আমার মমতাময়ী বড়বোন আনিকা মৌলা বেগম চৌধুরী রেহার
মহাপ্রয়াণ, আমার একজন শ্রেষ্ট শুভাকাংখী ও স্নেহময়ীর চিরবিদায়ঃ
জন্মঃ ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দ
মৃত্যু তারিখঃ ৩রা সেপ্টেম্বর
২০১৭ রাত ৭টা ৩০ মিনিট
মৃত্যুস্থানঃ ইউনাইটেড হাসপাতাল,
ধানমন্ডি, ঢাকা।
তার আসল নাম আনিকা মৌলা চৌধুরী,
ডাকনাম রেহা। আমার চেয়ে বছর দশেক বড় এই জৈষ্ট্যা বোনকে আমরা সবাই আদর করে ডাকতাম
ফুলবুবু। উচ্চতায় খানিকটা বেঁটে হলেও তিনি ছিলেন প্রস্ফুটিত গোলাপের মত সুন্দর।
গাত্রবর্ণ গোলাপি, চেহারাটা গোলাকার। তার ছিল সরল চাহনি, সাদা মন। মস্তিষ্কে ছিলনা
কোন জিলাফির প্যাচ। তিলকে তাল করা কিংবা তালকে তিল করা তার স্বভাবে ছিলনা। পৃথিবীর
সবই দেখতেন তিনি সরল রেখায়। তার রাস্থা ছিল সিরাতুল মুস্তামিক। বার্ধক্যের কোন ছাপ
শরীরে আচর কাটার আগেই ৩রা সেপ্টেম্বর ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি মাত্র ষাট বৎসর বয়সে পৃথিবী
হতে অকালে বিদায় নেন।
দুই.
১৯৫৪ সালের ২৫ মার্চ আমার
মাবাবার বিয়ে হয়। আম্মার কাছে শুনেছি এই বিয়ের বছর তিনেক পর ১৯৫৭ সালে সুনামগঞ্জ শহরে আব্বার কর্মক্ষেত্র
সুরমাপারের অফিস কাম বাসায় এই বোনের জন্ম হয়। নবজাতকটি ছিল অন্য দশজন শিশুর তুলনায়
স্বল্পকায়া ও দুর্বল। জন্মের পরমূহুর্তে তার শারীরিক অবস্থা ছিল শংকটাপন্ন,
শিশুটির গায়ের রঙ্গ দ্রুত বদলাতে থাকে, এই নীল এই লাল এই সাদা। নিঃশ্বাস নিতে তার বেশ
কষ্ট হচ্ছিল। উপস্থিত লোকজন ধরেই নেন, এই নবজাতক বেশিক্ষণ বাঁচবেনা। তাই তাড়াহুড়া
করে একটি খাশী কিনে এনে আকিকা করা হয়, যেন শিশুটি জীবন্ত থাকাকালেই সুন্নাত আদায়
হয়।
তিন.
আব্বা চাকুরি ছেড়ে সুনামগঞ্জ হতে
জন্মভূমি দাউদপুর চলে এলে তিনি ভর্তি হন তুরুকখলা পাঠশালায়। চাচাত মতিভাই ও ফলোকা
আপা একই ক্লাসে পড়তেন। পরবর্তী ক্লাসে ছিলেন আমার বড়ভাই তাহমিদ ও সেজোবোন সেহা। দাউদপুরের
বাড়ি হতে এই চারজন শিশু একসাথে পাঠশালায় আসা যাওয়া করতেন। মতিভাই ছিলেন দুষ্ট,
তিনি তাদেরকে প্রায়ই ভুতের ভয় দেখাতেন ও সবাইকে নিয়ে পাঠশালা পলায়ন করতেন। এখানে
থাকা ফুফুত রেজাভাই ছিলেন তাদের গবর্নর, চিরকুমার কালিমাটির চাচা মখলিসুর রহমান চৌধুরী ছিলেন
গৃহশিক্ষক। আমি যখন শৈশবে তাদের পাঠশালার পাঠ তখন শেষ হয়ে যায়। শৈশবে আম্মা সংসারের কাজে ব্যস্ত হলে এই বড়বোনরা আমাকে স্নেহযত্নে
দেখাশুনা করেন।
চার.
তখনকার চার ভাইবোনের মধ্যে আমি
ছিলাম ছোট, তাই সবার আদরের। আমি জৈষ্ট্যা বোন রেহা ও ফলখা আপার কোল চড়তাম। মনে পড়ে
এই বড়বোনেরা আমাকে কাঁধে বসায়ে আঙিনায় দৌড়াতেন। মেঝবোন সেহা একটু চালাক, তিনি
বিছানায় মড়ার মত শুয়ে থাকলে ফুলবুবু গিয়ে নাকে হাত দিয়ে দেখতেন নিঃশ্বাস চলছে
কিনা, তারপর বুকে হাত দিয়ে দেখতেন হৃদকম্পন হচ্ছে কিনা। এবার চিৎকার দিতেন, আম্মা
জলদি এসো, সেহা কেমন যেন করছে। আম্মা আসার আগেই খিলখিল করে হেসে উঠতেন সেহা। আমিও
অনেকবার এভাবে মড়ার ভান করে তাকে খুব দুচিন্তায় ফেলে দিতাম।
একসময় রেহা, সেহা ও তাহমিদ তিন
ভাইবোন মোগলাবাজার উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি হন। আব্বার পিছুপিছু হেঁটে হেঁটে দেড়মাইল
দূরে বিদ্যালয়ে যাওয়া আসা করেন। সহপাঠিদের নানা সুখগল্প শোনে অনেকের নাম আমার
মুখস্ত হয়ে যায়। তাদের কয়েকজন সহপাঠিনী সখীরা আমাদের বাড়ি আসতেন। আমার বোনেরাও
তাদের বাড়িতে মেহমান যেতে বাধ্য হতেন। তাপসী দিদি, শারিকোন আপা তাদের অন্যতম। আমিও
লাফ দিয়ে কত যে তাদের পিঠে চড়ে বসেছি।
পাঁচ.
আমি ফুলবুবুর কাঁধ ছেড়ে যখন পীঠে
চড়ি, তখন তার বিয়ে হয়। সময়টি ১৯৭৫ সালের ফালগুন মাস। আমার বয়স নয় হতে দশ, সবেমাত্র
পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র তখন তার বিয়ে হয়। এই বিয়ের কথা আমার লিখা হয়ে গেছে তাই এখানেই
থাক। তার বিবাহ হয় সিলেটের মুফতিবাড়ি, দরগামহল্লায়। বর মুফতি মোঃ খালিদ। বালক
আমাকে এই বিয়ে যারপরনাই মানসিক যন্ত্রণা দেয়, ঘর হতে বড়বোনের চলে যাওয়া নাবালক আমি
অনেকদিন পর্যন্ত মেনে নিতে পারি নাই। বোনের জন্য আড়ালে আড়ালে গিয়ে সবার অন্তরালে
চোখ মুছতাম।
ছয়.
সরকারী কোহিনূর কেমিক্যাল
কোম্পানিতে চাকুরি করতেন প্রকৌশলী দোলাভাই মুফতি মোহাম্মদ খালিদ। কারখানা ঢাকার
টঙ্গি শিল্প এলাকায়। এবার পারি জমান রাজধানী ঢাকায়। আমি কখনও তাদের ঢাকার খিলগাঁও
চৌধুরীপাড়ার ভাড়া বাসায় যাইনি। তাদের ঢাকাজীবনের কোন স্মৃতি আমার নেই। তখন বছরে
দুই একবার তারা সিলেটে আসতেন এবং বেশ কিছুদিন দাউদপুরে থাকতেন। তাদের সাথে
ফরিদপুরী একজন চঞ্চল কাজের ছেলে আসত। নামটা তার মনে পড়ে আঙ্গুর। সে হাফপেন্ট ও
হাফসার্ট পরত। আঙ্গুর ও আমি খেলা করতাম, বড় পুকুরে সাতার কাটতাম। আমরা সব সময়
দাউদপুরে তাদের আগমনের অধীর অপেক্ষায় দিন গুণতাম।
তখন টেলিফোন ছিলনা। আম্মা তার
বড়মেয়ে রেহার পত্রের অপেক্ষায় প্রতিদিন ডাকঘরে লোক পাঠাতেন। যেদিন চিটি আসত হলুদ
খাম খোলে পত্র হাতে নিয়ে আম্মা এত খুশী হয়ে পড়তেন যেন তার মেয়েকেই পেয়ে গেছেন।
চিটির উপর আটা দিয়ে লাগান থাকত বৈচিত্রময় নানান জাতের ডাকটিকেট। দেশ বিদেশের এসব
ডাকটিকেট সংগ্রহ করে আমরা গাম দিয়ে খাতার পাতায় এঁটে দিয়ে এলবাম তৈরি করতাম।
চিটি লিখার স্টাইল ছিল এরকম,
আম্মা সালাম নিবেন, আব্বা ও চাচা চাচিদেরকে সালাম দিবেন। ছোটদেরে স্নেহ ও শুভেচ্ছা
দিবেন। তারপর রাজধানী জীবনের নানা সুখ দুঃখের বিবরণ। সবশেষে সবাইকে শ্রেনিমত সালাম
ও শুভেচ্ছা দিবেন। আমার জন্য দোয়া করবেন। ইতি- তোমার স্নেহের কন্যা রেহা।
আম্মা খুব তাড়াতাড়ি এই চিটির
উত্তর লিখে ডাকে পাঠিয়ে দিয়ে আবার তার জৈষ্ঠা কন্যার জবাবের অপেক্ষায় বসে থাকতেন।
এই পত্র চালাচালি চলত বিরামহীন। এই পত্র বিনিময় চলত আর কিছু জায়গায়, বিশেষতঃ
নানাবাড়ি পাতারিয়া ও নিউইয়র্কে মেঝমামা ফজলুর রহমান চৌধুরীর ঠিকানায়। মেঝবোন সেহার
চিটিলেখার তেমন অভ্যাস ছিলনা। আম্মা চিটি দিলেও সহজে জওয়াব আসতনা। যারা চিটি কম
লিখতেন আম্মার মতে তাদের দিল পাষাণ, তাদের মায়ামমতা বলতে কিছু নেই। সব সময় নিয়মিত
চিটিদাতারাই সেকালে হয়ে যেতেন দয়ালু ও হৃদয়বান। বর্তমান মোবাইলের যুগে সেই
মূল্যবান ‘চিটি’ অবসরে চলে গেছে।
১৯৭৫ সালে ফুলবুবু ঢাকা এসে এক
ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের দেখা পান। তিনি রাজধানীর এই দুরাবস্থার গল্প বলতেন। শহরজুড়ে
কংকালসার ভিক্ষুক, কাজের খোঁজে হাজার হাজার ভাসমান মানুষ, ফুটপাতে ঘুমন্ত গরিব
মানুষ, বস্তিজীবন তাকে খুব কষ্ট দিত। ভিক্ষুকদের বাড়ি কোথায় জানতে চাইলে অধিকাংশ জবাব
দিত ফরিদপুর।
টি এন্ড টিতে কর্মরত ফুফুতো ওহিদ
ভাইয়ের বাসা ছিল কাছে মতিঝিল টি এন্ড টি কলোনিতে । সে বাসায় তার খুব যাতায়াত ছিল।
এই পরিবারের সেফু রাফু দিপু ও শামিমদের কথা তার মুখে প্রায়ই শোনা যেত।
সাত,
ভাগনা লবিদ, হুদহুদ ও হুর, এবং ভাগ্নি পপির জন্ম হয় তাদের নানাবাড়ি দাউদপুরে। তাদের জন্মের দেড় দুই মাস আগে ফুলবুবু
ঢাকা হতে চলে আসতেন দাউদপুর। বছর দেড়েকের ব্যবধানে এই ভাগনা ভাগ্নিরা পৃথিবীতে
আসে। আমরা এই দুগ্ধধবল শিশুদেরকে কোলে নিয়ে খেলাধুলা ও দৌড়াদৌড়ি করতাম। লবিদের
জন্মের কথা ইতিপূর্বে লিখেছি। হাইস্কুল কিংবা কলেজ থেকে ফিরে দেখতাম এসে গেছে নতুন
এক শিশু, শুয়ে আছে বিছানার কোন এক কোনে।
এই পাঁচ সন্তানকে নিয়ে দোলাভাই ১৯৮১
সালের কোন একদিন বদলি হয়ে আসেন ফেন্সুগঞ্জ সারকারখানায়। জৈষ্ঠ্য কন্যা রেহার কাছে
ফেরা আমার আম্মা ও আব্বার জন্য ছিল খুবই আনন্দের বিষয়। তারা খুশীতে হন আটখানা,
এবার আর চিটি পাঠাতে হবেনা, নিজেরা গিয়েই কন্যা ও নাতি-নাতনিদেরকে দেখতে পারবেন। লবিদের
বয়স তখন বড়জুর আটনয়, অন্যরা নিতান্তই অবোধ শিশু। অন্য তিন কনিষ্ট ভাগনা তাঞ্জির,
তানভির, হিমুর এবং ভাগ্নি পলির জন্ম হয় ফেন্সুগঞ্জ সারকারখানা হাসপাতালে।
আট.
ফেন্সুগঞ্জ সার কারখানায় শুরু হয়
ফুলবুবুর নুতন জীবনসংগ্রাম। দাউদপুর হতে ফেন্সুগঞ্জ সারকাখানার দুরত্ব মাত্র বার
মাইল। দাউদপুর হতে নৌকা বেয়ে, রিকশা চড়ে কিংবা পায়ে হেঁটে মোগলাবাজার রেলস্টেশন পৌছে
আমরা ট্রেন ধরতাম। কতোয়ালপুর ও ফেন্সুগঞ্জ দুটি রেলস্টেশন পার হলেই মাইজগাও
স্টেশন। মাইজগাঁও স্টেশনে নেমে রাস্থা পেরুলেই একটার পর একটা বেবিট্যাক্সি
সারকারখানায় ট্রিপ দিচ্ছে।
বাস যোগাযোগ ছিল খুব বন্ধুর। মোগলাবাজার
হতে একটি গাড়িতে গিয়ে রেলক্রসিং পেরিয়ে ছয়দফার ভগ্নসেতুর আগে নেমে অনেক কসরত করে
নদী পার হয়ে অন্যগাড়িতে উঠতে হত। এই গাড়ি নিয়ে যেত দুইমাইল দূরের কুশিয়ারার পারে।
এখানে নেমে মানুষ দুইভাবে নদী পার হত, হয় খেয়া নৌকায় নয়ত রেলসেতুর উপর দিয়ে হেঁটে।
রেলসেতু দিয়ে কুশিয়ারা পার হওয়া ছিল খুব বিপদজনক কাজ। সেতুর দুই প্রান্তে হঠাৎ
রেলগাড়ি এসে গেলে গাড়িকে পাশ দেবার জন্য দাঁড়ানোর কোন নিরাপদ জায়গা নেই। এখানে
প্রাণ বাঁচাতে নদীতে ঝাঁপ দেয়া ছাড়া আর কোন পথ নেই, কিন্তু নিচে জলে না পড়ে নদীর
কিনারায় পড়ে গেলে হাতপা ভেঙে বারটা বেজে যেতে পারে। এই ফেন্সুগঞ্জ রেলসেতু পার হতে
গিয়ে রেলের চাকায় পৃষ্ট হয়ে অনেক লোক পরপারে পাড়ি জমান। একদিন আমি হেঁটে এই সেতু
পার হওয়ামাত্রই দেখি ভু ভু করে একটি ট্রেন তেড়ে আসছে। খানিকের জন্য আল্লাহ আমাকে
বাঁচান। সেদিন প্রতিজ্ঞা করি আর কখনও এই সেতু হেঁটে পার হবনা। এই প্রতিজ্ঞা আমি
রক্ষা করি। পরে সব সময় আমি খেয়া নৌকায় কুশিয়ারা পার হতাম। ফেন্সুগঞ্জ হতে পনের বিশ
মিনিট হেঁটে মাইজগাও গিয়ে সারকারখানার ট্যাক্সি ধরতাম। দাউদপুর হতে ফেন্সুগঞ্জ
সারকারখানা এই বার মাইল সড়কে এত প্রতিবন্ধকতা ছিল যে, এই বার মাইল অতিক্রম হতে মানুষের
যে সাধনা ও সময় ব্যয় করতে হত আজকের দিনে
একশত বিশ মাইল পথ পেরুতেও তা হবেনা।
বোন ও ভাগ্না-ভাগ্নিদেরে দেখার
এক দুর্নিবার আকর্ষণে এই জলপথ ও স্থলপথ পার হয়ে রত্না, কুশিয়ারা ও হাকালুকি হাওরের
ঢেঊ, জলাটিলা, বনবাদাড়, চাবাগান, ফেঞ্চুগঞ্জ নদীবন্দর দেখে দেখে আমরা প্রায়ই যেতাম
ফুলবুবুর বাসায়, ফেঞ্চুগঞ্জ সারকারখানায়।
একবার ভীষণ বন্যা হয়, সেই
বানভাসা মেঘলা দিনে আমি দাউদপুর হতে একাকি সারকারখানা যেতে বের হই। সময়টা ছিল
বর্ষাকাল। প্লাবনে ভেসে গেছে সব। গ্রামের রাস্থাগুলো বন্যায় ডুবে আছে। দুপাশে
ভাসান জল থৈ থৈ করছে। নৌকা চড়ে লোকজন সোজা ধান্যজমি দিয়ে গন্তব্যে যাচ্ছে। বন্যায়
ডুবে থাকা বিভিন্ন গ্রামের মানুষ লুঙ্গি হাটুর উপর তুলে কাদা পানি মাড়িয়ে বড়
রাস্থায় হেঁটে আসছে। দুপাশের হাওরের পানি রাস্থার পিচ ছুঁয়ে আছে। কোন কোন নিচু
জায়গায় রাস্থার উপর দিয়ে বন্যার পানি বইছে। এভাবে আমি চৌধুরীবাজার হতে কোনারচর
তিমুখা পৌছলাম।
মেঘলাদিনে বেশ ঠান্ডা বাতাস
বইছে, হাঁটতে যারপরনাই আরাম লাগছে। কিছুদিন আগে শোনেছি আব্বার গুরুবন্ধু শ্রী
কৃপেশ ভট্টাচার্য্য আশী বছর বয়সে নেগাল হতে নাকি মাঝে মধ্যে আট মাইল দূরে সিলেট
শহরে হেঁটে হেঁটে চলে যান। তার ছিল অদম্য মানসিক শক্তি। তিনি নিজেকে সব সময় যুবকই
ভাবতেন। আমার মনে হল তিনি যদি আশী বছর বয়সে একটানা আট মাইল হাঁটতে পারেন, তবে তরুণ
বয়সী আমি কেন বার মাইল হাঁটতে পারবনা। কোন গাড়িতে না চড়ে রাস্থার দুপাশের বন্যা
দেখে দেখে আমি মোগলাবাজার রেলস্টেশন পার হলাম। রেঙ্গা হাজীগঞ্জ বাজার জলে ডুবে
আছে। বিশাল হাকালুকি হাওরের ঢেঊ এসে রাস্থায় আঘাত হেনে শূন্যে উড়ে এসে রাস্থার
মাঝখানে উছলে পরছে। শোনা যাচ্ছে জলের একটানা ছপাত ছপাত শব্দ। পানির ঝাপ্টা ও
বাতাসের কনকন সুরধ্বনী কয়েক মাইল রাস্থায় এমন এক অপূর্ব মনকাড়া সুর ও দৃশ্য সৃষ্টি
করেছে। এই অপরূপ প্রাকৃতিক দৃশ্য কক্সবাজারের সিবিচকেও হার মানাবে। দেখতে না দেখতে
দুই মাইল দূরের সেনেরবাজার রত্নাসেতু পার হলাম। আমার মনোবল আর বেড়ে গেল। হ্যাঁ
তরুণ আমি পারব। আবার রাস্থায় সেই জলকেলীর সে কি অপূর্বদৃশ্য। বাতাস ও জলের ঝাপ্টার
বুকে লোকচুরি খেলে খেলে আচমকা কুশিয়ারার বিশাল জলরাশির পারে আমি বিজয়ীর বেশে হাজির
হলাম। আমি যেন আজ সিন্ধুনদের তীরে দাঁড়ানো বিশ্ববিজয়ী সম্রাট আলেকজান্ডার দি
গ্রেট।
কুশিয়ারা পার হতে খেয়ানৌকায় উঠে
পড়ি আমরা বেশ কজন ওপারের যাত্রী। বন্যা প্লাবিত নদী, মেঘের কূলে রোদেলা আকাশ। সেদিন
কুশিয়ারাকে অবিশ্বাস্য রূপসী চেহারায় দেখে মনে মনে বলি এই নদীও বুঝি নারীর মত কথা
কয়। নৌকায় বসে মনে আমার খেয়ানৌকার মাঝি হবার শখ জাগে। কবিতা আবৃতি করি ‘মা যদি হন
রাজি, বুড়ো হলে হব আমি খেয়াঘাটের মাঝি’। ফেন্সুগঞ্জ ও মাইজগাঁও, এই দুটি স্টেশনের
মাঝখানে মাত্র এক কিলোমিটার রাস্থা পার হলাম পদব্রজে। এবার বিজয়ী হবার প্রচন্ড
ইচ্ছে আমাকে টেক্সিতে উঠতে বাঁধা দিল।
আবার হাঁটা, টিলা, চাবাগান,
ফেন্সুগঞ্জ ডিগ্রি কলেজ পেরিয়ে সহসা ফিরায়ে চোখ চেয়ে দেখি সারকারখানা, সামনে
বাজার, বাতাসে মিথেন গ্যাসের ঝাঝালো গন্ধ, আর কারখানার ঘড় ঘড় অসহ্য আওয়াজ।
সারকারখানা স্কুল পেরিয়ে আমি হাজির হই হাউজিং কলোনিতে বোনের বাসায়, ভাগনা
ভাগ্নিদের প্রাণ কোলাহলে আনন্দ সরোবরে।
সারকারখানায় জোড়ায় জোড়ায় সাজানো
পাকা টিনের আবাসিক বাসা। জোড়বাসার দুটিতে দুই পরিবার লোকজন স্বাচ্ছন্দে বসবাস করতেন।
গ্যাস পানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ ছিল ফ্রি ও বিরামহীন। সারাদেশে লোড শেডিং হলেও এখানে
বিদ্যুৎ যেতনা, কারণ এই কারখানাতেই অবিরাম বিদ্যুৎ উৎপাদন হত। দুইটি জোড়বাসায়
সামনে পিছনে প্রচুর পতিত জায়গা। এই জায়গায় কেউ কেউ গড়ে তুলেন ফুল ফল ও শাক সবজির
শখের বাগান। পানির কোন অভাব নেই, সুদীর্ঘ নল দিয়ে তারা ক্ষেতে পৌছে দিতেন পর্যাপ্ত
জল। তখনকার দিনে খুব স্বল্প সংখ্যক পরিবার ফ্রিজ-টিভি ব্যবহার করলেও এখানে প্রতিটি
বাসায় এই দুইটি জরুরি জীবনপণ্য দেখা যেত। খেলাধুলা, সুন্দর হাঁটার রাস্থা, চাবাগান
সবমিলে বসবাসের এক সুন্দর পরিবেশ। আসলে কারখানার মানুষের জীবনমান দেশের অন্যজায়গার
তুলনায় উন্নতই ছিল।
দোলাভাই মুফতি মোঃ খালিদ সিলেট
শহরের দরগামল্লার লোক, খাস সিলেটি কুট্টি। তিনি কোদাল মারতে অক্ষম, তাই এখানে খালি ঘাসের
প্রান্তর। আমাদের গ্রামের আলচন আলী সারকারখানায় কাজ করেন। একদিন তিনি বাসার সামনে
দাঁড়ানো কয়েকজন ভিনজেলার লোককে গর্বভরে বললেন এই ঘরের মাইঝি আমাদের গাঁয়ের চৌধুরী
বংশের মেয়ে, বাসার আশপাশে তাকালেই অনায়াসে বুঝা যায়। তারা জন্মগত বড়লোক, তাই
অন্যদের মত কোদাল মারামারিতে নেই। অন্য বাসাগুলোর দিকে আপনারা তাকান, আর এদিকে
তাকান, দেখেন এই বাসার চারপাশ কেমন ফকফকে পরিস্কার।
বাসার চারপাশে বাগান করতে অক্ষম
একজন অলস মানুষকে নিয়ে আলচন আলীর গর্বোক্তি শুনে আমার মনে বেশ হাসি পায়। সে সময়ের
একটি প্রচলিত জীবন দর্শনবোধ আমার মনের চোখে ধরা পড়ে, যারা খাটা খাটুনি করে তারা
ছোটলোক এবং যারা অলস বসে বসে অন্ননাশ করে তারাই বড়লোক।
এই বাসার পানির চৌবাচ্চায় ভাগনারা ডিমওয়ালা তেলাপিয়া ছেড়ে দিত। কিছুদিন পর তেলাপিয়ার রেনুপোনায় চৌবাচ্চা ভরে যেত। একবার ফুলবুবু একটি কাচের বোতলে প্রচুর রেনুপোনা দেন। আমি এই পোনা এনে বাড়ির বড়পুকুর ও ছোটপুকুরে অবমুক্ত করি। মাস দেড়েকের মধ্যে পুকুর দুটি তেলাপিয়া মাছে ভরে যায়। আমরা পিছনের ছোটপুকুরে প্রচুর ভাত ও তুষা ছিটিয়ে দিতাম। ঝাঁকে ঝাঁকে তেলাপিয়া এসে পানিতে লাফালাফি করে খাবার খেত। আমরা ঘাটে বসে বরশি ফেলে প্রচুর তেলাপিয়া শিকার করতাম। আমি দাউদপুর হতে বেরিয়ে আসার আগ পর্যন্ত আমাদের দুইটি পুকুর তেলাপিয়া মাছে পরিপুর্ণ ছিল। আমরা বরশি দিয়ে এত তেলাপিয়া ধরতাম যে তেলাপিয়া খেতে কিছুটা অরুচি জন্মে যায়। আম্মা বললেন, এভাবে আর তেলাপিয়া খাওয়া যাবেনা, এই তেলাপিয়া আগুনে পুড়ায়ে টাকি ভর্তা করে খেতে হবে।চুলার অঙ্গারে ঝলসানো তেলাপিয়ার কাটা ফেলে দিয়ে সরিষা তেল, পিয়াজ, ধঞ্চে পাতা, কাচামরিচ, লাইপাতা ইত্যাদি মিশিয়ে আম্মার হাতে বানানো তেলাপিয়া ভর্তা ছিল খুবই মজাদার।
নয়,
জোড়বাসায় প্রতিবেশী বনিক বাবু।
তিনি ছিলেন আমাদের প্রিয় বনিক দাদা ও তার সহধর্মিনীকে আমরা ডাকতাম বৌদি। তারা আমার
ভাগনা ভাগনিদের নিজ সন্থানের মত স্নেহ করতেন। তারা ছিলেন আমার ভাগনা ভাগনিদের যেন
আপন কাকা ও মাসিমা। বনিকদার তিন পূত্র সমর বাবু, শেখু এবং শ্যাম। একমাত্র কন্যা
মনী ছিল দক্ষ গায়িকা ও নৃত্যশিল্পী। পরীর মত সেজেগুজে আসা মনীকে ছাড়া সারকারখানার
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান নিস্প্রভ মনে হত। তাই সারকাখানার সবগুলো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে
মনীর উপস্থিতি ছিল নিত্য ঘটনা।
আমি ছিলাম জোড় দুই প্রতিবেশী
বাসার সবার মেঝমামা।
বনিক দা ছিলেন বহুমুখী প্রতিভা,
তিনি একাধারে গানের শিক্ষক, হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক এবং কারখানার পদস্থ কর্মকর্তা। এই
পরিবারে নিয়মিত গানের রেওয়াজ হত। আমি যে বছর সিলেট পলিটেকনিকে ভর্তি হই, সে বছর
ভাগনা সমর বাবু পাশ করে বের হন। শেখু মধ্যম মেধাবী হলেও শ্যাম ছিল লেখাপড়ায় একদম
কাচা, তার তেমন লেখাপড়া হয়নি। মনী মাস্টার্স পাশ করে আজ কৃষিব্যাংকের উচ্চপদস্থ
কর্মকর্তা।
মুফতি মোঃ খালিদ খাঁটি ধর্মাচারী
ব্যক্তি। তিনি যখন কোরান তেলাওত করতেন তখন পাশের বাসায় গানের রেওয়াজ হত, শোনা যেত
হারমোনিয়াম ও সেতার বাজছে। ছাত্রছাত্রীরা গাইছে সা রে গা মা পা দা নি ছা সা। দুই মেরুর
দুইধর্মের দুইটি পরিবারের এখানে ছিল এক মমতাময় সহাবস্থান। কেউ প্রতিবেশীকে না দিয়ে
ভাল কিছু নিজেরা একাকি খেতেন না।
ফেন্সুগঞ্জ সারকারখানা টিলা ও
চাবাগান পরিবেষ্টিত এলাকা। প্রাকৃতিক পরিবেশ বেশ মনোরম।
আমি সারকারখানায় গেলে শেখু ও
শ্যাম আমাকে নিয়ে ছুটে যেত পাশের পুড়া টিলায়। এখানে কারখানার গ্যাসের বিষের দুষণে কোন গাছ ঘাস জন্মায় না। লাল ও হলুদ শরীর মেলে ধরে কয়েকটি পাহাড় আকাশ পানে চেয়ে
আছে। এই পাহাড় হতে পাশের প্রাচীরঘেরা সারাটা কারখানায় যন্ত্রদানবের নানা দানবীয়
কাজ কারবার দেখা যেত। দাউদাউ আগুন জ্বলছে, বৃষ্টির মত ইউরিয়া সার ঝরছে, বস্থা সারে
পূর্ণ হচ্ছে, বেল্টে করে গোদামে যাচ্ছে।
ঘাসহীন মরুময় লাল পাহাড়ে পাহাড়ে
টেকিং করে সন্ধ্যা গনিয়ে যেত। একবার শেখুদের একটি দামী বাদ্যযন্ত্র আমার হাত হতে
পড়ে ভেঙে যায়। তারা কিছুই বলেনি, কিন্তু আমি লজ্জা পাই। বহুদিন হয় বনিক বাবু
পরিবারের সাথে আমার কোন যোগাযোগ নেই। তবে ভাগ্নাদের কাছে শুনেছি চাকুরি হতে অবসর
নিয়ে বনিক দা ও বৌদি সিলেট শহরে চলে আসেন এবং এই শহরেই তারা মারা যান। সারকারখানার
সেই জোড়বাসার প্রতিবেশী দুই জোড় দম্পতির চারজন বনিকদা, বৌদি, ফুলবুবু ও খালেদ
দোলাভাই আজ আর আমাদের মাঝে নেই। মহান ঈশ্বর সাদামনের এই চারজন মানব ও মানবীকে পুরস্কৃত
করুন।
দশ.
মুফতি মোঃ খালিদের পদোন্নতি হলে
এবার বড় একটি ফ্ল্যাট পান। একটি সুন্দর চারতলা ভবন। তিনবেডের আটটি বড় ফ্ল্যাট, চারপাশে
খোলামেলা বাগান। কাছেই মসজিদ ও সুরম্য চাবাগান। জায়গাটি আগের চেয়ে নিরিবিলি। পাশেই
সন্নিবেশিত ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বাংলো ও পুকুর। এই ভবনে ফুলবুবুর প্রতিবেশী হন ডাঃ
জাহানারা খানম চৌধুরী। তিনি ফেঞ্চুগঞ্জ সারকারখানা হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার। তার সাহেব মাখন মিয়া
সারকারখানার একজন পদস্থ কর্মকর্তা। খুবসম্ভব এই দম্পতি আপন খালাত ভাইবোন। সুন্দরী
ও ফর্সা ডাঃ জাহানারা চৌধুরী সিলেট সরকারি ওসমানী মেডিকেলে অধ্যয়ন করেন। তাদের তিনটি
সুদর্শন ছেলে- রাজি, সাদি, সাকিব ও একমাত্র মেয়ে রিমা বেশ নাদুস নুদুস। দুই বাসার
প্রতিবেশী বাচ্চারা খেলাধুলায় সর্বদা ছিল একে অন্যের সহচর।
বড় ভাগনি মুফতি লতিফা খানম পপি ছিল
অনিন্দ্যসুন্দরী, এই বাসায় অল্প বয়সে তার বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়। বর মাহমুদুস সামাদ চৌধুরী ছিলেন বৃটেনের একজন চার্টার একাউন্টেন্ট। তিনি একটি বহুজাতিক ব্যাংকের উচ্চপদস্থ
কর্মকর্তা। কনে উঠানো হয় বরের ঈদগাহের আবহাওয়া অফিসের সামনের বাসায়। বিয়ের পর পপি
কিছুদিন লন্ডনে কাটায় এবং পরে সামাদ বদলি হলে তারা নিউইয়র্ক চলে যান।
এই বাসায় আমার বড় ভাগনা মুফতি মোহাম্মদ লবিদেরও
বিয়ে হয়। বিয়ের ঘটক ছিলেন আমার চাচাতো ভাবী নাসরিন চৌধুরী। কনে মৌলভীবাজার শহরের
একজন লন্ডনি কন্যা রোকশানা তরফদার। ফুলবুবু অনুরোধ করলেও একরোখা দোলাভাই তার
বড়কক্ষ ছাড়লেন না। বাধ্য হয়ে কনেকে উঠানো হয় ছোট কামরায়। যাক কিছুদিন পর লবিদ
লন্ডনে চলে যায়।
এই বিয়েতে বিদেশ হতে ভাগ্নি পপি আসে
সপরিবারে। তার ঘুম হত কম এবং কিছুটা
রহস্যময় আচরণ করে। সে কথা বলত অল্প ও সব সময় কি যেন দুশ্চিন্তা করত। তাঁর পুত্র মাহদী অন্য গাড়িতে চড়ে বিয়ের দিন ফেঞ্চুগঞ্জ ফেরে। আসার সময় তাকে খুঁজে না পেয়ে সে বেশ অশান্তি ও পাগলামি করে। অনেক তাবিজ টোকা করা হয়। আমার মনে হয় বিদেশে আপনজনহীন বিরূপ পরিবেশে
থাকায় এমনটি হয়েছে। তাছাড়া তাঁর চার্টার্ড একাউন্টেন্ট স্বামী উচ্চপদস্থ বহুজাতিক ব্যাংক নির্বাহি হওয়ায় হয়ত পর্যাপ্ত সময় সংগ দিতে পারেননি। আম্মা তার নাতনীর চিন্তায় বেশ কিছুদিন সারকারখানার এই বাসায়
অবস্থান করেন। পপি পরে লন্ডনে গিয়ে চিকিৎসা করে সুস্থ্য হয়।
এগার.
একদিন দাউদপুরে খবর এলো ভাগনা মুফতি মোহাম্মদ শামস ওরফে হুরকে খোঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। আম্মাকে নিয়ে আমি সাথে সাথে গিয়ে হাজির হলাম সারকারখানার বাসায়। গিয়ে দেখি ফুলবুবু শয্যাশায়ী, তার শারীরিক ও মানসিক অবস্থা গুরুতর। ভাগনা ভাগ্নিরা কোনমতে রান্নাবান্নার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। সারা বাসায় এক নীরব বিষন্নতা।
লবিদ কানে কানে বলল, সারকারখানায় জামায়াতে মুজাহেদিন নামক এক উগ্রপন্থি
দল কাজ করছে। তারা মসজিদেও শেকড় গেঁথেছে এবং সহজ সরল নামাজি ছেলেদেরে বেহেশতের
লোভ দেখিয়ে জঙ্গি প্রশিক্ষণে নিয়ে যাচ্ছে। শৈশব হতে হুর সরল ও একটু বেশী মাত্রায়
ধর্মাসক্ত। শয়তান জঙ্গীরা তাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে কাবু করে চট্টগ্রামের পাহাড়ে জঙ্গি
প্রশিক্ষণ দিতে নিয়ে যায়। ফুলবুবু হুর হুর করে কান্নাকাটি করছেন, আর দোলাভাই জঙ্গিদের
প্রতি রাগে ফুসে চিৎকার দিচ্ছেন, হারামজাদা মরুক, সে শয়তানদের ফাঁদে পড়ছে। এই
শয়তানরা আর অনেক লোকের ছেলেদেরে অনুরূপ নিয়ে গেছে।
কিছুলোক ভীতিকর গোজব ছড়াল, কিডনি
চোরেরা কৌশলে জঙ্গি প্রশিক্ষণের নামে ছেলেদেরে নিয়ে গেছে এবং একসময় ওদেরে মেরে
কিডনি, হার্ট, চোখ ইত্যাদি বিক্রি করে দেবে। আম্মা এই অবস্থায় দাউদপুর ফিরতে
পারলেন না, প্রায় একমাস কন্যার কাছে অবস্থান করলেন। কারখানায় এই মুজাহিদ দলের
নেতাদেরকে প্রচন্ড চাপ দেবার পর একদিন ফিরে আসে হুর। কিন্তু ততোদিনে পুত্রের
দুশ্চিন্তায় ফুলবুবুর শরীরে ঘুনরোগ ডায়বেটিস পয়দা হয়ে গেছে।
ফেঞ্চুগজ্ঞ সারকারখানায় এই উগ্রবাদ আমদানির নায়ক ছিল চাঁদপুরের শরিফ শাহেদুল আলম ওরফে বিপুল। নানা উগ্রবাদী কার্যকলাপ একসময় তাকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। হজরত শাহজালালের দরগায় বৃটিশ হাইকমশনার আনোয়ার চৌধুরীর উপর বোমা হামলার ঘটনায় সে ধরা পড়ে এবং সেখানে দুইজন পুলিশ সদস্য হত্যার দায়ে মৃত্যুদন্ডের শিকার হয়। সিলেট কারাগারে ফাঁসি কার্যকর করে সরকার তাঁর লাশ গ্রামের বাড়ি চাঁদপুর পাঠিয়ে দেয়।
সারকারখানায় আমাদের কয়েক ঘর
আত্মীয় ছিলেন। মামাতো সেজু ভাইয়ের বাসায় একবার দর্শন দিয়ে আসা ছিল ফরজ কাজ। আব্বা
মোগলাবাজার হাইস্কুলের তার সহকর্মী শিক্ষক শ্রী অমেলেন্দু চক্রবর্তীর বাসায় গিয়ে আড্ডা
দিতেন। অমেলেন্দু স্যার হাইস্কুলে আমারও বিজ্ঞান শিক্ষক ছিলেন। বেশ কিছু বাসায় গিয়ে চানাস্তা হত। সারকারখানাকে কেন্দ্র করে এখানে বাঙ্গালীদের
সুন্দর একটি শান্তি ও সৌহার্দময় আবাসিক সমাজ গড়ে উঠেছিল।
বার.
১৯৬২ সালে স্থাপিত ফেন্সুগঞ্জ
সারকাখানায় আয়ু যখন নিভু নিভু, মুফতি দোলাভাইয়ের চাকুরীও তখন শেষ সীমানায়। ভাগনা মুফতি রশিদ ওরফে হুদহুদ
তখন শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং এবং মুফতি শামস ওরফে হুর নর্থইস্ট মেডিক্যাল কলেজে
এমবিবিএস পড়ছে। চাকুরি হতে অবসর নিয়ে ২০০৬ সালে তাঁরা চলে আসেন সিলেট শহরে। ফুলবুবুকে
আমার কাছে নিয়ে আসতে আমি ও হুদহুদ সাগরদিঘির পারে বাসা খোঁজতে থাকি। এই পাড়া হতে
দোলাভাইয়ের দরগামহল্লা মুফতি বাড়ি খুব একটা দূরে নয়। সিলেট সরকারি মেডিক্যাল
কলেজের পিছনে নিরিবিলি পরিবেশে একটি চারতলা বাসা পেয়ে যাই। সামনে বড় আঙ্গিনাসহ তিন
বেডরোমের বাসাটি ছিল নিচতলায়। তাঁরা ফেন্সুগঞ্জ ছেড়ে এই বাসায় এলে আমরা দুই ভাইবোন খুব
কাছাকাছি এসে যাই। জীবনের ভোরবেলা আমরা পাশাপাশি ছিলাম, ফুলবুবুর সন্ধ্যা বেলাটায়ও
তাকে আমি পাশে পেয়ে ধন্য হই।
তের.
মুফতি মোহাম্মদ খালেদ সাহেবের দিন যায়
ধর্মেকর্মে মসজিদ ও শাহজালালের(রঃ) দরগায়। মাঝে মাঝে দরগার জলসা ঘরে বসে ছেলেবেলার সাথীদের সাথে আড্ডা দেন। কর্মজীবনের সাথী জনকয়েক শশ্রুধারী বন্ধু
এবং আত্মীয়স্বজন আসেন ও খুশগল্প করে ফিরে যান। আমি ও নুরজাহান বেগম প্রায়ই সেথায় যাই সকাল ও সন্ধ্যায়।
এবাসার এক অদৃশ্য আকর্ষণ আমাদেরকে টানতো। টানতো আমার একমাত্র পুত্র জেফারকেও। সে
তার ফুফু ও ভাইবোনদের মেলায় গিয়ে বেশ আনন্দ পেত।
আম্মা ও আব্বা তখন প্রায়ই আমার
বাসায় অবস্থান করতেন। তারা তখন কিছুদিন শহরে ও কিছুদিন গ্রামে কাটাতেন। ডায়বেটিস
আক্রান্ত আম্মা তেমন হাঁটতে পারতেন না। আম্মা ফুলবুবুকে দেখতে চাইলে আমার কারে করে
এই ছোট্ট দুরত্বে তাঁকে পৌঁছে দিতাম। ছোটভাই নিশাত তখন মদন মোহন কলেজে অর্থনীতির
শিক্ষক। সেও প্রায়ই এখানে থাকত। আসলে এই ফেলে আসা দিনগুলো ছিল আমার জীবনের খুব
আনন্দময় কাল।
ফুলবুবুর শরীরও তেমন ভাল নয়, তার
পুরানো ডায়বেটিস। তিনি আট আটটি সন্থানের জননী। এতগুলো বাচ্চার গর্ভধারণ ও লালনপালন
তাকে অবসন্ন করে দেয়। অসুস্থ ফুলবুবু গুটিগুটি পায়ে হেঁটে হেঁটে প্রতিদিন আমার
বাসায় আসতেন তার মাবাবাকে দেখতে। শীততাপ নিয়ন্ত্রিত আম্মার কক্ষে বসে থাকতেন
আম্মার পায়ের কাছে। একদিন আমার বাসা হতে ফেরার পথে মনীপুরী শ্মশানে তিনি ছিনতাইকারীদের
পাল্লায় পড়েন। দিনদুপুরে একটি মোটর সাইকেলে আসা দুইজন ছিনতাইকারী তাকে একাকি পেয়ে
গলার স্বর্ণের হার নিয়ে চম্পট দেয়।
চৌদ্দ.
এই বাসায় ভাগনি পলির বিয়ে হয়। ভাগ্নি পলি নিখাদ সুন্দরী। টল ফিগার, ধারলো নাক, কালোচুল কিন্তু দুধফর্সা চর্মবর্ণ। সে যেন নিউইয়র্কে আমার দেখা খুব সুন্দরী ইহুদি নারীদের প্রতিরূপ। পলি তখন সিলেট সরকারি মহিলা কলেজের ছাত্রী। প্রায়ই তার কোন না কোন বিয়ের আলাপ আসে। প্রথম প্রথম তার পড়ার দোহাই দিয়ে এসব আলাপ আমরা ফিরিয়ে দেই। নালিউরির ধনী লন্ডনি ভাগনা পাপুর আলাপ ফিরিয়ে দেয়া হয় এজন্য যে পাপু একটু বেঁটে ও শ্যামলা, কনের সাথে খাপ খাবেনা। সবশেষে ভাদেশ্বরের বিমান বাহিনীর জিডি পাইলট ইশতিয়াক আহমদ চৌধুরীর সাথে তার বিয়ে হয় ২৯ ডিসেম্বর ২০০৬ সালে। ইশতিয়াক এখন বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর কোয়ার্ডন লিডার।
আমার বাসায় খুব ঝাঁকজমকের সাথে পলির গায়ে হলুদ অনুষ্ঠান হয়। বরের দক্ষিণ ভাদেশ্বের গ্রামের বাড়ি শূন্য পড়ে আছে। একজন চাচা একাকি বাড়িতে থাকেন। গাছ ও জঙ্গলে সেমিটিলা বাড়িটা ছেয়ে আছে। কনে গিয়ে উঠেন বরের নানাবাড়ি কুয়ারপার। জমজমাট বিশাল বাড়ি। বাউল কবি জমিদার হাসন রাজার বংশধরদের পাশাপাশি দুইটি বাড়ি। দুইবাড়ির মাঝখানে বড় পুকুর। হাসন রাজার কয়েক পুরুষ এই দুই বাড়িতে বসবাস করছেন। বর ইশতিয়াকের মা রুকশানা খানম চৌধুরী বাউল কবি হাসন রাজার একজন অধস্তন বংশধর। এই বাড়িতে হাসন রাজার অনেক অনেক স্মৃতিচিহ্ন এবং ছবি, দেয়ালে দেয়ালে ও আলমিরায় শোভা পাচ্ছে।
হাসন রাজার বোন সিলেটের প্রথম মহিলা কবি সহিফা বানু ওরফে হাজু বিবি নাকি এই বাড়িতে
জীবন কাটান। তাঁর একটি গানের কলিতে এর প্রমাণ পাওয়া যায়- ‘তোমরা যাইবায়নিরে সুরমা
নদীর পার/ হাজুবিবির বাড়ি সিলেট কুয়ারপার’। সহিফা বানু ওরফে হাজুবিবি নিঃসন্থান
জমিদার ছিলেন, সেই বৃটিশ আমলে মহিলা হয়েও সমুদ্রপথে হজ্জ করেন। বিশ্বনাথের সহিফাগঞ্জ বাজার তাঁর
স্মৃতিবহন করছে।
পলির বিয়ের ওয়ালিমা হয় ঢাকার
সেনাকুঞ্জে ১৯ জানুয়ারি ২০০৭ সালে। সেনাকুঞ্জে এই প্রথম আমি কোন বিয়েতে যোগ দেই। বিরাট
বিয়ে সেন্টারে শামিয়ানার প্রান্তে প্রান্তে অজস্র নানাবর্ণের মরিচবাতি ঝিলমিল
করছে। সামনের আঙিনায় চা কফি ও শীতপিঠার ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রায় দুই তিন ফার্লং
প্রবেশপথ লাইটিং করা হয়েছে। খাবারদাবারও ছিল খুব উচ্চমানের। পুরো সেন্টারে মেহমানরা
গিজগিজ করছেন। চারপাশে আনন্দ উল্লাস হচ্ছে। এমন সময় একটা গুঞ্জন শুনা গেল বরের
একমাত্র অনুজ সায়হান আহমদ চৌধুরী বন্ধুদেরকে নিয়ে কার চালিয়ে সেনাকুঞ্জে প্রবেশের
পথে এক্সিডেন্ট করেছে। তারপর শোনা গেল সে হাসপাতালে। সবশেষে খবর আসে ছেলেটা বেঁচে
নেই। এই খবরে সারাটা সেনাকুঞ্জ বিষাদে ছেয়ে যায়। আনন্দভরা রাত যেন নিকশ কালো
অন্ধকার হয়ে যায়। নিমিষেই সেনাকুঞ্জ লোকশূন্য হয়ে পড়ে। আমরাও সিলেট
থেকে আসা আমাদের গাড়িতে উঠে পড়ি।
পরদিন ভাদেশ্বর দক্ষিণভাগে আমরা
এই প্রণোচ্ছল তরুণটার জানাজায় অংশ নেই। বাবার কাঁধে নাকি পৃথিবীর সবচেয়ে ভারী
বস্তু পুত্রের লাশ। হ্যাঁ, এই কঠিন ভার বহন করলেন হতভাগ্য বাবা বাংলাদেশ সরকারের অবসরপ্রাপ্ত
যুগ্নসচিব আহমেদুল গনি চৌধুরী। মোকামবাজার মসজিদের সামনে শাহপুতলার(রঃ) মাজারের
পাশে আমরা তাকে সমাহিত করি।
পনের.
২০০৭ সালের ২৪ নভেম্বর আব্বার মৃত্যুর পর আম্মা গ্রাম ছেড়ে স্থায়ীভাবে আমার বাসায় চলে আসেন। আম্মা আমাদেরকে চাপ দিতেন দাউদপুরের বাড়িতে গিয়ে আব্বার সমাধি জেয়ারত করতে। নানা ব্যস্ততায় যেতে দেরী হলে বিরক্ত হয়ে বলতেন আমিও মারা গেলে তোমরা কবরে রেখেই ভূলে যাবে, আমার সমাধিতে গিয়ে হয়ত কদম ফেলবেনা। এবার ফুলবুবু বাসা বদল করে চলে আসেন আমার আর কাছে, সামনের নুরজাহান মনজিলের নিচতলায়। চারবেডের বাসা, বেশ বড়সড়। আমার বাসা থেকে মাত্র তিন মিনিটের রাস্থা। দুই বাসায় আমাদের ঘোড়দৌড় চলত সারাদিন।
মুফতি খালিদ দোলাভাইয়ের উচ্চরক্তচাপ বহুদিনের কিন্তু সুস্বাধু খাবারদাবারে তিনি ছিলেন আপোষহীন। চিকিৎসকের নির্দেশ উপেক্ষা করে বেশি বেশি গরু-খাসি, দুধ-ডিম খেয়ে যান অবলীলায়। ফলে রক্তচাপ বেড়ে ভয়ানক স্টোক হয়ে একদিন শয্যাশায়ী হন। এখানেই তাঁর চিকিৎসা চলে দীর্ঘদিন।
এই বাসায় আমার দুই ভাগনা হুর ও
তাঞ্জিরের বিয়ে হয়। হুদহুদ লন্ডন হতে এসে তাদের বিয়ের সব আয়োজন করে। ডাঃ শামস ওরফে
হুরের বউ ডাঃ রেবেকা সুলতানা ঈদগাহের মেয়ে। হুর ও রেবেকা দুইজন ব্যস্ত চিকিৎসক।
তাদের মধ্যে সবসময় কথা কাটাকাটি লেগে যেত। তাদের এই অশান্তি দেখে ফুলবুবু বলতেন,
আমার হুরের জন্য সবাই দোয়া করবেন যেন ওদের জীবন শান্তিতে কাটে। তাঞ্জিরের পত্নী
ফারাহ চৌধুরী কুলাউড়ার পাশের গ্রাম কৌলার কন্যে। সে লম্বা মেদহীন ও সুন্দরী। আমার
কানিহাটির ফুফুতো বোন সালমা আপার নাতনি। ফুলবুবু যে কদিন বেঁচেছিলেন ফারাহ তার খুব
সেবাযত্ন করেন। তিনিও ফারাহকে খুব স্নেহ করতেন।
ষোল.
সারকারখানায় থাকাকালে ফুলবুবুর
ডায়বেটিস ধরা পড়ে। তিনি খুব শিক্ষিত ছিলেন না কিংবা বইপুস্তক পড়ার কোন অভ্যাস তাঁর
ছিলনা। ডায়বেটিস হলে রোগীকে এই রোগ সম্পর্কে পড়তে হয়, জানতে হয়। কিন্তু তিনি এই
রোগের ভয়াবহতা সম্পর্কে ছিলেন অজ্ঞ ও উদাসীন। ফলে যা হবার তা হল। ভাত খেতেন তিনবার,
সামনে রাখা মিষ্টি, জিলাফী কিংবা চিনি, আম কাটাল কিংবা লিচু কিছুই খেতে ভয় পেতেন
না তারা। ঔষধ কেউ বললে খেতেন, নইলে ভূলে যেতেন। অথচ সারকারখানায় ডাক্তার ও পথ্য
দুটোই ফ্রি, সর্বোপরি একজন দয়াবতী চিকিৎসক জাহানারা চৌধুরী তাঁর প্রতিবেশী। ফুলবুবুর
বেলায় যা ঘটেছে আমার মায়ের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। ব্যায়াম সেতো অসম্ভব ব্যাপার, যা আমাদের
সাত প্রজন্মের কোন নারী করেনি। কিংবা হাঁটাহাঁটি, সাঁতার ও খেলাধুলা তাদের কাছে ছিল
এবয়সে লজ্জার বিষয়। অনিয়ন্ত্রিত ডায়বেটিস যে তাদের শরীরের সব অঙ্গ প্রত্যাঙ্গ ধ্বংস
করে সহসাই মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাবে তা তারা বুঝতেই পারেন নি।
অতীব দুঃখের বিষয় মা ও মেয়ে
দুজনই তাই বাংলাদেশের গড় আয়ু ’৭৪ বছর’ বয়স ছুঁইতে পারেননি। তারা দুজন যখন সিলেটে
আসলেন ততদিনে ডায়বেটিস ঘুনপোকার মত ক্ষুরে ক্ষুরে খেয়ে ফেলেছে তাদের সারাটা দেহঘর।
হার্ট, কিডনি, চোখ, পা সবখানেই সমস্যা তৈরি হয়ে গেছে। ডায়বেটিস তখন এমন পর্যায়ে
চলে গেছে যা ইনসুলিন দিয়েও নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছেনা। তাদের পায়ে চৈতন্য নেই,
দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ, কিডনির ফাংশন অল্প, শরীর দুর্বল। মাপলেই দেখা যায় সুগারমাত্রা তের/ চৌদ্দ/ পনের
পার হয়ে আছে। আবার নিয়ন্ত্রণ করা হলে নেমে যাচ্ছে চারের নিচে বিপদ সীমানায়। সাথে
সাথে মুখে ঢেলে দিতে হচ্ছে চিনি কিংবা গ্লকোজ শরবত। আমার চিকিৎসক পত্নী ডাঃ
নুরজাহান বেগম চৌধুরী সারাক্ষণ ব্যস্থ থাকতেন তাদের রক্তে শর্করার মাত্রা
পরীক্ষায়। বারবার টেনেটুনে আমার কারে তুলে নিতে হয়েছে ডাক্তার চেম্বারে।
আমি নিউইয়র্ক, লন্ডন কিংবা
টরেন্টোতে দেখেছি চিকিৎসকরা মানুষকে ডেকে নিয়ে নিয়ে ফ্রি উন্নত চিকিৎসা দেন। তাই সেখানে
ডায়বেটিস রোগীরা এই রোগ নিয়েও সুদীর্ঘ জীবনকাল সুস্থ্য শরীরে বেঁচে থাকেন। আমার
মেঝমামার আবেদনের প্রেক্ষিতে আমাদের নিউইয়র্ক থাকার কথা ছিল। আমার মা ও বোন যদি ভাগ্যচক্রে
সেখানে চলে যেতেন, তাহলে হয়তো আর বেশ কয়েকটি বছর পৃথিবীতে বেঁচে থাকতেন। যাক, যা
হয়নি, যা ভাগ্যে ঘটেনি তা নিয়ে হাহুতাশ করে লাভ নেই, আসলে সবই মহান আল্লাহ পাকের
ইচ্ছে ও এখতিয়ার।
মুফতি মোঃ খালিদ স্টোকে
শয্যাশায়ী, আপার শারিরীক অবস্থা ভাল নয়। এমনই এক শোচনীয় মুহুর্তে ফুলবুবুর
স্বাস্থ্যের বারবার অবনতি ঘটে। সিলেটের চিকিৎসায় কোন উন্নতি নেই দেখে তাকে ঢাকার
বারডেম হাসপাতালে নেয়া হয়। ভাল হয়ে ফিরেন সত্য কিন্তু কিছুদিন পর আবার সে
দুরাবস্থা। তানভীর তাকে নিয়ে বারবার ঢাকা দৌঁড়ায়। এম্বুল্যান্সে মূমূর্ষু রোগীকে
ঢাকা নিয়ে গিয়ে বারডেমে চিকিৎসা করানো বেশ জটিল কাজ। এই কাজটি তানভির বেশ ধর্য্যের
সাথে করে যায়। ভাগনি পলিও ঢাকা হতে সহায়তা করে।
ফুলবুবুর রক্তে ক্রমে ক্রমে ক্রিয়েটিনিন বাড়ছে। এই ক্রিয়েটিনিন বাড়ার মানে হচ্ছে তার কিডনি বিকল হয়ে যাচ্ছে। একদা কিডনি বিশেষজ্ঞ ডাঃ আলমগীর চৌধুরী ও ডাঃ নাজমুস সাকিব চৌধুরী রোগীনির হাতের রগ কেটে ফিস্টোলা বসানোর পরামর্শ দেন, যাতে প্রয়োজন হলেই ডায়লাইসিস করা যায়। আমরা ভাবলাম ক্রিয়েটিনিন হয়ত আবার নেমে যেতে পারে, আগেবাগে রগকেটে কেন তাকে আমরা কষ্ট দিতে যাব। কিন্তু অচিরেই বুঝলাম তাদের পরামর্শ কত সঠিক ছিল। একদিন আমরা তাকে নিয়ে এক অবর্ণনীয় বিপদে পড়ি। হঠাৎ তার সারাটা শরীর ফুলে ওঠে এবং প্রস্রাব একদম বন্ধ হয়ে যায়। চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে একবারও প্রস্রাব হলনা। চিকিৎসক বললেন এখনই ভর্তি করে তার কিডনি ডায়লাইসিস করতে হবে। আমরা তাঁকে নুরজাহান হাসপাতালে নিয়ে যাই। তার অসহায় মুখের দিকে চেয়ে আমাদের চোখে অশ্রু ঝরে। তাঁর বয়সী, এমন কি তার চেয়ে পনের/বিশ বছরে বড়রা সবাই সুস্থ্য শরীরে হাঁটাফেরা করছেন, আর তিনি আজ মরণযাত্রী। আমরা গিয়ে তাঁর রোগশয্যায় অসহায়ের মত বসে থাকি।
ইতিমধ্যে প্রস্রাব না হওয়া অবস্থায় দুইদিন পার হয়ে যায়। হাত পা মুখ ফুলে ফুটবলের আকার ধারন করে। ফিস্টুলা বসাতে সার্জন তাকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে হাতের রগ খুঁজে না পেয়ে তলপেঠে অপারেশন করে ফিস্টুলা বসান। এই ফিস্টুলা দিয়ে সেদিন ডাইলাইসিস করা হয়। এই ডাইলাইসিসের পর তার অশান্তি কিছুটা কমে আসে। তলপেঠের এই ফিস্টুলা দিয়ে বেশ কিছুদিন ডাইলাইসিস চলে। কিন্তু অপারেশনের ক্ষতস্থানে মাঝে মাঝে ইনফেকশন হয়। ঢাকা হতে আগত একজন দক্ষ ভাস্কুলার সার্জন অপারেশন করে রোগীর হাতে নতুন ফিশটুলা বসান। এবার হাতের রগ দিয়ে ডাইলাইসিস করা শুরু হয়। সাপ্তাহে তিনদিন ডাইলাইসিস করা হত। একদিন ফুলবুবু আমাকে বললেন এখন আমার প্রস্রাব হয়না। আমি বলি কি একেবারেই হয়না। বললেন না একদম বন্ধ হয়ে গেছে। চিকিৎসককে ব্যাপারটা জানালে বললেন, ডাইলাইসিসের মাধ্যমে মূত্র বেরিয়ে আসে তাই প্রস্রাবের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। কিডনি এখন মুত্র নিঃসরণ করছেনা, তাই রোগীর প্রস্রাব বন্ধ হয়ে গেছে।
তাঞ্জির ও হিমু তাঁকে নুরজাহান
হাসপাতালে নিয়ে দুইতিন ঘন্টা কাছে বসে ডাইলাইসিস করে নিয়ে আসত। শনিবার আমার ছুটি
থাকায় আমি প্রতি শনিবার সকাল ১০টায় তাকে নুরজাহান হাসপাতালে পৌঁছে দিতাম এবং বিকেল
২টার পর নিয়ে আসতাম। প্রতিমাসে আপা ও দুলাভাই দুই রোগীর চিকিৎসা বাবদ প্রায়
লক্ষাধিক টাকা খরচ হত। লন্ডন হতে ভাগনা লবিদ ও হুদহুদ চিকিৎসার খরচ জুগাতো।
তাঞ্জির ও শামস অন্য খরচাদি বহন করত।
দুই বছর এভাবে ডাইলাইসিস চলে। এই
কঠিন দুঃসহ সময়ে শামস ও তাঞ্জিরের বিয়ে হয়। ডাইলাইসিস চলাকালে শেষদিকে রোগীর
প্রেসার বেড়ে যেত, কখনো সুগার ৩ হতে ২০ পর্যন্ত উঠানামা করত। মাঝে মধ্যে শরীরের
দারুন অবনতি হত। কিডনির জন্য ফলমূল নিষেধ, কলেস্টরলের জন্য তেল ঘি নিষেধ, এভাবে সব
ধরনের ভাল খাবারই নিষিদ্ধ, এমনকি পানিও পরিমাপ করে খেতে হত। বেমজা পানিভাত খেয়ে
বেঁচে থাকা, এযেন কেবল প্রাণে বেঁচে থাকার জন্য খাওয়া। মজার মজার খাবার সামনে আছে
অথচ খেতে বারণ, এসবে গ্রাস দিলেই মরণ। প্রথমজীবনে আপার ভয় ছিল একটু বেশী কিন্তু
শেষ জীবনে সেই ভয় কেটে যায়। কষ্ট সইতে সইতে সর্বংসহা হয়ে যান। সব কষ্ট তিনি নিঃশঙ্ক
চিত্তে সহে যান। আর এই সহে যাওয়া ছাড়া কোন উপায়ও ছিলনা। আমি ভাবতাম আম্মা জীবিত
নেই, তার ভাগ্য ভাল যে মেয়ের এই এত কষ্ট তাকে আর দেখতে হলনা।
সতের.
এমন এক সময় আসে ফুলবুবুকে
ডাইলাইসিস করতে বেশ জটিলতা তৈরী হয়। প্রেসার ও সুগার ডাইলাইসিস চলাকালে উতাল পাতাল
নাচানাচি শুরু করে। একদিন হার্টেও সমস্যা দেখা দেয়। ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব
না হওয়ায় অতি জরুরী অঙ্গ হার্ট ধীরে ধীরে বিকল হয়ে পড়ে। রোগীর অবস্থা সঙ্গীন হয়ে
গেলে ভাগনা তাঞ্জির মায়ের এই শোচনীয় সময়ে নুরজাহান হাসপাতালের চিকিৎসক ও সেবিকাদের
সাথে একটু রাগারাগি করে। সিলেটের সেরা হার্ট বিশেষঞ্জরা বললেন, এখন সিলেটে আর করার
কিছু নেই। চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে ঢাকায় নিয়ে গেলে সেখানে হয়ত কোন চিকিৎসা হতে পারে।
হেলিকপ্টার ভাড়া করতে গিয়ে তাৎক্ষণিক পাওয়া গেলনা। আমি ও তাঞ্জির হারামাইন
হাসপাতালে গিয়ে এবার একটি এম্বুল্যান্স কাম হাসপাতাল ভাড়া করি। এই এম্বুলেন্সটি
হার্ট-মনিটর, অক্সিজেন ও স্যালাইন ব্যবস্থা সুসজ্জিল একটি মিনি হাসপাতাল। প্রয়োজন
হলে সাথে চিকিৎসক ও নার্স নেয়া যাবে। আমার ভাগনা ডাঃ তানভির হোসেন চৌধুরী মুন্না ও
মুফতি তানভির সাথে গেল। ডাঃ মুন্না তখন ঢাকায় হার্ট বিষয়ে ডি-কার্ড পড়ছে। আমার বাসায়
থাকা ষাট হাজার টাকা আমি তানভিরের হাতে তুলে দেই।
২রা সেপ্টেম্বর ২০১৭ বাদসন্ধ্যায়
নিশাত, মান্না, আমি ও ঘনিষ্ঠ আত্মীয়রা নুরজাহান মঞ্জিলে মূমূর্ষু আপাকে
এম্বুল্যান্সে তুলে বারবার গ্লাস দিয়ে তাঁর নিস্তজ ও নিস্পাপ মুখটি দেখতে থাকি। আসলে
এই দেখাই ছিল তাঁর সাথে আমাদের শেষদেখা।
আটার.
পরদিন ভাল খবর আসে, ইউনাইটেড
হাসপাতালে আপার চিকিৎসা চলছে, তিনি একটু আরাম অনুভব করছেন। আমরা আশান্বিত হই, যাক
এত কাটখড় পুড়ায়ে রাজধানী যাওয়া কাজে লেগেছে। তাই ৩রা সেপ্টেম্বর ২০১৭ দিনটি আমাদের
বেশ স্বস্তিতে কাটে। কিন্তু রাত ৮টায় খবর পাই হঠাৎ তাঁর শরীরের অবনতি হয়েছে।
আমরা নুরজাহান মঞ্জিলে গিয়ে দেখি সবাই কাঁদছেন। একটু আগে নাকি ফুলবুবু ঢাকার ইউনাইটেড
হাসপাতালে তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। ছোট্ট একটি জীবন, পুত্রকন্যাদের নিয়ে
সাজানো একটি মধ্যভিত্ত সংসার, না আনন্দের না ব্যদনার, এমনই একজন সাধারণ গৃহিনী
ফুলবুবু চলে গেলেন অকালে। চারপুত্র ও দুই কন্যাকে বিয়ে দিয়ে যান সযতনে, কেবল বাকি
থাকে তানভির ও হিমু। কনিষ্ট সন্থান হিমুকে তিনি খুব স্নেহ করতেন, আমি কোন দিকে
যাচ্ছি শুনলেই বলতেন আমার হিমুকে নিয়ে যাও।
উনিশ.
৪ঠা সেপ্টেম্বর ২০১৭। নুরজাহান
মঞ্জিলে আত্মীয়রা জমায়েত হয়েছেন। বড়জরি ও সেনুরা চা বিস্কুট এনে সবার সামনে রাখছে।
বাসায় এক পিনপতন নীরবতা। সবার হাতে তছবিহ, মাথায় টুপি। কেউ কুরআন তেলাওত করছেন,
কেউবা তছবিহ গুনছেন। এমন সময় ফুলবুবুর লাশবাহি এসি এম্বুলেন্স এসে নুরজাহান
মঞ্জিলে প্রবেশ করে। তাঁর মুখপানে চেয়ে মনে হল এতদিনের অমানুষিক কষ্ট ও ধকল পার হয়ে
যেন এক মহাশান্তির ঘুমে শুয়ে আছেন। বাসার আঙিনায় গোসল করানোর আয়োজন করা হয়। আমি
কার নিয়ে ছুটে যাই লোহারপাড়ায় শাহিন ভাগ্নির বাসায়। আমার খালাতো বোন রনকেলির ছফা আপার কন্যা শাহিন ভাগ্নি বিখ্যাত সিলেট গবেষক আসদ্দর আলীর সহধর্মিনি। তিনি ধার্মিকা, সমাজসেবিকা। তিনি মহিলা লাশ ধর্মানুসারে গোসল করান। আমি বাসায় পৌঁছামাত্রই বেরিয়ে আসেন। জলি
আপা, ছোট আপা মান্না, ছোটখালা মরিয়মুন্নেছা, সেনুরা ও আত্মীয় মহিলারা মিলে বাসার সামনে
পর্দাঢাকা খাটে লাশ গোসল করান। গোসল শেষ হলে আমরা তাকে সাদা কাপন জড়িয়ে নুরজাহান
মঞ্জিলের ড্রয়িংরূমে লাশবাহি খাটিয়ায় শুইয়ে রাখি।
আয়ু কাউকে প্রচুর সময় দেয়, কাউকে
তেমন সময় দেয়না। এখানে আমাদের অনেক আত্মীয়স্বজন এসেছেন যারা তার চেয়ে বয়সে অনেক
প্রবীণ। এত ছোট জীবনটাও আনন্দ ছাড়াই নানা রোগ যন্ত্রনায় কাটান। খুব একটা প্রাচুর্যও
ছিলনা। হুদহুদ লন্ডন হতে প্রচুর টাকা পাঠালেও খরচের কোন সীমা ছিলনা। এই টাকা উপভোগ
করার মত শরীর ও মন তখন আর নেই। একবার প্রবাসী বড়পুত্ররা হিমু ও তাঁকে লন্ডন নিয়ে যায়। আসার পর বুঝলাম
লন্ডন তাকে খুব একটা কাছে টানতে পারেনি। বিপরীত ধর্ম ও সংস্কৃতির দেশকে হয়ত তিনি
তেমন বুঝতে পারেননি। কয়েক মাস লন্ডনে কাটিয়ে এসে বললেন দেশটা একদম ঠান্ডা, আবহাওয়া
খারাপ, আমাদের নিজদেশেই সবচেয়ে বেশি আরাম। মুফতি দোলাভাই অবসরে গিয়ে হজ্জ করলেও
তাঁকে নিয়ে যাননি। তাই হাজিনী হওয়া তাঁর ভাগ্যে জুটেনি।
বিশ.
সিঁড়িবেয়ে হজরত শাহজালালের(রঃ)
দরগায় ওঠার ডানদিকে দোলাভাইয়ের কাছে তাঁর কবর খনন করা হয়। স্থানটির অবস্থান মহিলা
এবাদাতখানার ঠিক পশ্চিমে টিলার উপরে। এটি দরগার মুফতিবাড়ির পারিবারিক কবরগাহ।
সেদিন টিপটিপ বৃষ্টি হয়, গোরখোদক সুরুজ আলী তেরপাল টাঙ্গিয়ে কবর খনন করেন। দরগাহ
মসজিদে আসরের নামাজের পরপরই তার নামাজে জানাজা হয়। নামাজের পর আমরা কয়েকটি ফুলগাছ
লাগিয়ে চলে আসি। তবে বৃষ্টির জন্য তেরপালটি বেশ কিছুদিন কবরের উপর ছাতার মত
টাঙ্গানো থাকে। বেশ কয়েকদিন সকালে আমি ভাগ্নাদেরকে নিয়ে জেয়ারত করি।
পৃথিবীতে সবার ভাগ্য কখনও সমান
হয়না। কেউ খুব সুখী হয়, আবার কেউ জীবনভর কেবল কষ্টই সহে যায়। দুনিয়াতে তিনি
নাতিদীর্ঘ জীবনে রোগের কারণে কেবল কষ্টই করে গেছেন, খুব একটা আরাম আয়েস করেননি। মহান আল্লাহের
কাছে আমাদের আকুল প্রার্থনা ‘হে রাহমানুর রহিম তুমি আমার এই জৈষ্ঠ্য বোনকে
জান্নাতুল ফিরদাউসে দাখিল করুন। আমিন’। আমার শোকে দুঃখে মাথায় হাত বুলিয়ে দেবার,
বিপদে আপদে সান্তনা দেবার বড়বোন ফুলবুবুকে হারিয়ে আমি বাকি জীবনের জন্য যেন অনেকটা
একা হয়ে গেলাম।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন