সিলেট পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের স্মৃতিমালা,
প্রচন্ড খাটুনি নিস্ফলাঃ
সেশনঃ
১৯৮৩-১৯৮৪ চুড়ান্ত পরীক্ষাবর্ষ- ১৯৮৬ সাল
অবস্থানঃ
জানুয়ারি ১৯৮৫ হতে ডিসেম্বর ১৯৮৮ সাল
১৯৮৩ সালে
এইচএসসি পাস করে ছুটলাম ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে সিলেট পলিটেকনিক
ইন্সটিটিউটে। দক্ষিণসুরমার টেকনিক্যাল রোডে সুরমাপারে
খোজারখলা ও বরইকান্দি গ্রামের মধ্যভাগে প্রতিষ্ঠানটি
অবস্থিত। প্রতিষ্ঠানের
আরম্ভমাত্রই টেকনিক্যাল রোডের পাশঘেষে
রয়েছে প্রতিভা ছাত্রাবাস। রেললাইন পারহয়ে একটি বর্গাকার দিঘির
উত্তরপারে তিনতালা সুদীর্ঘ্য ক্যাম্পাস, পশ্চিমপারে মসজিদ, সুরমা ছাত্রাবাস ও
বাইসাইকেল সেড। দিঘির দক্ষিণপারে
বিশাল খেলারমাঠ, এমাঠে প্রতিবছর বাহিরের স্থানীয় লোকজনের আয়োজনে হত স্বর্ণকাপ
ফুটবল টুর্নামেন্ট। বর্গকার দিঘির
পুর্বপারে শিক্ষক কোয়ার্টার, অধ্যক্ষের বাসা ইত্যাদি স্থাপনা। সিলেট-ছাতক রেললাইন ইন্সটিটিউটকে
দ্বিখন্ডিত করে চলে গেছে। বিশ একর
জায়গা জুড়ে প্রতিষ্ঠানটি প্রসারিত রয়েছে। আমার জন্মের দশ
বছর আগে প্রতিষ্ঠানটির সূচনা হয়, যার প্রতিষ্ঠাকাল
১৯৫৫ সাল।
আমার ছোট
দোলাভাই লিয়াকত হোসেন চৌধুরী জেদ্দায় এক আমেরিকান কোম্পানিতে চাকুরি
করতেন। তিনি বললেন সেখানে তার কয়েকজন ডিপ্লোমা
ইঞ্জিনিয়ার ভাতিজা প্রচুর রোজগার করেন ও আমি
তিনবছরের এই কোর্স করে সেখানে চলে গেলে ভাল আয় করতে পারব। হতাশাগ্রস্ত দিশেহারা
আমি তাই আগপিছ চিন্তা না করেই কোন পুর্ব পরিকল্পনা ছাড়াই এদিকে ছুটলাম।
১৯৮১ সালের
এসএসসি সার্টিফিকেট দিয়ে আবেদন করলাম। সিবিল, ইলেকট্রিক্যাল, মেকানিক্যাল এবং
পাওয়ার টেকনোলজির প্রতি বিষয়ে চল্লিশজন করে মোঠ একশত ষাটজন ছাত্র ভর্তি হন, কোন
মেয়ে ভর্তি হতে আসেনি। পুরো পলিটেকনিকে আমাদের সিনিয়র ক্লাসে একজনমাত্র ছাত্রী
ছিলেন যার নাম দীপ্তা মজুমদার। এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল অনুসারে প্রথম ভাল
চল্লিশজনকে সিবিল টেকনোলজীতে ভর্তির সুযোগ
প্রদান করা হয়। আমি সিবিল টেকনোলজীতে সুযোগ পাই ও আমার ভাগ্যে জোটে একটি সুন্দর
রোল নং ৮৩ ১০০ সেশনঃ ১৯৮৩-৮৪।
তিন বছরের কোর্স, প্রথমবর্ষে সবার জন্য অভিন্ন পাঠ্যক্রম এবং পরবর্তী দুই বছর
প্রতিটি বিষয়ের (বিভাগের) আলাদা আলাদা সিলেবাস।
সেশনজটের
জন্য একবছর পর ১৯৮৫ সালের প্রারম্ভে কোন এক সময় পলিটেকনিকে ক্লাস শুরু হল।
ইতিমধ্যে আমি মদন মোহন কলেজে বিএ প্রথমবর্ষ সমাপন করে দ্বিতীয়বর্ষে বিচরণ
করছি। পলিটেকনিকে ক্লাস শুরু হল, কিছুদিনের মধ্যে একসন্ধ্যায় জমকালো
নবীনবরণ অনুষ্ঠান
হল। কিন্তু আমার জন্য বড় সমস্যা হল এখানে ক্লাস শুরু হয় সকাল সাড়ে সাতটায়। আমাকে
পলিটেকনিকে পাঠাতে আম্মা ভোরের আজানের আগে উঠে আমার জন্য রান্না করতেন। এখানে
ভর্তি হয়ে মাকে অনেক যন্ত্রণা দিয়েছি। পাহাড়
লাইনে বা মোগলাবাজারে এসে এত সকালে গাড়ি মেলা ছিল ভার। তাই দ্রুতখেয়ে সাত সকালে
রফিপুর নয়ামসজিদের দিকে উদ্ধশ্বাসে হাঁটতাম। ঘন কুয়াশায় চূল ভিজে যেত। দড়া ও
শানখপুরের ভিতর দিয়ে চল্লিশ পঞ্চাশ মিনিট হেটে এখানে পৌছে গেলে সিলেটগামী গাড়ির
অভাব হতনা, আসামাত্রই গাড়ি মেলত।
রফিপুর
নয়ামসজিদের পাশের চৌধুরীবাড়ি আমার বড়চাচির আত্মীয়, এবাড়ির একজন মেম্বার এখানে
দোকান দিতেন। তার সাথে আমার বেশ ভাব জমে উঠে। অবশ্য ফিরতাম পাহাড় লাইন হয়ে। সিলেটে
নেমেও বাস টার্মিনাল হতে
পলিটেকনিক পর্যন্ত অনেক পথ হাটতে হত। সীমিত হাতেগুনা কিছু টাকা নিয়ে বের
হতাম, তাই পয়সা বাঁচাতে প্রচুর হাটতে হত। কোন কোন দিন হাতে টাকা থাকলে একটা
সিঙ্গারা কিনে মুখে পুরতাম, আবার অতিরিক্ত খরচ হয়ে গেলে সস্তা ভাড়ায় টাউনবাসে মোগলাবাজার তিমুখায় নেমে সোয়ামাইল
হেটেও মাঝে মাঝে ঘরে ফিরতাম। বাড়িতে প্রচুর সুপারী হত, আমাদের ঘরে সুপারী চিবানোর
কেউ ছিলেন না। সারাদিন গ্রামের মহিলারা এসে সুপারী কিনে নিত। এই টাকা জমিয়েও আম্মা
মাঝে মাঝে আমার পথ খরচের টাকা হাতে তুলে দিতেন।
এখানে আমার
এম সি কলেজের কয়েকজন এইচ এস সি সহপাঠি এসে
ভর্তি হন। যেমন চট্টগ্রামের
শ্রী সুশান্ত শেখর
চক্রবর্তী (সিবিল), সুনামগঞ্জের কাজি শামসুল হুদা সুহেল (সিবিল), ধোপাদিঘিরপারের
ডাঃ হাবিবুর রহমান চৌধুরীর পুত্র ইসমাম হাবিব চৌধুরী
(সিবিল), তাতিপাড়ার নিয়াজ আহমদ চৌধুরী (সিবিল) নাজিম উদ্দিন, ফুলবাড়ির
খাইরুল আক্তার চৌধুরী (ইলেকট্রিক্যাল), ফুলবাড়ির
আসফাকুল ইমরান চৌধুরী (পাওয়ার), ঢাকাদক্ষিণ
রায়গড়ের পাপু (মেকানিক্যাল) এবং ভাদেশ্বরের
মুমিন (মেকানিক্যাল)।
এমসি কলেজ ছাড়া অপরিচিত সুত্র
হতে এসে সিবিল টেকনোলজিতে ভর্তি
হন সিলাম চরমোহাম্মদপুরের মাহবুবুল হক চৌধুরী টিটু,
শ্রীমঙ্গলের ধ্রুব ও তাপস, জিন্দাবাজার গোবিন্দজিউড় আখড়ার নিতাই পাল, সত্যেন্দ্র
বৈদ্য, বড়লেখার কামাল আহমদ, ফরিদপুর জেলার আবুল বাশার, হবিগঞ্জের
বেলাল আহমদ, কুমিল্লার তপন, সুনামগঞ্জের কালিকৃষ্ণ ছাতকের
জগদিশ চন্দ্র দেব ও যশোদা রায় প্রমুখ।
বর্তমানে
নিতাই পাল জালালাবাদ গ্যাসে, নাজিম উদ্দিন শাবিপ্রবিতে ও সত্যেন্দ্র বৈদ্য সরকারি
পানি উন্নয়ন বিভাগে কর্মরত আছেন। টিটু ও পাপু আজ যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী। নিয়াজ
চৌধুরী কিছুদিন পর ঝরে পড়ে ও এ বি ব্যাংকে যোগদান করে। নিয়াজ
এখন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী। মুমিন চৌধুরী এ বি
ব্যাংকে কিছুদিন কাজ করে যুক্তরাজ্যে চলে যান।
ইমরান চৌধুরী একদিন রহস্যজনক কারণে
ফুলবাড়িতে মারা যান। সুশান্ত, ধ্রুব, তাপস, যশোধা,
বাশার ও কামাল এরা কে কোথায় আছে জানিনা।
সিলেট পলিটেকনিক ছাড়ার প্রায় ৩৩
বছর পর ২০২১ সালে আমার এম সি কলেজ এবং পলিটেকনিকের সুদীর্ঘ পাঁচ বছরের সহপাঠি কাজি
শামসুল হুদা সুহেলের সন্ধান পাই ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে। সে এই দুই প্রতিষ্ঠানের
ছাত্রাবাসে থেকে লেখাপড়া করে। ছাত্রাবাসে তাঁর কক্ষে বসে অনেক আড্ডা দেই। সে ছিল
মাঝারী মেধাবী। কোথায় আছ জিঞ্জেস করলে জানালো, পলিটেকনিক হতে বেরুনোর পর চাকুরির
বয়স চলে যাচ্ছে দেখে সে তফসিলদার পদে ঢুকে পড়ে। বর্তমানে সে জগন্নাতপুরের
তফসিলদার। তাঁকে বললাম, আমার পিতাও পাকিস্তান আমলের প্রথম দিকে সুনামগঞ্জের
কানুনগো ছিলেন। তাঁর কাছে জানলাম সহপাঠি কালিকৃষ্ণ এখন সুনামগঞ্জ পৌরসভার
প্রকৌশলী।
ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে মঝেমধ্যে
বিস্তর অবসর সময় থাকত। তখন আমরা ইনডোর গেইম খেলতাম। আবার সুরমা ও প্রতিভা হোস্টেলে
গিয়ে আড্ডা দিতাম। সহপাঠিদের অধিকাংশই ছিল বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা হতে আগত। তাঁরা
তাদের ভিন জেলার আঞ্চলিক টানে মজার মজার রসালো দেশী গল্প বলত। এসব গল্পের
অনেকগুলোই অশ্লীল কৌতুক, যা আমি এই আত্মজীবনীতে বলা উচিত হবে কিনা ভাবছি। তাই আমার
মত বয়স্করাই কেবল এই গল্পগুলো পড়বেন এবং জুনিয়ররা দয়াকরে বিরত থাকবেন।
গল্প- একঃ বরিশালের গ্রামে
একজোড়া নবদম্পতি বাসর ঘরের দরজা বন্ধ করে সাজ-পালঙ্কে যান। অনেক রুমাঞ্চের পর বর
কনে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে মিলনে যাবেন, এমন সময় বাহির হতে একটি শব্দ শুনা গেল-
কে-চো দে। কন্ঠ বরের বুড়ো দাদুর। তাহলে দাদু কি কোন গোপন পথে সব দেখে শব্দটা
ছুড়লেন। বর সারাটা কক্ষের টিনের ওয়াল খুঁজে কোন ছিদ্রের সন্ধান খুঁজে পেলনা। ঘণ্টা
খানেক পর আবার তাঁরা যখন মিলতে যাবে অমনি শব্দ শুনতে পায়- কে-চো দে। এভাবে বার বার
ব্যর্থ নবদম্পতি শেষরাতে আসামি দাদুকে হাতেনাতে ধরতে বাসরঘর হতে বেরিয়ে আসেন। বাসর
ঘরের পিছনের পুকুরের ঘাটে দাদু পূর্নিমার আলোয় বসে বরশি বাইছেন। দাদুর পাশে কাজের
ছেলেটা টোপ নিয়ে বসে আছে। বরশির টোপ শেষ হলেই দাদু কাজের ছেলেটাকে বড়গলায় ঝাড়ি
মারেন- এই, কে-চো দে। আসামী ধরতে আসা নাতি ও নাতিবউ পুকুরঘাটে দাদুর কাছে গিয়ে বসে
বলল, দাদু তুমি আমাদের সর্বনাশ করলে, তোমার বরশির টোপের কেঁচো, আমাদের এই রঙ্গিন
বাসর রাতটা পুরোপুরি বরবাদ করে দিল।
গল্প- দুইঃ স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ
ডাঃ প্রতিমা বালা দেবী চেম্বারে বসে রুগী দেখছেন। রুগিনীর স্বামী জানতে চাইলেন
জন্ম নিয়ন্ত্রনের কোন পদ্ধতি নিরাপদ। ডাঃ প্রতিমা বালা বললেন কনডম। কনডমে কোন
ধরনের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নেই। কিছুদিন পর রুগিনীর স্বামী ভীষণ রেগেমেগে ডাঃ
প্রতিমা বালা দেবীর চেম্বারে এসে বললেন, আমি আপনার কথামত কনডম ব্যবহার করলাম,
তারপরও আমার গিন্নীর গর্ব হল কেন? সঠিক জবাব দিন। ডাঃ প্রতিমা বালা বললেন
আপনি কি সঠিকভাবে কনডম পরেছেন? জবাব এল,
কেন? আমি তো বিগত দুমাস ধরে দিনরাত কনডম পরেই আছি। এবার ডাঃ প্রতিমা বালা বললেন
তাহলে আপনি মূত্রত্যাগ করছেন কিভাবে? আরে হিসি ছাড়া কি থাকা যায়, তাই বুদ্ধি
খাটিয়ে কনডমের অগ্রভাগে আমি একটা ছিদ্র করে রেখেছি। হাসির রোল উঠল- হাঃ হাঃ হা।
গল্প- তিনঃ মুফিজ আলী একজন খাস
কৃষক। তাঁর কয়েক প্রজন্ম কৃষি জমিতেই খেলানেলা করে জীবন পার করেছে। মুফিজ আলীর মনে
কেবল কৃষি জমি চাষের চিন্তা ঘুরপাক খায়। একদিন মুফিজ আলী বিয়ে করে নববধূ ঘরে আনেন।
বাসর রাতে নতুন বউয়ের শরীরটা তিনি তলিয়ে দেখছেন। বউয়ের বুকে হাত লাগাতেই বেশ উচু
উচু লাগে। মুফিজ আলী বললেন, উচু জায়গায় ভাল কলা হয়। এখানে জৈষ্ট্য মাসে কলা
লাগাবো। বউয়ের পেঠে হাত ঠেকিয়ে দেখলেন সমতল। এবার বললেন সমতলে ধান হয়। এখানে
ভাদ্রমাসে ধানচাষ করব। আরেকটু নিচে হাত যেতেই বললেন জমিটা একদম নিচু, এখানে খুব
ভাল রবিশস্য হবে। আগামী কার্তিকে এই জমিতে মূলা লাগানো যাবে। মুফিজ আলীর এসব
কথাবার্তা শুনে বিরক্ত নববধু বলল, এখন ফাগুন মাস, জৈষ্ট্য মাস আসার এখনও তিনমাস
বাকি। এই উর্বর জমি নিয়ে আমি তিনমাস আবাদের অপেক্ষায় বসে থাকতে পারবনা। আপনি যা
চাষ করার এখনই করুন। নইলে এই জমি অন্য কাউকে বর্গা দিয়ে দেবো। আবার সবাই হাসে- হাঃ
হাঃ হা।
আমাদের
ব্যবহারিক ক্লাস অনুষ্ঠিত হত ক্যাম্পাস ভবনের নীচতলার
বিভিন্ন ওয়ার্কসপে- যেমন ইলেকট্রিক্যাল, প্লাম্বিং এন্ড সেনিটেশন, ওয়েল্ডিং,
উডওয়ার্ক্স, আরসিসি ওয়ার্কসপ ইত্যাদি। এসব ওয়ার্কসপে কাজ করতে গিয়ে খুব পরিশ্রম হত
ও ঘামে কাপড় ভিজে যেত। তাছাড়া ওখানে তীব্রশব্দ দুষণ
সৃষ্টি হত। আমার বামকানে শ্রবণশক্তিহীনতা
থাকায় অন্যের কথাবার্তা শুনতে সেখানে ভীষণ অসুবিধায় হত। তাই
এইসব ওয়ার্কসপে গিয়ে আমি কথাবলা বন্ধ করে দিতাম যাতে অন্যরা আমার
সাথে কথা বলা হতে বিরত থাকে।
আমাদের সময়
এই ইন্সটিটিউটের অধ্যক্ষ ছিলেন মোঃ নেছওয়ার
আহমদ। তার অফিস ছিল ক্যাম্পাসের দ্বিতীয় তলায়। তিনি আমার বড় দোলাভাই মুফতি মোঃ
খালিদের সহপাঠি ছিলেন। পাঠাগারে ছিল নানা বিঞ্জান ও প্রকৌশল বিষয়ক বইয়ের বড় সমাহার
ও পড়ার সুব্যবস্তা। হ্যান্ডসাম ও ইয়াং
স্যার কামরুল হাসান পড়াতেন ড্রইয়িং এন্ড ইস্টিমিটিং, দাড়িওয়ালা প্রৌড় জমিরউদ্দিন
স্যার সার্ভে ও স্ট্রাকচারাল ডিজাইন, মাখন লাল পাল প্লাম্বিং এন্ড সেনিটেশন।
পলিটেকনিকে অনেক শিক্ষকের কাছে ইংরেজী, গণিত, স্টেংকথ
অব মেটেরিয়ালস, রসায়ন, রোডস এন্ড হাইওয়ে ইত্যাদি বিষয় পড়ি কিন্তু তাদের নাম আজ মনে
নেই।
সবসময় একটি
টি-স্কেল, ড্রয়িংবক্স ব্যাগে রাখতে হত। ওয়ার্কসপে আমারা বিভিন্ন দ্রব্য তৈরি
করি, ইটের দেওয়াল, ইলেকট্রিক্যাল ওয়ারিং, ইলেকট্রিক আর্কওয়েল্ডিং, গ্যাস ওয়েল্ডিং,
পাইপ ফিটিং, কাটের কাজ, সি সি ব্লক তৈরি করে বিভিন্ন
মেয়াদে কিউরিং করে শক্তিপরীক্ষা ইত্যাদি।
ইন্সটিটিঊটের
প্রায় বার্ষিক ম্যাগাজিনে আমার লেখা বের হয়। এখানে এক বৎসর ছাত্র সংসদ নির্বাচনে
ভাগনা পাপু সাধারণ সম্পাদক পদে প্রার্থী
হন। ভোটের দিন বাড়িতে জরুরী কাজ থাকায় আমি ভোট দিতে যাইনি, অথচ পরদিন শুনলাম পাপু
মাত্র এক ভোটের জন্য হেরে গেছে। পাপুর পিতা ছিলেন জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপক, তাদের
বাসা সিলেটের শাহজালাল উপশহরে হলেও পৈত্রিকবাড়ি
ঢাকাদক্ষিণের পাশের টিলাটক্করে ভরপূর রায়গড় গ্রামে।
তৃতীয় বছরে
এসে খুবসম্ভব ১৯৮৮ সালে আমরা সরকারি খরচে সিবিল
টেকনোলজীর চল্লিশজন ছাত্র শিক্ষাসফরে ট্রেনে চট্টগ্রাম গমন
করি। আমাদেরকে চট্টগ্রাম বন্দরের ভিতর নিয়ে গিয়ে বন্দরের সবধরনের যান্ত্রিক কার্যাবলী
দেখান হয়। ডকড্রাইতে ঢুকে জাহাজ নির্মাণ
ও মেরামত কারখানার কাজ দেখি। বিশাল জলাধারে ভাসমান জাহাজ ডুকিয়ে জলাধারটি জলশুন্য
করে জাহাজটির তলদেশে শ্রমিকেরা মেরামত কাজ করেন। মেরামত কাজ শেষ হলে আবার জল
প্রবেশ করায়ে জাহাজটিকে এই জলাধারে ভাসমান করে পুনরায় কর্নফুলি নদীর মোহনার সাগরে
সহজে ফেলে দেওয়া হয়।
চিটাগাং
স্টিলমিলে প্রায় চারঘন্টা ঘুরে ফ্যাক্টরির দানবীয় উৎপাদন প্রক্রিয়া দেখে বিষ্মিত
হই। জ্বলন্ত লোহার বিরাট বিরাট লালবার জলে পড়ে পানি বাস্পে পরিনত করে ঠান্ডা হয়ে
জমাট বাধছে; রড, পাত ও টিন তৈরি হচ্ছে।
ইস্টার্ন রিফাইনারিতে ঢুকে
আমরা নানা ধরনের জ্বালানী তৈলের প্রক্রিয়াজাতকরণ
পদ্ধতি পর্যবেক্ষন করি। কর্নফুলী পেপারমিলে ঢুকে
গলিত বাশ হতে কাগজ তৈরির পদ্ধতি দেখি। চট্টগ্রাম উইভিং মিলে সুতা তৈরির
পদ্ধতিও দেখান হয়।
দুই তিন দিন
ধরে এত এত দৈতাকার কলকারখানার ক্রিয়াকলাপ দেখে মনে হল আমাদের দেশে কত কিছুইতো হয়,
এই দেশ কম কিসের? নিজ দেশের একটা বড়ত্ব তখন আমার চোখে ধরা পড়ে। আমরা সবাই মিলে পতেঙ্গা
সিবিচে যাই, কর্নফুলির
মোহনায় পাতরের বাধে সাগরের ঢেউ আচড়ে পড়তে দেখি। সাগরপারে
ঝিনুকবাজার ঘুরে দেখা হয়। আমরা চার বন্ধু টিটু, আমি, নিতাই ও সুশান্ত সব সময়
একত্রে অবস্থান করি।
চট্টগ্রামের
দুইতিন দিনের মিশন শেষকরে আমরা একটি বাসে করে কক্সবাজার যাই। এটা ছিল আমার জীবনের
প্রথম কক্সবাজার যাত্রা। লাবনী পয়েন্টের কাছে ‘হোটেল পূর্বানী’ নামের একটি হোটেলের
সামনে বাসটি থামে। হোটেল হতে একটু দূরে সাগর দেখা যাচ্ছিল। প্রথম দেখা এই সাগরের
রূপসৌন্দর্য্য আগে আমি কল্পনাও করতে পারিনি, তাই বিষ্মিত চোখে দুনিয়ার সেরা এই
সুন্দরের খনি দেখে বারবার বললাম ‘সুবহান আল্লাহ’। দৃষ্টিসীমা
জুড়ে ঢেউয়ের পর ঢেউ, জলের সাদাফেনা দেখে মনে হল এই অপরুপ স্বর্গরাজ্যে চিরদিনের
জন্য যদি রয়ে যেতে পারতাম। সাগরের গর্জন ও সুশীতল বাতাসে আমাদের সব ক্লান্তি ধুয়ে
মুছে সাফ হয়ে গেল।
সন্ধ্যায়
সাগরে এই প্রথম অস্তগামী লালসুর্যকে সুদুর উর্মিমালার দেশে রূপের স্নিগ্ধ পসরা
বিলায়ে ধীরে ধীরে ডুবে যেতে দেখলাম। এসিয়ার সেরা
এই সমুদ্রসৈকত সম্পর্কে সাধারণের ধারনা
নিতে রিকশায় সাগরপারে যেতে যেতে চালককে
বললাম ড্রাইভার ভাই, সত্যি করে বলুনতো এখানে এতলোক আসে কেন? সে অবহেলার সাথে জবাব
দিল নীল পানি দেখতে আসে, এখানে এই পানি ও বাতাস ছাড়া তেমন কিছু নেই। একথা বলে সে
আমাকে উল্টো প্রশ্ন ছুড়ে দেয়, বলুন তো এখানে কি দেখার আছে যে প্রতিদিন হাজার হাজার
লোক লাখ লাখ টাকা খরচ করে দেখতে আসে। রিকশাচালকের এই জবাব শুনে আমি খানিকটা স্থব্দ
হয়ে গেলাম, মনে হল এখানে সর্বক্ষন অবস্থানকারীদের চোখে এই বিচের অপরুপ সুন্দর ধরা
পড়েনা, সুন্দরের পিপাসা একসময় তাদের ফুরায়ে যায়। তাই তারা বলতে পারে এখানে দেখার এমন কি আর আছে।
আমি রাতে
কক্সবাজার লিঙ্করোডে আমার
ফুলবাড়ির ভাগনা রুহেলের বাসায় অবস্থান করি। সে আমাকে একটি সামুদ্রিক
মৎসাগারের কোল্ডস্টরেজ দেখার সুযোগ করে দেয়। পশমের গরম কাপড়ে
সারাশরীর আবৃতকরে এই বিশাল কোল্ডস্টরেজে প্রবেশ করি। কিছুক্ষণ অবস্থান করে মনে হল
আমি ঠান্ডায় জমে যাচ্ছি, তাই দেরী না করে বেরিয়ে আসি। এটা আমার প্রথম কোন কোল্ডস্টোরেজ
দর্শন। একেএকে আমার তিন বছরের ছয় সেমিস্টার পড়া সমাপ্ত হয়ে আসে।
এই তিন বছর
বাড়ি হতে এসে প্রতিদিন সাড়ে সাতটায় ক্লাস ধরতে খুব কঠিন শ্রম দিতে হয়। সমাপনী
বছরের চুড়ান্ত থিয়োরিটিক্যাল পরীক্ষার পর প্রাকটিক্যাল পরীক্ষা শুরু হয়।
প্রাকটিক্যাল শেষ দুইটি
পরীক্ষার সাথে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার এম এস এস প্রথমবর্ষের চুড়ান্ত
পরীক্ষার তারিখ পড়ে যায়। বাহির হতে আসা পরীক্ষক স্যারদের সাথে যোগাযোগ করলে তারা
পরীক্ষাগুলোর তারিখ পরিবর্তন করে আগেই আমার পরীক্ষা নিয়ে নেন।
চট্টগ্রাম
বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএসএস প্রথমবর্ষের চুড়ান্ত পরীক্ষা দিয়ে ফিরে এসে নির্মানাধীন
বাংলাদেশ ব্যাংক আবাসিক ভবন, শাহজালাল উপশহর, সিলেট, নির্মাণ
প্রজেক্টে দুই মাসের জন্য শিক্ষানবিশ সিবিল ইঞ্জিনিয়ার
হিসাবে যোগদান করি। এই কাজের একটি বড়সড় প্রজেক্ট প্রফাইল বই নির্মান করে সিলেট
পলিটেকনিকের সিবিল টেকনোলজি বিভাগে জমা দেই ও ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং (সিবিল)
কোর্স কমপ্লিট সার্টিফিকেট নিয়ে চলে আসি।
আমদের সময়
সিলেট পলিটেকনিকে ছাত্রসংখ্যা পাচ শতও পার
হয়নি, অথচ আজ সেখানে প্রায় ছয় হাজার ছাত্রছাত্রী অধ্যয়ন করছে। সে সময় এই প্রতিষ্ঠানে মাত্র একজন ছাত্রী অধ্যয়ন করলেও আজ আলাদা
ছাত্রীনিবাস তৈরী হয়েছে। কম্পিউটার ও ইলেকট্রনিক্স টেকনোলজি সহ অনেক নুতন নুতন
অনুষদ যুক্ত হয়েছে। আমাদের সময়ের তিন বছরের
ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্স এখন চার বছরের কোর্সে পরিণত
হয়েছে।
পলিটেকনিক
যাওয়া আসার পথে একজন মহান মানুষের সাথে আমার মাঝেমধ্যে সাক্ষাৎ হত। তিনি ভার্তখলার
গনমানুষের কবি দিলওয়ার
খান। তার বাসার সামনের রাস্থা দিয়ে প্রায়ই আসা-যাওয়া করতাম। তার
বাড়ি খান মঞ্জিলের সামনে আসামাত্রই কবিদর্শনের এক
তীব্র আকর্ষণ মনে জেগে উঠত। টিনের নিরিবিলি ঘরের
সামনের কোঠায় এসে কবি দেখা দিতেন। প্রথমদিন আমার
পরিচয় দেই, আমার লেখা কবিতার খাতা নিয়ে আসি। তিনি অতি ধৈর্যের
সাথে পড়েন ও ভূলভ্রান্তি শুধরে দেন। বসে বসে দীর্ঘক্ষণ
এই মহাজ্ঞানী মানুষটি আমার সাথে সাহিত্য, ইতিহাস ও মানুষের বিবর্তন নিয়ে আলোচনা
করতেন। সাম্যবাদ, পুঁজিবাদ, ধর্ম, দর্শন, বিজ্ঞানসহ প্রতিটি বিষয়ে জ্ঞানতাপস এই
কবির সাথে আলাপ হত। শীর্ণকায়া শ্যামলা চশমাপরা কবি দিলওয়ার
পত্নীর সাথেও দেখা হত। আমি চা নাস্তা না খেয়ে এই বাসা হতে কোনদিন উঠে আসতে পারিনি।
২০১৩ সালে
আমি পুবালী ব্যাংক লিমিটেড বরইকান্দি শাখার সহকারী মহাব্যবস্থাপক থাকাকালে বহুবছর
পর আবার কবির বাসা খান মঞ্জিলে
আমার রচনাসমগ্র তাকে উপহার দিতে যাই। এবার সেই আগেকার টিনের ঘরের বদলে তার একটি
সুন্দর ডুপ্লেক্স বাসায় গিয়ে বসি। দুতলা হতে নেমে এসে বইটি হাতে নিয়ে তিনি
অবিশ্বাস্য মাত্রায় খুশি হন। তাকে আমার খুব প্রশান্ত প্রশান্ত মনে হল। গল্পের মাঝে
একবার চা নাস্তা করে আবার পানীয় খেতে বাধ্য হলাম। বললেন তার আমেরিকা প্রবাসী পুত্র
সুন্দর এবাসাটি নির্মাণ করেছেন।
উঠে আসার
মুহুর্তে কবি দিলওয়ার এমন এক অভিনয় করলেন যে
সৌজন্য দেখে আমি বিস্ময়ে অভিভুত হয়ে গেলাম। তিনি দুইশত টাকা আমার হাতে দিয়ে
বললেন তোমার ছেলের জন্য কিছু কিনে দিবা।
আমি বললাম আমার টাকা লাগবেনা কিন্তু তিনি জুরে পকেটে ডুকিয়ে দেন। সেইদিন কবির
শরীরস্বাস্থ্য দেখে আমার মনে হল তিনি খুব সুখে
আছেন, তাই তিনি বেঁচে রইবেন বহুদিন। কিন্তু আমি আসার দশবার দিন পর ব্যাংকে বসে
শুনলাম তিনি হঠাৎ পৃথিবী হতে চিরবিদায় নিয়েছেন। পরদিন খান মঞ্জিলের ঐ ডুপ্লেক্স
বাসার সামনে আমরা “রক্তে আমার অনাদী অস্থি” কাব্যের এই অমর কবি ও ভাল
মানুষটিকে সমাধিস্থ করে চোখমুছে বাড়ি
ফিরলাম। তখন হৃদয়ে বাজল তার কবিতার লাইন “পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, সুরমা, অজস্র নদী ও
ঢেউ।/ রক্তে আমার অনাদী অস্থি, বিদেশে জানেনা কেউ”।
আমার
চিরকুমার চাচা মখলিছুর রহমান চৌধুরী তার জমিজামা ও সহায় সম্পদসহ মতিভাইয়ের সাথে
ছিলেন। বার্ধক্য জনিত রোগে তিনি এক সময় শয্যাশায়ী হলে
লালই পুতী তার সেবাযত্ন করতেন। যার হাতে তার সহায়সম্পদ তিনি লালই পুতীর বেতন
পরিশোধ করেন নি, ফলে বছর দেড়েক ধরে বেতন না পেয়ে
লালই পুতী অবহেলার সাথে দায়ছাড়া কাজ করতেন। পুর্বঘরে অনাদর অবহেলায় তিনি রাতদিন
একাকী পড়ে থাকতেন।
এমতাবস্থায়
আব্বা লালই পুতীর বেতন চারহাজার টাকা আমার অগ্রজা মান্নার কাছ হতে ধার নিয়ে পরিশোধ
করে দেন, যদিও এই চাচার কোন সম্পদ তিনি কোনদিন স্পর্ষও করেননি। আব্বা ছিলেন খুব
মহানুভব, তিনি বড়ভাইয়ের কষ্ট দেখে তাকে আমাদের ঘরে নিয়ে আসেন। চাচা রাতে ঘুমাতেন
না, আব্বা ও ভাই তাহমিদ রাত জেগে তার সেবাযত্ন করতেন, এমনকি তিনি অচল হওয়ায় তার
মলমূত্রও নিজহাতে পরিস্কার করতেন। আমাদের ঘরে বছর দেড়েক শয্যাশায়ী থেকে ১৯৮৬ সালের
২৭ জানুয়ারি আমার চিরকুমার চাচা মখলিছুর রহমান চৌধুরী ইন্তেকাল করেন। আমি পলিটেকনিক
হতে ফেরার পথে তার মৃত্যুর সংবাদ পাই। সারা জীবন হজরত আজরাইলের(আঃ) ভয়ে
ভীতসন্তস্ত্র আমার বড়চাচী সফিকুন্নেছা চৌধুরী এই একই
বছর ২৭ অক্টোবর বুড়ো বয়সে শেষনিঃশ্বাস
ত্যাগ করেন।
আমার অগ্রজ
তাহমিদ চৌধুরী বিএ কমপ্লিট করে ১৯৮৬ সালের শুরুতে ঢাকা তেজগাও
শিল্প এলাকায় অবস্থিত আমার চাচাত ভাই এমপি শফি আহমদ চৌধুরীর আলবার্ট ডেবিড
ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেডে চাকুরীতে যোগদান করেন।
এই বছরের শেষদিকে বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত
হয়। এই নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ
করে নি।
শফি আহমদ
চৌধুরী এই সংসদ নির্বাচনে দক্ষিণসুরমা ও ফেঞ্ছুগঞ্জ
(সিলেট-৩) আসনে রিকশা মার্কা প্রতীক নিয়ে স্বতন্ত্র ভোটপ্রার্থী হন। নির্বাচন কাজে
ব্যবহারের জন্য ঢাকা হতে এলবার্ট ডেবিটের পনের বিশটি নীলরঙ্গের সুন্দর গাড়ি আসে। এলবার্ট
ডেবিটের সিলেট অঞ্চলের সবাই ঢাকা হতে এসে ভোটের কাজে যোগদেন। এই ভোটে তার
প্রচারনায় আমরা দুইভাই, শাহনাজ ভাই, কামরান ভাতিজা, মুর্শেদ ভাই, ডাঃ নিয়াজ ,
কামাল ভাতিজা, আবুলেইস ভাই প্রমুখ দিনরাত খেটে যাই। কামালবাজার হতে শ্রীরামপুর,
নাজিরবাজার হতে ফেঞ্ছুগব্জ সারকারখানা পর্যন্ত সারাটা এলাকা আমরা ভোটের গাড়িতে করে
ঝড়ের বেগে ছুটে বেড়াই। গাড়ির মাইক ও ক্যাসেটে তখন
ভোট কামনায় বাজত সুন্দর সুন্দর প্যারোডি গান ও
শ্লোগান। এসময় জন্মভূমি দক্ষিন সুরমা ও ফেঞ্ছুগঞ্জ,
এই বিশাল এলাকার প্রায় সবগুলো গ্রাম, জনপদ ও
বাজার আমার ঘুরে
ঘুরে দেখার সৌভাগ্য হয়। আসলে সেই তরুণ বয়সে নিজ এলাকাটাকে একবার সরজমিনে
দেখা দরকারও ছিল।
এডভোকেট
সোলেমান রাজা চৌধুরীর কুমারপাড়ার বাসায় ভোট পরিচালনা অফিস স্থাপিত হয়। ভোট
পরিচালনার প্রধান ভূমিকা রাখেন এডভোকেট সোলেমান রাজা চৌধুরী, কদমতলীর সোলেমান বখত,
কুচাই পশ্চিমভাগের দারা মিয়া, মোল্লারগাওয়ের মখন মিয়া চেয়ারম্যান, খিত্তার উসমান
মিয়া, মদন মোহন কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম, বরইকান্দির শিশু মিয়া,
দাউদপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান খলিলুর রহমান, ডাঃ নিয়াজ এ চৌধুরী, আমার পিতা সফিক
চৌধুরী ও এলবার্ট ডেবিটের আতা সাহেব প্রমুখ। বাজারে বাজারে অসংখ্য নির্বাচন অফিস
স্থাপন করা হয়। কোন কোন অফিসের ছাদে আস্ত রিকশা উঠে
যায়। অফিসগুলো পোষ্টার, ব্যানার ও নানারঙ্গের বিদ্যুৎ
বাতির আলোর বন্যায় ভেসে যায়। সবগুলো বাজারে ও জনপদে জনসভা ও মিছিলে এক উৎসবময় পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
নির্বাচনের
শেষদিকে ভোট ক্যাম্পেইনে সদ্য অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ প্রধান
ই এ চৌধুরী এসে যোগ দেন। একদিন রিকশা ব্যানার লাগান একটি
জীপে করে তার সাথে রশিদপুর হতে আসছিলাম। তিনি ছিলেন সামনের সিটেবসা, পথে একজন লোক
হাত উঠালে তিনি ড্রাইভারকে গাড়ি থামিয়ে লোকটাকে উঠাতে বলেন। লোকটি তার পাশে বসেই
একটি সিগারেট বের করে তার কাছে আগুন চাইল। তিনি পিছন হতে একটি দিয়াশলাইয়ের
ইন্তেজাম করে দেন। লোকটা সিগারেটে সুখটান দিয়ে কালো ধুয়া ছাড়তে ছাড়তে তাকেও টানার
জন্য জ্বলন্ত শলাকা এগিয়ে দিল। স্টেশন রোডে এসে এই লোকটা নেমে গেলে বিরক্ত ই এ
চৌধুরী বললেন, আমার মুখের উপর সিগারেটের ধুয়া
ছাড়ার সাহস বাংলাদেশে ক’জনের আছে, অথচ এই ভোটের জন্য এসে আজ
সব নীরবে সইতে হচ্ছে।
ভোটের
দুইদিন আগে দুইশত ট্রাক ও শতাধিক গাড়ির বিশাল মিছিল হয়। মিছিলটি কদমতলী হতে
জালালপুর যায় ও বিকালে ফিরে আসে। এতগাড়ি নিয়ন্ত্রণ করা খুব
কঠিন হয়ে পড়ে। সিলেট ঢাকা মহাসড়কে
প্রচন্ড যানজট সৃষ্টি হয়। ফেরার সময় রাত ৮ ঘটিকায় সিলেট স্টেশনরোডে গাড়ির সারি ঢুকামাত্র
কিছু দুবৃত্তের দল হকিস্টিক দিয়ে দামি দামি গাড়িগুলোর গ্লাস ভাংচুর শুরু করে। এই
নির্বাচনে শফি চৌধুরীর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন পনের দলীয় আওয়ামীলীগ জোটের ন্যাপনেতা
পীর হবিবুর রহমান। জালালপুর ইউনিয়নের বাঘরখলা নিবাসী পীর হাবিবুর রহমান ছিলেন মাদ্রাসা ছাত্র কিন্তু
সিলেট আলিয়া মাদ্রাসায় অধ্যয়নকালে কমিউনিষ্ট মতাদর্শে জড়িয়ে পরায় তিনি মাদ্রাসা
হতে বহিস্কৃত হন।
ইতিপুর্বে
তিনি কূড়েঘর প্রতীক নিয়ে বহুবার সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে পরাজিত হন। লোকে কৌতুক করে বলত, ‘পীর হবিবের ভাঙ্গা ঘর, কুকুর ঢুকে
বরাবর’। তবে এবার পীর সাহেবের মার্কা আওয়ামী
লিগের নৌকা, ন্যাপের সেই
অপয়া কুড়েঘর নয়।
ভোটের দিন
সন্ধ্যার পর সোলেমান রাজা চৌধুরীর বাসায় ভোটের ফলাফল আসা শুরু হয়। ভোটের যোগফল
কখনো রিকশা, কখনো নৌকার দিকে উঠানামা করছিল। ফলে এই বাসার একদঙ্গল লোকের মাঝে কখনো
আনন্দ কখনো ব্যদনার ঝড় বইছিল। কিন্তু শেষপর্যন্ত রাত ১২টা নাগাদ সব
আনন্দ পরিণত হল বিষাদে। এক বিষন্নতা বাড়িটিকে
গ্রাস করে ফেলে। এত লোকজনের একমাসের অক্লান্ত পরিশ্রম জলে ভেসে গেল, মাত্র ১০১৭টি
ভোটের জন্য দলবিহীন স্বতন্ত্র প্রার্থি শফি এ
চৌধুরী পনেরদলীয় জোটপ্রার্থী পীর হবিবুর রহমানের নৌকার কাছে হেরে যান।
কেউকেউ চোখ
মুছেন, একে অন্যকে সান্তনা দেন, আবার কেউবা বলেন সব ভোট চুরি হয়ে গেছে। যদি ভোট
চুরি না হত তবে আমাদের বিজয় ঠেকায় কে? কেউকেউ বলেন গণনায়
ভুলও হতে পারে, তাই এখনও নিরাশ হবার কোন কারণ
নেই। কিন্তু আসল সত্য হল, এবার আল্লাহ তায়ালা পীরসাহেবের দিকে তার রহমতের বারিবর্ষণ
করেছেন, পীরসাহেব সারাজীবন ভোটে হারতে হারতে শেষপর্যন্ত বুড়ো বয়সে এই প্রথম বিজয়ের
মুখ দেখলেন, তাও আবার কূড়েঘর নয়, আওয়ামি লিগের নৌকায় চড়ে।
প্রতিপক্ষের লোকজনও বললেন তারা সব আশা ছেড়ে
দিলেও পীর হবিবুর রহমান অবশেষে কেমন করে যেন জেতে
গেলেন।
সুলেমান
রাজা চৌধুরীর পত্নী সুরাইয়া খালা আমার মায়ের আপন মামাত বোন, পরদিন লতিফা চৌধুরী খালাকে জড়িয়ে ধরে চোখের পানি মুছে সিলেট ত্যাগ করেন। লতিফা
চৌধুরী তার পিতা খ্যাতিমান সাংবাদিক ও মন্ত্রী শেরপুরের খন্দকার আব্দুল হামিদের ভোট বিজয়
কাহিনি বলতেন। তিনি
১৯৫৪ সাল হতে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত আমৃত্যু নাকি এমপি
ছিলেন। লতিফা ভাবির ভাষায় ভোটের সময় তারা সবাই
মহানন্দে বাবার সাথে গ্রামে যেতেন, ভোট চাইতেন ও মহোৎসব
করে বিজয়ীর বেশে শেরপুর হতে ঢাকায় ফিরে আসতেন। সামরিক
শাসক এরশাদের গ্রাম সরকার, উপজেলা, রাষ্ট্রধর্ম, নারী কেলেঙ্কারী,
ঘরুয়া রাজনীতি, হ্যাঁ ভোট-না ভোট ইত্যাদি নানান
তুঘলকি কান্ডকারখানা দেখে দেখে পলিটেকনিক
জীবনের পুরো সময়কাল পার করলাম।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন