সপরিবারে নেপাল সফর- কাটমন্ডু, পুখারা, নগরকোট, এভারেস্টশৃঙ্গ দর্শন ও আকাশে প্যরাস্যুট গ্রাইডিং
সফরকালঃ ৩রা মে হতে ১০ম মে ২০১৪ সাল।
নেপাল একটি ছোট্ট অপরূপ সুন্দর
দেশ। বাংলাদেশের সমান আকারের দেশটির আয়তন ৫৬,৮২৭ বর্গমাইল। দেশটি পূর্ব-পশ্চিমে
দৈর্ঘ্যে ৫০০ মাইল এবং উত্তর-দক্ষিণে প্রস্থে গড়ে ১২০ মাইল। নেপালের পূর্ব, পশ্চিম
ও দক্ষিণে আবর্তন করে আছে ভারত এবং উত্তর দিকে চীনের তিব্বতের দুর্গম পাহাড়ি
অঞ্চল। বেশ কয়েকটি কারণে দেশটির বিশ্বব্যাপী পরিচিতি রয়েছে। প্রথমতঃ দেশটিতে রয়েছে
পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতমালা হিমালয় এবং সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্ট। দ্বিতীয়তঃ
প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে এই দেশটিতে একজন ধর্ম প্রচারকের আবির্ভাব হয়। হজরত
ঈসা(আঃ) এবং আমাদের নবী হজরত মোহাম্মদের(সঃ) পর পৃথিবীতে যার সর্বাধিক অনুসারি
রয়েছেন। সার্কভূক্ত দেশ ভূটান, শ্রীলংকা ছাড়াও আমাদের পার্শ্ববর্তী মিয়ানমার হতে
শুরু করে জাপান পর্যন্ত বিশাল এক অঞ্চলের বিশাল জনগোষ্টির ধর্মীয় বিশ্বাস ও
সংস্কৃতি যে মানুষটিকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হচ্ছে সেই গৌতম বুদ্ধ ছিলেন বর্তমান
নেপালের লুম্বিনি এলাকার সুপ্রাচীন রাজ্য কপিলাবস্তুর রাজা শুদ্ধধন ও রানী
মায়াদেবীর সন্থান। শৈশব হতে তার বৈরাগ্যভাব উপলব্ধি করে পিতা রাজা শুদ্ধধন তাকে
সংসারে আবদ্ধ করার জন্য যশোদা নামের একজন অনিন্দ্যসুন্দরীর সহিত বিবাহ দেন কিন্তু
তিনি রাজ্য সংসার ত্যাগ করে মানুষের মুক্তির সন্ধানে বেরিয়ে যান ও দীর্ঘ্যকাল
ধ্যানমগ্ন হন। ভারতের মহান সম্রাট অশোক তার ধর্ম গ্রহন ও প্রচার করেন। গৌতমের ধর্ম
বিশ্বব্যাপী প্রচারিত হয়। বিশ্বে তার এত মূর্তি ও ভাস্কর্য্য রয়েছে, যা কারো নেই। আমাদের ইসলাম ধর্ম দুনিয়ায় আসার
প্রায় হাজার বছর আগে এই বৌদ্ধ ধর্ম পৃথিবীতে প্রচার ও প্রসার হয়।
আমি অষ্টম শ্রেণির ছাত্র
থাকাকালে আমাদের পাঠ্যসুচীতে একটি প্রবন্ধ ছিল ‘এভারেস্ট বিজয়’। মাউন্ট এভারেস্টের
উচ্চতা ২৯০৩৫ ফুট, যা প্রায় সাড়ে পাঁচ মাইল। এই এভারেস্টে আরোহন করতে গিয়ে বিভিন্নকালে
অসংখ্য মানুষ বৈরি আবহাওয়ায় বরফে প্রাণ হারান। প্রাচীন নেপালিরা মনে করত এইসব
অগম্য বিপদসঙ্কুল পর্বতমালায় দৈত্যদানব ও দেবতারা বসবাস করেন। হিমাঙ্কের নীচে
তাপমাত্রা বিশিষ্ট বায়ুচাপহীন বা অক্সিজেন শূন্য বরফ মেঘ ও তুষারঝড় কবলিত এইসব
পর্বতমালার একটি নিদৃষ্ট উচ্চতার পর প্রাচীন নেপালিরা আর উপরে উঠার চেষ্টা করত না।
দৈত-দানব ও দেবতাদের সেই উপরের রাজ্যে যেতে তারা ভয় পেত।
আমি অষ্টম শ্রেণিতে অধ্যয়নকালে
জানতে পারি নেপালের শেরপা উপজাতির লোক তেনজিং নরগে ও নিউজিল্যান্ডের অধিবাসী
এডমন্ড হিলারি ১৯৫৩ সালের ২৯ মে সর্বপ্রথম এই দুর্জয় মাউন্ট এভারেস্টে আরোহন করেন।
সেই অধ্যয়ন আমার মনে এভারেস্ট শৃঙ্গ ও হিমালয় পর্বতমালা স্বচক্ষে দেখার ইচ্ছে
জাগ্রত করে।
আমি, পুত্র জেফার, পত্নী নুরজাহান
বেগম চৌধুরী এবং ওয়ালী সিটি হাউজিং চেয়ারম্যান ভাগনা জিন্নুন বখত চৌধুরী মাউন্ট
এভারেস্টের উপরে উঠে বিশ্বস্রষ্টা আল্লাহর এই অপরূপ সৃষ্টিকে পর্যবেক্ষণ ও
পরিদর্শন করি। অত্যন্ত বৈচিত্রে ভরা দেশ নেপাল। আমি যখন পার্বত্য চট্টগ্রাম ভ্রমণ
করি মনে হয়েছিল আমাদের সিলেটের টিলাগুলো যেন মাটির ঢিবি। পরে যখন মেঘালয় পর্বতে
যাই মনে হল পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়গুলো কিছুই না। পরে যখন মালয়েশিয়ার
গ্যান্টিং হাইল্যান্ডে উঠি মনে হল এটা বুঝি আর কয়েক ধাপ উপরে। মক্কার আইনুল হিজরায়
হজরত মোহাম্মদ(সঃ) মদীনায় হিজরতকালে যে গোহায় আশ্রয় গ্রহন করেন, দু’ঘন্টা পাহাড়
বেয়ে সেখানে উঠে নিচে মানুষের সারিকে মনে হচ্ছিলো ধাবমান পিপিলিকার সারি। কিন্তু
আমার দেখা সব উচ্চতাকে অতিক্রম করে যাবে নেপালের অনন্যসাধারন পর্বতগুলোর উচ্চতা ও
বিশালতা। হালকা সবুজে ডাকা পাহাড়ের ধাপে ধাপে সাজানো গ্রাম, কৃষিক্ষেত ও নরনারীর
সম্মিলিত জীবন সংগ্রাম বিদেশীদের চোখে এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের আবতারনা করে। আমি
নেপাল ও নেপালের মানুষকে অন্তদৃষ্টি দিয়ে উপলব্ধি করার চেষ্টা করেছি। আমার এরচনায়
আমার দৃষ্টিভঙ্গিতে নেপাল, নেপালের মানুষ এবং তাদের কৃষ্টি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে তুলে
ধরার চেষ্টা করব।
৩রা মে ২০১৪ সাল। গ্রীনলাইনের
বাসে ঢাকা যাই। ধানমন্ডি লেকপারে সম্মন্দি আজিজ আহমদ চৌধুরীর ফ্ল্যাটে উঠি। ৫ মে
২০১৪, সোমবার, সকাল ১১টায় বিমান বাংলাদেশ এয়ারওয়েজের বিমানটি ঢাকা শাহজালাল
আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ছাড়ে এবং ১ঘন্টা ১০মিনিট পর কাটমন্ডু ত্রিভূবন আন্তর্জাতিক
বিমানবন্দরে অবতরন করে। আমাদের ভিসা ছিলনা, বিমানবন্দরে তাদের ইমিগ্রেশন সহজেই
এন্ট্রি দিয়ে দেয়। বিমানবন্দরের বাহিরে এসে আমাদের ভ্রমণ প্রতিনিধি অনিল আগরওয়ালকে
আমাদের নাম লিখা একটি সাইনবোর্ড হাতে দেখতে পাই। তিনি একটি দামি এসি মাক্রোবাসে
করে আমাদেরকে শহরের দিকে নিয়ে যান। উঁচুনিচু রাস্থা দিয়ে গাড়ি অগ্রসর হয়। এই শহরটি
নেপালের রাজধানী কাটমন্ডু। হাজার বছরেরও পুরানো শহর, রাস্থাগুলো ছোট, আমদের সড়কের
মত একটু ভাঙ্গাচুরা, কিছুটা অপরিচ্ছন্ন। গাড়ির চাকার ঘর্ষনে ধুলাবালি বাতাসে উড়ছে,
ট্রাফিক পুলিশ মুখে পলিঊশন মাস্ক ব্যবহার করছে। আগরওয়াল আমাদেরকে একটি তিন তারকা
হোটেলে নিয়ে যান। সুন্দর পরিপাঠি এই আবাসের নাম ‘হোটেল গেনজং’। হোটেলের বয়েরা
আমাদের ব্যাগগুলো স্যুটে পৌছে দেয়। দুইটি বড় রূম, উন্নত বাথরুম, এসি ও গরম-ঠান্ডা
পানির লাইন রয়েছে। আভ্যন্তরিণ একটি ছোট্ট দরজা দিয়ে রূমদুটি সংযুক্ত করা যেন
দুইরূম দুই বাথের এটি একটি স্যুট। গেনজং হোটেলের এই জায়গাটির নাম নাজিমপথ।
আমরা জোহরের দুরাকাত কসর নামাজ
পড়ে খেতে বের হই। এখানে বাংলাদেশী খাবার নেই। কিছুদূর হেঁটে আমরা থেইম
রেস্টুরেন্টে ডুকে ভেজ খাবার খাই। নেপালের সর্বত্র খাবারের অর্ডার দেবার পর তারা
রান্না করে পরিবেশন করে। ফলে ক্ষিধা পাবার একটু আগে রেস্টুরেন্টে যেতে হয়।
ডিমভাতের সাথে ডাল। এই ডাল ঝাঁঝালো গন্ধযুক্ত মসলা দিয়ে রান্না করা ও খানিকটা
লবনাক্ত, খুব একটা ভাল লাগেনি। সাথে আসে নেপালী সালাদ। নেপালে মাছ নেই, আবার
ধর্মের বিধিনিষেদের বেড়াজালে মোরগও বাতিল। বৌদ্ধের শিক্ষার কারণে প্রাণি হত্যা
মহাপাপ, তাই নেপালিরা ডিম খেলেও মোরগ খায়না। দুধ খেলেও গরু ছাগলের মাংস খুব একটা
ভক্ষণ করেনা। নেপালিরা মূলতঃ নিরামিষভোজী জাতি। তারা ডাল ও ডিম খেয়ে প্রুটিনের
অভাব পূরণ করে নেয়। বিকেলে শহরে হাঁটতে বের হই, নিউরোডে হাটাহাটি করি। শহরের
সুপ্রসিদ্ধ কাটমন্ডুমল পরিদর্শন করি। এখানে বসে নেপালি আইসক্রীমের স্বাদ নেই।
কাটমন্ডুর একটি প্রসিদ্ধ ব্যবসাকেন্দ্র তামেল ঘুরে দেখি। সার্ক সচিবালয়ও দেখা হয়।
আমাদের ঘুরে দেখা কাটমন্ডু
মহানগর এক পাহাড় পরিবেষ্টিত সমতল উপত্যকা। এই শহরটি ঢাকার পাঁচভাগের একভাগও হবে
কিনা সন্দেহ এবং লোকসংখ্যা নাকি মাত্র বার লক্ষ। বাসাবাড়ি প্রশস্থ ও বেশ জায়গা
নিয়ে গঠিত। অধিকাংশ বাড়ি তিনচার তলা এবং আস্তরহীন অনেক ভবন রয়েছে। এখানকার
রাস্থাগুলো ঢাকার সড়কের চেয়ে ছোট ছোট। বিশাল খোলা মাঠে একদিকে সেনাবাহিনী প্যারেড
করছে, আরেকপ্রান্তে বালকেরা খেলছে। সেই একই মাঠে লোকজন জগিং ও ব্যায়াম করছে।
নগরকোট যাত্রাকালে কাটমন্ডুর উপকন্ঠে একটি চারলেনের বড় রাস্থা পেয়েছি, তাও আবার
জাপানের অর্থসাহার্য্যে নির্মিত। আসলে কাটমন্ডু আমাদের চট্টগ্রামের মতই একটি শহর
হবে কিনা সন্দেহ। এখানে ঢাকা-চট্টগ্রাম-সিলেটের মত ১৩/১৪ তলা ভবন তেমন নেই।
ত্রিভূবন আন্তর্জাতিক
বিমানবন্দরটি একটি সুউচ্চ পাহাড়ি উপত্যকায় অবস্থিত। এই বিমানবন্দর ঢাকার তুলনায়
অনেক ছোট ও অনুন্নত। এমন কি সিলেট বিমানবন্দরকে আমার চোখে এরচেয়ে উন্নত মনে হয়েছে।
এবার বলব কিভাবে আমরা মাউন্ট
এভারেস্ট জয় করি, সোজা কথায় এভারেস্টের উপরে যাই। পরদিন ভোরে মাউন্ট এভারেস্ট খুব
কাছ হতে দেখার জন্য জনপ্রতি ১৫০ মার্কিন ডলার করে Simrik Airlines Pvt, limited এর চারটি টিকেট সংগ্রহ করি। পরদিন ৬ মে ভোর ৫টায় উঠে হোটেলের লবীতে যাই।
হোটেলে ব্রেকফাস্ট ফ্রি। কিন্তু এত সকালে রেডি হয়নি। সকাল ১০টার মধ্যে ফিরে এসে
নাস্তা করা যাবে, তাই নাস্তার অপেক্ষা না করে দ্রুত রাস্থায় নেমে একটি ছোট্ট কার
ভাড়া করে বিমানবন্দরের ডমেস্টিক কাউন্টারে ডুকি। টিনের ছাদে ও বাহিরে অসংখ্য বানর
লাফালাফি করছিল। কিছু শীত শীত লাগছিল। নেপালে ডুকেই বাংলাদেশের তীব্র গরম হতে
মুক্তি পাই। ঐদিন কাটমন্ডুর তাপমাত্রা ছিল ১৯ ডিগ্রী সেলসিয়াস। হিমালয়ের দিকে একে
একে কয়েকটি ছোট ছোট আকাশযান উড়ে গেল। ভোর সাড়ে ৬টার সময় আমাদের প্লেনে ঊঠার ডাক
আসে। তখনও আকাশে সুর্য মুখ মেলেনি। মাত্র ১৬ সিটের ছোট্ট উড়ালযান। দুইজন পাইলট ও
একজন সুন্দরী এয়ার হোস্টেস। যাত্রি মোঠ ১৬ জন। সবমিলে ১৯ জন লোক। উড়োজাহাজের
প্রতিসিটের পাশে জানালা। ডানে একসিট বামে একসিট, মাঝ বরাবর রাস্থা। একটা বড়
কালবার্টের গোলাকার চুঙ্গার ভিতর ডুকে যেন একটা সিটে বসে পরা। ৬টা ৪৫ মিনিটে
বিমানটি উড়াল দিল, তখনও চারপাশ মৃদু অন্ধকার। দশ মিলিট পরই নিচে দেখা গেল বরফ ডাকা
হিমালয় পর্বতমালা। নিচুদিয়ে উড়ছে ছোট্ট বিমানটি। নিচে ঘন কুয়াশা আর মেঘ, মেঘের ঘা
ঘেষে বিশাল বরফের পাহাড় যেন ভেসে আছে। সেসব পাহাড়ে পাহাড়ে দেখা যাচ্ছে একটার পর
একটা সুউচ্চ শৃঙ্গ হাকরে আকাশের পানে তাকিয়ে আছে। এভারেস্টের মত এত উঁচু না হলেও
২০০০০ফুট ও তদুর্ধ উচ্চতার অনেক শৃঙ্গ দেখা যাচ্ছে। ইতিপূর্বে আমাদেরকে একটি ম্যাপ
দেয়া হয়েছিল। ম্যাপের সহিত মিলায়ে পাহাড় শৃঙ্গ দেখা সম্ভব নয় দেখে কেবল জানালার
পানে তাকিয়ে রই। আল্লাহর এক মহান সৃষ্টি হিমালয়। সিমরিকের দেয়া সুমিষ্ট চকলেট চুষে
চুষে অপূর্ব সুন্দর হিমালয় পর্বতমালা দেখে নেই। ভোরের সুর্যকিরন বরফে পড়ে আলোর
জ্যোতি বিচ্ছুরিত হচ্ছিল, যেন অজস্র চাঁদ ঝিলমিল করছে। লালড্রেসে সুসজ্জিত
এয়ারহোস্টেস একজন একজন করে আমাদেরকে দুই পাইলটের মধ্যে নিয়ে যায় ও তিনটি শৃঙ্গের
মাঝখানে একটু এভারেস্ট শৃঙ্গ দেখায়। সেদিন মুগ্ধ হয়ে দেখি স্রষ্টার অপরূপ
সৃষ্টিকে। মহান আল্লাহকে অজস্র ধন্যবাদ জানাই আমার মত একজন অতি সাধারন মানুষকে এত
কাছ হতে তার অপূর্ব সুন্দর সৃষ্টি মাউন্ট এভারেস্ট প্রদর্শন করার জন্য। আমি বেয়ে
বেয়ে এভারেস্টে উঠিনি অথচ সামনে একটু নিচে অজেয় এভারেস্ট, যেন হাত বাড়ালেই ছুঁয়ে
ফেলবো তাকে। না তা কোনমতে সম্ভব নয় কারন বিমানের রিডারে তখন বাহিরের তাপমাত্রা
মাইনাস (-) ৩০ ডিগ্রী হতে মাইনাস (-)৩৫ ডিগ্রী উঠানামা করছে। একটানা প্রায় ৪০মিনিট
হিমালয় পর্বতমালা দেখা হল। ইতিমধ্যে লক্ষ করি বিমানটি বরফের পাহাড় হতে বেরিয়ে
এসেছে। এয়ার হোস্টেস আমাদেরকে কাছ থেকে হিমালয় দেখার একটি সুন্দর সনদপত্র প্রদান
করেন। নাম, সনদ ও তারিখ সহ সনদপত্রটি প্রদান করেন Simrik Airlines Pvt,
limited । ছোট্ট উড়ালযানটি কাটমন্ডু শহরের উপরে চলে আসে। বিমানবন্দর
টি পাহাড়ের উপর উচ্চভূমিতে হওয়ায় বিমানটিকে নিচে নামতে হয়নি। বরং দেখলাম উপরের
দিকে উঠে বিমানবন্দরের রানওয়েতে অবতরন করছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি তখন সকাল ৭টা
৩০মিনিট। বের হয়েই কারে দ্রুত Hotel ganjong এর ডাইনিং হলে
চলে যাই। হোটেলে প্রচুর মজাদার খাবার। ব্রেকফাস্ট ফ্রি পরিবেশন করা হয়। দুপুরে ও
রাতে নিজেদের খরচে খেতে হয়। বাহিরে ভাল খাবার পাওয়া যায়না, আবার আমাদের তিন তারকা
হোটেলে আকাশচুম্বি দাম। ব্রেকফাস্টের খাদ্য সমাবেশে রয়েছে একদিকে চাপাতি, ডাল,
সবজি ও ডিম। অন্যপ্রান্তে দুধ, কুকারিজ ও কনফ্লেক্স। আরেক টেবিলে টুস্ট, মাখন ও
জেলী। আরেক দিকে আলাদাভাবে কমলা, পাইন আপেল ও আমের জুস। একপ্রান্তে চা ও কফি। অন্য
আরেক জায়গায় শুকরের মাংস ও মদ। আমরা ইচ্ছেমত খাবার খাই। তারপর বাথরুমে ঢুকে স্নান
করি।
সকাল ১০ টায় অনিল আগরওয়াল
আমাদেরকে কাটমন্ডু সাইট সিয়িং করাতে একটি দামি এসি মাইক্রোবাস পাঠান। মাইক্রোবাসটি
ডানে বামে ঘুরপাক খেতে খেতে আমাদেরকে এক সুউচ্চ পাহাড়ের উপর শম্ভুনাথ বৌদ্ধমন্দিরে
নিয়ে যায়। ৫০ নেপালি রুপি টিকেট কেটে অসংখ্য সিড়ি বেয়ে বেয়ে মন্দিরে প্রবেশ করি।
সারাটা পাহাড় জুড়ে অসংখ্য বানর লাফালাফি করছে। একটি বানর মাতৃস্নেহে মৃত শিশুকে বুকে
জড়িয়ে রেখেছে। সামনে লোকে মানত করে বৌদ্ধমূর্তির সামনে আধুলী নিক্ষেপ করছে। আধুলী নিক্ষেপকারীদের
মধ্যে চীনা জাপানিসহ বিদেশীরা রয়েছেন। মন্দিরের চারপাশে বৌদ্ধবানী খচিত অসংখ্য
চাকতি রয়েছে। লোকেরা এগুলো স্পর্শ করে চাকতি ঘুরাচ্ছে। এখানে কমলা বর্ণের কাপড়
পরিহিত মাথা মুন্ডানো অনেক ভিক্ষু ধর্মচর্চারত আছেন। মন্দিরের পিছনের চত্বরে
দাঁড়িয়ে ছবি উঠাই। নীচে কাটমন্ডু শহরটা পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। সময় নষ্ট না করে
নেমে আসি। পথে একজন অক্ষম ভিখারীকে পাই যে নেপালে আমার দেখা একমাত্র ভিক্ষুক। তাই
১০ নেপালি রুপি তার হাতে তুলে দেই। পথে রানির দিঘি দেখি। এই দিঘির মাঝখানে একটি ঘর।
রানী একটি ছোট্ট সেতু বেয়ে সে ঘরে যেতেন। পথে ছোট্ট ত্রভূবন বিশ্ববিদ্যালয় দেখি যা
আমাদের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তুলনায় কিছুই না। তারপর আমাদেরকে ললিতপুর
প্রাচীন পাতান রাজবাড়িতে নিয়ে আসে। রাজবাড়ি তিনভাগে বিভিক্ত- রাজবসত (বাড়ি),
রাজদরবার (রাজ অফিস) এবং রাজমন্দির। সর্বত্র অসংখ্য সিংহ ও মানব মূর্তি। তাছাড়া
দেবদেবীরও অনেক মূর্তি রয়েছে। ভবনগুলো ইস্টক নির্মিত। প্রচুর কাটের কারুকাজ রয়েছে।
নেপালের সংস্কৃতি ভাস্কর্য্য শিল্পের সহায়ক হওয়ায় এখানে প্রাচীনকাল হতে কাট ও
পাতরের অজস্র উন্নত ভাস্কর্য্য গড়ে উঠছে, যা হাজার বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য হিসাবে
টিকে আছে। তিনচার ঘন্টা শহর দেখে টুরিস্ট বাসে হোটেলে চলে আসি। নামাজ ও খাবার সেরে
জেফার ও তার মা ঘুমিয়ে পড়েন।
আমার মনে হল আর কোনদিন এদেশে হয়ত
আসা হবেনা। বরং ঘুমানোর চেয়ে ভাল হবে শহরটা ঘুরে ঘুরে দেখে নেই। হোটেল হতে বের হয়ে
বামদিকে সরলরেখায় হাঁটা শুরু করি। আবহাওয়া তেমন গরম নয়। আমাদের শীতকালের মত রোদকে
মিঠে মিঠে লাগছিল। বাতাসে আদ্রতা কম, তাই শরীর ঘামেনা। প্রায় দুইঘন্টা অগ্রসর হই। প্রথমে
জাপান এমব্যাসি, তারপর প্রেসিডেন্ট ভবন। এখানে একজন সৈনিক টাওয়ারে দাঁড়িয়ে নজরদারী
করছে। গেটে কিছু সৈনিক। আমাদের কিংবা ভারতের প্রেসিডেন্ট ভবনের মত এত চাকচিক্য
নেই। তারপর হঠত এক বিশাল বাড়ি দৃষ্টিগোচর হয়। বাড়িটির দৃশ্য নৈসর্গিক। অজস্র
সুরম্য বৃক্ষশোভিত। গাছে গাছে অসংখ্য হলুদগৃবা বক ঝুলে রয়েছে। একজন নেপালিকে
জিজ্ঞেস করে জানলাম এটা নারায়নহিতি প্রসাদের পিছনের দিক। দু’এক ঘন্টা আগে এবাড়ির
গেটে ট্যুরিস্ট কার আমাদেরকে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আজ বন্ধ থাকায় আমাদেরকে ঢুকতে
দেয়নি।
এবার এই রাজপ্রসাদের গল্পে চলে
আসি। বিগত ২৪০ বৎসর যে রাজবংশটি নেপাল শাসন করেছে সেই বংশের রাজাদের বাড়ি এই
নারায়নহিতি প্রসাদ। এই রাজপ্রসাদে ২০০১ সালের পহেলা জুন জনপ্রিয় নেপাল রাজ
বীরেন্দ্র, রানি ঐশ্বরিয়া, যুব্রাজ দীপেন্দ্র আর সাতজন লোকসহ নিহত হন। পরবর্তীতে
তদন্ত রিপোর্ট আসে প্রেমিকাকে বিয়ে করতে বাঁধাগ্রস্থ হয়ে যুবরাজ এই হত্যাকান্ড
ঘটান এবং নিজে আত্মহত্যা করেন। এই ঘটনার পর রাজত্ব চলে যায় রাজভ্রাতা জ্ঞানেন্দ্রের
হাতের মুঠোয়। এই হত্যাকান্ডের রহস্য নিয়ে নেপালিদের মধ্যে সন্দেহ রয়েছে। রাজা
বীরেন্দ্র ছিলেন জনপ্রিয় ও বুদ্ধিমান। প্রত্যক্ষ রাজতন্ত্রের দিন যে শেষ হয়ে গেছে,
তা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি জনপ্রতিনিধিদের (সংসদ) হাতে ক্ষমতা হস্থান্তর করে
বৃটেনের মত নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র প্রবর্তনের পথে হাঁটছিলেন। তার ভ্রাতা
ঞ্জানেন্দ্রের তেমন রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ছিলনা। তিনি তার বাপ-দাদার মত সর্ব ক্ষমতা
কুক্ষিগত করার চেষ্টা করেন। পার্লামেন্ট বাতিল করেন। মাওবাদি দমনে গণহত্যা চালান।
ফলে এক গৃহযুদ্ধ অতিক্রম করে ২০০৬ সালের ২৪ এপ্রিল তিনি ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন।
নেপালের মানুষ রাজভক্ত। নেপালে গনতন্ত্রের সাথে নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রও বহাল
থাকত। কিন্তু রাজা ঞ্জানেন্দ্রের নির্বুদ্ধিতা প্রায় আড়াই শত বছরের নেপালের শেষ
রাজবংশটির কবর রচনা করে। সেইসাথে ঐতিহ্যবাহী নারায়নহিতি প্রসাদ জাদুঘরে পরিণত হয়।
একজন নেপালি চালককে রাজা ঞ্জানেন্দ্র সম্পর্কে জিঞ্জেস করলে জবাব দেন- তিনি এখন
একজন সাধারণ পাবলিক। কাটমন্ডুর বাহিরে রাজ মৃগয়ার এলাকায় এক অখ্যাত নগরজুন
প্যালেসে বসবাস করছেন। ১৭৬৮ সালে পৃথ্বি নারায়ন শাহ যে রাজবংশ প্রতিষ্টা করেন ২০০৫
সালে তার বংশধর ঞ্জানেন্দ্রের হাতে তার পরিসমাপ্তি ঘটে। কাটমন্ডুর পথে পথে অসংখ্য
গাছে ফুটে আছে এক ধরনের হালকা বেগুনী নীলাভ ফুল। পাতা দেখা যায়না কেবল ফুল আর ফুল।
যে দু’একটা পাতা দেখা যায় তা আমাদের কৃষ্ণচূড়ার মত। এই গাছগুলোর তলায় ঝরাফুলের
গালিচা রচিত হয়। নেপালিরা এই ফুলের নাম দিয়েছে ‘গোলমোহর’।
রাতে নেপালি টেলিভিশন অনুষ্ঠান
দেখি। চ্যানেলগুলো আমাদের দেশের চ্যানেলগুলোর মতই। খবর, বিঞ্জাপন ও ছবির গানে
পরিপূর্ণ। আমাদের মত তাদের অনুষ্ঠানও তেমন উন্নত নয়, তাই মানুষ ভারতের টিভি
চ্যানেলই বেশি উপভোগ করে থাকে। খবরে রাজনীতিবিদ ও শাসকগোষ্টির প্রাধান্য লক্ষ্য
করা যায়। কিছু নেপালী শব্দ শুনি যা আমাদের বাংলা শব্দের অনুরূপ। যেমন- বাল বালিকা
(শিশু বা ছেলে মেয়ে), মায়া (প্রেম), মায়ালু (প্রেমিকা), এন্ডা (ডিম), ইত্যাদি।
নেপালী বর্ণমালা বাংলা বর্ণমালার প্রায় অনুরূপ। যেমন ল (বাংলা-ল), ব (বাংলা-ন),
< (বাংলা-ে) ড (বাংলা-ড)। এই দুই ভাষাকে আমার মনে হয়েছে একই বৃক্ষের দু’টি
শাখা।
৭ মে ২০১৪ সাল। আমরা পুখারা
যাত্রা করি। ঐদিন ভোর ৫টায় উঠে ব্রেকফাস্ট করি। ছোট কারে কান্তিপথ বাসস্ট্যান্ডে
আসি। অনিল আগরওয়াল প্রদত্ত টিকেট বের করে আমাদের বাসে উঠি। উন্নত এসি বাস। ৭ টার
বাস ছেড়ে দেয়। এখানে পুকরাগামি অসংখ্য বাস সারিবদ্ধ রয়েছে। শহরে কোন যানজট নেই। বাস
ছাড়ার পর কাটমন্ডু শহর হতে বেরিয়ে আসতে প্রায় ৪০ মিনিট সময় ব্যয় হয়। পুকরার দূরত্ব
২১০ কিলোমিটার। দুর্গম আঁকাবাঁকা পার্বত্য পথ। উঁচু পাহাড়ের গা কেটে কেটে রাস্থাটি
তৈরি হয়েছে। রাস্থার নিচদিকে সুদীর্ঘ্য ঢালু বরাবর যেমন গ্রাম, ক্ষেত, লোকালয়
রয়েছে। অন্যপাশে উপরের দিকেও ধাপে ধাপে গ্রাম, ক্ষেত ইত্যাদি দেখা যায়। পথে পথে
ভীতিকর বাক, এক পাহাড় হতে অন্য পাহাড়ে সেতু দিয়ে যুক্ত করা। দূর পাহাড়ের গায়ে
মানুষের বাড়িগুলো খেলনা বাড়ির মত ছোট ছোট মনে হয়। প্রায় বাড়িই দুতলা ও কাস্ট
নির্মিত। ঘরের নিচতলায় গৃহস্থলী জিনিসপত্র এবং উপরে মইয়ের সিড়ি বেয়ে ঘুমের জায়গা ও
বসার বারান্দা। ঘরের ছাদ টিন কিংবা শনে ছাওয়া। বাড়ির সামনে কলাফুল, জবাফুল,
বাগানবিলাস ও গোলমোহর ফুটে আছে। এখানে এক গ্রামের উপরে আরেক গ্রাম, নিচদিকে এক
গ্রামের নিচে আরেক গ্রাম, সেইসাথে ইক্ষু ক্ষেত, ভূট্টা ক্ষেত, কলা ক্ষেত পাহাড়ের
ধাপে ধাপে সাজানো। গরু-ছাগল নেপালিদের মূল্যবান সম্পদ। পাহাড়ের ধাপে শনের
চালাযুক্ত খোলা বাশের খুঁটির ঘরে গরু বাঁধা। পিছনের ঢালুতে গোবরের খাদ। পাশে
গোখাদ্য, খড়ের ডিবি। শস্যের মধ্যে টমেটো, মিষ্টি লাউ, করোলা ইত্যাদি। শস্যমাঠ পাথর
ও মাটির সংমিশ্রণ। এখানে ক্ষেতের কাজ
আমাদের মত সহজ নয়। কোদাল ও গরুর লাঙ্গল দিয়ে এখানে নর ও নারী একত্রে কৃষি
জমিতে কাজ করেন। জমির উপর জমি ধাপে ধাপে সাজানো। বৃষ্টির পানি আল দিয়ে আটকাতে হয়।
ক্ষেতে হিমালয়ের বরফগলা পানিও ব্যবহৃত হয়। খাড়া পাহাড় বেয়ে শিশুরা স্কুলে যাচ্ছে।
এক সময় পুখরা রোডের পাশে একটি সুন্দর পাহাড়ি নদী চোখে পড়ে। নদীটির নাম ত্রিশোলী
নদী। এই নদীটি অনেকটা আমাদের জাফলংয়ের পিয়াইন নদীর মত। নদীটির তীরে তীরে ধানক্ষেত
ও শস্যক্ষেত। নদীর অন্যপারে আকাশ ছোঁয়া পর্বতমালা। এযেন পাহাড়, নদী ও উপত্যকার এক
অপূর্ব স্বর্গভূমি। কাটমন্ডু হতে পুখরা
যাবার পথে পথে তিন জায়গায় গাড়ি থামে। প্রথমে পাহাড়ি নদীর ধারে অপরূপ শুভাময়
জায়গায়। আবার এই নদীর তীরে এক সুন্দর মহাসড়ক হোটেলে। নদীর তীরে গাছের ছায়ায় টেবিলে
বসে আমরা ২০০ নেপালি রুপিতে ৪ প্লেট নুডুলস খাই ও কোকিলের সুমধুর গান শুনি। এযেন
একদম বাংলার কোকিলের সুর। পরবর্তী সুন্দর মহাসড়ক হোটেলে বাসটি রাস্থা হতে খানিক
নিচে নেমে যায়। বাথরুম সেরে নদীতীরের ঝুলন্ত টেবিলে বসে আমরা Tourism Co. পরিবেশিত খাবার খাই। ভাত, চাপাতি, মোরগ, সবজি, ডাল আমরা প্লেটে করে নিয়ে
সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশে সজ্জিত টেবিলে গিয়ে বসি। এখানেও একটানা কোকিলের কুহু
কুহু গান শুনি। পাশের সিড়ি বেয়ে নিচে নামি। খুতিয়ে খুতিয়ে দেখি পাহাড়ি নদীর তীর,
নেপালী ঘরবাড়ি ও ক্ষেত। নেপাল এমন একটি দেশ যেখানে সবকিছু উপর নিচ ধাপে ধাপে সাজানো।
মনে হল নদীও তাই। একধাপে নদী গর্তাকার করে পানি জমানো- এভাবে প্রতি ধাপে পানি
জমিয়ে রেখে শস্য ফলানো হচ্ছে। আগস্ট ও সেপ্টেম্বর নেপালের বর্ষাকাল। তখন পাহাড়ি
নদীগুলোয় জলের খড়স্রোতা ঢল নামে। নেপালের পাহাড়ে ঘন বৃক্ষ নেই, তবে প্রচুর ঘাস
রয়েছে। মোঠ আট ঘন্টার জার্নি সেরে বিকেল ৩ ঘটিকায় আমরা পুকরা বাস টার্মিনালে অবতরণ
করি। একটি ছোট টাটা কারে পুকরা লেকের তীরে এসে হোটেল সেন্ট্রাল লেকে উঠি। হোটেল
কতৃপক্ষ পৌছামাত্র সুমিষ্ট শরবত পরিবেশন করে আমাদেরকে বরন করেন। বইরা মালামাল ও
আমাদেরকে চারতলার ৪০৭ ও ৪০৮ নম্বর কক্ষে নিয়ে যায়। সদ্যনির্মিত ছিমছাম হোটেল।
প্রতিরূমে দু’জন করে থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। হোটেলের পিছনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে দূরে
সাদা বরফের পাহাড় দেখা যায়। উঁচু পাহাড় হতে প্যারাসুট গ্রাইডিং করে অসংখ্য মানুষ
কোন যন্ত্র ছাড়াই পাখির মত উড়ে বেড়াচ্ছে। একজন পাইলট মাত্র একজন যাত্রি নিয়ে ছোট
দুইজনি উড়ালযান নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সবকিছু হোটেল বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমরা উপভোগ
করি। উড়ালযান, প্যারাসুট সবকিছু উঁচু উঁচু পাহাড়ের উপর হতে পরিচালনা করা হচ্ছে।
একটু পরে বের হয়ে আমরা পুকরা লেকের পারে যাই। পাহাড়ঘেরা এক অনন্যসুন্দর লেক। লেকটির
অসংখ্য শাখা প্রশাখা পাহাড়ের ভাজে ভাজে ঢুকে গেছে। লেকপার হতে অনেক নিচে টলটলে
পরিস্কার জল। বিদেশীরা নৌকা ভাড়া করে নৌবিহার করছে। আমরা নামি নি, মনে হল এত টাকায়
কেন নৌকা চড়বো। দেশেতো উত্তরের হাওয়-বিলে সতত কত নৌকা চড়ে থাকি। লেকের এপার সমতল,
অন্যপারে সুউচ্চ বনঘেরা পাহাড়। পাহাড়ের উপর সুন্দর সুন্দর বাড়ি। খুব সম্ভব এলাকার
ধনী লোকদের আবাস স্থল। একটি সেতু বেয়ে লেকের মধ্যে টাওয়ারে যাই। নিচে লোকেরা বরশি
দিয়ে মাছ ধরছে। ধরাপড়া মাছগুলো বেশীই তেলাপিয়া। নেপালি চটপটি খাই। এখানে সিঙ্গারা,
পিয়াজু, পুচকা সব ভেঙে একত্রে মিশায়ে দেয়। এক অদ্ভুত নেপালী স্বাধ। একটু পর বৃষ্টি
নামে। মুষলধারে বৃষ্টি। আমরা দৌড়ায়ে একটি টিনের ঘরে আশ্রয় নেই। নেপালিরা লেকের
পারে বসে নানা ধরনের হস্থশিল্প পন্য বিক্রি করছে। রাতে আমি ও জিন্নুন হাঁটতে বের
হই। উদ্দেশ্য রাতের খাবার হোটেল খোজা। খাবার হোটেল পেলাম, হোটেলের বিশাল লবি।
একদিকে নেপালের সুদর্শন সুদর্শনা যুবক যুবতীরা গানের তালে তালে নৃত্য পরিবেশন
করছে। নেপালী পাহাড়ি গান ও নাচ উপভোগ করে করে বিদেশীরা ডিনার সেরে নিচ্ছে। আমরা
হোটেলে যাই ও বের হয়ে একটি খাবার হোটেলে চারপ্লেট এগসহ চৌমিন খাই। পরে রূমে গিয়ে
কিছুক্ষন টিভি দেখে নামাজ পড়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হই।
৮ মে ২০১৪ সাল। আমার খুব ভোরে
ঘুম ভেঙে যায়। ভোরের পুখরা দেখার লোভ আমি সামলাতে পারিনি। তাই একাকি বেরিয়ে পড়ি।
রাস্থায় কোন লোকজন নেই। কোকিল ঘুঘু সহ অসংখ্য প্রজাতির পাখি ডাকছে। নেপালের ভদ্র ও
স্বাস্থ্যবান কুকুরগুলো হাটতেছে। নেপাল শান্তির দেশ। এখানে চোর ডাকাত বাদ্মায়েশ বা
হাইজ্যাকারের ভয় নেই। ভোরের পুকরা লেক নয়নাভিরাম। ওপারে পাহাড়ের ঘা ঘেষে ঘেষে দলবদ্ধ হলুদগলা সাদাবক উড়ে উড়ে যাচ্ছে। লেকের
মধ্যে ভাসমান পাহাড়ের রেস্তোরা দেখা যাচ্ছে। এখানে নৌভ্রমণকারীরা চা-নাস্তা করে
থাকে। লেকপারের বাগানে নানা জাতের ফুল ও ফলের সমারুহ। নীলফুল, লতাফুল, পামগাছের ময়
বৃক্ষ আর কত কি। এখানে একা মাঠ পেয়ে মনভরে জগিং করি। লেকের মাঝের টাওয়ারে যাই। দুই
জাপানি স্বল্প বয়সি কপোত-কপোতি একাকি বসে বাক বাকুম করছে। দূরে জেলে নৌকায় বসে
জেলেনীরা (নারী) মাছ ধরছেন। এদেশে কৃষিকাজ, মাছধরা ও হোটেল পরিচালনায় পুরুষ ও
নারীরা সমানভাবে অংশগ্রহণ করে।
পাহাড়ের গায়ে গায়ে মেঘ ও কোয়াশা
জমে রয়েছে।পাহাড়ের বাড়িঘরে মেঘের বাষ্প ঢুকে পড়ছে। হঠাৎ পুক্রা লেকের অন্য পারে
সূর্যের লাল মুখটি ভেসে উঠে। চেয়ে দেখি সাদা ফুলের মত লেকপারে বাশবনে অজস্র বকেরা
বসে আছে। পুকারার এই স্বর্গীয় সুন্দরের মালিক মহান আল্লাহকে অশেষ প্রশংসা জানাই।
ফিরে এসে আমাদের হোটেলে ব্রেকফাস্ট করি। নানাপদের খাবার- চাপাতি, ডিম, সবজি, দুধ,
কুকারিজ, শরবত, কফি ও টুস্ট মাখন জেলী ইত্যাদি। ধর্মীয় কারনে মোরগ খাওয়া হতে বিরত
থাকি। সকাল ১০টায় একটি এসি মাইক্রোবাসে এসে আমাদেরকে সাইট সিয়িংয়ে নিয়ে যায়। কি কি
দেখা হল এবার তা পাঠকদের কাছে ধারাবাহিক বর্ননা করার চেষ্টা করব। প্রথমে আমাদেরকে
নিয়ে যায় Seti river gorge বা সেতু জলপ্রপাতে। দুই সুউচ্চ পাহাড়ের
মধ্যভাগ দিয়ে তীব্র শব্দে জল নামছে। একটু নিচে নেমে দেখি দুটি পাহাড়কে একটি সেতু
দিয়ে যুক্ত করা হয়েছে। ও সেতুর নিচে তীব্র নিনাদে জলপ্রপাত বয়ে যাচ্ছে। সেতুর
মধ্যভাগ দিয়ে একটি ক্যানেল নির্মান করে জল অন্যপারে নেওয়া হচ্ছে। সেপারে একজন
সাধুসন্থ গঙ্গার পবিত্র জল মানুষের গায়ে ছিটিয়ে দিচ্ছেন। খুবসম্ভব হিমালয়ের উপর
হতে নেমে আসা এই বরফগলা পানি পুকরা শহরে সরবরাহ করা হচ্ছে। তারপর আমাদেরকে নিয়ে
যাওয়া হয় ডেভিড ফলস জলপ্রপাতে। সিড়ি বেয়ে বেয়ে অনেক ভিতরে যাই। এই জলপ্রপাতের
বৈশিষ্ট্য হল পানি উপর হতে নিচে পড়ে অদৃশ্য হয়ে যায়। এটা আবার কিভাবে সম্ভব? আসলে
ঐ পানি পতন স্থলে গর্ত খুড়ে এক সুড়ং পথে আড়ালে চলে যায়। এবার আমাদেরকে Cave
of Pukra বা পুকরা গোহায় নিয়ে যাওয়া হয়। পাঁচ হাজার বছরের পুরানো
মহেন্দ্র গোহা বা সুড়ঙ্গ। অজস্র সিড়ি বেয়ে বেয়ে আমরা ভূগর্বে নামতে শুরু করি।প্রথমে
গনেশ ওগাভীর মূর্তি প্রদক্ষিন করি। তারপর আবার স্যেতস্যেতে সুড়ং পথে বৈদ্যুতিক
আলোয় আর নিচে নামতে থাকি। পথে এক বিশাল কাটের কালো নাগমূর্তির (সর্প) দেখা পাই।
একটু পরেও আমার ছেলের পায়ের কাছে ছোট্ট একটি সাপ দেখতে পাই। ডাঃ নূরজাহান ভয়ে
গর্তে ঢুকা হতে বিরত থাকেন। আমরা গর্ত বেয়ে প্রায় তিন শতাধি সিড়ি বেয়ে অনেক নিচে
নেমে আসি। ভীষণ ভয় লাগছিল। কবরের গর্ত বেয়ে বেয়ে আর কত নিচে যাব। হঠাত নিচে
প্রাকৃতিক আলোর রেখা ফুটে উঠে। দুই পাহাড়ের ফাটল দিয়ে সূর্যের উজ্জ্বল আলো ঢুকছে।
এবার ফেরার পালা। সিড়ি বেয়ে বেয়ে ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলে উপরে উঠে আসি। এবার ড্রাইভার
আমাদেরকে নিয়ে আসে পুকরা লেকের পারে মূল শহরে। এখানে এসে এক দুঃসাহসসী অভিজানের
নেশা জিন্নুন ও আমাকে পেয়ে বসে। দেড়মাইল উঁচু পাহাড় হতে প্যারাস্যুট গ্রাইডিং করে
ঈগলের মত উড়ে উড়ে পুক্রা লেকের তীরে আসা। সুযোগ পেয়ে যাই, প্রতিজন ১০৭০০/= নেপালী
রুপি করে খরচ হবে। প্যারাস্যুট গ্রাইডিং ফি ৯০০০/= রুপি এবং ভিডিও করারখরচ ১৭০০
রুপি। টিকেট করে হোটেলে ফিরে সামান্য সময় রেস্ট নেই। তারপর চলে আসি প্যারাস্যুট
গ্রাইডিং অফিসে। প্যারাস্যুট গ্রাইডিং করতে আমরা স্বেচ্ছায় গিয়েছি এবং আমরা আহত বা
নিহত হলে তারা দায়ী নয়, এমন এক অঙ্গিকারনামায় আমাদের স্বাক্ষর নেয়। আমরা সাতজন
কাস্টমারের সাতজন প্যারাস্যুট চালক একটি মাইক্রোবাসে করে আসেন। কোম্পানিয় মালিক
একজন রূমানিয়ান শ্বেতাঙ্গ । তিনি চারটি ছোট ছোট লাটি একটির পর একটি শূন্যে ঊড়ায়ে
হাতে এনে খেলা দেখাচ্ছেন। দুইটি লাটি দু’হাতে এবং দুইটি লাটি শূন্যে ঘুরছে। তার মাথায়
লম্বা চূলের চুটি বাঁধা। রুমানিয়ানকে নিয়ে আমরা সাতজন গ্রাইডার মাইক্রোবাসে উঠার
পর আর সিট খালি নেই। তাই জেফার ও তার মা ইচ্ছে থাকা সত্বেও আমাদের সাথে সারাংকোট
পাহাড়ে যেতে পারেননি। তারা প্যরাস্যুট গ্রাইডিং অফিসে বসে আমরা ফেরার অপেক্ষায় বসে
থাকেন। গাড়িতে উচ্চশব্দে ইংলিশ ব্রেন্ড সঙ্গীত বাজতে থাকে। আমরা দু’জন বাংলাদেশী,
বাকী সবাই চীনা ও জাপানিজ। প্যারাস্যুট পাইলটও কয়েকজন শ্বেতাঙ্গ অনেপালি। শহর হতে
বের হয়েই গাড়িটি একটি সুউচ্চ পাহাড়ে উঠতে থাকে। চালক গাড়িটিকে এক ভীতিকর উচ্চতায়
নিয়ে যায়। শুনলাম আমরা মাটি হতে সাত হাজার ফুট উচ্চতায় এসেছি। জায়গাটির নাম
সারাংকোট। এবার গাড়ি আর উপরে উঠার রাস্থা নেই। আমরা পাহাড় বেয়ে আর পাচ/সাত শত ফুট
উপরে উঠি। সেখানে চূড়ায় একটি টাওয়ার। চূড়ায় খানিক নিচে পাহাড়ের ঢালু মাঠ। ঐ মাঠে
সবুজ ঘাসের আস্তরন। নিচের দিকে বৃক্ষ দেখা গেলেও এখানে কোন গাছপালা নেই। এখান থেকে
সারাটা পুকারা শহর লেকসহ সূদূরে দেখা যাচ্ছে। এটা পুকারা শহরের সন্নিকটের সর্বোচ্চ
পর্বতচূড়া- সুপ্রসিদ্ধ সারাংকোট। গাড়ীটি আমাদেরকে নিয়ে আঁকাবাঁকা পাহাড় বেয়ে এতই
উপরে উঠে যে ভয়ে গা শির শির করছিল। তারপর বেয়ে আর হাজার ফুট উপরে উঠার সময় মনে হল
এই জল্লাদের দল যেন আমাদের মৃত্যুদন্ড কার্য্যকরের জন্য উপরে ফাঁসীর মঞ্চে নিয়ে
যাচ্ছে। প্যারাস্যুট সুন্দরভাবে মাঠে বিছানো হল। একটা ব্যাল্ট দু’পা সহ কোমর প্যাচিয়ে
তিন জায়গায় লক করা হল। তারপর লক আবার পরীক্ষা করা হল। আমার মনে কিছুটা ভীতি এসে
যায়। আমি প্রথমে আয়াতুল কুরসি পড়ি, তারপর ইসমে আজম। খোদার কাছে ‘সাহস’ প্রার্থনা
করি। প্রভূকে বলি তুমি আমাকে হার্টের এক সামান্য ভাল্বের মাধ্যমে ৪৭/৪৮ বৎসর
জীবন্ত রেখেছো, নিশ্চয় এবারও বাঁচিয়ে রাখবে। আমার পিছনে প্যারাস্যুট পাইলট পিঠে
একটি ব্যাগ ও হাতে ভিডিও করার ক্যামেরা ধরে আমাকে সামনে দৌড়াতে বলে অথচ সামনে দেড়মাইল
গভীর গীরিখাদ। ভয়ে থেমে যাই ও প্যান্টে কাদামাটি লেগে যায়। দাঁড়িয়ে সাহস করে
গিরিখাদে ঝাপ দিতেই দেখি আমরা দ’জন প্যারাস্যুট নিয়ে বাতাসে ভেসে গেছি। শৈশবে
স্বপ্নে বহুদিন বাতাসে পাখির মত নিজেকে উড়তে দেখেছি। বেশ কিছুদিন আগেও ঘুমের মধ্যে
স্বপ্নে দেখছি আমি বাতাসে শূন্যে উড়ছি। সেদিনের স্বপ্নটি মহান আল্লাহ পাক নেপালের
পুকরার সারাংকোটে বাস্তবে পরিণত করলেন।
প্যারাস্যুট চালক একজন স্লিমবডি
স্মার্ট ইংরেজি দক্ষ লোক। সুদর্শন এই যুবকের বয়স পঁয়ত্রিশের বেশি হবেনা। নাম
জিজ্ঞেস করি তাকে। নাম বলল- কাজি। নাম শূনে ভাবলাম সে মুসলিম। Are you a
Muslim? বলতেই উত্তর দিল- No, I am Buddist. আবার
প্রশ্ন করি- How long time you drive parasuit? সে জবাব দিল-
More than five years. আবার বলি-Do you fall any
accident? উত্তর দিল- Only one time, when I was learning
And fall down safely in pukara lake. কাজি এবার বলল- Do not
fear, We are now fully safe.
How we are flying? জানতে
চাইলে কাজি বলল- We are flying now like as Eagles. তাকিয়ে
দেখি কাজি প্যারাস্যুটের সুতার গুচ্ছ ধরে টান দিচ্ছে, সেই টানে বাতাসে শন শন আওয়াজ
করে প্যারাস্যুট চিলের মত এপার ওপাশ করে বৃত্তাকার পথে চক্কর মেরে উপরের দিকে বেয়ে
উঠতেছে। আশপাশে মেঘ উড়াউড়ি করছে, যেন মেঘ ছুঁয়ে ফেলব আমরা। পাহাড়ের সর্বোচ্চ চূড়ার
উপরে উঠে চারপাশে চিলের মত বাতাসের স্থম্ব ধরে অনেক চিল-চক্কর দেই। কাজি জানতে চায়
আমি কি করি। বলি বাংলাদেশের একটি ব্যাংকে চাকুরী করি। সাথে ছোটখাট ব্যবসায় জড়িত
আছি। সবশেষে বলি, আমি একজন লেখক। আমার এই অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের পত্রিকায় লিখব। কাজি
খুবই অনুপ্রাণিত হয়। ও খুব মনযোগ দিয়ে ভিডিও করে। সে আমার পারসেপশন জানতে চায়। আমি
বলি- Thanks to God, he gives me an excellent experience to fly like as
bird in the sky of Pukara, Nepal. কাজিকে জিঞ্জেস করি- Your
believe please? সে বলল- I belive only one God has created
the universe. আমি বললাম- My belive is same as you. হাজার ফুট নিচে পাহাড়ের ধাপে ধাপে নেপালের জনপদ, বৃক্ষ, শস্যক্ষেত্র দেখা
যাচ্ছে। কৃষকেরা মাঠে কাজ করছে, গরু চরাচ্ছে। নিচে বৈদ্যুতিক খুটি ও তার দেখা
যাচ্ছে। দূরের পুকরা লেক ও শহরটাকে আকাশ থেকে অপূর্ব মনোরম লাগছে। প্যারাস্যুট
পুকারা শহরের কিনারায় চলে আসে। নিচে গাড়ি, লোকজন ও তিনচার তলা পাকাবাড়ি দেখা
যাচ্ছে। আমাদের সাথে জাম্পকরা অন্য প্যারাস্যুটগুলোও এই একই উড়াল রাস্থা দিয়ে একে
একে উড়ে আসতে থাকে। হঠাত একটি বিশাল পাহাড়ের পাশঘেষে আমাদের প্যারাস্যুট পুকরা
লেকের উপরে চলে আসে। নিচে লেকের জলে বিদেশীরা নৌভ্রমন করছে। দূরে লেকের ওপারে একটি
সবুজ মাঠ দেখা গেল। মাঠটি পুকরা মধ্যে একটা উপদ্বীপ হয়ে ডুকে পড়েছে। কাজি ধীরে
ধীরে আকাশ হতে প্যারাস্যুট নিচে নামিয়ে আনছে। এবার কাজি বলল- Sir, now we
will be land. সে আমাকে পা’দুটি সামনের দিকে সোজা করতে বলল। একটু পর
লক্ষ্য করি চিল যেমন শিকারে ছু মারতে মাটিতে নেমে আসে আমাদের প্যারাস্যুটি আমাদের
দু’জনকে নিয়ে তেমনই ভূমিতে নেমে আসছে। একটি হালকা ধাক্কা খেয়ে মাটিতে যখন পা
রাখলাম তখন ১টা ৩৪ মিনিট। আমরা ১২টা ৩০ মিনিটে সারাংকোট পাহাড় চূড়া হতে প্যরাড্রপ
করে ৬৪ মিনিট পর মাটিতে অবতরণ করি। আট হাজার ফুট উচ্চতা হতে চিলের মত চক্কর মেরে
উড়াউড়ি করে চার মাইল দূরের পুকরা লেকপারের মাঠে নেমে আসি। ধন্যবাদ আল্লাহকে, তিনি
আমাকে উড়ন্ত ঈগল হবার বাসনা পূরণ করে দেন।
এবার পুকরা শহর নিয়ে আলোচনা করব।
ইহা আমাদের কক্সবাজারের মত নেপালের প্রধান পর্যটন শহর। পুকরা শহরের আয়তন ১৮০
বর্গমাইল, যেখানে প্রায় চার লক্ষ লোক বসবাস করে। কাটমন্ডুর চেয়েও আয়তনে বড় হলেও এই
শহর কিন্তু জনসংখ্যায় নেপালের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। উঁচু পাহাড় ও লেকঘেরা এক
অপূর্ব সুন্দর ৫৭০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত একটি মালভূমিতে এশহর গড়ে উঠেছে। এটা আয়তনে
আমাদের সিলেট শহরের সমান বা একটু বড় হতে পারে। শহরটির সমৃদ্ধির কারন হল হাজার
হাজার বিদেশী পর্যটকের আগমন। এই শহরটি পর্যটনের স্বর্গরাজ্য। পর্যটক আকর্ষনের সব
ব্যবস্থাই এখানে রয়েছে। প্যারাস্যুট গ্রাইডিং, পাহাড়ি খরস্রোতা নদী, নদীতে বোট
চালানো (রাফটিং), পর্বতারোহন (ট্রেকিং), বরফের পাহাড় দর্শন, ছোট্ট ফ্লাইং যন্ত্রে
উড়াউড়ি, পুকারা লেকে নৌভ্রমণ, নেপালি নাচগান সংস্কৃতি উপভোগের ব্যবস্থা। এখানে আছে
বিশ্ববিখ্যাত জলপ্রপাত, পার্বত্যগোহা, হিমবাহ বেয়ে আসা গঙ্গার পবিত্র জল, আর কত
কি। নেপালের আর একটি মূল্যবান সম্পদ রয়েছে তাহল এখানকার ভদ্র সুসভ্য নেপালি
জনগোষ্টি। এখানে মৃদু বৃষ্টি হয়। সব সময় শীতল ও নাতিশীতুষ্ণ চমৎকার আবহাওয়া বিরাজ
করে। সত্যিই পুকরা একটি আরামদায়ক ভাগ্যবান শহর। এইদিন সন্ধ্যায় আমি ও জিন্নুন
লেকপারে যাত্রীবাসে চড়ি। এই শহরে কোন রিকশা বা ঠেলাগাড়ি নেই। মানুষ কারে কিংবা
প্যাসিঞ্জার বাসে চলাফেরা করে। ফলে পুকারার রাস্থায় কোন যানজট নেই। আমাদের লক্ষ্য
পুকরার প্রধান বানিজ্য এলাকা মহিন্দ্রপুর পরিদর্শন। বাসের হেলপার যুবকটি একটু
বাচাল। প্রথমে ক্রিকেট ও আশরাফুল, তারপর কিছুদিন আগে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দাঙ্গাহাঙ্গামা।
ভাবলাম অনেক নেপালি বুঝি বাংলাদেশের খবর রাখেন। সে বলল, পুকরার পর্যটন এলাকায়
পন্যের গলাকাটা দাম। যদি কিছু কিনতে হয় মহিন্দ্রপুরে কিনুন। অর্ধেক মূল্যে পন্য
পেয়ে যাবেন। মহিন্দ্রপুরে অনেক বড় বড় বিপনিবিতান রয়েছে। দোকানে নেপালি, ভারতিয় এবং
চীনা পণ্যের ছড়াছড়ি। বড় বানিজ্যকেন্দ্র রয়েছে, যেখানে তরিতরকারী, মসলা সহ সব ধরনের
পণ্যসামগ্রী একত্রে পাওয়া যায়। পণ্যের গায়ে Fixer price স্টিকার
লাগানো থাকে। এরমধ্যে আবার বৃষ্টিপাত শুরু হল। সবগুলো ভবনের ছাদ হতে সামনের
রাস্থায় পানি পড়ছে। আমাদের মত ছাদের পানি পাইপের মাধ্যমে নামিয়ে আনার কোন ব্যবস্থা
নেই। বাস নাপেয়ে আমরা একটি ছোট্ট কার ভাড়া করে হোটেল সেন্ট্রাল লেকে ফিরে আসি।
৯ মে ২০১৪ সাল। খুব ভোরে উঠে
পুকরা লেকে পারের পার্কে জগিং করি। কোকিল, ঘুঘু, চড়ুই ডাকছে। হলুদ গলা বকেরা খেক
খেক করছে। পাশের বাশবনে এত বক বসে আছে যে মনে হচ্ছে এগুলো বাশবনের বাঁকে বাঁকে শত
সহস্র সাদা-হলুদ ফুল ফুটে আছে। কাছে যেতেই টের পাই বকের গায়ের ও বিষ্টার গন্ধে
জায়গাটি সয়লাব। হোটেলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে দূরে বরফের পাহাড়ের উপর সূর্যোদয় দর্শন
করি। সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়ে বরফের পাহাড় পূর্ণিমার চাদের রংধারন করেছে। এই
রঙ্গ দিনে হালকা হয়ে আসে ও অনেকটা আমাদের সাদা মেঘের মত হয়ে যায়।
মনে হয় এজন্য কাটমন্ডু হতে Mount Everest এর mountain flight কেন খুব ভোরে পরিচালিত হয়।
পর্যটকরা যেন সর্বোত্তম সময়ে পূর্ণিমার চন্দ্রসম বরফাবৃত হিমালয় পর্বতমালার সৌন্দর্য্য দেখে বিমুগ্ধ হন। একটু পর হোটেলের ডাইনিং হলে মালপত্র সহকারে নেমে আসি। এখনও খাবার তৈরি হয়নি। আমাদেরকে তারা কনফ্লেক্স,
কুকারিজ ও দুধ দেয়। সকাল ৭টা ৩৫ মিনিটে বাস ছাড়বে। দ্রুত বাস স্ট্যান্ডে এসে বাসে
উঠি। একজন ফেরিওয়ালার কাছ থেকে ২৫০ নেপালি রুপিতে ৫টি নেপালের পাহারি দৃশ্যের
চিত্রকর্ম ক্রয় করি। বাস ছেড়ে দেয়। অপরূপ সুন্দর নগরী পুকরাকে বিদায় জানাতে মনটা
ভারী হয়ে আসে। প্রিয় শহর পুকরা তোমাকে গুড বাই। একই রাস্থা দিয়ে আবার কাটমন্ডু
ফিরছি। পথে সেই মহাসড়ক হোটেলে গাড়ী থামে। এবার নদীতীরে বসে বুফে খাবার। মোরগ খাওয়া
হলনা ধর্মীয় কারণে, আবার মাছেরও দেখা নেই বহুদিন ধরে। নেপালে এই প্রথম ও শেষবারের
মত মাছ খাবার পাই। একটি ছোট বাটিতে করে আমাদেরকে বাছা মাছের মত ছোট ছোট এক ধরনের
মাছ দেওয়া হয়। ঘন মশলাযুক্ত ঝুল। খেতে মন্দ লাগেনি। এইরাস্থা দিয়ে যাবার সময়
দু’পাশের বিবরণ দিয়েছি, তাই এবার বিরতি দিলাম। দুপুর ২টায় আমরা কাটমন্ডু পৌছি।
আমাদের ট্র্যাভেল এজেন্ট
নির্ধারিত সুন্দর একটি এসি মাইক্রোবাস এসে হাজির হয় এবং আমাদের চারজনকে নিয়ে
পরবর্তী গন্তব্য নগরকোট অভিমুখে যাত্রা শুরু করে। ‘নগর’ শব্দের অর্থ শহর এবং ‘কোট’
শব্দের অর্থ ‘উঁচু বা চূড়া’ তাই নগরকোট হচ্ছে উঁচু চূড়ার শহর। বাস একটু অগ্রসর হয়ে
জাপানের আর্থিক সাহায্যে নির্মিত একটি চারলেনের রাস্থা দিয়ে অগ্রসর হয়। তারপর আমরা
নেপালের হাজার বছরেরও আগে নির্মিত প্রাচীন রাজধানী ভক্তপুর অতিক্রম করি। এবার বাস
রাস্থা বেয়ে উপরে উঠা শুরু করে। ধাপে ধাপে বাস উপরে উঠতে থাকে। মনে হল আমরা বুঝি
পৃথিবীর ছাদে আরোহন করতে যাচ্ছি। দু’দিকে পাহাড়ি জমিতে রূপালি গমক্ষেত। কৃষাণ ও কৃষাণীরা
দল বেঁধে গম কাটছেন, খড় সংরক্ষণ করছেন। কোলার দিয়ে কৃষানীরা বাতাস প্রবাহকে
ব্যবহার করে গমের খড় অপসারণ করছেন। নেপালের এই অঞ্চল যেন রূপালি গমের রাজ্য। এত
উপরে গাড়ি উঠছে যে বায়ুচাপের অভাবে কানের পর্দা পট পট করছে।
নগরকোট গ্রামটি পৃথিবীর সবচেয়ে উচু
স্থানে অবস্থিত। নেপালের এই পর্যটন গ্রামটি ভুসমতল হতে ৭২০০ ফুট উপরে। আমরা বাংলাদেশে উপরের দিকে তাকিয়ে মেঘ দেখি কিন্তু নগরকোটের
মানুষ নিচের দিকে তাকিয়ে মেঘমালা দেখেন। ঘুম হতে জেগে দরজা খুললেই দেখা যায় সামনে
খন্ড খন্ড ভাসমান মেঘ ও মেঘবাষ্পের ছুটাছুটি। কাটমন্ডু হতে মাত্র ২০ মাইল
পূর্বদিকে অবস্থিত এই গ্রামটির সৌন্দর্য্য চোখে পড়ার মত। ঠিক যেন বেহেস্তের অপার
সৌন্দর্য্য অনুভব করার মত এই গ্রামটিতে মাত্র ৩৫০০ জন অধিবাসী বসবাস করেন। মাইল,
দুই মাইল, তিন মাইল নিম্নদিকে দেখা যাচ্ছে গ্রাম, বাড়িঘর, ফসল ক্ষেত, পাইন গাছের
সারি। এবার চালক বললেন হোটেল বহুত উপর মে রয়েগা। নুরজাহান ভয় পেয়ে বললেন, নামিয়ে
দিন আমরা হেঁটে উঠব। আমরা দারূন সুন্দর পাইন বনে প্রবেশ করি। পাইনের বনে অতি মনোরম
শন শন সুর তুলে বাতাস বইছে। নিচে পাইনের পাতা জমে অপূর্ব খয়েরি গালিচার রঙ্গ ধারন
করেছে। কিছু কিছু ভবন, হোটেল, রিসোর্ট, দোকান-পাঠ পাহাড়ের ধাপে ধাপে দেখা যাচ্ছে।
আমরা নগরকোট শহরে প্রবেশ করি।
তিন চারটি উঁচু পাহাড় একস্থানে এসে মিশেছে। তিনদিকে তিন পাহাড় বরাবর তিনটি রাস্থা
চলে গেছে। গাড়ি সংকীর্ন পাহাড়ি রাস্থা বেয়ে এক অপূর্ব সুন্দর রিসোর্টে প্রবেশ করে।
রিসোর্টের নাম ‘চৌতারি’ চৌতারি একটি নেপালি শব্দ, যার বাংলা অর্থ ‘বৃক্ষচ্ছায়া’। সামনের
পাহাড়ি ধাপে একটি একতলা টালি ছদের বিশাল ভবন। ভবনটি চৌতারি রিসোর্টের রেসিপশন,
ডাইনিং ও অফিস। রিসোর্টটির হোটেল লবিও এখানে অবস্থিত। গাড়ি হতে নেমে রেসিপসনে
উঠামাত্র হোটেল কতৃপক্ষ নেপালি কায়দায় মিষ্টি জুস দিয়ে আমাদেরকে বরণ করেন। কয়েক সিড়ি
বেয়ে নিচে নেমে পাহাড়ের ধাপ দিয়ে কয়েকটি লতাফুলের গেট পার হই। আবার সিড়ি বেয়ে একটু
উপরে উঠে একটি সবুজ বাগানের সামনে দু’টি কক্ষ। প্রতিটিতে দুইজনের থাকার সব
ব্যবস্থা রয়েছে। এই রিসোর্টটি সৌর বিদ্যুতের আলোতে চালিত হয়। ছাদে প্রচুর সৌর
প্যানেল রয়েছে। এখানে আবহাওয়া সব সময় শীতল থাকায় এসি কিংবা ফ্যানের কোন ব্যবস্থা
নেই। নেই মশামাছি, তাই মশারিও নেই। সন্ধ্যার পর শীত হতে আত্মরক্ষার জন্য দরজা
জানালা বন্ধ করে দিতে হয়। সৌরবিদ্যুতের মৃদু আলো পরিবেশকে ছন্দময় করে দেয়। এখানে
পানি গরম করার কাজও সৌরবিদ্যতের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়।
আমরা রূমে ঢুকে কিছুক্ষণের মধ্যে
সূর্যাস্থ উপভোগ করতে বেরিয়ে আসি। চারজন হেঁটে হেঁটে অর্ধমাইল দূরের
এক পর্বতচূড়ায় গমন করি। আমি ও জেফার এখানকার শীত হতে বাঁচার জন্য দু’টি সার্ট
একসাথে পরে নেই। কারণ জুনের গরমে আমরা শীতের কাপড় সাথে নিয়ে নেপাল যাইনি। আমাদের
শেষ ডিসেম্বরের মত ঠান্ডা বাতাস বইছিল। সামনে বিশাল গীরিখাদ। গীরিখাদের
অন্যপ্রান্তে হয়ত সাত আট মাইল দূরে একটি চারপাচ তলা ভবন দেখা যাচ্ছে। ভবনটি এত
দূরে যে মনে হল ছোট্ট খেলনা বাড়ি। হাত প্রসারিত করে ফটো ঊঠাই ফটোতে ভবনটিকে দেখে
মনে হল ইহা আমার হাতের উপরে বসানো ছোট্ট ভবনের মিনিয়েচার। আমাদের মত সমতল দেশে
এধরনের দৃশ্য বিরল। দূর দিগন্তে লাল গোলাকার সূর্য অদ্ভুদ রূপ ধারন করে নিচে নেমে
যাচ্ছে। নানা দেশের নানা ধর্ম ও বর্ণের লোকেরা ফুরফুরে মেজাজে আনন্দ করছে। সূর্যকে
হাতে নিয়ে, বুকে জড়ায়ে, মাথার উপর দু’হাতে ধরে নানা ভঙ্গিমায় ছবি তুলছে। নিস্পাপ
শিশুরা মহানন্দে লাফালাফি করছে। জন কয়েক চীনা ও জাপানি পর্যটক ধ্যানে বসে সূর্যের
অপরূপ সৌন্দর্য্য উপলব্ধি করে নিচ্ছে। চোখের সামনে হিমালয়ের বরফ রাজ্য এক সময় আমাদের প্রিয়
নক্ষত্র সূর্যতা হারিয়ে গেল। সেইসাথে আমাদের জীবনের এই সেরা সুন্দর সন্ধ্যাটিও
হারিয়ে গেল। ভূতুড়ে রাস্থা দিয়ে হেঁটে হেঁটে রিসোর্টে ফিরছি। চোর ডাকাতের ভয় হল।
জিন্নুন একটি দোকানে এই শহরের নিরাপত্তার বিষয় জানতে চাইলে মেয়েটি বলল- কোন ভয়
নেই, এখানে ডলার, ক্যামেরা, মোবাইল নিয়ে ২৪ ঘন্টা নির্ভিঘ্নে চলাফেরা করতে পারেন।
আমরা এখানে কোনদিন চুরি কিংবা ছিনতাই হতে দেখিনি। আসলে এই সুন্দর নিরাপত্তার জন্য
শত শত বিদেশী এখানে শঙ্কাহীন ঘুরে বেড়ায়। রাতে এক নেপালি মেয়ের হোটেলে ঢুকে আমরা
তিনজন চৌমিন খেয়ে নেই এবং গিন্নীর জন্য খাবার নিয়ে আসি। পিছন দিকে একটি ইকোপার্ক
দেখা পাই। দু’চার পা অগ্রসর হয়ে ভয়ে এই নির্জন স্থান হতে ফিরে আসি। আবার ফিরে আসি
চৌতারি রিসোর্টে।
পরদিন সূর্যোদয় দেখার স্পট
নির্ধারণে আমরা পর্যবেক্ষণ শুরু করি। চৌতারি কতৃপক্ষ জানালেন তাদের ডাইনিং হলের লবি
হতে নাস্তা করে করে সূর্যোদয় দেখা যাবে। আমাদের রূমের উপরে পাহাড়ের ধাপ কেটে কেটে
হোটেলটি নির্মিত। আমরা বেয়ে ছাদে উঠি। এক ভূতুড়ে পরিবেশ। আকাশে চাঁদ দেখা যাচ্ছে।
চা-বাগানের মত যেন এক নির্জন প্রাকৃতিক পরিবেশ। রিসোর্টটির চারপাশে চাঁদ তার
মিষ্টি আলো বর্ষণ করছে। নানা প্রজাতির বৃক্ষপত্র বাতাসে মৃদু দুলছে। নেপালি
তক্ষকের আওয়াজ শুনি। আমার নানাবাড়ি পাতারিয়ার গৃহের কাটের ছাদ হতে নির্জন দুপুরে
কিংবা সন্ধ্যায় ভেসে আসত ককার (তক্ষক) আওয়াজ। সিলেটি তক্ষকেরা চৌদ্দ পনের বার
‘কক্ষা, কক্ষা’ শব্দ করে বন্ধ হয়ে যেত। কিন্তু নগরকোটের তক্ষকের মিষ্টি আওয়াজ এত
তাড়াতাড়ি বন্ধ নাহয়ে বহুক্ষণ বাজতে থাকে। তারপর নির্জনতা বেদ করে কানে বাজে
লক্ষিপ্যাচার গান। সারাটা রিসোর্টে সৌরবিদ্যুতের মৃদু আলোর অজস্র বাতি মনোরম
ভূতুড়ে পরিবেশ সৃষ্টি করে। আমরা বের হয়ে জিন্নুনের কোঠায় ঢুকলাম। জিন্নুন বলল-
মামা এই জায়গাটা জ্বীনে ভরা। বললাম কেনরে ? সে বলল- আমার সামনের এই সিঁড়িতে একটি
জ্বীন বসেছিল, আমি তাকে মানুষ মনে করে পাশে যেতেই অদৃশ্য হয়ে গেছে। আমার কেন যেন
মনে হল তার এ কথাটি সত্যও হতে পারে। কারণ এখানে অসংখ্য বিকট মূর্তির মন্দির রয়েছে।
নানা দেও দানবের পূজা হয়। তাছাড়া নিচের পাহাড়ি গোহা, জনহীন গীরিখাদ, বনজঙ্গলে
জ্বীনভূত থাকতেই পারে। হয়ত এখানে বহুযুগ জ্বীনের আস্থানাই ছিল, পরে বন সাফ করে এই
হয়ত পর্যটন শহর গড়ে উঠেছে। আমার পুত্র জেফার তার দাদার কাছে শুনা জ্বীনের গল্প
বললেন নেপালের এক নির্জন ভুতুড়ে শহরে শীতল সন্ধ্যারাতে সৌরবিদ্যুতের মৃদুমন্দ আলোয়
ভূতের গল্প শুনে ভয়ের সাথে খুব ভালই লাগে। আমি বলি আমার মায়ের কাছে শুনা ভুতের
কাহিনি। আমার নানারা ছিলেন চার ভাই। নানা ছোট সন্থান হিসাবে তার পিতার বড় দিঘিওয়ালা
বাড়িটি পান। সামনে ও পিছনের অন্য দুই বাড়ির মালিক হন অন্যরা। নানার এক ভাইয়ের ছিল
একমাত্র কন্যা। কন্যাকে বিয়ে দিয়ে আম্মার চাচি কয়েকজন বুয়া নিয়ে একাকি বসবাস
করতেন। একদিন রাতে বাইরে এক ভূতুড়ে পাখির ডাক শুনে বিরক্ত হয়ে বল্লেন- শালার পাখি,
দিনে এভাবে যন্ত্রণা দিলে লাটি দিয়ে তাড়া করতাম। বলতেই ঘরের টিনে অজস্র ইস্টক বর্ষণ
শুরু হয়। সবাই ভয়ে এক কোঠায় জড় হয়ে এক বিছানায় আশ্রয় নেন। শেষে ঘরের ভিতরও মাটির
ডিল আসতে থাকে। এভাবে আমার মায়ের চাচি এক দুর্বিসহ রাত অতিবাহিত করেন। মনে মনে
ভাবলাম নেপালে এসে এভারেস্টের চূড়ায় উঠলাম, প্যারাস্যুটে পাখির মত উড়লাম, এবার
বুঝি জ্বীনও দেখা হয়ে যাবে। বাহিরে গিয়ে অনেকক্ষণ জ্বীন দেখার আশায় ঘুরাঘুরি করি।
দূরের সুউচ্চ রিসোর্ট হতে কিছু বাংলাদেশী শিশুর গলার আওয়াজ শুনলাম। এখানে
হারমোনিয়ামের সুরের সাথে নির্জনতা বেদ করে কিছু বাংলা গানের সুর কানে আসে। কিন্তু
কোন জ্বিনের দেখা পেলাম না। আমার কক্ষে গিয়ে আমরা ডাঃ নুরজাহান বেগমকে বলি এখানে
তো প্রচুর জ্বীন এদিক ওদিক একা একা বসে আছে। তোমার কক্ষে এসে কোন যন্ত্রণা করে নাইতো।
বললেন না আমাদেরকে কোন জ্বিন এসে যন্ত্রণা করে নাই। এবার তিনি জ্বীন দেখতে উৎসুখ
হয়ে কক্ষ হতে বেরিয়ে আসেন। জিন্নুন অন্ধকার ডালের দিকে আঙ্গুল নির্দেশ করে বলল- ঐ
দেখুন দালে জ্বীনেরা বসে আছে। বলতেই ভুদৌড়ে কক্ষে ঢুকে দরজা বন্ধ করেন। বালকবেলার
রাতে আমরা সবাই বসে ভুতের গল্প বলতাম এবং ভয়ে শিহরিত হতাম। আমরা বিশ্বাস করতাম
ভূতের কাহিনি মিথ্যা নয়, নিরেট সত্য। আজ পৌড় বয়সে নেপালের পাহাড়ি ভূতুড়ে নগরকোট
শহরের চৌতারি রিসোর্টে আবার সেই ভুতের গল্প আমাদেরকে রুমাঞ্চিত করে।
নগরকোটের সূর্যোদয় দেখতে খুব ভোরে
ঘুম হতে উঠি। একজন মাত্র প্রহরী হাঁটছেন। চারপাশে কোকিল, ঘুঘু, প্যাচা, তক্ষকসহ
নানা প্রজাতির পাখির কলরব। আমরা সিড়িবেয়ে আমাদের হোটেলের ছাদে যাই। কিন্তু সুবিধে
হচ্ছেনা দেখে নেমে আসি। সামনে আরেক পাহাড়ের এক ভবন বারান্দায় যাই। ঐ স্থান আমাদের
ভবনের ছাদের উপরে অবস্থিত। একটি খাড়া গীরিখাদের কিনার ঘেষা আঙ্গিনা। নানা প্রজাতির
ফুল ফুটে আছে। সামনের ভবনের ছাদে আরোহন করি। অনেক দূরের বরফ পাহাড় আলোকিত হয়ে উঠে।
মাইল দেড়েক নিচে পাহাড়গুলো ধাপে ধাপে উঠে আট দশ মাইল দূরে আকাশ ছুঁয়েছে। কি অপূর্ব
দৃশ্য। সেইসাথে ফাগুনের শীতল হাওয়া। ঘন্টা খানিক ছবি তুলি। সেখানে এক ভারতীয়
যুবকের সাথে দেখা হয়। সে আমাদের ফটো তুলে ও আমরা তার ফটো তুলে দেই। তারপর নেমে এসে
চারপাশে বাগানে। ফ্লাওয়ার বক্সে ফুটে থাকা ফুলের রূপ সৌন্দর্য্য পর্যবেক্ষন করি। ফ্লাওয়ার
কক্সে ফুটা এক জাতের ফুলেরর ছয় পাপড়িতে একদম একটি প্রজাপতির ছবি অঙ্কিত রয়েছে।
অন্য আরেক প্রজাতির ফুলের পাপড়িতে প্যাচার মুখ ভেসে রয়েছে। প্রকৃতিতে এই বিস্ময়কর
ফুল দেখে স্রষ্টার সৃষ্টির মহিমা হৃদয়ে জাগরিত হয়। পাশের হোটেলের সাদাফুলের গাছটা
প্রজাপতিতে ছেয়ে আছে। ব্রেকফাস্ট করে বের হই। পাশের ইকোপার্কে প্রবেশ করি। পাইনসহ
নাম নাজানা নানা প্রজাতির বৃক্ষ রয়েছে। জায়গাটি এতই নির্জন যে আমরা তিন জন ছাড়া কোন
লোক নেই। নিরাপত্তার জন্য আমরা তিনজনের হাতে তিনটি গাছের ডাল নেই। বনটি
ক্রমান্ব্যে নিচের দিকে নেমে গেছে। আমরা বুনো রাস্থা বেয়ে অনেক নিচে নেমে যাই
কিন্তু নিচ কোথায় গিয়ে শেষ হয়েছে তার কোন হাদিছ নেই। আমাদেরকে ভয় পেয়ে বসে। বুনো
পশু কিংবা ডাকাত যদি এসে পড়ে, তবে কে এসে রক্ষা করবে। তবে নেপালে ডাকাত নেই।
নেপালিরা দারূন ভদ্র ও অতিথি পরায়ন। কিন্তু বাঘ-বালুকের হামলা হলে কেউতো বাঁচাতে
আসবেনা। বনটি হয়তো আর দুই তিন মাইল নিচে চলে গেছে। নিচে নামা খুব সহজ কিন্তু উপরে
উঠে আসা এত সহজ নয়, তাই আবার আমরা উপরের দিকে ফিরে আসা শুরু করি। বিকেল ৩টায়
কাটমন্ডু ত্রিভূবন বিমানবন্দরে আমাদের ফিরতে হবে। শেষবারের মত এই সুন্দর জায়গাটি
দেখতে বের হই। ডাঃ নুরজাহান তার মক্কা হতে নিয়ে আসা হেজাব পরে বের হন। তিনজন ইংরেজ
নারী সিগারেটে সুখটান দিয়ে রাস্থায় হাঁটছেন। একটু পার হয়েই একজন বলছে এ মুজলেম
ওউমেন। জিন্নুন বলল- মামি এখানে আমাদের সংস্কৃতি তুলে ধরছেন। নেপালে মুসলিম
নরনারীর দেখা মেলা ভার। তারা হয়ত এই প্রথম কোন মুসলিম নারীকে নেপালে দেখেছে ও সাথে
সাথে চিনে ফেলতে পেরেছে- এ মুজলেম ওউমেন।
নগরকোটের অধিবাসীরা পাহাড়ের বুকে
টেরাকোটা কেটে কেটে এক একটা বাড়ি তৈরি করেছে। পাহাড়ের সরু ও উঁচু-নিচু ঢালুপথ দিয়ে
চলাচলে খুবই দক্ষ এই গ্রামের সাধারণ মানুষ। শিশু ও নারীরা পুরুষের পাশাপাশি কাজে
অংশগ্রহণ করে থাকে। মানুষের জীবনধারা অত্যন্ত সাদামাটা হলেও প্রশান্তিতে ভরপুর।
প্রতিটি বাসিন্দার মুখই বলে দেয় কতটা আনন্দে জীবনযাপন করছে তাঁরা। জীবিকা
নির্বাহের জন্য হোটেল-রিসোর্টে কাজ করে এবং পাহাড়ের ঢালে খাদ্যশস্য উৎপাদন করে
তাঁরা। বসতি কম হওয়ায় এখানকার বাসিন্দারা পরস্পর সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে
খুব শান্তিতে বসবাস করে।
আমরা নেপালের প্রাচীন রাজধানী
ভক্তপুর দেখার জন্য সকাল ১১টায় নগরকোট হতে বের হই। পথেই ভক্তপুর। ট্যুরের ড্রাইভার
ভক্তপুর দেখাতে রাজি হন। ঘন্টাদেড়েক পর এই প্রাচীন রাজধানী শহরে এসে আমাদের গাড়ি
থামে।
নেপালের সুপ্রাচীন রাজধানী
ভক্তপুর অষ্টম শতাব্দীর প্রথম দিকে নির্মিত শহর। শহরটি বারশত বছর আগের স্থাপত্যকলায়
সমৃদ্ধ। শত শত বছর কাটমন্ডুর সন্নিকটবর্তী এই শহরটি ছিল নেপালের রাজনীতির কেন্দ্র।
নেপালিরা সাহসী পাহাড়ি জাতি। অকুতভয় গোর্খারা কুকড়ি চালিয়ে শত্রুদেরে সব সময় রুখে
দিত। দুর্গম পাহাড় পর্বত অতিক্রম করে ঘোড় সওয়ার বাহিনী নিয়ে নেপাল আক্রমণ করা এত
সহজ ছিলনা। কেউ কেউ নেপালরাজকে শায়েস্তা করার জন্য অভিযান পরিচালনা করলেও তেমন সফল
হননি। নেপালের রাজমালা হতে জানা যায় কেবলমাত্র বাংলার শ্রেষ্ট স্বাধীন সুলতান
আলাউদ্দিন হোসেন শাহ চৌদ্দ শতকে একবার কাটমন্ডু আক্রমণ করে শহরটি পুড়িয়ে দেন।
কিন্তু তিনি দেশটি দখলে রাখতে পারেননি।
আমরা টিকেট কেটে ভক্তপুর
রাজবাড়িতে প্রবেশ করি। ভিতরে একটু উঁচু স্থান বেয়ে উপরে উঠি। প্রথমে পাই দরবার
স্কয়ার। ইস্টকে নির্মিত উঁচু গৃহ। ছাদ টিন নির্মিত। জানালা ৫৫টি। পশু, পাখি ও জীব
জন্তু আকৃতির নানা কারুকাজ। সর্বত্র বিশাল বিশাল বাঘ ও সিংহ মূর্তি। তারপর তামাদি
স্কয়ার। এখানে অসংখ্য সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে একটি দ্বি-ছাদ চতুস্কোন ঘর। সবশেষে পটারী
স্কয়ার। এখানে প্রাচীন নেপালীদের অবিস্মরণীয় কাটের কারুকাজ। প্রাচীন স্থাপত্যের
আশপাশে দোকানীরা নানা সামান বিক্রি করছেন। সময় অল্প তাই বেশী ঘুরাফেরা নাকরে
গাড়িতে ফিরে আসি।
১০মে ২০১৪ সাল। বিকেল ২টায় আমরা
ত্রিভূবন বিমান বন্দরে চলে আসি। মালয়েশিয়াগামী প্রচুর নেপালি যাত্রি নিয়ে বিমানটি
বিকেল ৪টা ৩০মিনিটে উড্ড্যন করে এবং ৫টা ৪৫ মিনিটে ঢাকা শাহজালাল বিমানবন্দরে
অবতরণ করে। আমার সমন্দিক আজিজ আহমদ চৌধুরী এবং ভাবী আনিকা চৌধুরী তাদের গাড়ি নিয়ে
বিমানবন্দরে হাজির হন। তাদের সাথে নেপালের নানা গল্প করে করে ধানমন্ডি লেকপারের
বাসায় চলে যাই।
এখন আমি নেপাল এবং নেপালের জনগন
নিয়ে আলোচনা করব। দেশটির জনসংখ্যা মাত্র ২ কোটি ৭০ লক্ষ। জনতার ৭৯% হিন্দু, ২০%
বৌদ্ধ এবং ১% অন্যান্য ধর্মাবলম্বী। বহুযুগ ধরে দেশটিতে রাজতন্ত্র ও সামন্ততন্ত্র
বিদ্যমান ছিল। ধনী ও গরীবের বৈষম্য প্রবল ছিল। পাহাড়ি দুর্গম দেশ হিসাবে এখানে
সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তন অল্পই সংঘটিত হয়। রাজা ও সামন্ত প্রভূরা হিন্দু
ধর্মকে নিজেদের শাসন ও শোষণ বহাল রাখার কাজে ব্যবহার করে। বুকের প্রচুর রক্ত ঢেলে
মাওবাদীরা রাজতন্ত্র, সামন্ততন্ত্র ও রাজনীতিতে ধর্মের অপব্যবহার পুরাপুরি অপসারণ
করতে সমর্থ্য হয়। যে নেপাল যুগের পর যুগ রাজতান্ত্রিক হিন্দু রাষ্ট্র ছিল তা এখন
একটি ধর্মনিরপেক্ষ বহুদলীয় গনতান্ত্রিক রাষ্ট্র। আট দশ বছর আগে জিন্নুন যখন নেপাল
সফর করে তখন সেনাবাহিনীর গাড়ি আগপিছ কর্ডন করে বিদেশিদের ট্যুরিস্ট বাস পুকরা নিয়ে
যায়।
এখন নেপালে পুরাপুরি শান্তি
বিরাজ করছে। নেপালের হিন্দু ধর্ম ভারতের চেয়ে যথেষ্ট ভিন্ন। বুদ্ধের মত একজন
মহাপুরুষ যে একজন নেপালি, তা নিয়ে নেপালের প্রতিটি মানুষ গর্বানুভব করে এবং
প্রতিটি নেপালি গৌতম বুদ্ধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আসলে নেপালের ধর্ম হল বৌদ্ধ ও
হিন্দু ধর্মের এক সম্মিলিত মিথষ্ক্রিয়া। দুইধর্মের এক অপূর্ব সম্মিলিত সহাবস্থান।
দুই ধর্মের বিশ্বাসে জন্মান্তরবাদ আছে। বৌদ্ধ ধর্মের নির্বাণ লাভ ও হিন্দু ধর্মের বৈকুন্ঠলাভ
মূলতঃ একই জিনিস। বৌদ্ধরা প্রার্থনা করেন
বৌদ্ধমূর্তি সামনে রেখে, আর হিন্দুরা তা করেন নানা দেবদেবীর মূর্তি সামনে রেখে।
আমার মনে হয়েছে এযুগের নেপালিরা ধর্ম নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামায়না। খুব ভোরে পুকরা
মন্দিরে মাত্র একজন নারী পূজারীর দেখা পাই। যিনি মন্দির ঝাড়ু দিয়ে দেবতার সামনে
কিছু ফুল রেখে দেন ও হাত জোড় করে মাথা একটু নিচু করেন। মনে হল মাওবাদীদের বিজয়
নেপালকে ক্রমান্বয়ে ধর্ম হতে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। নেপালিদের জীবনে ধর্মের প্রভাব
ক্রমশই ক্ষীণ হয়ে আসছে। নেপালে নারীর অবস্থান বেশ সম্মানজনক। মাছ ধরা, কৃষিকাজ,
হোটেল ব্যবসা ব্যবস্থাপনা, পর্যটন সংস্থা সর্বত্র নারীরা সাফল্যের সাথে কাজ করে
যাচ্ছেন। পুকরা লেকে জাল ফেলে মাছ ধরা, সাংসারিক কাজের সহিত গৃহপালিত পশুপাখি
পালনের কাজ মেয়েরা অবলীলায় করে যাচ্ছেন। নেপালি মেয়েরা পশ্চিমা নারীদের মত নগ্ন
নন, আবার আরবদের মত আবৃত নন। অনেক ক্ষত্রে তারা পুরুষের চেয়ে অনেক বেশী শ্রম দিয়ে
যান। নেপালিরা আমাদের চেয়ে গড়ে অনেক সুদর্শন ও ফর্সা। তারা হালকা পাতলা গঠনের
অধিকারী। চীন সীমান্তের লোকজনকে চাইনিজ মনে হয়। প্রায় নেপালি নামের শেষে বাহাদুর,
থাপা, নরগে এধরনের শব্দ রয়েছে। এই বাহাদুরেরা মাঝে মধ্যে প্রাকৃতিক বিপর্য্যের
শিকার হয়। সেপ্টেম্বর অক্টোবরে প্রচন্ড বর্ষায় হঠাৎ পাহাড় ধ্বসে পড়ে। অসংখ্য জনপদ
মাটির গভীর তলিয়ে যায়। শত শত মানুষ মারা যায়। তাদের বাড়ি মাটি ও ইস্টক নির্মিত
কিন্তু দ্বিতল। মই বেয়ে ছাদে উঠে তারা ঘুমায়। খুব সম্ভব হিংস্র প্রাণী ও সাপ
বিচ্ছু হতে রক্ষা পেতে তারা এভাবে বাড়ি-ঘর বানায়। দেশটি উন্নয়নে আমাদের চেয়ে অনেক
পিছিয়ে আছে। দেশটির প্রধান আয়ের উৎস পর্যটন। নেপাল হল পর্বত টেকিং (পর্বতারোহন),
প্যারাস্যুট গ্রাইডিং, রাফটিং (খড়স্রোতা নদীতে নৌকা চালানো) ইত্যাদির জন্য এক
স্বর্গরাজ্য।
নেপাল কৃষিপ্রধান দেশ হলেও এখানে
শস্য ফলানো খুবই কঠিন কাজ। দেশের পূর্বদিকে চা-চাষ হয়। অন্যান্য অংশে ভুট্টা, গম,
কলা ও ইক্ষু জন্মে। শস্যচাষে নেপালিরা আমাদের চেয়ে কয়েকগুণ বেশী পরিশ্রম করে থাকে।
নেপালের অনুন্নয়নের আরেক কারণ তাদের সমুদ্র নেই। তারা আমদানি ও রপ্তানির জন্য
ভারতের উপর নির্ভরশীল। মাওবাদিরা ক্ষমতায় আসার পর ভারত হতে অস্ত্র না কিনে চিনে
অস্ত্র আমদানি করায় ভারত নাখোশ হয় এবং নেপালে জ্বালানী তৈল সরবরাহ বন্ধ করে দেয়।
নেপাল একেবারে নাস্তানাবুদ অবস্থায় আপতিত হয়।
নেপাল ও ভারত এই দুই দেশের
যাতায়াতে কোনপক্ষের ভিসার প্রয়োজন হয়না। ভারতীয় রুপিতে নেপালে লেনদেন করা যায়। এমন
কি নেপালের লোকেরা ভারতীয় সেনাবাহিনীর গোর্খা রেজিমেন্টে চাকুরীও করতে পারে।
নেপালের কৃষ্টি ও সংস্কৃতি আমার
মনে হয়েছে ভারতের আগ্রাসনের শিকার। নেপালিরা
নেপালি এবং হিন্দি এই দুই ভাষায় অভ্যস্থ। নব্বুই ভাগ নেপালি ভারতীয় টিভি চ্যানেল
দেখেন। আমি দুইটি নেপালি ইংরেজি পত্রিকা পড়ি- ‘The Himalayan’ ও ‘The Katmondu post’ দুটি পত্রিকাই নেপাল ও ভারতের
সংবাদে ঠাসা। তাদের মূল আকর্ষণের দেশ তিনটি- ভারত, চীন এবং পাকিস্তান। খেলার খবরে
শ্রীলঙ্কার রমরমা অবস্থান। বাংলাদেশকে তাদের পত্রিকার পাতায় খুঁজে না পেয়ে বেশ
মনঃক্ষুন্ন হই। কারণ আমরা তো সার্কের সদস্য ও তাদের নিকট প্রতিবেশী। নেপালের অনুন্নয়নের
অন্যতম কারণ হল দুর্গম পর্বতমালা, এখানে রাস্থা নির্মাণে আমাদের চেয়ে অনেক বেশি
টাকার প্রয়োজন। আমাদের মত সরলরেখায় রাস্থা নির্মাণ সম্ভব নয়। বিশ মাইল দূরের কোন
জায়গায় হয়ত চল্লিশ মাইল ঘুরে যেতে হয়। ফলে পণ্য পরিবহন ও মানুষের যাতায়াত আমাদের
দেশের চেয়ে অনেক ব্যায়বহুল ও কষ্টকর। তবে নেপালের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। এখানকার
খরস্রোতা পাহাড়ি নদী কুশি, নারায়নি, কর্নালি হতে স্থানে স্থানে প্রচুর জলবিদ্যুৎ
উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে।
নেপালের জনশক্তির ৭৬% কৃষি, ১৮%
সার্ভিস এবং মাত্র ৬% ম্যনুফ্যাকচারিং কাজে নিয়োজিত আছেন। দেশটি এখনও কৃষি নির্ভর।
প্রতি বৎসর দেশটিতে গড়ে ছয় সাত লক্ষ বিদেশী পর্যটক আসেন। ২০১২ সালে পর্যটক আসেন
৫,৯৮,২০৪ জন।
নেপালের সবচেয়ে বড় সম্ভাবনা হল
দেশ্তির বর্তমান দুর্নীতিমুক্ত রাজনীতি। দেশটির আমলাতন্ত্র অন্য দশটি স্বল্পন্নোত
দেশের মত তেমন উন্নত না হলেও সৎ ও দুর্নীতিমুক্ত। বর্ত্মান প্রেসিডেন্ট রামবরণ
যাদবের সম্পদের তালকা তৈরি করতে যেয়ে প্রেসিডেন্ট ভবনের কর্মচারিরা তার হিসাবে কোন
টাকা পাননি। কাটমন্ডু শহরে তার কোন বাড়ি নেই। তিনি ভাড়া বাসা ছেড়ে এসে প্রেসিডেন্ট
ভবনে ঢুকেন। প্রধানমন্ত্রী সুশীল কৈরালারও কোন দুর্নীতির ইতিহাস নেই। তাই একসময়
নেপাল যে অনেক উপরে উঠে আসবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
নেপাল আমাদের চেয়ে দরিদ্র দেশ
অথচ আমাদের মত এত ভিক্ষুক নেই। নেই আমাদের মত রিকশা ও ঠেলাগাড়ি জাতীয় অযান্ত্রিক
যানবাহনের আধিপত্য। খুব সম্ভব উঁচুনিচু ভূমিরূপের করণে এধরনের পরিবহনের প্রচলন
নেপালে হয়নি। ফলে নেপালের যোগাযোগ ব্যবস্থা আমাদের চেয়ে অধিক যানজটমুক্ত ও আধুনিক।
আমি ‘The Katmondu
post’ পত্রিকার এক প্রতিবেদনে সড়ক দুর্ঘটনায় তাদের মৃত্যুহারের
একটি পরিসংখ্যান পাই। প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় মাত্র ১০/১৫ জন লোক নেপালে মারা
যান। ২০১৩ সালে এই সংখ্যা ছিল মাত্র ১৩ জন। অথচ ঢাকায় এসে খবরে দেখি এক লঞ্চ
দুর্ঘটনায় ৫৫টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে, যা নেপালের ২০১৩ সালের সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত
সংখ্যার ৪ গুণেরও বেশি। এত দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল হওয়া সত্ত্বেও নেপালের সড়ক আমাদের
চেয়ে অনেক বেশি নিরাপদ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন