সোমবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

বরইকান্দি শাখায় দেখা লোকজনের গল্পঃ

 বরইকান্দি শাখায় দেখা লোকজনের গল্পঃ

দক্ষিন সুরমার বলদি গ্রামের একজন দিলদরিয়া মানুষ আমাদের প্রিয় আব্দুল আহাদ ভাই। বরইকান্দি শাখা ছেড়ে এসেছি সে অনেকদিন, কিন্তু ভূলতে পারিনি আমার আহাদ ভাইকে। আরবি ছাট দাড়ি, সাদা পাজামা পাঞ্জাবি পরে আহাদ ভাই এসে আমার সামনে বসেই টিবয় সবুজকে ডাক দিতেন- সবুজ ! এই নোট নে, চা সিঙ্গারা নিয়ে আয়। আহাদ ভাই ধার্মিক আল্লাহওয়ালা লোক। হাসি-মুখ আহাদ ভাই, পকেটে টাকা আছেতো কুচ পরওয়া নেহি তার। খুব পরিশ্রমী লোক আহাদ ভাই, শৈশবের হীন ও দরিদ্র অবস্থা হতে কঠোর পরিশ্রম ও সদগুণের মাধ্যমে ধনে-জনে-মানে-সম্মানে অনেক উচ্চতায় উঠে আসেন।  

আহাদ ভাই একটি বড় ইটভাটার মালিক। সিলেট বিমানবন্দরের পাশে সালুকটিকরে তার বিশাল ইটবাটি। ইটভাটির আশপাশে অনেক জমিজামা কিনে তিনি সেখানকারও একজন জমিদার হয়ে যান। সেখানে তিনি মসজিদ মাদ্রাসা করেছেন, সালুকটিকর কলেজে বেশ অনুদান দেন, তিনি সেই কলেজ কমিটির একজন সম্মানিত সদস্য। আমি তাকে ঋন দিতে চাইলে তিনি বলতেন, ম্যানেজার সাব, আমি ঋণকে ভীষণ ভয় পাই, খুব বাধ্য নাহলে ব্যাংক ঋন নেই না। ব্যাংকঋন রাত পোহালেই বাচ্চা দেয়, ব্যবসার সব লাভ খেয়ে ফেলে।

আমি বরইকান্দি ছেড়ে চলে আসার বছর খানেক আগে আহাদ ভাই বললেন, ম্যানেজার সাহেব আমাকে ব্যাংক হতে দশ লক্ষ টাকা দিতে পারবেন? আমি তিন মাসের মধ্যে পরিশোধ করে দেব। আমি আহাদ ভাইকে বললাম, আহাদ ভাই আমিতো আপনাদেরকে টাকা দেবার জন্য বসে আছি। তবে তিন মাস নয়, এই টাকা আপনি দুই বৎসরে ফেরত দিলে চলবে। আহাদ ভাই বললেন, না দুই বৎসর না, ঋণকে আমি ভয় পাই, আমি তিন চার মাসের মধ্যে ফেরত দেবো। হ্যাঁ, ঋন পেয়ে তিনি তাই করলেন।

আমি অঞ্চলপ্রধান মোসাদ্দিক স্যারের সাথে আলাপ করে খুব স্বল্প সময়ের মধ্যে দশ লক্ষ টাকার একটি এসএমই ঋন বরাদ্ধ করে দিলাম। টাকাটা পেয়েই আহাদ ভাই টিটি করে টাকাটা আমাদের ব্রাহ্মণবাড়িয়া শাখায় দুইজন মানুষের হিসাবে পাঠিয়ে দেন। টাকা কোথায় পাঠালেন জানতে চাইলে বললেন, দুই জন লেবার সর্দারের হিসাবে পাঠিয়ে দিয়েছি। তারা গ্রামের দুইজন ইউপি সদস্য। এখন টাকা না পাঠালে পরবর্তী মৌসুমের ইট তৈরির লেবার পাওয়া যাবেনা। বললাম, কোন সাক্ষী প্রমান ছাড়াই এত টাকা দিয়ে দিলেন? আহাদ ভাইয়ের সপ্রতিভ জবাব এভাবে প্রতিবছর পাঠাই কোনদিন সমস্যা হয় নাই।

আল্লাহর অশেষ মেহেরবানীতে আহাদ ভাইয়ের ব্যবসায় সীমাছাড়া লাভ হয়। আহাদ ভাই বারবার লন্ডন যান, উমরায় যান। প্রতিবার তার বিদেশযাত্রা উপলক্ষে বন্ধু বান্ধব স্বজনরা জড় হন। দেশী মোরগ গরু খাসী জবাই হয়, চিতলের কুপ্তা রান্না হয়। দল বেঁধে লোকজন এসে খেয়ে যান। ব্যাংকের সব লোকজন দাওয়াত পান, তবে আমি দাওয়াত পাই সপরিবারে যাবার। আমি অনেকবার বিবি-বাচ্চা নিয়ে আহাদ ভাইয়ের বাড়িতে দাওয়াত খেতে যাই, এমনকি বরইকান্দি হতে বিদায় নেয়ার পরও গিয়েছি। বাহুল্য বর্জনের জন্য কেবল প্রথমবারের দাওয়াত খাবার বিবরন আপনাদের কাছে বর্ননা করব।

কোন এক শুক্রবার বিদেশযাত্রা উপলক্ষে এক জমকালো মেঝবান উৎসবের আয়োজন করেন আহাদ ভাই। ডাঃ নুরজাহান ও জেফারকে নিয়ে আমি কার চালিয়ে বলদি রওয়ানা হলাম। চন্ডিপুল পার হয়ে সিলেট-ঢাকা মহাসড়ক দিয়ে কিছুদূর এগুলেই একটি রাস্থা বামদিকে ডুকে গেছে। চারপাশে সবুজ মাঠ। সুনীল আকাশের নিচে ভারী সুন্দর কিছু অনুচ্ছ টিলা শিরতুলে নিস্থব্দ হয়ে রয়েছে। ছোট গ্রাম্য রাস্থা বরাবর কার চালিয়ে আহাদ ভাইয়ের বাড়ির গেটে গিয়ে হাজির হলাম। একটি টিলা কেটে সমতল করে বেশ সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশে পাকা ওয়ালঘেরা বাড়িটি নির্মিত। আঙ্গিনা পেরিয়ে ভিতরে গিয়ে গাড়ি পার্কিং করলাম।

‘খুব খুশি হলাম স্যারের সাথে ভাবী সাহেবাও এসেছেন’ বলে আহাদ ভাই এগিয়ে এসে আমাদেরকে অভ্যর্থনা জানিয়ে তার বসাকক্ষে নিয়ে যান। আহাদ ভাইয়ের বসার এক বিশাল কক্ষ, যেখানে ষাটজন মানুষ বসার মত সোফাসেট চারদিকে আবর্তন করে রয়েছে। সামনের মধ্যপ্রান্তে আহাদ ভাই বসায় এক বিশাল সিংহাসন। এমনকি একটি পালঙ্কও এই সিটিংরূমে পাতা আছে। আমি একজন ছোট্ট সিবিল ইঞ্জিনিয়ার, এবার মনে মনে হিসাব করে দেখলাম এই সিটিংরূমে চার বেডরুমের একটি বড় বাসা অনায়াসে ঢুকিয়ে দেওয়া যাবে।

আহাদ ভাইকে বললাম এত বড় সিটিংরূম আমি কোথায়ও দেখি নাই, এই সিটিংরূম দিল্লির লালকিল্লায় আমার দেখা সম্রাট আকবরের দরবার কক্ষকেও হার মানাবে। এবার আহাদ ভাই হেসে বললেন তাই নাকি, আমি বলদির কোন বিচার আচার কিংবা গ্রাম্য সভা যাতে এখানে করা যায় তাই মাথায় রেখে এত বড় সিটিংরূম করেছি স্যার।

আহাদ ভাইয়ের বালকপুত্র মাদ্রাসায় পড়ে। ইসলামি লেবাসপরা একমাত্র পুত্রকে ডেকে এনে আদেশ দিলেন স্যারকে সালাম কর? একটু পর হিজাবে মাথাঢাকা তার ছোট্ট মেয়েটি এসে একটা সালাম দিল। আহাদ ভাইয়ের পরিবারে তিনি জৈষ্ট্য ভ্রাতা হিসাবে তার একছত্র একনায়কত্ব প্রতিষ্টিত। তিনি লাখ লাখ টাকা আয় রোজগার করেন, ছোটভাইদের পরিবারও দেখাশুনা করেন। একান্নবর্তী এই বড় পরিবারের আসল মানিসাপ্লাইয়ারও তিনি। এখানে বেটি মানুষদের মুখে কোন রা নেই, তারা হিজাবের আড়ালে নির্বাক আনন্দে জীবন কাটান। আহাদ ভাইয়ের সুযোগ্য পিতৃসুলভ একাধিপত্যের স্নেহছায়ায় এক বিশাল যৌথ পরিবার এখানে পরম সুখশান্তিতে জীবন পার করছে। এখানে আহাদ ভাই যা আদেশ করেন তাই হয়, যা নিষেধ করেন তা বাতিল বলে গন্য হয়। তবে আহাদ ভাই একজন নিঃস্বার্থ ত্যাগী মানুষ, তার সিন্ধান্তে কারো ক্ষতি নেই, উল্টো সবার ভাগ্যে চন্দন পড়ে।

লোকেরা দলে দলে এসে খাবার সাবাড় করছেন, আর আহাদ ভাই মহানন্দে মেহমানদারী করছেন। ভাবলাম কেউ কেউ কেবল নিজে লুকিয়ে একাকি খেয়ে আনন্দ পায়, আবার কেউবা পকেটের হাজার হাজার টাকা খরচ করে মানুষকে খাইয়ে আনন্দ পায়। এই দুই নম্বর দলের লোকজন আজকালকার যুগে বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতি। আসলে আহাদ ভাই এই দুই নম্বর দলের বিলুপ্তপ্রায় মানুষ্য প্রজাতির একজন।

আহাদ ভাই তার ব্যবসার কাজে প্রায়ই ঢাকায় যেতেন। ঢাকায় গিয়ে আহাদ ভাই এক দারুণ বিপদে পড়তেন, তা জবান দিয়ে শত চেষ্টায়ও সিলেটি আওয়াজ ছাড়া কিছুই বেরুতোনা। একদিন আহাদ ভাই আমার চেম্বারে এসে বসে অভিযোগ করলেন ঢাকায় তিনি পুবালী ব্যাংকের একটি শাখায় অনলাইনে টাকা উঠাতে গেলে ব্যবস্থাপক সাহেব খারাপ আচরন করেন। আমার পত্নী ডাঃ নুরজাহান বেগম চৌধুরী স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকাকালে আমি প্রান্তপথ শাখায় টাকা তুলতে গিয়ে শাখার ব্যবস্থাপিকা সুলতানা সরিফুন নাহার ম্যাডামের উত্তম সেবা পেতাম। ম্যাডাম চানাস্তা করায়ে আপন ছোটভাইয়ের মত আমাকে সাহস যোগাতেন। আমি আহাদ ভাইকে বললাম, আপনি আমাদের প্রান্তপথ শাখায় গিয়ে ম্যাডামের চেম্বারে ডুকে আমার কথা বলবেন, বস আর কিছুই লাগবেনা। ঢাকা থেকে ফিরে আহাদ ভাই আমার চেম্বারে বসে বললেন, যে ভালা একজন হালকা পাতলা সুন্দরী ম্যাডামের কাছে স্যার আপনি আমাকে পাঠাইছেন। বাহ কি চমৎকার ব্যবহার, আমাকে চানাস্তা করালেন, নিজে ক্যাশ হতে টাকা এনে আমার হাতে তুলে দিলেন। এত সামান্যতে যে আহাদ ভাই খুশীতে আটকানা হন, তাকে কেন যে ঢাকার সেই ম্যানেজার মনোঃযাতনা দিলেন তা আমার আদৌ বোধগম্য হলনা।   

এই ছিলেন আহাদ ভাই। মহান আল্লাহ উদারপ্রান আহাদ ভাইয়ের মঙ্গল করুন।       

এই শাখার চেম্বারে বসে আরেক জন মানুষের সাথে আমি পরিচিত হই, তিনি ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাশের গালিমপুর রাস্থার সামনের মার্কেট ও স মিলের মালিক বাবুধন ভাই। আহাদ ভাই প্রতিদিন যেখানে পকেটের টাকা খরচ করে আমাদেরকে চানাস্তা করাতেন, বাবুধন ভাই সেখানে চা বিস্কিট সারতেন ব্যাংকের টাকায়। একদিনও তার পকেটের পয়সায় চা পান করার সৌভাগ্য আমাদের হয়নি। তবে ব্যাংকের কাছে বাবুধন ভাইয়ের গুরুত্ব ছিল আপরিসীম। তার ছিল এক কোটি টাকার সিসি ঋণ, সেই সাথে এক কোটি টাকার একটি স্থায়ী আমানত।  তিনি ক্ষেপে চলে গেলে ব্যাংক হারাবে কোটি টাকার ব্যবসা, সেইসাথে কোটি টাকার ডিপোজিট। বাবুধন ভাইয়ের আরেক পরিচয় তিনি প্রভাবশালী জামাতনেতা ও উপজেলা চেয়ারম্যান মাওলানা লোকমানের চাচাত ভাই। বাবুধন ভাইয়ের জন্ম পাশের ধরাধরপুর গ্রামে, তিনি খুব হিসেবী লোক, তাকে ঠকাবে এমন কোন মায়ের পুত বাংলাদেশে নেই। তিনি তার ঋনের ইনস্যুরেন্স নিজে ইনস্যুরেন্স কোম্পানীর অফিসে গিয়ে করতেন। ইন্সুরেন্সের কমিশন নিজেই মারতেন, এমন কি বাকীতে ইনস্যুরেন্স করে ইনস্যুরেন্স কোম্পানির লোকজনকে নাস্তানাবুদ করে ছাড়তেন। প্রতি বছর তিনি এক একটা নুতন ইনস্যুরেন্স কোম্পানি ধরতেন, কারন পাওনা টাকা অপরিশোধিত থাকায় সাবেক কোম্পানীগুলো আবার তাকে ইনস্যুরেন্স পলিসি দিতে রাজী হতনা। বাবুধন ভাই এমন একজন লোক যিনি এভাবেই বাটপারের উপর বাটপারি করে ছাড়তেন। ইনস্যুরেন্স কোম্পানীর লোকেরা আমার কাছে অভিযোগ করলে আমি বলতাম এটি আপনাদের ব্যাপার, এখানে আমার করার কিছু নেই। দয়াকরে আমাকে এব্যাপারে জড়াবেন না।

বাবুধন ভাইকে হিসাব বুঝানো ছিল বেশ কঠিন কাজ, প্রধান কার্যালয় সুদবৃদ্ধি করলে তাকে বুঝাতে আমরা মহা মুসকিলে পরতাম। তিনি অন্য ব্যাংকের সুদের খবর নিতেন। তবে দেখা যেত অন্য ব্যাংকগুলোর তুলনায় আমাদের সুদ ও ঋন খরচ অনেক সাশ্রয়ী। তার এই চারিত্রিক বৈশিষ্টের জন্য আমার অফিসের লোকজন তাকে সামনে সালাম দিলেও পিছনে ঘৃণা করত। তবে আমি বাবুধন ভাইয়ের ওজন বুঝতাম। আমার এতদিনের অভিঞ্জতা হতে এটি বুঝতে পারতাম যে, বাবুধন ভাইয়ের হাতে কখনও ব্যাংকের টাকা মার খাবেনা। যে সব লোক খুব হিসেব করে ব্যাংকের ঋন নেয় এবং সুদ নিয়ে দর কষাকষি করে তারা কখনও ঋণখেলাফি হয়না, আর বাবুধন ভাই সেই চরিত্রের একজন লোক। তাই আমি বাবুধন ভাইকে চা না খাইয়ে যেতে দিতাম না। বাবুধন ভাই আমাকে খুব স্নেহ করতেন, আমি যতদিন বরইকান্দি ছিলাম, তিনি ততোদিন এখানেই ছিলেন। আমি আসার কিছুদিনের মধ্যেই আমার সবচেয়ে বড় ও নিরাপদ কাস্টমার বাবুধন ভাই বরইকান্দি শাখা ছেড়ে পাততাড়ি গোটান। একদিন আমাকে রাস্থায় পেয়ে দুঃখ করে বললেন, আপনি নেইতো আর আগের সেই ব্যাংক নেই স্যার। আমি চলে এসেছি। আপনি চলে যাবার পর আর এখানে থাকার মত পরিবেশ নেই।  

কিনব্রীজের প্রবেশমুখে আমান ফার্মেসী নামে একটি খেলাফি সিসি ঋন ছিল। সেটেলমেন্ট ও মামলা সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ। আমি ও আমিনুল হক অফিস হতে ফেরার সময় আমান ফার্মেসীতে উঠে দেখা করতাম। জকিগঞ্জের এই লোকটা কাকুতি মিনতি করে আমাদের হাতে মাত্র দুইতিন শত টাকা পরিশোধ করে দিত, যেন ভিক্ষে দিচ্ছে। ঝামেলা হতে বাচতে আমি এই জকিগঞ্জিকে তাদের এমপি এবং আমাদের ব্যাংকের চেয়ারম্যান হাফিজ আহমদ মজুমদারের দরবারে চালান দিলাম। লাভালাভ সব ছাড় দিয়েই সেটেলমেন্ট করা হল যেন ভিক্ষা চাইনা কুত্তা সামলাও। লোকটা ছিড়ে ছিড়ে অনেক দিনে ত্রিশ হাজার টাকা ফেরত দিল কিন্তু লেজারে সবশেষে পাওনা রয়ে গেল মাত্র ৪৪০০/-টাকা। এবার সে পালিয়ে গেল, এই ৪৪০০/- টাকা আর কোনমতে আদায় করা গেলনা। একদিন দেখলাম সেটেলমেন্টের তারিখ চলে যাচ্ছে। এক্সপায়ার ডেট পার হলেই আবার এই সামান্য টাকার জন্য সেটেলম্যান্ট করতে হবে, মামলা চালাতে হবে। অনেক ঝক্কি ঝামেলায় পড়তে হবে। এবার একটি সহজ সমাধানে আসি। একজন হুজুরকে জিজ্ঞেস করি দেউলিয়া লোককে জাকাতের টাকা দান করা যায় কি না। তিনি বললেন দেয়া যায়। এবার আমার জাকাত ফান্ড হতে মেসার্স আমান ফার্মেসির ঋন হিসাবে ৪৪০০/- টাকা দান করে লেজার হতে এই ঋণটিকে চিরদিনের জন্য মুছে দিয়ে এই আপদ হতে প্রানে বাঁচি।

লাউয়াইয়ের বুরহান উদ্দিন ভাই বৃটিশ সিটিজেন। তার অনেক গুণ, তিনি শিক্ষিত কর্মঠ ভ্রমনপিপাসু আদমি। বুরহান ভাই পৃথিবীর ছয়টি মহাদেশ সফর করেছেন। একেকটা দেশ বারবার সফর করেছেন। একাকি বিশ্বভ্রমন করতে গিয়ে মাঝেমধ্যে বিপদেও পড়েছেন। একবার ফিলিপাইনের মান্দানাও দ্বীপে গিয়ে সামুদ্রিক ঘুর্নিঝড়ের কবলে পড়ে মরতে বসেছিলেন। প্রান নিয়ে ফিরে এসে গরুশিন্নি করেন। সুদর্শন স্মার্ট বুরহান ভাইয়ের কথাবার্তা ভদ্র ও মার্জিত। বয়স ষাট পার হলেও তাকে যথেষ্ট তরুণই মনে হত। আমি কোন দেশে রওয়ানা হবার আগে বুরহান ভাইয়ের পরামর্শ নিতাম। বুরহান ভাই আমাকে কোথায় কোন হোটেলে উঠব, কি দেখব, সস্তা ও আরামে কিভাবে ভ্রমন সমাধা করতে পারব সব পরামর্শ দিতেন। আমার নোট খাতায় আমি সব লিখে রাখতাম এবং ভ্রমণে গিয়ে সত্যই উপকৃত হতাম।

দুনিয়ার এদিক ওদিক ঘুরাঘুরি করে সাত আট মাস পরপর বুরহান ভাই দেশে ফিরতেন। বুরহান ভাই অনেক টাকা খরচ করে কেজি ওয়ান হতে ক্লাস-টেন পর্যন্ত একটি উচ্চবিদ্যালয় স্থাপন করেন। লাউয়াইয়ের অনেক ভিতরে ধানক্ষেতে একটি তিনতলা ভবনে এই স্কুলের অবস্থান। প্রতিষ্টানটির নাম বুরহান উদ্দিন একাডেমি। বুরহান ভাই আমাকে তার একাডেমিতে নিয়ে যান। শেষে বুঝলাম নিজ মাতৃভুমিতে নিজেকে ধরে রাখার মত কিছু একটা করার আবেগ তাকে এই কাজে উৎসাহিত করেছে। বুরহান ভাই একদিন বললেন, আমার ছেলেমেয়েরা লন্ডনে উচ্চশিক্ষিত হয়ে বড় বড় চাকুরী করছে। এরা আর কোনদিন বাংলাদেশে ফিরে আসবেনা। সত্য বলতে কি? কুরেশী ভাই জনম মাটি এই বাংলাদেশে তাই আমি নির্বংশ হয়ে গেলাম। এই স্কুল করলাম, এটা হবে বাংলাদেশে আমার একজন সন্থানের মত যে আমাকে ধরে রাখবে। আমি তখন জবাব দিলাম, এই একাডেমি কেবল একজন সন্থান নয়, হাজার সন্থানের চেয়েও অধিক শক্তি নিয়ে আপনাকে যুগেযুগে বাঁচিয়ে রাখবে।

একদিন আমার কানে একটি খবর আসল, বুরহান ভাই তার একাডেমির একজন স্বল্প বয়স্কা শিক্ষিকাকে বিয়ে করে বসেছেন। সামনের লোকজন বললেন, বুরহান ভাইয়ের লন্ডনি টাকা আছে, বিয়ে করছেন তাতে অসুবিধেটা কি? দেশে কেউ নেই, তার এত টাকা খাবে কে? যাক বিয়ে দুজন নরনারীর মধ্যে যদি তাদের পারস্পারিক সম্মতিতে হয়ে থাকে, তবে তা নিয়ে আমাদের এত মাতামাতি করার কি আছে। কিন্তু মানুষ যে সবকিছুতে কৌতুকের স্বাধ নিতে ভালবাসে, তাদের ঠুট কে করাবে চুপ?

লাউয়াইয়ের ফুলর মিয়া সাংবাদিক, তিনি দক্ষিণসুরমা উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। আজ তিনি এই স্কুলের পরিচালনা কমিটির সভাপতি। আমি দায়িত্ব নেয়ার পরই এই স্কুলে যাই ও প্রধানশিক্ষকের সাথে দেখা করি। আমি বেশ অবাক হলাম কাছেই আমাদের ব্যাংক রেখে তাদের সবগুলো হিসাব দূরের সোনালী ব্যাংক স্টেশন রোডে। আমি এখানে প্রভিডেন্ট ফান্ডসহ তাদের সব হিসাব নিয়ে আসার ব্যবস্থা নিলাম। সাংবাদিক ফুলর ভাই আমাকে সাহায্য করলেন। লাউয়াইয়ের খসরু ভাই ইনস্যুরেন্সে চাকুরী করতেন। আমরা প্রতিবেশী হিসাবে তাকে ইনস্যুরেন্স পলিসী দিতাম। শ্যামলা ভদ্র খসরু ভাই আমার একজন প্রিয় মানুষ ছিলেন। ওলী মিয়া লাউয়াইয়ের মুরব্বী। লম্বা ফর্সা ওলীমিয়া তার অসাধারন বুদ্ধিমত্তার গুনে ধনেজনে নিজেকে প্রতিষ্টিত করেন। তিনি লাউয়াইয়ের মসজিদ মাদ্রাসা স্কুল কলেজ সব কমিটির সদস্য। আমার সামনে আসলেই বলতাম, চাচা আপনি দক্ষিন সুরমার মাবাপ। তিনি খুব খুশি হতেন। একদিন তার বাড়িতে চানাস্তার দাওয়াত পাই। পুকুর সহ একটি বড় ট্রিপ্লেক্স বাড়ি যা নির্মানে তিন থেকে চারকোটি টাকা ঝরে যায়। ছেলেরা লন্ডনে, মাত্র একজন ছেলে দেশে। উপরের বদ্ধ কোঠাগুলো ঘুরে ঘুরে দেখে বললাম এই শূন্যতালায় ভূতে বাসা বাধতে পারে। একথা শুনে অলীচাচা কেবল হাসলেন। মুহিবুর রহমান স্টেশন রোডের চারতলা কুশিয়ারা মার্কেটের মালিক। পাশেই তার সুন্দর ডুপ্লেক্স বাড়ি। তার কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবসা কুশিয়ারা ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের নামে একটি খেলাফি ঋন রয়েছে। অর্থ ঋণ আদালতে একটি পুরানো মামলাও সক্রিয় আছে। আমি অনেক পরিশ্রম করে ঋণটি সেটেলম্যান্ট করি। কিন্তু সেটেলম্যান্ট করার পরও কিস্তি আসেনা। আমি ও আমিনুল হক টাকা আদায়ে প্রায়ই মুহিব ভাইয়ের বাসায় যাই। তিনি প্রচুর চানাস্তা করান। তার কথাবার্তা বেশ মনোহর, কিন্তু কিস্তি আদায় খুব কঠিন। তিনি অনবরত গল্প বলেন, অন্যের কথা শুনার চেয়ে তার বলার প্রবনতা বেশী। মুহিব ভাইয়ের বয়স আমার মতই হবে। একদিন অফিসে এসে শুনলাম মুহিব ভাই হার্ট এট্যাক করে মারা গেছেন। বাসায় গিয়ে তার টাটকা লাশ দেখলাম যেন এই সুদর্শন মানুষটি কালো কুকড়ানো একমাথা চুল নিয়ে মহাশান্তিতে ঘুমিয়ে আছেন, আমরা তার ঘনিষ্ট আত্মীয়দের সাথে দেখা করলাম। তিনচার দিন পর মুহিব ভাইয়ের লন্ডন প্রবাসী একজন হুজুর ধরনের বড়ভাই ব্যাংকে এসে আমার সাথে দেখা করেন। ভদ্রলোক লন্ডনে তাবলীগ জামাতের সাথে জড়িত। তিনি বললেন, আমাদের কনিষ্ট ভাই চলে গেছে, আমরা দুনিয়াতে তার কোন ঋন রাখবনা। একটা হিসাব দেন, আমরা পরিশোধ করে দেব। আমি যতটুকু সম্ভব ছাড় দিয়ে হিসাব দিলাম, হুজুর-লন্ডনী ঋণটি বন্ধ করে দেন।  

ডাঃ মিফতাউল হোসেন সুইট, একজন হ্যান্ডসাম চিকিৎসক। এমবিবিএস সার্টিফিকেট না থাকলেও তার রোগীর কোন অভাব নেই। সিলেট স্টেশন রোডের ফয়সল ফার্মেসিতে বসে কোন ভিজিট ছাড়া তিনি প্রতিদিন দুই আড়াই শত রোগী দেখেন। ডাঃ সুইট সাহেবের পুরো পরিবার উচ্চশিক্ষিত। এমনকি তার নিজের বেগমও একজন আইনজীবী। ডাঃ সুইট বড়মনের মানুষ। চারবিঘা আয়তনের বাড়িটির একাংশে তিনি তার মায়ের নামে নুরজাহান স্মৃতি মহিলা কলেজ স্থাপন করেন। ফয়সল ফার্মেসীর নামে ব্যাংকে তার একটি সিসি ঋণ ছিল। তিনি কখনও মুল ঋণ পরিশোধ না করে কেবল সুদ আসামাত্রই তা পরিশোধ করে দিতেন। এই ঋণটি ছিল শতভাগ নিরাপদ, কিন্তু লেনদেন তেমন না থাকায় পরে রিনিউয়্যাল করা কঠিন হয়ে পড়ে, ফলে একসময় ঋণটি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হই। মোঃ মোস্তফা কামাল চৌধুরী আমার একজন বড় কাষ্টমার। লাউয়াইয়ের প্রবেশমুখে তার পেট্রল পাম্প। যমুনা ওয়েল কম্পানির তৈল পরিবহনে তিনি পচিশ ত্রিশটি লরী ভাড়া দেন। অতিশয় ভদ্র  মোস্তফা কামাল ভাই একজন জাত ব্যবসায়ী। ন্যাশন্যাল টি কোম্পেনি ও সিঙ্গার কোম্পেনির প্রচুর পুরানো শেয়ার তার বিও হিসাবে কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়ে আছে। তার কর্মচারিরাও তার মত সজ্জন। ব্যাংকের সব আচার অনুষ্টানে আমরা তাদেরকে কাছে পেতাম।

খোজারখলা গ্রামের একজন ধনী জমিদার আমাদের মাখন ভাই। পিছনের হাওরে প্রচুর জমিজামা। টাওয়ার ও বস্তি ভাড়া পান লাখ টাকার উপর। একদিন খোজারখলা গিয়ে আমি মাখনভাইয়ের ফোম কারখানা দেখে আসি। আরেকদিন মাখন ভাইয়ের জমিতে মাছ ধরা দেখতে গেলাম। আসার সময় একব্যাগ মাছ উপহার পেলাম। নজরুল ইসলাম ভাই ব্যাংকের পাশে উয়েল্ডিং রডবার ও এঙ্গুলের ব্যবসা করতেন। ২০১০ সালে আমি হজ্জে গিয়ে মক্কায় বারবার তার দেখা পাই। সেখানে তিনি বললেন তার কি একটি জটিল রোগ আছে। তাই প্রবাসী ভাইবোনেরা তাকে হজ্জে পাঠিয়েছেন। তিনিও অল্প বয়সে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার একটি নিয়মিত সিসি ঋণ ছিল। তার ভাই অস্ট্রেলিয়া হতে এসে ঋণটি বন্ধ করে দেন। লাউয়াইয়ের কয়ছর ভাই বরইকান্দি শাখার জমিদার। একজন সাহায্যকারী ভাল মানুষ। পিছনে তাদের বসতবাড়ি, সামনে দুতলা মার্কেটের নিচতলায় আমাদের অফিস। তার বাবাকে দেখিনি তবে শুনেছি তিনি ছিলেন খুব পরিশ্রমী ও কৌশলী লোক। প্রচুর ধনসম্পদ করেন, সেইসাথে দেদারছে দান খয়রাত করতেন। পূত্ররা তার মত যোগ্য হননি। তাদের হাতে সম্পদ কেবল ক্ষয় হয়। একজন পুত্র ছিলেন নেশাগ্রস্ত, আমেরিকান কনে বিয়ে করলেও বউ টেকেনি। একদিন অফিসে গিয়ে শুনি রাতে তিনি মারা গেছেন। কয়েকদিন পর দেখি একটি বড় ট্রাক হতে সাতটি বড় বড় ষাড় নামানো হচ্ছে। জিয়াফতের দাওয়াত পেলাম সপরিবারে। পরদিন শুক্রবার হওয়ায় সপরিবারেই জিয়াফতে গেলাম। হঠাৎ গোজব শোনা গেল গরুর মাংশে আরবী হরফে ‘আল্লাহু’ লিখা দেখা যাচ্ছে। আমি আগ্রহী হয়ে গিয়ে দেখি মাংশপিন্ড বিবচ্ছেদের পর কিছুটা এরকম চিহ্ন তৈরি হয়েছে যা আমার কাছে মনে হল ‘আলৌকিক নয় বরং লৌকিক’।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন