তৃতীয়বার
যুক্তরাষ্ট্র যাত্রা- নিউইয়র্ক, ইংল্যান্ড ও ওয়েলস সফরঃ
যাত্রাঃ ১৭জুন ২০১৭ ফেরাঃ ৭জুলাই
২০১৭ অবস্থানঃ ২০ দিন।
১৭ জুন ২০১৭ সাল। সিলেটে প্রবল বৃষ্টি হচ্ছে। লাল কারটি চালিয়ে ভরা বর্ষনের
মধ্যে পুত্র জেফার ও ডাক্তার নুরজাহানকে নিয়ে আমি সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক
বিমানবন্দরে আসি। ৬টা ১০ মিনিটে বিমানটি আকাশে ডানা মেলে। সারাটা পথ সাদা ও ঘন
মেঘমালার উপর দিয়ে অতিক্রম করে পাঁচচল্লিশ মিনিট পর ঢাকায় অবতরণ করি। ঢাকায়
ইমিগ্রেশন ও চেকিং শেষে সকাল ১০টায় বাংলাদেশ বিমানের বিশালাকার উড়ালযানে আবার
আকাশে ভাসি। যাত্রি অল্প, অসংখ্য সিট খালি। আমি, পুত্র জেফার ও গিন্নী ডাঃ
নূরজাহান প্রত্যেকে তিনটি করে সিটে আরামে শুয়ে বসে পথ পার হই। বিমান ভারতের
পাঞ্জাব হয়ে পাকিস্তানে যায়। একটু পর আফগানিস্তানে প্রবেশ করামাত্র মনে হল বিশ্বের
সবচেয়ে ভয়ঙ্কর গোলযোগপূর্ন নরগোষ্টির মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছি। এবার বিমানটি
উত্তরদিকে মধ্য এসিয়ায় প্রবেশ করে। নৃশংস খুনী যুদ্ধা তৈমুর লঙ্গের রাজধানী
সমরখন্দ ও তাসখন্দের ভিতর দিয়ে আমরা রাশিয়ায় প্রবেশ করি। তারপর পোল্যান্ড,
জার্মানী ও নেদারল্যান্ড পার হয়ে নর্থশিতে আসি। ঘন্টা খানেক সময়ে নর্থসি অতিক্রম
করে আমরা লন্ডন শহরের উপরে চলে আসি। তখন লন্ডন শহরের আকাশে ধুঁয়ার মত মেঘমালা উড়ে
যাচ্ছে। সম্ভবতঃ হিথ্রোতে ট্রাফিক জ্যামের জন্য অনেকক্ষন লন্ডনের আকাশে চক্রাকারে
আবর্তন করে বিমান এল এইচ আরে অবতরণ করে এবং আমাদের নয়-দশ ঘন্টা ভ্রমনের অবসান ঘটে।
শুয়ে বসে পার হওয়া যাত্রাটি বেশ আনন্দময় ছিল, কোন ধরনের ক্লান্তি ক্লান্তি ভাব আমাদেরকে
স্পর্শ করতে পারেনি। সিলেট থেকে বাসে বা ট্রেনে ঢাকা গমনে যে ক্লান্তি বা কষ্ট
সইতে হয়, তার বিন্দু ভাগও এখানে সইতে হয়নি। বিমানের খাবারও দেশী ও মজাদার। সার্ভিস
নিশ্চিত আন্তর্জাতিক মানের। বেশ কয়েকবার চা, কফি ও পানীয় পরিবেশন করা হয়। মনে হল
আমাদের বিমান শীঘ্রই বিশ্বের এক উন্নত সংস্থা হিসাবে পরিগনিত হবে।
ট্রলিতে করে মালামাল নিয়ে বের হয়েই অগ্রজ তাহ্মিদ চৌধুরীর দেখা পাই। তিনি ১৯৯৪
সাল হতে লন্ডনে আছেন। গত রমজানে বাংলাদেশে তারসাথে দেখা হয়। এক বৎসর পর আবার
লন্ডনে এসে দেখা হলো। আমাদেরকে নিয়ে যেতে দু’টি গাড়ি এসেছে, একটি অগ্রজ তাহমিদ
চৌধুরী ও অন্যটি আমার মামাত ভাই আফজল নিয়ে এসেছে। দু’টি কারের বেনেটে মালামাল
পূর্ন করে ইস্ট লন্ডনে রওয়ানা হই। জেফার তার আফজল চাচার কারে বসে। আমরা দুইজন
ভাইয়ের গাড়িতে চড়ি। ভাতিজা আজফার বিমানবন্দরে চাচা ও চাচিকে সালাম করে কার স্টার্ট
করে। আমাদের গন্তব্য বড়ভাইয়ের বাসা। Address: Tahmid Chowdhury. 23, Dewey Road, Assex,
London, U.K.
আজফার নতুন ডাইভার, সে জেফারের এক বছরে বড়। তারা বিংশ শতাব্দীর শেষদিকে
পৃথিবীতে আসে। হিথ্রো বিমানবন্দরের অবস্থান পশ্চিম লন্ডন। বাসা প্রায় ৬০ কিলোমিটার
দূরে পূর্ব লন্ডন। প্রায় দুই ঘন্টা লন্ডন শহরের ভিতর দিয়ে আজফার কার চালিয়ে
আমাদেরকে তাদের ইস্ট লন্ডনের বাসায় নিয়ে যায়। ঘন বনবনানী ও কুসুমসজ্জিত রাস্থা
দিয়ে আমরা গন্তব্যে পৌছি। বাসায় ঢুকে মামাতো বোন নিপা ও তার স্বামী বাদশা ভাইকে
পাই, তারা আমাদের জন্য অপেক্ষায়। সন্ধ্যায় ইফতার পার্টিতে অনেক নিকটাত্মীয় শরীক
হন। ভাগনা লবিদ, হুধুদ, ভাগ্নি লিজা, পপি ও লিজার স্বামী রোমন। আসেন দুই ভাগ্না
বউ, ভাতিজা জাহিদ তার পত্নী ছেলে মেয়ে নিয়ে আসে। সেদিন ৩৫/৪০ জনের এক জমজমাট ইফতার
পার্টি হয় অগ্রজের বাসায়। ভাবী বিলকিস চৌধুরী ও ভাতিজী নওসীন সারাদিন পরিশ্রম করে
৩০/৩৫ আইটেমের ইফতার তৈরী করেন। চার/পাচ ধরনের শরবতই ছিল। আমি চিনিবিহীন কেলগেরী
জুস নেই। ফল ছিল কয়েক ধরনের, তবে পাকিস্থানের সুমিষ্ট আমই আমার সেরা মনে হয়েছে।
ইফতারের পরিমান এত বেশী ছিল যে সবাই কার্টুন ভরে ভরে নিয়ে যান। দু’তলা সুন্দর ও
সুবিধাময় ডুপ্লেক্স বাসা, সামনে ড্রাইভওয়ে ও ফুলের সারি। নিচতলায় ড্রয়িং, কিচেন ও
বাথরুম। উপরের তলায় তিনটি বেডরুম ও একটি বড়সড় বাথরুম।
নিচতলায় ডাইনিং সংলগ্ন একটি কাচের কক্ষ যাহা পিছনের সুসজ্জিত পুস্প উদ্যানে
ঢুকে আছে। এই কক্ষে সোফা সেট ও ব্যায়ামের মেশিন রয়েছে। বাগানের মধ্যে একটি বড়
ছাতার নিচে প্লাস্টিকের চেয়ার টেবিল রাখা বৈঠকখানা। বাগানে কাপড় শুকানোর রড-তারের
সুন্দর স্থাপনা। বাসাটি আমাদের দেশের সুসজ্জিত হোটেল স্যুটের মত। বাসার সামনে
ড্রাইভওয়েতে বিলাসবহুল দামী গাড়ি খোলা আকাশের নিচে ফেলে রাখা হয়।
আজফার লন্ডনের এক দামী প্রতিষ্টান হতে অর্থনীতিতে অনার্স সম্পন্ন করে একটি
প্রতিষ্ঠানে সদ্য চাকুরি নিয়েছে। সাথে মাস্টার্স পড়ার
প্রস্তুতি নিচ্ছে। নওসীন ‘মিডিয়া এন্ড কমিউনিকেশনে’র ছাত্রী।
এখন লন্ডনের সামার। দিনের দৈর্ঘ্য ১৭/১৮ ঘন্টা এবং রাত মাত্র ৫/৬ ঘন্টা।
শীতপ্রধান দেশসমূহে গ্রীষ্মকালের কদর খুব বেশী। তারা আরামদায়ক গ্রীষ্মকে প্রাণভরে উপভোগ করে।
সেদিন দ্রুত সেহরির সময় এসে যায় এবং আমরা সেহরি খেয়ে ফজরের নামাজ পড়ে ঘুমাতে যাই।
পাখির কলকাকলি শুনে ঘুম ভাঙ্গে। পিছনের জানালা দিয়ে বিভিন্ন বাসার বাগানের নানান
জাতের ফুলগাছ ও লতাপাতার বনে চেয়ে দেখি চড়ুই ও ঘুঘুর মত হরেক রকমের পাখির বিচরন ও
তাদের সুমিষ্ট গান। চড়ুইরা দুনিয়ার সব পরিবেশে খাপ খাওয়াতে পারে। মদীনার তপ্ত
মরুভূমির খেজুর বাগানেও চড়ুইদেরে আমি কিচির-মিচির করতে দেখি। লন্ডনেও রয়েছে
যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার মত বাসাবাড়ির আশপাশ জুড়ে নানান ফুলের সমারোহ। বৃটেনে দিবস
সুদীর্ঘ্য হলেও গরম তেমন হয়না। কারন রোদে তেমন উষ্ণতা নেই। এয়ার টাইট কক্ষে একটু
গরম অনুভূত হলেও বাহিরে বাতাস ঠান্ডা ও সহনীয়। জানালা একটু ফাঁক করে দিলেই কক্ষ
ঠান্ডা হয়ে আসে।
এখানে নানা ধরনের অজানা পাখির ডাক শুনি যা বাংলাদেশে কখনও শুনা হয়নি। আসলে
পাখির গানও দেশে দেশে ভিন্ন হয়। সামারের লন্ডন গাড় সবুজে একাকার। মনে পড়ে যায়,
বিখ্যাত ইংরেজ কবি সেক্সপিয়ারের একটি সনেটের নাম- Grabed age and youth. কবি এখানে যৌবনকে ইংল্যান্ডের গ্রীষ্ম
ও বার্ধক্যকে শীতের সাথে তুলনা করেছেন। সামারের ইংল্যান্ড ফল, ফুল, পাখি ও সবুজের
এক অপূর্ব মিলনমেলা। কবুতর, চড়ুই এবং চাইনচড়া দলবেঁধে বাতাসে সাতার কাটছে। গোলাপ,
ডালিয়া, গাঁদা, টিউলিপ, লিলি সর্বত্র মুখমেলে তাকিয়ে আছে।
অর্থনীতিতে গ্র্যাজুয়েট আজফার বলল- বৃটেন বিশ্বের পঞ্চম অর্থনীতি। যুক্তরাষ্ট্র,
চীন, জাপান ও জার্মানির পর তার অবস্থান। ভারত, রাশিয়া, ক্যানাডা ও ব্রাজিলের মত
জায়ান্ট দেশগুলোর মোঠ জাতীয় আয় বৃটেনের পিছনে রয়েছে। এইসব দেশ বৃটেনের চেয়ে
কয়েকগুণ বড় ও জনবহুল। আমি জিঞ্জেস করি, তোমাদের দেশের প্রকৃত নাম কি? আমরা তো
দেশটাকে UK,
Great Britain, England ইত্যাদি নামে ডেকে থাকি। আজফার বলল, UK বলতে ইংল্যান্ড, ওয়েলস,
স্কটল্যান্ড ও উত্তর আয়ারল্যান্ড এই চারটি রাজ্যকে নির্দেশ করে, যার কেন্দ্রীয়
রাজধানী লন্ডন এবং মোঠ আয়তন ৯৩,৬২৮ বর্গ মাইল। গ্রেটবৃটেন হল বৃহত্তর বৃটিশ
দ্বীপপুঞ্জ যেখানে উত্তর আয়ারল্যান্ড বাদ দিয়ে বাকি তিনটি রাজ্য রয়েছে। আসলে উত্তর
আয়ারল্যান্ড বাদ দিয়ে বাকী তিনটি রাজ্য হল গ্রেট বৃটেন। বৃটেন হল ইউরোপের সবচেয়ে
বড় দ্বীপ যার আয়তন ৮০,৮২৩ বর্গ মাইল। যুক্তরাজ্যের মোঠ লোকসংখ্যা ৬ কোটি ৫৬ লক্ষ
৪০ হাজার। ইংল্যান্ড যুক্তরাজ্যের সর্ববৃহৎ ও সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজ্য। এই রাজ্যের
আয়তন ৫০,৩১০ বর্গ মাইল ও রাজধানী লন্ডন। যুক্তরাজ্য ধনী রাষ্ট্র। এখানে মানুষের
মাথাপিছু আয় (Per capita income) ৩৯,৯০০ মার্কিন ডলার।
১৮ জুন ২০১৭ সাল। সুন্দর ভোর। আকাশ মেঘমুক্ত ও পরিস্কার। জানালা খোলে দেই।
ঠান্ডা বাতাস এসে ঘরটাকে সুশীতল করে দেয়। এযেন অন করা এসি দিয়ে ঠান্ডা বাতাসের
প্রবেশ। তাই একটু গরম গরম অবস্থা চলে যায়। সারিবদ্ধ বাসাগুলোর পিছনের বাগানে
দু’একজন শ্বেতাঙ্গ লোকজন বিচরন করছেন। তারা বড় মগে কফি পান করে বাগানের হালকা কাজ
করছেন। পাশের বাগানের পাতাবাহার ও ফুলগাছের ফাঁকে ফাঁকে পুতুল, প্যাচা, পাখি,
কুকুর ইত্যাদির মূর্তি ও ভাস্কর রয়েছে। দেখতে ভালই লাগল এই শিল্পগুলো। পাশের
বাগানে ইংরেজ বুড়োবুড়িকে শান্তভাবে নাস্তা করতে দেখি। মনে হল তারা সুদীর্ঘ্য
জীবনকাল পরস্পরের ভালবাসায় জড়িয়ে একত্রে কাটিয়ে দিয়েছে। ফুলে ফুলে বিভিন্ন ধরনের
প্রজাপতি ও পতঙ্গের উড়াউড়ি করছে। মৌমাছির গুনগুন সুরও কানে বাজে। সামারের লন্ডন
পাখি সম্পদেও সমৃদ্ধ। পাশের বাগানে শ্বেতাঙ্গ বুড়ো বুড়ি ফুলবাগানে নল দিয়ে পানি
ছিটাচ্ছে। তাদের বাগান বেশ সুন্দর ও সমৃদ্ধ। আসলে পাটচুলের এই নীল নয়না সাদারা
সৌন্দর্য্যপ্রিয় ও পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। সামারের লন্ডনে দু’একটা মাছিরও সাক্ষাত
পাই।
আফজাল এখনও কুমার। লন্ডনের উপকন্ঠে নতুন বাড়ি কিনেছে। গতকল্য তার বাসায় খাবার
নিমন্ত্রণ পাই। সবাই বললেন, আফজাল তুমি একা একা থাক, বই নেই ঘরে কিভাবে রান্না বান্না
করবে। কিন্তু সে নাছুড়বান্দা। ঐদিন আমরা দুই গাড়ি পুর্ণ হয়ে ছুটলাম। প্রথম বিশ্বের উন্নত রাস্থায় ভাবী বিলকিস চৌধুরী কার চালিয়ে
ঘন্টা খানেক পর গন্তব্যে নিয়ে যান। জিপিএস ব্যবহার করে গাড়িটি সহজে বুনো রাস্থা ও
উঁচুনিচু টিলা অতিক্রম করে এগিয়ে যায়। দু’পাশে অজানা বৃক্ষমালা ও ফুলের সমারোহ।
আফজালের বাসা নির্জন গ্রামে। সামনে সমতল মাঠজুড়ে নানা রঙের টিউলিপের বন্যা
বইছে। একটি গাছের ডালে ডালে নাশপাতি ঝুলে আছে। আমরা পাড়ে পাড়ে সুমিষ্ট নাশপাতি
খাই। আফজালের বাসায় এক বিরাট স্বজন সমাবেশ ঘটে। ভাতিজা জাহেদের পত্নী খুব সকালে
এসে রান্না বান্না শুরু করে। পড়ে নিপা এসেও যোগ দেয়। পনের বিশ জন আত্মীয় পরম
আনন্দে সময় কাটাই।
ঐ দিন এক মেঘাসপে যাই। মার্কেটের কয়েক তলা বিশিষ্ট পার্কিং। কাপড়, জুতা
ইত্যাদি কেনা হয়, নানা বর্ণ ও জাতির বিচিত্র ক্রেতাদের সাথে এখানে দেখা হয়। রাতে আবার
মামাতো বোন নিপার বাসায় দাওয়াত। সেখানে বাদশা ভাই কয়েক পরিবার আত্মীয় স্বজন নিয়ে
আমাদের অপেক্ষায় আছেন। এখানেও এক সমৃদ্ধ খাদ্য সমাবেশ লক্ষ্য করি। নিপা ও বাদশা
ভাই দম্পতির দুই পূত্র তাইরান ও ইব্রাহিম। তাইরান এখন নিউইয়র্কে আছে। ইব্রাহিম
ছোট্ট শিশু কিন্তু খুব স্নেহপ্রবন। মেহমানদের বিদায়বেলায় সে কান্না জুড়ে দেয়।
লন্ডন মহানগর দর্শনঃ
১৯ জুন ২০১৭ সাল। সকালে ঘুম ভাঙ্গে ঘুঘু পাখির ডাকে। আমাদের ঘুঘুর ডাকের চেয়ে
স্পষ্ট কিন্তু খানিক বিরতি টেনে বারবার ডেকে যায়- ঘুঘু-ঘুঘু-ঘুহ/ ঘুঘু-ঘুঘু-ঘুহ।
সেসাথে আছে চড়ুইয়ের কিচির-মিচির ও কাকের আওয়াজ। লন্ডনের কাকের ডাক আমাদের কাকের মত
কর্কশ নয়, বরং পাতলা ও শ্রুতিমধুর। জানালা একটু ফাঁক করি। শীতল বাতাস এসে গরম
তাড়িয়ে দেয়। ঘর শীতল হয়ে যায়। লন্ডনে হাতপাখা নেই, ফেন নেই। এখানে ২৫/২৬ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেট তাপমাত্রা মাত্র দুইচার দিন থাকে। তবে আমাদের কক্ষে একটি
টেবিল ফেন ছিল। এই ফেন জানালা দিয়ে আসা ঠান্ডা বাতাস এয়ারকুলারের মত সারাটা কক্ষে
ছড়িয়ে দিত। আমরা লন্ডনের সবচেয়ে উষ্ণ দিনের দেখা পাই। কিন্তু এই গরম আমাদের
মার্চের গরমের মত এবং অসহ্য নয় অবশ্যই। সামারের গরমকে ইংরেজরা আনন্দভরে উপভোগ
করেন। তারা স্বল্প বসনে তীব্র রোদে মনের আনন্দে ঘুরে বেড়ান।
আমি ও জেফার হেঁটে হেঁটে একটি সুরম্য প্রাকৃতিক পার্কে প্রবেশ করি। পার্কটির
নাম Beam
Velly Country Park. কাঁটাতার ঘেরা রেল লাইনের পাশ দিয়ে পার্কটি কয়েক ফার্লং
পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক এই বনে অজস্র বৃটিশ বুনো লতা
গ্লুগ্ন, ঘাস ও রংবেরঙ্গের বনফুল পর্যবেক্ষণ করি। এই বুনো
ফুল ও ঘাসফুল বাংলাদেশের প্রকৃতি হতে আলাদা ও বৈচিত্রময়। এখানে নীল, বেগুনি ও হলুদ
কালারের প্রাধান্য বেশী। ঘন অরন্যে কাটবিড়ালী ও নানা ধরনের পাকপাখালী দর্শন করি।
নয়নমুগ্ধ হয় ঘাসবনে আসংখ্য বুনো খরগোসের বিচরন দেখে। খরগোসগুলো মানুষকে তেমন ভয়
পায়না। পার্কের একদিকে ছয় লেন রেলসড়ক কাঁটাতারের বেড়ায় আলাদা রয়েছে। রেলের
যাত্রিরা এই নেচার বনের সৌন্দর্য্য উপভোগ করে সময় পার করেন। এই পার্কের একদিকে
বিশাল এক প্রাইভেট প্রপার্টি। সেখানে প্রবেশ নিষিদ্ধ। বাহির থেকে প্রপার্টি দেখে
নেই। কাটাতারে ঘেরা এই প্রপার্টিয়ে আছে একটি বিশাল লেক। লেকে ভেসে আছে বেশ কয়েকটি
ছোট ছোট দ্বীপ। এমন কি একটি বড় উপদ্বীপও লেকটির ভিতর ঢুকিয়ে
দেয়া হয়েছে। লেকের পারে সুন্দর করে গাছপালা লাগানো জলে নামার ঘাট। লেকে বড়শী
বাওয়ার জন্য বেশ কিছু মঞ্চ রয়েছে। জলে জাত বেজাতের শাপলা ও পদ্ম ফুটে আছে। একটি
দ্বীপে ছোট্ট বাঁশবন। নানান জাতের হাস ও পাখি বিচরণ করছে। স্থানে স্থানে রাজহাঁস, টেপিহাস মনের আনন্দে
সাঁতার কাটছে। এটা আসলে কোন পুঁজিপতি অথবা
প্রতিস্টানের লেক ও বাগান সজ্জিত প্রমোদ বাড়ি।
বাসায় ফিরে আমার একজন বৃদ্ধ নানির লন্ডন দেখার কাহিনি শুনি। আমার মায়ের বড়মামি
লন্ডন আসেন তার পুত্র ফয়জু মামার বাসায়। নানি পিছনের বাগানে গেলে প্রায়ই একজন
ইংরেজের সাথে দেখা হয়। ইশারা ও অঙ্গভঙ্গির ভাষায় দুইজনের মধ্যে বেশ কথাবার্তা হয়।
নানি মুখে আচল টেনে পর্দা আব্র্য হয়ে ভাব বিনিময় করেন। ফয়জু মামা বললেন মা এত
ঘুমটা টানাটানি করছেন কেন। নানি জবাব দেন, বুড়ি হলেও তো ভিনদেশি বেটা মানুষের সাথে
কথা বলছি। ফয়জু মামা হেসে বললেন- উনি তো পুরুষ না, একজন মহিলা। নানি অবাক হন,
প্যান্ট-সার্ট পরা, চুলছাঁটা, সমতল বক্ষের মানুষটি আবার মহিলা হয় কেমনে?
আজব দেশ বৃটেন। এখানে নর ও নারী একই সমতলের বাসিন্দা। নানির ভাষ্য- হায়রে
বিলাত, তোমার বেটা বেটি চেনা বড় দ্বায়।
বড়ভাবী, ভাই, জেফার, নূরজাহান বেগম ও আমি এবার লন্ডনের এক এসিয়ান মার্কেটে
প্রবেশ করি। এখানকার দোকানগুলো ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানি লোকজনের অধিকারে
রয়েছে। এখানে কাপড়, রেডিমেট গার্মেন্টস, প্রসাধনী, গৃহসজ্জা সামগ্রীসহ সব ধরনের
পন্যের ব্যবসা রয়েছে। কাস্টমারদের অধিকাংশ এসিয়ান, দু’চার জন শ্বেতাঙ্গও দেখা যায়।
লন্ডনের বাতাস ঠান্ডা ও রোদ আরামদায়ক হওয়ায় লোকজনের সহিত মার্কেটের সামনের বাগানের
টালি নির্মিত সিটিং ব্যবস্থায় বসি। আইসক্রিম কিনে সবাই বসে
খাই।
ঐ দিন বন্ধু সিদ্দিকুর রহমান নির্ঝর একটি সুন্দর ফুলের তুড়া নিয়ে আসেন। সাথে
আসেন তার জার্মান পত্নী ইভাঙ্কা জেজেগ, কন্যা সাকিবা ও শিশুপুত্র ইব্রাহিম ইশরাক।
নির্ঝর আমাদের তিনজনকে কাপড় উপহার দেন। ঐ দিনও ভাইয়ের বাসায় অনেক আত্মীয়সহ জমজমাট
ইফতার পার্টি হয়।
লন্ডন হতে যুক্তরাষ্ট্র যাত্রাঃ
২০ জুন ২০১৭। ভ্রমণে রোজা রাখার ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা নেই। তার ঐদিন রোজা রাখা হলনা।
সকাল ৬টায় উঠে তৈরি হই। ঘুম হতে উঠে নামাজ পড়ি। পিছনের সুন্দর বাগানের দিকে নজর
দেই। গত বিকেলে গাছগুলোতে পানি দিয়েছি। জীবন্ত ফুলগাছগুলোকে যেন আমার নির্বাক
বন্ধু মনে হচ্ছে। বাগানের কোনে কোনে অসংখ্য সৌর বিদ্যুৎ চালিত রঙ্গ-বেরঙ্গের বাতি
রয়েছে। এই সুন্দর বাতিগুলো ভোরেও মিটিমিট জ্বলছে। সূর্যদোয় হলে বাতিগুলো আটোমেটিক
নিভে যায় ও সূর্যালোকে চার্জিত হয়। তেমন কোনো খরচ ছাড়াই বাগানের এই বাতিগুলো
সারারাত নানা বর্ণের মোহনীয় হালকা আলো বিতরণ করে যায়। এ যেন এক ফ্রি আলোকসজ্জা।
ভাতিজি, নওসীন অনলাইনে আমেরিকান এয়ারলাইন্স টিকেট ক্রয় করেছে। আমরা বাংলাদেশে
অবস্থানকালে টিকেট কাটা হয়। হিথ্রো (ইউকে- সার্লট নর্থক্যারলিনা) হিথ্রো। প্রতি
রিটার্ন টিকেট ৫০০ ডলার করে মোট ১,৫০০ ডলার। আজফার কার
ড্রাইভ করে আমাদেরকে হিথ্রোতে নিয়ে আসে। পূর্ব লন্ডন হতে পশ্চিম লন্ডন। লন্ডন
শহরের বুক চিরে টেমসের পারে পারে কার চালিয়ে সে অগ্রসর হয়। পথে পাওয়ার ব্রিজ, লন্ডন ব্রিজসহ বিভিন্ন যুগে
নির্মিত নানা ডিজাইনের বিখ্যাত সেতুগুলোর সংক্ষিপ্ত মোলাকাত পাই।
এগুলো বিভিন্ন যুগের নির্মাণ শৈলী ও প্রযুক্তির সাক্ষ্য বহন করছে। যাত্রাপথে
কালজয়ী অসংখ্য ভাস্কর্য দেখি। রাণীর এক মধ্যযুগীয় বাড়ি ও জাদুঘরের পাশ দিয়ে যাই।
প্রায় দেড় ঘণ্টা পর হিথ্রো বিমানবন্দরের ৫নং টার্মিনালে প্রবেশ করি। আমেরিকান
এয়ারলাইন্স হতে টিকেট করা হলেও তারা ব্রিটিম এয়ারওয়েজ এ নিউইয়ার্ক জেএফকে
বিমানবন্দরের আরোহণ পত্র প্রদান করে। লন্ডন হতে প্রায় ৫/৬ ঘণ্টা পর আটলান্টিক
মহাসাগর পার হয়ে জেএফকে তে অবতরণ করি। আমাদের গ্রিনকার্ড একটি মেশিনে পরীক্ষা করা হয়।
কোন ধরণের প্রশ্নের মুখামুখী না হয়েই ইমিগ্রেশন পার হই।
মহিলা অফিসার, আমরা সত্ত্বর সংযোগ ফ্লাইট ধরব বলতেই দ্রুত সিল মেরে বিদায় জানান। এবার জেএফকে’র একটি অভ্যন্তরীণ
ট্রেনে উঠে ৪নং টার্মিনালে যাই। এমেরিকান এয়ারলাইসেন্স এর ছোট্ট যানটি প্রায় ৬০/৭০
জন যাত্রি নিয়ে ৪ ঘণ্টা পর উড়াল দেয়। আমেরিকার নর্থ ক্যারলিনা স্টেটের আন্তর্জাতিক
বিমানবন্দর হচ্ছে শার্লট। শহরটি নর্থ ও সাউথ ক্যারলিনা স্টেটের মধ্যে অবস্থিত।
সুদীর্ঘ পথ হেঁটে ও চলন্ত বেল্ট দিয়ে অতিক্রম করে বিমানবন্দরের বাহির দিয়ে বের হই।
বাহিরে এসে একজন কালো ভদ্রলোকের মোবাইল নিয়ে মেঝ ভাইকে আমাদের গেট নম্বর বলি।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ভাই জামিল এ চৌধুরীর কার সামনে হাজির। দ্রুত মালামাল উঠায়ে
গাড়িতে উঠে বসি। মেঝভাই রোজাদার। এখান থেকে ১০০ মাইল দূরে সাউথ ক্যারলিনার রাজধানী
কলম্বিয়া শহরে তার বাসায় নিয়ে যাবেন। বাইরে প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছে। রাস্তায় কোয়াশার মতো বাষ্প উড়ছে। একমুখী রাস্তার দু’দিকে সাদা
মার্জিন লাইন খুব কষ্টে দেখা যাচ্ছে। এখানে গাড়ি ৮০ মাইল প্রতিঘণ্টা বেগে চালাতে হয়। সামনের গাড়িগুলোর কেবল হেডলাইটের চিহ্ন দেখা
যাচ্ছিল। ইফতারের সময় হলে মেঝ ভাই গাড়ি নিয়ে একটি মহাসড়ক রেস্ট হাউসের পার্কিংয়ে
প্রবেশ করেন। সেখানে প্রচন্ড বৃষ্টির মধ্যে গাড়ি পার্ক করে সাথে নিয়ে আসা ইফতার
খেয়ে রোজার সমাপ্তি করেন। ২০/২২ মিনিট পর এই রাষ্ট্রের মধ্যে আবার মহাসড়কে ঢুকে যাই।
বৃষ্টির যেন বিরতি নেই। এ ধরণের বৃষ্টি সিলেটেও দেখা মেলা
ভার। প্রায় দুই ঘণ্টা পর শত মাইল দূরের কলম্বিয়ার সুরম্য এক মার্কিন বাসায় পদার্পণ করি।
মেঝভাবী খুব মজা করে দুই ধরণের মাছ রান্না করেছেন। আমাদের জন্য নতুন
খাবার তৈরি, বাফেলো ফিসের (মহিষ) স্বাদ অনেকটা আমাদের দেশের
রুই মাছের ও ক্যাট ফিসের (বিড়াল) স্বাদ কিছুটা পাঙ্গাশের মতন, তবে তেল তুলনায় অল্পই রয়েছে।
শেষ রাতে সেহরি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। মেঝভাইয়ের পুত্র আতিফ ও কন্যা তাইবা আসে।
তাইবা তার কর্মক্ষেত্র জর্জিয়া রাজ্যের রাজধানী আটলান্টা হতে বাসায় এসে গেছে। আতিফ
লন্ডনের কুইনমেরীতে আইন পাড়ার একটি অধ্যায় সমাপ্ত করেছে। সকাল ১০টায় বের হয়ে ওয়ালমেট
এবং সামস্ এর বিশাল শপিং মলে গিয়ে বাজার করি। লন্ডনের চেয়ে বড় বড় রাস্তার কলম্বিয়া
শহর নানা ধরনের বৃক্ষ ও শ্বেত গোলাপী ফুলে সুসজ্জিত। এখানকার আবহাওয়া শিলংয়ের মতো
দরুণ আরামদায়ক। আগের দিন বাংলাদেশের ঘন বর্ষার মতো মুষলধারে বৃষ্টি হয়েছে। বাসায়
ফিরে ঘুমে ঢলে পড়ি। ঘুম হতে উঠে তাইবা ও আতিফকে পাই। জেফার, তার মা ও মেঝমামা
কলম্বিয়া এয়ারপোর্ট গিয়ে তাদেরকে নিয়ে আসেন। সামনের রাতটি পবিত্র শবে কদর। অর্থাৎ
২৭ রমজান রাত। এগার মাইল দূরের এক মসজিদে, বাসার নর-নারী
সবাই তারাবির নামাজ পড়তে যাই। এই মসজিদে সামনের চার লাইনে
পুরুষ ও শেষ লাইনে নারীরা সারিবদ্ধভাবে দাড়িয়ে এক সাথে ইশা ও তারাবির নামাজ আদায় করি। মসজিদের ইমাম সাহেব একজন মিশরিয়।
মুসল্লিরা বেশিরভাগই কালো আফ্রিকান। সবাই বেশ রিষ্টপোস্ট।
এশার ফরজ নামাজ পড়ার পর দু’রাকাত সুন্নত পড়ার সুযোগ না দিয়েই
ইমাম ওয়াজ শুরু করেন। ওয়াজ শেষ, তারাবি
শুরু। আট রাকাতে তারাবি সমাপ্ত। নামাজে স্পষ্ট ও সুন্দরভাবে
তেলাওয়াত করা হয়। বিতরের নামাজের তৃতীয় রাকাতে রুকু হতে দাঁড়িয়ে দুই হাত তুলে মোনাজাতের ভঙ্গিতে সুদীর্ঘ সময় সব ধরনের আকুতি নিয়ে প্রার্থনা করা হয়।
যথারীতি নামাজ শেষ করে আর কোনো মুনাজাত করা হয় না। আরবদের মতো এখানেও মিলাদ মাহফিল
কিংবা নামাজ শেষে মোনাজাতের প্রচলন নেই। পরিস্কার
পরিচ্ছন্ন দেশ যুক্তরাষ্ট্র। এখানে কঠোর পরিশ্রম হলেও এর বিনিময়ে উন্নত জীবন পাওয়া
যায়। গাড়ি-বাড়ি, সুন্দর উন্নত পরিবেশ, বিলাস
সামগ্রী সহজেই মানুষের হাতে এসে ধরা দেয়। ঘুমের সময় পরিবর্তন হওয়ায় খুব একটা ঘুম
আসেনি। ভাগ্য ভালো, আমেরিকায় শবে কদরের পুরো রাত্রিটা সহজেই
পরম করুণাময়ের এবাদতি করে কাটিয়ে দেই।
ঘুম হতে উঠে নামাজা পড়ে প্রাত্যহিক তসবিহ পাঠ শেষ করি। এবার বাসার পাঠাগারে নজর
দেই। হাতে তুলে নেই এমেরিকান ডেমোক্রসি নামক সমৃদ্ধ একটি বই।
আমি রাষ্ট্র বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলাম। বইটিতে প্রাচীন মিশরিয়
আমল হতে গ্রিক যুগ, রোমান সভ্যতা হতে
বর্তমান কাল পর্যন্ত প্রসারিত শাসনতন্ত্র ও গণতন্ত্রের ইতিহাস সচিত্র বিবৃত হয়েছে।
তবে মুসলিম সভ্যতার কোনো ছিটাফোঁটা কোথায়ও পেলাম না। মুসলমানরাও গণতন্ত্র বুঝে;
এই সত্য হয়ত বইটির লেখকের ধারণায় নেই। এবার
ইংরেজী ভাষায় লিখিত উইলিয়াম সেক্সপিয়ারের বিশাল রচনা সমগ্র হাতে নেই। কবির লেখা
১৫৪টি সনেটের প্রতিটির শেষ দু’লাইন বোঝার চেষ্টা করি।
সেক্সপিয়ারকে আমরা কবি হিসাবে জানলেও মূলতঃ তিনি নাট্যকার। তার রচনাসমগ্রের
অধিকাংশ পৃষ্ঠাই নাটক। কবিতা বলতে এই ১৫৪টি সনেটই তাকে
বিশ্বকবির আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছে। আমাদের কবি রবীন্দ্রনাথের কবিতা কিংবা গানের
ভান্ডার সেই তুলনায় অনেক বিশাল বিস্তৃত। কলম্বিয়ার এই বিশাল ডুপ্লেক্স ভবনটিতে ২৪
ঘণ্টা সেন্ট্রাল এয়ার কন্ডিশন চালু থাকে। বারান্দায় বের হয়ে খানিকটা গরম অনুভব
করি। আকাশটা তখন বাংলাদেশের মতো মেঘাচ্ছন্ন রয়েছে। ২৩ জুন ২০১৭ শুক্রবার। পবিত্র জুমুয়াতুল
বিদা বা রমজানের শেষ জুমুয়া। কলম্বিয়ার আফ্রিকান মসজিদে জুমুয়াতুল বিদার নামাজ
পড়তে যাই। জামাতের পিছনের লাইনে রয়েছেন বোরকা পরা মাথা বাধা মহিলারা। বিষ্ময়কর হচ্ছে
ইমাম সাহেবের মাথায় কোনো টুপি নেই এবং ৯০% মুসল্লীই টুপিবিহীন অবস্থায় জুমুয়ার
নামাজ আদায় করেন।
পরে সোলার এনার্জিতে পরিচালিত কিছু বাসা পর্যবেক্ষণ করি। ত্রিপ্লেক্স বিশাল
শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসাগুলো নিজস্ব সৌর বিদ্যুতে পরিচালিত হচ্ছে। বাসার ছাদজুড়ে
সৌরপ্যানেল বসানো। আরও শুনলাম। অতিরিক্ত বিদ্যুৎ সরকার কিনে নেয়। একেতো বিদ্যুৎ
বিল দিতে হয় না, উল্টো টাকা পাওয়া যায়। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা নাকি বাড়ির
ছাদে সোলার এনার্জি প্লান্ট বসাতে প্রচুর ভর্তুকীর ব্যবস্থা করে দেন।
যুক্তরাষ্ট্রে শেষ দিবসঃ
২৪ জুন ২০১৭ সাল।
ঘুম হতে উঠে সেভ করি। আমেরিকার গ্রিনকার্ড ও সামাজিক নিরাপত্তা কার্ড ইতিমধ্যে পেয়ে গেছি। যুক্তরাষ্ট্রে
স্থায়ী হতে যাকিছু প্রয়োজন আল্লাহ পাকের অপার মেহেরবানিতে
সবই আমাদের হাতের মুঠোয় এসে গেছে। একজন ভুক্তভোগী বললেন যে সোনার হরিণের পিছনে আমরা বছরের পর বছর ছুটাছুটি করেছি আপনারা তা বিনা কষ্টে কোন খরচ
ছাড়াই পেয়ে গেলেন। আমি বলি, সবই করুণাময়ের অপার অনুগ্রহ,
এজন্য তাকে বেশুমার শোকরিয়া জানাই।
আমেরিকা আধুনিক
সভ্যতার পীঠস্থান। ধন
সম্পদে, জ্ঞানে বিজ্ঞানে, উন্নয়নে আধুনিকায়নে বিশ্বের একটি শ্রেষ্ট দেশ। এই
সুন্দর, শান্ত ও সুশৃংখল দেশটি ছাড়তে কার মন চায়। অথচ বাস্তবতা হল আমরা আবার ফিরছি
জন্মভূমি বাংলাদেশে। চাইলেও আমরা আপাততঃ থেকে যেতে পারছি না আমেরিকায়।
সাউথ ক্যারোলিনার
অনিন্দ্যসুন্দর বাসার বাগানের ফটো তুলি। গোলাপ, গন্ধরাজ, গাঁদা ইত্যাদি চৌদ্দ
জাতের ফুলগাছে বসেছে কুসুমের মেলা। সবুজ ঘাসের গালিচায় কিছুক্ষন খালিপায়ে
হাঁটাহাঁটি করি।
চব্বিশ ঘন্টা
আদ্রতা ও শীতোতাপ নিয়ন্ত্রিত বাসাটিতে চারদিন পাঁচ রাত অবস্থান করি। মেঝভাই জামিল
চৌধুরী ও ভাবীর আথিতেয়তা ও সেবাযত্নে খুব আনন্দে কেটে গেল চারটি দিন। বিদায়বেলা
আসন্ন। মনখারাপ সবার। বিকাল ৫টায় বের হলাম। তাইবা গাড়ি চালক। যাত্রি আতিফ, মেঝভাই
জামিল চৌধুরী ও আমরা তিনজন। সার্লেট বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন পার হলাম। আমাদের দিকে
করুণদৃষ্টিতে তাকিয়ে
রল তিন জোড়া চোখ। দৃষ্টিসীমা পার না হওয়া পর্যন্ত তাইবা, আতিফ ও মেঝভাই দাঁড়িয়ে
থাকতে দেখি। জানিনা, দেখা হবে আবার কবে।
রাত ১০টা ৩০
মিনিটে আমেরিকান এয়ারলাইনের উড়ালযানটি যাত্রা শুরু করে। বিদায় আমেরিকা, বিদায় সাউথ
ক্যারোলিনা।
পরদিন লন্ডন সময়
সকাল ১০টায় আমরা London Hethrow
International Airport এ অবতরণ করি।
আবার স্বাগতম
লন্ডনঃ
২৫ জুন ২০১৭ সাল।
সার্লেট হতে রাত ১০টায় আমেরিকান এয়ার লাইনের উড়ালযানটি লন্ডনের উদ্দেশ্যে উড়াল
দেয়। হিথ্রো হতে আমরা ভূল গেট দিয়ে বের হই। অন্য একটি গেটে আমার বড়ভাই তাহমিদ
চৌধুরী গাড়ি নিয়ে আমাদের অপেক্ষায় আছেন। ঐ দিনটি ছিল ঈদুল ফিতর। ভাই ঈদের নামাজ না
পড়েই আমাদেরকে নিতে আসেন। একজন ভদ্রলোকের মোবাইলে ফোন করে তাকে আমাদের অবস্থান
জানাই। তিনি কয়েক মাইল পথ ঘুরে এসে আমাদেরকে বের করেন এবং দুই ঘন্টা গাড়ি চালিয়ে
পূর্ব লন্ডনে তাদের বাসায় নিয়ে যান।
বহু বছর পর এই
প্রথম আমাদের ঈদের জামাত মিস হলো। তবে এই লন্ডনে ঈদের আনন্দের কোন কমতি ছিলনা।
এখানে ঈদ ও আমাদের আগমন উপলক্ষে নতুন জামাকাপড় পরে অনেক আত্মীয়স্বজন জমায়েত হন।
ভাগনা, ভাগ্নি, ভাতিজা, ভাতিজী, নিপা, আফজল, নার্গিস ও নাদিরা সহ অনেক আত্মীয়
স্বপরিবারে আসেন। ভাবী ও নওসীন রাতজেগে নানাপদের মজাদার নাস্তা তৈরী করেন। গল্পগোজব,
হাসি-টাট্টা ও আনন্দবন্যায় লন্ডনের ১৮ঘন্টার সুদীর্ঘ্য দিনটি পার হয়ে যায়।
রাতে ফুলবাড়ির
ফুফুতো বোন রুনু আপার মেয়ে তার চারকন্যা ও স্বামীকে নিয়ে আসে। এই চার নাতীনের সাথে
এটাই আমার প্রথম দেখা।
২৬ জুন ২০১৭ সাল
রোজ সোমবার। সকালে বীম ভেলি নেচারেল পার্কে নিয়মমাফিক চল্লিশ মিনিট প্রাতঃভ্রমণ করি। ঐদিন ১০টায় আমরা লন্ডন শহর
দেখতে বের হই। প্রাচীন শহর লন্ডন মানব সভ্যতার এক পীঠস্থান। এই শহর এক সময় বিশ্বের
ছয়টি মহাদেশে বিস্তৃত পৃথিবীর বৃহত্তম বৃটিশ সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল। এই শহরটি
এখন ইংল্যান্ড রাজ্যের রাজধানী, সেইসাথে যুক্তরাজ্যেরও রাজধানী। লন্ডনের সেই সোনালি
দিন আজ আর নেই। যে সাম্রাজ্যে কখনও সূর্যের অস্ত যেতনা, তা আজ বৃটিশ দ্বীপপুঞ্জ ও
উত্তর আয়ারল্যান্ডে এসে সংকুচিত হয়েছে। আরও ভাঙ্গনের সুর বাজছে। ভেঙে যেতে পারে
এমন প্রথম দশটি দেশের মধ্যে যুক্তরাজ্যের নাম রয়েছে। কিছুদিন আগে সামান্য ভোটের
ব্যবধানে স্কটল্যান্ড যুক্তরাজ্যে রয়ে গেল। যদি গনভোটে স্কটল্যান্ড সরে যেত তাহলে
অন্য রাজ্যগুলোও তাসের ঘরের মত ভেঙে যেত। আমরা আরেকটা সোভিয়েত ইউনিয়ন কিংবা
যুগাশ্লাভিয়ার পতন প্রত্যক্ষ করতাম। যুক্তরাজ্য নামক প্রভাবশালী রাষ্ট্রটির
অস্তিত্ব চিরদিনের জন্য বিলীন হয়ে যেত।
লন্ডন পৃথিবীর বড়
ও আদর্শ শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম। নগরটির আয়তন ১৭৩৮ বর্গ মাইল এবং জনসংখ্যা ৯৮ লক্ষ।
এই প্রথম একজন পাকিস্থানী মুসলিম সাদেক খান শহরটির মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। লন্ডন
প্রবাসী তৃতীয় প্রজন্মের এই এসিয়ান লেবার পার্টির একজন প্রভাবশালী নেতা এবং তিন
প্রজন্মে বদলে যাওয়া একজন আধুনিক বৃটিশ মুসলিম।
ভাবী গাড়িটি নিয়ে
থামান Canarioff Square । এই স্কয়ারে অপূর্ব সুন্দর ঝর্না, পানির ফোয়ারা
বইছে মানবসৃষ্ট জলপ্রপাতে। এই ফোয়ারা ও ঝর্নার চারপাশে ঘুরি, ফিরি, বসি ও ছবি
তুলি। ঢাকার মতিঝিল, নিউইয়র্কের ম্যানহাটানের মত এখানে যুক্তরাজ্যের সব বড় বড় কর্পোরেট
অফিসের অবস্থান। অসংখ্য নীল গ্লাসঘেরা পরিচ্ছন্ন ভবন সৌরকিরনে ঝলমল করছে। মতিঝিলের
মত এখানে যানবাহনের বিশৃংখলা ও দুষণ নেই। এখানে একটি সুন্দর বহুতল ভবনে আমার প্রিয় ভাতিজা আজফারের
অফিস। এখানে বড়বড় রাস্থা, ফাঁকা জায়গা ও পার্কিং স্পেস রেখেই ব্যাংক, বীমা ও কর্পোরেট
প্রতিস্টানগুলোর সুউচ্চ স্টিল ও কাচের ভবনমালা গড়ে উঠেছে। কোথায়ও জ্যাম নেই,
সর্বত্র শৃংখলার রাজত্ব। গাড়ির হর্ন, কালো ধূয়া কিছুই নেই যা মানুষকে বিরক্ত করতে
পারে। এ এক নিরবতার ভিতর গড়ে উঠা ব্যস্ত ও কর্মচঞ্চল স্কাইলাইন বিস্তৃত উপনগরী।
Canarioff Square হতে সিড়ি বেয়ে নিচে একটি ভূতল নগরে যাই। এই ভূতল
নগরে একটি নদী বয়ে গেছে। সেই নদীর তীরে তীরে গড়ে উঠেছে হোটেল, বার, সেলুন, বিউটি
পার্লার, দোকান ও ব্যবসা কেন্দ্র। নদীটির উপর সেতুও আছে। খুব সম্ভব টেমস হতে আসা
মানবসৃষ্ট কোন উপনদী যাহা এই সুন্দর জল সরোবর। আমাদের কার ১৯০৮ সালে টেমসের তলদেশে
নির্মিত বিশ্বের প্রথম ট্যানেল দিয়ে নদী অতিক্রম করি। টেমসের কাদাস্থরের অনেক নিচ
দিয়ে ট্যানেল্টি নির্মিত। আমরা গাড়ি পার্কিং করে টাওয়ার ব্রিজে আরহন করি। সেতুর
মধ্যবর্তী স্পেন যান্ত্রিক উপায়ে উঠানো যায়। ব্রিজটির দুইপারের কাছাকাছি দু’দিকে
দু’টি বড় বড় টাওয়ার রয়েছে। টাওয়ার দুটি বহুতল বিশিষ্ট। ব্রিজ হতে সিড়ি বেয়ে নিচে
নামি এবং টেমসের সুন্দর ভাবে বাঁধানো পার দিয়ে আমরা হাঁটতে থাকি। আকাশ প্রদীপ তখনও
কড়া মিঠে তাপ বর্ষন করছিলো। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ হতে আগত নানা বর্ন ও পোষাকের
লোকজন টেমসের পারে তখন আনন্দমত্ত ছিল। আমরাও নদীর পারে টাওয়ার ব্রিজ সামনে রেখে
অনেক ফটো উঠাই। সামনে টেমস নদী। আমাদের সুরমার চেয়ে খানিক বড় হবে। আসলে টেমস নদী
বিস্তারে সুরমা নয়, কুশিয়ারার মত হবে। নদীটির বুক চিরে নীল নয় বরং ঘোলা জল বইছে।
নদীতে বেশকিছু জাহাজ, ইঞ্জিন বোট চলাচল করছে। ভাবী বললেন টেমসের পার দিয়ে সারাদিন
হাটলেও শহর শেষ হবেনা। বাঁধাই করা পার ঘেষে সুন্দর হাঁটার রাস্থা, বসার জায়গা,
বানিজ্য কেন্দ্র, সুরম্য ইমারতমালা, বাগান, ভাস্কর্য্য, নানা ডিজাইনের বার, টেকওয়ে
ও দোকানের ছড়াছড়ি।
লন্ডন শহরে
প্রতিবছর প্রায় চারকোটি পর্যটক আসেন। এই পর্যটকরা গরিব দেশের ধনী লোকজন, সেইসাথে
ধনী দেশের পর্যটকের ছড়াছড়ি তো আছেই। ক্রেতারা ভিনদেশী ধনী লোকজন, তাই ব্যবসাও বেশ
রমরমা অবস্থায় রয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পর্যটন নগরীর মত লন্ডনেও ট্যুরিস্ট
বাসের ছড়াছড়ি। দু’তলা বাস। ছাদে সিট বসানো। পিছনে সেড থাকলেও সামনা খোলা। ছাদের
সিটে বসে কানে এয়ারফোন লাগিয়ে পর্যটকরা ইতিহাস ও বিবরন শুনে শুনে এই ঐতিহাসিক নগরী
লন্ডনের রূপ সুধা পান করছেন। সাদা, কালো, হলুদ, বাদামী নানা বর্ণের মানুষ সারাটা
শহরময় পায়চারী করে বেড়াচ্ছেন।
বিশ্বের
গনতন্ত্রের সুতিকাগার বৃটিশ পার্লামেন্ট। পঞ্চদশ শতকের স্থাপত্যের নিদর্শন টেমস
পারের পার্লামেন্ট ভবন দেখে দু’নয়ন ধন্য হল। পাশে কয়েক শতাব্দী আগে স্থাপিত ঘড়ি
বিগবেন টক টক করে সময় জানান দিচ্ছে। কাছেই ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিটে বৃটিশ
প্রধানমন্ত্রীর ঐতিহ্যবাহী বাড়িটি দেখা হল। সুপ্রাচীন সেন্ট থমাস হাসপাতাল চোখে
পড়লো। সামনে টেমসের পারে সুউচ্চ লন্ডন আই। লন্ডন আই তে আরোহন করে দিগন্ত বিস্তৃত
লন্ডন শহরের পাঁচ ছয় বর্গ মাইল এলাকা দেখা যায়। আমাদের গাড়ি ওয়াটার ব্রিজ অতিক্রম
করল। আজা পুরাতন লন্ডনের Coven Garden গমন করি। আমাদের দেশের পুরান শহরের মত এখানে কোন ঘিঞ্জি
বা দুষণ নেই। বরং এখানে বাড়িঘর খুব দামী এবং ইতিহাস ঐতিহ্যের স্বাক্ষ্যবাহী।
এবার আসি বিখ্যাত
ট্রাফালগার স্কয়ারে। বিভিন্ন ঐতিহাসিক যুদ্ধে বৃটিশদের বিজয়ের স্মৃতিস্থম্ব এখানে
রয়েছে। পঞ্চদশ শতাব্দীতে স্পেনের রানী ইসাবেলা ইউরোপ হতে মুসলমানদের বিতারিত করে প্রবল
শক্তিশালী হয়ে যান। ইসাবেলার নৌ-সাহায্য নিয়ে কলম্বাস আমেরিকা আবিস্কার করেন।
উত্তর ও দক্ষিন আমেরিকায় স্পেনের উপনিবেশ স্থাপিত হয়। স্পেনের নৌবাহিনী তখন ইউরোপে
অপ্রতিহত ছিল। সুদূর ডেনমার্ক পর্যন্ত স্পেন সাম্রাজ্য প্রসারিত। প্রবল নৌ-শক্তি
স্পেনিশ আর্মাডা তখন ইংল্যান্ড দখল করতে অগ্রসর হয়। বৃটেনের সেই দুর্দিনে বৃটিশ
সেনাপতি জেনারেল নিলসনের সাহসী ও নৌপুন্যময় রননেতৃত্বে বৃটিশরা জয়লাভ করে। সেনাপতি
নিলসন স্পেনিশ আর্মাডাকে সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্থ করে দেন। এই যুদ্ধে বিজয়ের পর ইউরোপের সেরা নৌশক্তি হিসাবে
বৃটিশদের উত্থান ঘটে। এই মনুমেন্টের সর্বোচ্চ শিখরে আছে জেনারেল নিলসনের উর্দিপরা
ভাস্কর্য্য।
১৮৫৭ সালে
ভারতবাসীর প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ দমণকারী সেনাপতি মেজর জেনারেল স্যার হেনরির ভাস্কর্য্যও দেখতে
পেলাম। এই লোকটি ভারতবাসীর কাছে ঘৃনার পাত্র হলেও এখানে একজন সম্মানিত দেশপ্রেমিক।
আর অনেক যুদ্ধ বিজেতা সেনাপতির মূর্তি নিজনিজ মর্যাদানুসারে
বড়-ছোট, উচ্চ-নিচে স্থাপন করা হয়েছে। প্রতিটি মূর্তির তলায় স্মৃতিফলকে ইতিহাস লিখা
আছে। বৃটেনের বিখ্যাত King 4th
Joerge এর মূর্তিটিও
দেখা হয়।
এবার ট্রাফালগার
স্কয়ারের পিছনের জাদুঘরে লাইন ধরে প্রবেশ করি। বৃটিশ ইতিহাসের এত স্মারক চিহ্ন
এখানে রয়েছে যে টা লিখতে গেলে আলাদা একটি বই হয়ে যাবে। বিখ্যাত সব যুদ্ধ বিজয়ী
সেনাপতি ও রাজাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাকিংহাম রাজপ্রসাদের সামনের যাই।
প্রাসাদের সামনের বড় গেট বন্ধ। গেটের দরজা ফাঁকা গ্রিলের তৈরী। ভিতরে ভবনের সদর
দরজার সামনে লাল ইউনিফরম পরা চার জন মোমের মূর্তির দেখা পাই। দেখতে মনে হল এগুলো
বুঝি দ্বাররক্ষীদের ভাস্কর্য্য। কিন্তু ভূল ভাঙল যখন দেখি দু’টি মূর্তি হাতের
বন্ধুক নামিয়ে সামনে মার্চ করে অগ্রসর হচ্ছে এবং অন্য দুটি অনুরূপ মূর্তি এসে ওদের
স্থলাভিষিক্ত হচ্ছে। আসলে মূর্তিগুলো রানির জীবন্ত নিরাপত্তা প্রহরী।
আমরা এবার National Art Gallery তে টিকেট কেটে প্রবেশ করি। ট্রাফালগার স্কয়ারের সন্নিকটস্থ এই
আর্ট গ্যালারিতে বিগত কয়েক শত বছরের শিল্পীদের আঁকা হাজার
হাজার অদ্ভুদ সুন্দর চিত্রকর্ম সাজানো রয়েছে। প্রতিটি শিল্পকর্মে রয়েছে বিভিন্ন
যুগের বিখ্যাত সব শিল্পীদের চিন্তা-ভাবনা ও দর্শন। এসব জলরঙ্গ ও তৈলরঙ্গ ছবিগূলোর
মধ্যে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য ঘটনা, গল্প ও ইতিহাস। সপ্তম শতাব্দীরও ছবি দেখতে পেলাম।
মানুষের জীবন, সংগ্রাম, যুদ্ধ, অভিজাততন্ত্র, সাধারণ মানুষের
প্রাত্যহিক জীবন যাত্রা, বিপ্লব, বিভিন্ন যুগের ফাঁসিচিত্র, রাজারাজড়া, প্রকৃতি সব
এসেছে এসব অমর চিত্রকর্মে। একজন শিল্পপ্রেমিক সারা জীবনও এই শিল্পকর্মগুলো অধ্যয়ন
ও গবেষণা করে শেষ করতে পারবেনা। এযেন চিত্রকর্মের এক মহাসাগর
যার কোন সীমা পরিসীমা নেই।
২৭ জুন ২০১৭ সাল।
আজ লন্ডনের আকাশ মেঘাচ্ছন্ন, বাহিরে শীতল বাতাস বইছে। ব্রাইটন সীবিচে যাবার
পরিকল্পনা তাই বাতিল হয়ে গেল। সকালে বিশাল ফুড মার্কেটে যাই। বিশ্বের প্রায় সব দেশের ফল ও তৈরী খাবার এই বাজারে
পাওয়া যায়। এখানে সব খাবারই একদর এবং ভেজালমুক্ত। ধনী
দেশ তাই বাজারে উৎকৃষ্ট ফলমূল আমদানী করে সাজানো হয়। ভাবী আমাদেরকে
পরিবেশনের জন্য প্রায় সব ধরনের ফল কিনতে থাকেন। বাসায় এসে এসব নূতন ফলের স্বাধ
গ্রহন করি। ফলগুলোর খানিক বিবরণ দিলাম।
Blue berry ফলটি সুস্বাধু ও মিষ্ট। বর্ণ- গাড় নীল ও গোলাকার।
ফলে কোন বীজ নেই। Stow berry লাল লিচুর মত ফল্টির স্বাধ টকমিষ্টি। Apricots হলুদ-গোলাপী ফলটি দেখতে আপেল
কূলের মত। Saron Fruit ফলটি হলুদ টমেটোর মত। Plam গাড় কালচে লাল ফলটি স্বাধে কষ্টি ও মিষ্টি। দেখতে বড় আঙ্গুরের চেয়ে বড় ও
গোলাকার। Fassion fruit আমড়ার মত সবুজ বেগুনী মিশ্রণ। Nectrins Fruit আপেলের মত তবে ভিতরের স্বাস ঘন। বর্ণ গাঢ় গোলাপী এবং স্বাধে মিষ্ট। Pear বিভিন্ন ধরনের নাশপাতি। স্বাধে পানসে মিষ্টি। Flat peach Fruit এক ধরনের চেপ্টা
নাশপাতি ফল। Kiwi Fruit টকফল, চাটনী করে খাওয়া যায়। Raj berry ছোট ছোট গোলাকার ফলটির বর্ণ Stow berry এর মত গাঢ় লাল।
মহান করুনাময়ের অশেষ শোকরিয়া
তিনি বড়ভাবীর সৌজন্যে পৃথিবীর এত এত ফলমূলের স্বাধ আমাদেরকে উপহার দেন।
ভাইয়ের বাসা হতে
ডাগেনহাম ইস্ট রেলস্টেশনের দূরত্ব এতোই অল্প যে চার মিনিট হেঁটে পৌঁছা যায়। টিকেট
সংগ্রহ করে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমেই প্লেটফরম। মিনিটে মিনিটে অটোমেটিক, চালকবিহীন বৈদ্যুতিক ট্রেন চলাচল
করছে। প্রতি পাঁচ মিনিট পরপর একই লাইনে একই দিকে ট্রেন যায়। ‘নেক্সট স্টেশন ইজ অলগেইট’ এইরূপ উচ্চারিত সংকেত আসে
প্রতিটি স্টেশনে এবং মানুষ দুই মিনিটের মধ্যে উঠানামার পালা শেষ করে। ট্রেনে
আফ্রিকান, এশিয়ান, ইউরোপিয়ান সব ধরনের
ও জাতের লোকজন রয়েছেন। এসেডের ভাষা মূলতঃ ইংলিশ হলেও ট্রেনে নানা ভাষার বিচিত্র
ধ্বনী ও শব্দ শোনা যায়। বিশেষ বিশেষ সময়ে ট্রেনে ভীড় হলেও অন্য সময় অল্প অল্প
যাত্রি নিয়ে ট্রেন চলাচল করে থাকে। ভীড়ের সময় আগে আসলে সিট মেলে নতুবা দাঁড়াতে হয়।
সাদারা ভদ্র, তাই নিজেরা দাঁড়িয়ে থাকেন ও ভিন দেশীদের বসার
সুযোগ করে দেন। প্রতি ৪/৫ মিনিট পরপর এক একটা স্টেশন আসে ও যাত্রিরা চোখের পলকে
উঠানামা করেন।
আমাদের গন্তব্য
ব্রিটিশ ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম, যাদুঘরটি চারটি জোনে বিভক্ত, লাল,
সবুজ, হলুদ এবং নীল জোন। প্রতিটা জোনই বিশাল
এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। ভিতরে ঢুকেই নীল তিমির (Blue Whale) এক বিশাল ফসিল পর্যবেক্ষণ করি। মাছটি দৈর্ঘ্যে শত ফুটের কম হবে না। সম্ভবতঃ
মাছটির ওজনও কয়েক টনের উপরে হবে। এই তিমি মাছের সদ্য প্রসূত বাচ্চাও একটি হাতির
চেয়ে বড় হয়। এখানে যে সব প্রাণীর ফসিল ও নমুনা দেখি তার মধ্যে রয়েছে শোকর জাতীয়
প্রাণী (Manafees), বড় ইদুঁর (Hyraxes), বন ছাগল (Yak), গন্ডার (Dainucher Rehino) ইত্যাদি অনেক প্রজাতি যা লিখে শেষ করা সম্ভব নয়।
এই পার্কে
যান্ত্রিক উপায়ে একদম অবিকল জীবন্ত ডায়ানুসার দেখানো হয়। এই বিশাল ডায়ানুসারের
হুঙ্কার শুনে মনে হল এরা পৃথিবীতে জীবিত থাকলে হয়ত মানুষদের খেয়ে সাবাড় করে দিত।
তবে মানুষ যেখানে পৃথিবীতে প্রায় দেড় লক্ষ বছর টিকে আছে, সেখানে ডায়ানুসার টিকে ছিলো উনিশ
কোটি বছর। মানুষের চেয়ে বহুগুণ বেশি সময় এরা পৃথিবীতে রাজত্ব করে উল্কাপিন্ডের
আঘাত অথবা কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।
হিউম্যান বায়োলজি ডিপার্টমেন্ট এ মানুষের নার্ভ সিস্টেম, ব্লাড সেল, পরিপাকতন্ত্র, হার্ড,
কিডনি, ফুসফুস, চোখ,
কান কিভাবে কাজ করে তা যান্ত্রিক উপায়ে দেখানো হয়। এখানে ঢুকে একজন
সাধারণ মানুষও একজন চিকিৎসকের মতো মানববডির ক্রিয়াকলাপ শিখে নিতে পারবে। এখানে
বিভিন্ন ধরণের সাপ। পাখি ও সরিসৃপের ফসিল ও তৈরি নমুনা
পর্যবেক্ষণ করি। সবশেষে পৃথিবীশ্রেষ্ঠ প্রকৃতি বিজ্ঞানী ডারউইনের নামে স্থাপিত
ডারউইন সেন্টারে প্রবেশ করি।
পৃথিবীতে মহাকাশ হতে পড়া অসংখ্য উল্কাপিন্ড স্পর্শ ও দর্শন করি।
একটিকে মনে হল শক্ত লোহায় পিন্ড।
যান্ত্রিক উপায়ে এখানে
আগ্নেয়গীরি হতে অগ্নি উৎপাত ও লাভাপ্রবাহ দেখানো হয়। এখানে লাল জ্বলন্ত লাভার স্রোত দেখার সৌভাগ্য হয়। এবার একটি ঘরে
প্রবেশ করি। একটু পরে মানবসৃষ্ট ভূমিকম্প শুরু হয়। চেয়ার, টেবিল,
আলমিরা সব দোলে উঠে। উপরের ফেন, ঝুলন্ত ঝাঁড়বাতি
সব এপাশ ওপাশ দোলতে শুরু করে। মনে হল এই ভূমিকম্পে ভবন ধ্বসে সবাই মারা পড়বে। এভাবে
প্রায় ১০/১৫ মিনিট ভূমিকম্প হল। নিচের মাটি যেন সরে যাচ্ছিলো, ভূমিকম্প ধীরে ধীরে
বন্ধ হলে সবাই যেন উৎকণ্ঠার চোরাবালি হতে মুক্তি পান।
এই মিউজিয়াম এতো
বড় যে দেখতে হলে সারা দিনের প্রয়োজন এবং শিখতে হলে অন্ততঃ ছয়মাস লাগবে। তাই
আকর্ষণীয় অংশটুকু তুলে ধরলাম। এটি মিউজিয়াম হলেও একটা জ্ঞানসমুদ্র। এই
জ্ঞানসমুদ্রে ঢুকেই মহান আল্লাহকে বললাম- রব্বি জিদনি ইল’মা। হে আমার রব তোমার এই নিদর্শণসমূহ হতে যতোটুকু সম্ভব জ্ঞান হে প্রভু আমাকে দান কর।
হেরড’স মার্কেট পৃথিবীর অন্যতম অভিজাত
ব্যবসা কেন্দ্র। ন্যাশনাল নেচার মিউজিয়াম হতে বের হয়ে বাংলাদেশ হাইকমিশনের সামনে
আসি। পাশে সোনালী ব্যাংকের লন্ডন অফিস। নিকটস্থ ভবনে পূবালী ব্যাংকের এক্সচেঞ্জ
অফিস ছিল, বর্তমানে পূবালী ব্যাংক নেই। ছয় কোটি টাকা লোকসান
দিয়ে উঠে এসেছে। এখন ঐ স্থানেই প্রাইম ব্যাংকের একটি এক্সচেঞ্জ হাউস সুন্দরভাবে
ব্যবসা পরিচালনা করছে এবং জানলাম ভাল প্রফিটও করে যাচ্ছে তারা।
হেরড’স মার্কেটে ঢুকলাম। বনেদি ডিজাইনে
নির্মিত ১৩ তলা ভবন। প্রতিতলা ঘুরে আসতে অন্ততঃ দুই ঘণ্টা সময় লাগে। কাজেই পুরো
হেরড’স মার্কেট ঘুরে দেখতে পুরো দুই দিন লাগবে। এক এক তলায়
এক এক জাতের পণ্যের সমাহার রয়েছে। এই মার্কেটে বিশ্বের অতি উন্নত ও বিরল ব্রেন্ডের
মালামাল রয়েছে। একটি ম্যানিব্যাগ হাতে নিয়ে দেখলাম দাম লিখা বাংলাদেশী দশ হাজার
টাকা। এখানে একজোড়া জুতার দামও পঞ্চাশ-ষাট লক্ষ টাকা রয়েছে। একটি হিরার লকেট
দেখলাম দাম সাত কোটি টাকা। আমার সব সম্পদ বিক্রি করেও তা কেনা সম্ভব নয়। অথচ
নিশ্চয়ই ক্রেতা আছে, নইলে এত হীরে এভাবে সাজিয়ে রাখতো না। এই
মার্কেটের ক্রেতা দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের রাজা-রাজড়া, উজির-মন্ত্রী
ও ধনকুবেররা। আমাদের মতো প্রজা লোকজনের পক্ষে এখানে পণ্য
কিনা দুঃসাধ্য। তবে মার্কেটে ৭ম তলায় কাপড়ের বাজার কিছুটা সস্তা মনে হয়েছে। এখানে
সাধারণ ধনীরাও হাত ঢুকাতে পারেন। এই মার্কেটের বর্তমান মালিক একজন ফরাসি মুসলিম। তিনি ফ্রান্সে একজন আলজেরিয় অভিবাসী ছিলেন।
তার পুত্র ডোডি আল ফাদ ছিলেন প্রিন্সেস ডায়নার প্রেমিক, যিনি
প্যারিসে এক রহস্যময় সড়ক দুর্ঘটনায় ডায়নার সাথে নিহত হন।
মাদামতুসা জাদুঘর
পরিদর্শনঃ
২৮ জুন ২০১৭।
আফজল, আজফার, বড় ভাই ও আমরা তিনজন খুব ভোরে ড্যাগেনহাম ইস্ট স্টেশনে গিয়ে সিটি লাইন অব
হ্যামার স্মিথের ট্রেন ধরি। স্টেশনে রাখা ফ্রি পত্রিকা হাতে নেই। পড়ে পড়ে কয়েকটি
স্টেশন পার হয়ে মাদামতুসার নিকটে নামি। বিখ্যাত শিল্পী মাদামতুসার (১৭৬১-১৮৫০) এই
যাদুঘরের স্বপ্নদ্রষ্টা ও প্রতিষ্ঠাতা। এই ভদ্র মহিলা তৎকালীন যুগে মোম দিয়ে
তখনকার সময়ের সব সেলিব্রেটি ও ঐতিহাসিক লোকজনের অবিকল মূর্তি তৈরি করে যাদুঘরটির
সূচনা করেন।
এই যাদুঘরে ঢুকতে
খুব ভোরে এসেও সুদীর্ঘ লাইনে দাঁড়াতে হয়। টিকেট জনপ্রতি চল্লিশ পাউন্ড যাহা
বাংলাদেশী টাকায় ৪৩০০/-টাকা। ঘণ্টাখানিক পর গেটের কাছে আসি। নিরাপত্তা পরীক্ষার পর
টিকেট সংগ্রহ করে সবাই প্রবেশ করি। শুনলাম বছরে প্রায় আড়াই মিলিয়ন লোক যাদুঘরটি
পরিদর্শন করে থাকেন। টিকেট বাবদ ব্যবসায়িক আয় যাদুঘরটির প্রায় এক হাজার কোটি টাকা।
ভিতরে ঢুকেই আমাদের অতিপরিচিত বলিউড ও হলিউডের অভিনেতা ও অভিনেত্রীদের মজলিসে এসে
পড়ি। আপন আপন স্টাইল ও ব্যক্তিত্ব নিয়ে জীবন্ত দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন অমিতাভ বচ্চন, শাহরুখ খান, সালমান
খান, ঋত্বিক রোশন, আমির খান, অজয় দেবগন, ঐশ্চ্যর্য রাই, কারিনা
কাপুর, প্রিয়াঙ্কা চোপড়া, রেখা,
সাইফ আলী খানসহ বরেণ্য ভারতীয় চিত্রতারকারা।
অন্যপাশে হলিউড ও উন্নত বিশ্বের অসংখ্য নামকরা অভিনেতাদের সমাবেশ। রয়েছেন- সুফিয়া
লরেন্স, জেনিফার লরেন্স, মেরিলিন মনরো,
এলিজাবেত টেলর, এমা স্টোন, ক্যাথরিনা হ্যাপবার্ন, টম ক্রুজ, উইল স্মিথ, রাবাট ডেওয়ে, মাইকেল
কেইন, স্যামুয়েল জেকসন, হ্যারিস ফোর্ড
প্রমুখ।
এবার এক সুড়ঙ্গপথ
পার হয়ে এক যান্ত্রিক বিশালাকার গরিলার মুখোমুখি হই। বিকট চেহারার দৈত্যাকৃতি
গরিলার লাল টকটকে চোখ নড়চড় করছে। ভীমকালো অতি শক্তিমান দৈত্যটি বডি নাচিয়ে রণহুঙ্কার
ও গরম নিঃশ্বাস ছাড়ছে। দানবটার রণহুঙ্কারে দেহের ভিতরের প্রাণটা হিম হয়ে আসে। মনে হয় খামচা মেরে এই
বুঝি আমাদেরকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে দেবে। গরিলাকে অতিক্রম করে আরেক হলঘরে প্রবেশ
করি। এখানে বর্তমান ও অতীত বিশ্বের প্রথিতযশা রাজনৈতিক নেতাদের অবস্থান। জর্জ
ওয়াশিংটন, আব্রাহাম লিঙ্কন, উইনস্টোন
চার্চিল, নেলসন ম্যান্ডেলা, শ্রীমতি
ইন্দিরা গান্ধি। ভারতের জাতির জনক মহাত্মা গান্ধী, হাত জোড়
করে বিনীতভাবে দাঁড়ানো সহাস্য নরেন্দ্র মোদী, মহারাণী
ভিক্টোরিয়া, বৃটেনের বর্তমান রানি এলিজাবেথসহ সম্পূর্ণ
রাজপরিবার, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এবং ওভাল
অফিসে প্রেসিডেন্ট চেয়ারে বসা বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
ব্রিটিশ
রাজপরিবারের মধ্যে ঢুকে রাণী এলিজাবেত দম্পতির দু’পাশে দাঁড়িয়ে আমি ও নূরজাহান জাদুঘরের ক্যামেরায় ছবি তুলি।
আমাদের অন্যদিকে ছিলেন প্রিন্স হ্যারি ও প্রিন্স উইলিয়াম,
রাজবধূ ক্যাট। আমি ছিলাম প্রিন্স চার্লস ও কিং ফিলিপসের মধ্যে
দাঁড়ানো। আমরা সাধারণ মানুষ। রাজভাগ্য আমাদের কপালে নেই। অথচ মনে হল আমরা যেন আজ
অনেক অনেক ভাগ্যবান। দুনিয়ার সব বিখ্যাত বিখ্যাত মানুষের সাহচর্য্যে যেন চলে
এসেছি। হযরত ঈসা (আঃ), মুসা (আঃ), গৌতম
বুদ্ধ সবাই আজ আমার চারপাশে ধ্যান ভঙ্গিমায় রয়েছেন। পরবর্তী হলে বিশ্ববিখ্যাত
ক্রীড়াবিদগণের মধ্যে ঢুকে পড়ি। ফুটবল জগতের পেলে, ম্যারাডোনা,
রোনাল্ড, বেকেন বাওয়ার, জিনেদিন
জিদান, প্লাথিনী, মেসি সবার সাথে দেখা
হল। ক্রিকেট জগতের শচিন টেন্ডুলকার, ইমরান খান, গ্যারি সবরস, কপিল দেব, মুরালীধরন,
স্যার ডন ব্রাডম্যানসহ অনেককে পেলাম। বক্সারদের মধ্যে মোহাম্মদ আলী
ক্লে, মাইক টাইসন, জর্জ ফোরম্যান,
লিওনেক্স লুইস প্রমুখ দাঁড়িয়ে আছেন। এখানে অন্য সব ধরনের ক্রীড়াবিদ
ও অলিম্পিক বিজয়ীদের সাথেও মোলাকাত হল।
এখান হতে বের হয়ে
বিশ্ববিখ্যাত বৈজ্ঞানিক আইনস্টাইন, স্যার আইজেক নিউটন ও স্টিফেন হকিংয়ের দরবারে যাই। হুইল চেয়ারে
বসা স্টিফেন হকিংকে অপূর্ব লাগছিল। সদ্য প্রয়াত এই ক্যামব্রিজ আধ্যাপক বর্তমান
বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী ছিলেন।
এখন আমরা চলে আসি
ম্যাদামতুসো জাদুঘরের ভিতরে স্থাপিত একটি ট্রেনের প্লেটফরমে। এখানে আমরা একটি
খেলনা ট্রেনের যাত্রি হব, এই
ট্রেন চড়ে ঘুরে দেখবো প্রাচীনকাল হতে আজ পর্যন্ত লন্ডনের জীবনযাত্রা ও প্রযুক্তির
সুদীর্ঘ্য ইতিহাস ও বিবর্তণ। পথে পথে দেখা হল- ছাপাখানার
বিবর্তণ। লন্ডনবাসীর বিভিন্ন যুগে ব্যবহৃত বাতি, কলম, ছাতা, পোষাকের বিবর্তণ ও ইতিহাস। এমনকি বিভিন্ন যুগের রান্নার চুল্লী, সোফাসেট,
প্রাচীন ঘোড়ার গাড়ি হতে বর্তমান আধুনিক যানবাহন পর্যন্ত।
মানুষের জীবন যে
থেমে থাকে না, রোজ রোজ একটু
একটু করে বদলে যায় সেই সত্য টয়ট্রেনে বসে হাজার বছরের লন্ডনকে দেখে সহজে অনুভব করি।
টয়ট্রেন হতে এক জায়গায় বিশ্ববিখ্যাত ইংলিশ কবি উইলিয়াম শেক্সপিয়ারকে ষোড়শ শতাব্দীর
ডিজাইনে নির্মিত চেয়ার টেবিলে বসে লিখতে দেখলাম। সামনে বিশাল খাতা, আঙ্গুলের ফাঁকে রয়েছে রাজহাঁসের পালকের কলম ও কালিদানী। ত্রিশ মিনিটে
হাজার বছরের লন্ডন সফর সুন্দরভাবে সমাপ্ত হল।
এবার মাদামতুসো
জাদুঘরের বিশাল অডিটোরিয়ামে ঢুকলাম। সামনে বিশাল পর্দা জুড়ে চার ডায়মেনশন ছবি
দেখানো হবে। হল ভর্তি লোকজন। আলো নিভে গেল। লন্ডন শহরে ভিনগ্রহের এলিয়নের আক্রমন ও
লন্ডনবাসীর প্রতিরোধ চিত্র। এলিয়নদের
আক্রমনে লন্ডন শহরের ভবনের কাচ ভেঙ্গে গুড়ো গুড়ো হয়ে যেন আমাদের উপর বৃষ্টির মত
ঝরে পড়ছে। সবাই ভাঙ্গা কাচ হতে বাঁচতে হাত দিয়ে মাথা ঢাকছে। শেষমেষ সভ্য
লন্ডনবাসীর বিজয়ের মাধ্যমে ছবির সমাপ্তি।
এবার বের হয়ে
ট্রেন ধরলাম। ট্রেনে বসে ২০ পাউন্ডে কেনা রাজ পরিবারের সাথে উঠানো আমাদের ছবিটি
আজফারের হাতে দিলাম। আজফার কৌতুক করে বলল- চাচা, আপনারাতো গেস্ট অফ কুইন। আজফারের কথাশুনে পাশের দু’জন ইংরেজ ভদ্রলোককে মৃদু হাসতে দেখলাম। তুসোর মানব মূর্তিগুলো এতোই
প্রাণময় যে পাশে দাঁড়ালে মনে হয় যেন জীবন্ত লোকটির পাশে দাঁড়িয়ে আছি। এই ট্রেনে হঠাৎ করে দেখা হল তুড়কখলা গ্রামের হোমিওপ্যাথি
চিকিৎসক জনাব ময়না মিয়ার একমাত্র সন্তান বাল্যবন্ধু যুবায়ের ভাইয়ের সাথে। তার
উদ্যোগে উক্ত গ্রামে একটি এতিমখানা পরিচালিত হচ্ছে। চৌধুরীবাজার শাখার ব্যবস্থাপক
থাকাকালে এক বৎসর পূর্বে দেখা হয়েছিল। আমাকে বাসায় যাবার আমন্ত্রণ জানিয়ে তিনি
ভূগর্ভস্থ অলগেট স্টেশনে নেমে যান।
রাতে ভাগ্নি
এনবের বাসায় যাই। সে আমার ফুফুতো বোন সেবি আপার একমাত্র কন্যা। সেবি আপা এক সময়ের
খুব হাসিখুশী ও আমোদে স্বভাবের ছিলেন। বহু বছর পর দেখা হল। তিনি আমার মায়ের প্রায়
সমবয়সী। আমার মা যখন দাউদপুর আসেন, তখন কয়েকজন প্রায় সমবয়সী ভাগ্নি ও ভাতিজি পান। যারা ছিলেন
একদিকে ভাগ্নি- ভাতিজি অন্যদিকে বান্ধবীও। সেবি আপা বুড়ি হয়ে গেছেন, কানে শ্রবণ শক্তিও নেই। চিৎকার করে করে কথাবার্তা বলতে হল। কিন্তু তার স্নেহ-মায়া এখনও আগের মতো অটুট রয়েছে।
২৯ জুন
২০১৭। সেদিন লন্ডনের কয়েকজন নিকটাত্মীয়ের বাসায় যাই। কানিহাটি হাজিপুরের ফুফুতো
বোন সায়মা আপা থাকেন দক্ষিণ লন্ডন। তার পুত্র রুহেলের সাথে বাংলাদেশে প্রায়ই দেখা
হত। তাকে পেয়ে যাই। তার বড় ভাই মামুনের সাথে দেখা হল বহুবছর পর। মামুন আমার প্রায়
সমবয়সী। ১৯৮১ সালে ছাতকে একসাথে অনেক ঘুরাফেরা করেছি। সেই কিশোর মামুন এখন আর নেই।
মাথায় টাক, আমার চেয়েও দেখতে তাকে অনেক বয়স্ক লাগছে। মামুন
কিচেনে গিয়ে বেশ কয়েকপদের নাস্তা নিজ হাতে তৈরি করে নিয়ে আসে।
মামুনের
বাসা হতে বের হয়ে ভাগ্নি পপির বাসায় যাই। এখানে রাতে থাকতে হবে। লন্ডন ঢুকার পর
হতে তার বাসায় থাকার আবদার শুনে আসছি। গাড়ি প্রধান গেটে আসতেই অটো গেট খোলে গেল।
গাড়ি বনজঙ্গল, বৃক্ষলতা সুসজ্জিত এক সুন্দর বাসায় প্রবেশ
করলো। লন্ডনের অন্যান্য বাসাগুলো রাস্তার পাশে পাশে সাজানো কিন্তু এ প্রাসাদদ্যোম
বাসাটি প্রধান রাস্তা হতে অনেক ভিতরে রয়েছে। মনে হলো বাসাটি বুঝি বাংলাদেশের
বিদেশী চা বাগানের এক নির্জন বাংলো। ভাগ্নিবর সামাদ বললেন রাস্তার ধারের বাসায়
খানিক শব্দ ও ধুলা দূষণ হয়, এখানে এসবের কোন অস্তিত্ব নেই।
লন্ডনের অভিজাত এলাকার ঘন অরণ্য পরিবেষ্টিত এই বাসার সামনে ও পিছনে বড় বাগান।
পিছনের বাগানে একটি ছোট্ট শিশুপার্ক সাজানো। যেখানে আমার নাতি ও নাতনিরা খেলা করে।
তিন তলার এই ট্রিপ্লেক্স বাসায় বড় বড় পাঁচটি বেডরুম, দুইটি
ড্রয়িং রুম। বড় কিচেন, পিছনের বাগানের মধ্যে ঢুকে পড়া বড়
একটি গ্লাসঘেরা সিটিং রুম সোফাসেট সজ্জিত রয়েছে।
বাসার দুইটি ফিস
এক্যুরিয়ামের একটিতে ছোট ফিস ও অন্যটিতে মিডিয়াম ফিস রয়েছে। পাখি কক্ষে কয়েক
প্রকার সবুজ, লাল ও শ্বেতকায়
পাখি লাফালাফি করছে। ভোরে এই পাখিগুলোর সুমিষ্ট কিচির-মিচির শুনে ঘুম ভাঙ্গে। এ
বাসায় সুস্বাদু স্যালমন ফিস খাই। মধ্য লন্ডনের এই অভিজাত বাসার নির্জন বন্য
পরিবেশে বসে শুনতে পাই ইংল্যান্ডের জাতীয় পাখি রবিনের সুমধুর ডাক। থ্রিডি
টেলিভিশনে ছবি দেখি। তৃতীয় তলার ব্যায়ামাগারে সকালে ব্যায়াম করি। দামীগাড়িসহ এমন
বিলাসবহুল বাসা বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ কল্পনাও করতে পারবে না। এমন বাসা গোলশান
বারিধারাতেও বিরল। ভাগ্নিবর সামাদ একজন চার্টার্ড একাউন্টেন্ট। একটি বহুজাতিক
ব্রিটিশ ব্যাংকের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। পূর্বে পোস্টিং ছিল নিউইয়র্ক। ফিরে এসে
কিছুদিন লন্ডনে কাটানোর পর এখন কাতারের রাজধানী দোহায় নিযুক্ত হয়েছেন। তিন/চার
সপ্তাহ পরপর লন্ডন আসেন। প্রতি ছয় সপ্তাহ পর পুরো পরিবার দোহায় গিয়ে দুই সপ্তাহ
কাটিয়ে আবার লন্ডনে ফিরে আসেন।
এবার আজদা মার্কেটে
বাজার করতে যাই। বাসায় ফেরার পর পপি তার ছোট্ট গাড়ি চালিয়ে আমাদেরকে মাহনুরের
স্কুলসহ আশপাশ ঘুরে আসে। বাসার চার পাশে ঘন অরণ্যে হাঁটি। আমি বললাম এতো সবুজ, যেন আমাদের বাংলাদেশের সবুজকে লজ্জা
পাইয়ে দেবে। পপি বলল- মামা, এখানে সবুজতো বাংলাদেশের মতো বারমাস
থাকে না। শীতে তুষার ঝরে। ডিসেম্বর জানুয়ারিতে বৃক্ষে কোনো পত্র থাকে না।
গাছগুলোকে মৃত মনে হয়। পত্রহীন ডালে যখন বরফ ঝুলে মনে হয় যেন শুভ্র ক্রিস্টাল
ঝুলছে। তুষারপাত হলে ঠান্ডা কমে যায়, বাতাস বিশুদ্ধ হয়। আসলে
তখন পাতা ঝরা বৃক্ষরাজি ও প্রকৃতি আলাদা এক সৌন্দর্য্যের আধারে পরিণত হয়।
ইস্ট লন্ডন পরিদর্শনঃ
৩০ জুন ২০১৭ সাল। পবিত্র
শুক্রবার। ভাগ্নি পপির বাসায় সকালের নাস্তা শেষ হতেই বড়ভাই তাহমিদ চৌধুরী এসে
হাজির হন। আমরা ভাইয়ের গাড়িতে করে ইস্ট লন্ডন চলে আসি। আজ ইস্টলন্ডন
বাংলাদেশীদের বড় মসজিদে জুমুয়ার নামাজ পড়ার সিন্ধান্ত নেই। ড্রাগেনহাম ইস্ট
স্টেশনে গিয়ে ভূতল ট্রেন ধরি। ইস্ট লন্ডন জামে মসজিদের সিন্নিকটে White Chapal স্টেশনে নামি। ভূতল স্টেশন হতে বের হয়েই উপরে বাংলা টাউন।
কিছুদূর হেঁটে যাবার পরই The East
London mosque লিখা
সাইনবোর্ড ও মসজিদ গম্বুজ চোখে পড়ে। টুপী পরা বাংলাদেশী মুসল্লিরা দলে দলে মসজিদে
ঢূকছেন। উপরের সবতলা লোকে লোকারন্য, ফাঁকা জায়গা নেই। তাই কোনমতে ভূতল মেঝে
ঢুকলাম। পূর্ব পরিকল্পনায় এখানে বন্ধু সিদ্দিকুর রহমান নির্ঝরের সাথে দেখা হয়।
মসজিদে আরবিতে
খুতবা পড়া হয়। তারপর এই খুতবা প্রথমে বাংলা ও পরে ইংরেজীতে অনুবাদ করে পাঠ করা হয়।
সুন্দর খুতবা পড়েন খতিব শেখ আব্দুল কাইয়ুম। খতিব বাংলাদেশের নোয়াখালী জেলার বাসিন্দা।
তিনি গভীর ধর্মীয় জ্ঞানসম্পন্ন বাগ্মী আলেম। খুতবার বিষয়বস্তু খুবই সাধারণ অথচ
জরুরী একটি বিষয় যে, পশ্চিমা বিশ্বে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যেসব অপপ্রচার ও
প্রপাগান্ডা চলছে সেগুলো নির্দেশ করে তার প্রতিকার ব্যবস্থা। ঈমাম সাহেব
মুসলমানদেরকে প্রতিটি অপকর্মের জবাব ভাল ব্যবহার ও সুকর্মের মাধ্যমে দিতে উদ্ভুদ্ধ
করেন। শান্তি বিঘ্নিত হয় এমন কোন কাজ কোন মুসলিম করতে পারেনা। ইতিমধ্যে কিছু
দুবৃত্ত জঙ্গি লন্ডনের রাস্থায় কিছু নিরীহ লোকজনকে কুপিয়ে হত্যা করে। এই ঘটনার
প্রতিক্রিয়ায় দু’চার জায়গায় মুসলমানরা এসিড হামলার শিকার হন। ঈমাম ধর্য্যধারণ ও
বৃটিশ আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে মুসল্লিদেরকে উপদেশ দেন।
মসজিদটির সবকটি
তলায় কয়েক সহস্র মানুষ নামাজ আদায় করতে পারেন। এখানে মক্কা ও মদীনা মসজিদের নিয়মে
নামাজ ও খুতবা পরিচালিত হয়। মসজিদটি সিলেটিরা প্রতিষ্ঠা করেন এবং কমিটি সিলেটিদের
দখলে। লন্ডনে পরলোক গমনকারী সিলেটিদের নামাজে জানাজাও সাধারণতঃ এই মসজিদে সম্পন্ন
হয়। বাদ জুমুয়ায় আমরা একজন অজ্ঞাত স্বদেশীর জানাজায় শরিক হই।
ইস্ট লন্ডন সিলেটি
অধ্যুষিত এলাকা। এখানে বাংলাটাউনের অবস্থান। দোকানপাঠ, ব্যবসা-বানিজ্য, বাসা-বাড়ি
সবই সিলেটিদের দখলে। এখানে রাস্থার দু’পাশে অসংখ্য ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট বাংলাদেশী
লোকজন পরিচালনা করেন। হোটেলগুলোর নামও ভারতীয়, যেমন হোটেল তাজ, হোটেল দিল্লি,
হোটেল হিন্দুস্থান ইত্যাদি। আসলে এই হোটেলগুলোর মালিক বাংলাদেশী, ব্যবসার কৌশল
হিসাবে এইসব ভারতীয় নামের ব্যবহার করা হয় মাত্র।
১৯৭০ সাল হতে
১৯৮৬ সালের মধ্যে ইহুদি অধ্যুষিত এই এলাকাটি সিলেটিদের হস্থগত হয়। বাংলাটাউনের
রাস্থা সিলেটি ভাষা ও সিলেটি লোকজনের কোলাহলে সর্বদা মুখরিত থাকে। এখানে দোকান
সমূহের সাইনবোর্ড বাংলা ও ইংরেজি হরফে লিখা রয়েছে। এখানে হাঁটার সময় মনে হয়েছে আমি
বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলে হাঁটছি। ক্ষণিকের ভ্রান্তি যখন ভেঙে যায় তখন মনে পড়ে
এটাতো উন্নত দেশ বৃটেন, তৃতীয় বিশ্বের কোন মফস্বল শহর নয়।
মসজিদের প্রচন্ড
মুসল্লি ভীড়ে গাদাগাদি দাঁড়িয়ে জুমুয়ার নামাজ আদায় করে আমি বন্ধু সিদ্দিকের হাত
ধরে বাংলাটাউনের রাস্থায় নেমে আসি। জেফার ও অন্যরা বাসায় চলে যান। আমি জড়াজড়ি করে
রাস্থায় হাঁটতে চাইলে সিদ্দিক বাঁধা দেয়। আমি কারণ জানতে চাইলে সে বলল এদেশে
অসংখ্য সমকামী পুরুষ (Gay) ও সমকামী নারী (Lesbian) রয়েছেন। এভাবে হাত ধরে হাঁটলে
লোকে আমাদেরকে Gay ভাববে। বুঝলাম, এসব উন্নত দেশগুলো নষ্টামিতে ভরা।
আমাদের দেশ দরিদ্র হলেও এসব নষ্টামি হতে পবিত্র। কিছুদূর গিয়ে নির্ঝর বলল- আমি
একজনের সাথে বক্ষ মেলাব। একটি বনাজি ঔষধের দোকানী ঢুকে হাত বাড়াতেই একজন শীর্ণতনু
শ্বেতাঙ্গ বেরিয়ে এসে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে কোলাকুলি করেন। জিন্সপ্যান্ট ও লাল
গ্যাঞ্জী পরা লোকটা পুরুষ, নাকি নারী বুঝার কোন উপায় নেই। তাকে যে কোন জেন্ডারে
ঢূকিয়ে দেয়া যায়। বক্ষ সমতল অথচ মসৃণ মুখশ্রী বিশিষ্ট লোকটা যে একজন নারী তা
অনেকক্ষণ পর বুঝতে পারলাম।
ইস্ট লন্ডনের
রাস্থায় হাঁটার সময় অসংখ্য সিলেটি ভাইসাবের দেখা পাই যারা সিদ্দিকের পরিচিত আপনজন।
সবাই দৌড়ে এসে তাকে সালাম দেন ও বুক মেলান। সাথে আমিও বাদ নই। এখানে কয়েকজন
সাংবাদিকের দেখা পেলাম যারা আমাকে নিয়ে প্রেস কনফারেন্স করার আমন্ত্রণ জানান।
ইস্টলন্ডনে বাংলা প্রেসক্লাব রয়েছে। এখানে দেশবার্তা, টেমস-সুরমাসহ যে সব ক্ষুদে
পত্র-পত্রিকা আছে এগুলোর সাংবাদিকরা সমবেত হন।
আমি দশ বারটি
বইয়ের লেখক হিসাবে তাদের দৃষ্টিতে প্রেস কনফারেন্সের জন্য একজন উপযুক্ত ব্যক্তি।
এখানে বাংলাদেশ হতে আগত ভূইফুড় নেতা, লেখক, কবি, শিল্পীরা প্রেস কনফারেন্সে এসে
সাক্ষাৎকার দেন। স্থানীয় পত্রিকাগুলোয় তাদের সচিত্র খবর প্রকাশিত হয়। আমার হাতে
সময় নেই, তাই প্রেস কনফারেন্সের আমন্ত্রণ ফিরিয়ে দেই। এবার ইস্ট লন্ডনের আফতাব আলী
পার্কে এসে বসি। এই আফতাব আলী একজন বিশ্বনাথী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে। সবেমাত্র
সিলেটিরা লন্ডনে আসতে শুরু করেছেন। তখন বর্ণবাদ ছিল তীব্র। বর্ণবাদীদের হামলার ভয়ে
এসব সিলেটিরা দলবেঁধে ঘুরাফেরা করতেন। কোন এশিয়ানকে একাকি পেলে উগ্র বর্ণবাদীরা
হামলা করত। প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে এই উগ্র বর্ণবাদীদের উপর্যুপরি ছুরিকাঘাতে আফতাব
আলী এখানে শহিদ হন। এই আফতাব আলী পার্কের চারপাশে আজকের বাংলাটাউন।
প্রাথমিক যুগের
সিলেটিরা তেমন শিক্ষিত ছিলেন না। আধুনিক উচ্চশিক্ষিত ইংলিশ সমাজ ও সংস্কৃতির সাথে
খাপ খাওয়াতে তাদের বেশ কষ্ট হয়। এই হাইটেক সমাজ ও নগর কাঠামোতে তারা তেমন মানানসই
ছিলেন না। একই ধরনের বাসাবাড়ি ও পাড়ামহল্লায় বসবাসে তারা অনভ্যস্থ ছিল। বাসা
হারানোর ভয়ে তারা বাসার সামনে ইট পাতর রেখে দিতেন কিংবা দাগ কেটে চিহ্ন তৈরি করতেন
বলে শুনা যায়। স্মারক বস্তু কিংবা চিহ্ন হেরে গেলে বাসার খোঁজে তারা গলদ ঘর্ম হতেন। আশপাশের শ্বেতাংদেরকে না ইশারায় না
কথাবার্তায় তারা বুঝাতে পারতেন ‘আবাস’ হারিয়ে ফেলেছি। কালিবডিয়ান সড়কে তারা সরকারি
স্নানাগারে দলবেঁধে গোসল করতেন। উচ্চারণ করতে না পেরে তারা সড়কটির নাম কালাপানি
রোডে পরিণত করেন। ইংরেজরাও বিভিন্ন দেশে এভাবে উচ্চারণ করতে না পেরে নাম নিজেদের
মত করে বদলে দিতেন। যেমন তারা চট্টগ্রামকে চিটাগাং এবং কোলকাতাকে ক্যালকাট্টায় পরিণত
করেন। জানালা দিয়ে বৃদ্ধ বাঙ্গালি মহিলা যখন পানের পিক ফেলতেন, তখন কেউ রক্তবমি
করছে মনে করে ছুটে আসত আম্বুল্যান্স। বাসার লোকজনের আম্বুল্যান্স উচ্চারণ করা ছিল
কঠিন কাজ। তারা আম্বুল্যান্সকে নিজের মত একটি নাম দেয় ‘আলী হোসেন’। আম্বুল্যান্সের
ইংলিশরা যখন জানলেন এটা রক্তবমি নয়, এক ধরনের খাবার, তখনই আলী হুসেনকে নিয়ে চিকিৎসক
প্রস্থান করেন। বর্তমান লন্ডন প্রবাসী বাংলাদেশী ও তাদের বংশধরগন আজ আর সেই
অবস্থায় নেই। এই ধরনের মিথ বা কাহিনী এখন অচল। বর্তমান সিলেটিদের সম্পর্কে এধরনের
হাস্যকর মিথ আর সাজেনা। তারা এখন লন্ডনের যথেষ্ট স্মার্ট ও চলনসই এসিয়ান জনগুষ্টি।
তাঁরা লন্ডনে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করছে, বাংলাদেশকে বিশ্বের কাছে
তুলে ধরছে।
সিদ্দিকের ছোট্ট
পরিপাটি বাসায় ঢূকে তার জার্মান পত্নী ইভাঙ্কা জেজেগকে পালঙ্কে ঘুমন্ত পাই। এক সময়
তিনি ছিলেন পরমা সুন্দরী। একেবারে গোলাপফুলের রঙ্গ মাখা তনু। এই শ্বেতাঙ্গিনী
সুন্দরীকে দেখে আশপাশের বাঙ্গালরা ঈর্ষানুভব করত এবং কাচা ভাষায় বলত- ছোট খাট
সিদ্দিক মিয়া এমন মাল লাগাইলায় কেমনে। এই সাদা পরী তোমার ঘরে টিকবেনা বেশী দিন।
অথচ এই রমণী আজ কন্যা সাকিবা ও পুত্র ইব্রাহিম ইশরাকের জননী। সগৌরবে পার করে
দেয়েছেন পনের ষোল বছর। তিনি বেশ দয়ালু মহানুভব মহিলা। দু’চারটা বাংলা বলার চেষ্টা
করেন। কন্যা সাকিবা খুব চালাক, তাকে বাঙ্গালি মেয়ে মনে হয়। ছেলে ইব্রাহিম উল্টো,
দুধে আলতা মেশানো রঙের এই শিশুটি যেন একজন বিদেশী শ্বেতাঙ্গের প্রতিরূপ। ইভাঙ্কা
ভাবী এখন বেশ মোঠা হয়ে গেছেন। দশ বছর আগের রূপ যৌবনে এখন ভাটার টান পড়েছে।
এবার ইভাঙ্কা
ভাবী আমাকে নিয়ে সপরিবারে চললেন বনভোজনে। শিশি ইব্রাহিমকে দোলনাগাড়িতে বসিয়ে হেঁটে
হেঁটে আসি বড় রাস্থায়। এবার একটি দুতলা বাসে চেপে অনেক দূরে ইভাঙ্কা ভাবীর জার্মান
বান্ধবীর বাসায়। ছয়তলা বাসার বাসার পাচতলার একটি ফ্ল্যাটে থাকেন ইভাঙ্কা ভাবীর
স্বদেশী বান্ধবী ও তার বাংলাদেশী স্বামী কুষ্টিয়া জেলার হারুন ভাই। হারূন ভাই
লন্ডনে পড়তে এসে এই জার্মান শ্বেতাঙ্গিনীর প্রেমে পড়েন, যা পড়ে বিয়েতে গড়ায়। তাদের
মিশ্রজাতের দুই সুন্দর পুত্র-কন্যা রয়েছে। বাসার পিছনের সুন্দর বাগানে যাই। বেশ বড়
বাগান, বাচ্চাদের খেলার জন্য অবারিত জায়গা। বাগানে ডিজাইন করে নানা জাতের কুসুমবীথি
লাগানো। চারপাশে নানা জাতের কুসুমের মধু হাসি। হারুন ভাই তার গিন্নীকে নিয়ে খোলা
আকাশের নিচে বারবিকিউ রান্না করছেন। কড়কড়ে মোরগের রোস্ট, সরষে বাটা, নানরুটি, কড়া
পানীয়, সবজি, সবমিলে এক ভূরিভোজের আয়োজন। চুল্লীর ধুয়া উড়ছে। কাবারের মজাদার খুশবো
বাগানে ভেসে বেড়াচ্ছে। রাতের আগমনের পূর্বে অতি ধীরলয়ে দুই/তিন ঘন্টা রান্না ও
খাওয়া দাওয়া চলল। পার্কের পাকা বেঞ্চে বসে ফুলের কুঞ্জে কুঞ্জে আড়ালে আবডালে বসে
বসে গল্প করে সুদীর্ঘ্য বিকেলটা আনন্দে হারিয়ে গেল। মান্নাদের প্রিয় গানটা মনে পড়ল-
‘কোথায় হারিয়ে গেল সোনালি বিকেলটা গুলো এই, আজ আর নেই’।
যুক্তরাজ্যের
বাচ্চাগুলো শান্তশিষ্ট, আমাদের শিশুদের মত এত দুষ্ট নয়। তারা ময়লা যেখানে সেখানে
ফেলেনা, ডাস্টবিনে নিয়ে যায়। গাছের কোন ফুল বা পাতা ছিড়ে না। এরা একে অন্যে
মারামারি করতেও জানেনা। এতগুলো বাচ্চা খেলাধুলা করছে কিন্তু কোন চেচামেচি নেই, হৈ
চৈ নেই। চারপাশ শান্ত ও নিস্থব্ধ। ভান করা, মিথ্যাচার কিছুই এই বাচ্চাদেরকে স্পর্শ
করতে পারেনা। পার্কের চেয়ারে কুসুমের কুঞ্জবনে বসে অনেক গল্প করি। বছরের পর বছরের
জমানো গল্প।
সিদ্দিকের কাছে
তার শ্বশুর-বাড়ি জার্মানি সফরের কাহিনি মনযোগ দিয়ে শুনি। সেই কাহিনিতে জার্মান
সংস্কৃতি সম্পর্কে বেশ জানা হয়। একবার সে তার শ্বশুরবাড়ি জার্মানির রাইনল্যান্ডে
যায়। অপরূপ সুন্দর নদী রাইনের নামে প্রদেশটির নাম রাইনল্যান্ড। বড় বাড়ি, ছবির মত
সুন্দর দেশ। আমাদের দেশে শ্বাশুর ও মেয়ে জামাইয়ের মধ্যকার সম্পর্ক পিতা-পুত্রের মত
কিন্তু জার্মানিতে এই সম্পর্ক ‘বন্ধু সম্পর্ক’। এখানে শ্বাশুড় মেয়ে জামাইয়ের সাথে
হাসিটাট্টা করেন। অনুরূপ শ্বাশুড়িও জননীর মত নন, যেন একজন বয়ঃজৈষ্ট্যা বান্ধবী।
সিদ্দিকের
জার্মান শ্বশুর উঁচু ও বেশ মোঠা তনুর লোক। সেই তুলনায় সে বেঁটে ও চিকন। শ্বশুর
মহাশয় কৌতুক করে বাচ্চা কোলে নেওয়ার মত তাকে কূলে তুলে নেন। শ্বাশুড়ী ও খালাশ্বাশুড়িদেরকে
নিয়ে বাড়ির গরম জলের সুইমিংপুলে আনন্দ গোসল করছেন। মেয়ে জামাইকে শ্বাশুড়িরা তাদের
সাথে আনন্দ স্নানে শরীক হবার আমন্ত্রণ জানান। শ্বশুর-শ্বাশুড়ী খালাশ্বাশুড়ি, মেয়ে
ও মেয়েজামাই সবাই মিলে সুমিংপুলের মৃদু উষ্ণ পরিস্কার জলে একসাথে আনন্দ গোসল,
সাতার-কাটা ও জলকেলি হল। এটাই জার্মান সংস্কৃতি। প্রতি তিন চার মাস পরপর জার্মানি
হতে লন্ডনে সিদ্দিকের ঘরে কাপড়, খেলনা ইত্যাদি উপহার আসে।
সময় শেষ কিন্তু
আমাদের গল্পের শেষ নেই। বিকেলটা ফুরিয়ে গেল। এবার চললাম হারুন ভাইয়ের পাচতলা
ফ্ল্যাটে। এখানে খোলা বারান্দার টেবিলে আসে দৈ, কফি ও মিষ্টি। ঝুলন্ত ফ্লাওয়ার
বক্স ও আর্কিড সজ্জিত সবুজ বারান্দায় মিষ্টি রোদেলা বিকেল শেষ হল। জার্মান
হোস্টভাবী হালকা-পাতলা শ্বেতাঙ্গিনী। দেখতে তরুণী ও সুন্দরী, যদিও দুইজন সাদা বালক
বালিকার জননী। জার্মান হোস্টভাবী ও হারুনভাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে নেমে আসি। হয়ত এটাই
চিরবিদায় যদি স্রস্টার অপার মহিমায় আবার না আসি এবাসায়। নিচে কার নিয়ে বড়ভাই
হাজির। এবার ছুটলাম লন্ডনে আমাদের স্থায়ী ঠিকানা ড্যাগেনহাম ইস্ট।
১লা জুলাই ২০১৭ শনিবার।
মর্নিংওয়ার্কে বের হয়ে ভিম ভ্যালি কান্ট্রি পার্কে ঢুকি। পার্কের সীমান্ত বের করার
জন্য দৌঁড়াতে থাকি। দু’পাশে
প্রাকৃতিক বন-বনানী, ফল-ফুলের বর্ণিল সমাহার। এই বন পার হয়ে
অপূর্ব সুন্দর সমতল পাহাড়ে যাই। দুই পাহাড়ের মধ্যভাগে নিম্ন উপত্যকা
দিয়ে একটি সুন্দর ছোট নদী বহমান। জল স্বচ্ছ ও দু’পারে
কাশফুল-শনফুলে একাকার হয়ে আছে। নদীর উপর কাঠের সেতু পার হয়ে সমতল পাহাড়ের মধ্যভাগ
দিয়ে পীচঢালা রাস্তা বরাবর হাঁটি। দু’পাশের সুবিশাল মাঠ জুড়ে
কাশবন। নাম না জানা বৃক্ষসারি। এযেন সিলেটের টিলার উপত্যকা ও ঝর্ণা। টিলার নিচের
শান্তজলাশয়। এখানে বড় বড় কাকের পাল ও নাম না জানা পাখির দেখা পাই। পাঁচ ছয়টি খরগোস
ঘাস খাচ্ছে। কিছু খরগোস আমাকে দেখে ঝোপ ঝাড়ের আড়ালে লুকিয়ে যায়। শিরশির বাতাস ও
বৃক্ষপত্রের ছন্দময় পট্ পট্ আওয়াজ বাংলাদেশের বসন্তকালের চা বাগানের ছায়াবৃক্ষের
কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
The O2- Millionium Domn পরিদর্শনঃ
লন্ডনে দু’ সহস্রাব্দকে
স্মরণীয় করে রাখতে ‘মিলিওনিয়াম
ডোম’ তৈরি হয়। ব্রিটিশরা বিশ্বের এক উন্নত উদ্ভাবনী
ক্ষমতাসম্পন্ন জাতি। নতুন নতুন ধারণা, দর্শন, স্থাপনা, অবকাঠামো উদ্ভাবনে তাদের জুড়ি মেলা ভার।
অনুরূপ পুরাতনকে সংরক্ষণও তাদের জুড়ি নেই।
‘The O2- Millionium Domn’ হচ্ছে কয়েক একর জায়গা জুড়ে স্থাপিত
অর্ধবলাকার স্থাপনা। শক্ত একধরণের কাপড় ও দড়ি দিয়ে প্রায় একশত ফুট উঁচু ফুটবলের
মতো বৃত্তাকার ছাদ। ঐ শক্ত কাপড়ের ছাদ দিয়ে ভোরের আলোর মতো সূর্যের প্রাকৃতিক আলো
আসে, অথচ তুষার, বৃষ্টি, বরফ এসব ঢুকতে পারে না। শীত প্রধান দেশের ঠান্ডা হতেও ভিতর থাকে সুরক্ষিত।
অনেকটা মরুদেশের এক্সিমোদের ঘর ইগলুর ডিজাইনে নির্মিত। ইগলু ক্ষুদ্র, এটি কয়েক একর জায়গা জুড়ে প্রসারিত। ইগলু বরফে তৈরি আর এটি শক্ত কাপড় ও
দড়িতে তৈরি। এই ডোম এতই শক্ত যে, শত শত মানুষ পাহাড় টেকিংয়ের
মতো দড়ি ধরে বেয়ে বেয়ে উপরের ছাদে উঠছে। লন্ডন শহরে পর্বতারোহণের স্বাদ গ্রহণ
করছে। ডুমের মধ্যে অজস্ত্র স্থাপনা, ব্যবসাকেন্দ্র ও দোকান
পাঠ রয়েছে। প্রিয় ভাতিজি নওশীন নতুন চাকুরির বেতন পেয়েছে। সে Millionium Domnতে অবস্থিত লন্ডনের বিখ্যাত জিম্মি (Jimmy) রেস্টুরেন্টে এ প্রিয়জনদের আমন্ত্রণ
করে। এই রেস্টুরেন্টের সামনে এসে চব্বিশ পঁচিশজন একত্রিত হয়ে ডুমের ভিতর ঘুরে ঘুরে
ছবি তুলি। এখানে ছিলেন ভাতিজা মাহবুব, তার পত্নী ফারজানা,
পুত্র রায়হান ও রিদওয়ান, একমাত্র কন্যা
সারিনা। আর আছেন জাহেদ ও তার পত্নী জেবুন্নেছা, দু’কন্যা জাহরা ও জাকিরা। বিখ্যাত জিম্মি রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করি। ভিতরে
দেশ-বিদেশের অজস্র লোকজন, শিখ সম্প্রদায়েরও কয়েকজনকে একটি
টেবিলে বসতে দেখি। এই হোটেলে ইহুদি টুপিপরা কাস্টমারও দেখা গেল। হোটেলের ওয়াল জুড়ে
সারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ঐতিহ্যবাহী স্মারকমালা চিত্রায়িত রয়েছে। ভারতের তাজমহল,
আইফেল টাওয়ার, কুতুব মিনার, স্ট্যাচু অব
লিবার্টি, রুমের ক্যালাশিয়াম, গ্রীকের
জিউসের মন্দির, চীনের প্রাচীর, মাচু
পিচু, রেড ইন্ডিয়ান গ্রাম, ভ্যাটিকান
সিটি, ধ্যানরত বৌদ্ধ, ক্রুশবিদ্ধ যিশু,
শকটে বসা চেঙ্গিশ খান, ক্লিও পেট্টা, পিরামিড, বেবিলনের শূন্য উদ্যান সব রয়েছে।
খাদ্যবিদ্যা
এদেশে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কোন দেশের পর্যটনের উন্নয়নে বিষয়টি অঙ্গাঅঙ্গি
জড়িত। এই হোটেলে এক এক লাইনে এক এক ধরনের খাদ্যের সারি রয়েছে। লাইন ধরে নানা
ডিজাইনে খাদ্য, পানীয়
ফলমূল সাজানো। হাজার হাজার পাউন্ডের খাদ্য ব্যবসায়ী এই জিম্মি হোটেলের খাদ্য ও
কোয়ালিটি ম্যানেজমেন্ট গবেষণা সেল রয়েছে। আমাদের বিল আসে প্রায় ২০০ পাউন্ড। ঘণ্টা
খানিক হোটেলে অবস্থান করে বেরিয়ে আসি। ডোম হতে বের হয়ে এমিরাত এয়ারলাইনের
মালিকানাধীন কেবলকার চড়ে টেমস ও তার এক শাখানদী পার হই। কেবলকার এতো উপরে উঠে যে
পুরো লন্ডন শহর দৃষ্টিগোচর হয়। নদী, নৌকা, জাহাজ, শাখা নদী, পারের পার্ক,
মানুষের হাঁটাচলা দেখে দেখে গন্তব্যের প্লেটফরমে চলে আসি। বাইরে
টেমসের পারে জাহিদের বাসায় এসে ফল খাই। তারপর যাই বাংলাদেশে বর্তমানে অবস্থানরত
আসাদ ভাইয়ের তালা দেওয়া বাসায়। বহুদিন পর তালা খোলা হলো। পিছনের বাগানে চেরিফল
পেকে কালো হয়ে মাটিতে পড়ছে। পাকা চেরীতে ব্যাগ ভরে ফিরে আসি।
২রা জুলাই ২০১৭
রবিবার। লন্ডনের এক উজ্জ্বল সামারের দিন। সুদীর্ঘ আটারো ঘণ্টা দিন আর রাত
ক্ষনিকের। এখানে ২.৩০ এ.এম তে দিবস শুরু হয় এবং ৯.৩০ পি.এম তে মাগরিবের নামাজের
সময় হয়। ২৪ ঘণ্টার দিবসে রাতের পরিমাণ মাত্র ৬ ঘণ্টা। এতদীর্ঘ দিনে দেশটা আগুনে
পরিণত হবার কথা অথচ তাপমাত্রা তেমনটি নেই। ঘরে বাতাস পাখার প্রয়োজন হয় না। এখানে
সূর্য পূর্বাকাশে উদয় হলেও উত্তর আসমানে অবস্থান করে আবর্তিত হয়। ফলে সূর্যের
রৌদ্রে তাপের পরিমাণ অল্প। সূর্য কিরণ নিস্তেজ। আমাদের দেশে গ্রীষ্মকালে সূর্যটা
মাথার উপর খাড়াভাবে অবস্থান করে, ফলে রৌদ্র প্রচন্ড তাপ বর্ষণ করে। লন্ডনের সামার আমাদের বসন্তের মতো
আরামদায়ক। মৃদুমন্দ সমীরণ শরীরে আনন্দ শিহরণ তুলে, শুনলাম
এখানকার শীতকালটা সম্পূর্ণ উল্টো। তখন রাত শেষ হয় না, সূর্যের
দেখা মেলে না। এক অস্বস্থিতে হৃদয়মন আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। তখন রাত আঠারো উনিশ ঘণ্টা।
বিদঘুটে কালো রাত্রি। তখন দেশটা রাতের করাল গ্রাসে আপতিত হয়। এখানে নামাজ, খাবার-দাবার, ঘুম, অফিস,
স্কুল সময় আমাদের দেশের মতো দিবস ও রজনীতে ভাগ ভাগ করে সম্পন্ন করা
সম্ভব হয় না। শীতকালে সব কাজ রাতে এবং গ্রীষ্মকালে দিবসের শরীরে ঢুকে পড়ে।
আজ সকালে বের হয়ে
ভাগ্নী লিজার বাসায় যাই। এখানে লিজার স্বামী রোমন, পুত্র আরমান ও কন্যা আমিরার সাথে দেখা হয়। তাদের বাড়ি ছাতকের
শিমুলতলা গ্রামে। বাসাটি সুন্দর, এখানকার অন্যতম আকর্ষণ
তিনটি পোষা বিড়াল। এদের জন্য আলাদা খাবার কেনা হয় ও বাহিরে নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে
ওরা তাদের পয়ঃকর্ম সেরে আসে।
সন্ধ্যায় জাহিদ
আমাদেরকে একটি টার্কিশ হোটেলে দাওয়াত করে। সাথে সপরিবারে শরিক হন বড় ভাই, নিপা ও আফজল। তিনটি গাড়িতে করে যাই।
ইস্টলন্ডনের হোটেলের নাম ‘হোটেল সুলতান’। টার্কিশ নর-নারীরা এই হোটেল পরিচালনা করে থাকেন। সূচালো নাক, পটলচেরা চোখ, কালো চুল, চিকন-চাকন এই শ্বেত মেয়েদেরকে
অটোম্যান ইতিহাসের প্রখ্যাত সিনেমা সুলতান সুলেমানের হেরেমের মেয়েদের মতো লাগছিলো।
হেরেমের মেয়েদের পোষাক ছিল মধ্যযুগীয় তুর্কি, আর এই হোটেলের তুর্কি মেয়েদের পরনে
আধুনিক কালো রঙের প্যান্ট সার্ট। তাদেরকে অপরূপ লাগছিলো। হোটেলটিতে কাস্টমারের
প্রচন্ডভীড়। এই তুর্কী সুন্দরীদের গলদঘর্ম অবস্থা। নারী হওয়া সত্ত্বেও এরা পুরুষের
মতো ক্ষীপ্রগতিতে কাজ করে যাচ্ছে। মনে হলো এই অনিন্দ্যসুন্দরীরা যদি বাংলাদেশে
জন্মাতো তবে নিশ্চয়ই বড় লোকদের বেগম হতো। পালংকে শুয়ে আরামে দিন পার করতো। এভাবে
হাড়ভাঙ্গা খাঁটুনি দিতে হতো না।
টার্কিস সুলতান
হোটেলে ভূরিভোজ করে চলে যাই মামাতো বোন নিপার বাসায়। দুতলা বাসার উপরতলার বেডরুমে
একঘুমে রাত পার হয়। সকালে নামাজ পড়ে নাস্তা করে হাঁটতে বের হই। আমরা সবাই
ইলফিল্ডের ভ্যালেন্টাইন পার্কে ঘরে বেড়াই। বিশাল এক তালদিঘীর পাকা রাস্থা ঘেরা
চারপার পনের মিনিটে একদৌড়ে ঘুরে আসি। এযেন আমাদের রাজনগরের কমলারানির দিঘি। পানি
ভরা দিঘির তীরলেবেল ছোঁয়ে আছে। পার্কের ভুমি লেবেলে দিঘির পানি-লেবেল বেশ ভালই
লাগে।
দিঘিতে কয়েকটি
বুট রাখা। কয়েক ডজন রাজহাঁস, পাতিহাঁস, ছোট ছোট ছানা নিয়ে লেকের জলে সাঁতার কাটছে।
পার্কটিতে ব্যায়ামাগার ও টেনিস মাঠ আছে। ব্যায়ামাগারে কয়েক ধরনের ব্যায়াম করি বিশ
পচিশ মিনিট। সাইকেল রেস, রানিং, নৌকা বাওয়া ইত্যাদি সব ধরনের ব্যায়াম করি একটু
একটু করে। তারপর আরেকটি বুনোহাসের সরোবরে যাই। একটি ঘন জলাবন এই সরোবরের ভিতর
উপদ্বীপের মত ঢুকে আছে। এখানে মাছরাঙ্গা টুপ করে মাছ ধরছে। এই পুকুরে অনেক জাতের
বকও বিচরণ করে। সরোবরের পারে একটি সাইনবোর্ডে এই জলাশয়ে বিচরণকারী সব প্রাণী ও
পাখিদের সচিত্র বিবরণ রয়েছে। এবার হাঁটি হাঁটি পা পা করে ফিরে আসি আজকের নিবাস
পাশেই নিপার বাসায়।
ওয়েলস সফরঃ
ভাগ্নি চুন্নীর
শহর সোয়ান সি যাবার আমন্ত্রণ পাই। ব্রিটেনের পশ্চিমের ক্ষুদ্ররাজ্য ওয়েলসের
দ্বিতীয় প্রধান শহর এই সোয়ানসি। আট হাজার ষোল বর্গমাইলের ওয়েলস রাজ্যটি পশ্চিমে
আটলান্টিক উপকূলে ব্রিটিশ দ্বীপের একটি উপদ্বীপ। রাজ্যটির রাজধানী ও প্রধান শহর
কার্ডিফ। লোকসংখ্যা প্রায় তিন মিলিয়ন।
ভগ্নিপতি হুমাউন
তাদের ব্যবসা প্রতিস্টানের একজন কর্মচারী ও নিগ্রো ড্রাইভারকে লন্ডনে পাঠান। সোয়ান
সি হতে কালো জিপটি আসে বিকেল ৫টায়। ঘন্টা খানেক পর যাত্রা শুরু হয়। সোয়ান সি
শব্দের অর্থ সমুদ্রের রাজহাঁস। এটি আমাদের মৌলভীবাজার শহরের মতো একটি শহর।
আটলান্টিক হতে ঢুকে পড়া এক ছোট্ট উপসাগরের পারে শহরটির অবস্থান। প্রায় আড়াই লক্ষ
জনসংখ্যার এই শহরটি লন্ডন হতে আড়াইশ মাইল পশ্চিমে অবস্থিত। জিপটি ব্রিটেনের মসৃন
আটলেনের রাস্তা দিয়ে দ্রুত অগ্রসর হতে থাকে। পথে একটি রেস্ট হাউস এ নামি। রেস্ট
হাউসটি যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার প্রতিরূপ। তবে এখানে একটি বাড়তি সুবিধা দেখলাম তা
হলো কম্পিউটারাইজড ক্যাসিনো। দু’চার জন লোককে বসে বসে জুয়া খেলতে দেখলাম। রাস্তায় ক্রমান্বয়ে সুইন্ডন ও
ব্রিস্টল পার হলাম। ব্রিটেনের রাস্তার দু’পাশের দৃশ্য
যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার অনুরূপ। তিনটি দেশই শ্বেতাঙ্গদের হাতে গড়া উন্নত রাষ্ট্র।
কাজেই এসব দেশের আবাসন, রাস্তাঘাট, জীবন
বিন্যাস প্রায় একই পদ্ধতির ভিতর রয়েছে। ব্রিটেন প্রাচীন ও তুলনামূলকভাবে জনবহুল
রাষ্ট্র হওয়ায় এখানে রাস্তাগুলো সামান্য অপ্রশস্ত। কিন্তু এ দেশের যে ইতিহাস ও
ঐতিহ্যের যে প্রাচীনত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে তা যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার নেই।
যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা কেবল ইংরেজদের রীতিনীতিকে অনুসরণ করছে।
রাস্তার দু’পাশ গাঢ় সবুজ। সমতল নেই, উঁচু নিচু পাহাড় ও উপত্যকায় রূপালী গমক্ষেত, শস্যক্ষেত
ও বনবনানীর ছায়া। সামনে এক বিশাল সামুদ্রিক খাড়ি। এখানে সমুদ্র একটি মহানদীর মতো
ভূভাগের ভিতর বেশ কয়েক মাইল ঢুকে রয়েছে। এ যেন আমাদের চাঁদপুরের দক্ষিণের কুলহীন
মেঘনা। এই সামুদ্রিক খাড়ির উপর কয়েক কিলোমিটার দীর্ঘ সেভেন রিভার ব্রিজ। সেতু হতে
সমুদ্র পারে এক ব্রিটিশ শিল্পনগরী দেখা যাচ্ছে। ব্রিটিশ স্টিল কোম্পানি চোখে পড়লো।
সেতু পার হয়ে ওয়েলস রাজ্যে প্রবেশ করলাম, ব্রিটেনের দু’টি রাজ্যের স্পর্শ পেলাম।
ঘণ্টাখানিক পর
কার্ডিফের রাস্তার সাইনবোর্ড দেখলাম। পরক্ষণেই আমাদের জিপ একদিকে সুউচ্চ পাহাড় ও
অন্যদিকে সাগর পারের স্বর্গীয় সুন্দর রাস্তা দিয়ে অগ্রসর হয়। রাস্তাটি অনেকটা
আমাদের কক্সবাজারের হিমছড়ি উনানী সৈকত রোডের অনুরূপ। ব্রিটেনের এই সুন্দর পর্যটন
নগরীতে ঢুকে চোখে পড়লো সোয়ান সি ইউনিভার্সিটি। সুউচ্চ পাহাড় ও উপত্যকার বুক চিরে
বয়ে গেছে। দু’পাশের বাসাবাড়ি
বাণিজ্যকেন্দ্র সমুদ্রতীর পার হয়ে এক প্রাসাদাপম বাড়ির সামনে এসে গাড়ি থামে। বাড়ির
সামনে গাড়ি পাকিংয়ে ব্যবহার্য্য আটটি যান রয়েছে। পার্কিং লনটি এতো বড় যে এখানে
অনায়াসে বিশ-পঁচিশটি গাড়ি পার্ক করা যাবে। বাড়ির গেটটি প্রাচীন স্থাপত্যের ঐতিহ্য
ধরে আছে। কাঠের বড় সদর দরজা দিয়ে যুক্ত-ত্রিতল ভবনে ঢুকলাম। ভাগ্নিবর হুমাউন
আভ্যন্তরীন সিঁড়ি দিয়ে তিনতলা প্রাসাদটি চক্কর দিয়ে নিয়ে আসেন। একে একে গুণে গেলাম
বড় বড় বাইশটি কক্ষ, অসংখ্য বাথরুম, বারান্দা,
বাসাটির পিছনে সুবিশাল ঘাসের সবুজ লন, বৃক্ষ,
দোলনা ও ব্যায়াম ঘর। ছোট ছোট তরকারি ফলানোর প্লট। বাইরে আর আছে
গোদাম ও কাপড় ওয়াশিংয়ের ঘর। এযেন বাংলাদেশের সুবিখ্যাত কোন জমিদার বাড়ি। মনে হল আমরা
যেন হুমাউন আহমদের ‘অয়ময়’ নাটকের
জমিদার বড় মির্জার বা ঢাকার নওয়াব বাড়ির অতিথি হয়েছি। বাসাটি ছিল কিং জর্জের আমলের
এক জমিদার বাড়ি। চুন্নীর শ্বশুর আলহাজ মো. আব্দুল আহাদ সময়ে সুযোগে বাড়িটি কিনে
নেন। দুইশ বছর আগে রাজা জর্জের আমলে নির্মিত ভবনের আভ্যন্তরীণ কাঠের সিঁড়ি শক্ত ও
ঐতিহ্যময়। ড্রয়িং কক্ষ এতো বড় যে এটির ভিতর লন্ডন শহরের একটি ছোট বাসা ঢুকিয়ে দেয়া
যাবে। কিচেন যেন একটি আস্তো বাসা। ডাইনিং টেবিলে এক সাথে ২০ জন বসে খাবার ব্যবস্থা,
যেন এক হলরুম। শীত প্রধান দেশগুলোর ঘরের মেঝে কার্পেট মোড়ানো থাকে।
বিশাল অতিথি কক্ষে ঘুমাতে যাই। বড় খান্দানি কাঠের পালঙ্কটি মনে হয় কক্ষের সামান্য
জায়গা দখল করে আছে। কক্ষটিতে দুইটি হাতা চেয়ার, হাফসেট
সোফাসহ টেবিল ও বড় আলমিরা রয়েছে। তারপরও প্রচুর ফাঁকা জায়গা কক্ষটিকে একটি লনে
পরিণত করেছে। একটি দোলক ওয়ালঘড়ি দোলে দোলে সশব্দে টকটক করে সময় জানান দিচ্ছে।
ওয়ালে কলিমা অঙ্কিত চিত্রকর্ম। বিশাল কক্ষের তিনদিকে ফায়ার মেশিন শীত এলে তাপ দেয়।
চারদিকে জমিদারী
আমলের আভিজাত্য। এ যেন ব্রিটেনের আটলান্টিক পারে কোন এক বাংলাদেশীর স্বপ্নময়
জমিদারী। একটি সুন্দর সাজানো গোছানো একান্নবর্তী বড় পরিবার। এ ধরনের বিশ পঁচিশ
জনের বিশাল একান্নবর্তী পরিবার আজকাল বাংলাদেশেও খুঁজে পাওয়া যায় না। চুন্নীর জা
নিপা সুদক্ষ রাঁধুনী। রান্নার ড্রেস পরে যখন রাঁধতে যান তখন খুবই স্মার্ট ও চৌকষ
মনে হয়। সবাই কাজ করেন। ‘দশে মিলে করি কাজ, সবাই জিতি কিসে লাজ’। এখানে কাজ সহজ।
মাছ, মাংস, তরি তরকারি সব বাজার হতে
তৈরি ও প্যাকেটজাত হয়ে আসে। শুধু চুলার উপর কড়াইতে ফেলে দিলেই হলো। সদ্যপ্রয়াত হাজি
আব্দুল আহাদ ছিলেন একজন উদ্যোমী ও পরিশ্রমী ব্যক্তিত্ব। তিনি তার সব ছেলে-মেয়েকে
উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলেন। কেউ ব্যারিস্টার, কেউ
ডাক্তার, কেউ বা ম্যাজিস্ট্রেট। ছেলেবউ দু’জনই চিকিৎসক। তাদের শাশুড়ি মা অসুস্থ, পালাক্রমে
পুত্র ও পুত্রবধুরা সেবা করে যাচ্ছেন। বিলাতের মতো জায়গায় তা সত্যিই প্রশংসনীয়।
এতো মানুষের এই সম্মিলিত সুখী পরিবার দেখে অনুপ্রাণিত হলাম এবং ভালোই লাগলো।
আমাদের আগের প্রজন্মে জমিদারী আমলে এধরনের বড় সংসারের কাহিনি শুনতাম। ব্রিটেনের
পশ্চিম প্রান্তে সোয়ান সি এসে এ ধরনের এ যৌথ পরিবারের সাক্ষাৎ পেয়ে মনে হলো আমি
যেন এমনই এক লর্ড পরিবার বাস্তবে পেয়ে গেলাম।
ব্রিটিশদের
ঐতিহ্যপ্রীতি সর্বজনবিদিত। এই ঐতিহ্যমুখিতা রাজধানী লন্ডন হতে শুরু করে প্রত্যন্ত
এলাকা পর্যন্ত প্রসারিত। রাজা জর্জের আমলের জমিদার বাড়ির কাঠের সদর দরজা নষ্ট হয়ে
গেলে একটি সাধারণ দরজা লাগানো হয়। কাউন্সিল হতে নির্দেশ আসে আগের খান্দানি
ডিজাইনের দরজা লাগাতে হবে। এতো ভারী ও কারুকার্যময় দরজা নির্মাণে প্রচুর অর্থের
প্রয়োজন, এটা কাউন্সিলকে জানানো হলো। আর্থিক সামর্থ্য না থাকলে কাউন্সিল হতে
খান্দানি দরজা নির্মানে ভর্তুকী প্রদান করা হয়। শেষমেষ অনেক অর্থ খরচ করে রাজা
জর্জের আমলের ডিজাইনের অনুরূপ ভারী কাঠের দরজা নির্মাণ করে ভবনের সদর দরজা
প্রতিস্থাপন করতে হলো।
কিছু দিন আগে
স্বপ্নে এক বিশাল ভবনে সপরিবারে বিচরণ করতে দেখি। এই বাড়িটি স্বপ্নে দেখা সেই
বিশাল বাড়ির প্রতিচ্ছবি মনে হলো। সিলেটের সিভিল সার্জনের বড় বাসাসহ অনেক চা
বাগানের বড় বড় বাংলোতে রাত কাটানোর অভিজ্ঞতা আমার রয়েছে। অথচ মনে হলো ওয়েলসের এই
বাড়িটি যেন আমার জীবনকালে ঘুমানো সর্ববৃহৎ বাড়ি।
৪ঠা জুলাই ২০১৭, মঙ্গলবার। সকালে ঘুম হতে ওঠে ঝিরি
ঝিরি বৃষ্টির দেখা পাই। মৃদু ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব। চুন্নী ছোট্ট কার চালিয়ে আমাকে
নিয়ে বের হয়। নাতি ইশরাকের অভিজাত স্কুলে যাই। ইশরাত বাংলাদেশে অবস্থান করে মাত্র
এগার বছর বয়সে কোরান হাফিজ হয়। মৌলভীবাজারের কচুয়া জামে মসজিদে এই বালক হাফিজের
পিছনে তিনরাত তারাবির নামাজ পড়ি। বাংলাদেশে টুপি ও লম্বা পাঞ্জাবিপরা ইশরাতের এখন
আর সেই ক্ষুদে হুজুরের বেশ নেই। এখন সে একটি নামী-দামী স্কুলের স্মার্ট স্টুডেন্ট।
তার বাৎসরিক টিউশন ফি দশ হাজার পাউন্ড।
বাসায় ফিরে হুমাউন বড় জিপে আমাদেরকে সোয়ানসি শহরের পর্যটন ও গ্রাম এলাকা
দেখাতে বের হন। তিনি আমাদের সুন্দর সৈকত ঘেরা গাওয়ার পেনিনসুলায় নিয়ে যান। পথে
চোখে পড়ে বড় বড় ভেড়ার খামার। খামারগুলোর চারদিকের বেড়া প্রাকৃতিক বন দ্বারা
নির্মিত। সাদা লোম বিশিষ্ট বেশ রিষ্টপুষ্ট ভেড়া। বাংলাদেশের ভেড়া এতো সুন্দর হয়
না। জিপ যাবার সরু রাস্তা ঘনো বনে আবৃত। উঁচু নিচু সবুজ পাহাড়, ঘাসের গালিচা দিগন্তহীন আটলান্টিক মহাসাগরের সাথে একাকার হয়ে অপূর্ব
সৌন্দর্য্য বিতরণ করছে। সাগরপারের এক পাহাড়ে অবতরণ করি। এই জায়গার নাম ঞযৎবব বষরঢ়
নধু. সামনে সমুদ্রে উটের আকৃতি বিশিষ্ট একটি ক্ষুদে দ্বীপ রয়েছে। এই পাহাড় হতে অনেক
নিচে সাগরের স্বচ্ছ জলের ঢেউ দেখা যাচ্ছে। মৃদু বাতাস বইছে। এখানে পাহাড়ের ঢালুতে
ধাপে ধাপে অসংখ্য ক্যারাভান গাড়ি রাখা। অসংখ্য তাবু টাঙ্গিয়ে যাযাবরদের মতো অসংখ্য
পর্যটক নরনারী অবস্থান করছেন।
এই সুন্দর
সামুদ্রিক পাহাড়ের মালিক এখানে তাবু ও ক্যারাভান রাখার জায়গা ভাড়া দিয়ে প্রচুর
অর্থ আয় করেন। আমি বললাম এখানে হোটেল রিসোর্ট তৈরি করলে বেশি আয় হতো। হুমাউন বললেন
সরকারি অনুমতি নেই। এখানে কোনো বিনিয়োগ ছাড়াই প্রচুর উপার্জন হচ্ছে। তাছাড়া
ক্যারাভান কিংবা তাবুতে থাকা লোকজন হোটেলে যাবে না। তারা এভাবে যতোটুকু সম্ভব প্রকৃতির
কাছাকাছি থাকতে পারে; হোটেল
বা রিসোর্টে থেকে তা সম্ভব নয়।
এখানে গ্রেট
ব্রিটেন ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশের লোকজন আসেন। কারাভ্যান গাড়ি নিয়ে দলবেঁধে পর্যটকরা
আসেন। পাহাড়ের মালিক ছোট ছোট রেস্টহাউস তৈরি করে দেন। এখানে টয়লেট ও গোসলের কাজ
চলে। ক্যারাভান গাড়িতে ডাইনিং, সিটিং ও স্লিপিং বেড রয়েছে। কোনো কোনো গাড়িতে গোসল ও টয়লেটের ব্যবস্থাও
আছে। এখানে প্রকৃতি ও মানুষ পরস্পর একাকার হয়ে যায়; যেমন
বনের সাথে পাখি ও জলার সাথে হাঁস একাকার হয়। সুনশান পাহাড়, পাদদেশে
শান্ত স্নিগ্ধ সমুদ্রে জোয়ান, বুড়া, নর-নারী
ও শিশুরা মনের আনন্দে প্রকৃতির সৌন্দর্য্যভূমে অবসর দিনে ঘুরে বেড়ায়। সাগরের নীরবতা
ভেদ করে দু’চারটা সীগাল আকাশে উড়ে বেড়ায়। এই সৈকত হতে ফেরার
পথে চেরিবাগান, বিটক্ষেত, গমক্ষেত,
গরু ও ঘোড়ার খামার, ভেড়ার খামার ও ভূট্টাক্ষেত
দেখি। এখানে পাহাড়ের ধাপে ধাপে ও উপত্যকায় প্রচুর ঘাস হয়। ঘাস আহরণ করে
প্রক্রিয়াজাত করে বড় বড় কালো পলিথিন ব্যাগ ভরে সংরক্ষণ করা হয়। বরফ ঢাকা শীতের তিন
মাস বৃক্ষপাতা ঝরে যায়, ঘাস মরে যায়। এই কঠিন তিন মাস গরু,
ঘোড়া ও ভেড়া এই ঘাস খেয়ে বেঁচে রয়।
সোয়ানসি একটি
উঁচু পাহাড়িয়া শহর। সমুদ্র হতে বেশ উপরে শহরটির অবস্থান। পাহাড় যেন ধাপে ধাপে নেমে
আটলান্টিক মহাসমুদ্রে এসে শেষ হয়েছে। সামনে বার্ধক্যনিবাস, ব্রিটেনে লোকজন বেশিদিন বেঁচে থাকে।
এখানে নব্বই উর্দ্ধ ও শতায়ু লোকজনের বিচরণ স্বাভাবিক ঘটনা। লোকেরা সাধারণত সত্তুর
আশি বছর পর্যন্ত কর্মক্ষম থাকেন। পুরো ওয়েলস্ রাজ্যটাই এক পার্বত্য উপদ্বীপ।
গ্রীষ্মে সর্বক্ষণ পিনপিনে মেঘঝরে ও শীতে তুষারপাত হয়। আবহাওয়া ঠান্ডা। সমুদ্র
উপকূল পাহাড়ি ও ভঙ্গুর।
এবার একটি সি বিচে
যাই। বিচটি দেখতে অনেকটা আমাদের হিমছড়ির মতো পাহাড় ও সমুদ্র ঘেরা। তবে বিচটির
অবস্থান খাড়া পাহাড়ের পাদদেশে নিম্নভূমিতে। পিছনের পাহাড়কে অপূর্ব দেখাচ্ছে। এখানে
পাহাড়ে একজন বৃদ্ধ বড়শি দিয়ে মাছ ধরছেন। নিচে এক বৃদ্ধা কুকুরকে সমুদ্রে গোসল
করাচ্ছেন। ইংরেজ বৃদ্ধার কুকুরটি বরশীর সুতায় পেছিয়ে গেলে দু’জনের মধ্যে ঝগড়া শুরু হয়। ব্রিটেনে এই
প্রথম দেখা ঝগড়া বেশ উপভোগ করি। বুডো ইংরেজের উত্তেজিত মোটা সুর ও বৃদ্ধার চিকন
গলা সাগরের বাতাসের সাথে ঝংকার তুলে। ওয়েলস ভাষার ঝগড়া, কিছুই
বুঝিনি, তবে হুমাউনকে বুড়ার কাধে হাত রেখে হাসতে দেখলাম,
এক সময় এই বৃদ্ধ নাকি তাদের হোটেলে কাজ করতেন। ইংরেজদের রাগ
বেশিক্ষণ থাকেনা। কিছুক্ষণ পর একটু হাসাহাসি করে তারা নিজ নিজ কাজে মনোনিবেশ করেন।
পাহাড়ি ঢালু পথ দিয়ে নেমে সৈকতে গেলাম। সৈকতের বেলাভূমিতে জগিং করে দশ পনের মিনিট
নিঃশেষ হয়ে গেল। সাগরপারের খাড়া পাথুরে সবুজ পাহাড়কে সামনে রেখে অনেকগুলো ছবি
উঠাই। হুমাউন বললেন, এখানে যদি একটি নৌকায় চড়ে সোজা পশ্চিমদিকে চালাতে থাকেন তাহলে
কলম্বাসের মত আমেরিকায় পৌঁছে যাবেন।
এখানে সমুদ্র
তীরবর্তী একটি হোটেলে কফি পান করি। কাটের মেঝে ও গ্লাসের ওয়ালঘেরা টিন ছাদের
বারটির ডিজাইন অসাধারণ। মনে হয় হোটেলটি সাগরের ভিতর ঢুকে আছে। এখানে কর্মরতা টিনএজ
মেয়েরা কালো প্যান্টসার্ট পরিহিত। কালো পোষাকে এই শ্বেতাঙ্গিনী চিকন সুন্দরী
মেয়েদেরকে অপরূপা লাগছিলো। কালোরঙের পোষাকের ভিতর দুগ্ধধবল চর্ম ও সোনালি চুল যে
হা-মেলে হাসছে।
আসার পথে
সমুদ্রতীরে বিমান চালানো শেখার স্কুল দেখলাম। মিনিকারের মতো দুই/তিন সিটের প্লেন।
হুমাউন বললেন- মামা, দু’এক মাস এখানে থেকে এই ক্ষুদে বিমান চালনা শিখে সমুদ্রের উপর উড়াউড়ি করতে
পারবেন। বললাম- জীবনে অনেক উড়েছি, আর না। এবার সোয়ানসি
শহরের কেন্দ্রে এসে হুমাউনের মালিকানাধীন ইন্ডিয়ান হোটেল ‘মহারানি’
পর্যবেক্ষণ করি। অতি সুসজ্জিত হোটেলটি ডিজিটাল ও অটোমেটেড। সেল
পয়েন্ট মেশিনে লেনদেন হয়। সুইচ টিপলেই পানীয়, ফ্রুট জুস,
ওয়াইন, কপি, পাত্রে চরে
আসে। রান্নাঘর অতি পরিচ্ছন্ন ও স্বাস্থ্যকর। নানরুটি ও তন্দুরী তৈরির স্থান আলাদা।
এবার তাদের পরিচালিত বড় মেঘাসপ দেখতে যাই। রাস্তার লেভেলে বড় শো-রুম ও নিচ তলায়
গোডাউন ও হিমাগার। আমাদের দেশের ‘স্বপ্ন’র শো-রুমের মতো এখানে হাজার হাজার পাউন্ডের নিত্য প্রয়োজনীয় মালামাল
রয়েছে। শহরের এপ্রান্তে হুমাউনদের অনেক বাসা বাড়ি ও দোকান ভাড়া দেওয়া আছে।
এবার বাসায় ফিরলাম। ইংরেজ জীবন নিয়ে কথা হলো। ইংরেজরা বাচ্চাদের খুব
স্নেহ যত্নে বড় করে। লেখাপড়া শেখায়। অথচ বাচ্চারা বড় হলে হারিয়ে যায়। এ যেন সেই মোরগীর
মতো যে বাচ্চাদের খুব ভালোবাসে, আলগে রাখে। শিয়াল বা চিল
বাচ্চার উপর হানা দিলে প্রাণ ভয় ভুলে গিয়ে শিয়ালের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। অথচ সেই মা
মুরগীই বাচ্চা বড় হলে মেরে তাড়িয়ে দেয়। ইংরেজরা বুড়ো বয়সে একাকী হয়ে পড়ে, ছেলে-মেয়েরা খবর রাখেনা। চুন্নীর ভাষ্য, এটা আল্লাহর
সিস্টেম। আমাদের দেশে বুড়ো মা-বাবাকে আল্লাহ সন্তান দিয়ে প্রতিপালন করান, আর উন্নত দেশে বুড়োদেরে রাষ্ট্রকে দিয়ে পরিপালন করিয়ে যান।
এবার চুন্নীর
মেঘাসপের ড্রাইভার আহমদ নাদিভ আমি জেফার ও নুরজাহানকে নিয়ে লন্ডনের পথে যাত্রা
করেন। উঁচু পাহাড়ের উপর নাদিভের পরিবার বসবাস করেন। চল্লিশ বৎসর বয়সী নাদিভ সুদানি, তাঁর পত্নীও একজন নিগ্রো সুদানি
মহিলা। তাঁর ভীমকালো পাঁচ পুত্রকে এক মাঠে ফুটবল খেলতে দেখলাম। সবগুলো একই চেহারার।
এ মাঠ থেকে নাদিভের এক কালো চাচাতো ভাই সামনের সিটে এসে বসলো। সামনে দু’জন কালো আফ্রিকান এবং আমরা তিনজন বাদামী এসিয়ান পিছনের সিটে বসে আছি। সাঁ
সাঁ করে গাড়ি পূর্বদিকে লন্ডনের পানে ছুটে যাচ্ছে। পথে ঐ আগের জায়গার রেস্ট রুমে
থামলাম। কপি পান করে বাথরুম সেরে আবার ছুটলাম। রাতের অন্ধকার গায়ে মেখে মেখে
লন্ডনের ডাগেনহাম ইস্টে ভাইয়ের বাসায় এসে নামলাম।
দুইভাগ্না লবিদ ও
হুদহুদের বাসা গমনঃ
০৫ জুলাই ২০১৭
সাল বুধবার। রাত পোহালে রুটিন মাফিক পাশের পার্কে এক ঘন্টা হাঁটি ও তারপর মার্কেটে
কেনাকাটায় যাই। দুপুরে ইস্টলন্ডন লবিদের বাসায় দাওয়াত খেতে যাই। লবিদ আমার বড়
বোনের ছেলে ও জৈষ্ট ভাগনা। তাদের দেশের বাড়ি দরগামহল্লা, সিলেট। লবিদের দুই ছেলে ও
এক মেয়ে। ভাগনা বউ মৌলভীবাজারের মেয়ে ও সে লন্ডনের স্কুলটিচার। ইস্ট লন্ডনে তাদের
পাঁচ বেডরুমের তিনতলা বাড়ি। এখানে বাংলাদেশের বহুপদের রান্না খাবার খাই। এসবে মাঝে
শিম বীজ ভাজি ও জলপাইয়ের খাট্টাও রয়েছে।
এইবাসা হতে বের
হয়ে লবিদের অনুজ ভাগনা হুদহুদের দক্ষিন লন্ডনের বাসায় যাই। এবাসায় ভিন্ন ভিন্ন
স্বাধ ও গন্ধ বিশিষ্ট কয়েকধরনের পানীয়তে একটু একটু করে চুমুক দেই। পানীয়গুলোর নাম 1. Tonik Water 2. Lima Cardian 3. Soda Water 4.
Ginger Ale 5. Bitter Lemon 6. Lemonade 7. Sparkling Sampaine 8. Diet Cooke
এসব পানীয়
সরোবরের মধ্যে Sparkling
Sampaine হচ্ছে এক ধরনের
হালাল মদ। এতে কোন এলকোহল নেই, তাই নেশা হয়না। অথচ এতে শতভাগ মদের স্বাধ ও ফ্লেবার
রয়েছে। এসব উন্নত দেশে এত এত প্রকার পানীয় তৈরি হয় যে আমাদের মত গরিব দেশের লোকজন
তার খবরও জানেনা। জীবনে এই প্রথম হালাল মদে চুমুক মেরে আসল মদের স্বাধ ও গন্ধ গ্রহণ
করি।
হুদহুদের সুন্দর
বাসার মালিক একজন নিঃসং বৃদ্ধ। তার বাড়ি শ্রীরামশি, জগন্নাথপুর। বললেন ১৯৭১ সালে
পাকবাহিনীর হাতে তার গ্রামের অনেক লোক শহীদ হন। তিনি তখন লন্ডনে থাকায় বেঁচে যান।
তার জীবন ট্রাজেডিতে ভরা। এক সময় স্ত্রী ও পুত্রকন্যা নিয়ে তার সুখের সংসার ছিল।
অকালে স্ত্রী-পূত্র-কন্যা সব হারিয়ে আজ তিনি একা। তার প্রচুর ধনসম্পদ আছে কিন্তু
কোন বংশধর নেই। তার সঙ্গি বলতে আমার ভাগনা ও ভাগনা বউ। ভাগনা বউ হাউজিং এস্টেটের জুলকারনাইন
খন্দকারের একমাত্র কন্যা-------। তাদের ফুটফুটে এক দুগ্ধধবল কন্যা হামাগুড়ি দেয়,
হাসে ও কথাবলার চেষ্টা করে।
নিঃসঙ্গ বৃদ্ধ
বাসাভাড়া পান চার হাজার পাউন্ড। বার্ধক্যভাতা যা পান তাই খরচ হয়না। তার কেবল টাকা
জমানোর অভ্যাস। তবে দেশে তিনি তিন চারটি মসজিদ নির্মান করে পরকালের জন্য কিছুটা
সঞ্চয় জমা রেখেছেন।
আমি ইংরেজদের
ভদ্রতা ও সৌজন্যের প্রশংসা করি। তাদের রাগ নেই, মস্তিস্ক ঠান্ডা রেখে কাজ করে।
আমার প্রশংসাবানী শুনে হুদহুদ কিছুটা কটাক্ষ্য করে বলল, রাগবে কেন, এরাতো Brooker জাতি, দালালি করে খায়। অভদ্রতা
দেখালে কিংবা চটে গেলে অন্যকে ঠকায়ে পকেট ভারী করা কি সম্ভব।
লন্ডন হতে ফেরার
প্রক্ষালেঃ
০৬ জুলাই ২০১৭
সাল। লন্ডনের এক উজ্জ্বল সামার মর্নিং। জ্যৈষ্ঠ ভাই তাহমিদ চৌধুরীর বাসার পিছনের
বাগানে নানা ধরনের ফুল ফুটে আছে। সবগুলো বাসার বাগান মিলে পিছনে এক নয়নাভিরাম
কুসুম্বাগ তৈরি হয়েছে। সীমানার বাহিরের বড়গাছ জুড়ে থোকা থোকা সাদা ফুল। সামারের
এলোমেলো বাতাসের ধাক্কায় নিচে ঝরে ঝরে পড়ে মেঝের উপর পুস্প আস্তরণ তৈরি করছে। এই
আস্তরণ প্রতিদিন ঝাড়ু দিয়ে পরিস্কার করতে হয়। এত কুসুম দেখে মাকে মনে পড়ে গেল,
তিনি ফুল খুব ভালবাসতেন। তিনি আজ নেই, বেঁচে থাকলে নিশ্চয় আমাদের সফরসঙ্গী হতেন। এই
পুস্পমেলা দেখে অবশ্যই আনন্দ পেতেন। সকালে বিমভেলী খরগোস বনে নিয়ম মাফিক একঘন্টা
আমরা তিনজন প্রাতঃভ্রমন করি। জগিং করে ঘেমে বাসায় ফিরে গরমজলে গোসল করি। তারপর
কেলগেরি জুস, পান করে কিনাট, চকলেট এবং হোজলনাট খেয়ে ঘুমিয়ে যাই। ঘুম ভেঙে গেলে
মজাদার দেশী মুড়ির মোয়া খাই। আজকে সিদ্দিক, জাহিদ, নিপা, আফজল ও বাদশা ভাই সহ অনেক
আত্মীয় এসে একে একে আমাদেরকে বিদায় জানান।
০৭ জুলাই ২০১৭
সাল, শুক্রবার। ঐদিন সকালে আজফার ও নওসিন ভোরে এসে আমরা দু’জনকে সালাম করে অফিসে
চলে যায়। আজ চলে যাবো, তাই তাদের সাথে আর দেখা হবেনা। গতরাত ভাই ও ভারী আমাদের
সুটকেস গোছগাছ ও বাঁধাবাঁধি করে দেন। তাই আমাদের কোন দুশ্চিন্তা করতে হয়নি।
স্বপ্নের শহর
লন্ডন। অনেক অনেক গল্প কথার রঙ্গীন শহর এই লন্ডন। ১৯৯১ সালে এই শহরের একটি কলেজে
ভর্তি হয়েও স্পন্সরের দুর্বলতায় ভিসা পাইনি। অনেক আত্মীয়স্বজন, পাড়া-পড়শী ও বন্ধু-বান্ধবের
জীবন ও জীবিকার এই শহরটি আল্লাহপাকের মেহেরবানীতে প্রাণভরে দেখলাম। এই মহানগরীর
আভ্যন্তরীণ সৌন্দর্য্য ও জ্ঞানের আলোকরশ্মির উজ্জ্বল জ্যোতি দেখে বিমুগ্ধ হলাম।
বিশ্বসভ্যতার
অগ্রযাত্রায় এই শহরের অবদান বিস্ময়কর। অসংখ্য ইতিহাসখ্যাত বিজ্ঞানী, গবেষক, উদ্ভাবক,
কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক ও জ্ঞানী গুণী মানুষের চর্চা ও চারণভূমি এই লন্ডন। এই
লন্ডনের জ্ঞান সমুদ্রের সৃষ্টি বৈজ্ঞানিক নিউটন, উদ্ভাবক জেমসওয়াট, কার্লমার্কস,
শেক্সপিয়ার, টি এস ইলিওট, চার্লস ডারউইন, স্টিফেন হকিং, বারটান্ড রাসেলের মত
ইতিহাস ও সভ্যতার গতি পরিবর্তনকারী মনিষীবৃন্দ। এই লন্ডন গণতন্ত্র, মুক্তচিন্তা ও
জ্ঞানবিজ্ঞানের এক সুপ্রাচীন সুতিকাগার। এশহরের এই জ্ঞান ঐতিহ্যের ধারা আজও বহমান।
ভাই তাহমিদ চৌধুরী ও আফজল মালামাল হিথ্রোর বেল্টে তুলে দিয়ে বিদায় নেন। লন্ডন
বিকেল ৩টায় যাত্রা সুরু করে পরদিন সকাল বেলা সিলেট বিমান বন্দরে অবতরণ করি।
দেশে ফিরলাম। তবে
লন্ডনকে মনে পড়ে, লন্ডনকে কি সহজে ভুলা যায়। গ্রেট বৃটেন, যে দেশটির বিশ্বে টিকে
থাকার সক্ষমতা অন্যান্য ইউরোপীয় জাতির চেয়ে অনেক বেশি। খৃস্টপূর্ব ৫৫ সালে রোমান
সম্রাট জুলিয়াস সিজার দেশটি দখল করে নেন। ৪১০ খ্রিস্টাব্দে রোমান শাসনের অবসান হলে
আর কোন শক্তি দেশটিকে পরাধীন করতে পারেনি। ষোড়শ শতাব্দীতে স্পেন যখন বিশ্বশক্তি
স্পেনের রানি ইসাবেলা তখন ইংল্যান্ড দখলে স্প্যানিশ আর্মাডার ১৩০টি জাহাজ বহর
প্রেরণ করেন। ইংলিশ সেনাপতি নিলসনের হাতে ১৫৮৮ সালে স্প্যানিশ আর্মাডা বিদ্ধস্থ
হয়। এই যুদ্ধজয়ের পর বৃটেন ইউরোপের শ্রেষ্ট নৌশক্তিতে পরিণত হয়।
ফরাসি সম্রাট
নেপোলিয়ন সারাটা ইউরোপ পদানত করলেও বৃটেনকে বশে আনতে সক্ষম হননি। একজন তৃতীয় শ্রেণির
বৃটিশ সেনাপতি Gebhard L. Von এর হাতে ইউরোপ বিজয়ী সম্রাট নেপোলিয়ন ওয়াটারলুর
যুদ্ধে ১৮১৫ সালে শোচনীয়ভাবে পরাজিত ও বন্দি হন।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলাকালে ইউরোপ
দখলকারী এডলফ হিটলারের বিজয়রথ বৃটেনে এসে থেমে যায়। শত শত নাজি যুদ্ধবিমানের হামলা
বৃটেনের মনোবল বিন্দুমাত্র টলাতে পারেনি। এই ছোট দেশটি এখনও যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও
রাশিয়ার পর পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সামরিক শক্তি।
সুপ্রাচীন রাজতন্ত্র, মধ্যযুগের
লর্ডতন্ত্র, ঐতিহ্যবাহী ও আধুনিক গণতন্ত্র সবকিছু একসাথে ধারণ
করে মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে আছে আজকের বৃটেন। বৃটিশ রাজতন্ত্র সম্পর্কে একটি কথা
প্রচলিত, একসময় পৃথিবীতে টিকে থাকবে কেবল দুইজন রানি, এক- তাসের রানি এবং দুই- ইংল্যান্ডের
রানি। দুই সাপ্তাহ এই গর্বিত ও সফল জাতির সাথে সহবস্থান করে অভিজ্ঞতার ঝুড়িকে
সামান্য হলেও সমৃদ্ধ করলাম। স্মৃতিময় বৃটেন, তোমাকে আমরা ভূলবনা কোনদিন। গ্রেট,
গ্রেট, গ্রেট বৃটেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন