অগ্রজ তাহমিদ চৌধুরীর বিয়ের স্মৃতিঃ
বিয়ের
তারিখঃ ২৯ জানুয়ারি ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দ
১৯৮৩ সাল হতে প্রথমে ঞ্জানার্জনে
ও পরে চাকুরী
উপলক্ষ্যে দাউদপুর হতে সিলেট শহরে আমার নিয়মিত যাতায়াত শুরু
হয়। ছুটির দিন বাদ দিলে আমার দিন সিলেট শহরে ও রাত দাউদপুর গ্রামে কাটত। বিগত দশ
বছরে যাত্রাপথের বাসে বেশ কয়েকজন নানা পেশার মানুষের সাথে পরিচয় হয়। এই
পরিচয় বন্ধুত্ব পর্যন্ত গড়ায়। সিলেট যাত্রাপথের এই বন্ধুদের একজন হাড়িয়ারচরের কালন
মৌলানা। নামের মতই তার গায়ের রঙ মেঘলা। সামান্য খাটো ও হাসিমুখের মানুষ তিনি। কালন
মৌলানার পেশা শাহজালাল উপশহরের বাসায় বাসায় গিয়ে বাচ্চাদেরকে আরবি
ও নামাজ পড়া শিখানো। তার জীবনটা ত্যাগের, তিনি অকৃতদ্বার থেকে তার পরলোকগত
বড়ভাইয়ের একপাল ভাতিজা ভাতিজির বিশাল এক সংসারের বুজা বিরামহীন টেনে যাচ্ছেন।
সহায়সম্পদ তেমন নেই, কঠোর পরিশ্রম করেই কোনমতে টিকে আছেন।
আমার অগ্রজ
তাহমিদ চৌধুরী তখন ঢাকায় এলবার্ট ডেভিট কোম্পানিতে কর্মরত ছিলেন। এখানে
দিনরাত কঠোর পরিশ্রম করতে হত। আমার কেন যেন মনে এখানে
থাকার চেয়ে তার লন্ডনে চলে যাওয়া উত্তম হবে। একদিন বাসে পাশে বসা কালন মৌলানা
আমাকে বললেন, চৌধুরী সাহেব, আপনার বড়ভাই তাহমিদ মিয়াকে এখন বিয়ে দেওয়ার কোন চিন্তাভাবনা
আপনার আব্বা করছেন কি? উপশহরে আমি এক বাসায় আরবি
পড়াই, সেখানে আমার জানাশুনা একজন লন্ডনি কনে আছেন।
আপনারা অনুমতি দিলে আমি আলাপ করে দেখতে পারি। আমি হুজুরকে বললাম ঘরে আলোচনা করে
পরে জানাব। পরদিন দেখা হলে বললাম কনে দেখতে কেমন? তিনি জবাব দেন কনের চেহারা আমি
কখনও দেখিনি, তবে একদিন শাড়ির নিচে পায়ের খানিকটা দেখেছি, রঙ ধবধবে সফেদ মনে
হয়েছে। আমাদের গ্রামবাসীরা মেয়েদের কেবল গায়ের রঙ দিয়েই রূপ পরিমাপ করেন। কনের মুখ
না দেখেও পায়ের দুগ্ধরঙ হিসাবে নিয়েই কালন মৌলানা রায় দেন কনে অনিন্দ্যসুন্দরী
হবেন।
কালন মৌলানা
একদিন আমাকে কনের ডি ব্লকের নিজস্ব বাসায় নিয়ে যান। সেদিন খালু ইলিমুর রাজা চৌধুরী
আমাদেকে খুব আপ্যায়ন করেন। সেখানে দুপুরে চিতল মাছের কোপ্তাসহ
অনেক ব্যাঞ্জনের খাবার খাই। খালু ও কনের একমাত্র অগ্রজ আসাদ ভাইয়ের শিষ্টাচার
আমাকে এক পজিটিভ বার্তা প্রদান করে। এদিনও কনে বিলকিস বাহার চৌধুরীর সাথে দেখা
হয়নি কিন্তু কনের দুই মায়াবী দর্শন ভাইপো ভাইজি কামরান ও নার্গিসকে দেখে মনে হল
তাদের ফুফু মন্দ হবেন না। তাছাড়া খালুও এই বয়সে লম্বাফর্সা একজন সুদর্শন লোক। এমন
একজন দৃষ্টিনন্দন পিতার কন্যা সুরুপা না হবার কোন কারণ
নেই।
একদিন সন্ধ্যার
পর আম্মা ও ছোটবোন মান্না দাউদপুর হতে এসে কনে দেখে যান। কিছুদিন পর আব্বা ও আমি
আমাদের হিতাকাঙ্ক্ষী কালন মৌলানাকে নিয়ে গিয়ে বিয়ের সব প্রয়োজনীয় আলাপ আলোচনা
সমাপ্ত করে আসি। পপি, লবিদ, হুদহুদ, চুন্নী, গিনি, আরফা, নিপা, রিপা, লিজা,
শহিদমামা, ছাদিকমামা, কচিমামি, সেবন মামি এই যারা সবাই আজ বিদেশ বিভূইয়ে ছড়িয়ে
গেছেন, তারা ছিলেন সেই বিয়ে অনুষ্টানের মধ্যমনি।
মনে পড়ে
বিয়ের আগের রাতে দাউদপুরের বাড়িতে খুব ধূমধামের সাথে গায়েহলুদ অনূষ্ঠান
হয়। বাড়ির আঙ্গিনায় গায়ে হলুদের প্যান্ডেল তৈরী করা
হয়। কাটের গুড়াকে নানারঙ্গে রঞ্জিত করে প্যান্ডেলের সামনে বিছিয়ে কার্পেট তৈরি করা
হয়। আনুষ্ঠানটি ভিডিও করতে সিলেটের তাতিপাড়া হতে
আসেন কার্তিক পাল। সেইরাত ছিল শীতবসন্তের মাঝামাঝি এক রাত। আত্মীয়স্বজন ও গায়ের
মানুষের ঢল নামে বাড়ির আঙ্গিনায়। আনন্দ ও হৈ-হিল্লোড়
করে গভীররাত পার হয়ে যায়।
কন্যাদান অনুষ্ঠান হয় শাহজালাল
উপশহর শিবগঞ্জ রোডের পাশে আধুনালুপ্ত পুরবী সেন্টারে।
আমাদের বাড়ির কোন বিয়েতে কোনদিনই যৌতুকের কোন কায়কারবার নেই। কিন্ত লাদাবি সত্বেও এই
বিয়েতে কেবল গাড়ি ছাড়া টিভি, ফ্রিজ, ভিডিও, ভিসিয়ার, সোফা, সোনারূপা, বাসন কোশন
কিছুই আসা বাদ পড়েনি। একদিন পর এক উজ্জ্বল রোদ্রঝরা দিনে আমাদের বাড়িতে ওয়ালিমা
অনুষ্ঠিত হয়। আজকে নেই এমন অনেক আত্মীয় যেমন ডঃ সদরুদ্দিন
ভাই, অহিদ ভাই, কাইয়ুম ভাই, মুরাদ ভাই, মতি ভাই, ফুলবুবু রেহা, রেশাদ
ভাই, ফজলু ভাই, এহিয়া ভাই, মসরু ভাই, মুফতি মোঃ খালেদ দোলাভাইসহ
অনেকে উপস্থিত ছিলেন।
আমার বড়
ভাইয়ের শ্বশুর ইলিমুর রাজা চৌধুরী ছিলেন একজন দিলদরিয়া লোক। একজন রাজার মতই ছিল
তার চেহারা সুরত ও আচার আচরণ। তিনি দুইহাতে টাকা উড়াতেন। বাসা সব উৎকৃষ্ট
মালামাল দিয়ে সাজিয়ে পরিচ্ছন্ন করে রাখতেন। প্রতিদিন ইস্ত্রি করা পরিষ্কার পাজামা
পাঞ্জাবি লুঙ্গি পরতেন। বৃটিশ সিটিজেন হলেও
বছরের বেশিরভাগ সময় তিনি জন্মভূমি বাংলাদেশে
অবস্থান করতেন। তার নিজস্ব বাসার সামনে ছিল শাহজালাল উপশহরের ডি ব্লকের জামে
মসজিদ। এই মসজিদে তার সবসময় জামাতে নামাজ পড়তেন।
তিনি আমাকে
ডাকতেন সিফাক। বাসায় ভাল রান্না হলে আমাকে অফিসে ফোন দিতেন, সিফাক আজ দুপুরে যে
কোন প্রকারে একবার এসো। কেন আসব জিজ্ঞেস করলে বলতেন আগে আস পড়ে বলব কেন ডেকেছি।
আমি কদমতলী ও সিলেট শাখা হতে অনেকদিন দুপুরে এসে দেখতাম পাকা চিতল মাছের কোপ্তা,
দই, দুধ বিরইন চালের ফিরনি, অনেক পদের খাবার সাজানো। আমার প্রতি তার ছিল এক অবারিত
আপত্যস্নেহ, তাই তিনি আমাকে খাওয়ায়ে এক অনাবিল আনন্দ পেতেন। আমার পুত্র জেফারের
জন্ম হবার পর তাকে দেখতে উপশহরের বাসায় গেলে বলতেন, তোমার মিয়া কেমন আছেন? তাইন
কিতা কররা?
খালাম্মাও
ছিলেন খুব স্নেহশীলা মহিলা। কোন রোগ হলেই আমার চিকিৎসক পত্নীকে ডাকতেন। হঠাৎ একদিন
তার কঠিন এক অজ্ঞাত রোগ হয়। চিকিৎসক রোগ পুরাপুরি সনাক্ত করার আগেই তার শরীরের
অবনতি ঘটে। তিনি ২৭ রমজানের পবিত্র রাতে পবিত্র শুক্রবারে মারা যান। আমরা তাকে
পরদিন বাদ জুমুয়ায় হজরত শাহজালালের(রঃ) দরগার ঝর্নাপাশের কবরগায় চিরশায়িত করি।
খালাম্মার
পরজগতে চলে যাওয়ার পর খালু একা হয়ে যান এবং বয়স তাকে চেপে ধরে। আব্বা ও আম্মার
মৃত্যুকালে তিনি আমাদের একজন আপনজন হয়ে পাশে দাঁড়ান। তিনি এক সুদীর্ঘ্য সুখী
জীবনকাল পান। শেষ বয়সে লন্ডনে দুই এক বার তার শরীরে অস্ত্রপ্রচার করা হয়। জীবনের
একদম শেষপ্রান্তে এসে তিনি স্মৃতিবিভ্রাটের কবলে পড়েন। অনেক সময় আমাদেরকেও চিনতে
পারতেন না। হঠাৎ তার স্বাস্থ্যের অবনতি হলে তার একমাত্র কন্যা আমার ভাবী বিলকিস
বাহার চৌধুরী দেশে ছুটে আসেন। সারাজীবন আল্লাহের উপাসনা এবং মানুষের সেবা করে
এক নিঃজঞ্চাট জীবন কাটিয়ে খালু ইলিমুর রাজা চৌধুরী ২০১৮ সালের ২৬
অক্টোবর রোজ শুক্রবার সকালবেলা তার উপশহরের বাসায় শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বাসার
সামনের ডি ব্লকের মসজিদে আমরা তার নামাজে জানাজায় অংশগ্রহণ
করি। রাতে তাকে শাহজালালের(রঃ) দরগায় তার জীবনসাথী
খালাম্মার কবরের পাশেই আমরা দাফন করে বিষন্ন মনে ঘরে ফিরে যাই।
আমার স্মৃতিতে তিনি সব সময় চিরজীবন্ত হয়ে থাকবেন। দয়াময় আল্লাহ তাহাকে শ্রেষ্ট
পুরস্কারে ভূষিত করুন। আমিন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন