বরইকান্দি
শাখায় বিদায়বেলার দিনগুলোঃ
তখন কিছুদিনের জন্য পুবালী
ব্যাংকের সিলেটের অঞ্চল প্রধান হয়ে আসেন দিলীপ কুমার পাল। একদিন অফিস খোলার আগ
মূহূর্তে তিনি বরইকান্দি শাখা পরিদর্শনে আসেন। আমার এত বছরের ম্যানেজারি জীবনে এই
প্রথম সেদিন অফিসের চাবী ভুলবশত বাসায় রেখে আসি। মোটর সাইকেলে আরিফ সাহেবকে বাসায় পাঠিয়ে
সাথে সাথে চাবী আনাই। এই ঘটনার কয়েকদিন পর একদিন অঞ্চল প্রধান দীলিপ বাবু ফোন করে
আমাকে বললেন, কুরেশী সাহেব আমি আপনাকে আমার কাছে নিয়ে আসব। আমি ইতিমধ্যে এমবিএ
করেছি, মনে হল একটু টেনশন মুক্ত হলে আঞ্চলিক অফিসে বসে ব্যংকিং ডিপ্লোমা করে ফেলব,
যা ভবিষ্যতে আমার পদোন্নতিতে সহায়তা করবে। দরগাগেইট শাখায় আমি দুই বৎসর কাজ করেছি।
এই শাখার প্রতি আমার একটা দুর্বলতা ছিল। ভাবলাম পরে না হয় দরগাগেইট শাখায়
ব্যবস্থাপক হয়ে চলে যাবো। কিন্তু আমার সেই স্বপ্ন আর কোনদিনই বাস্তব হলনা।
২০১৩ সালের ডিসেম্বর। একদিন অফিস
হতে বাসা ফিরছি। আমি ও আমার শাখার ক্যাশ অফিসার ফয়সল আহমদ রিকাবীবাজারে এসে একসাথে
হাটতে থাকি। ফয়সল বলল স্যার এই ফার্মেসিতে আমার বাবা ডায়বেটিস টেস্ট করান। সাথে
সাথে আমি এই ফার্মেসিতে ঢুকে পঞ্চাশ টাকা ফি দিয়ে আমার ডায়বেটিস টেস্ট করি। এই
টেস্টে আমার সুগারের মাত্রা ধরা পড়ে ৮.২০। এবার ফার্মাসিস্ট
বললেন আপনার ডায়বেটিস প্রায় হয়েই গেছে, তবে একদম প্রাথমিক অবস্থায় আছে। চিকিৎসক
দেখান এবং এখন হতে সাবধান হয়ে যান।
বাসায় এসে আমার চিকিৎসক বেগম
সাহেবাকে সব বললাম। আমার ভাগনা ডাঃ মুফতি মোঃ শামস কিছুদিন আগে ঢাকার বারডেমে
ডায়বেটিস রোগের উপর বেশ পড়াশোনা করে আসে। তার পরামর্শ নিলাম। সে কোন ঔষধ না দিয়ে
আমার খাদ্যব্যবস্থা ও জীবনব্যবস্থা বদলে দিল। তার বর্ণিত জীবন ব্যবস্থা মেনে চলা
শুরু করলাম। মিষ্টি একেবারেই ছাড়লাম, শর্করা আগের চেয়ে অর্ধেকেরও বেশী কমিয়ে
দিলাম। এভাবে বছর দেড়েক ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকলেও পরে আর কাজ হয়নি।
এবার তার পরামর্শে প্রতিদিন ৫০০
মিলিগ্রাম মিটফরমিন খাওয়া শুরু করলাম। আজ ২০২০ সালে এই মিটফরমিন ক্রমে ক্রমে বেড়ে
প্রতিদিন ১৫০০ মিলিগ্রামে এসে দাড়িয়েছে। আমার ভাগ্না ডাঃ মুফতি শামসের পরামর্শ হল
আমাকে তিনটি ‘ডি’ আমৃত্যু পালন করতে হবে, ডি-১ ড্রাগ (চিকিৎসকের নির্দেশ মত) ডি-২
ডায়েট (শর্করা কমাতে হবে ও সুগারের লোভ মন হতে মুছে ফেলতে হবে, দিনে তিন বেলার
পরিবর্তে অল্প অল্প করে পাঁচ ছয়বার খেতে হবে) ডি-৩ ডিসিপ্লিন (হালকা ব্যায়াম ও ৩৫
মিনিট জুরে হাঁটা, যথা সময়ে ঘুম, খাওয়া ও দুশ্চিন্তামুক্ত থাকা)।
৩১ ডিসেম্বর ২০১৩ সাল। এইদিন
হেতিমগঞ্জ ড্রিমল্যান্ড এমিউজমেন্ট পার্কে আমাদের নর্থইস্ট মেডিক্যাল কলেজ এন্ড
সার্ভিসেসের বাৎসরিক সাধারন সভা (এজিএম) অনুষ্ঠিত হয়। এই পার্কের প্রায় সব পরিচালক
আমাদের নর্থইস্টেরও পরিচালক। এখানে তারা নতুন ওয়াটার পার্ক স্থাপন করেছেন। আমরা
সপরিবারে প্রায় সব পরিচালক গোসলের কাপড় চোপড় নিয়ে যাই। ডাঃ হাফিজ স্যার কিছুদিন
আগে অস্ত্রপ্রচার করে আসেন। বেশ সাহসী তিনি, আমি ও জেফার একটি প্লাস্টিক কাটামোতে
শুয়ে ত্রিশ চল্লিশ ফুট নিচে বহমান পানির সাথে দ্রুতগতিতে পিছলে পড়ি। জলবহা
প্লাস্টিকের নালাপথে বাচ্চারা পিছলে নিচের হাটুজলে এসে পড়ে। যান্ত্রিক সীবিচে
কৃত্রিম ঢেউ ও বাতাসে জলক্রীড়া করে আমরা দিন পার করি। ডাঃ হেলাল ভাই, ডাঃ নাজমুল
ভাই, ডাঃ মাসুক ভাই, ডাঃ শাহরিয়ার ভাই, ডাঃ কাজী আখতার ভাই, ডাঃ নিজাম জাহিদ ভাই,
ডাঃ ফরহাত মহল আপা, ডাঃ গোলশান জাহান আপা, ডাঃ নাহিদ ইলোরা আপা প্রমুখ সপরিবারে
আসেন। আমাদের ছেলেমেয়েরা ও আমরা ওয়াটার পার্কের সদ্য স্থাপিত জলরাজ্যে সারাদিন পরম
আনন্দে ঝাপাঝাপি করে দিন কাটাই। দিনভর ভাল ভুরিভোজ ও চা নাস্তা হয়। আমাদের
সন্তানেরা এখানকার সবগুলো রাইড নিজেদের ইচ্ছেমত উপভোগ করে।
আগের রাতে যখন আমার ব্যাংক শাখার
বাৎসরিক হিসাব সমাপ্ত হয়, তখন দেখি আমাকে দেওয়া চারটি লক্ষ্যমাত্রাই অর্জিত হয়ে
গেছে। যা আমাকে বেশ আনন্দ দেয়। আসলে ২০১৩ সালের শেষদিনটি বেশ উপভোগ্য হয়ে আমাদের
কাছে ধরা দেয়।
প্রথম সাপ্তাহ, জানুয়ারি ২০১৪
সাল। একদিন নবঘটিত সিলেট ইস্ট আঞ্চলিক অফিসে বদলির আদেশ আমার হাতে এলো। লাউয়াই
গ্রামের মাজার টিলার পশ্চিমের বাড়ির খালেদ ভাই আমার বদলির খবর শুনে আমাকে তার
বাড়িতে সপরিবারে খাওয়ার দাওয়াত দেন। তার মাতা আমার গ্রামের মুল্লাবাড়ির কন্যা।
আমাদের মুল্লাবাড়ির বাসিন্দাদের মত তার ব্যবহার ভদ্রতা ও শিষ্টাচারে
ভরপুর। তিনি যে আমার গায়ের মেয়ের একমাত্র পূত্রধন। তিনি কর্মজীবনের একটি বড় সময়
সৌদি আরবে কাটিয়ে এখন দেশে স্থিত হন। তার বাড়িটি সিলেট শহরের একেবারে কাছে হলেও
গ্রামের বাড়ির মত বড়সড় পরিবেশে গড়া টিনের পাকা ঘর। বাড়িতে ফুল বাগ, ফল বাগ, সবজি
বাগান সব আছে।
এবার লাউয়াই গ্রামের মোস্তাক
ভাইয়ের বাড়িতে দাওয়াত পেলাম। এই বাড়িটি খালেদ ভাইয়ের উত্তরের পাকা ওয়ালঘেরা বড় বাড়ি।
মোস্তাক ভাই ও তার দুই বোনের অনেক এফডিয়ার আমার হাতে করা হয়। তারা আমার বেগমের
হাওয়াপাড়ার খালাতো বোন সালেহা আপার আত্মীয়। এখানে প্রচুর খাওয়া দাওয়া হল, সেইসাথে
আসার সময় তাদের গাছের পাকা কূল, পেঁপে, শাক-সবজি উপহার এলো। এই
গ্রামের মুরব্বী শাহান মিয়া একজন আকর্ষনীয় চরিত্র। তিনি সাউথ সুরমা স্কুল কমিটির মেম্বার ছিলেন। তিনি আমাকে ভালবাসতেন। আমার বেগম অসুস্থ হয়ে অশান্তি করলে
তিনি আমাকে বললেন ম্যাডামকে একদিন আমার বাড়িতে নিয়ে আসেন। আমার বেগমের কাছে আসলে
তার অশান্তি দূর হয়ে যাবে। তার বেগম সাহেবা কোর্মা পোলাও বিরুইন ভাত ও নানাপদের
খাবার তৈরি করে আমাদের আপ্যায়ন করেন।
সিলামের সানোয়ার আলী ও মনমোহন বাবুর
কাছে আমার কিছু টাকা পাওনা ছিল। তাদেরকে তাগদা দিয়েও আমি এই টাকা আদায়ে ব্যর্থ হই।
একদিন শাখার মুরব্বী মনমোহন বাবু বললেন আমরা স্যারকে একটা মখতছর অনুষ্টান করে
বিদায় জানাব। একথা শুনে আমার কিছুটা খারাপ লাগল, সুদীর্ঘ্য চার বছর এখানে সাফল্যের
সাথে ম্যানেজারী করলাম- এখন এই ‘মখতছর’ বলে সে কি বুঝাতে চাইছে। এই মনমোহন বাবু বছর
দেড়েক আগে এ শাখায় ক্যাশ ইনচার্জ হয়ে আসার পর থেকে আমাকে বেশ জ্বালাতন করতেন।
প্রায়ই বলতেন ক্যাশ সর্ট হয়ে গেছে, নয়ত জাল নোট নিয়ে এসে হাজির হতেন। তার ক্ষতি
পুষিয়ে দেবার জন্য জোকের মত আমাকে চেপে ধরতেন। আমার চেয়ে বার তের বছরে প্রবীন মুরব্বী
লোক মনমোহন বাবুকে কিছু বলাও যেতনা। অনেকবার আমি নিজের পকেট হতে অনেক টাকা তাকে
ভর্তুকি দিয়েছি।
নতুন ব্যবস্থাপক সৈয়দ ফয়জুল হক
দুইদিন আগে এসে দ্রুত চার্জ গ্রহন করেন। বিদায়ের দিন সন্ধ্যায় এক সাধারন বিদায়সভা
হল। অফিসের স্টাফ ও নিত্য আসা দশবার জন কাস্টমার এলেন। সামান্য চানাস্তা
স্মৃতিচারন- এই শেষ।
আমার সেকেন্ডম্যান আমিনুল ইসলাম
এই এত দায়সারা গোছের অনুষ্টান দেখে আমার কাছে লজ্জা পেয়ে কানে কানে বলল- স্যার, ক্যাশ
ইন চার্জ মনমোহন বাবু আপনার বিদায় সম্বর্ধনার কথা বলে কাস্টমারদের কাছ থেকে প্রচুর
টাকা তুলে আত্মসাত করে ফেলেছে, আমাদেরকে সে কোন হিসাব নিকাশই দেয়নি।
আমিনুলকে বললাম এখন আমার যাবার বেলা,
কাস্টমারদের কাছ থেকে বিদায়বেলায় আমার নাম বেচে টাকা উঠাতে মনমোহন বাবুকে কে বলেছে?
আমিনুল বলল, কেউ বলেনি, তিনি নিজ থেকেই একাজ করেছেন।
মনে সুতীব্র ক্ষোভ হল- আমার
বিদায়কে উপলক্ষ্য বানিয়ে মুরব্বী ক্যাশ ইন চার্জ মনমোহন বাবু কেন কাস্টমারদের কাছে
ভিক্ষে করে তার পকেট ভারী করবে?
মনে পড়ে গেল, আমার পত্নী ডাঃ নুরজাহানের অপারেশনে ঢাকার স্কোয়ার হাসপাতালে
প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকা খরচ হলেও পূবালী ব্যাংকের স্টাফ
ওয়েল ফেয়ার ফান্ড কিংবা সি এস আর ফান্ড হতে এক টাকাও সাহায্য চাইনি। আমি তো এক আল্লাহ ছাড়া কারো কাছে কোনদিন কিছু চাইতে যাইনি, আর আমার বিদায়
সুম্বর্ধণার জন্য ভিক্ষে। আল্লাহর অপার মেহেরবানীতে আমরা সারাজীবন কেবল ভিক্ষে
দিয়েছি, কখনও ভিক্ষে নেইনি। ছিঃ ছিঃ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন