পশ্চিমের পাকা ইবাদাতখানা। জায়গাটি একদম নিরিবিলি, এখানে বালক আমি প্রতিদিন আসর হতে মাগরিব পর্যন্ত ঘন্টা দেড়েক সময় ধ্যানে বসে একাগ্রচিত্তে আল্লাহ পাকের নানা গুবাচক নাম, কৃতঞ্জতা, একত্বতা ও পবিত্রতা জপে জপে মুরাকাবা করতাম। বাহিরে দুইচার জন লোক এসে দরগা জেয়ারত করে করে চলে যেত। এই এবাদাতখানায় তেমন কেউ ঢুকতনা, তাই আমার ধ্যানে কোন ব্যাঘাত হতনা। 

কিতাবে পড়লাম মানুষ শরিয়তের গেট দিয়ে মারেফতের ঘরে ঢুকে, তারপর ফানার স্থর পার হয়ে বাক্কার স্থরে গিয়ে সাধনা পুর্ণতা পায় ধ্যানের এই স্থরে মানুষ অনেক অধ্যাত্মিক শক্তি অর্জন করে ও ভুত ভবিষ্যৎ দেখে ফেলতে পারে। আমি পুরো ইসলামি শরিয়তি জীবন অনুসরণে সচেষ্ট হয়ে মনে মনে সুফিসাধনায় নিমগ্ন হলাম। 

যাক সুফি ও ওলিআল্লাহ হবার সাধনা চলল। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের সাথে চলল আম্মার শেখান চাশত, এশরাক, আওয়াবিন ও সালাতুত তাসবির লম্বা নামাজ। শীতকালে ও রমজানে শেষরাতে জেগে পড়তাম তাহাজ্জুদের নামাজ। অল্প শ্রমে বেশি সওয়াব লাভের দোয়া, দুরুদ, কোরানের আয়াত, সুরা, জিকির ইত্যাদি খোঁজে বের করে করে পড়তাম। যেমন এসময় সুরা ইয়াসিন, সুরা আর রাহমান, আয়াতুল কুরছি, সুরা জুমুয়ার শেষ তিন আয়াত ও ইসমে আজম মুখস্ত করি। প্রতিদিন প্রচুর নফল নামাজ ও তাসবিহ নিদৃষ্ট সংখ্যা নির্ধার করে পড়তাম, সারাদিন ওজুর সাথে থাকতাম।

অবাক হতাম, সে সময় আমার দেখা অনেক স্বপ্ন পরে হুবহু সত্য হয়ে যেত। অনেক দোয়াও মাঝে মাঝে বাস্তব হতে দেখি কিন্তু এত সুফল পাবার পরও আমি হেরে যাই, সুফি হওয়ার সাধনা ধরে রাখতে পারিনি। কারণ হতে পারে আমি সঠিক গুরু পাইনি, বা ধরতে পারিনি। এই লাইনে ভন্ডদের রাজত্ব, সঠিক গুরু কে, তা নির্ণয় অসম্ভব। আমার আধ্যাত্মিক শক্তি অর্জন হচ্ছে, দিব্যদৃষ্টি লাভ করছি, এমনটি মনে হলনা। এই সুফিসাধনার ধারাবাহিকতা ধরে রাখা ছিল খুব কঠিন কাজ। কিছুদিন পর পর এই সাধনা শিথিল হয়ে যেত। কখনো টাইট, কখনো ঢিলে, এই উতাল পাতাল তরঙ্গ ধারায় আমার ওলি আল্লাহ হবার সাধনা জীবনের সেই দিনগুলোকে বহতা নদীর মত বেগবান ছিল।

আমাদের বাড়ির সামনের অগ্নিকোনে প্রাচীনকালের একটি হলুদ পাকা লেট্রিন ছিল। জমিদারি আমলে বাংলোয় থাকা ছাত্র, হুজুর ও লোকজন এই লেট্রিন ব্যবহার করতেন। লোকে বলত দুষি লেট্রিন। অনেকে এই লেট্রিনে প্রেতাত্মা দেখার কেচ্ছা বলতেন। 

একদিন দেখতে পাই এই দুষি লেট্রিনের পাশের খালবনে সন্ধ্যা রাতের অন্ধকারে প্রতিবেশী বাদশাবাড়ির নরনারী আন্ডাবাচ্চা সবাই এসে ভীজমায়ে ভয়ে ভয়ে কি যেন দেখার চেষ্টা করছে। কি হয়েছে জানতে চেয়ে শুনলাম এখানে এক বালককে ভূতে থাপ্পড় মেরেছে, সেই থাপ্পড় খেয়ে সে বাঁচাও বাঁচাও চিৎকার দিয়ে বেহুশ হয়ে গেছে, লোকজন বালকটিকে উদ্ধার করে এনে মাথায় পানি ঢালছে। তাই বাদশাবাড়ির লোকজন ভূত দেখতে লেন্টন জ্বালিয়ে সবাই মিলে চৌধুরীবাড়ির সামনের বনে চলে এসেছে ভুতের ভয়ে তাঁরা সবাই তিরতির করে কাঁপছে এবং ঘটনাস্থলে না গিয়েই নিরাপদ দূরে দাঁড়িয়ে উঁকিবুঁকি মেরে ভুত দেখার আপ্রা চেষ্টা করছে। কেউ কেউ দাবি করছে, বনের ভুত তাঁরা দেখে ফেলেছে, ভূতের কিম্ভুতকিমাকার চেহারাসূরতের বিবরণও দিচ্ছে।

মাদ্রাসা ছাত্র বদরুদ্দোজা চৌধুরী ও আমি দুইজন বালক মিলে ভয়কে জয় করে এশার নামাজ প্রায়ই বড়মসজিদে জামাতে পড়ি। কিছুদিন আগে এশার নামাজ হতে আসার সময় অন্ধকারে ভয়ে ভয়ে পথ চলাকালে দুষি লেট্রিনের পাশের বনবৃক্ষে হঠাৎ বেশ বড়সড় ঝাঁকুনি সৃষ্টি হয়, ঝাঁকুনি শেষ হতে না হতে মনে হল কালোভূতরা উড়ে যাচ্ছে। আমরা ভয়ে চিৎকার দিয়ে কালুচাচার ঘরে আছড়ে পড়ি। 

চাচি সায়েরা চৌধুরী বললেন কি হয়েছে। আমরা বললাম ভুতেরা গাছে ঝাঁকুনি দিয়ে আমাদের পাশ ছুঁয়ে ছুঁয়ে উড়ে গেছে। পরদিন বাড়ির সামনে ঐ জায়গায় গিয়ে দেখি হাটুকলার গাছে বড় বড় কলার কাদি ঝুলে আছে। হাটুকলায় অত্যাধিক বিচি থাকায় বাড়ির কেউ এই কলা খেতনা, গাছে পেকে পশুপাখির উদরে যেত। এশা বেলার আঁধারে বাদুর ভুতেরা ঝাঁক বেঁধে এসে বিচিকলা সাবাড় করে জ্বীনের ভয় দেখায়। মহান আল্লাহপাক সহায় না হলে আমি আর বদরু সেরাতে ভয়ে হার্ডফেল হয়ে মারা যেতাম

আমার বুঝতে অসুবিধা হলনা এই বালককে ভূতে মারেনি, এটাও সেই একই জায়গায় একই বাদুর ভুতেরই কান্ড, যারা প্রায়ই হাঁটুকলার বনে সন্ধ্যার আঁধার নামতেই পাকা কলা খেতে আসে এবং কাছে মানুষ এলেই অন্ধকারে একসাথে পতপত শব্দে উড়াল দেয়।  

সেই আমলে মানুষ কলেরাকে ভীষ ভয় করত, গ্রামে কলেরা হলে অনেক মানুষ মরে সাফ হয়ে যেত। কোন বাড়িতে ডায়রিয়ার মত কিছু হলে মানুষ ভয়ে সেদিকে পা মাড়াত না। কলেরা কি ও কিভাবে ছড়ায় মানুষ তা জানতনা। কলেরার বালার ভয়ে দিনের বেলা রাতের নীরবতা নেমে আসত, লোক চলাচল বন্ধ হয়ে যেত ও সন্ধ্যার পর গাঁয়ের রাস্তা  একদম জনশূন্য হয়ে যেত। ভয়ে মানুষ রাতের বেলা নামাজে মসজিদে একাকি যেতনা। কলেরার ভূত তাড়াতে রাতে লোকজন দল বেঁধে উচ্চশব্দে “ইসমে আজম জালালি, নূরের পয়দা রাসুলি। ইয়া সাত্তার, ইয়া গাফফার, হজরত আলীর জুলফিকার” জিকির করে করে বাড়ি বাড়ি মিছিল করে বেড়াতো। এই জিকিরের অর্থ যাই হোক না কেন, গ্রামের মানুষের বিশ্বাস ছিল হজরত আলীর(রাঃ) তরবারি জুলফিকারের নাম শুনলেই কলেরার দৈত্য ভয়ে দেশ ছেড়ে পালায়। আমাদের বাড়িতে মেহমান এলে রাতে এধরনের জিকির শুনলে ঘুম হতে উঠেই চানাস্তা ফেলে রেখে তাঁরা দাউদপুর ছেড়ে ভূদৌঁড়ে পালাতেন।

কোন এক বন্যার সময় আমাদের গ্রামের একজন লোক দড়াগ্রামে আত্মীয় বাড়িতে গিয়ে কলেরা বা ডায়রিয়া হয়ে মারা যায়। দড়ার ভীতসন্তস্ত্র মানুষ লোকটির লাশ নৌকায় তুলে দাউদপুরের দিকে পাঠিয়ে দেয়। দাউদপুরের মানুষ ভয়ে এই লাশ এখানে ভিড়াতে দিতে রাজী নয় শেষে এই দুইগ্রামের ঠেলাঠেলিতে পড়ে মৃতের আত্মীয়স্বজনরা মাঝহাওরের এক উচু মাটির ডিবিতে লাশটি দাফন করতে বাধ্য হন। কেউকেউ বানিয়ে বানিয়ে রাতে কলেরার উচকোকুচকো চুলওয়ালা ভুত দেখার ভয়াল গল্প বলতেনআবার কেউকেউ আয়াতুল কুরশি কিংবা সুরা ইখলাছ পড়ে কলেরার কিম্ভুতকিমাকার ওলাউঠা ভূতকে ঝাড়ু মেরে তাড়ানোর কাহিনি বলে বলে সাহসের বাহাদুরি জাহির করতেন

দাউদপুর মাঝপাড়ার একজন লোক বর্ষার স্রোতে নালার মুখে ত্রিকোনজাল ফেলে হাঁটুজলে দাঁড়িয়ে মাছ ধরছিলেন। তখন আকাশের মেঘে বিদ্যুৎ চমকানোর সাথে সাথে বৃষ্টি হচ্ছিল। হঠাৎ বজ্রপাতের কানফাটা আওয়াজ শুনে লোকজন চেয়ে দেখে জলে তাঁর লাশ ভেসে আছে। লাশ রাস্তায় এনে দেখা গেল শরিরে কোন জখমের চিহ্ন নেই। এই হতভাগা লোকটি ছিলেন খুব ধার্মিক ও ভালমানুষ। লোকজন ভেবে কূলকিনারা করতে পারলনা এত ভাল একজন মানুষের মাথায় কেন আল্লার গজব ঠা ঠা পড়ল। কেউ কেউ ভাবল হয়ত এমন কিছু একটা কারণ আছে যা কেউ জানেনা। দাউদপুর ঈদগাহে আমরা তাঁর জানাজা পড়ি। লোকে বলাবলি করে, বজ্রপাতে মরা মানুষের লাশে মূল্যবান চুম্বক পাথর থাকে, যে পাথরের নাম চকমকি পাথর। এই চকমকি পাথরের লোভে চোরেরা লাশ কবর থেকে চুরি করে নিয়ে যেতে পারে। তাই মানুষ বুড়িবরাকপারের এই কবরটি বেশ কয়েকদিন নজরদারিতে রাখেন। 

আমার খুব শৈশবে পাশের গ্রাম তুড়ুকখলায় দুইজন অস্বাভাবিক শারীরিক গঠন ও মানসিক আচরণের অটিস্টিক জোড়ভ্রাতা ছিলেন। দেখতে অবিকল একই চেহারা ও আকার আকৃতির এঁরা দুইভাই একসাথে চলাফেরা করতেন এবং লোকজনের সাথে তাঁরা তেমন মিশতেন না। সেকালের মানুষজন জ্ঞানের অভাবে তাদেরকে অবহেলা ও হাসিটাট্টা করত। ফলে মানুষের সাথে তাদের একটি দুর্ভেদ্য দেয়াল তৈরী হয়ে যায় এবং তাঁরা সাধারণ মানুষকে এড়িয়ে যেত। এই দুইভাই সম্পর্কে সেকালের মানুষের এক অদ্ভুত ধারণা প্রচলিত ছিল। তারা মনে করত এই দুইভাই দেও অর্থাৎ জ্বীন, তাই ওদের দেখলেই বলত ‘মছার দেও’ আসছে। ছোট ছোট বাচ্চারা প্রতিবন্ধী এই দুইভাইকে দেখলে জ্বীন মনে করে দৌড়ে পালাত। আমার মনে খটকা লাগত দেখতে অবিকল মানুষ এরা আবার ‘দেও বা ভূত’ হয় কেমন করে। বড় হয়ে অনুসন্ধান করে যা জানলাম তা বেশ আকর্ষণীয়। এই দুই ভাইয়ের মাকে কিশোরী বয়সে নাকি জ্বীনে ধরত, তাই ভয়ে কেউ তাকে বিয়ে করেনি। একসময় এই মনরোগগ্রস্ত যুবতীর উদরে জোড়বাচ্চা এলে গোজব রটে গেল তিনি জ্বীনের মাধ্যমে গর্ভবতী হয়েছেন। কিছু হুজুরও ধর্মীয় কিতাব ঘেটে বললেন, জ্বীনে মানুষে বিয়েসাদি হতে পারে, এমনকি যৌনমিলনও ঘটতে পারে। এসব শুনে সেকালের অজ্ঞ ধর্মান্ধ লোকজনও বিশ্বাস করে নিল এই দুইভাইয়ের বাবা কোন এক অদৃশ্য জ্বীন। হয়ত আশপাশের কোন এক সুচতুর বদমায়েশ অমানুষ অপকর্ম করে অদৃশ্য জ্বিনের উপর দোষ চাপিয়ে নিজেকে সুকৌশলে আড়াল করে নেয় এবং মানসিক প্রতিবন্ধী এই দুইভাই জ্বীনের সোহবতে মানবীর গর্ভে জন্ম নেওয়া বাচ্চা ‘মছার দেও’ হয়ে অবহেলা অনাদরে জীবন কাটায়। 

এখন আমার কৈশরে চৌধুরীবাজারে জন্ম নিয়ে পরে মরে যাওয়া দুইটি সংঘের কাহিনি বলবচৌধুরীবাজারে উরফি মিয়ার টিনের পাকা ঘরে একদিন উদয়ন সংঘ নামে একটি অরাজনৈতিক যুবসংস্থার অফিস হয়। তুড়ুকখলার দক্ষিণপাড়া ও বাড়বাড়ির তরুণরা এই সংঘের সদস্য হন। এই সংঘের সদস্যরা তুড়ুকখলার বিশেষ শ্রেণিগোষ্ঠির লোকজন, যারা ভাবতেন তাঁরা সেখানকার অভিজাত। তুড়ুকখলার অনেকে এখানে ঠাঁই ও সম্মান না পেয়ে আমার বড়ভাই তাহমিদ চৌধুরী, শাহনেওয়াজ ভাই, কামরান ভাতিজা ও তারেক ভাইকে নিয়ে একতা সংঘ নামে এই বাজারে আরেকটি সংস্থার জন্ম দেন। তুড়ুকখলার মালন ভাই, ফুরুক আলী, লেইস মিয়া, খঞ্জর মিয়াসহ অনেকে এতে যোগ দেন আমার ভাই তাহমিদ চৌধুরী সবার জন্য একতা সংঘের দরজা খোলে দেন। দাউদপুরের গিয়াসুদ্দিন, বাদল, আলাউদ্দিন, ফারুক মিয়া, মইনুদ্দিনসহ ধর্ম বর্ণ গোষ্টি নির্বিশেষে সবাই এখানে ঢুকে যান।

একতা সংঘ তুড়ুকখলা ও দাউদপুরের সব শ্রেণির মানুষকে ঠাঁয় দেয়। একতা ও উদয়ন এই দুই সংঘ অফিসে সারাদিন চলত ক্যারম, দাবা ও তাস খেলা। খেলার পাশাপাশি চলত সমতালে রঙিন আড্ডা ও চানাস্তা

নানান অনুষ্ঠান করা নিয়ে দুই সংঘের মাঝে চলত তীব্র প্রতিযোগিতা। উদয়ন সংঘ সিলেট থেকে শিল্পী এনে করে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সাথে সাথে একতা সংঘ খাসি রান্না করে সিলেট থেকে হিমাংশু বাবু, মালতী পাল ও মুফতি জামাল উদ্দিন হাসান বান্নাকে সদলবলে এনে আর বড় মাপের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করে। একদল খেলার আয়োজন করলে অন্যদল আর বড় খেলা ডাকে। একদল বৃক্ষরূপণ করলে অন্যদল বিনামূল্যে মেডিকেল ক্যাম্প করে। এভাবে চৌধুরীবাজারে সব সময় এই দুই সংঘের মধ্যে প্রতিযোগিতা লেগেই থাকত যেন ভারত পাকিস্তানের লড়াই। এই লড়াইয়ে জয়ী হতে একতা সংঘের ধনবান সদস্য ও নেতা মালন ভাই দুইহাতে মাল ঢালেন।   

দাউদপুরের বাদলের নেতৃত্বে একরাতে উদয়ন সংঘ অফিসে এক চুরি সংঘটিত হয়। সাইনবোর্ডসহ উদয়ন সংঘের সব মালামাল উদাও হয়ে যায়। তারা থানায় গেলে রহস্যজনক কারণে পুলিশ তাদের মামলা নেয়নি। তাহমিদ ভাই, শাহনেওয়াজ ভাই, কামরান ভাতিজা ও মালন ভাই লন্ডনে চলে গেলে একতাসংঘের সদস্যদের উৎসাহে ভাটা পড়ে কাজকর্ম স্থিমিত হয়ে যায়। আসলে এই দুই সংঘের সদস্যরা এক সময় জীবন ও জীবিকার তাগিদে দেশবিদেশে পাড়ি জমান। ফলে এই দুই সংঘধুমকেতুর মত চৌধুরীবাজারে উদয় হয়ে অর্থ ও কর্মীর অভাবে সময়ান্তে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়।

এখন আমাদের সময়ে গ্রামের খেলাধুলা নিয়ে গল্প করব। নৌকাবাইচের কথা আগে বলা হয়ে গেছে, তাই এই বিষয়টি এখানে আনবনা। শীত ও বসন্তে ঘুড়ি উড়ানোর মজাই ছিল আলাদা। আমি ছোটভাই নিশাতকে নিয়ে উত্তর হাওর ও পুব হাওরে লম্বা লেজওয়ালা ঘুড়ি নিয়ে দৌড়াতাম। গ্রামে বেলম নামের এক ধরনের বুনো ফল হত। বেলমের আটা দিয়ে চিটিপত্রের খাম বনধ করা হত। বেলম ফলের গাম দিয়ে ভাঙ্গা কাঁচগুঁড়ো নাটাইয়ের সুতায় মাখিয়ে ঘুড়িদের মধ্যে মারামারি করা হত। বিজয়ী ঘুড়ি আকাশে পতপত করে উড়ত, পরাজিতটি কেটে নিচে এসে পড়ত। এই ঘুড়িখেলা সবাই বেশ উপভোগ করত।

মনে পড়ে আমি জীবনের প্রথম যে ঘোড়ায় চড়ি সেটি হাড়িয়ারচরের কুতুবের ঘোড়া। কুতুব আলী ছিল শৌকিন সুদর্শন লোক, যদিও তাঁর দেদার টাকাকড়ি ছিলনা। একদিন কুতুব তাঁর ঘোড়া নিয়ে আমাদের বাংলোয় আসে। কুতুবকে বললাম আমার বড় শখ ঘোড়া চড়ব কিন্তু আজও ঘোড়া চড়া হয়নি। কুতুব বলল, চদ্রিসাব, ঘোড়া চড়া পানির মত সহজ, অশ্বপীঠে উঠে পড়ুন। ঘোড়ার পিঠে উঠতে গিয়ে হোচট খাই, অনেক চেষ্টায় ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে দেখি উপরে টিকে থাকা বেশ কঠিন। ঘোড়া হাটামাত্র ভারসাম্য রাখতে না পেরে পড়ে যাই। নানাবাড়ি পাতারিয়ায় বাল্যকালে হাতি চড়ি। মাহুত হাতিকে লেট, লেট বলামাত্র হাতি লেটে (বসে) যেত। আমরা হাতির সুঠাম গাত্র বেয়ে সুপ্রশস্ত পিঠে চড়ে বসতাম। হাতি ধীর পায়ে হেলেদোলে শান্তভাবে চলত। মাহুত আবার লেট বললে ধীরলয়ে বসে যেত। মাহুত আমাদেরকে নামিয়ে নিত। কিন্তু ঘোড়ার পিঠ ছোট ও অস্থির। একটু চড়েই বুঝলাম ঘোড়সওয়ার হওয়া এত সহজ কাজ নয়। ঘোড়াচালক হওয়া আর কঠিন কাজ, তাতে গাড়ি চালনার মত যথেষ্ট প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতার দরকার। আমার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট মাবাপের একমাত্র পুত্র কুতুব আলী আজ দুনিয়ায় নেই। আল্লাহ তাঁর মঙ্গল করুন। 

একবার ফয়জুলের সাথে উত্তর হাওরের উত্তরপারের জনপদে ঘোড়দৌঁড় দেখতে যাই। হাওরে কলাগাছ গেথে গেথে ঘোড়দৌঁড়ের লাইন টানা হয়। শত শত লোক ঘোড়দৌঁড় দেখে উল্লাস করে। একজন লোক এসে বালক আমাকে পরিচয় জানতে চাইল। আমি পরিচয় দিলে লোকটি উপদেশ দিল আপনি রাত নামার আগেই দাউদপুর ফিরে যাবেন, বিপদ আপদ ঘটতে পারে। আমি ফয়জুলের কাছে জানতে চাইলাম এই লোকটা কেন আমাকে যেচে উপদেশ দিচ্ছেনসে বলল আপনার পরিচয় জানতে পেরে সে এই উপদেশ দিচ্ছে। বিকালে ঘোড়দৌঁড় সমাপ্ত হলে দাউদপুরের অজস্র মানুষের মিছিলে ঢুকে হাওরের আলপথে দেড় দুই মাইল হেঁটে বাড়ি ফিরে আসি।

সেকালে ষাড়ের লড়াই ছিল গ্রামবাসীর এক মহাআনন্দ উৎসব, লোকে বলত বিছাল লড়াই। একবার সবগুলো রাস্তা দিয়ে সিরাজপুরের মাঠে হাজার হাজার লোকের মিছিল যাইতে দেখি। লোকমুখে শুনলাম এই মাঠে বিছাল লড়াই হবে। জনতার মিছিলের মাঝে মাঝে জটলা বেঁধে কাঁধে ভারী গোঁজ ও মাথায় লম্বা শিংওয়ালা বিশাল বিশাল হস্তী আকৃতির মোঠা মোঠা ষাড় তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছেন কয়েকজন তাগড়া জোয়ান। এই লোকদের মাথায় গামছা বাঁধা ও হাতে লম্বা বাঁশের লাটি। সবকটি বলদের গালায় ফুলের মালা, শিংয়ে রঙের কারুকাজ। বিজয় নিশ্চিত করতে কোন কোন বলদের গলায় ঝুলছে হুজুরের দেওয়া তাবিজকবজ। চৌধুরীবাজারের ব্যবসায়ী পশ্চিম দাউদপুরের ভিরাই বাবুর ষাড়টিকে নিয়ে আমরা দাউদপুরের শতশত লোক দারু ফূর্তি করে সিরাজপুরের বন্দে উপনীত হই। এক একটা ষাড়কে কেন্দ্র করে এক একটি গ্রামের লোক জটলা বেঁধে মাঠে মাঠে হৈ হৈ রৈ রৈ করছে। লড়াইয়ের সরগরম মাঠের চারপাসে সীমারেখা আঁকা, সীমানা বরাবর অগুতি মানুষের ঠেলাঠেলি। লোকজনের ধাক্কাধাক্কি সামাল দিতে ভলেনটিয়ারদের নাজেহাল অবস্থা।

হাতে লাটি ও মাথায় গামছা বাঁধা জোয়ানরা দুই প্রতিদ্বন্দ্বী ষাড়কে দড়িফাগায় শক্ত করে বেঁধে টেনেহেচড়ে এনে মুখোমুখি দাড় করান। ষাড়েরা পায়ের খুর দিয়ে মাটিতে লাতি মেরে উত্তেজিত হয়ে উঠে। তারপর একে অন্যের শিঙয়ে শিং লাগিয়ে শক্তিযুদ্ধে নেমে পড়ে। মজা হয় যেইমাত্র একটি ষাড় হেরে ভূদৌড় দেয় ও জয়ী ষাড়টি পিছু পিছু তাড়া করে। তামেশখুর জনতার দল ষাড়ের তলায় পিষ্ট হবার ভয়ে চিৎকার দিয়ে খোলা মাঠের যে যেদিকে পারে দৌঁড়ে পালায়। ষাড়ের লড়াই শেষ হলে দেখা যেত প্রতিটি ষাড়ের শরীরের কোন না কোন মারাত্মক জখম ও চর্ম ছিড়ে রক্ত ঝরছে। ষাড়েরা এত মানুষের হট্টগোল দেখে ভয় পেয়ে যেত। ফলে পাঁচ ছয় মিনিটের ধাক্কায় খেলা খতম হয়ে যেত।

এইদিন আমাদের ভিরাই বাবুর ষাড়টি বিজয়ী হলে দাউদপুরের শতশত লোক “জিতল রে জিতল, দাউদপুর জিতল” শ্লোগানে আকাশ বাতাস মুখরিত করে আহত ও রক্তাক্ত বিজয়ী ষাড়টিকে গলে ও গুজে পুস্পমাল্য পরিয়ে একজন বীরের মর্যাদায় চৌধুরীবাজারে নিয়ে আসেন। ভিরাই বাবুর ষাড় যেখানেই যায়, সেখানেই যুদ্ধে জয়ী হয়। এই কিংবদন্তি ষাড়ের এত মানসম্মান দেখে হিলাইগঞ্জের ধনী মোক্তার লন্ডনি স্বপ্ন জাগে ষাড়টির মালিক হবার, তিনি এসে ভিরাই বাবুকে বললেন আমি লাখ টাকা দেবো, ষাঁড়টি আমার কাছে বিক্রি করে দিন। ভিরাই বাবু বললেন এই ষাড় আমার অহংকার, এই ষাড় প্রতিটি লড়াইয়ে আমাকে সম্মান এনে দেয়, লাখ কেন কোটি টাকা দিলেও বেঁচবনা। দাউদপুরের জনতাও সায় দেন, ভিরাই বাবুর কেন, এই বিছাল পুরো দাউদপুর ছয়কুফার সম্পদ, ছয়পাড়ার ইজ্জত। আমরা টাকা চাইনা, ইজ্জত চাই।  

তবে ভিরাই বাবুর ষাড়টি বারবার জয়ী হওয়ার একটি গোপন মারেফতি আছেদাউদপুরের জনসংখ্যা খুব বেশি, তারা যেদিকে ছুটত সেদিকে লোকবন্যা বইয়ে দিত। মাথায় গামছা বাঁধা যেসব লাটিধারী জোয়ানরা ষাড়টিকে নিয়ে যেত, তাদের লাটির গোত্ত ও তাড়া খেয়ে প্রতিপক্ষের ষাড়টি ভয়ে রণভঙ্গ দিয়ে পালাত। দাউদপুরের এই বিশাল জনতা ও জোয়ানদের ভয়ে প্রতিপক্ষের ষাড় কেন লোকজনও ভড়কে যেত ও তাদের ষাড়টিকে ঠিকমত পরিচালনা করতে ব্যর্থ হত। আসলে লড়াইয়ে ভিরাই বাবুর ষাড়টির বিজয়ে ষাড়ের চেয়ে পিছনের এই ভলেন্টিইয়ার জোয়ানদের অবদান ছিল অনেক বেশি। আমার মনে হয় মুক্তার লন্ডনি অগ্নিমূল্যে ষাড়টি কিনে নিলে লড়াইয়ের মাঠে গিয়ে তিনি হয়তবা ঠকাই খেতেন এবং অবাক হয়ে ভাবতেন, হায় হায় রে ব্যাপারখানা কি?

আমাদের শৈশবে মানুষ ক্রিকেট খেলার চর্চাত দূরের কথা ঐ খেলার নামই জানতনা। তারা দলবেঁধে কাবাডি ও ফুটবল খেলত। মাঝে মধ্যে বিবাহিত বনাম অবিবাহিতদের মধ্যে কবাডি খেলা হত। এধরনের আনন্দঘন প্রতিযোগিতায় প্রায়ই বিবাহিত বয়স্করা হেরে যেত ও অবিবাহিতদের নিচে চাপা পড়ে দর্শক হাসাত। বাচ্চাদের হাতে গো-হারা হওয়া বিবাহিত বুড়োদের দুরাবস্থা দেখে দর্শকরা খিলখিল করে হেসে পেটে বিষ ধরাত। কয়েকজন খেলোয়ারের মুখোচ্ছবি চোখে ভাসে, তাঁরা রফিক আলী, বাচ্চু, ফারুক আহমদ, গৌছঊদ্দিন, ফয়জুল আলী, মানিক আলী, আলমাছ আলী, মন্তই আলী, কুটন আলী, বতাই আলী, তছব্বির আলী প্রমুখ। কর্দমাক্ত মাঠে কবাডি খেলে কাদামাখা হয়ে খেলাড়ুরা এসে আমাদের বড়পুকুরের বেরাঘাটে ঝাঁপ দিত। 

ছয়পাড়ার কাবাডি প্রতিযোগিতায় প্রায়ই গাংপার বিজয়ী হত। গাংপারের খেলোয়াররা ছিল ভীমকালো ও স্থূলকায়, যেন শিল্পী এস এম সুলতানের আঁকা অবিকল পেশীবহুল তাগড়া কৃষক। তাঁদের মধ্যে নূরন আলী, তেরা ভাইয়ের নাম মনে আছে।  

আমার প্রিয় খেলা ছিল ব্যাডমিন্টন। অবর্ষায় প্রতিদিন বিকেলবেলা ঠিকাদার বাড়ির সামনের মাঠে আমি, যুক্তরাজ্য প্রবাসী গৌছউদ্দিন ও ইব্রাহিম আলী মিলে ব্যাডমিন্টন খেলতাম, অন্ধকার নামার আগেই ঘরে ফিরতাম। সুদর্শন ইব্রাহিম খুব ভাল ব্যাডমিন্টন খেলত। মাঝে মাঝে সারাদিন চলত মার্বেল খেলা। নানা রঙের ছোট ছোট গোলাকার মার্বেল ছিল দামে সস্তা ও সহজলভ্য। বিজয়ীরা প্রচুর মার্বেলের অধিকারি হত এবং কে কতটি মার্বেলের মালিক হল তা মহানন্দে গণনা করত।

২০২০ সালের ১৪ নভেম্বর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসাবে আমি দাউদপুর জি ইউ সিনিয়র মাদ্রাসার গবর্নিং বডির সভায় যাই। সেদিন আসরের নামাজের পর আমার কৌশরে বেডমিন্টন খেলার সাথী প্রিয় ইব্রাহিম আলীর নামাজে জানাজায় শরিক হই। সে দীর্ঘদিন বিদেশে ছিল। অসুস্থ হলে দেশে ফিরে আসে এবং মাত্র আটচল্লিশ বছর বয়সে মারা যায়।   

আজিকার যুগে মানুষ যেমন ক্রিকেটের জ্বরে ভোগে, আমাদের শৈশবে মানুষ তেমনি ফুটবলের জ্বরে ভোগত। আবাহনী ও মহামেডানের মধ্যে খেলা হলে মারামারি করে প্রায়ই লোকজন মারা যেত। এই দুই দলের সমর্থক সারা দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। রেডিওতে ধারাভাষ্য শুনে দেশের সর্বত্র সমর্থকরা চিৎকার করে উঠত। আমাদের গ্রামের পাড়ায় পাড়ায় ফুটবলের মাঠ ছিল। হেমন্তে ধানকাটা শেষ হলে মাঠগুলো তৈরি হত। বর্ষার জলে জমি কাদাসিক্ত না হওয়া পর্যন্ত ফুটবল খেলার কোন ইতি হতনা। দাউদপুর গ্রামের দক্ষিপুর্ব অগ্নিকোনে দড়ার রাস্তার পাশে ছিল ফুটবলের বিশাল মাঠ। এটি গ্রামের বড়মাঠ, এখানে প্রতি বছর ফুটবল টুর্নামেন্ট হতএই মাঠে আমি ল্যংড়া ডান পা নিয়ে বলের পিছুপিছু ছুটাছুটি করে ক্লান্ত বিকেলে ঘর্মাক্ত কলেবরে বাড়ি ফিরতাম।

আর দশগ্রামের মত এখানে ফুটবল টুর্নামেন্ট হত, প্যান্ডেল তৈরি হত, মাইক বাজত, রঙিন কাগজের ফ্ল্যাগ উড়ত, জার্সি ও বুটপরা খেলোয়াররা আসতেন। ফাইনেল খেলায় সাধারণত আব্বা সফিকুর রহমান চৌধুরী লেফারি হতেন এবং খেলাশেষে আব্বার হাত থেকে বিজয়ীরা পুরস্কার গ্রহ করতেন। মাঝে মাঝে ফুটবল টুর্নামেন্টে খেলা নিয়ে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটত, আবার মিটমাটও হত। আশপাশে উৎসব উৎসব পরিবেশ বিরাজ করত।

এবার চলে যাব তুড়ুকখলা ফুটবল মাঠে। তুড়ুকখলা পাঠশালার পুর্বসীমানা হতে বুড়িবরাকের পার বরাবর  ছিল দুই ফার্লং বিস্তৃত এক বড় শনখিত্তা। এই শনখিত্তার সাথে ছিল এক বিরাট ফুটবল মাঠ, যে মাঠে প্রতি শুক্রবার বিকেলে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী তুড়ুকখলা ও দাউদপুরের মধ্যে অনুষ্ঠিত হত প্রীতিফুটবল ম্যাচ। এখানে প্রায়ই লেফারি হতেন তুড়ুকখলার সমন হাজি। বেঁটে কালো দাড়িওয়ালা মুরব্বী সমন হাজি বেশ সুন্দর খেলা পরিচালনা করতেন তিনি একহাতে নিতম্ব কুচকাতেন, অন্যহাতে বাঁশী বাজাতেন। লোকে বলত হাজির পাছা দাউদে জ্বালায়। অসীম ধর্য্যশীল সমন হাজি, তাঁর পুত্র খঞ্জর মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায় মারা গেলে উহটি করেননি, সব আল্লার ইচ্ছে, আল্লাহ খুশ তো আমি খুশ, বলে হাসিমুখে পুত্রের ভারি লাশ কাঁধে তুলে নেন।

ফেঞ্ছুগঞ্জী মাস্টার লেফারিগিরি করলে কেউ কেউ তাকে মানতনা, তাই বারবার হাঙ্গামা বেঁধে যেত। কোন এক গোপনীয় ঘটনায় দাউদপুর মাদ্রাসায় তাঁর চাকুরি চলে যায়। আব্বা সফিকুর রহমান চৌধুরী লেফারি হলে মাঠে কিংবা মাঠপারে টু শব্দটি হতনা। কার আব্বা ছিলেন দুইগ্রামের সবার শিক্ষক, পুতের স্যার, বাপের স্যার, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে দাদুরও স্যার। তাই তিনি লেফারি হলে মাঠে এক পিনপতন নীরবতা বিরাজ করত।

শুধু বংশমর্যাদার কারণে যে আব্বার নির্দেশনা মানুষ মানত তা নয়, তিনি বৃটিশামলে কোলকাতা মহামেডানের বেকের খেলোয়ার ছিলেন তিনি ছিলেন ক্রীড়াবিদ, সংস্কৃতিসেবী এবং একজন সালিশ ব্যক্তিত্ব। বেডমিন্টন, কাবাডি, ভলিবলেও পারদর্শী। দুইগ্রামের এই মিলন ও ভালবাসার খেলায় আব্বা সফিকুর রহমান চৌধুরী ওরফে দলুমিয়া স্যার ছিলেন সবার আশার আলো। দুই গ্রামের মান্যবর আব্বা সফিকূর রহমান চৌধুরী মাঠে অনুপস্থিত থাকলে কোন না কোন হাঙ্গামা বেঁধে যেত। তিনি লেফারি হলে সবাই নিশ্চিন্ত থাকতেন খেলা সুন্দর হবে, ঝামেলামুক্ত হবে। দাউদপুর ও তুড়ুকখলার এই ফুটবল প্রতিযোগিতা ছিল যেন আবাহনী ও মহামেডানের মধ্যকার ফুটবল ম্যাচের একটা গ্রাম্য মিনিয়েচার।

দাউদপুর ছয়কুফার দর্শকরা মাঠের উত্তরের শনখিত্তা ও পশ্চিমদিকের আলে বসতেন, মাঠের পূর্ব ও দক্ষিণদিকে তুড়ুকখলার জনতা জমির আলে বসে খেলা উপভোগ করতেন। একবার দাউদপুর জিতলে পরেরবার তুড়ুকখলা বিজয়ী হত। এই হারজিত পালাক্রমে দুইগ্রামের মধ্যে অবিরাম চলত। একদিন আব্বা মাঠে ছিলেন না, সমন হাজি একটি ফাঊল ধরেন। একজন খেলোয়ার প্রতিবাদ করেন। খেলোয়ারদের বাধানুবাদ চলাকালে দুই চারজন উত্তেজিত দর্শক ছাতি হাতে মাঠে নেমে যান, সামান্য হাতাহাতি হওয়ামাত্র শুরু হয় দুদিক হতে অজস্র মাটির ঢেলা বর্ষ  

দুই গ্রামের মুরব্বীরা এই ঢিল ছুড়াছুড়ি বন্ধে আপ্রা চেষ্টা করেন। এখানে কেউ কারো শত্রু নয়, তাই কেউ কাউকে আহত বা জখম করার জন্য যে মারামারি করছে এমনটি মনে হলনা। লাটিসড়কিবিহীন এই খালিহাতের মারামারিটাও যেন দর্শকদের আরেক মজার খেলা। কেউ কাউকে মারধর করছেনা কেবল দুদলের ছোড়া অজস্র মাটির ঢেলা বৃষ্টির মত এসে পড়ছে শুন্য মাঠের মাঝখানে। এই রসাল ঢিল বর্ষ থামাতে গিয়ে বরং দুই গ্রামের কয়েকজন মুরব্বী দুইচারটা ঢিল খান। ঢিলের আঘাতে দুই একজনের রক্ত ঝরে। 

রোজ রোজ প্লেয়াররা খেলা করেন আর আজ যেন দুই গ্রামের শতশত দর্শকরা ঢিল ছুড়াছুড়ির খেলায় মেতে উঠেন। এই মজার ডিল ছুড়াছুড়ি ঘন্টাদেড়েক সময়  অব্যাহত থাকে। ভাবি, আব্বা লেফারি হলে হয়ত এমন দুর্ঘটনা হতনা। আমি মনে ভীষণ কষ্ট পাই, কারণ সেদিনের এই সংঘর্ষ এই বছরের জন্য দুই গ্রামের সুন্দর টকমিষ্টি ফুটবল ম্যাচ প্রতিযোগিতায় বিরতি টেনে দেয়

আগামি শুক্রবার বিকেলে দুইগ্রামের এই মজার ফুটবল ম্যাচ হবেনা, যে খেলা উপভোগ করতে শত শত দর্শক তুড়ুকখলা মাঠে ভিড় জমাত। আহারে, বছর বছর ধরে চলা প্রতি শুক্রবার বিকেলবেলার বড় মজার এই খেইড়টা অকালে খতম হয়ে গেল। এই দুইগ্রামের কয়েকজন ফুটবল প্লেয়ারের নাম এখনো মনে আছে। দাউদপুরের গৌছউদ্দিন, কুঠন আলী, আলচন আলী, নুরন আলী, হুসেন আলী, মুছাব্বির আলী, মসরুউদ্দিন, আলাউদ্দিন, আলমাছ আলী, বাদল আলী, মন্তই আলী, আব্দুল মন্নান, আব্দুল হক, ফয়জুল আলী, মিসান আলী, মোস্তাক আলী ও গোলরক্ষক আব্দুল মালিক প্রমুখ। তুড়ুকখলার হয়ে খেলতেন সানু মিয়া, কিনু মিয়া, এনু মিয়া, সোনামনি, লেইস মিয়া, ওলি মিয়া, কাপ্তান মিয়া, মুক্তিযুদ্ধা মকবুল হোসেন ভান্ডারি ও গোলরক্ষক আদল মিয়া প্রমুখ।   

এইবার আমার খুব শৈশবের দুই ফকিরনির গল্প বলব, এদের একজন আমাদের কুনারপাড়ার হারি ও অন্যজন দড়াগ্রামের রই। তখন সদ্য স্বাধীন দেশে তীব্র অভাব অনটন, সকাল হলেই একের পর এক ভিক্ষুক ও ভিখারিনির আগমন ঘটত। ভিক্ষার চাল বা ধান আলাদা করে পাত্রে রাখা হত ও ফকিরদের কাঁধে ঝুলান কাপড়ের থলীতে দুধপটে করে ধান বা চাল ফেলা হত। ভিখারিনী হারি ও রই প্রতিদিন একবারের খাবার আমাদের পাকঘরে সেরে নিত। আম্মা আসমতুন্নেছা প্লেটে ভাত তরকারী এগিয়ে দিতেন, তারা খাট পিড়ে টেনে বারান্দায় বসে খেয়ে নিত। হারি আমাদের পাশের কূনারপাড়ার লোক, তিনি অধিকার বলে তার চৌধুরীবাড়িতে খাবার খান কিন্তু ভিনগাঁয়ের রই এসে রোজ রোজ খাবার খায় তা তিনি মেনে নিতে পারেন না। তাই রইকে দেখলেই তার গা জ্বালা করতএকদিন হারি ও রইয়ের মধ্যে ঝগড়া বাঁধে। ঝগড়ার এক ফাঁকে হারি খুব গর্বের সাথে রইকে বলল আমার বাড়ি এই কাছে, খবর নিয়ে দেখ আমার ইস্টিগোষ্ঠীর মধ্যে একমাত্র আমি ছাড়া কেউ ভিক্ষে করেনা, আর তর সারা হাবিগোষ্ঠি ঘুম থেকে ঊঠেই ফকিরের ছালা কাঁধে নিয়ে ভিক্ষায় বের হয়। এবার হারির কাছে রই হেরে যান এবং পরাজিত রই চুপ হয়ে যান। আম্মা বললেন আমাদের হারি শেষমেষ জিতে গেল। হারি তখন হেসে বলল, সে হারবেই তো মাইজি, আমি যে তার আসল জায়গায় ছোবল দিছি।

আমাদের কাজের মেয়ে শমি নানাবাড়ির হাসমতি ঝির মেয়ে, সে ছিল একদম মোঠামাথা, সে একদিন সদ্য মাটিলেপা পাকঘরে গিয়ে দেখে মোরগের পায়ের আচড়ে লেপা নষ্ট হয়ে গেছে। সে এসে আম্মাকে বলল, ফুফু একটা মূরগির দুই পা, লেপার উপর দেখি যত পা। আসলে একটিমাত্র মোরগ আঁচড়িয়ে সারা লেপা যে নষ্ট করে দিয়েছে তা তার বুঝে আসছেনা। তার এই বার্তা শুনে আম্মা হাসলেন।

এবার শৈশবে আমাদের খতনা দেবার গল্প বলব। খতনা করাকে বলা হত মুসলমানি করা। লোকের ধারনা ছিল খতনা করার পরই বালকেরা পুরাপুরি মুসলমান হয়। তাই খতনাহীন বালকদের বয়স বেড়ে গেলে লোকজন তা নিয়ে নানা মন্দ কথা বলত, ছেলে বুড়ো হয়ে যাচ্ছে, বিয়ের লায়েক হয়ে গেছে, এখনো খতনা হয়নি, ছিঃ ছিঃ। আল্লাহর রাসুল(সঃ) খতনা করেননি, ধারনা করা হয় তিনি খতনা নিয়েই জন্মগ্রহণ করেন। 

বর্তমান কালের মত সেযুগে চিকিৎসকের দ্বারা খতনা করার প্রচলন ছিলনা। খতনা করার পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিকে বলা হত হাজাম। গতবছর এই হাজাম চাচাতো মতি ভাইকে খতনা করে। সেকালে অবশ না করেই ধারালো ছুরি দিয়ে খতনা করা হত, যা ছিল খুব কষ্টকর। মতি ভাই, ও মাইগো, ও বাবাগো বলে ভীষণ চিৎকার দেন। তাঁর চিৎকারে আমাদের অন্তরাত্মা কেঁপে উঠে।  

আমার অগ্রজ তাহমিদ চৌধুরীর তখন খতনা হবার কথা ছিল কিন্তু মতি ভাইয়ের আর্তচিৎকার শুনে আম্মা আসমতুন্নেছা এবং বড়বোন রেহা সুকৌশলে তাকে ধানের গোলাঘরে লুকিয়ে রাখেন। চাচাতো মতি ভাইয়ের খতনা করা শেষ হলে আসে তাহমিদ ভাইয়ের পালা, কিন্তু সেবার অনেক খুজাখুজি করে কেউ তাকে বের করতে পারেনি, তাঁকে না পেয়ে হাজাম চলে গেলে আম্মা ও ফুলবুবু তাঁকে গোপন আস্থানা হতে বের করে নিয়ে আসেন। তাই তিনি সেযাত্রায় বেঁচে যান।

পরের বছর ধবল বরণ পাতলা দাড়ির সেই জল্লাদ হাজাম মিয়া আবার দাউদপুরের বাড়িতে শুভাগমন করেন। সাদা পাঞ্জাবী ও সাদা লুঙ্গিপরা মধ্যবয়সী হাজামের হাতে একটা পুটলা, এই পুটলার ভিতর ধারালো ক্ষুর, চিমটি, ঔষধ ও কিছু সাদা কাপড়ের টুকরো। খতনা করা হাজামের পেশা। তিনি যেখানেই যান একসাথে কয়েকজন বালকের লিঙ্গের আগার চামড়া কেটে অপসারণ করে দেন। বিনিময়ে তিনি প্রচুর এনাম পান। হাজামের এইবার খতনার এবিপদ এসে পড়ে আমি, ভাতিজা বদরু, বড়ভাই তাহমিদ ও খালাত ভাই তারেকের ঘাড়ে। হাজাম মিয়া উপস্থিতি টের পেয়ে তারেক ভাই ভয়ে হঠাৎ উদাও। তিনি বাড়ির পিছনের ঘনবনের ভিতরের খাল পেরিয়ে মাঝের বাড়ির শনবনে লুকিয়ে যান। প্রথমে বড়ভাই তাহমিদ গিয়ে একটি ঘাইলের উপর বসেন। তাঁর বয়স একটু বেশি, তার সাহস ও ধৈর্য্য ছিল অসাধারতিনি দুই চারবার শুধু উহ আহ করলেন।

আমি লুঙ্গিপরে আসনে বসার পর জইর পুতি আমাকে আকড়ে ধরেন। চাচাত ফরহাদ ও ফজলু ভাই দুইপা চেপে ধরেন। পিঙল চোখের হাজাম একটি বাঁশের চিমটা দিয়ে অগ্রভাগ আলাদা করে চেপে ধরে ধারাল খুর দিয়ে চামড়া কেটে দেয়। মূহূর্তেই কাজ শেষ, আমিও একটু উফ উফ করলাম অনুচ্চ শব্দে।  

সমস্যা হয় ভাতিজা বদরুর খতনায়। তার অগ্রভাগের চামড়া আমাদের মত আলাদা ছিলনা। তার সংযুক্ত চামড়া আলাদা করতে অতিরিক্ত কষ্টপেতে হয়। বাঁশের ধারালো কাটি ঢুকিয়ে কিভাবে যেন আগার মাংশ হতে চামড়া আলাদা করে। বদরুর বয়স অল্প, সে ভয় পেয়ে ভীষ চিৎকার ও লাফালাফি করে। জবাইয়ের গরু ধরার মত বেশ কয়েকজন তাকে শক্ত করে চেপে ধরেন।

তারেক ভাই খতনা হতে রক্ষা পেতে পিছনের শনবনে পালিয়ে যান। বদরুর খতনা বেশ লম্বা সময়ে শেষ হয়। এবার তারেক ভাইয়ের ডাক পড়ে। কিন্তু তারেক ভাই লাপাত্তা। তাঁর খোঁজে বেশ তল্লাশি অভিযান চলে। পুলিশের দল আসামীর কোন সন্ধান না পেয়ে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে। এদিকে রাত ঘনিয়ে এসেছে, হাজাম মিয়া আর কত বসবেন। তিনি বিদায় নিলেন। বদরুর আর্তচিৎকার শুনে ভয়ে রাত কালো হওয়ার আগ পর্যন্ত তারেক ভাই সেখানে লুকিয়ে থাকেন। বন হতে বের হয়ে জল্লাদ হাজামটা এখন নেই, এখবর নিশ্চিত হবার পর তারেক চৌধুরী ঘরে ফিরেন। স্বজন ও প্রতিবেশীরা পরদিন অজস্র খাবারদাবার ও উপহারসামগ্রী নিয়ে আমাদেরকে দেখতে আসেন। সবার ক্ষতস্থানে খানিক ইনফেকশন হয় এবং জলগোটা জমে যায়। পুরো ভাল হতে বেশ কিছুদিন পার হয়। কয়েকদিন পর সাদা কাপড়ের পট্টি খোলা হয়। তখন লুঙ্গি পরে হাঁটতে গেলে কেমন যেন অশ্বস্তি লাগত। 

এবার আমার এলাকার বাল্যকালের চার চোরার গল্পচার করব। মাঝপাড়ার ইজ্জাদ চোরা এসে প্রতিরাতে বাড়ির কোন না কোন পাকঘরে ঢুকে খাবার খেয়ে যেত। সে বেশি মোরগ চুরি করত। কুট্টির তালা ভেঙ্গে বস্তায় পুরে মোরগ এমন কৌশলে ধরত যে মোরগরা কোন শব্দ করতনা। লোকে বিশ্বাস করত সে নাকি ধূলপড়া ছিটিয়ে মোরগের জবান বন্ধ করে দেয়। 

ইজ্জাদ চোরা একবার সিঁদ খনন করে আমাদের পাশের মুহিব চাচার ঘরে ঢুকে কাপড় চোপড় ও মালামালের সাথে খুব শখের বড় রেডিওটা চুরি করে নিয়ে যায়। 

তখন টেলিভিশন ছিলনা তাই গ্রামের ছেলেমেয়েরা শুক্রবারের অনুষ্ঠান শুনতে বারান্দায় রেডিওর কাছে ভীড় করত। ভাবতে অবাক লাগে বিদ্যুৎ টেলিভিশন ও মোবাইলহীন এক সুদীর্ঘ জীবনকাল আমরা পার হয়ে এসেছি। কই, তেমন তো কোন অসুবিধা হয়নি। 

চোর ধরার জন্য কেউ বাটি চালানের পরামর্শ দেন। আবার কেউ কেউ বললেন সুফানিঘাটের মন্তাজ আলী গন্তার (গণক) কাছে যান, তিনি চোর ও চোরাই মালের অবস্থান বলে দিতে পারেন। তবে ইজ্জাদ চোরকে ধরতে এসব পিরফকিরের কাছে যেতে হয়নি। চুরি হওয়া বড় রেডিও একজনের কাছে বেছতে গিয়ে ইজ্জাদ আলী ধরা খায়। ইজ্জাদ চোরাকে পিছমোড়া দিয়ে বেঁধে বাড়ির বাংলোয় আনা হয়। সেই স্মৃতি এখনও মনে হলে আমার গা শিউরে উঠে, যে লোকই আসে সেই লাটি ও রড দিয়ে তাকে অমানুষিক পিটুনী দেয় এবং সে কোনদিন চুরি করবেনা বলে হাউমাউ করে কেঁদে কেঁদে মাফ চায় তাঁকে আর না মারার জন্য মানুষের দুইপা জড়িয়ে ধরে। অমানুষিক মার খেয়ে সে কেবল ঝিমাতে থাকে। কেউ কেউ বলছে এই চোরের দেহে গন্ডারের চামড়া, এত মার খেয়েও সে মরছেনা। আমি খুব ছোট ছিলাম, আমার দয়ামায়া খুব বেশি, তাই এই নির্যাতন সইতে না পেরে বাংলো থেকে সরে পড়ি।

ছমির চোরা বলতে গেলে আমাদেরই লোক, সে আমাদের বাড়ি হতে বের হয়ে দড়ার মাঠে চলে যাওয়া কালই চৌকিদারের ভাগনা। চকচকে ভীমকালো ছমির আলী কখনও নিজগ্রাম দাউদপুরে চুরি করত না। ছমির আলী আমাকে খুব স্নেহ করত। আমি বললে সে যে কারো পিঠে লাটির ঘা বসিয়ে দিতে এক মিনিটও সময় নষ্ট করবেনা। বাহিরের গ্রামে চুরি করে ছমির আলী প্রায়ই জেলে যেত, তার জীবনের বেশিরভাগ সময়ই কারাগারে কাটে। গাংপারের মানিক চোরা ছিল হবিব সিদ্দিকি মৌলানার সহোদর, তাই লোকে বলত, একই মাতৃগর্ভে জন্ম নিয়ে একভাই আলেম, আরেক ভাই ডাকু জালেম। একই মায়ের গর্ভে জনম নিয়ে পাঁচ ভাই হয়ে যায় পাঁচ রকম, কেউ জানেনা কে হবে কেমন।

এবার চলে যাব পাশের গ্রাম তুড়ুকখলায়, সেখানে সজ্জাদ চোরের বাড়ি। এক শবেকদরের রাতে সে চুরি করতে তুড়ুকখলার কোন একঘরে সিঁদ কেটে প্রবেশ করে। গৃহকর্ত্রী জায়নামাজে সারারাত ইবাদাতে মশগুল থাকায় সে বিপাকে পড়ে। অনেক চেষ্টা করেও সোনাদানা ও টাকাকড়ির কক্ষে যেতে বিফল হয়। অবশেষে সে ঠিক করল সিঁদ খুড়ে যখন কল্লা ঢুকায়ে দিছি অন্ততঃ হাতের কাছে যা পাই একটা কিছু নিয়ে যাই। কিন্তু সিঁদের আশপাশে হাতড়িয়ে তেমন কোন মালামাল পাওয়া গেলনা। আবার হাত প্রসারিত করে পাওয়া গেল এককপি পবিত্র কোরান শরিফ। সজ্জাদ চোরা ভাবল, আজ পর্যন্ত সিঁদ কেটে কোন ঘর হতে শূন্য হাতে ফিরি নাই, এত সাধনার পর কিছু একটা না নিয়ে যাই কেমনে। শেষমেশ হাতের পাঁচ এই কুরান শরিফ চুরি করে সে সিঁদ দিয়ে বেরিয়ে যায়। পবিত্র কুরান চুরি করে সজ্জাদ চোর বাড়ি ফেরার পর তাঁর পেটে এক ভীষ ব্যথা শুরু হয়। এই মরণ ব্যথায় ছটফট করে করে কিছুক্ষণের মধ্যে চোরা সজ্জাদ আলী মারা যান । লোকে বলাবলি করল, আল্লার মার বড় মার, চুরি করতে করতে শেষপর্যন্ত আল্লাহ পাকের কিতাব চুরি, আল্লাহর সাথে হাতাহাতি। আল্লাহের বিচার নগদ বিচার, নগদ সাজা ।

তুড়ুকখলা ঈদগাহে সজ্জাদ চোরের নামাজে জানাজায় ঘটল আরেক নাটক। আমাদের অঞ্চলে মানুষের ধারণা কেউ মারা গেলে চল্লিশজন মানুষ যদি সাক্ষী দেয় মূর্দা ভাল মানুষ ছিলেন, তাহলে তিনি পার পেয়ে যান। সজ্জাদ আলীর জানাজার নামাজের পর একজন মুসল্লি দাড়িয়ে বললেন এই মুর্দার ইমান আমল কেমন ছিল? প্রচলিত নিয়মে আগের মত সবাই একবাক্যে সাক্ষী দিলেন, খুব ভালা কেবল একজন ক্ষেপাটে লোক বেশ জুরে চিৎকার দেন, ভাল নয়, খুব খারাপজানাজার লোকজন তাকে বলল লোকটা মারা গেছে, এই দুনিয়ার সব দায়দেনা তাঁর শেষ হয়ে গেছে, আপনি দয়া করে বলে দেন, খুব ভাল। 

কিন্তু এই বেরসিক ভদ্রলোক ফখরউদ্দিন ফখইমিয়া তখন বললেন, এই লোকটি আল্লার কিতাব চুরি করে আল্লার গজবে পড়ে মরেছে, আপনারা কি চান আমি আল্লার দরবারে ঐলোক সম্পর্কে মিথ্যা সাক্ষী দেই। এই মিছাসাফাই সাক্ষীর কারণে আল্লার গজব যদি আমার উপর এসে পড়ে তাহলে কি আপনারা সামাল দেবেন। একথা শুনে জনতা ভাবল তাঁর কথা তো ফেলে দেবার নয়। একটু আগে জানাজা শেষে মুর্দার আমল খাসলত ‘খুব ভাল’ বলে বাজারি মিথ্যা সাক্ষীদাতাদের এবার টনক নড়ে। তাঁরা ভীত হয়ে সবাই চুপসে যান এবং মিছা সাক্ষী দেওয়ার জন্য আল্লাহর দরবারে মাফ চেয়ে মনে মনে ওয়াসতাগফিরূল্লাহ ইন্নাল্লাহা গাফুরুর রাহিম পড়তে থাকেন।

ফখরউদ্দিন ফখই মিয়া ছিলেন তুড়ুকখলার বড়বাড়ির লোক, চৌধুরীবাজারে তিনি ফার্মেসি চালাতেন। তাঁর বড়ভাই নেখই মিয়া ছিলেন খুব ধনবান, কিন্তু তিনি অনেক সন্তানসন্ততি রেখে অকালে মারা যান। ভাইয়ের বেশ বড় সংসার টানতে গিয়ে ফখই মিয়া বিয়েসাদি করেননি, যদিও বয়স তখন চল্লিশ পেরিয়ে গেছে। আমি তাঁকে তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে বললে জবাব দিতেন, শুনো সেফাক মিয়া, সবার ভাগ্য সমান হয়না, কারো জীবন কাটে ভোগে, কারোবা কাটে ত্যাগে। আমাকে আল্লাহ ত্যাগের ঘরে ফেলেছেন। তবে আমি গ্রাম ছেড়ে আসার অনেক পর তিনি বিয়ে করেন এবং একজন পুত্রসন্থানের বাবা হন। তিনি সুন্দর ভাষণ দিতেন, ভাল গল্প বলতেন। আমি প্রায়ই তাঁর ফার্মেসিতে বসে আড্ডা দিতাম। 

ফখই মিয়ার ফার্মেসির আড্ডায় হাজির হতেন তুড়ুকখলার ললন মিয়া। ললন মিয়ার মাথায় পাতলা চুল, কথা বলেন ধিরে ধিরে। ভিলেজ পলিটিক্সে তাঁর ভীষণ ঝোঁক। বারবার দাউদপুর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারমেন পদে প্রার্থী হতেন এবং প্রতিবার হারতেন। চেয়ারমেন হবার স্বপ্ন তাঁর অধরাই থেকে যায়। এই ফার্মেসিতে আর দুইজন ভিলেজ পলিটিশিয়ানের সাথে মুলাকাত হত, তাঁরা তুড়ুকখলার মিনই ভাই ও দৌলতপুরের লিলুমিয়া। মিনই ভাই আমার বড়বোন রেহার সহপাঠি। কোটিপতি মনির আহমদের ভাগনা মিনই মিয়াও প্রায়ই চেয়ারমেন ভোটে প্রার্থী হয়ে প্রচুর টাকা ঢালতেন, লোকজন দেদারছে টাকা খেত কিন্তু ভোট দিতনা। লিলুমিয়ার মোটরসাইকেল প্রায়ই ফার্মেসির সামনে এসে দাঁড়াত। লিলুমিয়া একবারমাত্র সফল হন এবং পাঁচ বছর দাউদপুর ইউনিয়ন চেয়ারমেন ছিলেন। আমার কলেজ জীবনে দেখা আব্বার ছাত্র এই তিনজন মহান মানুষকে প্রায়ই মনে পড়ে, তারা আমাকে মনেপ্রাণে স্নেহ করতেন, অথচ আজ তাঁরা কেউই দুনিয়ায় বেঁচে নেই। আল্লাহ পাক তাঁদের মঙ্গল করুন।  

আমাদের দিঘির উত্তরের বাড়ির বাসিন্দা কটুবুড়া ছিলেন পাখিয়াল। ডাহুক, ময়না, টিয়া, কবুতর, তিতির ইত্যাদি পাখিপোষায় ছিল তার ভীষ শখ। তিনি কয়েকটি পাখিভর্তি পিঞ্জিরা নিয়ে আমাদের বাড়ির দিঘিঘাটে এসে পাখিদেরে গোসল করাতেন। তিনি পুকুর ঘাটে এলে আমরা ছোটরা এসে পাখি দেখতে ভীড় করতাম। গায়ের লোক বলত ঘরসংসার ফেলে রেখে কটু আলী পোষাপাখি নিয়ে এতই ব্যস্ত থাকতেন যে, একমাত্র পুত্র মোবারক আলীকে ফেলে রেখে তার বেগমপাখি পাশের বাড়ির ইসবর আলীর প্রেমে সাড়া দিয়ে উড়াল দেন, বিবির পালিয়ে যাওয়া তিনি ঘুণাক্ষরেও টাহর করতে পারেননি। একসময় মোবারক আলীর সংসার বড় হয়, মোবারক আলীর পক্ষে নিজের সংসার এবং সেইসাথে বুড়োবাপের বিশাল পাকপাখালীর সংসার টানা কঠিন হয়ে যায়। 

বুড়োবাপ কটু আলী ও বাপের পাখিসংসারের ভারী বুজা সরানোর পথ খুঁজে মোবারক আলী একদিন পাষাণ মোবারক তার বৃদ্ধ বাবার ভাতে বিষ মিশিয়ে দেয়। বাবা ভাত মুখের কাছে নিয়ে একটু কটুগন্ধ পেয়ে নিজে না খেয়ে প্রিয় তিতিরদেরে বিলিয়ে দেন বুড়ো কটু আলী বাঁচলেন কিন্তু তাঁর সব তিতির মরে সাফ। লোকে বলল, রাখে আল্লা, মারে কে? জীবনরক্ষার জন্য আল্লার দরবারে কটুআলীর যখন শোকরিয়া আদায় করার কথা, তখন তিনি চোখের জলে বুক ভাসিয়ে মাতম শুরু করলেন, ও আমার সোনার তিতির রে, আমারে তুইয়া তোমরা কই গেলায় রে

একরাতে দাউদপুর জামে মসজিদের চারতলা মিনারের সামনে ঘরফেরত পানবেপারীরা সাপের খপ্পরে পড়েনহঠাৎ অন্ধকারে তাদের সামনে এক বিশাল কালসাপ ফনা তুলে শিশ দেয়। তারা ভয়ে চিৎকার করে লাফ দিয়ে দূরে চলে যায় পানের বুজা ফেলে রেখে লাটি নিয়ে সাপ মারতে আসেতারা যতই লাটিপেঠা করেন সাপটি ততই লাফাতে থাকে। সাপটি মরছেনা দেখে সবাই ভীত হয়ে পিছুটান দেয়। রাস্তায় লোক চিলাচল বন্ধ হয়ে যায়। রাস্তা চালু করতে হবে তাই এবার মশাল নিয়ে সাপের দিকে কয়েকজন ছুটে আসেন। এসে দেখেন দাড়াশ সাপটি পাটের এক বড় কালোদড়ি। আর দেখলেন সাপটির লেজ ও মাথা হতে দুইটি চিকন তার চলে গেছে মসজিদের মিনারের দুতলায়। সেখান থেকে সুতার টান খেয়ে সাপটা শতবার মার খেয়েও মরছেনা, বারবার ছোবল মারতে লাফিয়ে উঠছে। দাউদপুর জামে মসজিদের চারতলা মিনারের দুতলায় ঘুমাতেন একজন মুয়াজ্জিন। এবার হাটফেরত লোকজন একে অন্যের মুখপানে চেয়ে চেয়ে হাসেন আর বলেন এটা যে আমাদের পাঁজি মুয়াজ্জিনের কারবার এই পাঁজি মুয়াজ্জিনটা দাউদপুর পুর্বপাড়ার উস্তার আলী, যিনি একজন বেঁটে ফূর্তিবাজ মানুষ ছিলেন। মনে পড়ে, সে সময় শখের বসে এই মিনারের মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে আমি প্রায়ই আজান দিতাম। 

মোগলাবাজারের কোন এক হাটবারের অমাবশ্যা রাতে এক মজার ঘটনা ঘটে। চৌধুরীবাজারে আখমল আলী ডাক্তারের দোকানে বসে দেখলাম অসংখ্য মানুষ বাসসড়ক দিয়ে দৌড়ে উর্ধশ্বাসে বাজারে ঢুকছে। একজন হুজুর প্রাভয়ে লুঙ্গি ফেলে কেবল লম্বা পাঞ্জাবিতে শরমগা ঢেকে এসে কাঁপছেন। কেউ কেউ সওদাপাতি রাস্তায় ফেলে রেখে আল্লারমাল জানটা নিয়ে কোনমতে পালিয়ে এসেছেন। সবার ভয়ের কার এক বিশালাকার রয়েল বেঙ্গল টাইগার। বর্তমান মনির আহমদ একাডেমির পাশের কেওড়া ঝোঁপের আড়ালে বসে আছে বাঘটি। অনেকে লাইটের আলো ফেলে নিজচোখে হলুদবর্ণের বড় ডোরাকাটা বাঘটিকে দেখে পালিয়ে এসে ভয়ে আল্লাহ আল্লাহ জপে জপে কাঁপছেন। হলুদকালো ডোরাকাটা বাঘটির দূচোখ হতে বিড়ালের চোখের মত আলো টিকরে বের হতে দেখেছেন তাঁরা।

কিছুক্ষণ পর শুনা গেল মাইকের আওয়াজ, কাছের মসজিদ হতে ঘোষণা আসছে পশ্চিম তুড়ুকখলা বন্দে বাঘ পড়েছে, কেঊ যেন এরাস্তা দিয়ে না যান। হাটফেরত লোকজন নেগাল ও মোগলাবাজার তিমুখায় আটকা পড়লেন। দাউদপুর চৌধুরীবাজারও লোকে লোকারণ্য। সিরাজপুর ও বাটিয়ারচর গ্রামের  স্বেচ্ছাসেবীরা  টিনে টিনে তীব্র করাঘাত করে উচ্চশব্দ তৈরি করে বাঘ তাড়ানোর আপ্রা চেষ্টা করছেন, যাতে বাঘটি তুড়ুকখলা হতে রাস্তা পেরিয়ে তাদের গ্রামে ঢুকে না পড়ে।

এবার চৌধুরীবাজারে একদল সাহসী যুবক লাটিসড়কি নিয়ে বাঘ মারতে তৈরি হন। মশাল জ্বলিয়ে তাদেরে এগিয়ে নিয়ে যান আর কয়েকজন বীরপুরুষ। হৈহৈ রৈরৈ করে অভিযান শুরু হল, পিছু ছুটলাম আমরা বড়সড় এক তামেশখুরের দল। ধারালো বল্লমদারীরা অগ্রবর্তী হয়ে বাঘের উপর বল্লম চার্জ করতে এগিয়ে যান। মশালবাহীরা তাদের অনুবর্তী হন। কিন্তু হলুদ বাঘটিকে বল্লম বিদ্ধ করতে গিয়ে তাদের চক্ষু চড়কগাছ, এযে বাঘ নয় তুড়ুকখলার জমিদার মাহবুব মিয়ার হালচাষের হলুদকালো ডুরাকাটা ট্র্যাক্টর দুই চোখ মেলে হা করে বাঘের মত বসে আছে কেওড়া ঝোঁপের আড়ালে।

পাশের বাড়ির কুটই মিস্ত্রি আমাদের বাড়িতে সবকটি পাকাঘর নির্মাণ করেন। চৌধুরীবাড়ির বিল্ডিং নির্মাণ করে করেই তার সারাটা জীবন পার করেন। তিনি হেসে হেসে অনুচ্চ স্বরে গল্প বলতেন, আমরা অবসরে বসে বসে শুনতাম। একজন বিকলাঙ্গ শিশুকে সংসারে সবাই অবহেলা করলেও মাবাবা কখনো ফেলে দেননা। অক্ষমরা সবসময় মাবাবার কাছে কলিজার টুকরো নয়নের মণি। মহান আল্লাহপাক মাত্রাতিরিক্ত স্নেহমমতা তৈরি করে অন্যকে দিয়ে পঙ্গুদেরে পরিপালন করে নেন। 

কুটই মিস্ত্রী বলে যান, হ্যাঁ, তাঁর বাল্যকালে গ্রামে একজন অন্ধ শিশু ছিল, মাবাবা খুব কষ্ট করে তাঁকে লালন পালন করেন। সে বড় হলে বুড়ো মাবাবা অন্য ছেলেদেরে ডেকে বললেন, যতদিন বেঁচে আছি আমরা তাঁকে দেখব, নাজানি আমরা চলে গেলে তাঁর কি যে দশা হবে। তোমরা কথা দাও আজীবন এই কানা পূতকে দেখাশুনা করবে। 

ছেলেরা বলল, আচ্ছা।

অন্ধ ধিরে ধিরে বড় হলো, শরীরে যৌবনের জোয়ার জাগতেই একদিন সে তাঁর মাবাবার কাছে আবদার জানালো, বিয়ে করব। সবাই বললেন, আ রে চোখে দেখিস না, বিয়ে করে কি করবি। 
সবাই বিয়ে করছে, আমি কেন বিয়েহীন রমু। 
লোকে বলল, তুমি অন্ধ, কে তোমাকে বউ দেবে? 
অন্ধ বলল, আমি শুনেছি আল্লাহ পাক সবার জন্য জোড়া সৃষ্টি করে রেখেছেন, নিশ্চয়ই আমার জোড় আছে, সবাই খুঁজে বের করুন, এই সামান্য কষ্টও কি একজন অন্ধের জন্য কেউ করবিনা। 
সবাই কনে খুঁজছে, কিন্তু বর অন্ধ শুনলেই লোকে ঝাড়ি মারে, আলাপ দেবার জায়গা পেলেনা, অন্ধের জন্য আলাপ। আন্ধার কাজ নেই, রুজি নেই, কে তাঁর বউ পুষবে। কিছুদিন পর বউয়ের বাচ্চা কাচ্চা হবে, ওদের দেখবে কোন শালায়।
সবাই যখন হাল ছেড়ে দেন, তখন ঘটক একজন কনের সন্ধান দেয়। কনে কুৎসিত কালো, সারা মুখে বসন্তের দাগ। এই বয়স্কা কনে এত কদাকার যে বিয়ে হচ্ছেনা, তবুও কনেপক্ষ শর্ত দেয়, বিয়ের পর কনের খাওয়াপরা কে চালাবে। সবাই বললেন, কেন? আল্লাহ রিজিকদাতা, তিনি চালাবেন। কথায় চিরে না ভাজায় বরের ভাইরা অভয় দেন, আগে আল্লাহ পরে আমরা আছি। এবার কনেপক্ষ অন্ধকে কন্যাদানে রাজি হন।
সবার চাঁদায় অন্ধের বিয়ে হলো, বাসর ঘর সাজানো হলো। অন্ধ বর বাসর ঘরে ঢুকে নববধুকে জিঞ্জেস করলেন, প্রেয়সী তোমার নাম কি জানতে পারি? 
হ্যাঁ, আমার নাম ফুলপরী।
ভারী সুন্দর নাম তো, নাজানি তুমি কত যে সুন্দর। 
বউয়ের নাম ফুলপরী শুনেই কানা প্রণয়ের জোয়ারে ভেসে নববধূকে দুহাতে জড়িয়ে ধরলেন। নতুন বউ খুশি হয়ে বললেন, আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ পাক তোমার পাতিহাড় থেকে আমাকে সৃজন করেছেন। 
অন্ধ বউয়ের প্রেমে পাগলপারা। সবার সন্দেহ চূর্ণ করে অন্ধ আজ সফল স্বামী। অন্ধকে একজন বউ উপহার দিতে পেরে সবাই ধন্য।  
বউ বাপের বাড়ি গেলেই অন্ধের মাথা নষ্ট হয়ে যায়। মা কাছে এলেই বলেন, আম্মা গো তানরে এনে দাও। মা বলেন, কেন রে পুত, যাবার মাত্র দুদিন হলো, বহুদিন পর গেছেন, কয়টা দিন যাক না। 
কানা একদিন মাইক বাজতে শুনেন গ্রামে ফ্রি চক্ষুশিবির হবে। পাশে বসা বউকে বললেন আমাকে চক্ষু শিবিরে নিয়ে চল। আমার একটাই বাসনা, সেটা তোমারে দেখার, তোমার নামটা এত সুন্দর, নাজানি তুমি আর কতনা সুন্দর। 
কানার বচন শুনে ফুলপরী প্রমাদ গুণে, অন্ধ পতি যদি দৃষ্টি নিয়ে ঘরে ফিরে তার এই রূপ দেখে তবে ভূদৌড়ে পালাবে, আর ফুলপরী হারাবে তাঁর অমাবশ্যার চাঁদ। ফুলপরী বুদ্ধি এঁটে বলল, আমার রূপ আগুনের লাহান, তুমি আমার রূপের তজল্লী সহ্য করতে পারবেনা। আমাকে দেখামাত্র তুমি উম্মাদ হয়ে যাবে, নতুবা আমার রূপের আগুনে পুড়ে মারা যাবে। 
কানা বলল, হয়ত তোমার রূপের আগুন হতে বাঁচাতে দয়াল আল্লাহ আমারে অন্ধ করেছেন। ফুলপরী বলে দারুন সত্য, আসলেই তাই।  
ফুলপরী শ্লোক ছাড়ে, আমরা দুইজন ভালই আছি, থাকুক তোমার চোখের ছানি। চোখ দেখাতে আর কোনদিন করনাগো টানাটানি।
বাল্যকালে বাড়ির যতসব কাটের কাজ করতেন পশ্চিম দাউদপুরের কাটমিস্ত্রী বংকেশ বাবু। ভূড়িওয়ালা লোক মাথায় টাক, মালকুচা ধুতি পরতেন। আমরা তাঁকে ডাকতাম ভটলা মিস্তরি। একটা চটের ব্যাগে হাতুড়ি, বাটালি, করাত, বাইশ ইত্যাদি সরঞ্জাম নিয়ে আসতেন। পাতলা শিকাগ্যাঞ্জি পরে ঘেমে ঘেমে কাজ করতেন। বংকেশ বাবু রাজা, উজির, বাবন, ধূপা, নাপিত এবং গোপালভাড়ের গল্প বলে বলে বাংলোয় কাজ করতেন। এত শৈশবে শুনা তাঁর গল্পগুলো মনে নেই, তবে রাজার তিনটি প্রশ্নের উত্তর দিতে নাপারা ব্রাহ্মণের সাজার কথা স্মরণে আছে। রাজা রায় দেন, শাস্ত্র না পড়ে আইছ বিদ্যা করতে বিতরণ/ তিন পাঁচে পনের কিল পিঠে, লও রে বাবন। শ্রোতারা জানতে চান, শাস্তিতো কারাদন্ড, অর্থদন্ড, মৃত্যুদন্ড, চাবুকদন্ড ইত্যাদি হয়। কিল (হাল্কা ঘুষি) আবার কেমন সাজা, জীবনে কখনো শুনিনি। ভটলা মিস্তরি বঙ্কেশ বাবু বললেন, এই সাজার নাম ধরুন কিলদন্ড, একটা প্রশ্নের জবাব দিতে না পারার শাস্তি পাঁচটা করে কিল।
১৯৭৬ সালে চাচা মুহিবুর রহমান চৌধুরী বাড়িতে তাদের অংশের জমি আমাদেরকে বদলা দিয়ে বাড়ির দক্ষিণে আমাদের খালিবাড়িতে চলে যান। ইঞ্জিনিয়ার মূরাদ ভাইয়ের উদ্যোগে সেখানে পুকুর ও পাকাবাড়ি নির্মাণ করা হয়। ১৯৭৯ ও ১৯৮০ সালে পূর্ববাড়িতে বিদেশযাত্রার ঢল নামে। চাচাত ফজলু ও রেশাদ ভাই সৌদি আরব চলে যান কিন্তু মতি ভাইয়ের লন্ডন অভিযান ব্যর্থ হয়। তবে তাঁর পুত্র জাহিদ চৌধুরী আজ লন্ডনে। আসলে সিলেটিদের লন্ডন যাবার স্বপ্ন এক প্রজন্মে বিফল হলেও পরের প্রজন্মে সফল হয়। দাউদপুর মাদ্রাসার তালবা ভাতিজা বদরু ছাত্র হিসাবে ভাল ছিল না। সে তুতামিয়া ইমাম সাহেবের নাতি সেজে লন্ডনে চলে যায়। 

চাচাত মুজিবুর রহমান চৌধুরী মুরাদ ভাই ছিলেন পিডিবি ইঞ্জিনিয়ার, তিনি প্রতি রবিবারে একটি মোটর সাইকেল নিয়ে বাড়ি আসতেন, তার পিছনের সিটে বসে আমরা মজা করে মটরসাইকেল চড়তাম। তিনি বিয়ে করেন গওহরপুর দেওয়ান বাড়ি। ভাবি নাসরিন চৌধুরী পাকিস্তান আমলের মন্ত্রী দেওয়ান আব্দুর রব চৌধুরীর নাতনী, দেওয়ান আব্দুর রসূল চৌধুরীর কন্যা। খানবাহাদুর আব্দুর রহিম চৌধুরী ছিলেন তাঁর পিতামহের আপন ভাই। 

মুরাদ ভাইয়ের বিয়ের দিন সিলেটের কুমারপাড়ার বাসায় বরকনে একত্রে বসলে তার শালা পাপু বরের কানে হাত দিতে চেষ্টা করে, ছোট বালক আমি বারবার বাঁধা দেই। একসময় সে আমাকে একটি ধাক্কা মেরে দেয়। এই ঘটনায় রেসাদ ভাই ভীষ রেগে গিয়ে ঝগড়া শুরু করেন। ভাবির আরেক ভাই দেওয়ান এহসান কবির পরে সিলেট এম সি কলেজে আমার এইচ এস সি সহপাঠি হন।

মতি ভাই বিয়ে করেন বিয়ানিবাজারের মেওয়া গ্রামে। কনে সাহানা খানম চৌধুরী তাঁর খালাত বোন। এই গ্রামের পাশেই কুশিয়ারা নদীর উপর শেওলা সেতুর অবস্থান। আগের রাতে স্বপ্নে দেখি বিয়ের গাড়িতে আগুন লেগে গেছে, ফলে বরযাত্রায় শরিক হইনি। 

চাচাত ফজলু ভাই বিয়ে করেন মৌলভীবাজার জেলার বেকামুরা গ্রামের সৈয়দবাড়ি। ভাবির নাম সৈয়দা বসরা খানম। বেশ কয়েকটি কার ও মাইক্রোবাসে চড়ে দাউদপুর হতে আমরা সিলেট শহর ছুঁয়ে যাত্রা করি। দীর্ঘ পথ, বেশ মজা করে সাদিপুর খেয়া ও শেরপুর সেতু পার হই। এই বরযাত্রা ছিল একটা প্রমুদভ্রমণ। মৌলভীবাজার শহরের মাত্র ছয় মাইল আগে ছোট্ট এক ব্যবসাকেন্দ্র কাজিরবাজার। এই বাজারের মাঝবরাবর একটি রাস্তা পশ্চিম দিকে ঢুকে গেছে। রাস্তার মুখে পাকা গেটে সিমেন্টের অক্ষরে লেখা সৈয়দ শাহদরং ও সৈয়দ শাহফরং এর মাজার। সৈয়দবাড়ির বড় বাংলোয় বিয়ের আপ্যায়ন হয়। সৈয়দবাড়ির সামনে একটি বড়দিঘি, চুনসুরকির আদিম গম্বুজওয়ালা মসজিদ। দিঘির বাম দিকে সৈয়দবাড়ির গুরুস্থান, এই গুরুস্থানের মাঝে ভাবগাম্ভির্যে ভরপুর একটি মাজার। লাল সালুকাপড়ে ঢাকা এই মাজারে শুয়ে আছেন হজরত শাহজালালের (রঃ) দুইজন সহচর হজরত সৈয়দ শাহদরং ও সৈয়দ শাহফরং(রঃ), যারা এই অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করেন। এই গ্রামটি আমার বেশ ভাল লাগে। প্রতি শীতকালে এই মাজারে উরুশ হয়। সৈয়দবাড়ির আত্মীয়স্বজন সবাই জমা হন। আমি সর্বদা বুশরা ভাবীর নিমন্ত্রণ পেতাম। কিন্তু যাওয়া হয়নি সেই সুন্দর গ্রামে আর কোনদিন। হয়ত এখন গেলে দেখতে পাব দীর্ঘ সময়ে বদলে যাওয়া আরেক বেকামুরা গ্রাম। 

চাচাত ফখরু ভাইয়ের বিয়ে হয় মৌলভীবাজার শহরের পাশে মোস্তফাপুর গ্রামে। কনের নাম সৈয়দা নাইয়র জাহান। বাড়ির সামনে প্যান্ডেল ও বিয়ের গেট। প্যান্ডেলে ঢুকে দুইটি বরমঞ্চ। ডানদিকের মঞ্চে বর ফখরু ভাই বসলেন। ঘন্টাখানিক পর আমরা অবাক হয়ে দেখি আরেক পাগড়িপরা বর মুখে রূমাল টেনে প্যান্ডেলে ঢুকছেন। সবাই অবাক, কি ব্যাপার। জানা গেল কনেরা দশ বোন, কোন ভাই নেই। ঝামেলা একসাথে সেরে নিতে একই দিনে দুইবোনের এই বিয়ের আয়োজন। বিয়ে বাড়ির সবাই বেশ সাবধান যেন বর ও কনে ভূলবসত অদল বদল হয়ে না যায়।

চাচাত মছরু ভাই সিলেট জেলাপ্রশাসক অফিসের স্টাম্প বিভাগে চাকুরি করতেন। বাড়ির পাশের জমি ভরাট করে গাছ লাগানো ছিল তাঁর নেশা। তাঁর বেশ সচ্ছলতা ছিল। তিনি বিয়ে করেন ঢাকাদক্ষিণের কানিশাইল গ্রামে। আমরা মাইক্রোবাসে করে পাহাড়লাইন দিয়ে কানিশাইল যাই। কনের বাড়ি এই রাস্তা দিয়ে দাউদপুর হতে মাত্র সাত মাইল দূরে ভাদেশ্বর সড়কের পাশে একটি টিলার উপর। এই বাড়িতে দাউদপুর হতে কনে সেজে কয়েক যুগ আগে আসেন আব্বার চাচাত বোন মাহফুজা খানম চৌধুরী। বাড়ির সামনে এক ধাপ নিচে বাংলো, পরের ধাপে দিঘি। বাড়িতে একটি বড় এম পেটার্ন পাকা ঘর। বাড়ির পিছনদিকে টিলা বেয়ে নেমেই ঢাকাদক্ষিণ ভায়া ভাদেশ্বর সড়ক। কনে সুলতানা জাহান চৌধুরী আব্বার চাচাত বোন মাহফুজা খানমের নাতনি।

বাড়ির আরেক বিয়ের স্মৃতি বেশ স্মরণীয় হয়ে আছে। সেই বিয়েতেও গাড়িগুলো পাহাড়লাইন দিয়ে যাত্রা করে। তবে এবারের গন্তব্য রনকেলী বড়বাড়ি। চাচাত ফরহাদ ভাইয়ের পত্নীর নাম খোদেজা খানম চৌধুরী জুহেনা। ভাবির পিতার নাম আব্দুল লতিফ চৌধুরী ওরফে মইয়ব মিয়া খুব আল্লাহ প্রেমিক লোক ছিলেন। তিনি ডাঃ শাহরিয়ার হোসেন চৌধুরীর চাচা। এই বাড়িও তিন ধাপে নির্মিত। বেশ উঁচু টিলার উপর পাকাঘর এবং নিচের ধাপে বাংলো ও পুকুর। পাহাড়ি এই গ্রামটি ক্যালেন্ডারের ছবির মত সুন্দর। বাংলোর সামনের প্যান্ডেলে খাওয়া দাওয়া সেরে আমরা অনেকগুলো সিঁড়ি বেয়ে বাড়িতে উঠি। সেখানে বরকনে একত্রে বসানো হয়। রাত নামার আগেই আমরা দাউদপুর চলে আসি। কনে ঊঠেন নবনির্মিত বাড়ির নতুন ঘরে।

চাচাত রেশাদ ভাই ছিলেন নম্রভদ্র লোক। খুব ভাল ও শিক্ষিত জন হলেও ভাগ্য তাঁকে তেমন সহায়তা করেনি। কিছুদিন ইনস্যুরেন্স কোম্পানিতে চাকুরি করে চলে যান রিয়াদে। তিনি মুরাদ ভাইয়ের হবিগঞ্জের বন্ধু প্রিন্সিপাল মুহিনুর রাজা চৌধুরীর ভাতিজিকে বিয়ে করেন। কনে ছিলেন অল্প বয়স্কা সুন্দরী। তাঁদের কোন সন্তান হয়নি। কয়েক বছর পর অজ্ঞাত কারণে এই বিয়ে ভেঙ্গে যায়। এই কনে নিয়ে আসতে বরযাত্রী হয়ে জীবনে প্রথম জেলাশহর হবিগঞ্জে যাই। সৌদি আরবে থাকাকালে রেশাদ ভাই একটি সুন্দর পাকা ঘর নির্মাণ করেন, কনেকে এই নতুন ঘরে তুলা হয়। এই স্ত্রী তালাক হয়ে চলে যাবার পর তিনি একা একা কাঁদতেন। তারপর দ্বিতীয় বিয়ে করেন বড়লেখার পানিধারে। এই পত্নীর গর্ভে কন্যা আনিকা চৌধুরীকে রেখেই তিনি মাত্র আটচল্লিশ বছর বয়সে নর্থইস্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান। চাচাতো বোন ফলকা আপার বিয়ের কথা তেমন মনে নেই। তবে তাঁকে পাল্কিতে করে চৌধুরীবাজারে থাকা বরের গাড়িতে তুলে দেওয়া হয়। সম্ভবত রাস্তা খারাপ ছিল তাই গাড়ি বাড়িতে আসেনি। 

এসব বিয়েতে আত্মীয়স্বজন পাড়াপরশি ও চৌধুরীবাড়িগুলোর লোকজন জমায়েত হতেন, বরযাত্রায় অংশ নিতেন। বিয়ের আগে চিনিপান অনুষ্ঠানে এসে সবাই বিয়ে নিয়ে আলোচনা করতেন। চিনিপানেও ভূরিভোজের আয়োজন করা হত। প্রতিটি বিয়েতে মাঝেরবাড়ির আবুলেইস ভাই ও পশ্চিমবাড়ির কামাল ভাতিজার উপস্থিতি নিশ্চিত ছিল। ভাতিজি দিপার বিয়েতে কাবিন নিয়ে কিছু কথা কাটাকাটি হয়। তারপর দুপক্ষের আলোচনার মাধ্যমে তা সমাধা হয়। এসবই আমার ছাত্রজীবনের স্মৃতির ঢালায় জমা আছে।         

একসময় সরকারি আইন হয় এক পরিবারে এতটুকুর বেশি জমি রাখা যাবেনা। আগের জামানায় আমাদের এতজমি ছিল যে, আর জমি কেনা হলে সরকার হয়ত কেড়ে নেবে। তাই বাপচাচারা পাতারিয়া গাংকুলের ফুফুতো ভাই রেজাঊর হমান চৌধুরীর নামে বিশপঁচিশ বিঘা জমি কিনে রাখেন। রেজা ভাই ছিলেন বড়লেখার সাংসদ এবাদুর রহমান চৌধুরীর আপন চাচাতো ভাই। আব্বা সফিকুর রহমান চৌধুরী সবার ছোট, জমিজামা ভাগবাটুরার সময় আব্বার অগোচরে রেজা ভাইয়ের নামের বেশিরভাগ জমি তাঁর ভাগে পড়ে যায়। এইসব জমির দলিলপত্র ও ফর্সা খলিলুর রহমান চৌধুরী কালুচাচার হাতে রয়ে যায়।  

চাচাতো মতি ভাইয়ের না ছিল তেমন লেখাপড়া, না ছিল কোন কাজের যোগ্যতা। তার উপর মড়ার ঘা ছিল খেলাধূলার দোষ। কোন চাকুরি কিংবা ব্যবসা করার যোগ্যতা না থাকায় তিনি সংসার চালাতে ও খেলাধূলার টাকা যোগাতে জমি বিক্রি শুরু করেন মখলিছ চাচা চিরকুমার, তার সমুদয় সম্পত্তি মতিভাইয়ের সাথে একিভুত ছিল। একসময় কে বা কারা দড়ারবন্দে মখলিছ চাচার দেড়বিঘা জমি তার দস্তখত জাল করে বিক্রি করে দেয়। ক্রেতা আমাদের বাড়ি হতে বের হয়ে পূবহাওরে যাওয়া সিকন্দর আলী লন্ডনি। সিকন্দর আলী জমিটি দখল করলে মখলিছ চাচা তার জমি উদ্ধারে আব্বার শরণাপন্ন হন। বড়ভাই তাহমিদ, আব্বা ও আমি জমি উদ্ধারে রওয়ানা হই, হালের গরুজোড় নিয়ে সাথে চলেন বাদাইপুতী এবং তাঁর পূত্ররা। আব্বা সফিকুর রহমান চৌধুরী নিষেধ করলেও আমি পকেটে এক চকচকে ধারাল ছুরি লুকিয়ে নিয়ে যাই। জমিটি সিকন্দর আলীর বাড়ির সন্নিকটে ছিল। কিন্তু ভাগ্য ভাল জালিয়াতরা জমিতে আসেনি। সম্মানির মানসম্মান আল্লাহ বাঁচান, নইলে সেদিন নাজানি কি রক্তারক্তি কান্ড ঘটে যেত।

একসময় আমাদের ভাগে পড়া রেজা ভাইয়ের নামের জমিজামা গ্রামের সুরুজ আলী, সিকন্দর আলী ও ইসকন্দর আলীরা হরিলূটে নামে। সামান্য টাকার লোভে তাদের অপকর্মের আসল সহযোগী হন আমাদের রক্ত সম্পর্কের কিছু লোকজনআব্বার অসহায় অবস্থায় নানা সুযোগ সুবিধা নিতে মনির আলীর চক্রান্তে পড়ে ঘনিষ্ঠ কেউ কেউ তাদের সাথে যোগ দেন। দুই তিন বছরে আমাদের তেরচৌদ্দ বিঘা দুফসলা জমি শয়তানরা দখল করে নেয়। আব্বার হাতে দলিলপত্র কিছুই নেই, আমি সিলেট ভূমি অফিসে তল্লাসি করে দেখি রেকর্ড ফুফুতো ভাই রেজাঊর রহমান চৌধুরীর নামে। আমাদের অসহায়ভাবে দেখা ছাড়া আর কিছুই করার ছিলনা। খুবসম্ভব এখানেও তারা রেজা ভাইয়ের সহি জাল করে এইসব অপকর্ম করে গেছে। কার রেজা ভাই চট্টগ্রামে থাকতেন এবং তাকে আমরা দাউদপুরে খুব একটা আসতে দেখিনি। বর্তমানে ইসকন্দর আলী ও সুরুজ আলীর বসত বাড়িও আমাদের এসব অপদখলি জমির উপর রয়েছে। 

সেই দুর্যোগময় দিনগুলোতে তীব্র দুশ্চিন্তায় রাতে আব্বার ঘুম হতনা। এই পরধন অপহরণকারীরা আব্বাকে এতই জ্বালাতন করে যে, বাড়ির ফরহাদ ভাইয়ের গিন্নী আম্মাকে বলতেন, চাচি আপনি চাচার দিকে সব সময় নজর রাখবেন, দুশ্চিন্তায় তাঁর নাজানি কি হয়ে যায়। কিন্তু আব্বার ছিল অসাধার সবর ও ধর্য্যগু। তাই মহান আল্লাহপাক তাঁকে বেশ প্রতিদান দিয়েছেন। তার সন্থান হিসাবে আল্লাহপাক আমাকে আজ এতই র্থিক সামর্থ্য দিয়েছেন যে এই পনের বিঘা জমি কেন, চাইলে দাউদপুরের সারা হাওরই কিনে নিতে পারব। আমার বড়ভাইয়ের লন্ডন সিটিতে যে চারটি বাড়ি আছে সারা দড়ারবন্দ বিক্রি করলেও এই একটি বাড়ির দামও হবেনা। তাছাড়া আজ আমার পিতার লন্ডনের নাতি আজফার চার্টার্ড একাউন্টেন্ট এবং দেশের নাতি জেফার চিকিৎসক। বড়াই নয়, মনের ক্ষেধে এসব বেফাঁস কথা আমি এই স্মৃতিকথায় বলে ফেললাম, প্লিজ ক্ষমা করবেন।

আব্বার রেঙ্গা হাইস্কুলের ছাত্র ক্যাপ্টেন আব্দুল ওয়াহিদ তুড়ুকখলার বড়বাড়ির জাতক। তিনি সারাজীবন বাংলাদেশ রাইফেলসে চাকুরী করেন এবং অবসর নিয়ে সোজা জন্মভূমি তুড়ুকখলা চলে আসেন। ইতিমধ্যে তাঁর পুত্র সেলিম বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন নবীন মেজর হয়ে গেছেন। চৌধুরীবাজারের পূর্বদিকে তিনি প্রায় পাঁচছয় বিঘা জমিতে পাকা দেয়ালঘেরা সুন্দর বাড়ি নির্মাণ করেন। ভিতরে একটা পুকুর ও সুরম্য ঘাট। তাঁর প্রিয় শিক্ষক সফিকুর রহমান চৌধুরীকে শখের বাড়ি দেখাতে একদিন চৌধুরীবাজার হতে টেনে নিয়ে যান। আমিও আব্বার সাথে ছুটলাম। পাকা গেটে ঢুকে মধ্যম আকারের পুকুরের ঘাটে পুস্পসজ্জিত এক মনোরম বৈঠকখানা। বিশাল ঢালাই ভবনে অত্যাধুনিক কারুকাজ, প্রতিটি ফুল ফলের গাছ খুব পরিকল্পনা করে লাগানো। সেই সময়ে ঘরে এসি টিভি ফ্রিজ গাড়ি সব ছিল। আমরা বাসা ঘুরে দেখছি, হঠাৎ ফলস ছাদে একটি ফ্রিজার দেখিয়ে ক্যাপ্টেন সাহেব তাঁর স্যারকে জানালেন এটা গরম পানির মেশিন। আসলে তখনকার দিনে ফ্রিজার বাংলাদেশের গ্রামে কেন, শহরেও তেমন দেখা যেতনা। পরবর্তীকালে আমি নর্থইস্ট মেডিকেল কলেজের বোর্ডে এসে চক্ষু বিশেষজ্ঞ ফারজানা আপার দেখা পাই। চিকনসুন্দরী ডাঃ ফারজানা আপা সিলেট মেডিকেল কলেজে আমার পত্নীর এক ক্লাস সিনিয়র ছিলেন। ফারজানা আপার স্বামী সার্জারি বিশেষজ্ঞ মোস্তাক বড়ভূইয়া এফসিপিএস ছিলেন নর্থইস্ট মেডিকেল কলেজ এন্ড সার্ভিসেসের পরিচালক। একদিন জানলাম ফারজানা আপা আমার জন্মভূমির তুড়ুকখলার কন্যা। তাঁকে খুঁজতে আরেকটু এগুতেই জেনে যাই তিনি ক্যাপ্টেন আব্দুল ওয়াহিদ সাহেবের চাচাতো বোন। সিলেট স্টেডিয়াম মার্কেটে ভাল প্র্যাকটিস ফেলে একদিন ফারজানা আপা ও মোস্তাক ভাই আমেরিকায় উদাও হয়ে যান।

শিক্ষক সফিকুর রহমান চৌধুরীর হাতে গড়া আরেক ছাত্র পশ্চিম তুড়ুকখলার জনাব লুতফুর রহমান। তিনি দীর্ঘতনুর সুদর্শন মানব ছিলেন। জেলা আনসার এডজুটেন্ট পদ থেকে অবসর নিয়ে ফিরে আসেন জনমমাটি তুড়ুকখলায়। চৌধুরীবাজারের দক্ষিণে মনির আহমদ একাডেমির সামনে তিনি বাড়ি নির্মাণ করেন। পাকা টিনের ঘর, সামনে পুকুর। এত বিলাসবহুল না হলেও বেশ মনোরম। প্রিয় দলুমিয়া স্যারকে শখের নতুন বাড়ি না দেখিয়ে কি থাকা যায়। নিমন্ত্রণের ঠেলায় পড়ে বাপ-পুত মিলে একদিন লুতফুর সাহেবের নতুন বাড়িতে হাজির হলাম। তাঁর পত্নী একজন উপজাতীয় সুন্দরী রমনী। দুই জাতির মিলনে সব সময় খুব কিউট সন্তান জন্ম হয়। লুতফুর সাহেবের একজোড়া পুত্র-কন্যা অপরূপ-অপরূপা, দেখতে মাশয়াল্লাহ। তুড়ুক্কখলার আন্সার এডজুটেন্ট লুতফুর রহমান ও ক্যাপ্টেন আব্দুল ওয়াহিদ বয়সে আমার গুরুজন কিন্তু তাঁরা আমাকে আপন ছোটভাইয়ের মত স্নেহ করতেন। ছোট্ট এই জীবনে অনেক মানুষের নিঃস্বার্থ স্নেহমমতা পেয়েছি। শোকর আলহামদুলিল্লাহ।তারা কেউ বেঁচে নেই। আল্লাহ তাঁদের মঙ্গল করুন।   

এবার আমার সেই সময়ে দেশের রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করব। আমার পাঠশালা জীবন কাটে স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর আমলে যা আগেই আলোকপাত করেছি। কিন্তু আমার হাইস্কুল জীবনের পুরো সময়টাই কেটেছে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাসনামলে, যা লেখা হয়নি। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুর মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পর খুনীরা খন্দকার মোস্তাক আহমদকে মসনদে বসায়। কিন্তু তিনি মাত্র আশি দিন রাজত্ব করে ৩রা নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের হাতে গদি হারান। ৭ই নভেম্বর ১৯৭৫, এক গৃহযুদ্ধ হয়। ঢাকায় এক রক্তপাতের বন্যা পেরিয়ে ক্ষমতায় আসেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। 

দাউদপুর গ্রামের বাড়ির সিনিয়ররা চারব্যান্ড রেডিও বাজিয়ে বিবিসি, আকাশবানি এবং বয়েস আব আমেরিকা ধরে মহাউৎকন্ঠায় দেশের দুঃসময়ে খবর শুনতেন। পাশে অতি উৎসাহিরা ভিড় করে আলোচনায় মেতে উঠতেন। প্রকৃত খবরের চেয়ে গোজবের ছড়াছড়ি ছিল ঢের বেশি।বাড়িতে একটি মাত্র পত্রিকা আসত, তা দৈনিক ইত্তেফাক। তাও আসত একদিন পর, এ যেন ভাসি ভাত। তারপরও এই ভাসি ভাত ইত্তেফাক খেতে সবার মাঝে বেশ প্রতিযোগিতা লেগে যেত। ভাবুন তো দেখি, তখন টিভি কিংবা মোবাইল ছিলনা, ফেসবুক কিংবা ইউটিউব কিছুই ছিলনা। কি এক দমবন্ধ অবস্থা মনে হচ্ছে একালে, তাইনা।     

জিয়াঊর রহমান মুক্তিযুদ্ধের একজন অকুতোভয় সেনানায়ক ও জেড ফোর্স প্রধান ছিলেন। এই ঘটনায় নিহত হন মুক্তিযুদ্ধের দুইজন সাহসী যুদ্ধা সেক্টর কামান্ডার ও কেফোর্স অধিনায়ক খালেদ মোশাররফ এবং মুক্তিযুদ্ধে একটা পা হারানো সেনানায়ক কর্ণেল আবু তাহের। সে সময় সেনাবাহিনীতে নির্বিচারে খুনখারাবী হয় এবং বিচারের প্রহসনেও প্রচুর সেনা হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়

এই চারপাঁচ দিনের গৃহযুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের অনেক বীর সমরনায়ক ও সৈনিকেরা অবমাননা ও  নিষ্ঠুর মরণযজ্ঞের শিকার হন। চোখের সামনে সামরিক আইন প্রশাসক জিয়াউর রহমানের হ্যাঁ ভোট, না ভোট হতে দেখি। ক্ষমতা দখলের কিছুদিন পর জিয়া গভোট দেন, জনগণ তাকে চায় কিনা। এই ভোটে তিনিই একমাত্র কেন্ডিডেট। ভোটের রাতে শুনা গেল দেশের আশিভাগ ভোটার ভোট দিয়েছে ও তাঁরা একচেটিয়া হ্যাঁ ভোট দিয়েছে।

জিয়াউর রহমানের শাসনামলের অনুকুল সময়ে জামাতিরা কোমর মজবুত করে প্রচার ও প্রসারে নেমে যানসারাদেশের পথেপ্রান্তে তখন মরলে শহিবাঁচলে গাজি, আমরা সবাই মরতে রাজি” চিৎকার শুনা যেত। তখন হাসিনাবিহীন আওয়ামী লীগের এক করুন ত্রিশঙ্কু অবস্থা; আওয়ামী লীগ(মিজান- মালেক উকিল), আওয়ামী লীগ(রাজ্জাক- মহিউদ্দিন), আওয়ামী লীগ(গাজি) ইত্যাদিতে বিভক্ত আওয়ামী লীগে কে যে বঙ্গবন্ধুর আসল আওয়ামী লীগ তা বুঝা জনগণের জন্য বেশ কঠিন ছিল। তবে সবার শ্লোগান ছিল একটাই, শেখ শেখ শেখ মুজিব, লও লও লও সালাম। কমিউনিষ্ট ও বামরা রাজনীতিতে যথেষ্ট সক্রিয় ছিল কিন্তু জনগণের মাঝে তাঁদের ভিত্তি তেমন মজবুত ছিলনা। 

জেনারেল ওসমানি, মেজর জলিল, বাঘা কাদের সিদ্দিকি, শেখ মুজিব ও মাওলানা ভাসানি প্রমুখের নাম সেকালে মানুষের মুখে মুখে ভেসে বেড়াতো। মুসলিম বিশ্বের কোন দেশে যুদ্ধবিগ্রহ হলে কোন এক পক্ষের সমর্থনে মাদ্রাসার হুজুর ও তালবারা রাস্তায় মিছিল বের করতেন। যেমন ইরান ইরাক যুদ্ধের সময় এদেশের হুজুররা ইরাকের সাদ্দাম হুসেনের সপক্ষে রাস্তা গরম করেন, কারণ সাদ্দাম সুন্নি ও ইরানীরা শিয়া। কোন বিধর্মী দেশের সাথে কোন মুসলিম দেশের সংঘাত হলে তো আর উপায় নেই, দেশের হুজুররা জান কুরবান করার ডাক দিয়ে মাঠ কাঁপাতেন, যেন বাংলাদেশ থেকে সাত সাগর আর তেরনদীর ওপারের মুসলমানের শত্রুর চৌদ্দগোষ্টি খতম করে ছাড়বেন। সাথে সাথে আম মুসলিম জনতা মিছিলে যোগ দিয়ে পুণ্যের কাজে ভাগ বসাতেন। কিছুদিন রাস্তার জেহাদের পর সবাই রণক্লান্ত হয়ে আবার মাদ্রাসার চার দেয়ালের দুর্গে স্বেচ্ছা বন্দী হন। এখন যেই লাউ, সেই কদু। 

কে কোথায় কি লেখে ফেলল, কি বলে ফেলল, ইত্যাদি নিয়ে কিছুদিন পরপর একটা হাঙ্গামা বাঁধিয়ে দেওয়াও ছিল হুজুরদের রুটিন ওয়ার্ক। আমার বড়ভাই তাহমিদ চৌধুরী তখন কলেজে পড়তেন। বেশ দীর্ঘদিন ধরে তাঁর কলেজ অকারণে বন্ধ। তবে কারণ তো একটা থাকতেই হবে। সিলেট এম সি কলেজের সরদার আলাউদ্দিন নামক একজন অধ্যাপক দৈনিক সিলেট সমাচারে কি একটি নিবন্ধ লিখেন। পত্রিকার কতৃপক্ষ ও লেখক দুঃখপ্রকাশ করে ক্ষমা চাইলেন। তারপরও তাতিপাড়ায় পত্রিকা অফিস পুড়িয়ে দেওয়া হল। বেশ কয়েকদিন সিলেট শহরে এমন দাঙ্গা হাঙ্গামা করা হল যে পুলিশের গোলীতে সাতজন লোক মারা গেল। সিলেট শহরের পাশের দাউদপুর গ্রামের জনগণ তাঁদের প্রিয় শহরের এই দুরাবস্থা দেখে বেশ দুশ্চিন্তায় পড়লেন। অধ্যাপক সরদার আলাউদ্দিন ও দৈনিক সিলেট সমাচার পত্রিকায় কর্মরত লোকজন তখন সিলেট শহর ছেড়ে পালিয়ে প্রাণ বাঁচালেন।              

৩রা নভেম্বর ১৯৭৫। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে একদল সশস্ত্র লোক ঢুকে এক জগন্য হত্যাকান্ড ঘটায়। সেই হত্যাকান্ডে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী চারনেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, এ এইচ এম কামরুজ্জামান এবং কাপ্টেন মনসুর আলী নিহত হন। 

মজার ব্যাপার অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের কন্যা ডাঃ সৈয়দা জাকিয়া নুর লিপি এমপি সিলেট সরকারি মেডিকেল কলেজে আমার পত্নী ডাঃ নুরজাহান বেগম চৌধুরীর সহপাঠিনী ছিলেন। ডাঃ সৈয়দা জাকিয়া নুর লিপির অগ্রজ মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফ হঠাৎ মারা গেলে তাঁর আসনে প্রত্যক্ষ ভোটে এমপি নির্বাচিত হন তাঁর বোন ডাঃ জাকিয়া নুর লিপি। এই শুভসংবাদ আমার গিন্নিকে জানালে তিনি বললেন, লিপি খুব ভাল ও ভদ্র মেয়ে ছিল। মিশুক লিপির সাথে তাঁর খুব বন্ধুত্ব ছিল। কিন্ত ডাঃ সৈয়দা জাকিয়া নুর লিপি সিলেট মেডিকেলে দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যয়নকালে ডিএমসিতে চলে যান, তারপর আর কখনও দেখা হয়নি।       

আমি বিশদ রাজনীতি নয়, আমার জীবনের সেই সময়টার রাজনীতির কথা ছোট্ট করে লিখতে বসেছি। জিয়া খালকাটা বিপ্লব শুরু করেন, কোদাল হাতে টেলিভিশনে তাকে খাল কাটতে দেখা যেত। তিনি বলতেন, খাল কাটা হলে সারা, দূর হবে বন্যা খরা। অনেক ডান, বাম ও আওয়ামী লীগ নেতারা আদর্শ ও স্বদল ছেড়ে পদবী, ক্ষমতা ও রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা লাভের আশায় পঙ্গপালের মত জিয়ার বিএনপিতে ঢুকতে ঠেলাঠেলি শুরু করেন। প্রেসিডেন্ট জিয়া বেশ জনপ্রিয় একজন সৎলোক ছিলেন। তাঁর মাত্র পাঁচ বছরের শাসনকালেই তিনি বিএনপিকে আওয়ামী লীগের সমান ও সমান্তরাল একটি শক্তিশালী প্রতিপক্ষ দলে পরিত করেন।

আমি এসএসসি পাশ করে যখন এমসি কলেজে ভর্তি হবার কাজে ব্যস্ত এমন একদিন খবর রটে রাষ্ট্রপতি জিয়া কতিপয় বিদ্রোহী সেনা অফিসারের হাতে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে নিহত হয়েছেন দিনটি ছিল ৩০ মে ১৯৮১ সাল। তার অকালমৃত্যুতে সারাদেশ শোকে নিস্থব্ধ হয়ে যায়। ধারণা করা হয় তার আগে বাংলাদেশে আর কোন জানাজায় এত মানুষের ঢল নামেনি। 

বিটিভিতে তখন বারবার খালেদা জিয়া ও তার দুইপুত্র তারেক জিয়া ও আরাফাত রহমানকে দেখান হ। জিয়াউর রহমানের জৈষ্ঠ্য পুত্র আমার প্রায় সমবয়স্ক তারেক জিয়া তখন পনের ষোল বছর বয়সের কিশোর মাত্র। জিয়ার হত্যাকান্ড বিএনপিকে হযবরল অবস্থায় ফেলে দেয়। গদীতে বসেন অতিবৃদ্ধ দুর্বল চিত্তের শাসক বিচারপতি আব্দুস সত্তার। জিয়া হত্যাকান্ডের দ্রুত বিচার হয়। ফাঁসি দেওয়া হয় বারজন মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তাকে। জিয়া হত্যার ঘটনায় বিনাবিচারে হত্যা করা হয় চট্টগ্রাম সেনানিবাস প্রধান মেজর জেনারেল মঞ্জুরকে, যিনি মুক্তিযুদ্ধের একজন সেক্টর কমান্ডার ছিলেন। কেউ কেউ বলতেন প্রকৃত খুনিদেরে আড়াল করতে আত্মসমর্পণের পরও জেনারেল মঞ্জুরকে সেনাপ্রধান এইচ এম এরশাদের নির্দেশে গোলী করে মেরে ফেলা হয়। সন্দেহ করা হয় জিয়া হত্যায় এরশাদেরও হাত থাকতে পারে। 

সদ্য স্বাধীন যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে ক্ষমতার কামড়াকামড়িতে এতদিন যারা বিচার নাটকে কিংবা বিচারবহির্বুত হত্যাকান্ডের শিকার হন, তারা প্রায় সবাই ছিলেন একান্তুরের রণাংনের লড়াকু সৈনিক। তাঁরা ছিলেন মৃত্যুকে তুচ্ছ করে জীবন বাজী রেখে বাংলাদেশকে স্বাধীনতা দানকারী বীর মুক্তিযুদ্ধা। তাঁরা সবাই অঞ্চল, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে বাঙ্গালি জাতির পরম শ্রদ্ধার পাত্র। তাঁদের সমালোচনা করা আমাদের সাজেনা। আমি তাদের সবাইকে জাগতিক সব সমালোচনার উর্দ্ধে এক সম্মানের অমর আসনে রেখে দিলাম।

সেকালে দাউদপুর গ্রামের সম্মানিত চিকিৎসক ছিলেন আমার জ্ঞাতি ভাই ডাঃ নজিব আহমদ চৌধুরী ওরফে গোলামনবি। তিনি বৃটিশ আমলে আসামের গৌহাটি মেডিকেল স্কুলে লেখাপড়া করে বাড়ি ফিরেন। মমতা আপা ও তিনি, ভাইবোন মাত্র দুইজন। দাউদপুর ফেরার কিছুদিনের মধ্যে তাঁর বাবা মারা যান। ডাঃ গোলামনবি ভাই চাকুরীতে যোগদান না করে জনসেবায় লেগে যান। সারাদিন রোগীরা আসে, তিনি রোগী দেখেন, আড্ডা দেন। ভিজিট যার যা পারে দেয়, না দিলেও চলে, গ্রামের গরীব মানুষের আশ্রয় তিনি। এই গরীবের ডাক্তার প্রতি বিকেলে চৌধুরীবাজার ও মোগলাবাজারের ফার্মেসিতে বসে রোগী দেখতেন।  

ডাঃ গোলামনবি ভাই খানবাহাদুর গৌছউদ্দিন আহমদ চৌধুরীর ভাতিজা। বাবা মজাহার আহমদ চৌধুরীর মৃত্যুতে একমাত্র সন্তানের হাতে আসে প্রচুর পৈত্রিক ভূসম্পত্তি। বড় জমিদার বাড়ি, বন জংগলে ভরা T- আকৃতির একটি সেমিপাকা পৈত্রিক ঘরে ডাক্তার নজিব সাহেব একাকি বসবাস করতেন। একদিন বাথরুমে বসে দেখেন সামনে লম্বা কালো সাপ। তিনি গুটিসুটি মেরে বসে থাকেন। সাপ বুঝতে পারেনি পাশে কেউ বসে আছে। সাপটি হেলেদুলে তাঁর গা ঘেষে ঘেষে গর্ত দিয়ে বেরিয়ে যায়। 

ডাক্তার ভাইয়ের ঘরের দেয়াল বেয়ে মানিপ্ল্যান্টের লতাপাতা ছাদে চলে গেছে। বাড়ির গাছে গাছে বড় বড় পত্রসহ মানিপ্লেন্ট লতা পেচিয়ে পেচিয়ে আকাশে উঁকি মারছে। এমনই এক ভূতুড়ে পরিবেশে তিনি থাকতেন। 

আমি একদিন তাঁকে বললাম, এই টাকালতার বন সাফ করছেন না কেন? জবাব দেন যে বাড়িতে মানিপ্লেন্ট থাকে সেখানে প্রচুর টাকা থাকে। আমি খানিক চিন্তা করে দেখি তাঁর কথাটা একেবারে মিথ্যে নয়, এই জংলা বাড়িটি অনেক শিল্পপতি, ব্যবসায়ী ও কোটিপতির আখড়া। 

আমার বয়স অল্প, ভাবলাম মানিপ্লেন্ট এনে আমার নিজ বাড়িতে লাগিয়ে দিলে সহজেই ধনি হয়ে যাব। বিনা কষ্টে ধনি হতে কে না চায়। আমি তাঁর কাছে মানিপ্লান্টের চারা চাইলাম। সামনে মাঝপাড়ার একজন শ্রমিক কাজ করছিলেন। গোলামনবি ভাই তাঁকে দিয়ে মূল-উপমূলসহ দুইটি বিশাল ভারী আকারের টাকালতার গাছ উপড়ে বের করে বললেন নিয়ে যাও। বিপদে পড়লাম এত ভারী জিনিস নেই কেমনে? এবার সেই শ্রমিক ভাইকে অনুরোধ করলে তিনি সিলেটি সিকাবাং এনে সামনে পিছে ঝুলিয়ে আমার বাড়িতে রওয়ানা দেন। পথে পথে লোক এই জঙ্গলের বুজা দেখে আড়চোখে তাকায় আর হাসে। 

আমার বাড়ির আঙ্গিনায় টাকালতার এই বুজা নামাতেই আম্মা বললেন, এই জঙ্গল কে পাঠালো, কেন পাঠালো। শ্রমিক বললেন, গোলামনবি মিয়া পাঠিয়েছেন, সেফাক মিয়া চেয়েছেন তাই। আম্মা হেসে বললেন এতো দেখছি দুই পাগলা মিয়ার খেলা। পরে আমার বাড়িতে প্রচুর টাকালতা হল কিন্তু টাকাতো হলনা, দিল্লি হনজু দূরকাওয়াস্ত।          

তাঁর রাঁধুনী ছিলেন বাবার আমলের একজন বুড়ি মহিলা।    

ডাঃ গোলামনবি ভাই ছিলেন অসাধারণ জ্ঞানীগুণী দার্শনিক ব্যক্তি। আমি সবসময় জ্ঞানীদের প্রতি আকৃষ্ট হই। একটা বড় পালঙ্কের মাঝখানে তিনি ঘুমাতেন, দুপাশে ছিল উঁচু উঁচু দুই তাক বই ও ম্যাগাজিনের সারি। বড় মশারি টাঙ্গালে এই দুই তাক বই ভিতরে ঢুকে যায়। এই উঁচু বইয়ের স্থূপ দেখে একজন লোক একদিন গোলামনবি ভাইকে বলল, সাবধানে ঘুমাবেন স্যার, বইয়ের তাক হেলে হেলে উপরে পড়ে গেলে আপনাকে কিন্তু খুঁজে পাওয়া যাবেনা জনাব।

আমি ম্যাগাজিন পড়তে ও নানা অজানা বিষয় জানতে তাঁর দরবারে প্রায়ই হাজির হতাম। হলুদ চৈনিক চেহারায় চীনাদের মত পাতলা গোঁফ ও দশবারগাছি দাড়ি ছিল তাঁর। আয়নার সামনে পেয়ালায় রাখা ব্লেড দিয়ে তিনি সহজেই ক্ষৌরকর্ম সেরে নিতেন।

গোলামনবি ভাই বয়সে আমার অনেক সিনিয়র। তাই সম্পর্ক গুরু শিষ্যের। তাঁর ভূতুড়ে ঘরে বসে রেডিও শুনতাম, বই ও ম্যাগাজিন পড়ে সময় কাটাতাম। রেডিওতে খবর শুনে শুনে বিজ্ঞানের নানা জটিল বিষয় জেনে নিতাম। তাঁর ঈমান ছিল সুদৃঢ়, দার্শনিক আরজ আলী মাতব্বরের সব জিঞ্জাসার জবাব ছিল তাঁর কাছে। 

ডাঃ গোলামনবি সর্বশেষ বিজ্ঞানের নানা তথ্যের খবরাখবর রাখতেন। তিনি বলতেন মহাবিশ্ব দুইটি বাইওনারী সংখ্যায় আবদ্ধ, তাহা ১ (এক) এবং ০ (শূন্য)। তাঁর মতে এক হল আল্লাহ এবং শূন্য হল তাঁর সৃষ্টি। এক সূচনাকারী, তিনি কারণহীন সত্বা। সৃষ্টির কারণ থাকে, সেই কারণ এই এক সংখ্যার সত্বা আল্লাহ। আমি বললাম, শূন্য মানে নাই। নাই হতে সৃষ্টি হলো কিভাবে। তিনি কাগজে একটি সমীকরণ আঁকলেন, ০ = ১০+ (-১০)। অর্থাৎ সীমাহীন পজেটিভ এনার্জি + সীমাহীন নেগেটিভ এনার্জি = শূন্য। এবার ডাঃ গোলামনবি বাখ্যা করেন, এক স্রষ্টা শূন্য হতে সীমাহীন পজেটিভ এনার্জি + সীমাহীন নেগেটিভ এনার্জি বিগব্যাং এর মাধ্যমে বের করে নিয়ে এসে এই সীমাহীন মহাবিশ্ব সৃজন করেছেন।

আজ এত বছর পর বুড়ো বয়সে এসে জানতে পারি দুনিয়ার তাবৎ কম্পিউটারের ভাষা দুইটি বাইওনারি সংখ্যা এক এবং শূন্য, যা আমাকে বড়ভাই ডাঃ এন, এ চৌধুরী ছাত্রজীবনে শিখিয়ে ছিলেন। অথচ তখন বাংলাদেশে কম্পিউটারের কোন অস্তিত্বই ছিলনা। হ্যাঁ, আসলে জ্ঞানীরা তাঁদের সময়ের অনেক উপরে অবস্থান করেন।         

তবে মাওলানা ভাসানীকে তিনি বলতেন মাওলানা ডুবানী। তিনি মনে করতেন, ভাষানী কেবল ডানে বামে ভাষণ দিবার লোক, প্রশাসন চালানোর কোন যোগ্যতা তাঁর নেই বলেই কোন পদে ভাসানী বসেননি। তাঁর মতে মাওলানা ভাষানী ফালতু ভাষণের লোক, শাসনের নন।

ডাঃ গোলামনবি ভাই খুব মনযোগ দিয়ে দৈনিক ইত্তেফাকের পাত্রি চাই বিঞ্জাপন পড়তেন কিন্তু নিজে বিয়েসাদি করতেন না। আমার চাচাতো বোন ফলকা আপার জন্য একবার বিয়ের আলাপ দিয়ে বসেন। বয়সের বেশ তফাৎ বিবেচনায় প্রথমে কেউ রাজি নন। তবে তাঁর লেখাপড়া, বংশমর্যাদা, ভূসম্পত্তি, আমল আখলাক বিবেচনায় রেখে বেশ পরে কনের অভিভাবকরা পজেটিভ হন, কিন্তু তিনি পিছুটান মারেন। পরে জানা যায় আর অনেক জায়গায় বিয়ের আলাপ দিয়ে তিনি শেষ মূহুর্তে এসে ছেড়ে দে মা, পালিয়ে বাঁচি।

শেষ বয়সে অসুস্থ্য হয়ে গেলে বাড়িতে তাঁকে দেখাশুনা করার মত আপন কেউ ছিলনা। তিনি চট্টগ্রামের হালিশহরে একমাত্র বোন মমতা আপার বাসায় চলে যান। ২০০৬ সালে শেখ হাসিনার ডাকে লাগাতার হরতাল চলছে। দেশে গাড়ি রিকশা মানুষ, কিছুই চলছেনা। সহিংসতায় দেশ অচল। এমন সময় দাউদপুর শাহিমসজিদের মাইকে ঘোষণা আসে দাউদপুরের গরীবের বন্ধু চিকিৎসক ডাঃ এন এ চৌধুরী আর নেই। তাঁকে জানাজা শেষে হজরত শাহজালালের(রঃ) মাজারে দাফন করা হবে। রাজনীতিবিদদের বানানো দেশের রাজনৈতিক ব্যারামের শিকার হলাম আমরা জনগণ। ছয়মাইল দূরে জানাজা হল অথচ আমরা দাউদপুরবাসী শরিক হতে পারলাম না প্রিয় মানুষের জানাজায়। তাঁর মুখ শেষবারের মত দেখা হলনা কারো। মহান আল্লাহ পাক এই মহান চিকিৎসককে জান্নাতুল ফেরদাউসের বাসিন্দা করুন, আমিন।

সেকালে দাউদপুর গ্রামের সিংহভাগ মানুষই তেমন সচ্ছল ছিলনা। শিক্ষাদীক্ষায়ও তাঁরা ছিল বেশ পিছিয়ে। প্রায়ই শুক্রবার বাদমাগরেব বড়মসজিদে পেট্রোমাস লেন্টন জ্বালিয়ে মাওলানা হরমুজউল্লাহ সায়দা (রঃ) কুরান তাফসীর করতেন। আমরা অনেকে সেই তাফসীর শুনে এশার নামাজ জামাতে পড়ে বাড়ি ফিরতাম। মসজিদের দক্ষিণে চুনসুরকি নির্মিত ঈমাম তুতা মিয়ার হুজরায় বিছানাপাতা দুইটি বড় চৌকি ছিল। একটিতে ঈমাম সাহেব ঘুমাতেন ও অন্যটিতে মোতাওয়াল্লি আব্বা সফিকুর রহমান চৌধুরী, চাচা হাসিবুর রাজা চৌধুরী, হরমুজউল্লাহ সায়দা ও সেক্রেটারী আম্বর আলীরা বসতেন। তখন দেখা যেত তাবিজ ও পানিপড়া নিতে অনেক লোকজন দাঁড়িয়ে আছেন। রোগ ও অজানা বিপদ তাড়াতে গরিব লোকজন এভাবে ধর্মগুরুদের কাছে ধর্ণা দিতেন।

চৌধুরীবাজারে সেকালে হোমিওপ্যাথিক ডাক্তারদের বেশ দাপট ছিল। আমার শৈশবে তুড়ুকখলার বজলু মিয়া ও ময়না মিয়া হোমিওপ্যাথিক ঔষদ বিক্রি করতেন। তাঁরা সাদা মিষ্টিগুঁড়ো, সাদাবড়ি এবং সিসির পানিতে ঔষধ মিশিয়ে দাগ কেটে পথ্য দিতেন। রোগের লক্ষণ জানতে প্রশ্ন করে করে রোগীকে ফেনা ফেনা করতেন। আমি তাঁদের দোকানে বসে পত্রিকা পড়তাম। সবশেষে আসেন হোমিও ডাক্তার জামাল মিয়া এবং আমার সহপাঠি ডাঃ শ্রীতমাল ভট্টাচার্য্য। একমাত্র তমাল ভট্টাচার্য্য ছাড়া অন্য কারো কোন হোমিওপ্যাথি ডিগ্রী ছিলনা। তাঁরা সবাই বই পড়ে হোমিও ডাক্তার বনে যান। লোকে বলত, যার নাই গতি সে করে ওকালতি, নইলে করে হোমিওপ্যাথি। 

হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসায় আমার তেমন আস্থা ছিলনা। ঔষধ খাবার পর রোগ কমছে নাকি বাড়ছে, কিছুই বুঝা যেতনা। রোগ কমলে ডাক্তার বলতেন, তাঁর ঔষধে কমেছে। আবার রোগ বেড়ে গেলে বলতেন, রোগকে ভালভাবে নির্মূল করার জন্য ঔষধ রোগ বাড়িয়ে দিয়েছে। রোগ কমলেও ক্রেডিট, বাড়লেও ক্রেডিট। তবে হোমিও ডাক্তারদের পাকনামির ঠেলায় পড়ে গরিবেরা সস্তায় সেবা নিতে হোমিওপ্যাথি দোকানে ভীড় করত।

যেজন পণ্য কিনে সস্তায়, সেজন পরে পস্তায়। আগের জামানায় হজে গিয়ে হাজীরা মক্কার বাজারে কুরবানীর পশু কিনতেন। দরদাম শেষ হলে হাজীরা পশুর রশি শক্ত করে ধরে দখলে নিয়ে তারপর বদ্দুদেরে পশুর দাম পরিশোধ করতেন। কুরবানির পশু খুব সস্তায় পেয়ে তাড়াহুড়া করে যারা রশি না ধরে আগেই টাকা দিতেন, তাঁদের টেকা যেত, সাথে ডেকাও যেত। আমার কেন যেন মনে হত, হোমিও বাজারে পথ্য কিনে গোবেচারা রোগীদের টেকা ও ডেকা দুই-ই যেত।        

দৈনিক ইনকিলাব ও মাসিক মদিনা পড়ার সুবাদে হোমিও চিকিৎসক ময়না মিয়ার দোকানে বসা হত বেশি। তিনি ছিলেন ডানপন্থী লোক। তাঁর ভাই এডভোকেট আব্দুল মুকিত ছিলেন ধনি লোক। সিলেট শহরে তাঁর তিনটি দালান বাড়ি। এডভোকেট আব্দুল মুকিত প্রতিটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নেজামে ইসলাম অথবা মুসলিম লিগ নামক কোন একটি ভূইফুড় দল থেকে সবসময় সাংসদ প্রার্থী হতেন। একটি অর্ধউলঙ্গ জিপে মাইক ও ব্যানার বেঁধে তাঁর চালক ও দুইএক জন কর্মচারি নিয়ে প্রচারে নেমে যেতেন। সংসদ নির্বাচনের কোন একদিন চৌধুরীবাজারের চাস্টলে একজন লোক জানতে চান এবারে ভোটে প্রার্থী কতজন। অন্যরা গুনে গুনে বলল আট জন। সামনে রাখা আব্দুল মুকিতের গাড়ির দিকে তাকিয়ে ভদ্রলোক ভবিষ্যৎবানী করলেন মুকিত সাহেব ভোটে হবেন আট নম্বর, তাঁর জামানত বাজেয়াপ্ত হবে। ভোটের ফলাফল বের হলে আমি অবাক হয়ে দেখি চাস্টলের সেই দূরদর্শী নিরক্ষর আমআদমির ভবিষ্যৎবানী অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেছে। সিলেট-৩ আসনের নির্বাচনী ফলাফলে ভোটপ্রাপ্তির তালিকায় এডভোকেট আব্দুল মুকিতের সিরিয়াল আট এবং তিনি সবচেয়ে কম ভোট পেয়ে জামানত হারান।

সেইযুগে মানসিক ডাক্তার ছিলনা, মানসিক হাসপাতালও ছিলনা। মানসিক রোগী মানেই তাঁকে জ্বীনে কিংবা ভূতে ধরেছে। তাঁর উপর প্রেতাত্মা কিংবা খান্নাস ভর করেছে, উপরি লেগেছে ইত্যাদি। মানুষ জাদুটুনা বিশ্বাস করত। অজ্ঞাত রোগ হলেই মনে করত শত্রু কিবা ঈর্ষাখোর কেউ বান মেরেছে। তাবিজের মাধ্যমে কাউকে প্রেমে ফেলা কিংবা বশ করা যায় বলে লোকজন বিশ্বাস করত। টুটকা, তাবিজ ও তন্ত্রমন্ত্র দিয়ে লোক বশীকরণ, শত্রুনিদন এবং উপরি রোগ নিরাময় নিয়ে সেকালে দেদারছে ব্যবসা হত। মানুষের এসব হরেক কিসিমের অপবিশ্বাসকে কেন্দ্র করে জ্বীনহুজুর, পুরোহিত এবং খাসিয়া তান্ত্রিকেরা রমরমা ব্যবসা করে ধনবান হয়ে যেত। টলাখালের পানিতে পড়ে কুনারপাড়ার একজন মৃগীরোগী মারা গেলে মানুষ ধরে নেয় জলের দৈত্য তাঁকে মেরে ফেলেছে।  

তুড়ুকখলার হামদু মিয়া, উরফি মিয়া, সাব রেজিস্টার মসরু মিয়া ও দাউদপুরের আওলাদ মিয়া প্রমুখ জাদুটুনা এবং জ্বীনে ধরা রোগীর চিকিৎসা করতেন। মানসিক রোগীদেরে ভয় দেখিয়ে এবং নানা ধরনের দৈহিক এবং মানসিক নির্যাতন চালিয়ে অসংলগ্ন আবুলতাবুল কথা বলায়ে তাহা জ্বীনের কথাবার্তা বলে জ্বীনসাধকরা চালিয়ে দিতেন। তাঁরা জ্বিন বোতলে ভরে মুখ বন্ধ করে মাটিতে পুতে দিতেন, ঘরে তাবিজ লটকায়ে জ্বীন এবং জাদুশক্তি আটকাতেন। অপচিকিৎসার পাল্লায় পড়ে মানসিক রোগ এতই জটিল হয়ে যেত যে তা জীবনে আর কোনদিন ভাল হতনা। এইসব রোগীরা জ্বীন হুজুরের কাছে বারবার আসত এবং হুজুরের স্থায়ী আয়ের উৎস হয়ে যেত। দুষ্ট জ্বীনসাধকেরা অনেক সময় ভয়ভীতি দেখিয়ে নিরিহ মহিলা রোগীদের শ্লীলতাহানিও করে বসত।  

আব্বা সফিক চৌধুরী পূর্বভাগ হাইস্কুলের ছাত্র (মেট্রিকুলেসন ১৯৩৭) ছিলেন। সে সময় ভাদেশ্বর এলাকায় একজন জ্বীনহুজুর ছিলেন। তিনি দাবী করতেন সূরা জ্বীনের আমল করে তিনি জ্বীন হাসিল করেছেন। হুজুর অমাবশ্যা রাতে তাঁর ঘরে জ্বীন ডেকে এনে জীন্নাতের সাহায্যে মানুষের নানা রোগ ও সমস্যার তদবীর করতেন। সাধারণ মানুষ তাঁকে বিশ্বাস করলেও ভাদেশ্বরের জনকয়েক শিক্ষিত লোক হুজুরের জ্বীন তলবের কাহিনিকে মিথাচার মনে করতেন। 

কোন এক অমাবশ্যা রাতে এই হজুর তাঁর ঘরে কয়েকজন কাস্টমার নিয়ে জ্বীন তলবে বসেন। হুজুর জ্বীন আনতে নানা তন্ত্র মন্ত্র পড়ছেন, এমন সময় ঘরের টিনে গাছের ডালের আঘাতের শব্দ হল। হুজুর বললেন টিনের চালা বেদ করে জ্বীনেরা নামতেছে। জ্বীন হুজুর বাতি নিভিয়ে দেন, কারণ জ্বীনেরা নাকি আলোতে আসেনা। জনতা গুটিসুটি মেরে ভয়ে চোখ বন্ধ করে দেন। জ্বীনসাধক তাঁর কাস্টমারদের নানা সমস্যার কথা একে একে জ্বীনকে জানিয়ে সমাধান চান। চিকন গলায় জ্বীন ধারাবাহিক জবাব দিতে থাকে। এমন সময় বাতি জ্বেলে ঘরের চালার উপরের গাছে একজনকে পাকড়াও করে অবিশ্বাসী শিক্ষিত জনতা। বাতি নিয়ে ঘরে ঢুকে তাঁরা আবিস্কার করে জ্বীনহুজুরের চৌকির তলে লুকিয়ে বসে আছে জবাবদাতা জ্বীনরূপী এক বালক। আসলে সবটাই সাজানো নাটক।          

আমাদের বাংলোর সামনে একবার বাঁশের ঝারে প্রচুর ঝিংগে হয়, হলুদ ফুলে সারাটা ঝার ছেয়ে যায়। কালই উল্লাহ চৌকিদার এসে দেখে বললেন, ভারী চমৎকার। তিনি চলে যাবার পরপরই সব ঝিংগে ফুল ঝরে যায়। পরদিন পুরো ঝার মরে যায়। লোকে বলল, কালই চৌকিদারের খুব চক্ষু লাগে। তাঁর চোখ নাকি ভাল কিছুর দিকে তাকালেই তা সাথে সাথে মরে শুকিয়ে কাট হয়ে যায়।   

শাহিমসজিদের ইমাম তুতা মিয়াকেও মানুষ গাভীর দুধ খাওয়াতে ভয় পেত। হুজুরকে দুধ খাওয়ালে তাঁর কুনজরে পড়ে গাভীর দুধ নাকি কমে যেত, ডিম খেতে দিলে হাস ডিম দেয়া বন্ধ করে দিত, ফল খাওয়ালে গাছের সব ফল ফেটে যেত। তাই তুতা মিয়া হুজুরকে দুধ, ডিম, ফল ইত্যাদি উপহার হিসাবে পাঠানোর আগে কুনজর হতে রক্ষা পেতে লোকেরা আয়ুজুবিল্লাহ ও বিসমিল্লাহ পড়ে তাতে ফুঁক দিয়ে তাঁর সামনে পেশ করত। 

গ্রামের বেশ কয়েকজন লোক সম্পর্কে মানুষের ধারনা ছিল তাঁদের কুনজর লাগে। তাঁদের কুনজর হতে শস্যক্ষেত বাঁচাতে কালো টিন বা কাস্ট ফলকে চোখ এঁকে এঁকে ক্ষেতে ঝুলিয়ে দিতেন। কুনজরকে এড়াতে কেউ কেউ পুরানো ঝাড়ু জুতা সেন্ডেল ইত্যাদি শস্যভরা মাঠে ঝুলিয়ে দিতেন। সুন্দর শিশুদের উপরও কুনজর কাজ করে, তাই বাচ্চাদেরকে কুনজর হতে বাঁচাতে কপালের একাপাশে মায়েরা কাজলের টিপ এঁকে দিতেন।

ডিট নামের এক অদৃশ্য জিনিস মানুষ বিশ্বাস করত। ডিট লাগার ভয়ে লোকজন মজাদার খাবার লুকিয়ে খেত। খাবার সময় সুস্বাদু খাদ্য দেখে কারো জিবে জল এসে গেলেই তাঁর ডিট লেগে যায় বলে মানুষ বিশ্বাস করত। ভূরিভোজের পর পেট খারাপ হলেই মানুষ ডাইনিং টেবিলে উঁকি মারা কাউকে না কাউকে সন্দেহ করত ডিট দিয়েছে। ডিট সারাতে তাঁরা ডিটপড়া ও পানিপড়া খেত। শুকিনো মরিচে আয়াত পড়ে ফুঁক দিয়ে তা পুড়িয়ে ডিটের চিকিৎসা করা হত। 

বাবুল আলী বলল আগে সে খুব শখ করে ডিম খেত। একবার কয়েক জন বালকের সামনে ডিম খেলে তাঁদের কেউ ডিট দেয়। তারপর ডিম দেখলেই তাঁর বমির ভাব হত। হুজুরের পানিপড়া খেয়ে সে বহুদিন পর ডিমের স্বাদ ফিরে পায়। আম্মা আসমতুন্নেসা আম, কাঁটাল, লিচু মিস্টি, জিলাপি ইত্যাদি ভাল কিছু খেতে বসলে আশপাশের সবাইকে আগে বিলিয়ে দিতেন, তারপর আমরা খেতাম। তাই আমরা কোনদিন ডিটের কবলে পড়িনি। সেকালে সবখানে মাছি উড়ত, খোলা লেট্রিন ছিল, হাইজিন কেউ মানতনা, তাই পেঠের পীড়া লেগেই রত, আর সব দুষ নন্দ ঘোষ, ডিট বেচারার উপর যেত। তবে আধুনিক বিজ্ঞান ডিট কতটুকু সত্য ভাবে তা আমার জানা নেই। হয়তবা এটাও মানুষের আরেক অলীক বিশ্বাস।

দাউদপুর গ্রামে আমার স্ববংশীয় প্রতিবেশি চাচা ডাঃ আব্দুল হক চৌধুরী। ডাঃ গোলামনবি ভাইয়ের চিকিৎসায় কাজ না হলে সবাই ছুটতেন ডাঃ আব্দুল হক চৌধুরীর কাজিটুলার বাসায়। নতুবা অধীর অপেক্ষায় বসে থাকতেন তিনি কবে বাড়ি আসবেন। তাঁর জন্ম ১৯২৮ সালে দাউদপুর গ্রামে। সিলেট সরকারি পাইলট স্কুল থেকে ১৯৪৪ সালে এসএসসি, ১৯৪৬ সালে এমসি কলেজ থেকে বিজ্ঞানে এইচএসসি এবং পরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করেন।

তিনি সরকারি মেডিকেল অফিসার পদে কিছুদিন গোলাপগঞ্জ উপজেলা হাসপাতালে এবং চিফ মেডিকেল অফিসার পদে ছাতক উপজেলা হাসপাতালে ছিলেন। আমরা তাঁকে ডাকতাম ডাক্তার চাচা। তিনি মিষ্টিভাষি অমায়িক মানুষ ছিলেন। চিকিৎসা পেশায় থেকে তিনি নীরবে মানুষের সেবা করে গেছেন। অগ্রাহায়ণ মাসে ধান উঠাতে ডাক্তার চাচা ও নিরা চাচি দাউদপুরের দক্ষিণ-চৌধুরীবাড়ি অবস্থান করতেন। 

ডাক্তার চাচা বেশ রাজনীতি সচেতন মানুষ। একবার ভোট দিতে সিলেট থেকে বাড়ি আসেন। দাউদপুর ইউনিয়ন পরিষদের ভোটকেন্দ্রে ঢুকে দেখেন তাঁর ভোট আগেই দেওয়া হয়ে গেছে। তাঁর চেহারায় তীব্র বিরক্তির চিহ্ন ফুটে উঠে। আস্তে করে বললেন, যে দেশে সঠিক ভোট নেই, সেখানে গণতন্ত্র নেই, নেই গণনেতাদের জবাবদিহিতা। এমন সব দেশে শান্তি ও আইনের শাসন কখনো আসেনা।

ডাক্তার আব্দুল হক চাচা ফিল্ড মার্শাল আয়ুব খান নিয়ে একদা একটি ছোট্ট গল্প বলেন। একবার আয়ুব খান কোন কাজের জন্য আল্লাহর সাথে দেখা করতে যান। আল্লাহ পাক আয়ুব খানকে দেখামাত্রই দৌড়ে গিয়ে তাঁর আরশের আসনে বসেন। আয়ুব খান বিদায় নেয়ার পর ফেরেশতারা বললেন, হে আল্লাহ আপনি কেন এই বনি আদমকে দেখে এত পড়িমরি  করে আরশের চেয়ারে এসে বসলেন। আল্লাহ তখন জবাব দেন, এই ক্ষমতালোভী আদমটা এতই বেয়াদব যে, সে খালি পেয়ে আমার চেয়ারে নিশ্চিত বসে যেত, তাই।

১৯৫৪ সালের মার্চে দাউদপুর গ্রামের পাশাপাশি দুই চৌধুরীবাড়িতে এক সাপ্তাহের ব্যবধানে দুইজন নববধু আসেন, একজন আম্মা আসমতুন্নেছা চৌধুরী এবং অন্যজন ডাক্তার চাচার পত্নী নিরা চৌধুরী। নিরা চৌধুরী রনকেলি গ্রামের শিল্পপতি ব্যবসায়ী ওয়াজিহ উদ্দিন চৌধুরী লতমিয়া ও ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভি সি ডঃ মুসলেহ উদ্দিন চৌধুরীর একমাত্র বোন। সুদুর পাতারিয়া পরগনার দক্ষিণভাগ হতে ট্রেনে চড়ে আসেন আম্মা আসমতুন্নেছা চৌধুরী

২০০১ সালের ৩১ জানুয়ারি ডাঃ আব্দুল হক চৌধুরী সিলেটে ইন্তেকাল করেন। তিনি দাউদপুর জামে মসজিদের পশ্চিমে তাঁদের পারিবারিক জমিতে হজরত শাহদাউদ কুরেশি(রঃ) হাফিজিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। এই মাদ্রাসার পাশে পারিবারিক গুরুস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়। তিনি সারাজীবন মানুষের সেবা করে গেছেন। জাজাকাল্লাহু খাইরান।

এলাকায় কে সবচেয়ে বেশি ধনি, তা নিয়ে বাল্যকালে আমাদের  মধ্যে হরহামেশা বিতর্ক লেগে যেত। এই বিতর্কে একেক জন, এক একজন ধনকুবেরের নাম বলতেন। এই বিতর্কে তিনজন মানুষের নাম প্রায়ই উচ্চারিত হত, তাঁরা শফি এ চৌধুরী এমপি, নাসির এ চৌধুরী এবং মনির আহমদ। তাঁদের পরে যাদের নাম শুনা যেত তাঁরা মাখন মিয়া, মইনুদ্দিন কুরেশি, মাহবুব মিয়া, ই এ চৌধুরী প্রমুখ। 

তবে কে সবচেয়ে ধনি তা নির্ণয় করা বেশ দুরূহ ব্যাপার। কেউ কি তাঁর সম্পদের বিবরণ অন্যকে জানায়। বুদ্ধিমানরা তাঁদের সম্পদের হিসাব সবসময় লুকিয়ে রাখে। কারো বেশি বেশি সম্পদের তালিকা প্রকাশ হলে ইনকাম টেক্স অফিসার ঘুষ খাবে এবং তাঁর টার্গেট অর্জনে এসে হানা দেবে। আমজনতা ঈর্ষা করবে। প্রতারক ও চুর ডাকাতরা পিছু নেবে। এমন কি অপহরণ করে চাঁদা আদায় করবে। ধনির আপদের শেষ নেই, লিল্লাহখোর আসবে লিল্লাহ নিতে, ধারখোর আসবে কর্জ নিতে। তৈলবাজ এসে গলায় একখান মালা দিয়ে লাখ টাকা নিয়ে যাবে। লোক মনজ্বালায় পড়ে বলবে, ঔ কিছুদিন আগে সে ফতুর ছিল, আজ এত টাকার মালিক কেমনে হলো, নিশ্চয় কোন না কোন দুইনম্বরী কাজ করতেছে। তাই কি দরকার সম্পদের গান গেয়ে লোক দেখাতে গিয়ে নিজ পায়ে কুড়াল মারার।

এখন আমার আলোচনার বিষয় আব্বার প্রিয় ছাত্র তুড়ুকখলার মনির আহমদ। জনাব মনির আহমদ আমি ও আমার পিতার জীবনে নানাভাবে জড়িয়ে আছেন। একই জন্মভূমির সন্তান আমরা, সিলেট শহরে এসেও পাশাপাশি বাসায় আছি। আব্বার স্বপ্ন ছিল গ্রামে হাইস্কুল করা। আমাদের পৈত্রিক জায়গায় রেঙ্গাস্কুল করতে আব্বা সফিকুর রহমান চৌধুরী সুনামগঞ্জের জেলা ভুমিকর অফিসের প্রধানের চাকুরি ছেড়ে গ্রামে আসেন। আমার চৌধুরী বংশের            

      


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন