চতুর্থবার
যুক্তরাষ্ট্র যাত্রা, এযাত্রায় নিউইয়র্ক, আবুধাবি এবং দুবাই সফরঃ
চতুর্থবার যুক্তরাষ্ট্র যাত্রার প্রক্কালে আমি সিন্ধান্ত নিলাম এবারের ফিরতি পথে সংযুক্ত আরব আমিরাত সফর করে আসব। ইতিহাদ এয়ার লাইন হতে পুত্র জেফার ও পত্নী নুরজাহান চৌধুরী ও আমার জন্য তিনটি
রিটার্ন টিকেট কিনলাম। ১৫ জুন শুক্রবার
ছিল রমজান মাসের সর্বশেষ দিন। দুটি বড়ব্যাগ, দুটি
হ্যান্ডব্যাগ ও সামান্য ইফতারী সাথে নিয়ে নবএয়ারের ফ্লাইটে সিলেট বিমানবন্দর হতে
ঢাকা শাহজালাল আন্তজাতিক বিমানবন্দরে পৌছি। সিলেটে বৃষ্টি রেখে আসি অথচ ঢাকা
মেঘহীন। ঢাকা বিমানবন্দরে তিনঘন্টা কাটিয়ে
ইতিহাদের বর্ডিং কার্ড সংগ্রহ করি। অফিস হতে ষোলদিনের ছুটি নিয়েছি তাই ষোলদিনের মধ্যেই ফিরে আসবো।
নিউইয়র্ক ছয়দিন, আমিরাত পাচদিন ও বাকী দিনগুলো যাত্রাপথের জন্য বরাদ্ধ রইল।
ঢাকা হতে রাত দশটায় উড়ে পাঁচঘন্টা পর আবুধাবী আন্তজাতিক বিমানবন্দরে অবতরন করি। এই
বিমানবন্দরে স্থাপিত যুক্তরাষ্ট্রের হোমল্যান্ড সিকিউরিটি অফিসে আমাদের ইমিগ্রেশন হয়, মার্কিন
ইমিগ্রেশন অফিসার এহসান মালিক আমাদেরকে যুক্তরাষ্ট্রের ইমিগ্রেশন আইন বুঝাতে একজন
বাংলাদেশী দুভাষী লোক খুঁজেন কিন্তু নাপেয়ে ভগ্নমনে ছেড়ে দেন। তাই নিউইয়র্ক
বিমানবন্দরে নেমে আমাদের আর কোন ঝামেলা রইলনা। দুইঘন্টা পর আবুধাবী হতে নিউইয়র্ক
অভিমুখি তেরঘন্টার সুদীর্ঘ্য যাত্রা শুরু হল। দুতলা উড়ালযানে প্রায় ছয়শত যাত্রি
ছিলেন। ইতিহাদের খাবার মান খুব ভাল, যাত্রিসেবাও
উন্নত।
যুক্তরাষ্ট্রের ১৬ই জুন শনিবার
আমরা নিউইয়র্কের জে এফ কে বিমানবন্দরের চারনম্বর টার্মিনালে অবতরন করি। বেরিয়ে
আসার কিছুক্ষণ পর আমার সমনদিক আজিজ এ চৌধুরী আমাদেরকে নিয়ে যেতে হাজির হন। তার
পুত্র আরিক খেলতে গিয়ে পায়ে আঘাত পেয়ে শয্যাগত থাকায় গাড়ি গ্যারেজ বন্দি, তাই
একটি হলুদ টেক্সিক্যাবে দশবার মিনিটে তাদের ওজনপার্কের বাসা যেতে হয়। মিটারে
ভাড়া আসে ২৩ আমেরিকান ডলার। আগের দিন ১৫ জুন আমরা প্লেনে অবস্থানকালে নিউইয়র্কে ঈদ
হয়ে গেছে। জীবনে এই প্রথম একটি ঈদের দিন আকাশে অসনাক্ত হয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।
নিউইয়র্কের দিন বাংলাদেশের রাত হওয়ায় চোখজুড়ে ঘুম আসে। দিনটা ঘুমিয়ে পার হয়।
দুপুরে এক অদ্ভুদ ফল খাই, ফলটির নাম এভোকেডো ফ্রুট। অদ্ভুদ বললাম এই কারনে যে এটির
স্বাদ না মিষ্টি, না টক। ফলটির রঙ সবুজ পরিপক্ক হলে কাল। ভিতর ঘিরং এবং খেতে ঘন
ঘিয়ের স্বাধ। তার বীজ দেখতে গোলাকার ছোট লাল বল।
বিকেলবেলা আমার আত্মীয় ভ্রাতা
রনকেলী গ্রামের সাহাদ ভাই আসেন। আমি সজাগ থাকলেও বাকীরা ঘুমে আচ্ছন্ন থাকায় আমি ও
আজিজ ভাই ছুটলাম সাহাদ ভাইয়ের বাসায়। সাহাদ ভাই কোরানের সুরা পড়ে অনুবাদ করে করে
গাড়ি চালান। তিনি কোরানের প্রতিটি শব্দের অর্থ জানেন। তারা দুইজন এমসি কলেজের ১৯৭৬
সালের এইচ এস সি (বিজ্ঞান) পরীক্ষার্থী ব্যাচের সহপাঠী ও একই সময়ের এই কলেজের আবাসিক হোস্টেলবাসীও ছিলেন। সাহাদ
ভাই এখানে একত্রে জোড়বাসা ক্রয় করেন। মাঝের দুইবাসা একত্রকরা বেশ বড়সড় বাসাটিতে
নিজে থাকেন। উপরে দুই বাসায় চার হাজার
ডলার ও নিচের বেজমেন্ডের দুইবাসায় দুই হাজার ডলার ভাড়া পান। বাসাটির সামনে ও পিছনে
প্রচুর খালি জায়গা ও বাগান রয়েছে। তার দুইটি ট্যাক্সীক্যাবের লাইসেন্স রয়েছে, এগুলো
ভাড়া দিয়ে বিনাকষ্টে প্রচুর আয় করেন। এখানে ভাবীর হাতে তৈরী নানাপদের মজাদার
নাস্থা খাই ও ছবি উঠাই। রাতে ফেরার পথে কুইন্সে বড়মামা ছাদ্দিক চৌধুরীকে দেখতে
যাই। আচমকা আমাদেরকে দেখে তারা হতচকিত হন। কিছুদিন আগে ওপেনহার্ট সার্জারি করা মামাকে
বেশ প্রশান্ত মনে হল। ২০১৫ সালে নিউইয়র্ক এসে আমরা কয়েকদিন এই সুন্দর ছিমছাম বাসায়
ছিলাম। তিন বছর পর আবার আসলাম। ভাগ্নি নিয়ামা ও মুনিয়াতের সাথেও দেখা হল। এখানে
মামী ও বোন রিপা এত নাস্তা টেবিলে এনে সাজালো যে রাতের খাবার প্রায় হয়েই গেল।
১৮ ও ১৯ জুন পাশের সপিংমল ও
বাগানে হেটে ব্যায়াম করে পার হয়। বদ্ধঘরে গরম
মনে হলে বাহিরের ঠান্ডা বাতাসে হাঁটলে আরাম অনুভূত হয়। রাতে বৃষ্টির পর পার্কে হেটে আসি।
কাটের চেয়ারে বসে গল্প করি। ওজনপার্কে এত বাংলাদেশী বাস করেন যে মনে হল বাংলাদেশেই আছি।
এইখানে বাংলাদেশীদের বেশীরভাগ সিলেটি ও এই সিলেটিদের প্রায়ই বিয়ানীবাজারের লোকজন।
দোকানপাঠ, বাসাবাড়ি, ফুটপাত সবখানে বাংলাদেশীদের
ছড়াছড়ি। মান্নান সুপার মার্কেটের শাখাসহ অসংখ্য বাংলাদেশীদের মুদীদোকান, হোটেল
রেস্টোরা, ওয়াসিং মেশিনসহ নানা ব্যবসা প্রতিষ্টান বড় রাস্থার পাশেপাশে
গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশী বুড়ো লোকজন মিলে পার্ক ও রাস্থাপাশের ব্রেঞ্চে বসে অলস আড্ডা
দিয়ে সময় কাটান। আজিজ চৌধুরী বললেন এসব লোকজন আরামে খাওয়াপরার নিশ্চয়তা পেতে এদেশে
এসেছেন। বুড়ো বয়সে বার্ধক্যভাতা, ফ্রি চিকিৎসা সব পান। ডাক্তারের কাছে যাবার ট্রেন টিকেটও
ফ্রি পান। তারাতো তাদের সব চাওয়াই এখানে পেয়ে যান, তাই তারা সবাই
মসজিদে প্রভূধ্যানে ও পার্কে খুশগল্প করে পত্রিকা
পড়ে দারুন সুখে দিন কাটান। উন্নত এই দেশে সরকার তার জনগণকে নিজ সন্তানের মত আগলে
রাখে। সব চিকিৎসা খরচ ইন্সুরেন্স কোম্পেনী বহন করে আবার সামথ্যহীন লোকজন জটিল
চিকিৎসা সম্পূর্ন ফ্রি পেয়ে থাকেন। কেউ আয়হীন কিংবা প্রতিবন্ধি হলে তাদের
ফুডস্ট্যাম্প ও বাসস্থানের দায়িত্বও সরকার বহন করে। এখানে পুরো জীবন একটা সরকারী
নিরাপত্তার চাদরে ডাকা থাকে। এদেশে জাকাত কিংবা ভিক্ষা গ্রহনের লোক খুজে মেলা ভার, কারন সবার
সব চাওয়া পাওয়া সরকারই পূর্ণ করে দেয় তা খাবার, বাসস্থান, কঠিন
চিকিৎসা খরচ যাই হোক না কেন।
এত সুযোগ সুবিধার দেশে আমাদের
দেশের বড়লোকেরা কিন্ত আর লাভের আশায় এসে কিছুটা বিপদেই পড়েন। এখানে কোন প্রহরী নেই, গৃহকর্মি
নেই,
গাড়িচালক নেই। নিজহাতে যখন চাকরের কাজ করেন তখন টের
পান বাংলাদেশ কেমন। বাংলাদেশের সব কালো দিক তখন তাদের চোখে সাদা হয়ে যায়। কল্পনার আয়নায় তখন
ধরা পড়ে কত ধানে কত চাল। যুক্তরাষ্ট্র
পুজিবাদী কল্যাণ রাষ্ট্র। এখানে আসলে ফ্রি লান্স বলে তেমন কিছু নেই। এখানে ভাল
অঙ্কের বার্ধক্য ভাতা ও সুযোগ সুবিধা পেতে হলে দীর্ঘ্যদিন যুক্তরাষ্ট্রে কাজকরার
অভিজ্ঞতা দেখাতে হয়। অতীতে ভাল ইনকামটেক্স দাতা হতে হয়। যার রেকর্ড ভাল নয় তিনি
সুযোগ সুবিধা সীমিতই পেয়ে থাকেন।
২০শে জুন আরিকের ডাক্তার দেখাতে
আলমাকে নিয়ে এম্বুলেন্সে আমি ও জেফার ম্যানহাটান ব্যালাবু হাসপাতালে যাই। তিন বছর
পর আমি আবার ম্যানহাটানের মাটিতে পা রেখেই হেটে হেটে জাতিসংঘের প্রধান কার্যালয়ে
যাই। ২ নং এভ্যিনিউ ৪৩ স্ট্রিটে জাতিসংঘের প্রধান কার্যালয়ের গেটে সিকিউরিটিরা গেট
বন্ধ রাখায় ভিতরে ডুকার সুযোগ পাইনি। পৃথিবীর সব দেশের পতাকার লাইনে আমাদের লাল
সবুজ পতাকা সগৌরবে উড়তে দেখলাম। গ্লাসের সুউচ্চ ভবনের সামনে জলের ঝর্নাধারা, পাশে
ইউ এন ও এভ্যিনিউ। সামনে আবার হার্ডসন নদীর তরঙ্গমালার সাথে দেখা হয়ে গেল। সময় নেই, তাই
সেন্ট্রাল পার্ক এবার দেখা হলনা।
২১জুন ২০১৮ বৃহস্পতিবার, আজিজ
ভাই,
জেফার ও আমি মেট্রোট্রেনে কয়েক স্টেশন পেরিয়ে টি ডি ব্যাংকে যাই। এখানে একটি কলমদানিতে প্রচুর বলপেন ও একটি পাত্রে প্রচুর চকলেট রাখা আছে। কাস্টমাররা কলম ও চকলেট ফ্রি নিয়ে যান। এখানকার মেট্রোট্রেন কম্পিউটারের মাধ্যমে অটোমেশনে পরিচালিত হয়। কোন ড্রাইভার ও টিকেট চেকারের দরকার হয়না। প্রতি স্টেশনে কেবল একজনমাত্র লোক টিকেট ইস্যু করে থাকেন। আমাদের চল্লিশজন লোকের কাজ হয়তো একজনেই করে থাকেন। উচ্চ প্রযুক্তির সহায়তায় খুব অল্প খরচে মেট্রোরেল পরিচালিত হওয়ায় এখানে জনগণ অতি সস্তায় ট্রেন ভ্রমনের সুযোগ পেয়ে থাকেন।
ওজনপার্কের রাস্থার ফুটপাতে
নানান ফলের পসরা সাজিয়ে বসে আছেন একজন বিয়ানীবাজারি ভদ্রলোক। গরমের রোদে ও
শীতের
বরফে দাড়িয়ে এই ফুটপাত ব্যবসা করে তিনি তার মার্কিনজীবন পারিদিয়ে যাচ্ছেন। সামনের
মান্নান সুপার সপে প্রবেশ করলাম। জিন্সের প্যান্ট ও গেঞ্জিপরা একজন লোক এসে বুকে
জড়িয়ে ধরলেন। চিনতে সামান্য বেগ পেতে হল। তিনি কানাইঘাটের ফজল মিয়া, যিনি
এক সময়ের আমার চারতলার ডান ফ্ল্যাটের ভাড়াটিয়া ছিলেন। ফজল মিয়া ও তার স্ত্রী ছিলেন
কট্টর জামাতি। দেশে তার স্ত্রী জামাতিদের মহিলা মাহফিল নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাতেন।
ফজল মিয়া কোন এক প্রাইভেট কলেজে প্রভাষক ছিলেন। তিনি করতেন মৎস্য চাষের ব্যবসা।
দেশে দেউলিয়া হয়ে নিদারুণ অর্থকষ্টে দিন কাটাতেন। তিন সন্থান নিয়ে বেদ্বীনের দেশ
আমেরিকা এসে খুব খুশি। মাসে ৫০০ ডলার ফুডস্টাম্প পান, ঘন্টায় ১৫ ডলার
মজুরীতে চাকুরী করেন। তার স্ত্রীও এক মাদ্রাসায় পার্ট টাইম আরবী পড়ান। ফজল
মিয়ার দুঃখের দিন শেষ, তাই চেহারা সুরত বদলে গেছে, মনে হয় বয়স
অনেক কমে গিয়ে তিনি যেন বয়সে তরুন হয়ে গেছেন।
নিউইয়র্কে সরকার নির্ধারিত
নুন্যতম মজুরী প্রতি ঘন্টায় ১৫ ডলার। কিন্তু অদক্ষ ও অবৈধ অভিবাসীরা ঘন্টায় ১০/১২
ডলারেও কাজ করতে দেখেছি। এদেশে আয়ের সাথে প্রচুর ব্যয় এসে হাজির হয়। টেক্স, স্বাস্থ্য
ইন্সুরেন্স, গাড়ি ইন্সুরেন্স, গাড়ি ও বাসার ঋন কিস্তি, নানা ইউটিলিটি
বিল ইত্যাদি। আমেরিকার লোকজন আমাদের মত এত কঠিন পরিশ্রম করেনা। মুঠে বওয়া , রিকসা
চালান,
ঠেলা টানা, ইটপাতর ভাঙ্গা, কোদালে মাটিকাটা, হালচাষ, লোহা পেঠানো ইত্যাদি অমানুষিক পরিশ্রমের কাজ যুক্তরাষ্ট্রে
নেই। তাদের সব কঠিন কাজগুলো মেশিন ও কম্পিউটার অটোমেশনে করে ফেলে। কাজের পরিবেশও
আমাদের চেয়ে অনেক অনেক ভাল। তবে তারা চেয়ারবিহীন অফিসে দাড়িয়ে দাড়িয়ে কাজ করে। উন্নত
সফটওয়ারের জন্য অফিস ও ব্যবসায় মানসিক শ্রমও তেমনটি নেই, সফটওয়ার
অপারেইট জানলেই হল। যন্ত্রচালিত অলস জীবনধারার ক্ষতিকর দিক
অপসারন করতে তারা সামান্য মাসিক চাঁদা পরিশোধ করে হেলথক্লাবের সদস্য হয়ে নানা
আনন্দময় ব্যায়ামের আশ্রয় গ্রহন করেন।
আজ রাতে আমরা বাসার সবাই মিলে
মেডিটরিয়ান মমস হোটেলে টার্কিস খাবার খাই। এই দিনটি
নিউইয়র্কে আমাদের এবারের শেষ দিন। কালকে আমিরাত সফরে নিউইয়র্ক ছেড়ে চলে যাব। আমার
বড়ভাই তাহমিদ চৌধুরী লন্ডন হতে সপরিবারে ক্যানাডার বোনের বাসায় এসেছেন। আগামীকল্য
তারা নিউইয়র্ক আসবেন। মাত্র একটি দিনের জন্য ভাতিজা আজফার ও ভাতিজি নওশিনের সাথে
দেখা হলনা। ইতিহাদ ও আমিরাত এয়ারলাইনে ভ্রমনকালে বেশ কয়েকবার দুবাই ও আবুধাবি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আমরা পদচারনা করলেও দেশটির ভিতর
প্রবেশ করার সৌভাগ্য আমাদের হয়নি। মনে মনে আনন্দ অনুভব করলাম মহান আল্লাহর অপার
করুনা ও মেহেরবানিতে আমাদের ভ্রমণকাহিনীতে আরেকটি তৈলসমৃদ্ধ চাকচিক্যময় মরুদেশ যুক্ত
হতে যাচ্ছে। রিটার্ন টিকেটে দুবাই হতে ছয়দিন পর ঢাকায় ফেরত
যাত্রার তারিখ নির্ধারিত রয়েছে।
২২ জুন ২০১৮ সাল, শুক্রবার। সকাল
১০টায় বেরহয়ে একটি হ্লুদক্যাবে নিউইয়র্ক জন এফ কেনেডি আন্তজাতিক বিমানবন্দরে
প্রবেশ করি। সাথে ছিলেন আজিজ ভাই। ইতিহাদের ফ্লাইট নং ০১০২ বিমানবন্দরের চারনম্বর
টার্মিনাল হতে বিকেল ২-৪০ মিনিটে আকাশ যাত্রা শুরু হয়। প্রায়
তের ঘন্টা পর ২৩ জুন ২০১৮ সাল, বেলা সকাল ১১-৪০ মিনিটে আমরা আবুধাবী আন্তজাতিক বিমানবন্দরে অবতরন করি।
ইমিগ্রেশন দিয়ে বের হতে চাইলে তারা পাশে ট্রানজিট ভিসা অফিস দেখিয়ে দিল। আমি
চারদিনের ট্রানজিট ভিসার আবেদন করলে তারা একমাসের ভিসা প্রদান করল। তারা আমাদের
তিনজনের ভিসা ফি বাবদ ৩৬২*৩= ১০৮৬ আমিরাত দিরহাম ক্রেডিট কার্ড মাধ্যমে জমা করতে বলল।
আমাদের ক্রেডিট কার্ড নেই, আবার নগদ প্রদানের কোন সুযোগও নেই। আবার কাছের ইতিহাদ অফিসে
ছুটলাম। ইতিহাদে কর্মরতা একজন স্মার্ট ভারতীয় সুন্দরী তার কার্ডের মাধ্যমে আমাদের
ফি জমা প্রদানে রাজী হন। তার হাতে ১১০০ দিরহাম তুলে দেই। সাথে আনা প্রচুর খাবার খেয়ে
আমরা পাশে বিছানো তুলতুলে নরম জায়নামাজে সব ওয়াক্ত কছরের নামাজ আদায় করে সোফায় বসে
রই। তিন চার ঘন্টা পর ডাকপেলাম একমাসের ভিসা হয়ে গেছে। আবুধাবী আন্তজাতিক
বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন ও নিরাপত্তা চেকিং পার হয়ে নিচের ব্যাগেজ বেল্টে এসে
আমাদের ব্যাগদুটি সামনে পেয়ে যাই। বের হয়েই ডুবাই যাবার টেক্সি খুঁজতে থাকি।
আবুধাবী হতে ডুবাই দুই ঘন্টার রাস্থা, যদিও আমাদের দেশে এতটুকু রাস্থা পার হতে অন্ততঃ
চারপাঁচ ঘন্টা লেগে যাবে। ২৮০ দিরহামের কমদরে কোন ট্যাক্সি নেই।
চারপাশে শুষ্ক গরম হাওয়া বইছে। এসি হতে বের হয়ে যেন কোন এক কারখানার আগুনে পড়লাম।
আমি ভাড়া নিয়ে ইতস্ততঃ করছি দেখে একজন আরবি ভদ্রলোক এসে বললেন আপনি কি ইতিহাদের
যাত্রি? আমি হ্যাঁ বললে তিনি একটু দূরে ইতিহাদের একটি বাস দেখিয়ে
বললেন ঐ বাসে আপনি ইতিহাদের বিমানটিকেট দেখালে বিনেভাড়ায় দুবাই যেতে পারবেন। বের
হয়েই আমার ৩০০ দিরহাম সেইভ হয়ে গেল। ইতিহাদের বাসে চড়ে জানলাম তাদের বাসে এখানে
ফিরে আসাও ফ্রি হয়ে যাবে। আল্লাহর অপার মেহেরবানীতে মোঠ ৬০০ দিরহাম ভাগ্যবলে খরচ
না হয়ে বাজেটে বেঁচে গেল। মাত্র পনের বিশ জন নানাদেশী যাত্রি নিয়ে বাসটি দূবাইয়ের
পথে রওয়ানা হল। রাস্থাটির নাম শেখ জায়েদ মহাসড়ক। বিভিন্ন স্থানে আরবী
ড্রেসপরা শেখ জাহেদের ছবি শোভা পাচ্ছে। বাসের অর্ধেক আসনই খালি। প্রত্যেকের
হাতে ধরিয়ে দেওয়া হল এক একটা ঠান্ডা পানির বোতল। নতুন দেশ দেখবো তাই বসলাম বাসের
সামনের সিটে জানালার পাশে। পারশ্য উপসাগরের পূর্বতীরের এই আরব দেশটি আসলে আরব
উপদ্বীপের এক বালুপাতরের মরু অঞ্চল। এখানে বছরে মাত্র পাঁচসাত দিন বৃষ্টিপাত হয়।
কিন্ত রাস্থার এত সবুজ দেখে মনেই হয়না দেশটি বৃষ্টিহীন মরুভূমি। নানা ডিজাইনের
দৃষ্টিনন্দন ফুলে ফলে নুয়ে থাকা খেজুরগাছের সারি, সেইসাথে নিম, কুল, ক্যাকটাস, কৃত্রিম বনবনানী এত ছড়িয়ে আছে যে চোখ জুড়িয়ে যায়। সারিসারি
রাস্থাগুলো উন্নত দেশগুলোর রাস্থাকেও হার মানাবে। রাস্থার হরিৎ বৃক্ষমালার বাহিরে
দৃষ্টি গেলে চোখে পড়ে বালুর হলুদ জমিনে ছিটা ছিটা সবুজের জলছাপ। এই সবুজ জলছাপে
আছে ঘাস ও কাটার মরুদ্যান। সারাটা মরুভুমি জুড়ে ছাপড়া ছাপড়া এসব সবুজের স্থুপে যুগে
যুগে যাযাবরের দল তাদের উট ও দুম্বার পাল নিয়ে ঘুরে বেড়াত। কিন্তু আজ এই আধুনিক
যুগে এই সুদীর্ঘ্য পথে কোন উট দুম্বা কিংবা যাযাবর তাবুর দেখা পেলামনা। বালির
ময়দানের সীমানা শেষ হয় বৃক্ষহীন রুক্ষশুষ্ক শিলার পাহাড়ে। দেশটা যেন উন্নত বালু ও
পাতরের এক সুবিস্তৃর্ন খনি। এবার ডুবাই রাজ্যের সীমানায় গাড়ি প্রবেশ করল। আবুধাবির
তুলনায় দুবাই রাজ্যে সবুজের প্রাবল্য খানিকটা কমই মনে হল। আবুধাবী দেশটির রাজধানী
হলেও দুবাই সবচেয়ে বড় শহর ও বৃহত্তম বানিজ্য কেন্দ্র। পরিচ্ছন্ন
ছিমছাম নগর ডুবাই। সুপ্রশস্ত বহুলেইন রাস্থার দুইপাশে চকচকে কাঁচের আকাশছোঁয়া ভবন।
রঙ্গীন গ্লাসে সুর্্যের আলো প্রতিফলিত হয়ে ঠিকরে ঠিকরে এসে রাস্থায় পড়ছিল। শহরের
বুকচুরে অগ্রসর হয়ে অনেকক্ষণ পর সুপ্রসিদ্ধ ডুবাইমলের বিপরীতে শেখ জায়েদ রোডের
পাশে মাজায়া সেন্টারের ইতিহাদ অফিসে এসে বাসটি থামল। নেমে বড় সড়কে গিয়ে টেক্সিক্যাব
ধরি। চালককে জুমায়রা বিচের পাশে চার তারকা
হোটেল,
রিজেন্ট বিচ রিসোর্টে নিয়ে যাবার ঠিকানা দেই। ড্রাইভার পাকিস্তানি পাঠান, নাম
ইমতিয়াজ খান, বাড়ি পেশোয়ারের সন্নিকটে এক গ্রামে। এখানে কারে উঠামাত্রই
মিটারে ৫ দিরহাম, আবার
বিমানবন্দর গুলোতে ২০ দিরহাম কাটা পড়ে। গাড়ি চলামাত্র ৫ অথবা ২০ দিরহামের পর হতে বিল আসা আরম্ভ হয়।
চালক জুমায়রা বিচরোডে বেশ খুজে হোটেলটি বের করেন। তিনজনের একটি ফেমিলি স্যুট
নিলাম। দুবাইয়ে ডিসেম্বর হতে মার্চ পর্যটন সিজন। এই সময় ধনী শীতপ্রধান দেশ হতে
এখানে হাজার হাজার পর্যটক আসেন। দুবাইয়ে এখন অফফ পর্যটন সিজন হওয়ায় হোটেল অনেক
সস্তা। তিনদিনের ভাড়া বাবদ ২৪০ আমেরিকান ডলার পরিশোধ করে শেষদিন কয়টা পর্যন্ত
অবস্থান করতে পারব জেনে নেই। সকালের বুফে নাস্তা
এই বিলে অন্তভূক্ত করা হয়। এই রিসোর্টের
ডিনারের ব্যবস্থাও আছে, তবে বিল এক্সট্রা পরিশোধ করতে হয়। এবার গরম পানিতে সবাই
গোসল করে ঘুমিয়ে পড়ি। সন্ধ্যা নাগাদ ঘুম্ ভেঙ্গে গেলে আমরা রিজেন্ট হোটেলের
ইন্ডিয়ান রেস্তুরায় গমন করি। শাড়িপরা স্টাইলিস্ট একজন ইংরেজি দক্ষ ইন্ডিয়ান
সুন্দরী হোটেলটি পরিচালনা করেন। তার শাড়ি ও চুলের স্টাইল, মাথার সিদুর ও
কপালের লালটিপ যেন পুরো ভারতীয় নারী সমাজকে
প্রতিনিধিত্ব করছে। ফিলিপিনো মেয়েরা খাবার পরিবেশন করেন। আমি তাদেরকে নেপাল
কিংবা আসামের উপজাতি মেয়ে সন্দেহ করলে তারা বলল, অনেকেই এমনটি
ভাবে তবে আমরা ফিলিপাইনের মেয়ে। মোরগ পোলাও, ডাল খিচুড়ি ও
কোকের অর্ডার দেই। সাথে সাথে সামনে চলে আসে এক থালা পাপড়, সেই সাথে সস, আচার, টক দই
ও মিনহাজ। আধা ঘন্টার মধ্যে সদ্য রান্না করা গরম খাবার ও সালাদ টেবিলে এসে যায়। বড়
বাটির উপরে পোলাও এবং তলায় মোরগের ফ্রাই। অন্য বাটিতে অতি সুস্বাধু জাল ডাল খিচুড়ি। আন্তাজ
করলাম এই খিচুড়িতে তিনভাগ চাল ও একভাগ ডাল রয়েছে। বাংলাদেশে এমন মজাদার খিচুড়ি
তৈরি হতে দেখিনি। তিনজনের ভালভাবে ডিনার হয়ে গেল। বিল পরিশোধ করলাম ৮৫ দিরহাম।
হোটেল হতে রাত ৮টায় বেরিয়ে রাতের
জুমায়রা বিচের রূপসুধা পান করতে ছুটলাম। বিচটির দূরত্ব মাত্র চারপাচ মিনিটের
হাঁটার রাস্থা। বিশ্বের সেরা স্থপতিরা হয়ত জুমায়রা বিচদুটি সৈকতের সুসজ্জিত
উপশহরসহ ডিজাইন করেছেন। দুইটি জুমায়রা বিচের মধ্যখানে মানব সৃষ্ট একটি ছোট উপদ্বীপ, দুটি
বিচের অন্য দুদিকে পাতরের জমাটবদ্ধ বাধে পারস্য উপসাগরের ঢেউমালা আচড়ে
পড়ে আর প্রবলশক্তি নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে। প্রতিটি খানিক
বৃত্তাকার বিচের স্বচ্ছ বালির বেলাভূমির দৈর্ঘ্য হবে প্রায় অর্ধ কিলোমিটার।
বিচপারের উপশহর রাতে এক রঙ্গীন স্বর্গরাজ্যের রূপ ধারন করে। এই দুই জুমায়রা সৈকত
যেন অপূর্ব সুন্দর ঘুঙ্গুর হয়ে সেজে আছে পারশ্য উপসাগর নামক কোন এক অপরুপা রমনীর রাঙ্গা
দুটি পায়। স্তরে স্তরে সাজানো রাস্থামালা, রাস্থার
উপর জুড়ে মশারির মত বর্নিল লাইটের জাল রাতকে যেন দিনের মত উদ্ভাসিত করে তুলে। দুইরাস্থার
মাঝঘিরে পরিপাঠি ফুলবাগ ও বৃক্ষসজ্জায় সুসজ্জিত বার, সপিং মল, রেস্তুরা, ব্যায়ামাগার, গেইম
স্পট,
নানান দেশের খাবার হোটেল, এমুজমেন্ট পার্ক, পোষাক গহনাসহ নানা পন্য বিক্রয়কেন্দ্র ও পাঁচ তারকা আজস্র
আবাসিক হোটেলের মিলন মেলা। খেজুর গাছ
পেছিয়ে টপ পর্যন্ত সজানো লাইটিং বেশ মনমুগ্ধকর। মৃদু মধুর মুর্চনায় বাজছে হিন্দি
আরবি ও পশ্চিমা সঙ্গীতের সুর লহরী। বিচের আবছা আলোয় মৃদুমন্দ হাওয়ায় আমার দৈনন্দিন
চল্লিশ মিনিটের হাটার পর্বটা সেরে নিলাম। সৈকতে অনেকক্ষণ আমরা তিনজন
হাঁটাহাঁটি করে রাত ১১টায় রিসোর্টে ফিরে এলাম।
২৪ জুন ২০১৮ সাল। পাখির
কলকাকলিতে ঘুম ভাঙ্গল। ডাঃ নুরজাহান ও জেফার তখনও ঘুমে আচ্ছন্ন। জানালায় পর্দা
সরিয়ে বাহিরে চোখ রাখলাম। পাশে চারটি সমউচ্চ খেজুরগাছ জানালার সমতলে হলুদ ফলে ছেয়ে
আছে। এক একটি গাছে অন্ততঃ দুইমন করে খেজুরফল ঝুলে আছে। এই খেজুর বৃক্ষদেরে খুটি
করে তেরপালের ছাদ তৈরি করে নিচে একটি আরবী খাবারের হোটেল। ছাদের উপরে ফল ফুল পাতা
মেলিয়ে চার খেজুরবৃক্ষ যেন ফ্যাশন স্যুর মডেলদের মত নিজের সব রূপ সৌন্দর্য্য উজাড়
করে তুলে ধরেছে। এই খেজুর গাছে অনেক পায়ুলাল বুলবুলি, চড়ুই, ঘুঘু, ময়না
ইত্যাদি পাখিরা ফল খেয়ে খেয়ে কিচির মিচির করছে। কিছু পাখি রস মুখে করে নিয়ে
মাতৃস্নেহে বাচ্ছাদের মুখে ডেলে দিচ্ছে। মনে পড়ল শৈশবের একটি ছড়া-“বুলবুলি
গো বুলবুলি, তোমার পায়ু কেন লাল আল্লায়
বানিয়ে দিছেন, গুয়া খাওয়ার গাল।“
রিসোর্টের রিসিপশন হতে তিনদিনের ব্রেকফাস্টের টোকেন এবং তাদের ইন্টারনেট লাইন ব্যবহারের পাসওয়ার্ড পেলাম। টোকেন নিয়ে
সকাল ৮টায় রিসোর্ট সংলগ্ন আলীবাবা রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করি। বুফে খাবার পদ্ধতি, আইটেমের
পর আইটেম খাবার তাকে তাকে সাজানো। রান্না ব্লাঙ্কেটের নিচে বার্নার লেমে আগুন
জ্বলছে।
সব খাবারই গরম ও সুস্বাধু। মেশিনে টিপ দিলেই আঙ্গুর, আপেল, আনারাস, কমলা ও
আপেল জুসে গ্লাস ভরে যায়। পরের টেবিল চা, কফি, গ্রিন টি, গরম জল, দুধ, কনপ্লেক্স, চিড়ে, কুকারিজ
ও উইটাবিচ। পরের টেবিলে এক গামলা ভরা কুচি কুচি নানান ফলের মিশ্রন, একটি
পাত্রে কালো ভারতীয় মিষ্টি যা প্লেটে নিয়ে দেখলাম আসলে মিষ্টি নয় একধরনের উন্নত
বিচিবিহীন নরম সুস্বাধু খেজুর। পাশে লাল গম ও চালের লোফ। মেশিনে রাখলেই গরম হয়ে
বেরিয়ে আসে। কাছে রাখা পনীর, মাখন, জেলি ও সিদ্ধ ডিম। সব শেষে চার ব্লাঙ্কেট ভরা গরম পোলাও, জালফ্রাই, চৌমিন, মাটন, পরটা, মাংসের
সমুচা,
চিংড়ি, বিফ, সবজি, ডাল ইত্যাদি। কিছু আইটেম খাওয়ার পর উদর পুর্ণ হয়ে যায়, বাকী
সব আইটেম কেবল চোখে দেখে আসতে হয় মাত্র।
আজকের দিনটি আমরা দুবাই মহানগর
ঘুরে দেখার জন্য বরাদ্ধ রাখি। ব্রেকফাস্টের পর একটু সীবিচ ঘুরে শহর ভ্রমনে বের হলাম। কোন
বাংলাদেশী ট্যাক্সিক্যাব খুজে নাপেয়ে এবার পড়লাম আরেক পাকিস্তানি চালকের ঘাড়ে। এই
ড্রাইভারের নাম সালমান, বাড়ি পাকিস্তানের পাঞ্জাব। তিনি ভাল উর্দু ও হিন্দি জানেন।
বিদেশীদের সাথে চালিয়ে যাবার মত তার যথেষ্ট ইংরেজী জ্ঞানও রয়েছে। ইন্টারনেট হতে
ডুবাইয়ের ভিজিট স্পটগুলোর তালিকা বের করে সালমানের হাতে দেই। একে একে
স্পটগুলোতে নিয়ে গিয়ে ড্রাইভার সালমান
এগোলার বিবরন দেন। তিনি আমাদেরকে ছবি উঠাতেও সহায়তা করেন। তিনি প্রথমে ডাউন
টাউনে আমিরাতের সেরা নির্মান কোম্পানি আমায়ার বিল্ডিং বন্সট্রাকশন এর অনেকগুলো
বহুতল ভবনের অফিসরাজ্যে নিয়ে যান।
তারপর নিয়ে যান বিশ্বের সর্বোচ্চ
ভবন বুরুজ আল খলিফায়, যার উচ্চতা ৮২৮ মিটার। এর চারপাশে বাগান ও কয়েকটি ফোয়ারায়
জলের ছন্দময় উদ্দাম নৃত্য বইছে। মৃদু জলের
শব্দের ঝংকারের সাথে জলকনা ভেসে যাচ্ছে। বুরুজ আল খলিফার অর্ধেকে উঠার আরোহন ফি
২৫০ দিরহাম ও চুড়ায় আরোহন করতে হলে ৫০০ দিরহাম গুনতে হবে। লাইনে দাড়িয়ে টিকেট
সংগ্রহ করে চূড়ায় উঠতে গেলে দিন শেষ হয়ে যাবে, আমাদের হাতে এত
সময় নেই। তাছাড়া ইতিপূর্বে বিশ্বের অনেক সুউচ্চ ভবনে আমার উঠা হয়ে গেছে। তারপর
বুরুজ আল আরব যাই।
ডুবাই ওয়াটার পার্ক পার হয়ে
আভিজাত এলাকা ডেরা দুবাই চলে আসি। দুবাইয়ের আমিরের বাড়ি দেখা হল। এখানে ধনী ধনী আরব শেখদের বড়
বড় বাগান বাড়ি, প্রতিটি বাড়ি কয়েক একর জায়গা দখল করে আছে। বাড়িগুলোর
সামনে বড় রাস্থা ও পিছনে পারশ্য উপসাগরের বায়ু ও ঢেউ। গেটে রয়েছে সশস্ত্র পুলিশ
প্রহরা।
এবার গাড়ি আমাদেরকে নিয়ে ছুটল
পাম আইল্যান্ড বা খজুরগাছ দ্বীপে। খেজুরগাছ দ্বীপপুঞ্জ পারশ্য উপসাগরে আমিরাত
সরকারের তৈরি একটি ছোট ছোট দ্বীপের কৃত্রিম সজ্জা যা সাগরে একটি খেজুরবৃক্ষ আকৃতির
দ্বীপসমষ্টি তৈরী করেছে। কোটি কোটি পেট্রো ডলার ডেলে হাজার হাজার কর্মী , নির্মাণ
শ্রমিক, ইঞ্জিনিয়ারগন বিশ্বের সেরা যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে বেশ কয়েক
বৎসরে এই পাম আইল্যান্ড নির্মাণ করেন। রিকেইভিং মেশিনে সমুদ্র খনন করে পাহাড়ের
পাতর কেটে ফেলে পানির নিচে বিশেষ প্রযুক্তিতে জমাট বাধান হয়। পাতরের বড় বড় খন্ড জমাট বাধিয়ে
শক্ত ড্যাম তৈরি করে মরুভূমির বালু দিয়ে ভরাট করে দ্বীপগুলো নির্মান করা হয়েছে। খেজুর
পত্রাকার দ্বীপগুলোকে পরিবেষ্টন করে আর কিছু লম্বা বৃত্তাকারের দ্বীপের মালা
চারপাশ পেছিয়ে আছে।
পাম আইল্যান্ড জুড়ে রয়েছে অসংখ্য
নয়নাভিরাম অট্টালিকা, এসব অট্টালিকায় ফ্ল্যাট কিনে ধন্য হন বিশ্বের নামী দামী
অভিনেতা, ব্যবসায়ী, কোম্পেনি সি ই ও, রাজনীতিবিদ ও বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ। এখানে একটি ছোট্ট দ্বীপের মালিক
বলিউড বাদশা শাহরুখ খান। এই দ্বীপে তিনি গড়ে তুলেছেন সুরম্য বাগান বাড়ি। এই পাম
আইল্যান্ডে আছে উন্নত রিসোর্ট, বহুস্টার রেস্টিন হোটেল, বিখ্যাত
আটলান্টাস হোটেল, মিডিয়া সিটি ও মেরিনা মল। এখানে পাতরের বাধে যে বিশাল
কৃত্রিম পাম সীবিচ তৈরি করা হয়েছে তার কোন তুলনা হয়না। এই বিচে ঢেউয়ের কাছে আমরা
ছবি তুলি। দূরের জাহাজে, গগনে বিমান ও হ্যালিকপটারে পর্যটকেরা ঘুরাফেরা করছেন।
মেরিনা মলের কছে একটি ওপেন বিচ ক্লাবে যাই। ক্লাবটির নাম
বারাস্তি। এটি পশ্চিমা সংস্কৃতির আদলে পরিচালিত একটি অভিজাত ক্লাব। এই পাম সি বিচে
একজন আমেরিকান কাল বিদগুটে চেহারার নিগ্রো ভদ্রলোক তার অনিন্দ্য সুন্দরী অর্ধনগ্ন
শ্বেতাঙ্গিনী পত্নীকে নিয়ে ফটো তুলছেন, আর আমাদের পাকিস্তানি যুবক চালক সালমান কাল চশমার ফাঁক দিয়ে
চোর-চোখে অবাক হয়ে দেখছেন। এযেন দুধ এবং আলকাতরা মাখামাখি ও গলাগলি।
এবার ড্রাইভার সালমান দূরের
আউটলেট ভিলেজে। শহর হতে অনের দূরে মরুর বুকে গাড় শ্যামল বৃক্ষ লতা পাতা ঘেরা এক
অনন্য পর্যটন শহর এই আউটলেট ভিলেজ। কুসুম কানন, ফাকে ফাঁকে
হোটেল,
বার, রিসোর্টের মেলা। সুইমিংপুল এই গরম মরুদেশে পরম আদর ও
বিলাসের বস্তু। এখানে মাটির নিচদিয়ে নল বসিয়ে বৃক্ষের মুলে পানি সরবরাহ করা
হয়। আউটলেট ভিলেজ আমাদের প্রাকৃতিক গ্রামের মত এক অপুর্ব গ্রাম, যাহা
কোটি কোটি ডলার খরচ করে নির্মান করা হয়েছে। এখানে
স্থাপিত দুটি ঘোড়ার ভাস্করর্য্যের সামনে ফটো উঠাই।
পথে আল এলিসাইট বিল্ডিং দেখলাম।
এখানে নিচে মল ও উপরে বিশ্ব বানিজ্য কেন্দ্র। ইবনে বতুতা মল বেশ বড় বানিজ্য কেন্দ্র। ডুবাইয়ের লুলু মার্কেটে সস্থায় ভাল পন্য বিক্রি হয়, এযেন আমাদের হাসান মার্কেট। উন্নত এই দেশে প্রায় নির্মানকাজ এত শক্তভাবে করা হয় যে কয়েক যুগ আর সেখানে কাজের দরকার হয়না। খরচটা বড় হয় এবং একবারই হয়। কিন্তু আমাদের দেশে হয় উল্টো, এখানে অল্প বাজেটে দ্বায়ছাড়া গোছের নির্মাণ
কাজ হয়, প্রতি বছর নষ্ট হয়ে যায়। বছর বছর টাকা ঢালতে হয়। চট্টগ্রামের পতাঙ্গা বিচের কথা মনে হল, সেখানে প্রতি বছর পাতরের ব্লক বসান হয় ও প্রতি বছর ভেঙ্গে সাগরে তলিয়ে যায়। অথচ দুবাইয়ে কৃত্রিম দ্বীপ ও উপসাগরে যে শক্ত বাঁধ নির্মিত হয়েছে তা শতবর্ষেও কিছু হবেনা। এ যেন এক স্থায়ী বিনিয়োগ।
চালক সালমান বললেন ডিসেম্বর হতে
ফেব্রুয়ারী এদেশে পর্যটনের উপযুক্ত সময়। তখন এখানে আবহাওয়া এত গরম থাকেনা। এই সময়
ইউরোপের শীতপ্রধান ধনী দেশসমূহে বরফ পড়ে, তাই ঠান্ডা
এড়াতে এসব দেশের লোকজন দুবাই এসে ভীড় জমান।
দোবাইয়ের সাগরপারের বিচসমুহে বিদেশীদের কোলাহলে মুখর হয়ে উঠে। হোটেল
রেস্তুরা ও সপিংমলে গিজগিজ করেন বিদেশী ক্রেতারা। সালমান বললেন বোম্বের মাফিয়া ডন
ভারতের মোষ্ট ওয়ান্টেড আসামী দাউদ ইব্রাহিম দোবাইয়ে সংগোপনে বসবাস করেন। তিনি
এখানকার রাজপরিবারের বন্ধু ও ব্যবসা পার্টনার। তিনি এখানকার একজন টাকার খনি, এখানে
কেঊ তাকে ধরার ক্ষমতা রাখেনা। সারাদিন ডুবাই ঘুরে সালমানকে ৩০০ দিরহাম ভাড়া পরিশোধ করি। আমি লিখি জানতে পেরে যাবার বেলা ড্রাইভার সালমান বললেন আমার কথা স্মরণ রাখবেন, আমার কথা লিখবেন। আমি কথা দিলাম আমার একদিনের পাকিস্তানি
বন্ধুকে
অবশ্যই মনে রাখব। রিজেন্ট বীচ রিসোর্টে কিছুক্ষণ ঘুম দিয়ে বিকেলে জুমাইরা বিচে চলে যাই। এখানে আবহাওয়া গরম কিন্তু অনাদ্র। চারপাশে এলোমেলো বাতাস, ঘামহীন শুস্ক শরীরে গরম তেমন বিরক্তকর নয়। বরং বাতাস ও ঢেউ মনে তৈরি করে আনন্দের বন্যা। রাতে হেটে হেটে চলে চলে যাই ইন্ডিয়ান নওয়াব হোটেলে। চিকেন রাইছ, ফিস রাইছ, কোক, টক দই, সালাদ ও সস খেয়ে ৮৬ দিরহাম বিল পরিশোধ করে ফেরে আসি রাতের ঠিকানায়।
২৫ জুন ২০১৮ খ্রীস্টাব্দ, এই সোমবার দিনটি সুমাইয়া সীবিচের জলে সাতরে কাটানোর সিদ্ধান্ত নেই। সুমাইয়া সীবিচে আমরা পাজামা পরে নামতে চাইলে বিচ কতৃপক্ষের নিযুক্ত শ্রীলঙ্কান পরিদর্শক এসে বললেন এই বিচের জলে হাফপেন্ট পরে নামতে হবে, পাজামা কিংবা ফুল প্যান্ট চলবেনা। হাফপেন্ট ও টাইট সর্টবসনে নতুবা বিকিনি পরে সাগরে নামা আমার পত্নী ডাঃ নুরজাহানের পক্ষেও সম্ভব নয়, তিনি নীরবে সরে পড়লেন। আমার পূত্র বলল আমরা দুবাইয়ের কিছুতেই ঢুকিনি, কেবল বাহির হতে দেখেছি। এই সুন্দর বিচে সাঁতার কাটার সুযোগ ওকি মিছ করব। কাছের দোকানে ছুটলাম দুটি হাফপ্যান্ট কিনতে, কিন্তু দাম শুনে চক্ষু হল চড়কগাছ। দুটি হাফপ্যান্টের দাম বলল সাত হাজার টাকা। জেফার বলল, আব্বা বাদ দেন, দরকার নেই সাগরে সাতরাবার। আমি হাল ছাড়লাম না, ছুটলাম দুরের জুমায়রা বীচ মলে, সেখানে এই দোকানের সবচেয়ে সস্তায় সাড়ে তিন হাজার টাকায় দুইটি হাফপ্যান্ট কিনলাম। মনে হল এই টাকাগুলো যেন সাগরে সাতারে নামার খাজনা বাবদ খসে গেল। এই বীচটির অবস্থা এতই নগ্ন ও উদোম যে এটাকে কোন মুসলিম দেশের সীবিচ মনে হয়না। দেখলাম এখানে প্রচুর পশ্চিমা নরনারীরা নগ্নদেহে সমুদ্রস্নান করে সোনালী বালিতে গড়াগড়ি করছেন। আমরা থাইল্যান্ডের ফুকেট সিবিচে পাজামা পরে নামলেও এখানে হাফপেন্ট পরে নামতে বাধ্য হই। সৈকতে একদল সরকারী পরিদর্শক ও দক্ষ সাতারু টিম নজরদারী করেন। তারা সৈকতের আইন কানুন তদারকি করেন ও কেউ বিপদগ্রস্ত হলে সাগরে ঝাঁপ দিয়ে উদ্ধার করেন। সৈকত হতে প্রায় দুইশত ফুট সাগরের গভীরে বেলাভুমির সমান্তরালে একটি দড়িটানা রয়েছে। দড়িটি ভাসিয়ে রাখে আনেকগুলো বড়বড় রাবারের বায়ুভর্তি বল। দড়ি ও বলের এই
নিরাপত্তা রেখা সাতরে অতিক্রম করা নিষেধ। কেউ সমুদ্রে নেমে ভেসে গেলে এই দড়ি ধরে ভাসে থেকে প্রান বাঁচাতে পারেন। এই দড়িটি ঢেউয়ের তালে তালে জলের উপর নীচ উঠানামা করে। বেশিক্ষন সাগরে থাকার জন্য আমরা সিন্ধান্ত নিলাম চোখ জলে ভিজতে দিবনা, গরম মনে হলে মাথায় পানি ডেলে পিছনদিকে ফেলে দেব। পাশের ওয়াটারপার্কে জলের
নলদিয়ে পিছলে পড়া বাচ্চাদের চিৎকার আসছিল। সুমাইয়া সিবিচের একদিকে নেমে সাতরে দড়ির
বল স্পর্ষ করে এসে অন্যপ্রান্তে ছুটলাম, প্রায় এক ঘন্টা সাতরে শেষ সীমারেখা ছুইলাম। কয়েকবার সাতরে নিরাপত্তা বলের কাছে দড়িতে বসে উদ্দাম বাতাসে জিরিয়ে নিলাম। এত বড় বল যা একজন মানুষের পুরোভার বহনে সক্ষম। অন্যপ্রান্ত হতে সাতরে ফিরে এসে দেখলাম প্রায় তিনঘণ্টা পার হয়ে গেছে। বিকেল ৫টা বেজে গেছে। জেফার সাঁতার কেটে কেটে পরিশ্রান্ত হয়ে গেছে। আমার সাগরে থাকার স্টেমিনা থাকলেও তার আর নেই। এবার সমুদ্র হতে উঠে সাগরপারে স্থাপিত মিষ্টজলের ফ্রিঝর্ণার নিচে গোসল করে সাগরপারের ফ্রি ড্রেসিংরূমে পোষাক পাল্টে পরিপাঠি হয়ে রিজেন্ট বিচ রিসোর্টে ফিরে এলাম।
২৬ জুন ২০১৮ সাল, মঙ্গলবার।
রিজেন্ট বিচ রিসোর্টে আজ ২টা পর্যন্ত আমাদের থাকার অধিকার থাকা সত্তেও আমরা এখানে ফ্রিলান্স
সমাধা করে সকাল ১০টায় আবুধাবীর উদ্দেশ্যে বের হলাম। ইতিহাদের ফ্রি বাস ধরতে
টেক্সিক্যাবে ছুটলাম মাজায়া সেন্টারের ইতিহাদ অফিসে। যাবার বেলা ভাড়া ৩৫ দিরহাম দিলেও এবার সেই
জায়গায় এসে দিলাম মাত্র ১৫ দিরহাম। নিশ্চয়ই আগের দুষ্টচালক ঘুরপথে গিয়ে মিটারে
বেশী বিল তুলেছে। মাজায়া সেন্টারে এসে টিকেট দেখিয়ে বাস পেলাম। ভারি সুন্দর এই
মাজায়া সেন্টারে ঘন্টা দেড়েক হাঁটাহাঁটি ও অপেক্ষার পর ১২-৩০টায় বিনে
ভাড়ার ইতিহাদের বাসটি যাত্রা শুরু করে ২-৩০মিনিটে
আবুধাবী বিমানবন্দরের টার্মিনালে এসে থামল।
আবুধাবী দেশটির রাজধানী শহর।
একটি টেক্সিক্যাব থামিয়ে চার তারকা ‘ওয়ান টু ওয়ান’ হোটেলের ঠিকানা আল সালাম রোড দিতেই চালক চিনে ফেলেন।
জায়গাটি শহরের গুরুত্বপূর্ন আল নাহিয়ান ক্যাম্প এরিয়া। গাড়িটি শনশন করে শহরের বড়
রাস্থার সারি দিয়ে ছুটল। পথে এই শহরের প্রায় সব স্থাপনা দেখা হয়ে গেল। এক ঝলকের
জন্য তাজমহলের মত দেদীপ্যমান শেখ জাহেদ গ্রেন্ড মসজিদ দেখলাম। এই মসজিদের বিশালতা
দেখে ঠিক করলাম হোটেলে একটু বিশ্রাম নিয়ে আজ বিকেলে এই সুন্দর মসজিদ দেখতে আসবই। কারন
কালকে সময় নেই, ঢাকার ফ্লাইট ধরতে সকাল ৯টায় হোটেল ছেড়ে বেরিয়ে যেতে হবে।
প্রায় চল্লিশ মিনিটে পূরো শহর ঘুরে এবার সাগরপারের ‘ওয়ান টু ওয়ান’ হোটেলে
নামিয়ে ক্যাবচালক চলে যান। কিছুলোক দৌড়ে আসলেন ব্যাগেজ নিতে, আমরা সুযোগ না
দিয়ে নিজেরাই বয়ে নিলাম। আমি রেসিপশনে গিয়ে বললাম আমরা অন লাইনে দেখে এসেছি, এখানে
তিনজনের ফেমিলি স্যুট ৬৫ আমেরিকান ডলার। তারা বলল, হ্যাঁ, আপনাদের
অনলাইন বুকিং রিসিপ্ট দেন। আমি বুকিং করিনি বলতেই বলল অন লাইন বুকিং হলে ৬৫ ডলারে
থাকতে পারতেন কিন্তু এখন ৪৫০ ডলার লাগবে। এই চার তারকা হোটেলে তাদের গাড়িতে ফ্রি
শহর ভিজিটের সুযোগও অন্তভূক্ত ছিল। অবাক হলাম অনলাইনে বাংলাদেশ হতে বুকিং করা থাকলে যেখানে
লাগত মাত্র ৬৫ ডলার, তা এখন হয়ে গেছে ৪৫০ ডলার, অথচ আমরা থাকব
মাত্র বার তের ঘন্টা। মনে হল এটা কাষ্টমারকে কাবু করা, সিদ্ধান্ত
নিলাম তাদের অন্যায় কাবুতে পড়বনা, এই চার তারকা হোটেলে থাকবনা। তাদের কাছে আশপাশের হোটেলের
ঠিকানা চাইলে দিলনা, বলল, অনলাইনে খোঁজে নিন। গেটে যেতেই পাকিস্তানী প্রহরীরা বলল
আপনারা ফিরে আসলেন কেন? আমরা বুঝিয়ে বললে তারা একটি ট্যাক্সি ডেকে ‘সেন্ট্রাল
ভিল’
নামক কাছের এক হোটেলে পাঠাল ও বলল সেখানে ১০০ ডলারের মধ্যে আপনারা থাকতে
পারবেন। ১০০ ডলার পরিশোধ করে ও ১০০ দিরহাম জামানত দিয়ে চারতলার রুমে ঢুকলাম। একশত
দিরহাম জামানতের ব্যাপারে আমি আপত্তি জানালে হোটেলের চীনা রেসিপশনিষ্ট বললেন এটা
তাদের হোটেলের নিয়ম, হোটেল ত্যাগকালে এই ১০০ দিরহাম ফেরত দেওয়া হবে। এখানে রুমটি
দোবাইয়ের হোটেলের চেয়ে আর বড় ও হাইফাই। গরম জলে গোসল করে একটু ঘুমিয়ে নেই।
বের হয়ে খাওয়া দাওয়া শেষ করে
আবুধাবির বিখ্যাত কিং জাহেদ গ্রেন্ড মসজিদ দেখতে ছুটলাম। একটি ভবনে নেপালি
প্রহরীরা আমাদের নিরাপত্তা চেকিং করেন ও পরে মেটাল ডিটেকটিভ নিরাপত্তা লাইন পার
হয়ে আমরা মসজিদ চত্বরে প্রবেশ করি। তখন বিকেলের
রোদের তেজ কমে এসেছে। একটি সুবিশাল টিলার উপরিভাগ সমতল করে বিশাল এক বাগান ও
কয়েকটি জলাশয়ের মাঝে অতিকায় মসজিদটির অবস্থান। মসজিদ আবর্তনকারি জলাধার সমুহে
পানির গভীরতা হবে মাত্র দুই তিন ফুট। জলাধার আবর্তন করে আছে পুষ্পোদ্যান ও খেজুরসহ
নানা বৃক্ষের অপূর্ব সমাবেশ। বাগানটি পাখির কলকাকলিতে মুখর হয়ে আছে। মসজিদের সামনে তিনটি চত্বর জুড়ে পানির ফোয়ারায় জলের চন্ডাল নৃত্য বইছে। মসজিদটির
সুউচ্চ চার মিনার সারাটা আবুধাবী শহর হতে দৃষ্টিগোচর হয়। এই মসজিদের মিনার ও
গম্বুজের চুড়ায় বসান টন টন সোনা সুর্যের কিরণে চকচক করতে দেখা যায়। উপরের বিশাল
সুরম্য মিনার ও গম্বুজগুলো ইসলামের স্বর্নযুগকে স্মরন করিয়ে দেয়। শত শত বিদেশী
বিধর্মী
লোকজন মসজিদে ও বাহিরের চত্বরে মহানন্দে ঘুরে বেড়ান। শ্বেতাঙ্গ, ভারতীয়
ও চীনা নারীরা মসজিদের প্রবেশকক্ষে রাখা নীলাভ বোরকা পরে সারা মসজিদ ঘুরে বেড়ান ও
সেলফি উঠান। মনে হল এসব বিধর্মী নারীরা জীবনে প্রথমবারের মত বোরকা পরার মজা বেশ
ফুর্তি করে উপভোগ করছেন। অনভ্যস্ততার কারনে কারো লাল ও সফেদ পা, কারো
কাল লাল ও সোনালী কেশধাম বোরকা বেদ করে বেরিয়ে আসছে।
মসজিদের ডানদিকের বাগানের
শেষসীমায় একটি তিন গম্বুজ এবাদাতখানার সামনে একটি সাদামাঠা কবরে ঘুমিয়ে আছেন কিং
জায়েদ বিন সুলতান আল নাহিয়ান, সংযুক্ত আরব আমিরাতের জাতির জনক। কবরগাহ পরিবেষ্টন করে আছে
গ্রীলের বেড়া। একজন প্রহরী এখানে দায়িত্ব পালন করছেন। বেড়ার ফাক দিয়ে তাকিয়ে
দেখলাম কবরটির চারদিকে অনুচ্চ পাকা দেয়াল এবং শিরোভাগে কবরফলক, কবরের উপর হলুদ
বালির আস্থরন। এই ছোট্ট এবাদাতখানা হতে সব সময় ক্যাসেটে কোরান তেলাওতের মধুর সুর
ধ্বনিত হয়। তবে কাউকে কবরটি জেয়ারত করতে দেখিনি, খুবসম্ভব এদেশে
কবর জেয়ারতের তেমন প্রচলন নেই।
ক্ষুধা লাগলে পাশের স্নেক্সবারে
ঢুকে গরম চিকেন বার্গার কিনে তিন জন মিলে খেয়ে বের হই। বেরিয়ে এই মসজিদে মাগরিবের
নামাজ আদায়ের জন্য তৈরী হই। এখানে বিচরণকারী লোকজনের মাত্র বিশ পচিশ শতাংশ লোক
মুসলিম, বাকিরা বিধর্মী। মক্কা মাদিনার মত সুললিত কন্ঠে আজান হল।
আমরা মাটির নিচের অপূর্ব ডিজাইনের শীতল অজুখানায় অজু করে পিছনের বড় মসজিদে ছুটলাম।
মসজিদের ডানদিকে নারীরা ও বামদিকে পুরুষরা আলাদা অজু খানায় অজু করে বড় মসজিদে ডুকে
মধ্যে পর্দা টেনে জামাতে একই লাইনে দাড়িয়ে নামাজ পড়েন। জামাত চলাকালে অজস্র বিদেশী নরনারী
মসজিদের ভিতর ও বাহিরে বিচরণ করে মুসল্লীদের নামাজ পরার দৃশ্য অবলোকন করেন।
মাগরিবের নামাজ জামাতে পড়ে বের হয়ে
বেশ কিছুক্ষণ আমরা মসজিদের ঝমকাল আলোকসজ্জা উপভোগ করে বাহিরে এসে হোটেল সেন্ট্রাল
ভিলে ফিরলাম। তখন রাতের খাবারের সময় হয়ে গেছে। কাছে কোন ইন্ডিয়ান হোটেল
পেলামনা। নিতান্ত বাধ্য হয়ে একটি সিফুডের হোটেলে ডুলাম। থাই নারীরা এই হোটেল
পরিচালনা করছেন। কয়েক প্রকার সীফিস সহযোগে রান্না করা পোলাও খেতে খুব মজাদার,
সাথে আসল সালাদ, পাপড়, ডুমুর, ক্যাপ্সিক্যাম, গাজর, সস, আচার, টকদই ইত্যাদি। ইন্ডিয়ান হোটেল খোঁজে না পাবার
হতাশা নিমিষেই কেটে গেল। প্রচুর খাবার রয়ে গেলে তারা প্যাক করে দিয়ে দেয়। এই
অতিরিক্ত খাবারে পরদিন ব্রেকফাস্ট হয়ে যায়। সকাল ১০টায় হোটেল সেন্ট্রাল ভিল ছেড়ে
আবুধাবী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ৪নং টার্মিনাল দিয়ে প্রবেশ করি। তিন ঘন্টা পর
ইতিহাদের বিমান ঢাকায় যাত্রা শুরু করে পাঁচ ঘন্টা পর ঢাকায় রাত ৯টায় অবতরন করে।
সমনদিক আজিজ ভাইয়ের ড্রাইভার খোকন তার কালগ্লাসের দামি গাড়িতে করে আমাদেরকে
ধানমন্ডির লেকপারের বাসায় নিয়ে যায়। আমরা আজিজ ভাইয়ের নিউইয়র্কের বাসায় ছিলাম।
দেশে এসে আবার দুইরাত তার খালিবাসায় বিশ্রাম নিয়ে গ্রিনলাইনের দুতলা বাসের উপর
তলায় বসে সিলেট ফিরলাম।
সংযুক্ত আরব আমিরাত একটি বংশগত
শেখতন্ত্র ও রাজতন্ত্রের দেশ। সাতটি রাজ্য শাসন করেন সাতটি শেখ পরিবার। তারা
প্রেসিডেন্ট ও প্রধাননন্ত্রি নিয়োগ করেন। বর্তমান প্রেসিডেন্ট খলিফা বিন জাহিদ বিন
সুলতান আল নাহিয়ান এবং প্রধান মন্ত্রি মোহাম্মদ বিন রশিদ আল মাখতুম। দেশটি আয়তনে
আমাদের দেশের চেয়ে অনেক ছোট, মাত্র ৩২,৩০০ বর্গমাইল। রাজ্যগুলোর নাম আবুধাবি, দুবাই, সারজাহ, ফুজাইরা, আজমান, রাস আল
খাইমাহ ও উম আল খোয়াইন। দেশটির তিনদিকে কাতার, সৌদি
আরব ও ওমানের সীমান্তরেখা ও পুর্ব দিকে রয়েছে
পারশ্য উপসাগরের সুদীর্ঘ্য তটরেখা।
আমিরাতের মোঠ জনসংখ্যা মাত্র ৯২ লক্ষ ৭০ হাজার, কিন্তু অবাক করা ব্যাপার হল এই জনসংখ্যার মাত্র ১২% স্বদেশী
আরব নাগরিক, বাকী ৮৮% মানুষই বিদেশের
লোকজন। এখানে ভারতীয়দের সংখ্যা সবচেয়ে
বেশি ২৭*৮০%, তাছাড়া পাকিস্তানী ৯*৫০%, বাংলাদেশী
৬*১০%, ফিলিপাইনী
২*২০%, চীনা ২*২০% এবং
অন্যান্য দেশের ১৫*১০% লোকজন বসবাস করেন।
এখানে সরকারি ভাষা আরবি ও ইংরেজি।
তবে হিন্দির প্রচলন রয়েছে। এখানকার বানিজ্যে ভারতের মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীদের দাপূটে
আধিপত্য। ভারতিয়রা এই দেশের সব কিছু দিকভাল করেন। চীনারা
এগজিকিউটিভ লেবেলে কাজ করেন। পাকিস্তানিরা প্রহরী ও গাড়ি চালক এবং বেশিরভাগ
বাংলাদেশিরা পরিচ্ছন্নতাকর্মী, বাগান
ও নির্মাণ শ্রমিক। ফিলিপিনো মেয়েরা করেন পর্যটন শিল্পের সাথে জড়িত
নানা ধরনের ভাল আরামদায়ক চাকুরি। বিভিন্ন ধর্ম, ভাষা ও
সংস্কৃতির লোকজন এখানে স্বাধীনভাবে নিজেদের মত অবাধে চলাফেরা করেন। দুবাইকে মনে হয় পশ্চিমা ও ভারতীয় সংস্কৃতির লীলাভূমি। আরব
সংস্কৃতির মানুষ অল্পই দেখা যায়। এই দেশটিতে সমানতালে আমিরাত দিরহাম ও আমেরিকান
ডলারে লেনদেন হয়। দেশটির মানুষের মাথাপিছু আয় ৩৮,৪৩৬
আমেরিকান ডলার। মুসলিম দেশ হলেও এখানে ধর্মীয় গোঁড়ামি ও ধর্ম নিয়ে কোন হৈ চৈ নেই।
আইন শৃংখলা প্রায় সিঙ্গাপুরের মত উন্নত। এখানে মানুষ সুখী সুন্দর এক সমৃদ্ধ
জীবন উপভোগ করেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন