মৌলভীবাজার অঞ্চলিক অফিসের আমার প্রিয় সহকর্মীরাঃ
মৌলভীবাজার আঞ্চলিক অফিসে আমার
বস উপমহাব্যবস্থাপক দিলীপ কুমার পাল। তিনি শক্ত ব্যাক্তিত্বের লোক, সরকারের কর দেন
পাই পাই হিসেব করে। তিনি সৎ এবং সাবধান মানুষ। তার আত্মমর্যাদা খুব প্রখর। একবার
ব্যাংকের একজন অফিসার বিদেশ হতে এসে তাকে একটি দামী ঘড়ি ও টাই উপহার দেয়। তিনি
টাইটি রাখেন ও ঘড়িটি ফেরত দেন এই বলে আপাততঃ আমার একটি ঘড়ি আছে, আরেকটির প্রয়োজন
নেই।
অদম্য স্বপ্নবাজ সিনিয়র
প্রিন্সিপাল অফিসার মোঃ আবু তাহের বাহুবল উপজেলার মিরপুর এলাকার জাতক। প্রথম জীবন
মাদ্রাসায় লেখাপড়া করে আধুনিক শিক্ষায় ফিরে আসেন। বড় হবার স্বপ্ন তাকে সব সময়
তাড়িয়ে বেড়ায়। তিনি ঢাকার কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হতে এলএলবি, এলএলএম এবং এমএ
ডিগ্রি অর্জন করেন। আমার চেয়ে মাত্র তিন বছরে বড় মোঃ আবু তাহেরকে আমি মৌলভীবাজার
জেলা কমিটির ক্যাবের প্রেসিডেন্ট, নাটাবের সাধারণ সম্পাদক এবং সিলেট বিভাগ উন্নয়ন
পরিষদের মৌলভীবাজার জেলার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালনে কর্মব্যস্থ
দেখি। তিনি তখন তার গাঁয়ের হাফিজপুর মৌলানা ইরফান আলী ফান্ডেশনের প্রেসিডেন্ট
ছিলেন।
অঞ্চলপ্রধান দিলীপ কুমার পাল এবং
আইন কর্মকর্তা মোঃ আবু তাহেরের কথা এই আত্মজীবনীতে বারবার এসেছে। এই বইয়ের অনেক
পাতাজুড়ে তারা আছেন।
প্রবীন সিনিয়র প্রিন্সিপাল
অফিসার আব্দুল ওয়াহেদ হবিগঞ্জের লোক। আমি বরইকান্দি শাখায় থাকাকালে একদিন ফোন করে
বললেন আমার ছেলে আপনাদের নর্থইস্ট মেডিক্যালে পড়ে, একটু পর সে আসবে তাকে একটা
একাউন্ট খুলে দিবেন। আমার সাথে তার কখনও দেখা নেই, অথচ এমন দরদের সাথে আলাপ করলেন
যে আমি যেন তার অতি পরিচিত। তার ছেলে এসে আমাকে আঙ্কেল বলে সম্বোধন করে। আমি
মৌলভীবাজার এসে তাকে অডিট বিভাগের দায়িত্বে পাই। বিএ পাশ আব্দুল ওয়াহিদ কাজে বেশ
দক্ষ, সমবয়সীদের তুলনায় কম্পিউটার চালনায়ও বেশ পারদর্শী। তিনি যথেষ্ট সরল এবং তার
মনটা উদার।
এক রমজানে আব্দুল ওয়াহেদ অফিসে
ইফতার করান। আমার সহধর্মিনী বলতেন হবিগঞ্জের দাওয়াতে খাবারে টান পড়ে।
ওয়াহেদ সাহেব এত পদের এত বেশী ইফতারের সমাবেশ ঘটালেন যে আমার পত্নীর সেই ধারনা
সেদিন মিথ্যা মনে হল। তিনি নিয়মিত নামাজ পড়তেন, তার মাথায় প্রায়ই টুপি দেখা যেত।
আমার ইনকাম টেক্স রিটার্ন তিনি করে দিতেন। আমার লাভ করাতে গিয়ে তিনি আয়কর রিটার্নে
আয় খানিকটা কম দেখায়ে অঞ্চল প্রধানের ধমক খান।
আব্দুল ওয়াহিদের ছিল ডায়বেটিস রোগ
যার মাত্রা ১২ এর নিচে কখনও নামতনা। এত ডায়বেটিস নিয়েও তিনি নির্ভয়ে চা, মিস্টি,
জিলাপী সব খেয়ে ফেলতেন। রুটি না খেয়ে তিনবারই খেতেন সাদা ভাত। আমি মৌলভীবাজার ছেড়ে
আসার আগে তিনি অসুস্থ্য হলে আমরা ব্যাংকের জিপে হবিগঞ্জ শহরে তাকে দেখতে যাই। তার
সদ্য নির্মিত ভবনটি আমাদেরকে হেঁটে দেখান। তার বেগম আমাদেরকে বহুপদের নাস্তা করান।
আমি ঢাকায় যোগদানের কিছুদিন পরই খবর পাই আব্দুল ওয়াহেদ হবিগঞ্জে ইন্তেকাল করেছেন। চাকুরি
হতে অবসরে যাবার তখন তার খুব একটা বেশিদিন বাকি ছিলনা। আল্লাহ তাকে জান্নাতবাসী
করুন।
বয়স্ক সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার
মুজিবুর রহমানের বাড়ি হবিগঞ্জ জেলায়। সুদর্শন মুজিবুর রহমান শান্তশিষ্ট মানুষ, তার
লেখাপড়া উচ্চ মাধ্যমিক। বয়স হলেও এখনও তার কোন রোগবালাই নেই। তিনি সংস্থাপন বিভাগ
পরিচালনা করতেন। তাকে নিয়ে আমি অনেকবার হবিগঞ্জে অফিসিয়েল ভিজিটে যাই। আমি আসার
কিছুদিন পরই তিনি অবসরে চলে যান।
শ্রীমঙ্গলের সন্থান সুমিত সেন ঋণ আদায় বিভাগে কাজ করতেন। তিনি সাস্টের বিএসএস (অনার্স) এমএসএস। কাজে-কর্মে
সুদক্ষ সুমিত সেন আমি সেখানে থাকাকালেই পদোন্নতি পেয়ে প্রিন্সিপাল অফিসার হন।
প্রিন্সিপাল অফিসার বশির উল্লার বাড়ি
চাঁদপুর জেলার মতলব উত্তর উপজেলায়। তিনি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহের পশুপালন
অনুষদের মেধাবী ছাত্র। তিনি বিএসসি(অনার্স)
এমএস। তিনি অনার্সে ১ম শ্রেণিতে ২য় এবং মাস্টার্সে ১ম শ্রেণিতে ১ম স্থান লাভ করেন।
ব্যাংকে সিনিয়র অফিসার হিসাবে যোগদান করা বশির উল্লা তখন ছিলেন প্রিন্সিপাল
অফিসার। তার এক হাত ও এক পায়ে খানিকটা সমস্যা রয়েছে। এই শারীরিক প্রতিকূলতা সত্বেও
তিনি দক্ষতার সাথে দৃঢ মনোবল নিয়ে জীবনসংগ্রাম করে যাচ্ছেন। তিনি দীর্ঘদিন যোগ্যতার
সাথে মৌলভীবাজার আঞ্চলিক অফিসের মানবসম্পদ বিভাগের দায়িত্ব পালন করেন ও ২০১৬ সালে
বদলী হয়ে প্রধান কার্যালয় ঢাকায় চলে যান।
অর্থনীতিতে স্নাতক(সম্মান) আবু
সাইদ মৌলভীবাজারের সন্থান। সে কিছুদিন পর মৌলভীবাজার শাখায় বদলী হয়ে যায়। ডেপুটি
জুনিয়র অফিসার নাজনিন আখতারের বাড়ি হাজিপুর, কানিহাটি। সে আমার মত রাষ্ট্রবিঞ্জানে
মাস্টার্স। বশির উল্লার পর মানব সম্পদ বিভাগের হাল ধরেন সুদর্শন তরুণ সাইদুর
রহমান। তিনি ইংরেজীতে ন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ের এম এ। বানিয়াচংয়ের জাতক কর্মকর্তা
গৌরাঙ্গ দেব অডিটে কাজ করতেন। ফর্সা ও খানিক বেঁটে গৌরাঙ্গের কাজ ছিল নির্ভুল।
তিনি ছিলেন এমএসসি এবং এমবিএ। জুনিয়র অফিসার জাহিদুল ইসলাম খাটি মৌলভীবাজারী আদমি।
তিনি ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি হতে গনিতে বিএসসি(অনার্স) এমএসসি। থাকতেন মৌলভীবাজার
সরকারী কলেজের পাশে। কলেজ মসজিদে নামাজে তার সাথে প্রায়ই দেখা হত। মৌলভীবাজার
শহরের কুট্টি অফিসার অনির্বান তালুকদার শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএসসি। আমি
যোগদানের কিছুদিন পর তিনি যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। সিনিয়র অফিসার শ্যামল বরণ দত্ত জিএসডিডি দেখাশুনা করেন। তিনি ন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয় হতে গণিতে এমএসসি করেন। তিনি দক্ষ ও পরিশ্রমী। তার মুখে সব সময় হাসি লেগেই থাকে।
অফিসার পলাশ মুখার্জি আই টি
ইঞ্জিনিয়ার। তিনি ত্রিপল-ই তে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং করেন। তার বাসা সিলেট শহরের
মির্জাজাঙ্গাল। তিনি মনিপুরী সম্প্রদায়ের জাতক। সিলেট থেকে প্রতিদিন মৌলভীবাজার
আসা যাওয়া করতেন। উপমহাব্যবস্থাপক মশিউর রহমান খান, মাহবুব আহমদ ও আমি সিলেটে তার
বিয়েতে যোগ দেই। এই বিয়েতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামালের স্বামী
রঞ্জুদার সাথে আমাদের দেখা হয়।
সিনিয়র অফিসার সুধাসিন্ধু রায়
সুনামগঞ্জের ভাটি এলাকা জামালগঞ্জের সন্থান। তিনি ঢাকা কলেজের মেধাবী ছাত্র। ইংরেজিতে মাস্টার্স সুধাসিন্ধু খুব ভাল ইংরেজী জানেন। তিনি চারবার বিসিএস ভাইবা
বোর্ড হতে আউট হন। বলতেন ভাগ্য আমাকে ফেভার করেনি, কারণ সময়টা ছিল বিপরীত, এখন হাসিনার
আমলে ভাইবা দিলে হয়ত চাকুরিটা হয়ে যেত।
মৌলভীবাজার আঞ্চলিক অফিসের ঋণ
বিভাগে আমি একঝাঁক পরিশ্রমী কর্মকর্তার দেখা পাই। এই বিভাগের প্রধান আমি হলেও
অপারেশন পরিচালনা করতেন সিনিয়র অফিসার নুপুর বৈদ্য। তিনি এমসি কলেজ হতে
পদার্থবিঞ্জানে বিএসসি(অনার্স) এমএসসি। তার ব্যাংকিং ডিপ্লোমা এবং এমবিএ সনদপত্র
রয়েছে। নুপুর অফিসে একাই একশ। তাকে পরে শমশেরনগর শাখার ব্যবস্থাপক করা হয়।
সিনিয়র অফিসার শান্ত কুমার দত্ত
মৌলভীবাজারের বাসিন্দা। তিনি মাস্টার্স এবং ডি এ আই বি বি। শান্ত দত্তের পত্নী
প্রাইমারি শিক্ষিকা। তার প্রিয়তমা সহধর্মিনি ক্যান্সার আক্রান্ত হওয়ায় তাকে কিছুটা
চিন্তিত ও বিমর্ষ মনে হত। সিনিয়র অফিসার মাসুম সিদ্দিকি ইংলিশে মাস্টার্স এবং এম
বি এ। একসময় তিনি কমলগঞ্জ শাখার ব্যবস্থাপক হয়ে আঞ্চলিক অফিস ছেড়ে যান।
এখন আমি এই অফিসের দুইজন মায়াবী
চেহারার তরুণীর কথা বলব। একজন সারাহ মাহমুদ ও অন্যজন ইমরানা আখতার চৌধুরী। সারাহ
শ্যামলা কিন্তু চেহারায় মিষ্টি হাসি লেগেই থাকে। ইমরানা দুধের মত ফর্সা ও লম্বা
সাড়ে পাচফুটের কম হবেনা। এই দুইজনই যথেষ্ট বুদ্ধিমতি ও ভদ্রতায় তাদের জুড়ি মেলা
ভার। আমি তাদের মুখে কখনো পরচর্চা শুনিনি। জুনিয়র অফিসার সারাহ মাহমুদ ইংরেজিতে
মাস্টার্স। অফিসার ইমরানা আখতার চৌধুরী মেধাবী ছাত্রী, তিনি শাহজালাল
বিশ্ববিদ্যালয় হতে এম বি এ পাশ করে পুবালী ব্যাংকে যোগ দেন।
সাব স্টাফদের মধ্যে ছিলেন
ড্রাইভার অলি মিয়া, তিনি কুমিল্লার লোক। তিনি অঞ্চলপ্রধানের গাড়ি চালাতেন।
ড্রাইভার মানিক মিয়ার বাড়ি মৌলভীবাজার, তিনি ভিআইপিদের দায়িত্বে ছিলেন। এই দুইজন
ড্রাইভারের মধ্যে প্রায়ই বচসা বেঁধে যেত। আমি ও তাহের সাহেব তাদের ঝগড়াঝাটি মিটমাট
করে দিতাম। কেয়ারটেকার আব্দুল মতিন ও সিনিয়র আর্ম গার্ড আনিসুর রহমানের কথাও বেশ
মনে পড়ে।
এবার একজন দুঃখিনী জীবন সংগ্রামী
নারীর কথা বলব। তিনি এই অফিসের ক্লিনার ও ওয়ার্কার সঞ্চিতা রায়। এক পুত্র ও এক
কন্যা জন্মের পর তিনি অল্প বয়সে স্বামীহারা ও বাস্তুহারা হন। কঠোর পরিশ্রম করে
টিকে থাকার যুদ্ধে নামেন। একমাত্র ছেলেটা মৃগিরোগী ও অক্ষম। আমি এই ছেলের চিকিৎসার
জন্য সাহায্য করি। কিন্তু ভাল হবার কোন সম্ভাবনা নেই। আমরা চাদা তুলে তার মেয়েটাকে
বিয়ে দেই। কিন্তু এখানেও শান্তির কোন দেখা পাননি সঞ্চিতা রায়। তার জীবনটা যেন বেদনার
নীল সাগর। তিনি থাকেন ভাড়া বস্তিতে এবং মৌলভীবাজারে একাকী থাকা অঞ্চল প্রধানদের
রান্নাবান্না করে দেন। এভাবেই তার যাচ্ছে জীবন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন