শনিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

চাকুরি নামক সোনার হরিণের সন্ধানে আমিঃ

 

চাকুরি নামক সোনার হরিণের সন্ধানে আমিঃ

একদিন দুইবন্ধু আমি ও নির্ঝর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হতে সিলেট ফিরলাম। পলিটেকনিকের ঝামেলা খতম, তাই এবার নিজেকে বেশ ভারমুক্ত মনে হল। ভাবলাম আর বসা যাবেনা, একটা কিছু আমাকে করতে হবে। আমার লেখাপড়ার যে হযবরল অবস্থা তাতে আমি যে একটা বড় চাকুরি পাব এমনটি মনে হলনা। বিসিএস অসম্ভব, এমনকি সরকারি কোন বাহিনীর কর্মকর্তা হবার শারীরিক যোগ্যতাও আমার নেই। তাহলে আমার কি আর করার আছে। মনে হল আমার ভবিষ্যৎ পৃথিবী একটি সংকুচিত পৃথিবী। আমাকে একটি সাধার মানুষের জীবনই বেছে নিতে হবে। বেঁচে থাকার স্বার্থে আমাকে যে কোন একটি কাজ বেছে নিতে হবে সেইকাজ কতটুকু ছোট কিংবা কতটুকু বড় তা ভাবার অবকাশ আপাততঃ আমার নেই

এককালের এক ক্রমবিলয়মান এলিট পরিবারে আমার জন্ম হয়েছে সত্য কিন্তু একজন এলিট মানুষ হওয়ার জন্য যেন আমি জন্মিনি। স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যাবার প্রচেষ্টাও সফল হলনা। বিয়ে করে বিদেশী সিটিজেন কনের আচল ধরে দেশখেশ আপনজন সবফেলে কেবল পরাটা নিয়ে পালাতেও মন চাইল না। তাছাড়া শুকনো মাথায় কেউ তেল দেয় না, তৈলাক্ত মাথায়ই কেবল তেল ঢালে তাই আমার খসখসে মাথায় কেউ এসে যে তৈল ঢালবে সেই সম্ভাবনাও তেমনটি নেই। 

আব্বা সফিকুর রহমান চৌধুরীর বয়স সত্তুর পেরিয়ে গেছে অথচ ঠেকায় পড়ে সামান্যটাকা বেতনের জন্য দেড়মাইল দূরে মোগলাবাজার উচ্চ বিদ্যালয়ে আজও হাঁটাহাঁটি করছেন। বছরের পর বছর আমাদের জমিলোভী  সংঘবদ্ধ একদল জানোয়ারের জিহবা দিয়ে তখনও অনবরত কুত্তাজিহবার মত লোভের লালা বেরুচ্ছে, ওদের যন্ত্রণা আব্বার জীবনটাকে দুর্বিসহ করে তুলে। আমি সিন্ধান্ত নিলাম আব্বাকে এবার কিছুদিন বিশ্রাম দেব ও মোগলাবাজার উচ্চ বিদ্যালয়ে তার বদলে আমি ক্লাস নেব। যেই সিদ্ধান্ত সেই বাস্তবায়ন, তার পরিবর্তে আমি শিক্ষক হয়ে ক্লাসে পড়ানো শুরু করলাম। শিক্ষকতা আমার কাছে বেশ আনন্দের কাজ মনে হল। গণিত, পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়ন আমি উচ্চমাধ্যমিক ও পলিটেকনিকে দুইবার করে পড়ে আসায় এসব বিষয় পড়ানো আমার কাছে ছিল একদম ডালভাত আমি খুব যতনে আন্তরিকতার সাথে ক্লাসে পড়ানোর চেষ্টা করতাম। ছাত্রছাত্রীরা আমার বক্তব্য এত আগ্রহভরে শুনত যে ক্লাসে পিনপতন নরবতা নেমে আসত।

১৯৮১ সালে বিদ্যালয় ছেড়ে চলে যাবার ৮/৯ বৎসর পর এই স্কুলে আবার পা রাখলাম। তখন ছিলাম ছাত্র আর আজ হলাম শিক্ষক। একটা নষ্টালজিয়া মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। নয় বছর আগে যে প্রিয় স্যারদেরকে রেখে এসেছিলাম, তারা সবাই এখনও তবিয়তে বহাল। প্রধানশিক্ষক আমার প্রিয় শিক্ষাগুরু শ্রীগুনেন্দ্র চক্রবর্তী। মাথানত করে আমার এককালের শিক্ষকগণকে প্রতিদিন সালাম দিয়ে শিক্ষক মিলনায়তনের কোনের দিকের একটি চেয়ারে নরব হয়ে বসতাম। সবাই আমার এককালের শিক্ষাগুরু, সেই গুরুশিষ্যের সম্পর্কটা বজায় রেখেই আমি কাজ করে যাই।

কিছুদিন পর দেখলাম পথে প্রান্তরে বাজারে শ্রদ্ধেয় পিতার মত আমিও অনবরত ছেলেদের সালাম পাচ্ছি, বাসে উঠলে কোন না কোন একজন ছাত্র দাড়িয়ে আমাকে সিট দিচ্ছে। তখন উৎসাহটা আর বেড়ে যায় এবং মনে করলাম কোথায়ও আমার স্থান নাহলে আমার সাধের কবিতা ও সাহিত্যকে সাথী করে এখানে নিভৃতে পড়ে থাকব। সেইসাথে এই রেঙ্গা পরগনার মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালবাসা নিয়ে আব্বার মত জীবনটা পার করে দেব। আমার ছাত্রদের মধ্যে পরবর্তীকালে তুড়ুকখলার নুরুল ইসলাম আলম দাউদপুর ও নৈখাইয়ের শায়েস্তা মিয়া মোগলাবাজার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হন। তুড়ুকখলার দীপক চক্রবর্তী হন কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষক।  

একদিন স্কুলে আমার সাথে দেখা করতে আসেন আমার এক কালের সহপাঠি তুড়ুকখলার দুলু। তিনি আমার কাছে এসে বললেন তার অষ্টম শ্রেণি পাশের একটা সার্টিফিকেট দরকার, আমি যেন একটু সাহায্য করে বের করে দেই। আমি তাকে হেডস্যারের কাছে নিয়ে গেলাম। হেডস্যার তাকে প্রশ্ন করলেন, ‘করিম স্কুলে যায়’ ইংরেজিতে কি হবে। দুলু উত্তর দিলেন ‘karim go to school’ হেডস্যার শ্রীগুনেন্দ্র চক্রবর্তী খানিকপর আমার কানের কাছে বললেন তাকে এইট পাশ সার্টিফিকেট দেওয়া কি ঠিক হবে। আমি স্যারকে অনেক বুঝিয়ে বাজিয়ে রাজি করে বেরিয়ে আসতেই দুলু দৌড়ে এসে বললেন, স্যার এমন সহজ একটা প্রশ্ন করলেন যে আমি গড় গড় করে উত্তর দিয়ে দিলাম। আমি জবাব দেই স্যার বড় বোকারে ভাই, তরে এত সহজ প্রশ্ন করেছেন। তোর ও আমার সম্মানটা যাক বেঁচে গেছে।

পরীক্ষার উত্তরপত্র দেখার অভিজ্ঞতাও নিলাম। একদিন একটি উত্তরপত্র দেখার অভিজ্ঞতা বলব, খাতাটি পরীক্ষার্থীর লেখায় পরিপূর্ণ হয়ে অতিরিক্ত  পৃষ্টাও সংযুক্ত রয়েছে। পানিপথের যুদ্ধের বিবরণে লেখা পানিপথ নামক জায়গাটি জলাডুবা বিলঝিলে ভরা, তাই জায়গাটির নাম পানিপথ। দিল্লির কাছে অবস্থিত এই পানিপথের জলে বড়বড় যুদ্ধ হয়। নারায়গঞ্জের বিবরণে লিখা আছে নারায়নগঞ্জ মেঘনা নদীর তীরে অবস্থিত। নানা আজেবাজে তথ্যে উত্তরপত্র ঠাসা হয়ে আছে। পরদিন এই ছেলেটিকে বললাম তোমার পরীক্ষা কেমন হয়েছে। সে উত্তর দিল খুব ভাল হয়েছে স্যার, আমি বানিয়ে বানিয়ে এত লিখেছি যে অতিরিক্ত আর দুইপাতা সংযুক্ত করতে হয়েছে।

একদিন সিলেটে সিদ্দিকুর রহমান নির্ঝরের বাসায় যাই। মেঝ আপা বললেন, তাদের এনজিও ভার্ডে সিলেট অঞ্চলের জন্য একজন সিলেটি ম্যানেজার নেবে, বেতন- ২৫০০/-টাকা। সেসময় পুবালী ব্যাংকের জুনিয়র অফিসারের বেতন ছিল- ২৩৬৫/-টাকা। সুতরাং আড়াই হাজার টাকার পরিমাণকে একদম ছোটকিছু ভাবা যায় না। তিনি আমাকে অবেদন করতে বললেন। আমি আবেদন করার কিছুদিন পর ইন্টারভিউ কার্ড পেলাম। ইন্টারভিউ দিতে গেলাম ঢাকায় ভার্ডের হেডঅফিস। ইন্টাইভিউ দিতে সিলেট অঞ্চলের মাত্র তিনজন লোক এসেছেন। প্রথমে যাকে ডাকা হল তিনি একজন কালোবর্ণ দীর্ঘতনু হ্যান্ডসাম ভদ্রলোক। তিনি হাসিমুখে বেরিয়ে এসে তাঁর খুবভাল ইন্টারভিউ হবার গল্প বলে যান। তারপর ঢুকেন পাজামা পাঞ্জাবীপরা ছাগলী দাড়িওয়ালা একজন আনস্মার্ট হুজুরমার্কা লোক। প্রথম জনের হাস্যজ্জল মুখে ভাল ইন্টারভিউ হবার খোশগল্প শুনে আমি ধরে নিলাম তিনি চাকুরিটা পেয়েই গেছেন। আর যদি কোন কারণে ফসকে যায় তবে আমিই পাব। আমি কোনভাবেই ধরে নিতে পারি নি যে হুজুরের চাকুরি হবে। কিছুদিন পর আমি সিলেটে গিয়ে আপাকে বললাম চাকুরিটা কে পেয়েছে। তিনি বললেন  ভিজে বিড়ালমার্কা একজন হুজুর পেয়েছে, যার দোলাভাই ভার্ডের একজন প্রভাবশালী পরিচালক। আপা বললেন তোমাকে আমি ঢাকা পাঠালাম সিলেট অঞ্চলে গোপনে একজন ম্যানেজার নেওয়া হবে শুনে কিন্তু এখানেও দেখি শালা দোলাভাইয়ের কারবার ঘটে গেল।

একদিন চাকুরির জন্য ধর্ণা দিতে গ্রামের ছেলে আমি ঢাকার প্রভাবশালী আত্মীয়স্বজনের দরবারে ছুটলাম। একগাদা পাসপোর্ট সাইজ ফটো ও জীবনে অর্জিত সব সার্টিফিকেটের একটি বড় আটি নিয়ে তেজগাও শিল্প এলাকায় এলবার্ট ডেভিট ঔষধ কোম্পেনিতে চাকুরিরত অগ্রজ তাহমিদ চৌধুরীর কারখানার কক্ষে গিয়ে উঠি। প্রথমে গেলাম কলাবাগানে চাচাত ভাই সাবেক গপুর্ত সচির ইমাম উদ্দিন চৌধুরীর বাসায়। তিনি তখন জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান। চিফ ইঞ্জিনিয়ার থাকাকালে তিনি আমাদের অঞ্চলের অনেক লোককে বাংলাদেশ রেলওয়েতে চাকুরি দেন। ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং করে এসেছি শুনে তিনি বললেন এই ডিপ্লোমা সার্টিফিকেট নিয়ে এখন চাকুরিতে ঢুকে উন্নতি করা খুবই কঠিন, তাছাড়া সময় ও সুযোগ ছাড়া হঠাৎ করে সরকারি চাকুরি হয় না।

ইমাম উদ্দিন চৌধুরী আমাকে উপদেশ দেন তার অগ্রজ পুবালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ই এ চৌধুরী এই ব্যাংকে অফিসার নিবেন, তার কাছে গিয়ে যেন ধর্ণা দেইকলাবাগান হতে ছুটে গেলাম পুবালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়, দিলকুশায়। তিনতলায় গিয়ে চেয়ারম্যান জনাব ই এ চৌধুরীর সাথে দেখা করার আবেদন করি। ভিতরে কি এক জরুরি সভা হওয়ায় প্রায় দেড় ঘন্টা পর আমার ডাক পড়েসেদিন তার গাঁয়ে ছিল খুব সুন্দর টিয়াবর্ণের স্যুট। আমি সালাম দিলে তিনি আমাকে সামনের চেয়ারে বসতে বলেন।

এইদিন ক্লিনসেভ ই এ চৌধুরীকে এত স্মার্ট ও হ্যান্ডসাম  লাগছিল যে মনে হল আমি একজন শ্বেতাঙ্গ বৃটিশ লর্ডের সামনে বসে আছি। তিনি আমাকে বললেন আমরা অফিসার নিয়োগের জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েছি, আবেদনের শেষ তারিখ পার হয়ে গেছে। আগামীকালই যেন আবেদনপত্র জমা দেই। পরদিন আবার তার সাথে দেখা করি, তিনি আবেদনপত্রটি হাতে নিয়ে ব্যাংকের মানবসম্পদ বিভাগে পাঠিয়ে দেন এবং মানবসম্পদ বিভাগ হতে পুবালী ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষার বিগত দশ বৎসরের প্রশ্নপত্র এনে আমার হাতে তুলে দেন।

পুবালী ব্যাংকের হেডঅফিস হতে বেরিয়ে পাশে গ্রিনডেল্টা ইন্সুরেন্স কোম্পেনির হেডঅফিসে গিয়ে এবার ঢুকলাম এই কোম্পেনির প্রতিষ্ঠাতা ব্যাবস্থাপনা পরিচালক এবং সি ই ও নাসির এ চৌধুরীর অফিসে। ই এ চৌধুরীর ছোটভাই কৃশকায়া দীর্ঘতনু শ্বেতাঙ্গ সুদর্শন নাসির এ চৌধুরী বাংলাদেশের একজন কর্মপাগল কিংবদন্তী বীমা ব্যাক্তিত্ব। কক্ষের বাহিরে বসা পিএ একজন সুদর্শনা রমণী, তার কাছে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সাথে দেখা করার আবেদন পেশ করলাম। খুব একটা সময় লাগেনি ভিতর হতে সক্ষাতের অনুমতি আসল।

অতিভদ্র সুজন নাসির এ চৌধুরী তার সামনে বসা একজন গণ্যমান্য লোককে আমার পরিচয়ে শুধু এই কথাই বলতে শুনলাম, সে সিলেটের একটি এরিস্টক্রেটিক ফেমিলির ছেলে, তারপর একজন কর্মকর্তাকে ডেকে এনে আমার জীবনবৃত্তান্ত ও আবেদনপত্র রেখে দেন। চাকুরি খোঁজার এই ঝটিকা অভিযান সমাপ্ত হলে আবার সিলেট ফিরে আসিকিছুদিন পার হলে গ্রনডেল্টা ইন্সুরেন্স কোম্পানি হতে সিনিয়র অফিসার পদে নিয়োগপত্র পেলাম। নিয়োগের সূচনাতে ঢাকায় বাংলাদেশ বিমাশিল্প প্রশিক্ষ ইন্সটিটিউটে ছয় মাসের প্রশিক্ষ নিতে হবেসামনে রমজান মাস ও রমজানের ১৫/২০ দিন আগে প্রশিক্ষ শুরু হবে। সবাই বললেন ব্যাংকের চাকুরি বীমার চেয়ে ভাল, রমজানে বাড়ি ছেড়ে ঢাকা গমন ও এই বিমা কোম্পির হেডঅফিস ঢাকায় নিয়োগ আমাকে গ্রনডেল্টা ইন্সুরেন্স কোম্পেনিতে যোগদানে নিরুৎসাহিত কর, বরং আমি পুবালী ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষার অপেক্ষায় রইলাম।

গ্রীনডেল্টায় যোগ না দিয়ে সে সময় আমি হয়ত ভুলই করেছিলাম। কারণ বেশ কয়েক বছর পর আমার ভাতিজা মুত্তাকিম কুরেশী রিপন গ্রীনডেল্টায় যোগ দিয়ে বেশ কিছু দেশভ্রমণের সুযোগ পায়, কোম্পানি হতে গাড়ি পায়, ধানমন্ডিতে বড়বাসায় সপরিবারে থেকে সচ্ছন্দে চলার মত বেতন এবং সুযোগ সুবিধা পায়। আমি পূবালীতে যোগ দিয়ে সে তুলনায় কিছুই পাই নি। তদুপরি চাকুরি জীবনের শেষপ্রান্তে এসে ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল হালিম চৌধুরীর আমলে গোদের উপর বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়ায়- যেখানে সেখানে বদলিকরণ ও পদোন্নতি আটকে দেয়া।  

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন