চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চত্বরে, আমি এক সুবিশাল জ্ঞান সরোবরেঃ
সেশন শিক্ষাবর্ষঃ- ১৯৮৬-১৯৮৭ চুড়ান্ত পরীক্ষাবর্ষঃ- ১৯৮৮ অবস্থানঃ জানুয়ারি ১৯৮৮ হতে অক্টোবর ১৯৯১ মাস্টার্স ২০তম ব্যাচ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
আমাদের সময় সিলেটের শিক্ষার্থীদের মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করা ছিল খুব কঠিন কাজ। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া অন্য কোথায়ও মাস্টার্স ডিগ্রি লাভের কোন উপায় ছিলনা। তাই সেকালে সারাদেশে মাস্টার্স ডিগ্রিধারী লোকজন ছিলেন হাতেগুণা। উচ্চমাধ্যমিকের পর নানা ঘাত প্রতিঘাতে বিপর্যস্ত হলেও আমার মনে যেমন করেই হউক এই উচ্চডিগ্রি লাভের বাসনা সুপ্ত ছিল। একদিন সিলেটের চৌহাট্টায় আমার বিএ পাঠের অন্তরঙ্গ সহপাঠী বন্ধু সিদ্দিকুর রহমান নির্ঝরের মুখোমুখি হই। হাত মেলাতেই তিনি বললেন, হেই সেফাক, চল আমরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ তে ভর্তি হই।
তখন আমি
পলিটেকনিক দ্বিতীয় বর্ষের শেষপর্বে অধ্যয়ন করছি। সহজেই সম্মতি জানাই এবং ভর্তির সব
মালমশলা ফাইলবন্দি করে তার বাসায় পৌঁছে দেই।
তিনি একাকী চট্টগ্রাম গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা রনধীর শর্মাকে হাত করেন ও
তার সহায়তায় রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এম এস এস প্রথমবর্ষে
আমরা দুইজন ভর্তি হয়ে যাই। দুই বছরের
মাস্টার্স কোর্স। আমাদের সেশন শিক্ষাবর্ষ- ১৯৮৬-১৯৮৭
চুড়ান্ত পরীক্ষাবর্ষ- ১৯৮৮।
রনধীর বাবু খাঁটি
চট্টগ্রামি লোক, বাড়ি কক্সবাজার, তাঁর কথাবার্তায় হালকা চট্টগ্রামি আঞ্চলিক ভাষার টান বেশ মজাই লাগত। তিনি নিদারূণ
সিগারেট আসক্ত, আমরা ধুমপানমুক্ত হলেও সাথে একপকেট দামি সিগারেট নিতাম। এই উপহার পেয়ে রনধীর বাবু খুশিতে আটকানা হয়ে সব কাজ
করে দিতেন। শর্মাদার সাথে আমাদের এত অন্তরঙ্গ সম্পর্ক জন্মিল যে, একদিন চট্টগ্রাম
শহরে আসগরদিঘির পারে তার
বাসায় গিয়ে বউদির হাতের চানাস্তা খেতে হল। 
শর্মাদা
গাইড, সিলেবাস, পরীক্ষা রুটিন সব ডাকযোগে সিলেটে পাঠাতেন ও আমরা মূল্য পরিশোধ করে
দিতাম। আমি পলিটেকনিক চূড়ান্ত বৎসরে অধ্যয়নে ব্যস্ত থাকায় সিদ্দিক নির্ঝর সাহেব বারবার
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে আমরা দুইজনের সব কাজ আঞ্জাম করতেন। তার বদান্যতায়
আমি ভারমুক্ত থেকে থেকে এগিয়ে যাই। সিদ্দিকুর রহমান নির্ঝরের এই
নিঃস্বার্থ সহায়তা না পেলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার
এমএসএস পড়া হত না।
মানুষ জন্মক্ষণ
হতেই এই পৃথিবীতে কোন না কোন মানুষের সহায়তা নিয়ে টিকে রয় এবং সামনের পানে এগিয়ে
যায়। আমি বিএ এবং এমএসএস অধ্যয়নে অনুরূপ স্রষ্টা প্রেরিত একজন সাহার্য্যকারী পাই,
তিনি সিলেট শহরের চৌহাট্টা সন্নিবেশিত পুরাতন মেডিকেলের সিদ্দিকুর
রহমান নির্ঝর। এই পুরাতন মেডিকেল এখন শহিদ শামসুদ্দিন সদর হাসপাতাল।
আর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রনধীর শর্মা বাবুকেও হেলাফেলা করা যাবেনা,
তিনি স্বপ্রণোদিত হয়ে ফোন করতেন, যত রকমের
সহায়তা দরকার সব করতেন।        
১৯৮৯ সালের
শেষলগ্নে আমি সিলেট পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটে সিবিল টেকনলজিতে
ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ চুড়ান্ত পরীক্ষা দেই। এই পরীক্ষা দিয়েই
রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাস্টার্স ইন সোশ্যাল সাইন্স (এমএসএস) প্রথমবর্ষ ফাইন্যাল পরীক্ষা
দিতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছুটে যাই। প্রতি এক
সাপ্তাহ করে বিরতি দিয়ে এক এক বিষয়ের
পরীক্ষার তারিখ পড়ে। তাই একটানা মাস দেড়েক চট্টগ্রাম শহরে অবস্থানের সিন্ধান্ত নেই।
তিনচার মাস
আগে আমরা সিবিল টেকনোলজির
ছাত্ররা সরকারি খরচে সাপ্তাহ দিনের এক
শিক্ষাসফরে এসে চট্টগ্রাম বন্দর ও শিল্প নগরীর যতসব কলকারখানা পর্যবেক্ষণ করি এবং সেইসাথে পর্যটন নগরী সাগরকন্যা কক্সবাজারের রূপসুধা পান করে সিলেট ফিরে যাই।
সিদ্দিকুর
রহমান নির্ঝর চট্টগ্রামে অবস্থান করায়
রাতের ট্রেনে আমি একাকী চট্টগ্রাম রওয়ানা হলাম।
এবারের গন্তব্য চাচাতো ভাই মুজিবুর রহমান কুরেশীর (মুরাদ)
সরকারি বাসা। তবে তার বাসার ঠিকানা নেই নি, শুধু জানতাম তিনি তখন পিডিবির নির্বাহী
প্রকৌশলী এবং চট্টগ্রাম শিকলবাহা পাওয়ার প্ল্যান্টের প্রকল্প পরিচালক। পরদিন সকাল
১০/১১ ঘটিকায় মেইল ট্রেনটি চট্টগ্রাম স্টেশনে যাত্রা বিরতি করে। চট্টগ্রাম
রেলস্টেশনে এই প্রথম আমার পদচিহ্ন পড়ে, বাহিরে এসে
লোকজনের কাছে শিকলবাহা পাওয়ার প্ল্যান্টের অবস্থান জানতে চাই। আমার ধারনা ছিল
চট্টগ্রাম শহরের মাঝে কোথাও এর অবস্থান হবে কিন্তু মানুষ বলল কর্ণফুলীর
অনেক উজানে শিকলবাহা নদীর সাথে কর্ণফুলীর
মিলনস্থলে এই পাওয়ার প্ল্যান্টের অবস্থান। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা বুঝতেও বেশ
অসুবিধা হল। লোকজনের নির্দেশনায় একটি রিকশায় করে ফিরিঙ্গি ঘাটে
ছুটলাম। অনেক পথ পেরিয়ে কর্ণফুলীর এই
সাম্পান ঘাটে এলাম।
আমার সামনে
আজ চট্টগ্রামের ভুবনবিখ্যাত নদী কর্ণফুলী, মনে
পড়ল পাঠশালায় পড়া সেই কবিতার চরণ ‘নুপুর
পায়ের ঝুমুর তালে চলছে দোলী, আমার গাঁয়ের হীরের ফুলের কর্ণফুলী’।
এবার উঠলাম শিকলবাহাগামী চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী পালতুলা সাম্পান নৌকায়। এই নৌকার
একপ্রান্তে উচু খাড়া গলুই, অন্যপ্রান্ত চ্যাপ্টা গলুইবিহীন। এযেন আমাদের সিলেটি
নৌকার একগুলুই আধখানি দীর্ঘ প্রতিরূপ। দাঁড়িয়ে
দুহাতে জোড়বৈঠা বেয়ে ঢেউভেঙ্গে একজন সাম্পানওয়ালা নদীর পার ঘেষে ঘেষে
এগিয়ে যাচ্ছেন, দু’নম্বর মাঝি পিছনে দাড়িয়ে লগি মারছেন।
জোড়বৈঠার মাঝি সাম্পানের অগ্রভাগ একচাপে ঢেউয়ের উপর নৌকা উঠিয়ে দেন ও ঢেউটি পেরিয়ে গেলে
সাম্পানটি কয়েক হাত সামনে চলে যায়। এক বিশেষ কৌশলে তিনি জোড়বৈঠা বেয়ে যান। এই অদ্ভুদ ডিজাইনের নৌকা আমি জীবনে আর কোনদিন দেখিনি।
নদীর
গুরুগম্ভীর ঢেউয়ের বুকে অজস্র সাম্পান চলাচল করছে। নয়ন সম্মুখে বিশাল কর্ণফুলী নদী, সামনে সাম্পান নৌকা, সাম্পান মাঝি। সেদিন বন্দরনগরী চট্টগ্রামকে মনে হল আমার শত জনমের যেন এক রূপকথার স্বপ্নরাজ্য। সাম্পানে বসে যতনে শুনা সেফালী ঘুষের গানের
কলি ‘ওরে ও সাম্পানেওয়ালা, তুই আমারে করলে দেওয়ানা’ অথবা ‘পাল উড়াইয়া দিলে সাম্পান
ঘুর ঘুরাইয়া টানে, তোমরা কনকন যাইবে অ্যাঁর সাম্পানে’
মনের গহীনে আবার অনুরণিত হল। একসময়
বিখ্যাত কালুরঘাট ব্রিজের নীচ দিয়ে
সাম্পান এগিয়ে গেল। এই ব্রিজের পাশেই চট্টগ্রাম কালুরঘাট
বেতারকেন্দ্র, যেখান থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র
পাঠ করেন মেজর জিয়াউর রহমান। 
আটশত
মেগাওয়াট শিকলবাহা পাওয়ার প্ল্যান্টের ঘাটে সাম্পান হতে নামলাম। প্রহরীকে পরিচয়
দিলে সে আমাকে তাদের বড়স্যার মুজিবুর রহমান কুরেশীর অফিসে নিয়ে যায়। কর্ণফুলী
ও শিকলবাহা এই দুইনদীর মিলনকোনে  টাওয়ার,
তারজট ও লোহালাক্কড়ের এই বিশাল আলো ঝলমল পাওয়ার প্ল্যান্ট, চারপাশে অথৈ জলরাশী
থৈ থৈ করছে। পুরো পাওয়ার প্লান্ট হেঁটে এসে মনে হল এযেন এক ভাসমান দ্বীপ।
এই দ্বীপের দন্ডমুন্ডের কর্তা ও রাজা আমার চাচাতো ভাই নির্বাহী প্রকৌশলী মুজিবুর রহমান কুরেশী মুরাদ। এই রাজার
নির্দেশনায় কয়েক শত লোক এখানে কাজ করেন। অফিসে গিয়ে আমি তার সামনে দাঁড়াতেই
তিনি বেশ বিস্মিত হন, কেমন করে আমি এত দূরে এলাম, জানতে চান। বাথরুমে ঢুকে ফ্রেস হই, লোকেরা চা নাস্তা নিয়ে
আসে।
সুদীর্ঘ পনের
ষোল ঘন্টার ক্লান্তি পুরোপুরি ধুয়ে মুছে ফেলে বিকেলে বেরুই, এবার প্রকল্পের স্পিডবোটে
কর্ণফুলীর মাতাল ঢেউভেঙ্গে দুপাশে পানির ফোয়ারায় জলকণা উড়ায়ে
ভেজা বাতাসে সতেজ হয়ে আবার এই ফিরিঙ্গিঘাটে এলাম। অফিসের একটি গাড়ি আমাদেরকে নিয়ে গেল চট্টগ্রাম মহানগরীর জামাল খান রোডের
পাহাড়ঘেরা পিডিবি কলোনির সুরক্ষিত বাসায়।
দীর্ঘাঙ্গিনী ফর্সা অনিন্দ্যসুন্দরী ভাবী নাসরিন চৌধুরী পাকিস্তান সরকারের শিক্ষামন্ত্রী খান বাহাদুর দেওয়ার আব্দুর রব চৌধুরীর নাতনি ও দেওয়ান আব্দুর রসুল চৌধুরীর কন্যা। তিনি বালাগঞ্জ উপজেলার গওহরপুরের দেওয়ানবাজার সংলগ্ন দেওয়ান আব্দুর রহিম চৌধুরী কলেজের সামনের বিখ্যাত দেওয়ানবাড়ির কন্যা। ভাতিজা তাছিম তখন ছোট্টশিশু, বাবু ও টুনি পাঠশালার পদচারী। এই বাসার গেস্টরূমে ফুলবাড়ির ফুফুতো বোন নজু আপার ছেলে পাবেল অবস্থান করে সিঙ্গার কোম্পানির আন্দরকিল্লা শাখায় চাকুরি করতেন। একজন কালো যুবতী বাসায় রান্না বান্না করতেন।
সিদ্দিকুর
রহমান নির্ঝর পাশের চেরাগি পাহাড়ের সন্নিকটে একটি আবাসিক হোটেলের কক্ষ ভাড়া করেন।
আমার বাসা হতে পায়েহাঁটা দুরত্বে এই হোটেলের অবস্থান। এই হোটেল কক্ষেই আমরা দুইজন
বসে পরীক্ষার সব প্রস্তুতি নেই। আমাদের চট্টগ্রামী সহপাঠী মিরেরসরাইবাসী ফিরুজ আলম প্রায়ই এখানে এসে আমাদের সাথে মিলিত হন। কাছে জামালখান রোডের লাভলি হোটেলের চায়ের খ্যাতি বাতাসে উড়ে। বেশ দুরদূরান্ত হতে এখানে চা পানে চাটগাঁবাসী
ছুটে আসেন। আমরাও কয়েকদিনের জন্য এই লাভলি হোটেলের
মজাদার চায়ের  নিয়মিত কাস্টমার হয়ে গেলাম।
পরীক্ষার কিছুদিন আগে আমি ও নির্ঝর এক সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যাটল ট্রেনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে রওয়ানা হই। চট্টগ্রাম রেলস্টেশনে ঝাঁকে ঝাঁকে প্রাণোচ্ছল তরুণ তরুণীরা এসে হৈ চৈ করে ট্রেনে আরোহন করেন। সুদীর্ঘ ট্রেনটি দেড়দুই হাজার ছাত্রছাত্রীতে পরিপুর্ণ হয়ে যায়, তাই অনেককে সিট না পেয়ে দাঁড়িয়ে যেতে হয়। আমরা দুজন আগে এসে দুটি সিট জুড়ে বসি। অনেক মেয়ে সিট না পেয়ে সামনে দাড়িয়ে আছেন কিন্তু ছেলেরা উঠে মেয়েদেরকে সিট ছেড়ে দেবার সংস্কৃতি এখানে নেই।
চট্টগ্রাম রেলস্টেশন হতে ইউনিভার্সিটি রেলস্টেশনের দুরত্ব বাইশ কিলোমিটার। পথে কয়েকটি স্টেশন রয়েছে। প্রতিটি স্টেশনে গাড়ি থামে ও ছাত্রছাত্রীরা উঠানামা করেন। এই লাইনের জনগণও এসব ট্রেনে টিকেটবিহীন চলাচলের সুযোগ গ্রহণ করেন। ইউনিভার্সিটি রেলস্টেশনে নেমে বের হয়েই দেখি অসংখ্য বাস দাড়ান। দ্রুত বাসগুলো ভরে জ্যাম হচ্ছে, আর ক্যাম্পাসে ছুটে যাচ্ছে। এই বাসগুলো এক বৃত্তাকার পথে সারা বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে আবার রেলস্টেশন চলে আসে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসের সারি চট্টগ্রাম
শহরেও যাতায়াত করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেনে ও বাসে ঘুরে বেড়ানো যেমন জরুরি,
তেমনই এক দারুণ মজাদার অভিজ্ঞতাও
বটে। ছাত্রছাত্রীদের এক বিশাল মিছিল
পায়ে হেঁটে হেঁটে
ক্যাম্পাসের পানে ধাবিত হয়। আমরা এই
মিছিলের সহযাত্রী হলাম। বড়গেট পেরিয়ে বামপাশে শাহজালাল
ছাত্রাবাসে প্রবেশ করি। এখানে আমার হাইস্কুল জীবনের সহপাঠী তৌহিদুল ইসলাম চৌধুরী টিপুর কক্ষে
যাই। সে গণিত অনার্স ফাইন্যাল পরীক্ষার্থী। বিভিন্ন হলে আর
অনেক পরিচিতজনদের কক্ষে বসে সময় কাটাই। 
ক্যাম্পাসে ঢুকেই মনে হল পাহাড়ের
কোলে চিরসবুজ ক্যানভাসে নিপুন কোন শিল্পীর আঁকা মহৎ একটি চিত্রকর্ম যেন এই
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল হতে আসা অপরিচিত মুখগুলো খুব অল্প
সময়েই একে অন্যকে আপন করে নেয়। বিভিন্ন অনুষদে বিভিন্ন বিভাগে ক্লাস, লাইব্রেরি
ওয়ার্ক্স, ল্যাব ওয়ার্ক্সের পর শত শত ছাত্রছাত্রী মেতে উঠে প্রাণের উম্মাদনায়। দল
বেঁধে তাঁরা নেমে পড়ে নিকুঞ্জ বন, বোটানিক্যাল গার্ডেন ও পাহাড়ের চূড়ায়। শ্যাটল
ট্রেনে তাঁরা কোরাস গানে গলা মেলাত, প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে মুভি দেখত, ট্রেনে চড়ে শহরের
নিউমার্কেট গিয়ে ডায়মন্ড হোটেলে চা-আড্ডা জমাত। গ্রীষ্মের দিনে সাউথ ক্যাম্পাসের
পুকুরে ছাত্ররা দলবেঁধে সাঁতার কাটত। সন্ধ্যার পর আশপাশে জোনাকি জ্বলত, নির্জন ক্যাম্পাসে শুনা যেত
শেয়ালের ডাক, হুক্কা- হুয়া, হুয়া।     
আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান ফেকাল্টিতে গিয়ে পরীক্ষাস্থল দেখে আসি। পরীক্ষার সময় বিকাল ১টা হতে ৫টা মোঠ চার ঘন্টা। প্রতি পরীক্ষায় পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়। প্রতি প্রশ্নের জন্য ২০ নম্বর করে পরীক্ষায় মোঠ নম্বর ১০০। আমরা চট্টগ্রাম শহর হতে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে প্রতিদিন পরীক্ষা দেওয়ার সিন্তান্ত নেই।
আমার জন্মের মাত্র ২০ দিন পুর্বে ১৯৬৫ সালের ৩রা ডিসেম্বর এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রী ফজলুল কাদের চৌধুরী। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মদিন পাকিস্তান আমলের ১৬ নভেম্বর ১৯৬৬ সাল, তাই বলা যায় এই জ্ঞানসাগরটি আমার প্রায় সমবয়স্ক একটি প্রতিষ্ঠান। সাগর এই কারণে বললাম যে, এই প্রতিষ্ঠানের আয়তন ১৭৫৪ একর তথা ৮ বর্গকিলোমিটার, যাহা আয়তনে স্বাধীন রাষ্ট্র ভ্যাটিকান সিটির প্রায় দ্বিগুণ। ১২৪ একরের এমসি কলেজকে আমরা নদী বললে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে অবশ্যই সাগর বলতে হবে। নয়নাভিরাম পাহাড়, টিলা, উঁচু উঁচু উপত্যকা জুড়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিস্তৃতি। অজস্র বৃক্ষলতা ঘেরা এক নির্জন নিসর্গে বিশ্ববিদ্যালয়টির অবস্থান।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতর দিয়ে ছয়সাত কিলোমিটার পাকারাস্তা রয়েছে। পঞ্চাশ ষাটটি বড়বাস সারাদিন বৃত্তাকার পথে অনবরত
শিক্ষার্থী পরিবহন করে থাকে। এখানে প্রায় পঁচিশ হাজার ছাত্রছাত্রী লেখাপড়া করেন।
চট্টগ্রামের আংশিক পাহাড়ি উপজেলা
হাটহাজারির প্রকৃতির অপরূপ লীলানিকেতন ফতেহপুর
ইউনিয়নে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের  অবস্থান।
এখানে সাড়ে
তিনলক্ষ বই সমৃদ্ধ একটি পাঠাগার রয়েছে। ইতিহাস বিভাগের তত্ত্বাবধায়নে রয়েছে এক অতি
মুল্যবান পুরাবস্তু সংরক্ষিত বড় যাদুঘর। এখানে রয়েছে ফরেষ্টি ও মেরিন সাইন্সের মত
বিরল বিষয়ে শিক্ষার সুযোগ। নোবেল বিজয়ী ডঃ মোঃ ইউনুস, ঢাকার মেয়র আনিসুল হক,
প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাসহ অনেক দেশবরেণ্য
ব্যক্তিবর্গ এখানে অধ্যয়ন করেন। প্রতিদিন আমরা শহর হতে বেবিট্রেক্সি
করে গিয়ে পরীক্ষা দিতাম ও ফিরতাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেনে কিংবা বাসে। একদিন শাহ আমানত ছাত্রাবাসে আমাদের সন্দীপবাসী এক সহপাঠীকে পরীক্ষাদিবসের সকালে পাঠ্যবই পড়ার পরিবর্তে ইয়াসিন
সুরা তেলাওত করতে দেখে আমি ও সিদ্দিক বেশ অবাক হই। 
আমাদের সময় ২৩মে ১৯৮৮ সাল হতে ২৯ নভেম্বর ১৯৯১ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরের দায়িত্ব পালন করেন প্রফেসর আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজউদ্দিন। সেই সময় রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ছিলেন অধ্যাপক ডঃ রফিকুল ইসলাম চৌধুরী, শ্রদ্ধা ও কৌতুহল জাগানো এই শিক্ষক জনারণ্যে অধ্যাপক আর আই চৌধুরী নামে পরিচিত ছিলেন।
অধ্যাপক ডঃ বি পি বড়ুয়া ছিলেন ছোটখাট ফিগারের বড়মাপের শিক্ষক। গাম্ভীর্য ও মুচকি হাসি একসাথে ধারণ করতেন তিনি। সহযোগী অধ্যাপক ছিলেন ডঃ আফতাব চৌধুরী ব্রিফকেস হাতে রাজসিক ভঙ্গিতে চলাফেরা করতেন, তাকে আসতে দেখলেই ছাত্ররা একপাশে সরে রাস্তা করে দিত। তিনি পরবর্তীকালে বাংলাদেশ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর হন। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় মহাজ্ঞানী ডঃ আফতাব চৌধুরী স্যার আততায়ীর উপর্যুপরী দায়ের কোপে শাহাদত বরণ করেন।
তখনকার সহযোগী অধ্যাপক বদিউর রহমান স্যার এক সময় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হন। সহযোগী অধ্যাপক ডঃ আব্দুল হাকিম শিক্ষাদানে আন্তরিক ছিলেন। অত্যন্ত ব্যক্তিত্ববান এই স্যারকে সবাই ভয় পেত। ডঃ সানাউল্লাহ হেসে হেসে পড়াতেন এবং হেসে হেসে ছাত্রদেকে শাসনও করতেন।
কয়েকজন সহকারী অধ্যাপকের নাম বলছি, তাঁরা ছিলেন জহির আহমদ, ডঃ ইমদাদুল হক, ডঃ সিদ্দিক আহমদ, ডঃ মুনির আহমদ চৌধুরী এবং খাদিজা খানম। ডঃ হাসান মোহাম্মদ স্যারের পড়ানোর সাবলিল ভঙ্গি ও ডঃ মনোয়ার স্যারের শুদ্ধ বাংলা উচ্চারণ ছাত্রদের স্মৃতিতে অমলিন হয়ে আছে।
তখন বেশ কয়েকজন প্রাণচঞ্চল তরুণ প্রভাষক ছিলেন। এই প্রভাষকরা হলেন ডঃ শামসুদ্দিন, ডঃ ইমদাদ, ভূইয়া মনোয়ার কবির, মোস্তাফিজুর রহমান, ফাইমুল কাদির, জিয়াউন নাহার এবং হাফিজা বেগম। হাফিজা বেগম ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দীর্ঘকালীন সময়ের ভাইস চেন্সেলার ডঃ এমাদ উদ্দিনের সুকন্যা। আমাদের এই শিক্ষকরা প্রায় সবাই ছিলেন তাদের সময়ের দেশবরেণ্য চিন্তক ও বুদ্ধিজীবী।
তুড়ুকখলা পাঠশালা হতে শুরু করে চট্টগ্রাম
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত অনেক শিক্ষাগুরুর কাছে লেখাপড়া করেছি। তাঁদের সবার কাছেই আমি কমবেশি ঋণী হয়ে আছি। তাঁদের ঋণ শোধ করা কখনো সম্ভব নয়। আমার এই সব শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষকদের জন্য মহান আল্লাহর দরবাকে প্রার্থনা করি
সুস্থ্য শরীরে সুখী ও প্রশান্ত জীবন। আর যারা নেই, তাঁরা যেন জান্নাতবাসী হন। আমিন।  
একমাসে সবগুলো পরীক্ষা সমাপন করে পরিব্রাজকের বেশে আমরা দুইজন সহপাঠী বন্ধু সিদ্দিক নির্ঝর ও ইসফাক কুরেশী সারাটা চট্টগ্রাম এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল চরে বেড়াই। সহপাঠী ফিরোজ আলম বলল, চলো, ঝাউতলা গিয়ে চিড়িয়াখানার মরা বাঘ দেখে আসি। তার আমন্ত্রণে ঝাউতলা গিয়ে ছোট চিড়িয়াখানা দেখে এগিয়ে যাই পাহাড়ঘেরা মনোরম ফয়েজ লেকে। একটি নৌকা ভাড়া করে পাহাড়ের আড়ালে আবডালে নীরব ঘুমপাড়ানো মনোরম লেকটি তিনবন্ধু মিলে সারাদিন প্রাণভরে উপভোগ করি।
একদিন চট্টগ্রাম বাদশা মিয়া রোডে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত সৈনিকদের কবরগাহ ওয়ারসিমেট্রি দেখতে যাই। সবুজঘাসের গালিচাবৃত পুস্পশোভিত অজস্র সৈনিকের এপিটাক পড়ি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন জাতি, ধর্ম ও বর্ণের অকালমৃত্যুর শিকার বৃটিশ মিত্রবাহিনীর সৈনিকরা সবাই তরুণ, মনকষ্ট পাই যখন দেখি তাঁদের সবার বয়স আটার হতে পয়ত্রিশ মাত্র। উঁচু নিচু পাহাড়ি এই জায়গা শান্ত ও ছায়া সুনিবিড়। এই নীরব নির্জন নিসর্গে সারিসারি কবর দেখে মনে হয় এই নিহত অল্পবয়সী নানা জাতি, ধর্ম ও বর্ণের সৈনিকেরা যেন সেই যুদ্ধবাজ অশান্ত পৃথিবীকে বিদায় জানিয়ে এখানে তাঁরা সব বেদাবেদ ভূলে পরম শান্তিতে পাশাপাশি গভীর নিদ্রায় শুয়ে আছেন। কৃতজ্ঞ বৃটিশ সরকার এই সমাধিক্ষেত্র সযতনে ব্যবস্থাপনা করছেন।
এবার ছুটলাম পাহাড়ি হ্রদের শহর রাঙ্গামাটি। পাহাড়ের গাকেটে তৈরি করা রাস্তা দিয়ে এই প্রথম বাসে ছুটলাম, রাস্তার একদিকে নিচের ঢালু উপত্যকা, আন্যদিকে খাড়া সুউচ্চ পাহাড়। মনোরম কাপ্তাই লেকের শহর রাঙ্গামাটি পৌঁছে আমরা লেকপারের একটি হোটেল ভাড়া করি। চাঁদনী রাতে আমরা দুই বন্ধু হোটেলের ছাদে আরোহন করে লেকের মৃদুমন্দ ঢেউয়ে বুকে চাঁদের রূপালি মুখ ঝলমল করতে দেখে মুহিত হই। ঘুম হতে উঠে পর্যটনে যাই। বসন্তের রাঙ্গামাটি বৃষ্টিহীন অথচ লেকে এতপানি টাইটুম্বুর করছে যে পর্যটনের ঝুলন্ত সেতুটিতে ছিল প্রায় আধহাঁটু জল। প্যান্ট ভাজ করে হাঁটুর উপর তুলে সেতুর জলে পরমানন্দে হেঁটে বেড়াই ও নির্ঝরের ক্যামেরায় অনেক ছবি উঠাই। এখানে মিসবাহ উদ্দিন নামক এক উচ্ছল সিলেটি তরুণের দেখা পাই। বিয়ানিবাজারের সেই ছেলেটি সহজেই আমাদের আপনজন হয়ে যায়। মিসবাহ গাইডের মত আমাদেরকে সময় দেয়। আমার ক্যামেরা দিয়ে সে বেশ সুন্দর সুন্দর কিছু ছবি তুলে দেয়। সেই ছবিগুলো আজও আমার কাছে রক্ষিত আছে।
পরদিন একটি নৌকা ভাড়া করে আমরা বৌদ্ধবিহার ও চাকমা রাজবাড়ি নৌসফর করি। রাজবাড়িতে চাকমা রাজবংশের অনেক অনেক রাজারানীর ছবি, বংশতালিকা ও নানা নিদর্শন ঘুরে দেখি। জলেভাসা টিলার প্রান্তে বসে অনেক গল্পগোজব করি। পরের ঘনবর্ষায় আবার রাঙ্গামাটি যাই কিন্তু গত বসন্তের মত এই বর্ষায় লেকে এত ভরাজল ছিল না, তাই লেকটিকে কেমন নিস্প্রভ মনে হল। তখন নৌকা ভাড়া করে কাপ্তাই লেকের শান্তজলে পাহাড়ের আঁকাবাঁকা নৌপথে শুভলঙ জলপ্রপাতে যাই। নৌপথে চেয়ে দেখি লেকের জলে অজস্র পাহাড় নমঃশির হয়ে ধ্যানমগ্ন সাধকের মত দাড়িয়ে আছে। এই খাড়া পাহাড়ের উপর হতে আর্কিড ও কুসুমসজ্জিত বৃক্ষ ও লতাপাতা নিচের নীলজলে নেমে এসেছে। এই ভাসমান মনোহর পাহাড়গুলোর রূপসৌন্দর্য্য বর্ণনাতীত। তবে শুভলঙ জলপ্রপাত একটি ছোট জলধারা যা আমার চোখে খু্ব একটা আকর্ষণীয় মনে হয়নি। মাধবকুন্ড জলপ্রপাতের মত শুভলং এর জলধারা এত তীব্র নয় এবং বারমাস বহমান নয়। আসলে শুভলঙ্গের নৌপথের স্বর্গীয় সৌন্দর্য্য কেবল অনুভবের যা ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব। মনে মনে গাই, রঙ্গিলা বাঁশিতে কে ডাকে, ঘুম ঘুম নিঝুম, রাতের মায়ায়/ রূপসী নদীর বধুয়ায়, হাওয়ায় দোলা মহুয়ায়, মনে কে আগুন জ্বালায়।
পিডিবি প্রজেক্টের সরকারি স্পীডবোটে কর্নফুলির মাতাল ঢেউভেঙ্গে শিল্পনগরী, সমুদ্রবন্দর ও নদীমোহনা পেরিয়ে পতেঙ্গা সীবিচের সাগরে সীগালের মত কত যে ঘুরে বেড়াই। মহান আল্লাহপাককে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই, অপার মেহেরবানিতে তিনি চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের বনবনানী, পাহাড়, নদী, সাগর, দ্বীপ ও লেক এই সামান্য বান্দাকে নয়নধন্য করে উপভোগ করান।
আমরা বাংলাদেশের নতুন এক অঞ্চলিক ভাষার আনন্দও বেশ উপভোগ করি। চট্টগ্রামের ‘মাইয়া পুয়া’ ও ‘মরদ পুয়া’ শব্দ দুটি শুনে আমরা মজা পেতাম। বাসের লোকভীড়ে বসে চাটগাইয়া ভাষা শুনে আনন্দে হাসতাম। চট্টগ্রামের পথে প্রান্তরে ট্রেনে বাসে সর্বত্র আপাদমস্তক কালো বোরকায় ঢাকা নারীদের প্রাবল্য ছিল, যদিও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বোরকাওয়ালী নারী তেমন দেখা যেতনা।
একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের চাঘরে বসে শুনি ক্যাসেটে বাজছে গান ‘বদ্যায় ভাবীরে ধরি কিলাই ইয়ে, বাবুর্সিখানার পিছনত খন্দন জুড়াই ইয়ে’---। ‘মধু গই গই বিষ খাওয়াইলা---খন খারনে, ভালবাসার দাম নদিলা--- ছিনার লগে বান্দি রাইখুম তুয়ারে, ও ননাইরে’---। চাকাপে চুমুক দিয়ে ক্যাসেটে শেফালী ঘোষ ও শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব জুটির চাটগাইয়া রম্যগান শুনে হাসি আটকানো যেতনা।
এম এস এস
প্রথমবর্ষ চুড়ান্ত পরীক্ষা হবার কথা ছিল ১৯৮৮ সালে কিন্তু সেশনজট ও অপছাত্ররাজনীতির
কারণে তা অনুষ্ঠিত হল দুই
বছর পর ১৯৮৯ সালে। কারণ এই বিশ্ববিদ্যালয়টি তখন দখল করে বসে
আছে এক ধর্মান্ধ ছাত্র সংঘটন। আশপাশের জনপদে তারা বিয়েসাদি করে
শক্তিসঞ্চয় করে বিশ্ববিদ্যালয়ে এক শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা সৃষ্টি করে। ট্রেনে বাসে ও ক্যাম্পাসে
প্রায়ই রগকাটা লাশ পড়ত। তাছাড়া স্বৈরাচারী এরশাদের সামরিক শাসনের উৎপাতে প্রায়ই
বিশ্ববিদ্যালয় দীর্ঘদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যেত। এই অবস্থায় এমএসএস ফাইন্যাল পরীক্ষা
যে কবে নাগাদ হবে তা কেউ বলতে পারছেনা।
ইতিমধ্যে আমাদের এমএসএস প্রথমবর্ষের ফলাফল বেরুল। জানিনা কেমন করে এই পরীক্ষায় আমি সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম হয়ে গেলাম। চট্টগ্রামের মিরেরসরাইয়ের ফিরোজ আলম দ্বিতীয় স্থান লাভ করেন।
১৯৯১ সালের সেপ্টেম্বর/ অক্টোবর মাসে এমএসএস ফাইন্যাল পরীক্ষার রুটিন ঘোষিত হয়। আমি তখন পূবালী ব্যাংকের শিক্ষানবিশ কর্মকর্তা। পুবালী ব্যাংকে একমাসের ছুটি নিয়ে নির্ঝর ও আমি আবার পরীক্ষা দিতে ট্রেনে চট্টগ্রাম ছুটলাম। যথারীতি আগের মত চট্টগ্রাম শহর হতে বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে পরীক্ষাসমুহে অংশগ্রহণ করি।
এবার আমার চাচাতো ভাই ডাঃ এন এ চৌধুরী ওরফে গোলামনবির অনুরোধে খুলশীতে
তার বোন মমতা আপার বাসায় যাই। মমতা আপার অর্ধাঙ্গ ভাটিপাড়ার মনসুরুল হক চৌধুরী একটি
বহুজাতিক কোম্পানির সর্বোচ্চ
নির্বাহী কর্মকর্তা। টেনিস গ্রাউন্ড ও গার্ডেন সজ্জিত সুন্দর বাড়িতে মমতা আপা
আমাদেরকে খুব আপ্যায়ন করেন। এই বাসা হতে
বেরিয়ে আসার পুর্বক্ষণে ভাগ্নী ও তার চিকিৎসক স্বামী এসে
দেখা করেন। মমতা আপা অনিন্দ্যসুন্দরী, নির্ঝর বললেন মা ও মেয়ের মধ্যে কোনজন যে
বয়সে বড় বুঝার উপায় নেই, এই ভদ্র মহিলা যে শ্বাশুড়ি
তা কেঊ বিশ্বাস করবেনা।  
আমরা ছিলাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০তম মাস্টার্স ব্যাচ। বিয়ানীবাজারের শ্রীধরা নিবাসী আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সহপাঠী শামসুদ্দিন বিসিএস দিয়ে এখন সিলেট সরকারি এম সি কলেজের সহযোগী অধ্যাপক ও গোলাপগজ্ঞের বারকোটের কামরুল আক্তার বিসিএস দিয়ে পুলিশের এএসপি হন। প্রাইমারি স্কুল টিচারের পুত্র কামরুল এখন পুলিশের এডিশনাল ডিআইজি। চট্টগ্রাম সাতকানিয়া উপজেলার মাদারীটুলার আবুহেনা মুর্শেদ জামান টিটু (বিসিএস এডমিন) আজ সরকারের অতিরিক্ত সচিবের দায়িত্বে আছেন। গোলাপগঞ্জ ঢাকাদক্ষিণের রায়গড় গ্রামের মোঃ জসিম উদ্দিন মুরাদ জেলা শিশু বিষয়ক সরকারি কর্মকর্তা। দক্ষিণসুরমার ধরাধরপুর মিরেরবাড়ির সৈয়দ মাহবুব ই করিম মুকুল বেসরকারি চাকুরিতে আছেন। হবিগঞ্জ চুনারুঘাটের মোঃ শহিদুল ইসলাম শামিম বার্ডে পদস্থ কর্মকর্তা। ১৭৫/৪ শুভেচ্ছা, মিয়া মঞ্জিলের তারিকুল কিবরিয়া ব্যাংক এশিয়া সিলেটের এফএভিপি।
সৈয়দা খায়রুন্নেছা ইয়াসমিন এখন মৌলভীবাজার হাফিজা খাতুন বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষিকা। মোঃ শাহ নেওয়াজ সহকারী সাধারণ সম্পাদক বাংলাদেশ ফেডারেল ইউনিয়ন অব জার্নালিস্ট (বিএফইউজে)। নূরূল মুমিন সহযোগী অধ্যাপক রাঙ্গুনিয়া কলেজ, চট্টগ্রাম। শামিম আক্তার এভিপি ঢাকা ব্যাংক পিএলসি, এস কে ওমর ফারুক প্রিন্সিপাল, চট্টগ্রাম সি সি কায়সার-নিলুফার কলেজ, মোঃ আলতাফ হোসেন সহযোগী অধ্যাপক, বদরখালি কলেজ কক্সবাজার। তাহমিন আরা প্রশিকার উর্ধতন কর্মকর্তা। মিরেরসরাইয়ের ফিরুজ আলম উর্ধতন এনজিও কর্মকর্তা।
এই ২০তম ব্যাচের মাস্টার্স চুড়ান্ত পরীক্ষায় অর্থনীতি বিভাগ হতে অংশ নেন আমার এম সি কলেজের এইচ এস সি সহপাঠি জকিগঞ্জের মোঃ পারভেজ আলম, তিনি এখন সীমান্তিকে কর্মরত। এম সি কলেজের এইচ এস সি সহপাঠি হেতিমগঞ্জের অলিউর রহমান এই বছর মাস্টার্স পরীক্ষা দেন। অলিউর এখন আমেরিকার মিশিগানে আছেন, আমার সুপরিচিত মৌলভীবাজারের শান্তিবাগের মোঃ রফিউদ্দিন (নাজিম) আমাদের সাথে সেই বছর রসায়নে মাস্টার্স সমাপন করেন। এখন তিনি মৌলভীবাজার সরকারি কলেজে অধ্যাপনা করছেন।
একদিন এমএসএস ফাইন্যাল পরীক্ষা ১৯৮৮ এর চুড়ান্ত ফলাফল বেরুল। রেজাল্ট ভাল হয়, আমি ও নির্ঝর দ্বিতীয় বিভাগ পাই। ১৯৯২ সালে খালেদা জিয়ার আমলে একবার চট্টগ্রামে প্রচন্ড সামুদ্রিক ঘুর্ণীঝড় হয়, এই ঘূর্ণীঝড়ের পরপরই এমএসএস সার্টিফিকেট উঠাতে একাকী চললাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। চট্টগ্রাম মহানগরে সাইক্লোনের যে তাণ্ডব দেখলাম তা আমার ধারনার অতীত। কোন ভবনে গ্লাস নেই, সব ঝরে পড়েছে। বৃক্ষ, বিদ্যুৎ ও টেলিফোনের সব খুঁটি উপড়ে রাস্তায় পড়ে আছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এই করুন দশা দেখে নিদারুন অন্তজ্বালা অনুভব করি। আমার প্রাণপ্রিয় শ্বাসতসুন্দর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একি করুণ অবস্থা, পুরো ক্যাম্পাস বৃক্ষশূন্য, নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে- প্রধান সড়ক হতে শুরু করে সারাটা বিশ্ববিদ্যালয়ে দেশী বিদেশী অনন্যসুন্দর বৃক্ষবন্ধুরা যুদ্ধের মাঠের সারি সারি মৃত সৈনিকদের মত এলোমেলো শুয়ে আছেন ডালপালা ছড়ায়ে।
রনধীর শর্মাকে ধরে সার্টিফিকেট তুলে ফিরব এমন সময় দু’চোখে নেমে এলো চিরবিদায়ের অশ্রুজল। আমার প্রিয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে এতদিনের সব লেনদেন চুকিয়ে আমি ফিরে যাচ্ছি অনেক দূরের সিলেট শহরে। তারপর পেরিয়ে গেছে তিরিশ বছর, সেদিন কি জানতাম এই ফেরাই ছিল আমার শেষ ফেরা- ‘আর কোনদিন পড়বেনা মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে’।
 
 
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন