সিলেট
আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যবয়সী একজন ছাত্র আমিঃ
শিক্ষাকালঃ ১লা মার্চ ২০১২ হতে
২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ খৃষ্টাব্দ অবস্থানঃ দুই বৎসর।
আমি একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান
পূবালী ব্যাংকে চাকুরী করি এবং চাকুরীর ফাঁকে ফাঁকে সময়ে সুযোগে ছোটখাট ব্যবসাপাতি
করি। ব্যবসা সম্পর্কে জানতে গিয়ে আমার মনে এমবিএ পড়ার একটি ইচ্ছে জেগে উঠে। জায়গাটির
নাম বাগবাড়ি, পিছনে বিশাল মৎস্যখামার, কাছেই সুরমানদী বহমান। আমার বাসার পাশে
বাগবাড়িতে ২০০১ সালে স্থাপিত সিলেটের প্রথম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ‘সিলেট
আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়’ একদিন দেখতে যাই। দুতলা সুবৃহৎ ভবনে ঢুকে অফিসে আমার
ফুফুতো ভাগ্নি সুমা জায়গীরদারকে পাই। সে আমাকে তার মামা ও আমার ফুফুতো ভাই এই
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ভিসি ডঃ সদরুউদ্দিন চৌধুরীর চেম্বারে নিয়ে যায়। তিনি
শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়েরও প্রতিষ্ঠাতা ভাইস চ্যান্সেলর ছিলেন। সদরুদ্দিন ভাইকে
আমার মনের অভিলাশ জানালে তিনি বললেন, ভর্তি হয়ে যাও। এখানে এমবিএ কোর্সে ভাল টিচার
আছেন, কোন সমস্যা হবেনা।
কিন্তু তখন আমি ভর্তি হইনি,
হয়েছি অনেক পরে ২০১২ সালে। এমবিএ সেশন বসন্ত-২০১২। আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের
মাস্টার্স, তাই আমার এমবিএ কোর্সের মেয়াদ দুই বৎসর, আরম্ভ মার্চ-২০১২ সাল ও
সমাপ্তি ফেব্রুয়ারি-২০১৪ সাল। একদিন বাদসন্ধ্যায় এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে আমার
অনুজ নিশাতের মোটর সাইকেলের পিছন সিটে বসে এই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যাই। যাবার রাস্তায় মোটর সাইকেলের চাকায় একটি
লোহা ঢুকে গেলে মনে হল এটা কি কোন অশুভ লক্ষণ? তবে নিজেকে বললাম এসব বিষয় নিয়ে শুভ
অশুভ চিন্তা নির্বোধের কাজ। অফিসে ঢূকে আমার ফুফুতো ভাতিজা শরীফ চৌধুরীকে পেলাম।
সে আমার ভর্তির সব কাজ আঞ্জাম করে দিল।
ছয়মাসের এক সিমিস্টারের ফি বাবদ বাইশ
হাজার টাকা পরিশোধ করলাম। চার সেমিস্টারের এমবিএ কোর্স সমাপনে বিশ্ববিদ্যালয়কে
আমার পরিশোধ করতে হবে সর্বমোঠ আটাশি হাজার টাকা।
ভর্তি হলাম, আমার রোল নং ১৩২১৩।
এবারও একজন আত্মীয়কে ভাইস
চ্যান্সেলর দেখতে পেলাম। তিনি আমার পত্নী ডাঃ নুরজাহানের ফুফুতো বোনের দেবর সৈয়দ
আকমল মাহমুদ। তিনি সারাজীবন বিভিন্ন সরকারি কলেজের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও
বিভাগ প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। অবসর গ্রহণের পর এখানে ভারপ্রাপ্ত ভিসির
দায়িত্ব নেন।
এই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তখনকার
ট্রাষ্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন শামিম আহমদ পিতা মইনুদ্দিন যার নামে বাগবাড়িতে
একটি মহিলা কলেজ রয়েছে। আসলে শামিম আহমদ ও তার চাচা কুতুবউদ্দিন এই দুইজন মিলেই এই
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন।
শামিম আহমদের নামে এলাকাটির নাম শামিমাবাদ আবাসিক এলাকা।
আমার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের
মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষাবর্ষ ছিল ১৯৮৮ সাল। কিন্তু প্রচন্ড সেশনজটের কারণে এই
চুড়ান্ত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯১ সালে। শিক্ষাজীবন ইতি হবার কুড়ি বছর পর
সাতচল্লিশ বছর বয়স্ক একজন প্রৌঢ়লোক আমি আবার শখের বসে ছাত্রজীবনে প্রবেশ করলাম।
সিলেটের এই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়টি দেশের অন্যসব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মত
একর একর জায়গা জুড়ে স্থাপিত না হলেও বর্তমান কালের মার্কেটের উপর স্থাপিত বেসরকারি
বিশ্ববিদ্যালয়ের মত ‘ঘটি ডুবেনা, নামে তালপুকুর’ ছিলনা। এখানে বড় শিক্ষাভবন এবং
চারপাশে বিশাল খোলা আঙ্গিনা ছিল। দুইটি গেট, গাড়ি ও মোটর সাইকেল পার্কিং এরিয়া, ফুলের
বাগান, খেলার মাঠ সবই ছিল। মার্কেটের ভিতর স্থাপিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে
বড় কোচিং সেন্টার মনে হলেও সিলেট আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়কে তেমনটি মনে হতনা,
বরং আকারে আয়তনে মনে হত এটি একটি মিনি বিশ্ববিদ্যালয়।
ক্লাস হত সপ্তাহে দুইদিন, প্রতি
শুক্রবার ও শনিবার সন্ধ্যা ৪টা হতে রাত ১০টা। একটি ক্লাশ দুই ঘন্টা, তিনটি ক্লাশে
ছয় ঘন্টা পার হত। ফলে মাগরিবের নামাজ প্রায়ই বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদে জামাতে আদায়
করি।
প্রথম দিন আসরের নামাজ পড়ে
লালকার চালিয়ে আমি ক্লাসে যাই। মনে একটা লজ্জা লজ্জা ভাব ছিল এত প্রবীণ বয়সে আমি
আবার ছাত্র হতে যাচ্ছি। ক্লাশে ঢুকে প্রায় পঞ্চাশ ষাট জনের মত ছাত্রছাত্রীর দেখা
পেলাম। অধিকাংশ ছাত্র-ছাত্রীদের বয়স চব্বিশ পঁচিশের বেশী হবেনা। সহপাঠিরা কেমন করে
জেনে যায় আমি পুবালী ব্যাংকের একজন সহকারী মহাব্যবস্থাপক এবং আমাকে তারা ‘কুরেশী
স্যার’ বলে সম্বোধন করে। শেষে দেখি আমরা ক্লাসের বয়স্ক প্রবীণরা তরূণদের সহপাঠী
হয়েও ‘স্যার’ হয়ে গেছি।
মনেপড়ে সুদর্শন তরূণ রাজিব
আহমদের কথা, তাকে আমি প্রায়ই ছুটির দিনে আমার সাগরদিঘিরপারের বাসায় ডেকে নিয়ে যেতাম
এবং দুজন মিলে একটি টেবিলে বসে পড়াশুনা করতাম। সে পরে প্রাইম ব্যাংকে চাকুরী পায়।
কনক কান্তি আমার নানাবাড়ি বড়লেখা
উপজেলার দক্ষিণভাগের সন্থান। সে তার নানা স্বপ্নের কথা আমাকে শুনাতো। তার গ্রামের
মন্দিরে পুজা উপলক্ষে সে একটি ম্যাগাজিন বের করে। সেই ম্যাগাজিনে আমার লেখা
‘মাধবকুন্ডের জলে’ নামক কবিতাটি ছাপিয়ে আমার বাসায় এসে এক কপি ম্যাগাজিন উপহার
প্রদান করে।
তরুণ সহপাঠী রনি, ধ্রুব, সুমন,
শাহরিয়ার ও আব্দুল্লাহ আল মামুনকে আমার খুব মনে পড়ে। কয়েকজন তরুণী সহপাঠিনীও
আমাদের ভাগ্যে জুটে, তারা উম্মে ফাতেহা রিম্মি, জেনী, সুদীপ্তা প্রমুখ। রিম্মির
বাসা কানিশাইল এবং সে পুবালী ব্যাংক পাঠানটুলা শাখায় কর্মকর্তা ছিল।
আমাদের শিক্ষাজীবনে ছাত্রদের
মাঝে রাজনীতির ডামাডোল থাকলেও এখনকার তরুণদের দেখি এব্যাপারে তারা একেবারে
নির্বিকার। ছাত্র রাজনীতি নিয়ে তাদের কোন মাথাব্যথা নেই। আসলে বাবার প্রচুর অর্থ
খরচ করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পড়তে আসা একালের ছেলেদের একটাই ভাবনা কোনমতে পাস করে
বের হয়ে একটা চাকুরি বাগিয়ে নেয়া।
আমাদের সময়ে সেরা মেধাবীরা
চিকিৎসক হত, পরবর্তী মেধাবীরা প্রকৌশলী হত, তার পরবর্তী মেধাবীরা বিজ্ঞান বিষয়ে
বিশ্ববিদ্যালয় হতে উচ্চতর ডিগ্রি নিত, তার পরের মেধাবীর দল অন্যান্য বিষয়ে
বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা নিত ও সাধারণ গ্রেজুয়েট হত। ছাত্রজীবনে শেষস্থরের পোড়
খাওয়া অমেধাবীরা কোনমতে সনদপত্র নিয়ে করত ওকালতি, হোমিওপ্যাথি কিংবা রাজনীতি।
চিকিৎসকরা ক্ষমতাহীন আমলা হত, তবে
স্বাস্থ্যব্যবসা করে টাকা কামাতো। প্রকৌশলীরাও সরকারি আমলা হত, তবে পার্সেন্টিস
খেয়ে কোটীপতি হত। তার পরের দল বিসিএস পাশ করে ক্ষমতাবান আমলা হয়ে উপরোক্ত দুইদলকে
শাসন করতো। আর উপরের সবকটি দলের উপর জননেতা, এম পি, মন্ত্রী, চেয়ারম্যান, মেয়র ইত্যাদি
হয়ে ছড়ি ঘুরাতো পিছনের মেধাহীনদের দল। যার করুন পরিণতি ভোগ করছে আজকের বাংলাদেশ।
এখনকার যুগের ছেলেমেয়েরা ছুটছে
ব্যবসা এবং কম্পিউটার অধ্যয়নে, নুতন নুতন বিষয়ে পড়ে নুতন নুতন পেশায় যোগ দিতে।
আসলে এতসব বিষয় এবং এতসব বৈচিত্রময় পেশা আমাদের সময় ছিলনা। ফোন, শেয়ার, সফটওয়ার ও
নানান কোম্পানির চাকুরী আমাদের শিক্ষাজীবনে ছিল অনুপস্থিত। আমরা চাকুরী বলতে
ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিসিএস ও বাহিনী অফিসার ও শিক্ষকতা বুঝতাম।
সিলেট আন্তর্জাতিক
বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সহপাঠিদের অনেকেই ছিলেন পরিণত বয়স্ক ও চাকুরীজীবী। আমার চেয়ে
আটদশ বছরে সিনিয়র কুতুবউদ্দিন ভাই ছিলেন বিসিএস অফিসার, তার পদ ছিল যুগ্নসচিব। পরিবার
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সিলেটের তিনি ছিলেন বিভাগীয় প্রধান। তিনি আলমপুর হতে মাইক
লাগানো সরকারি মাইক্রোবাসে চড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতেন। লেখাপড়ায় তিনি ছিলেন বেশ মনোযোগী
এবং খুব ভাল রিজাল্ট করতেন।
শাব্বির আহমদ চৌধুরী ছিলেন
দরগাগেইটের তিন তারকা হোটেল স্টার প্যাসিফিকের ব্যবস্থাপক। তার বাড়ি কুলাউড়া। তিনি
বি কম, তার শখ ছিল মাস্টার্স হবেন। কিন্তু তার মাথায় লেখাপড়া খুব সহজে ঢুকেনা।
তিনি আমার সমবয়স্ক। এক সেমিস্টার ফাইন্যাল পরীক্ষায় তার হাতে কিছু লিখা পেয়ে অল্পবয়স্কা
টিচার মেয়েটি খাতা কেড়ে নেয়।
কয়েকবার অনুরোধ করার পরও পেপার
ফিরিয়ে দিচ্ছেনা দেখে শাব্বির ভাই অনুচ্চ স্বরে বললেন, হারামজাদী তুই আমার মেয়ের
চেয়েও বয়সে ছোট, আমার নকল ধরতে তর লজ্জা করার কথা ছিল, তুই বড় নির্লজ্ব বেহায়া মেয়েরে
বাবা। আমি হাসলাম, নকলে ধরা খেয়ে লজ্জা পাবার কথা আসলে শাব্বির ভাইয়ের অথচ উল্টো
তিনি বলছেন টিচার মেয়েটির কোন লাজলজ্জা নেই। যাক ১৫/২০ মিনিট পর অন্য একজন পরীক্ষক
টিচার এসে মুরব্বী শাব্বির ভাইকে পেপার ফেরত দেন।
রাসেল চট্টগ্রামের ছেলে, সে
ইউসিবিএলে চাকুরী করত এবং চট্টগ্রামের আঞ্চলিক সুরে কথা বলে। আমার অনেক জুনিয়র
নুরুল ইসলাম রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপক। পরে তার সাথে আমি পরীক্ষা দিয়ে ব্যাংকিং
ডিপ্লোমা প্রথম পর্ব (জেএআইবিবি) পাস করি। সুলতান আহমদ ছিলেন আনসার ভিডিভি ব্যাংকের
ব্যবস্থাপক। আনিস সরকারি সমাজসেবা অধিদপ্তরে এবং মামুন মোহাম্মদ কোন এক ফার্মাসিউটিক্যাল
কোম্পানিতে চাকুরী করতেন। আমরা অন্য বয়স্করা
সবাই ছিলাম ব্যাংকার। স্মার্ট ও সুদর্শন নজরুল ইসলাম প্রাইম ব্যাংক এবং নিশীত
কান্তি দেবনাথ কৃষি ব্যাংকের ব্যবস্থাপক ছিলেন। আমাদের পুবালী ব্যাংকের অফিসার
কাজী মাহবুবা ছিলেন নজরুল ইসলামের সহধর্মিনী। সালেহ আহমদ চৌধুরীর সাথে ব্রাক
ব্যাংক সুবিদবাজার শাখায় আমার প্রায়ই দেখা হত। বাসার পাশের এই শাখায় আমার বেগম
সাহেবা ডাঃ নুরজাহান বেগম চৌধুরীর ব্যাংক হিসাব রয়েছে। সেখানে গেলেই সালেহ ভাই আমাদের
খুব খাতির যত্ন করতেন। তার গ্রামের বাড়ি ভাটির দেশ দিরাই, সুনামগঞ্জ।
এবার আমাদের পাঠকক্ষ এবং
শিক্ষকদের নিয়ে খানিকটা আলোচনা করব। এখানে আমাদের প্রথম যে ক্লাস হয় তা ‘বানিজ্যিক
গণিত’। যে স্যারকে পেলাম তিনি আব্দুল লতিফ, এমএসসি (বানিজ্য) চট্টগ্রাম
বিশ্ববিদ্যালয়। ন্যাড়া মাথার উপর হ্যাট পরা এই কালো চিকন শিক্ষককে আমার কেমন যেন
পরিচিত একজন মনে হল। সেদিন তাকে কোথায় দেখেছি মনে করতে না পারলেও কিছুদিন পর এমসি
কলেজের আরেকজন সহপাঠী খায়রুল চৌধুরীকে ফোন করে বুঝতে পারি, তিনি নিশ্চিত আমার এমসি
কলেজের এইচএসসি(বিঞ্জান) পরীক্ষার্থী ১৯৮৩ ব্যাচের একজন সহপাঠী। আব্দুল লতিফ
ক্লাসে আমাকে বারবার ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করায় আমি সহজেই বুঝতে পারি তিনি আমাকে চিনতে পারেননি। আমি ধাঁধায় পড়ে যাই
তাকে আমার পরিচয় দেবো কিনা। ভাবলাম পরিচয় দিলে বর্তমানে আমরা সাবেক দুইজন সহপাঠির
মধ্যে যে গুরুশিষ্য সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে তা গুড়েবালি হয়ে যাবে। শেষে ভাবলাম
পরিচয় দেবার কিবা প্রয়োজন, বরং গুরুশিষ্য হিসাবেই এমবিএ কোর্সের সময়টা পার করে
দেই। আমি বিঞ্জানের ছাত্র, তাই বানিজ্যিক গণিত আমার কাছে খুব একটা কঠিন কিছু মনে হয়নি।
তিনি সিলেটের রাজা ম্যানশনের বিখ্যাত মালঞ্চ লাইব্রেরির স্বত্বাধিকারী।
মহসিন হোসেন স্যার আমাদেরকে ‘মার্কেটিং’
পড়াতেন। এই সাবজেক্ট আমাকে বেশ মজা দিত, কারণ আমি তো সেবাপনণ্য মার্কেটিং প্রতিষ্ঠানে
কাজ করি। ম্যানেজমেন্ট আমার প্রিয় সাবজেক্ট, পড়াতেন খান মোঃ মহিউদ্দিন বাহার। এই
শিক্ষক একেবারেই তরুণ। তার বাসা আমার কাছে, সুরমা আবাসিক এলাকা, সাঘরদিঘিরপার। বয়সে
অনেক জুনিয়র হলে কি হবে, সামনে পেলে ছোট্ট করে একটা সালাম দিতাম। শত হোক তিনি যে
আমার গুরু, আমি যে তার শিষ্য। ফিনান্স বেশ কঠিন সাবজেক্ট, গণিতের প্রাবল্য আছে। এই
সাবজেক্ট পড়াতেন রেজাউল কবির।
আরেক তরুণ শিক্ষক প্রদীপ দে,
তিনি আমাদেরকে পড়াতেন বানিজ্যিক আইন। একদিন আমার লেখা ‘ইসফাক কুরাইশী রচনাসমগ্র’
বিশ্ববিদ্যালয় পাঠাগারে উপহার দিতে নিয়ে গেলে তিনি ক্লাসে এই বইটি হাতে তুলে নেন।
কিছুক্ষণ বইটি নাড়াচাড়া করে এবার দাঁড়িয়ে বললেন, আমি বিষ্মিত, আপনাদের সহপাঠি একটি
বিশাল বড়মাপের কাজ করেছেন। আপনারা সবাই একবার দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়ে তাকে অভিনন্দন
জানান। ক্লাসভর্তি আমার সব সহপাঠীরা তখনই
একসাথে দাঁড়িয়ে গেল, মুহুর্মুহু করতালিতে ক্লাস কক্ষ কেঁপে উঠল।
সৈয়দ তৌফিক হোসেন স্যার একটু গাঢ়বাঁকা
সুদর্শন শ্বেতকায় লোক। তিনি শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, আমাদেরকে পড়াতেন
‘ব্যাংকিং এন্ড ইনস্যুরেন্স’। তিনি আমার বাসার কাছে আপন টাওয়ারে বসবাস করেন। তবে
আমি যে তার ছাত্র ছিলাম তা তিনি কিছুদিনের মধ্যেই ভূলে যান। বাহার কিংবা প্রদীপ
স্যার আমাকে দেখলেই যেমন তাদের একজন সাবেক ছাত্র হিসাবে চিনে ফেলেন তৌফিক স্যারের
বেলায় তা হয়নি। আসলে মানুষকে নাম সহকারে মনে রাখার ক্ষমতা সবার সমান হয়না।
‘বানিজ্যিক যোগাযোগ’ সহজ ও মজার
বিষয়, সেইসাথে চাকুরীক্ষেত্রে সার্বক্ষণিক জরুরী বিষয়ও বটে। একজন গম্ভীর প্রৌঢ়
শিক্ষক আব্দুল হামিদ আমাদের এবিষয়ের ক্লাস নিতেন। বর্তমান কম্পিউটার ইন্টারনেটের
যুগে ‘এম আই এস- ম্যানেজারিয়েল ইনফরমেসন সিস্টেম’ খুব গুরুত্বপূর্ণ সাবজেক্ট। এই
বিষয়ের শিক্ষক ছিলেন সাদ উদ্দিন।
এমবিএতে আমার মেজর সাবজেক্ট ছিল
‘এইচ আর এম- হিউম্যান রিসোর্ট ম্যানেজমেন্ট’। এই বিষয়টি আমার জন্য ছিল সবচেয়ে
গুরুত্বপূর্ণ। এই সাবজেক্টের শিক্ষিকা ছিলেন কামরুন নাহার। ভিনজেলা হতে আগত ২৩/২৪ বছর
বয়েসী এই তরুণী শিক্ষিকা ছিলেন পরমা সুন্দরী। তার ফর্সাদেহ, কাজল কালো চুল এবং
মায়াবী চেহারা ছাত্রদেরকে আকর্ষণ করত। কেউ কেউ অতি আগ্রহী হয়ে ম্যাডামের খোঁজখবর
নিতে গিয়ে এই জেনে মনঃক্ষুন্ন হন যে তিনি বিবাহিতা অর্থাৎ তালাবদ্ধ। এমবিএতে
আমাদের শিক্ষার মাধ্যম ছিল ইংরেজি, এখানে বাংলার কোন স্থান ছিলনা। আমি যেহেতু একজন
ক্ষুদে ব্যবসায়ী ও ব্যাংকের চাকুরীজীবী, তাই ফাঁকিবাজি না করে যতটুকু সম্ভব শেখার
চেষ্টা করি। কারণ এই শেখাটা আমার চাকুরী ও ব্যবসায় কাজে লাগবে।
এমনই করে করে ২০১৪ সালের এক
বসন্ত রাতে শেষ সেমিস্টার চুড়ান্ত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হল। সেইসাথে নবীন প্রবীণ
পঞ্চাশ/ষাট জন শিক্ষার্থীর সুদীর্ঘ দুই বছরের এই শিক্ষাসংঘটির মৃত্যু সংঘটিত হল
এবং আমরা ষাটজন ঘনিষ্ঠ মানুষ ষাটদিকে হারিয়ে গেলাম। প্রতি সাপ্তাহে ক্লাস টেস্ট,
কেইস স্টাডি, সলিউশন পেপার ইত্যাদি নিয়ে বেশ ব্যস্ত থাকি। প্রতি সেমিস্টার চুড়ান্ত
পরীক্ষা ছিল বেশ কঠিন মাথাব্যথার কাজ। আসলেই এখানে বেশ মাথা ঘামাতে হত, তাই অনেকে
ভর্তি হয়ে দুই এক সেমিস্টারের মধ্যে ঝরে পড়ে। শেষমেশ চুড়ান্ত পরীক্ষা দিয়ে মনে হল যাক
দুই বছর ধরে কাঁধে চেপে বসা একটি ভারী বোঝা নেমে গেছে। সেইসাথে নিজেকে বেশ হালকা ও
ভারমুক্ত মনে হল।
এবার আমি পূবালী ব্যাংক লিমিটেডের
কয়েক বছরের ধারাবাহিক ব্যলেন্স সিট বই সংগ্রহ করি। আমার অফিসের শাহজালাল
বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র এমবিএ ক্লাশের শিক্ষানবিস তুষারকে নিয়ে আমি একটি
প্রজেক্ট প্রফাইল নির্মাণে হাত দেই। ‘পুবালী ব্যাংক লিমিটেড- ব্যবসা ও প্রশাসন’
নামে পূবালী ব্যাংকের উপর প্রায় শত পৃষ্টার একটি প্রকল্প পরিকল্পনা প্রণয়ন করি। ব্যাংকের
ইতিহাস, প্রশাসন ও ব্যবসা হতে শুরু করে সময়ের সাথে উন্নয়নের বিবর্তন ও বর্তমান
অবস্থা কিছুই তাতে বাদ পড়েনি। কম্পিঊটারে লেখা পাতাগুলো প্রিন্ট করে মোহাম্মদি
অফসেট প্রেসে নিয়ে একটি ঝকঝকে বইয়ে পরিণত করি। এক বিকেলে আমি ক্যাম্পাসে গিয়ে এই
বইটি নির্ধারিত শিক্ষক আব্দুল লতিফের কাছে জমা দিলাম। কিছুদিনের মধ্যে তিনি আমাকে
এই বিষয়ে সাক্ষাৎকার দিতে ডাকলেন। সেই একই দিন ভাইবা দিতে খুব সেজেগুজে এসে আমাদের
পুবালী ব্যাংকের সুন্দরী কর্মকর্তা সুপ্রভা চক্রবর্তী সুমী। ইন্টারভিউ নেন আমাকে
চিনতে না পারা এইচএসসি সহপাঠী আব্দুল লতিফ
এবং আমার পাড়ার খান মোঃ মহিউদ্দিন বাহার। কিছুদিন পরই দুই বছরের পরিশ্রমের ফসল
এমবিএ সার্টিফিকেট আমার হাতে এসে গেল।
আমার এতদিনে এমবিএ লাভের রণ হল
ভঙ্গ, খেলা হল সাঙ্গ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন