সোমবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

একমাত্র পুত্র জেফারের নর্থইস্ট মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি প্রসঙ্গঃ

 একমাত্র পুত্র জেফারের নর্থইস্ট মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি প্রসঙ্গঃ   

 

জানুয়ারি ২০১৭ সাল। একমাত্র পুত্র জেফারকে নিয়ে এক মহা দুশ্চিন্তায় আপতিত হই আমি এবং তার স্নেহময়ী জননী ডাঃ নুরজাহান বেগম চৌধুরী। ইতিমধ্যে গ্রিনকার্ড নিয়ে দুইবার যুক্তরাষ্ট্রে গেলেও তাকে রেখে আসিনি। এইচএসসি বিঞ্জানে সে একদম না পড়েই তুলনামূলক ভাল ফলাফল করে, যা ছিল আমাদের কাছে আশাতীত। আমাদের দুশ্চিন্তা হল তাকে কোথায় পড়াব? আমেরিকায় নাকি বাংলাদেশে। সে গ্রিনকার্ডধারী তাই আমেরিকায় পড়ার তার সহজ সুযোগ ছিল। তাকে জিজ্ঞেস করেও এই ব্যাপারে তার কোন সিন্ধান্ত পাইনি। কি বিষয়ে পড়বে সে ব্যাপারেও তার কোন মতামত নেই। অদ্ভুদ ব্যাপার জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণে জেফারের কোনই চিন্তা ভাবনা নেই। তার সিন্ধান্ত তাই আমাদেরকেই নিতে হচ্ছে। সে নিজে সিন্ধান্ত নিলে আমরা এত টেনশনে ভূগতাম না।   

তার মা চাইলেন ছেলে তার মত চিকিৎসক হোক। আমার ইচ্ছে ছেলের যে বিষয় ভাল লাগে সে বিষয়ে পড়ুক। আমি তার উপর আমার কোন ইচ্ছে চাপিয়ে দেবোনা। পুত্রের কোন নিজস্ব ইচ্ছে না থাকায় তার মায়ের ইচ্ছাই সবশেষে জয়ী হল। মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষায় সে উত্তীর্ণ হল। আমরা তাকে আমাদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান নর্থইস্ট মেডিকেল কলেজে ভর্তি করে দেই। আমরা পরিচালক হিসাবে পনের লক্ষের স্থলে দশ লক্ষ টাকা এককালীন পরিশোধ করি। পাঁচ লক্ষ টাকা রেয়াত পাই।

নর্থইস্ট মেডিক্যাল কলেজে জেফারের ক্লাশ শুরু হলে আবার সমস্যা দেখা দেয়। এইচ এস সি পরীক্ষা দেবার আগে তার যে মানসিক অবস্থা ছিল, আবার তা হুবহু তার মধ্যে প্রকাশ পায়। নেপাল, ভারত এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল হতে আসা সহপাঠিদের সাথে তাল মিলিয়ে চলা ও ক্লাশে এগিয়ে যাওয়া তার জন্য কঠিন হয়ে যায়।

জেফার পড়ায় বসতে পারেনা, রাতে ঘুমায়না, হাতপা ছুড়াছুড়ি করে। আবার তাবিজ ও পানিপড়ার পিছনে দৌড়াই। তার দুশ্চিন্তায় নুরজাহানের অবস্থাও সঙ্গীন হয়ে পড়ে। এমনই এক কঠিন সময়ে পুবালী ব্যাংক আমাকে মৌলভীবাজার পাঠিয়ে দেয়। আমি শুক্রবার সিলেটে গিয়ে ঘরে ঢুকেই এক অশান্তিতে পড়তাম। সাপ্তাহিক ছুটি এই দুইদিন আমার খুব মনঃকষ্টে পার হত। মা ও পুত্রের এই অশান্তি দেখে বলতাম, আমি আর মৌলভীবাজার হতে আসবনা। ঘরের এই অশান্তিতে আসা আমার আর ভাল লাগেনা। এই বিপদের দিনে ব্যাংকের শীর্ষে বসা কিছু খাটাস আত্মীয়কে বলেও কোন সহায়তা পাইনি। অথচ সিলেট শহরে একই চেয়ারে লোকজন বসে আছে বছরের পর বছর।   

জেফারের মায়ের ধারনা হল তার পুত্র মেডিকেলে পড়তে পারবেনা। দুশ্চিন্তায় তারও ঘুম হারাম হয়ে গেল। আমি তাকে কলেজের হোস্টেলে পাঠানোর সিন্ধান্ত নেই এবং অগ্রীম জামানতের টাকা জমা করি। কিন্তু তাকে হোস্টেলে পাঠাতে চাইলে সে তখন যেতে রাজি হলনা, বলল হোস্টেলে ছেলেরা গঞ্জিকা সেবন করে, মারামারি করে ইত্যাদি। দেড়বর্ষ সমাপনী পরীক্ষায় সে রেজাল্ট ভাল করতে পারেনি।

আমি ভাবি একটু দেখি। যদি সে ব্যর্থ হয় তবে আমেরিকা খোলা আছে। তাকে সেখানে কোন কমিউনিটি কলেজে ভর্তি করে দেবো। একমাত্র ছেলেকে বিদেশে পাঠিয়ে তার মায়ের অবস্থা কি হবে, কারন আমরা দুজন চাকুরি, প্র্যাকটিস, বাসাবাড়ি সব ফেলে এখনই আমেরিকা যাচ্ছিনা। 

কলেজ কতৃপক্ষ অনুত্তীর্ন কয়েকজনকে আলাদা করে দেন। আমরা তাকে মূলস্রোতে রাখার চেষ্টা করলেও কোন কাজ হলনা। কিন্তু এই আলাদা গ্রুপে গিয়ে তার শাপে বর হল, জেফার দ্রুত উন্নতি করে। বাহিরাগত শিক্ষকরা তার পরীক্ষা নিয়ে বললেন, ও তো ভাল ছাত্র, তাকে কেন আটকানো হল। তার মানসিক অবস্থা সুস্থিত হয়, আড়াই বর্ষ সমাপনী পরীক্ষায় তার অতীতের সব ফলাফল ক্লিয়ার হয়ে যায়।  

ঘরের এই অশান্ত অবস্থা দেখে লোকজন আমাদেরকে দুষলেন, এত সুযোগ থাকতে আমরা পুত্রকে বাংলাদেশে পড়াচ্ছি কেন? এখানে ডাক্তারি পড়ে আমেরিকায় গিয়ে কি লাভ হবে? কম্পিউটারে পড়লে তারচেয়ে ভাল হত, ইত্যাদি। লোকজনের এসব নানা কথাবার্তা শুনলেই নুরজাহান বেগমের দুশ্চিন্তার মাত্রা আর বেড়ে যেত। হাহুতাস তার ঘুম কেড়ে নিত। মাঝে মাঝে বলতেন, আমি নিজে সরকারি মেডিকেলে পড়েছি, কঠিন পড়া জানা সত্বেও ছেলেটাকে ভর্তি করে কষ্টে ফেলে দিয়েছি।

আমি এতসব শুনে একদিন মা ও পুতকে একটি গল্প বলি। একবার কোন এক পিতা তার পুত্রকে নিয়ে দুরদেশে যাত্রা শুরু করেন। বাহন একটি গাধা। বাবা গাধায় চড়লেন, পুত্র হেঁটে চলল। কিছুলোক বলল, লোকটার পুত্রের প্রতি কোন মমতা নেই, নিজে আরাম করে গাধার পিঠে চড়ে যাচ্ছে আর বালক পুত্রটা হেঁটে যাচ্ছে। একথা শুনে বাবা পুত্রকে গাধায় চড়িয়ে নিজে হেঁটে চললেন। কিছুদুর যেতেই আবার কয়েকজন লোকের দেখা পান। এইবার এই লোকেরা বলল, ছেলেটা কি বেয়াদব নিজে গাধায় চড়ে বৃদ্ধ বাবাকে হাটিয়ে নিচ্ছে। এবার আর কি করা যায়। বাপ বেটা দুইজনই গাধার পিঠে চড়ে বসলেন। সামান্য এগুলেই রাস্থার লোকেরা বলল, লোকদুটি কি নিষ্ঠুর, সামান্য একটা দুর্বল গাধার পিঠে দুইজন লোক চেপে বসেছে। লোকজনের কথাবার্তা হতে নাজাত পেতে এবার বাপবেটা দুইজন গাধার পিঠ হতে নেমে হেঁটে হেঁটে গন্তব্যের দিকে ছুটলেন। এবার ভাবলেন লোকজন আর কিছুই বলবেনা। অথচ সামান্য এগুতেই এবার সামনে জনকয়েক লোককে বলতে শুনলেন, এই লোক দুজন গাধা নাকি, বাহন থাকা সত্বেও বোকার মত হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে।

গল্প শেষে বললাম, লোকে যে যাই বলুক, কেবল শুনবে। জী জী বলে নিজ বুদ্ধিতে পথ চিনে এগিয়ে যাবে এবং আরেকটি কথা, মহান আল্লাহ যাকে যা দেবার তাই দিবেন, যাকে যা করার তাই করবেন। আমরা তার হাতের ক্রীড়ানক মাত্র। আমাদের ভালমন্দ তিনিই সঠিক জানেন, তাই দুশ্চিন্তা না করে তারি কাছে প্রার্থনা কর, তারি কাছে আশ্রয় চেয়ে যাও। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন