সোমবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

মনুর পারে নির্বাসন, ভিন্ন এক জীবন। মৌলভীবাজার আঞ্চলিক অফিস গমনঃ

 

মনুর পারে নির্বাসন, ভিন্ন এক জীবন। মৌলভীবাজার আঞ্চলিক অফিস গমনঃ     

যোগদানঃ ১২ এপ্রিল ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দ বিদায়ঃ ৬ জানুয়ারি ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দ  

অবস্থানঃ ২ বৎসর ৭ মাস ২৪ দিন।

 

এখানে আমি বৈচিত্রময় এক ভিন্ন জীবনের গল্প শোনাবো। সব সময় আমার জীবনটা কেটেছে পরিবারের স্নেহচ্ছায়ায় এক আনন্দময় সংসারিক পরিবেশে। কেবল এমসি কলেজের কয়েকটি মাস আমি বাধ্য হয়ে জায়গীর বাড়ির স্বাধ নেই। সেই স্বাদও জীবনের এক পরম অভিজ্ঞতা। তবে জীবনে আর কিছুর স্বাদ নেয়া বাকি ছিল। আসলে জীবনের অনেক স্বাদ থাকে মিষ্টিস্বাদ, টক স্বাদ, ঝাল স্বাদ, ঝাল মিষ্টি, তিতা কত কি। জীবনে সব স্বাদই সামান্য হলেও চেখে দেখা দরকার। আমার জিহ্বা সব ধরনের স্বাদ নিতে সদা উদগ্রীব।

প্রথমদিন মৌলভীবাজার যাত্রাকে মনে হয় অনেক দূরের কোন এক বিদেশ যাত্রা। আমার অনুজের সহধর্মিনী ফাহমিদা লোমা আমাকে ফোনে বললেন মৌলভীবাজার ছুয়ে যাওয়া  হবিগঞ্জি বাসের আমি যেন যাত্রি হই। এই গাড়ি শেরপুর ছাড়া আর কোথায়ও থামেনা। রাস্থাটি খুব দীর্ঘ্য মনে হল যদিও সময় লেগেছে এক ঘন্টা তিরিশ মিনিট। সিলেট হতে শেরপুর একঘণ্টা, শেরপুর হতে মৌলভীবাজার বাস টার্মিনাল অর্ধঘন্টা।

আত্মীয় স্বজনে ভরা এই শহরে অতীতে আমি অনেক গিয়েছি কিন্তু ফিরে এসেছি দিনের আলোয়। সুন্দর এশহরে অতিথি হয়ে আমি কতবার যে গিয়েছি বিয়ে সেন্টারে, ট্যুরে, আত্মীয়দের বাসায় তার কোন হিসেব নেই। এই কিছুদিন আগে ছোটভাই নিশাতের বিয়ে উপলক্ষে বেশ কয়েকবার গিয়েছি তার শ্বশুর এডভোকেট তজম্মুল হোসেনের কাজিরগাওয়ের বাসায়। আমার চাচাত ভাই নির্বাহি প্রকৌশলী মুফিজুর রহমান কুরেশী ছিলেন মৌলভীবাজার পিডিবির জেলা প্রধান। কলেজ রোড পেরিয়ে সুউচ্চ টিলার উপর তার সুন্দর দুতলা বাংলোয় একবার রাত কাটিয়েছি অনেক অনেক আগে। বাবু, টুনি ও তাছিন তখন কিশোর কিশোরী। টুনির প্রথম সিজারিয়ান অপারেশনে আমার সহধর্মিনী ডাঃ নুরজাহান বেগম ও আমি এই বাসায় এসে আবার রাত্রি যাপন করি। টুনির সিজারিয়ান করেন ডাঃ আব্দুল হাদি। অপারেশন থিয়েটারে আমার পত্নী অবাক হয়ে দেখেন ডাঃ আব্দুল হাদী প্রথমে এনেস্তেশিয়া দেন ও পরে তিনিই সিজারিয়ান করেন। অর্থাৎ একই চিকিৎসক সার্জন কাম এনেস্তেসিষ্ট। তিনি সিলেটে কখনো সার্জন কতৃক এনেস্তেশিয়া দিতে দেখেননি। মৌলভীবাজারের পিডিবির এই বাসাটির নিচতলা অফিস ও উপরতলা ছিল আবাস। আমার অন্য চাচাত ভাই গোলাম এহিয়া কুরেশী ছিলেন এই জেলার ডাক বিভাগের প্রধান। তার জৈষ্ট্যা কন্যা রুবার এখানেই বিয়ে হয়। মৌলভীবাজার কলেজের সামনের কলিমাবাদে অনুচ্চ টিলায় তাদের তিনতলা বাসা এবং হামিদনগর চা বাগান ছিল তাদের মালিকানায়।

মৌলভীবাজার শহরটি আগেই ছিল আমার আপন। এই শহর আমার সহধর্মিনীর স্মৃতিবিজড়িত শহর, এখানকার মুসলিম কোয়ার্টার পাড়ার মসজিদের পুকুরপারে একটি ভাড়া বাসায়  পিতৃসংসারে তার কিশোরীবেলা পার হয়। অবশ্য একবার তিনি অসুস্থ হলে চিরবিদায়ের আশংকায় এই স্মৃতিময় বাসাটি আমাকে নিয়ে শেষবারের মত দেখে আসেন। তবে গাছপালা ও লতা-পাতা-ঘাসপূর্ন বাসার লোকেরা আমাদেরকে চিনেনি, তারা পরিচয় জানতে চাইলে এককথায় পরিচয় দেই আমরা একদা এই বাসার ভাড়াটিয়া ছিলাম।    

আজ মহান আল্লাহর অপার মেহেরবানী ও করুনায় এই প্রিয় শহরের বাসিন্দা হতে ছুটে এলাম। ইতিপূর্বে মৌলভীবাজার আঞ্চলিক অফিসে আমি কখনও পা রাখিনি। বদলীর আদেশ হওয়ামাত্রই মৌলভীবাজারের আইন অফিসার মোঃ আবু তাহের আমাকে ফোন করেন। তিনি আমাকে অভয় দিয়ে বললেন, কোন চিন্তা করবেন না আমরা আপনাকে এখানে সব ধরনের সহযোগিতা করব। পশ্চিমবাজারে সমাজকল্যান মন্ত্রি সৈয়দ মহসিন আলীর মার্কেটে পুবালী ব্যাংক মৌলভীবাজার শাখা এবং আঞ্চলিক অফিসের অবস্থান।

শহর হতে খানিক দূরে শাহবন্দর এলাকা, শাহবন্দর মসজিদ দেখামাত্র আমরা নামতে প্রস্তুত হই। মনুনদের তীরে তীরে এসে রাস্থা পেরিয়ে বাস একটু এগুলেই টার্মিনাল। আমরা বেশ কজন যাত্রি এখানে নেমে পড়ি। এরা প্রায় সবাই সিলেট থেকে এসেছেন এখানে অফিস ধরতে এবং দু একজন ছাড়া তাদের প্রায় সবাই আমার মতই ব্যাংকার। কেউ কেউ নিতে আসা কারে চড়ে অফিসে চলে যান। আমরা পাশে স্টার্ট দেয়া ব্যাটারি চালিত যানবাহন টমটমে গাদাগাদি হয়ে বসি চালকসহ নয়জন যাত্রি। একটু পর আমরা নেমে যাই কুসুমবাগে, এখানে কুসুমবাগ নামক এক প্রসিদ্ধ প্রেক্ষাগৃহ ছিল, যা আজ আর নেই। যানভাড়াও অল্প মাত্র পাঁচ টাকা। সিলেটে এতটুকু রাস্থা পার হতে দশ-পনের টাকা খরচ হত নিশ্চিত।

কৃষ্ণচুড়া ও রাধাচুড়ার লাল হলুদ ও সবুজের ক্যানভাস আকা ছোট ছিমছাম সুন্দর এই শহরটি পা রাখতেই আমাকে যেন বুকে টেনে নেয়। রাস্থা দিয়ে যখন হাটি তখন এই শহরের সহজ সরল জনতাকে মনে হয় বহুযুগের পরিচিত কত যে আপনজন।  

গতকাল্য বেগম সাহেবা ডাঃ নুরজাহান বেগম চৌধুরী বললেন নতুন অফিসে যাচ্ছ, তাও ভিনজেলা মৌলভীবাজার, খালিহাতে যাওয়াটা কি ঠিক হবে? তিনি আমাকে নিয়ে ঢুকলেন দাড়িয়াপাড়ায়, এখানকার একটি হিন্দু বাসার মিষ্টি ও নমকির নামডাক সারা শহরে। বাসা ও মৌলভীবাজারের জন্য এখান থেকে খানিক নমকি ও মিষ্টি কিনলাম। মৌলভীবাজার শাখা ও আঞ্চলিক অফিস ভবনের একই তলায় যেন একই অফিসের দুইটি অংশবিশেষ। শাখার সবাইকে মিষ্টিমুখ করাতে মৌলভীবাজার শাখার পরিচ্ছন্ন কর্মির হাতেও কিছু টাকা দিলাম।  

অঞ্চল প্রধান উপমহাব্যবস্থাপক দিলীপ কান্তি পাল আমার বহুল পরিচিত আপনজন। আমাদের এইচ এস সি ব্যাচ একই যদিও কলেজ ভিন্ন। ব্যাংকে যোগ দেই একই সময়ে। তিনি এম সি কলেজ হতে অর্থনীতিতে বিএসএস(সম্মান) ডিগ্রী নেন। কিছুক্ষণ তার চেম্বারে বসে গল্প করি। দিলীপ কান্তি পালের সহধর্মিনীর সাথে আমার পত্নী নুরজাহান বেগমের গভীর সম্পর্ক ছিল। তিনি ছিলেন প্রাইমারী শিক্ষিকা, সিলেট বেতারের একজন সঙ্গীতশিল্পী এবং মৌলভীবাজার শহরের গীর্জাপাড়ার মেয়ে। একদিন তার মরনব্যাধি ক্যান্সার হয়। সুদীর্ঘ্য যন্ত্রনা ভূগের পর ছোট ছোট তিন শিশুপুত্রকে বাবার কাছে রেখে অকালেই বিদায় নেন তিনি। আমরা দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে কালিবাড়ি তাদের বাসায় গিয়ে লাশ দেখে আসি। এমন কি চালিবন্দর শ্মশানঘাট পর্যন্ত দৌড়ে যাই। আমি অনুভব করি দিলীপ বাবু তার পূত্রদেরকে মায়ের অভাব বুঝতে দেননি। সিলেট সুবিদবাজারের ক্যাসল মান্তাকার নিজফ্ল্যাটে থাকা পুত্ররা তাকে বারবার ফোন দিত। তিনিও মূহুর্তে মুহুর্তে তাদের খবর নিতেন। সন্তানস্নেহ তাকে দ্বিতীয় বিবাহ হতেও বিরত রাখে। আসলে তিনি ছিলেন একজন পূত্রবাৎসল আদর্শ পিতা।

অঞ্চলপ্রধানের চেম্বারের সাথে আমার চেম্বার, গ্লাসডাকা এই চেম্বারে আমার পাশের চেয়ারে বসেন আইন কর্মকর্তা মোঃ আবু তাহের এস পি ও। আগে তার সাথে আমার ভাসাভাসা পরিচয় ছিল। এবার ঘনিষ্ট হলাম। তিনি নেতাধরনের বুদ্ধিমান লোক। মানুষকে সাহায্য করেন সব সময়, বেশ পরোপকারী একটা মন আছে তার। মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলাদ্বয়ের এই আঞ্চলিক কার্যালয়ের সাইত্রিশটি শাখার সব সিন্ধান্তদাতা প্রধান কর্মকর্তা আসলে আমরা এই তিন জনই।

ভবনটি দুতলা তাই ছাদে রোদ পড়ে বিকেলে অফিস আগুন হয়ে ওঠে। এসি নেই, ফ্যানের অগ্নিবাতাস শরীর ঘামিয়ে দেয়। ঢাকা হতে বিভিন্ন শাখার অফিস সামগ্রি এলে মৌলভীবাজার আঞ্চলিক অফিস ফাইলপত্র ও মালামালের একটি গোদামঘরে পরিনত হত। বৃষ্টি হলে ছাদ চুষে কয়েক স্থানে পানি পড়ে নিচের মেঝ ভিজে যেত। মাঝে মাঝে ভাবতাম এত জঞ্জালময় কোন অফিসে আগে আর কখনও আমি কাজ করিনি। একেতো এতদূরে বদলি তার উপর কষ্টদায়ক অফিসগৃহ, এযেন মড়ার উপর খরার ঘা।  

সকালে আমি একটি ছোট ব্যাগে সামান্য সফরসামগ্রি নিয়ে সিলেট ছাড়ি। রাতে কোথায় থাকব তাও ঠিক করিনি। তাহের সাহেব বললেন পাশের হোটেল সেরাটাউনের মালিক তার লন্ডনি সমনদি। ভবনটির নিচের দুতলা মার্কেট ও উপরের তিনচার তলা আবাসিক হোটেল সেরাটাউন।

আপাততঃ এই সেরাটাউন হল আমার অস্থায়ী ঠিকানা। হোটেলের ব্যবস্থাপক আমাকে খুব খাতিরযত্ন করতেন। আমরা দুজন একসাথে পশ্চিম বাজার জামে মসজিদে গিয়ে জামাতে নামাজ পড়তাম। সিঙ্গুল কক্ষের ভাড়া প্রতিদিন ২০০/- টাকা, তাহের সাহেবের অনুরোধে ৫০/-টাকা ছাড় পেলাম। বৃহস্পতিবার সকালে সেরাটাউন ছাড়তাম ও রোববার রাতে কোন এক সিঙ্গুল কক্ষে এসে ঢূকতাম। হোটেলকক্ষে ছিল বিছানা, বালিশ, মশারি টানার স্ট্যান্ড যুক্ত ছোট পালঙ্গ, ছোট্ট চেয়ার টেবিল, ছোট বাথরুমে প্লাস্টিকের মগ বালতি বদনা ও সেন্ডেল। মাথার উপর ঘুরঘুর করত একটি ঝুলন্ত ফেন। সমস্যা হল কক্ষগুলো প্রায়টিই ছিল জানালাবিহীন, ফলে কপাটবদ্ধ হবার পর  তা উষ্ণপ্রস্রবনে পরিনত হত। প্রচন্ড গরমে শরীর ঘেমে বিছানার চাদর ও বালিশ ভিজে যেত। রাতে শহরের ধুলিধুসর রাস্থায় নিয়ম মাফিক অর্ধঘন্টা হেঁটে নিতাম। ঘর্মাক্ত হয়ে হোটেলের আয়রণযুক্ত জলে দিনে অন্ততঃ দুইবার গোসল করতাম। তবে একটা সুবিধা হত অফিস ও আবাস পাশাপাশি হওয়ায় আসা-যাবার রিক্সাভাড়া ও সময় বেচে যেত।

খাওয়া দাওয়া হত পশ্চিমবাজারের হোটেলে হোটেলে। কিছু হোটেলের কর্মিরা আমার পরিচিত হয়ে যায়। আমি প্রায়ই তাদেরকে বখশিস দিতাম। তারা আমাকে সালাম দিত ও যত্ন করে খাওয়াত। আমি ডায়বেটিস রোগী, একজন ডায়বেটিস রোগী হিসাবে সঠিক খাদ্যশৃংখল অনুসরন করা আমার পক্ষে অসম্ভব হয়ে যায়। শেষমেষ আমার সব দ্বায়দায়িত্ব মহান আল্লাহের হাতে অর্পণ করে দিয়ে আমি নিস্ক্রান্ত হলাম।

সাপ্তাহে সাড়ে চারদিন মৌলভীবাজারে কাটত, তাই সিলেটের বাসা আমার জন্য আড়াই দিনকা ঝুপড়ায় পরিণত হয়। এই যাযাবর জীবনের যন্ত্রনায় পড়ে রাগ হত আত্মীয় ব্যবস্থাপনা পরিচালক হালিম সাহেবের প্রতি, তার আস্কারা পেয়ে কেউ না কেউ আমাকে নিয়ে তামাশা করছে। আসলে সিলেটে এত জায়গা থাকতে আমাকে নিয়ে এত রংতামাশা করার আদৌ কোন দরকারই ছিলনা। সিলেট শহরে এক্সিকিউটিভ পদের অন্য কাউকে নিয়েও আমি পুবালী ব্যাংকে এত ভানুমতির খেলা হতে দেখিনি।

আমাদের সহকর্মী মোঃ আবু তাহের মৌলভীবাজারের একজন গণ্যমান্য নেতা। এই শহরের সবকিছুতেই তার অবস্থান। একদিন আমাকে একজন উকিলের বিদেশগমন সম্বর্ধণা অনুষ্টানে তিনি দাওয়াত করলেন। বিদায়ী আইনজীবী এডভোকেট সাইয়েদ মাইন উদ্দিন জুনেল অভিবাসী ভিসা পেয়ে যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে চলে যাচ্ছেন। এইসভায় সভাপতি হন মোঃ আবু তাহের। বিশেষ অতিথির চেয়ারে বসেন মৌলভীবাজার জেলাজজ সফিকুল ইসলাম। সন্ধ্যার পর হোটেল ট্রেডিশনে এই অনুস্টানে বিদায়ীর অনেক শুভাকাংখিরা জমায়েত হন। এখানে বক্তা প্রায় সবাই, তাই সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দিতে বারবার অনুরোধ করা হল। এডভোকেট মুজিবুর রহমান মুজিব সহ অনেকেই বক্তব্য রাখেন। আমাকে বক্তব্য দিতে ডাকা হয়, বহুদিন পর যুক্তরাষ্ট্র সফরের অভিঞ্জতা বর্ননা করে আমি একটি প্রাঞ্জল বক্তৃতা দিলাম। বিদায়ী এই উকিল সাহেব সারা জীবন এই জেলাশহরের নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সমিতির কর্মকান্ডে নিয়োজিত ছিলেন। মনে হল তিনি এই ছোট্ট শহরের একজন জনপ্রিয় লোক। এইরাতে এখানেই ফ্রি সাফার হল।

কিছুদিন পর মার্কেন্টাইল ব্যাংকের দীর্ঘদিনের গ্রাহকপ্রিয় ব্যবস্থাপক গোলাম মাওলার বিদায় অনুষ্ঠানে দাওয়াত পেলাম। তিনি বহুদিন মৌলভীবাজার ব্যাংক অফিসার্স ক্লাবের সভাপতি ছিলেন এবং মৌলভীবাজারের ব্যাংকারদের কাছে তিনি খুব গ্রহনযোগ্য লোক। মোঃ আবু তাহের তখন ব্যাংক অফিসার্স ক্লাবের সাধারন সম্পাদক। ব্যাংক এসিয়ার চৌমুহনা শাখায় এই সম্বর্ধনা সভা হয়। ব্যাংক অফিসার্স ক্লাব এবং মার্কেন্টাল ব্যাংকের অনেক ব্যাংকার এখানে সমবেত হন। এখানে পরিচয় হয় আমার পত্নীর আত্মীয় সাফির আহমদ চৌধুরীর সাথে, তিনি ব্যাংক এসিয়া মৌলভীবাজার শাখার ব্যবস্থাপক। বহুদিন পর আমার এমবিএ সহপাঠী প্রাইম ব্যাংকের ব্যবস্থাপক নজরুল ইসলামকেও পেয়ে গেলাম। এখানে আমাদের মৌলভীবাজার শাখার ব্যবস্থাপক মনিরুল ইসলামও বক্তব্য রাখেন। আমিও বক্তব্য রাখার সুযোগ পাই। সে রাতেও বাহিরে কিনে খাবার হাত থেকে রেহাই পাই।

আমাদের মৌলভীবাজার আঞ্চলিক অফিসের ড্রাইভার ওলি মিয়া, তার বাড়ি কুমিল্লায়। একদিন মধ্যবয়সী একজন মহিলা এসে অফিসে হাজির হন, সাথে তার অসুস্থ্য কিশোর পুত্র। মহিলা বললেন তিনি কুমিল্লা হতে অলিমিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাতে এসেছেন। সেদিন অঞ্চল প্রধান অফিসে ছিলেননা। মহিলার কাছ থেকে আমরা জানলাম তিনি অলিমিয়ার প্রথম স্ত্রী, যদিও এখন বনিবনা নেই। অলিমিয়া দুসরা যুবতী বউ নিয়ে এখন সিলেটে থাকেন।

অসুস্থ্য কিশোরটিকে দেখে আমাদের খুব দয়া হল, কারন এই অল্প বয়সে সে কিডনী ডায়লাইসিস করে বেচে আছে। এবার জানলাম এই ছেলের চিকিৎসার জন্য সাহায্যের আবেদন করে অলি মিয়া পুবালী ব্যাংক হতে পাচলক্ষ টাকা অনুদান পেয়েছেন। কিন্তু মহিলার অভিযোগ তার পূত্র চিকিৎসার জন্য এই টাকাটা পাচ্ছেনা। আমি এবং তাহের সাহেব চিকিৎসার জন্য কিছুটাকা রুগ্ন ছেলেটার হাতে তুলে দিলাম।

আমরা অলিমিয়াকে ফোন করে বললাম এই বিষয়টি জটিল, অঞ্চল প্রধান দিলীপ বাবু কিংবা হেডঅফিস বিষয়টি জানলে বিপদ হবে। চাকুরী বাচাতে হলে শীঘ্রই আমাদেরকে নিয়ে এই মহিলা ও রুগ্নপুত্রের সাথে বসে বিষয়টি ফয়সালা করে ফেলতে হবে। অলিমিয়া রাজি হলে আমরা একটি তারিখ ঠিক করে মহিলাকে আসতে বলে দেই।

এই তারিখে মাতা-পুত্র এসে হাজির হলে আমরা আসামী অলিমিয়া ও বাদীপক্ষকে নিয়ে আবু তাহের সাহেবের শালাদের সেরাটাউন হোটেলের লবিতে বিচারসভায় বসি। এই পাচলক্ষ টাকার চিকিৎসা খরচ নিয়ে তাদের মধ্যে বেশ বচসা শুরু হয়।

বিচারে বসলে আসামীকে অনেক সময় সত্য মেনে নিতে অনুপ্রাণিত করতে হয়। তাই আমি অলিমিয়াকে ভারত সম্রাট বাবুরের পূত্র হুমাউনের জন্য নিজের প্রান বিসর্জনের গল্পটি বললাম। একবার শাহজাদা হুমাউন অসুস্থ্য হয়ে মৃত্যুশয্যায় শায়িত হন। পিতা বাবুর যখন দেখলেন শাহজাদা হুমাউনের জীবনের আশা শূন্য হয়ে এসেছে, তখন পূত্রের শয্যাপাশে বসে মহান আল্লাহের দরবারে দুহাত তুলে প্রার্থনা করলেন হে দয়াময় আল্লাহ তোমার অপার মেহেরবানীতে আমি দীর্ঘ্যজীবন পেয়েছি কিন্তু আমার পূত্র হুমাউন অকালে মারা যাচ্ছে। তুমি আমার জীবন হতে কিছু আয়ু কেটে নিয়ে আমার প্রিয় শাহজাদা হুমাউনের জীবন রক্ষা কর, তার আয়ু বাড়িয়ে দাও। আল্লাহ দিল্লীপতির প্রার্থনা কবুল করলেন। শাহজাদা হুমাউন আরোগ্য হন ও সেই রোগশয্যার শায়িত হন তার মহান পিতা সম্রাট বাবুর। নিজের মুল্যবান জীবন বিসর্জন দিয়ে মোগল সম্রাট বাবুর শাহজাদা হুমাউনের প্রাণরক্ষা করে যান। আমার এই গল্পশুনে অলিমিয়ার ভাবান্তর হল। তার মন গলে গেল।

আমি আর বললাম টাকা পয়সার মালিক আল্লাহ। তিনি না চাইলে কেউ ধনী হতে পারেনা, আবার গরীবও হয়না। পুবালী ব্যাংক এই টাকা যে রোগীর চিকিৎসার জন্য দান করেছে সেই খাতেই খরচ করতে হবে, এই টাকা খেয়ানত করা হলে ব্যাংক যেমন ধরবে আল্লাহও তেমন ছাড় দিবেন না। বলি অলিমিয়া তোমার বয়স হয়েছে, বাঁচবে আর কতদিন, টাকার লোভ ছাড়? এবার দয়াকরে আল্লাহকে ভয় কর?   

অলিমিয়া এবার বুঝলেন কোনপথ খোলা নেই। এখানে উল্টাপাল্টা কিছু করলে দুনিয়া (অর্থাৎ চাকুরী) যাবে সেইসাথে আখেরাতও বরবাদ হবে। তাদের তিনজনের কথাবার্তায় আমরা বুঝলাম এই পূত্রকে ভারতে চিকিৎসায় নিয়ে গিয়ে অলিমিয়ার প্রায় দুইলক্ষ টাকা খরচ হয়েছে। বাকী তিনলক্ষ টাকা রুগ্নপুত্রকে দিতে এবার রাজি হন অলিমিয়া। তিনি মাসে মাসে এই টাকা প্রদানের লিখিত অঙ্গিকারনামা দেন। আমরা পিতাপুত্রকে আবার মিলায়ে দেই। অলিমিয়া পূত্রকে জড়িয়ে ধরেন। পিতাপূত্র দুজন কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। আবুতাহের সাহেব শালিসি শেষে চানাস্তার ব্যবস্থা করেন। দুইপক্ষকে ফটোকপি দিয়ে অঙ্গিকারনামার  মূলকপি মৌলভীবাজার শাখার ব্যবস্থাপক মোঃ মনিরুল ইসলামের কাছে রক্ষিত থাকে। সালিশ অনুযায়ি ওলিমিয়া টাকা পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলে আমরা দেখবো বলে মা ও পুত্রকে সেদিন বিদায় জানাই, তবে ওলিমিয়া অঙ্গিকারমত প্রতিমাসে পূত্রের ডায়লাইসিসের জন্য টাকা পাঠাতে আর কোন কার্পন্য করেন নি।

অলিমিয়া বিষয়ক এই লেখাটি সমাপ্ত করামাত্রই কাকতালীয়ভাবে অলি মিয়া এসে আমার সামনে হাজির। তিনি চট্টগ্রাম হতে হেডঅফিস এসেছেন গাইবান্ধায় তার বদলী ঠেকাতে, তার সাথে হোমরাচোমরা ধরনের একজন কর্মচারী নেতা। অলিমিয়া এমডির অফিস পর্যন্ত ঘুরে এসে আমার সাহায্য চাইলেন। আমি বললাম আমার অবস্থাই পান্তাভাত। কদিন চৌধুরীবাজার, কদিন মৌলভীবাজার, সবঘুরে এখন ঢাকায়। ব্যাংকের প্রভাবশালীদের আত্মীয় হয়েও আমার এই  দুরাবস্থা সেখানে তোমার জন্য বলত আমার কি করার আছে? সেদিন অলিমিয়ার কাছে জানলাম তার এই কিডনিহীন কিশোর পুত্রটি এখন আর পৃথিবীতে বেচে নেই।

একদিন আঞ্চলিক অফিসে নিরীক্ষা করতে প্রধান কার্যালয় হতে আসেন কর্মকর্তা কামাল আহমদ। আমাকে সেরাটাউন হোটেলে ছন্নছাড়া জীবন যাপন করতে দেখে কামাল বললেন, স্যার আপনি আমার বন্ধু মশিউর রহমানের সাথে তার বাসায় থাকতে পারেন। আমি অডিটে এসে কোন হোটেলে না ওঠে তার বাসায় থাকছি। মশিউর রহমান আমাদের সাথে শিক্ষানবিশ অফিসার হয়ে পূবালী ব্যাংকে যোগদান করে রবিরবাজার শাখার ব্যবস্থাপক হন। তিনি এখন মৌলভীবাজার সরকারী কলেজের অর্থনীতির প্রভাষক। এই বাসায় আরেকজন বাস করেন, তিনি পূবালী ব্যাংক মৌলভীবাজার শাখার অফিসার ওলিউর রহমান। ওলিউর রহমানের বাড়ি ময়মনসিংহ, তার বদলির অর্ডার হয়ে গেছে। লোকসংকটের জন্য মৌলভীবাজার শাখা ওলিউরকে ছাড়ছেনা। তবে নুতন অফিসার নিয়োগ হলেই তাকে ছেড়ে দেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন ব্যবস্থাপক মনিরুল ইসলাম। ওলিউর রহমানের বিয়ের পর নববধুকে এবাসায় নিয়ে আসেন, বেশ কিছুদিন তার স্ত্রী এখানে কাটালেও পরে ময়মনসিংহ চলে যান।

একদিন ছুটির পর কামাল আহমদ আমাকে বেশ জুর করেই মশিউর রহমানের আস্থানায় নিয়ে যান। বৃষ্টির জন্য ছাতা নিয়ে বেরুই ও চৌমুহনা যাবার ব্যাটারী চালিত টমটমে দুজন জড়সড় হয়ে বসি। চৌমুহনা হতে অন্য একটি ব্যবিট্যাক্সি চড়ে মৌলভীবাজার কলেজের গেটে নামি। ভাড়া স্বল্পই, পাঁচ + পাঁচ = দশ টাকা। গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। এক ছাতার নিচে দুজন ভিজে ভিজে হেঁটে কলেজ গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকি। মৌলভীবাজার সরকারী কলেজে ইহাই আমার প্রথম পা রাখা। টিলা বেয়ে উপরে ওঠে ঝুমবৃষ্টি থামার অপেক্ষায় কলেজের বারান্দায় অনেকক্ষণ অপেক্ষায় থাকি। বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ টিনের চালায় সুরের অপূর্ব লহরী তুলে। একসময় বৃষ্টিধারা কমে আসে। আবার একছাতার নিচে দুজন সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে পিছনের কলেজগেট দিয়ে বের হই। দুইটিলার মাধ্যভাগ দিয়ে একটি নিচু সড়ক বর্ষিজোড়া পাহাড়ে চলে গেছে। এই রাস্থার ওপাশে ছাত্রদের ‘সৈয়দ মুজতবা আলী ছাত্রবাস’ সামনে খেলাধুলার জন্য সমতল টিলামাঠ, এমাঠের প্রান্তঘেষে পাঁচতলা শেখ হাসিনা পাঠ্যভবন।

আশপাশে লন্ডনীদের সুরম্য ভবনমালায় দৃষ্টি মেলে মেলে পাহাড়ি পাকা সড়ক বরাবর হেঁটে হেঁটে আমরা যে সুন্দর পাড়ার প্রবেশ করি তার নামটি বেশ কাব্যিক ‘ওরেঞ্জ টিলা’। এক বিরাট সমতল টিলাজুড়ে এই সুরম্য পাড়া গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশ ওপেন ইউনিভার্সিটির দুতলা ভবনের সামনের গেট দিয়ে একটি দুতলা বাসার নিচতলার বাম ফ্ল্যাটে কলিংবেল টিপতেই দরজা খোলেন ছাপদাড়ি তরুণ প্রভাষক মোঃ মশিউর রহমান। টিলার নিচে বিশাল উপত্যকায় জলাভূমিতে জলজ ভেট পদ্ম ভেসে আছে। বকেরা উড়াউড়ি করছে। কিছু বক মাছ ধরতে তপস্যায় একপায়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি সব সময় প্রাকৃতিক সুন্দরের মাঝে থাকতে ভালবাসি, তাই মহান আল্লাহ আমাকে বেছে বেছে সব সুন্দর জায়গায় বসবাসের সুযোগ করে দেন। জায়গাটি আমার খুব পছন্দ হওয়ায় বললাম আলহামদুলিল্লাহ।

আমি সেদিন এই বাসায় থাকতে যাইনি, কেবল দেখতে গিয়েছিলাম। কিন্তু রাতে ফেরা হলনা। আমাকে ওলিউরের পালঙ্কে দিয়ে তারা তিনজন মশিউর রহমানের বড় বিছানায় গাদাগাদি হয়ে শুইলেন। বাবুর্চি মাসুমের মার বাড়ি কুমিল্লা, তিনি রাঁধেন ভাল কাজেও নিয়মিত। তিনি কখনও কাজে ফাঁকি দেন না। তার রাঁধা দুই তিন আইটেমের খাবার মন্দ হলনা।

বাসার দুইটি বেডরুম, ড্রয়িং, ডাইনিং ও কিচেন আছে। ভাড়া মাত্র ছয় হাজার টাকা, তবে বিদ্যুৎবিল আমাদেরকে পরিশোধ করতে হবে। বাসাভাড়া দেব দুইহাজার, বিদ্যুৎবিল ও বাবুর্চি মাসুমের মার বেতন অর্ধেক করে দিতে আমি সম্মত হই। খাবারের হিসাব হবে মেসের মত, যত টাকার মাসিক বাজার করা হবে তা দুজনের মোঠ মিলসংখ্যা দিয়ে ভাগ করে গড় বের করে প্রত্যেকের মিলসংখ্যা অনুসারে যা আসবে তাই দিতে হবে। প্রতি মিলে খরচ হত প্রায় সত্তুর হতে আশী টাকার মত।

আমি হিসেব করে দেখি মৌলভীবাজারে অবস্থানের জন্য আমার মাসে প্রায় দশ-বার হাজার টাকা অতিরিক্ত খরচ করতে হয়। বসে বসে ভাবি সিলেটের যারা কখনও বদলী হয়নি, তারা একেতো পরিবার পরিজন নিয়ে আরামে আছে, তদুপরি মাসে প্রায় দশ হাজার টাকা রেয়াত পাচ্ছে। বারবার গাড়ি চড়ার বিপদ হতেও তারা মুক্ত। এযেন আমি মড়ার উপর গোটাকয়েক খরার ঘা। যাক সবই আমার পোড়াকপাল।

সে দিনই মাসদেড়েকের সেরাটাউন হোটেল জীবনের যবনিকা টেনে আমি প্রভাষক মশিউর রহমানের সাথে মেসজীবনের অভিঞ্জতায় যোগ দিলাম। মশিউর রহমানের সাথে আমার পরবর্তী আড়াই বছরের জীবনটা ছিল আনন্দময়, শান্তিময় এবং আল্লাহময়। মশিউর রহমান আল্লাহওয়ালা ফরহেজগার লোক। পাচ ওয়াক্ত জামাতে নামাজ তার কখনও কাজা হতনা। তিনি সব সময় আলেম ও ইসলামি চিন্তাবিদদের ওয়াজের ক্যাসেট শোনতেন এবং বিশুদ্ধ ইসলামী জীবন যাপনের চেষ্টা করতেন। ডঃ আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গিরের ওয়াজ আমরা ধ্যানভরে শুনতাম।

মশিউর রহমান সবসময় পাজামা পাঞ্জাবী ও টুপি পরতেন। প্যান্ট সেলাই করাতেন পায়ের ঘনটার উপর। বৃষ্টির দিনে ছাতা টাঙ্গিয়ে আবার শীতের কুয়াশা ঝরা ভোরে গরম পানিতে অজু করে সুয়েটার গাঁয়ে দিয়ে আমরা দুইজন মৌলভীবাজার কলেজ মসজিদে গিয়ে জামাতে নামাজ পড়তাম। শীতের রাতে মশিউর রহমান চুলা জ্বালিয়ে পানি গরম করে অজুর বদনায় ঢেলে ডাক দিতেন, স্যার উঠে যান, জামাতের সময় হয়ে গেছে। ইতিমধ্যে তাহাজ্জুদের নামাজ তিনি সেরে ফেলতেন। নামাজ পড়তে টিলা বেয়ে বেয়ে কলেজ মসজিদে ওঠা এবং ফেরার বেলা নিচের দিকে ভাটির টানে ঘরে ফেরা। মেঘ বৃষ্টি ঝড়ে কিংবা শীতের কুয়াশা মাড়িয়ে এভাবে বারবার বাসা হতে মসজিদে চলত উজান ভাটির খেলা।

বাসার সামনের নিম্ন উপত্যকা পেরিয়ে ডানদিকের বেশ কয়েকটি টিলাজুড়ে মৌলভীবাজার টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউট। এই ইন্সটিটিউটের ছোট্ট মসজিদেও আমরা নামাজ পড়তাম। ভোরে ঘুম ভাঙতে দেরী হলে আমরা কাছের এই মসজিদে ছুটে যেতাম। মৌলভীবাজার কলেজের ইসলামের ইতিহাসের শিক্ষক মোঃ মাহবুবুর রহমান ওসমানী । নোয়াখালী জেলার বাসিন্দা মাহবুব ওসমানী স্যার বহুমুখী প্রতিভা, তিনি ক্কারী ও হাফিজে কোরান। একজন ধর্মঞ্জানী বক্তা হিসাবে আশপাশের গ্রামে ইসলামী জলসায় তিনি ওয়াজ নসিহত করতেন। ইসলামী লেবাসে আবৃত দাড়িওয়ালা মাহবুব ওসমানী স্যারের মুখে সবসময় একটা লাবণ্যময় হাসি লেগেই থাকত। তিনি প্রতি সোমবার এই টেকনিক্যাল মসজিদে আমাদেরকে ছহি করে কোরান পাঠ শিখাতেন। বোর্ড, ডাস্টার, কালিকলম দিয়ে একেবারে ব্যবহারিক শিক্ষা দিতেন। আশপাশের অনেক গন্যমান্য লোক এই কোরান শিক্ষায় অংশ গ্রহন করতেন। আমি ও প্রফেসর মশিউর রহমান প্রায়ই এই কোরান শিক্ষার ক্লাশে যোগ দিতাম। প্রতিটি ক্লাশে কেউ না কেউ তবররূক নিয়ে আসতেন। টেকনিক্যালের প্রিন্সিপাল ছিলেন খুব আমলদার লোক। মসজিদগুলো ছিল শীতোতাপ নিয়ন্ত্রিত।

রুচি বদলের জন্য পাশের আরেকটি মসজিদে আমরা মাঝে মাঝে নামাজ পড়তাম। খুব সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশে নির্মিত টিলাবাড়ি মসজিদ। এই মসজিদের সুউচ্চ গোলাকার মিনার অনেক দূরহতে দেখা যেত। টিলার উপর নির্মিত মসজিদটি এক গম্বুজ বিশিষ্ট এবং মাটির নিচে ইমাম কক্ষ ও নামাজের স্থান আছে। তবে মাটির নিচের কক্ষ পাশের রাস্থার লেবেলের উপরেই রয়েছে। টিলাবাড়ির লোকজন প্রবাসী ও খুব ধনী, তাই টিলার উপর নির্মিত বাড়িগুলো খুবই সুন্দর ও সুরম্য। টিলাবাড়ির এই মসজিদে নামাজ পড়লে মনে হত জমিদারি আমলের গম্বুজওয়ালা কোন মসজিদে যেন নামাজ পড়ছি। এই তিনটি মসজিদই এত কাছে ছিল যে আমরা প্রতিটি মসজিদের আজান শুনতে পেতাম।

এশার নামাজে যেতে টেকনিক্যাল মসজিদের গমনপথের দুপাশে বহুদিন পর মুগ্ধনয়নে দেখতাম উড়ন্ত জুনাকি পোকাদের জ্বলানিভা, শোনতাম ঝিঝি পোকার ডাক, টিলাবাড়ির বাড়ির মসজিদে এশার নামাজে যেতে পুর্ণিমার আলোর বন্যায় সয়লাব বনভূমির স্নিগ্ধতা দেখে ভূলে যেতাম পরিবার পরিজন হতে দূরে থাকার দুঃখটুকু।

মশিউর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যরত অবস্থায় ব্যাংক কর্মকর্তা হন। তার বাড়ি রবিরবাজারের কাছে তিরাশীজোড়া গ্রামে। পূবালী ব্যাংক রবিরবাজার শাখার ব্যবস্থাপক থাকাকালে প্রার্থনা করতেন, হে আল্লাহ আমাকে এই সুদের চাকুরী হতে মুক্তি দিন। আল্লাহ তার প্রার্থনা মঞ্জুর করেন। বিসিএস পাশ করে হন অর্থনীতির প্রভাষক। আমরা দুজন বাসার দুই কক্ষে থাকি। শীতোতাপ নিয়ন্ত্রিত ড্রয়িংরুমে মশিউর রহমান টিউশনি করেন। সকাল বিকেল বেশ কয়েক ব্যাচ, প্রতি ব্যাচে পনের বিশ জন ছাত্রছাত্রি। আয় ভালই। কলেজ ১০টা হতে ৩টা, প্রায়ই থাকে নানা ছুটি ছাটা। মশিউর বললেন যেদিন ব্যাংকের ব্যবস্থাপক হতে ইস্তফা দিয়ে আসি মনে হল যেন জেল হতে মুক্ত হয়ে এসেছি। দুপায়ে বাঁধা শক্ত শিকল কে যেন হেকস দিয়ে কেটে দিল। আমি পিঞ্জিরামুক্ত পাখি হলাম।    

মর্দে মুমিন মোঃ মশিউর রহমানের সাথে থেকে আমিও একজন পাক্কা মুমিন বান্দায় পরিনত হই। লাশরিক আল্লাহ বিশ্বাসে এক গভীর প্রশান্তি আছে, আল্লাহ উপাসনায় এক অনাবিল সুখ আছে। সেই সুখ সেই প্রশান্তি আমার মনকে সেই দিনগুলোতে আচ্ছন্ন করে রাখে। মহান আল্লাহর প্রতি ইমান বা নির্ভরতা আমাকে নির্ভার করে দিত, আল্লাহর প্রতি কৃতঞ্জতা আমার সব না পাওয়ার ব্যদনা ভুলিয়ে দিত, আল্লাহর প্রতি সুধারণা আমাকে সঠিক পথে সুদৃঢ় রাখত, আল্লাহর জিকির মনটাকে এক স্বর্গীয় আনন্দরাজ্যে বিচরণে সাহায্য করত। ভিন্ন এক সুফি জীবনের স্বাধ এখানে পেলাম।

মশিউর রহমান একটি প্রবন্ধ বই লিখেন। বইটি তেমন বড় না হলেও নামটি বেশ বড় ‘অপসংস্কৃতির ভিড়ে বিপর্যস্ত তরুণ তরুণী’। ত্রিশ চল্লিশ হাজার টাকা খরচ করে প্রকাশিত এই বই বিতরনের পর অনেকগুলো কপি বাসায় বস্তাবন্দি হয়ে আছে। আমি বইটি পড়লাম। তারূন্যের তেজদীপ্ত এই প্রবন্ধগুলো বেশ মানসম্মত। বললাম আপনার কলমের শক্তি আছে, লেখালেখি ছাড়লেন কেন? জবাব দেন লেখালেখিতে মূল্যবান সময় অপচয় নাকরে আল্লাহর জিকির করাইতো উত্তম। এবার আমি মশিউর রহমানের আরেক খনির সন্ধান পেলাম, খনিটি মূল্যবান গ্রন্থমালার। সব নামিদামি লেখকের বইয়ে সমৃদ্ধ এই পাঠাগার আমার আরেকটা নিত্য সহচর হয়ে গেল। এখানে হুমাউন আহমদের লেখা অনেক বই গোগ্রাসে পড়ে সাবাড় করি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একে একে দুইশত ছোটগল্পও আমার পেঠে গেল। মোফজ্জিল করিম, ফারুক চৌধুরী, ডঃ আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গির, শরৎচন্দ্র চট্টপাধ্যায়, খুশবন্ত সিং প্রমুখ লেখকের অজস্র বইমালা পড়ে গেলাম একটানা আড়াই বছর। এই পাঠাগার আমাকে আত্মজীবনী লিখতে বেশ প্ররোচিত করে এবং সুদীর্ঘ ‘জীবন ও ভ্রমণ’ কাহিনি লেখার কঠিন শ্রমঘন কাজে নামায়, যে কাজে আমার একটানা প্রায় তিনচার বছরের শ্রম ও সাধনা খরচ হয়ে যায়।

একসময় প্রভাষক মশিউর রহমান ঢাকার সরকারি কলেজ শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউটে ছয়মাসের প্রশিক্ষণে চলে যান। শুক্রবার ও শনিবার ঢাকা থেকে এসে খানিক টিউশনি করতেন। আমি তখন সাপ্তাহিক ছুটিতে সিলেটে থাকতাম। জানুয়ারীর রোববার, সিলেট থেকে এসে সারাদিন অফিস করি। সেই প্রচন্ড শীতের রাতে দেরী করে অরেঞ্জটিলার বাসায় এসে দেখি পালঙ্গ, বিছানা, বালিশ, কম্বল কিছুই নেই। মশিউর রহমানের কক্ষ তালাবদ্ধ। হোটেলে খেয়েদেয়ে আসলেও এখন ঘুমাই কেমন করে। মশিউর রহমানকে মোবাইলে যোগাযোগ করলে বললেন, আহ ভূল হয়ে গেছে। আমি ব্যস্ত থাকায় আপনাকে জানাতে পারিনি, পুবালী ব্যাংকের বদলি অফিসার এবাসার সাবেক বাসিন্ধা অলিউর ট্রাক নিয়ে এসে তার পালঙ্গ, বিছানা, বালিশ, কম্বল ও মশারী সব নিয়ে গেছে।

একবার মনে হল কোন হোটেলে কিংবা আত্মীয়ের বাসায় চলে যাই। পরক্ষনেই মনে পড়ল আব্বার উপদেশ, তোমাকে জীবনে যে কোন পরিবেশের সাথে খাপখাইয়ে নেওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে, নইলে জীবন সংগ্রামে টিকে থাকতে পারবেনা। আর ভাবলাম কত অসহায় মানুষ এই শীতের রাতে রাস্থার পাশে ফুটপাতে ঘুমিয়ে রাতের পর রাত কাটায়, আমি না হয় একরাত সেই অভিজ্ঞতা নিলাম। তারা কেমন করে রাত পোহায় সেই যন্ত্রণায় জীবনে অন্ততঃ একরাতের জন্য না হয় শরীক হলাম। এবার আমার কক্ষের মেঝে কিছু অংশ পানি দিয়ে মুছে নেই। মেঝেতে বিছানার বদলে পত্রিকা বিছিয়ে দেই। আমার একটি হ্যান্ডব্যাগকে বালিশে পরিনত করি। প্যান্ট, সার্ট, মুজা ও সোয়েটার পরে ঘুমাতে যাই। কানের কাছে মশার ভেনভেন শব্দ হলে আমার ঘুম আসেনা। তাই আমার লুঙ্গিটি চাদর করে মুখটা ডেকে নেই। রাতে ভালই ঘুম হল, তবে ভোরে ঘুম হতে জাগার পর মনে হল মুখচর্মে খানিকটা জ্বলছে এবং আয়নায় চেয়ে দেখি আমার সারাটা ফেইসে মশার কামড়ের লাল লাল দাগ ফোটে আছে। জীবনে এই আরেক অভিঞ্জতা হল। তবে ঘুম ভাঙ্গার পর মনে হল আমি বিজয়ী হয়েছি, মরহুম পিতার উপদেশ পালন করেছি।    

তাছবিহ জপেজপে প্রতিদিন চল্লিশ/পঞ্চাশ মিনিট হাটার অভ্যাস আমার অনেক পুরানো। ডায়বেটিস হবার অনেক আগ থেকেই আমি হাঁটতাম, তাই এই হাটা আমার নিয়মত অভ্যাস হয়ে গেছে। লোকেরা দলবেঁধে হাটলেও নিদৃষ্ট কিছু তছবিহ পাঠের জন্য আমি একাকি হাটা পছন্দ করতাম। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা নিরিবিলি রাস্থাই সব সময় আমার পছন্দ। এমন সব রাস্থা দিয়ে আমি হাটি যে পথ জনহীন এবং দুপাশের প্রকৃতি নয়নাভিরাম। একই রাস্থায় হেঁটে হেঁটে বিরক্তি এসে গেলে নুতন রাস্থা আবিস্কার করি। ভোরে ঘুম থেকে উঠেই হাটতে বেরুতাম। প্রথমে ছুটে যেতাম বর্ষিজুড়া পাহাড়ে। দালানময় টিলাবাড়ি পেরিয়ে যক্কা হাসপাতাল, কিছু জনপদ টিলা টক্কর উপত্যকা পেরিয়ে বর্শিজুড়া পাহাড়ের উচ্চভুমি। নিরিবিলি এই পাহাড়ে নতুন বসত গড়ে উঠছে। কিছু ডায়রি,পল্টিখামার, বৃক্ষবাগ, টিলা, ছোট মসজিদে আমসিপারা পাঠ্যরত শিশুর দল ও হুজুর। এখানে আসতেই হুজুর ও তালবারা আমাকে লক্ষ্য করে বলতেন আসসালামুয়ালাইকুম। তারা একজন হেন্ডসাম পৌড় বয়সের নবাগত লোককে তাদের এলাকায় হাটতে দেখে এভাবেই সম্মান জানাত। আমি ওয়াআলাইকুম সালাম বলে বলে একনাগাড়ে হেঁটে যেতাম। আসলে এই শহরের মানুষ পথে পথে কাঊকে দেখলেই রসুলের (সঃ) সুন্নাত সালাম দেয়, এটা তাদের অভ্যাসে পরিনত হয়ে গেছে।

আরেক রাস্থা দিয়ে মাইল দেড়েক হেঁটে আমি শমশেরনগর রোডে পৌছে যেতাম। ধানক্ষেত, উচুভূমি, আবাসিক এলাকা, কবরগাহ পার হতাম। এই রাস্থার পাশে ছিল আমাদের আইন অফিসার আবু তাহেরের বাসা। যদিও এবাসার পাশ দিয়ে যাই তবুও বাসাটি সনাক্ত হতে আমার দুই বছর পার হয়ে যায়। কিছু সুন্দর সুন্দর বাসা আমার চোখ ঝলসে দিত। আমার হাটার একটা সেরা রোড ছিল সরকারি কলেজ হতে উত্তর দিকে যে পাহাড়ি রাস্থাটি গিয়ে শ্রীমঙ্গল সড়কে মিলিত হয়েছে। খ্রিষ্টান পল্লী গীর্জাপাড়া, টিলার উপর গীর্জা, সুনসান নীরবতায়ভরা খ্রিষ্টানদের কবরের সারি, যেন ক্রসদন্ডের সামনে মাটির নিচে মহাশান্তিতে ঘুমিয়ে আছেন ওরা। বামে একটি রাস্থা চলে গেছে মৌলভীবাজার ন্যাচারাল পার্কে। এখানে একটি স্টেডিয়াম, প্রায় ভোরে এই স্টেডিয়ামে নরনারীগণ প্রাতঃভ্রমন করেন। গীর্জাপাড়ার উত্তরের সৈয়ারপুর ও মধ্যপাড়া  বেশ সুরম্য ও নয়নমুগ্ধকর। এপাড়ার কিছুবাসা টিলার উপর, কিছু টিলার তলায়, কিছু উপত্যকায় স্থরে স্থরে সাজানো। এসব পাড়ায় হাটতে ভালই লাগত।

এই টিলাময় সড়কের একপাশে আমার ভাগ্নি চুন্নীর সুরম্য দুইতলা ভবন। চুন্নী তখন সিলেটে তার পুত্র ও কন্যা মুমেনাকে বাংলা আরবি শিখাতে ব্যস্ত। তার পুত্র খুব স্মৃতিধর, সে মাত্র নয়দশ বছর বয়সে কোরান হাফিজ হয়। পাশেই টিলার উপর পিডিবির সেই বাসা যেখানে আমি অতীতে বেশ কয়েক রাত থেকেছি। চুন্নীর বাসার অনেক স্মৃতি আছে আমার। চুন্নীর শ্বশুর আব্দুল আহাদ ছিলেন একজন ধনাট্য বৃটিশ প্রবাসী। এই শহরে তাদের অনেকগুলো বাসা, বিয়ের পর নববধু চুন্নী চৌমুহনার কাছে তাদের শমশেরনগর রোডের বাসায় ওঠে।

এখন পিডিবি অফিসের সামনের এই টিলাময় সুরম্য পাড়ার শীতোতাপ নিয়ন্ত্রিত দুতলা বাসাটি তাদের স্থায়ী ঠিকানা। যুক্তরাজ্য হতে সবসময়  এই পরিবারের কেউ না কেউ দেশে আসেন এবং এই বাসায় অবস্থান করেন। চুন্নীর স্বামী হুমাউন এক রমজানে আমাকে ফোন করে ইফতারির দাওয়াত দেন। ইফতার খাবার পর তাদের বালক পুত্র ইসরাকের ইমামতিতে তারাবি নামাজ পড়ার আমন্ত্রন জানান। ইসরাকের পিতামহের ইচ্ছে ছিল নাতিকে কোরান হাফেজ করবেন। মহান আল্লাহ তাদের ইচ্ছে পূরন করেন। বাসার সামনে দুইটি নিজস্ব গাড়ি প্রস্তুত হল। আমরা বাসার কয়েকজন মুসল্লি, একজন বড় হাফেজ ও নাতি শিশু হাফেজ ইসরাক সহ দশবার জন গিয়ে গাড়িতে বসি। গাড়ি দুটি শহরের প্রধান রাস্থা দিয়ে অগ্রসর হয়ে মনুসেতু পার হয়। অপারে গিয়েই বামদিকে একটি গ্রামের রাস্থায় ঢূকে যায়। ধানক্ষেত ও পাকাবাড়ি পেরিয়ে প্রায় দুইমাইল দূরে একাটোনা বাজার। এই বাজার পেরুলেই লন্ডনী গ্রাম কচুয়া। আমাদের সদালাপী প্রিয় বেয়াই আব্দুল আহাদ বছর তিনেক আগে মারা যান। আমরা হজরত শাহ মোস্তফার(রঃ) মাজারে তার নামাজে জানাজায় শরীক হই। এই জানাজায় আসেন সমাজকল্যাণ মন্ত্রী সৈয়দ মহসিন আলী ও সাবেক মন্ত্রী এবাদুর রহমান চৌধুরী। আমি বেয়াইয়ের সেই লাশের গাড়ি মিছিলে আমার কার নিয়ে শরীক হয়ে প্রথম কচুয়া আসি। একটি পাকা ওয়ালঘেরা লম্বা বাড়ি, বাহিরে বড়পুকুর। পাকা টিনের দুইসারি ঘরে একই রক্তের বেশ কয়েক ঘর মানুষের বসবাস। সারাটা বাড়ির বিস্তর লোকজন বৃটিশ সিটিজেন।

এইগ্রামে এবার আমার দুসরা আগমন ঘটে। আগের আগমন ছিল শোকের, এই আগমন হল আনন্দের এক তীর্থযাত্রা। একটি দ্বিতল মসজিদের সামনে আমাদের গাড়ি দুটি থামল। নিজগ্রামের এই মসজিদে রমজান আসার আগে ভাগ্নিবর হুমাউন শীততাপ নিয়ন্ত্রন যন্ত্র বসিয়ে দেন। শিশু হাফেজ ইসরাক দশ রাকাত ও হুজুর হাফেজ দশ রাকাত নামাজ ভাগ করে পড়ান। শিশু হাফেজ কোন বাধাবিঘ্ন ছাড়াই নির্ভুল নামাজ পড়ান। তার কন্ঠ সুমধুর, না নারী কন্ঠ না পুরুষ কন্ঠ এমন এক সুন্দর উভকন্ঠের নির্ভুল তেলাওত আমাদেরকে বিমোহিত করে। আমি তিনদিনই এই শিশু হাফেজের ইমামতিতে কচুয়া গিয়ে তারাবির নামাজ পড়ি। নামাজ শেষে এই শিশু হাফেজকে নিয়ে গ্রামের আত্মীয়দের উচ্ছাসের কোন সীমা ছিলনা। অরেঞ্জটিলার বাসায় মোঃ মশিউর রহমান কচুয়া হতে আমার ফেরার অপেক্ষায় অনেক রাত জেগে রইতেন।

হুমায়নের এক ভাতিজার লন্ডনে বিয়ে হয়। শাহ মোস্তফা রোডে চুন্নীদের মালিকানাধীন সাদিয়া হোটেল এন্ড কমিউনিটি সেন্টারে বৌভাত অনুষ্টান হয়। আমি আমন্ত্রিত হয়ে সপরিবারে সেই বৌভাতে যোগ দেই। আমার চাচাত ভাতিজী রুবার হাজবেন্ড প্রতি ডিসেম্বর দেশে আসেন। প্রতিবারই তিনি পশ্চিমবাজারে আমার অফিসে এসে দেখা করেন এবং আমাকে দাওয়াত করে তার কলিমামাবাদের বাসায় নিয়ে যান। এই সুন্দর তিনতলা বাসায় রুবা আমাকে খুব খাতির যত্নের সাথে নানাপদের হাতে তৈরি খাবারে আপ্যায়ন করে এবং তাদের বাসায় রাতে থাকার আমন্ত্রন করলেও আমি থাকতে যাইনি। চুন্নীদের বাসায়ও রাতে থাকার অনুরোধ আমি রাখিনি। সবসময় ফিরে আসতাম আমার অরেঞ্জটিলার আস্তানায়। আমার হাজিপুরের ফুফুত বোন সায়মা আপার পুত্র সৈয়দ হারুন ভাগনার বাসায় একদিন যাই। তার পত্নী আমাদের একজন দুরসম্পর্কীয় ভাগ্নি। এশহরে তাদের প্রচুর সম্পদ রয়েছে। অনেক ব্যাংক তাদের ভবনের ভাড়াটিয়া। তাকে নিয়ে বেরিরপারে ঘুরে বেড়াই।

মধ্যএশীয়দের মত সুদর্শন এডভোকেট সৈয়দ আনোয়ার মাহমুদ আমার পত্নীর দোলাভাই, তিনি গোদরাইলের ফুফুত বোন হুসনা আপার স্বামী। আমি দুইতিনবার মুসলিম কোয়ার্টারে তাদের বাসায় যাই। উকিল দোলাভাইয়ের বয়স আশি পেরিয়ে গেছে, তাই প্রতিবারই আমাকে চিনতে তার বেশ বেগ পেতে হয়। একবার তিনি কাস্টমার মনে করে আমাকে চেম্বারে বসিয়ে রেখে অন্য কাস্টমারের সাথে আলোচনায় নিমগ্ন হন। আমাকে জিঞ্জেস করলেন কি কাজে এসেছি। কোন কাজের জন্য আসিনি বলে পরিচয় দিলাম। এবার চিনতে পেরে আমাকে বুকে জড়িয়ে ড্রয়িংরুমে নিয়ে যান। তাদের ছেলেমেয়েরা প্রবাসী, কেউই কাছে নেই। তাই বুড়াবুড়ির এখন বড্ড ক্লান্ত বিকেলই যাচ্ছে।

ডাঃ নুরজাহানের শৈশবে তার পিতৃপরিবারের ফ্রি পারিবারিক চিকিৎসক ছিলেন এডভোকেট আনোয়ার মাহমুদের জৈষ্ট ভ্রাতা ডাঃ সৈয়দ আফসার মাহমুদ। আমার পত্নী মৌলভীবাজার এলেই এই প্রবীণ ডাক্তার সাহেবকে না দেখে ফিরতেন না। পাশেই ডাক্তার সাহেবের  তিনতলা বাসা। নূরজাহান বেগম বলতেন শৈশবে এই পাড়ায় থাকাকালে আমাদের রোগ হলেই সময়ে অসময়ে এসে তাকে অনেক যন্ত্রণা দিতাম, তাও আবার কোন ভিজিট ছাড়া, তদুপরি মাঝেমাঝে বিনামূল্যে ঔষধও বিতরণ করতেন। তিনি একজন ব্যক্তিত্ববান আদর্শ চিকিৎসক ছিলেন। এই ডাঃ সৈয়দ আফসার মাহমুদের পূত্র ডাঃ সৈয়দ সাদী মাহমুদ এফসিপিএস একজন নাক-কান-গলা রোগ বিশেষঞ্জ। 

নিশাতের শ্বশুর তোফাজ্জল হোসেন আমাকে বারবার ডেকে নিয়ে দাওয়াত খাওয়াতেন। আমি মৌলভীবাজারে থাকাকালেই তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন। বিষয়টি আমি আগেই আলোচনা করেছি। তার পূত্র তানভির হোসেন আলো এখন মৌলভীবাজার বারের সদস্য। সে ভাল ইংলিশ জানে। সবধরনের বই পড়ে ও সব ব্যাপারে যথেষ্ট ঞ্জান রাখে। তার সাথে আমি প্রায়ই সাহিত্য নিয়ে আলোচনায় বসতাম। আলোর তিন বোনের বিয়ে হলে বাপ ও পুত দুজন কাজিরপাড়ার বাসায় থাকতেন। নারীবিহীন সংসারে দুইজন পুরুষ মানুষকে বুয়া রান্না করে খাওয়াত। ইতিমধ্যে বাবা এডভোকেট তোফাজ্জল হোসেন মারা গেলে এই বড় বাসায় তানভির হোসেন আলো একাকি জীবনের ঘানি টানছে। মৌলভীবাজার ছাড়ার আগের রাত আমি হেঁটে হেঁটে আলোর বাসায় যাই বিদায়ী দেখা করতে। সে আমাকে খুশবন্ত সিংয়ের ‘দিল্লি’ সহ বেশকিছু মূল্যবান গ্রন্থ উপহার দেয়।   

একদিন আমার ছোট দোলাভাই লিয়াকত হোসেন চৌধুরী মৌলভীবাজার আসেন দাওয়াত খেতে। আমরা কয়েকজন আত্মীয় সন্ধ্যারাতে চাদনিঘাটে মনুসেতু হেঁটে পার হচ্ছি। সেদিন পূজাশেষে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন মনু নদে প্রতিমা বিসর্জন দিচ্ছিলেন। ঠেলাগাড়ি, লেগুনা, ট্রাকে করে আনা একের পর এক প্রতিমা মনুনদে ফেলা হচ্ছিল। প্রতিমা বিসর্জন দেখতে সেতুতে ভীষণ ভীড় জমে যায়। সেতুর উপর ও দুইপ্রান্তে বেশ যানজট তৈরি হয়। ইতিমধ্যে লিয়াকত দোলাভাই ভীড়ের মধ্যে বারবার সাবধান করতে থাকেন, সবার মোবাইল ও ম্যানিব্যাগ সাবধানে রাখুন, পকেটমার মেরে দিতে পারে। তার চিৎকারে আমরা সাবধান হলাম বটে কিন্তু এই সাবধান বানীদাতা লিয়াকত দোলাভাই হঠাৎ বলে ওঠেন, হায় হায়রে আমার দামি মোবাইলটা নাই। প্যান্টের বাম প্যাকেট, ডান প্যাকেট, কোট প্যাকেট কোথাও মোবাইলটা খোঁজে পাওয়া গেলনা।

সামনের একজন লোককে তিনি সন্দেহবশে ঝাপটে ধরেন, এই এই লোকটা আমার মোবাইল মেরেছে। লোকটা দাঁড়িয়ে বলল আমি আপনার মোবাইল নেইনি। আপনি চাইলে আমার সারা দেহ তল্লাশি করে দেখতে পারেন। আমি বুঝে ফেলি এই লোকটি তার মোবাইল চুরি করেনি। যে চুরি করেছে সে ভীড়ের মধ্যে দ্রুত সটকে পড়েছে। আমরা হারানো মোবাইলে ফোন করে দেখি কোন সাড়াশব্দ নেই, স্মার্ট চোর ইতিমধ্যে সিমকার্ড খোলে ফেলেছে। আমি শংকিত হলাম লিয়াকত দোলাভাই এমন হাবভাব করছেন যে হয়ত এই নির্দোষ লোকটাকে হাটুরে পিঠুনি খাইয়ে ছাড়বেন। আমি এগিয়ে এসে লোকটাকে ধাক্কা দেই, বলি যাও পালাও। লোকটা ভীড়ের মাঝে হারিয়ে গেল।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন