পূবালী ব্যাংকের আমি একজন এক্সিকিউটিভ (সহকারী মহাব্যবস্থাপক) হলামঃ
১৯৯০ সালের ২৭ আগষ্ট পূবালী ব্যাংকে
শিক্ষানবিস জুনিয়র অফিসার হিসাবে যোগদানের পর সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার পর্যন্ত
পৌছাতে আমার কোন পদোন্নতি বাদ পড়েনি। জুনিয়র অফিসার হয়ে যোগদান করার হতাশা কিছুটা
থাকলেও ধারাবাহিক পদোন্নতি আমাকে উৎসাহ দিয়ে এখানে টিকিয়ে রাখে। সহকারি
মহাব্যবস্থাপক, উপমহাব্যবস্থাপক এবং মহাব্যবস্থাপক আমাদের পূবালী ব্যাংকে বেশ
মর্যাদাসম্পন্ন এক্সিকিউটিভ লেভেলের পদ। এবার আমার সামনে সহকারী মহাব্যবস্থাপক
হবার পালা এসে গেল।
আমার শাখার উন্নতি খুব
সন্তোষজনক- ৩১ ডিসেম্বর ২০১৩ তারিখে শাখার সঞ্চয়, অগ্রিম, লাভ এবং আদায় চারটি লক্ষ্যমাত্রা
অর্জিত হয়ে যায়। এখনও মনে আছে সঞ্চয় লক্ষ্যমাত্রা ২৪.০০ কোটির স্থলে ২৪.৩৩ কোটি,
অগ্রীম ৬.৫০ কোটির স্থলে ৬.৫৪ কোটি, লাভ লক্ষ্যমাত্রা ০.৬৫ কোটির স্থলে ০.৬৭ কোটি
এবং আদায় লক্ষ্যমাত্রা ০.৪৮ কোটির স্থলে ০.২২ কোটিতে নেমে আসে। এধরনের সাফল্য
সিলেট শহরের চৌদ্দ শাখার মধ্যে কোনটিতে হয়নি। এমনকি সিলেট সুনামগঞ্জের ৪৮ শাখার
মধ্যে কেবলমাত্র দু’একটি শাখা করতে পেরেছে।
একদিন ইন্টারভিউ কার্ড পেলাম। এই
ইন্টার্ভিউয়ের তারিখ ছিল ২০ জানুয়ারি ২০১৪ সাল। প্রমোশনের জন্য স্বাক্ষাৎকার দিতে
ঢাকায় গেলাম উড়োজাহাজ চড়ে। উঠলাম আমার চিরায়ত আস্থানা ছোট সমনদিক আজিজ ভাইয়ের
ধানমন্ডি লেকপারের বাসায়। রেমন্ডের সাইকালার স্যুট কোট পরলাম, আজিজ ভাই কোটের
বোতাম লাগিয়ে দিলেন। এবার ছুটলাম ইন্টারভিউ দিতে ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় ২৬
দিলকুশা বানিজ্যিক এলাকা মতিঝিলে।
পুবালী ব্যাংকের হেড অফিসের তিন
তলা, অনেক স্মৃতির এই তিন তলা। আজ পর্যন্ত এই তিন তলায় আমার কোন দুঃখের অভিঞ্জতা
নেই। সুখ উপচাইয়া পড়ার মত এত তৃপ্তি না থাকলেও এই তলা আমাকে কখনও ঠকায়নি। এখানে এই
ছোট মানুষটি যখনই এসেছি কিছু না কিছু নিয়ে বাড়ি ফিরেছি। হ্যা, এতদিন পর্যন্ত আমার
প্রিয় এমডি স্যাররা আমাকে কেঊ খালিহাতে ফিরিয়ে দেননি। খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ
স্যার, হেলাল আহমদ চৌধুরী স্যার আমাকে চিনতে পারতেন। লোক চেনার মত যথেষ্ট মগজ এবং দুরদর্শিতা
তাদের ছিল। তাই এইসব স্কলারদের আমলে আমি সর্বদা সম্মান পেয়েছি, জয়ী হয়েছি, ব্যাংককেও
দিতে পেরেছি আমার সর্বোচ্চ শক্তি উজাড় করে।
তাই সুদৃঢ় আত্মবিশ্বাস নিয়েই আমি
হেডঅফিসের তিনতলায় সহকারি মহাব্যবস্থাপক হবার জন্য সাক্ষাৎকার দিতে আগেবাগেই গিয়ে
হাজির হলাম। আব্দুল মুমিত চৌধুরীর পরই আমার ডাক পড়ল। ভিতরে গিয়েই আমাদের মহামান্য
ব্যবস্থাপনা পরিচালক হেলাল আহমদ চৌধুরীর মুখোমুখি বসলাম। এমডি স্যারের সাথে আছেন
এএমডি আব্দুল হালিম চৌধুরী, ডিএমডি শফিউল আলম খান চৌধুরী, মানবসম্পদ বিভাগের
মহাব্যবস্থাপক সৈয়দ আজিজ আহমদ প্রমুখ। আমার সব জরুরী তথ্য এমডি স্যারের হাতে ছিল।
এবার হেলাল স্যার বললেন, দেখছি গত ৩১ ডিসেম্বরে আপনার সবগুলো টার্গেট হয়ে গেছে।
ডিপোজিট টার্গেট প্রসঙ্গে স্যার বললেন, এখানে কোন উইন্ডো ড্রেসিং নেইতো। আমি জবাব
দিলাম, প্রশ্নই উঠেনা। সিলেটের অঞ্চল প্রধান মোসাদ্দিক স্যার আমাকে প্রথমে যে
টার্গেট নিদৃষ্ট করে দেন, তা অনেক আগেই হয়ে যায়। তারপর তিনি বর্ধিত করে আবার
টার্গেট দেন, তাও হয়ে গেছে।
এবার হেলাল স্যার প্রশ্ন করলেন, ‘বংশ
তালিকা’ শব্দের ইংরেজি কি? আমি জবাব দিলাম- Family tree, এবার হেলাল
স্যার বললেন, কুরেশী সাহেব আপনার উত্তরটা পুরোপুরি সঠিক হয়নি, আসলে শব্দটি হল Genealogy. স্যার আমাকে বললেন আপনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্স? আমি ‘হ্যা
স্যার’ জবাব দিয়ে একটু আগ বাড়িয়ে বললাম আমার এমবিএ সমাপ্ত হয়ে গেছে, এখন কেবল
সার্টিফিকেট হাতে আসা বাকী আছে। কোন বিশ্ববিদ্যালয় হতে এমবিএ করেছি জানতে চাইলে
বললাম- সিলেট আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় হতে। হেলাল স্যার জিঞ্জেস করলেন এই
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ভি সি কে ? আমি বললাম আমার ফুফুতো ভাই ডঃ সদরুউদ্দিন
আহমদ চৌধুরী।
এভাবে বেশ সুদীর্ঘ্য সময়ের একটি
সাক্ষাৎকার দিয়ে সেদিন আমি বেরিয়ে আসি।
বের হয়ে এসে মহসিন সাহেবকে নিয়ে
বাহিরের একটি হোটেলে দুপুরের খাবার খেয়ে সিলেটের বাসে চেপে বসি। বাস ভৈরব
আসামাত্রই মহসিন সাহেবের ফোন পেলাম- স্যার আপনাকে অভিনন্দন, এইমাত্র ফলাফল এসেছে
আপনি সহকারী মহাব্যবস্থাপক হয়ে গেছেন। তারপর একটার পর একটা ফোন আসল, সবাই খুশী হয়ে
আমাকে অভিনন্দন জানিয়ে কৃতার্থ করল। পরদিন ২১জানুয়ারী পদোন্নতি পত্র পেলাম। পদোন্নতি
পাওয়া আমরা তিনজন এজিএম সফিউল হাসান চৌধুরী, আব্দুল মুমিত চৌধুরী এবং আমি
দরগাগেটের একটি হোটেলে আমাদের সকল সহকর্মি ও শুভানুধ্যায়ীগণকে ঘটা করে ডিনার করাই।
খালাত বুলবুল ভাই, নিশাত, তাঞ্জির, তানভীর পলিসহ অনেক পারিবারিক সদস্যও এই ডিনারে
আমন্ত্রিত হয়ে যোগ দেন।
সহকারী মহাব্যবস্থাপক পদে আমার
এই পদোন্নতি কার্যকর হল চারমাস আগের ১লা সেপ্টেম্বর ২০১৩ থেকে। তাই বিষয়টা আমার জীবনীতে
২০১৩ সালেই প্রবিষ্ট করলাম। এই প্রমোশন ছিল আমার চাকুরী জীবনের সেরা আনন্দের ঘটনা।
সেইসাথে ইহাই হল আমার চাকুরী জীবনের শেষ আনন্দের ঘটনা। তারপর চাকুরী জীবনে আর কোন
শুভ সংবাদ নেই।
এই পদোন্নতির পর আমি কিছু
পরশ্রীকাতর হিংসুটে ছোটমনা লোকদের পাল্লায় পড়লাম। সুযোগ্য ও সুদক্ষ ব্যবস্থাপনা
পরিচালক হেলাল আহমদ চৌধুরীর বিদায়ের পর ব্যাংকের ভাল ও ঈমানদার লোকজন একেএকে অবসরে
চলে যান। আব্দুল মান্নান, মোঃ মোসাদ্দিক চৌধুরী, আব্দুল করিম চৌধুরী, ফরিদ উদ্দিন
স্যারদের মত ন্যায়পরায়ন উদারমনের ভদ্রলোকেরা সবাই একে একে বিদায় নেন। তাদের জায়গায়
কিছু ঈর্ষাকাতর, স্বার্থপর, বদমায়েশ ও ছোটলোক প্রকৃতির লোকদের আগমন ঘটে। পুরো
প্রতিষ্টানের সর্বত্র এধরনের জগন্য প্রকৃতির কিছু বদলোকেরা দখল বসায়। ‘বাহিরে
ফিটফাট, ভিতরে সদরঘাট’ মার্কা এসব তৈলবাজ লোকেরা নতুন এমডি আব্দুল হালিম চৌধুরীকে
তাদের স্বার্থমত যা বুঝায় তিনি তাই বুঝেন। সর্বক্ষেত্রে আমার দ্রুত উন্নতিতে
ঈর্ষাকাতরের দল আমার চাকুরী জীবন ধ্বংস করে দিতে গভীর ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করে।
আমি একজন কবি ও লেখক। আমার
আত্মমর্যাদাবোধ খুব প্রখর। আমি নিজেকে রক্ষা করতে আমার আত্মীয় এমডি আব্দুল হালিম
চৌধুরী কিংবা প্রতিবেশী পরিচালক মনির আহমদ, কা’রো কাছে ধর্ণা দিতে যাইনি। আমার
সোজা কথা আমি তাদের একজন আত্মীয় ও আপনজন, আমি কেন তাদেরকে আমার ব্যাপারে বুঝাতে তুষামুদি করতে যাব। তাছাড়া আমার চাকুরী ফাইলে কোন দাগ নেই। আমার রয়েছে দুইটি পাবলিক ও
প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্স্টাস এবং জেএআইবিবি। রয়েছে বার বছর শাখা
ব্যবস্থাপনার সফল অভিঞ্জতা, আইটি দক্ষতা এবং দুইবার শ্রেষ্ট ব্যবস্থাপক হবার পদক।
সবশেষে বুঝলাম ঈর্ষাকাতরের দল
আসলে আমার ঘনিষ্ঠ এই দুইজন লোককে ব্যবহার করে তাদেরকে দিয়ে আমার চাকুরি জীবন ধুলায়
মিশিয়ে দেয়, এমন কি আমাকে চাকরি থেকে বের করে দেবারও চেষ্টা করে। ব্যাংকে চাকুরি
করার যে উৎসাহ ও আনন্দ এতদিন ছিল তা আমার তিরোহত হয়ে যায়। আমার চাকুরি জীবনে এতকাল
যে গতি ছিল তা স্থিমিত হয়ে যায়, চাকুরি পরিণত হয় হতাশার এক অনল প্রবাহে। সব ধরনের
লেখাপড়া ও যোগ্যতা দক্ষতা থাকা সত্বেও আমাকে তারা এক ‘বনসাই বৃক্ষে’ পরিণত করে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন