সোমবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

মৌলভীবাজার সরকারি কলেজ এবং আমি

 মৌলভীবাজার সরকারি কলেজ এবং আমি

আমার বসতসঙ্গি প্রফেসর মশিউর রহমানের সৌজন্যে মৌলভীবাজার সরকারি কলেজ আমার স্মৃতির একটি অংশে পরিণত হয়। কলেজ পাঠাগারে ‘ইসফাক কুরায়শী রচনাসুমগ্র’ দিতে গিয়ে প্রিন্সিপাল সৈয়দ মুহিবুর ইসলামের সাথে আমার পরিচয় হয়। প্রিন্সিপাল সৈয়দ মুহিবুর ইসলাম জগন্নাথপুর উপজেলার সৈয়দপুর গ্রামের লোক। তিনি বাউল কবি সৈয়দ শাহনুর সম্পর্কে একটি পুস্তক লিখেন। বইটি ছাত্র ও শিক্ষকদের কাছে বিক্রি করে খরচ বের করে আনেন। বসের লেখা বই, তাই মশিউর রহমান এককপি বই কিনে আনেন। কিন্তু বাউলের জীবনী নিয়ে তার তেমন কোন আগ্রহ নেই, তবে আমি কবি শাহনুরের জীবন ও গান খুব আগ্রহ সহকারে পাঠ করি।

কিছুদিনের মধ্যে প্রিন্সিপাল সৈয়দ মুহিবুর ইসলাম অবসরে যান। এবার প্রিন্সিপাল হন ডঃ ফজলুল আলী। এই হাসিখুশি কর্মচঞ্চল রাষ্ট্রবিঞ্জানের স্যারকে আমি আগেই চিনতাম। কলেজের ভিতরের সংক্ষিপ্ত রাস্থা দিয়ে সকাল বিকেল যাবার অনুমতি তিনি আমাকে দেন। মুখোমুখি হলেই সালাম দিতাম, তিনিও থেমে হাত মিলায়ে কুশলবার্তা জিঞ্জেস করতেন। তিনি শহরের শান্তিবাগের স্থায়ী বাসিন্দা। অধ্যক্ষ হওয়ামাত্রই তিনি ঘাস ও জঙ্গল সাফ করে সারাটা কলেজ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে ফেলেন।

এই কলেজটি বাংলাদেশের অন্যতম সুন্দর কলেজ। ১৯৫৬ সালে এই সুন্দর পাহাড়ি জায়গায় কলেজটি স্থাপিত হয়। সিলেটের এমসি কলেজের মত এখানে আছে টিলা, উপত্যকা ও নিচুভূমি, সিড়িকাটা সড়ক ও ঢালু রাস্থা। দুই পাহাড়ের মধ্যে দেখতে নদীর মত এক লম্বাকার সর্পিল পুকুর। উচ্চ টিলার উপর মহিলা ছাত্রাবাস ও অধ্যক্ষের বাসা। অনুচ্চ টিলায় কলা, বানিজ্য ও বিঞ্জান ভবন। গেটে ঢুকেই বামদিকে এম সাইফুর রহমান অডিটোরিয়াম, ডানদিকে শহিদমিনার এবং ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গকারী এই কলেজের চারজন শহিদ মুক্তিযুদ্ধা ছাত্রের স্মৃতিস্থম্ব। বামদিকের একটি নিচু উপত্যকা ভূমি ঘুরে বেয়ে বেয়ে উপরে উঠতে হয়। এই পাহাড়ঘেরা নিচুভুমি ব্যাডমিন্টন ও নানা খেলাধুলার জায়গা হিসাবে ব্যবহৃত হয়। সামনে অফিস, পাঠাগার, টিচার সম্মেলন কক্ষ। উপরে গিয়ে সামনে বিশালাকার আঙ্গিনা। এই টিলা আঙ্গিনার প্রান্তে প্রান্তে বৃক্ষছায়ার বসার জন্য পাকাবেঞ্চ পাতা।

এই অঙ্গনে দুটি ব্যাডমিন্টন খেলার মাঠ। শিক্ষকরা রাতে লাইট জ্বালিয়ে এখানে ব্যাডমিন্টন খেলেন। এখানে ব্যাডমিন্টন খেলতে আসেন আমার প্রিয় শেয়ার ব্যবসায়ী ভাই সৈয়দ তোফাজ্জল আলী, তার বাসা সামনের কলিমাবাদ। সৈয়দ তোফাজ্জল শেয়ার ব্যবসা করেন, তবে তিনি শেয়ার সম্পর্কে তেমন কিছুই জানেন না। আমি বলি আপনি শেয়ারের ‘অ’ অক্ষর বুঝেন না, তাহলে কিভাবে শেয়ার ক্রয়ের সিন্ধান্ত নেন। তিনি বললেন, আমি রাজধানী ঢাকা হতে ‘খবর’ কিনে শেয়ারে বিনিয়োগ করি। এবার বলি, আপনি কিভাবে খবর কিনেন? বললেন ঢাকায় আমাদের লোক আছে, আমরা অর্থ পাঠালে তারা ‘খবর’ কিনে পাঠায়। আমরা এই খবরের দাম সাথে সাথে পরিশোধ করে দেই। তোফাজ্জল ভাই খুব উদার লোক, ‘খবর’ গোপন রাখার নির্দেশনা থাকা সত্বেও তিনি আমাকে তার কেনা ‘খবর’ বিনে পয়সায় সরবরাহ করতেন। আমি অবাক হয়ে দেখতাম তার কেনা শেয়ারের দাম তার কথামত বাড়ছে। তিনি ঢাকার সেই ‘খবর’ বিক্রেতার নির্দেশ পেলেই শেয়ার বিক্রি করে বেরিয়ে আসতেন। তবে আমি তার কাছ থেকে খবর নিয়ে তা খুব যাচাই বাছাই নাকরে বিনিয়োগ করতে যাইনি। তার মত চোখবুজে বিনিয়োগে আমি কখনও বিশ্বাসী নই এবং সেজন্য বড় কোন বিপদে পড়িনি। সৈয়দ তোফাজ্জল প্রতিরাতে কলেজ প্রাঙ্গনে  এসে শিক্ষকদের সাথে ব্যাডনিন্টন খেলেন এবং আমাকেও খেলাতে আমন্ত্রণ জানান।

আমার ডান পায়ে সামান্য ক্রুটি থাকায় ফুটবল তেমন খেলতে পারিনি, তাই ব্যাডমিন্টন ছেলেবেলা হতে আমার প্রিয় খেলা। কলেজের রসায়ন শিক্ষক রফিউদ্দিন এই শহরের শান্তিবাগের লোক। তিনি আমার প্রিয় ব্যক্তিত্ব পুবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপক আব্দুল ওয়াহিদের মামাতো ভাই। তাকে এখানে ব্যাডমিন্টন খেলার একজন প্রিয় সহখেলোয়ার হিসাবে পেয়ে যাই। তিনি আমার মত সিলেট এমসি কলেজের সাবেক ছাত্র ছিলেন। কলেজের স্যারদের সাথে কিছু সাবেক ও সিনিয়র ছাত্ররাও এখানে খেলতেন। রাত ১২টা অবধি এই খেলাধুলা চলতো। রাতে বাসা ফেরার পথে আমি এই কলেজ আঙিনায় খানিকক্ষণ ব্যাডমিন্টন খেলে বাসা ফিরতাম। এতে আমার পর্যাপ্ত ব্যায়ামটা হয়ে যেত।

আমার বন্ধু সৈয়দ তোফাজ্জল আলী সরল লোক, কিন্তু উচ্চবিলাসী। তিনি সবখানে অর্থ ঢালতেন ও নেতাগিরী করতেন। কিছু ধুরন্ধর প্রকৃতির লোক তার খাইতো আবার তাকে কনুইয়ের গুতো মেরে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করতো।  

পিছনের পাহাড়ের ঢালুতে উদ্ভিদবিঞ্জান বিভাগের একটি সুন্দর বুটানিক্যাল গার্ডেন। এখানে নানা জাতের ফুলগাছের সমাহার। প্রকৃতির প্রায় সব রূপ-সোন্দর্য্য এসে এই মৌলভীবাজার সরকারি কলেজের মধ্যে জমায়েত হয়েছে।

আমার দরদিনী বেগম সাহেবার দারুণ মাথাব্যাথা আমি মৌলভীবাজারে কি খাচ্ছি, কোথায় থাকছি, কেমন করে ঘুমাচ্ছি? তাকে বলি আমি যেখানেই থাকিনা কেন আল্লাহ আমাকে ভাল রাখেন, সুখেই রাখেন। তারপরও তিনি যেমন করেই হউক আমার আস্তানা দেখবেন। একদিন অফিসে বসে তার ফোন পেলাম, আমরা গাড়িতে, একটু পরই মৌলভীবাজার টার্মিনালে নামছি। এই ফোন পেয়ে আমি বিকেলের ছুটি নিয়ে টমটম চড়ে বাস টার্মিনাল চলে যাই। এবার আমার অযাচিত মেহমান এই মা ও পুতকে নিয়ে কোর্ট রোডের টমটমে উঠে মৌলভীবাজার কলেজগেটে নামি। এই সুন্দর পাড়া এবং সুরম্য কলেজ দেখানোর লোভে আমি তাদেরকে নিয়ে কলেজের ভিতর দিয়ে হেঁটে যাই। মেহমান দেখে মশিউর রহমান বাজার করলেন। রাধুনী মাসুমের মা ও ডাঃ নুরজাহান বেগম দুজন মিলে রান্না করলেন। অরেঞ্জটিলার এই বাসায় আমার সাথে ডাঃ নুরজাহান ও জেফারের একদিন থাকা হল, যাক আমি এখানে কেমন আছি তাদের দেখা হল। আমি আরামে আছি দেখে আমার ডাক্তারনি মনে মনে খুব প্রশান্তি অনুভব করলেন। আমাকে নিয়ে তার মনে জমে থাকা একরাশি দুশ্চিন্তার অবসান হল।        

মৌলভীবাজার সরকারী কলেজে সেদিন ছিল পূজা অনুষ্ঠান। সারাটা কলেজে আলোকসজ্জা করা হয়েছে। পুজামঞ্চে কয়েকজন পুজারী, ক্যাসেটে হিন্দি গান বাজছে। রাতে মশিউর রহমানকে বললাম, আসেন কলেজের পুজো দেখে আসি। তিনি বললেন, আমি এসব গোনাহের কাজে যাইনা। প্রতিমা পূজার মত শিরক কাজ হতে সর্বদা দূরে থাকি। এবার আমরা তিনজন হেটে হেটে পিছনের মসজিদের পাশের গেটদিয়ে কলেজে ঢুকি। আলোকসজ্জায় সারাটা কলেজ প্রাঙ্গণ ঝলমল করছে। হিন্দু ছাত্রছাত্রীরা বরকনের মত সেজেগুজে এসে পুজামঞ্চের সামনে আনন্দ উল্লাস হৈ-হল্লা করছেন। তারা কীর্তন করছেন, হরিনাম জপ করছেন। সেদিন আমরা তাদের সেই আনন্দ উল্লাসে শরিক হই।

নুরজাহান বললেন, জেফার তোমার মেঝমামা জামিল চৌধুরী এই কলেজের ছাত্র ছিলেন, তিনি এইচ এস সি এবং বি এস সি এই কলেজ হতে পাস করেন। হ্যাঁ তা অনেক আগের কাহিনী, আমার শ্বশুর এনাম উদ্দিন চৌধুরী তখন এই শহরে চাকুরি করতেন এবং সপরিবারে এই শহরের বাসিন্দা ছিলেন। সে রাতে সাবেক ও বর্তমান সংখ্যালঘু ছাত্রছাত্রীদের সাথে রংবেরঙ্গের মরিচবাতির মৃদু আলোছায়ার বন্যায় সারা কলেজ প্রাঙ্গন আমরা ঘুরে বেড়াই। কলেজের টিলা ও উপত্যকা কিছুই বাদ পড়েনি। রাত ৯ ঘটিকার পর আমরা টিলাসড়ক দিয়ে হেটে হেটে অরেঞ্জটিলার বাসায় ফিরি।

ডঃ ফজলুল আলী অধ্যক্ষ হলে রাষ্ট্রবিঞ্জান বিভাগে তার আসনে বসেন অধ্যাপক ডঃ ফয়েজ আহমদ। মশিউর রহমানের সাথে একদিন ডঃ ফয়েজ আহমদ আমার অফিসে আসেন। মাথার তালুতে চুল তেমন নেই, শরীর বেশ মোঠাসোঠা। তিনি মৌলভীবাজার জেলার নাগরিক। কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন জানতে চাইলে তিনি বললেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বললাম, আমিও তাই। এবার বলি, কত সালের মাস্টার্স? বললেন ১৯৮৮ সাল। বললাম, আমিও তাই। আমরা দুইজন অন্ততঃ মাস্টার্স চুড়ান্ত বর্ষে একসাথে ছিলাম, কিন্তু কেউ কাউকে চিনতে পারিনি। আমার অনুমান ছিল তিনি মৌলভীবাজার সরকারি কলেজেরই ছাত্র এবং নিজ কলেজেই রাষ্ট্রবিঞ্জানের বিভাগীয় প্রধান হয়ে এসেছেন। বিষ্ময় এখানেই শেষ নয়, এবার তার কাছে জানতে চাই, তিনি কোন কলেজের ছাত্র? জবাব দেন সিলেট এম সি কলেজ। এইচ এস সি দিয়েছেন কবে? জিঞ্জেস করে জবাব পাই ১৯৮৩। তাকে বলি আপনি এইচএসসি বিঞ্জানে আমার সহপাঠী ছিলেন। এবারও আমাদের মনে পড়েনি, আমরা জীবনে কক্ষণও কেউ কাউকে দেখেছি। কখনও কখনও স্মৃতি এমনই আপনভোলা হয়, সে সব ভূলে যায়। আবার কখনও দীর্ঘদিনের প্রিয় মানুষের মুখও বিস্মৃতির কবরে চিরতরে হারিয়ে যায়, মনে পড়েনা একদিন সে আমার খুব কাছে ছিল, খুব আপন ছিল।

একদিন মৌলভীবাজার সরকারি কলেজের ‘বার্ষিক ভোজ’ অনুষ্ঠানে যোগদানের আমন্ত্রণ পাই। প্রতি বছর জানুয়ারী মাসের কোন এক ঠান্ডা রাতে এই ভোজ অনুষ্ঠান হয়। সম্ভবতঃ ডঃ ফজলুল আলী এই বার্ষিক ভোজে আমাকে আমন্ত্রণ জানান। তিনি মশিউর রহমানকে বললেন, আপনার ঘরের দ্বিতীয় সদস্য এ জি এম কুরেশী সাহেবকে আমাদের এই ভোজ সভা ও অনুষ্ঠানে নিয়ে আসবেন। এই ভোজ অনুষ্ঠানে কলেজের শিক্ষক ও কর্মচারীরা সপরিবারে অংশ নেন। শিক্ষকগন তাদের জনকয়েক ঘনিষ্ট বন্ধু বান্ধবকেও আমন্ত্রণ জানান।    

এই শহরে অধ্যাপক মশিউর রহমানের পরিবারের সদস্য কেঊ নেই, তেমন বন্ধুবান্ধবও নেই, তাই আমি ভোজে গিয়ে তার এই দুই কোঠা একাই পূরণ করি। টিলার শেষপ্রান্তে ভিতরের নিরিবিলি শিক্ষক মিলনায়তনে একটি সভামঞ্চ তৈরি করা হয়। সামনে অনেকগুলো দর্শক চেয়ার টেবিল সাজিয়ে রাখা হয়েছে। খুব সম্ভব গোপনীয়তা সংরক্ষণে কলেজের সুপ্রশস্ত এম সাইফুর রহমান অডিটোরিয়াম একাজে ব্যবহার করা হয়নি। সামনে ব্যাডমিন্টন খেলা চলছে, ভিতরে চলছে ভোজসভা। আপনারা হয়ত ভাবছেন ভোজের আবার সভা কিসের? আসলে এই বার্ষিক ভোজ অনুষ্ঠান একের ভিতর তিন। এই অনুষ্ঠান সাবেক ও বর্তমান শিক্ষকদের একটি মিলনমেলা। এই ভোজসভায় বিগত বছরে বদলি হওয়া কিংবা  অবসর নেয়া শিক্ষকদের দুইজনকে বিদায় সম্বর্ধণা প্রদান করা হয়। যথানিয়মে বিদায়ীদেরকে মানপত্র ও ক্রেস্ট প্রদান করা হয়। এই বিদায়ী শিক্ষকরা ছিলেন ছয়ফুল কবির চৌধুরী এবং শহিদ উল্লাহ।

শিক্ষকরা স্মৃতিচারণ করছেন, তাদের সহকর্মীরা বউ বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে সামনের দর্শক চেয়ারে বসে শুনছেন। সবাই বেশ সেজেগুজে পরিপাঠি হয়ে এসেছেন। কলেজ শিক্ষকরা ক্লাসে ছাত্র পড়াতে পড়াতে একসময় দক্ষ বক্তা হয়ে যান। যিনি মাইকে যান, তার কথা আর সহজে শেষ হয়না। বেশ কয়েকজন হাসিমুখ শিক্ষক শিক্ষিকা অনেক দূর হতে এমন কি সিলেট এবং ব্রাক্ষনবাড়িয়া হতেও এসেছেন তাদের এই সাবেক কর্মক্ষেত্রে। এখানে আগত শিক্ষক শিক্ষিকাদের আলোচনার বিষয়বস্তু তাদের স্পাউস  ও সন্তানরা, একে অন্যের স্পাউস ও সন্তানদের লেখাপড়া, চাকুরি ইত্যাদির খবরাখবর বেশ আগ্রহভরে নেন। নুতন কর্মক্ষেত্রের কাহিনির সাথে এই ফেলে যাওয়া সাবেক এই কলেজের স্মৃতিচারণ করে করে তারা বেশ মুখর সময় পার করেন।  

সভামঞ্চের এই আলোচনার মধ্যেই খাবার দাবার চলে। ডঃ ফজলুল আলী ও রফি উদ্দিন মৌলভীবাজার শহরের জাতক অধ্যাপক। এখানে খাবারের মানে কোন গন্ডগোল হলে তাদেরই বদনাম হবে। তাই তাদেরকে খুব কর্মতৎপর দেখা গেল। রাতের এই ভোজনে ছিল অনেক অনেক ব্যঞ্জন, ছিল অনেক রাঁধুনিগুন ও পুষ্টিমান। একসময় মঞ্চের বক্তৃতা শোনার ধর্য্য সবার শেষ হয়ে গেল। বক্তা বলছেন কিন্তু শ্রোতারা একে একে চলে যাচ্ছেন।

কলেজ প্রাঙ্গণে বিদ্যুৎবাতির আলোয় আড্ডা চলছে। আমি ও মশিউর রহমান বেরিয়ে সামনের প্রাঙ্গণে এই খোলা আড্ডায় যোগ দেই। এখানে চলে গল্প ও খুনটুশি। গল্প ফুরাতে চায়না কিন্তু সময় ফুরিয়ে যায়। আড্ডা ভাঙ্গার আগেই সেদিন ফিরে এলাম অরেঞ্জটিলার বাসায়। এসে ঘড়ির পানে চেয়ে দেখি বেশ রাত হয়ে গেছে, ফজরের জামাত যে খুব একটা দূরে নেই। 

কলেজের কর্মচারীরা মনে করত আমি এই কলেজের একজন। প্রহরীরা আমাকে দেখামাত্র সালাম দিয়ে গেট খোলে দিত। সকালে কলেজের ভিতর দিয়ে যাবার সময় ছাত্রছাত্রীরা আমাকে তাদের কলেজের একজন শিক্ষক মনে করে অনবরত সালাম দিত। আমার সহকর্মিনী ইমরানা আক্তার চৌধুরীর স্বামী লুৎফর রহমান  ছিলেন কলেজের ইংরেজি শিক্ষক এবং সহকর্মিনী সারাহ মাহমুদের বোন রেহনুমা মাহমুদ ছিলেন অর্থনীতির প্রভাষিকা। তাদের সাথে প্রায়ই কলেজ প্রাঙ্গণে আমার দেখা ও কুশল বিনিময় হত।

মৌলভীবাজার কলেজ মসজিদে আমি দুইটি রমজান মাসে তারাবির নামাজ পড়ার সুযোগ পাই। বৃহস্পতি, শুক্র ও শনি এই তিনরাতের তারাবী পড়া হত সিলেটে এবং সাপ্তাহের বাকি চার রাতে তারাবি আদায় হত এই কলেজ মসজিদে। প্রথমবার আমি হাফিজদেরকে মাত্র পাচশত টাকা দান করি। দ্বিতীয় রমজানে একজন শুনিয়ে দেন, এত সচ্ছল হয়েও গতবার কুরেশী স্যার দিয়েছেন মাত্র পাঁচশত টাকা। জবাব দেই, সিলেটের পাড়া ও গ্রামে আর দুইটি মসজিদে আমাকে তারাবির জামাতে চাঁদা দিতে হয়। তবে এসব কথা শোনে এবার আমি এক হাজার টাকা কলেজ মসজিদের তারাবি ফান্ডে জমা দেই। কলেজ মসজিদের ঈমাম ও মুয়াজ্জিন মনে করতেন মুসল্লী আমি এই কলেজে বদলি হয়ে আসা হয়ত একজন শিক্ষক। এখানে পাশের সৈয়দ মুজতবা আলী ছাত্রাবাস, কলেজের শিক্ষক ও স্টাফরা এবং পাশের পাড়ার লোকজন নামাজ পড়তেন। অধ্যক্ষ ফজলুল আলীকেও প্রায়ই নামাজে দেখা যেত। মসজিদের সব বড় খরচাদি কলেজ ও মুছল্লীরা সবাই মিলে বহন করতেন।

অধ্যাপক মশিউর রহমানের মাধ্যমে মৌলভীবাজার সরকারি কলেজের সাথে আমার পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা। আমি এই কলেজের ছাত্র, শিক্ষক, চাকুরীজীবী কিংবা কমিটি সদস্য কিছুই ছিলাম না। কোন যথাযত সূত্র ছাড়াই কেউ কেউ কোন কোন সময় যেমন বন্ধু হয়ে যায়, মৌলভীবাজার সরকারি কলেজও তেমনই অধ্যাপক মশিউর রহমান ব্যতিরেকে আর কোন যোগসূত্র ছাড়াই আমার এক বন্ধু প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়, যা আজ আমার জীবনস্মৃতির স্মরণীয় একটি উজ্জ্বল তারকা হয়ে আছে। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন