অতিথি পাখি দর্শনে শ্রীমঙ্গলের বাইক্কার বিল ভ্রমণঃ
২০১৪ সালের শীতকাল। সুদীর্ঘ শীতার্ত
প্রভাত জুড়ে ঘন কুয়াশা ঝরে, ফুল ঘাস লতা পাতা শিশিরে ধুয়ে পরিস্কার হরিৎ রঙ্গ ধারন
করে। মাথায় উপর দিয়ে আকাশ ছেয়ে দক্ষিন দিকে সারি বেঁধেবেঁধে অতিথি বলাকারা উড়ে
যায়। সুর্যের মুখ ৯টা বাজার আগে দেখাই যায়না। নেচারের খবর আমাকে টানে, ‘দৈনিক
প্রথম আলো’ পত্রিকায় একদিন দেখি বাইক্কার বিলের অজস্র অতিথি পাখির ঝাঁকের মনকাড়া
ছবি। দিন দুয়েকের মধ্যে আর কিছু পত্রপত্রিকায় বাইক্কার বিলে আমাদের সাইবেরিয়ান
মেহমানদের উড়াউড়ির আর কিছু দৃশ্য ও প্রতিবেদন পাই।
প্রকৃতিতে স্রষ্টার এক
অনিন্দ্যসুন্দর সৃষ্টি পাখি, বিচিত্র রঙের বিচিত্র বিহঙ্গের দল যখন নানা সুরে গান
গায়, রঙ্গীন ডানামেলে বাতাসে ভাসে তখন আশপাশে যেন স্বর্গের ছোঁয়া নেমে আসে। আমার
বেগম সাহেবাকে বললাম তৈরী হও, চলনা আগামী শুক্রবার আমরা বাইক্কার বিল যাই। দুই
হাজার মাইল দূরের তিব্বত ও সাইবেরিয়া হতে আসা আমাদের প্রিয় মেহমান পাখিদের
কলকাকলিতে একটু শরীক হই। অন্ততঃ একটা দিন ওদের ভালবাসায় নিজেকে বিলিয়ে দেই।
আমার শখের ছোট্ট লালাকার যে
আমাকে বারবার নিয়ে যায় বনে-বাদাড়ে জলা-ডুবায় নদীর কিনারায় এবং চাবাগানের টিলায়। আজ
কুয়াশাঝরা এক ঝাপসা ভোরে চাবিস্কুট খেয়ে কারটি আমাকে নিয়ে ছুটল আমার প্রিয় শহর
মৌলভীবাজার। এই সুন্দর শহরটিতে এসে আমরা অনুজ নিশাতের শ্বশুর এডভোকেট তজম্মুল
হোসেনের কাজিপাড়ার বাসায় যাই। তিনি মৌলভীবাজার জেলাবারের সভাপতি। তিনি ও তার দুই
মেয়ে ঝুমা-তামান্না আমাদেরকে খুব আপ্যায়ন করেন। সময় অপচয় নাকরে বাংলাদেশের চা
স্বর্গ ও পর্যটন নগরি শ্রীমঙ্গলের দিকে এবার গাড়ির নিশানা ঠিক করি। বাইক্কার বিল
কোথায় আমার তা জানা ছিলনা। আমাদের মহাব্যস্থাপক আহমদ এনায়েত মঞ্জুরের গিয়াসনগর জমিদার
বাড়ি পার হই। ভৈরববাজারে গাড়ি থামিয়ে জনতার কাছে জানলাম সামনে বরুনা মাদ্রাসার
রাস্থা দিয়ে বেশ ভিতরে ঢুকে বাইক্কার বিল। তারা বলল সড়কটি মেঠোপথ হলেও কার চালিয়ে
নিতে কোন অসুবিধে হবেনা।
চলন্ত কার হতে রাস্থার
পশ্চিমদিকে একসময় বরুনা মাদ্রাসার সাইনবোর্ড দেখতে পাই। কিছুক্ষণ পিচ রাস্থা দিয়ে
গিয়ে সামনে প্রসিদ্ধ দীনি প্রতিষ্ঠান বরুনা মাদ্রাসায় এসে গাড়ি থামাই। বিশাল
এলাকাজুড়ে কয়েকটি বহুতল ভবন ও একটা বড়পুকুর পাকা দেওয়ালে আবদ্ধ। পবিত্র জুমুয়ার
নামাজ বরুনা মাদ্রাসার বহুতল ভবনের মসজিদে আদায় করি। বরুনা মাদ্রাসা হতে বাইক্কার
বিলের অবস্থান বড়জুর দেড়দুই মাইল হবে।
শীতের বৃষ্টিহীন দিনের উঁচুনিচু
শক্তজমাট মেঠোপথে কার চালিয়ে আমরা বাইক্কার বিলের সীমানায় ঢুকলাম। সড়কের দুপাশে
একটার পর একটা বিল ও মৎস্যখামার। বাঁধে বাঁধে পল্লবঘন বৃক্ষরাজির সারি। এবার কার
রাস্থার পাশে লক করে হেঁটে হেঁটে সামনে ছুটলাম। দুপাশের বৃক্ষের শাখায় শাখায় শত শত
অতিথি পাখি কিচিরমিচির করছে। একটা ঝনঝন মধুশব্দে এই নির্জন প্রান্তর মুখরিত। একপাল
বুনোহাস দলবেঁধে উড়ে এসে ঝিলের জলে ঝাপ দিচ্ছে, অন্যদল ঝাঁকবেধে আকাশে উড়াল
দিচ্ছে। আমার পুত্র জেফার মনের আনন্দে উড়ন্ত বলাকাদলের অনেক অনেক ছবি ওঠালো।
বিহগের গানে উড়ালের ঐক্যতানে বিমুগ্ধ আমরা হেঁটে হেঁটে প্রায় এক কিলোমিটার পথ পার
হলাম। এখানে আমাদের সরকার পাখি দেখার একটি ওয়াচ-টাওয়ার ও প্রদর্শনি কক্ষ স্থাপন
করেছেন। জলাবন ও ঝোপঝাড়ের মাঠ পেরিয়ে টাওয়ার যাই। সিড়ি বেয়ে বেয়ে সুউচ্চ টাওয়ারে
আরোহন করি। এই টাওয়ারে এখানে আসা সব প্রজাতির পাখিদের নামসহ সুন্দর তৈলচিত্র রয়েছে।
এবার দূরবীনে চোখ রাখি। অনেক দূরে বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে বুনো হাসের দলকে সাতার কাটতে
দেখি। দুরবিনের সামনে জলে-স্থলে—বৃক্ষে-আকাশে
কেবল হাস আর হাস, পাখি আর পাখি। ঝাঁকে ঝাঁকে শামখৈল, পাতি সরালি, পানকৌড়ি, গাংচিল,
বালিহাঁস, চখাচোখিসহ নানা প্রজাতির অতিথি পাখিরা বাইক্কার বিলের প্রশান্ত জলে সাঁতার
কাটছে, উড়াল দিচ্ছে, গান গাইছে, ডুব দিয়ে জলের ভিতর হতে খাবার তুলছে, জলে ঝাপ্টা
দিয়ে স্নান করছে। আহা কি নয়নাভিরাম দৃশ্য।
ভাবলাম বাইক্কার বিল, পাখিদের
অভয়াশ্রম, আমার দেশে গর্ব করার মত একটি বিহঙ্গ রাজ্য। পৃথিবীর অনেক দেশে আমি অনেক পাখি
দেখেছি কিন্তু বাইক্কার বিলের মত এত জলহাস, এত পাখির সমাবেশ অন্য কোথাও দেখিনি।
পাখি মহান আল্লাহের এক অনন্য সৃষ্টি, তাই পাখি ভালবাসা প্রকারান্তে মহান আল্লাহকেই
ভালবাসা। নিষ্টুর মানুষ কেমন করে আশ্রয় নেয়া এসব নিরিহ মেহমানদের হত্যা করতে পারে,
ওদের বিবেক কি কেঁপে ওঠেনা।
নিজেকে দোষ দিলাম এতকাল কেন এই
পাখিদেরে আমরা ভালবাসা ও শ্রদ্ধা জানাতে এলাম না। কেন এত দেরী হল, কেন এই অতিথিদের
সাথে এতদিন- ‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হতে বাইরে দুপা ফেলিয়া’।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন