সোমবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

উমরা পালনে দ্বিতীয়বার সৌদি আরব গমন। হৃদয়ের ভাবাবেগে পরম শ্রদ্ধায় আবার দেখা পবিত্র কাবাঘর ও রসুলের রওজা মোবারক। এবার প্রথম দেখলাম হেরা গোহা ও জ্বীনের উপত্যকা।

 উমরা পালনে দ্বিতীয়বার সৌদি আরব গমন। হৃদয়ের ভাবাবেগে পরম শ্রদ্ধায় আবার দেখা পবিত্র কাবাঘর ও রসুলের রওজা মোবারক। এবার প্রথম দেখলাম হেরা গোহা ও জ্বীনের উপত্যকা।   

যাত্রাঃ ১৪ ডিসেম্বর ২০১৬, ফেরাঃ ২৯ ডিসেম্বর ২০১৬, অবস্থানঃ ১৫ দিন

 

আমাদের একমাত্র সন্থান জেফার কুরেশী এইচ এস সি (বিজ্ঞান) পাশ করে নর্থইস্ট মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হলে আমার গিন্নী ডাঃ নুরজাহান বেগম চৌধুরী মহান আল্লাহ পাকের দরবারে শোকরিয়া আদায়ে ছেলেকে পবিত্র কাবাঘর ও রসুলের রওজায় নিয়ে যেতে উদগ্রীব হয়ে পড়েন। আমাদের সাথে সহযাত্রি হন ছোটবোন মান্না, ছোটভাই জালালাবাদ গ্যাসের ডিপোটি ম্যানেজার নিশাত কুরেশী, তার পত্নী প্রাইম ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার ফাহমিদা হোসেন লোমা ও তাদের ছোট্ট মেয়ে জাইমা কুরেশী।

আমরা লতিফ ট্রেভেলসের পঞ্চাশ সদস্যের এক কাফেলায় শরিক হই। মহান আল্লাহ পাকের দরবারে অশেষ শোকরিয়া তিনি আমাদেরকে আবার তার পবিত্র কাবাঘর ও রসুলের রওজায় সপরিবারে তওয়াফের সৌভাগ্য দান করেন। ১৪ ডিসেম্বর ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দ হজরত শাহজালাল(রঃ) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ইহরাম বেঁধে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ে আমরা বাংলাদেশ বিমানে আরোহন করি। মনে পড়ে ২০১০ সালে ফরজ হজ্জ আদায়ে এখানে আমরা অনুরূপ ইহরাম বেঁধে ‘লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক অর্থাৎ আমি হাজির ,প্রভূ আমি হাজির’ জপে জপে বিমানে আরোহন করেছিলাম। এ এক দারূন অনুভূতি। ঐশ্বরিক আলো এসে মনকে আচ্ছন্ন করে দেয়। মহান আল্লাহের মেহমান আমি- ভাবতেই মনটা পুলকিত হয়ে উঠে। মনে হয় আমি মেহমানকে আল্লাহ যেন দাওয়াত দিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন তার পবিত্র কাবাঘরে।

ভোরের আজানের বেশ আগে আমরা জেদ্দা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করি। ফজরের আজান হলে বিমানবন্দরের জামাতে নামাজ পড়ে মক্কা যাবার জন্য বাসে আরোহন করি। আমাদের গাইড হাসান আব্দুল্লাহ যেন একজন দাড়িবিহীন হুজুর। তার বাসা সুবিদবাজার। বাসের মাইকে তিনি উমরা হজ্বের নিয়ম কানুনের সাথে সব প্রয়োজনীয় ধর্মীয় বিষয়ে বিজ্ঞ আলেমের মত আরবী-বাংলার মিশ্রনে বয়ান পেশ করেন। পুরো পথেই তিনি হ্যান্ডমাইকে আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক তালবা পড়েন এবং সাথীরা সমস্বরে উচ্চারণ করেন। বাস মক্কায় প্রবেশ করে কাবাঘরের পাশ দিয়ে অতিক্রমকালে সবার চোখ জলে ভিজে যেতে দেখি। বাসটি ইব্রাহিম খলিল রোডে প্রবেশ করে অতি ধীর গতিতে চলে নির্ধারিত দ্বার আল খলিল হোটেলের সামনে আসে। মালামাল নামানো শেষ হলে সামনে আসেন আমাদের সিলেটের পাশের বাসার ভাড়াটিয়া ও আত্মীয় ইসলাম উদ্দিন চৌধুরী। তিনি এখানে লতিফ ট্রেভেলসের প্রতিনিধি। আমরা সবাই প্রচন্ড ক্লান্তি নিয়ে গোসল ও খাবার সেরে গভীর ঘুমে ডুবে যাই। জোহরের নামাজ কাবাঘরে জামাতে পড়ে উমরা হজ্ব শুরু করি। কাবাঘর তওয়াফ জীবনের এক অনন্য অভিজ্ঞতা। তওয়াফের মত ইবাদাতি করার সুযোগ অন্য কোথায়ও নেই। হাজরে আসওয়াদ বা পবিত্র পাথরের সোজা রেখা বরাবর এসে সবুজ বাতির নিচে নেমে ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবর, ওয়ালিল্লাহীল হামদ’ পড়ে কাবাঘরকে হাতের বায়ে রেখে তওয়াফ শুরু হয়। এই তওয়াফের মিছিল এখানে বয়ে যাচ্ছে শত শত বছর ধরে।

প্রাক ইসলামী যুগে ইব্রাহিম(আঃ) এই ঘর প্রতিষ্ঠার পর হতে এই তওয়াফ শুরু হয়ে শত শত বছর ধরে ৩৬৫ দিন ২৪ ঘন্টা এখানে নানা জাতি- ভাষা- বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের আল্লাহমুখী অভিযাত্রা চলছে। এখানে মিছিলে শরিক হয়েছেন হজরত ইব্রাহিম(আঃ), হজরত ইসমাইল(আঃ), আমাদের প্রিয়নবি হজরত মোহাম্মদ(সঃ), তার সাহাবি, তাবেইন, তাবে তাবেইনসহ মুসলিম বিশ্বের বরেণ্য ও ঐতিহাসিক ব্যক্তিবর্গ ও ধর্মপ্রাণ জনমন্ডলী। আমাদের সৌভাগ্য দয়াময় স্রষ্টা আমাদের ভাগ্যে ছয় বছর পর আবার এই আলোর মিছিলে শরিক হবার সুযোগ করে দেন। কাবাঘর সাত বার আবর্তনের সময় মনটা যেন দেহমুক্ত হয়ে পরমাত্মার সাহ্নিধ্যে চলে যায়। পাশে পবিত্র কাবাঘর- এ যে মানবাত্মা ও পরমাত্মার সম্মিলন কেন্দ্র। এখানে মানুষের মনের পর্দায় ভেসে উঠে জীবনের লক্ষ্য ও অভিমুখ। মনে নানা স্বপ্ন জাগে, অজস্র স্বপ্ন মানব মনকে আচ্ছন্ন করে দেয়। জীবনে ভাল কিছু করার ও মরণোত্তর উত্তম কিছু পাবার আকাঙ্ক্ষা মানুষকে আবেগতাড়িত করে। এযেন পরমাত্মা স্বয়ং এসে মানবাত্মায় ভর করেন। মানুষকে তিনি পথ দেখান, স্বপ্ন দেখান। এক ঐশ্বরিক আলো এসে নশ্বর জীবনটাকে নয়নের সামনে তুলে ধরে, আর বলে পড়-‘রাব্বানা আতিনা ফিদ্দুনিয়া হাসানাতো ওফিল আখিরাতি হাসানাও ওয়াকিনা আজাবান্নার, ওয়াদ খিলনাল জান্নাতা মা আল আবরার, ইয়া আজিজু, ইয়া গাফফার, ইয়া রাব্বিল আলামিন।‘ প্রভুর মিছিলের লক্ষ লক্ষ মানুষের উচ্চারনে মুখরিত উক্ত বানীর অর্থ হচ্ছে-“ হে প্রভু তুমি আমাদের দুনিয়া ও আখেরাত জীবন মঙ্গলময় কর। আমাদেরকে দোযখ হতে বাচাও ও জান্নাত দান কর। তুমি প্রতাপশালী ও ক্ষমাশীল, তুমি বিশ্ব ব্রক্ষান্ডের প্রতিপালক।“ মানুষের এই উদাত্ত ফরিয়াদ মনে হয় তাৎক্ষনিক চলে যায় নিরাকার সর্ব শক্তিমান আল্লাহর শাহী দরবারে। বিজন মরুপ্রান্তরে পুত্র ইসমাইলের জন্য পানির খোঁজে সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের দুই পাদদেশে দৌড়ান হজরত ইব্রাহিম(আঃ) পত্নী বিবি হাজেরা(রাঃ)। আর বিবি জাহেরার(রঃ) পবিত্র স্মৃতির স্মরনে ও অনুকরনে  উমরা হজ্বের অংশ হিসাবে সাড়ে তিনবার সাফা হতে মারওয়া পাহাড়ের পাদদেশে হাটেন ও দৌড়ান হাজীগন। এই দুই পাহাড়ের মধ্যভাগে শিশু হজরত ইসমাইলের(আঃ) পায়ের আঘাতে তৈরী হয় বিশ্বের সর্ব উৎকৃষ্ট আবে জমজম প্রস্রবণ- যার পি এইচ মান্সম্পন্ন পানি আর কোথায়ও পাওয়া যায়না। এখানে এহরাম পরা মানুষের ধাবমান মানুষের দ্রুতগামী প্রবাহ দেখলে মনে হয় এযেন খোদাপ্রেমে ফানাফিল্লাহ এক অদম্য ম্যারাথন দৌড়। যেন এক আদিম অকৃত্রিম মানব মিছিল। এখানে একাকার হয়ে গেছেন রাসুলের কালো উম্মত, সাদা উম্মত, খাটো উম্মত, দীর্ঘ্য উম্মত, আরবি উম্মত, আজমি উম্মত। এমন কোন জাতি, বর্ণ, ভাষা ও নৃতাত্বিক জনগোষ্টি নেই যাদের উপস্থিতি এখানে নেই।

কাবাঘরে প্রচন্ড ভীড়। তাওয়াফ একসাথে হলেও নারী ও পুরুষের নামাজের প্রাংম আলাদা তাওয়াফ কালে মাকামে ইব্রাহিম বারবা দেখা যায়। ভীড় ঠেলে হাতিমে ঢুকে আমি ও জেফার কয়েক রাকাত নামাজ পড়ি। অর্ধ বৃত্তাকার হাতিম চত্বর এক সময় কাবাঘরের মূল অংশ ছিল। কুরাইশরা কাবাঘর পুনঃনির্মাণের সময় এইস্থান বাদ পড়ে যায়। কাবাঘরে সুউচ্চ দরজার নিচপ্রান্তে হাত রেখে প্রার্থনাও করি। ২০১০ সালে ফরজ হজ্ব আদায়কালে হাজরে আসওয়াদ স্পর্ষ করা সম্ভব হলেও এবার ভীড়ের জন্য অগ্রসর হতে সাহস করিনি।

কাবাঘর যেন নরনারী পরস্পরকে হারিয়ে ফেলার স্থান। ভিন্ন ভিন্ন প্রাঙ্গণে নামাজ পড়ে কিংবা তাওয়াফকালে চোখের আড়াল হলে ফিরে পাওয়া খুবই কষ্টকর। কাবাঘর আয়তাকার হলেও কাবা মসজিদ ও মাতাফ প্রাঙ্গণ গোলাকার। এই বৃত্তাকার জায়গায় গোলক ধাঁধা সৃষ্টি হয়। সবদিক সমান ও দেখতে একই ধরনের এখানে চোখের পলকে সঙ্গিনী নারীরা হারিয়ে যান। অনেক প্রচেষ্টার পর ভাগ্য সুপ্রসহ্ন হলে খোঁজে পাওয়া যায়, নতুবা দেখা হয় হোটেলে ফিরে। দারূন দুশ্চিন্তায় কাটে দুজনের বিরহবেলা। সবার পকেটে হোটেলের কার্ড রাখতে হয়। উক্ত কার্ড নারীদেরকে পৌছে দেয় হোটেলের ঠিকানায়। এই হারিয়ে যাওয়ার যন্ত্রনা প্রতিদিন আমাদেরকে আক্রান্ত করে। ২০১০ সালে হজ্বের সময় মিসফালার যে আল মদীনা হোটেলে ৩৩দিন অবস্থান করি, সেই হোটেলের কোন অস্থিত্ব খোঁজে পেলাম না। ঘড়ি মিনারের সামনের সবকিছু ভেঙ্গেচুরে বিশাল ময়দান হয়ে গেছে। এই ময়দানে তাবু ফেলে নামাজের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এখানে বিচরন ও উড়াউড়ি করে শতশত কবুতর। ১৪ ডিসেম্বর হতে ২২ ডিসেম্বর ২০১৭সাল পর্যন্ত আমরা মক্কায় অবস্থান করি। আমার জান্নাতবাসী জনক, জননী ও অসুস্থ বড়বোন রেহার অনুকূলে তিনবার ও নিজের একবার মোঠ চারবার উমরা হজ্ব করি। কাবাঘরের কিনারায় বাসে চড়ে আয়শা মসজিদে গিয়ে ইহ্রাম বেঁধে দু’রাকাত নামাজ পড়ে আবার কাবায় ফিরে আসতাম। খরচ হত ছয় দিরহাম। মক্কায় অবস্থানকালে একদিন জবলে রহমত বা রহমতের পাহাড়ে যাই। নিষিদ্ধ ফল ভক্ষনের অপরাধে বেহেশত হতে বহিস্কৃত আমাদের আদিপিতা হজরত আদম(আঃ) পৃথিবীতে এসে মা হওয়া(আঃ) হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। অনেক কান্নাকাটি করে আল্লাহের কাছে বহুবছর প্রার্থনার পর আল্লাহ তাদের ডাক কবুল করেন এবং এই পাহাড়ের উপর তাদের সম্মিলন ঘটান। জবলে রহমতে আমাদের সিলেটের সুউচ্চ টিলার মত তবে পাতরের গড়া পাহাড়। এই পাহাড়ের উপরে একটি চতুভূজ স্থম্ব রয়েছে। এই স্থম্বের ওয়ালে অজস্র মানুষ কি যেন লিখে যাচ্ছে। কাবাঘরের সন্নিকটে রাসুলের(সঃ) বাড়ি দেখতে যাই। স্থানটায় একটি পাঠাগার দেখতে পাই এখানে নাকি রাসুলের জন্ম হয়। রাসুলের আর তেমন কোন স্মৃতিচিহ্ন এখানে নেই। ফরজ হজ্ব আদায়কালে ২০১০ সালে জবলে সুরের যে পাহাড়ি গোহায় হিজরতের সময় রাসুল তিনদিন লুকিয়ে ছিলেন সেখানে আরোহন করি। তখন জবলে নূরের পবিত্র হেরাগোহায় ঢুকার সৌভাগ্য আমার হয়নি। এবার আশা পূর্ন হল। আমি, জেফার এবং নিশাত একঘন্টা হেঁটে নূরপাহাড়ের চুড়ায় পৌছি। আসরের নামাজ পড়ে নূর পাহাড়ের পাদদেশে যাই। সেখানে এক পাকিস্থানি দোকানে খেজুর ও পানি কিনে তা খেয়ে খেয়ে শক্তি সঞ্চয় করে সিড়ি সিড়ি পাহাড় বেয়ে এক বিশাল উচ্চতায় আরোহন করি। উপরে কিছু জায়গায় কিছু দোকান আছে। আমাদেরকে প্রথম কোরান শরীফ নাজেল হবার পবিত্র স্থানটি স্বচক্ষে দেখানোর জন্য মহান আল্লাহ পাককে প্রাণভরে শোকরিয়া জানাই । পাহাড়ের উপর বিশাল পাতরের গায়ে লিখা রয়েছে পৃথিবীতে সর্বপ্রথম অবতীর্ণ হওয়া কোরানের পবিত্র আয়াত- ‘ইকরা বিসমী রাব্বিকাল্লাজি খালাক্ক, খালাকাল ইনসানা মিন আলাক্ক’। এদিকে পশ্চিম দিগন্তে সূর্য অস্ত যাচ্ছে। মাইল খানেক নিচে মক্কাগামী মহাসড়ক দেখা যাচ্ছে। সুদূরে কাবার সামনের ঘড়িমিনার সগৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। এযুগে এই সুউচ্চ শক্ত শিলার পাহাড়ে ওঠার সিড়িকাটা রাস্থা রয়েছে। কিন্তু প্রাচীনকালে এই এবড়ো তেবড়ো খাড়া ও ভঙ্গুর পাতুরে পাহাড় বেয়ে আল্লার নবী কিভাবে যে এত উঁচুতে উঠে আসতেন ভাবলে অবাক লাগে। এখানে দিনের পো দিন, রাতের পর রাত, ধ্যানমগ্ন নবীকে বিবি খাদিজা(রাঃ) কখনও নিজে কখনও দাসী মারফত খাবার পাঠাতেন। তখন ঝিরঝির ঠান্ডা বাতাস বইছে। হঠাৎ মাগরিবের আজান শুনা গেল। চারপাশে পিনপতন নিরবতার খেলা। এই ভয়ঙ্কর নিস্থব্ধতা মানুষকে ধ্যানী করে দেয়। চারপাশে অসংখ্য জায়নামাজ ফলে রাখা আছে। আমরা অজু অবস্থায় ছিলাম। একটি প্রকান্ড সমতল পাতরের উপর চারটি জায়নামাজ বিছায়ে আমরা জামাতে নামাজ পড়ার প্রস্তুতি নেই। লাল রক্তিম সূর্য পশ্চিমের পার্যত্য মরুভূমিতে মিলিয়ে গেল। কাবার ঘড়িমিনার বরাবর কাবার দিকে কিবলামুখী হয়ে আমরা জামাতে দাড়াই। এই জামাতে আমি ইমামতি করি। একজন আরবি, জেফার ও নিশাত পিছনে দাঁড়ান। সুদূরে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে মসজিদুল হারামাইন সংলগ্ন বিখ্যাত মক্কাঘড়ি। সুরা আল ফিল ও সুরা আল কুরাইশি আমি নামাজের মধ্যে তেলাওত করি। সুরা ফিল পাঠের সময় মনে হচ্ছিল আব্রাহার হস্থি বাহিনী হয়তো বা আশপাশেই আবাবিল পাখির আক্রমণে ধ্বংস হয়েছিল। সুরা কুরাইশ পাঠের সময় মনে পড়ছিল প্রাক ইসলামি যুগের সেই কুরাইশদের কাহিনি যারা শীতে ও গ্রীষ্মে ইয়ামেন, ওমান, ইরাক, সিরিয়া, মিসর ইত্যাদি দেশে উটের কাফেলা নিয়ে নিরাপদে ব্যবসা করে বেড়াতো। পবিত্র কাবাঘরের খাদেম হবার সম্মানে কেউ তাদের উপর হামলা বা লোটতরাজ করার সাহস করতনা। সুনসান নিরবতা সন্ধ্যার বিদায়ী ছায়ায় ছোট ছোট পাহাড়ি গোহায় বসে ছবি তুলি। আর পাহাড় বেয়ে হেরা গোহার ছাদের উপরে যাই। এবার নেমে এসে মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে ২০/২৬ ফুট দৈর্ঘ্য এক চিকন সুড়ুংপথ পার হয়ে পবিত্র হেরার গোহার সামনে যাই। ত্রিকোনাকার গোহা, উপরে ত্রিকোনাকার পাতুরে ছাদ। সামনে দাঁড়ানোর জন্য প্রায় ১২ ফুট x ১৫ ফুট খোলা জায়গা। গোহার একদিক খোলা। গোহাটি প্রায় ২০ ফুট লম্বা ও ১০ ফুট চওড়া হবে। সামনে খানিক উচুতে সমতল পাতুরে বসার বেঞ্চের মত জায়গা। পাশঘেষে পাহাড়ের প্রায় খাড়া ঢালু প্রায় অর্ধমাইল নিচে নেমে গেছে। আনন্দদায়ক শীতল পবন বইছিল তখনও। ইন্দোনেশিয়ার হাজিরা হেরাগোহায় তখন পালাক্রমে নফল নামাজ পড়ে। কোনমতে ভীড় ঠেলে ঠেলে আমি পবিত্র গোহায় প্রবেশ করি। আল্লাহর রসুলকে স্মরণ করে তখন চোখে জল এসে গেল। এই সেই হেরাগোহা যেখানে আল্লাহর শ্রেষ্ট গ্রন্থ পবিত্র কোরান সর্বপ্রথম অবতীর্ণ হয়। মুহূর্তে মনটা চৌদ্দশত বৎসর পূর্বের সেই দিনটিতে চলে গেল। এই নূরপাহাড় আছে, হেরার পবিত্র গোহাও অবিকৃত আছে, কিন্তু সেই সোনালি সময়টি নেই, আর নেই সেই সর্বশ্রেষ্ট মহামানব যার পদস্পর্শে এই পাহাড় ধন্য হল। মনে হল এই পাহাড় ও গোহায় যেন তার পবিত্র ছায়া ও মোবারক দেহস্পর্শ কাঁদছে নীরবে। মনে মনে জপি ‘সালামুন ইয়া রাসুল আল্লাহ আলাইকুম, সালামুন ইয়া নবি আল্লাহ আলাইকুম, সালামুন ইয়া হাবিব আল্লাহ আলাইকুম’। নিজের অজান্তে চোখের অশ্রু হতে বের হয়ে বাহিরের পাহাড়ি মরু বাতাসে মিলিয়ে গেল।

একদিন হেঁটে হেঁটে কাবার খানিক দূরে অবস্থিত মক্কার পবিত্র জান্নাতুল মাওয়া কবরগাহে প্রবেশ করি। গেটের ভিতর রসুলের প্রিয় সহধর্মিনী উম্মুল মুমিনীন হজরত খাদিজা তাহেরার(রঃ) সমাধীতে যাই। এখানে অজস্র সাহাবী, তাবেইন, তাবে তাবেইন সহ অনেক পূণ্যবান মানুষ ঘুমিয়ে আছেন। যথেষ্ট সময় নিয়ে অতিভক্তি সহকারে জেয়ারত করে আমি ও জেফার বেরিয়ে আসি।

একদিন আমরা লতিফ ট্রেভেলসের বাসে মক্কা জিয়ারায় বের হই। আমি নিশাত ও জেফার গাড়ি মিস করে অন্য একটা ভাড়া কারে চড়ে মিনা, মুজদালিবা, জামারাত ও আরাফাতের ময়দান ঘুরে আসি। মক্কায় অবস্থানকালে একদিন গাড়ি ভাড়া করে জেদ্দা যাই। আমার চিকিৎসক পত্নীর একজন রোগিনীর স্বামী আমাদেরকে নিয়ে সারা জেদ্দা শহর ঘুরে দেখান। পুড়ামক্কা নামক স্থানে হজরত হাওয়ার(আঃ) সমাধী, লোহিত সাগরের বাঁধানো তীরবর্তী সৈকতে লাল সূর্য সমুদ্রে সন্ধ্যার আলো বর্ষন করতে করতে ডুবে যাবার দৃশ্য দেখি। সাগরের তরঙ্গমালা ও উদ্যম বাতাসের সহিত আমাদের মাখামাখি হয়। মরুভূমি ও সাগর ঘেরা হাইটেক নগরী জেদ্দা মরুফুল ও বৃক্ষে সুসজ্জিত হয়ে শতশত বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ধারণ করে আছে।

২২ ডিসেম্বর ২০১৭ সাল। আমরা একটি বড় বাসে চড়ে অর্ধশত যাত্রি বাদজোহর মদীনায় রওয়ানা হই। পথে গাড়ী থামিয়ে স্থানে স্থানে আসর এবং মাগরিবের নামাজ পড়ানো হয়। প্রতিস্থানে ছোট বাজার রয়েছে। সবশেষে এক মহাসড়ক বাজারে গাড়ী যাত্রা-বিরতি করে। আমরা এসার নামাজ আদায় করে বড় একটি খাবার দোকানে প্রবেশ করি। একটি টেবিলের খালি চেয়ারে বসামাত্র এক বিদেশী দম্পতি তাদের সমুদয় খাবার মোরগ বিরিয়ানী ও পানীয় আমাদের দিকে ঠেলে দিয়ে উঠে যান। আমাদের আর তেমন কোন খাবার কিনতে হয়নি। আমরা তিনজন আল্লাহ প্রদত্ত উপহার তৃপ্তি সহকারে উদরে পাঠিয়ে দেই। দারূন শান্তির শহর মদীনা। এযাত্রায় আমাদের আবাস হোটেল আস সালাহিয়া। মসজিদে নবুবীর সন্নিকটে হোটেলটির অবস্থান। চারপাচ মিনিট হাঁটলেই মসজিদে নবুবী চত্বরে প্রবেশ করা যায়। মদীনা মসজিদের বহির বাউন্ডারীতে প্রতি গেটে ধারাবাহিক নম্বর রয়েছে। এই নম্বর মনে রাখলেই পথ চিনতে ভূল হয়না। মদীনা মসজিদ কাবা মসজিদের মত গোলাকার নয় বরং আয়তাকার। মূল মসজিদে নবুবী রওজা মোবারক সহ বর্গাকার এবং সম্প্রসারিত হয়ে পরবর্তীকালে নির্মিত পিছনে বিশাল আয়তাকার মসজিদ। নারী ও পুরুষদের জন্য আলাদা অজু, বাথরুম ও ভিতরে মসজিদ প্রাঙ্গণ। মক্কা কাবাঘর দক্ষিণে, তাই এই মসজিদের কিবলা দক্ষিণ দিকে রয়েছে।

২২ ডিসেম্বর হতে ২৯ ডিসেম্বর ২০১৭ সাল পর্যন্ত মোঠ আটদিন আমরা পবিত্র মদীনায় অবস্থান করি। শেষরাতে মসজিদে নবুবীতে প্রবেশ করে প্রতিদিন তাহাজ্জুদ, সালাতুস তাসবিহ ও জামাতে ফজরের নামাজ আদায় করি। তারপর রাসুলের(সঃ) রওজা মোবারক জেয়ারত করে ব্রেকফাস্ট সেরে হোটেলে এসে ঘুমিয়ে পড়তাম। কাবাতে প্রতি রাকাতে একলক্ষ রাকাত ও মসজিদে নবুবীতে পঞ্চাশ হাজার রাকাত নামাজ পড়ার সওয়াব অর্জিত হয়। তাই সময় নষ্ট না করে এই দুই মসজিদে অধিক সময় অবস্থানের চেষ্টা করি। নবুবি মসজিদের মিম্বর হতে রসুলের(সঃ) রওজা পর্যন্ত স্থানটি সবুজ কার্পেটে আবৃত। এই জায়গা হল রিয়াজুল জান্নাত বা বেহেশতের টুকরা। এখানে প্রায় ২০০/২৫০ জন লোক এক্ত্রে নামাজ পড়তে পারেন। এখানে তীব্র প্রতিযোগিতা করে ডুকতে হয়। প্রতি দশ মিনিটে ২৫০ জন মুসল্লী ডুকে নামাজ আদায় করে ভিন্ন পথে বেরিয়ে যান। সকালে নিদৃষ্ট সময় মহিলাদের জন্য রিয়াজুল জান্নাত বরাদ্ধ থাকে। সৌদি মসজিদ পুলিশ অতি শৃংখলায় রিয়াজুল জান্নাতে ২৪ ঘণ্টা ৩৬৫ দিন মুসল্লীদের নামাজ পরিচালনা করেন। আমি ও জেফার প্রতিদিন ৪০/৫০ মিনিট লাইনে দাঁড়িয়ে রিয়াজুল জান্নাতে প্রবেশ করে রসুলের রওজা শরীফ ঘেষে দাঁড়িয়ে বহু রাকাত নফল নামাজ পড়ি। আল্লাহ পাকের কাছে চাওয়া প্রতিটি ভাল কাজ সম্পাদনে সাহায্য চেয়ে দুইরাকাত করে করে নামাজ আদায় করি। আমার জীবনে নিঃস্বার্থ অবদান রেখেছেন এমন কয়েকজন মানুষ যেমন মা-বাবা, শ্বশুর-শ্বাশুড়ি, চাচাতো ভাই সাবেক আইজিপি ইমাদ উদ্দিন চৌধুরী, ফুফুতো বোন সিরিয়া আপার স্বামী ভাদেশ্বরের নালিউরি গ্রামের সৈয়দ মইনুল ইসলাম কদই মিয়া প্রমুখের প্রতি কৃতঞ্জতা প্রকাশে দুই রাকাত করে নামাজ পড়ে তাদের রূহের প্রতি বখসিয়ে দেই।

লতিফ ট্রেভেলসের উদ্যোগে একদিন আমরা বড় বাসে মদীনা জিয়ারাহ করি। গাইড ছিলেন ভারতের করিমগঞ্জের একজন হুজুর। তিনি লাউড স্পিকারে ওহুদ ও খন্দকের ইতিহাস ঐসব স্থানে যাবার পর বর্ননা করেন। হজরত আলী(রাঃ) এবং ফাতেমার(রাঃ) বাড়ি দেখি। খন্দকের প্রান্তরে যাবার পথে হজরত বেলাল(রাঃ), ওসমান(রাঃ), ওমর(রাঃ) ও আবু বকরের(রাঃ) নামে প্রতিষ্টিত সুন্দর সুন্দর গম্বুজওয়ালা মসজিদ পরিদর্শন করি। এবার ইসলামের প্রথম এবাদাতখানা কুবা মসজিদে নামাজ পড়ে কিবলাতাইন মসজিদে যাই। এই কিবলাতাইন বা দুই কিবলা মসজিদে আবারও নামাজ পড়ি। এই কিব্লাতাইন মসজিদে ইসলামের কিবলা জেরুজালেমের বায়তুল মোকাদ্দাস হতে মক্কার কাবাগৃহে স্থানান্তরিত হয়। দুই মসজিদে প্রচন্ড ভীড়। অসংখ্য খেজুর বাগান পার হয়ে এক সুবিস্তৃত খেজুর বৃক্ষের রাজ্যে প্রবেশ করি। অসংখ্য গাড় সবুজ অনুচ্চ সারি সারি খেজুর বৃক্ষ। শত সহস্র চড়ুই পাখি গাছে গাছে কিচির মিচির করছে। বাগানের মাটি ভেজা ভেজা ও কিছু কিছু ঘাসও রয়েছে। রোদ ও পত্রছায়া জড়াজড়ি করে খেজুর বীথিকে দারুন আকর্ষণীয় করে রেখেছে। খেজুর বাগানের ভিতর আমরা এক ছাউনী ঘেরা বিশাল খেজুর বাগানে প্রবেশ করি। এখানে ২০/২৫ ধরনের খেজুর বিক্রয় করা হয়। লাল, হলুদ টিয়া কালো নানা বর্নের সাথে ক্ষুদ্রাকৃতি, বৃহদাকৃতি, গোলাকৃতি, ডিম্বাকৃতি নানাবর্ন ও আকৃতির খেজুর এখানে রয়েছে। আজোয়া খেজুর সবচেয়ে উৎকৃষ্ট ও দামী। ধারনা করা হয় রসুলের(সঃ) হাতে লাগানো খেজুর গাছের বংশধ্র বৃক্ষে আজওয়া খেজুর জন্মে। প্রায় ২৫/৩০ কেজি খেজুর কিনে আমরা বাসে ফিরে আসি। গাইড হুজুর আজোয়া খেজুর বিচির গুনাগুন ও ফজিলত বর্ননা করে এই বিচির গুড়াকে সর্বরোগের মহা ঔষধে পরিনত করেন। হাজীগন হুজুরের বয়ানে আকৃষ্ট হয়ে প্রচুর পরিমানে গুড়োখেজুরের কৌটা ক্রয় করেন। হুজুরের প্রচুর আয় হয়। সবার বিশ্বাস এই গুড়া খেয়ে তাদের সর্বরোগ চিরতরে ভাল হয়ে যাবে।

একদিন মদীনা মসজিদের সামনে কোরান এক্সিভিশনে প্রবেশ করি। কোরানের আয়াতের অর্থ বহন করে পৃথিবীতে ছ্ড়ানো এমন নিদর্শনের অনেক ছবি ও ভিডিও চিত্র দেখি। এখানে হাজার বছর আগের হাতে লিখা অসংখ্য কোরান শরীফ পর্যবেক্ষন করি। কালো, লাল, হলুদ, নীল ও সোনালি হরফে পেপিরাস কাগজে লিখা এই কপি সমূহ মনে হয় হাতে নয় যেন অত্যাধুনিক ছাপাখানায় মুদ্রিত। হাতে লিখা কোরানের পবিত্র কপিগুলো অনেক বৃহদাকৃতির। ২ ফুট * ৩ ফুট এবং প্রায় ৪/৬ ইঞ্চি উচ্চতারও কোরান শরীফ রয়েছে। কাগজ অনেকটা আমাদের দেশের ট্রেসিং পেপারের মত মনে হয়। প্রাচীন মানুষের হস্তলিখিত কোরান প্রত্যক্ষ করে সেই লিপিকার শিল্পীদের পরিশ্রম ও নৈপুন্যের প্রশংসাই করতে হয়। আরেকদিন আসমা উল হুসনা বা আল্লাহের গুণবাচক নামের প্রদর্শনিতে প্রবেশ করি। এখানে কোরানে বর্নিত আল্লাহের প্রতিটি নামের অর্থ ও বাখ্যা রয়েছে। টেলিভিশনের পর্দায় পৃথিবী ও মহাবিশ্বে স্রষ্টার নামগুলোর যে প্রভাব ও কার্যকারিতা বয়ে যাচ্ছে এর অসংখ্য নিদর্শন দেখানো হচ্ছে। নিরাকার ও সর্বশক্তিমানের সিফতের নিদর্শনাবলী প্রত্যক্ষ করে অন্তরের উপলব্ধি শানিত হয়। আকাশমন্ডলী, ছায়াপথ, নক্ষত্রগুচ্ছ, সৌরজগত, বেহেশত ও দোযখের কাল্পনিক চিত্র বিশাল টিভি পর্দায় ফুটে উঠে।

পৃথিবীর অপার সৌন্দর্য ও বৈচিত্র যেন মহান স্রষ্টার সৃষ্টিশক্তির মহিমা ঘোষণা করছে। তখন মানুষের মুখ দিয়ে মনের গভীর গহীন হতে বেরিয়ে আসে-‘সোবহান আল্লাহ, আলহামদু লিল্লাহ, লাইলাহা ইল্লাল্লাহু, আল্লাহু আকবর’। যার মর্মার্থ- ‘আল্লাহ পবিত্র, আল্লাহ প্রশংসিত, আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই, তিনি মহান’।

একদিন মদীনা মসজিদের পাশে জাদুঘরে প্রবেশ করি। এখানে রাসুলের যুগের মসজিদে নবুবী ও তার রসুলের বাড়ির মিনিয়েচার প্রত্যক্ষ করি। খেজুর খুটি, মাটির ওয়াল ও খেজুর পাতার ছাওনীঢাকা তাও আবার অর্ধেক ছাদ সেকালের মদীনা মসজিদ ও বাড়িঘরগুলার সাথে বর্তমান কালের আলো ঝলমলে মদীনা মসজিদ ও শহরকে কোনমতেই মেলানো সম্ভব নয়। মদীনা শহর হতে ৪০/৪৫ মাইল দূরে অদ্ভুদ একটি জায়গা ওয়াদী আল জ্বীন বা জ্বীনের উপত্যকা। এক সুন্দর ঠান্ডা সকালে আমরা একই পরিবারের সাতজন বাস ভাড়া করে জ্বীনের উপত্যকায় রওয়ানা হই। মদীনা শহর হতে বের হয়েই চোখে পড়ে ঝিলের মত একটি জলাভূমি। এরকম জলাভূমি আমি আরবের অন্য কোথাও দেখিনি। রাস্থার দু’দিকে বালির মাট সুদূর পাহাড় পর্যন্ত প্রসারিত। হলুদ বালি ও পাতুরে পাহাড় ভোরের আলোয় দারূন সুন্দর লাগছিল। পাহাড় হতে রাস্থা পর্যন্ত দ’দিকের বালির প্রান্তর জুড়ে অজস্র খেজুর বীথি। কোথাও ফ্যাকাসে কোথায়ও সবুজ। এখানে ঋতু তিনটি- গ্রীষ্ম, বসন্ত ও শীত। শীতের আগে বসন্তে এসব বাগানে খেজুর শস্য উঠানো হয়ে গেছে। এখনও দু’চারটা গাছ ফুলে ফলে সুশোভিত হলেও বেশির ভাগ বৃক্ষই শুন্য। তবে এসব বাগানের আলাদা একটা সৌন্দর্য রয়েছে। সারিবদ্ধ খেজুর বাগানগুলো যেন মরুভূমির অঙ্গশোভা। প্রায় চল্লিশ মিনিট পর অপূর্ব সুন্দর মরুপথ ও খেজুর বীথি পার হয়ে আমরা ওয়াদী আল জ্বীনে পৌছি। ওয়াদী আল জ্বীন এক অপ্রাকৃতিক ঘটনা সংঘটিত হবার জন্য বিখ্যাত। এখানে পৃথিবীর মধ্যাকর্ষন শক্তি যেন উল্টো কাজ করে। এখানে পানি, বোতল, গোলাকার বল ইত্যাদি রাস্থায় রাখলে ঢালুর দিকে না গিয়ে উল্টো উপরের দিকে গড়য়ে যায়। এমন কি গাড়ি থামিয়ে ব্রেক নিস্ক্রিয় রাখলে গাড়ি উপরের দিকে ধাবমান হয়। এই উদ্ধমুখি দিকে মদীনার অবস্থান হওয়ায় লোকে বিশ্বাস করতো আল্লাহর রসুলের আকর্ষনে এই অপ্রাকৃতিক ঘটনা সংঘটিত হয়। আবার প্রাক ইসলামী যুগের মানুষ মনে করত অদৃশ্য জ্বীনেরা এসব ঘটনা ঘটায়, তাই তারা এই পাহাড়ি জায়গাটির নাম দেয় ওয়াদী আল জ্বীন বা জ্বীনের উপত্যকা। আমরা দেখি অসংখ্য মানুষ এই অপ্রকৃতিক ঘটনা প্রত্যক্ষ করছে। সবশেষে অনেক ঘাটাঘাটি করে জানলাম পৃথিবীতে এধরনের আরও চার পাঁচটি জায়গা রয়েছে। এই স্থানগুলো আমরা দু’চোখে যেভাবে দেখি বাস্তবে তেমনটি নয়। পৃথিবীপৃষ্টের সহিত দৃষ্টিগোচর উঁচু দিক হচ্ছে আসলে নিচু ও যে দিক আমরা নিচু দেখি তা প্রকৃতপক্ষে উঁচু অবস্থায় রয়েছে। এটা আসলে এক ধরনের দৃষ্টিভ্রান্তি ছাড়া আর কিছু নয় এবং এই দৃষ্টিভ্রান্তির জন্য মনে হয় মধ্যাকর্ষন শক্তি যেন এখানে উল্টোভাবে কাজ করছে।

একদিন মদীনায় এক সুন্দর পার্কে প্রবেশ করি। কয়েকজন বাংলাদেশী পার্কটিতে কাজ করেন। তাদের কাছে শুনলাম এটা হজরত আবু বকর(রাঃ) পার্ক। ইসলামের প্রাথমিক যুগে এই জায়গা ক্রয় করে হজরত আবু বকর(রাঃ) এই বাগান প্রতিষ্টা করেন। হজরত মুহাম্মদ(সঃ) ও তার সাহাবীরা এই বাগানে বসে প্রায়ই গল্পগোজব করতেন। মক্কা ও মদীনায় প্রচুর বাংলাদেশী ও পাকিস্থানী লোকজন বসবাস করেন। এখানে পাকিস্থানীরা সংখ্যায় সৌদিদের চেয়েও অধিক। মক্কা-মদীনার ব্যবসাপাতি সবই পাকিস্থানী উর্দুভাষীদের দখলে রয়েছে। এখানে ভিক্ষাবৃত্তি হতে শুরু করে সব ধরনের কাজের কাজী পাকিস্থানীরা। পাকিস্থানী নরনারীরা সাফা-মারওয়া, কাবা প্রাঙ্গণ, মসজিদে নবুবী সর্বত্র আচমকা হাত পেতে ভিক্ষা কিংবা সাহায্য চেয়ে বসে, যেন পকেটমার তাদের সবকিছু সাবাড় করে ফেলেছে। এদেশে কিছু সংখ্যক বাংলাদেশীরা ব্যবসা বানিজ্য করলেও বেশীরভাগই শ্রমিকের কাজ করেন। বাংলাদেশীরা আত্মমর্যাদাশীল, তাদেরকে কখনও ভিক্ষাবৃত্তিতে দেখা যায়না। মদীনার ঢাকা হোটেল হতে বাংলাদেশী খাবার কিনে আনি। প্রতিদিনের এই খাবারে দেশী মাছ, মাংস, শাকসবজি সবই রয়েছে। চট্টগ্রামের লোকজন কতৃক পরিবেশিত এই খাবার খুবই মজাদার ও সুস্বাধু। আমি ও জেফার প্রতিদিন সকালে পাকিস্তানী দোকানে ফাস্টফুড খেয়ে পুষিয়ে নিতাম।

২৯ ডিসেম্বর ২০১৭ খৃষ্টাব্দ। দেশে ফেরার সময় ঘনিয়ে এলো। মদীনা ছাড়তে কারও মন চায়না। রসুলের রওজা শেষ জেয়ারত করে একবুক যন্ত্রনা নিয়ে সবাই বিদায় নেন। জলসিক্ত নয়নে আমরা অর্ধশত লোক বাসে জেদ্দা পানে রওয়ানা হই। বাংলাদেশ বিমানের যাত্রিসেবার মান আন্তর্জাতিক মানের ও প্রশংসনীয়। তাছাড়া বিমানের সময়সূচিতে কোন অনিয়ম হয়নি। যথাসময়ে বিমানের ফ্লাইটটি আমাদেরকে নিয়ে সিলেট ওসমানী বিমানবন্দরে অবতরণ করে। মনে হল বাংলাদেশ বিমান ধীরে ধীরে উচ্চ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছে। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন