পুবালী ব্যাংক লিঃ সিলেট শাখা, বন্দর বাজার,
সিলেট, প্রথম পর্বঃ
অবস্থানকালঃ
১৯ মার্চ ১৯৯৩ হতে ৮ জুলাই ১৯৯৪ সাল
অবস্থানঃ ১ বৎসর
৩ মাস ১৯ দিন
একদিন
সিলেটের আঞ্চলিক প্রধান আব্দুল মজিদ স্যার আমাকে তার কার্যালয়ে
ডেকে নিয়ে জিঞ্জেস করেন আমি কোথায় থাকি। উত্তরে দাউদপুরে থাকি
জানালে তিনি বললেন আমি আপনাকে একটু এদিকে নিয়ে
আসব। মজিদ স্যার খাঁটি শহুরে লোক, তার বাসা ছিল সুবিদবাজার।
সবাই বলত স্যার নাকি খুব গরম কিন্তু আমি স্যারের কেবল স্নেহমমতা পেয়েছি, কোন রাগ
দেখিনি। আব্দুল মজিদ স্যার
তার তিন সন্থানের বিয়েতে এই অধম সামান্য অফিসারকে চিটি দিয়ে আলাদাভাবে দাওয়াত
করেন।
অল্প
কিছুদিনের মধ্যেই আমার হাতে সিলেট শাখায় তাৎক্ষণিক
বদলির আদেশ আসে। মনে মনে খুশি হলাম এই ভেবে, যাক পথের দুরত্ব এখন খানিকটা কমে গেল।
সিলেটের বন্দর বাজারে ব্যাংকের নিজস্ব মালিকানাধীন পাঁচতলা
ভবনের নিচের আড়াইতলা সিলেট শাখা ও উপরের দুইতলা জুড়ে ছিল সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলার
আঞ্চলিক অফিস। আমি সহকারী মহাব্যবস্থাপক ইলিয়াস উদ্দিন আহমদের কাছে আমার যোগদান
পত্র পেশ করি।
ইলিয়াস স্যারের
বাড়ি কুলাউড়ার লংলা পরগনার বিজলি নামক গ্রামে। প্রথম দিনই আলাপে মনে হল স্যার মজার
লোক, বেশ রসে রঙ্গে কথা কন। ওজনহীন হালকা খাটো শরীরটা যেন ফুদিলে বাতাসে উড়ে যাবে।
তিনি তার চেম্বারে বসেন কম, সারাদিন অফিসারদের টেবিলে টেবিলে ঘুরে বেড়ান ও মজার
মজার কথামালার ফুলঝুরি বর্ষন করেন। তার
বেশিরভাগ গল্পই বানানো হলেও মনে হত সত্য, গল্পের ধরনটা ছিল এরকম- ‘ঘোড়ায় চড়িয়া
মর্দ হাটিয়া চলিল, ছয় মাসের পথ মর্দ ছয় দিনে গেল’। তিনি
পঞ্চাশ উদ্ধ একজন হাসিখুশি লোক। লোকের পিঠ চাপড়ে তিনি কাজ আদায় করে নিতেন। স্যারের
সান্নিধ্যে সিলেট শাখায় প্রথম মেয়াদের দিনগুলো বেশ আনন্দেই পার হয়। একদিন তার
মেহদিবাগের নতুন পাকাবাড়ি উদ্বোধনের ডিনার পার্টিতে যোগদান করি।
সিলেট শাখায়
আঞ্চলিক অফিসের বেতন, কয়েকটি গাড়ির খরছ, ক্লিয়ারিং ও ক্যাশ রিমিটেন্সসহ বাহিরের নানা
মাত্রাতিরিক্ত খরচের চাপ থাকায় এই শাখায় কখনও লাভ হতনা। সবসময় শাখাটি লস করলেও এই লসেরও
একটা লক্ষমাত্রা হেডঅফিস হতে নির্ধারন করে দেওয়া হত।
তখন
কম্পিউটার ছিলনা, হাতেকলমে সুদ হিসাব করে বের করা হত। ৩১শে ডিসেম্বর শাখার বাৎসরিক
হিসাব সমাপনীর পর দেখা গেল সামান্য টাকার জন্য লাভ/ক্ষতির লক্ষমাত্রা অর্জিত
হচ্ছেনা। ইলিয়াস স্যার বিভিন্ন লেজারের হাতেকরা সুদহিসাবের খাতা ডেকে নিয়ে
অনেকগুলো সঞ্চয়ী হিসাব হতে একটু একটু সুদ কমিয়ে দিয়ে লক্ষমাত্রায় পৌঁছে
যান।
আমি সামনের চেয়ারে
বসে প্রশ্ন করলাম, স্যার এভাবে সুদ গ্রাহককে কমিয়ে
দেওয়া কি ঠিক হচ্ছে? স্যার বললেন, কুরেশী সাহেব সুদতো এমনি হারাম, হারাম জিনিস কম
দিলে বরং আল্লাহ খুশি হবেন।
আমি আবার
বললাম গ্রাহক যদি বুঝে ফেলে তাহলে কি করবেন? তিনি উত্তর দেন, বলবো সুদ হিসাব করতে
আমাদের একটু ভূল হয়ে গেছে, সরি, আমরা এখনই আপনার সব সুদ
দিয়ে দিচ্ছি বলে সাথেসাথে পরিশোধ করে দেব।
কিন্ত আমি
পরে কোন গ্রাহকেই সুদ কম পাবার কোন অভিযোগ নিয়ে আসতে দেখিনি। আসলে কোন গ্রাহকই তা
টাহর করতে পারেনি। ইলিয়াস স্যারের একটা দোষ ছিল তিনি একটার পর একটা সিগারেট টানতেন। মাঝে
মাঝে চোখদুটিও ঈষৎ রক্তলাল দেখা যেত। কেউ কেউ বলত, তাঁর নাকি
সুরাপানের বাতিক রয়েছে।
অত্যন্ত
পরিতাপের বিষয় কিছুকাল পর সিলেটের অঞ্চলপ্রধান থাকাকালে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে
আকর্ষিক মৃত্যুবরণ করেন। ওসিয়ত অনুসারে তাকে জন্মভূমি
বিজলি গ্রামে তার পিতার কবরের পাশে দাফন করা হয়।
দশবার জন
কর্মীর মহিলা কলেজ শাখা ছিল ছোট একটি ছোট জলা, সেখান হতে
সিলেট শাখায় এসে মনে হল আমি একটি বড় পুকুরে পড়েছি। নতুন অফিসারদের সবধরনের কাজ
শেখার জন্য ছোট মহিলা কলেজ শাখাই বেশী উপযোগী, কারণ
ওখানে টেবিল বদল করে করে সব ধরনের কাজ করার ও শেখার
সুযোগ রয়েছে। প্রায় অর্ধশতাধিক কর্মীর সিলেট
শাখায় সেই সুযোগ সীমিত, এখানে যেজন যে টেবিলে কাজ করে সেই একই কাজ সারাদিন করেও
শেষ করতে পারেনা, তাই অন্যদিকে তাকানোর ফুরসৎ কারো নেই। এখানে
টেবিল বদল করে নবনব কাজ শেখার সুযোগ তেমনটি নেই।
এখানে
যোগদান করেই আমি লেজার পোস্টিং করতে যাই। তখন কম্পিঊটার ছিলনা। পনের বিশটি বড়বড়
লেজার একটার পর একটি সারিবদ্ধভাবে প্রায় ৫০ফুট দীর্ঘ টেবিলে সাজিয়ে রাখা ছিল। জাহাঙ্গির
এবং রিনা দিদি সারাদিন হেটে হেটে লেজার পোস্টিং করেন। জাহাঙ্গিরের
বাড়ি কুচাই শ্রীরামপুর। বি এ পাস করে তিনি দৈনিক সিলেটের ডাক পত্রিকায় কাজ করতেন।
ই এ চৌধুরীর বদন্যতায় জুনিয়র অফিসার হয়ে আসেন পূবালী ব্যাংকে। জাহাঙ্গির
খুবই ভাগ্যবান, তিনি লটারি জেতে পরে ওপি-ওয়ান
ভিসা পেয়ে যুক্তরাষ্টে চলে যান। জুনিয়র ক্লার্ক রিনা দিদি বিয়ানীবাজারের মেয়ে।
তিনি সপরিবারে জিন্দাবাজার শ্রী শ্রী গোবন্দজিউড় আখড়ায় বসবাস করতেন। স্বল্পভাষী
রিনা দিদির মনটা ছিল খুব ভাল। তিনি অনবরত নীরবে কাজ করে
যেতেন। আমরা তিনজন পোস্টিং, ডে বুক লিখা, লেজারচেকিং, প্রগ্রেসিভ এন্ট্রি, চেকবহি
ইস্যু ইত্যাদি কাজ করে ব্যস্ত দিন পার করতাম। মাস শেষে দুই তিনটা করে লেজার
বেলেন্সিং করতাম।
সিনিয়র
অফিসার সৈয়দ কামরান বখত মানবসম্পদ ও বিলস বিভাগের কাজ করতেন। এখানে কাজের অতিরিক্ত
চাপ থাকায় আমাকে পরে তার সাথে সংযুক্ত করে দেওয়া হয়। কামরান ভাইয়ের বাড়ি কুশিয়ারাপারের
শেরপুরে, যেখানে এসে সিলেট, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ এই তিন জেলার সীমানা মিশে গেছে।
কামরান ভাই পরে সপরিবারে ক্যানাডা চলে যান।
১৯৯৩ সালের
মে মাসে চৌধুরীবাজার শাখার ব্যবস্থাপক আব্দুল ওয়াহিদ বদলি হলে আমি কিছুদিন
চৌধুরীবাজার শাখায় অস্থায়ী ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব পালন করি। নুতন শাখা
চৌধুরীবাজার যেন ছোট একটা কুপ, মাত্র চল্লিশ পঞ্চাশটি ভাউচারের ক্লিনক্যাশ মিলাতে
হয়। কাজের তেমন কোন চাপ নেই, তাই আমার আজন্ম পরিচিত
বন্ধুজনদের সাথে গল্পগোজব করে বেশ আনন্দে সময় কেটে যেত।
ক্যাশে কাজ করতেন কুমিল্লার নিরীহ লোক আব্দুল বারি এবং লক্ষিপাশার সরল ও একগুয়ে
ক্যাশিয়ার কাম ক্লার্ক আব্দুল জলিল বাহিরের এক টেবিলে বসতেন। বিনয়ী গার্ড মইনুল হোসেনের
বাড়ি ছিল খালেরমুখ, তাছাড়া আর দুইজন ম্যাসেঞ্জার ও ক্লিনার কাজ করত।
তখন লেনদেন
সময় ছিল সকাল ৯টা হতে ১টা, বিকেল ৩/৪টা হবার আগেই সব কাজ খতম হয়ে যেত। আমার বাড়ির
দুরত্ব মাত্র পাঁচ-সাত মিনিটের রাস্থা, বাড়িতে গিয়ে
দুপুরের খাবার খেয়ে নামাজ পড়ে অফিসে ফিরতাম। ওয়াহিদ সাহেব আমাকে পরামর্শ দিলেন-
কুরেশী সাহেব, এই শাখায় আরাম আছে তাছাড়া আপনি এখানকার লোক, আপনি এইখানে স্থায়ী
ম্যানেজার হয়ে যান- আপনার ভাল হবে, সেইসাথে ব্যাংকেরও ভাল হবে।
ভাবলাম বেশতো, তাহলে বিগত দশ বছর ধরে আমি সিলেটমুখী পাগলা ঘোড়ার যে দৌড় দিচ্ছি,
তাহতে এবার রেহাই পাব।
একদিন সিলেট
আঞ্চলিক প্রধান আব্দুল মজিদও আমাকে বললেন আপনাকে এখানে পারমানেন্ট করার
চিন্তাভাবনা করছি। ভাবলাম শীঘ্রই এই শাখার স্থায়ী ব্যবস্থাপক হয়ে যাব।
কিন্তু মানুষ ভাবে এক, আর আল্লাহ ঘটান আরেক। একদিন হঠাৎ আমার অফিসে আসেন ব্যাংক
চেয়ারম্যান বড়ভাই জনাব ই এ চৌধুরী। তিনি বললেন ইসফাক,
তোমার বাড়িতে চাকুরি করা মনে হয় ঠিক হচ্ছেনা। সেইযুগে
এলাকায় আমাদের খুব মানসম্মান ছিল, তিনি হয়তো ভাবলেন সেখানে জনসাধারণেরর
সাথে আমার ঢলাঢলি ইগো সংকট তৈরি হতে পারে।
এই রাজদর্শনের দু’চার দিন পর আবার সিলেট শাখায় ফেরার
আদেশ আসে। বেশ কিছুদিন বাড়িতে আরামে কাটিয়ে
আবার আমি ফিরলাম আমার মুলক্যাম্প সিলেট শাখায়।
দরবস্ত
শাখার ব্যাবস্থাপক দাড়িওয়ালা সাইদুর রহমান ছুটিতে সাভার গেলে ৭ম জুলাই ১৯৯৩ সালে
আমি সেখানে রিলিভিং ম্যানেজারের দায়িত্ব পালনে গমন করি। একই ভবনের অর্ধেকাংশ শাখাঅফিস
ও বাকী অর্ধেক ম্যানেজারের বাসভবন। দুই
সাপ্তাহ এই বাসায় অবস্থান করি। সাইদুর
সাহেবের পত্নী হাসিখুশি ও খুবসুন্দরী। তাদের
একছেলে ও একমেয়ে নিয়ে ছিল এক সুখী সংসার। ভাবীর রান্না খাই, তিনি আমাকে খুব
আদরযত্ন করেন। বিদায়বেলা কিছু একটা করতে চাইলেও তাদের সীমাহীন বদন্যতায় আমি হেরে
যাই। সাইদুর ভাবীর কথা আমার সারাজীবন মনে থাকবে। জৈন্তার লোকজনের সরলতা আমাকে বেশ
মুগ্ধ করে। একদিন দরবস্তের এক হোটেলে দেখলাম
কিছু মুরব্বী বসে চা পান করছেন। আমরা যেমন
চায়ে বিস্কুট ভিজায়ে খাই তারা তেমনি জিলাপী চাকাপে ডুবায়ে পরম তৃপ্তির সাথে নাস্তা
করছেন। বিকেলের বিষন্ন বাতাসে পাশের তামাবিল রোডের সেতুর রেলিঙ্গে বসে উত্তরের
আকাশছোঁয়া মেঘপাহাড়ের রূপ দেখে সময় পার করতাম।
দরবস্ত হতে
আসার কিছুদিন পর ২৭ম জুলাই ১৯৯৩ সালে ভাদেশ্বর মোকামবাজার শাখায় যাবার নির্দেশ
আসে। ব্যবস্থাপক মামুন বখত স্যারের ছুটিতে রিলিভিং ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করতে
হবে। ভাদেশ্বর পশ্চিমভাগ মসজিদের দক্ষিণসীমায় উচু
টিলার উপর আমার বড় খালা আবেদা চৌধুরীর বাড়ি।
সাহেদ ও বড়খালা এই বাড়িতে থাকেন। আমি এই জনহীন বাড়ির মেহমান হলাম। বাড়িটির নীচ লেবেলে
পশ্চিমভাগ জামে মসজিদ, সিঁড়ি বেয়ে উঠে মাঝ লেবেলে বাংলো ও আবার
সিঁড়ি বেয়ে আর উপরে
উঠে মুলবাড়ির অবস্থান। বাড়ির
দুইঘরের আঙ্গিনায় বেশ মনকাড়া দুটি ফুল ও পাতাবাহারের বাগান।
বাড়িটির উত্তরে
ও দক্ষিণে নিচু টিলায় নির্মিত পাকাবাড়িগুলোর
টিনের চাল এই বাড়ির গ্রাউন্ড লেভেলের অনেক নিচে দেখা যায়। পিছনে ৪০/৫০ ফুট নিচে
বালুচোষা পরিস্কার পানিতে গোটা কয়েক লালপদ্ম বক্ষে ধারন করে আছে একটি নির্জন পুকুর। এইবাড়ি এককালের
ভাদেশ্বরের সবচেয়ে প্রতাপশালী জমিদার বাড়ি ছিল, যে বাড়ির লোকজন তাদের ভুমিসম্পদের
উপর দিয়ে হেটে সুদূর ফেছুগঞ্জ পর্যন্ত পৌছে যেতে পারতেন।
বাড়িটিতে
মানুষ মাত্র আড়াই ঘর। আমার বড়খালা, খালার জ্যা
মান্নুর আম্মা ও একজন স্নেহময়ী ফুফু। এই ফুফুকে আমি হাফ ধরলাম এই জন্য যে, বৃটিশ
আমলে একজন ম্যাজিষ্ট্রেটের সাথে তার বিয়ে হয়েছিল, কিন্তু ম্যাজিষ্ট্রেট মহোদয়ের
লম্বাদাড়ি তার পছন্দ হয়নি। এই দাড়ি নিয়ে
বিরাট সমস্যা তৈরি হল, একগুয়ে ম্যাজিষ্ট্রেট মহাশয় বউ
হারাতে রাজী কিন্তু দাড়ি হারাতে রাজী নন। শেষমেশ প্রতাপশালী বৃটিশ
ম্যাজিষ্ট্রেট তবিয়তে বহাল রাখলেন দাড়ি ও
পত্নী হারালেন। ফুফু এই যে ফিরলেন বাপের বাড়ি, আর কোনদিন পা রাখতে যাননি দাড়িওয়ালা
ম্যাজিষ্টেটের ঘরে। দ্বিতীয় বিয়েও করেননি, এখানে
পৈত্রিক ভিটায় কুমারী জীবন কাটিয়ে বুড়ো হয়ে আল্লাহর বাড়িতে পারি জমান। সামনের বড়
মসজিদে গায়কি সুন্দর গলায় সুমধুর সুরে কেরাতপাঠে নামাজ পড়াতেন একজন ইমাম। এখানে নামাজ
পড়তে বেশ স্বাধ পাওয়া যেত।
মোকামবাজার
শাখায় ব্যবস্থাপক মোঃ মামুন বখত সিনিয়র অফিসার কিন্ত
ক্যাশ ইনচার্জ ছিলেন তারচেয়ে পদে বড় একজন
প্রিন্সিপাল অফিসার, যিনি ছিলেন কানেখাটো বয়স্ক লোক। শাহজাহান নামে একজন বাঁচাল
ক্যাশিয়ার ছিলেন যিনি অল্প বয়সে মারা যান।
আমার
ফুলবাড়ির ফুফুত বোন রুনু আপার বাসা দক্ষিণ ভাদেশ্বর,
সেখানেও যাওয়া হল। বিদায়ের দিন মামুন স্যার আমাকে একটি সার্ট উপহার দেন। শাখায়
একজন স্থানীয় গার্ড ছিলেন, যার যন্ত্রনায় অফিসের সবাই অতিষ্ঠ।
আমাকে সবাই অভিযোগ করলে সিলেট গিয়ে আমি বিষয়টি আঞ্চলিক অফিসের গোলাম মোস্তফা এস পি ও
স্যারের কানে দেই। তিনি এই গার্ডকে সাথে সাথে এই শাখা হতে বদলি করে দেন।
১৯৯৪ সালের
২৮ মার্চ আমি আস্থায়ীভাবে চন্দরপুর শাখায় গমন করি। সাতসকালে বের হয়ে পাহাড় লাইনের
বাসে প্রথমে ঢাকাদক্ষিণ যাই, সেখান হতে বাসে সোনামপুর গিয়ে
খেয়ানৌকায় কুশিয়ারা পার হলেই চন্দরপুর শাখা। কুশিয়ারার ওপারে লন্ডনি অধ্যুষিত
ভাটির ধনাট্য গ্রাম চন্দরপুর, কালারুয়া ও বাগিরঘাট, নদীপারের চন্দরপুর বাজারটা যেন
ছিল এই ভাটি অঞ্চলের রাজধানী।
এই শাখায়
কর্মরত আব্দুল আজিজ তালুকদার কিছুটা মানসিক রোগগ্রস্থ ছিলেন। ব্যাংকের কাজের কঠিন
চাপ তার সহ্য হতনা। কাজের চাপ অত্যাধিক হলেই তিনি কাস্টমার ও সহকর্মীদের
সাথে উৎপাত শুরু করতেন। তিনি মেডিকেল ছুটিতে থাকায় আমাকে সেখানে পাঠানো হয়।
এই শাখার
ব্যবস্থাপক গিয়াসউদ্দিন ছিলেন স্থানীয় লোক। একজন উত্তম
ভাবমূর্তির সম্মানী মানুষ হিসাবে এই এলাকায় তার বেশ নামডাক। এখানে
এই মর্যাদাবান ব্যবস্থাপক গিয়াসউদ্দিন স্যারের সাহ্নিধ্যে দুইমাস পার করে
১লা জুন ১৯৯৪ সালে আবার সিলেট শাখায় ফিরে আসি। এখানে এক কুরবানীর ঈদ পাই, ঈদের
ছুটির পর কয়েকদিন ধরে বেশকিছু বাড়ি হতে টিফিন ক্যারিয়ারে খাবার আসে। বার মাইল দুর
হতে দৌড়ানো অস্থায়ী কর্মকর্তা আমাকে গিয়াসউদ্দিন স্যার বদন্যতা দেখিয়ে প্রতিদিন
বেশ আগেই ছেড়ে দিতেন। গিয়াস স্যার দীর্ঘছুটিতে লন্ডন সফরে গেলে আমি ভারপ্রাপ্ত
ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করি। সে সময় ব্যাংকের পক্ষ হতে চন্দরপুর বাজার সংলগ্ন আল
এমদাদ উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজে ২০টি বৈদ্যুতিক পাখা একটি অনুষ্ঠান
করে কলেজের অধ্যক্ষা খালেদা খানমের হাতে তুলে দেই।
পরে জানতে পারি, এই সুন্দরী অধ্যক্ষা আমাদের নর্থইস্ট মেডিকেলের একজন পরিচালক ও
স্ত্রীরোগ বিশেষঞ্জ ডাঃ ইউসুফ গজনবীর জীবনসঙ্গিনী ও প্রখ্যাত সিবিল ইঞ্জিনিয়ার
মহিউদ্দিনের বোন। অতীব দুঃখের বিষয় চন্দরপুর গ্রামের এই
গুণবতী বিদুষী রমণী
অল্প বয়সে ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে একমাত্র কন্যা রেখে যুক্তরাষ্ট্রে শেষ নিঃশ্বাস
ত্যাগ করেন। চন্দরপুর হতে ফিরে এসে দুইমাসের অবস্থান ভাতার প্রচুর টাকা পাই যাহা
ডাবল বেতনে পরিণত হয়।
বিয়ের প্রায়
একবছর একমাস পর আমার অগ্রজ তাহমিদ চৌধুরী ১৯৯৪ সালের ৫ম ফেব্রুয়ারি
স্থায়ীভাবে লন্ডনে চলে যান। লন্ডনে চলে যাবার সময় হতে পরবর্তী কয়েকদিন ধরে আম্মা
এতই কান্নাকাটি ও অশান্তি করেন যে আমরা সবাই তাকে শান্ত করতে হিমহিস খেয়ে যাই।
মাঝে মধ্যে মাঝরাতে তাহাজ্জুদের নামাজে উঠেও কান্না জুড়ে দিতেন।
পুত্র তাহমিদ চৌধুরী প্রবাসী হবার শোক কাটিয়ে
উঠতে না উঠতে আর এক শোক আমার জননীকে আঘাত হানলো। ২৯ মে ১৯৯৪ সালে এদেশে
অবস্থানকারী তার দুইভাই সপরিবারে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। সহসা তার জমজমাট বাপের
বাড়ি একদম জনশুন্য বিরানভূমি হয়ে গেল।
আমার তখন
মনে হল, আমিও যদি বিদেশে চলে যাই তবে আম্মা কেঁদে কেঁদে
নির্ঘাত মারাই যাবেন। এদিকে আব্বারও অনেক বয়স হয়ে গেছে। ভাবলাম বিদেশে গিয়ে আমি
যতই সুখী হবার আশা করিনা কেন, শেষমেশ দেশ ছেড়ে গিয়ে হয়ত আমার ভাগ্য বদলাবে ঠিকই
কিন্তু মাবাবাকে চিরজন্মের জন্য হারাতে হবে। সেই তারূণ্যের
দিনে আমি ছোট চাকুরী নিয়ে দারুন হতাশার সাগরে সাঁতার কাটলেও মনে মনে
সিন্ধান্ত নিলাম, মাবাবা যতদিন আছেন আমি ততদিন দেশেই থাকব এবং আপাততঃ বিদেশে
স্থায়ী হবার আর কোন চেষ্টা করব না।
আমার
ছোটচাচি সায়রা খানম চৌধুরী ছিলেন মায়ের প্রতিরূপ। আমার জন্মকাল হতে তার অকৃত্রিম
স্নেহ মমতা পেয়ে আসি। তার বাপের বাড়ি ছিল বিয়ানীবাজারের কাছে পাহাড়ি গ্রাম
মাটিকাটায়। ছেলেবেলায় চাচির কাছে ঘুমাতাম, সাথে একটা হলুদ বিড়ালও ঘুমাত। কয়েকদিন
ধরে তিনি জ্বর ও মাথাব্যাথায় ভুগছিলেন। একদিন অফিস হতে বাড়ি ফিরে গিয়ে দেখি আমার
অতিপ্রিয় সহজ সরল ছোটচাচি সায়রা খানম তার
ঘরের চৌকিতে উত্তরশির হয়ে শুয়ে আছেন চিরনিদ্রায়। শোকাবহ দিনটি ছিল ২৭ মে
১৯৯৪ সাল।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন