শেষমেশ পূবালী ব্যাংকে হলো যে মোর ঠাইঃ
একদিন
পুবালী ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষার সুচীপত্র পেলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনায়
লিখিত নিয়োগ পরীক্ষায় আমার সিট পড়ল ঢাকা সিটি কলেজে। এই কলেজটির
অবস্থান ধানমন্ডি। পরীক্ষা শেষ হলে যখন বেরিয়ে আসি তখন দেখি শতশত
পরীক্ষার্থীরা রাস্থায় জ্যাম লাগিয়ে দিয়েছে। ব্যাংকের চাকুরিকে
আমার কাছে কোনদিন খুব একটা ভাল পেশা মনে হতনা। এখানে সুদের এই চাকুরিতে
এতলোক যে পরীক্ষা দিতে আসবে তা আমার ধারণায় ছিল না।
প্রায় একশত অফিসার পদে নিয়োগের জন্য
পরীক্ষায় ছয়সাত হাজার লোক অংশগ্রহণ করেন।
মনে এক অজানা ভয় তৈরি হল আমি আদৌ এই লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ
হতে পারবতো? এটাতো স্কুল কলেজের কেবল পাশ করার কোন
পরীক্ষা নয় বরং এটা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা। এই পরীক্ষার উত্তীর্ণ
হতে হলে কত নম্বর উঠাতে হবে তাও কেঊ বলতে পারেনা।
কিন্তু
একদিন মৌখিক পরীক্ষার আমন্ত্রণপত্র পাই।
আগের দিন ভাইবা দিতে রাতের ট্রেনে রওয়ানা হলাম। এই একি ট্রেনে করে ঐ রাতে জনাব ই এ চৌধুরী সিলেট হতে
ঢাকা যান। পুবালী ব্যাংক হেডঅফিসের তিনতলায় সকাল ১১ ঘটিকা
হতে মৌখিক পরীক্ষা শুরু হয়। কার্ডে ভাইবার সময় উল্লেখ থাকায় একসাথে এসে
সবপ্রার্থীরা একসাথে ভীড় জমান নি। বিকেল
২টা নাগাদ আমার ডাক পড়ে। পুবালী ব্যাংক সম্পর্কে ইতিপুর্বে আমার তেমন কোন ধারণা
ছিলনা। ইন্টারভিউ বোর্ডে চারজন লোক বসে আছেন তাদের মধ্যে মাত্র একজনকেই আমি চিনি,
তিনি আমার আত্মীয় ব্যাংকের চেয়ারম্যান ই এ চৌধুরী।
আমার পরম
শ্রদ্ধাভাজন বড়ভাই ই এ চৌধুরী জানতেন আমি ইতিহাসে খুব পারদর্শী, তাই তিনি আমাকে
কেবল ইতিহাস বিষয়ক প্রশ্ন করলেন। তার প্রথম প্রশ্ন হল সিলেটে মুসলিম শাসন কবে শুরু
হয়? আমি উত্তর দিলাম ১৩০৩ সালে। এই তারিখ তুমি নিশ্চিত হলে কেমন করে? এবার বললাম
বঙ্গের সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহের আমলে স্থাপিত আম্বরখানায় প্রাপ্ত শিলালিপি
হতে, যাহা ঢাকা যাদুঘরে রক্ষিত আছে। তিনি আমাকে
আবার প্রশ্ন করলেন দিল্লির দাস রাজবংশের নাম কি শুনেছ? আমি
হ্যাঁ বললে তিনি বললেন এই বংশকে দাস রাজবংশ কেন বলা হয়। আমি উত্তর দিলাম এই বংশের
সুলতানরা ক্রীতদাস ছিলেন, তাই এই বংশকে দাস রাজবংশ বলা হয়।
এবার প্রশ্ন করলেন দুই একজন দাস সুলতানের নাম বলুন তো।
এবার উত্তর দিলাম কুতুব উদ্দিন আইবেক, ইলতুৎমিশ, গিয়াস উদ্দিন বলবন প্রমুখ। আচ্ছা
যেতে পার, বললে আমি সালাম দিয়ে বেরিয়ে আসলাম।
ট্রেনে
সিলেট ফেরার রাতে খুব প্রশান্তি প্রশান্তি লাগছিল, যাক শেষ পর্যন্ত একটা চাকুরি
হল। মনে মনে মহান আল্লাহর প্রতি একটা শোকরিয়া, শোকরিয়া ভাব নিয়ে ট্রেনের সময় পার
করলাম। এবার অপেক্ষার পালা, দিন যায় রাত যায় কিন্তু নিয়োগপত্রের কোন খবর নেই।
বহুদিন একটানা অপেক্ষার পর একদিন নিয়োগপত্র পেলাম। রেঙ্গা দাউদপুর ডাক অফিস হতে
নিয়োগপত্র নিয়ে মহানন্দে বাড়িতে দৌড় দেই।
পরদিন
ছুটলাম পুবালী ব্যাংক চৌধুরীবাজার শাখায়। একদিন পুবালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান জনাব ই
এ চৌধুরী বাড়িতে এলে আব্বা সফিক চৌধুরী তার এই ভাগ্নাকে এখানে একটি শাখা করার
অনুরোধ করেন। তখন সিলেট শহরে গিয়ে অনেক কষ্টকরে
লোকজনকে ব্যাংকিং কাজ পরিচালনা করতে হত। কিন্তু চৌধুরীবাজারে
তখন ব্যাংক স্থাপনের মত কোন উপযুক্ত ভবন ছিলনা। এই ব্যাংকের পরিচালক মনির উদ্দিন
সাহেব তখন বাজারে একটি পাকাভবন নির্মাণ করে দেন।
আমি পুবালী ব্যাংকে আমার যোগদানের তিন বৎসর আগে ১৯৮৭ সালে পুবালী ব্যাংকের এই
শাখাটি স্থাপিত হয়।
এই শাখার
প্রতিষ্ঠাতা ব্যবস্থাপক আব্দুল ওয়াহিদ সাহেব
আমাকে খুবস্নেহ করতেন। নতুন শাখা উদ্বোধনের
আগে তিনি আমাকে নিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে অসংখ্য হিসাব খোলেন। সেই থেকে তার সাথে আমার
নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠে। এই শাখার একনম্বর চলতি হিসাবটি ছিল দরগাহ ই হজরত শাহদাউদ
কুরেশীর(রঃ) নামে। দুইনম্বর চলতি হিসাবটি আমাদের দাউদপুর জামে মসজিদের নামে
মোতাওয়াল্লি আমার পিতা সফিক চৌধুরীর দস্তখতে
খোলা হয়। একনম্বর সঞ্চয়ী হিসাবটি আমার পিতা সফিকুর রহমান চৌধুরীর নামে খোলা
হয়েছিল।
শাখাটি
উদ্ভোধনে ২০/২৫টি গাড়িভর্তি ভি আই পি নিয়ে ব্যাংকের চেয়ারম্যান ই এ চৌধুরী, পরিচালক
মনির আহমদ ও শফি চৌধুরী এমপি যোগদান করেন। সেই
১৯৮৭ সাল থেকেই ব্যাবস্থাপক আব্দুল ওয়াহেদ আমাকে বলতেন পুবালী ব্যাংকে ঢুকে
যান কিন্তু ব্যাংকের প্রতি আমার তেমন আগ্রহ না থাকায় ও লেখাপড়ায় ব্যস্ত থাকায় বিরত
থাকি। শেষে অনেক দেরি করে ১৯৯০
সালে হঠাৎ যেন কেমন করে পুবালী হাওয়ায় উড়তে গেলাম। পুবালী ব্যাংককে মনে হত হাতের
কাছের সুরমা নদী, এখানে যখন খুশী তখন নেমে
সাঁতার কাটা যাবে।
ব্যবস্থাপক
আব্দুল ওয়াহিদ আমাকে চাকুরির একটি
পার্সোনাল ফাইল তৈরি করে দেন এবং এখানে চাকুরি
বিষয়ক সব কাগজপত্র সংরক্ষণ করতে বলেন।
আমার চাকুরি জীবনের বিগত ত্রিশ বৎসরের কাগজপত্রে
এই ঐতিহাসিক ফাইলটি এখন স্ফীত হয়ে আছে। আত্মীয় নন অথচ গণ্যমান্য
এমন একজন লোককে দিয়ে একটি বন্ডে সই করাতে হয়। ব্যাংকে বসা তুড়ুকখলা গ্রামের আব্বার
ছাত্র অবসরপ্রাপ্ত জেলা আনসার এডজুটেন্ট লুতফুর রহমান সাহেবকে বলা মাত্রই তিনি
হাসিমুখে বন্ডে স্বাক্ষর করে দেন। লুতফুর
রহমানের একপুত্র ও কন্যা মোগলাবাজার স্কুলে আমার ছাত্র ছিল।
এভাবে চাকুরি যোগদানের সব ধরনের কাগজপত্র পিবিএল
চৌধুরীবাজার শাখায় বসে তৈরি করে ফেলি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন