সোমবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

চৌধুরীবাজার শাখায় যোগদান, যেন একজন পলাতকের ঘরে ফেরাঃ

 চৌধুরীবাজার শাখায় যোগদান, যেন একজন পলাতকের ঘরে ফেরাঃ

যোগদানঃ ২৬ জানুয়ারি ২০১৫ বিদায়ঃ ১০ এপ্রিল ২০১৬ অবস্থানঃ ১ বৎসর ২ মাস ১৪ দিন।

 

আজ ২৬ জানুয়ারি ২০১৫ সাল। সেদিন সাগরদিঘিরপার, সিলেট হতে আমার চৌধুরীবাজার যোগদানে আসার অভিঞ্জতা খুব একটা সুখকর ছিলনা। কিছুদিন আগে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়। বিজয়ী হন শেখ হাসিনা-এরশাদ জোট। বিরোধী বিএনপি-জামাত জোট ভোটচুরির অভিযোগ এনে সরকার পতনে লাগাতার সহিংস হরতালের ডাক দেয়। সেই হরতালের শিকার হলাম আমি। সাত সকালে বের হয়ে কোন বাহন পেলাম না, প্রায় তিন মাইল পথ হেঁটে হুমাউন রশিদ স্কয়ার পেরিয়ে শিববাড়ি যেতে হল। সুদীর্ঘ পথ হেঁটে হেঁটে ব্যাংকের এমডি আমার আত্মীয় হালিম সাহেব ও তার দোসর অঞ্চলপ্রধান সিরাজুল হক চৌধুরীকে কেবল অভিশাপ দিলাম। কিশোরেরা বেবিট্যাক্সি চালক, ভয়ে ভয়ে দ্বিগুণ ভাড়ায় একটিতে বসি, তাও অনেক ঠেলাধাক্কা করে। এবার নামতে হল মোগলাবাজার তিমুখিতে। আবার হাটি সোয়া মাইল জায়গা। পুনরায় এই বদ লোকদেরে অভিশাপ দিয়ে দিয়ে চৌধুরীবাজার শাখায় গিয়ে হাজির হলাম। সিলেট আঞ্চলিক অফিসে আমার চেয়ারে বসায়ে অন্য লোকদেরে আরাম ও সম্মান দিতে আমাকে জেনেশুনে অপমান করা হয় এবং এই নিদারূন পথকষ্টে ঠেলে দেয়া হয়। যে শাখায় একজন সিনিয়র অফিসারই যথেষ্ট, সেখানে একজন সহকারী মহাব্যবস্থাপক পাঠানোর কিবা প্রয়োজন ছিল। এছাড়া আঞ্চলিক অফিসে আসার আমার একবছরও পূর্ণ হয়নি। মনে হল এটা পরশ্রীকাতরতা, অল্প সময়ে সর্বক্ষেত্রে আমার সাফল্যে কারো কারো গাত্রজ্বালা। এটা পরিকল্পিতভাবে আমার ক্ষতিসাধন করা। এই সিলেটে কোন কোন চেয়ারে একই ব্যক্তি বছরের পর বছর পার করে, আর আমাকে বছর না পেরুতেই বৃন্দাবনে পাঠানো হল। আমি পরবর্তী কয়েক বছর ধরে  গ্রামশাখা, মৌলভীবাজার ও রাজধানী ঢাকা ঘুরি অথচ এই দীর্ঘ সময় সিলেটে ও হেড অফিসে অনেকে একই ভবনে একই চেয়ার দখল করে বসে থাকে বছরের পর বছর। দেখি তাদের একটু নড়চড় করানোর শক্তি কিংবা ক্ষমতা কোনটিই নেই পুবালী ব্যাংকের খলনায়ক এম ডি আব্দুল হালিম চৌধুরীর। এই ছোট্ট গ্রাম্য শাখায় পাঠিয়ে পরিকল্পিতভাবে চাকুরীতে আমার অবনতির ষোলকলা পূর্ণ করেন সিরাজ-হালিম চক্র। এই ছিল সিরাজ-হালিমের পূবালী ব্যাংকে ন্যায়বিচারের নমুনা। আমাকে ঢাকার লোকেরা বলত হালিম সাহেব শক্তের ভক্ত, নরমের যম। তাদের কথা আমার বিশ্বাস না হলেও পরে বিচার বিশ্লেষণ করে তাই সত্য ও সঠিক দেখতে পাই।   

আমি ছাত্রজীবনে একটি সনেট লিখেছিলাম যার শিরোনাম হল ‘হৃদয়ে আজন্ম রবে, জ্যান্ত তুমি আমার বাজার’। শৈশব ও কৌশরের স্মৃতিময় সেই চৌধুরীবাজারের পুবালী ব্যাংক শাখায় দুইযুগ পর আবার এলাম। শাখায় তখন পুনঃসজ্জা কাজ চলছে, ধুলা উড়ছে, থাই ও টালী কাটার কর্কশ শব্দে টেকা দায়। ব্যবস্থাপক আব্দুল জব্বার চাকুরী শেষে শীঘ্রই অবসরে যাবেন। আমি চার্জ নেব সেইসাথে তিনি চাকুরী হতে বিদায় নিবেন। তিনি খুব হাসিখুশি বাকপটু মানুষ। জব্বার সাহেব সারাজীবন ক্যাশে কাজ করলেও খুব সুন্দর সবাইকে ম্যানেজ করে চলতে পারতেন। আসলেই তিনি ছিলেন একজন দিলখোলা ভাল মানুষ।

সেই বাইশ বছর আগে শাখাটি ছিল বর্তমানের এক তৃতীয়াংশ জায়গায়, পুনঃসজ্জা কাজ শেষ হলে কয়েক দিনের মধ্যে শাখাটি ৩৫০০ বর্গফুটের বেশ বড় হাইফাই অফিসে পরিনত হয়। নতুন সোফা, উন্নত টাইলস গ্লাস, লেইটেস্ট সাজসজ্জা, সিসিটিভি ক্যামেরা ও সেন্ট্রাল এয়ারকন্ডিশন ব্যবস্থা সবমিলে শাখাটি একটি অভিজাত চেহারা লাভ করে। গ্রাম অঞ্চলে তখন এরকম একটি সুন্দর আধুনিক অফিস মেলা ছিল কল্পনাতীত। ভবনটির মালিক ছিলেন আমাদের ব্যাংকের পরিচালক মনির আহমদ।

চৌধুরীবাজারে যে ভাত খাবার হোটেল আছে তা আমার জানা ছিলনা। একটি খাবার হোটেলে মাছভাত খাই। দাউদপুর মাঝপাড়ার পরিচিত হোটেল মালিক বললেন, তিনি পাশের সরকারি পুকুর লিজ রেখেছেন সেই পুকুরের ফ্রেস মাছ প্রতিদিন তার হোটেলে আসে। এই হোটেলে প্রায়ই দুপুরে আমার মাছভাত চলত।

সেদিন জোহরের নামাজ দাউদপুর জামে মসজিদে পড়ে মাবাবার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে জেয়ারত করি। হেঁটে হেঁটে বাড়ি গিয়ে পুকুরঘাটে কিছুক্ষন বসে ফিরে আসি। সেই হরতালের দিনে আব্দুল জাব্বার সাহেব আমাকে তাড়াতাড়ি বিদায় জানান। এবার বাসাফেরার যুদ্ধে নামি। সকালে চার মাইল হেঁটেছি, এখন জানিনা কত মাইল হাঁটতে হবে। গাড়ি তেমন নেই, একটি টেক্সিতে মোগলাবাজার এসে লেগুনায় উঠলাম দ্বিগুণ ভাড়ায়। শিববাড়ির খানিকটা সামনে নেমে আবার হাটার পালা। বুড়ো বয়সে এই যন্ত্রনায় ফেলায় আবার হালিম-সিরাজকে প্রাণভরে ধিক্কার দিলাম।

ইতিমধ্যে হরতাল প্রাণঘাতী হয়ে ওঠে। প্রতিদিন সন্ত্রাসীরা চলন্ত গাড়িতে পেট্রোল বোমা মেরে মানুষকে পুড়িয়ে মারতে আরম্ভ করে। টিভির পর্দা পুড়ে অঙ্গার হওয়া মানুষের লাশে ভরে যায়। হাসপাতালে অগ্নিদগ্ধ মানুষের আর্তচিৎকারে পৃথিবীটা কেঁপে ওঠে। হরতাল ও দুবৃত্তদের এই অপকর্ম চলে সুদীর্ঘ পাঁচমাস। এই পাঁচমাস চৌধুরীবাজার শাখায় আমার যাতায়াত ছিল দুঃসহনীয়। প্রতিদিন বাসা ফিরতে রাত হত। মোগলাবাজার হতে লেগুনায় অন্ধকারে ফেরার পথে পিছনে কোন মোটরসাইকেল দেখলেই অজানা বিপদের ভয়ে প্রান কেঁপে যেত যদি পেট্রোল বোমা ছুড়ে পুড়িয়ে মেরে ফেলে। পাঁচ মাস ধরে দেশে এই অগ্নি সন্ত্রাস ও মানুষকে পুড়িয়ে মারার উৎসব চলে। এবার র‍্যাব এসব সন্ত্রাসীদের চিহ্নিত করে ক্রসফায়ারের নামে মেরে ফেলতে থাকে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় অনেক দুবৃত্ত ধরা পড়ে র‍্যাব ও পুলিশের ক্রসফায়ারে নিহত হয়। এই হরতাল ফ্লপ হতে শুরু হয় এবং ২০১৫ সালের ১৫ জুনের পর তা প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। এই পাঁচমাস এত কষ্ট করি, এত অতিরিক্ত ভাড়া প্রদান করি যে আমি চাকুরী জীবনে এধরনের যন্ত্রণা ও কষ্টে আর কখনো পড়িনি।  

এলাকাটি আমার জন্মভূমি, তাই প্রতিদিন কেউ না কেউ নানা সমস্যার সমাধান ও অর্থ সাহায্য নিতে আসত। প্রথম দিন বসামাত্র গ্রামের একজন গরীব মানুষ তার মেয়ের বিয়েতে সাহায্যের আবেদন পেশ করে, পরদিন হাসপাতালে ভর্তি রোগীর জন্য একজন সাহায্যের আর্জি জানায়। আমার সহপাঠি ও খেলার সাথীরা এসে তাদের অভাবের গল্প বলত, আমি তাদের হাতে দুই চার শত টাকা তুলে দিতাম। এখানে এসে আরেকটা লাভ হল তা আমার অতিকষ্টের বেতনের অর্ধেক টাকা বড় বড় অঙ্কের সাহায্য বিতরণে খসে যেত। প্রতি রমজানে আমি গ্রামের ঘরে ঘরে ইফতারির ছোলা মশলা বিতরন করে থাকি কিন্তু এবার খুব বেশী করে ছোলা বিতরণ করি। প্রায় তিনশত দরিদ্র ঘরে ইফতারি সামগ্রী বিতরণ হয়। যাক দয়াময় আল্লাহ আমাকে সামর্থ দিয়েছেন তাই সাহায্য করতে পেরেছি। ফলে মহান আল্লাহের প্রতি কৃতঞ্জতা জানাই। 

একদিন আমার সুহৃদ উপমহাব্যবস্থাপক মশিউর রহমান খান বললেন আপনি আপনার প্রতিবেশী ব্যাংক পরিচালক মনির আহমদকে দিয়ে জিএম সাহেবকে ফোন করায়ে সিলেট শহরে চলে আসেন। আমার ধারনা হল এই বদলীর সাথে এমডি অবগত, তার সম্মতি জড়িত। বস সিরাজ সাহেব এখনও সিলেটের বড় মাতব্বর। ভাবলাম হয়ত আল্লাহর ইচ্ছায় এখানে এসেছি, আমার যদি পরবর্তী পদোন্নতি ক্ষতিগ্রস্ত না হয় তাহলে ফোন করায়ে সিলেটে যাবার দরকার কি? এম ডি আব্দুল হালিম চৌধুরী আমার আত্মীয় তাই সামনের পদোন্নতি হলেই স্বাভাবিকভাবে আমি সরে যাব, না হয় বছর দিন কষ্ট করলাম। কিন্তু গোপনে আমি যাতে আর কোনদিন পুবালী ব্যাংকের পদোন্নতি না পাই এমন বন্দোবস্ত চলল আমার অজান্তে। কানকথা শোনা ও তৈলাক্রান্ত এমডি আব্দুল হালিম চৌধুরীও সেই ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে তার ঈর্ষাকাতর দোসরদের সাথে স্বেচ্ছায় নাকি অনিচ্ছায় যোগ দেন জানিনা, তবে আমার অনুমান এতে তার পূর্ণ সংশ্লিষ্টতা ছিল।

আমি খুব লজ্জায় ছিলাম আমাকে এখানে বসতে দেখে লোকে কিনা ভাবে, কিন্তু দেখলাম আমার পরিচিত লোকজন খুব খুশী হয়ে আমার সাথে দেখা করছেন। তারা অতীতের নানা স্মৃতিচারণ করে আমাকে জড়িয়ে ধরছেন। ব্যাংক যে অনলাইন হয়ে গেছে অনেকেই জানেন না। এখানে নাকি বড় অঙ্কের টাকা উঠানো যায়না। তাদের টাকা তাই পড়ে থাকে শহরের অন্যান্য ব্যাংকে। আমি বুঝিয়ে বলি এই শাখার হিসাবের টাকা শহরের যে কোন শাখা হতে অনলাইনে তুলা ও জমা করা যায়, তখন তারা বড় বড় চেক জমা দিয়ে এখানের হিসাবে তাদের টাকা নিয়ে আসে।

সাগরদিঘীপার বাসা হতে সাতসকালে বেরিয়ে রাত আটনয় ঘটিকায় বাসায় ফিরতাম। আমি ডায়বেটিস রোগী। আমাকে প্রতিদিন চল্লিশ মিনিট হাটতে হয়। এখন এই হাটার সময় কোথায়? তাই অফিসের কাজের ফাঁকে বেরিয়ে চল্লিশ মিনিট হেঁটে আসতাম। আমার জন্মভূমি দাউদপুর-তুরুকখলাকে বিশ বছর পর আবার খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতে আমি প্রতিটি পাড়া পরিভ্রমন করি। আমার বাল্যকৈশবের সেই দাউদপুর-তুরুকখলা এখন আর নেই। গ্রামদু’টি পুরাপুরি বদলে গেছে, এখন কোন ছনের কুড়েঘর নেই, সব পাকা টিনের দালান, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ এসেছে, সর্বত্র টিভি ফ্রিজের ছড়াছড়ি। পায়ে হেঁটে পাশের সিরাজপুর, বাটিয়ারচর, হুসেনপুর, নেগাল গ্রামগুলোও পরিদর্শন করি। এসব গ্রামের মেঠোপথে হেঁটে হেঁটে শৈশবের মিষ্টগন্ধ আবার শুকে নেই। সবখানে কেবল পরিবর্তন ও নতুনত্ব চোখে পড়ে। আমার হাটার একটি কমন রাস্থা ছিল ব্যাংক হতে তুড়ুকখলা দক্ষিণপাড়ার মসজিদ। হাওরপারের এই প্রাচীন গম্বুজওয়ালা মসজিদে আমি প্রায়ই আসরের নামাজ জামাতে আদায় করতাম। এখানে আমার সহপাঠি মিন্টুর বাড়িতে কয়েকদিন চানাস্তা করি। মিন্টুর মাছ ও পল্ট্রি খামার ঘুরে দেখি। আমার সহপাঠি মালেকা, শুয়ারা, কলুন, কামাল, সেলিম, দিপা, শাহানা, টফি, টিপু ও মিনারের জনহীন বাড়ির পাশে হেঁটে বেড়াই। সেলিম এখন গ্রামের একজন গণ্যমান্য মেম্বার। তার দোকানে বসে দু এক বাক্য কথাবার্তা বলে যাই। এপথে আব্বার ছাত্র মুক্তিযোদ্ধা সিপাহি মকবুল ভান্ডারীর সাথে দেখা হত। তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধে গোলার আঘাতে একটি চোখ হারান। বর্তমানে অন্যের দানকরা চোখে পৃথিবী দেখছেন। পড়ন্ত বিকেলে ধানের খালি মাঠে কিশোরদের ফুটবল খেলা দেখে নিজের অজান্তে শৈশবে চলে যেতাম। এসব মাঠের দর্শক ও কিশোরেরা সালাম দিত। তাদের পানে তাকালে কি এক মুগ্ধতায় মন ভরে যেত। আমরা অনেক দিন আগে গ্রাম ছেড়ে চলে গেছি, একদিন ওরাও জীবনযুদ্ধে দেশদেশান্তরে চলে যাবে। আমার বাড়িতে অল্পই যেতাম, কারণ পিতামাতা শূন্যগৃহ বুকটা হাহাকারে ভরে দিত। শৈশবের ভাই বোনের এলোমেলো স্মৃতি আমাকে তাড়া করত। মাঝে মাঝে বাড়ির পিছনের বাশঝাড় সুপারি বাগানে নীরবে হেঁটে উত্তরের গড়েরমাঝের সাইয়িদ আহমদের মাজার জেয়ারত করে হাওরপারে হাজির হয়ে সুদুরে সিলেট শহরের সুউচ্চ ভবন পানে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়তাম।       

রাস্থাঘাট পাকা, সবার পায়ে স্যান্ডাল, পরনে ভাল কাপড় লুঙ্গি, মানুষ আর শিক্ষিত ও মর্জিত। সারাটা গ্রামে যেখানে একটি বড় জামে মসজিদ ছিল, এখন প্রতিটি পাড়ায় পাড়ায় একাধিক পাকা মসজিদ দেখতে পাই। মাদ্রাসা, পাঠশালা ও মসজিদে লোক গিজগিজ করছে। এমনকি অসংখ্য পাকাবাড়ি, কারখানা, মার্কেট, বিয়ে সেন্টার, দোকানপাটে সারাটা চৌধুরীবাজার ভরে গেছে। বাজারের সীমারেখা চলে গেছে বহুদূর। মনে হল সেখানে আর সেখানটি নেই।

ব্যাংকের সামনে একটি ওয়ালঘেরা পাকা বাড়ি। ওবাড়িতে আমার কার রাখি, বাড়ির কিশোরেরা ডাক দিলো স্যার, চা খেয়ে যান। দাড়িওয়ায়ালা বৃদ্ধ মুরব্বী বললেন স্যার এসে না বসলে আমরা খুব বেজার হব। এবার চানাস্তা নিয়ে এসে অর্ধঘোমটা বৃদ্ধা বললেন আমি কোনারপাড়ার আপনার পাঠশালার সহপাঠিনী মঞ্জু বেগম। বেশ কষ্টে আমার স্মৃতিতে তার ছবি ভেসে ওঠে। এই শ্রীহীন বুড়ি ছিলেন একজন উজ্জ্বল শ্যামলা নাদুস নুদুস ফ্রকপরা সুন্দরী বালিকা মঞ্জু। আজকের চেহারায় আমি সেই ফ্রকপরা সুন্দরী বালিকার কোন চিহ্নই খোজে পেলাম না।

ফরমুজ উল্লাহ মাওলানা সাহেবের নাতি আমার সহপাঠি হাড় জিরজিরে মুক্তার আহমদ প্রায়ই এসে সামনে বসেন। তাকে নিয়ে চায়ে চুমুক দেই। ইউনিয়ন চেয়ারমেন নুরুল ইসলাম আলম আমার মোগলাবাজার হাইস্কুলের ছাত্র। সে এসে সালাম জানায়। সহপাঠী আজাদুর রহমান তার সুন্দরী লন্ডনী পত্নীকে নিয়ে একদিন অফিসে আসেন। তাদের গাড়িতে চড়ে আমি তার অসুস্থ পিতা দাউদপুর ইউনিয়নের প্রাক্তন চেয়ারম্যান মাহমুদুর রহমান আবুল মিয়াকে দেখতে যাই। আবুল মিয়া আব্বার ছাত্র, তিনি আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। দীর্ঘদিন ধরে ক্যন্সারের সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকা আবুল মিয়ার মনবল লোহার মত শক্ত হলেও সেই দৈহিক শক্তিসামর্থ্য আজ আর নেই। তিনি আমার দিকে চেয়ে চেয়ে প্রচুর চোখের জল ফেললেন। এই দুপুরে আজাদের ঘরে মধ্যাহ্ন ভোজ হল। আমার সহপাঠি দুলু আজ কবিরাজ, তিনি পাঞ্জাবী টুপী পরে এসে প্রায়ই আমাকে ঔষধ, আচার, চাটনি ইত্যাদি উপহার দেন। একদিন বললেন তোমার পত্নী চিকিৎসক, এই কবিরাজি বইগুলো তাকে দিলে চিকিৎসা কাজে লাগবে। ছবিসহ গাছগাছড়া শাকসবজি ও ফলফুলের গুনাগুন বর্ণিত এইসব বই বেশ সমৃদ্ধ, আমি খুব মন দিয়ে পড়ি।

একদিন মনির আহমদ একাডেমিতে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা হয়। প্রতিষ্ঠানের অডিটরিয়ামে নিয়োগ উপলক্ষে একটি অনুষ্ঠান হয়। প্রিন্সিপাল আমাকে এই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানান। আমার ব্যাংকের পরিচালক মনির আহমদ উপস্থিত থাকবেন মনে করে আমি একটি সুচিন্তিত বক্তব্য প্রস্তুত করি। কিন্তু তিনি এলেন না, ঢাকায় চলে যান। এই সভায় আমি সেই সুন্দর দীর্ঘ বক্তব্য রাখি। আমার আগের দিনের স্মৃতি ও আব্বাকে নিয়ে রাখা বক্তব্য শোনে আগের প্রজন্মের আব্বার ছাত্ররা চোখের পানি ফেলেন। এই সভায় আমার প্রিয় মিনই ভাই বিশেষ অতিথি ছিলেন। সভাশেষে আমি ও সহকর্মী আফ্রিন আক্তার বেরিয়ে এসে একাডেমি ক্যান্টিনে মোরগ-পোলাও ভোজন করি। পাকঘরের সবাই পরিচিত লোকজন। তারা বেশ খাতিরযত্ন করে খাওয়ান।

আমার সহকর্মী সাহানার আব্বা হাড়িয়ারচরের মছব্বির ভাই এসে প্রায়ই সামনে বসেন, গল্পগোজব করেন। বিকেলে বাসা ফেরার সময় তার বাগানে ফলানো কদু মূলা শসা পুইশাক ঢেড়স ইত্যাদি আমার গাড়িতে তুলে দেন। বেশ কয়েকবার সপরিবারে তার বাড়িতে আমি দাওয়াত খেতে বাধ্য হই।

জুন ২০১৫ সালে প্রাণঘাতী হরতাল স্থিমিত হয়। লাল কার চালিয়ে আমার অফিসে আসা যাওয়া শুরু করি। আমার কারে শহর হতে শরিক হতেন আমার সেকেন্ডম্যান পিজুস কান্তি দাস। ফেরার সময় পিজুস বাবু ও কোম্পানি গার্ড হাফিজ উদ্দিন। মোগলাবাজার পর্যন্ত রাস্থা ভাল তারপর মাত্র সোয়া মাইল রাস্থা ভেঙ্গে নাজেহাল অবস্থা। এই সড়ক হতে চৌধুরী বাজার যাবার তিনটি রাস্থা আছে, অথচ তিনিটি রাস্থারই বেহাল অবস্থা। দুচার জায়গায় গাড়ির তলা নিচের ভাঙা খাদে ঘস করে লেগে যেত। এই গাড়িটি সারাদিনের জন্য গ্রামে নিয়ে আসায় আমার চিকিৎসক বেগম সাহেবা গাড়িটি হারান। তার ড্রাইভার বিদায় হয়।

এবার অঞ্চলপ্রধান সিরাজুল হক চৌধুরীর আরেক ছোটলোকির কাহিনি সবাইকে বলতে হয়। আমি তার অফিসে থাকাকালে প্রধান কার্যালয় হতে জারি করা স্টাফ গাড়িঋণের একটি সার্কুলার পাই। সার্কুলারটি পড়ে দেখি সহকারী মহাব্যবস্থাপক হিসাবে আমার এই ঋণ পেতে কোন বাধা নেই। গতবছর সিলেট শহরে কেবল আমিই বরইকান্দি শাখায় সবকটি টার্গেট করে এসেছি। কাজেই মনে হল এই গাড়ি ঋণ সহজেই পেয়ে যাব। আমি তার চেম্বারে গিয়ে গাড়ি ঋণ আবেদন করতে চাইলে তিনি বললেন সব রেডি করে দেন আমি হেড অফিসে পাঠিয়ে দেব। তার অনুমতি পেয়ে আমি কারের কয়েকটি কোটেশন সংগ্রহ করে আবেদনটি পেশ করি। ইতিমধ্যে আমাকে চৌধুরীবাজারে পাঠান হয়। দুই চার দিন ফোনে বললাম, এই গাড়িটি আমার বেগম ব্যবহার করেন, আমার চৌধুরীবাজার যেতে আরেকটি গাড়ি দরকার, কাজেই আবেদনটি শীঘ্রই প্রধান কার্যালয়ে পাঠিয়ে দিলে আমার জন্য হিতকর হয়। দেখলাম কিছুই হচ্ছেনা। একদিন আমাকে বললেন এই আবেদনে হবেনা চৌধুরীবাজার হতে আবার আবেদন করতে হবে। আমি কষ্ট করে আবার আবেদন করি। এবারও তিনি আবেদন পত্রটি ফেলে রাখেন। ফোন করলেই হয়ে যাবে, হয়ে যাবে বলেন কিন্তু পাঠান না।  

একদিন এব্যাপারে ফোন করলে সিরাজুল হক চৌধুরী বললেন আপনারা শুধু নিজের স্বার্থ দেখেন ব্যাংকের স্বার্থ দেখেন না। চৌধুরীবাজার এমনিতেই ছোট্ট শাখা আপনি গাড়িঋণ নিলে এই শাখাটি লসে পড়ে যাবে। তার যুক্তি শোনে হাসলাম এ যে নদীর উজানে থাকা দুষ্ট শেয়ালের ভাটিতে থাকা নিরিহ ছাগলছানা শিকারের যুক্তি। তুমি আমার খাবার পানি ঘোলা করছ, এজন্য তোমাকে ধরব। ছাগলছানা বলল, আপনি উজানে আমি ভাটিরে এটা কেমন করে হয়। এবার শেয়াল বলল, তুমি আমাকে গতবছর গালী দিয়েছো। সাথে সাথে ছাগলছানা বলল, গত বছর আমার জন্মই হয়নি, আমি কেমন করে আপনাকে গালী দেব? এবার শেয়াল বলল, তাহলে তোমার মা আমাকে গত বছর গালী দিয়েছে, বলেই সে ছাগলছানার উপর ঝাপিয়ে পড়ে।

সিরাজুল হক চৌধুরীর যখন আমার গাড়ি ঋণ হেড অফিসে পাঠানোর কোন ইচ্ছে ছিলনা, তাহলে কেন তিনি দুইবার আমার কাছ থেকে কাগজপত্র চেয়ে নেন। আমিতো তার সাথে পূর্বালোচনা ছাড়া আবেদনপত্র পাঠাইনি। তাছাড়া এটি আটকে রাখারও কোন অধিকার তার নেই। আমাকে গাড়িঋণ দেবে কিনা সেই সিন্ধান্ত নেবে হেডঅফিস, এখানে তার কিছু করার নেই।           

অবাক হলাম আমার আত্মীয় এমডি আব্দুল হালিম চৌধুরীকে সিলেটে বিষয়টা অবগত করলেও লোকটা বোবা হয়ে গেল। আমি আর অবাক হলাম, যে ব্যাংক বছরে হাজার কোটি টাকা লাভ করে, বছরে আটদশ কোটি টাকা দান খয়রাত করে, প্রায় চার শত কোটি টাকা আয়কর দেয়, সেই ব্যাংক এই গাড়ি ঋনের মাত্র চৌদ্দলক্ষ টাকা আমাকে দিলে দেউলিয়া হয়ে যাবে। অথচ আমার চোখের সামনে ব্যাংকের অনেক অনেক লোকেরা একবার নয়, এই গাড়ি ঋন দুই/তিন বার করে নিয়ে আহরহ গাড়ি কিনছে।

মনে হল খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ, হেলাল আহমদ চৌধুরী ও আমার চাচাত ভাই ই এ চৌধুরীর অক্লান্ত সাধনায় গড়া এই ব্যাংকে আজ রাজত্ব করছে কিছু ঈর্ষাখোর ছোটলোকের দল। এই গাড়ি ঋণের টাকা দেয় ব্যাংক, আবার মাসিক কিস্তিতে ছয় বছরে পরিশোধও করে ব্যাংক।

আমি যাতে এই সুবিধাটা না পাই তাই এই ঈর্ষাখোর ছোটলোকের দল বোবা ও কালা হয়ে যায়। অথচ তারা ব্যাংকের টাকায় দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়ায়। ব্যাংক হতে পাই পাই করে সব সুযোগ সুবিধা আদায় করে নেয় এবং পায়ের উপর পা তুলে নাসারন্দ্রে সরিষার তেল ঢেলে নাকে ঘত ঘত আওয়াজ তুলে আরামছে ঘুমায়।

আমি জীবনে দুইবার বড় ধরনের সড়ক দুর্ঘটনায় পড়ি। প্রথম দুর্ঘটনার কথা ইতিমধ্যে আমার ১৯৭৬ সালের যষ্ট শ্রেণির বিবরণে দিয়েছি। দ্বিতীয় দুর্ঘটনার কাহিনি এবার লিখব। সেদিন ছিল হরতাল, তাই গাড়ি নিয়ে চৌধুরীবাজার যাইনি। দিনটি ছিল ২৪ নবেম্বর ২০১৫ সাল আমার পিতার উফাত দিবস। আমার প্রতিবেশী একজন লোক মারা গেলে আব্বার কবর জেয়ারত করে  তাকে দেখতে যাই। আব্বাকে স্মরন করে বাড়ির দিঘিঘাটে বসে গরিবদের মধ্যে প্রচুর টাকা বিতরন করি। রাতে অফিস হতে বেরিয়ে আমি ও পিজুস বাবু একটি রিকশায় মোগলাবাজার যাই। সেখানে একটি বেবিট্যাক্সিতে আমরা দুজন উঠি। আমি পিছনের ডান এবং পিজুস বাবু সামনের ডান সিটে ছিলেন। একজন আনাড়ি নতুন চালক খুব দ্রুত ট্যাক্সী চালিয়ে খালেরমুখ বাজারে পৌছে। এবার সে বেশ কয়েকটি ট্যাক্সী ওভারটেক করে সামনে এগুতে থাকে। চোখের পলকে বিপরীত দিক হতে আসা একটি দ্রুতগামী কারের সাথে ধাক্কা খায়। সাথে সাথে আমি কলিমা পড়ি লাইলাহাইল্লালাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ। ট্যাক্সিটি সটকে ডানদিকে শুয়ে পড়ে। আমার বামে বসা দুজন লোক আমাকে নিচে দলে বেরিয়ে আসে, তারপর আমি বের হই। আমি বেশ জখম হলেও নিজের চিন্তা না করে পিজুস বাবুকে বের করে আনার জন্য চিৎকার করি। আমার আশংকা ছিল, নাজানি পিজুস বাবু বেঁচে আছেন কি নেই। কারন সামনের ঐ দিকে সংঘর্ষ হয়। লোকজন ট্যাক্সী উল্টায়ে তাকে যখন বের করল দেখি তিনি পুরোপুরি সুস্থই আছেন। এমনকি তার গায়ে কোন ক্ষতচিহ্ন নেই।

হঠাৎ আমার বুকে একটা চিনচিন ব্যাথা অনুভব করি, ঘুব ঘুম ভাব আমাকে জড়িয়ে ধরে। আমি জানতাম, এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে না থেকে আমার ঘাসে শোয়ে পরা উচিত। রাস্থাপাশের ঘাসে শোয়ামাত্রই আমি ঘুমিয়ে যাই। আমার স্পষ্ট মনে আছে ঘুমের মধ্যে আমি স্বপ্নে দেখি আমার সিলেটের বাসার পালঙ্কে প্রশান্ত মনে রোগশয্যায় ঘুমিয়ে আছি। আমার পুত্র জেফার ও পত্নী ডাঃ নুরজাহানকে কাছে দেখি। তিনি আমার চিকিৎসা ও পরিচর্যা করছেন। এমন মজার স্বপ্নেরাজ্যে বিচরনকালে হঠাৎ লোকজনের হৈচৈ শোনে আমার ঘুম ভাঙল। এবার চেয়ে দেখি সাগরদিঘীপারের বাসার পালঙ্গের নরম বিছানা  নয়, আমি যে শুয়ে আছি সবুজ ঘাসের শক্ত গালিচায়। মানুষ আমার মাথায় পানি ঢালছে, চোখমুখে জলের ছিটা দিচ্ছে। পিজুসবাবু ও লোকজন আমাকে পাশের ফার্মেসিতে নিয়ে যান। এই ফার্মেসিকে আমি কিছুদিন আগে একটি এসএমই ঋন প্রদান করি। তরুণ ফার্মেসি মালিক আমাকে বেডে শোয়ায়ে জখমের স্থানগুলো সযতনে পরিস্কার করে ব্যান্ডেজ করে দেন। বেশ কিছু ঔষধ দেন যার মূল্য তিনি নেন নি। আমি তার কাছে শত কৃতঞ্জ।

ইতিমধ্যে লোকজন এই আসামি বেবীট্যক্সি চালককে আমার কাছে ধরে নিয়ে আসেন। সে আমার কাছে নতজানু হয়ে পা ছুয়ে ক্ষমা চাইল এবং আমার চিকিৎসার খরচ দিতে চাইল। আমি তাকে ক্ষমা করে উপদেশ দিলাম, গাড়ি চালানো কোন ছেলেখেলা নয়, এক্ষেত্রে সামান্য ভুল হলে মানুষের জীবন এমনকি নিজের প্রানটাকেও অকালে হারাতে হবে। আমি সর্বদা ধীরে সুস্থে সাবধানে বেবী চালাতে তাকে বলি যাতে এধরনের দুর্ঘটনা আর না ঘটে।

এবার একটি ট্যাক্সি চড়ে আমি ও পিজুস বাবু সিলেটে বাসায় ফিরে আসি। রাতে শরীরে ভীষন ব্যথা অনুভব করি। কয়েকদিন বাসার বেডে ছিলাম। আমার পত্নী ডাঃ নুরজাহান এমন আচরণ করলেন যা আমি বেহুশ অবস্থায় স্বপ্নের ঘুরে দেখেছিলাম। কিছুদিনের মধ্যে সুস্থ্য হয়ে আবার অফিসে যোগ দেই।

২০১৫ সালের সুদীর্ঘ্য হরতাল কিছূটা ডিলে হয়ে আসলে একদিন চৌধুরীবাজার শাখার নবসজ্জাকরণের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হয়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত হন ব্যাংকের চেয়ারম্যান হাফিজ আহমদ মজুমদার, ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল হালিম চৌধুরী, পরিচালক মনির আহমদ, সাবেক ব্যাংক চেয়ারম্যান ই এ চৌধুরীর শ্যালক পরিচালক মনজুর রহমান, অধ্যাপক ডাঃ নিয়াজ আহমদ চৌধুরী, দক্ষিণসুরমা উপজেলা চেয়ারম্যান আবু জাহিদ, দাউদপুর ইউপি চেয়ারম্যান আলম আহমদ প্রমুখ। ব্যাংকের সামনে সামিয়ানা টাঙ্গিয়ে অনুষ্ঠান করা হয়। শাখার সাবেক ব্যবস্থাপক আব্দুল জব্বার আমাকে এসব কাজে খুব সহায়তা করেন। সিলেটের মহাব্যবস্থাপক আবু হাবিব খায়রুল কবির ও আমার বস সিরাজুল হক চৌধুরী ভিআইপিগণকে আমার সাথে এখানে বরণ করেন। অনুষ্ঠানের কর্মসূচি তৈরী করেন অঞ্চল প্রধান সিরাজুল হক চৌধুরী এবং উপস্থাপনা করেন ব্যাংকের প্রিন্সিপাল অফিসার জাকিয়া আক্তার। সিলেট হতে আসেন উপমহাব্যবস্থাপক আহমদ এনায়েত মনজুর এবং উপমহাব্যবস্থাপক মশিউর রহমান খান। যাকে দিয়ে শাখা চলবে, সেই শাখা ব্যবস্থাপকের কোন স্বাগত বক্তব্য সিলেটে প্রস্তুত করা এই সিডিউলে রাখা হয়নি। তাই এই অনুষ্ঠানে আমি ছিলাম কেবল একজন নীরব দর্শক।   

সেদিন মাছ মাংস সবজি ডাল দৈ পানীয়সহ অনেক পদের প্রচুর খাবার শহরের ভাল হোটেল হতে নিয়ে আসা হয়। মেহমান ও আমরা ব্যাংকের লোকজন ভিতরে ডাইনিং সাজিয়ে ভোজনে অংশ নেই। প্রচুর প্যাকেট খাবার বিতরণ করে মেহমানগণ মনির আহমদ একাডেমি ছুটে যান। ছাত্ররা সুদীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে মেহমানগণকে স্বাগত জানায়। সিলেট ফেরার পথে সবাই ডাঃ নিয়াজ আহমদ চৌধুরীর উদ্যোগে স্থাপিত জাপান বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ স্কুল ঘুরে দেখে যান।

একদিন আঞ্চলিক অফিস সিলেট ইস্ট হতে ফোন পেলাম পাঁচ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হবে। কিসের চাঁদা প্রশ্ন করে জানলাম সিলেট ইস্টের ঈদ পুনর্মিলনী হবে। আমাকে গাড়ি ঋণ দিলে যে শাখা লসে পড়ে যাবে সেই ছোট্ট শাখার জন্য পাঁচ হাজার টাকা বেশ বড় চাঁদা বলতেই আঞ্চলিক অফিসের নওশাদ আক্তার বললেন শহরের শাখাগুলো আর বেশি দিচ্ছে, তাদের অঙ্ক দশ হাজার টাকা। বসের প্রমোশন হয়নি বিগত তিনবার, উপমহাব্যবস্থাপক পদে আটকে আছেন বেশ ক’বছর। আমার বুঝতে অসুবিধে হলনা এটি আমার বসের এমডি আব্দুল হালিম চৌধুরীকে হাতকরার একটি সুন্দর কৌশল। এবার ইলিশের তৈলে তিনি ইলিশ মাছ ভাজবেন। আমাদের চাঁদার টাকায় সামনের পুলসেরাতের পুল তিনি পার হবেন। তৈলটা এমন কৌশলে দিতে হবে যাতে গ্রহীতা তৈলমর্দন  টাহর না পান, আবার উদ্দেশ্যও হাসিল হয়। আমি সপরিবারে যাবার দাওয়াত পেলাম। চাঁদা পাঠিয়ে দেওয়ার পর জানলাম অনুষ্টান হবে আলীবাহার চাবাগানের বাংলোয়, এমডি আব্দুল হালিম চৌধুরী সস্ত্রীক শুভাগমন করে সারাদিন উপস্থিত থেকে অনুষ্ঠানকে আলোকিত করবেন। বললাম তদস্তু, আমার ভাবনাই সত্য।

দিনটি শনিবার, আমার সিডিউলে সেদিন ছিল অনেক জরুরি কাজ। আমার অফিসের সব লোকজনকে সময়মত পাঠিয়ে একটুপরে আমার লালকার চালিয়ে আলীবাহার চাবাগানের বাংলোয় পৌছলাম। এই কিছুদিন আগে এই বাংলোয় আমার বেগম সাহেবার সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজের সহপাঠিরা সপরিবারে পুনর্মিলনী অনুষ্টান করেন। চাগাছ ঘেরা টিলার উপর সুন্দর বাংলো, পার্কিং, অনুষ্টান মঞ্চ ও ছাতাঢাকা প্রাঙ্গণ। নিচে চা-কারখানা, একটু দূরে বিশাল কাজলদিঘী। আমার পত্নী ব্যস্ত চিকিৎসক তাই দুপুরের খাবারের সময় গাড়ি চালিয়ে এসে তাকে নিয়ে যাই। এমডি পত্নী রিপা আমার ভাতিজী। দুপুরের খাবারের মুহুর্তে আমি সস্ত্রীক এমডির সাথে বাংলোয় ঢুকতে গেলে বস সিরাজ সাহেব বললেন, ডিজিএম ছাড়া প্রবেশ করা যাবেনা। পাশে থাকা আমার পত্নী তা শোনে মাইন্ড করলেন। আমিও মাইন্ড করলাম, এজিএম হলেও সিলেট ইস্ট জোনের আমি সর্বোচ্চ পদবীধারী। তাছাড়া আব্দুল হালিম চৌধুরী আমার আত্মীয়। কাজেই আমাকে দরজায় আটকানো মানে চরম অপমান করা। আমি এবং আমার পত্নী ডাঃ নুরজাহান বেগম চৌধুরী বাহিরের রোদে বসে সবার সাথে দুপুরের খাবার গিলে সেদিন মানসম্মান নিয়ে পলায়ন করি। বিকেলে এখানে দড়ি টানাটানি, হাড়িভাঙ্গা, কানামাছি, চেয়ারে দ্রুতবসা, লাফ ঝাফ ইত্যাদি খেলা হয়। প্রধান অতিথি মহামান্য এমডি আব্দুল হালিম চৌধুরী ও তার বেগম রহিমা চৌধুরী রিপা এসব লম্ফঝম্ফ বড় বড় চেয়ারে বসে উপভোগ করেন।  

সেদিন খেলাধুলায় চৌধুরীবাজার শাখার লোকজন প্রচুর পুরস্কার পান। পুরস্কার গ্রহনের জন্য লাউড স্পিকারে আমাকে ডাকা হলেও খোঁজে পাওয়া গেলনা। কেউ জানে না, আমি যে আত্মসম্মান নিয়ে নিরুদ্দেশ। পরদিন অফিসে ঢুকার পর শাহানা আমার সামনে এনে বেশ কিছু মগ, বাটি, কাপ, প্লেট, জগ ইত্যাদি রাখেন। এসব গতকালের খেলার পুরস্কার, আমি এসব পুরস্কার খেলায় অংশগ্রহণকারীগণকে বিতরন করে দিলাম।

একদিন শুনি আমার বস সিরাজুল হক চৌধুরী আমাদের মহামান্য এমডি আব্দুল হালিম চৌধুরীকে সিলেট স্টেশন ক্লাবে এনে কৃতি সম্বর্ধনা দিচ্ছেন। অনেকে দাওয়াত পান, তবে আমি পাইনি। শুনলাম সিলেটের অকৃত্রিম দরদি এমডি মহোদয়কে তার সীমাহীন ত্যাগ-তিতিক্ষা ও অবদানের জন্য পুষ্পমাল্যের সাথে ক্রেস্ট ও সনদপত্র দেওয়ার ব্যবস্থা করেন সিলেট স্টেশন ক্লাব সদস্য পূবালী ব্যাংক সিলেটের পূর্বাঞ্চল প্রধান সিরাজুল হক চৌধুরী। সিলেট স্টেশন ক্লাব এমন একজন মহামানবকে সিলেটের কৃতিসন্থান সম্মাননা দিল যিনি এত ক্ষমতাবান হয়েও একটি নজির দেখাতে পারবেন না যে তিনি সিলেটের কোন একজন লোককে একটি সামান্য ঝাড়ুদার কিংবা পিয়নের চাকুরী জোগাড় করে দিয়েছেন কিংবা সিলেটের কোন লোকের কোন উপকার করেছেন।

আমার কেন যেন মনে হল এবার বড়হুজুরের দিলের মসুদ পুর্ন হবে অবশ্যই। সাবেক এমডি হেলাল আহমদ চৌধুরী ছিলেন মহাজ্ঞানী বিচক্ষন লোক। তিনি মানুষ চিনতে ভূল করতেন না। তিনি বুঝতেন কাকে দিয়ে ব্যাংকের কি কাজ হবে। আব্দুল হালিম চৌধুরীর জ্ঞান সীমিত, মানুষ চেনার ক্ষমতা তার নেই। তার নিজের চোখে কোন জ্যোতি নেই। তিনি মানুষ বিচার করেন তাকে বৃত্তকরে ঘিরে থাকা স্বার্থবাজ দুধের মাছিদের চোখে দেখে ও ওদের কন্ঠে শোনে।

এই নতুন এমডি আব্দুল হালিম চৌধুরী আসা মাত্রই সিরাজ সাহেব দাও মারলেন। সুদীর্ঘ্য নয়-দশ বছর পর হন মহাব্যবস্থাপক। সেই সাথে হয়ে যান পুবালী ব্যাংকের সিলেট বিভাগীয় প্রধান।

সে বছর মাত্র পাঁচজন লোক পদোন্নতি পেয়ে মহাব্যবস্থাপক হন। আমার প্রতিবেশী ব্যাংক পরিচালক মনির আহমদ একদিন আমাকে বললেন, আমরা চৌচল্লিশ জনের তালিকার তেতাল্লিশ নম্বর হতে তুলে এনে সিরাজ সাহেবকে পাঁচ নম্বরে ফেলে মহাব্যবস্থাপক করেছি। আমি বললাম, বেশ করেছেন একজন সিলেটি লোককে সাহায্য করেছেন এবং সিরিয়ালে পাচ নম্বরে থাকা হতভাগ্য লোকটিকে আপনারা হরি, হরি, হরিব্বল মন্ত্র পড়ে বলী দিলেন। সিরাজুল হক চৌধুরী, সামান্য ডিগ্রী সার্টিফিকেট নিয়ে ব্যাংকে এসে বাঘা বাঘা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রী ও ব্যাংকিং ডিপ্লোমাধারীদেরকে কনুইয়ের গুতোয় নিচে ফেলে সেরা পাঁচে ঢূকে যান। তৈলের যে কি মহাশক্তি, এক তেলে চাকা ঘুরে অন্য তেলে মনও ঘুরে।   

চৌধুরীবাজার শাখা হতে আমি বিদায় হবার কিছুদিন আগে সিরাজুল হক চৌধুরী মহাব্যবস্থাপক হয়ে সিলেট প্রিন্সিপাল অফিসে বদলী হন। নতুন পূর্বাঞ্চল প্রধান হন উপমহাব্যবস্থাপক আহমদ এনায়েত মঞ্জুর। তিনি অসাধারন বাগ্মী, বুদ্ধিমান এবং কুটকৌশলী ব্যক্তিত্ব। মৌলভীবাজারের উচ্চ বংশজাত এই ভদ্রলোকের জাতীয় নেতৃত্ব দেবার মত পর্যাপ্ত গুনাবলী রয়েছে। তিনি ও আমি একই সময়ে ব্যাংকে যোগদান করি। আমরা ব্যাংকে যোগদানকালে দুইটি বঞ্চনার শিকার হই। আমাদেরকে ঘোষিত পদে নিয়োগ না দিয়ে একপদ নিচে নিয়োগপত্র দেয়া হয় ও আমাদের শিক্ষানবীশকাল এক বছরের স্থলে দুই বছর করে দেওয়া হয়। নতুন বস আহমদ এনায়েত মনজুর একদিন আমার শাখা পরিদর্শনে গেলে তাকে তিনকোটি টাকার এফডিয়ার দেখিয়ে বলি আমার গাড়ি ঋনের প্রস্তাব সিরাজ সাহেব মাটিচাপা দিলে কি হবে, আল্লাহ আমাকে যে পরিমান নগদ অর্থদান করেছেন তা দিয়ে পচিশ ত্রিশটি গাড়ি কেনার সামর্থ আমার রয়েছে।

চৌধুরীবাজার শাখায় এসে আমি শাখার জন্য একটি ব্যবসা পরিকল্পনা করি। কিস্তি বড় হওয়ায় এখানকার কাস্টমাররা ঋন ফিরিয়ে দিতে হাবুতাবু খাচ্ছে। আমি ঋন বিতরন করতে গিয়ে রাখালগঞ্জ, লক্ষিপাশা, মোগলাবাজার, খালেরমুখ, হাজিগঞ্জ, হিলাইগঞ্জ ইত্যাদি বাজার প্রদক্ষিণ করি। কয়েকটি সমিল, রাইসমিল, কাট কারখানা এবং বিস্কুট কারখানা পর্যবেক্ষন করি। বেশ কিছু পল্লীগ্রামে গিয়ে গড়ে উঠা মৎস্যখামার, দুগ্ধখামার, পল্ট্রিফার্ম ইত্যাদি দেখে আমার মন আনন্দে ভরে যায়।

এখানে ইতিমধ্যে বিতরণ করা দশ লক্ষ টাকার অধিক বড় ঋণের কিস্তি আদায় হচ্ছেনা। আমি এখানে ছোট ছোট কিস্তি ঋণ বিতরণের সিন্ধান্ত নেই। আমার সোয়াবছর সময়ে তিন হতে সাত লক্ষ টাকার শতাধিক ছোট ছোট এসএমই এবং কঞ্জুমার ঋণ বিতরণ করি। যে ঋণগুলোর আদায় ছিল নিয়মিত ও সন্তোষজনক।

এলাকার মানুষের শহরের ব্যাংকে রাখা টাকা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেই, ফলে ১৪ মাসে ডিপোজিট ২২.৭৩ কোটি হতে প্রায় ৯.০০ কোটি বৃদ্ধি পেয়ে ৩১.৫৩ কোটিতে উন্নীত হয়। মাসে গড় প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় ৬৫ লক্ষ টাকা। আমি এখান থেকে চলে যাবার দুই বছর পর শাখার ঋণ কর্মকর্তা আদনান কুরেশীকে ফোন করে আমার বিতরণ করা ঋণসমূহের খোজ খবর নেই। চৌধুরীবাজার শাখার ডিপোজিট কত জানতে চাইলে সে বলল, স্যার আপনি চলে যাবার পর ডিপোজিট দ্রুত নেমে যায়, বর্তমান ডিপোজিট প্রায় ৩০.০০ কোটি। এই দুই বছরে ডিপোজিট বাড়েনি, উলটো কমে গেছে। আদনান কুরেশীর কাছে এখবর শুনে খুশী হই যে আমার বিতরণ করা কোন ঋণই এখন আর চৌধুরীবাজার শাখায় অনাদায়ী কিংবা খেলাফি নেই। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন