চৌধুরীবাজার শাখায় আমার সহকর্মীরা
প্রিন্সিপাল অফিসার পিজুস কান্তি
দাস আমার সেকেন্ডম্যান, তিনি সুনামগঞ্জের ভাটি এলাকার সন্থান। থাকতেন শহরের ভাতালি
পাড়ার। চাকুরী আছে আর মাত্র তিন বৎসর। আমার কারে আমরা দুইজন অফিসে আসা যাওয়া
করতাম। তার অনুজ অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক। পিজুস বাবুর পত্নী বেশ সুন্দরী এবং ছেলেরা
স্কুল-কলেজে লেখাপড়া করছে।
জুনিয়র অফিসার আফ্রিন আক্তারের
স্বামী মনির আহমদ একাডেমিতে শিক্ষকতা করেন। মনির একাডেমির আবাসিক ভবনে তারা বসবাস
করেন। একটিমাত্র মেয়েকে নিয়ে তিনজনের সুখী সংসার তাদের। আমি ও নুরজাহান বেগম
লালকারে বাড়ি আসার পথে অনেকবার আফ্রিনদের বাসায় যাই। আফ্রিন নানাপদের নাস্তা তৈরি
করে পরিবেশন করতেন। ফেরার বেলা মাঠে ফলানো শাকসবজি কারে তুলে দিতেন। আফ্রিন
জাহাঙ্গিরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্স। আফ্রিনের ভাই উপজেলা নির্বাহি কর্মকর্তা।
আফ্রিনের উদরে কয়েকবার বাচ্চা নষ্ট হয়। তিনি আমার চিকিৎসক পত্নীর স্মরণাপন্ন হন।
আমি আসার পর তিনি একটি পুত্রসন্থানের মা হন।
জুনিয়র অফিসার মোঃ আব্দুল
কাশেমের বাড়ি দুই মাইল পশ্চিমে খালেরমুখের সতিঘর গ্রামে। সে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের
মাস্টার্স। আমি চলে আসার পর সে আমার বাসায় গিয়ে তার বিয়ের দাওয়াত দেয়। একদিন
সপরিবারে আমি ফেন্সুগঞ্জের কুশিয়ারাপারের বিয়েসেন্টারে গিয়ে তার সাদি মুবারকে
অংশগ্রহন করি।
ক্যাশ ইন চার্জ শাহাব উদ্দিনের
বাড়ি ছিল দশ মাইল দূরে ভাদেশ্বর গ্রামে। যুবক বয়সি শাহাব উদ্দিন প্রতিদিন ভাদেশ্বর
হতে মোটরসাইকেলে অফিসে আসা যাওয়া করতেন।
খেলুমিয়া ছিলেন একজন পরিশ্রমী
অফিসার(ক্যাশ)। তিনি একজন দক্ষ লোক ও সর্বকর্মে পারদর্শী হওয়ায় তাকে আমি জেনারেল
ব্যাঙ্কিং কাজে ব্যবহার করতাম। তিনি বলতেন, আমি ব্যাংকে আসার আগে ক্ষেতের কাজ,
গার্মেন্টের কাজ, শ্রমিকের কাজ সব করে এসেছি, শক্ত মাটিতে ঘুমিয়ে রাত কাটিয়েছি, সে
তুলনায় ব্যাংকের কাজ আর এমন কি? আমি লোহায় গড়া মানুষ, আমি সব পারি, আমাকে আটকাবে
আবার কোন সে বাপের পুত? আমার এই কাজের মানুষটিকে অঞ্চলপ্রধান সিরাজ সাহেব
ফেন্সুগঞ্জ বদলি করে দেন।
আদনান কুরেশী আমার সবংশজাত।
ইন্টারমেডিয়েট পাস করে সে ক্যাশিয়ার কাম ক্লার্ক পদে ব্যাংকে যোগদান করে। তার আইটি
দক্ষতা এবং সর্বকাজে পারদর্শিতা অসাধারণ। আমি তাকে দিয়ে ঋন ও আদায়ের জটিল কাজ
করায়ে নিতাম। সে কাজে কর্মে একজন সিনিওর অফিসারের সমকক্ষ ছিল। আদনান একজন
চট্টগ্রামি মেয়েকে বিয়ে করে। দাউদপুর পশ্চিম চৌধুরীবাড়ি গিয়ে আমরা আদনানের একমাত্র
কন্যার জন্মদিনের কেক কেটে বেশ আনন্দ উল্লাস করি। আদনান সম্পর্কে নাতি, তাই তার
কন্যা আমার পন্তি। এই অনুষ্টানে গিয়ে আমার চার পুরুষের মিলন ঘটে। এই শাখায়
থাকাকালে বেশ কয়েকবার আদনানের বাড়িতে গিয়ে তার দাদা ও আমার চাচাত রেজওয়ান ভাইকে বেশ
কয়েকবার রোগশয্যায় দেখে আসি। তার বয়স তখন সাতান্নব্বই। একদিন তিনি মারা গেলে
দাউদপুর ঈদগাহে জানাজায় অংশ নেই। তাকে জামে মসজিদের সামনে তার মামাবাড়ির পারিবারিক
কবরগায় দাফন করা হয়। রেজওয়ান ভাই ছিলেন আমার বিয়ের উকিল।
শাহানা আক্তার ক্যাশিয়ার কাম
ক্লার্ক। তার বাড়ি ব্যাংক সংলগ্ন হাড়িয়ারচরে। সে আমার প্রিয় মছব্বির ভাইয়ের মেয়ে। চৌধুরীবাজার
হতে বদলী হবার কিছুদিন পরই শাহানার বিয়ে খাই। তার স্বামী পুবালী ব্যাংকের অফিসার ফয়েজ
আহমদ। সে গনিতে সাস্টের মাস্টার্স, বাড়ি জৈন্তা। কুমারি মাজেদা আক্তার ক্যাশিয়ার
কাম ক্লার্ক, বাড়ি মোগলাবাজার, আমি চলে আসার পর তার সাথে আর কোন যোগাযোগ হয়নি।
আমি যোগদানের কিছুদিন পর এখানে
আসে সিনিয়র প্রহরি তাজুল ইসলাম। সে একসময় পুলিশে চাকুরী করত, কিন্তু চাকুরী চলে
যায়। জকিগঞ্জে বাড়ি তাজুলের বাসা কুচাই শিল্প এলাকা। সে একটি মোটর সাইকেলে আসত।
পুলিশে তার খুব প্রভাব ছিল। আমি তাকে দিয়ে আমার ড্রাইভিং লাইসেন্স বের করি। সিলেট
জেলা প্রশাসক অফিসে ড্রাইভিং লাইসেন্স পরীক্ষা দিতে গেলে সে আমাকে একদম সামনের
চেয়ারে বসায়। পরীক্ষক এসে বললেন আপনি যে কটি উত্তর পারেন কেবল সেকটি বৃত্ত ভরে
দেবেন, না পারলে শূন্য রেখে দিবেন। আমরা উত্তরপত্র দেখার সময় সঠিক বৃত্তটি পূর্ন
করে নেবো। এমনই এক পরীক্ষা যেখানে সবাই পাশমার্ক অটোমেটিক পেয়ে যান, পিছনে গোপন থাকে
এই পাশের বিপরীতে এক ছোট্ট অবৈধ লেনদেন।
তাজুল ইসলাম আমার ও ডাঃ
নুরজাহানের পাসপোর্ট নবায়ন করে দেয়। কুচাই পাসপোর্ট অফিসে আমার পরিচয় দেয় ঢাকার
সাংবাদিক। পাসপোর্ট অফিসের লোকজন সবকাজ ফেলে ভিতরে নিয়ে আমাদের পাসপোর্ট খুব সহজে
সরবরাহ করে দেন। পাসপোর্ট প্রতি ১০০০/= টাকার একটি গোপন চাঁদা সবাই দেন। আমাকে সেই
চাদাও দিতে হয়নি।
কিন্তু তাজুল ছিল ব্লাডপ্রেসার রোগী।
সে অফিসে আসত দেরীতে আবার চলে যেতে চাইত আগে। যা অন্য প্রহরীরা মেনে নিতে পারত না।
তা নিয়ে তাদের মধ্যে ঝগড়া লেগে যেত। আব্দুন নুর ছিলেন কোম্পানী গার্ড, তিনি জীবন
কাটান বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে। সেনাবাহিনীতে দীর্ঘ্যদিন কাজ করায় তিনি ছিলেন খুবই
আনুগত্যপ্রবন। মানুষটি সরল ও নিষ্টাবান। তার বাড়ি টিকরপাড়া, গোলাপগঞ্জ। তিনি আমার
গাড়ি চড়ে প্রতিদিন রাতে কদমতলি এসে গোলাপগঞ্জের বাস ধরতেন।
সিনিয়র প্রহরি মিজানুর রহমান ছিল
বিয়ে কামলা লোক। সে বয়স্ক লোক হওয়া সত্বেও প্রায়ই বিয়ে করত। উশৃংখল জীবন কাটাতে তার
প্রচুর খরচ হত। সুযোগ পেলেই লোকের কাছে ধারকর্জ করত। তাকে আমার শাখায় পাঠানোর পর
তার সাথে অসংখ্য পাওনাদার এসে তাদের পাওনা আদায়ে আমাকে নালিশ জানায়। ইতিমধ্যে সে
চৌধুরীবাজারেও বেশ ধারকর্জ করে বসে। আমি বাজারে ঘোষণা দিলাম কেউ যেন মিজানকে টাকা ঋণটিন
না দেয়। সিরাজ সাহেব যেসব লোকদেরে কেউ রাখছেনা সেসব ভেজালদেকে একে একে আমার দরবারে
পাঠিয়ে দেন। একরাতে গার্ড মিজান ব্যাংক অরক্ষিত ফেলে তার কোন একজন বউয়ের বাড়ি চলে
যায়। এই রাত ১টায় আদনান খবর দেয় ব্যাংক অরক্ষিত, গার্ড মিজান নেই। বাজারের লোকজন
তাকে এই খবর দেওয়ায় সে ও আব্দুল কাশেম ব্যাংকে এসে মিজানকে পায়নি। ইতিমধ্যে
মোগলাবাজার থানার পুলিশের একটি গাড়ি এসে তাদেরকে ব্যাংকের সামনে পেয়ে সন্দেহ করে
বসে। পুলিশ তাদের পরিচয় জেনে নিয়ে নির্দেশ দেয় তারা যেন সারারাত এখানে অবস্থান করে
পাহারা দেন। সেই তীব্র শীতের রাতে আব্দুল কাশেম ও আদনান ব্যাংকের বারান্দায় পাহারা
দিয়ে রাত পার করেন।
আমি অঞ্চলপ্রধান আহমদ এনায়েত
মঞ্জুরের সাথে এব্যাপারে আলাপ করে চৌধুরীবাজার শাখা হতে আমার বিদায়ের দিনে প্রহরী মিজানুর
রহমানকে একটি কড়া মেমোরেন্ডাম দিয়ে আসি। উপমহাব্যবস্থাপক মশিউর রহমান খান বললেন
আপনি বিদায়ের দিনে ‘মেমো’ দিলেন। আমি বললাম আমার ‘মেমো’ না দিয়ে যে কোন উপায় ছিলনা,
কারণ উপরের নির্দেশ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন