বিস্মৃত অক্ষরে একটি বিয়ের না বলা উপখ্যানঃ
যৌবনের পরশ
পাওয়ামাত্র মানুষের স্বপ্নরাজ্যে এসে আনাগুনা শুরু করে তার মানসী প্রতিমা দেবীর
সোনালি ছবি। সেই স্বপ্নদেবী হবেন স্মার্ট,
সাদাঙ্গিনী, দারুণ সুন্দরী ও ভাল মানবী। সেই ভাবনা
সবার মত আমাকেও আহরাত্র তাড়িয়ে বেড়াত। ২৯ জানুয়ারী ১৯৯৩
অগ্রজ তাহমিদ চৌধুরীর শুভ পরিণয়
সমাপ্ত হলে সিরিয়ালে আমার পালা আসে। আমাদের সিলেট অঞ্চলে সুন্দরী মেয়েদের ঠিকানা
হত প্রায়ই বিদেশে। অবশিষ্ট সুন্দরীরা চলে যেতেন ধনী ব্যবসায়ী ও ভাল চাকুরীজীবীদের
ঘরে। আমি বড় চাকুরীজীবী কিংবা ধনীর দুলাল কোনটাই নই। সিলেট শহরের সাত মাইল দূরের
দাউদপুর গ্রামে জমিজামা সহ বড়বাড়ি থাকলেও সিলেট শহরে কিছুই ছিলনা। সমাজসেবক আব্বা
সফিকুর রহমান চৌধুরী তেমন বৈষয়িক লোক ছিলেন না। টাকার পিছনে
ছুটাছুটি করা ছিল তার নীতিবিরুদ্ধ কাজ।
বিয়ের
বাজারে পুরুষ মানুষের সুন্দর চেহারা ও উচ্চ ডিগ্রির
তেমন কোন মূল্যবহন করেনা, যদিনা থাকে তার অর্থবল।
বংশ মর্যাদা তখনও কিছুটা মুল্যবহন করলেও এখানে একটু আধটু ছাড় দিয়ে সুবিধা নিতে
আমার পিতার ছিল নিদারুণ অনীহা। অগ্রজ তাহমিদ চৌধুরী লন্ডনে
চলে গেলে মায়ের মনোভাব বিবেচনা করে আমি দেশে থাকার এক
অলিখিত সিন্ধান্ত ইতিমধ্যে নিয়েই ফেলি। তখন মাবাবার
অনেক বয়স হয়ে গেছে। তাই তাদেরকে ফেলে রেখে বিদেশে চলে যেতে মন তেমন সম্মতি দিলনা।
গ্রামের
মানুষের কাছে এক হাসির গল্প শুনতাম, কোন এক গ্রামে হাবলূ নামক একজন হাবাগোবা বেকার
যুবক বসবাস করতেন। তাকে একপাশে ফেলে রেখে ভাইরা সবাই একে একে বিয়ে করে সংসারী হন।
প্রথা ভেঙ্গে সিরিয়াল ডিঙ্গায়ে অনুজরাও বিয়ের দিল্লিকা
লাড্ডুর স্বাধ নেয়।
লোকে বলল
হাবলু মিয়া, এটাত দারুণ অন্যায় যে
তোমাকে ফেলে রেখে তোমার ছোটরাও বিয়ে করে মজা লুটছে আর তুমি শুয়ে শুয়ে আঙ্গুল
চুষছো। হাবলু বলল, কি করব আমি, বড়রা যে আমার অন্তরের জ্বালা আদৌ বুঝতে চাইছেনা,
তারা আমাকে বিয়ের সুযোগ করে দিচ্ছেনা। এবার প্রতিবেশীরা
হাবলুকে কানে কানে কি এক উপদেশ দিয়ে বিদায় নিল।
পরদিন হাবলু
একটি বড় সিজর দিয়ে তার বিছানা ও চাদর মাঝামাঝি কেটে দ্বিখণ্ডিত করে ফেলে। বড়রা এসে
বললেন হাবলু তোমার মাথা কি পাগল হয়ে গেছে, তুমি এসব
কি করছ? হাবলু জবাব দিল আমি একা মানুষ, এত বড় বিছানা দিয়ে কি করব, আমার অর্ধেক
বিছানাতেই চলবে। এবার বড়রা ভাবলেন তবেরে আচ্ছা, কে বলে হাবলুর বুদ্ধিসুদ্ধি নেই,
এই হাবলুকে বোকা ভাবে কোন সে বোকায়। তারপরও সবাই ভাবে হাবলুর চাকুরী নেই, টাকা কড়ি
নেই, ওই হাবাটা বউ পালবে কেমনে? ঘনঘন বাচ্চা হলে তাদেরে টানবে কেডায়। আরেক দিন
দেখা গেল হাবলু করাত চালিয়ে পালং কেটে দ্বিখন্ডিত করে ফেলেছে। ঘরের লোকজন জড় হলে
হাবলু বলল এত বড় পালঙ্কের আমার দরকার নেই, এখানে এত বড় পালঙ্কে আমার একাএকা ঘুম
আসেনা, তাই কেটে দু টুকরো করে নিলাম। এবার অভিভাবকদের টনক নড়ল, সবাই ভাবলেন
তাড়াতাড়ি একটা বিহিত ব্যবস্থা করতে হবে, নইলে হাবলু মিয়া
হয়ত কুড়াল চালিয়ে এই ঘরটাই নাজানি কোনদিন কেটে দুই টুকরো করে ফেলবে।
অবশ্য হাবলু
মিয়ার মত এত দুঃসহ অবস্থার মুখোমুখী আমাকে হতে হয়নি। আমি সিরিয়াল লাইনে দাড়ান আছি,
সবার চেষ্টা তদ্বিরও চলছে। আমার অগ্রজের বিয়ের কিছুদিন পরই একজন অপরূপ সুন্দরী
বিশ্বনাথী লন্ডনী কনে দেখান আমার এক ভাবী, কনে তার বোনের ননদ। সদ্য বড়ভাইয়ের বিয়ের
ঝামেলা শেষে ক্লান্ত কারো মানসিক অবস্থা নেই আরেক বিয়ের ঝামেলায় জড়ানোর।
তাই সহজে হাতে পাওয়া এই সর্বাঙ্গ সুন্দরী বিদেশিনীর সাথে আমার আর জোড় রচনা হয়নি।
নিউইয়র্ক ও লন্ডনে অনেক আত্মীয় সুন্দরীরা আছেন, কেউ কেউ উপদেশ দেন ঘরে রত্নরেখে
বাইরে কেন কনে খুঁজবেন, এসবে ডুব দেন। সাত সমুদ্র তের নদী অপারের হার্ডসন নদে
কিংবা টেমসের জলে ঝাঁপ দেওয়ার উপদেশ বিতরন যত সহজ, আসলে বাস্থবতা তত সহজ নয়। আষাড়
শ্রাবনে যখন বন্যা নেমে চারপাশে থৈ থৈ করে ভাসান জল, অথচ তখন তৃষ্ণা মেঠাবার মত জল মেলেনা। আপনি
যেই নামলেন তো কনের খোঁজে অমনি বেহিসাব কনেভরা দুনিয়ায় কনের অকাল দুর্ভিক্ষ তৈরি
হয়ে যায়। তাইত ‘লালন মরল জল পিপাসায়, কাছে থাকতে নদী মেঘনা’।
এবার একজন
স্বেচ্ছাসেবী এসে সওয়াব পাবার আশায় আমার কনের খোঁজে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি মৌলানা
সফিকুল ইসলাম, তার বাড়ি রেঙ্গা মাদ্রাসার দেড়দুই মাইল পূর্বের এক অগাধ ভাটি গ্রাম
সাদতপুর। তিনি নিজের খরচে আমার কনের খোজে
গলদঘর্ম হন। কোনদিন টাকা দিলে নিতেন না, বলতেন দুইজন নরনারীর মধ্যে বিয়ে করিয়ে
দেওয়া খুব সওয়াবের কাজ, একাজে আল্লাহ খুব খুশি হন। আমি যদি টাকা নেই তাহলে সেই
সওয়াব আর থাকবেনা। আব্বার দারুন ভক্ত এই হুজুর মৌলভীবাজার শহরের কোন এক মসজিদে
ইমামতি করতেন। তার কনে খোঁজার উৎস মৌলভীবাজার। তিনি স্বপ্রনোদিত
হয়ে বর দেখাতে একবার এক লন্ডনি কনের বাবাকে নিয়ে আসেন। আমাদের বাড়ির সামনে এসে
গাড়িটি বাড়ির দিকে মুখ করামাত্র স্ট্রাট বন্ধ হয়ে যায়। কনের বাবা ধরে নিলেন এটা
অশুভ লক্ষন। তাই এখানেই নাটকের ইতি ঘটে। তার কনে খোঁজায় আস্থিরতা চলল। বেশ কয়েকজন
কনের অভিভাবক তিনি ধরে নিয়ে আসেন। আমাকে টেনে নিয়ে তিনি কিছু কনের দরবারে হাজির
করেন।
সফিক মৌলানা
বলতেন, আল্লাহর রাসুল(সঃ) বিয়ের ব্যাপারে মেয়ের বংশ মর্যাদা ও ধার্মিকতাকে প্রথমে
আমলে নিতে বলেছেন। মেয়ের রূপ ও অর্থকে তারপরে স্থান দিয়াছেন।
সফিক মৌলানা কনেদের মুল্য নির্ধারনে একটা
ডিজিটাল হিসাব পদ্ধতি আবিস্কার করেন। তিনি কনের বংশ মর্যাদায় ২০০, আমল খাসলত ২০০,
রূপ সৌন্দর্য ১০০, শিক্ষাদীক্ষা ১০০ ও আর্থিক অবস্থায়সহ অন্যান্য ১০০ নম্বর ধরে
তার তালিকায় থাকা কনেরা কে কোন বিষয়ে কত নম্বর পাবে, হিসাব করে বের করেন। এই
সর্বমোঠ ৭০০ নম্বরের মধ্যে যে কনেরা বেশি নম্বর
পাবেন তারা হবেন সেরা কনে। তিনি এই সুক্ষ পদ্ধতিতে হিসাব কষেকষে আমার জন্য
মৌলভীবাজার এলাকার বেশ কিছু ভাল নম্বর পাওয়া কনের সন্ধান নিয়ে আসেন। কিন্তু সমস্যা
হল অনেক ক্ষেত্রে হুজুরের চোখের আন্দাজে প্রদত্ত এই নম্বার আসলে কতটা সঠিকতা ও
বাস্তবতা উপহার দিবে তা আদৌ বলা যায়না। তবে পাগলা সফিক
মৌলানার এই হিসাব পদ্ধতিকে পরে আমি কনে নির্বাচনে
কাজে লাগাই।
মাওলানা
সফিকুল ইসলাম ছিলেন সে সময়ের এক অতি চিত্তাকর্ষক চরিত্র। কালো দাড়িগোফ ও আধা কাচাপাকা
চুলের মৌলানা সাহেব চোখে সুরমা দিতেন। তার
বিশ্বাস মুসা (আঃ) তুর পাহাড়ে আল্লাহর সাথে কথা
বলতে গেলে আল্লাহর নূরের তজল্লি পড়ে
ঐ পাহাড়টি পুড়ে যায়। এই পূড়ে যাওয়া
পাহাড়ের গুড়ো হচ্ছে সুরমা। তাই সুরমায়
চোখ ভাল হয়। তিনি বলতেন চোখে সুরমা লাগানো হল বেশ কয়েকজন নবির
সুন্নাত। পাকিস্তান আমলে তাঁর
ধারকাছের সব আলেমরা পাকিস্তানপন্থী হলেও তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর একজন সঙ্গিহারা
দলছুট ভক্তহুজুর। তিনি গর্বভরে বলতেন আমি আওয়ামী লিগের
আলেম, আমি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া হাতেগোনা গোটাকয় আলেমদের একজন। আমার কনে খোঁজা
অভিযানের তার সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলেও একাজে তার আন্তরিকতার কোন ঘাটতি ছিলনা। তার
মাথার মধ্যে কিছু একটা ঢুকে গেলে সব কাজ ফেলে রেখে তিনি
সেইকাজে লেগে যেতেন। তার চিন্তা ভাবনার সারাটা অংশ জুড়ে এই একই
চিন্তা সারাক্ষণ ঘুরপাক খেয়ে যেত।
তিনি মনে
করতেন রেঙ্গার বিখ্যাত চৌধুরী বংশের রক্তধারী ও এই অঞ্চলের
সর্বজনের পরম শ্রদ্ধাভাজন দলুমিয়া স্যারের ছেলের এই উপকার করে দিলে তিনি যেন দীন ও
দুনিয়ায় ধন্য হন। তিনি মসজিদের সানি ইমামের হাতে নামাজের দায়িত্ব সপে দিয়ে আমার
কনের খোঁজে দৌড়াতেন। ১৯৮৬ সালে এই
সফিক মৌলানাকে মোগলাবাজারে আমার ফুফুতো ভাই
স্বতন্ত্র সাংসদ প্রার্থী শফি চৌধুরীকে জেতাতে জনগণের
পায়ে ধরে ধরে ভোটভিক্ষা চাইতে দেখি। আসলে তিনি ছিলেন দাউদপুর চৌধুরী বংশের একজন
একনিষ্ট ভক্ত ও সমর্থক। বিগত বহুবছর ধরে ইমাম সফিকুল ইসলামের সাথে আমার কোন
যোগাযোগ নেই। তিনি আছেন, নাকি মারা গেছেন তাও জানিনা। মহান
আল্লাহ এই উদার নিঃস্বার্থ সত্যবাদী আলিফ সোজা মানুষটির মঙ্গল করুন। এই দুই নম্বরী
দুনিয়াকে বদলাতে হলে আজকের দিনে সফিক মৌলানার মত সৎ বিশ্বস্ত ও ভাল লোকজনের খুবই
প্রয়োজন।
কদমতলীর
ব্যবসায়ী আব্দুল আহাদ ভাই, তার বাড়ি মোমিনখলা। তিনি আমার আরেক হিতাকাংখী, তিনি
আমাকে তার এক সুন্দরী লন্ডনি ভাগ্নী
দেখান। কিন্তু আল্লাহ না মারলে জোড়, মক্কা থাকে বহুদূর। আহাদ ভাই একটু জামাতঘেষা।
একদিন জীবনবিমার একজন লোক আসেন। আহাদ ভাইকে
জামাতি লোক মনে করে তিনি তাকে দিয়ে বিমা করাতে জামাতে ইসলামের প্রশংসায় লিপ্ত হন।
আহাদ ভাইও বুঝতে পারেননি ইনি বিমার লোক। বিমা কর্মকর্তা তার পরিচয় দিয়ে তার সাথে
দেখা করার ঠিকানা চাওয়ামাত্র আহাদ ভাই উঠে দাড়ান ও বলেন আমার এখন সময় নেই, পরে
দেখা হবে বলে কোন ঠিকানা না দিয়েই বিমা দালালের খপ্পর হতে পালান। রড সিমেন্ট
ব্যবসায়ী আহাদ ভাই গল্পবাজ লোক। অতিরঞ্জনে তার গল্পগুলো হয়ে যেত ‘লাখে লাখে সৈন্য
মরে হাজারে হাজার,/ গুণিয়া
দেখা যায় বত্রিশ হাজার’।
একদা আমার
আত্মীয়ের আত্মীয় একজন ধনী ডাক্তারনীর একমাত্র সুন্দরী মেয়েকে বিয়ের প্রস্তাব
পাঠাই। কিছুদিন পর ঘটক আত্মীয় এসে আমাকে বললেন- ওহে
কুরেশী ভাই, এই মেয়েকে বিয়ে করলে তুমি নির্ঘাত বিপদে পড়বা। আমি
বললাম কেন? তিনি জবাব দেন, তুমি হয়ত জাননা এই মেয়ের সাজগুজে মাসে
যে অঙ্কের টাকা খরচ হয় তা তোমার পুবালী
ব্যাংকের সামান্য বেতনে সামাল দিতে পারবানা। তাই বিপদে ঝাঁপ না দিয়ে
ভাই, তুমি এক্ষুণি চুপেচুপে সরে পড়। তার কথায় মনে হল
এই কনে একজন আলালের ঘরের দুলালী। আমি ভাবলাম দিল্লিকা
লাড্ডু কেঊ খেয়ে পস্তায়, আবার কেউ না খেয়ে
পস্তায়। না হয় আমি না খেয়ে
পস্তানর দুসরা দলেই রইলাম।
ভাবলাম
ভদ্রলোকেরা বিয়েতো জীবনে একবারই করেন। এখানে বিজয়ী হলে সারাজীবনের জন্য মানুষ যেমন
ভাগ্যবান হয়, অনুরূপ হারলে সে আজীবনের
জন্য ভাগ্যহতের তালিকায় নাম লিখায়। এ যেন ভাগ্যের হারজিতের এক জুয়াখেলা। এখেলায়
নায়ক ও নায়িকা দুজনের একজন হারেতো অন্যজন জেতে। কিন্তু আমি ভাবলাম আমি হারবনা,
আবার জিততেও যাবনা। এই খেলার আমারা দুজনের খেলার রেজাল্ট হবে উইন উইন পজিশন। আমার
নায়িকা ও আমি এককভাবে হারজিতকে পাশ কাটিয়ে দুইজনই সমভাবে একত্রে জিতবো। এবার আমি
এই সমভাবে আমরা দুজন নায়ক নায়িকার বিজয়ী হওয়ার গল্প শুনাব।
আমি একদিন
ফুফুতো বোন সিরিয়া আপার বাসায় যাই। সেখানে
দোলাভাই হোসেন মিয়ার সাথে দেখা হলে তিনি বললেন, চাকুরিতো করতেছ এখন বিয়েটিয়ে নাকরে
আর কতদিন একাএকা থাকবায়। আমি প্রতিত্তরে বললাম কনে খোজে দেন, তাহলে বসে থাকতে
হবেনা। তিনি বললেন আমার হাতে একজন কনে আছেন তুমি অনুমতি দিলে দেখতে পারি। হোসেন
দোলাভাইয়ের বোনের নিকটাত্মীয় এই কনে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হতে সদ্য এম বি বি
এস পাশকরা একজন চিকিৎসক নুরজাহান বেগম চৌধুরী ওরফে শাহরিন। তিনি
বললেন আয়শা ক্লিনিকে গিয়ে আগে কনে দেখে এসে আমাকে জানাও তারপর আমি বিয়ের আলাপ দেব।
একদিন সিলেটের আয়শা ক্লিনিকে গিয়ে চিকিৎসক কনের টেবিলের সামনের চেয়ারে বসি এবং
কিছু কথাবার্তা বলে চলে আসি। মনে হল সহজ সরল নিরহংকার মহিলা। পোষাক পরিচ্ছদে একদম
সাধারণ। কথা বলেন মেপে মেপে, বুদ্ধিমত্তার
চেয়ে সততার ধার বেশী মনে হল। কনে ঘুনাক্ষরে বুঝতে পারলেন না একজন পানিপ্রার্থী
তাকে দেখে যাচ্ছে।
সেকালে
ডাক্তার ছিল সোনার হরিণ। আজকের মত তখন বেসরকারি মেডিকেল
কলেজ ছিলনা, ফলে ডাক্তার তখনও লোহার হরিণে পরিণত
হয়নি। এই আয়শা ক্লিনিকে চাকুরী করেন আমার মোগলাবাজার হাইস্কুলের ছাত্র গোপাল বাবু।
সে তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। গোপাল বলল, স্যার নুরজাহান ম্যাডামকে বিয়ে করলে আপনার
খুব ভাল হবে। সিলেট শাখায় আমার সহকর্মী গুরুজন
সাদেক আহমদ শিকদার ভাই কনের একই পাড়ার প্রতিবেশী। তিনি আমাকে এখানে মতামত
দিতে নানাভাবে বুঝাতে থাকেন। গোপাল বাবু ও সাদেক শিকদার ভাই এব্যাপারে
আমার সিন্ধান্ত গ্রহণে প্রভাবক হিসাবে কাজ করেন।
তখন আমার
হাতে নানা ডায়মেনশনের বেশ কয়েকজন কনের তালিকা ছিল। আমি
সফিক মৌলানার বর্ণিত অঙ্ক কষে
প্রত্যেক কনের কোর নির্ণয় করি। এই কনের কোর নির্ণয়
করতে গিয়ে ডাঃ নুরজাহান বেগম চৌধুরীর হিসাবে কনের বংশ মর্যাদায় ২০০তে ২০০, আমল
খাসলত ২০০তে ২০০, রূপ চেহারা ১০০তে ৫০, শিক্ষাদীক্ষা ১০০তে ৮০ ও আর্থিক অবস্থায়সহ
অন্যান্য ১০০তে ৮০ নম্বর ধরে মোঠ ৭০০ নম্বরে ৬১০ স্কোর আসে। আমার হাতের নাগালে
থাকা অন্য অতিসুন্দরী কনেদেরও এত স্কোর আসেনা। আমি আবেগকে কোন প্রশ্রয় দেইনি,
মুল্য দেইনি প্রেমের ভাবাবেগেরও। আমার ভাবনা ফুলের কেবল রূপ থাকলেই চলবেনা, খুসবুও
থাকতে হবে। বাস্তবের দাঁড়িপাল্লা দিয়ে
মেপে ওজন করে কেউ বিয়ে করে কিনা জানিনা, কিন্তু আমি কনের মুল্য চুলচেরা মেপে এক পা
এগুই তো তিন পা পিছাই, এমন করে করে
সুদীর্ঘ্য সময় পেরিয়ে কেমনে কেমনে যেন এখানে বিয়ের লতাকুঞ্জে জড়িয়ে যাই।
এযেন ছিল আমার স্রষ্টার লিখন, বিধির লিখন কে করে খন্ডন?
হোসেন আহমদ
চৌধুরী আমার ফুফুত বোন ফাবিয়া চৌধুরীর জীবনসঙ্গী। তিনি
সোনালী ব্যাংক কর্মকর্তা, তার বাসা খাদিম দাসপাড়া। ১৯৪৭ সালে
তিনি ভারত হতে হিজরত করে সিলেট আসেন এবং এখন হিজরত করে যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দা।
তিনি হলেন আমার অবৈতনিক ঘটক, নিজের খেয়ে করে যান শালার ঘটকালী। একদিন মামা শ্বশুর
সফিক চৌধুরীকে নিয়ে হোসেন দোলাভাই যান কনের বাসায়, ৪৬ কাজলশায়। কনের দুইভাই আব্বার
পাছুয়ে দেন সশ্রদ্ধ সালাম, বৃদ্ধ পিতার (আমার শ্বাশুর) প্রতি তাদের শ্রদ্ধা ও
আনুগত্য দেখে আব্বা মনে করলেন এই সুদর্শন
উচ্চশিক্ষিত দুই ভাইয়ের একমাত্র চিকিৎসক বোন নিশ্চয় তাদের প্রতিরূপ হবেন। বিনয়ী
কনে এসেও পরম ভক্তি ও শ্রদ্ধাভরে সালাম নিবেদন করেন। আব্বার মতামত হয়ে গেল সুদৃড় ও
অটল। কনেপক্ষ শীঘ্রই আকদ করার তাগদা দেন। পরদিন কদমতলী শাখায় আমার সামনে আসেন ছোট
সমনদিক বি এস সি ইঞ্জিনিয়ার আজিজ আহমদ চৌধুরী জুয়েল। তিনি ঢাকার তেজগাও শিল্প
এলাকায় অবস্থিত ফারুক কেমিক্যাল ইন্ডাষ্ট্রির মালিক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক। আমার
টেবিলের সামনের চেয়ারে বসে দুইচার কথা ভালমন্দ বলেই তিনি চলে যান।
কিছুদিন আগে
শেষরাতে স্বপ্নে দেখি আমি লন্ডনের এক মেডিকেল কলেজে পড়ছি। স্বপ্নের মধ্যেই মনে হল
আমিতো মেডিকেলে পড়ার সুযোগ পাবার মত এত মেধাবী ছাত্র নই। স্বপ্নের ঘুরে ভালভাবে
চেয়ে সত্যিই সুন্দর ভবনমালায় সাজানো একটি মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের ভিড়ে নিজেকে
একজন ছাত্রই দেখলাম। আকদ সমাপ্ত হলে মনে হল মহান আল্লাহর ইচ্ছায় আমার দেখা সেই
স্বপ্নটিই যেন একটু হেরফের হয়ে সত্যে পরিণত হয়েছে,
আমি না হলেও আমার অর্ধাঙ্গিনী সিলেট সরকারি
মেডিকেলের ছাত্রী ছিলেন। তাহলে নিশ্চয়ই এই বিয়ে পরম করুনাময়ের ইচ্ছারই এক শ্বাশত
প্রতিফলন ছাড়া আর কিছু নয়।
আমাদের
পক্ষে কোন তাড়া না থাকলেও কনেপক্ষের প্রবল চাপে ১৯ফেব্রুয়ারি
১৯৯৫ রোববার আকদ অনুষ্ঠিত হল।
এই বিয়ের কাবিন সাব্যস্থ হয় চার লক্ষ টাকা। আমার পশ্চিমবাড়ির চাচাত ভাই জহিরুল
ইসলাম চৌধুরী ওরফে রেজোয়ান ভাই হন আমার বিয়ের উকিল। আমার এজিন নিয়ে আব্বা সফিকুর
রহমান চৌধুরী তার ভাগনা আমার স্বাক্ষী এডভোকেট মাসিয়াত উল্লাহ চৌধুরীর কারে চলে
যান সিলেট শহরের ৪৬, কাজলশায়, কনের পিত্রালয়ে। কনে পক্ষের স্বাক্ষি হন আমার বড়
সমনদিক কবির আহমদ চৌধুরী ও আমার ফুফুত দোলাভাই হোসেন আহমদ চৌধুরী।
তখন রোববার
ছিল সাপ্তাহিক ছুটির দিন। আকদ অনুষ্ঠানের পর আমি
এক অবর্ণনীয় ভাবনার সাগরে ডুব সাঁতার দিলাম। আমি কি করলাম,
সঠিক করলাম নাকি অঠিক কিছু করে বসলাম? ভাবনার রাজ্যে তখন বিরাজ করছে এতএত
অল্পবয়স্কা অনিন্দ্যসুন্দরী তরুনী কনেদেরে হাতের তালু হতে ছুড়ে ফেলে দিয়ে কিনা
বেছে নিলাম আমার কাছাকাছি বয়সের একজন চিকিৎসক যুবতীকে।
সুতীব্র রূপের ঝলকানি এড়িয়ে বংশ, শিক্ষা ও সদগুণকে কবুল বলে বুকে জড়িয়ে আমি কি
তাহলে নিজেকে সেক্রিফাইস করলাম। মনে হল আমার মহাসম্মানিত জনক ও মহাগুনান্বিতা
জননীর শুভ ইচ্ছেকে বাস্তবে রুপায়িত করতে আমি যেন শেষবেলা নির্বাক হয়ে গেলাম। আমার
এত চিন্তিত বিবর্ণ চেহারা দেখে আকদের দুই এক দিন আগে
আম্মা বললেন সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে, আজকের মধ্যে হ্যাঁ অথবা না একটি আমাদেরকে বলে
দিতে হবে। কিন্তু এত দুশ্চিন্তার পরও আমি না বলতে পারলাম না। জাতীয় সংসদে প্রায়ই
হ্যাঁ জয়যুক্ত হবার মত আমার মনের সংসদে শেষ পর্যন্ত ‘হ্যাঁ’ ই জয়যুক্ত হল।
বিয়ের
শুভদিন নির্ধারণ হল ১৪মে ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দ রোজ
রবিবার। তখন রবিবার ছিল সাপ্তাহিক ছুটির দিন। গত পাঁচ বৎসর পূবালী ব্যাংকের জুনিয়র
অফিসারের চাকুরির সামান্য বেতন হতে ফোটা ফোটা করে কিছু
টাকা ভান্ডারে জমা হয়। বিয়ের খরচের জন্য এটা যথেষ্ট ছিলনা। লন্ডন
হতে বড়ভাই বিয়ের খরচের জন্য পাঠান ষাট হাজার টাকা। সেই সময়ের
জন্য একটা বড় অঙ্কই ছিল। তখন পঞ্চাশ হাজার টাকায় কনের ভাল সোনার সেট ক্রয়করা সম্ভব
হত।
বিয়ে দিনের
আগের সাপ্তাহ আমার খুব দুশ্চিন্তা ও
অস্থিরতায় অতিবাহিত হয়। বড়ভাই তাহমিদ চৌধুরী লন্ডনে ও মামাবাড়ির আত্মীয়রা সবাই
ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যাওয়ায় ঘনিষ্ট আত্মীয়স্বজন অনেকেই বিয়েতে নেই। তাদের
অনুপস্থিতি মনটাকে ভারাক্রান্ত করল। আমার বড়খালা আবেদা চৌধুরী জবা ও ছোটখালা
মরিয়মুন্নেছা আসেন। খালাত ভাই বুলবুল, তারেক ও সাহেদ আসেন। পাতারিয়া হতে হাসমতি ঝি
তার সমি, ছামিনা ও অকিলকে নিয়ে আসেন। মনেপড়ে আম্মার প্রিয় সুয়াই ঝিও এসেছিলেন।
বাড়ির
আঙ্গিনায় গাঁয়ে হলুদের স্টেইজ ও প্যান্ডেল তৈরি
হয়। বোন রেহা, সেহা, মান্না ছোটভাই নিশাত, ভাগ্নি পপি, পলি, চুন্নি, গিন্নি, লিজা
ভাগনা লবিদ, হুদহুদ, রুহুল, মুন্না, হুর সহ বাড়ির চাচাত ভাইবোন, ভাবী, বাড়ির
ভাতিজা ভাতিজি আত্মীয় প্রতিবেশী সবাই জমায়েত হন। ফুফুত ভাই বোনরাও অনেকে উপস্থিত
ছিলেন। গ্রামের লোকজন এলে বাদসন্ধ্যা বাড়ি লোকে লোকারণ্য হয়ে পড়ে। নাসরিন ভাবী, মিছবাহ ভাবী, ভাগ্নী পপি, চুন্নী, গীনি ভাতিজি হামিদা, জুবেদা, এমেলি, টুনি গাঁয়ে হলুদ পব শেষ করে দুইহাতে
মেহদি লাগিয়ে দেন। আমার তিন দোলাভাই লিয়াকত চৌধুরী,
আব্দুল কুদ্দুস চৌধুরী ও মুফতি মোঃ খালেদ সবকিছু দেখবাল করেন। ছোটভাই নিশাত অনুষ্ঠান
ভিডিও করা, প্যান্ডাল সাজান নিয়ে ব্যস্ত। আম্মা ও আব্বার উপর খুব কাজের চাপ পড়ে। ঘরের বাহিরে আঙ্গিনা ও
বাংলো জুড়ে জুনাকির মত জ্বলানিভা করা অজস্র রঙিন
মরিচ বাতির তীব্র আলোকসজ্জা বাড়ির সামনের বড় পুকুরপারে স্থাপিত সুন্দর বিয়ের গেট
“বিয়ে বাড়ি” পর্যন্ত এক অনাবিল আনন্দ ও উৎসবের পরিবেশ সৃষ্টি করে।
আত্মীয়স্বজনদের
অনেক গাড়ি ছিল, তাসত্বেও আর পনের ষোলটি কার ও মাইক্রোবাস ভাড়া করা হয়। একটি দামি
সুন্দর ঘিকালার টয়োটা কার শহর হতে কাচা ফুলদিয়ে বিয়ের অপুর্ব সাজে সাজিয়ে আনা হয়।
বাড়ির ড্রয়িংরূমে বিয়ের পাজামা পাঞ্জাবী ও শেরওয়ানী পরলাম। পাগড়ী সবাই ছুঁয়ে এনে
আমার মাথায় তুলে দেন। বরের আঁটানো
ধারাল স্পেশাল জুতাজোড়া খুব কষ্টকরে পরলাম। এবার আব্বা, আম্মা, খালা, ফুফু ও
মুরব্বীদেরকে পাছুয়ে সালাম দিয়ে বের হয়ে বিয়ের সাজান কারে আরোহন করি। বিয়ের কারের সামনের
সিটে বসেন দোলাভাই আব্দুল কুদ্দুস চৌধুরী ও পিছনে আমার সাথে বসেন পপি, চুন্নী ও
বোন মান্না। বাড়ির সামনে প্রায় ত্রিশ পয়ত্রিশটি
গাড়ির লম্বা লাইন রচিত হল। বরের কার সামনে রেখে যাত্রা আরম্ভ হয়। তাতিপাড়ার
কার্তিক পালের পুরো পরিবার সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলের লোক। তার বড়দাদা সঞ্জুদা কবি ও
দিদি মালতী পাল গায়িকা। কার্তিক পাল ভিডিও রেকর্ডিং কাজে দক্ষশিল্পীর মত কাজ করেন।
তিনি একটি মোটর সাইকেল চড়ে বরযাত্রার গাড়ি মিছিলের আগপিছে ছুটাছুটি করে বিয়ে
রেকর্ডিং করে যান। আমার বড়ভাইয়ের বিয়েও তিনি রেকর্ডিং করেছিলেন।
বিয়ের গাড়ির
মিছিলটি প্রথমে চৌধুরীবাজার পার হয়। দশবার
মিনিট পর যখন গাড়ির সারি মোগলাবাজার ত্রিমুখা পার হচ্ছিল, এমন সময় পিছনে কি এক
হট্টগোল শুরু হয় এবং সবকটি গাড়ি একসাথে থেমে যায়।
একজন বুড়ালোক বুজালিদা হাতে নিয়ে একটি মাক্রোবাসের গতিরোধ করে দাড়ায়। কোনারচরের
এই বেয়াদবটার ত্রিমুখায় একটি দোকান ছিল। সকালে আমাদের এই ভাড়া করা মাক্রোবাসটি
নাকি রাস্থায় দড়ি বাঁধা তার গরুকে ধাক্কা
মেরে আসে। এইসব বেতমিজের দল সড়কে গরু চরিয়ে অজস্র গাড়ি দুর্ঘটনা ঘটায়, যা অনেক
মানুষের মৃত্যু ও পঙ্গুত্বের কারণ হয়। দুষ্ট
বুড়োটা গণপিটুনি খেত, আব্বা তাকে বাঁচান। বিষয়টি আব্বা ফয়সালা করে দিলে বিশ পঁচিশ
মিনিট পর আবার সিলেট অভিমুখে আমাদের গাড়ি মিছিলের শুভযাত্রা শুরু হয়।
আমাদের
গন্তব্য সুবিদবাজার পল্লবী কমিউনিটি সেন্টার। গাড়ির লাইন সেন্টারের পার্কিং পূর্ণ
করে ফেলে। পার্কিংস্পেসে স্থান সংকুলান না হওয়ায়
কিছু গাড়ি বাহিরের রাস্থায় অবস্থান নেয়। তিনজন
সমনদিক ছাড়া আমার তেমন কোন ঘনিষ্ট শালা কিংবা শালিকা ছিলনা
যারা জ্বলাতন করবে। প্রথাপালনে কনেপক্ষের কিছু নরনারী, কিশোর কিশোরী লম্বা ফিতা
টেনে বিয়ের গেট ধরেন। নাইম, নাসিম, সুফিয়ান, সেলিম, হালিম, আনিকা ভাবী, লিয়াকত
দোলাভাই, কুদ্দুস দোলাভাই, হোসেন দোলাভাই, মাসিয়ত ভাই, বুলবুল ভাই, তসনু চাচা,
আজিজ ভাই, কেফায়ত ভাই, সেলিম ভাই ও ভাবীরা অনেক ঠেলাধাক্কা, বাকবিতণ্ডা ও রঙ
তামাশা করে, গেট ধরার ফিসবাবদ কিছু টাকা আদায় করে সবাই আমার হাতে ফিতা কাটার সিজর
তুলে দেন। ফিতা কাটতেই তসনু চাচা এসে আমাকে ধরে
ধীরে ধীরে বাঁপাশের বরের জন্য নির্ধারিত স্টেজে নিয়ে যান।
কার্তিক
বাবু তার রেকর্ডিংয়ের কাজ যথারীতি করে যান। পল্লবী সেন্টারের পুরুষ ও মহিলা হলরোম
অনেক ডাক্তার, ব্যাংকার ও আত্মীয় স্বজনে কানায় কানায় ভরে যায়। তখন ছিল প্রচন্ড
গরম, বরাসনে বসেই আমি চিকন জুতামুক্ত হই। কিছুক্ষণ পর মনে হল মুখে রুমাল ধরে রাখার
কোন দরকার নেই, তাই রুমালটি চুপে চুপে পকেটে পুরে নেই। গাত্রে বিয়ের মোগলযুগীয় অভিজাত পোষাক শেরওয়ানী ও শিরোপরে
সাদা পাগড়ীটা কেবল বহাল থাকে। গলে ঝুলে
সোনালী জরির মালা। ঘনিষ্ট শালা শালিকা না থাকায় বরমঞ্চে বসে কোন ধরনের রঙডং কিংবা
খুনটুসির জ্বালায় আমাকে পড়তে হয়নি। কেবল আনিকা ভাবী, জেসমিন ভাবী, নাটেশ্বরের
মোস্তফা ভাবী ও ডাঃ রেজা ভাবী এসে দুই চার কথা বলে চলে যান। রেবু আপা, বেবী
বোন, এনি বোন, মনাক্কা আপা, খুশনা বোন,
হুসনা আপা, লুকবা আপা, সালেহা আপা, আনোয়ারা আপাসহ কয়েকজন জ্যাঠালি এসে উকিঝুকি
মেরে লম্বাফর্সা, চিকন, মায়াবী চেহারার ঘন কালকেশী বরমিয়াকে দেখে সন্তুষ্টচিত্তে
চলে যান।
প্রথা পালনে
বরের জন্য সযতনে তৈরি করা হয় এক বিশেষ ধরনের খাবার, যাকে
সিলেটী ভাষায় বলে ‘সদরি’। আমার সামনে সদরি পরিবেশন করা হল। বড়বড়
ডিস জুড়ে সাজানো বেশ কয়েকটি আস্থ মোরগের রোস্ট
পোলাওয়ের উপর বসিয়ে দেওয়া হল। ডিসগুলোর চারপাশ জুড়ে চিপস, নারকেল, টমেটো,
গাজর, আলু ও ডিম শৈল্পিকভাবে কেটে দৃষ্টি নন্দন করে সাজিয়ে আনা হয়। বন্ধু নির্ঝর,
ভাগনা লবিদ, হুদহুদ, রুহুল, নুরুল, সাহেদ আমার সামনে সদরি খেতে ঠেলাঠেলি করে বসেন।
আস্ত মোরগের রোষ্টগুলো কেটে ছিড়ে সবার পাতে পড়ে।
ঐ দিনটা যেন
দ্রুত পার হয়, কখন যে বিকেল হয়ে আসে টের পাওয়া যায়নি। এবার বরকনে একত্রিত করার ডাক আসে। আমার
বোনরা বললেন সন্ধ্যার সাথে সাথে দাউদপুর চলে যেতে হবে। কয়েকজন
দুই পক্ষের আত্মীয় এসে আমাকে মহিলাহলে কনের মঞ্চে নিয়ে যান। এখানে
আমরা বর ও কনেকে ঘিরে আত্মীয়স্বজনের ভিড় জমে। প্রায় তিনমাস আগে ১৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৫
আকদ অনুষ্ঠান হলেও দুইচার বার ফোনালাপ ছাড়া আমি
কখনও কনের মুখোমুখি হইনি। অবাক ব্যাপার হল
তিনমাস আগে পত্নীর অধিকার পাওয়া একজন নারীর কাছে আমি এই প্রথম আসি, তার সাথে এটাই
আমার প্রথম দেখা সাক্ষাত।
কনের পাশে
তখন ছিলেন তার বাল্য বান্ধবী সুনামগঞ্জ সরকারি জেলা হাইস্কুলের
স্বনামধন্য প্রধানশিক্ষক মোহাম্মদ আলী স্যারের কন্যা সিলেট সরকারি মহিলা কলেজের শিক্ষিকা ফাহমিদা আক্তার দিবা।
প্রথমে বিয়ের লাল শাড়িপরা কনে আমার গলে মালা পরান, পরে
আসে আমার মালা পরানোর পালা। মালাবদলের পালা শেষ হলে আমরা পরস্পরকে মিষ্টিমুখ করাই।
এবার আত্মীয় মুরব্বিদের সালাম করার পালা আসে। সাদা ইস্ত্রিকরা পরিপাঠি প্যান্ট ও
সার্ট পরে আমার শ্বশুর এসে সামনে দাঁড়ান। তার দুচোখ ভেজা ছিল।
কারণ তিনি কোনদিন মেয়ে হতে বিচ্ছিন্ন হননি। পা ছুঁয়ে সালাম
করি, তসনু চাচা (আমার শ্বশুরের মামাতো ভাই, বাডি রনকেলী দিঘিরপার)
বললেন পা ছুতে হবেনা, মুখে আসসালামু আলাইকুম বললেই চলবে।
শ্বাশুড়িকে
পাছুয়ে সালাম করে দাড়ানোর পর তিনি আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, আমার একটিমাত্র
মেয়ে, তাকে আগে আল্লাহ পরে তোমার হাতে সপে দিলাম।
নিশ্চয়ই তুমি তার যথাযত মুল্য বুঝবে। তখন আমার
মনে হল তার এই মেয়েতো কোন কচি কিশোরী নন বরং একজন পরিপুর্ণ মানবী। তিনি
শহরের একজন স্বনামধন্য চিকিৎসক, বরং আমিই তার কাছে হয়ত নিজেকে তার
কাছে সপে দিয়েই প্রাণে বাঁচলাম। দরগা
মহল্লার সাজেদা খালা, রণকেলি দিঘিরপারের বড়খালা ও রাউতখাই চৌধুরীবাড়ির খালাকেও তখন সালাম করি। নতুন কনেও
আমার আম্মা, আব্বা, খালা, ফুফু ও মুরব্বিদেরকে জনে জনে সালাম করেন।
নববধু ডাঃ
নুরজাহান বেগম চৌধুরী শাহরিন ও আমি সন্ধ্যা নাগাদ পল্লবী সেন্টারের কনেমঞ্চ হতে
নেমে ধীরপদে হেটে হেটে সেন্টারের সামনে
এসে বিয়ের সাজানো কারে আরোহন করি। গাড়ি সিলেট শহর ঘুরে
শাহজালাল সেতু পার হয়ে দ্রুত ফেছুগঞ্জ রোড ধরে এগিয়ে যায়। মাত্র বারচৌদ্দ মিনিটের
মধ্যে দাউদপূর পূর্ব চৌধুরীবাড়িতে নির্মিত বিয়ের গেট পার হয়ে বাংলো ঘরের বামদিকে
এসে থামে। নববধু উঠানোর জন্য বাড়ির ভাবীরা ও গাঁয়ের মহিলারা এসে ভীড় করেন। আমার
মাতা ও খালারা সবাই এগিয়ে আসেন। বাড়ি ও গ্রামের বালবাচ্চাদের হট্টগোলের মধ্যে কনে
গাড়ি হতে নেমে অতি ধীর পদক্ষেপে অগ্রসর হন। আমাদের টিনের পাকা বড়ঘরের ড্রয়িং রোমে গিয়ে সুসজ্জিত
সোফাসেটে লাল ওড়নায় মুখডেকে লালশাড়ি ও সোনার অলঙ্কারে সুসজ্জিত নববধু নির্বাক হয়ে
নিরবে বসে থাকেন। সিলেটের অতি সন্নিকটে এই সবুজ নিরিবিলি পাড়াগায়ে এই প্রথম
শ্বশুড়বাড়িতে শহরের চিকিৎসক ডাঃ নুরজাহান বেগম চৌধুরী ওরফে শাহরিন তার পায়ের চিহ্ন
একে দিলেন।
এবার হাসমতি
ঝির মেয়ে শমি ও সামিনা একটি শূন্য চিঁলিমছি ও একটি বদনায় জল নিয়ে আসে। তারা
নববধুকে পা ধুয়ে বধুবরন করে । পা ধুয়া কালে কে যেন কনের হয়ে একমুঠো আধুলী টংটং শব্দে চিলিমছির জলে নিক্ষেপ করেন।
এটা নাকি পদধুয়ার পারিশ্রমিক। একটু পরে ছোট আপা মান্না দুইগ্লাস শরবত ও দুই কাঁপ
মিষ্টি এনে সামনের টেবিলে রাখেন। আমি শরবতে চুমুক দিয়ে কনের ঠুটে ডেলে দেই। নববধুও
তার গ্লাসে চুমুক দিয়ে আমার ঠোট ছুয়ান।
অনুরূপ দুজনের মিষ্টিও ভাগাভাগি করে খাওয়া হল। এখানে আবার কাচা ফুলের মালা বদল হল।
খুবদ্রুত বেশ রাত নেমে আসে। আমি নববধুকে নিয়ে পাশের ডাইনিং রোমে গিয়ে খাবার সেরে
নিলাম।
আমাদের
পাকাটিনের লম্বাঘরের মধ্যবর্তী কক্ষটি আমার বোনেরা বাসরকক্ষ রূপে অপূর্ব সাজে
সাজান। একটি বড় সেগুন কাটের পালংজুড়ে
ডাবল পুরু বিছানা পাতা ছিল। এই পালংটি এতবড় ছিল যে এখানে তিনজন লোক অনায়াসে ঘুমানো
যেত। তিনপাশে প্রচুর খালি জায়গা রেখে কক্ষের মাঝখানে পালঙ্কটি
বসানো ছিল। কাচাফুলে সাজানো পালঙ্কে গোলাপ ফুলের পাপড়ি ছিটানো ছিল। তখন ছিল
গ্রীষ্মকাল, সেই সাথে মশার উপদ্রপ। উপরের ছাদে ঝুলানো বৈদ্যুতিক পাখাটি ধীরলয়ে
ঘুরছিল। একটি নাইলনের মিহিসূতার রঙ্গীন মশারি পালংটিকে আবৃত করে রেখেছিল। মশারি
আবর্তন করে সাজিয়ে রাখা গোলাপ, রজনীগন্ধ্যা, বেলী, গন্ধরাজের পুস্পমালার সারি হতে সারাটা কক্ষে মধুর সুবাস
বইছিল। এই কক্ষে কয়েকটি চেয়ারযুক্ত একটি টেবিল, একটি ওয়াড্রব ও একটি আয়নাযুক্ত সাজ
টেবিল ছিল। বড় বাথরুমযুক্ত কক্ষটি এত প্রশস্থ যে এখানে যথেষ্ট হাঁটাহাঁটি করার
জায়গাও রয়েছে। রাত দশটায় দুইটি খালি গ্লাস ও এক গ্লাস ঠান্ডা পানি নিয়ে কক্ষে
ডুকেন আমার মুরব্বী সুয়াই ঝি।
‘তোমরা বসে
বসে গল্প কর’ বলে তিনি বেরিয়ে যান এবং দরজার বাহিরের দিকে খিল লাগিয়ে বন্ধ করে
দেন। তিনি বেরুবার পথ বন্ধ করে দিয়ে আমারা দুইজন অজানা অচেনা নর ও নারীকে জেলখানার
নির্জন প্রকোষ্টে নিক্ষেপ করে দেন।
রাত পেরিয়ে
ভোরের আজান শুনলাম। কিভাবে সেই চিরস্মরণীয় রাতটি হারিয়ে গেল জানিনা। পরদিন অনেক
বেলা করে ঘুম ভাঙল, ডাক্তারনী ঘুম হতে
উঠলেন খিকড়ানো এলোমেলো চুল নিয়ে যেন বহু বছরের ধকল সয়ে ফিরে এসেছেন। দুজন উঠে
নাস্তা করলাম, কিন্তু ঘুম আমাদেরকে ছাড়তে চায়না। দিনটা পেরুলো এক তন্দ্রাচ্ছন্ন
মাদকতার নেশায়।
পরদিন ১৬ মে
১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দ, মঙ্গলবার, শাহজালাল উপশহরের আধুনালুপ্ত গ্রীন কমিউনিটি
সেন্টারের আমাদের ওয়ালিমা অনুষ্টান হয়। পাশেই
আমার তালুই ইলিমুর রাজা চৌধুরীর বাসা। বিউটি পার্লারে
না পাঠিয়ে এই বাসায় কনে সাজাতে বসেন আমার ছোটবোন মান্না। বিউটি পার্লারের
পেশাদার কর্মীদের মত নিখুত করে কনে সাজানো সম্ভব হয়নি। রঙ ও ম্যাকআপ তেমন যুতসই
হয়নি। আমি কনেপক্ষের দেওয়া উপহার স্যুট কোট টাই জুতা পরে একটি কালো সানগ্লাস চোখে
দিয়ে এগারটা নাগাদ গ্রীন কমিউনিটি সেন্টারে আসি। কিছুলোককে কানের কাছে বলতে শুনলাম
দোলামিয়াকে দারুন স্মার্ট মনে হচ্ছে, যেন একদম অভিনেতা সালমান খান।
আমি কিনা সালমান খান, নিজের প্রশংসা শুনে আমি কিছুটা
ব্যংফোলা ফোলে গেলাম।
উপশহরের
কমিশনার সফিক ভাই, ফজলু দোলাভাই, জদিদ ভাই ও তালুই ইলিমুর রাজা চৌধুরী সব কাজে
কাছে থেকে সহায়তা করেন। অত্যাধিক কর্মব্যস্ত অফিসের কাজ সামাল দিয়ে বিকেলবেলায়
পূবালী ব্যাংক লিমিটেড, কদমতলী শাখার ব্যাবস্থাপক মিনহাজ স্যার আমার সব সহকর্মীদেরকে
নিয়ে উপস্থিত হন। তখন তিনচার ব্যাচের খাবার সমাধা হয়ে গেছে, তাই পড়ন্ত বেলায় এসে
তাদের ঠান্ডা খাবার খেতে হয়। অবশ্য পরে আরেকদিন আমি একটি হোটেলে তাদেরকে আলাদা করে
পার্টি দেই।
গ্রীন
কমিউনিটি সেন্টার হতে বেরিয়ে কনেপক্ষের একটি মাইক্রোবাসে সিলেট শহরে শ্বশুরের বাসা
৪৬, কাজলশায় চলে যাই। বাসার মাত্র দুইজন বাসিন্ধা আমার শ্বশুর এনাম উদ্দিন চৌধুরী
ও শ্বাশুড়ি মলিকা খাতুন। কনের খালাতো মোস্তফা ভাবী রান্নাবান্নাসহ সবকাজে আমার
বৃদ্ধা শ্বাশুড়িকে সহায়তা করে যান। আমার পত্নীকে শৈশবে লালন পালনে সহায়তাকারী
ছলফুরমা ঝি তার মেয়ে ছলফুকে নিয়ে এই বাসায় অবস্থান করেন।
যে দুই তিন দিন এই বাসায় অবস্থান করি তখন কনেপক্ষের আত্মীয় ফুফুত সেলিম ভাই ও ডাঃ
রেজা ভাই, খালাত কেফায়ত ভাই, তসনু চাচা, কবির ভাই ও জেসমিন ভাবী আসেন। আজিজ ভাই ও
আনিকা ভাবী রাতে একটি হোটেলে অবস্থান করে দিনে এখানে সময় কাটান।
দাউদপুর
ফিরে আসার পর সাতদিনের ছুটি গাঁয়ের সবুজ শ্যামল বাড়িতে মা, বাবা, ভাই বোন, ভাগনা
ভাগ্নী ও ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজন পরিবেষ্টিত হয়ে আনন্দ
উচ্ছেসের মধ্যে পার হয়। আমাদের বেশিদিন অলস বসে কাটানোর সুযোগ নেই। আমি ছুটলাম
আমার কর্মক্ষেত্র সিলেট শহরের পুবালী ব্যাংক লিমিটেড, কদমতলী শাখায় এবং ডাঃ
নুরজাহান চৌধুরী শহরে ফিরে এসে তার গাইনি রোগী
নিয়ে আবার ব্যস্ততার সাগরে সাঁতার দেন। একদিন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ ফরহাত মহল নব
বরবধুকে চাইনিজে দাওয়াত করেন। ফরহাত মহল আপার স্বামী তারেক দোলাভাই, তাদের দুই
ছেলে ও এক মেয়ে, ডাঃ মাহবুব, ডাঃ হাবিব ও চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ শামিমা আক্তার এই
চাইনিজ পার্টিতে উপস্থিত ছিলেন। ডাঃ হাবিব বিসিএস পাস করে সরকারি
চাকুরীতে যোগ দেন, বিশেষজ্ঞ হন। দুঃখের বিষয় তিনি অল্প বয়সে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া
বন্ধ হয়ে মারা যান। ডাঃ মাহবুব কিডনি ডায়লাইসিস করে বেঁচে আছেন।
তারপর নব
বরবধূকে দাওয়াত খাওয়ানোর ধুম লেগে যায়। দাওয়াত খেতে ছুটলাম
রেবু আপা, লুকবা আপা, হুসনা আপা, ডাঃ আহমেদুর রেজা ভাই,
সাজেদা খালা প্রমুখের বাসায়। আমার শ্বাশুড়ির চাচাত বোন
সাজেদা খালার দরগার বাসায় দাওয়াত খেতে গিয়ে আমার আব্বা সফিক চৌধুরী পেয়ে যান তার
পুরানো দিনের ১৯৩৭-১৯৪১ সালের এমসি কলেজের সহপাঠি ঢাকাদক্ষিন কানিশাইল গ্রামের
আব্দুর রহমান চৌধুরীকে, যিনি সাজেদা খালার জীবনসাথী। বহুবছর পর বৃদ্ধ বয়সে
দুইবন্ধু আবার অতীতের স্মৃতিচারনে নিমগ্ন হন।
নাটেশ্বর
গ্রামে খালাত মোস্তফা ভাইয়ের বাড়িতে যাবার আমন্ত্রন পেলাম। এবারও গেলাম সপরিবারে
আমার জনক ও জননীকে নিয়ে। সাচান গ্রাম হতে দুইমাইল পূর্বে এই জনপদেরও একপাশে সিলেট
জকিগঞ্জ সড়ক ও অন্যপাশে সুরমানদী বয়ে যাচ্ছে। বিকেলে সুরমা নদীতে নৌভ্রমনে বের
হলাম। খোলা নৌকাটি নদীর পারঘেষে চালিয়ে দেড়দুই মাইল দূরের গাছবাড়ি বাজারে নিয়ে
গেল। জীবনে এই প্রথম ঘরের পাশের জনপদ কানাইঘাটের মাটিতে পা রাখলাম। গাছবাড়ি
বাজারঘাটে পারেখে মনে হল আমি যেন এক বোরকা ও টুপির দেশে নামলাম। নদীর এপারে
মহিলাদের পরনে সবুজ শাড়ি ও ওপারে কেবল কালো বোরকার ছড়াছড়ি। ছোট ছোট বালিকাসহ
জোয়ানবুড়ো সবনারীই এখানে আপাদমস্তক কালো বোরকার ভিতর লুকিয়ে হাঁটাহাঁটি দৌড়াদৌড়ি
করছেন। বাজারে অবস্থিত গাছবাড়ী মাদ্রাসা মসজিদে আমরা আসরের নামাজ আদায় করে নৌপথে
ফিরে আসি। মোস্তফা ও মর্তোজা ভাইয়ের বাবা ছিলেন এই গ্রামের এককালের সম্পদশালী লোক
কিন্তু এখন তাদের সেই রমরমা অবস্থা নেই।
আমার বিয়ের
পর সবচেয়ে আন্তরিক ও ঘনিষ্ঠ একজন আত্মীয় লাভ করি। তিনি আমার
শ্বশুরের আপন মামাতো ভাই তসনু চাচা। অতি হাসিখুশি তসনুচাচার মেয়ে রুমা তখন সিলেট
ওসমানি মেডিকেল কলেজের ছাত্রি। মেয়েকে
পড়াতে গিয়ে সপরিবারে কাজলশাহ এলাকায় বাসাভাড়া করে একই পাড়ায় বসবাস করতেন। রুমা
মেধাবী ছাত্রি, সে ময়মনসিংহ মহিলা ক্যাডেট কলেজ হতে এস এস সি এবং এইচ এস সি পাশ
করে সিলেট মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়। খেলাধুলায় স্কলার রুমার কক্ষজুড়ে সাজানো আছে
ক্যাডেট কলেজ জীবনে অর্জন করা অগুনতি ক্রেষ্ট ও মেডেল।
১৯৮৩ সালে
এম সি কলেজ মাঠপারের রাস্থায় সিরিয়া আপার কারের স্টিয়ারিং ধরে খানিকটা গাড়ি চালানো
চেষ্টা করলেও ড্রাইভার হতে পারিনি। ড্রাইভার হতে হলে দীর্ঘদিন গাড়ি চালানোর
প্রয়োজন হয়। তসনু চাচা আমাকে নুতন করে গাড়ি চালানো শেখান। আমাদের সাদা টয়োটা কারটি
চালাতো আমার ছোটভাই নিশাত। এই কারটি
দাউদপুরের বাড়ি হতে কাজলশাহ নিয়ে আসি। তসনু চাচা আমাকে নিয়ে যান সিলেট মেডিকেল
কলেজের মাঠে। গাড়ি চালানোর খানিক পুর্ব
অভিজ্ঞতা থাকায় অল্প কয়েকদিনেই গাড়ি চালান রপ্ত করে ফেলি। গাড়ি চালানো প্রথম দিকে
পাহাড়সম কঠিন মনে হলেও কিছুদিনের মধ্যে জলবৎ তরলং হয়ে যায়।
এবার তসনু
চাচা আমাকে তার গ্রামের রনকেলী দিঘিরপারের
বাড়িতে নিয়ে যেতে অধীর হয়ে উঠেন। শ্বশুরেরও খুব আগ্রহ, কারণ
তিনি এই নানাবাড়িতে অবস্থান করে বাল্যকালে গোলাপগঞ্জ এম সি
একাডেমিতে লেখাপড়া করেন। তাই মামাতো
ভাইদের সাথে তার সম্পর্ক অনেকটা আপন ভাইয়ের মত সুদৃঢ়। একদিন সুযোগ হল,
সেদিন আমার শ্বশুরের মামাতো
ভাই মেজর জেনারেল শফি আহমদ চৌধুরী রনকেলী আসেন। ১৯৮০ সালে এরশাদের ক্ষমতা দখলকালে
তিনি ছিলেন বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষীবাহিনী বিডিয়ার প্রধান। এই সময় তার অন্য
ভাইদের মধ্যে তজন চাচা ছিলেন জয়েন সেক্রেটারি,
টিয়া চাচা মেজর, মনুচাচা বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর উপপ্রধান, রসুচাচা পুলিশের এস পি
এবং ফজন চাচা ব্যবসায়ী। এখন অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল শফি চাচা প্রায়ই ঢাকা হতে রনকেলী
আসতেন। তার ছিল বরশী দিয়ে মাছ ধরার তীব্রনেশা।
অপুর্ব সুন্দর তিনস্থরের টিলা বাড়ির সামনে চার একর জায়গা জুড়ে
রনকেলী দিঘি, তিনি একটি চেয়ারে বসে একমনে এই দিঘির
জলে বরশী ফেলে মাছধরে সময় কাটাতেন ও দিঘিপারের
মসজিদে নামাজ পড়তেন।
কোন এক
ছুটির দিনে শ্বশুর শ্বাশুরি ও তসনু চাচাকে
নিয়ে আমার সাদা কার ড্রাইভ করে আমরা শ্বশুরের নানাবাড়ি রনকেলী দিঘিরপারে
যাই। খাবারের আয়োজন হল এস পি রসুচাচার পুত্র উজ্জলের বাগানঘেরা সুন্দর বাংলোয়। এই
চাচারা আমাকে এতই স্নেহ ও সম্মান করলেন যে মনে হল আমি তাদের আপন ভাগ্নীপতি। আমার
জীবনে এমন ঘটনা দেখেছি যেখানে আমার সম্মান পাবার কথা সেখানে পাইনি, আবার যেখানে
সম্মানের তেমন আশা করিনি, সেখানে সবার কাছে প্রচুর সম্মান
পেয়ে মুল্যায়িত হয়েছি।
এই রনকেলী
দিঘিপারের অন্যটিলায়
আমার বড় খালা শ্বাশুড়ির বাড়ি। একমাত্র খালাত ভাই সোফন
চৌধুরী লন্ডনে অবস্থান করেন। তিনি দেশে এলে
খালাতো বোন সেবু আপা ও বেবি
বোন আমাদেরকে দাওয়াত দেন। বড় গরু জবাই করে শিরনি করা
হয়। আমার বড় খালা শ্বাশুড়ি আমাদেরকে তার বারমাস ফলা কাটাল গাছের পাকা কাটাল ও রান্নার তরকারীর জন্য
কাচা কাটাল (ঘাটি) সর্বদা আমাদের গাড়ির বেনেটে তুলে দিতেন,
যদিও তখন কাটালের মৌসুম ছিলনা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন