সোমবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

বাউল আরকুম শাহের মাযার পরিদর্শনঃ

 

বাউল আরকুম শাহের মাযার পরিদর্শনঃ

‘সমুদ্রের জল উঠে বাতাসের জুরে/ আবর হইয়া ঘুরে পবনের ভরে/ জমিতে পড়িয়া শেষে সমুদ্রেতে যায়/ জাতেতে মিশিয়া জাত তরঙ্গ খেলায়’। ‘ও মন চুয়ারে একবার পিঞ্জিরায় আও দেখি’। ‘কৃষ্ণ আইল রাধার কুঞ্জে, ফুলে পাইলা ভোমরা/ ময়ুর বেশেতে সাজুইন রাধিকা’। ‘বাউল আরকুমে কইন মুর্শিদও বানিয়া, দুয়াং পাতাইয়া থইছে উলুরে গাথিয়া/ উলুরে খাইতে যদি না যাইত মন, না লাগিত প্রেমের লাঠা না হইত মিলন’। শৈশবে বাউল আরকুম শাহের অনেক গান আমি শুনেছি। বরইকান্দি শাখা হতে তার মাজার খুব একটা দূরে নয়। আরকুম শাহ শিল্পী গোষ্টির লোকজন আমার অফিসে আসেন। আরকুম শাহের মাযারের খাদিম তারই ঘনিষ্ঠ রক্তের একজন ভদ্রলোক ব্যাংকে প্রায়ই আসতেন। আমি তার কাছে আমার এই প্রিয় শিল্পী সম্পর্কে জানার চেষ্টা করতাম।

আমি বরইকান্দি শাখা ছেড়ে আসার আগে একদিন আরকুম শাহের মাজার দেখার সিন্ধান্ত নেই। সময়টা ছিল শীতকাল, আমি দুপুরে খাওয়া শেষে একাকি হেঁটে হেঁটে সিলেট ঢাকা রোড দিয়ে অগ্রসর হই। ‘আরকুম শাহের(রহঃ) মাজার’ লিখা একটি টিনের সাইনবোর্ডের তীর চিহ্ন দেখে আমি পশ্চিমের একটি রাস্তা দিয়ে ঢুকে যাই। গ্রামটি সিলেটের এক বিখ্যাত জনপদ ধরাধরপুর। এই সুদীর্ঘ্য গ্রামটি ঢাকা-রোড হতে সুদূর সুরমা-নদী পর্যন্ত প্রসারিত। জনতার কাছে পথ চিনে নিয়ে অল্প সময়ের মধ্যে আমার প্রিয় বাউলের মাজারে হাজির হলাম। আমি এবার এই মাজারে আমার অনুসন্ধিৎস্নু চোখ রাখলাম। প্রায় এক একর জায়গাজুড়ে মাজার এলাকা বিস্তৃত। গেট দিয়ে ঢুকেই একটি পুকুর, যে পুকুরের স্বচ্ছ জল টলটল করছে। ছোট্ট ঘাট দিয়ে নেমে প্রথমেই অজু করলাম। এই পুকুরের দক্ষিণপারে আরকুম শাহ মাজার মসজিদ। এই মসজিদে বাউল আরকুম শাহ নিয়মিত জামাতে নামাজ পড়তেন, ইবাদাত বন্দেগী করতেন। এই নির্জন মসজিদে আমি একাকি আসরের নামাজ পড়লাম।

পুকুরের উত্তরপারে আরকুম শাহের বাড়ি ও আখড়া। বাউল আরকুম শাহের আখড়ায় তার ব্যবহৃত ডেগ-ডেসকি, জামা কাপড়, কাট বাশের জিনিসপত্র দেখলাম। তার আমলের শিন্নির বড় বড় ডেগ দেখে মনে হল তিনি জীবিত থাকাকালে মানুষকে খাওয়াতে ভালবাসতেন। একটি কক্ষে একটি বিশাল তৈলচিত্র দেখলাম। এই তৈলচিত্রটি একটি পর্দা দিয়ে আয়নার মত ঢেকে রাখা হয়েছে। বাশের লাটি দিয়ে পর্দাটি সরিয়ে আমি বাউল আরকুম শাহের এই তৈলচিত্রটি ভালভাবে দেখলাম। একজন দাড়িওয়ালা পাঞ্জাবী পরা পহেজগার লোকের প্রতিবিম্ব। আখড়ার পশ্চিমে একটি পাকা ঘরের ভিতর তার মাজার শরীফ। মাজারের বাহিরে তার বেশ কয়েকজন শিষ্যের পাকা কবর রয়েছে।  বাউল আরকুম শাহ আমার পিতামহের আমলের লোক। তার মাজারে হেঁটে মনে হয়েছে, বাউল আরকুম শাহ একদিকে ছিলেন একজন মানবতাবাদী বাউল, অন্যদিকে একজন শরিয়ত মানা আলেম। তিনি ইসলামের পাঁচ ফরজ খুব কঠোরভাবে পালন করতেন, মসজিদে বসে এবাদতি করতেন আবার পাশের আখড়ায় বসে নিয়মিত সঙ্গীতচর্চা করতেন। তার সঙ্গীতের বিষয়বস্তু ছিল সুফিবাদ ও ভাববাদ। তিনি ১৮৭৭ সালে সিলেটে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৪১ সালে এখানেই দেহত্যাগ করেন। ইসলামের শরিয়ত ও মারেফতের সাগরে ডুবসাঁতার কাটা এই মহান বাউলের মাজার জিয়ারত করে এক অনাবিল মানসিক প্রশান্তি নিয়ে শেষবিকেলে আমি বরইকান্দি শাখা, লাউয়াই, ফিরে আসি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন