মৌলভীবাজার
ও হবিগঞ্জ জেলার বিভিন্ন এলাকা সফর
অফিসে আমার উপর আঞ্চলিক ঋণ প্রধানের
দায়িত্ব অর্পিত হয়। ঋণ কমিটির সদস্য ছিলাম আমরা পাঁচজন, এই অফিসের তিনজন
অঞ্চলপ্রধান দিলিপ কুমার পাল, আইন কর্মকর্তা মোঃ আবু তাহের, আমি ইসফাক কুরেশী,
মৌলভীবাজার শাখার ব্যবস্থাপক মোঃ মনিরুল ইসলাম এবং চৌমুহনার ব্যবস্থাপক সৈয়দ
শহিদুল ইসলাম। প্রায় সাপ্তাহে একদিন কিংবা দুইদিন ঋণ কমিটির সভা হত। প্রতিটি সভায় আমরা
ত্রিশ চল্লিশটি ঋণ অনুমোদন করতাম, যা পরিমানে কয়েক কোটি টাকা পার হত। অঞ্চলপ্রধান
এক কোটি টাকা পর্যন্ত যে কোন ঋণ পাশ করে দিতেন। কোটি টাকার উপরের ঋণগুলো সিলেট
কিংবা ঢাকা পাঠিয়ে অনুমোদন করাতে হত। বিভিন্ন বিজনেস সাইট ও বন্ধকি জমি দেখতে গিয়ে
আমি মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জের অগনিত হাটবাজার, খামার, কলকারখানা ঘুরে বেড়াই। বড়বড়
মোরগের খামার, মৎস্যখামার, দুগ্ধ খামার, সবজিক্ষেত, দোকান, পণ্যগোদাম, কারখানা,
চাবাগান, শিল্পাঞ্চল দেখে মনে হত আর কদিন, বাংলাদেশ উন্নত দেশের তালিকায় উঠে যাবে।
আমাদের অফিসে একটি জিপ সবসময়
ভিআইপিদের জন্য বরাদ্ধ ছিল। পরিচালক মনজুর রহমান চুনারুঘাটে রেমা চাবাগানে এলে
গাড়িটি তার ডিঊটিতে চলে যেত। তাছাড়া অন্যসব সময় আমরা অফিসের কাজে গাড়িটি ব্যবহার
করতাম। মৌলভীবাজারের স্থানীয় ড্রাইভার মানিক গাড়িটি চালাতো। মানিক পরিচালক মনজুর
রহমানের কন্ঠ অবিকল নকল করে তিনি কিভাবে তাকে ডাক দেন, কিভাবে কথা বলেন আমাদেরকে শোনাত,
আমরা মজা পেয়ে হাসতাম। মানিক আমাদেরকে শহরের উপকন্ঠে পাহাড়ের উপর নির্মিত সুন্দর
সুন্দর লন্ডনী বাড়িতে নিয়ে যেত।
শমসেরনগর বাজারে গিয়ে এখানকার এত
ব্যবসা দেখে অবাক হই। আমার শৈশবে হাজিপুর ফুফুবাড়িতে যেতে পথে দেখা রেলস্টেশনের
পাশের সেই ছোট বাজারটি এখন একটি উপজেলা শহরের মত বড় হয়ে গেছে। একটি আন্ডারগ্রাউন্ড
জমজমাট হোটেলে শমসেরনগরের ব্যবস্থাপক নুপুর বৈদ্য আমাদেরকে লান্স করান। দলে দলে
লোকজনকে মজার মজার দামী মাছ মাংস খেতে দেখে মনে হল দরিদ্র এই অঞ্চলটিতে এখন আর
দারিদ্র নেই। জনগন ধনী হয়ে গেছেন। জানলাম এখানে বিমানবাহিনীর ঘাটি হয়েছে, বিমান
বাহিনী এখানে একটি আদর্শ শিক্ষালয় ‘শাহিন স্কুল এন্ড কলেজ’ করেছে। ভবনাধি ভাড়া
নিয়ে লোকজন সন্থান পড়াতে শমসেরনগরে এসে ভীড় করছে। এখানে জমির দাম আকাশ ছুঁয়েছে। এই
সেনাঘাটি, শাহিন স্কুল, চাবাগান এবং পর্যটনশিল্প এলাকাটিকে বদলে দিয়েছে।
মৌলভীবাজার শহরের উত্তরপূর্ব
দিকে রাজনগরে একজন চৌধুরী সাহেবের ব্যবসাক্ষেত্র পরিদর্শনে যাই, পথে কমলারানীরদিঘী
ও বালিদিঘী দেখা হয়। ২০০বিঘা আয়তনের বালিদিঘিপারের দেওয়ানবাড়িতে আমরা চাচাত ভাতিজী
এমেলির বিয়ে হয়। তার স্বামী ‘দৈনিক সিলেটের ডাকের’ ব্যবস্থাপনা পরিচালক দেওয়াম
মজিদ লায়েক। এই দিঘীপারে মসজিদের পাশে চিরশায়িত আছেন লংলার জমিদারকন্যা
করিমুন্নেছার হাতে নিহত তারই হতভাগ্য স্বামী কালু দেওয়ান। ঋনগ্রাহক চৌধুরী এই
বাড়ির সন্থান।
অঞ্চলপ্রধান দিলীপ কুমার পাল আমাকে
একবার রাজনগর উপজেলার কাউয়াদিঘি হাওরে নিয়ে যান। তখন ছিল শীতকাল কিন্তু হাওরটি
বর্ষাকালের মত জলে থৈ-থৈ করছিল। বৃষ্টিহীন শীতকালে দুপাশে জলভরা হাওরের বুক চিরে
বয়ে যাওয়া রাস্থা দিয়ে যেতে খুব ভাল ভাল লাগছিল, যেন বিদেশী কোন হ্রদের ভিতর দিয়ে
যাচ্ছি। এই হাওরে নাকি প্রচুর মাছ জন্মে। একজন সাদামাটা ধনী মুরব্বী এখানে বড় আকারের
একটি অটোমেটিক রাইস মিল ও গোডাউন করেছেন। তার তিন যুবকপূত্র এই কারখানায় শ্রম দেন।
বুড়ো মুরব্বী আমেরিকায় গিয়ে বেশীদিন টেকেন না। এই জমিজামা ও ব্যবসার মায়ায় সবফেলে ছুটে
আসেন। এখানে আমাদের ব্যাংক প্রচুর ইনভেস্ট করেছে।
ঋনের কাজে টেংরাবাজার, ব্রাক্ষনবাজার
ও ফেন্সুগঞ্জ রোডের মুন্সিবাজার বেশ কয়েকবার আমাকে যেতে হয়। অনেক অনেক মানুষ ও
ব্যবসায়ীদের সাথে মিশতে হয়।
এক বর্ষায় একটি এসএমই ঋনের সাইট
ভিজিটে নবীগঞ্জ শাখায় যাই। সেই ভিজিট ছিল বেশ আনন্দের। নবীগঞ্জের ব্যবস্থাপক
আব্দুল মোমেন, আমি এবং মাছুম সিদ্দিকিকে নিয়ে গ্রাহক একটি হাওরপারে যান। আমরা একটি
নৌকায় আরোহন করি। নৌকা বেয়ে বেয়ে মাঝি আমাদেরকে দূরের একটি ভাটিগ্রামে নিয়ে যান।
দুপাশের শাপলা পদ্ম ভেটফুল দলে দলে নৌকাটি বিলের মত বিরাট একটি মৎস্যখামারে এসে
নোঙর করে। বিলের সাথে কয়েকটি ছোট ছোট পুকুর আছে। এই খামার একটি বহুমুখী প্রকল্প।
এখানে গরু, মোরগ এবং কালো ছাগলও চাষ হয়। খামারের ঘোড়ায় আমি আরোহনে সচেষ্ট হই।
গ্রাহকের পরিবারের লোকজন লন্ডন প্রবাসী। এখানে তাদের প্রচুর ইনভেস্ট রয়েছে। খামারের
বিলে একদল জেলে নৌকা বেয়ে সবসময় মাছ ধরেন। পানিতে জিইয়ে রাখা বেশ কয়েকটি বড় মাছ
আমরা দেখতে পাই। গ্রাহক বললেন এই বিল থেকে প্রতিদিন দশবার হাজার টাকার মাছ শেরপুর
ও নবীগঞ্জে বিক্রি করা হয়। এই নিত্যদিনকার মাছবিক্রি চলে বারমাস। কেবল শীতকালে
বিলসেচে একসাথে লাখ লাখ টাকার মাছ ধরা হয়। আমাদের আপত্তি উপেক্ষা করে গ্রাহক
আমাদের সবাইকে কয়েকটি মাছ উপহার দেন। মাছটি অরেঞ্জ টিলায় নিয়ে আসলে মাসুমের মা খুব
মজা করে রাঁধেন। ভাবলাম ইস, জায়গাটা কাছে হলে প্রতিদিন বিলের মজাদার জ্যান্ত বড়মাছ
কিনে কিনে খাওয়া যেত।
আমরা কোনদিকে অফিসের গাড়ি নিয়ে রওয়ানা
হলে সেইদিকের সবকটি শাখার কাজ নিয়েই যেতাম। কাজ বেশি হলে অনেক সময় সবকাজ একদিনে সেরে
আসা সম্ভব হতনা। একবার কমলগঞ্জ ও আদমপুরের বেশকিছু কাজ নিয়ে বের হই। আমি বিষ্মিত
হয়ে দেখি ভানুগাছ রেলস্টেশনের আশপাশই কমলগঞ্জ বাজার, যা আগে আমার ধারনায় ছিলনা।
এখানে প্রচুর মনিপুরী ধুতি ও ঘাঘরাপরা নরনারীকে বাজার করতে দেখি। এবার আদমপুর
শাখায় রওয়ানা হই। পথে বাংলাদেশের প্রথম সংখ্যালঘু প্রধান বিচারপতি এস, কে সিনহার
সাদামাটা বাড়িটি দেখি। একাত্তরের যুদ্ধপোরাধীদের বিচারের রায় উপলক্ষে জামাতিরা এই
বাড়িটিতে হামলা ও ভাংচুর চালায়। তাই সেখানে এখন পুলিশি নিরাপত্তা রয়েছে।
আদমপুরে মনীপূরি লোকজন গিজগিজ
করছেন। এখানকার মন্দির ও ক্যালচারাল কমপ্লেক্সে কার্তিকের পূর্ণিমা তিথিতে মনীপূরীদের উৎসব
রাধাকৃষ্ণের মহারাসলীলা অনুষ্টিত হয়। এখানে রাখাল নৃত্যে অংশ নেন মনিপুরী শিশু
কিশোরেরা। আমাকে একজন মনীপূরী নেতা রাসলীলার আমন্ত্রণ জানিয়ে বললেন এই অনুষ্টান
উপভোগ করতে সারাদেশ হতে নানা সম্প্রদায়ের লোকজন মাধবপুর জোড়মন্দিরে আসেন। এই নেতা
বললেন মনীপুরের মহারাজা ভাগ্যচন্দ্র সিংহ ১৭৭৯ সালে এই উৎসবের সুচনা করেন যা পরে
গৌড়ীয় বৈষ্ণব মনীপুরিদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব শ্রীকৃষ্ণের মহারাসলীলা হিসাবে পালিত
হয়ে আসছে।
আদমপুরে মনীপুরি নারীদেরকে তাদের
হস্তশিল্প বিকশিত করার জন্য অল্পসুদে প্রচুর ঋণ দেয়া হয়। বাংলাদেশের এই
মনীপুররাজ্য হতে সন্ধ্যার আগে ফেরার পথে ধুতিপরা পুরুষ ও ঘাঘরা জড়ানো মহিলাদের
আনাগুনা দেখে দেখে কমলগঞ্জ ফিরে আসি। লোকজন বলল এখানকার মনীপুরীরা উচ্চশিক্ষিত,
তারা উপজাতি কোঠা ব্যবহার করে শিক্ষা প্রতিষ্টান ও প্রশাসনের সর্বত্র ঢূকে পড়ছেন।
তাদের কোন একটি গ্রামে নাকি বিসিএস অফিসার আছেন চৌচল্লিশ জন। মনিপুরীদের মধ্যে এখন
ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার এবং বিসিএস অফিসারের কোন অভাব নেই।
একবার ঋনের কাজে আমাকে কুলাউড়া ও
জুড়ি যেতে হয়। কুলাউড়া শহরের পাশে আম্মার নানাবাড়ি ঘাঘটিয়া সাহেববাড়িতে গিয়ে
অসুস্থ্য তাহির মামাকে দেখে আসি। জুড়ি শাখার ব্যবস্থাপক আনোয়ার হুসেন আমাদেরকে
দুপুরে একটি হোটেলে আপ্যায়ন করেন। জুড়ির ব্যবসা বানিজ্য খুব জমজমাট। বিভিন্ন জেলার
লোকেরা এখানে এসে ব্যবসা করে ধনাট্য হয়েছেন। ব্যবস্থাপক আনোয়ার হোসেন একজন অমায়িক
লোক। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই বিপদে পড়েন। তার শাখায় সদ্য নিয়োগ পাওয়া কম্পিউটার
অফিসার রিমন আহমদ চেক জালিয়াতি করে অনলাইনে সিলেট থেকে কোন এক চলতি হিসাবের ছয়লক্ষ
টাকা তুলে নেয়। ফলে এই কর্মঠ ব্যবস্থাপক হবিগঞ্জে বদলী হন এবং সেইবার পদোন্নতি
বঞ্চিত হন। জালিয়াত রিমনকে সাসপেন্ড করে আঞ্চলিক অফিসে আনা হয়। লজ্জার ব্যাপার
রিমনের বাড়ি আমাদের বাড়ির কাছে ঢাকাদক্ষিনের পাহাড়ি গ্রাম রায়গড়।
দক্ষিণভাগ আমার নানাবাড়ি,
দক্ষিণভাগ শাখায় গিয়ে বেশ কিছু ঋণের সাইট ও মরগেজ পরীক্ষা করি। এখানে হিন্দুরা
ব্যবসায়ী। আমার বাল্যকৌশরের মধুর স্মৃতি বিজড়িত দক্ষিণভাগ বাজারের আগের সেই জৌলুস
নেই। আমরা শৈশবে এই বাজারে যে জমজমাট ব্যবসা ও লোকভীড় দেখেছি, এখন তার কিছুই নেই।
এই বাজারের উন্নতির উৎস্য ছিল রেলস্টেশন ও লাতুর ট্রেন। বিগত সরকারের আমলে কুলাউড়া
ভায়া লাতু রেলসড়ক বন্ধ করে দেয়া হয়। দক্ষিনবাগ রেলস্টেশন এখন পরিত্যাক্ত এবং বাজার
লোকশূন্য। পাশেই আমার নানাবাড়িতে বহুদিন পর পা রাখি। বাড়ির সামনের মসজিদে গিয়ে নানানানির
কবর জেয়ারত করি। অসুস্থ্য হাসমতি ঝিকে একনজর দেখে তার হাতে পাচশত টাকার একটি নোট
গুজে দিয়ে গাড়িতে উঠি। আমার মায়ের খেলার সাথি হাসমতি ঝির সাথে এটাই ছিল আমার শেষ
দেখা।
চুনারুঘাট একটি প্রাণচঞ্চল
ব্যবসাকেন্দ্র। এখানে স্থানীয়ভাবে বেশ কিছু উৎপাদন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। তবে
এখানকার মানুষ বেশ জেদী ও একরোখা। কোনকিছু লাভের জন্য তারা যে কোন ধরনের ভয়ঙ্কর
কাজ করে বসতে পারে। এই শাখার বড় গ্রাহক, স্থানীয় বিচারক ও জনপ্রিয় বয়স্ক মুরব্বী
আকল মিয়াকে বদলোকেরা রাতের আধারে মেরে ফেলে। আমরা এই শাখা হতে অনেক দূরের গ্রামে
গিয়ে বন্ধকি জমি পরীক্ষা করি।
হবিগঞ্জ সিলেট বিভাগের একটি
প্রাচীন নগর। এই শহরের রাস্থা সংকীর্ন, তাই ভীড় লেগেই থাকে সারাক্ষন। ময়লা ও
ধুলিদুষনে শহরটি ধুসরিত। খোয়াই সেতু পার হলেই বামে সংকীর্ণ রাস্থায় ভীড় ঠেলে গাড়ি হবিগঞ্জ শাখার সামনে পৌছে। শহরের চারটি শাখার কাজ জমিয়ে
একত্রিত করে নিয়ে বের হতাম আমরা। সারাটা দিন দৌড়ে হেঁটে কাজ সারতাম। শায়েস্থাগঞ্জ,
বারলাইব্রেরী ও টাউন মসজিদ শাখায় আমরা কাজ করলেও আমাদের দুপুরের খাবারে প্রায়ই আপ্যায়ন
করতেন হবিগঞ্জ শাখার ব্যবস্থাপক সমবারু চন্দ্র মোহন্ত, তিনি সিলেট ইস্ট আঞ্চলিক
অফিস আমার সাবেক সহকর্মী ছিলেন।
একজন ইটভাটা মালিককে আমরা ঋণ
দেই। বানিয়াচং রোডে তার ইটভাটা, পাশেই খামারবাড়ি, গরু ছাগলের খামার, ধারে বহমান
ছোট নদী। মৎস্য খামারের পুকুরের মাঝখানের দ্বীপে বাশের সেতু দিয়ে যাই। সেখানে
হাওয়াখানা ও বরশি শিকার মঞ্চে বসি। খামারের ঘোড়ার পিঠে বসে ছবি তুলি। খামারের
কাছেই নদীতীরে গ্রাহকের ইটভাটা।
হবিগঞ্জের ব্যবসায়ীরা পরিশ্রমী ও
হিসেবী। তারা খুব চালাক, কোথায় কমসুদে ঋণ পাওয়া যায় সেই ধান্ধায় থাকেন। তারা সবাই
মিলে সুদ কমানোর আবেদন করেন, নতুবা অন্য ব্যাংকে চলে যাবার হুমকি দেন। তবে তারা
গ্রাহক হিসেবে ভাল, মৌলভীবাজারীদের মত সহজে ঋনখেলাফি হননা। তারা মৌলভীবাজারীদের মত
তেমন বিলাসী নন এবং লাভের টাকা অপচয় না করে নুতন নুতন ব্যবসা কিংবা উৎপাদন কাজে
ব্যবহার করেন। মৌলভীবাজারের লোকজন ঋন পেলেই জাপ্টে ধরেন, সুদের ব্যাপারে তাদের কোন
মাথাব্যথা নেই। এই টাকা নিয়ে কি করবেন, কেমন করে ফেরত দেবেন এসব নিয়ে কোন ভাবনা
তাদের নেই। বেহিসেবী মৌলভীবাজারীরা ঋনখেলাফি হয়ে ফাটা বাশের চিপায় পড়লে শেষ
পর্যন্ত বিদেশী নিকটাত্মীয়রা এগিয়ে এসে উদ্ধার করে দেন কিন্তু হবিগঞ্জীদের ভর্তুকি
দেবার মত কেউ নেই। তাই তারা ঋনের ব্যাপারে খুব সাবধান, কোন কোন ঋনের লিমিট দরকার
নাহলে তারা অব্যবহৃত রেখে দেন। ফলে রিনিউয়েল কালে কম লেনদেনের জন্য বেশ সমস্যা
হয়।
হবিগঞ্জীরা মনে করেন
মৌলভিবাজারীরা ফগা। আমি লোকজনকে জিঞ্জেস করে জানতে পারি ‘ফগা’ একটি আঞ্চলিক শব্দ,
যার অর্থ উদার/সহজ/সরল/ খানিক বোকা ইত্যাদি। অন্যদিকে মৌলভিবাজারীরা মনে করেন
হবিগঞ্জিরা সেয়ানা, যার মানে স্বার্থপর/ধূর্ত/কঠিন/ খানিক দুষ্ট। আমি একদিন কৌতুক
করে বলি, মৌলভীবাজারের সব বুদ্ধি আমাদের মহাব্যবস্থাপক আহমদ এনায়ের মনজুর একাই
মেরে দিয়াছেন, তাই বাকি সব মৌলভীবাজারীদের তকমা ‘ফগা’ হয়ে গেছে। আমার কথা শুনে আবুতাহের
সাহেব ও উপস্থিত অন্যরা হেসে ওঠেন।
বিএনপি নেতা এডভোকেট মুজিবুর
রহমানের কাছে এই ‘ফগা’ শব্দের আমি আরেক বাখ্যা করি, ফগা মানে ভালমানুষ, যাদের
মধ্যে কোন ধান্দাবাজি নেই। আপনাদের ফগা বললে তা যে আমার অন্তরে লাগে। এজেলার পাতারিয়ায়
আমার নানাবাড়ি, কানিহাটিতে আমার ফুফু ও বোনের বাড়ি। এসব বংশের লোকজন এতই চালাক যে
সারা বাংলাদেশ খোঁজেও তাদের মত এত চালাক লোক একজনও খোঁজে পাওয়া যাবেনা। তা হলে
বলুন তো, আমি আপনাদেরকে ‘ফগা’ বলি কেমন করে।
এডভোকেট মুজিব সাহেবকে খুশী করতে
আর বললাম, আমরা ও আপনারা এক সময় একই সিলেট মহকুমা ছিলাম। অনেক পর আপনারা আমাদের
থেকে আলাদা হয়ে ‘দক্ষিন সিলেট’ মহকুমা হন। দক্ষিন সিলেট নাম পরিবর্তন হয়ে আর অনেক
পরে হয় মৌলভীবাজার মহকুমা। কাজেই আপনারা ফগা হলে আমরা সিলেটিরাও ফগা। আমি আপনি
আমরা সবাই ফগা। আবার হেসে ওঠেন মজলিশের সবাই।
একবার অফিসে একটি মজার গল্প
শুনি। উনিশ শ ষাটের দশকে মৌলভিবাজারীরা প্রথম লন্ডন যাত্রা শুরু করেন। মৌলভীবাজার
জেনারেল পোস্ট অফিসে একদিন একজন বুড়ো মানুষ এসে বললেন, আমার পূত্র লন্ডনে থাকে
আপনারা প্রায়ই আমার চিটি তাকে পৌঁছে দেন। আমার ছেলে খুব দৈখুর। আমি কি আপনাদের
মধ্যমে লন্ডনে দৈ পাঠাতে পারব? পোস্টমাস্টার বললেন, পারবনা কেন? আপনি আগে দৈয়ের
পাতিল নিয়ে আসেন তারপর দেখা যাবে। ভদ্রলোক কয়েকদিন পরপর এসে লন্ডনে ডাকে দইয়ের
পাতিল পোস্ট করে যান। ডাকঘরের লোকেরা ভদ্রলোক বিদায় হলে দইয়ের পাতিল সবাই মিলে
সাবাড় করেন। অনেকদিন পর ছেলে লন্ডন হতে দেশে এলে পিতা বললেন, আমি তোমার কাছে ডাকে
অনেকবার দইয়ের পাতিল পাঠিয়েছি, নিশ্চয় তুমি খেয়েছ। পুত্র বলল, না বাবা কোন দইয়ের
পাতিল আমি পাইনি। এবার বুড়ো রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে পোস্ট অপিসে গিয়ে জানতে চাইলেন,
এত দই লন্ডনে ছাড়লাম, আমার প্রবাসী পূত্র পেলনা কেন? চতুর পোস্টমাস্টার তখন জবাব
দেন। আপনার দইয়ের পাতিল আমরা ঠিকই পাঠিয়েছি কিন্তু দুঃখের বিষয় প্রতিবারই লন্ডন
হতে বাংলাদেশে আসা মালামালের সাথে ধাক্কা লেগে পাতিল ভেঙে সব দই নস্ট হয়ে যায়। ছিটিয়ে
পড়া এই পচা দই মানুষের কাপড়-চোপড় ও মালামাল নোংরা করে আমাদেরকে বেশ বেকায়দায় ফেলে
দেয়, পরিস্থিতি আমরা খুব কষ্টে সামাল দেই।
আমরা হবিগঞ্জের একজন অতিধনী
ব্যবসায়ীর বাসায় যাই। তার ঋনলিমিট সম্ভবতঃ পাচ কোটি। তিনি অটো রাইসমিল ও জ্বালানী
স্টিকার কারখানার মালিক। দুইটি গাড়ি ক্রস হবেনা এমন একটি সংকীর্ন রাস্থা দিয়ে
ভিতরে ঢুকে একটি বস্তি ধরনের পাড়া। রাস্থার ধারে ময়লা ড্রেন। এক জনবহুল গিঞ্জি
পাড়ার ভিতর তার সুরম্য পাকা ভবন। বাসায় আবার চোখ ধাঁধানো নানা রঙের বাহুল্যের
ছড়াছড়ি। হয়ত চোখের আন্তাজে মিস্ত্রির ডিজাইনে নির্মিত ভবন। বারান্দার সামনে দাঁড়িয়ে
দেখি কাছের বস্তির একজন নারীর মাথায় উকুন বাছাই করছেন অন্য এক অবসর নারী। শক্ত
টুস্ট ও গরম চায়ে চুমুক মেরে আমরা এই বাসা ছাড়ি।
মাধবপুর শাখাটি পূবালী ব্যাংকের
একটি ব্যস্ত ও লাভজনক শাখা। সিলেট বিভাগের শেষ সীমানায় শাখাটির অবস্থান। এইশাখার
ব্যবস্থাপক কোরক কান্তি সেন সাস্টের মাস্টার্স। এই শাখায় অনেকগুলো ক্যাশ ক্রেডিট
ঋন রয়েছে। এই ঋণগুলোর স্টক ও বন্ধকি জমি পরীক্ষা করতে আমি বেশ কয়েকবার এই শাখায়
যাই। ঢাকা সিলেট রোডের উপর একটি ছোটনদীর তীরে শাখার অবস্থান। নদীর এপার হবিগঞ্জ
ওপার ব্রাহ্মণবাড়িয়া। ঋনের বন্ধকের জমিগুলোও দুইজেলাতে ছড়িয়ে আছে। মাধবপুর শাখা
হতে সিলেট দুইঘন্টা এবং ঢাকা চারঘন্টার রাস্থা। মাধবপুর একটি দ্রুত বর্ধিষ্ণু শহর।
এই শহরটি সিলেট বিভাগে হলেও সিলেট ও কুমিল্লা বিভাগের মধ্যে সেতুবন্ধন রচনা করেছে।
যেভাবে উন্নতি হচ্ছে মনে হয় এই মাধবপুর শহরটির ভবিষ্যত খুবই উজ্জল।
কোরক কান্তি সেন একজন বেপরওয়া ম্যানেজার,
তিনি ব্যাংকের দুই চার হাজার টাকার ছোট ছোট অনাদায়ী ঋণের যন্ত্রণা হতে উদ্ধার পেতে
ব্যাংকের নানা আয়খাতের টাকা স্থানান্তর করে এসব হিসাব বন্ধ করে খাতা পরিস্কার
করেন। এই সোজা স্মার্ট লোকটি কোন টাকা নিজে আত্মসাৎ করেননি, অথচ খাতা পরিস্কার
করতে গিয়ে ধরা খান। পদোন্নতি ও ম্যানেজারি হারান।
হবিগঞ্জ হতে মাধবপুর এতটুকু
সড়কের দুইপাশে গড়ে উঠেছে অজস্র দানবাকার কলকারখানা ও শিল্প প্রতিষ্ঠান। সায়হাম,
প্রান ও স্কয়ারের মত ঢাকার অনেক বড় বড় কোম্পানী এখানে জমি কিনে বড় বড় ইন্ডাস্ট্রি
গড়ে তুলছে। সিলেট বিভাগের প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদ, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পাতর, সাজিমাটি
ইত্যাদি ব্যবহার করে অঞ্চলটি দ্রুত শিল্পনগরীতে পরিণত হচ্ছে। দুদিকের জমির দাম এখন
আকাশ ছুঁয়েছে। অনেক জমির মালিক ও দালালরা ফুলে ফেপে বটগাছে পরিনত হচ্ছে।
একদিন অঞ্চলপ্রধান দিলীপ কুমার
পালের সাথে বানিয়াচং শাখায় যাই। বানিয়াচং এসিয়া মহাদেশের বৃহত্তম গ্রাম। হবিগঞ্জ
হতে পশ্চিমের ভাটিপথে অর্ধঘন্টা জিপে চালয়ে আমরা উপজেলা জনপদ বানিয়াচং পৌছি। এটি
সিলেট বিভাগের একটি প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী জনপদ। এখানে বিখ্যাত গায়ক সুবির নন্দীর বাড়ি,
ব্রাকের প্রতিষ্ঠাতা সফল ব্যাক্তিত্ব স্যার ফজলে হাসান আবেদ এই গ্রামের সন্থান। ফজলে
হাসান আবেদের বাড়িতে কমলারানির দিঘি নামে আরেকটি সাগরদিঘির দেখা পাই।
আমি খুব আগ্রহভরে এই জনপদ ঘুরে
দেখি। পাশে প্রাচীন রাজবাড়ি দেখি, চানপাড়ায় ঘুরে দেখি সাইকেলে বিশ্বভ্রমনকারী ভূপর্যটক
রামনাথ বিশ্বাসের ঐতিহাসিক ভগ্নপ্রায় বাড়ি। বাড়ির পাতরফলক পড়ি। রামনাথ বিশ্বাস,
জন্মঃ ১৩ জানুয়ারি ১৮৫১, সাইকেলে বিশ্বভ্রমণে বের হনঃ ৭ জুলাই ১৯৩১, ভ্রমন সমাপ্ত হয়ঃ ২৬ এপ্রিল ১৯৪০ সাল। প্রায় নয়
বছরে সাইকেলে বিশ্বভ্রমন। বানিয়াচং জায়গাটি উজান না ভাটি আমি ধরতে পারিনি, কারন
এখানে উজান ও ভাটি উভয়াঞ্চলের বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তবে রাস্থার পাশের খালপারে
মুর্তাবন, হিজল, তমাল ও করচের সারি, ঘাসিয়ারা নৌকার সমাবেশ দেখে এলাকাটিকে ভাটি-বাংলাই
মনে হয়েছে।
মৌলভীবাজারের লোকমুখে হোটেল
গ্রান্ড সূলতান এবং পাচতারকা রিসোর্ট প্যালেসের সুনাম কানে আসে। আমাদের
মালিকানাধীন নর্থইস্ট মেডিক্যাল কলেজের এজিএম ইতিমধ্যে আমাকে সপরিবারে হোটেল
গ্রান্ড সুলতান নিয়ে গেছে। আমাদের পুটিজুরী শাখার কাছে রিসোর্ট প্যালেসের অবস্থান।
লোকমুখে গুণগান শুনে প্যালেস দেখার একটা স্বপ্ন যখন মনের কোনে উকি দেয়। এমনই এক
সময়ে ২০১৬ সালের শেষদিনে রিসোর্ট প্যালেসে এজিএমে সপরিবারে যোগ দিতে নর্থইস্ট
মেডিক্যাল কলেজ এন্ড সার্ভিসেসের আমন্ত্রণ পাই। এই দিনটি শুক্রবার হওয়ায় ব্যাংক
বন্ধ ছিল। পরিবারের আমরা তিনজন নর্থইস্টের একটি মাইক্রোবাস চড়ে সিলেট থেকে হোটেল
প্যালেসে আসি। জীবনে কিছু দিন আসে ভোজের ও আনন্দের, হ্যাঁ নর্থইস্ট মেডিকেল কলেজ
আমাদেরকে প্রতি বৎসর এমনই একটি দিন উপহার দেয়।
আমার সহধর্মিনী যখন কনভেনশন হলে
বার্ষিক সাধারণ সভায় ব্যস্ত, তখন আমরা বাপ পুত মিলে দুইশত একর আয়তনের এই সুন্দর
রিসোর্ট ঘুরে বেড়াই। পিছনে পাহাড়ঘেরা হ্রদে টিকেট কেটে লোকজন প্যাডেল নৌকা চড়ছে। আমরা
ঘাটে বসে এই নৌকাচড়া উপভোগ করছি। একজন চাটগাইয়া ভদ্রলোক তার শিশুপুত্রকে নিয়ে
নৌকায় উঠতে টিকেট কেটেছেন, কিন্তু পুত্র ভয় পেয়ে নৌকায় উঠছে না। ভদ্রলোক আমার দিকে
মুখ ফিরিয়ে বললেন, বদ্দা আর মরদপোয়া সাম্পান ন চইড়ব, টিকেটটা অনেরা কাজে লাগান। চাটগাইয়া
ভাইজানের এই দানের টিকেটে আমি ও জেফার একটি প্যাডেল নৌকায় চড়ে বসি। নদীর মত
প্রসারিত সুন্দর পাহাড়ি লেকের জলে আমরা দুজন মনের আনন্দে প্যাডেল মেরে মেরে ঘুরে
বেড়াই। লেকের চারপাশে যেন বেহেশতের মনোরম দৃশ্য বিধাতা সাজিয়ে রেখেছেন।
প্যাডেল বোট থেকে নেমেই জেফার
বলল, আব্বা ক্ষিধা লাগছে। আমি বললাম, নামাজের পর খাবার দেবে খানিক সবুর কর। জুমুয়ার
নামাজের পর খাবার তাই ছেলেকে এতক্ষণ কষ্ট দিয়ে লাভ নেই ভেবে কফি ও বিস্কিটের
অর্ডার দেই। আসে অবিশ্বাস্য বিল সাড়ে চার শত টাকা। বিল শুনে আমার পত্নী বিষ্মিত
হন, তার চক্ষু চড়কগাছ দেখে বললাম, চারশত কোটি টাকা বিনিয়োগে নির্মিত প্রতিষ্টানে
এই বিল আর তেমন কি? এই বিনিয়োগ সুদাসলে উঠানোর পরই না তাদেরকে লাভ গুনতে হবে। বিকেলে
জানান হল, দুটি কক্ষ ভাড়া আছে, কেউ চাইলে রাতে থাকতে পারেন। কিন্তু শশব্যস্ত
চিকিৎসক শ্রেনীর কাউকে খোঁজে পাওয়া গেলনা এখানে রাতে ঘুমাবেন। আমরা ব্যক্তিগত গাড়ি
নিয়ে আসিনি, এসেছি নর্থইস্টের গাড়িতে চড়ে। তাই প্যালেসে রাতে থাকার ইচ্ছে ছুড়ে
ফেলে আবার নর্থইস্টের গাড়িতে চেপে বসি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন