শনিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

সিলেট পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের স্মৃতিমালা, প্রচন্ড খাটুনি নিস্ফলাঃ

 

সিলেট পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের স্মৃতিমালা, প্রচন্ড খাটুনি নিস্ফলাঃ

সেশনঃ ১৯৮৩-১৯৮৪ চুড়ান্ত পরীক্ষাবর্ষ- ১৯৮৬ অবস্থানঃ জানুয়ারি ১৯৮৫ হতে ডিসেম্বর ১৯৮৮ সাল 

১৯৮৩ সালে এইচএসসি পাস করে ছুটলাম ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে সিলেট পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটে। দক্ষিসুরমার টেকনিক্যাল রোডে সুরমাপারে খোজারখলা ও বরইকান্দি গ্রামের মধ্যভাগে প্রতিষ্ঠানটি অবস্থি। প্রতিষ্ঠানের আসামাত্রই  টেকনিক্যাল রোডের পাশঘেষে রয়েছে প্রতিভা ছাত্রাবাস। রেললাইন পার হয়ে একটি বর্গাকার দিঘির উত্তরপারে তিনতালা সুদীর্ঘ্য ক্যাম্পাস, পশ্চিমপারে মসজিদ, সুরমা ছাত্রাবাস ও বাইসাইকেল সেড। দিঘির দক্ষিপারে বিশাল খেলারমাঠ, এমাঠে ছাত্ররা ফুটবল খেলত, প্রতিবছর বাহিরের স্থানীয় লোকজনের আয়োজনে হত স্বর্ণকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট। বর্গাকার দিঘির পুর্বপারে শিক্ষক কোয়ার্টার, অধ্যক্ষের বাসা ইত্যাদি স্থাপনা। এখানে একটি সুউচ্চ পানির ট্যাংক মিনারের মত দাঁড়িয়ে আছে। সিলেট-ছাতক রেললাইন ইন্সটিটিউটকে দ্বিখন্ডিত করে চলে গেছে বিশ একর জায়গা জুড়ে প্রতিষ্ঠানটি প্রসারিত। আমার জন্মের মাত্র দশ বছর আগে প্রতিষ্ঠানটির সূচনা হয়, যার প্রতিষ্ঠাকাল ১৯৫৫ সাল।

আমার ছোট দুলাভাই লিয়াকত হোসেন চৌধুরী জেদ্দায় এক আমেরিকান কোম্পানিতে চাকুরি করতেন। তিনি বললেন সেখানে তার ডিপ্লোমা ইজ্ঞিনিয়ার ভাতিজা জাফর ও সামুয়েল প্রচুর রোজগার করেন ও আমি তিনবছরের এই কোর্স করে সেখানে চলে গেলে ভাল আয় করতে পারব। তাছাড়া তখন কয়েকজন ডিপ্লোমা ইজ্ঞিনিয়ার আত্মীয় বেশ ভাল পদে চাকুরি করতেন। হতাশাগ্রস্ত দিশেহারা আমি তাই আগপিছ চিন্তা না করে কোন পুর্ব পরিকল্পনা ছাড়াই হঠাৎ এদিকে ছুটলাম।  

১৯৮১ সালের এসএসসি সার্টিফিকেট দিয়ে আবেদন করলাম। সিবিল, ইলেকট্রিক্যাল, মেকানিক্যাল এবং পাওয়ার টেকনোলজির প্রতি বিষয়ে চল্লিশজন করে মোঠ একশত ষাটজন ছাত্র ভর্তি হন, কোন মেয়ে ভর্তি হতে আসেনি। পুরো পলিটেকনিকে আমাদের সিনিয়র ক্লাসে একজনমাত্র ছাত্রী ছিলেন যার নাম দীপ্তা মজুমদার। এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল অনুসারে প্রথম ভাল চল্লিশজনকে সিবিল টেকনোলজিতে ভর্তির সুযোগ প্রদান করা হয়। আমি সিবিল টেকনোলজিতে সুযোগ পাই ও আমার ভাগ্যে জোটে একটি সুন্দর রোল নং ৮৩ ১০০ সেশনঃ ১৯৮৩-৮৪ তিন বছরের কোর্স, প্রথমবর্ষে সবার জন্য অভিন্ন পাঠ্যক্রম এবং পরবর্তী দুই বছর প্রতিটি বিষয়ের (বিভাগের) আলাদা আলাদা সিলেবাস।

সেশনজটের জন্য একবছর পর ১৯৮৫ সালের প্রারম্ভে কোন এক সময় পলিটেকনিকে ক্লাস শুরু হল। ইতিমধ্যে আমি মদন মোহন কলেজে বিএ প্রথমবর্ষ সমাপন করে দ্বিতীয়বর্ষে বিচর করছি। পলিটেকনিকে ক্লাস শুরু হল, কিছুদিনের মধ্যে একসন্ধ্যায় জমকালো নবীনবর অনুষ্ঠান হল। কিন্তু আমার জন্য বড় সমস্যা হল এখানে ক্লাস শুরু হয় সকাল সাড়ে সাতটায়। আমাকে পলিটেকনিকে পাঠাতে আম্মা আসমতুন্নেসা ভোরের আজানের আগে উঠে আমার জন্য রান্না করতেন। এখানে ভর্তি হয়ে আমার মাকে অনেক যন্ত্রণা দিয়েছি। আজ ভাবলে দুঃখ হয়, যে পড়া জীবনে কাজে লাগাইনি, তা অনর্থক পড়তে গিয়ে মাকে কেন এত কষ্ট দিলাম। রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বাইয়ানে ছগিরা।

পাহাড়লাইনে কিংবা মোগলাবাজারে এসে এত সকালে গাড়ি মেলা ছিল ভার। তাই দ্রুতখেয়ে সাতসকালে রফিপুর নয়ামসজিদের দিকে উদ্ধশ্বাসে হাঁটতাম। ঘন কুয়াশায় চূল ভিজে যেত। দড়া ও শানখপুরের ভিতর দিয়ে চল্লিশ পঞ্চাশ মিনিট হেঁটে এখানে সিলেট-গোলাপগঞ্জ রোডে পৌঁছে গেলে সিলেটগামী গাড়ির অভাব হতনা, আসামাত্রই গাড়ি মেলত

রফিপুর নয়ামসজিদের পাশের চৌধুরীবাড়ি আমার বড়চাচির আত্মীয়, এবাড়ির একজন মেম্বার এখানে দোকান দিতেন। তার সাথে আমার বেশ ভাব জমে উঠে। অবশ্য বিকেলে বাড়ি ফিরতাম পাহাড় লাইন হয়েসিলেটে নেমেও বাস টার্মিনাল হতে পলিটেকনিক পর্যন্ত অনেক পথ হাঁটতে হত। সীমিত হাতেগুনা কিছু টাকা নিয়ে বের হতাম, তাই পয়সা বাঁচাতে প্রচুর হাঁটতাম। কোন কোন দিন হাতে টাকা থাকলে একটা সিঙ্গারা কিনে মুখে পুরতাম, আবার অতিরিক্ত খরচ হয়ে গেলে সস্তা ভাড়ায় টাউনবাসে মোগলাবাজার তিমুখায় নেমে সোয়ামাইল হেঁটেও মাঝে মাঝে ঘরে ফিরতাম। 

বাড়িতে প্রচুর সুপারী হত, আমাদের ঘরে সুপারী চিবানোর কেউ ছিলেন না। গ্রামের মহিলারা এসে সুপারী কিনে নিত। এই টাকা জমিয়েও আম্মা মাঝে মাঝে আমার পথ খরচের টাকা হাতে তুলে দিতেন। এত হেঁটে দৌড়ে বাসে প্রায় আট মাইল দূর হতে এসে একটু লেট হলে শিক্ষকদের কথা শুনতে হত। বাড়ি দূরে বলেও পার পাওয়া যেতনা। জবাব পেতাম তাহলে মেছে কিংবা হোস্টেলে চলে এসো।

এখানে আমার এম সি কলেজের কয়েকজন এইচএসসি সহপাঠী এসে ভর্তি হনযেমন চট্টগ্রামে শ্রীসুশান্ত শেখর চক্রবর্তী (সিবিল), সুনামগঞ্জের কাজি শামসুল হুদা সুহেল (সিবিল), বিনয় ভূষণ রায় (সিবিল), ধোপাদিঘিরপারের ডাঃ হাবিবুর রহমান চৌধুরীর পুত্র ইসমাম হাবিব চৌধুরী (সিবিল), তাঁতিপাড়ার নিয়াজ আহমদ চৌধুরী (সিবিল) নাজিম উদ্দিন, ফুলবাড়ির খাইরুল আক্তার চৌধুরী (ইলেকট্রিক্যাল), ফুলবাড়ির সফাকুল ইমরান চৌধুরী (পাওয়ার), ঢাকাদক্ষি রায়গড়ের পাপু (মেকানিক্যাল), গোপেন দেব (ইলেক্ট্রিক্যাল), নকুল দে (মেকানিক্যাল)  ফনিভূষণ সরকার, গোপী সরকার এবং ভাদেশ্বরের মুমিন চৌধুরী (মেকানিক্যাল)

এমসি কলেজ ছাড়া অপরিচিত সুত্র হতে এসে সিবিল টেকনোলজিতে ভর্তি হন সিলাম চরমোহাম্মদপুরের মাহবুবুল হক চৌধুরী টিটু, শ্রীমঙ্গলের ধ্রুব ও তাপস, জিন্দাবাজার গোবিন্দজিউড় আখড়ার নিতাই পাল, সত্যেন্দ্র বৈদ্য, বড়লেখার কামাল আহমদ, ফরিদপুর জেলার আবুল বাশার, হবিগজ্ঞের বেলাল আহমদ, কুমিল্লার তপন, সুনামগঞ্জের কালিকৃষ্ণ, ছাতকের জগদীশ চন্দ্র দেব ও যশোদা রায় প্রমুখ।

নিতাই পাল জালালাবাদ গ্যাসে, খায়রুল আক্তার চৌধুরী ও নাজিম উদ্দিন শাবিপ্রবিতে এবং সত্যেন্দ্র বৈদ্য সরকারি পানি উন্নয়ন বিভাগে কর্মরত ছিলেন। টিটু ও পাপু আজ যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী। নিয়াজ চৌধুরী কিছুদিন পর ঝরে পড়েন এবং এ বি ব্যাংকে যোগদান করেন। নিয়াজ চৌধুরী ব্যাংক এসিয়ার চাকুরি ছেড়ে এখন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী। মুমিন চৌধুরী এ বি ব্যাংকে কিছুদিন কাজ করে যুক্তরাজ্যে চলে যা ইমরান চৌধুরী একদিন রহস্যজনক কারণে ফুলবাড়িতে মারা যা। সুশান্ত, যশোধা, বাশার ও কামাল এরা কে কোথায় আছে জানিনা। তাঁদের সাথে আর কোন যোগাযোগ নেই। শ্রীমঙ্গলের জাতক ধ্রুব আমেরিকায় ও তাপস কানাডায় আছে।

সিলেট পলিটেকনিক ছাড়ার প্রায় ৩৩ বছর পর ২০২১ সালে আমার এম সি কলেজ এবং পলিটেকনিকের সুদীর্ঘ পাঁচ বছরের সহপাঠি কাজি শামসুল হুদা সুহেলের সন্ধান পাই ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে। সে এই দুই প্রতিষ্ঠানের ছাত্রাবাসে থেকে লেখাপড়া করে। ছাত্রাবাসে তাঁর কক্ষে বসে অনেক আড্ডা দেই। সে ছিল মাঝারী মেধাবী। কোথায় আছ জিঞ্জেস করলে জানালো, পলিটেকনিক হতে বেরুনোর পর চাকুরির বয়স চলে যাচ্ছে দেখে তফসিলদার পদে ঢুকে পড়ে। বর্তমানে সে জগন্নাথপুরের তফসিলদার। তাঁকে বললাম, আমার পিতাও পাকিস্তান আমলের প্রথম দিকে সুনামগঞ্জের কানুনগো ছিলেন। তাঁর কাছে জানলাম সহপাঠী কালিকৃষ্ণ এখন সুনামগঞ্জ পৌরসভার প্রকৌশলী।

পলিটেকনিকের ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে মঝেমধ্যে বিস্তর অবসর সময় থাকত। তখন আমরা ইনডোর গেইম খেলতাম। আবার সুরমা ও প্রতিভা হোস্টেলে গিয়ে আড্ডা দিতাম। মদন মোহন কলেজে গিয়ে বি এ ২য় বর্ষের ক্লাস করতাম। সহপাঠিদের অধিকাংশই ছিল বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা হতে আগত। তাঁরা ভিন জেলার আঞ্চলিক টানে মজার মজার রসালো দেশী গল্প বলত। এসব গল্পের অনেকগুলোই অশ্লীল কৌতুক, যা আমি এই আত্মজীবনীতে বলা উচিত হবে কিনা ভাবছি। তাই আমার মত বয়স্করাই কেবল এই গল্পগুলো পড়বেন এবং জুনিয়ররা দয়াকরে বিরত থাকবেন।

গল্প- একঃ বরিশালের গ্রামে একজোড়া নবদম্পতি বাসর ঘরের দরজা বন্ধ করে সাজ-পালঙ্কে যান। অনেক রুমাঞ্চের পর বর কনে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে মিলনে যাবেন, এমন সময় বাহির হতে একটি শব্দ শুনা গেল- কে-চো দে। কন্ঠ বরের বুড়ো দাদুর। তাহলে দাদু কি কোন গোপন পথে সব দেখে শব্দটা ছুড়লেন। বর সারাটা কক্ষের টিনের ওয়াল খুঁজে কোন ছিদ্রের সন্ধান খুঁজে পেলনা। ঘণ্টা খানেক পর আবার তাঁরা যখন মিলতে যাবে অমনি শব্দ শুনতে পায়- কে-চো দে। এভাবে বার বার ব্যর্থ নবদম্পতি শেষরাতে আসামি দাদুকে হাতেনাতে ধরতে বাসরঘর হতে বেরিয়ে আসেন। বাসর ঘরের পিছনের পুকুরের ঘাটে দাদু পূর্নিমার আলোয় বসে বরশি বাইছেন। দাদুর পাশে কাজের ছেলেটা টোপ নিয়ে বসে আছে। বরশির টোপ শেষ হলেই দাদু কাজের ছেলেটাকে বড়গলায় ঝাড়ি মারেন- এই, কেচো দে। আসামী ধরতে আসা নাতি ও নাতিবউ পুকুরঘাটে দাদুর কাছে গিয়ে বসে বলল, দাদু তুমি আমাদের সর্বনাশ করলে, তোমার বরশির টোপের কেঁচো, আমাদের এই রঙ্গিন বাসর রাতটা পুরোপুরি বরবাদ করে দিল। হাহ হাহ হা।

গল্প- দুইঃ স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ সুরমা বালা দেবী চেম্বারে বসে রুগী দেখছেন। রুগিনীর স্বামী জানতে চাইলেন জন্ম নিয়ন্ত্রনের কোন পদ্ধতি নিরাপদ। ডাঃ প্রতিমা বালা বললেন কনডম। কনডমে কোন ধরনের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নেই। কিছুদিন পর রুগিনীর স্বামী ভীষণ রেগেমেগে ডাঃ সুরমা বালা দেবীর চেম্বারে এসে বললেন, আমি আপনার কথামত কনডম ব্যবহার করলাম, তারপরও আমার গিন্নীর গর্ব হল কেন? সঠিক জবাব দিন। ডাঃ সুরমা বালা বললেন আপনি  কি সঠিকভাবে কনডম পরেছেন? জবাব এল, কেন? আমি তো বিগত দুমাস ধরে দিনরাত কনডম পরেই আছি। এবার ডাঃ সুরমা বালা বললেন তাহলে আপনি মূত্রত্যাগ করছেন কিভাবে? আরে হিসি ছাড়া কি থাকা যায়, তাই বুদ্ধি খাটিয়ে কনডমের অগ্রভাগে আমি একটা ছিদ্র করে রেখেছি। হাসির রোল উঠল- হাঃ হাঃ হা।

গল্প- তিনঃ মুফিজ আলী একজন খাস কৃষক। তাঁর কয়েক প্রজন্ম কৃষি জমিতেই খেলানেলা করে জীবন পার করেছে। মুফিজ আলীর মনে কেবল কৃষি জমি চাষের চিন্তা ঘুরপাক খায়। একদিন মুফিজ আলী বিয়ে করে নববধূ ঘরে আনেন। বাসর রাতে নতুন বউয়ের শরীরটা তিনি তলিয়ে দেখছেন। বউয়ের বুকে হাত লাগাতেই বেশ উঁচু উঁচু লাগে। মুফিজ আলী বললেন, উঁচু জায়গায় ভাল কলা হয়। এখানে জৈষ্ট্য মাসে কলা লাগাবো। বউয়ের পেঠে হাত ঠেকিয়ে দেখলেন সমতল। এবার বললেন সমতলে ধান হয়। এখানে ভাদ্রমাসে ধানচাষ করব। আরেকটু নিচে হাত যেতেই বললেন জমিটা একদম নিচু, এখানে খুব ভাল রবিশস্য হবে। আগামী কার্তিকে এই জমিতে মূলা লাগানো যাবে। মুফিজ আলীর এসব কথাবার্তা শুনে বিরক্ত নববধু বলল, এখন মাত্র ফাগুন মাস, জৈষ্ট্য আসার এখনও তিনমাস বাকি। এই উর্বর জমি নিয়ে আমি তিনমাস আবাদের অপেক্ষায় বসে থাকতে পারবনা। আপনি যাহা চাষ করার এখনই করুন। নইলে এই জমি অন্য কাউকে বর্গা দিয়ে দেবো। আবার সবাই হাসে- হাঃ হাঃ হা।

আমাদের ব্যবহারিক ক্লাস অনুষ্ঠিত হত ক্যাম্পাস ভবনের নীচতলার বিভিন্ন ওয়ার্কসপে- যেমন ইলেকট্রিক্যাল, প্লাম্বিং এন্ড সেনিটেশন, ওয়েল্ডিং, উডওয়ার্ক্স, আরসিসি ওয়ার্কসপ ইত্যাদি। এসব ওয়ার্কসপে কাজ করতে গিয়ে খুব পরিশ্রম হত ও ঘামে কাপড় ভিজে যেত তাছাড়া ওখানে তীব্রশব্দ দুষ সৃষ্টি হত। বামকানে একটু সমস্যা থাকায় অন্যের কথাবার্তা শুনতে সেখানে ভীষ অসুবিধা হততাই এইসব ওয়ার্কসপে গিয়ে আমি কথাবলা বন্ধ করে দিতাম যাতে অন্যরা আমার সাথে কথা বলা হতে বিরত থাকে

আমাদের সময় এই ইন্সটিটিউটের অধ্যক্ষ ছিলেন মোঃ নেছওয়ার আহমদ। তার অফিস ছিল ক্যাম্পাসের দ্বিতীয় তলায়। তিনি আমার বড় দুলাভাই মুফতি মোঃ খালিদের সহপাঠি ছিলেন। পাঠাগারে ছিল নানা বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিষয়ক বইয়ের বড় সমাহার ও পড়ার সুব্যবস্থা।  হ্যান্ডসাম ও ইয়াং স্যার কামরুল হাসান পড়াতেন ড্রইয়িং এন্ড ইস্টিমিটিং, একটানা দেড় ঘন্টার ক্লাস। বিল্ডিং ড্রয়িং বেশ কঠিন কাজ, আর কঠিন ইস্টিমিটিং। রড, সিমেন্ট, চুরকি, ইট, বালুর পরিমান হিসাবনিকাশ করে মোঠ বাজার মুল্যে বাড়ির শ্রমসহ নির্মাণখরচ বের করা হত। 

দাড়িওয়ালা প্রৌঢ় জমিরউদ্দিন স্যার সার্ভে ও স্ট্রাকচারাল ডিজাইন, মাখনলাল পাল প্লাম্বিং এন্ড সেনিটেশন পড়াতেন। জমিরউদ্দিন স্যার পলিটেকনিকের মাঠে ও সড়কে রোদের মধ্যে চেইন সার্ভে এবং থিয়োডুলাইট সার্ভে করাতেন। জমির স্যার ঘামতেন, সাথে আমরাও।  

পলিটেকনিকে অনেক শিক্ষকের কাছে ইংরেজি, গণিত, স্টেংকথ অব মেটেরিয়ালস, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, রোডস এন্ড হাইওয়ে ইত্যাদি বিষয় পড়ি কিন্তু তাদের নাম আজ মনে নেই। আমরা এইচ এস সি পড়ে আসায় এসব তেমন কঠিন মনে হয়নি। প্রায় সিমিস্টারে কি একটা বৃত্তি পেতাম।

সবসময় একটি টি-স্কেল, ড্রয়িংবক্স ব্যাগে রাখতে হত। ওয়ার্কসপে আমরা বিভিন্ন দ্রব্য তৈরি করি, ইটের দেওয়াল, ইলেকট্রিক্যাল ওয়ারিং, ইলেকট্রিক আর্কওয়েল্ডিং, গ্যাস ওয়েল্ডিং, পাইপ ফিটিং, কাটের কাজ, সি সি ব্লক তৈরি করে বিভিন্ন মেয়াদে কিউরিং করে শক্তিপরীক্ষা ইত্যাদি। উয়েল্ডিং করা বেশ কঠিন কাজ। ইলেক্টর লোহার কাছে নেওয়া মাত্র জট লেগে যায়। ইকেক্টরকে লোহার সাথে ছোয়ানো যাবেনা, আবার দূরেও রাখা যাবেনা। একদিন একটি ছোট ব্রিকওয়াল নির্মাণ করে বুঝলাম মিস্ত্রিরা কি কঠিন কাজ করে থাকে। কাটের কাজও শরীর ঘামিয়ে দেয়।  

পলিটেকনিক ইন্সটিটিঊটের প্রায় বার্ষিক ম্যাগাজিনে আমার লেখা বের হয়। মনে পড়ে একবার আমেরিকা ও রাশিয়ার সেই সময়ের স্নায়ুযুদ্ধ নিয়ে প্রবন্ধ লিখেছিলাম। এখানে এক বৎসর ছাত্রসংসদ নির্বাচনে ভাগনা পাপু সাধার সম্পাদক পদে প্রার্থী হন। ভোটের দিন বাড়িতে জরুরী কাজ থাকায় আমি ভোট দিতে যাইনি, অথচ পরদিন শুনলাম পাপু মাত্র এক ভোটের জন্য হেরে গেছে। পাপুর পিতা ছিলেন জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপক, তাদের বাসা সিলেটের শাহজালাল উপশহরে হলেও পৈত্রিকবাড়ি ঢাকাদক্ষিণের পাশের টিলাটক্করে ভরপূর  রায়গড় গ্রামে। 

ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের নানা দাবিদাওয়া নিয়ে প্রায়ই মিছিল মিটিং হত, ক্লাস হতনা। এতদূর থেকে এসে প্রায়ই দেখা যেত আজ ক্লাস হবেনা। এমন দিনে মদন মোহন কলেজে গিয়ে বি এ শেষবর্ষের ক্লাস করতাম। পলিটেকনিকেও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংঘটন ছিল, এসব দলগুলোর ছাত্রদের মধ্যে সে সময় বেশ কুন্দল বিরাজ করত। দুই একদিন বেশ মারামারি ও হাতাহাতি হতে দেখি। 

বরইকান্দি ও খোজারখলা গ্রামের লোকজন ও ছাত্রদের মধ্যে প্রায়ই অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে যেত। এই দুই গ্রামের নেতা, শিক্ষক ও সরকার মিলে এধরনের হাঙ্গামা সামাল দিতেন। একবার ছাত্রদের সাথে মারামারি করে খোজারখলার একজন যুবক নিহত হন। গ্রামবাসী তখন সুরমা হোস্টেলে হামলা করে আগুন ধরিয়ে দেয়। ফায়ার সার্বিস ও পুলিশ এসে হোস্টেলের নিরিহ ছাত্রদেরকে উদ্ধার করে। সেদিন আমাদের সহপাঠী পটুয়াখালীর একজন ছাত্র এই হামলায় নিহত হয়। আমাদের বেঁটে প্রিন্সিপাল নেছওয়ার আহমদ তখন এই পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটকে বরইকান্দি হতে কোন এক নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে সরকারের কাছে সুপারিশ করেন।   

তৃতীয় বছরে এসে খুবসম্ভব ১৯৮৮ সালে আমরা সরকারি খরচে সিবিল টেকনোলজীর চল্লিশজন ছাত্র শিক্ষাসফরে ট্রেনে চট্টগ্রাম গমন করি। আমাদেরকে চট্টগ্রাম বন্দরের ভিতর নিয়ে গিয়ে বন্দরের সবধরনের যান্ত্রিক কার্যবলী দেখান হয়। ডকড্রাইতে ঢুকে জাহাজ নির্মা ও মেরামত কারখানার কাজ দেখি। বিশাল জলাধারে ভাসমান জাহাজ ঢুকায়ে জলাধারটি জলশুন্য করে জাহাজটির তলদেশে শ্রমিকেরা মেরামত কাজ করেন। মেরামত কাজ শেষ হলে আবার জল প্রবেশ করায়ে জাহাজটিকে এই জলাধারে ভাসমান করে পুনরায় কর্নফুলি নদীর মোহনার সাগরে সহজে ফেলে দেওয়া হয়।

চিটাগাং স্টিলমিলে প্রায় চারঘন্টা ঘুরে ফ্যাক্টরির দানবীয় উৎপাদন প্রক্রিয়া দেখে বিষ্মিত হই। জ্বলন্ত লোহার বিরাট বিরাট লালবার জলে পড়ে পানি বাস্পে পরিনত করে ঠান্ডা হয়ে জমাট বাধছে; রড, পাত ও টিন তৈরি হচ্ছে। ইস্টার্ন রিফাইনারিতে ঢুকে আমরা নানা ধরনের জ্বালানী তৈলের প্রক্রিয়াজাতকর পদ্ধতি পর্যবেক্ষণ করি। কর্নফুলী পেপারমিলে ঢুকে গলিত বাঁশ হতে কাগজ তৈরির পদ্ধতি দেখি। চট্টগ্রাম উইভিং মিলে  সুতা তৈরির পদ্ধতিও দেখান হয়।

দুইতিন দিন ধরে এত এত দৈত্যাকার কলকারখানার ক্রিয়াকলাপ দেখে মনে হল আমাদের দেশে কত কিছুই তো হয়, এই দেশ কম কিসের? নিজদেশের একটা বড়ত্ব তখন আমার চোখে ধরা পড়ে। আমরা সবাই মিলে পতেঙ্গা সিবিচে যাই, র্নফুলির মোহনায় পাথরের বাঁধে সাগরের ঢেউ আচড়ে পড়তে দেখি সাগরপারে ঝিনুকবাজার ঘুরে ঘুরে দেখা হয়। আমরা চার বন্ধু টিটু, আমি, নিতাই ও সুশান্ত সব সময় একত্রে অবস্থান করি।

চট্টগ্রামের দুইতিন দিনের মিশন শেষকরে আমরা একটি বাসে করে কক্সবাজার যাই। এটা ছিল আমার জীবনের প্রথম কক্সবাজার যাত্রা। লাবনী পয়েন্টের কাছে ‘হোটেল পূর্বানী’ নামের একটি হোটেলের সামনে বাসটি থামে। হোটেল হতে একটু দূরে সাগর দেখা যাচ্ছিল। প্রথম দেখা এই সাগরের রূপসৌন্দর্য্য আগে আমি কল্পনাও করতে পারিনি, তাই বিষ্মিত চোখে দুনিয়ার সেরা এই সুন্দরের খনি দেখে বারবার বললাম ‘সুবহান আল্লাহ’দৃষ্টিসীমা জুড়ে ঢেউয়ের পর ঢেউ, জলের সাদাফেনা দেখে মনে হল এই অপরুপ স্বর্গরাজ্যে চিরদিনের জন্য যদি রয়ে যেতে পারতাম। সাগরের গর্জন ও সুশীতল বাতাসে আমাদের সব ক্লান্তি ধুয়ে মুছে সাফ করে দেয়।

সন্ধ্যায় সাগরে এই প্রথম অস্তগামী লালসুর্যকে সুদুর উর্মিমালার দেশে রূপের স্নিগ্ধ পসরা বিলায়ে ধীরে ধীরে ডুবে যেতে দেখলাম। এসিয়ার সেরা এই সমুদ্রসৈকত সম্পর্কে সাধারণের ধারনা নিতে রিকশায় সাগরপারে যেতে যেতে চালককে বললাম ড্রাইভার ভাই, সত্যি করে বলুনতো এখানে এত লোক আসে কেন? সে অবহেলার সাথে জবাব দিল নীল পানি দেখতে আসে, এখানে এই পানি ও বাতাস ছাড়া তেমন কিছু নেই। একথা বলে সে আমাকে উল্টো প্রশ্ন ছুড়ে দেয়, বলুন তো এখানে কি দেখার আছে যে প্রতিদিন হাজার হাজার লোক লাখ লাখ টাকা খরচ করে দেখতে আসে। রিকশাচালকের এই জবাব শুনে আমি খানিকটা স্থব্দ হয়ে গেলাম, মনে হল এখানে সর্বক্ষণ অবস্থানকারীদের চোখে এই বিচের অপরুপ সুন্দর ধরা পড়েনা, সুন্দরের পিপাসা একসময় তাদের ফুরায়ে যায়। তাই তারা বলতে পারে এখানে  দেখার এমন কি আর আছে।

আমি রাতে কক্সবাজার লিঙ্করোডে আমার ফুলবাড়ির ভাগনা রুহেলের বাসায় অবস্থান করি। সে আমাকে একটি সামুদ্রিক মৎসাগারের কোল্ডস্টরেজ দেখার সুযোগ করে দেয়পশমের গরম কাপড়ে সারাশরীর আবৃতকরে এই বিশাল কোল্ডস্টরেজে প্রবেশ করি। কিছুক্ষণ অবস্থান করে মনে হল আমি ঠান্ডায় জমে যাচ্ছি, তাই দেরী না করে বেরিয়ে আসি। এটা আমার প্রথম কোন কোল্ডস্টোরেজ দর্শন। একে একে আমাদের তিন বছরে ছয় সেমিস্টার পড়া সমাপ্ত হয়ে যায়।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএসএস প্রথমবর্ষের চুড়ান্ত পরীক্ষা দিয়ে ফিরে এসে নির্মাণাধীন বাংলাদেশ ব্যাংক আবাসিক ভবন, শাহজালাল উপশহর, সিলেট, নির্মা প্রজেক্টে কয়েক মাসের জন্য শিক্ষানবিশ সিবিল ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে যোগদান করি। এই কাজের একটি বড়সড় প্রজেক্ট প্রফাইল বই নির্মাণ করে সিলেট পলিটেকনিকের সিবিল টেকনোলজি বিভাগে জমা দেই ও ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং (সিবিল) কোর্স কমপ্লিট সার্টিফিকেট নিয়ে চলে আসি। পলিটেকনিকে তাত্ত্বিক জ্ঞানের চেয়ে ব্যবহারিক জ্ঞানের গুরুত্ব বেশি। কোর্স কমপ্লিট সার্টিফিকেট দিয়ে চাকুরী আবেদন করা যেত।                     

আমাদের সময় সিলেট পলিটেকনিকে ছাত্রসংখ্যা পাঁচশতও পার হয়নি, অথচ আজ সেখানে প্রায় ছয় হাজার ছাত্রছাত্রী অধ্যয়ন করছে। দিঘির দক্ষিণপারে নতুন বহুতল ক্যাম্পাস ও কম্পিউটার ল্যাব্রেটরি হয়েছে। সে সময় এই প্রতিষ্ঠানে মাত্র একজন ছাত্রী অধ্যয়ন করলেও আজ আলাদা ছাত্রীনিবাস তৈরী হয়েছে। কম্পিউটার ও ইলেকট্রনিক্স টেকনোলজিসহ অনেক নুতন নুতন অনুষদ যুক্ত হয়েছে। আমাদের সময়ের তিন বছরের ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্স এখন চার বছরের কোর্সে পরিত হয়েছে। 

শেখঘাটে আমার পূবালী ব্যাংক প্রিন্সিপাল অফিস হতে এক শীতের দিনে কাছের পলিটেকনিক হেঁটে হেঁটে ঘুরে আসি। দিঘিঘাটে আনমনা হয়ে অনেকক্ষণ বসি। ক্যাম্পাস ভবনের ল্যাবে ল্যাবে ঢু মারি। আমাকে চেনার মত সেখানে কেউ নেই। গোটাকয় ছাত্ররা আমাকে মুরব্বী মানুষ কিংবা শিক্ষক ভেবে সালাম দেয়। পলিটেকনিকে এত ছাত্রছাত্রীর ভীড় দেখে বেশ ভাল লাগে, মনে হয় বাংলাদেশের ভাগ্য সুপ্রসন্ন। বাংলার ছেলেমেয়েরা উৎপাদনশীল কারিগরি শিক্ষায় অতি উৎসাহে এগিয়ে এলে, তদেরে কাজে লাগালে বাংলাদেশের উন্নতি ঠেকায় কে? 

সিলেট পলিটেকনিক জীবনে কাছে দেখা গণমানুষের কবি দিলওয়ারঃ 

পলিটেকনিক যাওয়া আসার পথে একজন মহান মানুষের সাথে আমার মাঝেমধ্যে সাক্ষাৎ হত। তিনি ভার্থখলার গণমানুষের কবি দিয়ার খানতার বাসার সামনের রাস্তা দিয়ে প্রায়ই আসা-যাওয়া করতাম। তার বাড়ি খান মঞ্জিলের সামনে আসা মাত্রই কবিদর্শনের এক তীব্র আকর্ষ মনে জেগে উঠত। টিনের নিরিবিলি ঘরের সামনের কোঠায় এসে কবি দেখা দিতেনপ্রথমদিন আমার পরিচয় দেই, আমার লেখা কবিতার খাতা নিয়ে আসি। তিনি অতি ধৈর্যের সাথে পড়েন ও ভূলভ্রান্তি শুধরে দেন। বসে বসে দীর্ঘক্ষ এই মহাজ্ঞানী মানুষটি আমার সাথে সাহিত্য, ইতিহাস ও মানুষের বিবর্তন নিয়ে আলোচনা করতেন। সাম্যবাদ, পুঁজিবাদ, ধর্ম, দর্শন, বিজ্ঞানসহ প্রতিটি বিষয়ে জ্ঞানতাপস এই কবির সাথে আলাপ হত। শীর্ণকায়া শ্যামলা চশমাপরা মহীয়সী কবিপত্নীর সাথেও দেখা হত। আমি চা নাস্তা না খেয়ে এই বাসা হতে কোনদিন উঠে আসতে পারিনি।

২০১৩ সালে আমি পুবালী ব্যাংক লিমিটেড বরইকান্দি শাখার সহকারী মহাব্যবস্থাপক থাকাকালে বহুবছর পর আবার কবির বাসা খান মঞ্জিলে আমার রচনাসমগ্র তাকে উপহার দিতে যাই। এবার সেই আগেকার টিনের ঘরের বদলে তার একটি সুন্দর ডুপ্লেক্স বাসায় গিয়ে বসি। মাথায় টুপি পরে দুতলা হতে নেমে এসে বইটি হাতে নিয়ে তিনি অতিমাত্রায় খুশি হন। তাকে আমার খুব প্রশান্ত প্রশান্ত মনে হল। অনেকক্ষণ নানা বিষয়ে কথা বললেন, গল্পের মাঝে একবার চা নাস্তা করি, আবার দুসরা বার পানীয় আসে, খেতে বাধ্য হলাম। কবি বললেন তার আমেরিকা প্রবাসী পুত্র সুন্দর এবাসাটি নির্মা করেছেন

উঠে আসার মুহুর্তে কবি দিলওয়ার এমন এক অভিনয় করলেন যে তাঁর সৌজন্যতা দেখে আমি বিস্ময়ে অভিভুত হয়ে গেলাম। তিনি দুইশত টাকা আমার হাতে দিয়ে বললেন, তোমার ছেলেকে কিছু কিনে দিবা। আমি বললাম আমার টাকা লাগবেনা, ছেলের জন্য কেবল আপনার দোয়া চাই, কিন্তু কবি দিলওয়ার কিছুই শুনলেন না, জুরে পকেটে দুইটি নোট ঢুকিয়ে দেন। কি আর করব অগত্যা তাঁর নজরানা নিয়ে আসি ও ভাবি এই নোট দুটি কবির স্মৃতিস্বরূপ রেখে দেব।  

সেইদিন কবির শরীরস্বাস্থ্য দেখে মনে মনে ভাবি তিনি বেশ ভাল আছেন, খুব সুখে আছেন, তাই তিনি বেঁচে রইবেন বহুদিন। কিন্তু আমার এই ধারনা ভূল প্রমাণ হল, দশবার দিন পর ব্যাংকে বসে যখন শুনলাম তিনি এই নশ্বর পৃথিবী হতে চিরবিদায় নিয়েছেন। পরদিন খান মঞ্জিলের ঐ ডুপ্লেক্স বাসার সামনে আমরা “রক্তে আমার অনাদী অস্থি” কাব্যের এই অমর কবি ও ভাল মানুষটিকে  সমাহিত করে অশ্রুঝরা নয়নে বাড়ি ফিরলাম। তখন হৃদয়ে বাজল তার কবিতার লাইন “পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, সুরমা, অজস্র নদী ও ঢেউ।/ রক্তে আমার অনাদী অস্থি, বিদেশে জানেনা কেউ”। মনে পড়ে আমি তখন তাঁকে নিয়ে একটি কবিতা রচনা করি। সেই সময়ে লেখা এই কবিতাটি নিম্নে দিলাম।

                     দিলওয়ারসিলেটের মাতৃত্বের অহংকার

একটি সোনার মানুষপ্রাণ যারদিনরাত জ্বলে জ্বলজ্বল,
কণ্ঠে শুধু আর্তনাদনিপীড়িত মানুষের মুক্তির সংলাপ।
চশমার ফাঁকে চোখ কথা কয়যেন কথা নয়প্রাণ কোলাহল,
ইতিহাসে খুঁজে ফিরেযুগে যুগে মানুষের প্রজন্মের ধাপ।

সহসা ফিরায়ে চোখচেয়ে দেখেকিনব্রিজে রক্তাক্ত অরুন,
হাড্ডিসার শ্রমিকের ঘামে ভেজাখাঁ-খাঁ অথর্ব দেহ।
হৃদয়ের তারে তার জ্বলে উঠেযন্ত্রণার বিভৎস্য আগুন,
প্রতিবাদী কলম তার ঢেলে দেয় জননীর আপত্য স্নেহ।

অস্থিময় অঙ্গ তাঁরলালপদ্মছানাবড়া দুই চোখ,
মানুষের দুঃখে কাঁদেঅন্তরালেসিক্ত করে বুক।
গণমানুষের আবেগবাহি কবিআমাদের দিলওয়ার,
সর্বকালে পৃথিবীতে সিলেটের মাতৃত্বের অহংকার। 

 সিলেট পলিটেকনিক জীবনে কিছু ঘটনার ঘনঘটাঃ 

আমার চিরকুমার চাচা মখলিছুর রহমান চৌধুরী তার জমিজামা ও সহায় সম্পদসহ মতিভাইয়ের সাথে ছিলেন। বার্ধক্য জনিত রোগে তিনি এক সময় শয্যাশায়ী হলে লালই পুতী তার সেবাযত্ন করতেন। যার হাতে তার সহায়সম্পদ তিনি লালই পুতীর বেতন পরিশোধ করেন নি, ফলে বছর দেড়েক ধরে বেতন না পেয়ে লালই পুতী অবহেলার সাথে দায়ছাড়া কাজ করতেন। পুর্বঘরে অনাদর অবহেলায় তিনি রাতদিন একাকী পড়ে থাকতেন।

এমতাবস্থায় আব্বা লালই পুতীর বেতন চারহাজার টাকা আমার অগ্রজা মান্নার কাছ হতে ধার নিয়ে পরিশোধ করে দেন, যদিও এই চাচার কোন সম্পদ তিনি কোনদিন স্পর্শও করেননি। আব্বা ছিলেন খুব মহানুভব, তিনি বড়ভাইয়ের কষ্ট দেখে তাকে আমাদের ঘরে নিয়ে আসেন। চাচা রাতে ঘুমাতেন না, আব্বা ও ভাই তাহমিদ রাত জেগে তার সেবাযত্ন করতেন, এমনকি তিনি অচল হওয়ায় তার মলমূত্রও নিজহাতে পরিস্কার করতেন। আমাদের ঘরে বছর দেড়েক শয্যাশায়ী থেকে ১৯৮৬ সালের ২৭ জানুয়ারি আমার চিরকুমার চাচা মখলিছুর রহমান চৌধুরী ইন্তেকাল করেন। আমি পলিটেকনিক হতে ফেরার পথে তার মৃত্যুর সংবাদ পাই। সারাজীবন হজরত আজরাইলের(আঃ) ভয়ে ভীতসন্তস্ত্র আমার বড়চাচী সফিকুন্নেছা চৌধুরী এই একই বছর ২৭ অক্টোবর  বুড়ো বয়সে দাউদপুরে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

আমার অগ্রজ তাহমিদ চৌধুরী বিএ কমপ্লিট করে ১৯৮৬ সালের শুরুতে ঢাকা তেজগাঁও শিল্প এলাকায় অবস্থিত আমার চাচাত ভাই এমপি শফি আহমদ চৌধুরীর আলবার্ট ডেবিড ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেডে চাকুরীতে যোগদান করেন এই বছরের শেষদিকে বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহ করেনি।

শফি আহমদ চৌধুরী এই সংসদ নির্বাচনে দক্ষিসুরমা ও ফেঞ্ছুগঞ্জ (সিলেট-৩) আসনে রিকশা মার্কা প্রতীক নিয়ে স্বতন্ত্র ভোটপ্রার্থী হন। নির্বাচন কাজে ব্যবহারের জন্য ঢাকা হতে এলবার্ট ডেবিটের পনের বিশটি নীলরঙ্গের সুন্দর গাড়ি আসেএলবার্ট ডেবিটের সিলেট অঞ্চলের সবাই ঢাকা হতে এসে ভোটের কাজে যোগদেন। এই ভোটে তার প্রচারনায় আমরা দুইভাই, শাহনাজ ভাই, কামরান ভাতিজা, মুর্শেদ ভাই, ডাঃ নিয়াজ, কামাল ভাতিজা, আবুলেইস ভাই প্রমুখ দিনরাত খেটে যাই। কামালবাজার হতে শ্রীরামপুর, নাজিরবাজার হতে ফেঞ্ছুগব্জ সারকারখানা পর্যন্ত সারাটা এলাকা আমরা ভোটের গাড়িতে করে ঝড়ের বেগে ছুটে বেড়াই। গাড়ি মাইক ও ক্যাসেটে তখন ভোট কামনায় বাজত সুন্দর সুন্দর প্যারোডি গান ও শ্লোগান। এসময় জন্মভূমি দক্ষিণসুরমা ও ফেঞ্ছুগঞ্জ, এই বিশাল এলাকার প্রায় সবগুলো গ্রাম, জনপদ ও বাজার আমার ঘুরে ঘুরে দেখার সৌভাগ্য হয়। আসলে সেই তরুণ বয়সে নিজ এলাকাটাকে একবার সরজমিনে দেখা দরকারও ছিল।

এডভোকেট সোলেমান রাজা চৌধুরীর কুমারপাড়ার বাসায় ভোট পরিচালনা অফিস স্থাপিত হয়। ভোট পরিচালনার প্রধান ভূমিকা রাখেন এডভোকেট সোলেমান রাজা চৌধুরী, কদমতলীর সোলেমান বখত, কুচাই পশ্চিমভাগের দারা মিয়া, মোল্লারগাওয়ের মখন মিয়া চেয়ারম্যান, খিত্তার উসমান মিয়া, মদন মোহন কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম, বরইকান্দির শিশু মিয়া, দাউদপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান খলিলুর রহমান, ডাঃ নিয়াজ এ চৌধুরী, আমার পিতা সফিকুর রহমান চৌধুরী ও এলবার্ট ডেবিটের আতা সাহেব প্রমুখ। বাজারে বাজারে অসংখ্য নির্বাচন অফিস স্থাপন করা হয়কোন কোন অফিসের ছাদে আস্ত রিকশা উঠে যায়। অফিসগুলো পোষ্টার, ব্যানার ও নানারঙ্গের বিদ্যুৎ বাতির আলোর বন্যায় ভেসে যায়। সবগুলো বাজারে ও জনপদে  জনসভা ও মিছিলে এক উৎসবময় পরিবেশ সৃষ্টি হয়।

নির্বাচনের শেষদিকে ভোট ক্যাম্পেইনে সদ্য অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ প্রধান এ চৌধুরী এসে যোগ দেন। একদিন রিকশা ব্যানার লাগান একটি জীপে করে তার সাথে রশিদপুর হতে আসছিলাম। তিনি ছিলেন সামনের সিটেবসা, পথে একজন লোক হাত উঠালে তিনি ড্রাইভারকে গাড়ি থামিয়ে লোকটাকে উঠাতে বলেন। লোকটি তার পাশে বসেই একটি সিগারেট বের করে তার কাছে আগুন চাইল। তিনি পিছন হতে একটি দিয়াশলাইয়ের ইন্তেজাম করে দেন। লোকটা সিগারেটে সুখটান দিয়ে কালো ধুয়া ছাড়তে ছাড়তে তাকেও টানার জন্য জ্বলন্ত সিগারেট শলাকা এগিয়ে দেয়। স্টেশন রোডে এসে এই লোকটা নেমে গেলে বিরক্ত ই এ চৌধুরী বললেন, আমার মুখের উপর সিগারেটের ধুয়া ছাড়ার সাহস বাংলাদেশে কজনের আছে, অথচ এই ভোটের জন্য এসে আজ সব নীরবে সইতে হচ্ছে

ভোটের দুইদিন আগে দুইশত ট্রাক ও শতাধিক গাড়ির বিশাল মিছিল হয়। মিছিলটি কদমতলী হতে জালালপুর যায় ও বিকালে ফিরে আসে। এতগাড়ি নিয়ন্ত্র করা খুব কঠিন হয়ে পড়েসিলেট ঢাকা মহাসড়কে প্রচন্ড যানজট সৃষ্টি হয়। ফেরার সময় রাত ৮ ঘটিকায় সিলেট স্টেশনরোডে গাড়ির সারি ঢুকামাত্র কিছু দুবৃত্তের দল হকিস্টিক দিয়ে দামি দামি গাড়িগুলোর গ্লাস ভাংচুর শুরু করে। এই নির্বাচনে শফি চৌধুরীর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন পনের দলীয় আওয়ামীলীগ জোটের ন্যাপনেতা পীর হবিবুর রহমান। জালালপুর ইউনিয়নের বাঘরখলা নিবাসী পীর হাবিবুর রহমান ছিলেন মাদ্রাসা ছাত্র কিন্তু সিলেট আলিয়া মাদ্রাসায় অধ্যয়নকালে কমিউনিষ্ট মতাদর্শে জড়িয়ে পরায় তাঁকে মাদ্রাসা হতে বহিস্কার করা হয়। তিনি মাদ্রাসায় লেখাপরা করলেও একজন প্রগতিশীল চিন্তার আধুনিক মানুষ ছিলেন।

ইতিপুর্বে তিনি কুঁড়েঘর প্রতীক নিয়ে বহুবার সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে পরাজিত হন। লোকে কৌতুক করে বলত, ‘পীর হবিবের ভাঙ্গা ঘর, কুকুর ঢুকে বরাবর’তবে এবার পীর সাহেবের মার্কা আওয়ামী লিগের নৌকা,  ন্যাপের সেই অপয়া কুঁড়েঘর নয়।

ভোটের দিন সন্ধ্যার পর সোলেমান রাজা চৌধুরীর বাসায় ভোটের ফলাফল আসা শুরু হয়। ভোটের যোগফল কখনো রিকশা, কখনো নৌকার দিকে উঠানামা করছিল। ফলে এই বাসার একদঙ্গল লোকের মাঝে কখনো আনন্দ কখনো ব্যদনার ঝড় বইছিল। কিন্তু শেষপর্যন্ত রাত ১২টা নাগাদ সব আনন্দ পরিত হল বিষাদে। এক বিষন্নতা বাড়িটিকে গ্রাস করে ফেলে। এত লোকজনের একমাসের অক্লান্ত পরিশ্রম জলে ভেসে গেল, মাত্র ১০১৭টি ভোটের জন্য দলবিহীন স্বতন্ত্র প্রার্থী শফি এ চৌধুরী পনেরদলীয় জোটপ্রার্থী পীর হবিবুর রহমানের নৌকার কাছে হেরে যান।

কেউ কেউ চোখ মুছেন, একে অন্যকে সান্তনা দেন, আবার কেউবা বলেন সব ভোট চুরি হয়ে গেছে। যদি ভোট চুরি না হত তবে আমাদের বিজয় ঠেকায় কে? কেউ কেউ বলেন গনায় ভুলও হতে পারে, তাই এখনও নিরাশ হবার কোন কার নেই। কিন্তু আসল সত্য হল, এবার আল্লাহ তায়ালা পীরসাহেবের দিকে তার রহমতের বারিবর্ষ করেছেন, পীরসাহেব সারাজীবন ভোটে হারতে হারতে শেষপর্যন্ত বুড়ো বয়সে এই প্রথম বিজয়ের মুখ দেখলেন, তাও আবার কূঁড়েঘর নয়, আওয়ামি লিগের নৌকায় চড়ে। প্রতিপক্ষের লোকজনও বললেন তারা সব আশা ছেড়ে দিলেও পীর হবিবুর রহমান অবশেষে কেমন করে যেন জিতে গেলেন। কেউ কেউ বললেন, ওস্তাদের মার শেষরাতে, শেষরাতের এবাদাতি পিরসাহেবকে বিজয় দিয়েছে। 

সুলেমান রাজা চৌধুরীর পত্নী সুরাইয়া খালা আমার মায়ের আপন মামাতো বোন, পরদিন লতিফা চৌধুরী খালাকে জড়িয়ে ধরে চোখের পানি মুছে সিলেট ত্যাগ করেন লতিফা চৌধুরী তার পিতা খ্যাতিমান সাংবাদিক ও মন্ত্রী শেরপুরের খন্দকার আব্দুল হামিদের ভোট বিজয় কাহিনি বলতেন তিনি ১৯৫৪ সাল হতে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত আমৃত্যু নাকি এমপি ছিলেন লতিফা ভাবির ভাষায় ভোটের সময় তারা সবাই মহানন্দে বাবার সাথে গ্রামে যেতেন, ভোট চাইতেন ও মহোৎসব করে বিজয়ীর বেশে শেরপুর হতে ঢাকায় ফিরে আসতেন 

সামরিক শাসক হোসেন মোহাম্মদ এরশাদের গ্রাম সরকার, উপজেলা, রাষ্ট্রধর্ম, নারী কেলেঙ্কারি, ঘরুয়া রাজনীতি, হ্যাঁ ভোট, না ভোট ইত্যাদি নানা তুঘলকি কান্ডকারখানা দেখে দেখে পলিটেকনিক জীবনের পুরো সময়কাল পার করি। আজ যখন অতীত নিয়ে ভাবি তখন মনে হয় আমার পলিটেকনিক জীবনও কি এমনি একটা তুঘলকি কান্ড ছিলো? কারণ এই শ্রমঘন শিক্ষা থেকে কোন ফসল আমার গোলাঘরে আসেনি। 

আমার স্মৃতির খাতায় বেঁচে থেকো সিলেট পলিটেকনিক। বিদায়। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন