আমার নতুন কর্মক্ষেত্র পুবালী ব্যাংক লিমিটেড, আঞ্চলিক অফিস সিলেট ইস্টঃ
যোগদানঃ ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৪
বিদায়ঃ ২৫ জানুয়ারি ২০১৫ অবস্থানঃ ১১ মাস ৭ দিন
ব্যাংকের শাখা অফিসে সারাজীবন
কাজ করলেও আমি কোনদিন আঞ্চলিক অফিসে কাজ করিনি। সুব্যবস্থাপনা প্রতিষ্টার জন্য কিছুদিন
আগে প্রায় অর্ধশত শাখা নিয়ে ঘটিত সিলেট-সুনামগঞ্জ আঞ্চলিক অফিস ভেঙ্গে সিলেট ইস্ট
এবং সিলেট ওয়েস্ট এই দুই অফিসে বিভক্ত করা হয়। বৃহত্তর সিলেট বিভাগে ব্যাংকের কাজ
গতিশীল করার জন্য সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ এই চার জেলাকে একজন
মহাব্যবস্থাপকের অধীনে একত্রিত করে সিলেট প্রিন্সিপাল অফিস প্রতিষ্টা করা হয়। পুবালী
ব্যাংকের সিলেটের প্রথম বিভাগীয় প্রধান হবার ঐতিহাসিক গৌরব অর্জন করেন আমার
পরবর্তীকালের মাননীয় সুযোগ্য বস আবু হাবিব খায়রুল কবির।
সিলেটের আওয়ামী লিগ নেতা ইফতেখার
হোসেন শামিম ওরফে চাক্কা শামিম আমাদের ব্যাংক হতে কয়েক কোটি টাকা ঋন নিয়ে শেখঘাটের
ডাঃ হাসি রানির বাড়িতে সংযুক্ত তিনটি টাওয়ার বিশিষ্ট বিশাল আটাশ তলা সিলভ্যালী
ক্যাসেল নির্মান করেন। ইফতেখার হোসেন শামিম সিলেট-ঢাকা মহাসড়কে এক গাড়ি দুর্ঘটনায়
হঠাৎ নিহত হলে তার এই হাউজিং ব্যবসা স্থবির হয়ে পড়ে। শামিম সাহেবের অকাল মৃত্যুতে
ব্যাংকের টাকা আদায় কঠিন হয়ে যায়। ব্যাংক তার পাওনা আদায়ে নেহায়েত বাধ্য হয়ে এই
ভবনের বামপাশের টাওয়ারে কয়েক হাজার বর্গফুট জায়গা কিনে নিয়ে কয়েক কোটি টাকার ঋন হ্রাস
করে। ইতিপূর্বে পূবালী ব্যাংকের সিলেট আঞ্চলিক অফিস ও সিলেট শাখা বন্দরবাজারে
ব্যাংকের নিজস্ব ভবনে ছিল। সেখান থেকে চারটি অফিস শেখঘাটে সিলভ্যালি টাওয়ারে
স্থানান্তরিত হল। নিচতলায় সিলেট শাখা এবং উপরের বিশাল এরিয়ার উত্তরপ্রান্তে
আঞ্চলিক অফিস সিলেট ইস্ট, মধ্যভাগে সিলেট প্রিন্সিপাল অফিস এবং দক্ষিনাংশে আঞ্চলিক
অফিস সিলেট ওয়েস্ট স্থাপিত হয়।
বন্দরবাজারের সাবেক পাচতলা ভবনে
নতুন বন্দরবাজার শাখা, গোদাম, ট্রেইনিং সেন্টার, পাঠাগার ও একটি ক্ষুদে রেস্ট হাউস
স্থাপন করা হয়।
আমি যোগদান করি সদ্য স্থাপিত
আঞ্চলিক অফিস সিলেট ইস্টে। বৃহত্তর সিলেট-সুনামগঞ্জের যে আঞ্চলিক প্রধান
উপমহাব্যবস্থাপক দীলিপ কুমার পাল বরইকান্দি শাখা হতে আমাকে সিলেট আঞ্চলিক অফিসে
নিয়ে আসেন কিন্তু তাকে বদলি হয়ে এসে আমি পাইনি। তিনি তখন সদ্য স্থাপিত
আঞ্চলিক অফিস সিলেট ওয়েস্টের প্রধানের দায়িত্বে ছিলেন।
দিনটি ছিল ২০১৪ সালের ২৪ জানুয়ারি। কুয়াশাঝরা ভোরে জেফার ও আমি তারাপুর চাবাগানে প্রাতঃভ্রমন করি। সেই
সকালে কুয়াশার জলে স্নাত হয়ে বাগানের পুষ্প পল্লব সতেজ ও উজ্জল হয়ে ওঠে। বাগানের অজস্র
কফিগাছের হাস্যমান সাদা ফুল দারুন লাগছিল।
সেই শীতার্ত সকালে ১০টা হবার আগে
বেশ আনন্দচিত্তে গিয়ে হাজির হই নবঘটিত সিলেট আঞ্চলিক অফিস- সিলেট ইস্টে। আড়াইতলা
উপরে বিশাল ফ্লোরজুড়ে কাচদিয়ে বিভক্ত ঝকঝকে তকতকে তিনটি অফিসের এক সুন্দর সম্মিলন।
প্রথম অফিসটিই আঞ্চলিক অফিস- সিলেট ইস্ট, যেটি আমার নতুন কার্যালয়। আমার গতকল্যের বরইকান্দি
অফিসের তুলনায় বেশ কাছেই শেখঘাট মাদ্রাসার সামনে এই ফিটফাট অফিসের অবস্থান।
সিলেট ইস্টের অঞ্চল প্রধান ছিলেন
তাতিপাড়ার এ এস সিরাজুল হক চৌধুরী। সেইদিন চেম্বারে ঢুকে
তাকে একটা সালাম দিয়ে আমি যোগদান পত্র দাখিল করি। সিলেট ওয়েস্টে এজিএম চেম্বার
আছে, কিন্তু ইস্টে অঞ্চলপ্রধান ছাড়া আর কোন চেম্বার নেই। আমি অফিসের সামনে স্থাপিত
একটি খোলা বড় টেবিলে আসন পাতলাম। সামনে একটি কম্পিউটার ও ফোন সেট পেলাম। আমার ডানপাশে
পেলাম একজন দিলখোলা ভাল মানুষকে, তিনি জকিগঞ্জের সন্থান মোহাম্মদ সিরাজ উদ্দিন সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার। তিনি তার
ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সব সুখ দুঃখের গল্প আমাকে শোনাতেন। আহারে, অন্তরে ভীষণ ব্যথা হয় যখন ভাবি আমার এই বন্ধু সহকর্মীর একমাত্র
পুত্রটি অটিস্টিক, আমি তাকে সান্তনা দিতাম।
বামপাশে ছিলেন সুদক্ষ ব্যাংক
অফিসার সমবারু চন্দ্র মোহন্ত এসপিও। তিনি রংপুরের লোক, কালো চিকন কিন্তু হাসিঝরা
মায়াবী চেহারা তার। তিনি শোনাতেন তার একমাত্র কন্যাটির গল্প যে মায়ের সাথে ঢাকায়
থাকে, বেবীস্বুলে পড়ে। ঢাকায় একজন সহকারী মহাব্যবস্থাপকের অন্যায় আচরনের সরব প্রতিবাদ
করার অপরাধে তিনি শাস্তিস্বরূপ সিলেটে বদলি হন এবং সেইবার তিনি পদোন্নতি
হারান। আমি এই মানুষটিকে সব সময় একজন কর্তব্যপরায়ণ ও
ন্যায়পরায়ণ লোক হিসাবেই দেখেছি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এই ভাল
মানুষটি নিখুঁত ষড়যন্ত্রের বলী হয়েছে।
বিগত আট নয় বছরের ব্যস্ত ব্যবস্থাপক
জীবন হতে বেরিয়ে এসে মনে মনে বেশ প্রশান্তি অনুভব করি। সেদিন বুঝিনিতো আমার এই
আরাম যে বছর না পেরুতেই হারামে রূপ নেবে। ঘুণাক্ষরেও বুঝিনিতো ব্যবস্থাপক চেয়ার হতে
এই সরে আসা আমার চাকুরী জীবনকে ধাক্কা মেরে স্থবিরতায় এক বদ্ধকুয়ায় ফেলে দেবে।
এই বদ্ধকুয়ার ময়লা জলে পড়ে আমি শীঘ্রই
হয়ে যাই এক অসহায় কুলোব্যাঙ। চারপাশের কিছু দুষ্ট লোকের প্রবল ইস্টক বর্ষনে বদ্ধকুয়ায়
আমি নাজেহাল হই। এটা তাদের জন্য খেলা হলেও আমার জন্য ছিল মৃত্যুবান।
পরবর্তীকালে ৭ম ডিসেম্বর ২০১৪
খৃস্টাব্দে ব্যাংকের সর্বোচ্চ চেয়ারে জেঁকে বসেন আমার এক আত্মীয় আব্দুল হালিম
চৌধুরী। তিনি যেদিন ভারপ্রাপ্ত এমডি হন সেদিন পুবালী ব্যাংকের আর কোন লোকই আমার মত
এত খুশী হয়নি। মনের আনন্দে অফিসের সবাইকে আমি মিষ্টি খাওয়াই ও নামাজ পড়ে দোয়া করি
তিনি যেন সফল হন। পরক্ষনেই দেখলাম মতলববাজরা তার পাযুগলে তৈল মালিশে লেগে গেছে।
আমি এদিকে নাগিয়ে তার সহধর্মিনী আমার ভাতিজী রিপাকে ফোন করে ছোটমুখে বেশকিছু উপদেশ
দেই, অভিনন্দন জানাই। বললাম এমডিকে সব সময় ছয়টি প্রেসার বলের মধ্যে বসে কাজ করতে
হয়- মালিক, কর্মী, কাস্টমার, রাজস্ব বিভাগ, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং সরকার। কাজেই তাকে
মানসিকভাবে সম্পূর্ন চিন্তামুক্ত রাখতে হবে। আর বললাম আত্মীয় বা স্বদেশীরা যাতে
অন্যায় কিছু তাকে দিয়ে করাতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখবে, যাতে পরে তিনি বদনামের
শিকার না হন।
হালিম সাহেবকে এমডি করার আশায়
সবসময় আমার প্রতিবেশী পূবালী ব্যাংকের পরিচালক মনির আহমদের কাছে আমি তার প্রশংসায়
পঞ্চমুখ হতাম। বলতাম- ‘হালিম সাহেব যোগ্য লোক এত সুযোগ্য ব্যাংকে আর কেউ নেই, তার
সহোদররা সবাই ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার, এমন একটি পরিবার সিলেটে নেই, তিনি সৎ এত সৎ লোক
আজকাল পাওয়া যায়না, তিনি সিলেটের একটি এলিট পরিবারের সন্থান, তাকে নিয়ে চলতে আপনাদের
দারুন সুবিধে হবে’- ইত্যাদি।
অথচ এই আব্দুল হালিম চৌধুরী
ব্যাংকের শীর্ষপদে বসেই বদলে যান। তিনি বিচার বিবেচনা ছাড়াই দুষ্টলোকদের কানকথা শোনার
একজনে পরিনত হন। নিজস্ব বিচার বিবেচনা শক্তি তিনি হারিয়ে ফেলেন। তার পত্নীকে বলে
এমন কি তাকে টুনটুনিয়েও সিলেটে আমার উপর চাপিয়ে দেয়া কিছু দারূন অন্যায় অবিচার ও
স্বেচ্ছাচারের কোন প্রতিকার পেলামনা বরং তাকেও মনে হল এসব জুলুমবাজির একজন নীরব সহায়ক। তিনি আমাকে কোন পাত্তাই দিলেন না, যদিও দিলেজানে আমি ছিলাম তার
একজন শুভাকাঙ্খি ও ভক্ত সমর্থক। পাত্তা দিলেন কঞ্চিকে। আমার মনে হল, আব্দুল হালিম
চৌধুরীর পূবালী ব্যাংকে বাশের চেয়ে কঞ্চি বড় ও শক্ত হয়ে গেছে।
তারপর আমার আর ভরসা করার মত কোন
জায়গা রইলনা। এই শীর্ষকর্তা লোকের কাছে কিছু চাওয়া বা মনের কথা বলার আগ্রহ আমার
নিভে গেল। তিনি সিলেটে আসলে তাকে গিয়ে দেখারও আমার কোন আগ্রহ হতনা।
আমি দুচোখ বুজে নিলাম, কানে তুলা
দিলাম, পিঠে কুলাবেঁধে নিজেকে আড়ালে রেখে সব অন্যায় অপমান সহ্যকরে অপয়া আব্দুল হালিম
চৌধুরীর অশুভ সময়কালটা কোনমতে অতিক্রম করে যাই। এই দীর্ঘ অলক্ষি সময়ে আমি ঘরছাড়া
হলাম, সংসার ছাড়া হলাম, বারবার পদোন্নতিহারা হলাম, সিলেট শহর ছেড়ে এখানে সেখানে সুদীর্ঘকাল
নির্বাসনে থাকলাম। এমনটি আর কোন অনাত্মীয় ব্যবস্থাপনা পরিচালকের আমলে হয়নি। আমার
ভাগ্যকে মহান আল্লাহের হাতে সপে দিয়ে নিজেকে বললাম- ‘যা গেছে যাক চলে গোল্লায়/
যেবা করে ভাল করে আল্লায়’।
আজ এখানেই থাক, পরে এব্যাপারে আর
অনেক কথা বলা হবে।
নতুন ঝলমলে সিলভ্যালি অফিসে
যোগদানের কিছুদিনের মধ্যেই এই তিন অফিসের জমজমাট উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হয়। হলুদ ও
সবুজ হচ্ছে পূবালী ব্যাংকের ব্রেন্ডিং কালার। তিন অফিসে ওঠার সিড়িমুখে হলুদ সবুজ
বেলুন দিয়ে ফটক তৈরি করা হয়। রঙ্গীন ফিতায় বাধা হলুদ সবুজ ও সাদা বেলুনে সারাটা
ভবন ছেয়ে যায়। বেশ কিছুদিন ছাদের সাথে এই বেলুনগুলো ঝুলে রয়। অফিসে বসে পরবর্তী কয়েকদিন
ধরে একটা উৎসব উৎসব আমেজ আমরা অনুভব করি।
ভবনের সামনে কাপড়ের গেট নির্মাণ
করা হয়। ভবনের ভিতর বিশাল পার্কিং এলাকায় সামিয়ানা টাঙ্গিয়ে প্যান্ডাল করা হয়। আমাদের
সিলেট ইস্ট প্রধান উপমহাব্যবস্থাপক সিরাজুল হক চৌধুরী ব্যাংকের বেশ কজন সুন্দরী
মেয়ে সংগ্রহ করেন এবং তাদেরকে ব্যাংকের অর্থে কেনা হলুদ ও টিয়া রঙের শাড়ি ও পোষাকে
পরিপাঠি করে সাজান।
একঝাক সুসজ্জিত সুন্দরী তরুণীরা সবুজ
পাতার ফাঁকে এক একজনা সদ্যফোটা শাপলা সেজে অনুষ্ঠান পরিচালনায় অংশ নেয়।
অনুষ্ঠানের দিন পূবালী ব্যাংকের
কাস্টমার ছাড়াও সিলেটের সব স্থানীয় গণ্যমান্য লোকজন আসেন। সাংবাদিক, গণপ্রতিনিধি, বড়
ব্যবসায়ী কেউ বাদ পড়েনি। আসেন আমাদের ব্যাংকের চেয়ারম্যান হাফিজ আহমদ মজুমদার, ব্যবস্থাপনা
পরিচালক হেলাল আহমদ চৌধুরী এবং পুবালী ব্যাংকের পরিচালক মনজুর রহমান।
প্রফেসর ডঃ কবির চৌধুরী এক প্রাণবন্ত বক্তব্য রাখেন। কবির চৌধুরী এই বক্তব্যে জায়গা মত প্রচুর তৈলমর্দন
করেন। পুবালী ব্যাংকের আজীবন চেয়ারম্যান স্বনামধন্য ব্যাক্তিত্ব ই এ চৌধুরীর
শ্যালক মঞ্চে আসীন ব্যাংক পরিচালক মনজুর রহমান সম্পর্কে কবির চৌধুরী বললেন, তিনি
কথায় নীরব কিন্তু কর্মে সরব ব্যক্তিত্ব। নাসির এ চৌধুরী এবং মনজুর
রহমানের অপার মহিমা ও করুনায় কিছুদিন আগে কবির চৌধুরী গ্রীনডেল্টা ইনস্যুরেন্স
কোম্পানীর পরিচালক হন।
ভিআইপিদের এতই ভীড় জমে যে আমাদের
অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল হালিম চৌধুরী কোন একজন নগন্য ভিআইপিকে নিজ
চেয়ারে বসিয়ে মঞ্চ হতে নেমে দর্শক সারির সামনের চেয়ারে এসে বসেন। হালিম চৌধুরী তেমন
ভাষণ দিতে জানেন না কিন্তু তার এই সুকর্মে প্রমাণ দিলেন তৈলমর্দনে কবির চৌধুরী তার কাছে নস্যি মাত্র। তার এই দৃষ্টিকটু বদান্যতা
দেখানো এই ভিআইপি ছিলেন পুবালী ব্যাংকের কোন একজন পরিচালকের তরুণ পুত্রধন। আপনার
কোন জ্ঞানগরিমা ও সদগুন থাকুক কিংবা নাই থাকুক আপত্তি নেই, কেবল সঠিকভাবে তৈলমর্দনের
যোগ্যতা থাকলেই বাংলাদেশে খুব সহজেই যে কোন প্রতিষ্টানে শীর্ষপদে ওঠে আসা যায়। মেয়র
আরিফুল হক চৌধুরী বক্তব্য রাখলেন, তার মস্তিস্কে কেবল খিলবিল করছে ব্যাংকের সিএসআরের
অনুদানের টাকা, টাকার এই খনিটি কেমনে খনন করা যায়।
আমার সহপাঠী বন্ধু, শক্তিমান
ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তা শিল্পপতি বারাকা পাওয়ারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম
রাব্বানী চৌধুরীকে মঞ্চে ডেকে নেন আমাদের ব্যাংকের চেয়ারম্যান হাফিজ আহমদ মজুমদার।
গোলাম রাব্বানীর সুন্দর বক্তব্য আমাদেরকে মুগ্ধ করে।
এত বক্তার ভীড় হল যে সভার
শেষদিকে তাদের চর্বিত চর্বন শোনার আগ্রহ কারো থাকলনা। বুভুক্ষ সবাই পেঠের জ্বালায় খাবার
প্যাকেট সংগ্রহে ছুটে গেল।
নতুন কার্যালয়ে এসেই আমি সিলভ্যালিতে
পুবালী ব্যাংক লিমিটেড সিলেটের তিনটি বৃহৎ অফিস এবং সিলেট শাখার সুচনাকাল প্রত্যক্ষণ করি।
কোন এক রোজার দিনে আমি, জকিগঞ্জি
সিরাজ উদ্দিন ও মোহন্ত বাবু বসে আছি আমার বস সিরাজুল হক চৌধুরীর
চেম্বারে। এসময় আমাদের সিলেট স্টেডিয়াম শাখার সহকারী মহাব্যবস্থাপক শফিউল হাসান
চৌধুরী এসে হাজির হন। তিনি বড়স্যারকে তার শাখায় ইফতারের দাওয়াত জানিয়ে একটি
আমন্ত্রণপত্র এগিয়ে দেন। বস পত্রটি খোলে বিরক্ত হয়ে বললেন
আমি সবার সিনিয়র অথচ দাওয়াত দিতে এসেছেন মাত্র দুদিন আগে, আমি আপনার ইফতারে যাবনা।
শফিউল হাসান করজুড়ে ক্ষমা চেয়ে বেরিয়ে গেল।
এবার ডিজিএম সিরাজুল হক চৌধুরী স্যারকে আমরা আর রেগে যেতে দেখি। স্টেডিয়াম শাখার
ইফতারবেলায় তিনি তার তাতিপাড়ার বাসায় ইফতারের আয়োজন করলেন। সিলেট স্টেডিয়াম শাখার
কয়েকজন বড় কাস্টমার আমার বসের সহপাঠী ও বন্ধু ছিলেন। তিনি তাদেরকে স্টেডিয়াম শাখার
ইফতার বয়কট করে তার বাসার ইফতার পার্টিতে আসতে বললেন। ইফতারের অনুস্টানে শফিউল
হাসান চৌধুরী দেখল তার বড় কাস্টমার মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী নেই, ব্যবসায়ী এজাজ এ
চৌধুরী নেই, বিএনপি নেতা ব্যবসায়ী নাসিম চৌধুরীও নেই।
জকিগঞ্জি সিরাজ সাহেব আমাকে
বললেন, এই সামান্য ব্যাপারে স্যারের এত রাগ ওঠার কারণ কি? স্টেডিয়াম শাখাতো তার অধীনেও নয়, এ টি সিলেট পশ্চিম অঞ্চলের একটি
শাখা। আমি জবাব দিলাম, জানিনা, বড়লোকদের উদ্ভট আচরণের মানে
আমার মাথায় আসেনা। পাশের একজন বলল স্যার প্রমান করলেন সিলেট স্টেডিয়াম শাখার সব বড়
কাস্টমার উনার। সমবারু চন্দ্র মোহন্ত বললেন, থেমে যান, বড়স্যারদের এসব মান অভিমান
নিয়ে আমাদের এত গবেষনার কি বা দরকার। এবার পিছন হতে কে একজন বলল আমাদের স্যার
সিলেট অঞ্চলের পূর্ব পশ্চিম সব চালান। এবার আরেক কন্ঠে শুনলাম- মহাব্যবস্থাপক
স্যার নন, আমাদের উপমহাব্যবস্থাপক সিরাজ স্যারই সিলেটের চারটি জেলার মহারাজধিরাজ,
তার মতামতের হেলাফেলা করার কোন ক্ষমতা জিএম স্যারেরও নেই।
পটুয়াখালির মেয়ে মাকসুদা
আক্তার অপূর্ব সুন্দরী তরুণী। আমাদের বস সিরাজুল হক চৌধুরী
এক সময় সিলেট স্টেডিয়াম শাখার ব্যবস্থাপক ছিলেন। তার শাখায় তখন কর্মরতা এই স্মার্ট
অল্প বয়স্কা সুন্দরীকে দিয়ে ব্যাংকের সব অনুষ্ঠান উপস্থাপনা
করাতেন। তিনি সিলেট ইস্টের অঞ্চল প্রধান হয়েই তার পছন্দের পাত্রি মাকসুদা আক্তারকে
পশ্চিমাঞ্চল হতে ছিনিয়ে এনে তার অধীন ঈদগাহ শাখার ব্যবস্থাপক করেন। অফিসের
ড্রাইভার বলল এখন এমন কোন দিন নেই বড়স্যার যেদিন ঈদগাহ শাখা জেয়ারত করতে যাননা। তবে
জেয়ারতে হুজুর খুব বেশীদিন সুবিধা করতে পারলেন না। মাকসুদা খুব বুদ্ধিমতি তরুণী, বড়স্যার
এখন ঈদগাহ শাখায় গেলেই সামনে হাজির সাংবাদিক স্বামীকে দেখিয়ে মাকসুদা বসকে বলে- স্যার
এই আমার সাহেব, ওর সাথে বসে বসে গল্প করুন, আমি কাজ সারি।
কেউ চেম্বারে মিষ্টি পাঠালে আমার
বস সিরাজুল হক চৌধুরী মুখে নিতেন না, যতক্ষণ মিষ্টিদাতা নিজে গিয়ে তাকে
আমন্ত্রন না জানায়। আমরা মিষ্টিদাতাকে তার শুভসংবাদ জানিয়ে স্যারকে নিমন্ত্রন দিতে
চেম্বারে পাঠিয়ে দিতাম। নয়তো এই মিষ্টি সারাদিন টেবিলে পড়ে থাকত ও বিকেলে
ক্লিনারের উদরে যেত।
শত হোক তিনি আমাদের শ্রদ্ধেয় বস।
তাই আমি ও জকিগঞ্জি সিরাজ সাহেব বসের যত্তসব উদ্ভট ক্রিয়াকলাপ ঢেকে রাখি এবং সব
স্বেচ্ছাচার সুকৌশলে সামাল দেই। অফিসে আমরা দুজন ছিলাম যেন এই হবুচন্দ্র রাজার দুইজন
গবুচন্দ্র মন্ত্রি। নিশ্চুপ সমবারু চন্দ্র মোহন্ত বড়স্যারের সব কেরানিগীরি একমনে
করে যান। এই একনিষ্ট কেরানিগীরির প্রচুর এনাম পান মোহন্ত বাবু, তিনি হবিগঞ্জ শাখার
রাজত্ব পান, সেই রাজত্বের সাথে ভাগ্যে জুটল রাজকন্যে ‘পদোন্নতি’। এবার তিনি হয়ে
যান ব্যাংকের সহকারী মহাব্যবস্থাপক।
মোহন্ত বাবু ভাল ইংলিশ জানেন,
আইটি জানেন, আসলে তিনি খুব যোগ্যই ছিলেন। আমি তার উন্নতিতে সীমাহীন আনন্দ পাই।
অভিনন্দন জানাই।
একবার বেশ কয়েকদিন বস সিরাজুল হক
চৌধুরী ঢাকায় প্রশিক্ষনে ছিলেন, আমি তখন সিলেট ইস্টের ভারপ্রাপ্ত অঞ্চল প্রধান।
এসময় হাফিজ আহমদ মজুমদারের ব্যাংক চেয়ারম্যান পদের মেয়াদকাল তিন বৎসর বর্ধিত হয়।
তিনি ঢাকা হতে এসে ব্যাংকের সিলেট স্টেডিয়াম রেস্টহাউসে উঠেন। সিলেটের মহাব্যবস্থাপক
ও তিনজন উপমহাব্যবস্থাপক ফুলের তোড়া নিয়ে তাকে অভিনন্দন জানাতে রেস্টহাউসে ছুটে
যান। কিন্তু সেখানে রাজসমীপে ধর্নাদিয়ে তারা পুস্প্যমাল্যের বদলে পাটকেলটি খান। হাফিজ
মজুমদার তাদের প্রতি ক্ষেপে যান- কেন তার পদের মেয়াদবৃদ্ধির খবর পত্রপত্রিকায় যায়
নাই। তারা কি ব্যাংকে বসে বসে অলস ঘোড়ায় ঘাস কাটছেন, আর শুয়ে শুয়ে জাবর কাটছেন?
সেদিন পুবালী ব্যাংকের সিলেট
বিভাগের সেই রথী মহারথীরা বিষন্ন বদনে রেস্টহাউসের দুতলা হতে নেমে তিনটি গাড়িতে
চড়ে তিনদিকে উদাও হয়ে যান।
মাহবুব সাহেবকে বললাম সেদিন কি
ঘটেছিল? তিনি কোন জবাব না দিয়ে তার শৈশবের একটি গল্প শুনালেন। একবার তাদের গ্রামে
সার্কাস হয়। সার্কাসের একটি খেলা ‘ভূতের ঘর’। হার্ডবোর্ড দিয়ে নির্মিত একটি নিকশ
অন্ধকার সরুপথের একপ্রান্ত দিয়ে টিকেট কেটে কিছুলোক ফুর্তি করে ঢুকছে কিন্তু অন্যপ্রান্ত
দিয়ে তারা বিষন্ন বদনে বেরিয়ে যাচ্ছে। বের হওয়া লোকদেরকে মানুষ জিঞ্জেস করছে তারা ভুতের
বাড়ি ঢূকে কি দেখলেন? কিন্তু কি দেখলেনের সরাসরি কোন উত্তর না দিয়ে তারা বলছেন
আপনিও ডুকেন, তাহলে ভুতের ঘরের মজা টের পাবেন। মাহবুব সাহেব ভিতরে ডুকামাত্র
কিম্ভুতকিমাকার একজন লোক(ভূত) অন্ধকারে তার চুল জাপটে ধরে টেনেহিচড়ে ভিতরে নিয়ে
যায়, আরেক গরিলাকৃতি লোক(দানব) তাকে সবশেষে পাছায় লাতি মেরে বাইরে বের করে দেয়। বললেন
নিজের গাটের পয়সায় টিকেট কেটে পাছায় ভুতের লাথি খেয়ে সেদিন ভূদৌড়ে পালাই।
মনে কিছুটা ক্ষেদ হল, আমি সিলেট
পূর্বাঞ্চলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান হলেও তারা আমাকে সাথে নেয়নি। এবার বললাম ‘শোকর
আলহামদুলিল্লাহ’ আল্লাহ তুমি আমার ইজ্জত বাঁচিয়েছো। তাঁরা আমাকে ডেকে নিয়ে গেলে
নিশ্চয় পাছায় ভূতের লাথি খেয়ে ফিরতাম।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন