সোমবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

জন্মস্থান চৌধুরীবাজার শাখায় বদলির আদেশঃ

 জন্মস্থান চৌধুরীবাজার শাখায় বদলির আদেশঃ   

আমার বয়স পঞ্চাশ ছুই ছুই করছে, বাড়ি হতে বেরিয়ে আসার হয়ে গেছে প্রায় কুড়ি বছর। জন্মগ্রামে আবার ফিরে যাবো কখনো মাথায় আসেনি। এই শাখায় আমি ১৯৯২ ও ১৯৯৩ সালে ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপক হয়ে কাজ করেছি কয়েকবার বেশ দীর্ঘ্য সময়। শাখার প্রথম ব্যবস্থাপক আব্দুল ওয়াহিদ বলতেন কুরেশি সাহেব আপনি এখানে স্থায়ী ব্যবস্থাপক হয়ে চলে আসেন। একবার কয়েকমাস ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপক হয়ে এই শাখায় ছিলাম। সিলেট অঞ্চল প্রধান উপমহাব্যবস্থাপক আব্দুল মজিদ স্যার একদিন আমাকে বললেন, কুরেশি সাহেব কিছুদিনের মধ্যে আপনাকে আমি এই শাখার স্থায়ী ব্যবস্থাপক করে দেব।

আমি স্থায়ী ব্যবস্থাপকের আদেশ পাবার অপেক্ষায় আছি, এমনই একদিন আমার চাচাতো ভাই ব্যাংকের চেয়ারম্যান ই এ চৌধুরী বাড়ি আসেন। তিনি ফেরার পথে শাখায় তার শাহি পদধুলি দিলেন। তিনি আমার সামনে খানিকক্ষণ বসলেন, দু চার কথা আলাপ করলেন। সামনের চেয়ারে কয়েকজন লোক বসা ছিল। তারা সালাম দিয়ে সরে গেল। এবার যে কথাটি বললেন তা হল, তুমি কি এখানে? নিজ বাড়িতে চাকুরি করা ঠিক নয়। পরিচিত লোকজন উলটো পালটো আবদার নিয়ে আসবে, বিপদে ফেলবে, আড্ডাবাজি করে সম্মান নষ্ট করবে।

কিছুদিনের মধ্যেই চৌধুরীবাজার শাখার ব্যবস্থাপকের পরিবর্তে আমি দ্বিতীয় কর্মকর্তা হিসাবে কদমতলী শাখায় বদলির আদেশ হাতে পেলাম। চৌধুরীবাজার শাখার স্থায়ী ব্যবস্থাপক হবার স্বপ্ন আমার পুর্ণ হলনা, এই স্বপ্ন আমার স্বপ্নই রয়ে গেল।

আমি জানতাম মহান আল্লাহ মানুষের স্বপ্ন কখনও অপূর্ণ রাখেন না। একদিন না একদিন তিনি তা বাস্তব করে দেন। তবে ১৯৯২-৯৩ সালের প্রায় ভূলে যাওয়া আমার সেইস্বপ্ন আল্লাহ যে ২০১৫ সালে প্রৌড় বয়সে পূর্ণ করবেন তা ছিল অকল্পনীয়। তাও মাঝখানে বহে গেছে সুদীর্ঘ্য বাইশটি বছর। সেইদিন খুশী হয়ে চেয়েছিলাম ব্যবস্থাপক হতে, আর এখন সেখানে ব্যবস্থাপক হতে চাইনি অথচ যেতে হল বিষন্ন মনে, অপমানের গ্লানী কাঁধে নিয়ে নিতান্ত বাধ্য হয়ে। যখন চেয়েছি তখন পাইনি, এখন চাইনি অথচ এসে কাঁধে চেপে বসেছে সেই তাসের রানি।  

এবার সেই কাহিনি বলব। সিলেট আঞ্চলিক অফিস ইস্টে আমার যোগদানের এক বছর এখনও পূর্ণ হয়নি। একদিন আমার অদূরদর্শী বস সিরাজুল হক চৌধুরী আমাকে বললেন, কুরেশি সাহেব আপনাকে চৌধুরীবাজার শাখায় পাঠিয়ে দিলে কেমন হয়? আমি বললাম আমিতো সিলেট শহরে থাকি, আমার বাসা হতে এবয়সে প্রায় দশ মাইল রোজ রোজ দৌড়াতে হবে আমাকে? গ্রামের বাড়ি এখন গোদাম ঘর, সেখানে একাকি বসবাস করা সম্ভব নয়। বললেন আপনার গাড়ি আছে, গাড়ি নিয়ে যাবেন। জবাবে বললাম এই গাড়ি আমার ডাক্তার পত্নী ব্যবহার করেন, আমি তা নিয়ে যেতে পারবনা। তার সাথে আলোচনা করে একটি গাড়ি স্টাফ ঋণ অঞ্চলিক অফিসে ইতিমধ্যে আমার পেশ করা ছিল। ভাবলাম তিনি হয়ত এটি পাঠিয়ে নতুন গাড়ি আমাকে সরবরাহ করে দিবেন।  

আমার মনে হল বস সিরাজুল হক চৌধুরী হয়ত আমার সাথে রংতামাশা করছেন। হয়ত এটি তার মনের কোন সিন্ধান্ত নয়। কারণ শহরে এত শাখা থাকতে একজন মুরব্বী সহকারি মহাব্যবস্থাপক আমাকে কেন শহর হতে এত দূরের গ্রামের একটি গুরুত্বহীন শাখায় পাঠাবেন, যেখানে আমি সাফল্যের সাথে শহরের শাখাগুলোতে প্রায় এক দশক ব্যবস্থাপনা করেছি। দুইবার ব্যাংকের শ্রেষ্ট ব্যবস্থাপকের পদক পেয়েছি। আমার ফাইলে কোন দাগ নেই। আজ পর্যন্ত আমার কোন পদোন্নতি বাদ যায়নি। আমি যে সব শাখায় গিয়েছি, সেই শাখাগুলার উন্নতি হত শনৈ শনৈ করে। তাছাড়া চৌধুরীবাজার শাখা ব্যবস্থাপনায় একজন প্রিন্সিপাল অফিসারই যথেষ্ট।   

এবার মৃদু গুঞ্জন শুনলাম আমাকে চৌধুরী বাজার পাঠিয়ে দেওয়ার আয়োজন চলছে। আমি বসের চেম্বারে ঢুকে বললাম চৌধুরীবাজার শাখায় আমি বাইশ বছর আগে দীর্ঘ্য সময় ব্যবস্থাপক ছিলাম। এখন আবার ব্যবস্থাপক হয়ে সেখানে গেলে লোকে কি ভাববে? এত বছর চাকুরি করে এসে বুড়ো বয়সে আবার সেই একই জায়গায়। আমাদেরকে এই অঞ্চলের সবাই মূলে-উপমুলে-প্রতিমূলে চেনে। আমাদের সম্পর্কে উচ্চ ধারনা পোষণ করে। আমাকে চৌধুরীবাজার শাখার চেম্বারে দেখলে তাদের সেই উচ্চধারনা ধুলিস্যাৎ হয়ে যাবে। আমি একজন কবি ও লেখক। সক্রেটিস, মুহাম্মদ(সঃ), ডঃ মুহাম্মদ ইউনুস, তসলিমা নাসরিনসহ অনেক জীবিত মহানদেরকে নিজদেশে বিড়ম্বিত হতেও দেখা যায়। তাই আমাকে চৌধুরীবাজারে আদৌ পাঠানো ঠিক হবেনা।   

আমি বস সিরাজ সাহেবকে ইশারা দিলাম, আমাকে চৌধুরীবাজার শাখায় না পাঠিয়ে বরং দরগাগেট শাখার ব্যবস্থাপক করে দিলে খুশী হব। এই শাখায় আমি অতীতে দু’বছর কাজ করেছি। এটি আমার জন্য হবে সম্মানের, তাছাড়া এখানে বসে ব্যাংককে আমি দিতেও পারব অনেক। তাছাড়া চৌধুরীবাজার শাখায় বদলি আমার উপমহাব্যবস্থাপক পদে পদোন্নতির জন্যও আদৌ উপযুক্ত নয়।  

আমি সহজে আল্লাহ ছাড়া কারও কাছে কোন কিছু চাইতে যাইনা। কারো কাছে হাত পাতা, ঋণ চাওয়া, সুপারিশ চাওয়া আমার নীতিবিরূদ্ধ কাজ। আমার কথায় চিড়ে ভিজছেনা দেখে এবার নিতান্ত বাধ্য হয়ে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল হালিম চৌধুরীর পত্নী আমার ফুফুতো ভাইয়ের কন্যা রহিমা চৌধুরী রিপার কাছে ফোনে সব জানিয়ে প্রতিকার চাই। রিপা এমডিকে অবগত করেছে কিনা জানিনা কিন্তু ঢাকা হতে আমার বদলির আদেশ পাঁচ সাত দিনের মধ্যে সিলেটে এসে যায়। আমার ধারনা হল এমডির মতামত নিয়েই বস সিরাজ সাহেব এই বদলির আদেশ করেছেন। এবার এমডিকে ফোন করলে তিনি জবাব দেন আমার কিছু করার নেই। সব বুঝিয়ে বলার পরও এমডির এই আচরণ আমাকে খুব বিষ্মিত করে। এই আদেশ পেয়ে আমার এতই রাগ হল যে, হাতে তিনচার দিন সময় থাকা সত্বেও এইদিনই আমি আঞ্চলিক অফিস সিলেট-পূর্ব হতে রিলিজ আদেশ নেই। বিকেলে ঘরোয়া পরিবেশে সহকর্মীদেরকে নিয়ে ছোট্ট বিদায়সভায় চানাস্তা করে বিরক্ত মনে বেরিয়ে আসি। সভায় বললাম আমার মাবাবা আজ দাউদপুরের মাটিতে ঘুমিয়ে আছেন। তারা হয়ত আমাকে ডাকছেন, তাই তাদের কবর জেয়ারত করাতে মহান আল্লাহ আমাকে এই পাড়াগাঁয়ের শাখায় বুড়োকালে পাঠিয়ে দিচ্ছেন।          

যে ব্যাঙ্কিং ডিপ্লোমা দিতে আমি অনিচ্ছাসত্বেও শাখা ব্যবস্থাপনা হতে উঠে আঞ্চলিক অফিসে সাময়িক চলে আসি, সেই পরীক্ষা দিতে গিয়ে টের পাই ব্যাঙ্কিং ডিপ্লোমা যত সহজ মনে করেছিলাম আসলে তত সহজ নয়। প্রতিটি বিষয়ে শতমার্কের মধ্যে পাসমার্ক পঞ্চাশ, যা অর্জন বেশ কঠিন। ব্লুবার্ড স্কুলে প্রথম পর্ব পরীক্ষা দিয়ে ছয় বিষয়ের মধ্যে পাঁচটি একসাথে উত্তীর্ণ হই। বয়স হয়ে যাওয়ায় পরীক্ষাহলে প্রবেশ ছিল বেশ লজ্জাকর। তাই চাইলাম বিষয়টা দ্রুত সমাপ্ত হউক। কিন্তু সেই সময়টা আমার ভাগ্যে জুটলনা। তবে চৌধুরীবাজার শাখায় গিয়ে পরবর্তী ডিসেম্বরে সিলেট ব্লুবার্ড স্কুল ও কলেজে কেবল একাউন্টিং পরীক্ষা দিতে যাই। আমি তখন এই বিদ্যায়তনের গভর্নিংবডির সম্মানিত সদস্য। মুরব্বী মানুষ আমাকে ব্লুবার্ডের শিক্ষকরা পরীক্ষার হলে দেখে কিছুটা হতচকিত হন।  আমি পরীক্ষা দিয়ে কোনদিকে না তাকিয়ে চুপেচুপে চলে আসি। যাক এবার একাউন্টিং উত্তীর্ণ হয়ে ব্যাংকিং ডিপ্লোমা প্রথমপর্ব জেএআইবিবি পার হলাম। তবে এই জেএআইবিবি সার্টিফিকেট হেডঅফিসে জমা দিয়ে যখন বিশ হাজার টাকা পুরস্কার পাই, তখন আমি মৌলভীবাজার আঞ্চলিক অফিসে কর্মরত এবং পাসের মিষ্টান্ন খায় সেই অফিসের ভাগ্যবান সহকর্মীরা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন