জামাতনেতা আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসি এবং ব্যাংকে হামলাঃ
কয়েক বছর ধরে আসামী আব্দুল কাদের
মোল্লার বিরুদ্ধে যুদ্ধপরাধ আদালতে বিচারকার্য চলল। সব বিচারিক কাজ ধারাবাহিক ভাবে
সমাপ্ত হয়ে গেলে এবার বিচারের চুড়ান্ত রায় মৃত্যুদন্ড কার্য্যকরের মহড়া শুরু হল। এইটি
যুদ্ধপরাধ আদালতে মামলার রায়ে প্রথম মৃত্যুদন্ড কার্য্যকরের ঘটনা। দন্ডপ্রাপ্ত
আসামি প্রেসিডেন্টের কাছে প্রানভিক্ষা চাইলেন না। ১২ ডিসেম্বর ২০১৩ সাল। এই দিবাগত
রাতে টিভির সামনে বসে আমরা কাদের মোল্লার ফাঁসী কার্য্যকরের তোলজোড় দেখতে পেলাম। একসময়
দণ্ডপ্রাপ্ত আব্দুল কাদের মোল্লার ঘনিষ্ট আত্মীয়স্বজনকে আসামীর সাথে শেষ দেখা করে কারাগার হতে রুমালে চোখ মুছে বেরিয়ে আসতে দেখলাম।
১২ টা ১ মিনিটে কাশিমপুর
কারাগারে কাদের মোল্লার মৃত্যুদন্ড কার্য্যকর হবে। সারা দেশে কড়া নিরাপত্তা, জেলের
সামনে র্যাব পুলিশের ভীড়, সেই ভীড়ে সাংবাদিকদের আনাগুনা। ঘন্টাখানিক পর এক টানটান
উত্তেজনার মধ্যে ফাসি কার্য্যকর করার জন্য ঢাকার সিবিল সার্জন, ঢাকার জেলা প্রশাসক,
জেল মসজিদের ঈমাম, ডিআইজি প্রিজন সহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাগন জেলে প্রবেশ করলেন।
সাড়ে বারটার পর একজন পুলিশ অফিসার জেলগেটে এসে সাংবাদিকদেরকে ফাঁসী কার্য্যকর হবার
খবর জানিয়ে দিলেন। তারও কিছুক্ষণ পর পুলিশ ও র্যাবের কয়েকটি গাড়ি আব্দুল কাদের
মোল্লার লাশবাহী এম্বুল্যান্স স্কর্ডন করে জেলগেট দিয়ে বেরিয়ে কাদের মোল্লার
গ্রামের দিকে যাত্রা শুরু করল। সংক্ষেপে আব্দুল কাদের মোল্লার ফাসির রাতে এই ছিল
আমার টেলিভিশন পর্যবেক্ষণ। আমি বেশ রাত জেগেই উৎসাহ নিয়ে এই বহুল আলোচিত রায়
কার্যকরের দৃশ্য টিভিতে দেখে শেষরাত ২টা নাগাদ ঘুমাতে গেলাম।
১২ ডিসেম্বর ২০১৩। এই দিনটিতে
সারা দেশে ছিল র্যাব পুলিশের কড়া নিরাপত্তা। এই ফাঁসি কার্যকর হলে দেশে এর
প্রতিক্রিয়া কি হবে তাই নিয়ে সবাই ছিল খুব উদ্ভিঘ্ন। এই আব্দুল কাদের মোল্লার
ফাঁসি নিয়ে আমার কোন ভাবনা নেই- কোন দুঃখ নেই, সুখও নেই। আমি একজন সাধারণ পাবলিক,
এসব রাজনীতি নিয়ে আমার এত মাথা ঘামানোর সময়ও নেই। দিন কয়েক আগে আমার অফিসের
লোকজনকেও সতর্ক করে দিয়েছি এইসব বিতর্কিত রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে কেঊ যেন অফিসে কোন
কথাবার্তা না বলেন।
পরদিন বাংলাদেশ জামাতে ইসলামী এই
ফাঁসির প্রতিবাদে হরতালের ডাক দেয়। হরতালে যতই বাধাবিঘ্ন আসুক না কেন আমাদেরকে
অবশ্যই অফিস করতে হয়। অফিসে না এলে কিংবা অফিস বন্ধ রাখলে সরকারের কাছে আমরা
বিদ্রোহী বলে গন্য হয়ে যাব। তাই অন্যদিন হেরফের হলেও হরতালের দিনে যথাসময়েই আমাদের
সবাইকে অফিসে আসতে হয়।
সবগুলো হরতালের দিনে অফিসের দরজা
জানালা বন্ধ করে দিয়ে ভিতরে আমরা সংগোপনে কাজ করতাম। খুব আর্জেন্ট না হলে লোকজনকে
আমরা অবাধে ব্যাংকে ঢুকতে দিতাম না। অফিসের নিরাপত্তা যথাযত বিবেচনা করেই ভল্টের
দরজা খোলা হত, নইলে সাধারণত ভল্ট বন্ধ থাকত। তেমন খুব জরুরী প্রয়োজন না হলে আমরা
লেনদেন বন্ধই রেখেদিতাম। ব্যাংকের ভল্টরুম বন্ধ থাকত, তবে কেউ নগদ টাকা জমা দিলে
তা থেকে দুচারজন জরুরী গ্রাহকের টাকার চাহিদা আমরা পূরণ করে দিতাম।
এত সাবধান থেকেও সেই ফাঁসির রাতে
আমি বুঝতে পারিনি এই ঘটনার জেরে আমার অফিস পরদিন আক্রান্ত হবে এবং একদল বিশৃংখল
লোকের লম্বা বুজালী দায়ের কোপে ব্যাংক অফিস ক্ষতবিক্ষত হবে।
১৩ ডিসেম্বর ২০১৩ সাল সকাল ১১
ঘটিকায় বাহিরের রাস্থায় হট্টগোল শোনা গেল। বেশ কয়েকটি মোটর সাইকেলে করে একদল জঙ্গি
যুবক মিছিল নিয়ে আগিয়ে আসে। গালে নাতিদীর্ঘ ছাট দাড়ি ও মাথায় টুপিওয়ালা মারোমুখি
লোকগুলোর হাতে হকি স্টিক এবং লম্বা বুজালী দা চকচক করছে। কপাটবদ্ধ করে আমাদের ব্যাংকের
একমাত্র সদর দরজায় নিরস্ত্র প্রহরী এনাম মিয়া দাঁড়িয়ে আছেন। বাহিরে আমাদের সদ্য
স্থাপিত এটিএন বুথের গ্লাস ও সাইনবোর্ড দায়ের কোপের আঘাতে ভেঙ্গে পড়ল। আমি
চেম্বারের চেয়ারে বসে আছি, তখনই বামপাশের জানালা ঝনঝন করে করে ভেঙ্গে পড়ল। এবার
একজন লোক ভিতরে ঢুকে চেম্বারের গ্লাসে দায়ের কোপ বসালো। গ্লাসের ভগ্ন টুকরায়
সারাটা মেঝে ছেয়ে গেল। আমি চেয়ার ছেড়ে চেম্বারের নিরাপদ কোনে সরে গেলাম। ভয়ে মহিলা
কর্মী রাজিয়া সুলতানা চিৎকার করে উঠলেন। এমন সময় বাহির হতে হামলাকারীদের একজন নেতা
আদেশ করলেন, তোমরা ব্যাংকের ভিতর হতে বেরিয়ে আস। হামলাকারীরা সাথে সাথে বের হয়ে নিমিষেই
রাস্থায় হারিয়ে গেল।
এই ক্ষণিকের হামলায় ব্যাংকের যে
ক্ষতি হল, তা সে সময়ের লাখ টাকার কম ছিলনা। হামলাকারী এই মর্দে মুমিনের দল এতই
উম্মুক্ত ছিল যে, এই পৃথিবী নামক সুন্দর গ্রহটা তাদের কারো সামনে পড়লে বুজালীর এক
কোপে দ্বিখন্ডিত করে দিত। যেমন আল্লার রসুলের(সঃ) আঙ্গুলের ইশারায় দ্বিখন্ডিত হয়ে
গিয়েছিল আসমানের চাঁদ।
এবার সিলেট শহরের বেশ কয়েকজন
সাংবাদিক হামলার বিবরণ জানতে ও ছবি উঠাতে ছুটে আসেন। তারপরই একদল সশস্ত্র পুলিশ
নিয়ে এসে হাজির হন দক্ষিণ সুরমা থানার পুলিশের ওসি। আমি বিষয়টি আমার অঞ্চল প্রধানকে
জানিয়ে দিলাম। অঞ্চল প্রধান দিলীপ কুমার পাল
নীরব রইলেন, তিনি আমাকে তেমন কোন বানী দিলেন না। তবে প্রধান কার্যালয় হতে
তৎকালীন জিএসডিডির প্রধান ডিজিএম এস এম সিরাজুল হক চৌধুরী দুই তিনবার ফোন করে
আমাকে বললেন, কুরেশী সাহেব কোন ভয় করবেন না। দরকার হলে পুলিশের সাহায্য নেন, আর
আমরা তো আপনাদের সাথেই আছি।
পরে জানলাম এই হামলাকারীরা ছিলেন
বরইকান্দি নিবাসী দক্ষিণ সুরমা উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান জামাত নেতা মাওলানা
লোকমান আহমদের লোকজন। হামলার কারণও ছিল বেশ অদ্ভুদ। এই ব্যাংকের চেয়ারম্যান হাফিজ
আহমদ মজুমদার আওয়ামী লীগের সাংসদ। তাই এই পাবলিক লিমিটেড ব্যাংকটিকে আওয়ামী লিগের
ব্যাংক মনে করেই তারা এই হামলা ও ভাংচুর চালায়। তারা হয়ত খেয়াল করেনি এই ব্যাংকে
বিএনপি এবং জাতীয়পার্টির রাজনীতি করা অনেক পরিচালকও রয়েছেন। এটা কোন রাজনৈতিক দলের
ব্যাংক নয়, এটা একটা জাতীয় ব্যাংক। আসলে রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, আর আমরা উলুখাগড়ার
প্রাণপাত হয়। সেদিনের সারাটা পত্রিকা ঠাসা ছিল কেবল এই বিখ্যাত ফাঁসির খবরে, ফাঁসির
জল্লাদের আদিঅন্ত বিবরণ হতে শুরু করে কাদের মোল্লার গায়েবে জানাজা কিছুই বাদ পড়লনা
পত্রিকায়।
পরদিন সিলেটের সকল স্থানীয়
পত্রিকায় ছাপা হল লাউয়াইয়ের পূবালী ব্যাংক লিমিটেড বরইকান্দি শাখায় সন্ত্রাসী
হামলার সচিত্র খবর ও বিবরণ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন