শনিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

পুবালী ব্যাংক লিমিটেড, কদমতলী শাখা, সিলেটঃ

 

পুবালী ব্যাংক লিমিটেড, কদমতলী শাখা, সিলেটঃ

অবস্থান কালঃ ৯ জুলাই ১৯৯৪ হতে ১৫ আগষ্ট ১৯৯৫ সাল

অবস্থানঃ ১ বৎসর ১ মাস ৬ দিন

 

তখন পূবালী ব্যাংকের সিলেট ঞ্চলপ্রধান ছিলেন স্থুলদেহ ও টাকমাথা এম এ ওয়াদুদ। তিনি ৫ জুলাই ১৯৯৪ সালে আমাকে কদলতলী শাখায় বদলির আদেশ দেন। দুইদিন পর ৯ জুলাই আমি কদমতলী শাখায় যোগদান করি। বাড়ির আর কাছে চলে আসি। বাড়ি হতে বেরিয়ে চৌধুরীবাজারে বাসে চড়ে কদমতলীতে নেমেই অফিস। ফলে আমার অফিসে আসা যাওয়ার খরচ ও সময় অনেক কমে গেল।

তখন ব্যবস্থাপক ছিলেন আলাউদ্দিন, যিনি কানাইঘাট এলাকার লোক। স্যারের শ্বশুর আব্দুস সালাম এককালে ছিলেন জৈন্তার এমপি। মিরাবাজারে সিলেট তামাবিল রোডের পাশে শ্বশুরের টিনের পাকাবাসা দুই সমনদিক লাউয়াই গ্রামের তুফা ভাই ও আলাউদ্দিন স্যার ভাগ করে নেন। স্যার বাসার সামনে দুইটি দোকানও ভাড়া দেন। তুফা ভাই ও তার পত্নী দুজন আওয়ামী লিগের নেতা ও নেত্রী। তাদের একমাত্র পুত্রধন চমক নানা সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে লিপ্ত হলে একদিন র‍্যাব তাকে ধরে নিয়ে গুলী করে মেরে ফেলে। একসময় দুই সমনদিকের মধ্যে শ্বশুরের সম্পত্তি ভাগ হয়। সুদীর্ঘ্য টিনেরঘর ও উঠোন  দ্বিখন্ডিত করে উচু পাকা দেয়াল হিমালয়ের মত শিরতুলে দুই বোনের মধ্যে আড়াল তৈরি করে।

আলাউদ্দিন স্যার সবসময় কি একটা অস্থিরতায় ভুগতেন। হাতের দু আঙ্গুলের ফাঁকে সর্বদা জ্বলন্ত সিগারেট পুড়ে ছাই হত। অফিসে অবস্থান করতেন খুবই কম। সকালে ক্যাশ খোলে কিছুক্ষ অবস্থান করে বেরিয়ে যেতেন, ফিরতেন বিকেলে ক্যাশ উঠাতেস্বাক্ষর কার্ড স্যারের টেবিলের সন্নিকটে থাকায় আমি স্যারের অবর্তমানে তার চেয়ারে বসে চেক পাশ করতাম। লোকে অফিসে আলাউদ্দিন স্যারের তেমন দেখা পেতনা, ফলে তারা শাখার দ্বিতীয় প্রধান আমাকেই মনে করত শাখাব্যবস্থাপকআলাউদ্দিন স্যারের সাথে এগার মাস কাজ করি। চেইনস্মোকার আলাউদ্দিন স্যার পরবর্তীকালে হৃদরোগে আক্রান্ত হন। চিকিৎসার জন্য ভারতে গিয়ে ভয়ে ওপেন হার্ট সার্জারি না করে ফিরে আসেন ও সিলেট আঞ্চলিক অফিসে কর্মরত অবস্থার হার্ডএটাক হয়ে অকালে মারা যান।

এখানে ক্যাশে কাজ করতেন মোজাম্মেল চৌধুরী, তিনি কুচাই পশ্চিমভাগে বিয়ে করেন। আমরা সেই বিয়েতে যোগদান করি। পত্রিকায় নিমগ্ন হয়ে কাজ করতে গিয়ে তিনি প্রায়ই ভুল করতেন ও ভর্তুকি দিতেন। এখানে নিরাপত্তা প্রহরী হিসাবে আমাদের পশ্চিমের গ্রাম কনারচরের আনোয়ার হোসেনকে পাই, যিনি আমাদের এলাকার লোক ও হালকা চিকন ভালমানুষ ছিলেন। নিরাপত্তা প্রহরী মোহাম্মদ আলীর বাড়ি আমাদের পুর্বদিকে ঘাসিবনি গ্রামে। গলগণ্ড রোগের জন্য তার গলা বেশ মোঠা ছিল। আমার এলাকার এসব সহজ সরল ভালজনেরা আজ আর নেই তারা আমাকে খুব ভালবাসত ও বলত- আপনি আমাদের চৌধুরী, আপনি আমাদেরই লোক।

এসময় মালঞ্চ সেন্টারে একদিন গ্রাহক সমাবেশ হয়। সবশাখার গুরুত্বপূর্ণ চারপাঁচ শত গ্রাহক ও ব্যবসায়ী সমবেত হয়ে আলোচনা সভা ও ডিনারে মিলিত হন। এই সমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন আমাদের ব্যাংকের মান্যবর চেয়ারম্যান জনাব ই এ চৌধুরী।

১৯৯৫ সালের ১৯ মার্চ কদমতলী শাখার ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব নেন মিনহাজুল ইসলাম। দারু কর্মঠ ও ভদ্র মিনহাজ স্যারের সাথে ইতিপূর্বে সিলেট শাখায় আমার একসাথে কাজ করার অভিঞ্জতা ছিল। শান্ত মেজাজের মিনহাজ স্যারের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া। তিনি গৃহনির্মা তুলে বিবাড়িয়ায় বাড়ি তৈরি করেন। স্যার খুব নামাজী ও সৎ লোক। তিনি আমাকে বড় ভাইয়ের মত স্নেহ করতেন। তার সেকেন্ডম্যান হিসাবে বেশ আনন্দে ও শান্তিতে চাকুরী করে যাই। ১৫ আগষ্ট ১৯৯৫ সালে আমি চলে যাবার প্রক্ষালে শাখাটির নবসজ্জাকরন অনুষ্ঠান হয়। এই অনুষ্ঠানেরও উদ্বোধন করেন ব্যাংকের চেয়ারম্যান ই এ চৌধুরী ও পরিচালক শফি এ চৌধুরী।

এখানে থাকাকালে ৮ মার্চ ১৯৯৫ সালে গোয়াইনঘাট শাখায় ব্যবস্থাপক মকবুল হোসাইন ছুটিতে গেলে রিলিভিং ম্যানেজারের দায়িত্ব পালনে যাই। গোয়াইন নদীর তীরে উপজেলাবাজার গোয়াইনঘাট। একটি বড়দিঘির পারে উপজেলা অফিস, সরকারি হাসপাতাল, থানা ও সোনালী, পুবালী, গ্রামীন সহ বেশ কয়েকটি ব্যাংকের অবস্থান। রাতে ব্যাংকের ভিতরে এককক্ষে ঘুমাই। এখানে পাশের অফিসার্স ক্লাবে সন্ধ্যার পর জম্পেস আড্ডা জমত।  ক্যারম, টেবিল টেনিস ও তাস খেলায় মেতে উঠতেন সমবেত কর্মকর্তারা। এই ক্লাবে প্রায়ই সুদর্শন উপজেলা নির্বাহি অফিসার ও বিপুলবপু পুলিশের অফিসার ইন চার্জ উপস্থিত হতেন। পুলিশের ও সি সাহেবের পত্নী প্রায়ই ব্যাংকে এসে তার নিজ হিসাবে টাকা জমা রেখে বলতেন এই হিসাবের কোন তথ্য যেন আমার সাহেব ঘুনাক্ষরে না জানেন।

এই ক্লাবে এসে গোয়াইনঘাট উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডাঃ রাজুর সাথে আমার বেশ ভাব জমে উঠে। উত্তরে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের সুউচ্চ পাহাড়ের সারি। পাহাড়ী নদীটি বৃষ্টি হলে মুহুর্তেই দুকূল ছাপিয়ে সড়ক পর্যন্ত ডুবিয়ে দেয়। এইনদীটি চেঙ্গেরখাল নাম ধারন করে সিলেট শহরের পাশ দিয়ে এসে সুরমায় মিলিত হয়েছে। প্রায়ই তামাবিল রোডের সারিঘাট হয়ে আসা যাওয়া করতাম। তবে একবার ঐ রোডে বাস ধর্মঘট থাকায় আমি বিমানবন্দর গিয়ে নৌপথে গোয়াইনঘাট যাই। বেশ কয়েকজন যাত্রি বেশবড় একটি ইঞ্জিন নৌকায় বসে ছোট নদীটির দুইপারের নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখে দেখে গোয়াইনঘাটে পৌছে যাই।

গোয়াইনঘাট শাখায় অস্থায়ী ব্যবস্থাপক হিসাবে একমাস তেইশ দিন পার করি। ব্যবস্থাপক মকবুল হোসেন সাহেব দিলখোশ লোক, বাড়ি দশ মাইল পুর্বে দরবস্তে। গোয়াইনঘাটে তার খুব জনপ্রিয়তা। তিনি চলে যাবেন, তাই এখানকার নানা সভায় তার বিদায় সম্বর্ধণা অনুষ্ঠিত হয়। আমার মনে হল তিনি ব্যাংক ম্যানেজার না হয়ে বরং এই অঞ্চলের একজন ভাল গনেতাও হতে পারতেন। ৩০ মার্চ ১৯৯৫ সালে গোয়াইনঘাট ছেড়ে আবার কদমতলী ফিরে আসি।

এবার কদমতলী শাখার কিছু গ্রাহকের স্মৃতি বলবব্যাংক ভবনের মালিক ছিলেন কদমতলীর ফজল মিয়া। তিনি অতিবৃদ্ধ হওয়ায় ছেলে আহমদ ভাই সব দেখাশোনা করতেন। একদিন ফজল মিয়া মারাগেলে আমরা শাহজালাল সেতুর নিচে সুরমাপারে শাহ সামালালের মাজার পাশে দাফনে শরিক হই। আহমদ ভাইয়ের পাকা ওয়ালঘেরা বড় বাড়িটি শাহজালাল সেতুর দক্ষি সীমানায়। উঠোন জুড়ে ধানের বড়বড় পারা, গরুর সারি হেটে হেটে ধান মাড়াই করছে। মনে হল বাড়িটি যেন সিলেট শহরের ভিতরেই একটি গ্রাম্য খামার বাড়ি। একসাথে গ্রাম ও শহরের সব সুবিধাভোগী এইবাড়িতে অনেকবার দাওয়াত খাই।

ধীরগম্ভীর সুলেমান বখত বুদ্ধিমান ব্যবসায়ী, ব্যাংকের সন্নিকটে তার চারতলা বাসা। তিনি কথায় নীরব ও কর্মে সরব লোক। ন্যাপনেতা হামিদ মিয়া প্রায়ই ব্যাংকে আসতেন। তিনি ইটভাটার মালিক ও গনেতা। এই এলাকার সালিশ বিচারক, খানিক টেকোমাথা বেঁটেমোঠা হামিদ মিয়া কদমতলীর বৃক্ষতলার ব্রেঞ্চে বসলে চারপাশে লোকজন জমে যেত। কদমতলীর লোকজন বলত এই মানসম্মানি হামিদ মিয়া শৈশবে দীনহীন অবস্থা হতে কঠোর পরিশ্রম ও বুদ্ধিমত্তাবলে উন্নতির উচ্চ শিখরে উঠে এসেছেন। কদমতলীর বীর মুক্তিযোদ্ধা ও রাজনৈতিক নেতা এডভোকেট রফিক মিয়া। তিনি তেজস্বী ভাষণ দিয়ে এখানকার জনসভা সরগরম করতেন।

দুইচার জন ভেজাল লোকও আসতেন, তাদের একজন টায়ার ব্যবসায়ী চারখাইয়ের সো আ চৌধুরী। তারমধ্যে সর্বদা একটা বেপরোয়া গুন্ডামস্তান  স্বভাব বিরাজ করতদারুন অহংকারী দাম্ভিক এই লোকটি ধরাকে সরা জ্ঞান করতেনলোভী এই লোকটি নানা অপকর্ম ও খুন খারাবীর জন্য কারাবাসও করেন। তার লোকেরা প্রায়ই ব্যাংকে এসে অযথা ঝামেলা করত।

একদিন সো আ চৌধুরীর বাপকা বেটা আমাদের চাটগাইয়া ক্যাশিয়ার বিপ্লব বাবু, যিনি চট্টগ্রামি আঞ্চলিক টানে কথা বলতেন, তাকে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করে কাদিয়ে দেয়। ভেজাল লোকটা ব্যাংক হতে বেরিয়ে গেলে এই হিন্দু ক্যাশিয়ার বিপ্লব বাবু কেঁদে কেঁদে আমাকে বললেন, “খুরেশী স্যার, আইজ পইয্যন্ত খুনুজনে আরে খোনদিন বঘা বঘা বখে হতা ন খইয়ে”আমি তাকে সান্তনা দিয়ে বললাম কি আর করবেন দাদা, ব্যাংকে চাকুরি করতে হলে সব বিষই খেয়ে হজম করে নিতে হয়। 

আরেক জন আয়রন কাস্টমার ছিল নুরুলসলাম চৌধুরী টিকাদার, সে পে-অর্ডার ভাঙ্গাতে দুই টাকার রেভিনিউ স্ট্যাম্প দিতনা। এই দুই টাকা নিয়ে প্রায়ই ঝগড়া করত। এই দুইটাকা তার অফিসে লোক পাঠালেও দিতনা। সে কারের পিছনের সিটে বসত, ড্রাইভার নেমে দরজা খোলে দিলে তবে বড়লোকি কায়দায় নামত। কদমতলীর প্রবীণ লোকজন বলতেন, তারা তাকে বাসের হেলপার নুরা হিসাবে দেখেছেন। পরবর্তীকালে তার কেবল প্রমোশন হয়- হেলপার নূরা থেকে ড্রাইভার নুরুল, ড্রাইভার হতে গাড়ি মালিক নুরুল ইসলাম, গাড়ি মালিক হতে মালিক সমিতির নেতা নুরুল ইসলাম চৌধুরী। উপশহরে বাড়ি হল, দামি গাড়ি হল, নামের ল্যাজে চৌধুরী যুক্ত হল, তারপর টিকাদার, টিকাদার হতে সিলেট শহরের একজন কমিশনার পদপ্রার্থকিন্তু তার আচার আচর দেখে লোকে তার সম্পর্কে বলত- ‘কুত্তার লেজ সোজা হয়না ঘি দিয়া মইলে, ছোটলোক বড় হয়না টাকাকড়ি অইলে’

পাঠানপাড়ার খান সাহেবের পুলের মুখে প্লাম্বিং ও সেনেটারি সামগ্রীর ব্যবসা ‘খান এন্টারপ্রাইজ’, অতি ধার্মিক ও উদারমনা খান সাহেব ব্যাংকে  দামি আতর নিয়ে আসতেন ও সবার হাতে লাগিয়ে দিতেন। এই খুশবু বিলাতে বিলাতে একদিন চিরহাস্য খান সাহেব মরনব্যাধী ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। আমি ও মিনাহাজ স্যার মোটরসাইকেলে পাঠানপাড়া গিয়ে তাকে মূমূর্ষু অবস্থায় দেখে আসার কিছু দিনের মধ্যে তিনি স্রষ্টার সান্নিধ্যে চলে যান।

 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন