শনিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

দশম শ্রেণি ১৯৮০ সালঃ

 

দশম শ্রেণি ১৯৮০ সালঃ

দশম শ্রেণির দিনগুলো বেশ আনন্দে পার হয়। এবছর আমরা সারা স্কুলের বড়ভাই ও আমাদের মনে সর্বদা নেতা নেতা ভাব বিরাজ করতনবম ও দশম এই দুই শ্রেণি মিলে এসএসসির সিলেবাস। তখন ক্লাস করার চেয়ে কোচিং ও প্রাইভেট টিউশনি নিয়ে সবাই ব্যতিব্যস্ত ছিলজলধীর স্যার পদার্থ বিজ্ঞানের ছাত্র কিন্তু তার মাথায় সব সময় বিরাজ করত মার্ক্সবাদ। আমাদের সমাজে মার্ক্সের তত্বের ব্যবহারিক উপস্থিতি সুন্দর করে বুঝাতেন। স্যার শহরের উচ্চ শিক্ষিত লোক কিন্তু বুঝতে পারতেন না এই অজপাড়াগায়ের সাধার জনতার সন্তান, এসব কম ধীশক্তির ছেলেরা  জটিল ফিলোসফি বুঝতে অক্ষম কিংবা এতে তাদের তেমন কোন আগ্রহ নেই। আমার ছিল তীব্র ঞ্জানস্পৃহা, তাই আমার ভালই লাগত, বারবার প্রশ্ন করতাম ও আগ্রহ নিয়ে নবতত্ব জানার চেষ্টা করতাম। পরবর্তীকালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিঞ্জান অধ্যয়নকালে স্যারের প্রদত্ত এই জ্ঞান আমার বেশ কাজে লাগে।

এদিকে  হুজুর বজলুর রহমান স্যার সিলেট আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে মৌলানা দেলোয়ার হোসেন সাইদির মাহফিলে গিয়ে গিয়ে মওদুদিবাদের কড়া ঔষধ খেয়ে আসেন। তার মগজে সর্বদা বাজত দেলোয়ার হোসেন সাইদির ওয়াজের ক্যাসেট। মাথায় ঘুরপাক খেত আল্লার জমিনে আল্লার দ্বীন প্রতিষ্ঠার ধান্দা। তিনি মওদুদিবাদের শরবত ছেলেদেরকে একটু একটু করে পান করান। আল্লাহ ও তার নবির নাম নিয়ে মওদুদিবাদের শরবত খাওয়ান যত সহজ, কার্ল মার্কসের টেবলেট গেলানো তত সহজ নয় বরং কিছু ছেলেরা মনে করত কমিউনিস্ট জলধীর স্যার ধর্মবিরোধী লোক এবং তারাই স্যারকে “কুচকুচ” লকব উপহার দেয়। হাইস্কুল ছাড়ার তেত্রিশ বছর পর একদিন রাজা জি সি হাইস্কুলের পাঠাগারে আমার রচিত “ইসফাক কুরায়শী রচনাসমগ্র” উপহার দিতে যাই। জলধীর রঞ্জন চৌধুরী স্যারকে তখন দেখতে পাই এই স্কুলের প্রধান শিক্ষকের আসনে সমাহীন  

দশম শ্রেণিতে বিঞ্জানের ব্যবহারিক ক্লাসে বেশ মজা হত। গুণেন্দ্র স্যার জারে অক্সিজেন ও হাইড্রজেন তৈরি করা শিখাতেন। আর শিখাতেন জবাফুলের ব্যবচ্ছেদ, ব্যাঙের পরিপাকতন্ত্র বের করে পরীক্ষা করা ইত্যাদি একদিন আমার সহপাঠিরা আমাকে ফেলে রেখে ব্যঙের পরিপাকতন্ত্র শিখে নেয়। আমার রাগ হল, আমি ঠিক করলাম বন্ধের দিনে তাদেরকে ফেলে রেখে আমি একাকী ব্যঙের পরিপাকতন্ত্র বিবচ্ছেদ করে শিখব। প্রধানশিক্ষক গুনেন্দ্র স্যারের অনুমতি নিয়ে বাড়ি হতে একটা বড় ব্যাঙ ধরে নিয়ে আসি। একটি কাচের জারে ব্যাঙটিকে রেখে ওটাকে মারতে গিয়ে এসিডের বোতল হাতে নেই। বোতলটির ছিপি খোলে ব্যঙের উপর সামান্য এসিড ঢালতে যাব তখনি ঘটল দুর্ঘটনা, এসিড এসে পড়ল আমার কাপড়ে। আমি সর্বদা প্যান্ট পরে স্কুলে যেতাম, ভাগ্য ভাল ঐদিন পরনে ছিল লুঙ্গি। এসিড এসে পড়ে ডানহাতে ও পরনের লুঙ্গিতে। বিনে আগুনে ধূয়া উড়ে উড়ে লুঙ্গি পুড়তে শুরু করল। পাশে একটা জানালার পর্দা ছিল, লুঙ্গি খোলে ফেলে পর্দাটা কোমরে জড়িয়ে নিলাম। গুনেন্দ্র স্যার দৌড়ে এসে হাতে পড়া এসিড ডিস্টিল্ড ওয়াটার দিয়ে মুছে দেন। উরুতে সামান্য ও ডানহাতের চামড়ায় বড় ক্ষত সৃষ্টি হল। ডানহাতের চামড়ায় এই ক্ষতচিহ্ন আজও রয়ে গেছে। প্রতিটি বিষয়ের ব্যবহারিক খাতায় ছবি আঁকাও ছিল খুব আনন্দঘন কাজ।

বর্তমান কালের মত এস এস সি পরীক্ষায় সবছাত্র পাশ করা সম্ভব হত না। ত্রিশপয়ত্রিশ শতাংশ ছাত্র উত্তীর্ণ হত ও বাকিরা ফেল করত। ফেলের হার বেশি হলে স্কুলের বদনাম হত এবং সরকারি অনুদান বাধাগ্রস্ত হত। তাই টেস্ট এবং প্রিটেস্ট নামে দুটি বাছাই পরীক্ষার মাধ্যমে পাশের অযোগ্য ছাত্রদেরকে বাদ দেওয়া হত এবং ভাল ছাত্রদের জন্য এস এস সি ফাইন্যাল পরীক্ষার দুইটি রিহার্সেল হয়ে যেত। টেষ্ট পরীক্ষায় আচমকা আমি টিপুর কাছে হেরে যাই। এই হারাটা আমার জন্য ভাল হয়, আমি সাবধান হয়ে যাইতাই এস এস সি ফাইনাল পরীক্ষায় আমি টিপুর চেয়ে বিপুল বেশি নম্বর পেয়ে উত্তীর্ণ হই। সেকালে প্রথম বিভাগে পাশ করা ছিল খুব কঠিন কাজ। একদিন রেজাল্ট বেরুল, এসএসসি পরীক্ষার মার্কসিট হাতে নিয়ে বাড়ি ফিরলাম, সামান্য চার নম্বরের জন্য প্রথম বিভাগ এবং সেইসাথে মাত্র দুই নম্বরের জন্য রসায়ন বিজ্ঞানে লেটারমার্ক হারিয়ে মনের দুঃখে রাতভর কাঁদলাম।

অতি শৈশব হতে আট মাইল দূরের শহর সিলেটে মা বাবার সাথে কতবার যে আসা যাওয়া করি তার কোন হিসেব নেইআমার এসএসসি পরীক্ষার সিট পড়ে সিলেট শহরের রাজা জি সি হাইস্কুলে। পরীক্ষা দিতে গিয়ে উঠি দরগামহল্লার মুফতি বাড়ি, ফুফুর বাসায়। বইখাতা ও কাপড়চোপড় নিয়ে উঠি পাশেই বড়বোন রেহার ঘরের এক নীরব কক্ষে যেখানে আছে বড় পালং ও পড়ার চেয়ার টেবিল। প্রতিদিন এসে এসে খাই পাশে ফুফুর বাসায়, আর বসে বসে পড়ি বড়বোনের নির্জন কোঠায়। নামাজের আকামাত শুনে লাফ মেরে উঠে ত্রিশচল্লিশ হাত দূরের হজরত শাহজালালের(রঃ) দরগা মসজিদে গিয়ে প্রতিটি জামাত ধরি। শ্রদ্ধাভরে মাজারের কাছে দাঁড়িয়ে জেয়ারত করে ভাল ফলাফলের জন্য প্রার্থনা করি। ফুফুর বাসায় রাখা শাহজালালের(রঃ) পবিত্র খড়মজোড় ও সুদীর্ঘ্য দ্বিফলা তরবারি পরীক্ষা করি। সাতশত বছর আগের এই ওলিআল্লার পায়ের পবিত্র চিহ্ন এখনও অঙ্কিত আছে। আর আছে সেই যুগের মানুষের আঁকা খড়মের পাতলা লালচে রঙ ও সুন্দর কারুকাজ করা বর্ডার সাত শত বছর ধরে মুফতি পরিবারের প্রতি সিঁড়ির বড়পুত্রের হাত ধরে ধরে এই খড়ম ও তরবারি এসে এখন আশ্রয় নিয়েছে সিলেটের বিয়ের প্রধান কাজি আমার ফুফুত ভাই মুফতি নজমুদ্দিন ওরফে মামুন ভাইয়ের হাতে। সেইদিন ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারিনি বড় হয়ে একদিন আমি এই মহান ওলিআল্লার একজন জীবনীকার হয়ে ধন্য হব 

এসএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় ১৯৮১ সালের মার্চ মাসে। এসএসসি পরীক্ষার প্রথম দিন পরীক্ষা শুরুর বেশ আগে আব্বা রিকশায় করে আমাকে রাজা জি সি হাইস্কুল কেন্দ্রে নিয়ে যান। দুতলার একটি কক্ষে বসে পরীক্ষা দেই। জানালা দিয়ে পিছনে বিশাল লালদিঘি জুড়ে দেখলাম কচুরীপনার নীল-ধূয়াটে ফুলের র্ণীল সমাহার। ঐদিনের বাংলা পরীক্ষা বেশ ভাল হয়। দশ বিষয়ের পরীক্ষা সমাপন করে একদিন বাড়ি ফিরে আসি। বিশপচিশ দিন পর সিলেট সরকারি পাইলট হাইস্কুলে ব্যবহারিক পরীক্ষার ডাক পড়ে। এইখানেও আব্বার একজন ছাত্রের বদান্যতা পাই। তিনি উক্ত স্কুলের বিজ্ঞানের শিক্ষক তুড়ুকখলার মইনুল হোসেন স্যার। পাজামা পাঞ্জাবী পরিহিত এই স্যারের ছিল গালভরা দাড়ি ও পিঙল চোখ। তার অপার মহানুভবতায় পদার্থবিদ্যা, রসায়ন ও জীববিদ্যা প্রতিটি ব্যবহারিক বিষয়ে পচিশের মধ্যে তেইশ চব্বিশ করে নম্বার পেলাম। তাকিয়ে দেখলাম স্কুলের পিছনের বিশাল গম্ভীর লালদিঘির ওপারে আমার এসএসসি পরীক্ষা কেন্দ্র রাজা জি সি স্কুল দেখা যাচ্ছে। হায়রে সিলেট, দুঃখ হয় এই সিলেটের অর্থলোলুপ নগরপিতারা আমার কৌশরে দেখা এই সুন্দর দিঘিটাকে গলাটিপে হত্যা করে অসংখ্য অপরিকল্পিত ঘিঞ্জি দোকানপাঠ বানিয়ে ভাগবাটুরা করে নিয়েছে অথচ জনাকীর্ণ বন্দরবাজারের কাছে লালদিঘিকে কেন্দ্র করে একটি লেকগার্ডেন হলে ব্যস্ত লোকজন এখানে এসে আরামে নিঃশ্বাস নিতে পারত, জায়গাটা হত পর্যটন কেন্দ্র। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন