সোমবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

দ্বিতীয়বার যুক্তরাষ্ট্র যাত্রা- মাস্যাসুসেট, মিশিগান এবং কানাডা সফর

 দ্বিতীয়বার যুক্তরাষ্ট্র যাত্রা- মাস্যাসুসেট, মিশিগান এবং কানাডা সফর

যাত্রাঃ ১৫ জুলাই ২০১৬ দেশেফেরাঃ ২৭ জুলাই ২০১৬ কানাডা গমনঃ ৭ জুলাই ২০১৬

যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার সীমান্তের দুইপার ঘুরে দেখাঃ

 

এবারের রমজান মাস, প্রচন্ড গরম। এই গরমে যুক্তরাষ্ট্র ও ক্যানাডা সফরের সিন্ধান্ত নেই। ঈদের ছুটি ১১ দিন, সেইসাথে যোগ করে আর ১৮ দিন ছুটি নেই। ১লা জুলাই ২০১৬ সাল। আমিরাত এয়ারলাইনে রাত সাড়ে নয়টায় ঢাকা শাহজালাল বিমান বন্দর হতে যাত্রা শুরু করি। সাড়ে চার ঘন্টা পর দুবাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করি। দুবাই হতে আমিরাতের বিমানটি ইরান-তুরস্ক-ইউরোপ হয়ে আটলান্টিক মহাসাগরে চলে আসে। ২৫ রমজান, ২জুলাই ২০১৬ সাল আমাদের দৈত্যাকার উড়োজাহাজটি প্রায় সাতশত যাত্রি নিয়ে নিউইয়র্কের অনেক উত্তরের রাজ্য ম্যাসাসুসেটের রাজধানী বোস্টনে অবতরণ করে। তখন সকাল সাড়ে নয়টা। দুবাই হতে আকাশে উড়ার পর টেলিভিশন পর্দায় সিএনএনের মাধ্যমে বারবার ঢাকার দুইজন পুলিশ অফিসার ও বিশজন নিরপরাধ বিদেশীর নৃশংস হত্যাকান্ডের খবর শুনে নিদারূন মর্মাহত হই। পাঁচ হামলাকারী দুবৃত্ত নিহত ও একজন জীবিত ধৃত হবার খবরো আসে। বোস্টন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশনে যুক্তরাষ্ট্রের হোমল্যান্ড সিকিউরিটি অফিসার প্রথমেই আমরা ঢাকার গোলশান হামলা সম্পর্কে অবগত কিনা জানতে চান। আমি ও জেফার বললাম, আমরা উড়োজাহাজের টিভিতে এই খবর পেয়েছি। এইচ এস অফিসার জেফারকে বললেন, বাংলাদেশ কি বিপদজনক দেশ? অচিরেই বাংলাদেশ কি পাকিস্থান, আফগানিস্থান, সোমালিয়ার মত ব্যার্থ রাষ্ট্রে পরিনত হবে? জেফার বলল, মনে হয়না। পাকিস্থান ও আফগানিস্থানে জঙ্গী দুবৃত্তরা প্রতিদিন বোমা ফোটায়, মানুষ মারে। বাংলাদেশের এই হত্যাকান্ড বিরল ঘটনা। বাংলাদেশের মানুষ শান্তিপ্রিয়; এখানে কেউ জঙ্গিবাদ বা উগ্রবাদ পছন্দ করেনা। হোমল্যান্ড সিকিউরিটির এই শ্বেতাঙ্গ কর্মকর্তার ধারনা বাংলাদেশ একটি নরক। এইদেশ মশা মাছি আর আবর্জনায় ভরা। আবহাওয়া উষ্ণ প্রস্রবনের মত আর্দ্র ও গরম। তার উপর বজ্জাত জঙ্গিদের উৎপাত। তার উপদেশ সুযোগ যখন পেয়েছেন ফেলে আসা নরকে আর ফিরবেন না। আমরা যদিও কিছুদিন পর বাংলাদেশে ফিরে যাবো, তারপরও বললাম, ইয়েস থ্যাংকস। তিনি আমাদেরকে যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাস করার উপদেশ দিয়ে মালামাল পরীক্ষা করে ছেড়ে দেন। দুবাই এয়ারপোর্টে একজন আত্মীয়ের দেখা পাই। তিনি আমার ভাতিজী এমেলির জীবনসঙ্গী দেওয়ান তওফিক মজিদ লায়েকের খালাতো ভাই। তার বাড়ি তাজপুর, ওসমানীনগর। তিনি দেড়যুগ ধরে যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানে আছেন। তিনি সদ্য বিবাহিতা সঙ্গিনীকে নিয়ে মিশিগান যাচ্ছেন। আমরা গল্প করে করে এয়ারপোর্টের বাহিরে চলে আসি। ভদ্রলোকের স্ত্রী চিরতরে আত্মীয়-স্বজন ছেড়ে চলে আসায় চিন্তিত ও আনমনা অবস্থায় ছিলেন। আমরা তিনজন সিলেটিকে পেয়ে তিনি দারূন স্বস্তি পেয়ে আলাপে মেতে উঠে। ভদ্রলোক নানা গল্প করেন। দেওয়ান লায়েক, খালা রাবেয়া খাতুন, খালু রাগীব আলী কিছুই আলোচনায় বাদ গেলনা।

বোস্টন আমেরিকার একটি পর্যটন নগরী। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যায়বহুল জীবনযাত্রার একটি শহর। এই শহরটিকে প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির শহরো বলা হয়। আটলান্টিক মহাসাগরের সৈকতে অসংখ্য চর ও দ্বীপমালা নিয়ে শহরটি গড়ে উঠেছে। নীলজলের ঢেউয়ে রাজহাসের মত ভাসমান চর ও দ্বীপগুলো রাস্থা ও সেতু দিয়ে পরস্পর সংযুক্ত রয়েছে। নীল জলরাশিতে বিচরন করছে অসংখ্য স্পিডবোট। বোস্টন শহরে তখন আটলান্টিক হতে ঠান্ডা বাতাস আসছে, যেন এয়ারকন্ডিশন মেশিন হতে বেরিয়ে আসা মজাদার বাতাস। গাছের পাতা ও বাগানের কুসুমরাজি বাতাসে দোল দিচ্ছে। ব্যাস্ত শহর বোস্টন অথচ শহরটি অরন্যের মত নির্জন। এখানে পৃথিবীর শ্রেষ্ট কুটনৈতিক শিক্ষা প্রতিষ্টান রয়েছে, যেখানে বিভিন্ন দেশের কূটনীতিতে নিযুক্ত কর্মকর্তারা শিক্ষা গ্রহণ করে থাকেন। বিমানবন্দর হতে বের হয়ে তিনচার ঘন্টা বোস্টনের রৌদ্রজ্জোল শীতল দিনটি বেশ উপভোগ করি, অথচ গতকাল বাংলাদেশে রেখে এসেছি ভ্যাঁপসা গরম আবহাওয়া। এযেন তীব্র গ্রীষ্মকাল হতে সরাসরি হীম শীতকালে ঢুকে পড়া। বিকেল সাড়ে চারটায় মিশিগান যেতে আমরা জেটব্লু এয়ারলাইনের আভ্যন্তরীণ ফ্লাইটে বোস্টন ছাড়বো। সংযোগ ফ্লাইট। ফ্লাইট ছাড়ার ঘন্টা দেড়েক আগে এসে আমরা বিমানবন্দর ডুকি। যথাসময়ে জেটব্লু ছেড়ে দিলো। বিমানে উঠার আগেই ছোটমামাকে জানিয়ে দিলাম আড়াই ঘন্টা পর আমরা ডেট্রয়েট অবতরণ করছি। উড়ালযান হতে বেরিয়ে বেল্টে এসেই দেখি সামনে দাঁড়িয়ে আছেন আমার ছোটমামা শহিদ চৌধুরী। মামার সাথে সাত আট বছর পর দেখা। লম্বা পাজামা-পাঞ্জাবী পরা মামাকে অনেক বয়স্ক মুরব্বী মানুষ মনে হল। সাথে ছিল তার কনিষ্ট কন্যা জেরিন, যার সাথে এই আমার প্রথম দেখা।

ছোটমামা শহিদ চৌধুরী ছিলেন বড়লেখা দক্ষিনভাগের একজন ক্রীড়া সংঘটক। খেলার জন্য যেন তার জন্ম। তার ধ্যান-ঞ্জান সব জুড়ে ছিল খেলা আর খেলা। দক্ষিণভাগ স্কুলমাঠে আমরা ফুটবল খেলতাম এবং মামা বলের সাথে দৌড়ে দৌড়ে বাঁশি বাজাতেন। দক্ষিনভাগ বাজারে ব্যাডমিন্টন প্রতিযোগিতা হত, মামা ছিলেন ধারাভাষ্যকার। মামার খেলা নিয়ে কি যে উৎসাহ। তখন ছিল রেডিওর যুগ। মামা কানের কাছে রেডিও রেখে খেলার বিবরন শুনতেন চোখ বন্ধ করে। বিকেলে মামা সওদা করতে ছুটতেন দক্ষিণভাগ কিংবা রতুলি বাজারে। ব্যাগ নিয়ে পিছু পিছু ছুটতো হাসমতি ঝির দুইপুত্র ছাকিল ও অকিল। হাসমতি ঝির পরিবারের ঠিকানা কেউ জানেনা। বৃটিশ আমলে আমার নানা শিশু হাসমতি ঝিকে কুড়িয়ে এনে সারাজীবন লালন-পালন করেন। তিনি আমার মায়ের সমবয়সী ছিলেন। নানার পালাপোষা আর একজন খুব সাদাসিদে লোক ছিলেন, যাকে আমরা বলতাম অসির মামু। নানা হাসমতি ঝিকে এই অসির মামুর সাথে বিয়ে দেন। এই হাসমতি ঝিয়ের ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনিরা আজ আমার নানার বিশাল জমিদার বাড়ির বাসিন্দা। মূল বাসিন্দারা সবাই যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী। মনে হয়না তাদের পরবর্তী বংশধর কেউ মসজিদ ও বড় দিঘীওয়ালা বিশাল জমিদার বাড়িতে কখনও ফিরে আসবে। একবার আমি এই বাড়িতে গিয়ে গরু-শিরনি করি। কিছু বালকদের বলতে শুনি হাসমতির বাড়ির শিরনি। হ্যাঁ বাড়িটির বর্তমান পরিচয় হাসমতির বাড়ি। সময় সব বিস্মৃত করে দেয় সহজেই। দেশে ছোটমামা রাতে তাস, দাবা, দশ-পঁচিশ, ক্যারম খেলা সমাপন করে মধ্যরাত পার করে ঘরে ফিরতেন। আমেরিকায় এসে সেই মামা এখন পুরোদস্তুর একজন সংসারী মানুষ। সারারাত ফ্যাক্টরিতে কাজ করেন ও দিনে ঘুমান। সাপ্তাহে চারদিন ডিউটি। তবে মাঝেমধ্যে সঙ্গীসাথি নিয়ে বরশি বাইতে যান মিশিগান লেকে, রাতভর মাছ ধরে ভোরে ঘরে ফিরেন। তার মেয়ে সুফার স্বামীকে নিয়ে বরশি বেয়ে রাত পার করে দেন।

ডেট্রয়েট বিমানবন্দরে বড় বক্সওয়াগন গাড়িতে মালামাল তুলা হয়ে গেল। কিশোরী জেরিন গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বিশাল আটলেনের মার্কিন রাস্থা দিয়ে গাড়ি ছুটালো। আটমাস আগে এসে আমেরিকার নিউইয়র্ক, ওয়াসিংটন ডিসি, কলম্বিয়া, আটলান্টা ঘুরেছি। তখন আটলান্টিক মহাসাগরপারের নয়টি স্টেইট সফর করি। এবার আর নতুন দুটি স্টেইটে পা রাখলাম, একটি ম্যাসাসুসেট, যাহা যুক্তরাষ্ট্রের সুদূর উত্তরের আটলান্টিকপারের রাজ্য। অন্যটি যুক্তরাষ্ট্র ও ক্যানাডার সীমান্তবর্তী লেইক-রাজ্য মিশিগান। যুক্তরাষ্ট্রের পঞ্চাশটি রাজ্যের মধ্যে ফেডারেল সরকারের অধীনস্থ ওয়াশিংটন ডিসি সহ এগারটি স্টেইট সফর করা আমাদের হয়ে গেল। রাজ্যগুলো- নিউইয়র্ক, নিউজার্সি, পেন্সিলবানিয়া, ভার্জিনিয়া, মেরিল্যান্ড, ওয়াশিংটন ডিসি, নর্থ-ক্যারোলিনা, সাউথ-ক্যারোলিনা, জর্জিয়া, ম্যাসাসুসেট ও মিশিগান। ডেট্রয়েট স্টেইট মিশিগানের সবচেয়ে বড় শহর। এটি যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী শিল্পনগরী। মিশিগান রাজ্যের আয়তন ৯৬,৭১৬ বর্গমাইল, যা বাংলাদেশের চেয়ে ১.৭৫ গুন বড় ও বৃটেনের সমান। রাজ্যটি দুইটি উপদ্বীপ নিয়ে গঠিত। লেক সুপিরিয়র ও লেক মিশিগানের মধ্যে একটি উপদ্বীপ রয়েছে এবং অন্য উপদ্বীপটির অবস্থান লেক মিশিগান ও লেক হুরনের মাঝে। সাগরের মত বিশাল এই লেকগুলো কানাডার সীমান্ত ঘেষে ছয়-সাত মাইল প্রশস্থ নদী বা চ্যানেল দিয়ে পরস্পর সংযুক্ত। ডেট্রয়েট বড় মহানগর হলেও মিশিগান রাজ্যের রাজধানী ছোট্ট শহর লেন্সি। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা সীমান্তের এই লেকগুলো বিশাল কূলকিনারাহীন এক একটা সমুদ্র।

আমাদের বক্সোয়াগন গাড়িটি এসে ছোটমামার তালবটের বাসার সামনে এসে থামে। বিদেশে জায়গার বিদগুটে নাম মনে রাখা বেশ কষ্টকর, কিন্তু বাংলাদেশের দুইটি গাছ তাল ও বটের নামে এলাকাটির নাম হওয়ায় সহজে স্মৃতিতে বসে যায়। যুক্তরাষ্ট্রের দশটা আবাসিক এলাকার মত একটি আবাসন। রাস্থার পাশে সারিবদ্ধ প্রায় একই ডিজাইনের সারিবদ্ধ বাড়িগুলোর মধ্যে একটি তিতলা বাসা। সামনে গাড়ি আঙ্গিনা এবং পিছনে ফল-ফুল সুভিত প্রাঙ্গন। এই পিছন প্রাঙ্গণের উর্বর মাটিতে কদু, ঝিঙ্গা, লালশাক, পাটশাক, ডেঙ্গা, মরিচ, দেড়েস ইত্যাদির সবজি বাগান। বাসার পিছন দিয়ে বাংলাদেশের গ্রামের মেঠো পথের মত সবুজে ছাওয়া পথ। দু’দিকে ঝুলে আছে থোকা থোকা বুনো আঙ্গুর। ঐ আঙ্গুরলতা ঘেরা পথে মামী আমাদেরকে হাঁটতে নিয়ে যান। তখন মনে হল এযে বাংলার কোন ছায়াঘেরা পল্লী পথ। উন্নত দেশ, তাই এই নির্জন পথটিও পিচ ডাকা।

আমার মামী সেবন চৌধুরী। বড়লেখার দাসেরবাজার তার বাপের বাড়ি। তিনি কঠোর পরিশ্রমী একজন সহজ সরল মহিলা। মানুষের প্রতি তার দয়ামায়ার কোন শেষ নেই। দক্ষিভাগের চারু নামের একটি মেয়ে তার কাজ করতো। চারুর ছেলেমেয়েকে কোন ধরনের জীবিকায় লাগিয়ে দেওতার জন্য মামী এক হাজার মার্কিন ডলার আমার হাতে তুলে দেন।

মামী তার বাগানে ফলানো শাকসবজি আমাদের জন্য সযতনে রান্না করেন। অনেক বাচ্চা-কাচ্চার বড় এক সংসার মামা ও মামী বটগাছের মত ছায়া দিয়ে আগলে রেখেছেন। ছেলে তাওহিদ ওয়াশিংটন ডিসিতে চাকুরী করে। গতবছর আমরা ওয়াশিংটন অবস্থানকালে সে তার পত্নী সুমাইয়াকে নিয়ে আসে। তারা আমাদেরকে নিয়ে মেরিল্যান্ড, বিখ্যাত টার্কি মসজিদ কম্পেক্স ও পটোমাক নদীর তীরের নগরী ও স্কাই-হুইলারে নিয়ে যায়। তাওহীদের বউ সুমাইয়া যুক্তরাষ্ট্রের মাস্টার্স। অন্য মামাতো ভাই রাহিদ লেখাপড়া শেষ করে নিউজার্সি স্টেইটে চাকুরী নিয়েছে। অফিসের কাজে সদ্য সে জার্মানী হতে ঘুরে এসেছে। বড় মামাতো বোন আরফার স্বামী সাদিক চৌধুরী, তারা সপরিবারে নিউইয়র্কে বসবাস করেন। সাদিক চৌধুরী ফেন্সুগঞ্জের ঘিলাছড়া গ্রামের সন্থান। মামাতো বন তুফার স্বামী নিয়াজ চৌধুরীর বাড়ি গোলাপগঞ্জের রনকেলী গ্রামে। তিনি বালক বয়সে নিউইয়র্ক যান। কিছুদিন হয় তিনি নিউইয়র্ক ছেড়ে মিশিগানের বাসিন্দা হন। তিনি ভাল বংশের ভাল মনের মানুষ। ছোটমামার তালবটের বাসার প্রতিবেশী তারা। তুফার ছোট্টমেয়ে মাহদিয়া খুব চঞ্চল, সব সময় সে ইংরেজিতে বকবক করে। বাসা থেকে বেরিয়ে সে চুপে চুপে চলে আসে নানার বাসায়। সারাদিন নাচে আর ইংলিশে কবিতা ও ছড়া বকে যায়- Twinkle, twinkle shining star./ How I wounder, what you are. মাহদিয়ার দুইটি জমজ ভাই হাসান এবং হোসেন। জমজ ভাই দুটি বিছানার বাসিন্দা। ক্ষুদে জমজদুটি প্রায়ই অসুস্থ থাকে, তাই তুফার দিন যায় হাসাহ-হুসেনের সেবা-শুশ্রুষায়। মামার অন্যমেয়ে সুফা সুন্দরী ও বুদ্ধিমতি। হেসে হেসে কথা বলে। তার কথায় সব সময় হাস্যরসের ছিটা বর্ষন হয়। সুফার স্বামী আলম ভাই স্মার্ট ও পরিশ্রমী লোক। তিনি আমাদেরকে সারাটা ডেট্রয়েট শহর ঘুরে দেখান। তাদের একমাত্র ছেলে মিরাজকে নিয়ে হোটেল স্যুটের মত পরিপাটি একটি সুন্দর বাসায় ভাড়া থাকেন। মামার ছোট্মেয়ে জেরিনের জন্ম নিউইয়র্ক। এখনও সে বাংলাদেশ দেখেনি। সে মাথায় হিজাবপরা ভদ্রগোছের স্বল্পভাষী একজন কিশোরী। নার্সিং কলেজে সে অধ্যয়ন করছে। সে আমেরিকান খাবার পছন্দ করে, মামির রান্না একটু আধটু চেখে দেখে এবং সুন্দর গাড়ি চালায়। বাংলা পড়তে জানেনা। আমার লিখা বইয়ের দু’টি গল্প ‘কাজের মেয়ে কুঠিনা’ এবং ‘সেই মুখ’ তার অনুরোধে পড়ে শুনাই। ছোট্ট খুকির মত কানটা আমার ঠুটের কাছে এনে মনযোগ দিয়ে শুনে বুঝার চেষ্টা করে। সে বাংলা পড়তে না পারলেও শুনে ও বুঝে। তবে বাংলা Ecoding and decoding করতে তাকে বেশ বেগ পেতে হয়। বাংলায় (সিলেটি বাংলা) কথা বলতে জড়তা নিয়ে সময়ক্ষেপন করে কথা বলতে পারে। মেয়েটি পাক্কা নামাজি ও রোজাদার। আশপাশের ভিনজাতির লোকজনের খবরাখবর নেয়। তাই সাদা-কাল-বাদামী সবাই তাকে বেশ ভালবাসে।

৩ জুলাই ২০১৬ সাল শুক্রবার। মামা ড্রাইভ করে আমাদেরকে পার্শবর্তী নূর-মসজিদে নিয়ে যান। মসজিদের পার্কিং-স্পেস খালি নেই। তাই দূরে গাড়ি পার্ক করে হেঁটে হেঁটে মসজিদে প্রবেশ করি। এই মসজিদের ৭০% মুসল্লি সিলেটি আদমি। খতিব আরবি ও ইংরেজির মিশেলে বক্তৃতা দেন। নামাজ শেষে মসজিদের চারপাশ সিলেটি ভাইসাবদের কোলাহলে সিলেটি আঞ্চলিক ভাষার গুঞ্জরনে মুখরিত হয়ে পড়ে।

ওয়ান ইলেভেনের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শক্তিবলে ইরাক ও আফগানিস্থান দখল করে নেয়। একসাথে দুইটি যুদ্ধের খরচ জোগাতে গিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অর্থনৈতিক মন্দা (Economical resition) শুরু হয়। মিশিগানে অনেক কলকারখানা বন্ধ হয়ে যায়। হাজার হাজার মানুষ চাকুরী হারিয়ে বেকার হয়। আমেরিকানদের তেমন সঞ্চয়ের অভ্যাস নেই। তারা বাংলাদেশী টাকায় প্রচুর রোজগার করে অথচ রোজগারের আগেই ঋনের টাকায় ঘি খায়। তাদের আয়ের সিংহভাগ টাকা ঋনের কিস্তি পরিশোধে চলে যায়। চাকুরী হারানো মানুষগুলো Mortgage Loan এর কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে তারা পানির দরে বাড়ি বিক্রি শুরু করে। কেউবা ব্যাংকের হাতে বন্ধকী বাড়ি অর্পন করে অন্য স্টেটে চলে যায়। তখন নিউইয়র্ক হতে দলে দলে সিলেটিরা ছুটে আসেন এবং পানির দরে ডেট্রয়েটে বাড়ি কেনা শুরু করেন। বাংলাদেশ হতে যুক্তরাষ্ট্রে আসা লোকজন ব্যস্ত নিউইয়র্ক শহরের কঠিন জীবন সংগ্রামে ত্যাক্ত-বিরক্ত হয়ে অনেকে গ্রাম্য শহর ও শিল্পনগরী ডেট্রয়েটে পাড়ি জমান। লন্ডনের মত ডেট্রয়েট এখন একটি সিলেটি অধ্যুষিত শহর।

রাতে তারাবি পড়তে আবার যাই নূর মসজিদে। আট রাকাত নামাজ পড়া শেষ হলে মসজিদ হতে অসংখ্য মানুষ একসাথে বের হয়ে যান। মসজিদের প্রায় অর্ধেক শূন্য হয়ে যায়। পড়ে মামার কাছে জানলাম, এই জামাতের আরবী ও ইয়ামেনি মুসল্লীরা আট রাকাত তারাবী নামাজ পড়ে বেরিয়ে যান। আমাদের মত সুদীর্ঘ্য বিশ রাকাত তারাবী পড়ার নিয়ম তাদের নেই।

নামাজ পড়া শেষ হওয়ামাত্র একজন দাড়িওয়ালা মুসল্লি আমাকে পরম মমতায় জড়িয়ে ধরেন। চিনতে দেরি হলনা তিনি আমার কৌশরের বন্ধু পাশের তুড়ুকখলা গ্রামের কালামিয়া সাহেবের পুত্র মওদুদ। জানতাম সে যুক্তরাষ্ট্রে আছে কিন্তু মিশিগানের তালবটের নুর-মসজিদে এসে তার দেখা পাবো ভাবতে পারিনি। মওদুদের বাবা কালামিয়া ছিলেন আমার আব্বার একজন সুহৃদ ও ভক্ত বন্ধু। ১৯৭৬ সালে তিনি আব্বাকে গ্রামের চেয়ারম্যান পদে দাড় করিয়ে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন এবং আব্বার জন্য প্রচুর টাকা খরচ করেন।

পরবর্তী তারাবীর জামাতে তুরুকখলার সাব রেজিস্টার মসরু মিয়ার পুত্র কয়েস আহমদের সাথে দেখা হল। তিনি ছিলেন আমার বড়বোন রেহার সহপাঠী। কয়েস ভাই কিছুদিন আগে সিলেটের দরগাগেটে ব্যবসা বন্ধ করে মিশিগান এসেছেন। প্রবাসে নতুন জীবন সাজাতে সদ্য যুদ্ধে নেমেছেন। পঞ্চাশোর্ধ বয়সে কঠোর পরিশ্রম তাকে পরিশ্রান্ত করে ফেলেছে। তার কথাবার্তা শুনে মনে হল- ‘দেশে ছিলাম, ভালই ছিলাম, এখন দেখি উপায় নাই, কোনবা পথে নিতাইগঞ্জ যাই’। খুব পরহেজগার সাব রেজিস্টার মসরু মিয়া ছিলেন আব্বার বাল্যবন্ধু। তাদের বন্ধুত্ব অটুট ছিল সারাটা জীবন। বুড়ো বয়সে একে অন্যকে দেখতে হেঁটে হেঁটে পরস্পরের বাড়ি ছুটে যেতেন। দু’জনই ছিলেন দীর্ঘ্যজীবি ও নির্লোভ। অতি ধার্মিক ও সৎ। বর্তমানকালের ঘুষখোর সাব রেজিস্টারদের সাথে তার কোন তুলনাই হয়না। তিনি ছনের ছাউনির মাটির ঘরে সততার সাথে জীবন কাটান। মওদুদের আব্বা কালামিয়া আব্বাকে পীরের মত মান্য করতেন।

আরেক তারাবিতে নাটেশ্বর গ্রামের আতিকের স্বাক্ষাৎ পাই। সে ডিভি (ডাইভার্সারি ভিসা) পেয়ে কয়েক বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রে আসে। এখন সে বাড়ি গাড়ি কিনে এখানে সুপ্রতিষ্ঠিত। আতিক আমার শালা-কুটুম। তার বাসায় দাওয়াত পাই কিন্তু সময়ের অভাবে যাওয়া হলনা।

ছোটমামার বাসায় ইফতার এক মহা অনুষ্ঠান। মামাতো ভাইবোনেরা সবাই প্রচুর ইফতারি কিনে নিয়ে সপরিবারে এখানে চলে আসে। ছোটমামির হাতে তৈরী হরেক রকমের মিলে দেশী বিদেশী খাদ্যে টেবিল উপচে যায়। আশপাশের আরবী ইয়ামেনি বাসা হতেও প্রচুর ইফতার উপহার আসে। প্রতিদিন সবাই মিলে উৎসবের আমেজে ইফতার পর্ব সমাপন হয়। তারপর ড্রয়িং রোমে জায়নামাজ বিছায়ে মামার ইমামতিতে মাগরিবের জামাত হয়।

একদিন ইফতারে শরিক হন একজন ইয়ামেনি যুবক। দেখতে হালকা-পাতলা তনু, রঙ্গ আমাদের মত শ্যামলা, কুকড়ানো চুল। অনেকটা আমার পুত্র জেফারের মত। এই ইয়ামেনি যুবক আমার মামাত ভাই রাহিদের বন্ধু। আমি ইয়ামেনীকে বললাম, একজন ইয়ামেনি দরবেশ হজরত শাহজালাল(রঃ) আমাদের সিলেট অঞ্চলে ইসলাম ধর্ম প্রচার করেছেন। তার নামেই ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নামকরণ করা হয়েছে। আমার কথা শুনে সে বেশ খুশি হল, তবে বিষয়টা সিলেটি প্রতিবেশী মারফত তার আগেই জানা ছিল। আমি বললাম, হজরত শাহজালাল(রঃ) আমাদের দেশে অতি সম্মানিত নাম। আমার একথা শুনে সে জবাব দেয়, তার সম্মান অবশ্যই বেশি হতে পারে, তবে তা কোনমতে সাহাবি, তাবেইন কিংবা তাবে-তাবেইনদের সমান নয়। আমি এখানেই থেমে যাই, আর কথা বাড়াতে যাইনি।

এই ইয়ামেনি ছেলেটির নাম মেকি। মেকির ইমামতিতে ঐদিন ইফতারের পর আমরা মাগরিবের নামাজ আদায় করি।

৪ঠা জুলাই ২০১৬ সাল। আলম ভাই গাড়ি চালিয়ে আমাদেরকে ডেট্রয়েট ডাউন টাউনে নিয়ে যান। ডাউন টাউনের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ৬/৭ মাইল প্রসস্ত একটি নদী কিংবা চ্যানেল, যাহা লেইক হোরন (Huron) এবং লেইক ইরি (Erie) কে সংযুক্ত করেছে। এই চ্যানেলের ওপারে আছে ক্যানাডার উইন্ডসর সিটি। ঐ উইন্ডসর সিটিতে গোলশান হলি আর্টিজেন হামলার মাস্টার মাইন্ড জঙ্গি তামিম চৌধুরী বেড়ে উঠেছে।

চ্যেনেলের পার বরাবর খানিক ঝুলন্ত রাস্থা এবং চ্যানেলপার ঢালাই করে রাস্থার নিচে যুক্ত করা। ছলাৎ ছলাৎ করে ঢেউয়ের পর ঢেউ আচড়ে পড়ছে রাস্থার নিচে চ্যানেলের তীরের কিনারায়। একদিকে ঠান্ডা বাতাস ও ঢেউ, অন্যদিকে পার্কের ফুলের অপূর্ব সমারোহ। পাশে পাঁচ তারকা Mariot Hotel এর বিশাল চত্বর। হেঁটে হেঁটে বিখ্যাত জেনারেল মটরস কোম্পানীর এলাকায় চলে আসি। গাড়ি আবিস্কারক উইলিয়াম ফোর্ডের প্রতিস্টিত এই কোম্পানীই আমেরিকাকে চাকার উপর দাড় করিয়েছিল।

পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ গাড়ি নির্মাতা এই কোম্পানির চত্বরে অসংখ্য সুউচ্চ ভবন। এই ভবনমালায় রয়েছে তাদের শ’রোম, অফিস, কারখানা, ট্রেইনিং সেন্টার, কনভেনশন সেন্টার ইত্যাদি। প্রায় ত্রিশ ফুট উপর দিয়ে অসংখ্য খুঁটির উপর বসানো হয়েছে মিটারগেজ ট্রেন লাইন। দুই বগির একটি ট্রেন সব সময় জেনারেল মটরস কোম্পানির প্রতিটি ভবনের সামনের প্লেটফর্মে থেমে থেমে প্রদক্ষিন করছে। কোম্পানির কর্মি, কাস্টমার ও স্টেকহোল্ডারগণ বিনা ভাড়ায় কোম্পানির বিশাল কমপ্লেক্স ঘুরে বেড়াতে পারেন। আমরা জেনারেল মটরসের প্রধান কার্যালয়ে প্রবেশ করে শ’রুমে রাখা দামি দামি গাড়ি দেখি ও ছবি উঠাই। তারপর ট্রেনে চড়ে চল্লিশ পঞ্চাশ মিনিটে পুরো কমপ্লেক্স ঘুরে আসি। ট্রেনের বেশ কিছু অংশ লেকের গা-ঘেষে নির্মিত। ট্রেনের জানালা দিয়ে চেয়ে দেখি লোকজন চেনেলে স্পিডবোট চড়ে ও ছোট্ট জলযান হেঁকে জলক্রীড়া করছে। বিশাল আকারের একটি জাহাজ দেখি যা অসংখ্য কার্গো বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমেরিকা ও কানাডার সীমানাবর্তী বিশাল আয়তনের পাঁচ লেকের পারে দু’দেশের বেশ কয়েকটি রাজ্য রয়েছে। তারা এই পাঁচ লেকে চ্যানেল দিয়ে তাদের আন্তুর্জাতিক বানিজ্য পরিচালনা করে থাকে।

লেকপার দিয়ে অনেকক্ষন হাঁটাহাঁটি করি। লেকপারের আসনে বসে শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গ নরনারীরা শুয়ে শুয়ে সামারের নাতিষীতুষ্ণ রোদে শীতল সমির অঙ্গে মাখছে। জায়গায় জায়গায় ফোয়ারায় কৃত্রিম বৃষ্টি হচ্ছে। শ্বেতকায় এবং কৃষ্ণকায় শিশুরা ফোয়ারার ছিটানো জলে ভিজে খেলে খেলে স্নান করছে। তাদের মায়েরাও কম যান না। ফোয়ারার জলে তাদের অর্ধনগ্ন শরীর ভিজে চুপসে আছে। তুফার মেয়েটিও ফোয়ার জলে ভিজে খেলা করে। ১৭৭৬ সালের ৪ঠা জুলাই যুক্তরাষ্ট্র বৃটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে। ঐদিন ছিল যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা দিবস। সন্ধ্যার পর সারাটা মহানগর জুড়ে আতশবাজি শুরু হয়। আমেরিকার অন্ধকার আকাশ আতশবাজির আলোয় ঝলমল করে উঠে। দুইতিন ঘন্টা আতশবাজির তীব্রশব্দ ও অগ্নি স্ফুলিঙ্গে ডেট্রয়েট মহানগরী এক বর্নিল আলোকসজ্জায় পরিনত হয়। অজস্র ফানুষ তারার প্রদীপ হয়ে আকাশে উড়তে থাকে। প্রতিটি বাসার সামনে বারুদে আগুন দেওয়া হচ্ছে, আর তা আকাশে গিয়ে বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়ে ফুলঝুরি হয়ে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে। ঐদিন এভাবেই আমেরিকানরা তাদের স্বাধীনতাকে স্মর করতে দেখি।

এই স্বাধীনতা দিবসের রাতে নয়টায় আমরা পাঁচ তারকা ম্যারিওট হোটেলের গ্রাউন্ড লেবেলে ঈদমেলায় যাই। প্রচুর কাপড়ের দোকান, ক্রেতা বিক্রেতা প্রায় সবাই দক্ষি এশিয়ার লোক। খুবসম্ভব তারা বাংলাদেশী, ভারতীয়, পাকিস্থানি ও আরবি। এই ঈদমেলার প্রধান আকর্ষণ মেহদি উৎসব। দশ ডলার খরচ করে মেয়েরা হাতে মেহদীর নানা ডিজাইনের আলপনা আঁকছেন। এখানে কেবল আনন্দের বন্যা বইছে।

আলম ভাই ও নিয়াজ ভাইয়ের দুইগাড়ি লোড হয়ে মেরিওট হোটেলে যাবার সময়ও আকাশে সশব্দে আতশবাজির তীব্র আলো-ফুলের মালা আকাশে ছড়িয়ে পড়ছিল। ধনী দেশ যুক্তরাষ্ট্র। সরকারী বিধিনিষেধ না থাকায় স্বাধীনতা দিবসের রাতে আমেরিকাবাসী আতশবাজি পুড়িয়ে কোটি কোটি ডলার হাওয়া করে দেয়।

৫ জুলাই ২০১৬ সাল। পবিত্র ঈদের দিন। গত ঈদ উৎযাপন করি যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটনে। এবার পালন করছি মিশিগান রাজ্যের ডেট্রয়েটে, বাংলাদেশ হতে বারহাজার মাইল দূরে এক বাঙ্গালি অধ্যুষিত মার্কিন শহরে। ভোরে ঈদের স্নান সেরে ৩০ মিনিট প্রাত্যহিক হাঁটা সমাপন করে নেই। মামী ও জেরিন গত দুইতিন দিন ধরে ঈদ উপলক্ষে মাংস সিঙ্গারা, চটপটি, পুডিন, পাপওয়ান, রজানিয়া (আমেরিকান খাদ্য), কুকিজ,  প্রিংকিজ মিক্স ইত্যাদি পদের খাবার প্রস্তুত করেন। দেশী বিদেশী সব খাবারেরই একটু একটু স্বাধ নেই। ছোটমামা তার বৌমা ডাঃ নুরজাহান বেগমের জন্য দামি ঈদপোষাক কিনে রেখেছেন। আমি ও জেফার বাদ যাইনি। মামার উপহার ঈদের জামা পরে ঈদমাঠে যাবার জন্য গাড়িতে উঠি।

এক বিশাল পার্কের এক প্রান্তে ঈদের জামাত হবে। কার্পেট দিয়ে মুড়িয়ে ফেলা হয়েছে ঘাসের জমিন। বাহিরে খাবার পানির উত্তম সরবরাহ আছে। সেদিনের ঈদ জামাতে প্রায় পাচ-ছয় হাজার মানুষের সমাগম হয়। জামাতের শতকরা আশিভাগ মানুষই সিলেটি। প্রথম খতিব ইংরেজীতে ভাষণ দেন। দ্বিতীয় খতিব খাস সিলেটি ভাষায় তার সুদীর্ঘ্য বক্তব্য পেশ করেন। বক্তব্যের বিষয়- এই অমুসলিম দেশে ছেলে মেয়েদের প্রতি নজরদারী রাখা। খতিব সিলেটি ভাষায় স্মরন করে দেন, সন্থানরা বিগড়ে গিয়ে ধর্মচ্যুত হয়ে গেলে সবার আম যাবে, ছালাও যাবে। আমেরিকায় হিজরত করার পূন্য জলে ভেসে যাবে। ডেট্রয়েট পার্কের এই ঈদগাহকে মনে হল বিশাল আমেরিকায় যেন এক টুকরো সিলেট। জামাত শেষে আমাদের নর্থইস্ট মেডিক্যাল কলেজের পরিচালক আবু আহমদ খসরু ভাইকে পাই, যিনি আমাদের সাগরদিঘিরপারের প্রতিবেশী।

মিশিগান শীতপ্রধান অঞ্চল। মিশিগানে এখন সামার। শীতাঞ্চলে সামার খুব আরামদায়ক ঋতু। এখানে দিন লন্ডনের মত দীর্ঘ্য, তবে রোদে তেমন উত্তাপ নেই। উত্তাপ বেশী হলে অঞ্চলটা সুদীর্ঘ্য দিনের তীব্র উত্তাপে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যেত। ভোরের আজান হয় সকাল তিনটায় এবং মাগরিব বিকেল নয়টায়। রমজানে তাই উপবাস কাল একটানা আটারো ঘন্টা। এখানে আমাদের ভাষার মাস ফেব্রুয়ারীর মত তাপমাত্রা, তবে বাতাস শুষ্ক। সব সময় উথাল-পাথাল বাতাস বয়। আসমান মেঘলা অথচ বৃষ্টিহীন। প্রায়ই হালকা হালকা বৃষ্টি হতে দেখি কিন্তু আমাদের দেশের মত ঝুম বৃষ্টি হতে দেখিনি। তবে শুনেছি শীতে মাঝে মধ্যে রাজ্যটি বরফে ঢেকে যায়।

তুফার শিশুপুত্র হাসান হাসপাতালে। নিয়াজ ভাই ও আমি তাকে দেখতে হাসপাতালে যাই। মেশিনে হাত ঢুকিয়ে জীবানু-নাশক গরম পানিতে হাত ধুয়ে খালিপায়ে শিশু ওয়ার্ডে প্রবেশ করতে হয়। অনিন্দ্যসুন্দরী ফর্সা সেবিকারা পরম মমতায় নানা বর্ন ও জাতের বাচ্চাদেরকে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন।

মামার পাশের বাসার এক শ্বেতাঙ্গ দম্পতি বসবাস করেন। ভদ্র মহিলার সাবেক প্রেমিক এলে স্বামী মহাশয় স্বেচ্ছায় উদাও হয়ে যান। আবার তিনচার দিন পর প্রেমিক চলে গেলে স্বামী বেচারা এসে হাজির হন। মামীর ভাষায় এসব বিদেশীদের কোন জিদ ঈর্ষে নেই। তারা সবকিছু মেনে নিতে পারে। এমন কি বউয়ের প্রেমিককেও সুযোগ করে দেয়।

ছোটমামাকে সব সময় দক্ষিনভাগের কিছুলোক সঙ্গ দিত। নমির আলী ও বিধান বাবু ছায়ার মত তাকে অনুসরন করত। বহু বছর পর আমাকে কাছে পেয়ে মামা তার অতীতের বাংলাদেশ জীবনের স্মৃতিচার করলেন। বললেন, বাংলাদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধের পর চুরি-চামারী বেড়ে যায়। যুদ্ধবিধ্বস্থ সদ্য স্বাধীন দেশ। জিরো ফান্ড নিয়ে সরকারের যাত্রা শুরু। চারদিকে শুধু অভাব আর অভাব। নানাবাড়িতে চোরের উপদ্রপ শুরু হলো। সুপারী চোর সব সুপারী নিয়ে যাচ্ছে। মামা একদিন সুপারী গাছে ধারালো ব্লেড বসিয়ে দেন। পরদিন গাছের তলায় সুপারি-ছড়া পড়ে আছে। চোর ব্লেডে কাটা পড়ে সুপারী ফেলে পালায়। ফোটা ফোটা রক্ত অনুসরন করে মামা চোরের বাড়িতে হাজির হন। চামড়া কেটে চোরের করুন অবস্থা। পরদিন হতে সুপারী চুরি বন্ধ হলো।

কোন এক রাতে সিঁদেল চোর এসে নানাবাড়ির কাষ্টনির্মিত প্রাচীন ঘরটিতে শাবল দিয়ে সিঁদ কাটা শুরু করে। মামা চোরের আগমন বুঝতে পেরে বড় বুজালী দাও নিয়ে ইদুর ধরার অপেক্ষায় শিকারী বিড়ালের মত খাপ ধরে বসে থাকেন। তার চোখের সামনে মাটিতে একটি গর্ত দেখা গেল। সিঁদকাটা শেষ হল, মামা শিকারের মাথাটার জন্য অপেক্ষা করছেন। প্রথমে সিঁদ চ্যানেলে চোর টর্স মেরে পরীক্ষা করল। এবার মামার বুজালী দাও রেডি। মামা চরম উত্তেজিত চোরের মাথা ঘরের ভিতরে ঢুকছে। চোরের মস্তকে মামা প্রান সপে কোপ বসালেন। বুজালী কোপ খাওয়া চোরের কোন চিৎকার শুনা গেলনা। কেবল একটা ঝরঝর শব্দ হল। দেখা গেল- চোরের মাথা নয় বরং চোর প্রেরিত লাটির অগ্রভাগে বেঁধে পাঠানো একটি মাটির হাড়িতে কোপ পড়েছে। চোর দৌড়ে পালায়। চোরের পিছু অনেক ধাওয়া করেও অন্ধকারে চোরধরা সম্ভব হলনা। তবে একটা লাভ হল এরপর আর কোনদিন চোর সিঁদ কাটতে এবাড়িতে আসেনি।

ছোট মামা বাংলাদেশের আর স্মৃতিচার করেন। একবার নানাবাড়ির মসজিদের দোলক ঘড়িটি চুরি হয়ে যায়। ঘড়িচোর ধরতে আশপাশের গ্রামে অনুসন্ধান চলে।  ঘড়িটি চোর দূরের এক গ্রামে বিক্রি করে দেয়। একসময় ঘড়িসহ চোরকে পাকড়াও করে আনা হলো। গ্রামের অনেক লোকজন জমায়েত হন। সবাই অবাক, চোর পাজামা, পাঞ্জাবি ও টুপি পরিহিত একজন ইয়া দাড়িওয়ালা হুজুর। যাকে দেখলেই সবার সালাম দিতে ইচ্ছে হয়। খবর নিয়ে জানা গেল তিনি দূর গায়ের কোন এক ভাল পরিবারের লোক। ধর্মীয় মাদ্রাসায় লেখাপড়া করেছেন। আমার বড়মামা মাওলানা মাহমুদুর রহমান মামই মিয়া তাই চোরের গায়ে কাউকে হাত তুলতে দিলেন না।

এবার বড়মামা চোরকে জিঞ্জেস করলেন- আপনি কি মসজিদের ঘড়ি চুরি করেছেন? চোর হুজুর জবাব দেন ‘হ্যাঁ’। মামা বললেন, আমি জানি আপনি একজন আলেম, চুরি করা শক্ত গোনাহ, তা কি আপনার জানা নেই? চোর হুজুর জবাব দেন- চৌধুরী সাহেব, সবই আমার জানা আছে কিন্তু আমার করার কিছুই ছিলনা। তিনদিন ধরে ঘরে খাবার নেই, বউ-বাচ্চারা উপোষ রয়েছে। রাতে এই মসজিদে এশার নামাজ আদায় করে অনেকক্ষণ আল্লাহকে ডাকলাম। লোকজন সব চলে গেলে দু’হাত তুলে আল্লাহকে বললাম- হে পাক পরোয়ারদিগার, আজ তিনদিন হয় তোমার দুনিয়ায় কিছুই আমাদের ভাগ্যে জুটে নাই। আমি নিরূপায়। বাঁচার জন্য আমার সামনে এখন চুরি করা ছাড়া আর কোন পথ খোলা নেই। তাই চুরি যখন করতেই হবে, তাহলে তোমার মাল ঐ ঘড়িটাই আমি চুরি করবো। হে আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করে দিও, আপাততঃ তোমার এই ঘড়িটা বিক্রি করে চাল-ডাল নিয়ে যাই, কয়েকটা প্রাণকে বাঁচাই।

চোর হুজুরের বিবরণ সবাই বিশ্বাস করলেন। বড়মামা চোর হুজুরকে কোন প্রকার হয়রানি না করে উল্টো প্রচুর টাকা পয়সা দিয়ে সসম্মানে বিদায় জানান। চোর হুজুরের জন্য তখনই প্রচুর দান-খয়রাত সংগ্রহ হয়ে গেল।   

বড়মামা বড় আলেম। কোনটি জায়েজ আর কোনটি নাজায়েজ, তা নিয়ে তিনি সদাই ব্যস্ত। নানাবাড়িতে একবার প্রচুর কচুর মুকি হয়। কিন্তু সমস্যা হল এই মুকি খেলে গলে চুলকায়। এত মুকি কি করা যায়। সবাই বললেন হাসমতি ঝির স্বামী অসির মামুকে দিয়ে এই মুকি বিক্রির জন্য দক্ষিণভাগ বাজারে পাঠানো হউক। এবার বড়মামা বললেন, চুলকানোর কথা গোপন রেখে ক্রেতার কাছে এই মুকি বিক্রি করা জায়েজ হবেনা। মাওলানা মামু কড়া নির্দেশ দেন, এই মুকি খেলে গলায় চুলকায় একথা ক্রেতাকে জানিয়ে যেন মুকি বিক্রি করা হয়।

অসির মামু মুকি নিয়ে বাজারে বসলেন। সুন্দর মুকি দেখে লোক কিনতে আসে। অসির মামু বলেন, কিনে নেন তবে এই মুকির তরকারি খেলে গলায় চুলকায়। বাজার শেষে দেখা গেল একটা মুকিও বিক্রি হয়নি। বড়মামার আদেশে অসির মামু দুইমন আলু রেল-লাইনের খালে ফেলে বাড়ি ফিরেন।

ঘরে ফিরে অসির মামু বেশ ক্ষেদ নিয়ে বললেন, আজকাল সৎলোকের ভাত নেই। আমি সততা দেখাই, তাই একটা মুকিও কেউ নেয় নাই। যদি মিথ্যাচার করতাম, তবে দুইমন মুকির একটিও খালে ফেলে আসতে হতনা।

ছোটমামি সেবন চৌধুরী আমাকে তার প্রবাসের নানা গল্প শুনান। আমেরিকায় এত সন্থান-সন্ততি নিয়ে গিয়ে নিউইয়র্কের কষ্টকর জীবনযুদ্ধ শেষে মিশিগান আগমন। বেবিকেয়ার, কারখানায় বোতল লেবেল করা, একাজ সেকাজ কতকাজ করেছেন। ভোরের বরফে বের হয়েছেন। শীতে গরমে বিরামহীন পরিশ্রম করেছেন। তালবটে অনেক সাধনায় গাড়ি বাড়ি করে স্থায়ী হয়েছেন।

তার কাছে বাংলাদেশেরও নানা গল্প শুনি, যা আমারও কৌশর-স্মৃতি। নানাবাড়িতে প্রচুর রাজহাঁস, টেপীহাস, মোরগ পোষা হত। এবাড়িতে প্রচুর ছাগল-খাসিও হত। মামীর একটি বড়সড় খাসি ছিল। টাকার প্রয়োজন হলে একবার ছাগলটাকে বিক্রয়ের জন্য বাজারে পাঠান। হাসমতি ঝির পুত্র মোঠামাথার ছাকিল বলল, চাচি খাসি কতদামে বিক্রি করব? মামী বললেন আমার এক হাজার চার শত টাকা দরকার, এর উপর দাম যা হয়। বড়সড় খাসি দেখে ক্রেতা এসেই দাম হাঁকে দুই হাজার টাকা দেবে। ছাকিল জবাব দেয় চাচি বলেছেন চৌদ্দ শত টাকা হলে বিক্রি করে দিতে। বাজারের লোকেরা ছাকিলের কথা শুনে হাসাহাসি করছে। বিধান বাবু দৌড়ে ছোটমামার কাছে গিয়ে বললেন, জলদি এসো, নইলে তোমার বগডুলটা পানির দরে খাসিটা বিক্রি করে দেবে। মামা এগিয়ে যান এবং খাসিটা অবিশ্বাস্য দরে তিন হাজার টাকায় বিক্রি করেন।

কানাডা যাত্রাঃ

৭ম জুলাই ২০১৬ সাল। সকাল ১০টায় আমার মেঝবোন সেহা ও দোলাভাই আব্দুল কুদ্দুস চৌধুরী আমাদেরকে নিয়ে যেতে কানাডার টরেন্টো হতে ডেট্রয়েট আসেন। এখানে মামীর হাতের রান্না বাংলাদেশী খাবারে লান্স করা হয়। আমেরিকার ডেট্রয়েট হতে কানাডার টরেন্টোর দূরত্ব প্রায় ৫০০ মাইল। সেভেন সিটের বড় গাড়ি। দুপুরের খাবার খেয়ে নামাজ পড়ে গাড়িতে বসি। চালক ভাগনা রুহুল চৌধুরী। ডেট্রয়েটের নতুন আবাসিক এলাকা ওয়ারেন পার হই। কিছুক্ষন পর গাড়ি ১৬ লেন বিশিষ্ট যুক্তরাষ্ট্র ক্যানাডা মহাসড়কে উঠে পড়ে। মিটারে তাকিয়ে দেখি গাড়ির গতি ঘন্টায় ১২০ মাইল, বা প্রায় ২০০ কিলোমিটার। আমি একজন চালক হিসাবে জানি এত গতিবেগে বাংলাদেশের রাস্থায় গাড়ি চালানো অসম্ভব। শতশত চকচকে গাড়ী এই প্রচন্ড গতিতে ছুটে যাচ্ছে। দুঘন্টা পর ব্লুওয়াটার ব্রিজে চলে আসি। ব্রিজটি পাচ/ছয় মাইল লম্বা এবং রাস্থার মত ষোল লেইন বিশিষ্ট। নিচের সুপ্রশস্ত নদী বা চ্যানেলটি সাগরসম দুইটি লেককে সংযুক্ত করেছে। ব্লুওয়াটার ব্রিজের এপার যুক্তরাষ্ট্র এবং ওপার ক্যানাডা। আমাদের গাড়ি ব্রিজ পার হয়ে কানাডার ইমিগ্রেশন অফিসের লাইনে দাড় হয়। এই অফিস অনেক লোককে এন্ট্রি না দিয়ে ফেরত পাঠায়। মনে মনে ভাবি আমাদেরকে যদি ঢুকতে না দেয়। তবে সান্তনা কানাডার মাটি ছোঁয়া হয়ে গেছে। তাই নদীতীরের কানাডার অপার সৌন্দর্য্যের দিকে অপলক তাকিয়ে রইলাম।

কানাডার ইমিগ্রেশন অফিস আমাদের গ্রীনকার্ড ও পাসপোর্ট পরীক্ষা করে কোন ধরণের হয়রানি ছাড়াই Go বলে রাস্থা ছেড়ে দেয়। আমাদের গাড়ির বেনেটে চারটি ব্যাগেজ ছিল তাও পরীক্ষা করেনি। অথচ দেখলাম বেশকিছু গাড়ি তারা আটকিয়ে মালামাল পরীক্ষা করছে। এই কৃতিত্বটা আমার ভাগনা রুহুলের। সে খুব স্মার্ট ও ঊয়েল কমিউনিকেটর। অনেকগুলো ভাষায় সে পারদর্শী। কথার ফুলঝরিতে সে ইমিগ্রেশন অফিসারদের সহজে ম্যানেজ করে নেয়। কানাডার রাস্থা যুক্তরাষ্ট্রের মত ১৬ লেনের, তবে আর মসৃণ।

গতবছর নিউইয়র্ক অবস্থানকালে মামাতো ভাই মুর্শেদকে ফোনে বলি, আমি এখন মিশিগান যাবো। তখন সে বলেছিল- সেফাক ভাই, আপনি মিশিগান নাগিয়ে আমাদের ওয়াশিংটন সিটিতে আসেন। মিশিগান আমেরিকার সবচেয়ে Ugly state মিশিগান গেলে আপনার কাছে যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে ভূল ধারণা সৃষ্টি হবে।

সত্যিই তো মিশিগানের রাস্থায় একটু দাগ-টাগ রয়েছে। রাস্থায় ফাটল, কিছু অপরিপাঠি ঘাস, ঝোপঝাড়, দু’একটা কাগজের টুঙ্গা ছড়ানো যা অন্য রাজ্যগুলোয় নেই। এবার আমাদের গাড়ি কানাডার ছোট্ট শহর লন্ডনে প্রবেশ করে। খানিক পরে একটি অত্যাধুনিক মহাসড়ক রেস্ট হাউসে প্রবেশ করি। এখানে যে উচ্চ প্রযুক্তি রয়েছে তা বাংলাদেশে এখনও প্রচলন হয়নি। অটো ফ্লাশ, অটো টেপ, অটো টিস্যু,  অটো শুষ্ক-উষ্ণ বাতাস বের হয়ে হাত শুকানো, অটো দরজা, অটো টি/কফি পরিবেশন ও অটো বিল পরিশোধ- এযেন এক অটোমেশনের রাজ্য। এখানে এসে বুঝতে পারি আমরা এখনও ম্যানুয়েল যুগে আছি আর উন্নত দেশগুলো অটোমেসন প্রযুক্তির যুগে রয়েছে। প্রযুক্তি ক্ষেত্রে তাদের সাথে আমাদের যোজন যোজন ফারাক।

এবার বায়ু-বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী এক বিশাল Wind Fen Electricity অঞ্চলে প্রবেশ করি। রাস্থার দুপাশে অসংখ্য দৈত্যাকার তিন ডানার Wind Fen মাইলের পর মাইল জুড়ে ঘুরছে এবং স্বল্প খরচে প্রচুর Recycle electricity উৎপাদন হচ্ছে।

আমাদের ছেলেবেলায় গ্রামের মেলা হতে আমরা ফরফরি নামে কাগজের তৈরি এক ধরনের রঙ্গীন খেলনা কিনতাম। বাশের মাথায় বসানো ফরফরিরা বাতাসে ঘুরতো, আমরা আনন্দ পেতাম। যেদিক হতে বাতাস বয়, ফ্যানগুলো অটোমেটিক সেদিকে মুখ ফেরায়। তাই উদ্দাম ঝড়ো বাতাসে এই অঞ্চলের কয়েক শত বর্গমাইল জুড়ে ২৪ ঘণ্টা অটো বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। তবে একটি সমস্যা হল পাখি, উইন্ড ফেনের ব্লেডে কাটা পড়ে অনেক পাখি মারা যায় যা পরিবেশবাদীরা মেনে নিতে পারছেন না। মনে হয়, আমাদের দেশের হাওর, দ্বীপ, সাগরপার ও চরাঞ্চলে এধরনের উইন্ড ফেনের সাহায্যে পুনঃ নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ করা হলে দেশ বিদ্যুৎ সক্ষমতায় অনেক এগিয়ে যাবে।

কানাডার রাস্থার দু’পাশের অপূর্ব সুন্দর পাহাড়, ক্ষেত, ওক-পাইনের বনে রাতের আধার নেমে আসে। রাস্থায় কেবল গাড়ির লাইটের আলো। রুহুল বলল আমরা এখন কানাডার সবচেয়ে বড় শহর টরেন্টো এসে গেছি।

সুন্দর আলো ঝলমলে নগরী। ওয়াশিংটন ডিসির মত বড় বড় রাস্থা, বাগান, ওভারব্রিজ অতিক্রম করে টরেন্টো সিটির ক্রিসেন্ট টাউনে আসি। বোন সেহার বাসা এই ক্রিসেন্ট টাউনের ৯ ক্রিসেন্ট প্যালেসের ২৮ তলা ভবনের দু’তলার ১০ নম্বার ফ্ল্যাট। এই একটি ভবনেই আছে ছয়শত ফ্ল্যাট। ভবনটির চারপাশ জুড়ে সুরম্য উদ্যান। ফুলবাগানে বসার জায়গা, হাঁটার রাস্থা, ব্যায়ামাগার, শিশুস্কুল, স্নানাগার সব নাগরিক সুবিধা ভবনটিকে ঘিরে আছে।

এই দৈত্যাকার ভবনের Ground Level হচ্ছে L. এখানে Visitor parking place. Under Ground এ P-1, P-2, P-3 নামে তিনতলা Parking এ প্রতি তলায় ২০০টি করে গাড়ি parking এর ব্যবস্থা রয়েছে। ভবনের ৬০০ ফ্লাটের ৬০০টি গাড়ি রাখার জন্য  P-1, P-2, P-3  Parking Space ব্যবহার করা হয়। তিনবেড তিনবাথের বড়সড় বাসা। ড্রয়িং, ডাইনিং ও কিচেন বেশ প্রশস্থ। বড় বারান্দায় দাঁড়িয়ে টিলা শহর টরেন্টোর সৌন্দর্য্য প্রাণভরে উপভোগ করা যায়।

৮ জুলাই ২০১৬ সাল, শুক্রবার। ঘুম হতে জেগে ট্রেডমিলে ব্যায়াম করি। জুমুয়ার নামাজ পড়তে আমরা গাড়ি নিয়ে টরেন্টো মসজিদে যাই। বিশাল মসজিদটি Steel Frame Structure এ নির্মিত। ছাদ সাদা টিনে তৈরী। মসজিদের আয়তাকার বারান্দায় খেজুর, শিরনি, হাতে তৈরি খাদ্য বিতরন করতে দেখি। মসজিদের পার্কিং এলাকা বিশাল হওয়ায় মুসল্লীদের শত শত গাড়ি পার্কিং করতে কোন অসুবিধা হচ্ছেনা।

আমার দোলাভাই কাম ফুফুতো ভাই আব্দুল কুদ্দুস চৌধুরী কুলাউড়ার হাজিপুর ইউনিয়নের তিনবারের নির্বাচিত চেয়ারম্যান। এই সুদক্ষ মানুষটি চেয়ারম্যানগীরির সাথে আব্দুর রশিদ ওয়াকফ স্টেটের চাবাগান দেখা শুনা করতেন। সিরাজনগর চাবাগানের লেকঘেরা টিলায় নির্মিত অপূর্ব সুন্দর বাংলোতে অবস্থান করে চাবাগান ও ইউনিয়ন চেয়ারম্যানী পরিচালনা করতেন। একসাথে দু’টি কঠিন দায়িত্বপালন তার কাছে কিছুই ছিলনা। কুদ্দুস চৌধুরীর আরেক অফিস ছিল পূর্ব দরগাগেটের রশিদ মঞ্জিল। রশিদ মঞ্জিল জরাজীর্ণ হলে তিনি সংস্কার করান এবং সিলেটে এলে তিনি এখানে অবস্থান করতেন। স্পিকার ও মন্ত্রী হুমাউন রশিদ চৌধুরী ছিলেন তার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়।

আব্দুল কুদ্দুস চৌধুরীর একমাত্র পুত্র রুহুল চৌধুরী এবং পাঁচ কন্যা চুন্নি, গিন্নি, উর্মি ও সুর্মিকে নিয়ে বাংলাদেশে এক সুখী জীবন কাটিয়ে কানাডায় আসেন। এখন এই কানাডার টরেন্টো শহরে সবাই মিলে এক শান্তিময় নিস্তরঙ্গ জীবন পার করছেন তারা। পুত্র রুহুলকে বিয়ে দেন ফুলবাড়ি গ্রামের এম পি ফাতেমা চৌধুরীর টিলাবাড়ি।

বড়কন্যা চুন্নী বৃটেনে, গিন্নী কানাডার সেকচেচুয়ান, মুন্নি এই একই ভবনে এবং সুর্মি, উর্মি রুহুল একসাথে একই ফ্ল্যাটে আছেন।

৯ জুলাই ২০১৬ সাল, শনিবার। সকাল ঘুম হতে জেগে বাহিরে আসি। আমাদের বসন্তকালের মত আরাম বাতাস বইছে। টরেন্টোর অপূর্ব সুন্দর সকাল। পরিচ্ছন্ন সুপ্রশস্ত রাস্থা। রাস্থার একপাশে ডেন্টনিয়া পার্ক অন্যপাশে নানাজাতের কুসুমসজ্জিত বাসা সারি সারি। হেঁটে হেঁটে ডেনফোর্ড বাজারে চলে আসি। এখানে বেশ কয়েকটি বাংলাদেশী গ্রোসারি আছে। এসব বাংলাদেশী দোকানে দেশের সব ধরনের উৎকৃষ্ট মানের মাছ, তরিতরকারী, শাকসবজি ও ফলমূল পাওয়া যায়। রাস্থার অন্যপাশে Shopper Mol এর ব্যবসাকেন্দ্র ও পার্কিং এলাকা।

ক্যানাডা খুব পরিচ্ছন্ন দেশ, কোথায়ও কোন ময়লার ছিটাফুটা নেই। এখানকার মানুষ ভদ্র ও স্বল্পভাষী। এখানকার শিশুদেরকেও কোন ধরনের হৈ-চৈ, চিল্লা-চিল্লী করতে দেখা যায়না। কি যেন এক নির্জনতা ও প্রশান্তি সারা দেশটিকে জড়িয়ে রয়েছে।

কানাডায় এখন সামার। প্রতিটি ডুপ্লেক্স-ট্রিপ্লেক্স বাসার চারপাশে প্রচুর খালি জায়গা ও প্রস্ফুটিত ফুলের বাগান। কোন বাসায় পাকা সীমানা দেয়াল নেই। পাকা দেয়ালের বদলে আছে কাট ও স্টিলের হালকা বেড়া। তাই বিভিন্ন বাসার বাগান মিলে মিশে সুদূর দৃষ্টিসীমা পর্যন্ত সুবিশাল উদ্যানে রূপ নেয়। ২৫/৩০ তলা যেসব বহুতল অট্টলিকা রয়েছে, যেখানে ৫০০/৬০০ পরিবার লোকজন বসবাস করে, সেই অট্টালিকাগুলোও সুবিশাল উদ্যানের মধ্যে রয়েছে। মানুষ, গাড়ি কখনও টুকাটুকি হয়না। বহুতল ভবনগুলো দূরে দূরে এমনভাবে নির্মিত যে এক ভবনের ছায়া অন্য ভবনে পড়তে পারেনা।

টরেন্টো শহরের সড়কগুলো চার থেকে ষোল লেনবিশিষ্ট। তা ছাড়া প্রতি রাস্থার দু’পাশে সুপ্রশস্ত ফুটপাথ ও বাইসাইকেল চালানোর আলাদা লেন রয়েছে। এখানে গ্রাউন্ড, আন্ডারগ্রাউন্ড ও ওভারগ্রাউন্ড এই তিন দিক দিয়েই রাস্থা নির্মিত। সর্বত্র গ্রাউন্ড ট্রেন ও আন্ডার গ্রাউন্ড ট্রেন চলাচল করে। কুসুম সজ্জিত পার্কে হাঁটার সময় হঠাৎ টের পাওয়া যায় মাটি কাঁপছে, মাটির তলায় ট্রেন যাচ্ছে। সারাটা টরেন্টো মহানগর জুড়ে উদ্যান আর উদ্যান।

আমাদের দেশের রাজধানী ঢাকা, বন্দরনগরী চট্টগ্রাম কিংবা পুন্যশহর সিলেটকে টরেন্টোর মত পরিকল্পিত ও সুসজ্জিত করা কখনও সম্ভব নয়। কারন আমাদের শহরগুলোতে এত জায়গা বের করে আনা সম্ভব নয়। আমার মনে হয় দক্ষিনে কোন জনশূন্য দ্বীপে কিংবা হাকালুকি, টাঙ্গুয়ার হাওরের মত কোন জনহীন এলাকায় এধরনের শহরের পরিকল্পনা করা যেতে পারে। কিন্তু পরিকল্পনা করলে তো হবেনা, আমাদের এত টাকা কোথায়? এত প্রযুক্ত কোথায়?

যুক্তরাষ্ট্র ও ক্যানাডার সীমান্ত জুড়ে পাঁচটি অপূর্ব সুন্দর লেক রয়েছে। এই লেকগুলো যেন এক একটা সমুদ্র। কূলকিনারাহীন এই লেকগুলো আয়তনে বাংলাদেশ, ভূটান কিংবা শ্রীলঙ্কার মত ছোট ছোট এক একটা দেশে সমান। ছয় সাত মাইল প্রশস্ত জলপথ দ্বারা একটির সাথে অন্যটি জড়িয়ে রয়েছে। এই লেকগুলোর পারে কোথায়ও বেলাভূমি, কোথায়ও পাহাড়, কোথায়ও সমতল ঘাসের গালিচা, কোথায়ও পাখিডাকা জলাবন। এদেরই মধ্যকার এক মিলনকেন্দ্র নায়েগ্রা জলপ্রপাত।      

লেকগুলোর নাম ভারী সুন্দর। পশ্চিম হতে শুরু করে পূর্বদিকে একে একে রয়েছে লেক সুপিরিয়র, লেক মিশিগান, লেক হুরন, লেক ইরি এবং লেক ওন্টারিও। এই পাঁচটি লেকের পানি একে একে এসে লেক ওন্টারিওতে জমা হয় এবং লাব্রাডা প্রনালী দিয়ে আটলান্টিক মহাসাগরে প্রবাহিত হয়। আটলান্টিক মহাসাগর পর্যন্ত প্রসারিত এই লেক জলপথ আমেরিকা-কানাডার সেরা আন্তর্জাতিক বানিজ্য ও পণ্য পরিবহন লাইন। কানাডার সর্ববৃহৎ মহানগর টরেন্টো। এই শহরে ছয়ত্রিশ লক্ষ মানুষের বসবাস। গড়ে প্রতি দশ জন কানাডাবাসী একজন এই শহরের বাসিন্দা। শহরটি লেক ওন্টারিওর পারে গড়ে উঠেছে।

৯ আগষ্ট ২০১৬ সাল। উজ্জ্বল রোদেলা বিকেল। আমরা দুইটি গাড়ি ভরে টরেন্টোর উপকন্ঠে Blueffer’s park দেখতে যাই। একটি গাড়ি ভাগনা রুহুল ও অন্যটি ভাগনা-বউ সিদরাত ড্রাইভ করে নিয়ে যান। কোন এক অপূর্ব সুন্দর রাস্থা দিয়ে গাড়ি অগ্রসর হয়। রাস্থার দু’পাশে বিচিত্র বৃক্ষলতা ও বনফুলের সমাহার। এই দৃশ্যাবলী অনেকটা আমাদের শ্রীমঙ্গলের রাস্থাপাশের সাথে তুলনীয়। এখানে সবুজ চায়ের বন আর সেখানে সবুজ মিহি ঘাসের গালিচা পাহাড়কে ঘিরে রেখেছে।

আমাদের গাড়ি দু’টি Blueffer’s park এর পার্কিং এরিয়া হতে বের হয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হয়ে লোকজনকে আনন্দমত্ত দেখতে পাই। লেকের পার শক্ত পাতরে বাঁধানো। অথচ নিচে বালির অপুর্ব সৈকত। ছোট ছোট বর্নিল উর্মিমালা আচড়ে পড়ছে সে সৈকতে। এখানে পাহাড় ও লেকের অপূর্ব সুন্দর সম্মিলন ঘটেছে। লেকে স্পিডবোট চড়ে লোক জলবিহার করছে। সাদা ফ্যালকন পাখিরা উড়ছে। পাশে পাখি ও মৎস্যের অভয়ারণ্য। লেক এসে ঢুকে পড়েছে পাহাড়ের ভাঁজে। ছোট ছোট ভাসমান সেতু দিয়ে অভয়ারন্যে প্রবেশ করি। এযেন বাংলাদেশের বাইক্কার বিলের জলাবন। বনের ঝোপঝাড়ে ছোট্ট ছোট্ট পাখির বাসা। মা পাখিরা বাসায় বসে ডিমে তাপ দিচ্ছে। একেবারে হাতের কাছে, চোখের সামনে। সুসভ্য কানাডাবাসী কেউ কোন ধরনের যন্ত্রনা করছেনা প্রকৃতির এই অপূর্ব সৃষ্টিদেরে। জলহাঁস ও রাজহাঁস দলবেঁধে সাঁতার কাটছে। মা হাঁসের পিছনে পাঁচ ছয়টি ছানাও নির্ভয়ে সাঁতার কেটে বেড়াচ্ছে। নিজেকে প্রশ্ন করি, আমাদের দেশের জলে এভাবে বাচ্চা নিয়ে বুনো হাঁসগুলো কি সাঁতার কাটার সাহস করবে।

এখানে ক্যানাডা সরকার মাছের প্রচুর পোনা উৎপাদন করে। পোনা বড় হলে তা ছেড়ে দেয় কানাডার শত শত লেকে।

নিবিড় বনে ডাকা মেঠো পথ। পথে দু’পাশে কাশবন, ছনবন, মুর্তাবন ও জলাবন। বনের ধারের জলে পদ্ম ভেট ও শাপলা মৃদুমন্দ বাতাসে মাথা নাড়ছে। দু’চোখের পাতা বন্ধ করে আমি এখানে বাংলাদেশের ভাটি অঞ্চল দেখার স্বাদ গ্রহন করলাম। এই অভয়ারন্যে শীতকালে যান্ত্রিক উপায়ে পানি উষ্ণ রাখা হয়, যাতে মৎস্য ও পাখিকূল বেঁচে রয়। লেকের পারে দুগ্ধধবল পাতরের খাড়া পাহাড় নয়ন বিমোহিত করে। এই হৃদের তীরের বিচটিও সমুদ্র সৈকতের মত। এলোমেলো হাওয়ার মাঝে সন্ধ্যা নামছে। আহা কি যে আরাম। কানাডার সামার সত্যই অসাধারন।

কানাডার সামারের সুন্দর প্রকৃতি ও আরামদায়ক আবহাওয়া উপভোগ করার জন্য স্কুল কলেজ একটানা দুইমাস বন্ধ থাকে। কানাডার সমৃদ্ধ ও সুখী নানা ধর্ম, বর্ণ, জাতির লোকজন মিঠেকড়া রোদে সুশীতল বাতাসে জীবনটাকে শতভাগ উপভোগ করে নেয়। চারদিকে তাকালে মনে হয় তাদের জীবনে কোন দুঃখ নেই, জ্বালা-যন্ত্রণা নেই। দেশটার সবাই যেন আনন্দে মাতোয়ারা।

১০ জুলাই ২০১৬ সাল। ঐ দিন আমরা ভূগর্বস্থ ট্রেনে টরেন্টো শহরের অন্টারিও লেকপারে যাই। আমাদের আবাস ক্রিসেন্ট টাউনের হাইরাইজ ভবনমালার কাছেই মেট্রোট্রেন স্টেশন। খানিক হেঁটে স্টেশনে গিয়ে লিফটে স্টেশনে নেমে ট্রেনে উঠি। পথে টরেন্টোর ডাউন টাউন দেখা হয়। কাঁচ নির্মিত অসাধারন শহর। এখানে আছে বিখ্যাত C N Tower (Canadian National Tower) যার উচ্চতা ১৪৬৮ ফুট। টরেন্টো যুক্তরাষ্ট্রের ডেট্রয়েটের চেয়ে অনেক উন্নত শহর। ডেট্রয়েটে রেলপথ নেই, অথচ এখানে মানুষ নিজ বাসে কিংবা পাতাল রেলে নির্বিঘ্নে সারাটা টরেন্টো ঘুরে বেড়াতে পারেন। টরেন্টো মহানগর পুরোটাই সবুজে ঢাকা ম্যাপল, উইলো, পাইন বৃক্ষে ছাওয়া এক নিরব উদ্যান। কানাডার এই শহর বন জঙ্গল জলা, বৃক্ষলতা ঘেরা কাটবিড়ালি, বুনোহাঁস ও পাখিদের এক স্বর্গরাজ্য।

সড়কের দুইপাশে সারি সারি ডুপ্লেক্স ও ত্রিপ্লেক্স বাসা। প্রতিটি বাসায় সুসজ্জিত বাগান ও দামি গাড়ি। প্রতিটি বাসার পাশে রয়েছে শিশুপার্ক কিংবা নেচার পার্ক। এযেন পৃথিবীর এক স্বপ্নপুরী। এখানে মানুষ বেশ সুখ-শান্তিতে কর্মব্যস্ত জীবন পার করেন। আমরা ভিক্টোরিয়া পার্ক স্টেশনে ট্রেনে উঠি। গন্তব্যে পৌঁছে আমরা টরেন্টোর বিখ্যাত পর্যটন দ্বীপ সেন্টারপার্কে যাবার জন্য টিকেটের লাইনে দাড়াই। আমাদের সাথে ছিলেন ভাগনা রুহুল, বৌমা ছিদরাত, ভাগনি মুন্নী ও নাইম। মুন্নির সুদর্শন তিনজন পুত্ররত্ন ওয়ামি, ওয়াজি ও ওয়াফি। আবার লাইন ধরে জাহাজে আরোহন করি। দু’তলা পর্যটন জাহাজ। কুলকিনারাহীন অন্টারিও লেকের অথৈ জলে সাঁতার কাটে। ঢেউ ভেঙে অসংখ্য দ্রুতগামী জলযান লেকে ছুটাছুটি করছে। আমাদের জাহাজ ভর্তি চার পাঁচ শত নানা জাতি, ধর্ম, বর্ন, ভাষা ও নৃতাত্বিক লোকজন। তাদের পোষাক আষাক সবই বিচিত্র। বিচিত্র গাত্রবর্ণের সাথে বিচিত্র চুলের স্টাইল। মনে হল মহান আল্লাহ বৈচিত্র পছন্দ করেন। এই বৈচিত্রের খেলা যেন তিনি তার সেরা সৃষ্টি মানুষের মধ্যেও প্রয়োগ করেছেন। জাহাজ হতে পিছনে তাকাই। চেয়ে দেখি টরেন্টো শহরকে ক্যালেন্ডারের ছবির মত অপূর্ব লাগছে। প্রতিদিন দুইটি জাহাজ এভাবে লোকজন নিয়ে অনবরতঃ সেন্টারপার্কে যাতায়াত করে থাকে।

সেন্টারপার্কে আসতে জাহাজের প্রায় ৪০/৪৫ মিনিট সময় পার হয়। সেন্টারপার্ক হতে লেক সৈকতে টরেন্টো সিটি দেখা গেলেও অন্য কোন দিকে উপকূল দেখা যায়না। অথৈ লেকে নৌকা বেয়ে দক্ষিনে এগিয়ে গেলে যুক্তরাষ্ট্রে পৌছা যাবে। চোখের সামনে অথৈ সাগরের মত সীমাহীন জলরাশির উপর উর্মিমালা খেলা করছে।

সেন্টারপার্ক হল অন্টারিও লেক-সাগরে ভাসমান বেশ কয়েকটি ক্ষুদে দ্বীপের নিকুঞ্জ। এই চরগুলোর মাঝে মাঝে আছে অগভীর জলাভূমি। এই দিঘীসম জলাভূমির উপর দিয়ে নির্মিত সেতু দিয়ে দ্বীপগুলোকে একসুতায় বেঁধে ফেলা হয়েছে। এই অগভীর জলাভূমি আমাদের ভাটি অঞ্চলের বিলের মত। তরঙ্গহীন পানিতে মুখ মেলে তাকিয়ে আছে জলপদ্ম, শাপলা ও ভেট জাতীয় জলজ লতাগ্লুগ্ন। পুরো জলাভূমি জলচর হাঁস ও পাখির অবাধ বিচরন ভূমি।

সারা চরাঞ্চলে সবুজ ঘাসের পরিপাঠি গালিচা, হাঁটতে মনে হয় সবুজ ইরানী মখমলের গালিচার উপর দিয়ে হাঁটছি। আমাদের মাথার উপর সারি সারি ম্যাপল, পাইন, উইলো, খৃস্টমাস ট্রি সেদিন ছাতা মেলে সামারের উজ্জল দুপুরে ছায়া বিতরন করে। নাস্তা সারতে আমরা একটি বড় ম্যাপল গাছের নিচে গোলাকার হয়ে বসি। বাদ সাধলো পাশে একজোড়া শ্বেতাঙ্গ কপোত-কপোতি। তারা পরস্পর জড়িয়ে ধরে লীলামত্ত। একসময় আমাদের গ্রামের বাড়ির ছন-ছাদের বাংলোয় শুয়ে শুয়ে ছাদের চেপ্টা তীরের উপর চড়ুইদের প্রকাশ্য কাম-উম্মাদনা দেখতাম। আজ তাই দেখছি পাশের ম্যাপল তলার সবুজ মাঠটায়। আমাদের দেশের চড়ুই কিংবা কবুতরের দল সবার সামনে যা করে এখানে দিবালোকে প্রায় তাই করে তরুণ তরুণীরা। কোন রাখডাক নেই, একেবারে নির্বিঘ্নে ও প্রকাশ্যে।

ক্যানাডায় কেউ কারো দিকে তাকায়না। পরস্পর সম্মতিতে নরনারীরা স্বাধীনভাবে কাজ চালিয়ে যেতে পারে। ও কাজে আমাদের মত তাদের কোন পাপবোধ নেই, বাঁধা নিষেধ নেই। আসলে নৈতিকতা ও পাপবোধ ধর্মে ধর্মে এবং জাতিতে জাতিতে ভিন্ন হয়, এমন কি বিপরীত হতেও দেখা যায়। আমাদের নারীদের শরীর না ঢাকা পাপ, কিন্তু ওদের তা নেই। আমাদের প্রকাশ্য ওরালসেক্স পাপ, ওদের কাছে এতে আবার পাপের কি? এটা তো জীবজগতের প্রাকৃতিক ব্যাপার স্যাপার। তখন আমার মনে হল পবিত্র কাবাঘরের দিকে পা রেখে অসংখ্য মানুষকে আমি বসতে দেখেছি। একজন কালো মানুষকে এটা ঠিক নয় বললে সে জবাব দেয় এতে আবার সম্মান অসম্মানের কি আছে। আল্লার ঘরের দিকে আপনি সেজদা দিবেন, মুখ রাখবেন, চোখ রাখবেন, হাত রাখবেন, সবগুলো অঙ্গ রাখবেন। আর পা রাখলেই পাপ হয়ে যাবে, অসম্মান হয়ে যাবে। এখন বলুন তো পায়ের দুষটা কিসের। আমি কাবার দিকে পা রাখা লোকের যুক্তি শুনে ভাবি আসলে তাইতো।

ভাগনা নাইম বললো- এখানে বসা যাবেনা, অন্যত্র চলে যাই। আমি বলি দরকার নেই। ওদিকে না তাকালেই হল। আমরা সবাই গোল হয়ে ঘাসের মাঠে খেতে বসি। ওয়ানটাইম প্লেটে নানা উপাদেয় উপাদানে তৈরি রসনাদার গম-পাউরুটির বার্গার আসে। এক বার্গারেই শুন্য পাকস্থলী ভরে যায়।

টরেন্টোর কাছে অন্টারিও লেকের পর্যটন চরাঞ্চল সেন্টারপার্ক নানা প্রজাতির পাতাঝরা বৃক্ষশোভিত, শীতদেশীয় নানা অজানা ফুলের এক সুসজ্জিত বাগান। সোয়ান ড্রাইভে নেমে দেখি পাতিহাঁসের মা-দেরে কচি ছানাদেরে নিয়ে সাঁতরাত কাটছে। সারাটা দীপাঞ্চলে জুড়ে প্রচুর সাদা গাংচিল ও ফ্লেমিঙ্গরা উড়াউড়ি করছে। দ্বীপগুলোর মধ্যবর্তী অগভীর জলাভূমি শান্ত নদীর মত। তীরে তীরে বন, বসার ও জলে নামার ঘাট, সামনে স্ফটিক স্বচ্ছ জল, মাছ, জলচর প্রানী, সবই অপূর্ব। ছোট ট্রেনে চড়ে দ্বীপের অনেক জায়গা ঘুরে আসি। কোথায়ও লেক-পার, কোথায়ও সুড়ঙ্গ পথ। পথে পড়ে একটি চিড়িয়াখানা। এখানে গরু, ছাগল, শুকর, খরগোস, ময়ুর, ঘোড়া, ভেড়া, মোরগ, টার্কিস সব ধরনের প্রানীর সমাবেশ রয়েছে। এক টিকেটে অনেক রাইড চড়ি।

চিড়িয়াখানা দেখে আমরা বিচদ্বীপে যাই। সেতু পার হয়ে এই মনমুগ্ধকর দ্বীপ। এখানে বাগান আর বাগান, ফুল আর ফুল, সুন্দর সুন্দর বিদেশী ছায়াবৃক্ষ। হাঁটুজলের জলাশয় জুড়ে ফোয়ারায় বৃষ্টি হচ্ছে। জনক-জননীকে নিয়ে কিশোর-কিশোরী ও শিশুরা জলকেলী করছে। গোলাপবর্নের অনিন্দ্যসুন্দরী মেয়েরা জলে ভিজে স্বর্গের হুর-পরী হয়ে আছে। সোনালী চুল, রক্তিম গাল, নীল নয়ন দেখে মনে হয় এরা যেন প্রাচীন মিশরের বিশ্বসুন্দরী গ্রিক রানী ক্লিওপেট্রা কম্বলের ভাঁজ হতে উলঙ্গ বের হয়ে রোমান সেনাপতি এন্টোনির সামনে নিরাভরন দাঁড়িয়ে আছেন। জলে সিক্ত নীল চোখের শিশুরা যেন এক একটা মোমের পুতুল।  

হাসি-খুশি ও আনন্দের দেশ কানাডা। সামারে কানাডাবাসী আনন্দের জোয়ারে গা ভাসিয়ে দেয়। সামনে একটি সেতু পার হয়ে লেকের ভিতর নির্মিত হাওয়াখানায় যাই। উদ্যম বাতাসে দাঁড়িয়ে নিচের বিচের দিকে চোখ ফেরাই। লেক সৈকত জুড়ে বাচ্চাদেরে নিয়ে স্নান করছে অনেক অনেক সুদর্শন ও সুদর্শনা নরনারী। প্রায় বিবস্ত্র হয়ে সাঁতার কাটছে, ঢেউয়ে তালে তালে জলক্রীড়া করছে তারা। যতদূর দৃষ্টি যায় কেবল স্বর্গের হুর গেলমান। মানব-মানবীর এত রূপ দেখে চোখ ঝলসে যায়। বিখ্যাত ভারতীয় লেখক খুশবন্ত সিং হাওয়াই সি-বিচে অনিন্দ্যসুন্দরী উলঙ্গ নরনারী দেখে শোকরানাস্বরূপ ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানান। আমারও ইচ্ছে হল আল্লাহকে শোকরিয়া জানাই কিন্তু আমাদের ধর্ম ওদিকে তাকাতে যে নিষেধ করেছে। বেগানা নরনারীদের উলঙ্গ শরীর দেখা যে আমাদের পাপ। তাই চোরা-চোখে একটু একটু দেখে নিলাম এবং আল্লাহকে বললাম প্রভূ আমাকে ক্ষমা কর।

লেকজুড়ে কেউ স্পিড-বোট, কেউ বৈঠা-বোট, প্লাস্টিক-ভেলা, কেউবা বায়ুভর্তি রাবার-বোটে শুয়ে বসে জলে ভেসে আছেন। এখানে ক্ষণস্থায়ী জীবনটাকে ভোগ করে নেওয়ার প্রতিযোগিতা চলছে। পানীয় ও ফাস্টফুডের বন্যা বইছে। মানুষগুলো কি হৃষ্টপুষ্ট। তাদের যে কোন দুঃখ আছে তা বুঝার কোন উপায় নেই।

দুঃখিনী বাংলাদেশের কথা তখন মনে পড়ল। এই বাংলা মুল্লুকে সামান্য ডাল-ভাতের জন্য মানুষ কি যে হাড়ভাঙ্গা খাটুনি দিয়ে যাচ্ছে। মানুষ নিজে যন্ত্র হয়ে রিকশা টানছে, ঠেলাগাড়ি ঠেলছে, রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে ফসলের মাটে গলদগর্ম হচ্ছে। কিন্তু এত পরিশ্রম করেও তেমন কোন ফলাফল পাচ্ছেনা তারা। তাদের জীবনটা ভোগ-বিলাসহীন এক অনিশ্চিত দারিদ্রের ঘুর্ণাবর্তে পাক খাচ্ছে।

আমাদের ঘরে অনিশ্চয়তা, বাহিরে অনিশ্চয়তা, কর্মে অনিশ্চয়তা, ব্যবসায় অনিশ্চয়তা, রাস্থায় অনিশ্চয়তা। আমরা জীবনটাকে পার করি অনিশ্চয়তার এক কূলহীন সমুদ্রে সাঁতার কেটে। ১৬ কোটি মানুষের জন্য জায়গা বরাদ্ধ মাত্র ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল। অথচ সাড়ে তিন কোটি কানাডাবাসী সাড়ে আটত্রিশ লক্ষ বর্গমাইল জায়গার মালিক। বনজঙ্গল, লেক জলাভূমি, আলুক্ষেত, গমক্ষেত, চেরি, পিচ, আঙ্গুর, আপেল বাগান, প্রাকৃতিক গ্যাস, খনি, বায়ুশক্তি কি নেই ক্যানাডায়। কানাডার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী পিয়েরে টুডো ইমিগ্রেশন আইন অনেকটা শিথিল করেছেন। আগামী বছরগুলোতে তারা কয়েক লক্ষ মানুষকে ইমিগ্রেশন ভিসা দেবে। আপনারা আবেদন করুন, চেষ্টা করুন। আপনিও হতে পারেন এই ভাগ্যবান দেশের একজন ভাগ্যবান নাগরিক।

সেন্টারপার্ক দ্বীপে ঘন ঝাউগাছ দিয়ে তৈরী লোকচুরি খেলার বন মেইজি(Mage)। বনটি একটি গোলকধাঁধা। বনের মধ্যভাগের মাটে পৌছা বেশ কঠিন কাজ। বয়স্ক লোক ও শিশুরা দিকভ্রান্ত হয়ে ভুলপথে চলে যায়। ঘন বনপথে মাথা খাটিয়ে বহুকষ্টে সফল হতে হয়। ইতিহাসে লোকচুরি খেলার অনেক রাজমহলের কাহিনী পড়েছি। আদিকালের রাজারা এধরনের ভবনে তাদের স্ত্রী ও রক্ষিতাদের সাথে লুকোচুরি খেলতেন। আর এই মেইজী ঘন ঝাউবনের প্রাকৃতিক লোকাচুরি খেলার মাট। এই ঝাউবনে কেউ লুকিয়ে গেলে তার কন্ঠ শুনে কাছে পৌছা কিংবা খুঁজে বের করা বেশ আনন্দদায়ক। কানাডার এই মেইজি বনে ছুটাছুটি করে রবি ঠাকুরের দু’টি লাইন মনে হল- “মেঘের কোলে রোদ হেসেছে বাদল গেছে টুটি/ আজ আমাদের ছুটি ও ভাই আজ আমাদের ছুটি। পথ হারিয়ে কোন বনে যাই, কোন বনেতে ছুটে বেড়াই, সকল বালক জুটি/ আজ আমাদের ছুটি ও ভাই আজ আমাদের ছুটি”।

এধরনের লোকচুরি বন বাংলাদেশেও তৈরী করা খুব সম্ভব। কেবল দরকার কোন একজন উৎসাহী মানুষের উদ্যোগ গ্রহন। হ্যাঁ এধরনের একটি ছোট লোকচুরি বন আমি হবিগঞ্জের প্যালেস রিসোর্টে দেখেছি অনেকদিন পর।

১১ জুলাই ২০১৬ সাল। রুহুলের গাড়ি চড়ে টেইলর পার্কে যাই। টিলার উপর পিকনিক করার মাট। উপত্যকা জুড়ে বৃক্ষলতা ফলফুল ঘাসফুল ও ঝর্নাধারা। এই পার্ক অনেকটা আমাদের লাউয়াছড়ার মত। এক ঘন্টা ঠাণ্ডা বাতাসে হাঁটি ও দৌড়াই। জেফারকে নিয়ে পাহাড় টেকিং করি, নিচের ঝর্নায় নেমে যাই। পাইন, উইলো ও ম্যাপল বন। বৃক্ষতলায় শুকনো পাতার গালিচা। ওদেশের বন সম্পর্কে তেমন জানিনা। যদি সাপ বেরিয়ে আসে তাই খুব সাবধানে হাঁটি। অসংখ্য লাল টিয়া ও হলুদ পাখি চোখে পড়ে। নানা ধরনের কাটবিড়ালি খটখট আওয়াজ করে লাফালাফি করছে। বিরহী ও বিষন্ন রূপবৃক্ষ উইলোর তলায় আমাদের ছবি তুলি। এই পার্কে মানুষ তাদের প্রিয়জনের স্মরণে অসংখ্য বৃক্ষরোপন করে।

বড় বড় বৃক্ষ শিকড়ের সন্নিকটে ঢালাই খোটার মাথায় প্রয়াত প্রিয়জনের নাম, ঠিকানা, জন্ম ও মৃত্যু তারিখ লিখে সৌজন্যে নিজের নাম ঠিকানা মার্বেল পাতরে খোদাই করে কাচের প্রলেপে ঢেকে রাখে। অর্ধ শতাব্দী আগেকারও অনেক স্মৃতিফলক চোখে পড়ে। মনে হল হারানো প্রিয়জনের সাথে নিজেকে স্মরণীয় করে রাখার এ এক উত্তম ব্যাবস্থা। এই স্মৃতিবৃক্ষ রোপন প্রথা বাংলাদেশে চালু করা গেলে এদেশ বৃক্ষে বৃক্ষে সবুজ হয়ে যাবে। ১৬ কোটি বাঙ্গালি প্রত্যেকে যদি প্রিয়জনের স্মরণে একটি করে বৃক্ষরোপন করে স্মৃতিফলক বসায় তাহলে দেশে ষোলকোটি দৈত্যাকার বৃক্ষ জন্মাতে সময় লাগবেনা।

আমার ক্যানাডা প্রবাসী দোলাভাই আব্দুল কুদ্দুস চৌধুরী বহুবছর কুলাউড়ার হাজিপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন। তার সাতাশ বিঘার একটি পাহাড়ি ফল বাগান ছিল। লোকে বলতো চেয়ারম্যান টিলা। খুবসম্ভব তিনি কানাডার ন্যাচারপার্কে দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে এই চেয়ারম্যান টিলার সামনে রাস্থার ধারে একটি স্মৃতি বটবৃক্ষ লাগান। এই বটবৃক্ষের শিকড়ে তিনি স্মৃতিফলকে যে কবিতাটি লিখে দেন তা আপনাদের কাছে বর্ননা করার লোভ আমি সামলাতে পারছিনা।

 

 

বটবৃক্ষ

শাহজাহানের স্মৃতি আছে যমুনার তীরে,

স্মরণ করছে লোকে যুগ যুগ ধরে।

রোপিলাম বটবৃক্ষ চেয়ারম্যান টিলায়,

পথিকেরা ছায়া পাবে, দুপুর বেলায়।

কোকিল ডাকিবে গাছে সুমধুর সুরে,

বধুরা শুনিবে বসে নিজ নিজ ঘরে।

ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি এসে খাবে তার ফল,

ময়না টিয়া আর শালিকের দল।

কেহ যেন নাহি কাটে ভূলেও কখন,

শিকারীরা এলে পরে করিও বারণ।

কোনকালে যদি গাছ মরে যায় আমার,

রোপন করিও একটি নুতন আবার।

ছদগায়ে জারিয়া রূপে থাকিবে সদায়,

আমি যবে চলে যাব চিরনিদ্রায়।

রচয়িতাঃ

আব্দুল কুদ্দুস চৌধুরী (ক্যানাডা প্রবাসী)

সাবেক চেয়ারম্যান, হাজিপুর ইউনিয়ন, কুলাউড়া।

 

প্রায়ই টরেন্টো টেইলর পার্কের জলাবনে প্রবেশ করি। নীরব নিস্থব্দ এক হিরন্ময় বন। জলের মধ্যে ছোট ছোট গুচ্ছ দ্বীপে নানা ধরনের লতাপাতা ঘাসের সমাহার। কোন এক শ্বেতাঙ্গ দম্পতিকে বনে জন্মানো এক ধরনের ফুল কুড়াতে দেখি। ভাসমান ছোট্ট জলাবনে কচ্ছপরা রোদ পোহাচ্ছে। প্রচুর ব্যাঙ লাফালাফি করছে। নাতি ওয়ামিকে বললাম তুমি ব্যাঙের ডাক শুনবা। তাহলে শুনো বলে ছোট ছোট করে পম্প পম্প বললাম। ওমনি আনেকগুলো ব্যাঙ পম্প পম্প করে ডাকাডাকি শুরু করে দিল। মাছরাঙ্গা, বক, নানা প্রজাতির জলচর পাখি ও বুনো হাঁস এখানে বিচরণ করতে দেখি।

১১ জুলাই ২০১৬ সাল। পাশের ডেন্টনিয়া পার্কে বেড়াই। ১৮৯৭ সালে এক শ্বেতাঙ্গ দম্পতি ডেন্টোনিয়া পার্ক প্রতিষ্ঠা করেন। তারা এই পার্কে জমি দান করে অমর হন। পার্কফলকে তাদের নাম ঠিকানা ও জন্ম-মৃত্যুর তারিখ লিখা আছে।

ডেন্টনিয়া পার্ক আমাদের অবস্থান ক্রিসেন্ট টাউনের সন্নিকটে হওয়ায় প্রতিদিন এই পার্কের মাঠে আমার প্রাত্যহিক হাঁটা ও দৌড়ার রুটিনওয়ার্ক সেরে নিতাম।

প্রতিদিনের মত এই পার্কে আজও টিচাররা স্কুলশিশুদের নিয়ে এসেছেন। বাচ্চারা ঘাসের গালিচায় গড়াগড়ি যাচ্ছে, দোলনা চড়ছে, পিছলে পড়ছে, উঠানামা করছে। টিচাররা বাচ্চাদের সাথে খেলা করছেন, খাবার দিচ্ছেন। ডেন্টনিয়া পার্কে চেয়ার টেবিল দাবা বোর্ড, খেলার মাট সব আছে। পাশের টেনিস মাটে কিশোরেরা খেলছে। মিশ্রবর্ণের দক্ষিণ ভারতীয় কিছু তরুণ মাটের একপ্রান্তে ক্রিকেট খেলছে।

ডেন্টনিয়া পার্কে একদিন অনেক দৌড়ায়ে আমি ক্লান্ত হয়ে টিলার সবুজ ঘাসের গালিচায় ঘুমিয়ে পড়ি। মাথার উপর ছিল ম্যাপল গাছের ছায়া। পাশে বাচ্চারা ঘাসে গড়াগড়ি করছে। কানাডার মিঠে কড়া রোদে ও সুশীতল উচ্ছল বাতাসে বেশ কদিন ব্যায়াম করে পার্কের বেঞ্চিতে শোয়ামাত্রই গভীর ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যাই। এসব উন্নত দেশের লোকজন প্রকৃতির স্পন্দন সহজে অনুধাবন করতে পারে। এখানকার নির্জনতা আমার মনে ধ্যানাবস্থা তৈরি করে। আমি এদেশের সৌন্দর্য্যে বিমোহিত হয়ে মাঝে মাঝে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে যেতাম।

বাসায় ফিরে এক মজলিশে বললাম, টরেন্টো আমার দেখা পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ট নগরী। উর্মি বলল, মামা আপনি মন্ট্রিল, কেলগেরি কিংবা ভেঙ্কুভার দেখেন নি। টরেন্টো কানাডার সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহর। মন্ট্রিল, কেলগেরি আর সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন শহর। ভেঙ্কুভার শহরের তো কোন তুলনাই হয়না। প্রশান্ত মহাসাগর ও রকি পর্বতমালার কাছের শহর ভ্যাঙ্কুভার জাতিসংঘের শ্রেষ্ট নগর সুচকে পরপর ছয়বার একনম্বর হবার গৌরব অর্জন করে। আমার চাচাত ভাতিজী টুনি এই শহরের নাগরিক। সে আমাকে ভেঙ্কুবারে আমন্ত্রণ জানালেও সময় স্বল্পতায় প্রায় আড়াই হাজার মাইল দূরের এই শহরে যাবার সৌভাগ্য আমার হয়নি।

বাংলা প্রবাদ হল, হাড়ির একটি ভাতে টিপুনি দিলে পুরো হাড়ির খবর মেলে। মজলিশের সবার কথাবার্তা হতে অনুমান করি আমি কানাডার সবচেয়ে মন্দ ভাতে টিপুনী দিয়েছি। আমি বলি, ক্যানাডা একটি স্বর্গ উদ্যান। ডেন্টোনিয়া পার্কে যখন প্রথম হাঁটি মনে হল, এই বাগানপারের মানুষ ভাগ্যবান। এই পার্কে হেঁটে খেলে দৌড়ে আরামে দিন কাটাতে পারবে। পরে টরেন্টো শহরের যেদিকে যাই, চেয়ে দেখি সবকটি বাসাবাড়ি কোন না কোন প্রাকৃতিক বন, উদ্যান, পার্ক, জলাভূমি, খেলামাট পরিবেষ্টিত। উর্মি বলল, বাংলাদেশ হতে এখানে প্রথম আসার পর আমাদেরও কানাডার সবকিছু খুব ভাল লাগতো, আমরা উদ্যানে উদ্যানে ঘুরে বেড়াতাম কিন্তু এখন তেমনটি মনে হয়না।

ভাগনা রুহুল আমাকে অবাক করে বলে- কানাডার মানুষ বাংলাদেশের মানুষের চেয়ে সুখী নয়। এরা স্বল্পবাক এবং কুকুর নিয়ে একা একা ঘুরে বেড়ায়। এরা আমাদের মত দলবদ্ধ ও সামাজিক নয়। তাদের মুখে হাসিখুশি নেই। অথচ বাংলাদেশের মানুষ গরিব হলেও ওদের চেয়ে হাসিখুশি। বাংলাদেশের মানুষের চাহিদা কম, তারা অল্পে সন্তুষ্ট তাই সুখী। সবকিছু বেশি বেশি পেয়ে যাওয়ায় কানাডাবাসী কোন কিছুরই মূল্য বুঝেনা। রুহুলের ভাষায়- বাতাস ছাড়া আমরা দশ মিনিটও বাঁচতে পারিনা অথচ এই বাতাস ফ্রি দানের জন্য আমরা কেউ কি আল্লাহর শোকরিয়া আদায় করি। না, করিনা। কানাডাবাসীর ক্ষেত্রে রূহুলের যুক্তি আমার কাছে সঠিকই মনে হল।

রূহুল আরেকটি হিসাব আমার সামনে পেশ করল, ক্যানাডা ও আমেরিকায় প্রায় দশকোটি কুকুর সযতনে পোষা হয়। কুকুরখাদ্যের দাম শিশুখাদ্যের চেয়ে বেশি। কুকুর স্যাম্পুর দাম মানব স্যাম্পুর চেয়ে বেশি। দিনে কুকুর রাখালকে প্রচুর অর্থ দিতে হয়। কুকুর প্রতি মাসে পাঁচ শত ডলার করে খরচ হলে দশকোটি কুকুরের জন্য দেশ দু’টির বাৎসরিক খরচ ষাট হাজার কোটি ডলার, যা বাংলাদেশী টাকায় প্রায় পাঁচ লক্ষ কোটি টাকা। এই অঙ্ক বাংলাদেশের বাজেটের দেড়গুণেরও বেশী।

একজন বাংলাদেশী মা এবং একজন ক্যানাডিয়ান মায়ের তুলনা করতে গিয়ে রুহুল একটি গল্প বলে যায়। রুহুলের এক বন্ধু দুইতিন মাস আগে বাংলাদেশ গিয়ে তার অসুস্থ্য বৃদ্ধ মাকে দেখে ফিরে এসেছে। ফেরার কিছুদিনের মধ্যে মায়ের স্বাস্থ্যের আর অবনতি হলে সে বসের কাছে আবার ছুটি চাইলে বস খুব অবাক হন। কারন বৃদ্ধ মাবাবার প্রতি পশ্চিমাদের তেমন দরদ কিংবা আসক্তি নেই। বুড়ো মাবাপ অসুস্থ্য হলে হাসপাতালে ভর্তি করেই তাদের দায়িত্ব শেষ। বাকি সব দায়িত্ব সরকারের। রূহুলের বন্ধু ছুটি দিয়ে অনিচ্ছুক বসকে বলল, দেখুন আপনি যখন বাচ্চা ছিলেন আপনার মা আপনাকে ফেলে কুকুর কোলে নিয়ে ঘুরেছে, আর আপনি কাঙ্গালের মত পিছু পিছু হেটেছেন। আপনার মা আপনাকে বেবি-সিটারে ফেলে দিন পার করেছেন। আর আমার মা আমাকে ২৪ ঘন্টা কোলে-পিঠে-বুকে জড়িয়ে রেখে বড় করেছেন। অভাব অনটনের বাংলাদেশে নিজে খেয়ে নাখেয়ে আমাকে খাওয়াতেন। পরম মায়া-মমতায় পেলে-পুষে মানুষ করেছেন।

এবার বাংলাদেশী কলিগের বক্তব্য শুনে কানাডিয়ান বস সত্যটা অনুধাবন করেন এবং বাংলাদেশে যাবার জন্য আবার ছুটি মঞ্জুর করে দেন।

যুক্তরাষ্ট্রের মত ক্যানাডায় সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে ধর্মের কোন প্রভাব নেই। মাইক বাজিয়ে হৈ চৈ করে পথে প্রান্তরে ধর্মপ্রচারের কোন সুযোগ নেই। মানুষের অর্থনৈতিক জীবনেও খৃস্টধর্মের তেমন হস্থক্ষেপ নেই। আসলে এই খৃস্টধর্ম অনেক উদার, মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের উপর অতি মাতব্বরি করতে যায়না। আমাদের মত ফরজ/ ওয়াজিব বলে তাদের কিছু নেই। আমরা বলি Islam is the whole code of life তারা ধর্মকে whole code of life মনে করেনা। খৃস্টধর্ম কেবল একটা বিশ্বাসের বিষয় ও সংস্কৃতি হিসাবে টিকে আছে। তারা মনে করে ধর্ম হল পরকাল ও ঈশ্বর বিষয়ক ব্যাপার, দুনিয়াবি কাজে ধর্মের হস্তক্ষেপের কোন দরকার নেই। এখানে যীশু আল্লাহর অবতার ও তার কুমারি মা মেরি (মরিয়ম) সম্মানিতা মহিলা। যুক্তরাষ্ট্রের মত কানাডায়ও উপাসনালয়ে মাইকে আজান কিংবা ঘন্টাধ্বনী বাজিয়ে শব্দদুষণ করার অনুমতি নেই। এমন কি এই দুই দেশে রাস্থায় গাড়ির হর্ণ শুনাও ভাগ্যের ব্যাপার।

কানাডার লোকজন গৃহে কিংবা উপাসনালয়ে নীরবে নির্জনে ধর্মপালন করেন। ডেট্রয়েটের ঈদের জামাতের উপর পুলিশের গোয়েন্দা ড্রোন উড়তে দেখি। কানাডায় রাজনীতিবিহীন  ধর্মচর্চা চলে। এখানে ধর্ম কেবল আধ্যাত্মিক ও পারলৌকিক বিষয়। জাগতিক কাজ চলে সংসদে রচিত রাষ্ট্রীয় আইনে, এখানে ধর্মীয় আইন অকার্যকর। কানাডার প্রায় বাসায় আজান মেশিন রয়েছে। নামাজের সময় হলে আজান মেশিনে স্বয়ংক্রিয় আজান বাজে। মক্কা-মদিনা মসজিদের মধু-সুরে ধ্বনিত আজান ঘরবাসীকে জাগিয়ে তুলে।

ক্রিসেন্ট টাউন বেবিকেয়ার স্কুল পরিদর্শনঃ   

একদিন আমি রূহুলের শিশুকন্যা নাতনী সুহার স্কুল দেখতে যাই। উদ্দেশ্য কানাডার মত উন্নত দেশের স্কুল কেমন চলে তা কাছ থেকে দেখা। প্রতিটি শিশুর জন্য বরাদ্ধ চেয়ার ও টেবিলে শিশুর নাম ইংরেজিতে লিখা আছে। খেলনা ও বইখাতা রাখার জন্য প্রতিটি শিশুর আলাদা আলাদা গ্লাস ক্যাবিনেট রয়েছে। প্রতিটি বাচ্চার কুষ্টিনামা (Family tree) বৃক্ষ ও ডাল আকারে দেয়ালে দাদা-দাদি, মা-বাবা, ভাইবোনের ফটো সহকারে রাখা হয়। প্রতিটি বাচ্চার একটি বড় ফটো তার আলমিরার উপর রাখা থাকে। শিশুদেরকে স্কুলে ব্রেকফাস্ট করানো হয়। প্রতিদিন ছুটির আগে ত্রিশ মিনিট অভিভাবক সহ বাচ্চাদের একটি ক্লাস হয়। স্কুলে ভর্তির পর চিকিৎসক এসে বাচ্চাদের চোখ কান ও বডি পরীক্ষা করে দেখেন। একজন টিচারের বিপরীতে পাঁচ ছয় জন শিশুছাত্র রাখা হয়। এখানকার স্কুলে বাচ্চাদের আচার আচরণ, খেলাধুলা, পোষাক পরিচ্ছেদ, সাংস্কৃতিক কার্যাবলী ইত্যাদির উপর পরীক্ষা নিয়ে নম্বার প্রদান করা হয়। স্কুলে ও বাসায় দুইসেট বই থাকায় বাচ্চাদেরকে ভারী স্কুলব্যাগ বহন করতে হয়না। ছুটির আগের ছাত্র-অভিভাবক মিলিত ক্লাসে আমিও নাতিন সুহার সাথে ক্লাশে যোগ দেই। অনিন্দ্যসুন্দরী অল্প বয়স্কা টিচারদের রূপ সৌন্দর্য্যে স্কুলঘর যেন আলোকিত হয়ে আছে। মাদুরের উপর প্রথমে বাচ্চারা বৃত্তাকারে বসে। তাদের পিছনে আরেক বৃত্ত রচনা করে বসেন অভিভাবকরা। প্রথমে সবাই একে একে নিজ নিজ নাম ও ঠিকানা বলে যান। আমার পালা এলে নাম বলে ঠিকানা দিলাম বাংলাদেশ। বললাম আমি একজন লেখক ও পর্যটক। শ্বেতাঙ্গিনী টিচাররা হাসিমুখে মাটিতে দু’হাতে আঘাত করে ছড়া পড়েন-Trinkle trinkle shining star/ How are wounder what you are. শিশুরা সাথে উচ্চারণ করে। তারপর ক্লাস শেষ হয়। কানাডার শিশুরা আমাদের শিশুদের চেয়ে অনেক ভাগ্যবান। আমাদের বাচ্চারা এত সুন্দর স্কুল, ফ্রি লান্স, খেলাসামগ্রী, স্কুলমাট, পাঠকক্ষ পায়না।

দুপুরে রাহাদ চৌধুরীর সুরম্য ট্রিপ্লেক্স বাসায় খেতে যাই। তিনি সিলেটের রনকেলী গ্রামের আমার ছোটবোন মান্নার দেবর। কয়েক বছর আগে এই অতি সুন্দর বাড়িটি তিন লক্ষ ক্যানাডিয়ান ডলারে ক্রয় করেন। তিনি বললেন বর্তমানে এই বাড়ির বাজার মূল্য আট লক্ষ ডলার। আমাদের দেশের মত এখানে মানুষ মিস্ত্রি দিয়ে বাড়িঘর তৈরী করেনা। ক্যানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রে বাড়ি বানানোর দ্বায়দায়িত্ব নির্মান কোম্পানির। কোম্পানীগুলো তাদের সব মেধা উজাড় করে পরস্পর প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এই অদ্ভুদ সুন্দর ও সুবিধাময় বাসা নির্মান ও বিক্রয় করে থাকে। এদেশে আইন লংঘন করে কিছু করার উপায় নেই। এক একটি এলাকায় কোম্পানীগুলো একই ধরনের ডিজাইন অনুসরন করে থাকে। বাসার ভিতরের ডিজাইনে একটু রদবদল হলেও পৌর কতৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া বাইরের ডিজাইন চুল পরিমান পরিবর্তন করা যাবেনা।

রাহাদ ভাইয়ের শ্বশুর শ্বাশুড়ির সাথে দেখা হয় এই বাসায়। তারা একসময় ফেন্সুগঞ্জ সার কারখানায় থাকতেন এবং আমার দোলাভাই ইঞ্জিনিয়ার মুফতি খালেদ ও বড়বোন রেহার খুব ঘনিষ্ট ছিলেন। সাহাদ ভাইয়ের বিয়ের ঘটকালীও করেন আমার বোন রেহা। সাহাদ ভাই পরে তার শ্বশুর শ্বাশুড়ি ও শালিকাদেরে কানাডায় নিয়ে যান। তার শ্বাশুড়ি লিভার ট্রেন্সপ্লান্ট করে বেঁচে আছেন। প্রতিদিন তার কিডনি ডাইলাইসিস করতে হয়। বড় বাসার এক কক্ষে ডাইলাইসিস মেশিন বসানো। সাপ্তাহে তিনদিন নার্স এসে এখানে ডাইলাইসিস করেন। এখানে চিকিৎসা খরচ সম্পর্ন ফ্রি। যারা হাসপাতালে যেতে অক্ষম তাদের জন্য সরকার বাসায় ডাইলাইসিসের ব্যবস্থা করে দেয়। কানাডার উন্নত চিকিৎসা ও জীবনধারন পদ্ধতি বিদ্যমান থাকায় তাদের গড় আয়ু ৮৮ বৎসর, যা আমাদের চেয়ে (৮৮-৬৩=২৫) পঁচিশ বছর বেশি। দুশ্চিন্তাহীন জীবনও তাদের দীর্ঘ্যায়ু লাভের অন্যতম কারন।

রনকেলীর আরেক বেয়াই আহাদ ভাইয়ের বাসায় নিমন্ত্রণ পাই। এখানে রাতে খেয়ে ফেরার সময় পোষাক ও ডলার উপহার পাই। অনেক রাতে বোন সেহা ও আমরা রুহুলের গাড়িতে করে বাসা ফিরি। সেদিন রুহুলের কাছে একজন প্রৌড় শ্বেতাঙ্গ চালকের জীবনকাহিনি শুনি। রুহুল প্রথম ক্যানাডা যাবার পর টেক্সিক্যাব চালাতো, সেই সুবাদে একজন বয়স্ক শ্বেতাঙ্গ গাড়িচালকের সাথে তার পরিচয় হয়। ঐ বৃদ্ধের গাড়িটি ছিল খুব দামী এবং এই গাড়ি ছাড়া বৃদ্ধের বাড়ি বা অন্য কোন সম্পদ ছিলনা। তিনি ফাস্টফুড খেতেন এবং গাড়িতে ঘুমাতেন। তিনি স্নান সারতেন সরকারী সুইমিংপুলে। সামারের পাচ-ছয় এভাবেই তিনি গাড়িতে কাটিয়ে দিতেন। ক্যানাডায় শীত আসামাত্র কোন গ্যারেজে গাড়ি ফেলে বৃদ্ধ উদাও হয়ে যেতেন। সামারে গাড়ি চালিয়ে জমানো টাকা খরচ করতে ছুটে যেতেন উষ্ণ কোন দেশে। সামারের আগমনে সবটাকা খরচ করে শুন্যহাতে ফিরে আসতেন ক্যানাডায়। এমনই এক বাৎসরিক ঘুর্ণীচক্রে এই শ্বেতাঙ্গ বৃদ্ধের জীবন বয়ে যাচ্ছে। তার কোন চিন্তা নেই, রোগ হলে সরকার দেখবে, অক্ষম হলে সরকার সামলাবে, মারা গেলেও দাফন করবে সরকার। তাইতো এই পশ্চিমা বৃদ্ধের No চিন্তা, Do ফূর্তি। বউ-বাচ্চা পরিবারহীন একাকী জীবন তার বয়ে যাচ্ছে বহতা নদীর মতন।

ঘুম হতে উঠে ডেন্টোনিয়া পার্কে আমি ও রুহুল হাঁটছি। একজন নীলাক্ষী শ্বেতাঙ্গিনী তার প্রিয় কুকুর নিয়ে হাঁটছেন। রুহুল বলল, Madam your dog is so nice. একথা শুনে ভদ্রমহিলার চোখমুখ খুশীতে ভরে গেল। মহিলার খুশী খুশী ভাব দেখে তাকে আর আনন্দ দেবার জন্য বলল, Madam, you are beautiful, but your dog is more beautiful than you. কুকুরটির আর প্রশংসা শুনে মহিলার আনন্দে গদগদ অবস্থা। তিনি কুকুরটাকে দিয়ে আমাদেরকে প্রণাম করিয়ে প্রশংসার প্রতিদান দেন।

১৩ ও ১৪ জুলাই ২০১৬ সাল। এই দুইদিন আমার সহধর্মিনী নুরজাহান বেগমের দুইজন খালাতো ভাইয়ের বাসায় কাটাই। এই দুই খালাতো ভাইয়ের নাম হেদায়েত চৌধুরী ও বেলায়েত চৌধুরী। তাদের বাড়ি ওসমানীনগর উপজেলার গওহরপুর পরগনার রাউতখাই গ্রামের বড়দিঘিওয়ালা চৌধুরীবাড়ি। সন্ধ্যায় ভাগনা নাইম আমাদেরকে নিয়ে যায় ছোট শালক  হেদায়েত চৌধুরীর নিজস্ব বাসায়। বাসার সামনে একটি সুন্দর শিশুপার্ক। সেদিন ছিল আমাদের ফাগুন গরম এবং আমাদের ফাগুনের মত এলোমেলো বাতাস। বাচ্চারা পার্কের ফোয়ারায় জলকেলী করে এবং আমরা বসে বসে বসন্ত বাতাস গায়ে মাখি।

হেদায়েত চৌধুরীর সুন্দরী তরুণী পত্নী কাওসার খানম চৌধুরী। একমাত্র পুত্র ইয়াসিন এবং তিনকন্যা লাবিবা, আলিয়া, আমিরাকে নিয়ে তাদের সংসার। রাতে বড় শালক বেলায়েত চৌধুরীর বাসায় যাই। দূরত্ব মাত্র অর্ধ মাইল। বাসাটি বেশ বড় ও ডাউন পেমেন্টে কেনা। এখানে ডিনার করে আবার হেদায়েতের বাসায় ফিরে আসি। বেলায়েত চৌধুরীর কন্যার বিয়ে অত্যাসন্ন তাই বাসায় প্রচুর মেহমানের ভীড়। থাকার জন্য ভাবীর চাপাচাপি উপেক্ষা করে তাই চলে আসি।

কাওসার খানম যেমন সুন্দরী, তেমন কর্মঠ। চার সন্থান লালন-পালন, রান্না-বান্না সহ ঘরে বাইরে সব কাজ সামাল দেন। তার স্বামী হেদায়েত চৌধুরীর সময় নেই, সারাদিন ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত। তার ফাস্টফুডের দোকানে কাজ করে আমার ভাগ্নি উর্মি ও তার একজন শালা-বউ।

কাওসার ভাবীর আতিথেয়তা অবর্ণনীয়। তার বাড়ি মৌলভীবাজার শহরের গোবিন্দশ্রী মহল্লায়। সেখানে জন্ম ও বেড়ে উঠা।

কাওসার খানম পরদিন ডাইভ করে আমাদেরকে টরেন্টো হাইডপার্কে নিয়ে যান। এটি টরেন্টো শহরের বৃহৎ ও শ্রেষ্ট নেচার পার্ক। এই পার্কটি এত বড় যে হেঁটে দেখতে হলে পুরোদিন লেগে যাবে। এখানে আছে অসংখ্য টিলা, খেলার মাট, পিকনিক সেন্টার, ফিসিং লেক, ফোয়ারা, কুসুমবাগ এবং চিড়িয়াখানা। এই পার্কে এই প্রথম পূর্ণ পেখম মেলা ময়ুর-ময়ুরীর প্রণয়নৃত্য উপভোগ করি। নীল সবুজ ও ধুয়া রঙের অপরূপ বিশাল ছাতা মেলে পুরুষ ময়ুর ছবির নায়কের মত নাচতে থাকলে নারী ময়ুরী আকৃষ্ট হয়ে তার চারদিকে মাথা নেড়ে নেড়ে বৃত্তাকারে নায়িকার মত ঘুরতে থাকে। এযেন প্রকৃতির রাজ্যে দুইজন মানব-মানবীর ছন্দময় বল ড্যান্স।

হাইডপার্কের ফিসিং লেকটি চারপাশে পাহাড়ঘেরা, যা আয়তনে আমাদের রাজনগরের ৫/৬ টি কমলা রানির দিঘির সমান হবে। লেকের পানির উপর স্থাপিত ফিসিং প্লেটফর্মে বসে লোকজন বরশি দিয়ে মাছ ধরছেন। পার্কের ভিতর বিভিন্ন বেবী সিটিং ও বিদ্যালয়ের বাচ্চারা এসেছে বড় বড় স্কুল বাসে করে। তারা পড়ছে, খেলছে, হাতে কলমে শিখে নিচ্ছে প্রতিটি বৃক্ষলতা ও পশুপাখির নাম। সবুজ ঘাসের গালিচায়, বৃক্ষতলায় প্রকৃতির সাথে একাকার হয়ে যায় এদেশের বাচ্চারা। তারা মহানন্দে টিলায় গায়ে ও ঢালুতে গড়াগড়ি খায়। তাদের টিচাররা প্রত্যেকে এক এক জন বয়স্ক শিশু। শিশুদের সাথে তারা বাচ্চাদের মত একাত্ম হয়ে যান।

হাইডপার্কের চিড়িয়াখানার তত্ত্বাবধায়ক ক্রিস্টোফারের সাথে আমার কথা হয়। তিনি একজন বৃটিশ কিন্তু তার পত্নী একজন পর্তুগীজ। ক্রিস্টোফার বললেন, তিনি ভারত অস্ট্রেলিয়া, মেক্সিকো ও কিউবা সফর করেছেন। জানালেন মেক্সিকো গিয়ে তিনি প্রথম গরিব মানুষ দেখেন। ক্যানাডায় ধনী-গরিবের জীবনমানে তেমন কোন ব্যবধান নেই। এখানে কে ধনী, কে গরীব তা বুঝার উপায় নেই। কানাডার বাহিরে গরীব দেশগুলো সফরে গিয়ে ধনী গরিবের মধ্যকার বৈষম্য সর্বপ্রথম ক্রিস্টোফারের চোখে ধরা পড়ে। তিনি মেস্কিকো সিটিতে গিয়ে অবাক চোখে দেখেন গরীব জনগোষ্টি ময়লা বস্তিতে মানবেতর জীবন যাপন করছে, আর পাশেই ধনী লোকগুলো নির্লজ্জের মত চাকচিক্যময় বিলাসবহুল ভবনে স্বার্থপরের মত জীবন কাটাচ্ছে।

তিনি আর বিস্মিত হন যখন দেখেন মেস্কিকোর রাস্থায় চোর ডাকাতরা প্রকাশ্যে মানুষের ম্যানিব্যাগ ও সেলফোন কেড়ে নেয়। এসব ঘটনা তিনি ক্যানাডায় কখনও দেখেন নি। আমি বলি ক্যানাডা চিরশান্তির দেশ। আমার মুখে তিনি কানাডার প্রশংসা শুনে আবেগ আপ্লুত হয়ে বললেন ক্যানাডায় জন্ম নেয়ার জন্য আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি। তাকে বললাম, আমার জন্মস্থান বাংলাদেশ গরিব হলেও চোর ডাকাতের দেশ নয়। তবে বাংলাদেশে মেস্কিকোর মত ধনী গরিবের জীবনমানের পর্বত প্রমাণ বৈষম্যের বিষয়টা অস্বীকার করতে পারলাম না।

কানাডার প্রতিটি নারী, প্রতিটি শিশু ও প্রতিটি পুরুষ আলাদাভাবে এক একটা অখন্ড স্বাধীন সত্ত্বা। কেউ কারো উপর কতৃত্ব করতে পারেনা, ছড়ি ঘুরাতে পারেনা। এখানকার শিশুরা স্কুলে, পার্কে, অরন্যে, সুইমিংপুলে প্রকৃতির সাথে এমনভাবে মিশে যায় যেন তারা পাখি কিংবা হংস ছানার একেবারে প্রকৃতির সন্থান। অনিন্দ্যসুন্দরী টিচারগন নেচে গেয়ে বাচ্চাদের সাথে মিলে মিশে একাকার হয়ে যান। ক্যানাডায় বাচ্চাদেরকে কোন ধরনের শারীরিক কিংবা মানসিক নির্যাতন ও কষ্ট প্রদান সম্পূর্ন নিষিদ্ধ। কানাডার সমাজ ব্যবস্থায় অনুমতি ছাড়া কাউকে স্পর্শ করা অপরাধ, সে নারী, পুরুষ, শিশু যাই হউক। এখানকার ভদ্রলোকেরা কোন প্রয়োজনে লাইন ধরে দাড়ালেও নিরাপদ দুরত্ব ফাঁক রেখে দাড়ান যাতে কারো গায়ে স্পর্শ না লাগে। একদিন আমি অভিমত ব্যক্ত করলাম কানাডার শিশুরা আমাদের দেশের শিশুদের চেয়ে অনেক উন্নত ও দক্ষ হয়ে গড়ে উঠবে। আমার ছেলে জেফার তখন দ্বিমত পোষন করে বলল, যে সব শিশুরা প্রতিকূল পরিবেশে বড় হয়, তাদের টিকে শক্তি বেশী হয়। বাংলাদেশের শিশুরা বৈরী ও প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বেড়ে উঠে, তাই আরাম ও শান্তিময় পরিবেশে বড় হওয়া কানাডার শিশুদেরকে যদি আমাদের শিশুদের সহিত একই বৈরী পরিবেশে ছেড়ে দেয়া হয় তবে আমাদের শিশুরা সহজে টিকে যাবে। এই অতি আরামে সযতনে বড় হওয়া কানাডার শিশুরা তা সহ্য করতে পারবেনা।

এখানে কি পড়বে তা ব্যক্তি নিজেই সিন্ধান্ত নেয়। প্রতিটি শিশু বড় হয়ে নিজের পছন্দ সই বিষয়ে লেখাপড়া করে। ভবিষ্যতে কোন পেশায় যাবে তাও এখানে নিজস্ব সিন্ধান্তের বিষয়। ক্যানাডায় আমাদের দেশের মত পড়ার বিষয় কিংবা পেশা অন্যরা নির্ধারন করে দেয়না। নিজের পছন্দের বিষয়ে অধ্যয়ন এবং পছন্দের পেশা জীবন বেছে নেয়ায় তারা পড়া ও কাজে আনন্দ পায়। তাই তাদের শিক্ষা ও পেশায় সর্বোচ্চ সাফল্য আসে। তাদের শিক্ষা ও পেশা জীবন আনন্দে ভরে উঠে।

রুহুলের কাছে একজন কানাডিয়ানের পছন্দের গল্প শুনি। তার জন্ম কানাডার এক নির্জন গ্রামে। তার বাবা পেশায় ছিলেন ঘোড়ার খামারি। তাদের বাড়িটি একটি ঘোড়ার খামার। ভদ্রলোক শৈশব হতে রান্না-বান্না খুব পছন্দ করতেন। পাকঘরে মাকে সব সময় রান্নার কাজে সহায়তা করতেন। রুহুল তখন একটি পাঁচ তারকা হোটেলে কাজ করত। তখন এই ভদ্রলোক ছিলেন এই হোটেলের রয়েল সেফ। অতি মেধাবী ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও তিনি ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হতে যাননি। তিনি তার পছন্দের বিষয় রান্না (Cooking) নিয়েই লেখাপড়া করেন। রান্না বিষয়ে কানাডার সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে এই বিষয়ে আর উচ্চশিক্ষা নিতে যান প্যারিস। রান্না বিষয়ে ফ্রান্সের সর্বোচ্চ ডিগ্রী নিয়ে হন এই পাঁচ তারকা হোটেলে রয়েল সেফ। তার বাৎসরিক বেতন দেড়লক্ষ ক্যানাডিয়ান ডলার। যা বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি টাকা। কিন্তু চাকুরী তার পছন্দ হলনা, এখানে সরাসরি মাঠকর্মের সুযোগ নেই। সারাদিন অফিস কক্ষে বসে থাকতে হয়। তিনি নিজহাতে রান্নাবান্না করা পছন্দ করেন, এমন সুযোগ না থাকায় একদিন তিনি পাঁচ তারকা হোটেলের লোভনীয় চাকুরিটা ছেড়ে দেন এবং টরেন্টোতে একটি খাবার হোটেল খুলে বসেন।

কানাডার টেলিভিশনে একটি সংবাদ দেখে আমার মনে বেশ দাগ কাটে। একজন মাকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাচ্ছে।  মহিলার অপরাধ তিনি তার শিশুকে গাড়িতে লক করে বাজার করতে গেছেন। রোদে গাড়ি গরম হলে শিশুটা কষ্ট পেয়ে কাঁদছে। পুলিশ গাড়ির লক ভেঙে শিশুটাকে মুক্ত করে এবং মাকে এরেস্ট করে। একে বলে মায়ের চেয়ে মাসীর দরদ বেশী। ক্যানাডায় শিশুদের আসল মালিক রাষ্ট্র, তারপর মায়ের অবস্থান।

১৫ জুলাই ২০১৬ সাল। কাওসার ভাবীর বাসা হতে ১৫ মিনিট হেঁটে আমি ও জেফার একটি পাহাড়ি পার্কে আরোহন করি। বিশাল সমতল পাহাড়ের মধ্যভাগ ফুটবল মাঠ। মাটের চারপাশে জগিং করার আবর্ত পথ। এখানে একর একর জায়গা জুড়ে ম্যাপল, তুঁত, উইলো, পাইন ও ঝাউ বন। ঘাসে ঘাসে ছেয়ে আছে ঘাসফুল। পাহাড়ের ঢালু বেয়ে নিচ পর্যন্ত নাম না জানা ফুল আর ফুল।

অর্ধনগ্ন রূপসী দেবীরা বসে আছেন মাঠের সবুজ গালিচায়, যেন স্বর্গের থাকিয়ায় ঠেস দিয়ে বসা সব হুরপরী। ছায়া বৃক্ষে রোডের ঝিলিমিলি, বসন্ত বাতাস ভাসিয়ে নিচ্ছে চারপাশ। স্বর্গ-পরীদের কোল জুড়ে বসে আছে ছোট পুতুল আকারের সুন্দর সুন্দর তুলতুলে সব পোষা কুকুর।

ক্যানাডায় বাঙ্গালী বিয়েতে যোগদানঃ

শ্রীমতি নূরজাহান চৌধুরীর খালাতো ভাই বেলায়েত চৌধুরীর কন্যা নুদরাতের আকদ হবে মসজিদে। জুমুয়ার নামাজ শেষে মসজিদের মহিলাঙ্গনে কনেকে নিয়ে বেশ কয়েকজন বাঙ্গালি, পাকিস্তানি ও আরবি মহিলা জমায়েত হন। মসজিদে বরকে নিয়ে আসেন তার আত্মীয়রা। বড় একজন কোরান হাফিজ। সে বর্তমানে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। কনের বয়স ১৯ ও বরের ২১/২২ বছর। আরবি ড্রেসপরা বাঙ্গালি বর লম্বা ও ফর্সা। পর্দার ওপার হতে কনের বাপ-চাচা কনের এজিন নিয়ে আসেন। কাজি সাহেব বরের সম্মতি গ্রহণ করে বিয়ে সম্পন্ন করেন। ভিনদেশী মুসল্লিরা মারহাবা বলে বরের সম্মতিকে স্বাগত জানান। ঈমাম সাহেব শরিয়াভিত্তিক দাম্পত্য জীবন নিয়ে এক নাতিদীর্ঘ্য মূল্যবান বয়ান পেশ করেন। বয়ানের বিষয় হল ইসলাম ধর্মানুসারে স্বামী ও স্ত্রীর দায়িত্ব, কর্তব্য ও অধিকার।

এই মসজিদে নব দম্পতিদের জন্য ইসলামি দাম্পত্য জীবনের উপর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। মহিলা আলেমা কনেকে এবং পুরুষ আলেম বরকে এই প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। বড় ও কনেকে এধরনের প্রশিক্ষণ দেয়া আমাদের দেশেও প্রয়োজন বলে আমার মনে হল। আমাদের দেশে মহিলাদেরকে ধর্মীয় নেতৃত্ব হতে দূরে সরিয়ে রাখা হয় এবং তাদেরকে মসজিদে ঢুকতে দেওয়া হয়না। ক্যানাডায় মুসলিম পুরুষ ও মহিলা ধর্মীয় কার্যাবলীতে সমভাবে অংশগ্রহণ করেন ও সমানধিকার ভোগ করেন।

রাতে প্রীতিভোজের আয়োজন করা হয়। বর ও কনে দু’পক্ষ মিলে একটি অনুষ্ঠান। বাদ মাগরিব বোনের ক্রিসেন্ট পার্কের বাসা হতে দুইটি গাড়ি ভরে বের হই এবং টরেন্টোয় সিলেটিদের বহুল পরিচিত শামিম কমিউনিটি সেন্টারে যাই। মসজিদে বিয়ে অনুষ্ঠানে আরবি পোষাক পরিহিত সেই বর সেন্টারে এলেন পশ্চিমা ড্রেস স্যুট-কোট-টাই পরে। মসজিদের সেই আনস্মার্ট হুজুরমার্কা বরকে এখন মনে হচ্ছে একজন লম্বা সুদর্শন অতিস্মার্ট ব্যাক্তিত্ব। দিনের হুজুর রাতে হয়ে গেলেন বোম্বে ছবির একজন নায়ক সালমান খান।

শামিম সেন্টারের একতলা মাটির নিচে অন্যতলা উপরে। নিচতলায় মহিলা ও উপরে পুরুষদের খাবার আয়োজন করা হয়। সেন্টারের সামনে সুবিশাল গাড়ি পার্কিং। এদেশে গাড়ির গতি ঘন্টায় একশ মাইলের উপর, রয়েছে ঘরে ঘরে প্রাইভেট গাড়ি। তাই দুই তিন শত মাইল দূর হতে এসে মেহমানরা বিয়ে খেয়ে মধ্যরাতের আগে নিজ নিজ বাটি ফিরে যান। সে রাতের ডিনার দুই পর্বে সম্পন্ন হয়। বুফে খাবার ব্যবস্থা। তিনচার জন ভারতীয় নারী ব্লাংকেটে গরম খাবার সাজিয়ে রাখেন। সবাই খাবার নিজ নিজ টেবিলে নিয়ে যান।

প্রথম পর্বে ভেজিটেবুল রোল, বাটার চিকেন, সস এবং ড্রিঙ্কস। দ্বিতীয় পর্বে পোলাও, নানপরোটা, মাংস, রোস্ট, সবজি, ডাল, চিংড়ি ও রসমালাই। সবশেষে চা ও কফি পরিবেশন করা হয়। খাবার আইটেমে ও পরিবেশনে বাংলাদেশের চেয়ে অনেক ভিন্নতা রয়েছে।

এই অনুষ্ঠানে কুলাউড়ার গাগটিয়া সাহেববাড়ির মামাতো বোন শোভার দেখা পাই। এক সময়ের ডাকসাইটে সুন্দরী কিশোরী শোভা এখন একজন শ্বাশুড়ি। আমার তিনচার বছরে ছোট শোভার শরীরে এখন বয়সের ছাপ সুস্পষ্ট। তাদের কুলাউড়ার বাসায় শোভার সাথে আড্ডা দিয়ে অতীতে অনেক সোনালি সময় পার করে দিতাম। আমরা শোভার বাসায় যাবার নিমন্ত্রণ পেলাম। পরদিন নায়েগ্রা জলপ্রপাতে যাবো। শোভার বাসা টরেন্টো ও নায়েগ্রা সিটির মধ্যবর্তী হ্যামিংটন শহরে। নায়েগ্রা হতে ফেরার পথে আমরা শোভার বাসায় রাতের খাবারের নিমন্ত্রণ গ্রহণ করি।

নায়েগ্রা ফলস পরিদর্শনঃ

১৬ জুলাই ২০১৬ সাল। দিনটি স্মরণীয় কারণ এদিন জীবনে দেখা সেরা সুন্দর নায়াগ্রা আমাদের দেখা হয়। টরেন্টো হতে মাত্র দুই ঘণ্টায় কানাডার পর্যটন শহর নায়াগ্রায় পৌছা যায়। দুই শহরের দুরত্ব প্রায় ২০০ কিলোমিটার। সকাল ১১ টায় রুহুলের সেভেন সিটের গাড়ি পূর্ণ লোড হয়ে যাত্রা শুরু করি। বোন সেহা, ভাগনা, ভাগ্নি, ভাগনা বউ সবাই আনন্দ স্ফূর্তি করে ১ ঘটিকার সময় নায়াগ্রা শহরে প্রবেশ করি। হাজার হাজার পর্যটকের পদভারে মুখরিত রূপের রানি পর্যটন নগরী নায়াগ্রা। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা সীমান্তের পাঁচটি সুবিশাল লেকের একটি ইরি ও অন্যটি লেক অন্টারিও। বড় বড় চ্যানেল দিয়ে ইরি লেকে এসে অন্য তিন লেক সুপিরিয়র, মিশিগান ও হুরনের অথৈ জলরাশি জমা হয়। ইরি লেক উচ্চভূমিতে এবং অন্টারিও লেক চারপাচ শত ফুট নিম্নভূমিতে অবস্থিত। ইরি লেকে জমা হওয়া বিশাল জলরাশির প্রবল তোড় প্রচন্ড বেগে উপচে পড়ে নায়াগ্রা নদী সৃষ্টি করে এবং এই নদী দিয়ে অন্টারিও লেকে বয়ে যায়। এই জলরাশির শেষ গন্তব্য লাব্রাডা প্রণালী হয়ে আটলান্টিক মহাসাগর। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার সীমান্তরেখা নায়াগ্রা নদী। এই সুন্দর টলটলে নদীর পূর্বপার যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমপার ক্যানাডা। নায়াগ্রা জলপ্রপাতের সিংহভাগ অংশ ক্যানাডায় অবস্থিত, তাই নায়াগ্রাকে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে ক্যানাডা হতেই ভালভাবে উপভোগ করা যায়।

নায়াগ্রার দুইটি অংশ, প্রথমাংশে যুক্তরাষ্ট্র হতে চারপাচ শত ফুট প্রশস্থ সুরমার মত একটি নদী সরলপথে এসে অনেক উপর থেকে নায়াগ্রা নদীতে উপচে পড়ছে। এই জলপ্রপাত হতে দুই ফার্লং দূরে  মূল নায়াগ্রা জলপ্রপাতের অবস্থান। বাংলাদেশের আয়তনের কয়েকগুণ বড় চারটি সমুদ্রসম লেকের কোটি কোটি টন পানি আমাদের এম সি কলেজ মাঠের মত আয়তনের বৃত্তাকার ক্ষেত্র রচনা করে ভয়ঙ্কর তর্জন গর্জন করে চার পাঁচ শত ফুট নিচে নেমে একটি নদীর জন্ম দেয়। এই নদীটিই পৃথিবী বিখ্যাত নায়াগ্রা নদী। এখানে জলের সাথে জলের প্রচন্ড সংঘর্ষে জলকনা কুন্ডলী তৈরি করে উড়ে যায় আকাশে। এই জলকনা উপরে মেঘমালা তৈরি করে নায়াগ্রার আকাশে সব সময় বিচরণ করে। ভাসমান জলকনা ভিজিয়ে দেয় আশপাশের বৃক্ষ-লতা-ভুমি। তাইতো নায়াগ্রার উদ্যানমালা এত সতেজ, এত সজিব, এত সুন্দর। নায়াগ্রা নদীর জলকনায় ফোটে উঠে শত সহস্র রংধনু। রংধনুর সাতরং মানুষের চোখে বর্নচ্ছটার আলোক ধাঁধা লাগিয়ে দেয়। এ যেন একই সাথে, একই সময়ে, হাজার হাজার রংধনুর বিচিত্র রংখেলা।

এখানে জলের সাথে বাতাসেরও সংঘর্ষ হয়ে। ভাসমান জলকনার সুশীতল ঘুর্ণীবায়ু শরীর-মন শিহরিত করে তুলে। এই প্রবল সংঘর্ষে জল ও বাতাস মিশে ধূয়াশায় রূপ নেয়। নায়াগ্রার অপরূপ বাগানে খোলা আকাশ তলায় বৃক্ষছায়ায় আমরা লান্স করি। লান্স শেষে নায়াগ্রার পারে পারে নায়াগ্রার অপরূপ রূপসুধা পান করে করে আমরা হেঁটে হেঁটে ওয়াটার-ক্রুজার স্টেশনে পৌছি। আমরা জাহাজে নায়াগ্রা জলপ্রপাতের নিচে যাবার জন্য রুহুল জনপ্রতি ২০ ডলার করে সাতটি টিকেট ক্রয় করে। আমার সহধর্মিনী ভয়ে জাহাজে উঠতে নারাজ। বোন সেহাও বহুবার এখানে এলেও জাহাজে চড়ার সাহস করেন নি। আমি ও রুহুল জুর করে তাদেরকে রাজি করাই। আমাদেরকে পানি-কাপড়ের লাল রেইনকোট পরানো হয়। লিফটে প্রায় দেড় দুই শত ফুট নিচে নেমে নায়েগ্রা নদীপারে জাহাজ ঘাট। আমরা তিনচার শত নানা জাত-বর্নের লোক লাইন ধরে জাহাজে আরোহন করি। এই ঘাট হতে দুইটি পর্যটন জাহাজ সারাদিন নায়াগ্রার নিচে আসা যাওয়া করে। লোকবুজাই দু’তলা জাহাজটি নায়াগ্রা নদীর উজান বেয়ে ধীরে ধীরে নায়াগ্রা জলপ্রপাতের দিকে এগিয়ে যায়। আমরা যাচ্ছি এমসি কলেজের মাটের সম আয়তনের বৃত্তাকার ক্ষেত্রটির দিকে যেখানে নায়েগ্রা জলপ্রপাত নায়েগ্রা নদীকে প্রসব করেছে। জাহাজঘাট হতে এই স্থানটির দূরত্ব মাইল দেড়েকের কম হবেনা। 

নায়াগ্রা পাহাড়ি নদী, তাই নদীতে বইছে খরস্রোতা জল। তবে আমাদের মেঘনার মত প্রশস্ত এই নদীটি পুরোপুরী নাব্য। জাহাজ জলের স্রোতে উজান বেয়ে প্রথম নায়াগ্রা জলপ্রপাতের কাছে আসে। এখানে আমরা যুক্তরাষ্ট্র হতে ছুটে আসা বর্ষার সুরমার আকারের মত একটি গর্জনশীল নদীকে তিনশত ফুট উপর হতে নায়াগ্রা নদীতে লাফিয়ে নামতে দেখি। রেটল স্নেইক অন্য প্রজাতির জীবন্ত সাপকে মাথার দিক হতে গিলে ধীরে ধীরে খেয়ে ফেলে। আমার মনে হল নায়েগ্রা নদী এখানে সেই রেটল স্নেইকের মত যুক্তরাষ্ট্র হতে ছুটে আসা জীবন্ত নদীটাকে এভাবে গিলে খেয়ে ফেলছে। সাথে বিশাল এলাকা জুড়ে চলছে জলকনা ও বাতাসের হিল্লোল। এখানে এত বিশাল রংধনুর সাথে দেখা হয় যে, এটাই আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে বড় রংধনু। রংধনুটি জলপ্রপাতের একপ্রান্ত হতে মাইলখানেক উপরে উঠে এক বিশাল অর্ধবৃত্ত তৈরি করে নদীর অন্যদিকে নেমে এসেছে। বাংলাদেশের আকাশে বাদল দিনে অনেক রংধনু দেখেছি, কিন্তু নায়াগ্রার রংধনু সৌন্দর্য্য ও বিশালতায় তুলনাহীন।

আমাদের ওয়াটার ক্রোজার ঢেউ ঠেলে ঠেলে নায়াগ্রা ফলসের কাছাকাছি চলে আসে। নায়েগ্রা নদী তীর প্রাকৃতিক শিলায় গড়া। শিলার ফাঁকে ফাঁকে পাখির বাসা। শত শত সাদা ফ্যালিকন উড়াউড়ি করে নায়াগ্রার রূপ সুধা পান করছে। আমাদের জাহাজ নায়াগ্রা জলপ্রপাতের বৃত্তাকার পতনভূমির প্রবল তোড়ের দিকে আগায়। এই ঝড়বৃত্তে বড় কষ্টে উত্তাল ঢেউ ভেঙে ভেঙে তার বডি প্রবেশ করায়। প্রায় এক কিলোমিটার বৃত্তাকার পথে কোটি কোটি টন জলের তুড় দুনিয়া তোলপাড় করে দৈত্যের মত নিচে নামছে। জাহাজের চারপাশে ছন্দহীন উশৃংখল দৈত্যাকার পাগলা ঢেউয়ের বিরামহীন লাফালাফি। রূপালী জলরাশির ভয়ঙ্কর তর্জন গর্জন, প্রচন্ড ঘুর্নী বাতাসের সজল ঝাপটা ভিজিয়ে দেয় সারাটা জাহাজের বাহির ও ভিতর। চোখ জুড়ে শুধু ঝড়, বৃষ্টি, জল, কুয়াশা ও বাতাসের তান্ডব। আধো আলো আধো অন্ধকার জলকনার রাজ্য জুড়ে কেবল রংধনুর বর্ণচ্ছোটা। নায়াগ্রার অপার সৌন্দর্য্যে সবার ভয়ভীতি পালিয়ে যায়। লোকজন ও বাচ্চারা নায়াগ্রার স্বর্গীয় রূপ দেখে বাহ্যজ্ঞান হারিয়ে চিৎকার করছে। আর আমি তখন স্মরণ করছি এই অপরূপ নায়াগ্রার স্রষ্টা বিশ্ব অধিপতি মহান আল্লাহকে, তার এই সৃষ্টি সত্যই অতুলনীয়। নায়াগ্রার এই সুন্দর চোখে দেখার, কানে শুনার, ত্বকে স্পর্শের এবং অতীন্দ্রিয় হৃদয় দিয়ে অনুভবের।

কুলাউড়ার হাজিপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও স্বভাব কবি আব্দুল কুদ্দুস চৌধুরীর কবিতায় নায়াগ্রার যে চিত্র ফুটে উঠেছে তা পাঠকের ভালই লাগবে-

“ছেলেবেলায় পড়েছিলাম ভূগোল ইতিহাসে,

বৃহত্তম জলপ্রপাত ক্যানাডা নামের দেশে।

বুড়ো কালে দেখিলাম বিষ্মিত চোখ নিয়ে,

নায়াগ্রা জলপ্রপাতের অতি কাছে গিয়ে।

শুনিলাম নিজকানে পানির গর্জন,

শুন্যে ঝুলে রামধনু জুড়ায় নয়ন।

দৃশ্য ছবি, কবিতা কিংবা মুখে বলিলে,

বুঝিবেনা কোনকিছু নিজে না দেখিলে”।

এমসি কলেজ মাটের সময়াতনের উপবৃত্তাকার নায়াগ্রার ক্ষেত্রটি এই গ্রহের এক অনন্য অপার্থিব স্থান। এযেন মর্তের পৃথিবীতে এক টুকরো বেহেশত। এইখানে যেন পৃথিবীর সিংহভাগ সুন্দর ও সব স্বর্গীয় আনন্দ লুকিয়ে রয়েছে।

জাহাজ হতে নামার পর রুহুল বলল, মামাকে নায়াগ্রার আর কিছু দেখাব যার খবর লোকেরা তেমন জানেনা। সেদিকে মানুষ খুব অল্পই যায়। সে দ্রুত গাড়ি ড্রাইভ করে আমাদেরকে নায়াগ্রা জলপ্রপাতের অনেক উজানে নিয়ে যায়। কয়েক মাইল জায়গা জুড়ে নায়াগ্রার দিকে ধাবমান পানির দৃশ্য নয়নকে সম্মোহন করে দেয়। এযেন চেঙ্গিস খানের ধাবমান বিশাল অজেয় অশ্বারোহী মোঙ্গর বাহিনী, যারা ধপাস ধপাস করে ঘোড়ার খুরের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ তুলে বিশ্ব জয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।

ফিরে এসে আমি ও জেফার পথের পাশে ভূতের বাড়িতে প্রবেশ করি। জেফার অন্ধকারে ভয় পেয়ে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। সামনে দুইজন চীনা নরনারী। একটি কবর ফুড় করে বেরিয়ে আসছে ভুতের হাত। আমাদের কানের কাছে তার নিঃশ্বাসের শব্দ টের পাচ্ছি। বেরুলেই জড়িয়ে ধরবে আমাদেরকে। আমরা ভয়ে শিহরিত। চীনা নরনারী ভয় পেয়ে তাদের মোবাইলের আলো জ্বেলে দিলো। তাদের করুনায় আমরা ভুতের আক্রমণ ও ভয় হতে রক্ষা পাই।

নায়েগ্রা তীরে তীরে টিউলিপ উদ্যান। সারি সারি লাল, হলুদ, নীল, সাদা টিউলিপে বাগান ছেয়ে আছে। মাঝে মাঝে বসার গ্যালারি। শ্বেতাঙ্গ, কৃষ্ণাঙ্গ ও চীনা চোখ ধাঁধানো কয়েক জোড়া ময়ূর ময়ুরী। আমাদের দেশে পাঁচ তারকার উপর হোটেল নেই। এখানে সাত তারকা ম্যারিওট হোটেল, সাত তারকা শেরাটন হোটেল উঁচু পাহাড়ের উপর নায়াগ্রার কুয়াশার রাজ্যে যেন ঘুমিয়ে আছে। বিচিত্র তার-ট্রেনে চড়ে ঐ পাহাড়ে যেতে হয়। নায়াগ্রার জলকনায় সিক্ত সতেজ ফুলবাগ, বৃক্ষলতা, পাহাড় চূড়ার ওয়াচ টাওয়ার, পাহাড়ে ওঠার কাঁচের লিফট, ক্যাসিনো হাউস, এমিউজমেন্ট পার্ক, গার্ডেন, মার্কেট এবং সাত তারকা হোটেলের ছড়াছড়ি।

এই নায়াগ্রা এসে বুঝা যায় পাশ্চাত্য জীবনে যে কত আনন্দ, কত রঙ্গ। সামারের নায়াগ্রা জীবনের শত রঙ্গে যেন রঙ্গীন হয়ে উঠে। এবার আমরা নায়াগ্রা পারের স্কাই হুইলারে আরোহন করি। হুইলার থেমে থেমে উপরে উঠছে। হুইলার হতে নায়াগ্রার ওপারের যুক্তরাষ্ট্রের পর্যটন এলাকা দেখা যাচ্ছে। নীল রেইনকোট পরে নায়াগ্রা ফলসে যেতে আমেরিকানরা জাহাজে উঠছে। নায়াগ্রা নদীর আমেরিকা-পারে একটি ওয়াচ সেতু নদীর ভিতর এসে সমাপ্ত হয়েছে। সুদূরে নায়াগ্রা নদীর উপর ক্যানাডা- যুক্তরাষ্ট্রের সংযোগ সেতু দেখা যাচ্ছে। নায়াগ্রা জলপ্রপাতের উপর নায়াগ্রাসৃষ্ট মেঘমালায় পর্যটক নিয়ে কিছু হেলিকপ্টার ও ছোট্ট প্লেন আবর্তন করতে দেখি।

নায়াগ্রা নদী আমাদের ভৈরবের মেঘনার মত প্রশস্থ কিন্তু দুইদিকে সুউচ্চ শিলার গীরিমালা। ক্যানাডা-পারে আল্লাহ পাকের অপূর্ব সৃষ্টি নায়াগ্রা জলপ্রপাত ও সুন্দরের রানি নায়াগ্রা শহর।  

আমাদের চোখের সামনে সন্ধ্যা নেমে আসছে আনন্দ নগরী নায়াগ্রায়। রাতে নায়াগ্রা আরেক রূপ ধারন করে। হাজার হাজার নামী দামী গাড়ি নায়াগ্রা ছাড়ছে। রাতের নায়াগ্রা ফলসে কাছের পাহাড় হতে ফেলা সাতরঙের আলো খেলা করে। ঘুর্ণায়মান বর্ণীল আলোর বন্যায় নায়াগ্রা রঙ্গিন হয়ে উঠে। আলোর লাইন বরাবর যতদূর দৃষ্টি যায় কেবল নানা বর্নের জলকনা হীরা, মুক্তা ও সোনা দানার মত ঝলমল করে। রাতের নায়াগ্রাও সত্যই অপরূপ।

রাত কালো ও গভীর হচ্ছে। এবার ফেরার পালা। সারাদিনের মধুস্মৃতি ফেলে আসতে কষ্ট হয়। এই হয়ত নায়াগ্রার সাথে প্রথম ও শেষ দেখা। মনে মনে মধুকবির ভাষায় বললাম- হে প্রিয় নায়াগ্রা, আর কি হে হবে দেখা যতদিন যাবে।

ঘণ্টা খানেক পর আমাদের গাড়ি এসে পৌঁছে আমার শৈশবের খেলার সাথী মামাতো বোন শোভার বাসায়। হেমিংটন শহরের লেকপারে এক অপূর্ব সুন্দর বাসা। শোভার স্বামী একজন অতিথিপরায়ণ সজ্জন ভদ্রলোক। তার গ্রামের বাড়ি শেরপুরের কাছে আওরঙ্গপুর গ্রামে। আমাদেরকে যে কত ভাল সেবা দিবেন তাই নয়ে একাট্টা তিনি। খাবারদাবারে টেবিল ভরে যায়। শোভার এক ছেলে ও দুই মেয়ে। ছেলে বউ শমসেরনগরের বিখ্যাত লোকসঙ্গীত শিল্পী আমার এইচএসসি সহপাঠী সেলিম চৌধুরীর ভাইঝি। ক্যানাডায় বড় হওয়া মেয়েটির ঘন কালো চুল, দুধে আলতা রঙ্গ, যেন হাফ শ্বেতাঙ্গ বিদেশিনী।

রাত ১ টায় টরেন্টো ফিরলাম। একটি ছোট্ট সময়ে সিন্ধুর গভীরতা ভরা নায়াগ্রা সফর এভাবেই সমাপ্ত হলো।

টরেন্টো ডাউন টাউন পরিদর্শনঃ

১৮ জুলাই ২০১৬ সাল। মধ্যাহ্ন ভোজের পর ২ টায় ইগ্লিংটন স্টেশনে যাই। দুতলা ট্রেনের দ্বিতীয় তলায় বসে ডাউন টাউনের ইউনিয়ন স্টেশনে নামি। এই স্টেশনটি কানাডার সর্ববৃহৎ রেলস্টেশন। এক অদ্ভুদ ডিজাইনের ট্রেন, একতলা নিচে পাচ-ছয়টি সিড়ি বেয়ে দেড় তলায় আরেক কম্পার্টমেন্ট, এই দেড়তলা হতে আবার ছয়-সাতটি সিড়ি বেয়ে উপরে দ্বিতীয় তলা। এই তিনস্থরে ট্রেনের কম্পার্টমেন্ট সাজানো। রেলসড়কের দুইপাশ বনফুল, ঘাসফুল ও কাশফুলে ছেয়ে আছে।

ইউনিয়ন স্টেশন হতে বের হয়ে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে সি এন টাওয়ারে (ক্যানাডিয়ান ন্যশনাল টাওয়ার) আরোহনের জন্য টিকেট কাটি। ভাল প্রতিষ্ঠানে চাকুরীর সুবাদে ভাগনা রূহুলের টিকেট ফ্রি এবং তার গেস্ট হিসাবে টিকেটের দাম মাত্র ৪০% গ্রহ করে। টিকেট ক্রয়ে ১১৮ ডলার পরিশোধ করে আমরা চারজন সিএন টাওয়ারে উঠার জন্য নিচতলার আঁকাবাঁকা সর্পিল লম্বা লাইনে দাড়াই। সিএন টাওয়ারের উচ্চতা ১৪৬৮ ফুট। লিফটের কাছে আসতে আমাদের প্রায় ৩০/৩৫ মিনিট লেগে যায়। ৫/৬ টা লিফট সারাদিন একসাথে চৌদ্দপনের জন করে লোক নিয়ে উঠানামা করে। আমাদেরকে নিয়ে সম্পূর্ণ গ্লাস নির্মিত লিফট দ্রুতবেগে উপরে উঠছে। বায়ুচাপ কমে যাওয়ায় কানের পর্দা পট পট করছে। লিফট হতে বেরিয়ে উপরের দ্বিতল টাওয়ার চাকতির উপর তলায় অবতরণ করি। নিচে চেয়ে দেখি নয়ন জুড়ানো টরেন্টো সিটি এবং অন্টারিও লেকের অথৈ নীল জলরাশি দিগন্তহীন দূর সীমানায় লীন হয়ে গেছে। লেকের মাঝে সুদূরে দেখা যাচ্ছে পর্যটন দ্বীপপুঞ্জ সেন্টার পার্ক। নৌকা ও স্পিডবোট নিয়ে ভিজিটররা দলে দলে জলবিহার করছে। সৈকতে মানুষ সাঁতার কাটছে। চূড়াতলা হতে সিড়ি বেয়ে একতলা নেমে শক্ত কাচ নির্মিত ফ্লোর। এই কাঁচের ফ্লোর মাটি হতে ১২৫০ ফুট উপরে। এই বর্ণহীন কাঁচ ফ্লোরে উঠে নিচের দিকে তাকালে ভয়ে গা ছমছম করে। আমরা সবাই এই কাঁচের ফ্লোরে উঠে অনেক হাঁটাহাঁটি করি ও ছবি উঠাই। এই গ্লাসে উঠা এক দুঃসাহসী এডভেঞ্চার, এক বিরল অভিজ্ঞতা।

এবার চাকতির বাহিরে তার-নেট ঘেরা টাওয়ার বেষ্ঠনকারী গোলচত্বরে হাঁটি। ১২০০ ফুট উপরের এই চত্বরে তখন ঝড় হাওয়া বইছে। শীত শীত লাগছে। প্রচন্ড বাতাসের ধাক্কায় দাঁড়ানো যাচ্ছেনা। আমাদের শরীর আপনা আপনি সামনের দিকে উড়ে যাচ্ছে। এত প্রবল বাতাসের ধাক্কা আমি জীবনে আর কখনও অনুভব করিনি। আট দশ মিনিটে চাকতির বৃত্তাকার আবর্তন আমাদের শেষ হয়। ভয় হচ্ছিলো, এই বুঝি ঝড়ের ধাক্কায় সুউচ্চ টাওয়ারটা কালবৈশাখীর ঝাপ্টায় পড়া সুপারী গাছের মত হেলে ভেঙে পড়বে। টাওয়ার সেন্টারের ফাস্টফুড সপে ঢুকে আমরা কুক, কুকিজ ও চিপস কিনে খাই। এই সুউচ্চ টাওয়ার হতে কাছে বিমানবন্দরে উড়োজাহাজের উঠানামা দেখি। ঘন্টাখানেক আর এন টাওয়ারের এক বিচিত্র জগতে অবস্থান করে দ্রুতগামি লিফটে আবার মর্তে অবতরণ করি।

এবার আমরা টিকেট কেটে জলজ প্রানীর এক্যুরিয়ামে প্রবেশ করি। ইতিপূর্বে এশিয়ার বিখ্যাত সিঙ্গাপুর এক্যুরিয়াম দেখেছি। টরেন্টোর এক্যুরিয়াম আয়তনে বিশাল। মাথার উপরে নীল আকাশ বিশিষ্ট একটি কাঁচের সমুদ্র তৈরী করা হয়েছে। এই সাগরের ভিতর দিয়ে স্বচ্ছ কাঁচের টিউব সড়ক। একটি চলন্ত বেল্ট চড়ে আমরা সামনে এগিয়ে যাই। আশপাশে সাগরের মীনগণ হীন হয়ে আছে সরোবরে। হাঙ্গর, লাল কাকড়া, অক্টোপাস, জেলিফিস, ভাইপার, সি-আরপিন, কফিন জেব্রাফিস ইত্যাদি সামুদ্রিক মাছ ও প্রানী কখনও দলবেঁধে কখনও দলছুট সাঁতার কাটছে। ডানে বামে উপরে অজস্র মাছ বিচরন করছে। পানির উপর দেখা যাচ্ছে নক্ষত্র খচিত নীল আসমান।

এক্যুরিয়াম হতে বের হয়ে কানাডিয়ান রেল জাদুগর ঘুরে দেখি। এখানে বিভিন্ন যুগের রেল ইঞ্জিনের নমুনা রয়েছে। রেলগাড়ির সুচনাকাল হতে আজ পর্যন্ত রেলের যে সব উন্নয়ন হয়েছে সেই ধারাবাহিক বিবর্তন এখানে প্রত্যক্ষ করি।

এবার কানাডার একটি প্রতিষ্টানের লোকজনের বাৎসরিক আনন্দ অনুষ্ঠান উপভোগ করি। দুইজন নর্তকী হাওয়াইয়ান ট্রাইভাল নৃত্য পরিবেশন করেন। এক চিলতে রেড ইন্ডিয়ান ঘাঘরা কোনমতে নিতম্ব ঢেকে রেখেছে। বুকের চুড়ো দুটি ছাড়া সারা শরীর অনাবৃত এই দুই শ্বেতাঙ্গিনী সুন্দরী সঙ্গীতের তালে তালে সাম্বা নৃত্য করছেন। লোকজন আনন্দে হৈ-হল্লা করছে, পানাহার করছে, চারদিকে আনন্দের ফোয়ারা বইছে। উৎসবে শ্বেতাঙ্গ বেশী হলেও অন্যরা  কেউ কালো, কেউ হলুদ, কেউ পীত, কেউ বাদামী, কেউবা মিশ্রবর্ণের। এযেন মানব চর্মে নানা বর্নের মেলা।

রাতে আবার দুতলা ট্রেনে বাসায় ফিরে আসি।

কানাডার পল্লীগ্রাম দর্শনঃ

২২ জুলাই ২০১৬ সাল। সকালে চানাস্তা শেষে রুহুল গাড়ি স্টাট দেয়। আমি ও জেফার সাত সিটের মিনিবাসে কানাডার খামারগ্রাম দেখতে বের হই। টরেন্টো শহর হতে বের হয়ে কৃষি অঞ্চলে প্রবেশ করি। রাস্থায় গাড়ি চলাচল নেই বললেই চলে। চারলেন সড়কের টরেন্টোগামী লেইনে গাড়ি সংখ্যা বেশী। বহির্গামি লেন প্রায় গাড়ি শূন্য। রাস্থার দূ’পাশে ঘাসের চাদরে ঢাকা এবং নীল, সাদা ও হলুদ বনফুলের সমারোহ। মনে হয় এই বুনো প্রকৃতিকে কে যেন সযতনে সাজিয়ে রেখেছে। কানাডার গ্রামগুলো আমদের পল্লীর চেয়ে আর সবুজ আর শ্যামল। মাইলের পর মাইল সবুজ গমক্ষেত, ভূট্টাক্ষেত ও আলুক্ষেত। মাঝে মধ্যে ডেইরী খামার। সড়কের দুই পাশে ফার্ন জাতীয় বৃক্ষের বন। ক্যানাডায় প্রকৃতিকে কোন অত্যাচার করা হয়না, তাকে তার মত রেখে দেয়া হয়। এখানে টিলা পাহাড় কখনও কাটা হয়না, ভূমিরূপ অযথা পরিবর্তন কিংবা ধ্বংস সাধন করা হয়না। এখানে পাহাড়ের পাশ ঘেষে কিংবা পাহাড়ের তল উপর ঢেউ রচনা করে রাস্থা নির্মান করা হয়। সাগর ও লেককে তারা প্রকৃতিতে যেমন ছিল তেমনটি রেখে দেয়।

কানাডার গ্রাম এলাকা জুড়ে সারি সারি  খামারবাড়ি। বিশাল বিশাল ক্ষেতের মাঝে ছবির মত সুন্দর বাংলো বাড়ির সামনে বাগান, পাশে লেকপুকুর এবং ঘোড়ার আস্থাবল। বড় বড় খামারে জালের মত বিস্তৃত পাইপ লাইনে বৃষ্টিপাতের মত জল ছিটানো হয়। বড় পাইপের মূল হুইলটা ঘুরালেই দুইতিন শত একর জায়গা জুড়ে বৃষ্টির ধারা বয়। আমাদের দেশে কিছু বিদেশী চাবাগানে এভাবে জলসেচের ব্যবস্থা রয়েছে। ক্যানাডায় অনেক অনেক বড় বড় লেক জুড়ে রয়েছে বরফগলা জল। সামারে এই জলসেচন করে বাংলাদেশের মত বিশাল এই এলাকা একটি কৃষি অঞ্চলে পরিনত হয়েছে। রুহুল বলল এখানে বাংলাদেশের মত বারমাস শস্য ফলানো যায়না। একবারই ফসল হয় এবং তা সামারে। বছরে মাত্র একবার শস্য ফলানোর জন্য মাটি থাকে খুব উর্বর এবং আমাদের তুলনায় ফসলের ফলন অনেক বেশী হয়। শীতে এই সারাটা খামার অঞ্চল সাদা বরফে ঢেকে যায়। বাংলাদেশ চিরসবুজ দেশ কিন্তু ক্যানাডা কেবল সামারে এত গাড় সবুজ থাকে। শীতে পাতাহীন বৃক্ষে বরফের ক্রিস্টাল ঝুলে থাকে।

ক্যানাডায় কাট সস্তা ও টেকসই। মাঠে ময়দানে পার্কে সর্বত্র কাটের বেড়া, চেয়ার, টেবিল, প্যান্ড্যাল ও বেঞ্চের ছড়াছড়ি। এগুলো এতই মজবুত যে রোদ বৃষ্টি হিমতুষার সহ্য করে বছরের পর বছর অবিকৃত টেকে রয়।

কানাডার পল্লীর খামারবাড়ি ঢূকার আগ্রহ নিয়ে আমরা বেলহেভেন নামক একটি সুন্দর পাহাড়ি গ্রামে গাড়ি থামাই। চারপাশে নির্জন নিরবতা। কানাডায় অনুমতি ছাড়া কোন খামারবাড়িতে ঢুকা অপরাধ। আর যুক্তরাষ্ট্রে অনুমতি ছাড়া কারো সম্পত্তিতে ঢুকলে মালিক গোলী করার অধিকার রাখে। তাই আমরা অনুমতি নিয়ে কোন একটা খামারবাড়িতে ঢুকার জন্য লোক খুজি। সুন্দর সুন্দর বাড়িগুলোতে এক ছিমছাম নিস্থব্ধতা। মানুষের দেখা মেলা ভার। ভাগ্য ভাল মোঠাসোঠা একজন শ্বেতাঙ্গিনীকে বেশ দূরে একটি ফুলবাগে জলসেচন করতে দেখি। রুহুল ‘গুড মর্নিং মেম’ বলতেই তিনি হাসি মুখে এগিয়ে আসেন। জনবিরল এলাকার লোকজন সামনে মানুষের দেখা পেলেই খুশী হন। হাসিমুখে পরিচয় দেন, মাই নেইম ইজ ডেইজি। তার বাবা কৃষক এবং তিনি এই  নির্জন গ্রামের একজন কৃষানী। ডেইজির সাথে ছুটে আসে তার প্রিয় কুকুর হান্টার। অদ্ভুদ সুন্দর কুকুর এই হান্টার, তার শরীর ভেড়ার হলুদ পশমে আবৃত। ওযেন ভেড়ার পশমের সোয়াটার জড়ানো বড়সড় এক রবোট কুকুর। কুকুরটি এসে রুহুলের সামনে বসে হেন্ডসেক করার জন্য সামনের ডান পা বাড়িয়ে দেয়। তারপর আমি ও জেফারের সাথে এসে করমর্দন করে। এমন সুন্দর ও স্নেহপ্রবন কুকুর আমি জীবনে কখনও দেখিনি। কানাডার মানুষগুলো যেমন ভদ্র, কুকুরগুলোও তারচেয়ে কোন অংশে কম যায়না। কুকুরদের ঞ্জানবুদ্ধি দেখে মাঝে মাঝে মনে হত, এরা বুঝি মানুষের কাছে থেকে থেকে একসময় মানুষের পরবর্তী আশরাফুল মাখলুকাত হয়ে যাবে। ডেইজি আমাদেরকে সিমকো লেইকের সন্ধান বাতলে দিয়ে বললেন ওখানে যান, জায়গাটা অসম্ভব সুন্দর। ডেইজির সাথে আলাপ করে আমাদের লাভই হল, আমরা কাছেই নতুন একটি অপরূপ লেকপল্লীর সন্ধান পেলাম।

ডেইজি টিচার। প্রতিদিন টরেন্টো এসে ভারত, শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশী শিশুদের স্কুলে শিক্ষকতা করে রাতে বেলহেভেনের খামারবাড়ি ফিরে যান। একারনে তার ইংলিশ উচ্চারন ও কথাবার্তা আমাদের বুঝতে আদৌ অসুবিধা হয়নি।

কানাডার খামারবাড়িগুলো অদ্ভুদ নিরবতার মাঝে অপার্থিব সৌন্দর্য্যের আধার। পল্লীর সড়কগুলো ডাবল লেন এবং কোন ধরনের ভাঙ্গাচুরা নেই। শহরের চেয়ে গ্রামের বাড়িগুলো অনেক বড়সড় এবং সুরম্য বাগানঘেরা। কানাডার গ্রামের মানুষ শ্বেতাঙ্গ। এরা হয়ত ইউরোপ হতে আসা আদি অভিবাসীদের বংশধর। তারা মাত্রাতিরিক্ত ভদ্র ও শুদ্ধাচারী।

যুক্তরাষ্ট্র ও ক্যানাডায় সামনের বামসিটে বসে গাড়ী চালাতে হয়, যা আমাদের দেশের বিপরীত। রুহুল বলল মামা গাড়ী চালান। এখানে রাস্থায় গাড়ি নেই, পুলিশও নেই। বেলহেভেন হতে সিমকো লেক যাবার পথে আমি গাড়ি ড্রাইভ করি এবং বিশ পঁচিশ মাইল ড্রাইভ করে সিমকো লেকের কাছে এসে ড্রাইভিং সিট ছাড়ি। বাংলাদেশের বাইরে বিদেশে এই প্রথম আমার গাড়ি চালানোর অভিজ্ঞতা। ক্যানাডায় গাড়ী চালানো খুব সহজ, বিরাটাকায় বহু-লেইন বিশিষ্ট রাস্থায় গাড়ির তেমন ভীড় নেই। গাড়িগুলো ঝকঝকে চকচকে, আমাদের ডিসি, এসপি ও এমপিদের গাড়িগুলোর অনুরূপ। কানাডার গাড়ি নিয়ে যখন লিখছি, তাহলে আর কিছু বলে নেই। ক্যানাডা কিংবা যুক্তরাষ্ট্রে গাড়ি থামিয়ে রোড টেক্স কিংবা সেতু টোল দিতে হয়না। সড়কের নির্ধারিত মুভি ক্যামেরা টেকস বিল তৈরি করে গাড়ি নাম্বারের ঠিকানায় অটো পাঠিয়ে দেয়। এমন কি গাড়ি মালিক টেক্স অগ্রিম পরিশোধ করে থাকলে ক্যামেরা স্কেন করে টেক্স পেইড প্রদর্শন করে। তাই এসব দেশে গাড়ি থামিয়ে সড়ক, সেতুর টেক্স প্রদানের বিড়ম্বনা নেই।

এখানে যানজটে গাড়িগুলো আটদশ ফুট দুরত্ব বজায় রেখে থামে এবং মহাসড়কে পরস্পর দুই তিনশত ফুট দুরত্ব বজায় রেখে রান করে। এবার আমরা সিমকো লেকের পারে ছোট্ট গ্রামীণ জনপদ জর্জে প্রবেশ করি। সিমকো লেকের আয়তন ৭৪৪ বর্গ কিলোমিটার। অনেকটা আমাদের টাঙ্গুয়ার হাওরের মত। এলাকাটা যেমন সুন্দর, লেকপারের পাড়াগুলোর নামও তেমনই সুন্দর। প্যারাডাইজ বিচ, ফিনলে বিচ ইত্যাদি। লেকের পারে পারে ছোট ছোট বালির বিচে তরঙ্গমালা এসে মাথা ঠুকছে। লেকপারের বাড়িগুলো ভারী সুন্দর। প্রতিটি বাড়ির সামনে দামি গাড়ি ও পিছনের ঘাটে বাঁধা স্পিডবোট। প্রতিটি বাড়ি অনন্য ও অসাধারন। এই লেকে প্রচুর বুনো হাঁস ও জলচর পাখি বিচরন করছে। রয়েছে সাজানো গুছানো ছোট ছোট বিচ- ফ্রাঙ্কলিন বিচ, উইলো বিচ ইত্যাদি। আর আছে শিশুপার্ক ও উদ্যান।  

আমাদের ‘রূপসী বাংলা’ কাব্যের কবি জীবনানন্দ দাশ এখানে এলে নিঃসন্দেহে ‘রূপসী ক্যানাডা’ নামে এক অনন্য কাব্যগ্রন্থের জন্ম দিতেন। সিমকো লেক হতে বের হয়ে আমরা আবার খামারগ্রামে ঢুকি। আমাদের দেশের মত খন্ড খন্ড ছোট জমি এখানে নেই। এখানে কৃষিকাজে বড় বড় বুলডজার ও যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয়। ফল কুড়ানোর মেশিন গাড়ি, শস্যকাটা যন্ত্র, যান্ত্রিক খড় সংরক্ষণ, উন্নত সেচব্যবস্থা দেখে মনে হয় অটোমেশন কৃষি ব্যবস্থা। উচ্চ প্রযুক্তির সাহায্যে এদেশে একজন কৃষক বাংলাদেশের শত কৃষি শ্রমিকের কাজ একাই সম্পাদন করতে পারেন।

এবার কেজুইক টাউনে গ্যাস ভরে রুহুল জিপিএস চালু করে। আমরা দ্রুত টরেন্টো সিটির দিকে ধাবিত হই।

আমাদের গাড়ী এখন টরেন্টো বুটানিক্যাল গার্ডেনে প্রবেশ করে। এই গার্ডেনের এডোয়ার্ড পার্কে যাই। নিচে একটি ঝর্না কলকল ধ্বনী তুলে বয়ে যাচ্ছে। ঝর্নার ভাসমান পাতরে দাড়িয়ে ছবি তুলি। শ্বেতরা অতিমাত্রায় দায়িত্ববান। তারা নিবিষ্ট মনে ফুলবাগ, বৃক্ষ, লতাপাতার সেবাযত্ন করছেন। তাদের কাজ নিখুঁত এবং কোন ফাঁকি ঝুঁকি নেই। এই বাগানে চীনারা বসে ধ্যান করছেন। বিচিত্র ধরনের যোগ-ব্যায়ামও করছেন তারা। নয়ন মুদিয়া তারা ডানে বামে ডলছেন। বৃক্ষলতা, ফুলে ফুলে সুরভিত টরেন্টো বুটানিক্যাল গার্ডেনের রূপখনি দেখা শেষ হলে গাড়িতে বসি।

এবার আমরা টরেন্টোর সবচেয়ে ধনী অভিজাত এলাকা পোস্ট রোড এরিয়ায় প্রবেশ করি। প্রতিটি বাড়ি দুই তিন একর জায়গা জুড়ে আছে। দামি বাড়িগূলোতে বিভিন্ন যুগের বিভিন্ন দেশের স্থাপত্যের সমুন্নয় ঘটেছে। প্রতিটি বাড়িতে নিজস্ব নিরাপত্তা ব্যবস্থা, বাগান, সুইমিংপুল, ফোয়ারা, ব্যায়ামাগার, সংগ্রহশালা, পাঠাগার, ইন্ডোর- আউটডোর খেলার মাট সব রয়েছে। আর আছে কুকুর ও ঘোড়ার আলাদা বাসঘর। এখানকার এক একটা বাড়ি যেন এক একটা স্বয়ং সম্পূর্ন দুর্গবাড়ি। নানা ডিজাইনে তৈরী বাড়িগুলোতে ইউরোপের প্রাচীন প্রাসাদ, গির্জা, দুর্গ ইত্যাদির স্থাপত্যের সংমিশ্রন রয়েছে। রুহুল বলল, এই প্রতিটি বাড়ির দাম বাংলাদেশী টাকায় শতকোটির কম হবেনা।

এবার ঘোড়া চড়ার বাসনা নিয়ে আমরা সানি পার্কে আসি। এটি টরেন্টো শহরের আর একটি বড় নেচারপার্ক। এই পার্কটি বিখ্যাত এজন্য যে এখানে ঘোড়া চালানো শেখানো হয়। ঘোড়া চড়ার জন্য আমরা পার্কের সানি ব্রোক স্টাবল (আস্তাবল) প্রবেশ করি। ভাগ্য খারাপ সেদিন গরম পড়ায় ঘোড়া রোদে বের করা হয়নি। তাই ঘোড় সওয়ার হবার স্বপ্ন অপূর্ন রেখেই বেরিয়ে আসতে হল। সকালে ব্রেকফাস্টের পর বের হয়ে ১২০ কিলোমিটার/ঘন্টা বেগে প্রায় দুই শত মাইল দুরত্ব আমরা ঘুরে আসি। দেশটি এত বিশাল যে ঐ দূরত্বকে টরেন্টো শহরের উপকণ্ঠই মনে হল। এযেন বাসা থেকে বের হয়ে আশপাশ ঘুরে এলাম। বেলহেভেনের ডেইজির পোষা কুকুর হান্টারের সাথে হেন্ডসেক এবং চুমু খেয়ে আমরা অপবিত্র। তাই বাসায় ফিরে দ্রুত স্নান করে আমরা পবিত্র হই। তারপর গাড়ি চড়ে সবাই মিলে জুমুয়ার নামাজ আদায়ে মসজিদে চলে যাই।

ক্যানাডা হতে যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান প্রত্যাবর্তনঃ

২৩ জুলাই ২০১৬ সাল। আজ আমরা আমেরিকার ডেট্রয়েট ফিরে যাবো। সকালে বোনের বাসায় নানা পদের নাস্তা হয়। ভাগনা ভাগনিরা আমাদেরকে চাইনিজে নিয়ে যায়। আমরা বাসার সবাই একটি পরিপাঠি চাইনিজ রেস্তোরায় যাই। এখানে সেফ ও পরিবেশক সবাই চীনা লোকজন। আপেল রাইস, সুইট মসলা চিকেন, ঝাল স্যুপ, অন্তুন ইত্যাদি। এক ধরনের বিস্কুট পরিবেশন করা হয় যার নাম Fortune Cookises বা ভাগ্য বিস্কুট। এই বিস্কট খাওয়া শেষ হলে কাগজে লেখা একটি ভবিষ্যতবানী বেরিয়ে আসে। চাইনিজ রেস্তুরা হতে বের হয়ে আমরা যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান রাজ্যের বৃহত্তম নগরী ডেট্রেয়েটের দিকে যাত্রা শুরু করি। গাড়িতে আমরা তিনজন ছাড়াও ভাগনা রুহুল, বৌমা সিদ্রাত, নাতি রাদি এবং নাতিন সুহা। সেভেন সিটার গাড়িতে আমরা যাত্রি সাতজন। ভাগনা রুহুল বলল, আসার পথে নয় আমরা ভিন্ন এক নতুন পথে ডেট্রয়েট ফিরবো। তাহলে নতুন জায়গা দেখা যাবে। শতশত পাহাড়, গ্রাম, ক্ষেত, হ্রদ একে একে পার হয়ে লেক হুরন এবং লেক ইরির সংযোগ নদীর ওপারের নগর উইন্ডসর প্রবেশ করি। শহরের প্রবেশপথে লিখা এই শহরের লোকসংখ্যা ২,১৭,০০০ জন। ভাবলাম এই লোকদের একজন ছিলেন গোলশান হলি আর্টসান হোটেলে হামলার মাস্টার মাইন্ড তামিম চৌধুরী। তামিলের বাপ-দাদা সিলেটের বিয়ানীবাজার হতে ক্যানাডা আসেন। এবার আমেরিকায় প্রবেশের জন্য লেইকতলা দিয়ে নির্মিত সুড়ঙ্গপথে প্রবেশ করি। জলতলার ৬/৭ মাইল লম্বা টিউব সড়কটি আমেরিকার ডেট্রয়েট সিটিকে কানাডার উইন্ডসর শহরের সাথে সংযুক্ত করেছে। চারলেনের সুড়ঙ্গপথটি অসংখ্য বিদ্যুৎবাতির আলোয় আলোকিত। বিশ/বাইশ মিনিটে লেকতলার ট্যানেল পার হয়ে আমরা ক্যানাডা হতে যুক্তরাষ্ট্রের ডেট্রয়েট শহরে বেরিয়ে আসি। কিছুক্ষনের মধ্যে ছোটমামার বাসা তালবট পৌঁছে যাই।

২৪ জুলাই ২০১৬ সাল। আলম ভাই গাড়ি চালিয়ে তার বাসায় নিয়ে যান। সিমসাম হোটেল স্যুটের মত বাসা। আমার মামাতো বোন সুফা এবং একমাত্র পুত্র মেরাজকে নিয়ে তার সংসার। এখানে ডিনার করি আরবী খাবার।

২৪ জুলাই ২০১৬ সাল। ফকুমামা আমার মায়ের মামাতো ভাই। আমার চেয়ে দুইতিন বছরে বড় ও তিনি আমার মামা হলেও ছেলেবেলার খেলার সাথী। তার বাড়ি কুলাউড়ার ঘাঘটিয়া সাহেববাড়ি। তিনি নানাবাড়ি থেকে কিছুদিন রতউলি মাদ্রাসায় লেখাপড়া করেন। মাদ্রাসায় লেখাপড়া করে বাংলাদেশে জীবন সংগ্রামে তার টিকে থাকা বেশ কঠিন হত। অথচ এখানে তিনি সুপ্রতিষ্টিত। মামামামি দুইজনই কর্মঠ। মামার শ্বাশুর নেই। শ্বাশুড়ির একমাত্র কন্যা পলিন চৌধুরী তার সহধর্মিনী। শ্বাশুড়িকেও নিয়ে এসেছেন আমেরিকায়। তিনি সংসারের মুরব্বী লক্ষী হয়ে সারাটা পরিবারকে আলগে রেখেছেন। ফকুমামা খুবই ভাগ্যবান। তিনি দুই পুত্র ও এক কন্যার জনক। মুখে ফেন্সীকাট সুন্নতি দাড়ি, প্রসাদুদ্যোম বাড়ি, দামী একাধিক গাড়ী, মূল্যবান আসবাব ও পন্য সামগ্রীতে বাসা ঠাসা। ফকুমামা দুপুরে আমাদেরকে নিয়ে ডেট্রয়েট শহরের পর্যটন এলাকা Vale Island নিয়ে যান। লেকের মাঝের দ্বীপটি এক সুদীর্ঘ্য সেতু দিয়ে ডেট্রয়েট শহরের সাথে সংযুক্ত। এখানে আছে অসংখ্য সিংহ ভাস্কর্য্য। এই ভাস্কর্য্য জুড়ে নয়নাভিরাম পানির ফোয়ারা। ভেলে দ্বীপের তীর বাঁধাই করা ও বৃক্ষলতা সজ্জিত। সব সময় লেক হতে দ্বীপে শীতল বাতাস বয়। ভেলেদ্বীপের মধ্যভাগেও রয়েছে এক বিশাল জলাশয়। এখানে সৌকিন মৎস শিকারীরা বরশি বেয়ে মাছ ধরে। ফকুমামা আমাকে নিয়ে যান  চাচাত ভাই দিলদার আহমদ কচির বাসায়। কচি দীর্ঘ্যকাল দক্ষিন সুরমার দাউদপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন। দুই পুত্র নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র আসেন, এখানে আরেক কন্যার জন্ম হয়। কচি কাজে থাকায় তার সাথে দেখা হলনা। কচির স্ত্রী আমার সহধর্মিনীর আত্মীয়। আমাদেরকে পেয়ে খুশিয়ে আটকানা।

এবার এলাম চাচাতো ভাই হেমায়েত চৌধুরীর বাসায়। তিনি এক কন্যাকে নিয়ে ডেট্রয়েট আছেন। তার আর দুই ছেলেমেয়ে সপরিবারে কানাডার টরেন্টোতে বসবাস করেন। কচি ও হেমায়েত ভাই সুন্দর ঘরবাড়ি করে এখানেই সুখ স্বাচ্ছন্দে জীবন পার করছেন। হেমায়েত ভাইয়ের পত্নী রুমানা চৌধুরীও আমার চাচাত বোন। তিনি লন্ডনে থাকায় তার সাথে আমার দেখা হলনা।

এবার ফকুমামা আমদেরকে গাড়ি করে তার ওয়ারেনের রাজপ্রসাদে নিয়ে যান। এই সুরম্য প্রাসাদে অনেক আত্মীয় স্বজনের দেখা পাই। ফকুমামা তার দুই ভাতিজাকে আমেরিকা নিয়ে যান। এখানে আমার ছোটমামা ও মামাতো ভাইবোনেরা সপরিবারে এসে সমবেত হন। ফুলবাড়িরও কিছু আত্মীয়কে পাই তারা ক্যানাডা হতে এসেছেন। এই বাসায় দুইটি করে ড্রয়িং রোম ও ডাইনিং রোম। পারিবারিক অনুস্টানে বড় ড্রয়িং ও ডাইনিং কক্ষ ব্যবহৃত হয়। এখানে আড্ডা, স্মৃতিচারণ, কৌতুক চলল অনেকক্ষণ। হাসি তামাসায় আড্ডা জমজমাট।

পলিন মামী বললেন আজকের এই অনুষ্ঠান আমার ভাগনা ও বৌমার আগমন উপলক্ষে উৎসর্গ। প্রায় পঞ্চাশ-ষাট জন আত্মীয়স্বজনের সমাবেশে ফকুমামা ও মামী আমাদেরকে এক রাজভোগ ও রাজকীয় সম্বোর্ধণা দেন। নিঃসন্দেহে আমরা সেদিনের সেই অনুষ্ঠানের ভি আই পি ছিলাম।

আরবী, টার্কি, আমেরিকান নানাপদের নাম নাজানা খাবারদাবারে টেবিল ভরে ঊঠে। এভোগেডো ফলের চাটনি ভাতের সাথে খেতে বেশ ভাল লেগেছে। পারসিমন নামের এক ধরনের চীনা ফল খাই। পারসিমন দেখতে টমেটোর মত, ডাটা সবুজ বাকিটা কমলা রঙের। বহিরাবরণ কমলা হলেও ভিতর হলুদ। পারসিমনের স্বাদ সুমিষ্ট পেঁপে ও আমের মিশ্রণ মনে হয়।

ফকুমামার বাসা হতে মেহমানরা বের হয়ে ৭/৮ টি গাড়ি স্টার্ট দেন। গভীর রাতে সবাই ফিরে যান নিজ নিজ বাসায়। আমরাও ফিরে আসি মামা শহিদ চৌধুরীর বাসায়।

গতবছর যুক্তরাষ্ট্র সফরের পর দেশটি নিয়ে অনেক লিখেছি। এবারের যাত্রায় যুক্তরাষ্ট্রে ছয়দিন ও ক্যানাডায় আটার দিন অবস্থান করি। তাই যুক্তরাষ্ট্র নয়, কেবল ক্যানাডা নিয়েই আলোচনা করে লেখার ইতি টানবো। ক্যানাডায় সরকারি সুযোগ সুবিধা যেমন বেশী, টেক্সও তেমন বেশী। ক্যানাডা শান্তি ও নিরাপত্তার দেশ হওয়া সত্ত্বেও অভিবাসীরা কানাডার চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিত্ব পছন্দ করে বেশী। খুব সম্ভব যুক্তরাষ্ট্রের সীমাহীন শক্তিমত্তা, প্রযুক্তি, অর্থনৈতিক ক্ষমতা ও সম্ভাবনা মানুষকে আকৃষ্ট করে। ক্যানাডা হীম ঠান্ডা দেশ, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছে বৈচিত্রময় আবহাওয়া ও সিড়ি বেয়ে অনেক উপরে উঠার উজ্জ্বল সম্ভাবনা। সে তুলনায় কানাডার ক্ষেত্র অনেক সীমিত। যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্তরেখা বরাবর সিংহভাগ কানাডাবাসী বসবাস করেন। কানাডার ৮০% ভূমি সারা বছর বরফে ঢাকা থাকে। এই কৃস্টাল কানাডাকে বাদ দিলে মানব বাসপোযোগী ভূমির পরিমান অল্প। শীতকালে ক্যানাডায় তাপমাত্রা যখন হিমাঙ্কের ৩০/৪০ ডিগ্রি নিচে নেমে আসে তখন উচ্চ প্রযুক্তির কৃত্রিম তাপের মাধ্যমেই ঘরে বাহিরে টিকে থাকতে হয়।   

কানাডায় জন্ম নেয়া সাদাদের তেমন সম্পদ নেই। এদের সম্পদ সঞ্চয়ের অভ্যাসও নেই। তারা যা আয় করে, তা খরচ করে উড়িয়ে দেয়। অথচ গরিব দেশের লোকজন এসে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে সহজেই গাড়ি বাড়ির মালিক হয়ে যায়। ১৯৮১ সালে চারখাইয়ের সাচান হতে আসা একজন লোক হেমিংটন শহরে ৪৫টি বাড়ির মালিক। রুহুলের কাছে একজন সংগ্রামী তামিল যুবকের গল্প শুনি। সে মাথাকাটা পাসপোর্টে এসে টরেন্টো বিমানবন্দরের ওয়াসরুমে ঢুকে পাসপোর্ট, টিকেট সব ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে কমোডে ফেলে দেয়। তারপর ইমিগ্রশন অফিসারের সামনে দাঁড়িয়ে বলে শ্রীলঙ্কায় তার কোন নিরাপত্তা নেই। সে তামিল সিংহলি গৃহযুদ্ধের শিকার। শ্রীলঙ্কা সরকার তাকে মেরে ফেলবে তাই প্রাণ বাঁচাতে এসেছে। আত্মীয়রা তাকে প্রাণ বাঁচাতে এখানে কিভাবে পাঠিয়েছে কিছুই সে জানেনা। এভাবে সে সহজেই কানাডার এন্ট্রি পেয়ে যায়। প্রতিদিন বিশঘন্টা শ্রম দিতে অভ্যস্থ এই তামিল যুবক এখন ৩/৪ টি বাড়ি গাড়ি ও প্রতিষ্ঠিত ব্যবসার মালিক। সে ঝুঁকি নিতে জানে। রুহুল তাকে ঝুঁকি নিতে বারণ করলে সে বলতো- অনেক ঝুঁকি নিয়ে শুন্যহাতে এই বডিটা নিয়ে ক্যানাডায় এসেছি। আজ কয়েক কোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়েছি। আমার সব হারিয়ে গেলেও এই বডিটা তো হারবেনা। এই বডিটা ঠিক থাকলে আর চিন্তার কোন কারণ নেই। অপার সম্ভাবনার দেশ ক্যানাডা। এখানে পরিশ্রমী লোকজনের শূন্য ঝুড়ি সহজেই ধন-ঐশ্বর্য্যে ভরে যায়।

কানাডায় আয়করদাতার ফাইল সরকার ভালভাবে পরীক্ষা করে দেখে। ভুলবশতঃ অতিরিক্ত টেক্স প্রদান করা হয়ে গেলে তা ফেরত দেয়। যে সব লোকজনের আয় কম অথচ খরচ বেশী তাদেরকে আয়কর ফেরত দেয়। এমন কি উল্টো গরীব মানুষকে ভর্তুকি প্রদান করে।

টরেন্টোয় অনেক বাংলা পত্রিকা বের হয়। সাপ্তাহিক এই পত্রিকাগুলো বিনামূল্যে বিতরন করা হয়। ক্যানাডা সরকার এসব পত্রিকা প্রকাশের জন্য প্রচুর অর্থ অনুদান প্রদান করে। এসব পত্রিকা জুড়ে দোকান, আইনজীবী, চিকিৎসক, বাসাবাড়ি ও গাড়ির দালালদের বিজ্ঞাপনে পূর্ন থাকে। বিভিন্ন বাংলাদেশী অনুষ্টান, সভা, পিকনিক পার্টি ইত্যাদিরও খবর এবং বিজ্ঞাপন রয়েছে। বাংলাদেশের সবধরনের খবরাখবর কপি পেইস্ট করে এসব পত্রিকায় ঢুকানো হয়। কানাডার প্রচুর প্রতিভাবান বাংলাদেশী লেখক রয়েছেন। ভিতর পৃষ্টায় তাদের লেখা কলাম ও প্রবন্ধ পড়ে আমার কাছে বেশ উচ্চ মানসম্পন্ন মনে হয়েছে।

কানাডার বিয়ে ও যৌনজীবন যুক্তরাষ্ট্রের মত। এখানেও নরনারী পরস্পরের সম্মতি নিয়ে ইচ্ছেমত যৌনজীবন  উপভোগ করে। বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলে অনেক আইনি বাঁধাধরায় পড়তে হয়। তাই বিবাহ ছাড়াই তারা দাম্পত্য জীবন (Live together) পরিচালনায় অধিক সাচ্ছন্ধ্যবোধ করে থাকে। বিবাহ ছাড়া বাচ্চা উৎপাদনেও কোন বাঁধা নেই, কোন অন্যায় নেই। এক প্রবীন দম্পতির মজার কাহিনি শুনলাম। বুড়ো বয়সে বৃদ্ধ তার পত্নীকে বললেন, হে শুনছো, এখনও যে আমাদের বিয়ে হয় নাই। বুড়ি অবাক হয়ে বললেন, কি বলছো এখনও আমাদের বিয়ে হয়নি। বুড়ো বল্লেন, সত্যি বলছি, দাম্পত্য জীবনের অর্ধশত বছর পার হয়ে গেছে অথচ এখনও আমরা বিয়ে ছাড়াই আছি।

পাশে দাঁড়ানো ছেলের কানের খবরটা গেলে সে তার সব ভাইবোন, আত্নীয় স্বজনদেরে দাওয়াত করে বাবামাকে গীর্জায় নিয়ে যায়। তারা আনন্দস্ফূর্তি করে বাবা-মায়ের বিবাহ অনুষ্ঠান উপভোগ করে।

ক্যানাডায় যুক্তরাষ্ট্রের মত সমকামিতা বৈধ। এখানে অনেক সমকামী নারী ও সমকামী পুরুষ জোড় বেঁধে প্রকাশ্যে দাম্পত্য জীবন পরিচালনা করেন। এই ব্যাপারটা আমাদের মনে ঘেন্যা সৃষ্টি করে। ছিঃ ছিঃ কেন এই প্রকৃতি বিরোধী  বিকৃত যৌনাচার? এসব আমার কাছে পশ্চিমাদের এক ধরনের মানসিক বিকৃতি ও মনোবৈকল্যই মনে হয়। তারা জীবনকে অবাধে ভোগ করতে করতে এমনই হয় যে উপভোগ ও কামাচারের অনেক অনেক নতুন নতুন কলাকৌশল তারা আবিস্কার করে এবং তা সবই শুদ্ধ মনে করে। এসব অপ্রাকৃতিক কলাকৌশলের বেড়াজালে তাদের অনেকেই চিরদিনের জন্য বন্দি হয়ে যায়।

কানাডার ধর্মীয় জীবনও যুক্তরাষ্ট্রের অনুরূপ। পশ্চিমারা ধর্মকে তেমন গুরুত্ব দেয়না। এখানে বর্ণ সাম্প্রদায়িকতা থাকলেও ধর্ম সাম্প্রদায়িকতা নেই। তাদের ধারণা ধর্ম হল প্রাচীন সেকেলে রীতিনীতি, আচার অনুষ্ঠান ও বিশ্বাস। বেহেশত, দোযখ, পরকাল এসব তারা কল্পনার ফানুসই মনে করে। পশ্চিমারা যুক্তিবাদ ও আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞানকে অধিক প্রাধান্য দেয়। তারা ধর্মকে মানবসৃষ্ট বলে মনে করে। তাদের রাজনীতিতে এবং জাতীয় শিক্ষা কার্যক্রমে ধর্মের কোন গুরুত্ব নেই। ধর্ম এদেশে গির্জার বাসিন্দা। পশ্চিমারা ধর্ম বিশ্বাসের চেয়ে যুক্তিবাদ ও মানবিক বিবেকবোধ দ্বারা পরিচালিত হয়।

ক্যানাডা ও যুক্তরাষ্ট্র আয়তনে মুসলিম বিশ্বের প্রায় সমান। এই রাষ্ট্রগুলো মানবচুক্তির মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে এবং মানুষের তৈরি আইনেই চলছে। নিঃসন্দেহে এই মানবসৃষ্ট রাষ্ট্রগুলো সুশৃংখল, উন্নত ও সমৃদ্ধ।

কানাডার নৈতিকতার উৎস মানবপ্রেম ও বিবেকবোধ। এখানে জাতি ধর্ম বর্ণ ভাষা নির্বিশেষে সব মানুষকে সমান চোখে দেখা হয় এবং সবাই সমমর্যাদা ভোগ করে। এদেশে এই কয়দিন বিচরণ করে আমি মধ্যযুগের কবি কালিদাসের মত বলছি, “শুনো হে মানুষ ভাই, ক্যানাডায় সবার উপরে মানুষ সত্য, তার উপরে নাই”।

এখানে আমরা মুসলমানরা কিন্তু ধর্মপরায়ণ। মসজিদ ভরা থাকে লোকজনে। তারা সবাই সদ্য আসা অভিবাসী মুসলিম। এই বিশ্বাসী মুসলিমরা পরিশ্রমী ও শান্তিপ্রিয়। তারা সুনামের সাথে এদেশে টিকে আছেন।

কানাডা পৃথিবীর প্রথম সারির অপরাধমুক্ত দেশগুলোর একটি। এখানে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই নেই। খুনখারাবি বিরল ঘটনা। এখানে নারীরা নগ্নভাবে চলাফেরা করলেও কোন ধরনের ইভটিজিং কিংবা ধর্ষণের শিকার হয়না। খুবসম্ভব যৌনজীবন অবাধ থাকায় লোকের মধ্যে যৌনতাড়না সৃষ্টি হয়না। ফলে ইভটিজিং ও ধর্ষণের মত অপরাধ এদেশে নেই বললেই চলে। এদেশে মৃত্যুদন্ডের বিধান নেই, সর্বোচ্চ শাস্তি কেবল আমৃত্যু কারাদন্ড।

একজন হুজুরকে বললাম, এরা বেদ্বীন এবং অবিশ্বাসী হওয়া সত্ত্বেও আল্লাহ তাদের জীবনকে জ্ঞান, ঐশ্যর্য, সুখ ও শান্তিতে ভরে দিয়েছেন। হুজুর জবাব দেন এদের পরকাল নেই। তারা দোযখে যাবে তাই আল্লাহ তাদেরকে দুনিয়া দিয়েছেন। হুজুরের কথাবার্তায় বুঝলাম, নরকের জ্বালানী কাট বানানোর জন্য এই বেদ্বীন ভাল মানুষদেরে আল্লাহ পৃথিবীতে এত জ্ঞানগরিমা, ধন-ঐশ্যর্য, সুখ-শান্তি দিয়েছেন। নইলে এসব কিছুই দিতেন না। আমাদের মত গরিবী ও অশান্তিতে রেখে দিতেন।

বাংলাদেশ হতে আসা অল্প শিক্ষিত লোকজনও তাই বিশ্বাস করেন। কিন্তু আমার মনে প্রশ্ন জাগে তাহলে মুসলমানদের স্বর্ণ যুগে আল্লাহ তাদেরকে দোযখে পাঠানোর জন্য কি এত পার্তিব উন্নতি দিয়েছিলেন। এবং সে যুগের বেদ্বীনদেরে কি স্বর্গে পাঠানোর জন্য দারিদ্রতা ও অজ্ঞানতার মধ্যে ডুবিয়ে রেখেছিলেন।

ক্যানাডা প্রবাসী কবি আব্দুল কুদ্দুস চৌধুরী তার ‘শুকতারা’ কাব্যের একটি কবিতায় কানাডার একটি সুন্দর বিবরণ দিয়েছেন। কবিতাটি এখানে উদ্ধৃত করিলাম-

আজব দেশ

কোন দেশেতে এলাম আমি কি বলিব ভাই,

মেয়েদের গরম বেশি ছেলেদের নাই।

অর্ধনগ্ন হয়ে তারা হাটে মাটে ঘুরে,

বুড়ীদের কাপড় থাকে সর্বাঙ্গ জুড়ে।

বয়ফ্রেন্ডের সাথে তারা থাকে রাত্রিকালে,

সমাজ তা মেনে নেয় ‘লিভ টুগেদার’ বলে।

বিয়ের আগে সন্থান আসে মায়ের উদরে,

ধূমে ধামে তখন তারা বেবি শাওয়ার করে।

স্বামী বদল করে তারা অতি ঘন ঘন,

পাউন্ড ডলার থাকলে তাদের বাঁধা নেই কোন।

বড় হলে ছেলে মেয়ে চলে যায় দূরে,

বৎসরে একবার তারা মাতৃদিবস করে।

লেকের ধারে গ্রীষ্মকালে বিবস্ত্র প্রায়,

জোড়ায় জোড়ায় একসাথে মাটিতে গড়ায়।

এরূপেতে সারাদিন সূর্যস্নান করে,

লাজলজ্জা কিছু নেই তাদের অন্তরে।

পুরুষেরা বিয়ে করে অন্য পুরুষেরে,

স্বীকৃত তারা সবে গে নাম ধরে।

বেশি দিন বাকি নেই ফিরবে আদিম কালে,

সভ্যতার শেষ ধাপে এসে গেছে বলে”।

একমাস ধরে আমরা আমেরিকা ও কানাডায় অনবরত ঘুরে বেড়াই। এখন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডাকে বিদায় দেয়ার পালা। খুবভোরে মামাতো বোন জেরিন বড় গাড়ি ড্রাইভ করে আমাদেরকে ডেট্রয়েট বিমানবন্দর নিয়ে যায়। ২৬ জুলাই যুক্তরাষ্ট্র হতে যাত্রা শুরু করে ২৭ জুলাই ২০১৬ তারিখে ঢাকা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করি। স্বদেশের মাটিতে পা রেখে মনে হল বিদেশের একমাস যেন স্বপ্নের ঘুরের মধ্যে দ্রুত কেটে গেছে। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন