সোমবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

মৌলভীবাজার, মনুনদের পার, হেসে-খেলে বেলা শেষ আমারঃ

 

মৌলভীবাজার, মনুনদের পার, হেসে-খেলে বেলা শেষ আমারঃ         

চাকুরি জীবনে মানুষের প্রথম লক্ষ্য থাকে ক্রমান্নয়ে পদোন্নতি পেয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া এবং  দ্বিতীয় লক্ষ্য থাকে সঠিক এবং সুবিধামত স্থানে পোষ্টিং লাভ করা। ২০১৫ সালের সুচনা থেকেই মানহানিকর ও অসুবিধাজনক জায়গায় ব্যাংক কতৃপক্ষ আমাকে পাঠানো শুরু করে। আমার গৃহিনী চিকিৎসক, সিলেটে তার পেশা ও ব্যবসা। একমাত্র পুত্র সিলেটে অধ্যয়নরত, সব জেনেশুনেও ব্যাংক কতৃপক্ষ আমাকে গ্রামে, মৌলভীবাজারে ও রাজধানীতে পাঠায়। ব্যবস্থাপনা পরিচালক হালিম চৌধুরী আত্মীয় হওয়ায় আমি মনে করলাম যারাই এসব সিন্ধান্ত নিচ্ছে, তার মতামত নিয়েই করছে। আমি তাই সব মেনে নেই এবং এসব বদলী অর্ডার বাতিল করার জন্য কখনো সিলেট বিভাগীয় প্রধানকে ধর্না দিতে যাইনি। আমার ভাবনা ছিল অসুবিধা ও কষ্ট যাই হোক না কেন আমি না হয় সহ্য করলাম, কিন্তু পদোন্নতিটা যেন যথা সময়ে পেয়ে যাই। উপমহাব্যবস্থাপক হলেই আমাকে আর ঠেকায় কে? গ্রামগঞ্জে পাঠাবে আবার কেডায়?

একদিন এজিএম থেকে ডিজিএম হবার জন্য প্রধান কার্যালয়ে স্বাক্ষাৎকার দেবার আমন্ত্রন পত্র পাই। মৌলভীবাজার এবং হবিগঞ্জ এই দুইজেলা হতে আমিই একমাত্র ডিজিএম প্রার্থী। ইন্টারভিউয়ের তারিখঃ ৭ম মে ২০১৭ সময়ঃ বিকেল ২.৩০ শনিবার।

আমার টিকেট দাতা আহমদ এভিয়েশনের ফুজায়েল ভাইকে ঢাকায় যাবার জন্য বিমানের একটি টিকেট বুকিং দিতে বলি। তিনি আমার ইমেইলে টিকেট পাঠিয়ে বললেন কুরেশী স্যার আপনি খুব ভাগ্যবান মাত্র পনের শত টাকায় প্লেনের টিকেট পেয়ে গেছি, যেখানে এসি বাসের ভাড়া এক হাজার টাকা। মনে বিভ্রম হল এটা হয়ত ভাগ্যের কোন শুভসংক্ষেত।

যে গ্রাজুয়েট লোকটা আমাকে চৌধুরীবাজার পাঠান, তিনি এবার প্রমোশন পেয়ে সিলেট বিভাগ প্রধান হন। আমি ধরে নেই পরশ্রীকাতর এই লোকটি কোনমতেই আমার পদোন্নতি পত্রে সুপারিশ করতে দেবেন না। খুব সম্ভব হলও তাই।  

ইতিপূর্বে ষড়যন্ত্র করে আমাকে মৌলভীবাজার পাঠানো হয়েছে। অথচ এই প্রমোশনের জন্য ইতিমধ্যে এই বয়সে আমি এমবিএ এবং ব্যাংকিং ডিপ্লোমা ১ম পার্ট সম্পন্ন করি। ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে ব্যবস্থাপক হতে ঊঠায়ে আমাকে আঞ্চলিক অফিসে আনা হলেও সে বছর সব টার্গেট করে আসি এবং শ্রেষ্ট ব্যবস্থাপক পদক পাই। সিলেটিদের মধ্যে যারা ইতিপূর্বে এজিএম/ ডিজিএম/ জিএম হন তাদের বেশিরভাগই ইন্টারমেডিয়েট কিংবা গ্র্যাজুয়েট, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন এমন সংখ্যা খুবই নগন্য। আমি সরকারি ও বেসরকারি দুইটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্স। সফল ব্যবস্থাপক হিসাবে সুদীর্ঘকাল কাজ করার অভিঞ্জতা আমার ছিল। তাই প্রমোশনের আশা নিয়েই আমি ঢাকা যাই এবং ভাতিজা রিপনের ধানমন্ডির বাসায় উঠি।

সকালে বরইকান্দি শাখার আমার সাবেক সহকর্মী হাবিব মহসিনের সাথে হেডঅফিসে দেখা করি। জোহরের নামাজ পড়ে প্রমোশন ইন্টারভিউ দিতে হেডঅফিসের তিনতলার ওয়েটিং হলের  বসে ডাক পাবার অপেক্ষায় থাকি। এই হলে বসেই বুঝতে পারি আমার নাম তালিকায় নেই। হেড অফিসের গোপনীয়তায় বল ছিদ্র হয়ে ফেটে গেছে। বুঝে ফেলি যারা প্রমোশন পাবে তারা দিনদুয়ের আগেই ফলাফল জেনে গেছে এবং তারা খুব ফুরফুরা মেজাজে আছে। এমডি আব্দুল হালিম চৌধুরী একবার বের হলে এমনভাবে তাকালেন যেন আমাকে তিনি চিনেননা। এই এমডির আমলে বিগত সাড়ে তিন বছর আমাকে যেখানে সেখানে পোষ্টিং দিয়ে অপমান করা এবং কষ্ট দেয়া হয়। এত যাতনার মধ্যে আবার পদোন্নতিও নেই, ভাবতেই অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে।  

আব্দুল মুমিত চৌধুরী ইন্টারভিউ দিতে ভিতরে ডুকে খানিকক্ষণ পর বেরিয়ে আসেন। এবার আমার ডাক পড়ে। একটি প্রশস্ত টেবিলের বিপরীত পাশে ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ আব্দুল হালিম চৌধুরী, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক আখতার হামিদ খান, মহাব্যবস্থাপক সৈয়দ আজিজ আহমদ প্রমুখ বসে আছেন। তাদের হেঁয়ালিপূর্ন কথাবার্তা ও আচরনে আরও পরিস্কারভাবে বুঝে ফেলি তালিকা ইতিমধ্যে তৈরী হয়ে গেছে। এখানে পদোন্নতির ইন্টারভিউ নামক একটি প্রহসনের নাটক করা হচ্ছে এবং আমি তাতে অংশ নিচ্ছি মাত্র। এই নাটকের অভিনয় হতে বেরিয়ে ফলাফল জানানোর দায়িত্ব হাবিব মহসিনকে দিয়ে আমি সিলেটের বাস ধরি। অতীতে একটি প্রমোশনও আমার মিস হয়নি। প্রতিবারই হাবিব মহসিন সিলেটের বাসে আমাকে শুভ সংবাদ জানিয়ে দিয়েছে।

আমি মহসিনের ফোনের অপেক্ষায় আছি এমন সময় আমিনুল হক ফোন করে বলল শুনলাম রেজাল্ট নাকি বের হয়ে গেছে? স্যার আপনার খবর কি? সেই রাতে ৯.০০ ঘটিকায় আমিই শেষ পর্যন্ত হাবিব মহসিনকে ফোন করি। সে জবাব দিল, স্যার তালিকায় আপনার নাম নেই। আপনি সম্ভবতঃ বাদ পড়ে গেছেন। পুবালী ব্যাংকের সুদীর্ঘ্য পদযাত্রার ইসিহাসে এই প্রথম আমি হোঁচট খেলাম। এই প্রথম প্রমোশন পেতে আটকে গেলাম।   

শুক্র ও শনি দুইদিনে মোঠ ৭২জন প্রার্থী ইন্টারভিউ দেন। ১৯ জনকে ডিজিএম করা হয়। পরে আর দুইজনকে যুক্ত করে মোঠ ২১ জনকে প্রমোশন দেয়া হয়।

এবার আমার বুঝতে কোন অসুবিধা হলনা এমডি এম এ হালিম চৌধুরীর কোন মেরুদন্ড নেই। মন্ত্রীরা তাকে যেমন বুঝায় তেমন বুঝেন, যেমনে নাচায় তেমনে নাচেন, তিনি তাদের হাতের একটা খেলার পুতুল মাত্র। পুতুলের কি দোষ, তিনি যে এক প্রাণহীন জড়পদার্থ। মন্ত্রীরা তাদের সুবিধামত সব সাজায়, সব বুঝায়, সব করায়, তিনি বৃটেনের নিয়মতান্ত্রিক রানির মত কেবল দস্তখতটা কাগজের নিচপ্রান্তে বসিয়ে দেন। অপরাধীর দন্ড কমানো সহ নানা সুপারিশ ক্ষমতা বৃটিশ রানি কিংবা আমাদের প্রেসিডেন্টের থাকলেও এম এ হালিম চৌধুরীর নিজস্ব ইচ্ছা, অনিচ্ছা কিংবা সুপারিশ করার বিন্দুমাত্র কোন ক্ষমতাই পুবালী ব্যাংকে নেই। আমার দেখা তার দুইজন পূর্বসুরী ঞ্জানীগুণী ব্যাংকপ্রধান খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ ও হেলাল আহমদ চৌধুরীকে এভাবে ধূর্তরা ব্যবহার করতে পারেনি, তাকে যেভাবে করেছে। একেই বলে বিজ্ঞতাহীনতার মুদ্রাদোষ।

“সময় বদলে যায়, জীবনের সাথে।/ জীবন বদলে যায়, সম্পর্কের সাথে।/ সম্পর্ক বদলায় না, আপনজনের সাথে।/ শুধু কিছু আপনজন বদলে যায়, সময়ের সাথে”। আব্দুল হালিম চৌধুরী বড়পদে বসে যেন এই শেষ পংক্তিতে পরিণত হন।   

এবার নিশ্চিতভাবে আমি কিছু পরশ্রীকাতর লোকের হিংসা ও ষড়যন্ত্রের শিকার হলাম। 

মৌলভীবাজারের কবি পুলক কান্তি ধর একবার পুজো উপলক্ষে একটি পুস্তিকা বের করেন। এই পুস্তিকার প্রকাশনা অনুষ্টানে আমি এবং মোঃ আবু তাহেরকে দাওয়াত করেন। অফিসের কাজ সেরে সন্ধ্যার পর আমরা দুইজন হেঁটে হেঁটে মৌলভীবাজার জেলা পাঠাগারে গিয়ে হাজির হই। তখন মঞ্চে আসীন ছিলেন বিএনপি নেতা ও বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের সাবেক পরিচালক এডভোকেট মুজিবুর রহমান মুজিব, আওয়ামী লীগের জেলা সাধারন সম্পাদক নেছার আহমদ যিনি পরে সাংসদ হন। বসে আছেন নানা বয়সের দর্শক শ্রোতা প্রায় পঞ্চাশ ষাট জন। শ্রোতা ও বক্তা হিসাবে হাজির ছিলেন টলফিগার ফর্সা সুদর্শন এডভোকেট আব্দুল মতিন। মোঃ আবু তাহের সুন্দর বক্তব্য দেন। উপস্থাপক পুলক কান্তি ধর এবার মাইকে আমাকে ডাক দেন। সেদিন কোন পুর্বপ্রস্তুতি ছাড়াই আমি খুব চিত্তাকর্ষক ভাষণ দেই। আনুষ্ঠানিকতা বাদ দিয়ে বক্তব্যটি এখানে হুবহু লেখার চেষ্টা করছি- ‘আমাকে এই প্রকাশনা অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখার সুযোগ প্রদানের জন্য কবি পুলক কান্তি ধর ও প্রকাশনা কমিটির সবাইকে অভিনন্দন জানাই। আমাদের এই বাংলাদেশ ও বাঙ্গালী সংস্কৃতি হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খ্রিষ্টান এই চারটি ধর্মের উত্তরাধিকার। এই চারটি ধর্মই বাঙ্গালী সংস্কৃতির অংশ, বাঙ্গালী জাতির অহংকার। আমরা পাল যুগের সাতশত বছর বৌদ্ধ সভ্যতা লালন করি ও বৌদ্ধ ধর্মকে পৃথিবীর আনাচে কানাচে পৌছে দেই, সেনযুগের সাতশত বৎসর হিন্দু সংস্কৃতি বহন করি। তারপর ত্রয়োদশ শতাব্দীতে আসে মহান ধর্ম ইসলাম। তখন থেকে আমরা ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নেই। তখন থেকে আমরা ধারন ও লালন করছি সত্য ও সাম্যের ধর্ম পবিত্র ইসলাম। তাই আমাদের রক্তে এই তিন ধর্মের অস্থি গেঁথে আছে। খৃষ্টধর্ম আসে অনেকপরে বৃটিশ শাসনামলে। আমাদের অনেকে এই ধর্মেও যোগ দেন। বিষয়টি দাঁড়ায় এমন যে আমরা অতীতের কয়েক প্রজন্ম ছিলাম বৌদ্ধ, পরের কয়েক প্রজন্ম হিন্দু তারপর হলাম মুসলিম। কাজেই আমরা এই তিন ধর্মের লোকজন একই রক্তের বন্ধনে বাঁধা। আমরা একে অন্যের আত্মার আত্মীয়।

একজাতের ফুলগাছ লাগালে যেমন সুন্দর বাগান হয়না, অনুরূপ একই ধর্ম বর্ণ ও শ্রেণির লোকজন দিয়ে সুন্দর সমাজ হয়না, সমাজে বৈচিত্র থাকেনা। আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খ্রিষ্টান বাঙালি উপজাতি মিলে সতের কোটি মানুষের এক সাজানো বাগান। আমরা সবাই এই বাগানের নানান বর্ন ও গন্ধের বিচিত্র কুসুমবীথি হয়ে হাজার বছর ধরে মিলে মিশে টিকে আছি। আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ক্লাশে একজন অধ্যাপক বলতেন, একজন লোক হাজার মানুষের সমান হতে পারে, আবার হাজার লোকও একজনের সমান হতে পারেনা। কবি ও সাহিত্যিকরা হচ্ছেন সমাজের চোখ, আপনারা এই বুদ্ধিভিত্তিক পথের পথিক। আপনাদের একেক জন হাজার মানুষের উচ্চতা ধারন করে আছেন। তাই আমার মনে হচ্ছেনা আপনারা মাত্র পঞ্চাশ ষাট জন মানুষ, মনে হচ্ছে আমি যেন পঞ্চাশ  ষাট হাজার মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছি’। সাথে সাথে হাততালি দেন সভার শ্রোতারা।

সভা শেষ হলে এডভোকেট মুজিবুর রহমান মুজিবুর অন্যান্য ভিআইপিদের কাছে আমার পরিচয় দেন এই বলে, আমি তাকে চিনি, তিনি সিলেটের রেঙ্গা পরগনার এক খ্যাতিমান পরিবারের সন্থান। তবে তিনি আমাকে চিনলেন কেমন করে এবার তাই বলছি। 

এডভোকেট মুজিবুর রহমান মুজিব একবার অসুস্থ্য হলে আমি ও মোঃ আবুতাহের মুসলিম কোয়ার্টারের বাসায় তাকে দেখতে যাই এবং সেদিন আমার লিখা দশটি বই তাকে উপহার দেই। আসলে শয্যাশায়ী মুজিবুর রহমান এই বই পড়েই আমাকে চিনলেন। সেদিন তিনিও আমাকে উপহার দেন হুমায়ূন আহমদের লেখা ভাগ্যহত মোগল সম্রাট হুমায়ূনের জীবন ভিত্তিক একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস ‘বাদশাহ নামদার’। এই বইটি আমাকে এত আনন্দ দেয় যে, আমি এক নিঃশ্বাসে বইটি পড়ে শেষ করি এবং বেশ কয়েকবার পড়ি। বিখ্যাত বৃটিশ ঐতিহাসিক স্টেনলি লেনপুল এই ‘হুমায়ূন অর্থাৎ ভাগ্যবান’ নামধারী মোঘল সম্রাট সম্পর্কে লিখেন, তিনি সারাজীবন আছাড় খান এবং শেষ পর্যন্ত আছাড় খেয়েই তার জীবনপ্রদীপ নিভে যায়। কিতাবপাগল এই সম্রাট বুড়ো বয়সে শাহিপাঠাগার হতে সিড়ি বেয়ে নামার সময় পা পিছলে পড়ে মারা যান। মুজিবুর রহমান মুজিব নানা বিচ্ছিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনাবলী নিয়ে লিখিত তার একটি চিত্তাকর্ষক বই দেন যেখানে শেষ মোঘল সম্রাট বাহাদুর শাহের জীবনের করুন কাহিনি পড়ে দেশপ্রেমের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হই। তিনি ‘নবাব সিরাজুদ্দৌলা’ নামক একটি বড় কলেবরের বই আমাকে উপহার দেন, বইটির লেখক পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার একজন মুসলিম পন্ডিত যার নামটি আজ আর মনে নেই। সম্ভবতঃ ‘নবাব সিরাজুদ্দৌলা’ নামক এই মূল্যবান বইটি প্রফেসর মশিউর রহমানের পাঠাগারে আমি রেখে এসেছি।      

মোঃ আবু তাহেরের বাড়ি হবিগঞ্জ কিন্তু তিনি মৌলভীবাজারে একটি সম্মানজনক সামাজিক অবস্থানে আছেন। তার এই মর্যাদা এমনি এমনি তৈরি হয়নি। তিনি পরোপকারী ও দানশীল ব্যক্তিত্ব। রোগাক্রান্ত বিপদগ্রস্ত মানুষকে তিনি নিজে সাহায্য করেন, এমন কি অন্যকেও সাহায্য করতে অনুপ্রানিত করেন। তার অনুরোধে আমি বেশ কয়েকজন ক্যান্সার রোগীর চিকিৎসায় বড় অঙ্কের অর্থদান করি। এমন কি তার প্রতি বিরূপ আচরণকারী একজন ক্যান্সারাক্রান্ত আইনজীবীর চিকিৎসার জন্যও তাকে লোকের কাছে হাত পাততে দেখি।

মোঃ আবু তাহের ছিলেন মৌলভীবাজার ব্যাংক অফিসার্স এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট। তিনি ভোটে বিজয়ী হয়ে এই পদ পান। দুই বৎসর রমজান মাসে সংঘটনেরর পক্ষ থেকে ধুমধামের সহিত শহরের অভিজাত হোটেলে ইফতার পার্টি করা হয়। এই ইফতার পার্টি মৌলভীবাজারের বিভিন্ন ব্যাংকের আমলাদের এক মিলনমেলায় পরিনত হয়। মৌলভীবাজার জেলার সিবিল সার্জন, পুলিশ সুপার শাহজালাল ও জেলাপ্রশাসক কামরুল হাসান আসেন পাজামা পাঞ্জাবী পরে। এই ছোট্ট জেলাশহরের হিন্দু, মুসলিম, উপজাতি সর্বশ্রেণির ভিআইপিরা এসে জমায়েত হন ব্যাংকারদের এই ইফতার সভায়। মৌলভীবাজারের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকের এক্সিকিউটিভরা তাদের তুলনায় পদে ছোট মোঃ আবু তাহেরের নেতৃত্ব ও মাতব্বরি খুবসম্ভব মেনে নিতে পারেনি। দুই বছর পর কমিটির মেয়াদ শেষ হলেই তারা একজোট হয়ে মোঃ আবুতাহেরকে ব্যাংক অফিসার্স ক্লাব হতে বিদায় জানান। মৌলভীবাজারে আমার তৃতীয় রমজানে তাই অফিসার্স ক্লাবের ইফতার পার্টিতে যাওয়া হয়নি, কারণ আমাদের আইন অফিসার মোঃ আবুতাহের তখন ব্যাংক অফিসার্স ক্লাবে নেই। মোঃ আবু তাহের নেই, তাই সেই ইফতার পার্টিতে আমিও নেই।

তাহের সাহেবের সাথে আমার অন্তরঙ্গ সম্পর্ক জমে যায়। তিনি অফিসে বসে আমাকে হাসিখুশির গল্প শুনান। একজন লোকের বউয়ের নাম হাসি এবং শালিকার নাম খুশী। একবার কোন এক বিয়ে উপলক্ষে তিনি স্ত্রী হাসিকে নিয়ে শ্বশুরালয়ে যান। বাড়িতে মেহমান গিজগিজ করায় স্থানাভাবে মেঝেতে বিছানা পেতে নেপালীদের মত ঘুমানোর আয়োজন করা হয়। রাতে দোলাভাই শালিকা খুশির দিকে হাত বাড়িয়ে দেন। শালিকা মনে করে দোলাভাই হয়তো ভুলবশতঃ তাকে ‘হাসি’ ভেবে এমনটি করছেন। সে দোলাভাইকে আস্তে করে বলল, আমি খুশী। দোলাভাই শালিকার সম্মতি মনে করে মহানন্দে বললেন, তুমি খুশীতো আমিও খুশী। দোলাভাই আরেকটু এগুতেই গর্জে ওঠে শালিকা খুশী, সাবধান দোলাভাই আপাকে ডাক দেব। এবার থেমে গিয়ে দোলাভাই তার শালিকাকে বললেন, ক্ষমা কর, তোমার খুশি যে নামের খুশী কামের খুশী নয় বুঝতে পারিনি। নইলে আগেই পালিয়ে যেতাম।         

মৌলভীবাজার শাখার ব্যবস্থাপক মোঃ মনিরুল ইসলাম আঞ্চলিক ঋন কমিটির সদস্য ছিলেন। তার সাথে আমার এক হৃদ্যতাপূর্ন সম্পর্ক গড়ে উঠে। তিনি এমন একটি শাখায় দায়িত্ব পালন করেন, যেখানে ৭০% ঋণই দ্রুত মন্দ হয়ে যায়। তাকে ঋন আদায়ে প্রায় দুইশত মামলা ঘাটাঘাটি করতে হয়। কুমিল্লার জাতক মনিরুল ইসলামের স্মৃতিশক্তি ছিল প্রখর, শত শত অনাদায়ী ঋনের শারীরিক অবস্থা তার মুখস্ত ছিল। এই জটিল শাখা পরিচালনায় তার নেতৃত্ব ছিল দৃঢ় ও বুদ্ধিদীপ্ত। মনির সঠিক সিন্ধান্ত গ্রহন করতে পারতেন এবং বাস্থবায়নেও ছিলেন পারদর্শী। তিনি সততা ও সম্মানের সাথে কাজ করে যান। পরে তিনি পদোন্নতি পেয়ে সহকারী মহাব্যবস্থাপক হন এবং হবিগঞ্জ শাখায় বদলী হয়ে যান।

মৌলভীবাজার আঞ্চলিক ঋণ কমিটির সদস্য ছিলেন চৌমুহনা শাখার ব্যবস্থাপক সৈয়দ শহিদুল ইসলাম। খুলনার জাতক সৈয়দ শহিদুল ইসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে এমবিএ করে সিনিয়র অফিসার হিসাবে ব্যাংকে যোগ দেন। তার বামহাত নিষ্ক্রিয়, তাই ডানহাতে তাকে সবকাজ করতে হত। শহিদুল ইসলামের পত্নী ফাতেমা জাহান ইংরেজিতে মাস্টার্স, তিনি একজন শক্তিমান কথাসাহিত্যিক। খুলনার মেয়ে ফাতেমা জাহানের ‘বিবর্তিত অনুভব’ এবং ‘হাকছাড়া বাঁক’ নামক দুইটি উপন্যাস আমি উপহার পাই। এই দুইটি উপন্যাস পড়ে আমি খুলনা, বাগেরহাট ও সুন্দরবন অঞ্চলের মানুষের সমাজজীবন ও সংস্কৃতি সম্পর্কে অনেক নুতন নুতন তথ্য জানতে পারি। নারকেল দিয়ে সুস্বাধু চিংড়ি রান্নার প্রনালী পড়ি। 

শ্রীমঙ্গলের ব্রাক কনভেনশন সেন্টার। কয়েকবিঘা সমতল ধান্যজমিতে একই কমপ্লেক্সে গড়ে উঠেছে আবাসিক হোটেল, অনুষ্টান কেন্দ্র, খাবার রেস্তুোরা, বিনোদন ব্যবস্থা ইত্যাদি। ভাড়া অপেক্ষাকৃত সস্তা ও সেবার মান ভাল। তাই জায়গাটা তেমন আকর্ষনীয় না হলেও উন্নত ব্যবস্থাপনায় এখানে সুন্দর ব্যবসা পরিচালনা করে যাচ্ছে ব্রাক। এই ব্রাক কনভেনশন সেন্টারে দুই বৎসর আমি দুইবার বার্ষিক আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক সম্মেলনে যোগদান করি। অনুষ্টান হয় শুক্রবারে। মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার প্রায় অর্ধশত ব্যবস্থাপক এই সভায় যোগ দেন। মৌলভীবাজার হতে অফিসের জিপে মোঃ আবুতাহের, মনিরুল ইসলাম, মুজিবুর রহমান এবং আমি এই সভায় যাই। এই দুই সভায় স্বস্ত্রীক যোগদেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ আব্দুল হালিম চৌধুরী, তার সাথে আসেন উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী। বুয়েট পড়ুয়া মোহাম্মদ আলী আইটি বিশেষঞ্জ, তিনি পুবালী ব্যাংকের ডিজিটাল বিপ্লবে নেতৃত্ব দেন। তিনি ব্যাংকের সার্বিক অবস্থা ডিজিটাল প্রজেক্তারের মাধ্যমে আমাদের সামনে তুলে ধরেন। দুপুরে এমডির সাথে একই টেবিলে খেতে বসি। একবার তার যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী মেয়েটা সাথে ছিল। সে আমাকে এমনভাবে ‘নানা, নানা’ ডাকছিল যে আমি যেন তার কতনা আপন। ভাবলাম, একেই বলে রক্ত সম্পর্ক, তার বাবার সাথে আমার সরাসরি কোন রক্ত সম্পর্ক না থাকলেও তার শরীরে যে আমার রক্তধারা বইছে। সভাশেষে বিকেলে সিলেটের বিভাগীয় প্রধান মহাব্যবস্থাপক বি এম শহিদুল হকের গাড়িতে চড়ে তার সাথে গল্প করে করে সিলেট শহরে ফিরে যাই।

সেসময় একবার সিলেটের বন্দরবাজারে ব্যাংকের সিলেট বিভাগীয় প্রশিক্ষন কেন্দ্রে বিভাগীয় সম্মেলনে যোগদান করি। ডিএমডি মোহাম্মদ আলী সেই সভায় প্রজেক্টরে বেশ শিক্ষনীয় একটি গল্প তুলে ধরেন। এই গল্পটি অনেকেই হয়ত জানেন। কচ্ছপ ও খরগোসের মধ্যে দৌড় প্রতিযোগিতার গল্প। একসাথে দুই প্রতিযোগি দৌড় শুরু করেন। মাঠের অর্ধেক পার হয়ে খরগোস দেখতে পায় কচ্ছপ অনেক পিছনে পড়ে আছে। সে ভাবলো একটুখানি জিরিয়ে নেই। জিরাতে গিয়ে খরগোস ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুম ভাঙতেই সে দেখে কচ্ছপ ইতিমধ্যে গন্তব্যে পৌছে গেছে। এই গল্পের দুইটি শিক্ষাঃ এক- আস্তে হাটে থামেনা, তার নাগাল কেঊ পায়না। দুই- প্রতিযোগীকে কখনও দুর্বল ভাবতে নেই।

আবার তারা প্রতিযোগিতায় নামলেন। এবার খরগোস কোনদিকে না তাকিয়ে ভূদৌড় দেয়। গন্তব্যে পৌছে পিছনে তাকিয়ে দেখে তার প্রতিযোগী কচ্ছপ গোহারা হেরেছে। এই গল্পের শিক্ষা- ‘আস্তা হাটে থামেনা’অপেক্ষা ‘দ্রুত হাটে থামেনা’ উত্তম।

এবার কচ্ছপ জেতার ফন্দি আটে। একদিন খরগোসকে সে বলল প্রথমবার আমি জয়ী হলেও দ্বিতীয়বার তোমাক কাছে পরাজিত হয়েছি। আমি তোমার সাথে আবার দৌড় প্রতিযোগিতা করব। এবার প্রতিযোগিতা হবে ঔ সুদূরের তালগাছ পর্যন্ত। দুইজন একসাথে দৌড় দেয়। খরগোস এক নিঃশ্বাসে অনেকদূর যাবার পর দেখতে পায় সামনে একটা নদী বইছে। খরগোস সাতার জানেনা। সে এখানে থেমে যেতে বাধ্য হয়, কিন্তু কচ্ছপ অনেক পরে এসেও সাতরে নদী পার হয়ে যায়। কচ্ছপ তালগাছে পৌঁছে বিজয়ী হয়। শিক্ষাঃ এক- শক্ত প্রতিযোগীকে হারাতে হলে কৌশলী হতে হয়। দুই- বুদ্ধির কাছে শক্তি অসহায়।

শেষমেশ পরাজয়ের লজ্জা গোছাতে খরগোস চাইল আবার কচ্ছপের সাথে লড়বে। কিন্তু কচ্ছপ আর তাকে সেই সুযোগ দিলোনা। বলল খরগোস ভাই অনেক হয়েছে, এবার আসুন আমরা এমন প্রতিযোগিতা করি যেখানে কেঊ না হেরে দুইজনই বিজয়ী হব। খরগোস বলল তা কেমন করে হবে। কচ্ছপ তখন খরগোসের কাঁধে চেপে বসে বলল এবার দৌড়ান। নদীর পারে এসে খরগোস থেমে গেলে কচ্ছপ বলল আমার পিঠে চড়ুন। পিঠে খরগোসকে তুলে নিয়ে কচ্ছপ সাতার কেটে কেটে নদী পার হয়ে আবার খরগোসের কাঁধে চেপে বসল। তারা দুইজন একসাথে তালগাছে পৌছে গেল। দুইজনই বিজয়ী হল। শিক্ষাঃ দলবদ্ধ কাজে প্রত্যেকের ভিন্ন ভিন্ন দক্ষতাকে সুযোগ মত ব্যবহার করলে সহজেই বিজয়ী বা সফল হওয়া যায়।

কবি পুলক কান্তি ধর গনমানুষের কবি দিলওয়ারকে নিয়ে আমার লিখা একটি কবিতা তার ম্যাগাজিনে ছাপেন। তিনি একদিন আমাকে জেলাপাঠাগারে মৌলভীবাজারের প্রবীণ কবি মনরঞ্জন ধরের আশিতম জন্মদিনের অনুষ্টানে দাওয়াত দেন। এখনও নিরোগ এই প্রবীন কবি মুখে মুখে অনেক ছড়া ও কবিতা পাঠ করেন। এই সভায় একজন প্রবাসী মহিলা কবির একটি কাব্যের প্রকাশনা উৎসব হয়, প্রধান অতিথি হয়ে উপস্থিত ছিলেন এডভোকেট মুজিবুর রহমান মুজিব। মহিলা কবি এবার সবাইকে তারপক্ষ হতে আখনি পোলাও খেতে আমন্ত্রন জানান। কিন্তু আয়োজকরা আখনি পোলাওয়ের বদলে উপস্থাপন করল ছোট ছোট প্যাকেটাবদ্ধ সিঙ্গারা, মিস্টি ও নমকি। এবার মহিলা কবি লজ্জায় রেগে গিয়ে বললেন, আমি এত টাকা দিলাম অতিথিদেরকে ভাল করে আখনি পোলাও খাওয়াতে আর আপনারা এসব কি নিয়ে এসেছেন,  এতটাকা করছেন কি? সহজেই বুঝলাম লন্ডনি এই মহিলা কবির বই প্রকাশনা উৎসবের বরাদ্ধ বাজেট থেকে প্রচুর অর্থ খসে গেছে।

মৌলভীবাজার আঞ্চলিক অফিসে থাকাকালে জেলা প্রশাসক মোঃ তোফায়েল ইসলামের ডাকে অনেক মাসিক সভায় আমি পূবালী ব্যাংকের প্রতিনিধি হিসাবে যোগদান করি। জেলাপ্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে কৃষিকমিটির সভায় বিভিন্ন ব্যাংক কৃষকদের মধ্যে ক্ষুদে কৃষিঋণ বিতরণ করে। ব্যাংকিং ডিপ্লোমা পরীক্ষা, ছেড়া ও জাল নোট, ঈদে জাল নোট প্রতিরোধ ইত্যাদি বিষয় নিয়েও জেলা প্রশাসকের সভায় আমরা আলোচনায় অংশ নিতাম। মোঃ আবুতাহেরের সহিত জেলাপ্রশাসনের নানা প্রদর্শনি মিছিলে যোগদিয়ে গ্যাঞ্জি উপহার পাই। মৌলভীবাজার হাইস্কুল মাঠে উন্নয়ন মেলায় আমাদের ব্যাংকের স্টল খোলা হয়। অনেক অনেক কোম্পানি এই মাঠে সযতনে স্টল সাজায়। সংসারহীন যাযাবর আমি উন্নয়ন মিছিলে যাই। রাতে খোলা মাঠের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বসে বসে উপভোগ করি। লোকসঙ্গীতের মধুর সুরে মুখরিত হয় আকাশ বাতাস। এই স্কুলমাঠের কাছে রাস্থার ধারে মৌলভীবাজার জেলা সংস্কৃতিক কেন্দ্র। একদিন এই কেন্দ্রে নাচের অনুষ্টানে আমন্ত্রণ পাই। সঙ্গীতের তালে তালে সুরে সুরে বেশ বৈচিত্রময় মনীপুরী নৃত্য, খাসিয়া নৃত্য, দেশীয় নৃত্য মনভরে উপভোগ করি এবং একটি অর্ধপাহাড়ি জেলার মানুষের নৃত্যচর্চার দক্ষতা আমাকে মুগ্ধ করে। মনে একটি অহংকার জাগে এই জেলা যে এক সময়ের দক্ষিণ শ্রীহট্ট, আমার শরীরের অর্ধেক রক্ত এজেলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।

মৌলভীবাজার শহরের একটি বিশাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম পড়ে আমি বেশ অবাক হই, এই স্কুল এন্ড কলেজের নামের অর্ধেক হিন্দু এবং অর্ধেক মুসলিম ‘কাশিনাথ আলাউদ্দিন স্কুল এন্ড কলেজ’। মনে মনে ভাবি কাশিনাথ এবং আলাউদ্দিন হয়ত দুজন বন্ধু ছিলেন, দুইবন্ধু মিলে নিজেদের যৌথনামে অতীতকালে স্কুলটি করেছেন। এই স্কুলের পাঠাগারে আমার লিখা বই উপহার দেবার লোভ আমাকে একদিন সেখানে নিয়ে যায়। প্রিন্সিপালের কক্ষে গিয়ে দেখি স্কুল কমিটির সভাপতি আমার পরিচিত মুখ সৈয়দ মোস্তাক আলী বসে আছেন। তিনি সদ্যপ্র্য়াত মন্ত্রী সৈয়দ মহসিন আলীর ভাই। বিদ্যালয়ের নামরহস্য জানতে চাইলে তিনি বললেন, ‘আলাউদ্দিন’ আমাদের ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক আহমদ এনায়েত মঞ্জুরের প্রপিতামহ। তিনি বৃটিশ আমলে নিজনামে এখানে একটি মাদ্রাসা স্থাপন করেন। ‘কাশিনাথ’ এখানে একটি হাইস্কুল দেন। পরে এই দুইটি প্রতিষ্ঠানকে একিভূত করে এই ‘কাশিনাথ আলাউদ্দিন স্কুল এন্ড কলেজ’ গড়ে উঠেছে। আমি বললাম, এই নামটি বাঙ্গালি জাতির অসাম্প্রদায়িক চেতনা বহন করছে। তাই নাকি, আমরা তো এতদিন বিষয়টা খেয়াল করিনি, বলে সবাই হেসে উঠলেন।

মৌলভীবাজারের একটি প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান হচ্ছে হজরত সৈয়দ শাহমোস্তফার(রঃ) মাজারের ওরস শরীফ। তিনি বিশ্ববিখ্যাত দরবেশ হজরত শাহজালালের(রঃ) একজন মুরিদ ও সহচর। মৌলভীবাজারে ইসলাম প্রচারকারী এই মহান ওলির মাজার আমি সুযোগ পেলেই গিয়ে জেয়ারত করে বেশ শান্তি পেতাম। সমাধিটি একটি খোলা ভবনের ভিতর বৃক্ষবেষ্টিত নিরিবিলি পরিবেশে অবস্থিত। শীত সকালে একদিন অফিসে আসতে টমটম শাহমোস্তফা রোডে এসে থেমে যায়। সৈয়দ শাহমোস্তফার(রঃ) মাজারে ওরস হচ্ছে, সামনে বেরিরপারের অর্ধকিলোমিটার রাস্থাজুড়ে গ্রাম্য মেলা বসেছে। একটি সুন্দর লেকের তীরের নাম বেরিরপার। এককালে এখানে বেরি নামে একটি নদী ছিল, যা আজ আর নেই। মৃত্যুর আগে সেই নদীটি উপহার দিয়ে গেছে একটি সুন্দর সরোবর, যেটি মৌলভীবাজার শহরের মাঝে যেন কোন এক সুন্দরী বধূর কপালের রাজটিপ। নানান হস্থপন্যে সয়লাব লোকে লোকারন্য শাহমোস্তফা সড়ক দিয়ে টমটম যাবেনা তাই এখানে নেমে যাই। হেঁটে হেঁটে মেলার পসরা দেখে দেখে অফিসে যাবার মজাই আলাদা। সহকর্মীদের জন্য মেলা থেকে খই মুড়ি লাড্ডু ইত্যাদি কিনে অফিসকর্মী সঞ্চিতা রায়ের হাতে তুলে দিয়ে বলি সবার টেবিলে বিলিয়ে দাও দিদি।

একদিন অজানা কন্ঠের টেলিফোন পাই, ইসফাক ভাই আমরা দাদাস্যারকে মরণোত্তর সম্বর্ধনা দেব, স্যারের ছবি ও বায়োডাটা দিতে পারবেন? এই দাদাস্যার আমার শ্রদ্ধাভাজন পিতা সফিকুর রহমান চৌধুরী যিনি দীর্ঘ্যজীবন শিক্ষকতা করেন। কিছুক্ষণ ভেবেচিন্তে বললাম আমি এখন মৌলভীবাজারে আছি, আমার ফেইসবুকে ঢুকলেই তার ছবি সহজে পেয়ে যাবে। আব্বার জীবনীর ব্যাপারে বলি আমার ব্লগ ও ইবুকে সার্চ দিলেই সেখানে তার বিবরণ লিখা আছে। আব্বা মোগলাবাজার রেবতী রমন হাইস্কুল ছাড়েন ১৯৯২ সালে এবং পৃথিবী হতে বিদায় নেন ২০০৭ সালে। এত বছর পর ২০১৮সালে তাকে সম্বর্ধনা দেয়া হবে শুনে আমি বেশ অবাকই হই, গর্ব অনুভব করি আমি এমন একজন পিতার সন্থান যাকে এত বছর পরও পুনরায় মানুষ স্মরণ করছে। টেলিফোনকারী আব্বাকে ‘দাদাস্যার’ বলার কারণ হল তারা ছিলেন আব্বার শেষ সময়ের ছাত্র যখন তিনি বয়সের ভারে জর্জরিত। এই সম্বর্ধনার আয়োজক কারা প্রশ্ন করে জানতে পারি স্কুলের ১৯৯৫ এবং ১৯৯৯ এসএসসি পরীক্ষার্থী ব্যাচ। আমি ছিলাম এই স্কুলের ১৯৮১ পরীক্ষার্থী ব্যাচ। অনেক পরের প্রজন্মের আয়োজক ছোটভাইদেরে বললাম আমি যতটুকু সম্ভব সহায়তা করব। রেবতী রমন উচ্চবিদ্যালয় পাঠাগারে রাখা ‘ইসফাক কুরায়শী রচনাসমগ্র’ হতে প্রয়োজনীয় ছবি ও তথ্য নিতেও আমি তাদেরে বলে দেই।

কোন এক ছুটির দিনে আব্বার মরণোত্তর সম্বর্ধণা পদক ও মানপত্র গ্রহণের জন্য আমার বাসায় এসে আয়োজকদের পক্ষে আমন্ত্র জানান খালেরমুখের মোঃ আবুল কাশেম। আব্বার এই সম্বর্ধণায় যোগ দিতে আমি ছুটি নেই। আমার ছোটভাই নিশাতকেও তারা আমন্ত্র জানায়। ১৫ জুলাই ২০১৮ বাসা হতে গাড়ি নিয়ে বের হবার আগে নিশাতকে ফোন করি। সে জবাব দেয় অফিসে কাজ আছে একটু পর আসছি। দাউদাবাদে অবস্থিত দক্ষিন সুরমা উপজেলা অফিসের সামনে রাস্থার উপর বিরাট সম্বর্ধনা তোরণ নির্মাণ করা হয়েছে। তারপর একটার পর একটা তোরণ চোখে পড়ে। সেদিন গুণেগুণে ছয়টি বাশকাপড়ে নির্মিত ব্যানার সজ্জিত সম্বর্ধণা গেটের ভিতর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে আমি রেবতী রমন উচ্চবিদ্যালয় প্রাঙ্গণে হাজির হই।

হ্যাঁ, এই সেইস্কুল যেখানে আমি পাঁচ বছর পড়েছি এবং কিছুকাল শিক্ষকতাও করেছি। আমাদের সময়ের শিক্ষকরা এখন আর নেই। তারা সবাই একে একে অবসরে চলে গেছেন। শিক্ষক মিলনায়তনে গিয়ে বেশ কজন নতুন শিক্ষক শিক্ষিকার দেখা পাই। তারা আমাকে চিনতে পারেনি, তাই বসতেও বলেনি। তারা খবর পায়নি ইসফাক কুরেশী নামের এই লোকটা একদিন এখানে তাদের মত একজন শিক্ষক ছিল, কিংবা সে এই স্কুলের একজন প্রবীন শিক্ষক সফিকুর রহমান চৌধুরীর সন্থান, যার মরণোত্তর সম্বর্ধনায় তার আগমন।

আমাদের সময়ের স্কুলটি শতকরা আশিভাগ বদলে গেছে। বৃটিশ আমলের সেই ইটসুরকির টিনের ভবন নেই। সেইস্থলে গড়ে উঠেছে তিনতলা ভবন। নতুন পাকা ভবনমালা দখল করে ফেলেছে পিছনের পুকুরপার ও আশপাশের খালি প্রাঙ্গণ। তবে গেট পেরিয়ে স্কুলের সামনের বড় প্রাঙ্গণ এখনও কোনমতে টিকে আছে। সেই প্রাঙ্গণ জুড়ে এক সুরম্য প্যান্ডেল এবং মঞ্চ স্থাপন করা হয়েছে। এইস্কুলের অবসরপ্রাপ্ত নয়জন সাবেক শিক্ষককে সম্বর্ধনা দেয়া হয়। জীবিত সাতজন হলেন শ্রী গুনেন্দ্র রঞ্জন চক্রবর্তী, শ্রী তপন কুমার ভট্টাচার্য্য, দেবব্রত চক্রবর্তী, নিত্যানন্দ চক্রবর্তী নিতু, সমরেশ ধর, নিশিকান্ত দাস এবং মৌলানা বজলুল ইসলাম। পৃথিবী হতে বিদায় নেওয়া অন্য দুইজন হলেন দেবব্রত চক্রবর্তী দেবু এবং আমার আব্বা সফিকুর রহমান চৌধুরী ওরফে দলুমিয়া। নান্দনিক এই বিশাল প্যান্ডেলের চারপাশে শোভা পাচ্ছে আমার এই শ্রদ্ধাভাজন প্রিয় শিক্ষকদের বড় বড় ছবি সম্বলিত ৫ফুট x ১৫ফুট পরিমাপের অনেকগুলো ভার্টিকেল ব্যানার। আয়োজকরা এই সম্বর্ধণা সভার জন্য কেবলমাত্র বড় অঙ্কের অর্থই ব্যয় করেনি ববং তাদের প্রচুর সময় ও শিল্পীসত্বা উজাড় করে ঢেলে দিয়েছে।

সভা আরম্ভ হলে মোগলাবাজার হতে সভায় অগনিত মানুষের ঢল নামে। সামনের প্রাঙ্গণে তিলধারণের ঠাই নাই অবস্থা তৈরী হয়। চারপাশের ভবনের নিচতলা ও দুতলার বারান্দা জনতায় ভরে যায়। সভামঞ্চে প্রধান অতিথির  আসন গ্রহন করেন মদন মোহন কলেজের অধ্যক্ষ সুসাহিত্যিক ডঃ আবুল ফতেহ ফাত্তাহ, বিশেষ অতিথি হন মোগলাবাজার ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আলহাজ্ব চুনুমিয়া এবং সভাপতিত্ব করেন নুরূল আমিন শিক্ষার্থী ব্যাচ ১৯৯৫। সভামঞ্চে আসন গ্রহন করেন সম্বর্ধনাগ্রহীতা সাতজন বিদায়ী শিক্ষক এবং দুইজন প্রয়াত শিক্ষকের পক্ষে ক্রেস্ট, মানপত্র ও উপহারসামগ্রী গ্রহণকারী দীপক চক্রবর্তী এবং আমি ইসফাক কুরেশী। সভামঞ্চে আর বসেন এই স্কুলের প্রবীন ছাত্র জনতা ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক রিয়াজ আহমদ, সাংবাদিক জাহাঙ্গীর আলম মুশিক, আওয়ামী লীগ নেতা  শায়েস্তা মিয়া প্রমুখ।

এই সভায় অনেক বক্তা বক্তব্য রাখেন। আমার অগ্রজ নিশাত কুরেশী এবং আমি এখানে বক্তব্য রাখার আমন্ত্রণ পাই। নিশাত তার বক্তব্যের এক পর্যায়ে বিশ্ববিজয়ী গ্রিকবীর আলেকজান্ডারের কাহিনি তুলে ধরে। প্রাচীন সভ্য জগতের প্রায় সারাটা অঞ্চল জয় করে ব্যাবিলনে এসে মাত্র তেত্রিশ বছর বয়সে তিনি মারা যান। মৃত্যুর পূর্বক্ষণে তিনি তার সেনাপতিদেরে ডেকে ওসিয়ত করেন, আমি মারা যাচ্ছি তোমরা শবযাত্রা মিছিলে আমার খালি হাতদুটি শকটের দুইদিকে বের করে রাখবে। মুর্দার খালিহাত বের করে রাখার রীতিনীতি মানবসমাজে নেই, তাই সেনাপতিরা জানতে চাইলেন কেন আমরা এই অদ্ভুদ কাজ করব হে মহামান্য সম্রাট? তখন আলেকজান্ডার দি গ্রেট জবাব দেন, বিশ্ববাসী দেখুক সারাটা পৃথিবীর বাদশাহ আলেকজান্ডার সব ফেলে কেবল দুটি রিক্তহাত নিয়েই কবরে যাচ্ছেন।

আমি বক্তব্যে বললাম প্রয়াত পিতার স্মৃতি, স্কুলজীবনের স্মৃতি, কিছু উপদেশ এবং কিছু নীতিবাক্য। স্কুলের ১৯৯৫ এবং ১৯৯৯ এসএসসি পরীক্ষার্থি ব্যাচকে এমন একটি সুন্দর অনুষ্ঠান করে আমাদের শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষকদেরকে এমন এক উষ্ণ সম্বর্ধনা দেয়ায় প্রাণভরে ধন্যবাদ জানাই। তপন কুমার ভট্টাচার্য্য স্যার তার বক্তব্যে আমার ভাষণের প্রসঙ্গ তুলে ধরে আমাকে বারবার ফোকাস করেন।

ফুলের তুড়া, ক্রেস্ট, মানপত্র ও উপহারসামগ্রী গ্রহণকালে ছবি তুলার ধুম পড়ে। অসংখ্য ক্যামেরা ও মোবাইলের আলো জ্বলে ওঠে। আমার প্রিয় শিক্ষক শ্রী গুনেন্দ্র রঞ্জন চক্রবর্তীর গালে অস্ত্রপ্রচারের চিহ্ন দেখে সেদিন জানতে পারি তার ক্যান্সার হয়েছে এবং ভারতে তার চিকিৎসা চলছে। আমি ও নিশাত গাড়িতে করে তাকে রাতে বাসায় পৌঁছে দেই। ক্যান্সারের চিকিৎসা খুব ব্যায়বহুল, তাই শ্রী গুনেন্দ্র রঞ্জন চক্রবর্তী স্যারের চিকিৎসায় আমি সাধ্যমত সহায়তা করি।

অরেঞ্জটিলায় অধ্যাপক মশিউরের মায়ের চাচাত ভাই একজন সাদাসিদা মামু মাঝে মাঝে আসতেন। এই শামিম মামু একজন যাযাবর স্বভাবের মানুষ। ভাইবনেরা সবাই বিদেশে, ধনবান মানুষ অথচ বিয়েটিয়ে করেননি। আজ এখানে কাল সেখানে ঘুরে বেড়ান। খুব মজা করে তিনি মোরগ রান্না করেন। নিজহাতে চা বানিয়ে আমার ঘুম ভাঙ্গিয়ে খেতে বাধ্য করেন যেন আমি তার খুব ঘনিষ্ঠ কেঊ। উপরের তলায় থাকতেন মশিউরের ছাত্রের পরিবার, প্রায়ই নাস্তা আসত। উপরের ডান ফ্ল্যাটের বাসিন্দা একজন যুবতীর স্বামী বুড়ো লন্ডনি। আমি বিদেশে যাতায়াত করি শুনে এই যুবতী এসে একদিন আমার কাছে ইংরেজি শেখার আবদার জানান। মশিউর বললেন স্যার বিপদে পড়বেন, উদ্দেশ্য কিন্তু ইংলিশ শেখা নয়। আমার হাতে ইংরেজি শেখানোর পর্যাপ্ত সময় নেই বলে ক্ষমা চেয়ে এই যুবতীর হাত থেকে সেদিন নিস্তার পাই। 

মৌলভীবাজার শহরে আমার আরামখানা অরেঞ্জটিলার দিন এক সময় ফুরিয়ে আসে। প্রফেসর মশিউর রহমানের মত একজন ফেরেশতা মানবের সাথে ২০১৬ সালের মে হতে বসবাস করছি। সাবেক লেখামালায় আমি কেবল মশিউর রহমানের সৌভাগ্যের কথাই বলেছি, যিনি একদিনও বেকার না থেকে পূবালী ব্যাংকে চাকুরী পান ও ব্যবস্থাপক হন। অল্প বয়সে ভাগ্যে জুটে তন্বী সুন্দরী তরুণী পত্নী। বছর তিনেকের মধ্যে আল্লাহ তাকে দান করেন ফুটফুটে দুজন পূত্রকন্যা। মহান আল্লাহের দরবারে সুদের চাকুরী হতে অব্যাহতি পাওয়ার জন্য তিনি সর্বদা প্রার্থনা করতেন। এমনই এক সময় বিসিএস পরীক্ষায় উত্তির্ণ হয়ে সরকারি কলেজের প্রভাষক হন। এভাবে ভাগ্য এতদিন তাকে কেবল আনুকুল্যই করে গেছে।

মশিউর রহমান ছিলেন জাকির, যার কলবে ও ঠুটে সর্বদা আল্লাহর জিকির লেগেই থাকে। তাই মাঝে মধ্যে আমার মনে হত তিনি একজন দরবেশ প্রফেসর। একদিন সৃষ্টিকর্তা এই সুফি শিক্ষককে একটি কঠিন পরীক্ষায় ফেলে দেন। তার কন্যার জন্মের সময় প্রিয়তমা পত্নী মাত্র বিশ/একুশ বছর বয়সে পরলোকে চলে যান। দুই শিশুসন্থান অতি শৈশবেই মাতৃস্নেহ হারায়। ফুফু ও দাদাদাদি এতই স্নেহমমতায় শিশুদুটিকে প্রতিপালন করেন যে তারা মায়ের অভাব আদৌ বুঝতে পারেনি। মশিউর রোজ রোজ ফোন করে গ্রামে থাকা শিশু সন্থানদের খবর নেন।

মশিউর রহমানের বয়স মাত্র ত্রিশের কোঠায়, আমি তাকে বলি এযুগে আপনার বয়সে অনেক নারী পুরুষের বিয়েই হয়না। আপনার সারাটা জীবন এখনও পড়ে আছে, আপনি আবার বিয়ে করে সংসারী হন।  মশিউর বললেন বিয়ে রসুলের সুন্নত, বিয়ে মানুষকে কলুষমুক্ত রাখে। আমার ছোটবোনের একটা গতি হয়ে গেলেই বিয়েতে জড়াব।

আমি সপরিবারে যুক্তরাষ্ট্রে থাকাকালে আইনজীবী সম্মন্দির সাথে মশিউরের বোনের বিয়ে হয়। এবার নবীর সুন্নত পালনে কোমর বেঁধে তিনি কনে খুঁজতে নামেন। জন কয়েক কলেজ ছাত্রিকে ঘটক পাঠিয়ে আলাপ দিয়ে ব্যর্থ হন। আচমকা মৌলভীবাজার শহরের স্থায়ী নিবাসী কোন এক তাবলিগী পরিবারের সুন্দরী কুমারি বধু তার ভাগ্যে জুটে যায়। মশিউর পাশের ফ্ল্যাট ভাড়া নেন এবং দুই বাসার জয়েন্ট ওয়ালে দরজা কেটে এক বাসায় পরিণত করেন। বাসায় তিনটি এসি লাগান। গ্রাম হতে মাবাবা ও পরিবারের সবাইকে বাসায় নিয়ে আসেন এবং দুই শিশুসন্থানকে শহরের ভাল স্কুলে ভর্তি করে দেন। বাসাটি নিজখরচে পেইন্ট করান। মশিউর রহমানের মাবাবা প্রবীন হলেও তেমন বয়স হয়নি। তারা এখনও সুস্থ্য সবল। অধ্যাপক মশিউর রহমানের পিতৃমাতৃ ভক্তিও অনুকরনীয়, আমি তার চরিত্রে গুন ছাড়া কোন দোষ খুঁজে পাইনি।  

অক্টোবরে মশিউর রহমানের বিয়ে হয়। সিলেট হতে আমি সপরিবারে এই বিয়েতে যোগ দেই। শরতের একটি উজ্জ্বল দিন। বেশ ভাল রান্নাবান্না হয়। বাসার সামনের আঙিনায় প্যান্ডেল করে খাবার আয়োজন করা হয়। আবু তাহের, অধ্যক্ষ ফজলুল আলী, ওসমানী স্যার এবং শহরের পরিচিত অনেকে যোগদেন। যৌতুকবিহীন সুন্নতি বিয়ে্তে কোন উপহার সামগ্রী আনা বারন। অধিকন্তু প্রত্যেক মেহমানকে মশিউর রহমান প্রখ্যাত ইসলামি চিন্তাবিদ আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীরের একটি মুল্যবান গ্রন্থ উপহার দেন।

এই বিয়ে অনুষ্ঠানের পর মাত্র সাপ্তাহ দিন আমি এই বাসায় ছিলাম। অরেঞ্জ টিলার এই বাসায় ৩১শে অক্টোবর ছিল আমার শেষ দিবারাত্রি। মনোরম এই বাসায় আমার অবস্থান কালটা ছিল কমবেশি আড়াই বছর। আমার পাশের কক্ষে সাজে মশিউরের বাসর ঘর। তখনও এই বাসায় বিয়ের মেহমানদের হৈ চৈ, আনন্দ উৎসব। মশিউরের দুই শিশুসন্থান বাবার এই বিয়ে খুব আনন্দে উপভোগ করে। শিশুকন্যাটি ফ্যালফ্যাল চোখে নতুন মাকে চেয়ে দেখে। মশিউরের মনের খবর জানিনা, তবে আমার অন্তরে তখন বেদনার একটা শীতল বাতাস শিরশির করে বয়ে যায়। নিঃশব্দে আল্লাহের কাছে প্রার্থনা করি মশিউর যেন সবাইকে নিয়ে সুখে থাকেন।

তবে একটুখানি হেসে দেই বিয়েতে আসা একজন বাবার কাছে তার অবুঝ বাচ্চার আবদার শুনে, তুমি একটা বিয়ে করনা বাবা, আমরা ফুর্তি করব বিয়ে খাব। বাবা ধমক দিয়ে বাচ্চাকে বললেন যা তোর মাকে গিয়ে বল, তিনি যেন একজন কনে খোঁজে বিয়ের সব আয়োজন করেন।   

১লা নভেম্বর ২০১৮ সকালবেলা সবাইকে সালাম ও শুভেচ্ছা জানিয়ে আমি চিরদিনের জন্য অরেঞ্জ টিলার বাসা ছেড়ে বেরিয়ে আসি। মৌলভীবাজার সরকারি কলেজের অর্থনীতির তরুণ অধ্যাপক মশিউর রহমান আমার বিশাল জীবন নদীর মাঝখানে কবি বন্দে আলী মিয়ার ‘উড়ানীর চর’ হয়ে আজীবন জেগে রইলেন।

পশ্চিম বাজারের জনতা ভবন। মাত্র আড়াই ডেসিমেল জায়গায় স্থাপিত একটি ছয়তলা ভবন। নিচতলায় মালিকের রড, সিমেন্টের ব্যবসা। বাকী পাচতলা চাকুরেদের মেস। ছাদের উপর পাকঘর ও খাবার কক্ষ। অনেকগুলো একক ও দ্বৈত কক্ষ ভাড়া দেয়া আছে। রত্ন প্রসবিনী এই আড়াই ডেসিমেল হতে ভবনমালিকের প্রতিমাসে ভাড়া আসে লক্ষাধিক টাকা। আমার সহকর্মী আব্দুল ওয়াহেদ থাকেন একটি দ্বৈত কক্ষে, ভাড়া দেন তিন হাজার টাকা। একদিন তার কক্ষে যাই। দুইটি করে ছোট্ট খাট, চেয়ার, টেবিল, বিছানা ও কম্বল। কক্ষের সামনে খোলা বারান্দা ও পিছনে সংযুক্ত বাথরুম। আমি চারতলায় একটি যৌথকক্ষ ভাড়া নেই, তবে মাসিক ভাড়া তিন হাজার দুইশত টাকা। ভবনমালিক বললেন, স্যার আপনি ইচ্ছে হলে আরেকজনকে এই কক্ষে ঢুকাতে পারেন তবে কোন নারী এই ভবনে একেবারে নিষিদ্ধ, এমন কি পত্নীও। জনতা ভবনে ছিলেন একজন পুবালী অফিসার। তিনি প্রথমরাতেই আমার কক্ষে এসে একটি ছোট্ট ফুলের তুড়া হাতে তুলে দিয়ে আমাকে বরণ করেন।

ছাদের পাকঘরে দুপুর এবং রাতে দুইবেলা আহার করি। খাবার প্রতিবেলা মাত্র ষাট টাকা। একজন নোয়াখালী মুরব্বী কোন নারী সহায়তা ছাড়াই এতলোকের রান্নাবান্না করেন। বেশ ফুরফুরে মেজাজের এই মুরব্বী বাবুর্চি খুব স্বল্প টাকায় ডাল সহযোগে পালাক্রমে মাছ, মোরগ ও ডিমের সবজিমিক্স পরিবেশন করতেন। একদিন বাবুর্চিকে বলি চাচা এই টাকায় এত ভাল খাবার পরিবেশন করেন কিভাবে? বললেন, স্যার এখানে গ্যাস ও পানি ফ্রি, তরকারি ও মালামাল পাইকারি বাজার হতে অনেক কমদামে নিয়ে আসি।

মুরব্বিকে বলি আপনি পারবেন চাচা, আপনি যে বাংলাদেশের সবচেয়ে বুদ্ধিমান অঞ্চলের লোক।

২০১৮ সালের ডিসেম্বরের কোন এক ছুটির দিনে সাবেক সাংসদ চাচাত শফি চৌধুরী ভাই আমাকে ব্যাংকের রেস্ট হাউসে ডাক দেন। তিনি সংসদ নির্বাচনে বিএনপির একজন প্রার্থি। আমি গাড়ি নিয়ে তার সাথে সাথে দুইতিন দিন দৌড়াই। দাউদপুর গ্রামের বাড়িতে তার সাথে অনেকক্ষন বসে কাটাই। খালেরমুখ, মোগলাবাজার, সেনেরবাজার ও ফেঞ্চুগঞ্জ চক্কর দেই। আমার মনে হল কর্মীরা তার কাছে যেতে ভয় পাচ্ছে, কারন তাদের উপর পুলিশের কঠোর নজরদারী। যেখানের সমর্থকরা সভা ডাকছে, সেখানেই পুলিশ হানা দিয়ে নেতাদেরকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। থানায় আটক রাখছে, জেলে পুরছে। সরকারের আচরণে শফি চৌধুরীর জনসংযোগ করা দুরূহ হয়ে যায়। সমর্থকের কোন অভাব নেই কিন্তু তারা উদ্যম হারিয়ে ফেলে। মনবলহারা কর্মীদল নিয়ে ভোটযুদ্ধে জেতা অসম্ভব। আমার মনে হল দুইটি টিম ফুটবল খেলতে মাঠে নেমেছে কিন্তু একদলের খেলোয়াড়দের হাতপা বেঁধে দেয়া হয়েছে। মাঠে বল নিয়ে খেলা করছে কেবল সরকারি দলের খেলোয়াড়রা।

জনতা ভবনের ডায়নিংয়ে নানা জেলার নানা পেশার মানুষের মিলন ক্ষেত্র। ডায়নিং হলে মানুষের আলোচনায় উঠে আসে দেশের নাড়ি নক্ষত্রের সব খবর। এই আলোচনায় স্থান করে নেন হাসিনা খালেদা হতে শুরুকরে কোথাকার ফেসবুকের হিরো আলম। সাংসদ নির্বাচন বিষয়ক আলোচনা প্রায়ই সরগরম অবস্থা তৈরী হয়। আমি বোবার মত বসে বসে উপভোগ করি আমজনতার যুক্তিতর্ক ও রাজনীতির বিচার বিশ্লেষণ। এই আমজনতার রাজনীতি ঞ্জান যে কতটুকু পরিপক্ষ ও নির্ভুল আমি ভোটের পরদিনই টের পেয়ে যাই।

জনতা ভবনের পাশে সুরম্য পশ্চিমবাজার মসজিদ। আমি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ এই মসজিদে জামাতে পড়ি। বেলা অবেলায় মসজিদের একতলা ও দুতলার ফ্লোরে শহরে আসা পরিশ্রান্ত লোকজন ফেন ছেড়ে আরাম করে ঘুমিয়ে থাকেন, যেন এক দাতব্য নিদমহল। বাংলাদেশের কোন এলাকার মসজিদে মানুষকে এভাবে ঘুমানোর সুযোগ দেয়া হয়না। ঘুমন্ত মানুষজন দেখে আমার খুব ভাল লাগত। সাধারন মানুষের প্রতি এই উদারতা ও মমতা দেখানোর জন্য মৌলভীবাজারবাসীকে আমি শ্রদ্ধাভরা ধন্যবাদ জানাই।

প্রচন্ড শীতের ভোরে বাজার মসজিদে জামাতে ফজরের নামাজ আদায় করে আমি হাঁটতে নামি। কখনও চাদনিঘাটের সেতু পার হয়ে ওপারের মনুপারের রাস্থা, কখনও হাইস্কুল মাঠ পার হয়ে পৌরসভা অফিসের পিছনের গীর্জাপাড়া, কখনও মুসলিম কোয়ার্টার লেকরোড হয়ে কাজিরগাও, কখনও সিলেট রোডের যুগিডহর, শ্রীমঙ্গল রোডের মোস্তফাপুর হতে হজরত শাহ মোস্তফার(রঃ) মাজার। ঘন্টাখানিক হাঁটলেই ছোট্ট এই সুন্দর শহরটা এফুড় ওফুড় হয়ে যায়। হেঁটে হেঁটে নতুন নতুন পাড়া আবিস্কার আমার নেশা হয়ে যায়। মনুর উপর বসানো বাশের সেঁকো দিয়ে বাচ্চাদের মত হেসে খেলে নদী পার হয়ে অপারের গ্রামে যাই। শাহজালালের(রঃ) আরেক সহচরের মাজার জেয়ারত করি। চাঁদনীঘাট ব্রিজে দাঁড়িয়ে সূর্যদোয় দেখি। মনুর এপারের হিন্দুপাড়ার মন্দিরের ভজন কীর্তণ প্রাণভরে উপভোগ করি।  

অফিসে আবু তাহেরের দরবারে সাপ্তাহিক মৌমাছি কন্ঠ নিয়ে হাজির হন একজন হুজুর, তার ভাষায় আল্লাহ তাকে অনেক খানেওয়ালা দিয়েছেন কিন্তু রোজগার দেন নাই। তাই তিনি হাত পাতেন, তার হাতে আমরা কিছু টাকা ছেড়ে দেই। পাঁচ দশ বিশ যাই হউক আপত্তি নেই। সাপ্তাহিক মৌমাছি কন্ঠে মোঃ আবুতাহেরের খবর ছাপলে তিনি খুশী হয়ে হুজুরকে প্রচুর এনাম দেন। এই হুজুরকে সুদূর ঢাকা হতে সর্বদা সাহায্য করেন আমাদের মহাব্যবস্থাপক আহমদ এনায়েত মঞ্জুর।

একদিন আমাকে আবুতাহের বললেন, মৌলভীবাজারে আপনার প্রায় তিন বৎসর হয়ে যাচ্ছে। সিলেটের মহাব্যবস্থাপককে ফোন করায়ে শীঘ্রই সিলেটে চলে যান, নতুবা আপনাকে নিশ্চিত ঢাকায় পাঠিয়ে দেবে। তিনি বিষয়টি কিভাবে আচ করলেন জানিনা তবে বাস্তবে তাই ঘটলো। আমি বিগত প্রায় পাঁচ বছর ধরে সিলেট শহর হতে নির্বাসিত কিন্তু ব্যাংকে নিজের ঘনিষ্ঠ প্রভাবশালীদের কাছে সিলেটে যেতে ধর্ণা দিতে যাইনি।

সিলেটের মহাব্যবস্থাপকের কাছে বললাম, মৌলভীবাজারে আমার তিন বৎসর হয়ে যাবে। আমি ইতিপূর্বে সিলেট শহরে আট বৎসর ম্যানেজারি করেছি। আমাকে সিলেটের ব্যবস্থাপকসহ যে কোন চেয়ারে বসাতে পারেন। মানব সম্পদ বিভাগের মহাব্যবস্থাপকে আহমদ এনায়েত মঞ্জুর সিলেট আসলে তাকে ফোন করে বললাম, আমাকে অযথা অনেক কষ্ট দেয়া হচ্ছে এবার সিলেটে আসার সুযোগ করে দিন। তিনি বললেন এম ডি স্যারের সাথে আপনি আলাপ করুন। তাকে বলি আমি এমডির শ্বশুর সম্পর্কীয় আত্মীয়, আমার সুবিধা অসুবিধা তিনি এমনিতেই দেখার কথা, তার সাথে আমি যেচে আলাপ করতে যাবো কেন?

স্থানীয়দের বিরোধীতায় সিলেটের বিভাগীয় প্রধান বি এম শহিদুল হক আমাকে সিলেটের গুরুত্বপূর্ণ কোন শাখায় দেবার চেষ্টা করে বিফল হন। ইতিমধ্যে পদোন্নতি না দিয়ে আমাকে পরিকল্পিতভাবে পঙ্গু করে ফেলা হয়। আমি আগেকার মানসিক শক্তি ও উদ্যম হারিয়ে ফেলি। ব্যবস্থাপক হবার আগের যে আগ্রহ ও স্বপ্ন ছিল তা তিরোহিত হয়, কারণ আমার সমকক্ষ সমবয়সীরা তখন বিভিন্ন স্থানে অঞ্চল প্রধান হয়ে আছেন। তাই সিলেটের কোন শাখা প্রধান হওয়াও তখন আমার জন্য আর শুভকর মনে হলনা।

শুভ নববর্ষ ২০১৯। বছরের সুচনাবেলা রাজধানী ঢাকায় আমার বদলির আদেশ পাই। খবরটি আমার বেগমকে জানাতে আমি সাহস পাইনি। জেফারকে মেডিক্যালে ভর্তি করে তিনি দারুন মানসিক অস্থিরতায় আছেন। তিন বছর ধরে আমিও কাছে নেই। মনে হল ঢাকা যাবার দিন তাকে জানাব, সাপ্তাহ দিন খবরটা গোপন থাক। আগেবাগে এই খবর জানিয়ে তাঁকে কষ্ট দিয়ে লাভ কি?

কিন্তু দুইতিন দিন পর তিনি বিমর্ষ হয়ে ফোন করলেন, তুমি নাকি ঢাকায় বদলী হয়ে গেছ? আমি জবাব না দিয়ে বললাম কোথায় শুনেছ? বললেন নিচতলায় শুনেছি, এব্যাংকে চাকুরীরত আমার ভাগনা তাঞ্জিরও বলেছে।

একরাতে খোয়াব দেখি আমি এক নতুন বাসা কিনেছি। এই নতুন বাসায় উপমহাব্যবস্থাপক মাহবুব আহমদ ও দিলীপ কুমার পাল আমাকে দেখতে এসেছেন। আমি খালিগাত্রে কেবল লুঙ্গিপরা। সলজ্জ মনে সামনে যাই। আড়াল হতে মশিউর রহমান খানের কন্ঠ শুনি কিন্তু তাকে দেখিনি। দুইতিন দিনের মধ্যেই আমার বস দিলীপ কুমার পাল এবং মাহবুব আহমদের ঢাকায় বদলির আরেকটি আদেশ আসে। শুনামাত্র আমি এই আদেশে মশিউর রহমান খানের নাম খুঁজতে থাকি। কিন্তু তালিকায় তার নাম নেই। অবাক হয়ে দেখি গতরাতের স্বপ্নের সাথে এই বদলী আদেশ যেন মিলে গেছে। আমরা তিনজনই বদলী কেবল মশিউর রহমান বাদ। কারণ তাঁর কন্ঠ শুনেছি কিন্তু দেখিনি।

৫ জানুয়ারি, শনিবার, ২০১৯ সাল। মোঃ আবুতাহেরের আমন্ত্রণে কার চালিয়ে সিলেট হতে মৌলভীবাজার যাই। শমসেরনগর রোডে মোঃ আবুতাহেরের নিজস্ব বাসা, নিরিবিলি পরিবেশে সুন্দর একতলা ভবন। পাশে পরিচিত একজন আইনজীবী আমাকে টেনে নিয়ে তার মনোরম বাসাটি দেখান। আবুতাহেরের বাসায় খানিকক্ষণ বসে দাওয়াতে যোগ দিতে তার শ্বশুরবাড়ি তারাপাশার পানে কার চালাই। কুলাউড়া রোড দিয়ে টেংরাবাজার পার হয়ে একটি হাওরপারে নিরিবিলি গ্রাম একাসন্তুষ। সাথে যান আবুতাহেরের কনিষ্ট পূত্র ইকরাম। একটি পাকা দেয়ালঘেরা বড় লন্ডনিবাড়ি, সামনে পুকুর বামপাশে খোলা প্রাঙ্গণ। একতলা ভবনটায় অনেক অনেক কক্ষ একটার পর একটা সুসজ্জিত। বাড়ির সামনে সিলেট ও মৌলভীবাজার হতে আগত মেহমানদের পাঁচসাতটা গাড়ি পার্ক করা আছে। এবাড়ির সবাই বৃটেনে থাকেন। শীতে দলবেঁধে প্রবাসীরা এসেছেন দেশে।

মৌলভীবাজারে বদলী হয়ে এসেই পশ্চিমবাজারে এবাড়ির মালিকানাধীন হোটেল সেরাটাউনে একমাস কাটাই। বাড়ির বারান্দার চেয়ারে বসে মেহমানদের সাথে আড্ডা দেই। বৃটেনে বড় হওয়া বাচ্চারা ইংরেজিতে কিচির মিচির করছে। পিছনের প্যান্ডেলে খাবারদাবারের এলাহি কান্ড। মাছ গোমাংস খাসী মোরগ ডিম দৈ ফিরনি সাদাভাত আখনি কিছুই বাদ নেই খাবার টেবিলে। বিকেলে আবুতাহেরের বাসা ছুঁয়ে আমি ফিরে যাই পশ্চিমবাজার জনতা ভবনে। আমার গাড়িটি লক করে আল্লার হাতে সপে রাতে ফেলে রাখি মৌলভীবাজারের ফাঁকা রাস্থায়।   

৬ জানুয়ারি, রবিবার, ২০১৯ সাল। রাত পোঁহাতেই নিত্যদিনের মত মোল্লার হোটেলে নাস্তা সেরে শেষদিনের দায়িত্ব পালনে অফিসে পা রাখি। পুবালী ব্যাংকের মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলাদ্বয়ের উপপ্রধান সহকারী মহাব্যবস্থাপক ইসফাক কুরেশীর ঢাকায় নির্বাসন দন্ড আজ কার্যকর হবে। আমার বিদায় উপলক্ষ্যে বাসায় দুপুরের খাবারে নিমন্ত্রণ জানান মৌলভীবাজার শাখার ব্যবস্থাপক আবু জাফর রকিবুল্লাহ। এই দাওয়াতে হাজিরা দেন আইন অফিসার মোঃ আবুতাহের, অঞ্চলপ্রধান দিলীপ কুমার পাল এবং বিদায়ী অতিথি আমি চৌধুরী ইসফাকুর রহমান কুরেশী। রকিবুল্লাহকে আমার দারূণ ভাল লাগে, ভীষণ বিনয়ী মানব তিনি। তার রংপুরী গিন্নীর নানা পদের মজাদার রান্না খেয়ে মনে হল তিনি আসলেই একজন সৌখিন রাঁধুনি।

আমার নির্বাসন দন্ডের পেপারবুক রেডি। মানবসম্পদ অফিসার সাইদুর রহমান রিলিজ অর্ডার ও লাস্ট পে সার্টিফিকেট তৈরী করে রেখেছেন। স্টাফ ডিমান্ড লোন ও ইনকামটেক্স প্রভিশন ঢাকার প্রিন্সিপাল শাখায় স্থানান্তর প্রক্রিয়া শেষ প্রায়। আমি ঢাকা যেতে মানসিকভাবে প্রস্তুত। অঞ্চল প্রধান দিলীপ কুমার পাল আমাকে ডেকে বললেন, আমরা বিকেলে সবাই বসে আপনাকে বিদায় দেবো। বিকেলে অঞ্চলপ্রধানের চেম্বার চেয়ার সজ্জিত করা হয়। অফিসের সব স্টাফ অফিসাররা সেখানে সমবেত হন। আসেন মৌলভীবাজার শাখার ব্যবস্থাপক আবু জাফর রকিবুল্লাহ এসপিও। অসুস্থতার কারনে কেবল অনুপস্থিত ছিলেন আমার প্রিয় ব্যক্তিত্ব আব্দুল ওয়াহেদ এসপিও। তার সাথে আমার আর দেখা হয়নি, অচিরেই তিনি চলে যান নাফেরার দেশে। বিকেলে বিদায় সভায় স্মৃতিচারন করেন সাইদুর, শান্ত, সুমিত, গৌরাঙ্গ, পলাশ, শ্যামল, ইমরানা, সুধাসিন্ধু, মুজিবুর রহমান, মোঃ আবুতাহের এবং অঞ্চলপ্রধান দিলীপ কুমার পাল। ভালবাসার চিহ্ন হিসাবে একটি দামি সার্ট তারা আমার হাতে তুলে দেন। পূবালী ব্যাংকে আমার অন্তরের পুঞ্জিভূত কিছু মান অভিমান ও হতাশার কথা শুনাই সবাইকে। কারও পদ ধরে সুযোগ সুবিধা আদায়, অন্যকে ডিঙ্গায়ে কিছু পাবার জন্য কাঙ্গালিপনা করার অভ্যাস আমার কোনদিন ছিলনা, এখনও আদৌ নেই।

জনতা ভবনের ভাড়া পরিশোধ করে সব মালামালে গাড়ির বেনেট লোড করি। কারের স্ট্রিয়ারিংতে হাত রেখে বলি গুডবাই মৌলভীবাজার, আমার প্রিয় শহর, আমার ভালবাসা। আজ আমি তোমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছি নতুন ঠিকানায়। অনেক প্রিয় মানুষের মুখ বারবার আমার মনের কিনারায় উকি দেয়। বুকে এক চিমচিম বিরহ ব্যাথা অনুভব করি। মনকে সান্তনা দেই জীবনের বন্দরে বন্দরে কত লোক আসে কত লোক যায়। আমরা কেউ কি কাউকেই ধরে রাখতে পারি? না পারিনা। মানুষ আসে, মানুষ যায়। আসলে এই পৃথিবীর সব সম্পর্কই কচুপাতার পানি, এখানে কেউ  কারও নয়। 

সেদিন গাড়িতে বসেন আমার সহকর্মী সুধাসিন্ধু এবং পলাশ মুখার্য্যি। আমরা তিনজন গল্প করে করে রাতে সিলেট পৌছি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন